- বইয়ের নামঃ বসন্ত রজনী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. মানুষের চেহারা
মানুষের চেহারা—তার আকৃতি, গঠন এবং তার মুখের গড়ন দেখে কি একটা মানুষকে চেনা যায়- চেনা যেতে পারে?
আমার প্রশ্নের উত্তরে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, তোর কি মনে হয় সুব্রত?
আমি তো জিজ্ঞাসা করছি তোমাকে কিরীটী!
না!
চেনা যায় না—বোঝা যায় না?
না।
তবে যে অনেকে বলে মানুষের মনের ছবিই হচ্ছে তার মুখ?
আমি বিশ্বাস করি না।
কেন?
কারণ মানুষের মনটা এমন একটা বিচিত্র বস্তু যে, বিশেষ কোন একটা formula-র মধ্যে ফেলে তাকে বিচার করতে গেলে আমার মনে হয় ঠিক বিচার করা হবে না। হতে পারে না।
কিন্তু তুই তো অনেক সময় মানুষের বাইরের চেহারাটা দেখেই তার চরিত্রের analysis করেছিস!
করেছি, কিন্তু তাই বলে সেটা যে সর্বক্ষেত্রেই অবধারিত সত্য তাও তো নয়।
কিন্তু আমার মনে হয়—
কি মনে হয় সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করে আমার মুখের দিকে তাকাল। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি তার।
চেহারা-মানে বলতে চাই আমি, কারও চেহারা বিশেষভাবে খুঁটিয়ে দেখলে সবটা না হলেও তার চরিত্রের কিছুটা আভাস-বলতে পার মোটামুটি আভাস আমরা পেতে পারি।
কথাটা আমি বলেছিলাম অদূরে একজন লোককে সাগর-সৈকত ধরে আমাদেরই দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।
কিরীটীর সেটা নজর এড়ায়নি। বলে, ঐ যে ভদ্রলোকটি এদিকে আসছে, ওকে দেখে তোর কি মনে হয় সুব্রত? নিশ্চয়ই একজন মার্ডারার, নয়?
যদি বলি তাই!
কিরীটী আমার কথায় হো হো করে হেসে ওঠে।
হাসছিস? বললাম আমি, কিন্তু লোকটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখ তো কিরীটী-ওর চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় না কি, লোকটা কোল্ড ব্লডে মার্ডার করতে পারে? অত্যন্ত শান্ত ও নির্বিকার ভাবে একজনের পিঠে ছুরি বসাতে পারে, গুলি চালাতে পারে বা চায়ের বা খাদ্যের সঙ্গে কোন তীব্র বিষ মিশিয়ে দিতে পারে?
যেহেতু লোকটার চেহারাটা তোর নয়নতৃপ্তিকর হয়নি। প্রথম দৃষ্টিতেই লোকটার চেহারা তোর বিচ্ছিরি লেগেছে, এটাই তো তোর একমাত্র যুক্তি সুব্রত।
আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, না, না, ঠিক তা নয়–
তাই-অবিশ্যি অস্বীকার করব না যে, এমন চেহারা কারও কারও আছে যার দিকে তাকানো মাত্র মনে হয়, লোকটা বুঝি যে-কোন ক্রাইম অনায়াসেই করতে পারে। এমন কি হত্যাও। মন ঘিনঘিন করে ওঠে। অথচ মজা হচ্ছে, খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে-সম্পূর্ণ বিপরীত। যা মনে হয়েছে আদৌ তা নয়। প্রকৃতিতে লোকটা হয়তো যেমন শান্ত, তেমনি নিরীহ, তেমনি ভীতু।
কিন্তু—
কিরীটী আমাকে বাধা দিয়ে বলে, ঠিক তাই সুব্রত। মানুষের চরিত্র বড় বিচিত্র, বড় দুর্বোধ্য। চেহারার ফরমূলায় ফেলে সেই দুর্বোধ্যকে solveকরা যায় না। তারপরই একটু থেমে বলে, ঐ যে ভদ্রলোকটি—যাকে দেখে তোর মনে হচ্ছে কোও নাড়ে লোকটা মার্ডার করতে পারে, মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি–
চিনিস?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোক তখন আরও এগিয়ে এসেছেন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দিকে।
কিরীটী তার দিকে চেয়েই বলতে থাকে, ওঁর নাম কালীপ্রসাদ সরকার। নামকরা একজন জুয়েলার বংশের ছেলে। অমন নিরীহ, অমন গোবেচারা লোক বড় একটা দেখা যায় না। তাছাড়া লোকটা পরম বৈষ্ণব। মানুষ মারা তো দূরে থাক, একটা মাছিও কোনদিন মারতে পারবে কিনা সন্দেহ।
আমি আর কোন জবাব দিই না।
কারণ জানি, জবাব দিলেও কিরীটীর মতের এতটুকু পরিবর্তন তো হবেই না, উপরন্তু সে তার থিয়োরি আরো জোরালো কণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করবে। আমাকে নস্যাৎ করে দেবে।
তার চাইতে সামনে সাগরের দিকে চেয়ে থাকতে বেশ লাগছে।
পুরীর সাগর-সৈকতে স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি দুজনে বসে ছিলাম।
সূর্য অনেকক্ষণ অত গিয়েছে, কিন্তু অন্ত গেলেও সাগরের বুক থেকেও আকাশ থেকে আলোটা যেন মুছেও মুছে যায়নি। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে তখনও যেন একটা আলোর রেশ থেমে যাওয়া শীতের রেশের মতই শেষ হয়েও শেষ হয়নি।
একজন নয় দুজন-কালী সরকার ও অন্য একজন। ভদ্রলোকরা আরও এগিয়ে এসেছেন ইতিমধ্যে এবং কিরীটীকে দেখে কালী সরকার হঠাৎ বলে ওঠে, কিরীটী না?
হ্যাঁ তারপর কালী, তুই এখানে এসময়ে?
এলাম। মাঝে মাঝে তো পুরীতে আসি-ঐ যে হোটেলটায়—
একটা হোটেল দেখায় কালী সরকার আঙুল তুলে। হোটেলটা নতুন এবং চোখ-ঝলসানো।
কালী জিজ্ঞাসা করে, উনি?
আমার বন্ধু-সুহৃদ—একমেবাদ্বিতীয় সুব্রত রায়—
নমস্কার। কালী সরকার হাত তোলে।
আমিও হাত তুলে নমস্কার জানাই। অন্য ভদ্রলোকটি কিন্তু আলাপ করলেন না আমাদের সঙ্গে, কেমন যেন অনিচ্ছুক ভাবে আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন সর্বক্ষণ।
অতঃপর দুজনে বালুবেলা দিয়ে এগিয়ে গেল। একসময় দূরে মিলিয়ে গেল।
.
ক্রমে ক্রমে সেই আলোর শেষ রেশটকু আকাশ থেকে, প্রকৃতি থেকে মুছে যায়।
অন্ধকার নামে চারিদিকে। অন্ধকারে সমুদ্রের ঢেডলোর মাথায় খেত ফেনার পুঞ্জ যেন হিংস্র জন্তুর ধারালো দাঁতের মত মনে হয়। একটানা গর্জনে মনে হয় যেন কোন অবরুদ্ধ জন্তু প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে।
কিরীটীর দিকে তাকালাম। মনে হল সে যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক। মনে হল সে বুঝি কিছু ভাবছে। সমুদ্রের হাওয়ায় চুরোটটা বোধ হয় একসময় নিভে গিয়েছিল—কিরীটী ঘুরে বসে নিভে যাওয়া চুরোটটায় আবার অগ্নিসংযোগে তৎপর হয়।
হঠাৎ কিরীটীই আবার কথা বলে, সুত! কি?
কালী সরকার লোকটা নিঃসন্দেহে কোন্ড ব্লডে কাউকে মার্ডার করতে না পারলেও, সঙ্গের ভদ্রলোকটির চোখের চাউনি কেন যেন আমার ভাল লাগল না।
ভাল লাগল না মানে? প্রশ্ন করলাম আমি।
চোখের দৃষ্টিটা দেখলি না ভদ্রলোকের, বেশ যেন বিরক্ত অপ্রসন্ন—মনে হল যেন কালীর আমাদের সঙ্গে আলাপ করাটা আদৌ তার মনঃপুত হয়নি।
হয়তো—
কি?
হয়তো দুজনের মধ্যে বিশেষ কোন জরুরী কথা হচ্ছিল, হঠাৎ সেই সময় আমরা সামনে পড়ায় এবং কালী সরকার আমাদের সঙ্গে কথা বলায় সে বিরক্ত বোধ করছিল–
স্বাভাবিক।
শুধু স্বাভাবিক নয়, তার চাইতে হয়তো—
কি?
কিছু বেশী। যাক গে, মরুক গে কালী সরকার আর তার সঙ্গে সেই অপ্রসন্ন লোকটি–
বলতে বলতে কিরীটী বালুবেলার উপরে টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ে, শিথিল অলস ভঙ্গীতে।
কিরীটী যাই বলুক, যাই তার থিয়োরি হোক-কি জানি কেন, লোক-দুটোর চেহারা কিন্তু মন থেকে কোনমতেই আমি মুছে ফেলতে পারি না।
কালীপ্রসাদ সরকার, আর সেই অপ্রসন্ন ভদ্রলোকটি।
সে-সময় সমুদ্র-সৈকতে বায়ুসেনার্থী অনেক বয়সের অনেক স্ত্রী-পুরুষ ছিল এবং আশ্র সেই ভিড়ের মধ্যেও ওদের দুজনকে দূর থেকে দেখেই ওদের দিক থেকে চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারিনি, বিশেষ করে কালী সরকারের দিক থেকে।
দুজনেরই পরিধানে সুট ছিল। একজনের দামী সুট, কোনো নামকরা টেইলার্স শপের তৈরী। অন্যজনের বোধ করি সাধারণ কোন দোকান থেকে কেনা রেডিমেড সুট। একটু ঢিলে, ঝলমলে।
পরনে সামী সুট ছিল কালীপ্রসাদ সরকারের।
লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে বলেই মনে হয়। বেশ মোটা চর্বিযুক্ত ভারী দেহের গড়ন। রীতিমত কালো গায়ের বর্ণ। ভারী ঈষৎ চৌকো মুখ। মোটা রোমশ ভু। কান দুটো বেশ বড় এবং কান-ভর্তি চুল। সুট পরা থাকলেও টাই না থাকায় খোলা শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের যে অংশটুকু দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল সেটা রীতিমত রোমবহুল। বোঝা যায় মানুষটা রোমশ। গায়ে খুব বেশী লোম। হাসলেই উপরের মাড়ির অনেকটা বেরহয়ে পড়ে ও সেই সঙ্গে প্রকাশ পায় ঝকঝকে মোটা মোটা একসারি এলোমেলো দাঁত।
আর হাতের থাবা ও আঙুলগুলোই বা কি-যেমন চওড়া তেমনি মোটা মোটা ও বলাই বাহুল্য রোমশ।
লম্বায় লোকটা কিন্তু খুব বেশী নয়, পাঁচ ফুট দুই থেকে তিন ইঞ্চির বেশী কিছুতেই হবে না—অর্থাৎ পুরুষের পক্ষে বেঁটেই লোকটা। দূরে থেকে মনে হচ্ছিল, যেন ঠিক এক ভল্লুক থপথপ করে হাঁটছিল।
আর তার সঙ্গী! সেই অপ্রসন্ন ভদ্রলোকটি! কম দামের ঢিলে ঝলমলে পোশাকের মধ্য দিয়েও যেন তার রূপ, তার সৌন্দর্য ফুটে বের হচ্ছিল। সত্যিই লোকটা সুন্দর। মাঝামাঝি লম্বা। গায়ের রং বেশ ফর্সা। চকিতের জন্য দেখেছিলাম, তবু মনে পড়ে, বেশ ভাসা-ভাসা পিঙ্গল চোখ। মাথার চুল সামান্য কটা।
কিরীটীর দিকে তাকালাম। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে।
সন্ধ্যার আকাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতকগুলো তারা। সমুদ্রতীরে বায়ুসেবনার্থীদের ভিড় একটু একটু করে পাতলা হয়ে আসছে। দূরে চোখে পড়ে সী সাইড হোটেলের আলোগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
আমিই প্রথমে কথা বলি, মনে হচ্ছে তুই যেন কিছু ভাবছিস কিরীটী!
অ্যাঁ! কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
কি ভাবছিস?
ঐ কালী সরকারের কথাই ভাবছিলাম রে—
কালী সরকারের কথা!
হ্যাঁ, প্রেসিডেন্সীতে একসঙ্গে দুজনে বছর-তিনেক পড়েছিলাম। সেই সময়ই আলাপ। মনে আছে আজও, ম্যাথেমেটিকসে ওর ব্রেন ছিল অদ্ভুত। ডাঃ সাহা বলতেন, একসেপসন্যাল। অথচ—
থামলি কেন, বল?
কিরীটী আবার বলতে থাকে, কলকাতা শহরের বিখ্যাত ধনী জুয়েলার সরকার ফ্যামিলির ছেলে, যাদের বাড়ির কোনদিন কোন ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চৌকাঠটিও ডিঙিয়েছে কিনা সন্দেহ, সেই বাড়ির ছেলে ম্যাথেমেটিয়ে দুটো লেটার ও রেকর্ড মাকর্স নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে আই-এস-সি পড়তে এল প্রেসিডেন্সীতে। বিরাট ঝকঝকে ওয়েলার ঘোড়া-বাহিত জুড়িগাড়ি করে আসত কলেজে। পরনে গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, হীরের বোম আংটি, চকচকে তৈরী ঝকঝকে ডার্বি সু পায়ে—যেন জামাইটি। কিন্তু যেমনি লাজুক তেমনি নিরীহ শান্ত গোবেচারা টাইপের। প্রথম প্রথম তো কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু ডাঃ সাহার স্তুতির পর হঠাৎ যেন ক্লাসের সবার নজর গিয়ে কালীর উপর পড়ল—সার্চলাইটের মত। ও যেন সর্বসমক্ষে আবিষ্কৃত হয়ে গেল।
তারপর?
ইন্টারমিডিয়েটে ফিজিক্স, কেমিস্ত্রী ও ম্যাথেমেটিকস্ তিনটেতেই ও লেটার পেয়েছিল মনে আছে এবং ম্যাথেমেটিকসে রেকর্ড মার্ক। বি-এস-সি পড়তে শুরু করল ম্যাথেমেটিকস্ নিয়ে এবং থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে ওঠার মাসখানেক পর–
কি?
হঠাৎ কলেজে আসা বন্ধ করলে।
কেন?
কে জানে?
তারপর?
তারপর দীর্ঘ দশ বছর পরে একবার একটা একজিবিশনে দেখা হয়েছিল। তারপর আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। বলতে গেলে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ-আরও কত বছর বাদে হঠাৎ আজ দেখা হল আবার। মনে মনে হিসাব করছিলাম, আরো দশ বছর পরে দেখা হল আজ।
বলিস কি!
তাই ভাবছিলাম। আমি ওকে চিনেছি যেহেতু ওর মুখের গঠনে কিছু peculiarities ছিল—যা আজো আমার মনে আছে, ভুলিনি এবং যে জন্য আজ দেখেই ওকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু ও আমায় সঙ্গে সঙ্গে চিনল কি করে তাই ভাবছি। ও বিশেষ তেমন বদলায়নি চেহারায়, কিন্তু আমি
কিরীটীর কথা শেষ হয় না, হঠাৎ কালী সরকারের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, কিরীটী!
কে?
আমি কালী।
ফিরে চেয়ে দেখি একা কালী সরকার, সঙ্গের সেই ভদ্রলোকটি নেই।
আয়, বস্। কিরীটী আহ্বান জানায়।
ভাই, বসব না। হোটেলে ফিরব।
আচ্ছা কালী–
কি?
তুই আমাকে চিনলি কি করে বল তো, এত বছর পরেও?
বিলক্ষণ! তোকে চিনব না কি রে? দুর্জনেরা যে যাই বলুক, কিন্তু তোকে আজ অস্বীকার করবার ক্ষমতা কার বল্। তা তুই এখানে?
কাজ-কর্ম নেই হাতে। বসে বসে গাঁটে গাঁটে বাত ধরছিল, তাই—
সমুদ্র-সৈকতে! তা বেশ। বাত সারবে হয়তো নোনা হাওয়ায়!
হুঁ, সেই আশাতেই তো এলাম।
কিরীটী এবারে জিজ্ঞাসা করে, তোর সঙ্গে সেই তিনি কে? তাকে তো চিনলাম না?
আমার বিশেষ পরিচিত বন্ধু-নামকরা মুক্তার ব্যবসায়ী, পার্ল-মার্চেন্ট দোলগোবিন্দ শিকদার। হঠাৎ বেড়াতে বেড়াতে সমুদ্রের ধারে এই কিছুক্ষণ আগে এখানে দেখা হয়ে গেল।
তারপর কি করছিস? কিরীটীই কালীপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে, বলতে গেলে একটা যুগ পরে দেখা।
বিজনেস মানে ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
জুয়েলারী-হীরাজহরতের!
তাহলে শেষ পর্যন্ত অঙ্কশাস্ত্র-মাথেমেটিকস্ ছেড়ে ঐ জুয়েলারীর ব্যবসাই করতে গেলি?
উপায় কি বল? আমাদের তিন-জেনারেশন ধরে ঐ জুয়েলারীর ব্যবসা, তুই তো জানতিস ভাই!
তা জানতাম। কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।
হঠাৎ কিরীটীই প্রশ্ন করে, তা হা রে, তুই তো ঐ সী-সাইড হোটেলটাতেই উঠেছিস, তাই না?
হুঁ। ওই হোটেলের ব্যবস্থাটা দেখলাম বেশ ভাল, তাই ওখানেই উঠলাম। তা তুই কোথায় উঠেছিস?
মিহিরবাবুর পুরী ভিউ হোটেলে।
ঐ যে সামনের হোটেলটা?
হ্যাঁ।
আচ্ছা চলি ভাই—
আহা বস্ না। কতদিন পরে দেখা হল—
তুই তো আছিস, পরে দেখা হবে। আজ উঠি ভাই।
কালী সরকার উঠে পড়ে এবং অন্ধকারে বালুবেলার উপর দিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে যায়।
মনে হল ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক।
০২. পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে
পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠেছি দুজনেই আমরা। এবং কোনমতে দুজনে গায়ে জামাটা চাপিয়ে সূর্যোদয় দেখব বলে বের হয়ে পড়ি হোটেল থেকে।
রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে এবং পাতলা অন্ধকারের একটা পর্দা সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যেন থিরথির করে কাঁপছে। তার মধ্যে অস্পষ্ট ঝাপসা সমুদ্র দেখা যায় যতদুর সামনের দিকে দৃষ্টি চলে ততদূর পর্যন্ত। একটানা গর্জন করে চলেছে এবং ঢেউ পড়ছে আর আকুল উচ্ছ্বাসে তীরভূমির উপরে এসে ভেঙে গুড়িয়ে ফেনায় লুটিয়ে পড়ছে পারাবারহীন সমুদ্রের জলরাশি।
অনেকেই সূর্যোদয় দেখবার জন্য বের হয়েছে। তাদের ঝাপসা ঝাপসা মূর্তিগুলো দেখা যায় এদিক-ওদিক। ভিজে নরম বালির উপর দিয়ে দুজনে পূর্বমুখে এগিয়ে চলি। একটানা সমুদ্রের গর্জন বাতাসে মমরিত হচ্ছে। একটা ক্রুদ্ধ দৈত্য বন্দী হয়ে যেন অবিশ্রাম মাথা কুটে চলেছে।
আধ মাইলটাক এগিয়েছি, হঠাৎ ঝাপসা ঝাপসা আলো-আঁধারিতে দূরে নজর পড়ল, তীরে একেবারে জল ঘেঁষে অনেকগুলো লোক। এক জায়গায় যেন গোল করে অনেকগুলো লোক ভিড় করেছে, হয়তো জেলেরা মাছ ধরেছে বা ধরছে-তাই ভিড়।
কিন্তু যত কাছে এগোই, সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে মৃদু একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনধ্বনি কানে আসে আমাদের। পূর্ব গগনে সূর্য তখন দেখা দিয়েছে। ঠিক যেখানে আকাশ ও জলে মেশামেশি সেই আকাশ ও জলের মিলন-রেখাটি ছুঁয়ে যেন কোকনদটির মত। আরও কয়েক পা এগুতেই ব্যাপারটা আমাদের চোখে পড়ল। একটি দেহ সমুদ্রের বালুবেলায় পড়ে আছে আর তাকে ঘিরে দু-তিনটি নুলিয়া আর দশ-পনেরজন পুরীর চেঞ্জার।
গুঞ্জনটা তাদেরই কণ্ঠে। বিস্ময়ের গুঞ্জন।
কি ব্যাপার মশাই, পার্শ্ববর্তী একজনকে জিজ্ঞাসা করি আমিই।
মারা গেছে—
কে মরল?
কে জানে, জলে ড়ুবে মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে।
জলে ড়ুবে?
তাই মনে হয়। নুলিয়ারা মাছ ধরতে গিয়েছিল, অনেকদূরে মৃতদেহটা ভেসে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে তুলে এনেছে।
সমুদ্রতীরে ব্যাপারটা একটা নতুন কিছু নয়, বিস্ময়েরও কিছু নয়, মধ্যে মধ্যে দানব সদ্র দু-একজনকে যে গ্রাস করে না তা নয়। হয়ত তেমনি একজন কেউ। হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীর বিস্ময়-ফুরিত কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়, এ কি, এ যে দেখছি আমাদের কালী সরকার।
কালী সরকার।
সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করি, দু পা আরও এগিয়ে যাই। তাই তো–মিথ্যা তো নয়, কালী সরকারই তো!
সমুদ্র-সৈকতে ভোরের আলো আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে তখন। সে আলোয় বালবেলায় শায়িত মৃত কালী সরকারের দেহটির দিকে তাকিয়েই যেন আমরা কয়েকটা মুহূর্ত বোবা হয়ে থাকি। চিৎ করে শোয়ানো বালুবেলার উপর কালী সরকারের মৃতদেহটা। চোখের পাতা বিস্ফারিত-বিস্ময়ের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে আছে নিষ্পলক স্থির দুটো চোখের তারায়। মাথার চুল এলোমেলো। পরিধানে পায়জামা-পাঞ্জাবি। খালি পা। আর বাঁ হাতে সোনার ব্যাণ্ডে রিস্টওয়াচ বাঁধা।
ইতিমধ্যে ভিড় দেখে সেখানে আরও লোক জমতে শুরু করেছে। সবাই বিস্মিত হতচকিত। একই প্রশ্ন সকলের। তার মধ্যে কেউ কেউ সমবেদনা প্রকাশ করে।
কিরীটী পায়ে পায়ে মৃতদেহের একেবারে খুব কাছে এগিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখতে থাকে। কি দেখছে কে জানে।
ক্রমেই মানুষের ভিড় একজন দুজন করে বাড়ছে।
হঠাৎ দেখি কিরীটী মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ঈষৎ ঝুঁকে মৃতদেহে কি যেন লক্ষ্য করছে।
আমি একটু এগিয়ে যাই।
কিরীটী সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং কতকটা যেন আত্মগতভাবেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলে, হুঁ–
ওর মুখের দিকে সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকালাম ও প্রশ্ন করলাম, কি রে?
কিরীটী মৃতদেহের দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বলে, দেখ–
কী?
দেখ, লক্ষ্য করে দেখ ভাল করে, কালীর গলায়
কী-বলে তাকাতেই আমারও নজরে পড়ল। কালো একটা আধ-ইঞ্চি চওড়া সরু ফিতের মত দাগ গলায় ঠিক চিবুকের নীচে।
হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন আবছা আবছা একটা কালো ফিতে গলায় জড়ানো। প্রথমে তাৎপৰ্যটা মনের মধ্যে উদয় হয়নি। কিরীটীর দ্বিতীয় কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ ঝলক দেয়।
স্ট্রাঙ্গুলেশন নয় তো!
কিরীটী স্বগতোক্তির মতই যেন ফিসফিস করে কথাটা উচ্চারণ করে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কথাটা কানে আমার প্রবেশ করেছিল।
সত্যিই তো! সঙ্গে সঙ্গে মনে দেখা দেয় সন্দেহটা, গলা টিপে হত্যা করে কেউ কালীকে সমুদ্রের জলে রাতারাতি ভাসিয়ে দেয়নি তো!
সম্ভবতঃ তাই এবং তাহলে তো ব্যাপারটা নিষ্ঠুর একটা হত্যা! কালী সরকার তাহলে নিহত হয়েছে!
হঠাৎ কিরীটীর হাতের স্পর্শে ফিরে তাকাই।
কি?
চল।
ভিড় ছেড়ে দুজনে খানিকটা এগিয়ে এলাম বালুর উপর দিয়ে হেঁটে। সূর্যোদয় আর দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে সূর্যদেব অনেকটা উঠে গিয়েছে জলশয্যা ছেড়ে।
কিরীটী দেখি হনহন করে ক্রমশঃ সমুদ্রতীর ছেড়ে পাড়ের দিকে হেঁটে চলেছে। পাড়ে উঠে শহরের দিকে চলেছে।
কোথায় চলেছিস?
বিজয় মহান্তির ওখানে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, বিজয় মহান্তির সঙ্গে মাত্র পরশুই ঘটনাচক্রে আলাপ হয়েছে। ওখানকার, ও, সি, বিজয় মহান্তি।
.
রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে গোলমাল হওয়ায় কিরীটী সাইকেল-রিকশাওয়ালাটাকে ধরে নিয়ে সোজা থানায় গিয়েছিল।
সেখানেই বিজয় মহান্তির সঙ্গে আলাপ। লোকটি বেশ ভদ্র ও অমায়িক এবং কিরীটীর
পরিচয়টা আমি দিতে আমাদের সে কি সাদর অভ্যর্থনা!
কী সৌভাগ্য আমার! আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে যে কি খুশি হলাম! তারপরই প্রশ্ন করেছিল, নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন মিঃ রায় পুরীতে?
হ্যাঁ। এবং সমুদ্র-দর্শন। কিরীটী জবাব দিয়েছিল, বেড়ানোটা গৌণ, সমুদ্রদর্শনটাই মুখ্য।
আসবেন কিন্তু মাঝে মাঝে।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসেছিল মৃদু, কোন জবাব দেয়নি।
আমি তো জানি, এতকাল খুন-জখম-চুরি-বাটপাড়ি এবং সেই কারণে থানা-পুলিস ঘেঁটে ঘেঁটে ওর ঐসবের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। পারতপক্ষে আজকাল ঐসব স্থানে ও যেন পা দিতেই চায় না।
তাহলেও সেদিন থানা থেকে বের হয়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে বলেছিল কিরীটী, মিঃ কাগতাভুয়া মনে হল বেশ সজ্জন ব্যক্তি! আর এদের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ যা হয় তাও নয়—ঘটে কিছু বুদ্ধি ধরে!
কাগতাড়ুয়া! সে আবার কোথা থেকে এল?
কেন রে! মহান্তি সাহেবকে কাগতাড়য়ার মতই দেখতে মনে হল না!
সত্যিই তো। বিজয় মহান্তির চেহারাটা মানসপটে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
কাগতাড়ুয়াই বটে!
লম্বা দেহের অনুপাতে মাথাটা যেন বড়ই। বিশাল একজোড়া কনক-চাঁপা গোঁফ। সরু সরু হাত-পা। ঝলঝলে একটা সুট পরিধানে। আবলুশ কাঠের মত কালো গাত্রবর্ণ।
মিথ্যা বলেনি কিরীটী-ক্ষেতের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলে কাগতাড়ুয়াই মনে হবে।
.
থানার কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করতেই বাঁদিকে মহান্তির কোয়ার্টারের সামনে নজরে পড়ল, মহান্তি তার কোয়ার্টারের সামনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। পরনে একটা সবুজ লুঙ্গি, গায়ে একটা গেঞ্জি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটিজুতো।
আমাদের এত সকালে থানায় আসতে দেখে মহান্তি যেন একটু অবাকই হয়।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানায়, আসুন আসুন, কিরীটীবাবু! এত সকালে? কি সৌভাগ্য!
বাইরের বারান্দায় চেয়ার পাতা ছিল। আমরা সেখানেই বসি।
বসুন, চায়ের কথাটা বলে আসি ভিতরে। হন্তদন্ত হয়ে মহান্তি ভিতরে গেল।
চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে এসে আমাদের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললে, এদিকে বেড়াতে বের হয়েছিলেন বুঝি? তা এ সময়টা সমুদ্রতীর ছেড়ে ঘিঞ্জির মধ্যে এই শহরের দিকে?
আপনাকে একটা খবর দিতে এলাম মহান্তি সাহেব-কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।
খবর! কী খবর?
সমুদ্রের মধ্যে একটা মৃতদেহ যাচ্ছিল, নুলিয়ারা মাছ ধরতে গিয়ে তুলে এনেছে।
মহান্তি হেসে ফেলে, অ্যাক্সিডেন্ট—দুর্ঘটনা! এ তো এখানে সমুদ্রে আকছারই হয়। নতুন কিছু নয়। তারপরই হঠাৎ যেন থেমে গিয়ে কিরীটীর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলে, আপনি কি সেইজন্যেই এসেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ। কারণ ব্যাপারটা আমার ধারণায় সাধারণ কোন একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে যেন মনে হল না।
কিরীটীর কথায় মিঃ কাগতাড়ুয়া—আমাদের মহান্তি সাহ্নে যেন একটু নড়ে-চড়ে বসল, তারপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধালে, কিসে?
হ্যাঁ, তাই।
Simple drowning case নয় বলে আপনার মনে হচ্ছে, মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
তবে কী?
মনে হচ্ছে ইটস কেন্স অফ মার্ডার! লোকটাকে হত্যা করে তারপর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই যেন আমার ধারণা। অবিশ্যি–
আপনার তাই ধারণা?
হ্যাঁ, কারণ এক হতে পারে লোকটা সমুদ্রের জলে আত্মহত্যা করবার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিল কিংবা স্নান করতে গিয়ে আচমকা ঢেউয়ের টানে অগাধ জলে গিয়ে আর সামলাতে পারেনি। কিন্তু ভাবলে মনে হবে, দুটোই যেন কতকটা অসম্ভব।
কেন—অসম্ভব কেন?
প্রথমতঃ লোকটা আমার পরিচিত ছিল।
বলেন কী!
হ্যাঁ, গতকাল সন্ধ্যায়ও ওর সঙ্গে সমুদ্র-সৈকতে আমার দেখা হয়েছে। আত্মহত্যা যদি সে করতও—সমুদ্রজলে ঝাপিয়ে তার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না আত্মহত্যা করাটা, যেহেতু লোকটা এককালে খুব ভাল চ্যাম্পিয়ান সাঁতারু ছিল। দ্বিতীয়তঃ স্নান করতে গিয়ে যদি স্লিপ করে থাকে-সেও নিশ্চয়ই শেষরাত্রে অন্ধকার থাকতে স্নান করতে যায়নি—কেউ যায় না বিশেষ করে সমুদ্রস্নানে—তাই যেন আমার মনে হচ্ছে ওকে কেউ হত্যা করেছে–
হত্যা করেছে-বলেন কী?
হ্যাঁ। অবিশ্যি হত্যাকারী হয়ত ভেবেছিল, নিঃশব্দে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে একবার যদি মৃতদেহটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়—তার কার্যসিদ্ধি হবে এবং হত্যার সমস্ত প্রমাণ সমুদ্রের জল ধুয়ে-মুছে দেবে। কিন্তু–
মহাতি কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
কিরীটী বলে, কিন্তু বেচারীর বোধ হয় বিধি বাম। সমুদ্র তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছেই–মৃতদেহটা বেশী দূরে টেনে না গিয়ে আশেপাশেই কোথাও ভাসছিল যার ফলে নুলিয়াদের নজরে পড়ে গেল, আর সেই সঙ্গে
কি সেই সঙ্গে?
মহান্তি কাল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিরীটী রায়ের উপস্থিতি পুরীতে—কিন্তু সেজন্যও ঠিক নয় মহাতি সাহেব। আমি এসেছি বিশেষ করে কথাটা আপনাকে জানাতে—একটু আগেই আমি আপনাকে বললাম না—আমি ওকে চিনতাম। লোকটার নাম কালী সরকার-কলকাতা শহরের একজন নামী ও ধনী জুয়েলার।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মাঝখানে অবিশ্যি অনেকদিন আমার ওর সঙ্গে দেখা হয়নি, তবে দেখা না হলেও কাগজেই হয়ত আপনিও দেখে থাকবেন, ভাইয়ে ভাইয়ে গণ্ডগোল হয়ে বৎসরখানেক আগে সব পাটিশন হয়ে আলাদা আলাদা হয়ে গিয়েছে-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে পার্টিশন–
জাস্ট এ মিনিট মিঃ রায়, মহান্তি বাধা দেয় ঐ সময়, ওরই ভাইরা কি-রাখাল সরকার, বৃন্দাবন সরকার, গোকুল সরকার
হ্যাঁ, কালী রাখাল বৃন্দাবন গোকুল আর দুর্গা সরকার। একদা কালীর সঙ্গে প্রেসিডেন্সীতে বছর তিন পড়েছিলাম। ম্যাথেমেটিকসে খুব মাথা ছিল ঐ কালীর।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আর দেখতে লোকটা, মানে চেহারাটা, একটা বনমানুষ ও ভিলেনের মত হলেও খুব শান্ত নিরীহ প্রকৃতির ছিল বলেই জানতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী আড়চোখে আমার দিকে তাকাল।
তাহলে তো একবার উঠতে হচ্ছে!
হ্যাঁ-চলুন একবার ঘুরে আসবেন।
কিরীটী উঠে দাঁড়াতেই মহান্তি বাধা দেয়, আরে উঠছেন কি, বসুন-বসুন—চা আসুক। আগে চা খান-মৃতদেহ যখন ডানা মেলে উড়ে যাবে না।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তা অবিশ্যি যাবে না। কিন্তু আপনার একবার যত শীঘ্র সম্ভব মনে হয় সেখানে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এলে ভাল হয়।
সে তো যাবই। বসুন-বসুন—
অগত্যা আমাদের পুনরায় বসতেই হল।
এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় চা এসে গেল। শুধু চা নয়, তার সঙ্গে প্রচুর জলখাবারও। চা ও জলখাবারের ব্যাপার শেষ করে আরও আধ ঘণ্টা পরে আমরা উঠলাম। আসবার সময় মিঃ মহান্তি বললেন থানায় মৃতদেহ এলেই আমাদের খবর দেবে।
০৩. থানা থেকে আমাদের ডাক
বেলা প্রায় নটা নাগাদ থানা থেকে আমাদের ডাকতে লোক এল। মহান্তি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছে।
আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম। থানায় পৌঁছে দেখি মহান্তি সাহেব বসে আছে মৃতদেহের অপেক্ষায়। মৃতদেহ তখনও এসে পৌঁছয়নি।
কালী সরকারের মৃতদেহটা থানায় এসে পৌঁছল যখন তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা।
একটা স্ট্রেচারে করে—একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে মৃতদেহ থানায় বহন করে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাহকরা এলে স্ট্রেচারটা সামনের বারান্দায় নামিয়ে রাখল মহাতি সাহেবের নির্দেশে।
ইতিমধ্যে মহান্তি সাহেব সমুদ্রতীরে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছিল। এবং সেই। প্রসঙ্গেই ঐ সময় কিরীটীর সঙ্গে মহান্তি সাহেবের আলোচনা চলছিল।
মহান্তি সাহেবের ইঙ্গিতে বাহকদের মধ্যে একজন মৃতদেহের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিল। কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং স্ট্রেচারে শায়িত মৃতদেহের কাছে এগিয়ে যায়—বোধ করি মৃতদেহটা আর একবার ভাল করে দেখবার জন্য। বলাই বাহুল্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে অনুসরণ করি।
আবার মৃতদেহের দিকে তাকালাম।
কিরীটীর সন্দেহ মিথ্যা নয়। গলার দাগটা সত্যিই সন্দেহজনক। এবং মনে হয় না। অনেকক্ষণ মৃতদেহটা সমুদ্রের জলে ছিল। খুব জোর ঘণ্টা দেড়েক বা দুই। তার বেশী নয়। এবং মৃতদেহে রাইগার মর্টিস তখনও সেট-ইন করেনি পরীক্ষা করে বোঝা গেল। তাতেই অনুমান হয় রাত বারোটার পরে কোন এক সময় নিহত হয়েছে লোকটা সম্ভবত।
পরীক্ষা করা হয়ে গেলে কিরীটী কম্বলটা আবার টেনে দেয় মৃতদেহের উপরে। ফিরে এসে চেয়ারে বসল।
তাহলে মিঃ রায়, আপনি নিঃসন্দেহ-লোকটাকে হত্যাই করা হয়েছে! মহান্তি কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আবার প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, মহান্তি সাহেব। অবিশ্যি লোকটার মৃত্যুর কজ অর্থাৎ স্ট্যাজুলেশান-শাসরোধ হয়ে
জলে ড়ুবে সেটা সঠিকভাবে ময়না তদন্তের দ্বারাই একমাত্র প্রমাণিত হবে। তবে–
তবে?
মৃতদেহ পরীক্ষা করে ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে যা মনে হচ্ছে-ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়–নিষ্ঠুর হত্যা। সে বিষয়ে এখন কিন্তু আমি নিঃসন্দেহ।
নিঃসন্দেহ সত্যিই আপনি মিঃ রায়?
হ্যাঁ। সামান্যতম সন্দেহও আমার মনের কোথাও নেই ঐ সম্পর্কে।
কিন্তু আপনি এত ডেফিনিট হচ্ছেন কি করে?
কারণ প্রথমতঃ ধরুন—যদি অ্যাক্সিডেন্টই হত অর্থাৎ ড্রাউনিং-ই লোকটার মৃত্যুর কারণ হত, সে নিশ্চয় স্নান করতে গিয়েই হত—কেমন কি না?
হ্যাঁ—সেটাই স্বাভাবিক।
তাই যদি হয় তো লোকটা নিশ্চয়ই পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে ও হাতে ঘড়ি, বিশেষ করে অমন দামী একটা ঘড়ি বেঁধে নিশ্চয়ই সমুদ্রস্নান করতে যেত না! আই থিঙ্ক ইউ উড এগ্রি উইথ মি অন দ্যাট পয়েন্ট মিঃ মহান্তি!
হ্যাঁ।
আসুন এবার দ্বিতীয় পয়েন্টে আমার। মৃতদেহ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না—অন্ততঃ দেড় ঘণ্টা থেকে দুঘণ্টা মৃতদেহটা জলে ছিলই এবং আমরা যতদূর জেনেছি নুলিয়ারা ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মৃতদেহটা জলে ভাসতে দেখে তুলে আনে ডাঙায়। তাই যদি হয় এবং লোকটা যদি স্নান করতে গিয়েই ড়ুবে গিয়ে মরে থাকে, নিশ্চয়ই সে রাত তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ সমুদ্রস্নান করতে যায়নি-অবিশ্যি যদি না লোকটার মাথায় কোন গোলমাল থেকে থাকে। কিন্তু আগেই আপনাকে আমি বলেছি কালী সরকার আমার পরিচিত এবং মাত্র গতকালই ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সন্ধ্যায় সমুদ্র-সৈকতে দুবার এবং কথাবার্তাও হয়েছে আমার লোকটার সঙ্গে। এবং সেরকম কিছুই তো মনে হয়নি। অতএব–
আর–এনি আদার পয়েন্ট মিঃ রায়? এবারে মহান্তি প্রশ্নটা করে।
আছে। আমার তৃতীয় পয়েন্ট, যদি অ্যাক্সিডেন্টের কথা বাদ দিয়ে ভাবি লোকটার আত্মহত্যার কথা—সেটা অবিশ্যি আমার পক্ষে এত তাড়াতাড়ি বলা সম্ভব নয়—আরো প্রমাণ ও অনুসন্ধানের-ইনভেস্টিগেশন-এর প্রয়োজন, তবে এ কথাও তো আপনাকে আমি বলেছি, কালী সরকার খুব ভাল সাতুরু ছিল। কাজেই সেটা তো আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না!
তা ঠিক।
নাউ দি ফোর্থ-চতুর্থ পয়েন্ট, মৃতের গলার দাগটা লক্ষ্য করুন মিঃ মহান্তি, ঠিক মনে হবে কোন কিছু ফিতে বা দড়ির মত গলায় বেঁধে শ্বাসরোধ করা হয়েছে লোকটাকে
কিন্তু–
অবিশ্যি সেটাও ময়না তদন্তের ফলাফলের উপরই অনেকটা নির্ভর করছে নিঃসন্দেহে। তবু আপাতত এই পয়েন্টগুলোর উপরে নির্ভর করেই তো আপনি তদন্ত শুরু করতে পারেন মিঃ মহাত্তি!
তা পারি—এবং তদন্ত তো করবই। তবে একটা কথা মিঃ রায়—
বলুন?
ঘটনাচক্রই বলুন আর যাই বলুন, আপনি যখন এখানে উপস্থিত আছেনই, আপনার সাহায্য এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই পাব আশা করতে পারি।
মোস্ট গ্লাডলি। আপনাকে আমার যথাসাধ্য-আমি শুধু নয়, আমরা দুজনেই আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করব মিঃ মহান্তি-কথা দিচ্ছি।
সত্যি বলছেন তো?
সত্যিই।
তাহলে এবারে কাজের কথায় আসা যাক মিঃ রায়—
নিশ্চয়ই, আপনি তাহলে তদন্ত–
শুরু করব এবং এখুনি। তাই ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব—
একেবার মূল স্থান থেকেই শুরু করুন মিঃ মহান্তি। কিরীটী বলে।
মূল স্থান!
হ্যাঁ, সী-সাইড হোটেল থেকে—যেখানে আমরা জেনেছি কালী সরকার উঠেছিল। সী-সাইড হোটেল মানে হারাধন অর্থাৎ হরডন বিশ্বাসের হোটেল! বিজয় মহান্তিই তখন সংক্ষেপে পরিচয় দেয় ঐ হরডন বিশ্বাস লোকটার ও স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাসের।
লোকটা ক্রিশ্চান—জাতে জেলে-গঞ্জাম জিলাতেই বাড়ি।
এক পাদ্রীর কৃপায় ক্রিশ্চান হয়ে তাঁরই দয়ায় লেখাপড়া শিখে চাকরি করছিল রেলেতে, তারপর ওর পালনকর্তা পাদ্রী ফারলোর মৃত্যুর পর কলকাতা হগ মার্কেটে তার ফুলের স্টল ও নার্সারি উইলে পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়। ফুলের কারবার করেছে বছর-পাঁচেক, তারপর বছরখানেক হল ঐ হোটেল খুলেছে এখানে এসে-কলকাতার ব্যবসা বেচে দিয়ে।
হোটেলটা তো বেশ চমৎকার। অনেক টাকা ঢালতে হয়েছে মনে হয়! কিরীটী বলে।
তা হয়েছে বৈকি। পাদ্রীর নার্সারী ও ফুলের স্টলটা বিক্রি করেও শুনেছি নেহাৎ কম টাকা পেয়েছিল না—সেই বিক্রির টাকা দিয়েই নাকি এখানে এসে হোটেলটা খুলেছে।
হুঁ, ভাগ্যবান বলতে হবে।
তা ভাগ্যবান বৈকি! তাছাড়া মিসেস বিশ্বাস—
মিসেস বিশ্বাস কি—
শি ইজ অ্যান অ্যাসেট!
কি রকম?
দেখলেই বুঝবেন। চলুন না—উঠুন –হোটেলেই তো এখন যাব।
চলুন।
.
সী-সাইড হোটেল।
সী-সাইড হোটেলটি অনেকখানি জায়গা নিয়ে এবং অনেক টাকা খরচ করে তৈরী হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। একেবারে বলতে গেলে বীচের উপরে যে রাস্তা সেই রাস্তার উপরেই। বিরাট গেট। তারপরই খানিকটা খোলা জায়গা।
হোটেলের বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েদের খেলবার ব্যবস্থা আছে সেখানে নানা ধরনের। তারপরই দোতলা বিল্ডিংটি।
ভিতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় ইংরাজী অক্ষর ই-র প্যাটার্নে তৈরী বাড়িটা। উপরে ও নীচে ছোট-বড়য় মিলে প্রায় ত্রিশটা ঘর। ফোর সিটেড-সিঙ্গল সিটেড ও পুরো ফ্যামিলি থাকবার মত সর্বপ্রকার ব্যবস্থাই হোটেলটিতে আছে।
চার্জও একটা খুব বেশী নয়-মডারেট।
ম্যানেজার-প্রোপ্রাইটার মিঃ হরডন বিশ্বাস নীচের তলায় এক কোণে একেবারে খানতিনেক ঘর নিয়ে থাকে। লোকজনের মধ্যে সে নিজে, তার স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাস ও একটি বেকার শ্যালক-রেণুকার ভাই রামানুজ।
তার পদবী যাই থাক, সবাই রামানুজ বলেই জানে এবং ডাকে। রামানুজই হোটেলের সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকার।
রামানুজই আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে বসাল, কাম-কাম, ওয়ান্ট রুম-সিঙ্গল-ডবল-ভেরি চিপ স্যার-ভেরি চিপ।
রামানুজের বয়স আটাশ-ত্রিশের বেশী হবে না।
অনর্গল ভুল ইংরাজী বলা তার মুদ্রাদোষ একটা। তবে সত্যিই সুশ্রী। লম্বা ঢ্যাঙা চেহারা। টকটকে রঙ-কটা চুল, কটা চোখ।
পরিধানে একটা স্ন্যাক-হাওয়াই শার্ট চিত্র-বিচিত্র অ্যামেরিকান টাইপের এবং পায়ে হাওয়াই চপ্পল। মুখে ধূমায়মান সিগারেট।
মিঃ মহান্তি শুধায়, মিঃ বিশ্বাস কোথায়?
হোয়াই স্ট্যাডিং? বসুন না বসুন, মিঃ বিশ্বাস মনে হয় থানাতেই গন। এখুনি আসবেন-কামিং সুন।
কথাটা শুনে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি।
মহান্তি বলে, মিসেস বিশ্বাস নেই?
হ্যাঁ–কিচেনে আছে-কল হার?
হ্যাঁ, তাকে খবর দিন।
রামানুজ চলে গেল এবং মিনিট দশেক পরেই রেণুকা বিশ্বাস এসে ঘরে ঢুকল। নমস্কার মিঃ মহান্তি—কি খবর? মিঃ বিশ্বাস তো থানাতেই গিয়েছেন আপনার কাছে। দেখা হয়নি?
না। তার আগেই আমরা বের হয়ে পড়েছি।
ও, তাই বুঝি—
হ্যাঁ।
তবে বসুন না, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন।
আমরা বসলাম।
একটু চায়ের কথা বলে আসি!
না, না-আপনাকে এই দুপুরে ব্যস্ত হতে হবে না। আপনি বসুন মিসেস বিশ্বাস—
মৃদু হেসে মিসেস বিশ্বাস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
পরে পরিচয় জেনেছিলাম মহান্তিরই মুখে ঐদিনই-মিসেস বিশ্বাসের মিশ্র রক্তে জন্ম।
ওর মা ছিল আদিবাসী সাঁওতাল, আর বাপ একজন স্কচ মিশনারী ডাক্তার। জম্মস্বত্বে কিন্তু স্কচ বাপের সব বৈশিষ্ট্যই পেয়েছিল মহিলা।
০৪. বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের
বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের। এবং বয়স চল্লিশের নিচে নয় বলেই মনে হয়।
কিন্তু বয়েস হলেও বোঝবার উপায় নেই, কারণ ছেলেপিলে না হওয়ার দরুনই বোধ হয় দেহের গড়ন এখনও এ বয়সেও বেশ আঁটসাঁট এবং যৌবন যেন সমস্ত দেহে ছড়িয়ে আছে এখনও।
রীতিমত ফর্সা গাত্রবর্ণ। রামানুজের মতই কটা চুল, কটা চোখ। পরিধানে কিন্তু বাঙালী মেয়েদের মত ড্রেস করে একটি ভাল শাড়ি পরা। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। খোঁপায় একটি ফুল গোঁজা। হাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।
কথাটা মহান্তিকে তুলতে হল না-মিসেস বিশ্বাসই উত্থাপন করল। বললে, একটা বড় স্যাড ব্যাপার ঘটে গিয়েছে!
কি হল?
আমাদের হোটেলেরই একজন বোর্ডার মনে হচ্ছে গতরাত্রে সমুদ্রের জলে সুইসাইড করেছিল
সুইসাইড! মহান্তি তাকাল মিসেস বিশ্বাসের মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি! কিন্তু বুঝতে পারছি না ভদ্রলোক হঠাৎ ওভাবে সুইসাইড করতে গেলেন কেন? অথচ পাঁচ-সাতদিন এখানে আছেন, খুব সোবার ধীর-স্থির বলেই তো মনে হয়েছে ভদ্রলোককে।
তবে হঠাৎ সুইসাইড করতে গেলেন কেন?
তাই তো বলছি-কিছু মাথামুণ্ডু বোঝাই যাচ্ছে না। বলেছিলেন এক মাস থাকবেন–
কোন্ ঘরে থাকতেন? মহান্তি আবার প্রশ্ন করে।
দোতলার দুটো পাশাপাশি ঘর নিয়ে ছিলেন।
সঙ্গে আরও কেউ ছিল বুঝি?
না, একাই ছিলেন। বড়লোক মানুষ, তাই হয়তো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকা অভ্যাস। দুটো ঘর হয়ত সেইজন্যই নিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের তো চিনতে পারছি না—আপনার সঙ্গে এরা–
আমার বিশেষ বন্ধু—
ও—তা আপনি কি মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছেন?
হ্যাঁ। আপনার হোটেলের বোর্ডার কালী সরকারের ব্যাপারেই–
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, রেণুকা বিশ্বাসের কটা চোখের চাউনি যেন হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল এবং পর্যায়ক্রমে আমাদের সকলের মুখের উপর দিয়ে দ্রুত একবার ঘুরে গেল।
বুঝলাম ভদ্রমহিলাটি বুদ্ধি ধরে এবং সজাগ। অতঃপর রেণুকা বিশ্বাস একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ মহান্তি? কোন রকম সন্দেহজনক কিছু কি?
তা একটু সন্দেহের কারণ ঘটেছে বৈকি মিসেস বিশ্বাস!
মিঃ মহান্তি, এটা আমার হোটেল, দশজন আসা-যাওয়া করছে সর্বক্ষণ এবং দশজনকে নিয়ে ব্যাপার। সেরকম কিছু হলে বুঝতেই পারছেন হোটেলের একটা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যস্ত হবেন না মিসেস বিশ্বাস-কিরীটীই এবার কথাটা বললে, মিঃ মহান্তি যথাসাধ্য। গোপনেই ব্যাপারটা অনুসন্ধান করবেন এবং আপনার যাতে করে কোন ক্ষতি না হয় সেটাও
উনি দেখবেন বৈকি। তবে
কী বলুন?
বুঝতেই তো পারছেন একটা সন্দেহজনক মৃত্যুর ব্যাপার—
সন্দেহজনক মৃত্যু! কি বলছেন আপনি?
দুঃখিত আমরা মিসেস বিশ্বাস, মহান্তিই এবারে বলে, কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই খানিকটা সন্দেহ রয়েছে, আমাদের ধারণা।
সন্দেহ! দুর্ঘটনা—মানে সুইসাইড নয় বলেই তাহলে আপনাদের ধারণা?
হ্যাঁ, দুর্ঘটনা অবশ্যই-তবে সুইসাইড কিনা সত্যি-সত্যিই এখনও সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।
মানে?
বুদ্ধিমতী আপনি-কিরীটী বলে, আপনিই ভেবে দেখুন না, আপনি যা যা একটু আগে কালী সরকার সম্পর্কে বললেন, তাতে করে লোকটা হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সুইসাইড করে বসবে, সেরকম কিছু বলে কি আপনার মনে হয়?
না।
তাছাড়া কালী সরকারকে—কিরীটী বলে, আমি এককালে ভাল করে চিনতাম। আমার সহপাঠী ছিল।
হ্যাঁ। লোকটা অবস্থাপন্ন নিঝঞ্জাট শান্ত স্থির বিবেচক বুদ্ধিমান।
কিন্তু–
হ্যাঁ, পরে তেমন কোন কারণ ঘটতে পারে এই তো বলতে চান! তা অবিশ্যি পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছুই তো চোখে পড়ছে না বা মনেও আসছে না।
মিসেস রেণুকা বিশ্বাস আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বলে, তবে কি আপনারা মনে করেন, সত্যিই ব্যাপারটার মধ্যে কোন গণ্ডগোল আছে? মানে–
ঠিক, মিসেস বিশ্বাস, আপনার সন্দেহ মিথ্যা নয়। আমাদের ধারণা তাই। মিঃ মহান্তি জবাব দেয় এবারে।
রেণুকা বিশ্বাস হঠাৎ যেন কেমন গম্ভীর হয়ে পড়ে। কপালে চিন্তার রেখা দেখা দেয়।
কিরীটীর ইঙ্গিতে অতঃপর মিঃ মহান্তি বলে, মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকার যে ঘরে ছিল সে ঘরটা একবার দেখতে চাই আমরা।
নিশ্চয় নিশ্চয়-উঠুন, চলুন—
আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি আর ঠিক সেই সময় হোটেলের মালিক মিঃ হরডন বিশ্বাস এসে ঘরে ঢুকল।
এই যে মিঃ মহান্তি, আপনি এখানে আর আমি থানায় গিয়ে—
কথাটা শেষ হয় না বিশ্বাসের। আমাদের দিকে নজর পড়ায় থেমে গেল যেন সঙ্গে সঙ্গে।
আপনি যে কারণে গিয়েছিলেন, আমরাও সেই কারণেই আপনার এখানে এসেছি মিঃ বিশ্বাস। কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতেই এসেছি।
তদন্ত করতে?
হ্যাঁ।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তো আপনার কথাটা মিঃ মহান্তি!
জবাব দিল এবারে রেণুকা বিশ্বাস, ওঁদের ধারণা কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারের মধ্যে কোন গোলমাল আছে—মানে সামথিং সাসপিসাস–
সন্দেহজনক! সে কি?
ওঁরা তো তাই বলছেন।
মিঃ মহান্তি—
হ্যাঁ, মিঃ বিশ্বাস। মহান্তি বললেন, ব্যাপারটা আপনারা যা ভেবেছেন তা মনে হয় না।
তবে?
মনে হচ্ছে ইটস এ কেস অব মার্ডার-হোমিসাইড। তাকে কেউ হত্যা করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।
সে কি! একটা অধস্ফুট চিৎকার বিশ্বাসের কণ্ঠ চিরে যেন বের হয়ে আসে।
আতঙ্ক-একটা বিস্ময় যেন ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমি দেখছিলাম লোকটাকে—মানে রেণুকা বিশ্বাসের স্বামী হরডন বিশ্বাসকে।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, রোগাটে, ডিসপেপটিক টাইপের চেহারা। মাথার চুল সামনের দিকে কিছু আছে। পিছনের সবটাই প্রায় বলতে গেলে ঘাড় পর্যন্ত কামানো। ছোট কুতকুতে একজোড়া চোখ। ধারালো খাড়া নাক। নাকের নীচে মাছির মত একটুখানি গোঁফ। বাদবাকি সব ক্লিন সেভ করা। ছোট ছোট দাঁত। দাঁত তো নয়—যেন মুক্তোর পংক্তি। পরনে প্যান্ট ও বুশকোট, পায়ে পাম্পসু।
হরডন বিশ্বাস তোতলাতে তোতলাতে বলে, মা-মার্ডার! আপনি কী বলছেন মিঃ মহান্তি?
বললাম তো আমার তাই ধারণা।
বাট হাউ অ্যাবসার্ড! এ যে অসম্ভব! কে-কে তাকে হত্যা করবে? আর হত্যা করতে যাবেই বা কেন?
কে হত্যা করবে, কেন হত্যা করবে তাকে এসব প্রশ্নের জবাব যদি পেতাম তবে আর ভাবনা ছিল কী মিঃ বিশ্বাস! সোজা খুনীকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরতাম। এতক্ষণে!
হরডন বিশ্বাস এবারে যেন একান্ত হতাশ এবং অন্যন্যোপায় হয়েই তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। শুকনো গলায় বললে, কি হবে রেণু?
কি আবার হবে–তুমি অত নার্ভাস হয়ে পড়ছ কেন?
বোঝা গেল হরডন বিশ্বাস নার্ভাস হয়ে পড়লেও রেণুকা বিশ্বাস এতটুকু নার্ভাস হয়নি। এবং তার কণ্ঠস্বরেই সেটা প্রকাশ পায়।
তুমি কি ব্যাপারটা কত সিরিয়াস বুঝতে পারছ না রেণু! অন্য কিছু নয়—মার্ডার-খুন! ব্যাপারটা একবার জানাজানি হয়ে গেলে এবং জানাজানি হবেই-সমস্ত হোটেলে কিরকম একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হবে তখন–
জানবে কী করে তারা? আর জানতেই বা যাবে কেন? রেণুকা বুঝি সানা দেবার চেষ্টা করে তার স্বামীকে।
বুঝতে পারছ না কেন ডারলিং! এরকম একটা সাংঘাতিক ব্যাপার-এ তুমি কতক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে পারবে? কী হবে মহান্তি সাহেব? আমি কি তবে ধনেপ্রাণে মারা যাব? এত টাকা খরচ করে হোটেল করেছি-সবে জমে উঠেছে–
হরডন বিশ্বাসের প্রায় কেঁদে ফেলবার যোগাড়।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় মহান্তি।
কিরীটীই বলে তখন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ব্যাপারটা মিঃ মহান্তি যথাসাধ্য গোপনে এবং সতর্কতার সঙ্গে ডীল করবেন।
আপনি-আপনি কে? হরডন কিরীটীর দিকে তাকাল।
আমি–আমি মানে—
কিরীটীকে ইতস্তত করতে দেখে মহান্তি বলে, মিঃ বিশ্বাস, ওঁর একটা বিশেষ পরিচয় আছে। বিখ্যাত ব্যক্তি উনি।
কে?
রহস্যভেদী কিরীটী রায়ের নাম শুনেছেন?
শুনিনি! বহুবার শুনেছি। আপনিই তাহলে সেই–
হ্যাঁ-উনিই তিনি। যাক, চলুন উপরে, একবার কালী সরকার যে ঘরে ছিল সে ঘরটা দেখে আসি।
চলুন।
তোমায় যেতে হবে না, তুমি থাক—আমি যাচ্ছি। রেণুকা বলে ওঠে।
তুমি যাবে? তবে তাই যাও রেণু। রামানুজ-রামানুজকে দেখছি না! সে কোথায় গেল? কোথায় যে থাকে সব! কাজের সময় কাউকে যদি সামনে পাওয়া যায়!
কেন, রামানুজকে দিয়ে কি হবে?
একটুকু চা-তাছাড়া সিগারেট আমার সব ফুরিয়ে গিয়েছে।
হেয়ার স্ট্যাণ্ডিং ব্রাদার–
দরজার বাইরে থেকে রামানুজের গলা শোনা গেল। সে ঘর থেকে গেলেও দূরে যায়নি। এতক্ষণ কান পেতে দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল।
রামানুজ এসে ঘরে ঢুকল।
০৫. আর অপেক্ষা করলাম না
আমরা, বলাই বাহুল্য, আর অপেক্ষা করলাম না।
রেণুকা বিশ্বাসের সঙ্গে হোটেলের দোতলায় কালী সরকার যে ঘর দুটো নিয়ে ছিল, সেই ঘর দুটো দেখবার জন্য অগ্রসর হলাম। আগে আগে রেণুকা বিশ্বাস, পশ্চাতে আমরা তিনজন। গ্রীষ্মের সিজন, হোটেলে বোর্ডার্স একেবারে ভর্তি। গমগম করছে।
নানা জাতের নানা ধরনের লোক। স্নানের সময় এটা, তাই বেশীর ভাগ বোর্ডারই সমুদ্রস্নানে গিয়েছে। যারা ছিল তারা রেণুকা বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ও পুলিসকে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখে এদিক ওদিক থেকে কৌতূহলের সঙ্গে উঁকি দেয়।
কৌতূহলটা অবিশ্যি খুবই স্বাভাবিক।
হঠাৎ কিরীটীই প্রশ্নটা ফিসফিস করে করে রেণুকা বিশ্বাসকে, মিসেস বিশ্বাস, আপনার হোটেলের লোকেরা কি মিঃ সরকারের ব্যাপারটা জানতে পেরেছে?
পেরেছে-তবে তারা জানে ভদ্রলোক সুইসাইড করেছেন। রেণুকা বিশ্বাস জবাব দেয়।
আপনাকে এ ব্যাপারে কেউ কিছু প্রশ্ন করেছে?
না।
ইতিমধ্যে আমরা দোতলায় নির্দিষ্ট ঘরের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল, বাইরে থেকে মিসেস বিশ্বাস তালা খুলে দিল। আমরা সকলে একে একে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
ঘর দুটি চমৎকার। খোলা জানালা-পথে তাকালেই চোখে পড়ে সম্মুখে প্রসারিত আদিগন্ত সমুদ্র। দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে-মুহূর্তে যেন সমগ্র দৃষ্টিকে গ্রাস করে। চোখের দৃষ্টি যেন আমার ফিরতে চায় না।
কিরীটীর প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকাই।
কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসকে আবার প্রশ্ন করছিল, আপনিই বুঝি ঘরে তালা লাগিয়ে
দিয়েছিলেন মিসেস বিশ্বাস?
হ্যাঁ। ব্যাপারটা জানার পরেই তালা লাগিয়ে রাখি। ঘরে তার কি মূল্যবান জিনিস আছে-আছে কে জানে। যদি কিছু খোওয়া যায় তাই–
ভাল করেছেন।
পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি বড় আকারের, অন্য সংলগ্ন ঘরটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দুই ঘরের মধ্যবর্তী একটা দরজা আছে, ঘরের মধ্যে তিনটি জানালা। তিনটি জানালাই খোলা ছিল এবং জানালাগুলি সমুদ্রের দিকে। খোলা জানালা-পথে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। দেওয়ালে টাঙানো একটা ক্যালেণ্ডারের পাতাগুলো ফরফর শব্দে উড়ছিল।
কিরীটী ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে থাকে।
আমি একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আসছে ঘরে। সামনে যতদূর দৃষ্টি চলে-বালুবেলার পরেই আদিগন্ত সমুদ্র প্রখর সূর্যকিরণে নীল মরকত মণির মত যেন জ্বলছে। বেলা প্রায় সাড়ে এগারটা হবে। অসংখ্য মানার্থী-সমুদ্রের তটে ও জলে।
ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র সামান্যই। একধারে একটি খাটে শয্যা বিস্তৃত। তার পাশে একটি টেবিল একটি কাঠের চেয়ার ও একটি ক্যাম্বিসের ইজচেয়ার। ইজিচেয়ারটার উপরিভাগে একটি ভোয়ালে বিছানো-মাথার তেল লাগবার ভয়ে বোধ হয়।
টেবিলের উপরে কিছু ইংরাজী, বাংলা ম্যাগাজিন ও খান-দুই মোটা মোটা হায়ার ম্যাথমেটিকসের বই। একপাশে একটা বড় চামড়ার দামী সুটকেস এবং তার উপর একটা অ্যাটাচি কেন্স।
পাশে দুজোড়া জুতো। একজোড়া কাবুলী চপ্পল। আরও একজোড়া চপ্পল আমাদের চোখে পড়ল খাটের ঠিক সামনেই। মনে হয় যেন কেউ চপ্পলজোড়া পা থেকে খুলে রেখে দিয়েছে। শয্যাটার দিকে তাকালে মনে হয়—সেটা ব্যবহৃত হয়েছে। শয্যার চাদরটা কুঁচকে রয়েছে।
মধ্যবর্তী দরজার কবাট দুটো এদিক থেকে বন্ধ-শিকল ভোলা ছিল। পাশের ঘরে গিয়ে দরজার শিকল খুলে ঢুকলাম আমরা। সে ঘরের ব্যবস্থাও ঠিক পাশের ঘরের অনুরূপ।
কেবল শয্যাটি সুজনি দিয়ে ঢাকা। এবং সেই শয্যার উপরে একটা রবারের বালিশ, একটা ৭৭৭ সিগারেটের কৌটো, একটা কাঁচের অ্যাসট্রে—অ্যাসট্রে ভর্তি সিগারেটের টুকরো ও ছাই। আর একজোড়া তাস।
সে-ঘর থেকে বেরুবার দরজাটা বন্ধই ছিল। দরজাটা খোলবার চেষ্টা করে খুলতে না পেরে কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করে, দরজাটা বুঝি বাইরে থেকে বন্ধ?
হ্যাঁ। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। মিঃ সরকারই বলেছিলেন তালা দিয়ে দিতে। এ দরজাটা তো তিনি ব্যবহার করতেন না।
সে তালার চাবি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
একটা মিঃ সরকারের কাছে ছিল। একটা আমাদের হোটেলের কী বোর্ডে আছে। আনব? রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
না, থাক এখন।
কিরীটী এদিক ওদিক তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ খাটের দিকে এগিয়ে যায়।
তাসের প্যাকেটের পাশেই একটা সাধারণ একসারসাইজ খাতা ও একটা বল-পয়েন্ট দামী বিলিতি পেনসিল চোখে পড়ে। কিরীটী হাত বাড়িয়ে খাতাটা তুলে নিল। খাতার অনেকগুলো পাতায় নানা ধরনের হিসাব লেখা। হিসাবের অঙ্ক কষা। নানা অঙ্কের ফিগার-সবই ইংরাজীতে।
আনমনে খাতার পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ এক জায়গায় যেন মনে হল কিরীটীর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। দুচোখে অনুসন্ধিৎসার আলো।
কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম ওর পাশে। কিন্তু তার আগেই খাতাটা মুড়ে কিরীটী জামার পকেটে রেখে দিল। তারপরই রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকে, মিসেস বিশ্বাস!
বলুন?
আমাদের-মানে আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কি কালী সরকারের পূর্বে কোন পরিচয় ছিল? কোন সূত্রে?
হঠাৎ যেন একটু চমকে ওঠে রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর আকস্মিক প্রশ্নে, বলে, পরিচয়।
হ্যাঁ, পরিচয় কি ছিল?
না তো!
কখনও কোনও পরিচয় ছিল না?
না।
এই হোটেলেই তাহলে তার সঙ্গে আপনাদের প্রথম পরিচয়?
হ্যাঁ।
ওঃ! আচ্ছা চলুন। মধ্যবর্তী দরজা-পথে আবার আমরা প্রথম ঘরে ফিরে এলাম। হঠাৎ কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসের দিকে আবার ঘুরে দাঁড়াল, মিসেস বিশ্বাস। বলুন? আপনি প্রথম কখন জানতে পারেন এবং কেমন করে জানতে পারেন দুর্ঘটনার কথাটা?
বোর্ডারদের প্রাতঃকালীন চায়ের ব্যবস্থা করবার জন্য আমাকে খুব ভোরে উঠতে হয়। রাত থাকতেই বলতে গেলে আমি উঠি। কিচেনে চায়ের ব্যবস্থা করছিলাম। হোটেলের নুলিয়া আঁড়িয়া এসে খবরটা আমাকে প্রথম দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দেখি।
চিনতে পেরেছিলেন মিঃ সরকারকে?
হ্যাঁ।
তারপর?
হোটেলে ফিরে এসে ব্যাপারটা আমি আমার স্বামীকে জানাই। স্বামী তখনই সমুদ্রতীরে চলে যান।
আর আপনি?
আমি সোজা এ-ঘরে আসি।
কেন?
মনে হল ঘরটা দেখা দরকার, তাই।
এসে কি দেখলেন। ঘরের দরজা খোলা ছিল?
হ্যাঁ। তবে শিকল ভোলা ছিল দরজার বাইরে থেকে।
অর্থাৎ তালা দেওয়া ছিল না?
না।
আপনি ঘরে ঢুকেছিলেন?
ঢুকেছিলাম।
কিছু উল্লেখযোগ্য আপনার নজরে পড়েছিল তখন এই ঘরে?
না। তাছাড়া মনের অবস্থা তখন আমার চঞ্চল। তাড়াতাড়ি কোনমতে ঘরে তালাটা লাগিয়ে নীচে চলে যাই।
তালার চাবিটা বুঝি উপরে আসবার সময় সঙ্গেই এনেছিলেন?
অ্যাঁ, কি বললেন?
বলছিলাম, তালার চাবিটা–
হ্যাঁ, সঙ্গেই এনেছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা মিসেস বিশ্বাস, কতদিনের জন্য সরকার এই ঘর দুটো আপনার নিয়েছিল? কিরীটীই প্রশ্ন করতে থাকে পূর্ববৎ।
দিন পনেরোর জন্য।
আর একটা কথা, সরকারের কাছে এ কদিন ভিজিটার্স কেউ এসেছে জানেন?
কই, না তো!
কেউ আসেনি?
না। অন্ততঃ এলেও আমার নজরে পড়েনি। আমি জানতেও পারিনি। তাছাড়া আসবে কি, লোকজন উনি বড় পছন্দই করতেন না-ঘরকুনো ধরনের লোকটি ছিলেন বলে মনে হয়।
আচ্ছা একজন বেশ সুন্দর ফর্সামত লোক—কটা চুল, কটা চোখ, ঝলঝলে সুট পরনে—এমন একটা লোককে সরকারের কাছে আসতে দেখেছেন কি?
না। তাছাড়া মিঃ সরকার তো প্র্যাক্টিক্যালি তার ঘর থেকে বেরুতেন না, একমাত্র ঘণ্টাদেড়েক-দুয়েকের জন্য সন্ধ্যার মুখে ছাড়া–
এই ঘরেই বুঝি সব সময় থাকতেন?
হ্যাঁ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা আর টিন টিন সিগারেট—এমন কি ডাইনিং হলেও এই কদিনে একবারও যাননি-খাবার এই ঘরেই পাঠিয়ে দিতাম আমরা।
আচ্ছা, আপনার স্বামীকে একবার উপরে পাঠিয়ে দেবেন গিয়ে?
দিচ্ছি।
মিসেস বিশ্বাস ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী ঘরের চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে এবং তাকাতে তাকাতে হঠাৎ ইজিচেয়ারটার সামনে গিয়ে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে তার আঙুলের সাহায্যে কি যেন তোয়ালের উপর থেকে খুঁটে তুলে নিল।
কি রে? শুধালাম।
একটা চুল।
চুল!
হ্যাঁ। দেখতে বেশ লম্বা কোঁকড়া। কোন পুরুষের নয়-নারীর মাথার কেশ—
নারীর–
আমার মুখের কথা শেষ হয় না, খোলা দরজা-পথে এক সুবেশা নারী ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে কথা বলতে বলতে এবং পশ্চাতে হরডন বিশ্বাস।
কি বলছেন ম্যানেজার আপনি পাগলের মত! কালী সরকার মারা গিয়েছে—অথচ কালও বিকেলের দিকে ট্রেনে চাপবার আগে তার সঙ্গে ফোনে কলকাতা থেকে এই হোটেলে কথা–
আগন্তুক ভদ্রমহিলার বোধ হয় এতক্ষণে আমাদের প্রতি নজর পড়ে। থেমে যায় সে। ভু কুঞ্চিত করে আমাদের দিকে তাকায় চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে। সরু ফ্রেমের সোনার চশমা চোখে।
আগন্তুক মহিলার বয়স চৌত্রিশ-পয়ত্রিশের নীচে কোনমতেই নয়। চেহারাটা সুশ্রী এবং সযত্ন-প্রসাধনও চোখে স্পষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও বয়সকে লুকোতে পারেনি মহিলা। কপালে বয়সের ছাপ পড়েছে। চোখে লাগে।
কিন্তু আশ্চর্য, চুল একেবারে মাথার কালো কুচকুচে-একটু যেন অস্বাভাবিক রকমেরই কালো। পরনে দামী শাড়ি, ক্রেপ সিল্কের রাউজ। হাতে সাদা ব্যাগ।
মিঃ মহান্তি-হরডন বিশ্বাসই বলে, ইনি লতিকা গুঁই-কালী সরকারের কাছে এসেছেন। বলছেন উনি নাকি তাঁর বিশেষ পরিচিতা!
কিন্তু এরা কারা? লতিকা গুঁই-ই প্রশ্ন করল।
থানা অফিসার মিঃ মহাডিআর উনি মিঃ কিরীটী রায়।
তাহলে ব্যাপারটা সত্যি? যেন স্বগতোক্তির মতই বলে অতঃপর লতিকা গুঁই।
খা। জবাব দিল মহান্তি, কিন্তু আপনি কোথা থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে।
আজই?
হ্যাঁ-আজই।
কলকাতার ট্রেন কি আজ লেট?
না, ঠিক টাইমেই এসেছে।
তবে আপনার আসতে–
আমি অন্য হোটলে উঠেছি। কথা ছিল কাল আমাকে স্টেশনে রিসিভ করে আনতে যাবে। কিন্তু সেখানে তাকে না দেখে সোজা হোটেলে যাই। সেখান থেকে এই আসছি।
আপনার সঙ্গে মিঃ সরকারের অনেক দিনের পরিচয় বুঝি?
হ্যাঁ-বলতে পারেন অনেক বছর।
দীর্ঘদিনের পরিচয় তাহলে আপনাদের?
নিশ্চয়ই।
কালী সরকারের বাড়িতে কে কে আছেন জানেন-কিছু বলতে পারেন?
কে আর থাকবে-ব্যাচিলার।
বিয়ে করেননি?
না-তবে ওর বড় ভাইয়ের এক ছেলে সাধন সরকার ওর কাছে থাকে হাজরা রোডের বাড়িতে–
তারপরই একটু থেমে লতিকা গুঁই বলে, কিন্তু ব্যাপারটা যে এখনও আমার রীতিমত অবিশ্বাস্য-absurd বলেই মনে হচ্ছে মিঃ রায়!
কথাটা লতিকা গুঁই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই শেষ করল।
আচ্ছা মিস্ গুঁই, আপনাকে যদি কয়েকটা প্রশ্ন করি?
কিরীটীর প্রশ্নে লতিকা গুঁই মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, নিশ্চয়ই, করুন না। কি জানতে চান বলুন? আমি জানলে এ ব্যাপারে আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে প্রস্তুত।
আপনি তো বলছিলেন আপনাদের-মানে আপনার সঙ্গে মিঃ সরকারের অনেক দিন থেকেই আলাপ–
হ্যাঁ।
কতদিনের আলাপ?
তা বছর দশ-পনেরো তো হবেই।
মিঃ সরকার কেন আজ পর্যন্ত বিয়ে করেননি কিছু বলতে পারেন?
না।
কোন ভালবাসার ব্যাপার?
মনে তো হয় না।
কেন? তিনি কি ভালবাসতে জানতেন না?
তা জানবে না কেন—তবে সে ভালবাসাটা তার ছিল একমাত্র অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি।
আচ্ছা পুরীতে এর আগে কখনো তিনি এসেছেন বলে আপনি কিছু জানেন?
জানি না।
০৬. কিরীটী আবার জিজ্ঞাসা করে
কিরীটী আবার জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলছিলেন না, আপনার সঙ্গে গতকাল বিকেলে কালীসরকারের ফোনে কথাবার্তা হয়েছিল?
হ্যাঁ, বললাম তো—
তার সঙ্গে আপনার কি কথা হয়েছিল লতিকা দেবী?
সঙ্গে সঙ্গে লতিকা গুঁইয়ের ভ্রূ দুটো কুঁচকে ওঠে, সে বলে, কেন বলুন তো? আপনার তা দিয়ে কি দরকার?
প্রয়োজন আছে বলেই উনি কথাটা জিজ্ঞাসা করছেন মিসেস গুঁই। জবাব দিল এবারে মহান্তিই।
কোন দরকারই থাকতে পারে না ওঁর সেকথায়। তাছাড়া সে আমাদের নিজস্ব প্রাইভেট কথা। সে-সব ওঁকে বলতে যাবই বা কেন, আর উনিই বা কোন যুক্তিতে শুনতে চান? কণ্ঠস্বরে এবং বলবার ভঙ্গিতে লতিকা গুঁইয়ের রীতিমত বিরক্তি।
বেশ বলবেন না। কিন্তু আপনি পুরীতে এসেছেন কেন জানতে পারি কি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
আপনারা কি জন্যে এসেছেন এখানে? সবাই কি জন্যে আসে পুরীতে? আমিও সেইজন্যই। এসেছি। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, এসব প্রশ্ন আমাকে করছেন কেন আপনারা?
জবাব দিলেন এবারে মহান্তিই, প্রশ্নগুলো করার কারণ হচ্ছে কালী সরকারকে কেউ হত্যা করেছে। হি ত্যাজ বিন ব্রটালি মাড়ারড়।
কী-কী বললেন! তাঁকে ব্রুটালি হত্যা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, মিস গুঁই। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বা তিনি আত্মহত্যাও করেননি-হি হ্যাজ বিন মার্ডারড়। মহান্তি আবার বলে আস্তে আস্তে, পরিষ্কার ভাবে।
কিন্তু হোয়াই–কেন তাকে হত্যা করবে কেউ-কেন?
তা জানি না—তবে যা ফ্যাক্টস্ তাই বললাম। মহান্তি আবার বলে, কিন্তু আপনি মিঃ সরকারের সঙ্গে যখন এত পরিচিত, তখন এখানে এসে এই হোটেলে না উঠে অন্য হোটেলে উঠতে গেলেন কেন?
লতিকা মহান্তির ওই প্রশ্নে একবার অদূরে দণ্ডায়মান হরডন বিশ্বাসের দিকে তাকাল, তারপর বললে, এই হোটেলটা আমার একটুও পছন্দ হয় না।
কেন? হোটেলটা নতুন হলেও বেশ সুনাম হয়েছে ইতিমধ্যে!
হোক, বাট আই হেট দ্যাট উওম্যান। আমি ঐ স্ত্রীলোকটিকে ঘৃণা করি।
কোন্ স্ত্রীলোকটি? কার কথা বলছেন? কাকে ঘৃণা করেন আপনি? কিরীটীই এবারে প্রশ্ন করে।
দ্যাট রেণুকা বিশ্বাস! এই হারাধন বিশ্বাসের স্ত্রীকে।
কেন ভদ্রমহিলা তো—
থামুন। ভদ্রমহিলা! সি ইজ এ ভাইপার।
আপনি তাহলে মিসেস বিশ্বাসকে চেনেন লতিকা দেবী?
চিনি না আবার–হাড়ে হাড়ে চিনি!
কতদিনের জানাশোনা আপনাদের?
তা দিয়ে আপনার প্রয়োজনটা কি শুনি? আমি চললাম। বলেই অতর্কিতে লতিকা গুঁই যেন সমস্ত কিছুর উপরে যবনিকাপাত ঘটিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমরা সবাই ঘরের মধ্যে স্তম্ভিত হতভম্ব।
কিরীটীই প্রথমে কথা বলে, মিঃ মহান্তি, আপনি চট করে নীচে যান, সঙ্গে যে প্লেন ড্রেস কনস্টেবল আছে তাকে বলে আসুন-টু কিপ অ্যান আই—ওঁর উপরে যেন দৃষ্টি রাখে।
মিঃ মহাতি তাড়াতাড়ি নীচে চলে গেল।
কিরীটী এবারে হরডন বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা ওঁকে চেনেন মিঃ বিশ্বাস?
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় হরডন বিশ্বাস।
আপনাদের কতদিনের পরিচয়?
আমার সঙ্গে ঠিক পরিচয় নেই মিঃ রায়, পরিচয় আমার স্ত্রীর সঙ্গে-মানে যে স্কুলে লতিকা টিচারি করে সেই স্কুলেই আমার স্ত্রী রেণুকা একসময় বছরখানেক চাকরি করেছিল। সেই সময় ওদের পরস্পরের পরিচয়।
লতিকা দেবী তাহলে একজন স্কুল-টিচার?
হ্যাঁ।
কোন স্কুলের?
জগমোহিনী সরকার গার্লস হাই স্কুল, বৌবাজারে।
স্কুলটার সঙ্গে কি কালী সরকারের কোন সম্পর্ক—
স্কুলটা তো ওঁর মার নামেই ছিল, আর কালী সরকার তো সেই স্কুলের সেক্রেটারি।
আই সি! তাহলে দেখছি আপনি ও আপনার স্ত্রী কালী সরকারকে বেশ ভাল ভাবেই চিনতেন?
হ্যাঁ–মানে—
কিন্তু আপনার স্ত্রী—কিরীটী ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, বলছিলেন আপনারা নাকি কালী সরকারকে আদৌ জানতেন না।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় হরডন বিশ্বাস, ঠিক, ঠিক বলেছে তো রেণুকা—ঠিকই বলেছে–
ঠিকই বলেছেন?
হ্যাঁ-মানে এখানেই তো এবারে পরিচয় আমাদের সঙ্গে ওঁর—
তাই যদি হবে তো তার জীবনের অত কথা জানলেন কি করে আপনি?
বুঝলেন না—ভদ্রলোক খুব মিশুঁকে ছিলেন তো! দুজনে আমাদের সন্ধ্যার পর খুব গল্প হত। গল্পে-গল্পেই সব বলতেন—বলেছেনও–
মিঃ বিশ্বাস!
বলুন?
আমি যদি বলি আপনি সত্যকে গোপন করবার চেষ্টা করছেন?
না, না—সে কি, তা কেন—তা কেন–
হ্যাঁ, আপনি বলছেন আপনি ও মিঃ সরকার প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় গল্প করতেন অথচ আপনার স্ত্রী বলে গেলেন—তিনি কারও সঙ্গে বড় একটা মিশতেনই না। তাছাড়া মাত্র কদিন তো এসেছিলেন তিনি, এর মধ্যেই এত ঘনিষ্ঠতা আপনাদের হওয়াটাও কি একটু অস্বাভাবিক নয় যে তার জীবনের গোপন কথা পর্যন্ত আপনাকে বলে ফেলবেন!
না, মানে—
থাক, বুঝতে পেরেছি। আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। কিরীটী বাধা দেয়।
হরডন বিশ্বাস যেন একটু ব্রিত হয়েই অতঃপর চুপ করে থাকে।
কিরীটী একটু থেমে আবার প্রশ্ন শুরু করে পূর্বের মত হরডন বিশ্বাসকে, আচ্ছা মিঃ বিশ্বাস, আপনি যে বললেন আপনার স্ত্রী জগমোহিনী স্কুলের টিচার ছিলেন, সেটা কবে-কতদিন আগে?
আমাদের বিয়ের আগে।
বিয়ের আগে—মানে কতদিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে?
বছর তিনেকের কিছু বেশী, মাস দু-তিন হবে।
মাত্র!
হ্যাঁ।
I see-যাকগে সে-কথা। আপনাকে আমি ডেকে ছিলাম একটা কথা জানতে মিঃ বিশ্বাস–
বলুন?
আচ্ছা একজন বেশ সুন্দরমত লোক-ফর্সা রঙ, কটা চুল, কটা চোখ, ঝলঝলে একটা স্যুট পরনে—কোন সময়ে কালী সরকারের কাছে আসতে দেখেছেন কি?
না।
মনে করে দেখুন!
না। কালী সরকার কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। বেরুতেন না, সন্ধ্যায় ঘণ্টা দেড়েক দুয়েকের জন্য ছাড়া।
বেশ, কালী সরকারের কাছে না হোক আপনার হোটেলে বর্তমানে যে রকম description একটু আগে দিলাম সেরকম কোন বোর্ডার আছেন বা কেউ–
না, না-কই, সেরকম তত বোর্ডার নেই বর্তমানে আমার হোটেলে—
এবারে একটু যেন সংযত হয়েই কথাগুলো ধীরে ধীরে থেমে উচ্চারণ করে হরডন বিশ্বাস।
আপনি ঐ ধরনের দেখতে কোন লোককে-হোটেলে না হোক পুরী শহরে তো বাজারহাট, এদিক-ওদিক যাতায়াত করেন-আপনার চোখে পড়েছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
কই না! মাথা নাড়ে হরড়ন বিশ্বাস।
হুঁ। আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন।
যাব?
হ্যাঁ, যান।
হরডন বিশ্বাস চলে যাবার জন্য দরজা-পথে ঘরের বাইরে গিয়েও সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে আসে। মনে হল সে যেন কি বলতে চায়।
কি হল? কিছু বলবেন? কিরীটীই পুনরায় প্রশ্ন করে।
না—মানে বলছিলাম কি—
বলুন-থামলেন কেন?
আপনাদের এভাবে হোটেলে আসায়, মনে হচ্ছিল যখন এ ঘরে আসি, হোটেলের অন্যান্য বোর্ভারদের মনে হয় কিছুটা সন্দেহ-ভয় দেখা দিয়েছে–
তা একটু তো হবেই, মিঃ বিশ্বাস। তবে পুলিসের দিক থেকে বেশী হৈ-চৈ করা হবে, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিরীটী আশ্বাস দেয়।
কিন্তু কি বিশ্রী ব্যাপার হল বলুন তো! মাত্র হোটেল এক বছর হল—এত খরচাপত্র করে করলাম–
ভাল কথা মিঃ বিশ্বাস, এই হোটেল খোলবার আগে আপনি কি কাজ করতেন?
ব্যবসা করতাম।
কিসের ব্যবসা?
ফুলের!
ফুলের ব্যবসা?
হ্যাঁ, একটা ফুলের স্টল ও নার্সারী ছিল আমার।
কোথায়?
স্টলটা ছিল নিউ মার্কেটে-নার্সারী বেহালায়।
সে ব্যবসা কতদিন করেছেন?
তা ধরুন বছর পাঁচেক হবেই। সে ব্যবসা করেছিলাম—আসলে ব্যবসাটা ছিল আমাকে যে পাদ্রী মানুষ করেন তারই। তার মৃত্যুর সময় ব্যবসাটা তিনি আমাকেই দিয়ে যান।
ব্যবসাটা লাভের ছিল নিশ্চয়ই?
তা ছিল।
তা সে লাভবান ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ এই পুরী শহরে এসে হোটেল খুললেন কেন? ইতিমধ্যে মহান্তি ঘরে ফিরে এসেছিল, প্রশ্নটা সেই-ই করল।
আমার স্ত্রীর অনেকদিন থেকে একটা হোটেল খোলবার ইচ্ছা ছিল তাই। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন গোপালপুর-অন-সীতে একটা ইউরোপিয়ান হোটেলে সুপারভাইজারের কাজ করেছিল। তাই ধারণা হয়, ভাল কোন জায়গায় সমুদ্রের ধারে বা পাহাড়ে ভাল করে একটা হোটেল খুলতে পারলে প্রচুর আয় হতে পারে।
তাই এই হোটেল?
হ্যাঁ। সেই ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে এই হোটেল করেছি আমরা।
হোটেলের এই বাড়ী আপনাদের?
হ্যাঁ। একটা ছোট বাড়ি ছিল-বাড়ি সমেত জায়গাটা কিনে নিয়ে এক্সটেনশন করিয়ে নিয়েছি।
বেশ খরচা পড়েছে নিশ্চয়ই?
তা পড়েছে। কিন্তু ওসব খবর আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ মহান্তি। আমার স্ত্রীই সব কিছু করেছে—সেই-ই সব জানে-বলতে পারবে।
০৭. সী-সাইড হোটেল
অতঃপর তখনকার মত আমরা বের হয়ে এলাম সী-সাইড হোটেল থেকে। মহান্তির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সারতে সারতে বেলা প্রায় দেড়টা হয়ে গেল।
আহারাদির পর গোবিন্দলালবাবুর একটা শারদীয়া রহস্য পত্রিকা নিয়ে শয্যায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম।
পুরী ভিউ হোটেলের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, একেবারে যেন পা বাড়ালেই সমুদ্র। মুহূর্তে মনটা ভরে ওঠে চোখ মেললেই। সামনের দিকে জানালাটা খুলে দিলাম। দুপুরের রৌদ্রে মরকতমণির মত জ্বলছে যেন সমুদ্র।
কী গাঢ় নীল। নীল সমুদ্রের প্রান্তে যেন নীল আকাশ অবগাহন করছে। সেই নীলের বুকে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের ভাঙা আর গড়া। শীর্যে শীর্ষে তার শ্বেতশুভ্র যুইয়ের মত ফেনার মুঠো মুঠো অঞ্জলি। আর একটানা শব্দ-গোঁ-গোঁ-গোঁ। বইটা আর পড়া হল না-বুকের উপর পড়ে রইল। সামনে চোখ মেলে অলস শয্যায় পড়ে রইলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে ওঠে কালীপ্রসাদ সরকারের প্রাণহীন দেহটা। মানুষটা কালও বেঁচে ছিল—আজ আর নেই! সমস্ত কিছুর উপরে অকস্মাৎ যেন একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছে মৃত্যু।
সত্যিই কি লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? তাকে নিষ্ঠুরভাবে কোন কিছুর সাহায্যে শ্বাসরোধ করে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে?
কিরীটীর ধারণা যখন তাই-নিঃসন্দেহে তাই ঘটেছে।
কিন্তু কেন? কে মারল–হত্যা করল অমন নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মানুষটাকে? বিয়েথা করেনি-ব্যাচিলার-নির্বাট মানুষটাপৃথিবীতে কেউই কি অজাতশত্রুর নয়? শত্রু সবারই আছে? কিংবা কোন পরশ্রীকাতর লোক হিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে হত্যা করেছে? কিংবা শত্রুতাও নয়, হিংসাও নয়, কুটিল কোন স্বার্থের জন্য অমন নৃশংস কাজ করেছে কেউ?
কিন্তু কে? কে করল?
হরডন বিশ্বাস—তার স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাস রামানুজ-তস্য শ্যালক—কিংবা ঐ স্কুলমিসট্রেস শ্রীমতী লতিকা গুঁই। আপাততঃ তো চোখের সামনে এই পাঁচজনকেই দেখা যাচ্ছে। তিনটি পুরুষ ও দুটি নারী।
যে কেউই কালী সরকারকে হত্যা করতে পারে। হঠাৎ মনে পড়ল আর একজন ক্ষণিক দেখা দিয়ে যে নেপথ্যচারী হয়েছে, সেই কশ্চিৎ মুক্তাব্যবসায়ী কালী সরকারের বিশেষ পরিচিত দোলগোবিন্দ শিকদার।
তাহলে হল চারটি পুরুষ-দুটি নারী। এই ছজনের মধ্যেই কি একজন হত্যাকারী? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন একসময় দু-চোখ ভরে তন্দ্রা এসেছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-ঘুম ভাঙল প্রায় তিনটে নাগাদ-ভৃত্যের ডাকে।
সে চা এনেছে।
কিরীটী ঘরে নেই। চেয়ে দেখি দরজা-পথে বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় গা ঢেলে দিয়ে দূর সাগরের দিকে চেয়ে আছে। সত্যি, সামনের ঐ সাগর এমনি একটি বিস্ময়, এমনি অখণ্ড আনন্দ যে তার যেন শেষ নেই—কোন একঘেয়েমির ক্লান্তি নেই।
বাইরে এসে বসলাম কিরীটীর পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।
অপরাহের রৌদ্রালোকে ঝলমল করছে যেন নীল সমুদ্রের। অবিশ্রাম ঢেউ একটার পর একটা আসছে, যাচ্ছে-ভাঙছে, গড়ছে, ভাঙছে।
অবিশ্রাম একটানা গর্জন।
কিরীটীই প্রথমে কথা বলে, একটা কথা ভাবছিলাম সুব্রত—
কি?
কালী সরকারের সঙ্গে লতিকার একটা ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল ঠিকই-সেই সঙ্গে বোধ হয় রেণুকারও ছিল।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। কিরীটী দূর সাগরের দিকেই চেয়ে আছে। বললাম, লতিকা গুঁইকে তোর কি রকম মনে হয়?
ওখানে একটা জট পাকানো আছে বলেই আমার মনে হয় সুব্রত।
কেন, লতিকার সঙ্গে রেণুকার একটা রেষারেষির ভাব আছে এবং ওদের মাঝখানে কালী সরকার ছিল বলে কি?
ঠিক তাই। দুটি নারী এবং দুটি নারীই বিশেষ আকর্ষণীয়া। যৌবনবতী বল বা না বল, ব্যাচিলার একজন পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়।
তার মানে তুই বলতে চাস—
কিরীটী বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, বলতে চাই একা রামে রক্ষা নাই তায় সুগ্রীব দোসর! একা রেণুকা বিশ্বাসেই রক্ষা নেই, তায় আবার সঙ্গে এসে ভিড়েছে ঐ লতিকা দিদিমণিটি। তারপর একটু থেমে বলে, বুঝলি পুরুষের পক্ষে ব্যাচিলার থাকাটা এমন কিছু নিন্দনীয় নয়, কিন্তু বিশেষ একটা বয়েসে সে পুরুষ বাঘের মত হয়ে ওঠে যদি তার সামনে পড়ে লতিকা বা রেণুকার মত পুরুষ-লোভী নারী–
তাই বুঝি?
তাই। আর তাইতেই তো এখনও বলি তোকে, তোর সেই বয়েস এসে যাচ্ছে এবারে–
অতএব?
অতএব আর নয়—
বলছিস!
হ্যাঁ সর্বান্তঃকরণে কায়মনোবাক্যে—
তাহলে চল না হয় কলকাতায় গিয়ে ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলি!
ফুল-চন্দন পড়ুক তোর মুখে, আজই কৃষ্ণাকে জানাব। কিরীটী বলে ওঠে।
তা জানাস, কিন্তু পাত্রী একটা চাই তো?
পাত্রী! পাত্রীর তোর অভাব আছে নাকি?
তোর মতলবখানা কী বল্ তো? আর ইউ থিঙ্কিং অফ দ্যাট লতিকা গুঁই!
তোর বন্ধু, কুন্তলা দেবী তো আজও বাসর-সজ্জা রচনা করে আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে–
আঃ কিরীটী!
কি হল?
মৃদুকণ্ঠে বলি, কিছু না।
কিছুই যদি না তো গলার স্বরটি অমন কেন বন্ধু? কেমন ভেজা—
ঠিক আছে, তুই বকবক কর আমি চললাম।
উঠে পড়লাম আমি। সোজা সমুদ্রতীরে নেমে গেলাম।
.
ভিজে বালুর বুকে অশান্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, তারপর আবার চলে যাচ্ছে।
কেমন করে কিরীটীকে বোঝাই, কুন্তলা আমার স্বপ্নের মধ্যে ধ্যানের মত রয়েছে। সে আমার সমস্ত জীবনসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই তো ভয় করে তাকে স্পর্শ করতে।
সে তো স্পর্শের নয়, সে যে ধ্যানের। সে আমার জীবনের একটি রঙ, একটি সুর, একটি সঙ্গীত। জীবনের দেওয়া-নেওয়া, প্রতিদিনের তুচ্ছতার মধ্যে মলিনতা ও অভিযোগের মধ্যে তাকে কি জড়াতে পারি!
জীবনে ঘর বাঁধবার মধ্যেই কি সব? সেখানে তো জীবন প্রতি মুহূর্তে সংকীর্ণ হয়ে যায়! না না, তার চাইতে এই তো ভাল। কুন্তলা আমার নাগালের মধ্যেই রইল। যখন ইচ্ছা পাব জানি, তাই তাকে তুচ্ছ পাওয়ার মধ্যে জড়ালাম না। সে থাক অধরা হয়ে-অপ্রাপণীয়া হয়ে।
.
মধ্যে মধ্যে এসে অশান্ত ঢেউগুলো ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পায়ের পাতা। আসছে যাচ্ছে ঢেউ নিরবধি, বিরাম নেই।
আবার মনে পড়ে কালী সরকারের কথা। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তার মৃত মুখখানা, আর তার পাশে পাশে ভেসে ওঠে আরও কয়টি মুখ।
হরডন বিশ্বাস, রামানুজ, দোলগোবিন্দ সিকদার, রেণুকা বিশ্বাস ও লতিকা গুঁই।
কে—এদের মধ্যে কে?
ঐ নেপথ্যচারী মুক্তা-ব্যবসায়ীই কি?
আশ্চর্য, কী বিচিত্র মানুষের হত্যালিঙ্গা!
এই দিগন্তবিস্তৃত সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়েও মানুষের মনের মধ্যে দুঃস্বপ্ন নখর বিস্তার করে। গোপন লিপ্সা ক্রূর হিংসার হলাহলে ফেনিয়ে ওঠে।
কেন-কেন এমন হয়! দুদিনের জীবন—কেন মানুষ তাকে সুন্দর করে তোলে না! সমস্ত অভাব-অভিযোগ মলিনতা ও কুশ্রীতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারে না!
গতকাল সন্ধ্যায় এই বালুবেলার উপর বসে বসেই আমাদের কথা হচ্ছিল। সেই কথাগুলোই হঠাৎ মনে হয়। কালী সরকারকে দেখে কী মন্তব্য আমি করেছিলাম, সেই মন্তব্যের কথাটা মনে হয়। যাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল কোল্ড ব্লডে মার্ডার করতে পারে সেই লোকটাই কিনা শেষ পর্যন্ত নিহত হল অন্যের হাতে। এবং একটা রাতও তারপর পোয়াল না, নিষ্ঠুর মর্মান্তিক ভাবে নিহত হল!
কথাটা আনমনেই ভাবতে ভাবতে সমুদ্রতীর ধরে ভিজে নরম বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছিলাম।
হোটেল ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম পশ্চিমের দিকে। এসময়ে সমুদ্রতীর একেবারে নির্জন। কদাচিং কখনও একটা-আধটা মানুষ চোখে পড়ে। স্বর্গদ্বারের পরেই ক্রমশঃ সমুদ্রতীরে বাড়িগুলো কমে আসে।
একটা দুটো বাড়ি অনেক দূরে দূরে এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তাও আর চোখে পড়ছে। বোধ হয় এদিকটায় তেমন লোকালয় নেই। সী-কোষ্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাওয়া যায়! হয়ত মাদ্রাজ পৌঁছনো যায়। হেঁটে গেলে কেমন হয়!
সমুদ্র তো আমার পাশেপাশেই রয়েছে। অপরাহের আলোয় যেন নীল মরকতমণির মত জ্বলছে।
হঠাৎ চমকে উঠলাম।
একেবারে জলের ধার ঘেঁষে কে যেন বালুর উপর বসে আছে। বাতাসে তার আঁচল ও মাথার চুল উড়ছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অপলক বসে আছে এক নারী। কে ঐ নারী।
আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই দ্বিতীয়বার চমকে উঠি : লতিকা গুঁই!
এখানে এই নির্জন সমুদ্রতীরে লতিকা গুঁই!
আরও এগোব কি এগোব না ভাবছি।
লতিকা গুঁইয়ের কিন্তু কোন দিকে নজর নেই। সে যেন নিজ ধ্যানে মগ্ন। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। কোন খেয়াল নেই লতিকা গুঁইয়ের। মধ্যে একআধটা ঢেউ এসে পায়ের কাছে একেবারে পড়ছে। সেদিকেও যেন খেয়াল নেই।
অপরাত্নের আলোয় সেই সমুদ্র-তীরবর্তিনী উপবিস্টা নারীকে মনে হল যেন বড় বিষণ্ণ, বড় ক্লান্ত, বড় একা। হঠাৎ যেন চোখে পড়ল, লতিকার দু চোখের কোণ বেয়ে ক্ষীণ অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে। লতিকা কাঁদছে।
আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ফিরে এলাম। আর অগ্রসর হলাম না।
.
হোটেলে ফিরে দেখি কিরীটী আর এক কাপ চা নিয়ে বসেছে।
আমাকে ফিরতে দেখে বলে, মন শান্ত হল?
আমি কোন কথার জবাব দিই না।
তুই যে কুন্তলার ব্যাপারে এতখানি টাচি সুব্রত, জানতাম না তো! ক্ষমা কর ভাই।
আমি সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বললাম, লতিকা গুঁইকে দেখলাম।
কোথায়? নিস্পৃহ কণ্ঠে শুধায় কিরীটী।
সমুদ্রের ধারে। বসে বসে মনে হল যেন কাঁদছে।
পুওর গার্ল, কিরীটী বলে, শিক্ষকতা করতে করতেই জীবনটা গেল।
আমাদের কথা শেষ হয় না, দেখি একটা সাইকেল-রিকশা থেকে মহান্তি নামছে হোটেলের সামনে।
মিঃ মহান্তি যে, কি ব্যাপার?
আপনি আমাকে ট্রাঙ্ক কলটার খোঁজ নিতে বলেছিলেন না? সী-সাইড হোটেলে কাল যে ট্রাঙ্ক কল হয়েছে–
হ্যাঁ। খবর পেলেন কিছু?
পেলাম। দুটো ট্রাঙ্ক কল ছিল। একটা কলকাতা থেকে আর একটা রাউরকেল্লা থেকে। কিন্তু–
কি?
দুটো কলেই পি. পি.পার্টিকুলার পারসন ছিল, কিন্তু তার মধ্যে তো কালী সরকারের নাম নেই!
০৮. কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে
কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, তবে কার নাম আছে?
একটা কল ছিল এইচ. বিশ্বাসের নামে। আর একটা ছিল কোন্ এক গনেন ব্যানাজীর নামে। লোকটা নিউজ-পেপার রিপোর্টার। লতিকা গুঁই যে ট্রাঙ্ক কলে কালী সরকারের সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে বললে, এখন মনে হচ্ছে সেটা মিথ্যা। তাছাড়া
থামলেন কেন বলুন? কিরীটী ওর দিকে তাকিয়ে তাগিদ দেয়।
মনে হচ্ছে লতিকা গুঁই যেন কিছু লুকোচ্ছে।
কি লুকোবে?
আমার যেন মনে হচ্ছে সে অনেক কিছুই হয়ত জানে এ ব্যাপারে।
তা যদি সে লুকিয়েই থাকে তো আমরা ঠিকই জানতে পারব মিঃ মহান্তি। ডোন্ট ওরি। আপনাকে কতকগুলো কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন।
বলুন?
এক নম্বর, কিরীটী বলে, ঐ সী-সাইড হোটেলটা তৈরী করতে মোটামুটি কত টাকা আন্দাজ খরচ হয়েছে এবং কত ট্যাক্স হোটেলের বাড়িটার জন্য দিতে হয়—
আর?
শুনুন দু নম্বর, খরচের টাকার অঙ্কটা তো জানতেই হবে, দ্বিতীয়তঃ কি ভাবে কনট্রাকটারকে সে টাকা payment হয়েছে-by cheque or cash এবং তিন নম্বর
বলুন?
বেহালার নার্সারী ও নিউ মার্কেটের ফুলের স্টল কত টাকায় বিক্রী হয়েছিল এবং কে কিনেছিল?
আর কিছু?
কিরীটী বলতে থাকে, চার নম্বর-জগমোহিনী স্কুলের চাকরি রেণুকা বিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছিল নিজেই, না তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন? পাঁচ নম্বর-রেণুকা ও হরডনের বিয়ের পরে ও আগে কালী সরকারের সঙ্গে ওদের দুজনের কোন যোগাযোগ ছিল কিনা! ছয় নম্বর-কালীর ভাইপো সাধন সরকারকে একটি ইনটিমেশন দিতে হবে–
আর কিছু?
হ্যাঁ, আর একটা কথা, দোলগোবিন্দ সিকদার নামে একটি লোক-লোকটি দেখতে সুন্দর, ফর্সা রঙ, ভাসা-ভাসা বড় বড় চোখ, চোখের তারা কটা এবং মাথার চুলও কটা। ঝলঝলে একটা স্যুট পরনে—আর বাঁ কপালের উপর আধ-ইঞ্চি পরিমাণ একটি জড়ল আছে। এই লোকটির সন্ধান এই পুরী শহরে করতে পারেন কিনা দেখুন।
কিন্তু–
সম্ভবতঃ লোকটা বিদেশী এবং শুনেছি ব্যবসায়ী। পার্ল-মার্চেন্ট অর্থাৎ মুক্তোর ব্যবসায়ী।
মুক্তো-ব্যবসায়ী!
হ্যাঁ। স্টেশনে একজন পুলিস নিযুক্ত করুন নজর রাখার জন্য।
যদি অলরেডি চলে গিয়ে থাকে পুরী ছেড়ে?
তাহলে আর কি করবেন!
খোঁজ করব কোথায় লোকটার?
আগে হোটেল ও ধর্মশালাগুলোতে করুন, তারপর শহরে করুন।
কিন্তু লোকটা কে?
বললাম তো মুক্তোর ব্যবসায়ী।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু এই মামলার সঙ্গে–
কালী সরকারের সঙ্গে লোকটার পরিচয় ছিল, আর গতকাল সন্ধ্যায় সী-বীচে লোকটাকে কালী সরকারের সঙ্গে আমরা দেখেছি।
তা না হয় খুঁজে দেখব, তবে আমার কিন্তু ধারণা—
কি ধারণা আপনার?
ঐ হোটেলওয়ালী রেণুকা বিশ্বাস স্ত্রীলোকটি আদৌ সুবিধার নয়।
কিন্তু তাতে করে আপনি কি খুব একটা এগুতে পারবেন মিঃ মহান্তি এই হত্যার ব্যাপারে?
মানে?
যদি আমাদের অনুমান সত্যিই হয় যে, তাকে স্ট্যাঙ্গেল করে অর্থাৎ গলা টিপে হত্যা করে পরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে আত্মহত্যা প্রমাণ করবার জন্য, সেক্ষেত্রে রেণুকা। বিশ্বাসের মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে কি–
অর্থাৎ আপনি বলতে চান সম্ভব কিনা? আপনি ঐ মেয়েমানুষটিকে চেনেন না, আমি কিছু কিছু জানি।
জানেন?
হ্যাঁ। এখানে জমি হোটেল ও লাইসেন্সের ব্যাপারে ওই স্ত্রীলোকটি মধ্যে মধ্যে আমার কাছে যেত। সেই সময় কথায় কথায় ওর অনেক পরিচয়ই আমি জানতে পারি।
কি জেনেছেন বলুন না!
সেদিন আপনাকে ঐ স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে সব কথা বলিনি কিন্তু আজ বলছি শুনুন–বিয়ের আগে রেণুকা ছিল দাশরেণুকা দাশ নামেই অন্ততঃ পরিচয় ছিল, যদিচ ওর জন্ম মিশ্র রক্তে–
কি রকম?
ওর বাপ ডাঃ আর্থার মূর ছিল সাঁওতাল পরগণার এক মিশনারী হাসপাতালের ডাক্তার। জাতে স্কচ।
কার কাছে শুনলেন একথা?
ও নিজেই বলেছে।
কে, রেণুকা?
হ্যাঁ। কথায় কথায় একদিন ও আমাকে বলেছিল ওর জীবনটা নাকি বড়ই বিচিত্র। ছোটবেলায় ছিল প্রচণ্ড দস্যি মেয়ে। দৌড়, লাফ-ঝাপ, কুস্তি, ছোরা খেলা, লাঠি খেলা, বন্দুক ছোঁড়া–
বলেন কি!
হ্যাঁ। সব তার পালক বাপের উৎসাহে। আসলে ঐ মিশনারী ডাক্তারের ঔরসে রেণুকার জন্ম হলেও লোকে জানত ওর আড়াই বছর বয়সের সময় মা মরে যাওয়ায় ঐ মিশনারী ডাক্তারই তাকে অনুগ্রহ করে পালন করেছে। যা হোক যা বলছিলাম, গায়েও বেশ শক্তি ধরত। ডাক্তার বাপ অবিশ্যি ওকে যে কেবল খেলাধূলা, দৌড়ঝাপেই উৎসাহ দিয়েছে তাই। নয়—লেখাপড়াও কিছু কিছু শিখিয়েছিল। কিন্তু লেখাপড়ায় ওর তেমন মন ছিল না।
তারপর?
পনের কি ষোল বছর বয়স যখন, এক সার্কাস পার্টির সঙ্গে ও পালিয়ে যায়। চার বছর ছিল সেই দলে। নানা ধরনের দৈহিক কসরত দেখাত। তারপর একদিন সার্কাস পার্টির ম্যানেজারকে ছুরি মেরে–
বলেন কি! এ যে রীতিমত এক উপন্যাস! তারপর?
সুব্রতই কথাটা বলে।
হ্যাঁ, ব্রতবাবু। মহান্তি বলতে থাকে, ম্যানেজার রাত্রে ওর তাঁবুতে এসেছিল। ও ছুরি মেরে পালায় সেখান থেকে। ও ফিরে আসে আবার মিশনারী বাপের কাছে। ক্রমে ম্যাট্রিক ও আই-এ পাস করে। ট্রেনে একদিন কলকাতায় যেতে যেতে টি. টি. হারাধন বিশ্বাসের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ঐ সময় ঐ মিশনারী ডাক্তার মারা যান এবং হারাধনের প্রচেষ্টাতেই জগমোহন গার্লস স্কুলে ও চাকরি পায়।
তারপর?
কিন্তু সেখানে ও এক বছরের বেশী চাকরি করতে পারে না।
কেন?
হোস্টেলে থাকত ও–মানে ঐ স্কুলেরই হোস্টেলে। সেখানে কি একটা চুরির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজে থেকেই ও চাকরি ছেড়ে দেয়।
সুব্রত বলে ওঠে, এ যে সত্যিই এক উপন্যাস দেখছি! মিশ্ররক্তে-জম্ম—একটি মেয়ে –কিছুদিন সার্কাসে—সেখান থেকে ম্যানেজারকে ছুরি মেরে পালালো-তারপর পড়াশুনা ও হোস্টেল-সেখানেও চুরি–theft–
সত্যিই উপন্যাস সুব্রতবাবু, মোহান্তি বলে—কিন্তু ঐ পর্যন্ত এসেই ওর জীবনের কিছুটা অংশ কেমন যেন ধোঁয়াটে–
মানে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ঐখানে বছর দুয়েকের কথা এলোমেলো ভাবে চলেছে। কেবল একটি কথা স্পষ্ট
কী?
ঐ সময় ও হারাধন বিশ্বাসকে বিয়ে করে। হারাধন তখন তার পালক পিতার মৃত্যুতে বেহুলার নার্সারী ও ফুলের স্টলটা পেয়ে সে দুটো নিয়ে মেতে আছে। তারপর ওদের বিয়ের পর কি হল-হঠাৎ ও চলে এল।
কে চলে এল? রেণুকা বিশ্বাস?
হ্যাঁ। চলে এল কলকাতা থেকে গোপালপুর-অন-সীর এক হোটেলে, চাকরি নিয়ে।
তারপর?
তারপর এক বছর পরে এই পুরী শহরে আবির্ভাব ও এই হোটলের পত্তন-হারাধনের স্টল ও নার্সারী বিক্রি–
একটা কথা মিঃ মহান্তি! কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলুন?
আচ্ছা ওর ঐ ভাইটি—
ঐ রামানুজ দাশের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে কি জানেন?
বিশেষ কিছুই জানি না। ওর সঙ্গে আজকেই তো হেটেলে প্রথম পরিচয় হল বলতে গেলে।
রেণুকা বিশ্বাসের মুখে ওর ভাই সম্পর্কে কিছু শোনেন নি?
না।
কিছু বলেনি সে?
না। তা না-ই বা জানা থাকল, কি জানতে চান ঐ রামানুজ সম্পর্কে বলুন? সব জেনে নেব।
বিশেষ কিছু না, এই হোটেলে ও কতদিন আছে, এর আগে কোথায় ছিল, কি করত।
ও আর এমন কি শক্ত, বলেন তো এখুনি ওকে এখানে ডেকে যা জানবার আমরা জেনে নিতে পারি মিঃ রায়।
না মহান্তি সাহেব, তাড়াহুড়ো নয়, ধীরেসুস্থে জানুন। ও যেন না কোনক্রমে আপনাকে সন্দেহ করতে পারে!
তবে কি মিঃ রায়, ঐ রামানুজকেই আপনি–
সন্দেহের কথা যদি বলেন মহান্তি সাহেব, অত্যন্ত সন্দিগ্ধ মন আমার-হরডন বিশ্বাস, রেণুকা বিশ্বাস, রামানুজ দাশ সকলকেই আমি—এমন কি কালী সরকারের দুপাশের ঘরে যে বোর্ডার দুজন আছে, রামগতি কানুনগো ও সুধাপ্রিয় মল্লিক তাদেরও–
কিরীটীর কথা শুনে বিস্ময়ে মহান্তি মস্ত বড় এক হাঁ করে।
একেবারে বন্ধ, কোন রা নেই। অনেকক্ষণ পরে ঢোক গিলে বলে, তবে—
কি তবে? নিশ্চয়ই। সকলকার উপরেই আপনার নজর রাখতে হবে-যাদের যাদের নাম এইমাত্র আমি করলাম। তারপর একুট থেমে কিরীটী বলে, মিঃ মহান্তি, এই দেখুন সী-সাইড হোটেলের কালী সরকার দুটো ঘর নিয়ে থাকত সেই ঘরের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে মোটামুটি একটা প্ল্যান আমি খাড়া করেছি। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে।

দেখলাম কাগজটায় একটা নকশা আঁকা আছে।
কিরীটী বলে, সাত ও আট নম্বর ঘর নিয়ে ছিল কালী সরকার। ছয় নম্বর ঘরে ছিল রামগতি কানুনগো, নয় নম্বর ঘরে সুধাপ্রিয় মল্লিক আর তের নম্বর ঘরে থাকেন আমাদের রামানুজ দাশ মশাই।
একটু থেমে আবার কিরীটী বলে, রামগতি কানুনগো আর সুধাপ্রিয় মল্লিক-রামানুজের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরও সম্পর্কে যতটা জানা যায় জানতে চেষ্টা করুন, এবং এই যাদের নাম করলুম ইনকুডিং আমাদের লতিকা গুঁই—আপাততঃ এই কয়জনের প্রত্যেকের উপর নজর রাখবেন এবং ওঁদের জানিয়ে দেবেন বিনানুমতিতে কেউ ওঁরা শহর ছেড়ে বাইরে যেতে পারবেন না।
বেশ, তাই হবে।
অতঃপর মহান্তি বিদায় নিল।
কিরীটী আর এক দফা চায়ের অর্ডার দিল।
চা-পানের পর বললে, চল, সমুদ্রের ধারে গিয়ে খানিকটা ঘোরা যাক। কালী সরকার। সকাল থেকে স্কন্ধারূঢ় হয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। একেই বলে বরাত-বুঝলি সুব্রত! এলাম পুরীর সমুদ্রকে উপভোগ করতে কটা দিন, তা না, পঁচিশ বছর বাদে এক কালী সরকার : এসে আবির্ভূত!
কেন, তুই তো বলিস টেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে!
যা বলেছিস। নে চল।
কিছুক্ষণ অনির্দিষ্ট ভাবে ভিজে বালুর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় ক্লান্ত হয়ে আমরা বালুবেলার উপরেই বসে পড়ি।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সমুদ্রতীর ঘেঁষে হোটেলগুলোতে সর আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তার আলো কিন্তু জ্বলেনি!
অন্ধকার সমুদ্রতীরে বহু লোক-আবছায়া ঘেরাফেরা করছে।
কিরীটী একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলে, লোকটা শুধু ম্যাথমেটিকসই জানত না, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসেবটাও বুঝত।
হঠাৎ কার কথা বলছিস?
কালী সরকার, আবার কে? তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার কালী সরকার সম্পর্কে জানতে পেরেছি–
কি?
লোকটা স্টেকে ব্রীজ খেলত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। চারজন কালী সরকারের ঘরে বসে খেলত।
কে কে?
মনে হচ্ছে কালী সরকার, হরডন বিশ্বাস ও শ্রীমতী বিশ্বাস তিনজন। বাকি চতুর্থজন যে কে বুঝতে পারছি না।!
রামানুজ নয় তো?
না।
তবে হয়ত হোটেলের বর্তমান বোর্ডারদের মধ্যেই কেউ!
তাই হবে। বলতে বলতে কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অন্ধকারে ওর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু মুখটা ভাল দেখা গেল না। বুঝলাম কালী সরকারের মৃত্যু-ব্যাপারে-একমাত্র তাকে কেউ হত্যা করেছে, এ ছাড়া আর বিশেষ এখনও রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারেনি। অন্ধকারেই এখনও ঘুরছে।
বললাম, হ্যাঁ রে, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসাবের কথা কি বলছিলি?
হ্যাঁ, একটা লেনদেনের ব্যাপার—
কার সঙ্গে কার?
কালী সরকারের সঙ্গে কারও বলেই মনে হয়!
তোর কি মনে হয়?
আপাততঃ চায়ের পিপাসা পেয়েছে-ওঠ চল্।
অগত্যা উঠতে হল।
০৯. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
পরের দিনই দ্বিপ্রহরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেল।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। শ্বাস-বন্ধ করেই কালী সরকারের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে-জলে ড়ুবে তার মৃত্যু হয়নি।
রিপোর্টটা নিয়ে এসেছিল মহান্তিই।
সে বলে, শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে সত্যিই কিন্তু একটু সন্দেহ ছিল মিঃ রায়। হয়ত স্ট্যাঙ্গুলেশান নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি আপনার অনুমানটা একেবারে নির্ভুল। এবং আরও একটা সংবাদ আছে মিঃ রায়
কী? কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
লতিকা গুঁই নিরুদ্দেশ হয়েছে।
আমি বলি, সে কি! কোথায় গেল জানতে পারলেন না কিছু?
না। আজ সকাল থেকে তার কোন পাত্তা নেই। কাল রাত্রেও এগারটার সময় হোটেলের চাকর তাকে তার ঘরে দেখেছিল। আজ সকালে আর তাকে নাকি দেখা যায়নি। সুটকেস আর বিছানাটা ঘরের মধ্যে আছে এবং ঘরের বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
কিরীটী এবারে কথা বলে, রাত এগারটা পর্যন্ত তাহলে সে হোটেলে ছিল?
হ্যাঁ। রাত দশটার সময় নাকি রেণুকা বিশ্বাস তার সঙ্গে দেখা করতে যায় ঐ হোটেলে।
কে কে গিয়েছিল দেখা করতে? কিরীটী উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
রেণুকা বিশ্বাস।
হুঁ। তাহলে রেণুকা বিশ্বাস নিশ্চয় জানে লতিকা গুঁই কোথায়। চলুন, এখনি একবার সী-সাইড হোটেলে যাব।
এখুনি যাবেন?
আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল। খবরটা আপনি কখন জানতে পারেন যে লতিকা গুঁই চলে গিয়েছে?
সকালেই। যে লোকটা হোটেলের সামনে প্রহরায় ছিল তার কাছে।
রাত্রে সেই হোটেলের সামনে কেউ প্রহরায় ছিল না। ছিল।
কিন্তু সে বলছে একমাত্র রেণুকা বিশ্বাস ছাড়া রাত দশটার পর কাউকে হোটেলে যেতে বা আসতে দেখেনি।
হোটেল থেকে বেরুবার অন্য কোন রাস্তা নেই?
আছে। পিছনের দিকে মেথরদের যাতায়াতের রাস্তা।
তাহলে সেই রাস্তা দিয়েই সে সরে পড়েছে।
আপনার কোনো রকম কিছু সন্দেহ হয় মিঃ রায়?
সী-সাইড হোটেলের দিকে যেতে যেতে মহান্তি কিরীটীকে প্রশ্নটা করে। কিরীটী চলতে চলতেই বলে, কি সন্দেহ?
ঐ লতিকা গুঁই কালী সরকারের হত্যার ব্যাপারে
সন্দেহের তালিকার মধ্যে লতিকা গুঁই তো অন্যতমা, কথাটা ভুলে যাচ্ছেন কেন মিঃ মহান্তি?
.
হরডন বিশ্বাস হোটেলে ছিল না, বাজারে গিয়েছিল।
তবে রেণুকা বিশ্বাস ছিল।
সে তার ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে বসে কাঁটা দিয়ে লেসের মত কি একটা বুনছিল আর তার পাশে বসেছিল ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসরের একটি সুশ্রী যুবক।
মহান্তিই দরজার বাইরে থেকে গলার সাড়া দেয়, ভিতরে আসতে পারি? কে?
আমি মহান্তি।
কে?
আসুন।
আমরা ভিতরে ঢুকতেই যুবকটি উঠে দাঁড়ায়।
এই ছেলেটি কে মিসেস বিশ্বাস? মহান্তিই প্রশ্ন করে।
রেণুকা বিশ্বাস বলে, সাধন সরকার। কালী সরকারের ভাইপো। আমাদের টেলিফোন পেয়ে আজই সকালের এক্সপ্রেসে এসেছে। তুমি যাও সাধন, তোমার ঘরে যাও।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সাধনবাবু, হোটেলের বাইরে যাবেন না কিন্তু আপনি, ঘরেই থাকবেন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। আমরা আপনার ঘরে আসছি একটু পরেই।
সাধন সরকার কোন জবাব দিল না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সাধন সরকার ঘর ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেণুকা বিশ্বাসও উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, তাহলে আপনারা একটু বসুন মহাতি সাহেব, আপনাদের চায়ের কথাটা বলি
কিন্তু কিরীটী রেণুকাকে কথাটা শেষ করতে দেয় না, তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, মিসেস বিশ্বাস, ব্যস্ত হবেন না। চায়ের আপাততঃ আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে একটা যেন চমকেই রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল। আপনি বরং ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিন। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। কথা? আমার সঙ্গে? রেণুকার গলার স্বরে বিস্ময়।
হ্যাঁ।
বলুন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আজ সকাল থেকে লতিকা দেবী নিখোঁজ।
না তো—
জানেন না?
না। তাছাড়া লতিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কি? সে নিখোঁজ হল কি না হল সে খবর রাখতে যাব–
কিন্তু একটা খবর আমরা যে পেয়েছি মিসেস বিশ্বাস—
কি খবর পেয়েছেন?
আপনি নাকি কাল লতিকা দেবীর হোটেলে রাত দশটার পর তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন?
কি বলছেন আবোল-তাবোল? লতিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি আমি কাল রাত্রে দশটার পর?
যাননি আপনি?
নিশ্চয়ই না।
কিন্তু আপনাকে আমাদের লোক দেখেছে। মহান্তি বলে এবারে।
মাথা খারাপ! কাকে দেখতে কাকে দেখেছে আপনার লোক।
কিরীটী কথা বলে, আপনি তাহলে যাননি?
নিশ্চয়ই না।
আর ইউ সিয়ের?
নিশ্চয়ই।
কাল রাত্রে তবে ঐ সময় কোথায় ছিলেন?
কেন, এখানে আমার নিজের হোটলে! রাত আটটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত বোর্ডারদের খাওয়া-দাওয়ার পাট না চোকা পর্যন্ত আমার কি নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় থাকে।
সাড়ে দশটার পর?
হোটেলেই ছিলাম।
হঠাৎ এবারে কিরীটী তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে, একটা কথা আপনার জানা দরকার মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকারকে সত্যি সত্যিই শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, কিন্তু সে কথা যাক। আপনাকে আরো আমার জিজ্ঞাস্য আছে।
বলুন?
কালী সরকারের ঘরে রোজ রাত্রে স্টেকে ব্রীজ খেলা হত- কে কে খেলত জানেন?
কালী সরকার ব্রীজ খেলতেন, কথাটা আপনার কাছেই এই প্রথম শুনছি!
তাই নাকি?
কিরীটী মিসেস রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকাল। আমি তো তাকিয়েই ছিলাম রেণুকার মুখের দিকে। একান্ত নির্বিকার ভাবলেশশূন্য মুখ। কোন একটা রেখার কুঞ্চন বা কম্প মাত্রও সেখানে যেন নেই। কিরীটী একটু থেমে বলে, তাহলে আপনি বলতে চান মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকার ব্রীজ কোনদিনই খেলেনি বা জানত না খেলতে?
তা তো আমি বলিনি মিঃ রায়, আমি বলেছি তাকে হোটেলে কখনও খেলতে দেখিনি।
কি করে বুঝলেন? তাকে কি দিবারাত্র সদাসর্বদা পাহারায় রাখতেন নাকি আপনি মিসেস বিশ্বাস যে তিনি হোটেলে তার ঘরে খেলতেন না সে বিষয়ে আপনি এত definite হলেন?
এবারে যেন মিসেস বিশ্বাসকে একটু কেমন ব্রিত বলে মনে হয়। কেমন যেন একটু থমকে গিয়েছেন।
কিরীটী আবার বলে, শুনুন মিসেস বিশ্বাস, সত্যকে গায়ের জোরে কখনও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জানি না বলে আপনি ভান করতে পারেন, কিন্তু জানবেন সত্য যা একদিন তা প্রকাশ পাবেই। যাক, আপনি তার ব্রিজ খেলা সম্পর্কে জ্ঞাত না হলেও একটা কথা কিন্তু সেদিন সত্য বলেননি–
সত্য বলিনি? কী কথা?
একসময় যে আপনার ঐ কালী সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল সেই কথাটা–
কে বললে?
কেন, দুজন বলেছেন!
দুজন?
হ্যাঁ, লতিকা গুঁই ও আপনার হাজব্যাণ্ড মিঃ হরডন বিশ্বাস।
কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেণুকা বিশ্বাস ওর মুখের দিকে তাকায় এবং কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলে, কি জানতে চান আপনি মিঃ রায়, বলুন তো? হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং অ্যাট?
আমার কথাটা তো অস্পষ্ট নয় মিসেস বিশ্বাস। আপনার সঙ্গে একসময় তার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। এবং ছিল কিনা সেটাই আমি জানতে চাইছি।
দেখুন প্রশ্নটা আপনার অত্যন্ত ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে না, মিঃ রায়। মিসেস বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরে যেন বেশ বিরক্তির সুর।
নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু এটাও নিশ্চয় ভুলে যাবেন না আপনি মিসেস বিশ্বাস, আমরা একটা মার্ডার কেসের তদন্ত করছি। এবং সেই মার্ডারটা আপনারই এই হোটেলের মধ্যে একটা ঘরে হয়েছে। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটাও যেন কঠিন বলে মনে হয়।
কি বলতে চান আপনি? আমার হোটেলে মার্ডার হয়েছে মানে?
আপনার হোটেলেই মার্ডারড হয়েছে কালী সরকার সেরাত্রে। তারপর তাকে হত্যা করে মৃতদেহটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্য সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
না, না। আপনি–
শুনুন মিসেস বিশ্বাস, সেরাত্রে ঠিক যা ঘটেছে তাই বললাম। এবং আপনিও যে সেটা জানেন না তাও নয়।
আমি–
হ্যাঁ, আপনিও সেটা জানেন। শুনুন, যে রাত্রে কালী সরকার মার্ডার হয়, অনুমান রাত একটায় এবং সম্ভবতঃ তাকে নিদ্রার ঘোরে ফাস দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল—
গলায় ফাঁস দিয়ে?
হ্যাঁ। এবং খুব সম্ভবত তাকে পূর্বেই চায়ের সঙ্গে কোন কড়া ঘুমের ঔষধ পান করানো। হয়েছিল, যেটা প্রমাণিত সহজেই হবে হয়ত তার স্টমাক কনটেন্ট-এর কেমিক্যাল। অ্যানালিসিসটা হলেই!
এ-এসব আপনি কি বলছেন?
মিসেস বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরে এবার যেন কাঁপুনি টের পাওয়া যায়।
যা বলছি জানবেন তার একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। নির্মম সত্য। এবারে আপনি বলুন, সে রাত্রে রাত বারোটা থেকে দুটো—এই দু ঘণ্টা আপনি কি করছিলেন?
কেন-রাত বারোটা থেকে দুটো তো আমি ঘুমোচ্ছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলেন?
হ্যাঁ।
বেশ। সেরাত্রে শেষ কখন আপনি কালী সরকারের ঘরে যান?
সেরাত্রে আমি আদৌ যাইনি তার ঘরে।
কিন্তু আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন।
না।
ইয়েস, গিয়েছিলেন। বলুন, কখন গিয়েছিলেন এবং কতক্ষণ ছিলেন?
আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি আপনার ঐ কথায়, মিঃ রায়! সহসা হরডন বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর শোনা গেল!
চমকে আমরা ফিরে তাকালাম দরজার দিকে।
হরডন বিশ্বাস ঠিক দরজার উপর দীড়িয়ে। সে যে ইতিমধ্যে কখন ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে আমরা টেরও পাইনি।
আপনি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিরীটী বলে হরডনের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ। অত্যন্ত আপত্তিকর কথা।
কিন্তু আপত্তিকর হলেও কথাটা সত্য জানবেন মিঃ বিশ্বাস। কিরীটী শান্তকণ্ঠে জবাব দেয়।
অসম্ভব। কারণ আমি জানি ঐ সময় সে রাত্রে আমার স্ত্রী আমার পাশে শুয়েই নিদ্রা যাচ্ছিল।
কিন্তু আমি যদি বলি মিঃ বিশ্বাস, আপনার স্ত্রী কালী সরকারের ঘরে সে রাত্রে গিয়েছিলেন? আপনি নেশার নিদ্রায় টের পাননি? টের পাবার মত আপনার সে সময় অবস্থাও ছিল না?
রাবিশ!
রাবিশ! আপনি ড্রিঙ্ক করেন না?
করব না কেন? করি। কিন্তু তাই বলে–
মিঃ বিশ্বাস, বিশ্বাস করা না করা ব্যাপারটা আপনার ইচ্ছে। তাছাড়া আপনার স্ত্রীর উপরে কোন রিফ্লেকশন আনবার চেষ্টা করিনি। যা ঘটেছিল সেরাত্রে তাই বলেছি। Mere facts–
আপনি কি বলতে চান মিঃ রায়, আমার স্ত্রী রাতদুপুরে হোটেলের একজন বোর্ডারের ঘরে গেল আমার অজ্ঞাতে আর তার চরিত্রের ওপর সেটা একটা রিফ্লেকশন নয়?
কিন্তু আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, একসময় আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঐ কালী সরকারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল?
অল ট্র্যাস! আমি ওকে দীর্ঘ দশ বছর ধরে জানি। তবে হ্যাঁ, একসময় ঐ কালী সরকারের স্কুলে আমার স্ত্রী কিছুদিন কাজ করেছিল। সে সময় একটু আধটু পরিচয় হয়ত ওর সঙ্গে হয়েছিল। কারণ আমি শুনেছিলাম সেক্রেটারী হলেও উনি প্রায়ই স্কুলে আসতেন এবং–
বলুন, থামলেন কেন? কি বলছেন বলুন?
ওঁর নারী সম্পর্কে বরাবরই একটা দুর্বলতা ছিল।
আপনি তাহলে জানতেন ব্যাপারটা মিঃ বিশ্বাস?
জানতাম বৈকি।
বেশ। মিসেস বিশ্বাস, এবারে আপনি বলুন তো সেরাত্রে শেষ কখন চা দিয়ে আসা হয় কালী সরকারকে? কারণ আমি জানি, সে ঘন ঘন চা-পান করত এবং আপনিও সেই কথা বলেছেন।
আমি জানি—হরডন বিশ্বাস বলে ওঠে, রাত তখন পৌনে এগারটা হবে। ও রান্নাঘরে একটু ব্যস্ত ছিল। রামানুজ এসে চায়ের কথা বলায় আমিই নিজে এক কাপ চা তৈরী করে তাকে দিয়ে আসতে বলি ঘরে।
তৈরী করেছিল কে চা-টা? আপনি নিজে?
না। মানে আমার স্ত্রীই করে দিয়েছিল।
নিশ্চয়ই চা-পানের পর খালি চায়ের কাপটা তার ঘর থেকে রামানুজ সেরাত্রে নিয়ে আসেননি?
না। আমি যতদূর জানি চা-টা দিয়েই চলে এসেছিল সে।
তাই যদি হয়, নিশ্চয়ই অত রাত্রে চা খাবার পর আপনারা কেউ কাপটা নিয়ে আসেননি। কাপটা সেখানেই থাকার কথা, কিন্তু আমি পরদিন সকালে গিয়ে তার ঘরেতে কোন কাপ দেখিনি। তবে কে সেই কাপটা নিয়ে এল ঘর থেকে? মিসেস বিশ্বাস, আপনি?
আ-মি–না–আমি কেন আনব। হয়ত কোন চাকর-বাকরই—
কোন্ চাকর সাধারণতঃ তার ঘরে যেত?
রঘুয়া।
ডাকুন তাকে।
সে তো নেই।
কোথায় সে?
কালই তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। হরডন বিশ্বাস বলে।
চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন। কেন?
সে আমার ঘর থেকে পঞ্চাশটা টাকা চুরি করেছিল।
থানায় রিপোর্ট করেছিলেন?
না।
কেন?
গোলমাল হবার ভয়ে। তাছাড়া হোটেলের চাকর চোর-ব্যাপারটা বোর্ডারেরা জানতে পারলে খারাপ হবে তাই।
মিসেস বিশ্বাস, আপনি যখন পরের দিন সকালবেলা আট নম্বর ঘরে যান, চায়ের কাপটা দেখেছিলেন? কিরীটী আবার মিসেস বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে।
না।
হুঁ, আপনার ভাই রামানুজ কোথায়?
ওর মাছ ধরার বাতিক আছে। এ সময়টা প্রায়ই ও নুলিয়াদের সঙ্গে নৌকোয় চেপে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। আজও গিয়েছে হয়তো।
রামানুজ আপনার নিজের ভাই?
হ্যাঁ।
আপন মায়ের পেটের?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট?
তা অনেক হবে।
কত?
পনের-ষোল তো হবেই।
আপনার এখন বয়স কত?
বিয়াল্লিশ হবে।
ফরটি-টু?
ঐ রকমই হবে। বলে মাথাটা নীচু করল রেণুকা।
১০. অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা
কয়েকটা মুহূর্ত ঘরের মধ্যে। অতঃপর অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করে, কারও মুখে কোন কথা নেই।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার কিরীটীই।
এখানে আসবার আগে-কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আপনার ভাই কোথায় ছিল?
কলকাতায়। ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় মিসেস রেণুকা বিশ্বাস।
কি করত সেখানে?
কোন একটা মিলে কি যেন সামান্য একটা চাকরি করত।
কি চাকরি করত?
বলতে পারি না।
জানেন না বলতে চান?
না, জানি না।
হুঁ। রামানুজ লেখাপড়া কতদূর করেছে?
সামান্যই।
মিঃ বিশ্বাস, সাধন সরকারকে একবার ডাকুন তো?
হরডন বিশ্বাস তখনই গিয়ে সাধন সরকারকে ডেকে নিয়ে এল।
বসুন সাধনবাবু—
সাধন সরকার চেয়ারটায় বসে।
আপনি এখনও শোনেননি বোধ হয় যে আপনার কাকা কালী সরকার—
উনি আমার কাকা নন-জ্যাঠামণি। সাধন বলে।
ও। তা শোনেননি বোধ হয় যে আপনার জ্যাঠামণিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে!
চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে সাধন সরকর বলে, সে কি! তবে যে মিসেস বিশ্বাস বলছিলেন জ্যাঠামণি সমুদ্রে সুইসাইড করেছেন।
না, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। নিহুর পৈশাচিক ভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁর দেহটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই প্রমাণ করবার জন্য যে, তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেছেন।
সাধন সরকার একেবার বোবা। বিমূঢ়। বিহ্বল। পাথর।
সাধনবাবু! একটু পরে কিরীটী আবার ডাকল সাধন সরকারকে।
সাধন সরকার মুখ তুলে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
রামানুজ দাশকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ।
কতদিন চেনেন?
অনেক দিন। আমাদের কলকাতার বাসায় জ্যাঠামণির কাছে তো প্রায়ই আসা-যাওয়া করত।
প্রায়ই কেন আসা-যাওয়া করত? জানেন কিছু?
না, তা বলতে ঠিক পারব না। তবে জ্যাঠামণিকে মধ্যে মধ্যে রামানুজকে টাকা দিতে দেখেছি।
আর উনি-মিসেস বিশ্বাস? উনি যেতেন না? যেতেন। প্রায়ই?
না, তবে যেতেন। দু-একবার বোধ হয় যেতে দেখেছি।
শেষ কবে ওঁকে দেখেন আপনার জ্যাঠামণির কাছে যেতে?
মাস পাঁচেক আগে বোধ হয় শেষবার ওঁকে দেখেছি।
সে-সময় রামানুজ সঙ্গে ছিল ওর?
না তো।
লতিকা গুঁই নামে কোন মহিলাকে আপনি চেনেন? চিনি।
তাঁকেও কি আপনি আপনার জ্যাঠামণির কাছে যেতে দেখেছেন?
হাঁ।
কোথায়?
আমাদের জুয়েলারীর দোকানে দোতলায় জ্যাঠামণির বিশ্রামের দুটো ঘর ছিল, সেইখানে প্রায় ছুটির দিনেই দুপুরে তিনি আসতেন।
আপনার জ্যাঠামণির কোন উইল আছে জানেন?
উইল?
হ্যাঁ।
ঠিক বলতে পারব না। আমাদের সলিসিটার গিরীন সিংহ বলতে পারবেন। হি ইয়ুজড় টু ডিল উইথ হিস অল ম্যাটার্স।
হুঁ, ঠিক আছে। মিঃ বিশ্বাস, আপনার শ্যালক এলে অতি অবিশ্যি থানায় মহান্তি সাহেবের কাছে একবার পাঠিয়ে দেবেন।
কথাটা বলে কিরীটী যেন কিছুক্ষণ কি ভাবে, তারপর সহসা উঠে দাঁড়ায়।
মহান্তির দিকে তাকিয়ে বলে, চলুন মিঃ মহান্তি।
যাবেন?
হ্যাঁ, আমার যা জানবার জানা হয়ে গিয়েছে। যাবেন? চলুন যাওয়া যাক।
কথাটা বলে আমাকে চোখের ইঙ্গিত করে বের হয়ে যায় সোজা ঘর থেকে। আমি ওকে অনুসরণ করি।
থানাতেই এলাম আমরা।
সারাটা পথ কিরীটী একটা কথাও বলেনি। অসম্ভব গম্ভীর।
বুঝতে পারি ভিতরে ভিতরে কিরীটী অত্যন্ত উত্তেজিত। তা সে যে কারণেই হোক।
থানায় পৌঁছে চেয়ারে বসে কিরীটী বললে, চা বলুন মিঃ মহতি।
নিশ্চয়–
মহাতি হতদন্ত হয়ে উঠে গেল।
চা-পানের পর একটা চুরুট ধরিয়ে ধীরে ধীরে ধূমপান করতে করতে কিরীটী বলে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন সেরাত্রে কি ভাবে কালী সরকারকে হত্যা করা হয়েছিল।
না-ঠিক—
এখনও বুঝতে পারেননি? সুব্রত?
পেরেছি কিছুটা। হত্যাকারী প্রস্তুত হয়েই কাজে নেমেছিল।
সত্যিই তাই।
কিরীটী বলে, প্রথমে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ দিয়ে হত্যাকারী কালী সরকারকে ঘুম পাড়ায়। তারপর সময় বুঝে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে কালী সরকারের ঘরে প্রবেশ করে। একটা কর্ড বা সিল্কের মজবুত রিবনের মত কিছুর সাহায্যে স্যাঙ্গল করে তাকে ঘুমের মধ্যেই শ্বাস-বন্ধ করে হত্যা করে। তারপর হত্যাকারী নিঃশব্দে ঘর থেকে ডেড বডিটা কাঁধে করে ঐ রাস্তা দিয়েই হোটেল থেকে বের হয়ে এসে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেয়।
ইট ওয়াজ ডেড অফ নাইট! মধ্যরাত্রি। কেউ কোথাও জেগে নেই। এবং এ থেকে হত্যাকারী সম্পর্কে আমরা কিছু guess করতে পারি–
কি? মহান্তিই প্রশ্ন করে।
প্রথমতঃ, কিরীটী বলতে থাকে, হত্যাকারী strong nerve-এর লোক; দ্বিতীয়তঃ, গায়ে শক্তিও যথেষ্ট ছিল তার–
রজনী বাধা দেয় মহান্তি ঐ সময়, বলে, হত্যাকারী নিশ্চয়ই পুরুষ?
পুরুষ কি নারী সেটা immaterial, কারণ—
কি?
কারণ এমনও হতে পারে, হত্যার পরিকল্পনা বা brainছিল একজনের এবং instrument ছিল অন্য একজন। তেমনি আবার একই ব্যক্তির brain-এ হয়ত বা কাজ হতে পারে। তবে এটা ঠিক, হত্যাকারী যেই হোক, দুটো মারাত্মক ভুল সে করেছিল।
ভুল!
হ্যাঁ।
কি ভুল করেছিল?
প্রথমতঃ ব্যাপারটা সুইসাইড প্রমাণ করার জন্য যেভাবে কালী সরকারকে হত্যা করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই মৃতদেহটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে। এবং দ্বিতীয়তঃ, ছদ্মবেশ ধরে–
কি—কি বললেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, মিঃ মহান্তি। একবার নয়, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো দু-দুবার সে ছদ্মবেশ ধরেছে ঐ রাত্রে এবং সেই ছদ্মবেশেই দুজনার সঙ্গে দেখা করেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, একজনের অন্ততঃ তার ছদ্মবেশের আড়ালে সত্য পরিচয়টা জানা উচিত ছিল। কিন্তু তার চাইতেও যেটা বেশী আমার কাছে পাজলিং মনে হচ্ছে এখনও-কেন-কেন হত্যাকারী তাকে হত্যা করল? হোয়াট ওয়াজ দি মোটিভ বিহাইও? কি উদ্দেশ্য ছিল? সেইটা—সেইটা জানতে পারলে–
তাহলে আপনি হত্যাকারী কে তা ধরতে পেরেছেন মিঃ রায়! উত্তেজনায় যেন মহান্তির গলা বুঁজে আসে।
পেরেছি বৈকি। শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে।
কে-কে? মহান্তি যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।
চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করুন। দুরেরও নয়। খুব ঝাপসা—অস্পষ্টও নয় সে। কাছের মানুষ–
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না—বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠঃ ডোন্ট টাচ মি, আমি—আমি নিজেই যাচ্ছি। দরজার দিকে আমরা তিনজনে তাকালাম।
একজন প্লেন ড্রেস অফিসার ও দুজন কনস্টেবল সমভিব্যাহারে লতিকা গুঁই এসে ঘরে প্রবেশ করল।
রুক্ষ মাথার চুল। সমস্ত চেহারা, পোশাক যেন এলোমেলো।
ঘরে ঢুকেই লতিকা গুঁই বলে, আমি জানতে চাই হোয়াট অল দিস? এসবের মানে কি? কেন ওরা আমাকে খুরদা রোড় জংশন থেকে ধরে নিয়ে এল? হোয়াই?
বসুন লতিকা দেবী—কিরীটী বলে, আপনি মিথ্যে চটছেন। ওদের কোন দোষ নেই। দারোগা সাহেবের আদেশমতই ওরা–
শাট আপ! গর্জে ওঠে লতিকা, আদেশ! কিসের আদেশ? আমি কি চোরছ্যাঁচোড় না খুনী যে আমাকে এমনি করে বেঁধে নিয়ে এল ওরা?
আপনি মিথ্যে উত্তেজিত হচ্ছেন। ব্যাপারটা আপনি বোঝবার চেষ্টা করুন লতিকা দেবী। মহান্তি বলে।
কি বুঝব, শুনি? বোঝবার এর মধ্যে আছেটা কি? বলুন, কেন আমাকে ধরে এনেছেন?
আপনাকে বলা সত্ত্বেও হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে হোটেল ছেড়ে চলে গেলেন কেন আপনি?
বেশ করেছি গিয়েছি। একশবার যাব।
বেশ, যাবেন। আপনাকে আমরা আটকাব না যদি আমাদের কতকগুলো প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দেন। কিরীটী এবারে বলে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে লতিকা বলে, আপনি কি মনে করেছেন আমি কালী সরকারকে হত্যা করেছি?
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লতিকার গলার স্বরটা কেমন যেন ভার-ভার হয়ে ওঠে।
কিরীটী বলে, না।
তবে? তবে এসবের মানে কি?
বললাম তো, সেদিন ভাল করে আপনি আমাদের সঙ্গে কথাই বললেন না, তাহলে এ গোলমালটা হত না।
কি জানতে চান আপনারা?
ঠিক জবাব দেবেন তো?
ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম! বলুন কি জানতে চান?
সেরাত্রে কখন আপনি হোটেল ছেড়ে চলে যান?
রাত একটার পর পিছনের দরজা দিয়ে।
হঠাৎ কাউকে না বলে চলে গেলেন কেন?
যাব না তো কি করব-কালীর মত মরে জলে ভাসব!
কি—কি বললেন? কিরীটী চমকে ওঠে যেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ–ঠিক বলেছি। না গেলে এতক্ষণে আমাকেও মরে সমুদ্রের জলে ভাসতে হত।
তাহলে আপনি বলতে চান, দেন সামওয়ান থ্রেটেও ইউ? ভয় দেখিয়েছিল কেউ আপনাকে?
লতিকা চুপ।
কি-বলুন? চুপ করে রইলেন কেন?
লতিকা তথাপি চুপ।
লতিকা দেবী।
আঃ, আমি কিছু জানি না—জিজ্ঞাসা করবেন না।
বেশ।
কিরীটী আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এবং চুপ করে থাকার পর আবার শুরু করে, লতিকা দেবী, রামানুজকে জানেন?
কে?
রামানুজ দাশ-রেণুকা বিশ্বাসের ভাই!
রেণুর ভাই?
হ্যাঁ।
আমি তো জানি না, রেণুর কোন ভাই কোনদিন ছিল বলে! কখনও শুনিওনি!
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন একটা সুস্পষ্ট উত্তেজনার ইঙ্গিত পাই।
কিরীটী যেন সোজা হয়ে বসে।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে অতঃপর, আর ইউ সিয়োর? আপনি যা বলছেন ঠিক বলছেন?
মিথ্যা বলব কেন?
কিরীটী আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কি যেন ভাবতে লাগল।
লতিকা দেবী, আপনার তো কালী সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। ডোন্ট টক অ্যাবাউট হিম এনি মোর! তিক্ত ঘৃণা যেন লতিকার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে, ঐ নোংরা লোকটা সম্পর্কে কোন আলোচনাই আর আমি করতে চাই না। এখন বুঝতে পারছি, এই ওর প্রাপ্য ছিল। হি হ্যাজ বিন রাইটলি সার্ভড! যে ওকে গলা টিপে মেরেছে সে খুব ভাল কাজ করেছে।
এ আপনি কি বলছেন লতিকা দেবী! মহান্তি বিস্ময়ের সঙ্গে বলে।
ঠিকই বলছি। আমি আগে যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম ঐ মেয়েমানুষটা এখানে এসে হোটেল খুলেছে, আর সেই হোটেলে ও এসে উঠেছে, এখানে আমি কি পা দিতাম? কখনও দিতাম না। কিন্তু কেন—কেন আপনারা আমাকে এখানে জোর করে ধরে নিয়ে এসে এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছেন বলুন তো? কি করেছি আমি আপনাদের—কি করেছি!
লতিকা গুঁই শেষ পর্যন্ত যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেল। কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ল।
কিরীটী যেন অত্যন্ত ব্ৰিত বোধ করে, বলে, I am really sorry-অত্যন্ত দুঃখিত আপনাকে এভাবে cross করবার জন্য, কিন্তু জানবেন একান্ত অনন্যোপায় হয়েই আপনাকে বিরক্ত করছি।
মাথা নীচু করে বসে থাকে লতিকা গুঁই। এবং বুঝতে পারি, প্রাণপণে উদগত অশ্রুকে দমন করবার চেষ্টা করছে।
লতিকা দেবী, আর দুটি প্রশ্ন আমার আছে—
বলুন? ধীরে ধীরে আবার মাথা তুলল লতিকা গুঁই।
সত্যি সত্যিই কি আপনি সেদিন ট্রাঙ্ক কলে কালী সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
লতিকা গুঁই একেবারে চুপ। যেন পাথর।
কি, চুপ করে রইলেন কেন, বলুন?
আমি—
আপনাদের পরস্পরের মধ্যে সেদিন অন্ততঃ ট্রাঙ্ক কলে কোন কথাই হয়নি আমি জানতে পেরেছি।
লতিকা পূর্ববৎ চুপ।
আর একটা প্রশ্ন—আপনি যে পুরীতে আসছেন কালী সরকার কি জানত?
এবারেও কোন সাড়া নেই শব্দ নেই লতিকার দিক থেকে।
কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ লতিকার দিকে চেয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে, আপনাকে আর আমরা ধরে রাখব না। আপনি যেতে পারেন। তবে অনুগ্রহ করে যদি অন্ততঃ আজকের রাতটা যে হোটেলে আপনি ছিলেন সেই হোটেলে থাকেন-কাল যেখানে আপনি যেতে চাইবেন, আমাদের লোক গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
জলে ভেজা দৃষ্টি তুলে তাকাল লতিকা গুঁই কিরীটীর মুখের দিকে, কিন্তু–
ভয় নেই আপনার, কেউ আপনার গায়ে যাতে এতটুকু আঁচড় না কাটতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা করব।
কিন্তু আপনি–
আমি জানি লতিকা দেবী, কে আপনাকে সেরাত্রে প্রাণের ভয় দেখিয়েছিল।
আ-আপনি জানেন?
জানি—কিন্তু আর দেরি করবেন না। যান আপনি হোটেলে।
লতিকা গুঁই ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১১. গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব
কিরীটী বললে, এবারে আমরাও গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব। কিন্তু আজ রাত্রে আপনাকে একটু প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রস্তুত থাকতে হবে!
হ্যাঁ।
কি ব্যাপারে?
লতিকা গুঁইয়ের ভীতি বা আশঙ্কাটা মিথ্যা নয়। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো নিশ্চয়ই হত্যাকারী তার ওপরে একটা অ্যাটেম্পট নেবে।
সত্যি তাই মনে করেন আপনি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
আমার মনে হচ্ছে যেহেতু উনি হত্যাকারীর একটা পরিচয় জানেন—যেটা আমাদের কাছে ভাঙলেন না, জানি না বলে গোপন করে গেলেন, সেটা সর্বসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ুক এটা হত্যাকারী নিশ্চয়ই চায় না।
কি সে পরিচয়?
পরিচয়টা হচ্ছে আসলে সে কে! কিন্তু আর দেরি করা চলবে না। বেলা এখন প্রায় পৌনে পাঁচটা। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে আমি একটা ট্রাঙ্ক কল কলকাতা থেকে এক্সপেক্ট করছি–
ট্রাঙ্ক কল! কার? প্রশ্নটা করলাম আমিই।
কালী সরকারের সলিসিটারের। চল। তারপরই ঘুরে তাকাল কিরীটী বিজয় মহান্তির দিকে। বলল, মহান্তি সাহেব, লতিকা দেবীর হোটেলে পাহারা রাখবেন। প্লেন ড্রেস পুলিস রাখবেন। আর রাত এগারটায় আমার হোটেলে আসবেন। চলি
বের হয়ে এলাম আমরা থানা থেকে।
.
সী-সাইড হোটেলের কাছাকাছি এসেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সাইকেলরিকসায় চেপে রামানুজ যাচ্ছে।
কিরীটী রামানুজকে দেখে হাতের ইশারায় থামতে বলল।
রিকশাটা থামল। আজ রামানুজের পরনে একটা আমেরিকান প্যাটার্ণের ড্রেন-পাইপ প্যান্ট ও চিত্র-বিচিত্র একটা সিল্কের হাওয়াই শার্ট। মুখে চিউয়িং গাম ছিল বোধ হয়। অনবরত চিবোচ্ছে।
রামানুজ সাহেব যে-কোথায় চলেছেন?
থানায় গোয়িং—
থানায় কেন বলুন তো?
হ্যাঁ-দিদির কাছে শুনলাম আপনিই তো অর্ডার করেছেন থানায় যেতে, আমাকে মহাতি সাহেবের নাকি প্রয়োজন আছে। কিন্তু হোয়াই বলুন তো?
কোথায় গিয়েছিলেন আপনি দুপুরে?
ফিসিং করতে সীতে। নাইস! চলুন না একদিন।
বেশ তো। যাওয়া যাবে।
হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে, আচ্ছা রামানুজ সাহেব, মনে হচ্ছে কি একটা বাংলা ফিল্মে অনেকটা আপনার মত একজনকে দেখেছিলাম—আপনি কি কখনও
কিরীটীর কথা শেষ হয় না।
একগাল হেসে ফেলে রামানুজ, ইউ ঠিকই কট মি। ধরেছেন তো ঠিক। ইয়েস, একজন কমেডিয়ান হিসাবে আমার নাম আছে।
তাহলে আপনি একজন অভিনেতা বলুন? চিত্রাভিনেতা–ফিল্ম-আর্টিস্ট?
হেঁ-হেঁ-ঠিক ধরেছেন-রাইটলি কট!
আচ্ছা যান, আপনাকে আর আটকাব না। থানাতেই যাচ্ছেন তো?
হ্যাঁ।
রামানুজ চলে গেল।
আমি তখনও সেই দিকে তাকিয়ে।
কিরীটী শুধায়, কিরে—কি দেখছিস?
একটা ক্লাউন। মৃদুকণ্ঠে বললাম।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হ্যাঁ, কোন প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনে হঠাৎ আসা কোন বসন্তরজনীর একটি ফল।
কি বললি?
চল, কিছু না। বড় চায়ের পিপাসা পেয়েছে। একটু পা চালিয়ে চল্।
কিন্তু হোটেলে আমাদের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। দরজা খোলা-ঘরে আলো জ্বলছিল। ঘরের মধ্যে একটা ইজিচেয়ারে বসে লতিকা গুঁই।
আমাদের পদশব্দে সে নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল।
লতিকা দেবী—আপনি—
লতিকার দুচোখে টলটল করছে জল।
কিরীটীই আবার বলে, আপনি হোটেলে যাননি?
না—আপনাকে আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম—
কী কথা বলতে এসেছেন আমি জানি।
চমকে সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকায় লতিকা এবং ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আ-আপনি জানেন!
জানি। কালী সরকারের সঙ্গে আপনার সত্যকার পরিচয়টা দিতে এসেছেন।
লতিকা দেবী চুপ করে রইল।
তাই তো।
হ্যাঁ, মানে-আ-
আমি জানি, বললাম তো। আপনি-মানে কালীর সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়েছিল।
কি কি করে আপনি জানলেন?
দুটো জিনিস থেকে।
দুটো জিনিস! বিস্ময় লতিকার কণ্ঠে।
হ্যাঁ। প্রথমতঃ কালীর ঘরে যে নোট-বই একট ছিল তার মধ্যে কালীর সলিসিটারের একটা চিঠি ছিল। যার মর্মার্থ হচ্ছে-সে আসছে দুচারদিনের মধ্যেই পুরীতে কালীর স্ত্রী লতিকা সম্পর্কে উইলের আলোচনা করতে।
আর–
আর আপনার হীরের লকেটটা যেটা আপনার হোটেলের ঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছেন মিঃ মহান্তি—এই যে আপনাদের দুজনের ফটো এর মধ্যে-বলতে বলতে লকেটটা এগিয়ে দেয় কিরীটী লতিকার দিকে।
লতিকা বোকার মতই যেন হাত বাড়িয়ে লকেটটা কিরীটীর হাত থেকে নেয়।
কিরীটী বলে, এখন তো বুঝতে পারছেন কেন হত্যাকারী আপনাকে threaten করেছিল? তার সেটা জানবেন কেবল মৌখিক threaten-ই নয়—তার intention-ও তাই ছিল এবং তাই করতও। কিন্তু আর সে হবে না—হবারও নয়। আপনি নিভাবনায় হোটেলে ফিরে যান। মিসেস সরকার। হত্যাকারীকে ধরা দিতেই হবে-তার পালাবার কোন পথই আর নেই। যান-বরং সুব্রত তুই যা ওঁকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।
চলুন। আমি বলি।
লতিকা উঠে দাঁড়াল।
আমরা ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল
ঠিক সাড়ে ছটায় কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল এল।
ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় সাত মিনিট কিরীটী কালী সরকারের সলিসিটারের সঙ্গে কথা বলে বেশ হৃষ্টচিত্তেই ঘর থেকে বের হয়ে এল। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।
বলি, কি ব্যাপার?
হারানো সূত্রটি মিলে গিয়েছে। কিরীটী বললো।
কিসের হারানো সূত্র?
হত্যার উদ্দেশ্যটা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। উদ্দেশ্যটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
পেয়েছিস?
হ্যাঁ। আমি একটু বেরুচ্ছি। ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরব। কথাটা বলে কিরীটী বের হয়ে গেল। মনে হল, বাইরে খুশি খুশি হলেও ভিতরে সে যেন তখনো আগের মতই উত্তেজিত।
.
রাত সাড়ে এগারটায় আমি, কিরীটী ও মহান্তি পূর্ব-পরিকল্পনা মত লতিকার হোটেলের দিকে চললাম।
যেমন যেমন বলেছিলাম, সেইভাবে সব ব্যবস্থা করেছেন তো মিঃ মহান্তি? কিরীটী শুধাল।
হ্যাঁ। কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে জানাল মহান্তি।
অন্ধকার রাত।
বীচের রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু সে আলো এতই সামান্য যে থাকা-না-থাকা বোধ হয় দুই-ই সমান। অন্ধকারে সমুদ্র দেখা যায় না বটে, তবে গর্জন শোনা যাচ্ছে।
বীচের একেবারে গোড়ায় ফ্ল্যাগস্টাফের কাছে একটু ভিতরের দিকে লতিকার হোটেলটা। বীচে তখন একটি জনপ্রাণী নেই। ঐ সময় থাকার কথাও নয়। পিছনের দরজা-পথে আমরা নিঃশব্দে লতিকা যে হোটেলে ছিল সেই হোটেলে প্রবেশ করলাম।
একতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছিল।
কিরীটী বললে চুপিচুপি, ঐটাই লতিকার ঘর।
হঠাৎ কানে কথা এলে-নারী-কণ্ঠ এবং লতিকার কণ্ঠ।
দাঁড়াও—আমি জানতাম তুমি আসবে।
নারীকণ্ঠের জবাব এল, জানতে?
হ্যাঁ, জানতাম। আর কেন যে এসেছ তাও জানি।
তবে তো খুবই ভাল!
এগিও না বলছি। স্টপ-স্টপ!
কিন্তু লতিকার কথা শেষ হল না। সহসা একটা শব্দ—
তারপরই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ ও সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ।
কিরীটী যেন ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল দরজার উপর, এবং আমাকেও বললে, সুব্রত উই-উই মাস্ট গেট ইন! দরজাটা ভাঙ। মহান্তি কুইক—
তিনজনের মিলিত চাপে দরজাটা ভেঙে পড়ল।
হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে তিনজন ঢুকে পড়ি। দেখি শয্যার উপর পড়ে আছে লতিকা, আর এক নারী তার উপরে ঝুঁকে রয়েছে তখনও।
কিরীটী ছুটে গিয়ে এক ঝটকায় সেই দ্বিতীয় নারীকে সরিয়ে দিয়ে লতিকার গলা থেকে সিল্কের রিবনের ফাঁসটা টেনে খুলে ফেলল তাড়াতাড়ি।
লতিকা নেতিয়ে পড়ে আছে তখনও শয্যার উপরে। সংজ্ঞাহীনা।
দ্বিতীয় নারী তখন ঘর থেকে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কিরীটী গর্জে ওঠে, নো ইয়ুজ-পালাবার চেষ্টা এখন বৃথা।
মহান্তির বিস্ময়-বিস্ফারিত কণ্ঠ থেকে বের হয়, এ কি, মিসেস বিশ্বাস?
কিরীটী বলে, না।
মিসেস বিশ্বাস নয়?
না—তার ছেলে রামানুজ।
রামানুজ। রেণুকা বিশ্বাসের ছেলে!
হ্যাঁ। খুব দক্ষ অভিনেতা রামানুজ। মিসেস বিশ্বাসের ছদ্মবেশে প্রথম রাত্রে উনিই এখানে এসেছিলেন এবং সেই সময়ই লতিকা দেবী ওঁকে চিনতে পারে আর তাই রামানুজ ওঁকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে লতিকার চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে হাওয়া করতে সে চোখ মেলে তাকায়।
আমি–, ক্ষীণ কণ্ঠে লতিকা সাড়া দেয়।
ভয় নেই মিসেস সরকার–you have been saved-কিরীটী বলে, হত্যাকারী ধরা পড়েছে–
ধরা পড়েছে। লতিকা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ-ওই যে দেখুন, পালাতে পারেনি।
ঘরের এক কোণে রামানুজ তখনো একটা চেয়ারে পুলিসের প্রহরায় বসে।
কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ রায়! ক্ষীণকণ্ঠে লতিকা বলে, রামানুজ–
হ্যাঁ, রেণুকার ছেলে রামানুজ—
রেণুকা বিশ্বাসের ছেলে-রামানুজ! কেমন যেন আমার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে!
হ্যাঁ–জট ঐখানেই পাকিয়ে ছিল এবং হত্যার বীজও ঐখানেই ছিল।
হত্যার বীজ!
তাছাড়া কি? সত্যিই বিচিত্র নাটক! ওই রামানুজ কে জানেন?
আসল পরিচয়—অর্থাৎ রেণুকার গর্ভজাত হলেও ওর জন্মদাতা বাপ কে জানেন?
কে? লতিকা ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে।
সে হচ্ছে আপনারই স্বামী-কালী সরকারের অপরিণামদর্শিতার ফল—দুষ্কৃতির ফল–কালী সরকার ও রেণুকার ক্লেদাক্ত, কামনা-পঙ্কিল অন্ধকারময় জীবনের কোন এক বসন্ত রজনীর স্বাক্ষর।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? সত্যি?
সত্যি-নিষ্ঠুর মর্মান্তিক সত্যি লতিকা দেবী! কিন্তু ঐ হতভাগ্য সেটা কোন দিনই জানতে পারেনি। ও চিরদিন জেনেছে ও রেণুকার ভাই।
কিন্তু আপনি-আপনি সে কথাটা জানলেন কি করে? মহান্তি প্রশ্ন করে।
প্রথমটায় অবিশ্যি নিছক অনুমানের উপরে নির্ভর করে-এবং যা চোখে দেখেছি তাই বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে।
কি রকম?
কিরীটী বলে, আপনারাও যদি চোখ মেলে দেখতেন তবে দেখতে পেতেন—রামানুজ রেণুকা ও কালী সরকারের চেহারার মধ্যে similarity দেখতে পেতেন, কেমন করে রেণুকা ও কালী সরকারের চেহারার ছাপ পড়েছে ঐ রামানুজের চেহারায়–
কিন্তু–
শুনুন মিঃ মহান্তি—
কিরীটীই বলতে থাকে, প্রথম দিন দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, কারণ রামানুজের কটা চুল, চোখ ও গৌর গাত্রবর্ণ রেণুকার মত হলেও মুখের গঠনটা অবিকল কালী সরকারের মত। এবং কথাটা যে সত্য সে সম্পর্কে আমি স্থির-নিশ্চিত হই আজই সন্ধ্যায় কালী সরকারের অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথা বলে। কালী সরকারের উইলে লেখা আছে, পুরীর সী-সাইড হোটেলটার একমাত্র মালিক কালী সরকার নিজে।
সে কি! মহান্তি বলে ওঠে, হোটেলটা তবে–
না, আসলে হোটেলটা কালী সরকারেরই। রেণুকা বিশ্বাসের সঙ্গে একটা চুক্তিপত্র আছে। যদিও সবাই জানে রেণুকা ও হরডন বিশ্বাসই হোটেলের মালিক। যাই হোক, যা বলছিলাম, ঐ হোটেলটা রামানুজ দাশকে দিয়েছে লেখা আছে।
রামানুজ ঐ সময় চেঁচিয়ে ওঠে, মিথ্যে কথা!
কিরীটী বলে, মিথ্যা কথা নয়। তোমার জননী দেবী ওইখানেই ভুল করেছে রামানুজ সাহেব। পাছে হোটেলটি হাতছাড়া হয়ে যায় কালী সরকারের মৃত্যুর পর, কালী সরকারকে নিয়ে এসে কৌশলে সেরাত্রে তোমাকে দিয়ে হত্যা করিয়ে সমূদ্রের জলে ভাসিয়ে দেয়। অ্যাও ইউ ফুল-ইউ কিলড ইয়োর ওন ফাদার—নিজের বাপকে তুমি হত্যা করেছ-যে বাপ তোমার ভালটাই চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
না, না-হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রামানুজ যেন পাগলের মতই-মিথ্যা—এ মিথ্যা–
না রামানুজ সাহেব, এ মিথ্যা নয়। কালী সরকারের অ্যাটর্নীও জানে সে কথা—তুমি তার অবৈধ সন্তান হলেও তোমার প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিল, মমতা ছিল।
কিন্তু আমি—I never dreamt of it- লতিকা বলে।
একমাত্র কালী সরকারের অ্যাটর্নী ছাড়া আর যারা জানে সে হছে ঐ রেণুকা বিশ্বাস।
হরডন বিশ্বাস জানে না?
না, সে জানে না। তবে না জানলেও তার মনে বোধ হয় ইদানীং একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল–
সন্দেহ?
হ্যাঁ মহান্তি সাহেব-সন্দেহ। সন্দেহ হচ্ছে তার স্ত্রী ও কালী সরকারকে নিয়ে—তাই সে কালী সরকারকে ডেকে পাঠায় পুরীতে।
তারপর?
কালী সরকার অবিশ্যি ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি-মানে সন্দেহ করেনি। সে সরল মনেই এসেছিল। তারপর আমার যা অনুমান, খুব সম্ভবতঃ কালী সরকারকে চেপে ধরে হরডন বিশ্বাস এবং তখন অনন্যোপায় কালী সরকার ব্যাপারটা মিটিয়ে নেবার জন্য কলকাতা থেকে তার অ্যাটর্নীকে আসতে বলে নতুনভাবে উইল করবার জন্য।
সত্যি?
বললাম তো, সবটাই আমার অনুমান। যা হোক, সমস্ত শলাপরামর্শ হত কালী ও হডনের মধ্যে, তার ঘরে বসে ব্রীজ খেলতে খেলতে। আসলে ব্রীজ খেলাটা ছিল সম্ভবতঃ eyewash-এবং ঐ সময় কোন একদিন রাত্রে হয়ত রেণুকা আড়িপেতে ব্যাপারটা জানতে পারে—যার ফলে সে অনন্যোপায় হয়ে তখন ছেলেকে পরামর্শ দেয় কালীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলবার জন্য, হতভাগ্য রামানুজকে হয়ত বুঝিয়েছিল, অন্যথায় হোটেল থেকে সে বঞ্চিত হবে।
হরডন তাহলে ব্যাপারটা জানে না বলতে চান?
সম্ভবতঃ না।
» ১৩. মহান্তি অতঃপর শুধায়
মহান্তি অতঃপর শুধায়, আপনি কি রামানুজকে প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ। তাকে দেখবার পর থেকেই বলতে গেলে। তবে সন্দেহটা ঘনীভূত হয় আপনার মুখ থেকে রেণুকার ইতিহাসটা শোনবার পর।
কেন-কেন ওকে সন্দেহ করলেন?
প্রথমতঃ ও আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি। কারণ ওকেই আমি আগের দিন বৈকালে সমুদ্রতীরে কালী সরকারের সঙ্গে যখন প্রথমে দেখি
তবে কি–
হ্যাঁ, ওই দোলগোবিন্দ সিকদার-পার্ল-মাচেন্ট! মানুষকে একবার দেখলে বড় একটা আমি ভুলি না। পরের দিন হোটেলে ওকে দেখে তাই আমি চমকে উঠেছিলাম। দ্বিতীয়তঃ, ওর মুখের সঙ্গে কালী সরকারের মুখেরও একটা ক্লোজ রিজেমব্লেন্স দ্বিতীয় দিন আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
একটু থেমে আবার বলতে থাকে কিরীটী, ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয়েছিল কোথায় যেন একটা আশ্চর্য রকমের মিল, একটা সাদৃশ্য আছে কালী সরকারের মুখের সঙ্গে ঐ রামানুজের মুখের। মনের চমকের সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি দৃষ্টিটা আমার আরও আকর্ষিত হয়। রং, চুল, চোখ সব রেণুকার মত, অথচ চেহারায় আশ্চর্য রকম আদল কালী সরকারের মত। এবং এও বুঝতে আর আমার বাকি ছিল না, রামানুজ যেই হোক, দোলগোবিন্দ সিকদার ও রামানুজ এক এবং অভিন্ন।
একটু থেমে কিরীটী একটা সিগার ধরাল-সিগারে একটা মৃদু টান দিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করে, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে একটা মিষ্টিই রয়ে গেল। কালী সরকার কেন হঠাৎ রামানুজ সম্পর্কে আমার কাছে মিথ্যে কথা বলতে গেল!
হয়তো এমনও হতে পারে, পাছে তোর মনে কোনরকম কোন কিউরিয়োসিটি রামানুজ সম্পর্কে জাগে তাই একটা মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ওর ব্যাপারটা তোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে চাপা দিতে চেয়েছিল। আমি বলি।
কথাটা যে আমারও মনে হয়নি সুব্রত তা নয়। কিন্তু কেন—কি প্রয়োজন ছিল তার? তবে সে কি তার বিপদ অ্যাপ্রিহেও করতে পেরেছিল?
হয়তো।
তাই যদি হবে তো সে সাবধান হল না কেন নিজে?
সাবধান!
হ্যাঁ, সাবধান হওয়া উচিত ছিল তার নিজের চা-পান সম্পর্কে।
কি বলতে চাস তুই কিরীটী? আমি প্রশ্ন করি।
মনে আছে নিশ্চয়ই তোদের, সেরাত্রে চা-টা রেণুকা বিশ্বাস তৈরী করে দিলেও, রামানুজ চা-টা কালী সরকারের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। হরডন বিশ্বাসের কথা থেকেই আমরা জেনেছি।
মনে আছে।
আমার মনে হয় সেই সময়ই চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয় রামানুজ।
তাহলে রেণুকা বিশ্বাস নয়? মহাতি প্রশ্নটা করে।
না, সে মিশোয়নি। আমি অবিশ্যি বুঝেছিলাম মিঃ মহান্তি-রেণুকাকে ঘিরে আপনার সন্দেহটা সবচাইতে বেশী দানা বেঁধে উঠেছিল, কিন্তু আমার তা হয়নি।
কেন?
তার কারণ রেণুকার মত এক স্ত্রীলোকের পক্ষে একজন বয়স্কি পুরুষকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। তবে হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে সে যে জড়িত সেটা তার জবানবন্দি থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানবার সঙ্গে সঙ্গে সে গিয়ে কালী সরকারের ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছিল। আসলে সে তালা দিতে চায়নি, গিয়েছিল ঘরের মধ্যে যদি কোনরকম সন্দেহজনক কিছু রামানুজ ফেলে এসে থাকে, সেটা সরিয়ে ফেলবার জন্য।
কেন?
কারণ সে ভাবতেই পারেনি, যে দেহটা তারা সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়েছে রাত্রির অন্ধকারে নির্মম ভাগ্যের ফলে সেই দেহটাই আবার নুলিয়াদের হাত দিয়ে ফেরত আসবে সমুদ্রের জল থেকে! তাই ভয় হয়েছিল তখন, যদি ব্যাপারটা হত্যা বলে কারও সন্দেহ হয় এবং পুলিস শেষ পর্যন্ত নাড়াচাড়া করে ব্যাপারটা নিয়ে, তাহলে যেন কোন প্রমাণ তারা ঘরে না পায়। চায়ের কাপটাও হয়ত সেই কারণেই সরিয়ে ফেলেছিল রেণুকা বিশ্বাস।
তারপর?
তারপর আর কি-ঘুমের ঔষধের প্রভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্চে দেখেই মধ্যরাত্রে কোন এক সময় রামানুজ গিয়ে ঘরে ঢোকে এবং নির্মমভাবে একটা চুলের রিবন গলায় ফাঁস দিয়ে নিজের জন্মদাতা বাপকে হত্যা করে মায়ের অনুরোধে। পাছে হোটেলের সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে যায়, এই ভয়েই হত্যা করাল রেণুকা কালী সরকারকে। অথচ ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস দেখ-কালী সরকার সজ্ঞানেই সে সম্পত্তি রামানুজকে দিয়ে গিয়েছিল উইল করেপাকাপোক্ত ভাবে।
রিয়ালি ইট ইজ অ্যান আইরনি অফ ফেট! মৃদুকণ্ঠে আমি বলি।
.
কিরীটীর অনুমানটা যে মিথ্যা নয়, সেটা ঐদিনই রাত্রে জানা গেল।
আমরা সকলে গিয়ে একসঙ্গে হানা দিলাম সী-সাইড হোটেলে।
রামানুজকে পুলিস দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিরীটীর পরামর্শে আগেই।
রেণুকা একটা চেয়ারে বসে হিসাব কষছিল আর হরডন একটা কান্ট্রি লিকারের বোতল নিয়ে মদ্যপান করছিল।
আমাদের দেখে ওরা অবাক!
কি ব্যাপার? এত রাত্রে মহান্তি সাহেব? রেণুকাই প্রশ্ন করে।
শুনে নিশ্চয়ই খুশি হবেন, কালী সরকারের হত্যাকারী ধরা পড়েছে মিসেস বিশ্বাস!
ধরা পড়েছে?
হ্যাঁ।
কে—কে? প্রশ্ন করে হরডন বিশ্বাস।
কালী সরকারের ছেলেই—
কি বললেন-কালী সরকারের ছেলে। সে তো বিয়েই করেনি। হরডন বলে।
সেটা অবিশ্যি সঠিক বলতে পারবেন কালীর ছেলের গর্ভধারিণী। রেণুকার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলে কিরীটী।
কালীর ছেলের গর্ভধারিণী—but who-কে?
রেণুকা–আপনার স্ত্রী।
What! চিৎকার করে ওঠে হরডন বিশ্বাস।
সত্যি কি মিথ্যা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিঃ বিশ্বাস।
সত্যি? বাঘের মত ঘুরে দাঁড়ায় হরডন রেণুকার দিকে–দুচোখে অগ্নিঝরা দৃষ্টি।
রেণুকা স্থির, বোবাযেন পাথর।
চুপ করে আছিস কেন হারামজাদী, বল–জবাব দে?
রেণুকা তথাপি নিপ।
হঠাৎ হরডন বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল রেণুকার উপরে-কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার করে নেতিয়ে পড়ল।
রেণুকা বিশ্বাস ছুরি বসিয়ে দিয়েছে হরডনের পেটে।
রক্তাক্ত ভূলুণ্ঠিত হরডনের দেহটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল রেণুকা।