- বইয়ের নামঃ রচনাবলি ১১ (একাদশ খণ্ড)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
বিচিত্রা
রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে পাঁচজনের সামনে কিছু বলতে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। সমস্যা তখন : কোনটা ছাড়ি, কোনটা বলি? প্রবাদে কয়, বাঁশবনে ডোম কানা। যে বাঁশটা দেখে, আহাম্মুখ ডোম সেইটেই কাটতে চায়। আখেরে আকছারই যা হয়, তাই ঘটে। একটা নিরেস বাঁশ কেটে বাড়ি ফেরে! রবীন্দ্রনাথের বেলা তবু খানিকটে বাঁচাও আছে, যে বাঁশই পেশ করিনে কেন, কেউ না কেউ সেটা পড়েছেন। তিনি বুড়া রাজা প্রতাপ রায়ের মতো আহাহা বাহাবাহা রবে সাধু! সাধু! রব ছাড়বেন।
মাইকেল শ্রীমধুসূদনকে নিয়ে সংকট উত্তটতর। আজ কেন, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেই মাইকেল-কাব্য-নাট্য-পত্রাবলি বাবদে ওয়াকিফহাল ছিলেন অঙ্কুজনই, যারা মাইকেল নির্মিত মধুচক্র থেকে গৌড়জন যারা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি রসাস্বাদ করতেন। পঞ্চাশ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বাঙলা ক্লাস নেবার সময় কেউ যদি বলাকার কোনও অপেক্ষাকৃত বিরল শব্দের অর্থ বলতে না পারত তিনি তখন হরহামেশা শাসাতেন, দাঁড়া! তোদের তা হলে “মেঘনাদ” পড়াব, তখন বুঝবি কঠিন শব্দ কাকে বলে? আমরা আতঙ্কে কুঁকড়ি সুকড়ি মেরে যেতুম।… আর আজ!! তবে একটি আশার বাণী আছে। বছর তিরিশেক পূর্বে মডার্ন কবিরা যখন বাঙলা শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরম্ভ করলেন তখন একাধিক জন সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে অনাদৃত শ্রীমধু শতাধিক বৎসর পূর্বে ওই কর্মটি করেছিলেন তাঁর সর্বপ্রতিভা নিয়োগ করে অসীম উৎসাহে। এবং বিশেষ করে শ্রীমধু উল্লাসবোধ করতেন, আলঙ্কারিক অর্থাৎ যারা কাব্যরস কী, সে রসের উত্তম-অধম বিচার, উত্তম রসসৃষ্টির সময় কোন কোন বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি এদের সেসব আইন লঙ্ঘন করতে পারলে।
মাইকেলের আমলে ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা-বিবাহের জাতশত্রু জনৈক মহেশচন্দ্রকে অপদস্থ করার জন্য প্রতি সপ্তাহে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতেন। ব্যঙ্গ, পি, কটুবাক্য সর্বঅস্ত্র ঈশ্বরচন্দ্র এস্তেমাল তো করতেনই, মাঝে মধ্যে অশ্লীলতার গা যে ছুঁয়ে যেতেন না সেকথাও বলা যায় না। ওই সময় গোড়ার দল মহেশকে কবিরত্ব উপাধি দেয়। ঈশ্বর প্রতিবাদ করে লিখলেন, না, তাকে দেওয়া হয়েছে “কপি-রত্ন” খেতাব। তার পর ঈশ্বর স্মৃতি, ন্যায়শাস্ত্রাদি থেকে তাঁর কপি-রত্ন সপ্রমাণ করার পর নিলেন অলঙ্কার। লিখলেন, সর্ব আলঙ্কারিক এক বাক্যে বলেন, ব অক্ষরটি কর্কশ, প অক্ষরটি মোলায়েম। উপাধি দেবার বেলা অবশ্যই মোলায়েম অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব কপিরত্ন। কাকতালীয় কি না, বলা সুকঠিন, কারণ শ্রীমধু ইতোপূর্বে অলঙ্কার শাস্ত্র গুলে খেয়ে পেটতল করে তৈরি ছিলেন। মনে মনে বললেন, বইট্টে! “ব” বুঝি কর্কশ। আমি নাগাড়ে “ব” এস্তেমাল করব। সামলাও দেখি ঠ্যালাডা।” সীতা-সরমায় সদম্ভে লিখলেন,
শুনিয়াছি বীণাধ্বনি দাসী
পিকবর-রব নব পল্লব মাঝারে—
পরপর চারটে শব্দে চারটে ব-এর অনুপ্রাস! এ অধম বহু বৎসর ধরে ত্রিযামা যামিনী যাপন করেছে অলঙ্কার অধ্যয়নে। সে চিল্কারিল উচ্চৈঃস্বরে,
ভো ভো গৌড়জন
সবে। কী মধু নিমিল মধু অবহেলে
বারম্বার ব অক্ষর বিভাসিয়া। বলো
কবে কবি কেবা, বর্ণিল বরদা বরে
বঙ্গভূমে পিকবর-রব নব?
(ব এবং ভ অনুপ্রাস সমধ্বনিসূচক)
এ তো অতি সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র। শ্রীমধুর কাব্য-নাট্যাদি যেকোনো সৃষ্টিকর্মের যেখানে খুশি হাত দাও, পাবে তার সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি, পূর্বসূরিদের স্মরণান্তে (নমি আমি কবিগুরু… বাল্মীকি/হে ভারতের শিরচূড়ামণি, কৃত্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলঙ্কার) তাঁদের ছাড়িয়ে যাবার সফল প্রচেষ্টা, অলঙ্কার নন্দনশাস্ত্র তুড়ি মেরে, সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতিতে নব নব সংকটের পথে নব নব অভিযানে নিষ্ক্রমণ, সৃষ্টির পর সৃষ্টি, অভূতপূর্ব সৃজন, যার থেকে অনাগত যুগের নবীন আলঙ্কারিক অভিনব নব নব সূত্র নির্মাণ করে গোড়াপত্তন করবেন নবীন নন্দনশাস্ত্রের সর্বোপরি বঙ্গভাষার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক অনুরাগ, বঙ্গসাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁর অচল অটল বিশ্বাস, সে ভবিষ্যৎকে সফল করার জন্যে তাঁর সর্বব্যাপী প্রত্যাশা– এমনকি, কোনও সার্থক মুসলমান কবি কারবালা নিয়ে একদিন রচনা করবেন অনবদ্য সমুজ্জ্বল (magnificient) এপিক* এবং এসব আশা-আকাঙ্ক্ষায় শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর অক্লান্ত বিদ্রোহ, দুর্বার সংগ্রাম।
[*“মেঘনাধ রচনার সময় শ্রীমধু সুপণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুকে লিখছেন, I must tell you, my dear fellow, that though, as a jolly Christian youth, I dont care a pins head for Hinduism, I love the grand mythology of ancestors. It is full of poetry. A fellow with an inventive head can manufacture the most beautiful things out of it. (…..) What a vast field does our country now present for literary enterprise! I wish to God, I had time. Poetry, Drama, Criticism. Romance a man would bare a name behind him, above all Greek, above all Roman fame. শুধু হিন্দু পুরাণাদিই না। অন্যত্র শ্রীমধু লিখছেন, “We have just got over the noise of Mohurrum. I tell you what, if a great Poet were to rise among the Mussulmans of India, he could write a mangnificient Epic on the death of Hossain and his brother. He could enlist the feelings of the whole race on his behalf. We have no such Suject. (অর্থাৎ হিন্দু পুরাণাদিতে নেই। ড. মনিরুজ্জামান, নাট্যগ্রন্থাবলি, পৃ. ৭৯৩, ৮১৬।]