কণ্ঠস্বরটা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল নায়েব বসন্তবাবুর।
এইমাত্র বোধ হয় সন্ধ্যা-আহ্নিক সমাপ্ত করে বসন্তবাবু, শুধু একটা ধুতি পরিধানে খালিগায়ে ঘরের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালের গায়ে একটা দেওয়ালবাতি জ্বলছে। তারই আলোয় কিরীটী পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত বাবুর মুখের দিকে।
বসন্তবাবুর দুচোখের তারায় যেন একটা কঠিন প্রশ্ন ছুরির মত ঝিকিয়ে উঠছে।
নায়েব বসন্ত সেনের দুই চক্ষুর ছুরির ফলার মত ধারালো শাণিত দৃষ্টি যেন কয়েকটি মুহূর্ত কিরীটীর দুই চক্ষুর দৃষ্টির সঙ্গে উদ্ধত স্পর্ধায় মিলিত হয়ে স্থির হয়ে থাকে। পলকহীন, অকম্পিত।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই, পরক্ষণেই বসন্ত সেনের চক্ষুর দৃষ্টি ও মুখের একটু আগে কঠিন হয়ে ওঠা সমস্ত রেখাগুলো সহজ ও কোমল হয়ে এলো। বিনীত হাস্যে চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
কিরীটীবাবু, যে! হঠাৎ কি মনে করে? বসন্তবাবুই প্রথমে প্রশ্ন। করলেন।
কিরীটী স্মিতকণ্ঠে বললে, একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম। বসতে পারি সেনমশাই?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বসুন। অভ্যর্থনা জানালেন নায়েব বসন্ত সেন। এবং সমস্ত আবহাওয়াটাকে সহজ ও লঘু করে সম্মুখের একটা খালি চেয়ার চোখের নির্দেশে দেখিয়ে দিলেন বসন্তবাবু কিরীটীকে।
আপনার সময় নষ্ট করছি না তো সেনমশাই? চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে কিরীটী কথাগুলো নায়েবমশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই উচ্চারণ করলে।
না, না—সন্ধ্যার পর আমি বিশেষ কোন কাজই করি না। এই সময়টা রাত্রে আহারের আগে পর্যন্ত আমার সম্পূর্ণ বিশ্রামের সময়।
কিরীটী চেয়ারটার উপর নড়েচড়ে একটু আরাম করে বসল এবং পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে কেস থেকে একটা সিগার নিয়ে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।
নায়েব বসন্ত সেনও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন করলেন। পরিধেয় ধুতিটার কোছাটা খুলে গায়ের উপর জড়িয়ে নিলেন।
খোলা জানলা-পথে জলসিক্ত ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আসছে, বেশ শীতশীত করে।
বৃষ্টিও যেন নেমেছে একেবারে আকাশ ভেঙে।
কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দে অতিবাহিত হয়, দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। বাইরে শুধু, একটা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। টেবিলের উপরে একটা সাদা চিমনি দেওয়া কেরোসিনের টেবিল বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় ঘরটা বেশ আলোকিতই হয়ে উঠেছে।
সহসা এক সময় নায়েব বসন্তবাবুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, তার মৃত্যুর সমস্ত ব্যাপারটাই তো আপনি সত্যজিৎ ও সবিতার মুখে শুনেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
এ সম্পর্কে সত্যজিতের যা ধারণা তাও নিশ্চয়ই শুনেছেন?
শুনেছি। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
কিন্তু ব্যাপারটা আপনার কি মনে হয় মিঃ রায়?
দেখুন ঘটনা সম্পর্কে যতটা শুনেছি তাতে অবশ্য আমার মনে হয় এর পিছনে একটা বিশ্রী চক্রান্ত আছে—
চক্রান্ত! কথাটা উচ্চারণ করে নায়েব বসন্ত সেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে বিস্ময়-দৃষ্টিতে।
হ্যাঁ। এবং এও ঠিক, মৃত্যুঞ্জয়বাবুর হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে হলে আমাদের দীর্ঘ উনিশ বৎসর আগে তাঁর স্ত্রীর হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুকে সর্বাগ্রে মীমাংসা করতে হবে—
হেমপ্রভার মৃত্যু! সে তো উনিশ বছর আগে ঘটেছে। তাছাড়া হেমপ্রভার মৃত্যুও তো যতদূর জানি স্বাভাবিক ব্যাপার। রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী বসন্ত সেনের মুখের দিকে। কানাইয়ের মার মুখ থেকে শোনা সত্যজিৎ-বর্ণিত হেমপ্রভার সে মৃত্যু-কাহিনী কি তবে বসন্ত সেনের অজ্ঞাত! সত্যই কি বসন্ত সেন সে ব্যাপারের কিছুই জানেন না? না তিনি স্বীকার করতে চাইছেন না? কিন্তু সত্য হোক মিথ্যা হোক, বেশ ভাল করে যাচাই না করে কিরীটী বসন্ত সেনকে মুক্তি দেবে না। সেই কারণেই ব্যাপারটা যেন আজও বসন্ত সেনের অজ্ঞাতই এইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী, কেন, আপনি কিছুই জানেন না—হেমপ্রভা দেবীর সত্যিকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা?
কই না! হেমপ্রভার মৃত্যুর মধ্যেও কোন একটা ব্যাপার ছিল, এ তো কই আমার এতদিন জানা ছিল না! তিনি হঠাৎ একদিন সকালে অসুস্থ অবস্থাতেই বেশী রকম অসুস্থ হয়ে পড়ায় কর্তা রত্রেই তাঁকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
না, তা বোধ হয় ঠিক নয়। গভীর কণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
কী আপনি বলছেন মিঃ রায়! আমি যে তখন এ বাড়িতেই ছিলাম। আমার চোখের সামনে দিয়ে অসুস্থ হেমপ্রভাকে পাল্কিতে চাপিয়ে কর্তা কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান!
হ্যাঁ, পাল্কি যেতে দেখেছেন বটে তবে তার মধ্যে একটা পাল্কিতে কেউ ছিল না—ছিল খালি। এবং তার আগেই হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু ঘটেছিল।
যত সব আজগুবী ব্যাপার। কে বলেছে আপনাকে এসব কথা শুনি?
আমাকে কেউ বলেনি। বলেছে কানাইয়ের মা সবিতা ও সত্যজিৎবাবুকে।
কানাইয়ের মা বলেছে! দাঁড়ান তো দেখি, হারামজাদীকে একবার ডাকি—
বসন্ত সেন চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটী তাঁকে বাধা দিল, ব্যস্ত হবেন না বসন্তবাবু, বসুন। আমার কথাটা শেষ করতে দিন আগে। এখনও আমার শেষ হয়নি।
কিন্তু এ যা আপনি বলছেন এ তো একেবারে সম্পূর্ণ আরব্য উপন্যাস। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!