কি বলছেন আপনি সত্যসিন্ধুবাবু! I am sure, she is dead, stone-dead!
কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে একবার দেখা দরকার এখুনি!
আমার কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের যেন এতক্ষণে খেয়াল হয়। সকলেই একসঙ্গে আমার প্রস্তাবে সায় দেয়, নিশ্চয় নিশ্চয়, চলুন চলুন সত্যসিন্ধুবাবু।
চলুন তো মহারানী! কোথায়?
আমি মহারানীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন মহারানী, না, না—আমি আর সেখানে যেতে পারব না। Dont request me, যান—আপনারা যান।
ঘরের মধ্যে তখন উপস্থিত ছিলেন শ্রীমন্ত পাল, মনোজ দত্ত, মহারানী অফ সোনপুর সুচরিতা দেবী, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, আমি ও বিশাখা চৌধুরী।
১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর
মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য তখন একটা মৃত্যুর মতই কঠিন পীড়াদায়ক স্তব্ধতা নেমে আসে।
সকলেই যেন একটা আকস্মিক আঘাতে যোবা হয়ে গিয়েছি। কারও মুখে কোন কথা নেই।
এবং সুকঠিন সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কথা বললেন শ্ৰীমন্ত পাল।
শ্ৰীমন্ত পালই জিজ্ঞাসা করেন, কোথায়? কোথায় আপনি দেখেছেন মহারানী মিত্রা সেনকে?
কামিনী ঝোপের সামনে যে বেঞ্চটা আছে, সেই বেঞ্চে—
আমিই এবার শ্ৰীমন্ত পালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, জানেন আপনি জায়গাটা মিঃ পাল?
হ্যাঁ, আসুন।
শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই অতঃপর সকলে আমরা হলঘরের এক নম্বর দরজা দিয়ে বের হয়ে লোহার সেই ঘোরানো সিঁড়িপথে উদ্যানে এসে নামলাম।
আকাশের পঞ্চমীর চাঁদ। মৃদু চন্দ্রালোকে উদ্যানটার মধ্যে একটা আলোছায়ার রহস্য যেন গড়ে তুলেছে। অদ্ভুত স্তব্ধ চারধার।
শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই সকলে আমরা অগ্রসর হলাম। উদ্যানের একেবারে পূর্ব কোণে গোটা দুই কামিনী ফুলের গাছ পাশাপাশি ডালপালা ছড়িয়ে একটা ঝোপ সৃষ্টি করেছে। সেই ঝোপটা ঘুরে সামনে এগিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম।
মৃদু চন্দ্রালোকে যে দৃশ্য আমার চোখে পড়ল আজও আমার যেন তা স্পষ্ট মনে আছে।
লোহার ব্যাকওয়ালা একটা বেঞ্চ। তারই একধারে উপবিষ্ট ভঙ্গীতে দেখলাম মিত্রা সেনকে।
মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে। হাত দুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা। পরিধানের সাদা জর্জেটের জরি ও চুমকি বসানো আঁচলটা বুকের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে। চাঁদের আলোয় সেই আঁচলার জরির কাজ ও চুমকিগুলো যেন চিকচিক করে জ্বলছে!
আশেপাশে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
স্তিমিত চন্দ্রালোকে সমস্ত দৃশ্যটা এমনি করুণ যে, কয়েক মুহূর্ত কারও কণ্ঠ থেকে যেন স্বরটুকু পর্যন্ত বের হয় না। মৃত্যুর হাতে কি মর্মান্তিক করুণ আত্মসমর্পণ! মিত্রা সেনের সমস্ত দম্ভ, আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্য যেন নিঃশেষে তার শেষ করুণ ভঙ্গিটির মধ্যে নিবিড় এক আত্মসমর্পণে ধ্যানস্থ হয়ে আছে।
নির্বাক চিত্রার্পিতের মত মৃতের চারিপাশে সব দাঁড়িয়ে।
ধীরে ধীরে আমিই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম উপবিষ্ট মৃতদেহের সামনে সর্বপ্রথম। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার ভাল করে তাকালাম মৃতার দিকে।
তারপর একসময় আবার ঘুরে গিয়ে দাঁড়ালাম মৃতের পশ্চাতের দিকে। এবং হঠাৎ সেই সময় নজরে পড়ল সেই মৃদু চন্দ্রালোকে মাটিতে কি একটা বস্তু চকচক করছে। কৌতূহলভরে নিচু হয়ে দেখতে যেতেই বুঝলাম সেটা একটা ছোট কাঁচের পেগ গ্লাস।
সন্তর্পণে মাটি থেকে পেগ গ্লাসটা তুলে নিলাম।
আমার হাতে পেগ গ্লাসটা দেখে অস্ফুটকণ্ঠে ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত বললেন, পেগ গ্লাস না?
হ্যাঁ।
গ্লাসটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই একটা আলতো অ্যালকহলের গন্ধ আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল।
মনোজ দত্তই আবার কথা বললেন, মিস সেন তো কখনও ড্রিঙ্ক করতেন না! পেগ গ্লাস এখানে এল তবে কি করে?
মনোজ দত্তর কথায় মনে পড়ল, সত্যিই মিত্রা সেনকে আজ পর্যন্ত কখনও ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি এবং বিশাখার মুখেই শুনেছি তিনি ড্রিঙ্ক করেন না কখনও। এবং বৈকালী সঙ্ঘের সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা আদপেই নাকি পছন্দ করতেন না। এমন কি তিনি দু-একবার এমন প্রস্তাবও নাকি তুলেছিলেন যে, বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা একেবারে তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু অন্যান্য সভ্য ও সভ্যাদের প্রতিবাদের জন্যই সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি আজও।
সেই মিত্রা সেনের রহস্যপূর্ণ আকস্মিক হত্যার অকুস্থানে পেগ গ্লাস তাহলে এল কি করে!
আর শুধু তাই নয়, পেগ গ্লাসটার মধ্যে এখনও সদ্য অ্যালকোহলের গন্ধ জড়িয়ে আছে।
পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সেই রুমালের মধ্যে অত্যন্ত সন্তর্পণে পেগ গ্লাসটা জড়িয়ে পকেটের মধ্যে আবার রেখে দিলাম।
মনোজ দত্ত ও আমার মধ্যে হঠাৎ দু-একটা কথাবার্তার শব্দের পরই যেন অকস্মাৎ সব আবার নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।
মৃদু চালোকে একবার আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান নির্বক নিশ্চল নরনারীদের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল কেউ যেন তারা জীবিত নয়। কতকগুলো পটে আঁকা ছবি মাত্র আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
পকেট থেকে এবারে সরু পেনসিল-টচটা বের করে মৃতার আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে ডান হাতে টর্চটা জ্বেলে বাঁ হাত দিয়ে মিত্রা সেনের চিবুকটা স্পর্শ করতেই একটা বরফ-শীতল বিদ্যুৎ-স্পর্শে যেন হাতের আঙ্গুলগুলো আমার শিহরিত হল।