উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক কোথায়? এস্থলে স্মরণে আনি, সুইটজারল্যান্ড দেশের বের্ন শহরে সর্বপৃথিবীর লেখকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সমাগত বিভিন্ন দেশ কপিরাইট সম্পর্কে কতকগুলি আইন প্রণয়ন করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেসব দেশ এসব আইনে (সংক্ষেপে বের্ন কনভেনশন) দস্তখত দেবেন তারা একে অন্যের কপিরাইট মেনে চলবেন। যেমন কোনও ভারতীয় প্রকাশক বিনানুমতিতে গত মাসে লন্ডনে প্রকাশিত, সর্বস্বত্বরক্ষিত কোনও পুস্তক ছাপতে পারবেন না। কত বৎসর পরে মূলগ্রন্থ, কত বৎসর পরে তার অনুবাদ বিনানুমতিতে ছাপতে পারা যায়, সে বিষয়ে মূল আইনকে কিঞ্চিৎ সীমাবদ্ধ, প্রসারিত, সংশোধিত করা হয়েছে।
পাকিস্তান বের্ন কনভেনশনের মেম্বার হল না। বাংলাদেশ হয়েছে কি না, জানিনে।
তার কারণ অতি সরল। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু বই না হলে পাঞ্জাবের চলে না। সেগুলো ছাপা হয় ভারতে, কপিরাইট ভারতীয় লেখকের। কাড়ি কাড়ি ফরেন কারেনসি চলে যায় ভারতে, এগুলো কিনতে গিয়ে। সে বইগুলো যাতে নির্বিঘ্নে, ভারতীয়দের কোনওপ্রকারের রয়েলটি না দিয়ে লাহোরে ছাপানো যায় সেই মতলব নিয়ে পাকিস্তান বের্ন কনভেনশনের মেম্বার হয়নি।
কিন্তু বললেই তো আর হয় না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, লাহোর কোনওকালেই উর্দুর পীঠস্থান ছিল না। তাই ফাউন্ডারি ছাপাখানা, কাগজ নির্মাণ, প্রুফ রিডার ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো রকমের জিনিস এবং মানুষ লাহোরে আছে অতি অতি অল্প, বহু বস্তু আদৌ ছিল না। এগুলো তো আর রাতারাতি গড়ে তোলা যায় না।
ঢাকাও সঙ্গে সঙ্গে সেই বিপদেই পড়ল। কিন্তু লাহোরের তুলনায় সে কিছুই নয়। কারণ ঢাকার ভাষা বাংলা, সাহিত্য বাংলা। লাহোরে বাস করে যদি একজন উর্দু লেখক, তবে ঢাকায় অন্তত দশজন বাঙলা লেখক। বর্ধমান যেমন কলকাতার আওতায় ছিল, ঢাকাও তাই ছিল। লাহোর সেরকম উর্দুভূমির আওতায় কোনও কালেই ছিল না। গোড়ার দিকে ঢাকার কুমতলব ছিল না, বেন কনভেনশনের পুটায়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ফাঁকি দিয়ে তাদের বই ছাপানো। তাদের প্রধান শিরঃপীড়া ছিল, আপন পাঠ্যপুস্তক রচনা করা, ছাপানো ইত্যাদি। তদুপরি পাঠ্যপুস্তকে প্রবন্ধ কবিতা সঞ্চয়নে ঢাকার ভাবনা অনেক কম। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, মাইকেল, হেমচন্দ্র ইত্যাদি বিস্তর ক্লাসিক লেখকের কপিরাইট ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছে কিংবা যাব যাব করছে। বের্ন থাক আর না-ই থাক– ঢাকা তার পাঠ্যপুস্তকে এঁদের লেখা তুলে ধরলেই তো যথেষ্ট। উপস্থিত না-ই বা থাকলেন শরৎচন্দ্র বা তারাশঙ্কর। উঠেপড়ে লেগে গেল ঢাকা পিছনে কবি, গল্পলেখক অসংখ্য না হলেও নগণ্য নয়, তদুপরি ঢাকা বিরাট পূর্ব পাকের রাজধানী। লাহোর পশ্চিম পাকের রাজধানী তো নয়ই, যে পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান নগর সে-ও তেমন কিছু বিরাট প্রদেশ নয়।
লাহোর কোনও উন্নতি করতে পারছে না দেখে তাকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে উৎসাহিত করার জন্য এক ঝটকায় ব্যান করে দেওয়া হল তাবৎ ভারতীয় পুস্তকের আমদানি। পাঞ্জাবি কর্তাদের অনুরোধে করাচির বড় কর্তারা অবশ্য ব্যান করার সময় ভেবেছিলেন উর্দু বইয়ের কথা। কিন্তু ফাঁদে পড়ে গেল পশ্চিম বাঙলার বইও। অর্ডারটা অবশ্য খুব খোলাখুলি দেওয়া হয়েছিল কি না জানিনে।
কিন্তু সেটা ফাঁস হয়ে গেল সেই যে ছোট্ট মাদ্রাসাটির কল্যাণে। তারা পড়ল সমূহ বিপদে। তাদের আরবি-ফারসি পাঠ্যপুস্তক ছাপবার জন্য আরবি অক্ষরের ফাউন্ডারি, প্রেস, প্রুফরিডার কোথায়? যে উত্তর প্রদেশের সর্বোচ্চ মাদ্রাসায় প্রচুর আরবি বই কিনত সেই উত্তর প্রদেশে মাত্র একটি আরবি প্রেসের নাম সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। নওলকিশোর প্রেসের মালিক ছিলেন আরবি-ফারসি-উর্দুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল জনৈক হিন্দু। এ অধম শৈশবে ঈশ্বর নওলকিশোরের ছাপা পুরাণ দিয়েই পাঠারম্ভ করে। খুদ মক্কাশরিফে একদা তাঁরই কুরান বিক্রি হত।
আরবি পুস্তক ব্যান করার বিরুদ্ধে মোল্লারা করলেন তীব্র প্রতিবাদ। সেটা প্রকাশিত হল এক উর্দু সাপ্তাহিক-এ। করাচির ইংরেজি ডন করল সেটার অনুবাদ। সেটা খবর হিসেবে প্রকাশিত হল কলকাতায়। তখন আমরা জানতে পারলুম, পশ্চিম বাংলার বই কেন ঢাকা যাচ্ছে না।
ইতোমধ্যে জুট-চা একসপ্লয়েটকারী লাহোরের চা-ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে, পুব বাঙলার বুক-মার্কেট কীভাবে একসপ্লয়েট করা যায়। সে-ও এক মজাদার কেচ্ছা।
.
উভয় বঙ্গে– আধুনিক গদ্য কবিতা
পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ পাঠক গদ্য কবিতা (গবিতা ও গবি বিপ্রকর্ষণ অসৌজন্যবশত নয়) সম্বন্ধে সবিশেষ কৌতূহলী না হলেও গবিকুল ও তাদের চক্র যে প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে গবিতা রচনা করেন, সাপ্তাহিক রবিবাসরীয় ছয়লাপে ভাসিয়ে দেন, সর্ববিধ ব্যঙ্গ কৌতুক চরম অবহেলাসহ উপেক্ষা করে এলিয়ট, পাউন্ড নিয়ে গভীর আলোচনা, তুমুল তর্কবিতর্কে মত্ত হন, এসব গ্র্যান্ডমাস্টারদের গবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন এবং বহু ক্ষেত্রে কষ্টার্জিত কার্ষাপণ ব্যয় করে ওইসব মহামূল্যবান রত্নরাজি রসিক-বেরসিক সকলের সামনে তুলে ধরেন, এসব কাণ্ডকারখানা দেখে সবিস্ময়ে মন ধায় একাধিক সাহিত্যের ইতিহাস অনুসন্ধান করে তুলনীয় একটা বিরাট আন্দোলন আবিষ্কার করতে। বহুতর প্রচেষ্টার পর দেখি, পঞ্জিকার ভাষায় সর্বদিকে যাত্রা নাস্তি। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ঝাঁকে ঝাঁকে কবি জমায়েত হতেন, গজনির মাহমুদ বাদশাহ ধনদৌলত লুট করার সময় দু-চারটে কবি লুট করতে লুষ্ঠিত হতেন না, মঙ্গোলদের সর্বনাশা দিগ্বিজয়ের ফলে হাজার দুত্তিন ইরানি কবি মোগল দরবারে আশ্রয় পান। একসঙ্গে একই দরবারে দুই তিন হাজার কবি। তৎসত্ত্বেও পরিষ্কার দেখতে পাই, এঁরা স্থায়ী-অস্থায়ী কোনওপ্রকার আন্দোলনের সূত্রপাতটুকু পর্যন্ত করতে পারলেন না। পক্ষান্তরে এই দীন পশ্চিমবঙ্গ সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ, পাঠক-সাধারণ কর্তৃক অবহেলিত গবিকুল কী প্রচণ্ড তেজে নয়া এক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তস্মাৎ প্রণমা-প্রণিধায় কায়ং। অতিশয় সত্য যে ন তৎসমোস্তৎ ভ্যধিকঃ কুতোৎনো।