ইরিনা সংক্ষেপে ওকে জানাল, প্রবলেম’টা কী।
ততক্ষণে কুমারমঙ্গলম দরজাটা ঠেলেঠুলে আরও খানিকটা ফাঁক করে ফেলেছে। এবং সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে ভেতরে।
পরক্ষণেই কুমারমঙ্গলমের মাথা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এবং ওর মুখের চেহারা এখন দেখবার মতো।
শ্যামলা মুখ থেকে রক্ত সরে যাওয়ায় ছাইরঙা ফ্যাকাসে লাগছে। ছোট-ছোট বুদ্ধিদীপ্ত চোখে বুদ্ধির দীপ্তির বদলে ভয় আর অবিশ্বাসের কুয়াশা। ওর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না।
ইরিনা আর সাবরিনা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কুমারমঙ্গলমের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ওরা বেশ বুঝতে পারছিল, কুমারমঙ্গলম ওদের খারাপ কিছু শোনাতে চলেছে।
বেশ কয়েকমিনিট জিভ আর ঠোঁট নিয়ে ধস্তাধস্তির পর কুমারমঙ্গলমের মুখ দিয়ে কয়েকটা মারাত্মক শব্দ বেরিয়ে এল। চাপা অস্পষ্ট গলায় ও বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি ইজ ডেড। আই থিং হি হ্যাজ বিন শট।’
তার মানে!—অবাক হয়ে ভাবল ইরিনা আর সাবরিনা : বন্ধ টয়লেটের ভেতরে মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ গুলি করেছে। ইমপসিবল! এ হতেই পারে না!
টয়লেটের দরজাটা আবার টেনে ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুমারমঙ্গলম ইরিনাকে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে খবর পাঠিয়েছিল যে, একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন অ্যারাইজ করেছে। ক্যাপ্টেন যদি একবার আসেন তা হলে খুব ভালো হয়।
খবরটা পাওয়ামাত্রই ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি চলে এসেছেন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের কাছে।
অর্জন সিনিয়ার পাইলট। ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এ আছেন প্রায় পাঁচবছর। শক্তসমর্থ পেটানো শরীর। ঠান্ডা চোখ আর চৌকো চোয়াল যেন বলে দিচ্ছে অর্জন সুখানিকে টলানো বড় সহজ ব্যাপার নয়।
ফ্লাইট ডেক থেকে অর্জন যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের অলিপথ দিয়ে হেঁটে আসছিলেন, তখন ওঁর ঠোঁটে ছিল পেশাদারি স্মিত হাসি, আর একই সঙ্গে প্যাসেঞ্জারদের লক্ষ করে ছোট-ছোট ‘নড’ করছিলেন।
বাইরের ভাবটা এরকম বজায় রাখলেও অর্জনের মনে ছিল বিরক্তি। কারণ, উড়ান সময়ের একঘণ্টা পার হয়ে গেছে…এখন এই ঝামেলার জন্য যদি কোনও এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে হয় তা হলে প্রচুর সময় নষ্ট হবে। কলকাতায় পৌঁছতে কত দেরি হবে কেউ বলতে পারে না। আর কাছাকাছি এয়ারপোর্ট বলতে বিশাখাপত্তনম। সুতরাং, সেখানকার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এর চিফ ফ্লাইট ম্যানেজারের সঙ্গেও। আবার, যদি তিনি বলেন তা হলে হয়তো চেয়ারম্যান কি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে অর্জনকে কথা বলতে হবে।
ইতিমধ্যে কুমারমঙ্গলম এক্সিকিউটিভ ক্লাসের প্যাসেঞ্জারদের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছে যে, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করা যাবে না। প্যাসেঞ্জাররা যেন ইকনমি ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করেন। এই অপ্রত্যাশিত অসুবিধে তৈরি হওয়ার জন্য ‘আকাশ এয়ারলাইনস’ দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন সুখানি বুঝলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। কারণ, কুমারমঙ্গলম, ইরিনা এবং সাবরিনার মুখের চেহারা সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কুমারমঙ্গলমকে অর্জন বেশ ভালো করেই জানেন। ছেলেটা বছরদুয়েক ধরে অর্জনের সঙ্গে ফ্লাই করছে। চটপটে, ঠাট্টা-রসিকতার সমঝদার, বুদ্ধিমান। কিন্তু এখন ওকে দেখে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আর ইরিনা, সাবরিনা যেন দুই যমজ বোন—কারণ, দু-জনেরই মুখ ফ্যাকাসে, বিহ্বল, ভয়ে দিশেহারা।
অর্জন ওদের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে টয়লেটের লক-ভাঙা দরজার দিকে তাকালেন : ‘এই টয়লেটটায়?’
‘হ্যাঁ—।’ কুমারমঙ্গলম জবাব দিল।
নিজের শরীরের ভার দরজাটার ওপরে ছেড়ে দিয়ে চাপ দিলেন ক্যাপ্টেন। দরজাটা ফাঁক হল আবার। সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলেন।
মদনমোহন চ্যাটার্জির দেহটা টয়লেট-সিটের ওপরে এলিয়ে রয়েছে। পোশাক-আশাক ফিটফাট। দুটো হাত অসাড় হয়ে দু-পাশে ঝুলছে। পাদুটো ছড়িয়ে রয়েছে সামনের দিকে। পায়ে আটকে যাওয়ার জন্যই দরজাটা পুরোপুরি খোলা যাচ্ছে না।
নিস্পন্দ দেহটার বাকি অংশের চেহারা যাচ্ছেতাইরকমের বীভৎস।
মুখ থেকে বুক পর্যন্ত রক্ত-মাংস-হাড় তালগোল পাকিয়ে ছড়িয়ে আছে। দু-গাল থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মাংসের টুকরো ঝুলছে। রক্ত ছিটকে লেগেছে দু-পাশে দেওয়ালে। ঠিক মনে হচ্ছে, একটা স্কন্ধকাটা মূর্তি টয়লেট-সিটের ওপরে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে।
অর্জন সুখানির শরীরের ভেতরটা কেমন পাক দিয়ে উঠল। বমির দমক উথলে উঠতে চাইল গলা দিয়ে। কিন্তু প্রবল চেষ্টায় তিনি সেটা রুখে দিলেন।
কুমারমঙ্গলম আগেই ওঁকে বলেছিল যে, মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ মুখে গুলি করেছে। সেইজন্যই অর্জন টয়লেটের মেঝেতে জরিপ নজর বুলিয়ে নিলেন। না, কোনও পিস্তল কিংবা রিভলভার চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা একটু অবাক করার মতো। তাই আরও একবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন সুখানি। এমনকী, বডির দু-পাশে শিথিলভাবে ঝুলে-থাকা দুটো হাতের মুঠোও ভালোভাবে নজর করে দেখলেন।
না, মুঠোয় কোনও অস্ত্র ধরা নেই।
মিস্টার চ্যাটার্জি যখন সুইসাইড করেছেন তখন অস্ত্রটা নিশ্চয়ই টয়লেটের কোথাও-না-কোথাও পড়ে থাকবে। সেটা দেখতে না পেয়ে অর্জন সুখানির ভুরু কুঁচকে গেল। এছাড়াও কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। কিন্তু গরমিলটা সুখানিকে বারবার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।