মুশকিল তো সেখানেই হয়েছে। তবু তোকে আমি স্পষ্ট বলছি ওদের মধ্যে তিনজন সম্পর্কে আমার মনে যথেষ্ট দ্বিধা আছে।
কোন্ তিনজন?
এক নম্বর হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তী, দু নম্বর ওয়েটার মীরজুমলা ও তিন নম্বর মক্ষীরানী শ্রীমতী মিত্রা সেন।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে প্রশ্ন করল, আর কারও ওপর তাহলে তোর সন্দেহ নেই?
না।
কিন্তু আমি হলে যতটুকু তোর মুখে শুনলাম তা থেকে আরও একজনের সম্পর্কে বেশ একটু বেশী রকমই চিন্তিত হতাম, সজাগ থাকতাম!
কে? কার কথা বলছিস?
একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবি, কার কথা আমি বলতে চাই।
কিন্তু—
কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, আমাকে বলে দিতে হবে না—চোখ মেলে রাখ, নিজেই দেখতে পাবি।
বাইরে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। সতর্ক পদশব্দ।
কে?
সমীরণ!
এস সমীরণ, ভেতরে এস।
কিরীটীর আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়েসী ভৃত্যশ্রেণীর একজন লোক ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। কিন্তু ভৃত্যশ্রেণীর হলেও বেশভূষায় ও চেহারায় একটা ধনীগৃহের ভৃত্যের ছাপ আছে। পরিষ্কার একটি ধুতি পরিধানে, গায়ে তদ্রপ একটি ফতুয়া ও পায়ে একটা চপ্পল। মাথার চুল কাঁচা-পাকায় মেশানো, দাড়িগোঁফ কামানো। কপালের উপরে ঠিক দক্ষিণ জ্বর উপরে একটা বড় আব আছে।
বোসো। আগন্তুককে কিরীটী তার সামনেই একটা সোফার উপরে বসবার জন্য নির্দেশ জানাল।
প্রথমত ভূত্যের নাম সমীরণ ব্যাপারটা আমার মনে কেমন একটু খটকা লাগিয়েছিল, তারপর তাকে কিরীটীর সাদর আহ্বান আমাকে বিশেষ কৌতূহলী করে তোলে।
লোকটা সোফার উপরে সবে একটিবার মাত্র আড়চোখে আমার দিকে তাকাতেই দুজনের আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল এবং মুহূর্তের তার সেই চোখের দৃষ্টিতেই যেন একটা সন্দেহের বিদ্যুতের ইশারা পেলাম।
সুব্রতকে তুমি চেন না সমীরণ? দেখনি ওকে কোনদিন?
সুব্রতবাবু! নমস্কার! বলে সমীরণ এবারে পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবারে। বলে, নাম শুনেছি ওঁর তবে দেখা-সাক্ষাৎ হবার সৌভাগ্য হয়নি।
কিরীটী এবারে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সমীরণ সরকার ইউ পির স্পেশাল ব্রাঞ্চে ছিল, মাসখানেক হল বাংলা দেশে বদলি হয়ে এসেছে।
আমি প্রতিনমস্কার জানালাম।
পরে জেনেছিলাম জ্বর উপরে ঐ আবটি দেহের পোশাক ও মাথার চুলের মতই অবিশ্যি ছদ্মবেশের উপকরণ।
বয়েসেও আমাদের চাইতে ছোট বলে সমীরণের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, কিন্তু এভাবে দিনের বেলায় আমার এখানে আসাটা কিন্তু তোমার উচিত হয়নি সমীরণ।
কিরীটী পরিচয় দেবার পর আমি প্রশংসমান দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলাম সমীরণ সরকারের দিকে। নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়েছেন বটে ভদ্রলোক।
উপায় কি? সমীরণ প্রত্যুত্তরে তখন কিরীটীকে বলছিলেন, এই সময়টাই হচ্ছে বেস্ট সময়। ডাক বা খোঁজ পড়বে না। আর তিনি বাড়িতেও থাকেন না এ সময়টা।
না, তাহলেও অন্যায় হয়েছে। তুমি তাকে চেন না সমীরণ। অত্যন্ত প্রখর দৃষ্টি লোকটার।
সে অবিশ্যি আমিও যে লক্ষ্য করিনি তা নয়। অতি সাধারণ গতিবিধির মধ্যেও কোথায় যেন একটা নিঃশব্দ সজাগ ও সতর্ক আসা-যাওয়া আছে যা চট করে কারোরই নজরে পড়বে না।
যাক। এখন এ কদিনের অবজারভেশনে কি জানতে পারলে বল?
সমীরণ সরকার তখন বলতে শুরু করে।
আপনি ঠিকই সংবাদ পেয়েছিলেন মিঃ রায়। বাড়িতে নিজেদের বলতে ডাক্তার, তাঁর বিকলাঙ্গ ভাই ত্রিভঙ্গ, ত্রিভঙ্গের স্ত্রী মৃদুলা—
নামগুলো শুনেই চমকে উঠলাম। ত্রিভঙ্গ মানে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর বিকলাঙ্গ ভাই নয় তো?
কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। বললে, ভুজঙ্গ ডাক্তারের একজন ভৃত্যের প্রয়োজন ছিল, ব্যাপারটা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরে ডাক্তারের এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সুপারিশে সমীরণকে সেখানে ভৃত্যের চাকরিটি করিয়ে দিয়েছি। কিরীটী আবার সমীরণের দিকে তাকিয়ে বললে, তারপর কি বলছিলে বল, সমীরণ!
বলছিলাম ঐ মৃদুলা দেবীর কথাই। সমীরণ তার বক্তব্য আবার শুরু করে, ভদ্রমহিলার বয়স আমার কিন্তু মনে হয় তার স্বামী ত্রিভঙ্গের চাইতে এক-আধ বছর বেশী না হলেও সমবয়সীই হবে প্রায়। এবং ডাক্তারের গৃহের সর্বময় কর্তৃত্ব তারই হাতে। কিন্তু বয়স তার যাই হোক, যৌবন তার দেহে এখনও অটুট আছে। দেখতে কালো এবং রোগাটে বটে তবে সে কালোর মধ্যে আছে একটা আশ্চর্য রকমের যৌবনদীপ্ত শ্ৰী। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য তার চোখ দুটি। বুদ্ধির একটা অদ্ভুত জ্যোতিও সে চোখের তারায়।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ত্রিভঙ্গ লোকটি অত্যন্ত শান্তশিষ্ট। গোবেচারী টাইপের। দোতলার একটা ঘরে সর্বদাই বই নিয়ে পড়ে আছে। বাড়ি থেকে তো দূরের কথা, সেই ঘরে থেকেই বড় একটা বের। হয় না। নিজের দাদার সঙ্গে তো নয়ই, স্ত্রীর সঙ্গেও বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
ত্রিভঙ্গের স্ত্রী মৃদুলা আলাদা ঘরে থাকে, না একই ঘরে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
স্বামী স্ত্রী আলাদা আলাদা ঘরে থাকে। বাড়িটা তিনতলা হলেও বাড়ির মধ্যে ঘর সর্বসমেত আটটি। অবশ্য রান্নাঘর, স্টোররুম বাদ দিয়ে। একতলা ও দোতলায় তিনখানি করে ছয়খানি ঘর; তিনতলায় দুখানি ঘর। তিনতলায় দুখানা ঘর নিয়ে থাকেন ডাঃ চৌধুরী, ডাঃ চৌধুরী যখন থাকেন না সে দুটি ঘরে তালা দেওয়াই থাকে দেখেছি।