- বইয়ের নামঃ শহর-ইয়ার
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০১. কাঁথার মতো চুল
০১.
যৌবনে আমার মাথায় ছিল কাঁথার মতো চুল। সেলুনের তো কথাই নেই, গায়ের নাপতে পর্যন্ত ছাঁটতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেত। কাজেই সমস্ত অপারেশনটা এমনই দীর্ঘস্থায়ী আর একঘেয়ে লাগত যে আমি ঘুমের বড়ি খেয়ে নিয়ে সেলুনে ঢুকতুম। চুলকাটা শেষ হলে পর সেলুনের নাপতে ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। সেদিনও হয়েছে তাই। কিন্তু ইয়াল্লা, আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি চুলের যা বাহারে কট দিয়েছে সে নিয়ে চিতা-শয্যায় পর্যন্ত ওঠা যায় না, ডোম পোড়াতে রাজি হবে না। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে। মহা বিরক্তি আর উম্মা গোস্সাসহ রাস্তায় নাবলুম।
ঠিক যে ভয়টি করেছিলুম তাই। দশ পা যেতে না যেতেই পাড়ার উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা। উভয়েই থমকে দাঁড়ালুম। আমার মস্তকে তখন বজ্রপাত হলে আমি বেঁচে যেতুম– উত্তমকুমার তা হলে সে বাহারে হেয়ার কট দেখতে পেত না। কিন্তু আমি জানি, আপনারা পেত্যয় যাবেন না, উত্তম শুধোলে, খাসা ফ্যাশানে চুলটা হেঁটেছ তো হে– সেলুনটা কোথায়? তোমার আবিষ্কার বুঝি? গোড়ায় ভেবেছিলুম বাবু আমাকে নিয়ে মস্করা করছেন। পরে দেখলুম, না। সে গড় ড্যাম সিরিয়স।
সেইদিন থেকে একটি বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়ে গিয়েছি। যা-ই করো, যা-ই পরো, কেউ না কেউ সেটার প্রশংসা করবেই। এমনকি যা-ই লেখ না কেন– সে লেখা সাগররমাপদমণীন্দ্রা সবাই ফেরত পাঠানোর পরও দেখবে, সেটি লুফে নেবার মতো লোকও আছে।
তাই আমার বিশ্বাস, কোনটা যে সরেস সাহিত্য আর কোনটা যে নিরেস সে সম্বন্ধে হলপ করে কিছু বলা যায় না। যদি বলেন, সবাই অমুকের লেখার নিন্দা করছে তবে আমি উত্তর দেব : প্রথমত ভোট দিয়ে সাহিত্য বিচার করা যায় না (এমনকি রাশায় নাকি একবার গণভোট প্লেবিসিট নেওয়া হয়, ভগবান আছেন কি নেই এবং ভগবান শতকরা একটি ভোট পান!), দ্বিতীয়ত, ভালো করে খুঁজলে নিশ্চয়ই সে লেখকের তারিফদার পাঠকও পাবেন।
তাই আমার পরের স্টেপ : সরেস সাহিত্যিক এবং নিরেস সাহিত্যিকে পার্থক্য করা অসম্ভব।
অবশ্য আপনারা নিশ্চয়ই বলতে পারেন, আমি নিরেস সাহিত্যিক বলে এই মতবাদটি প্রচার করছি। আমি ঘাড় পেতে মেনে নিলুম।
মেনে নিয়েছি বলেই ট্রেনে-প্লেনে বিশেষ করে ট্রেনে আমি আমার পরিচয় দিইনে। দু একবার আমার সঙ্গীসাথীরা মানা না শুনে ট্রেনে আলোচনার মাঝখানে অপরিচিতদের কাছে আমার নাম প্রকাশ করে দেন। দেখলুম, আমার ভয় বা ভরসা অমূলক। কেউ কেউ আমাকে চিনতে পারলেন। যদিও আমি নিরেস লেখক।
এসবের স্মরণে, একদিন যখন আমি একটা মহা বিপদে পড়েছি তখন নিষ্কৃতি পাবার জন্য আমার নাম, আমি যে সাহিত্যিক সে কথাটা প্রকাশ করলুম। সঙ্গে সঙ্গে যেন বোমা ফাটার শব্দ। কে একজন ব্যঙ্গ শ্লেষ ঠাট্টা মশকরা সবকিছুর একটা ঘাট বানিয়ে বললেন, সাহিত্যিক! ছোঃ! এরকম ঢের ঢের সাহিত্যিক দেখছি নিত্যি নিত্যি। আমি মশাই আমাদের পাড়ার লাইব্রেরি কমিটির মেম্বার কই, আপনার নাম তো কখনও শুনিনি! আর-সবাই তাঁরই কথায় সায় দিল।
ওইদিন থেকে স্থির করেছি, জেলে যাব, ফাঁসিতে ঝুলব তা-ও সই কিন্তু নিজের পরিচয় প্রকাশ করব না। পেঁয়াজ-পয়জার দুই-ই কবুল বিলকুল উল্লুকই শুধু করে।
***
আমার আপন ভাগ্নি পর্যন্ত ফরিয়াদ করে, আমার লয়েলটি-বোধ নেই। মুসলমান হয়েও মুসলমানদের নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখিনে। এবারে সে বুঝতে পারবে কেন লিখিনে।
খুব বেশিদিনের কথা নয়, বোলপুর থেকে শেয়ালদা যাচ্ছি। এবং পূর্ব সঙ্কসম অনুযায়ী মুখ যা বন্ধ করেছি তার পর কি ইরেসপনসিবল কি রেসপনসিবল কোনও টকের জন্যই ডিআই আর আমার গোপাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না– যদ্যপি তখন কম্পার্টমেন্টে তুমুল তর্ক বেধেছে শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্যের জাতিভেদ নিয়ে। একবার লোভও হয়েছিল কিছু বলি, যখন একে অন্যে সবাই সবাইকে শুধতে আরম্ভ করেছেন, কেউ লেডি চ্যাটারলিজ লাভারজ পড়েছেন কি না? দেখা গেল কেউই পড়েননি। আমার পড়া ছিল। কিন্তু পূর্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করে আলোচনাতে কোনও প্রকারের সাহায্য করলুম না– পাছে ওই খেই ধরে শেষটায় কেউ না দুম করে শুধিয়ে বসে, মহাশয়ের নাম? এদেশে এখনও অধিকাংশ লোক নাম জিজ্ঞাসা করাতে কোনও-কিছু আপত্তিজনক দেখতে পায় না। আমিও পাইনে অবশ্য আমি যখন কৌতূহলী হয়ে অন্যকে শুধোই, ভাইস-ভারসা নয়।
তবু আমি চুপ এবং এমনই নিশূপ যে স্বয়ং কম্যুনিস্ট ফরেন আপিস পর্যন্ত আমার বাক-সংযম দেখে, খরশো, খরশো, শাবাশ শাবাশ জয়ধ্বনি তুলত।
মাঝে মাঝে লক্ষ করছিলুম, এক কোণে যে একটি যুবতী বসে আছেন তিনি যেন আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন– আড়নয়নে না, পুরোপাক্কা সাহস ভরেই। আমি বিশেষ শঙ্কিত হলুম না, কারণ পারতপক্ষে আমি কাউকে আমার ফটো উপহার দিই না, আর খবরের কাগজে আমার যা ছবি উঠেছে তার তুলনায় আলীপুরের শিমপানজির ছবি উঠেছে ঢের ঢের বেশি।
১৮৩০ না ৪০ খ্রিস্টাব্দে আসামে বুনো চায়ের গাছ আবিষ্কারের দিন থেকে আজ পর্যন্ত বর্ধমান-কেনার খবর পায়নি যে চা নামক পানীয় আদৌ এ পৃথিবীতে আছে এবং বাঙলা দেশেও পাওয়া যায়। কারণ গত চল্লিশ বৎসর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমি বর্ধমান-কেনারের কাছ থেকে চা আদায় করতে পারিনি। এ তত্ত্বটি অনেকেই জানেন; কাজেই বর্ধমানে গাড়ি দাঁড়ানোমাত্রই কামরার অধিকাংশ লোকই চায়ের নিষ্ফল সন্ধানে প্ল্যাটফর্মে নেবে গেলেন। আমি মুসলমান–শ্রীশ্রীগীতার মা ফলেষু কদাচনতে না-হক কেন বিশ্বাস করতে যাব? বসে রইলুম ঠায়।