‘দেবারতি হুমকি দিয়ে শাসিয়ে চলে যাওয়ার পর রত্নাবলী বোধহয় দুশ্চিন্তায় পড়েন। তারপর, একটা প্ল্যান ছকে নিয়ে, সেদিনই রাত দশটা নাগাদ দেবারতিকে আবার নিজের ঘরে ডাকেন। অর্থাৎ, সমঝোতা ইত্যাদির নাম করে মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলেন। তারপর স্লিপিং পিল মেশানো হুইস্কি খাইয়ে ওকে অজ্ঞান করে দেন। দেবারতির সঙ্গে বোধহয় কোনও ব্যাগ ছিল—আর ব্যাগেই ছিল ওর ঘরের চাবি। রত্নাবলী ওর ব্যাগটা নিয়ে নিজের ঘর বন্ধ করে চলে আসেন দেবারতির ঘরে। চাবি দিয়ে দরজা খুলতে কোনও অসুবিধে হয়নি ওঁর। তারপর পশ্চিমের বড় জানলাটা খোলার ব্যবস্থা করে গোল টেবিলটাকে সরিয়ে নিয়ে যান জানলার কাছে। টেবিলের কাগজপত্র ঘেঁটে দেবারতির অসমাপ্ত লেখাটা দেখতে পান। আর ঠিক সেই সময়েই হয়তো উৎপলেন্দু সেন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এসে ডাকাডাকি শুরু করেন ঘরের দরজায়।
‘রত্নাবলীর তখনকার মনের অবস্থাটা আপনারা সকলে একবার ভেবে দেখুন। ওপরের তলায় ওঁর ঘরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে এক দুর্বিনীত জার্নালিস্ট—যে সুযোগ পেলেই সারা দুনিয়াকে রহস্য-সম্রাজ্ঞীর রহস্য জানিয়ে দেবে। চুরমার করে দেবে ওঁর মান-সম্মান, তছনছ করে দেবে ওঁর এতদিনের সাজানো বাগান। অর্থাৎ, রত্নাবলী ধ্বংস হয়ে যাবেন…চিরকালের জন্যে। সুতরাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন রত্নাবলী। একজন বয়স্ক গৃহবধূ শুধুমাত্র নিজের, নিজের পরিবারের, সামাজিক সম্মান আর প্রতিষ্ঠা অকলঙ্ক রাখার জন্যে কী করুণভাবে হিংস্র হয়ে উঠলেন! করুণ বলছি এই কারণে যে, ওঁর সেই অবস্থার কথা ভাবলে করুণা ছাড়া আর কোনও শব্দ মনে আসে না।
‘যাই হোক…উৎপলেন্দুবাবুকে সামাল দিয়ে রত্নাবলী দেবারতির লেখাটার শেষ দুটো লাইন কেটে দেন ওরই পেন দিয়ে। আমার ধারণা, ওই দুটো লাইনের কোথাও হয়তো রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের কীর্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু লেখাটা একেবারে লোপাট করতে ভরসা পাননি তিনি। কারণ, দেবারতি হয়তো পরিচিত অনেককেই বলে রেখেছে যে, ও একটা লেখা লিখছে। লেখাটা হয়তো ও কনফারেন্সের শেষ দিনে—মানে, আজ—পড়ার মতলব করেছিল। সুতরাং সেই লেখা যদি ওর ঘর থেকে খুঁজে না পাওয়া যায় তা হলে মুশকিল হতে পারে। আবার ওই লেখা অর্ধেকটা লিখে কেউ যে আচমকা আত্মহত্যা করতে পারে না, সেটাও তো ঠিক। তাহলে? সেই মুহূর্তে বিপর্যস্ত রত্নাবলী কী করবেন বুঝে উঠতে পারেননি। ওঁর তখন উদভ্রান্ত অবস্থা। তাই আধখোলা ”দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড” নিয়েও তিনি কিছু ভেবে ওঠার সুযোগ পাননি…।’
একটু হাসলেন এসিজি। কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘তা ছাড়া খুনি একটু-আধটু ভুল না করলে আমাদেরই বা চলে কী করে!…হ্যাঁ, যা বলছিলাম…দেবারতি মানির ব্যাগটা বিছানার ওপরে রেখে দিয়ে চাবিটা নিয়ে তিনশো আট নম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন রত্নাবলী। ঘরের দরজা বাইরে থেকে লক করে সোজা চলে যান নিজের ঘরে। অজ্ঞান দেবারতিকে টেনেহিঁচড়ে অতিকষ্টে নিয়ে যান জানলার কাছে। তারপর ওকে জানলা দিয়ে ফেলে দেন সোজা নীচে—ভাস্করবাবুর গাড়ির ছাদে।
‘রত্নাবলী খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু ওঁর বিশ্রাম নেওয়ার সময় ছিল না। কারণ, আরও একটা জরুরি কাজ তখনও বাকি। সেটা হল : দেবারতির ঘরের চাবিটা ওর ঘরে পাঠানো। সুতরাং, তাড়াতাড়ি একটা লম্বা সুতো নিয়ে ছুঁচে সুতো পরানোর মতো দেবারতির চাবির রিঙে পরিয়ে দিলেন রত্নাবলী। সুতোর দুটো মাথা এক করে—মানে, ঠিক যেভাবে রঞ্জন দেবনাথ খুনির দড়ি বেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি আমাদের শুনিয়েছিলেন—চাবির রিংটাকে জানলা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন বাইরে। তারপর সেটাকে সামনে পেছনে দোল খাইয়ে কিছুক্ষণের চেষ্টায় চাবিটাকে দেবারতির জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন ঘরের ভেতরে। রত্নাবলীর প্ল্যানমাফিক চাবিটা গিয়ে পড়ল টেবিলের ওপরে, তবে মেঝেতে পড়লেও কোনও ক্ষতি ছিল না। এইবার সুতোর একটা মাথা ছেড়ে দিয়ে অন্য মাথাটা ধীরে-ধীরে টানতে শুরু করলেন তিনি। একসময় লম্বা সুতোটা চলে এল ওঁর হাতে, আর চাবিটা পড়ে রইল ভেতর থেকে লক করা ঘরের মধ্যে : জন্ম নিল ”বন্ধ ঘরের রহস্য।” সব কাজ শেষ হওয়ার পর রত্নাবলী ধকল কাটাতে দু-এক ঢোঁক হুইস্কি হয়তো খেয়েও থাকতে পারেন—ঠিক বলতে পারব না।’
ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে কয়েকবার কাশলেন এসিজি। তারপর বললেন, ‘আজ সকালে তাঁর লেখালিখি নিয়ে ভাস্করবাবু আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে একটা কথা ছিল অনেকটা এইরকম :…রহস্যের প্রত্যেকটি টুকরোকে কল্পনার সুতোয় গেঁথে খুশিমতো খেলিয়ে…ইত্যাদি-ইত্যাদি। এই কথাটা শুনেই আমার বিগড়ে যাওয়া থিঙ্কিং মেশিন মুহূর্তে ঠিকঠাক হয়ে যায়। চাবি জানলা দিয়ে ঢোকানোর রহস্যটা পলকে ফাঁস হয়ে যায় আমার কাছে। এ-জন্যে ভাস্করবাবুর কাছে আমি ঋণী।’
ভাস্কর রাহার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোঁকালেন এসিজি।
উত্তরে ভাস্কর ছোট্ট করে হাসলেন।
‘আশা করি আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব আপনারা পেয়ে গেছেন?’ এসিজি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সকলের জন্য।
উত্তরে উৎপলেন্দু বললেন, ‘না, একটা প্রশ্নের জবাব পাইনি। কে সেই ছায়ালেখক? আমাদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয়ই?’