মুহূর্ত পরেই সম্মুখের দ্বারপথে মীরজুমলাকে দেখা গেল।
মীরজুমলা, সুধীরঞ্জন—
মীরজুমলা আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারপথে ক্ষণপূর্বে যেমন আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তেমনি করেই অন্তর্হিত হল।
আমরা দুজনেই এতক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট আবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, আপনার সত্যকার পরিচয় তাহলে সুব্রত রায় আপনি! লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রাক্তন সি.আই.ডি.!
তা যা বলেন।
হ্যাঁ। তা বেশ। কিন্তু কি যেন দুঃসংবাদের কথা বলছিলেন একটুক্ষণ আগে?
মিত্রা সেন মারা গেছেন।
কি? কি বললেন? অত্যন্ত চমকিত বিস্ময়ে প্রশ্নটা করলেন তিনি।
মিত্রা সেন মারা গেছেন এবং কোনও তীব্র বিষই তাঁর মৃত্যুর কারণ। তাঁর মৃতদেহ বাগানের বেঞ্চিতে–
মানে, এখানে?
হ্যাঁ।
Are you mad Mr. Roy! কি সব আবোল-তাবোল বকছেন?
নিজেই স্বচক্ষে বাগানে দেখবেন চলুন না। আপনার একবার দেখা দরকার। থানায় অবিশ্যি আমি এইমাত্র ফোন করে দিয়েছি।
কিন্তু কে–কে আপনাকে গায়ে পড়ে সর্দারি করতে বলেছে মিঃ সুব্রত রায়, জানতে পারি কি?
আমার কর্তব্য বলে মনে করেই থানায় আমি ফোন করেছি মিঃ চক্রবর্তী।
All right? আপনি এখন যেতে পারেন এ ঘর থেকে। আর একটা কথা জেনে যান, এই মুহূর্ত থেকে আর আপনি বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বার থাকলেন না।
ধন্যবাদ! আমারও ঘর ছেড়ে যাবার পূর্বে একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার, পুলিস আসা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে আপনি যেন কোথাও যাবার চেষ্টা না করেন।
ধন্যবাদ!
আমারই ক্ষণপূর্বের ধন্যবাদটা যেন ব্যঙ্গোক্তির মধ্যে ফিরিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট আমাকে।
আমি ঘর থেকে দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে সোজা হলঘরে চলে এলাম।
হলঘরে ঢুকতেই কানে এল ভায়োলিনের করুণ মিষ্টি সুর।
চেয়ে দেখি নির্জন হলঘরের মধ্যে একাকী এক কোণে একটা চেয়ারে বসে সুধীরঞ্জন আপন মনে ভায়োলিন বাজাচ্ছেন।
সুধীরঞ্জন কি তবে প্রেসিডেন্টের পরোয়ানা এখনও পায়নি। মীরজুমলা কি এ ঘরে আসেনি!
এগিয়ে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম, সুধীরঞ্জন!
প্রথম ডাকটা শুনতে পেল না। দ্বিতীয়বার ডাকতেই মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভায়োলিন বাজানো বন্ধ করে বলল, কি?
প্রেসিডেন্ট যে তোমাকে ডাকছেন, শোননি?
না।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
এসেই একটু বাইরে গিয়েছিলাম, এই মিনিট কয়েক হল ফিরে হলঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে একা একা কি করি, তাই একটু ভায়োলিন বাজাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কি ব্যাপার? আজ যে আসর ফাঁকা? সব গেল কোথায়?
একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাই তো একদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে দুর্ঘটনা! ওর মধ্যে নতুনত্ব তো কিছু নেই!
না, না—সত্যিই–
আমি কি বলছি মিথ্যে—
খুব সম্ভব মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন!
What! কি বললে?
মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন, বিষপ্রয়োগে।
এ যে সত্যিই Arabian Night-এর গল্প শোনাচ্ছ হে! কিন্তু সংবাদটা দিল কে?
মহরানী অফ সোনপুরই প্রথম মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন বাগানে।
তার মানে, এইখানে?
হ্যাঁ।
হঠাৎ এমন সময় পশ্চাতে মীরজুমলার কণ্ঠস্বর শোনা গেলঃ স্যার! আপনাকে প্রেসিডেন্ট তাঁর ঘরে ডাকছেন।
সুধীই প্রশ্ন করে মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়ে, কাকে?
তোমাকে। বললাম আমি।
আমাকে?
হ্যাঁ, আমার সম্পর্কে আলোচনার জন্যই বোধ হয় তলব পড়েছে তোমার।
তোমার সম্পর্কে? হঠাৎ–
সত্যকার পরিচয়টা যে এইমাত্র তাঁকে দিয়ে এলাম।
সর্বনাশ করেছ! তারপর?
মীরজুমলা আবার ঐ সময় বলল, চলুন স্যার।
সময় নেই যাবার এখন, প্রেসিডেন্টকে গিয়ে বলমীরজুমলা। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল সুধীরঞ্জন।
কিন্তু স্যার–
যা বললাম তাই বলগে–যাও!
ঠিক সেই মুহূর্তে হলঘরের প্রধান দরজা খুলে গেল এবং হলঘরে এসে প্রবেশ করল প্রথমে দারোয়ান, তার পশ্চাতে থানা অফিসার রজত লাহিড়ী এবং সর্বশেষে কিরীটী ও দুজন ইউনিফর্ম-পরিহিত পুলিস। পুলিস দুজনের দিকে তাকিয়ে রজত লাহিড়ী বললেন, তোম দোনো এই দরওয়াজা পর খাড়া রহে। বিনা হুকুমসে কোই বাহার না যায়। আউর বাহারসে ভি কোই নেই অন্দার ঘুষে।
কিরীটী ততক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বলা বাহুল্য আমার ছদ্মবেশই ছিল। তথাপি কিরীটী মুহূর্তকাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললে, মেক-আপটা বেশ জুতসই নিয়েছিস তো সুব্রত!
হেসে ফেললাম আমি।
চল্, কোথায় ডেড বডি আছে?
বাগানে।
এস হে রজত! কিরীটী রজত লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে আহ্বান জানাল।
হঠাৎ ঐ সময় লক্ষ্য করলাম হলঘরের মধ্যে কোথাও মীরজুমলা নেই।
নিঃশব্দে ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন সে সবার অলক্ষ্যেঅন্তর্হিত হয়েছে।
সুধীরঞ্জনও আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল।
দোতলার সরু প্যাসেজটা দিয়ে কিরীটী ও লাহিড়ীকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাবার সময় কিরীটী প্রশ্ন করল, অশোক রায় কোথায়?
এখনও পর্যন্ত তার কোনও হদিস পাইনি।
সে আজ এসেছিল, না মোটে আসেইনি?
তাও বলতে পারি না। এখনও বিশেষ কারও সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। তবে আমার ধারণা সে নিশ্চয় এসেছিল।
কিসে বুঝলি?
আজ শনিবার। বিশেষ করে তোকে তো বলেছিলাম বৃহস্পতি ও শনিবার মিত্রা সেন এখানে আসবেই, এ তো অশোক জানে।
আমার কথার প্রত্যুরে কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না অতঃপর আমরা লোহার ঘোরানো সিঁড়িপথে নেমে এসে একের পর এক নীচে বাগানে পা দিলাম। ইতিমধ্যে চাঁদ আকাশের পশ্চিম প্রান্তে অনেক হেলে পড়ায় তার আলোও ঝিমিয়ে এসেছিল।