- বইয়ের নামঃ রচনাবলি ৮ (অষ্টম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়
একদা এক ফরাসির সঙ্গে পেভমেন্টের উপর শামিয়ানা-খাটানো কাফেতে বসে কফি খেতে খেতে রসালাপ করছি এমন সময় আমার পরিচিত এক ইংরেজ চেয়ার-টেবিল বাঁচিয়ে এগুচ্ছে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলুম। ফরাসির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললুম, ইনি অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট– অনার্স। ফরাসি পরম আপ্যায়িত হয়ে উৎসাহভরে শুধাল, কোন সাবজেক্টে, মঁসিয়ে? হকি না টেনিসে ফরাসি মাত্ররই বিশ্বাস, পড়াশুনা বাবদে ইংরেজ এক-একটি আস্ত বিদ্যেসাগর। ইংরেজ চলে যাওয়ার পর মুগ্ধকণ্ঠে বললে, ধন্যি জাত, মসিয়ো। খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেটে যেটাকে ওদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম (জাতীয় চিত্তবিনোদন) বলা যেতে পারে সেটাকে তুলে নিয়েছে শিক্ষাদীক্ষার উচ্চ পর্যায়ে। আপনাদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম কী, মঁসিয়ে? আমি ঈষৎ চিন্তা করে বললুম, আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, পা-সুদ্ধ জানু ঘন ঘন দোলানো। বাচ্চারা বেঞ্চিতে বসে দুটো পা-ই। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, ওদের জানু পা-তে দড়ি বেঁধে পাওয়ার তৈরি করলে তাবৎ দেশের বিজলি-সাপ্লাই পাওয়া যাবে। ফরাসি বললে, ওটা তো নিতান্তই হার্মলেস, নির্বিষ। শুনেছি জর্মানদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম, বিশ-ত্রিশ বছর অন্তর অন্তর একটা বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া। আমি প্রতিবাদ মুদ্রা দেখাবার তরে ডান হাত দিয়ে এক কোণে সামনের বাতাস, দু টুকরো করে কেটে দিয়ে বললুম, নস্যি, নস্যি মঁসিয়ে, বিলকুল ধূলিপরিমাণ! আফগানিস্তানের নাম শুনেছেন? সেখানে কওমে কওমে ধনাধন্ গুলি ছোঁড়াছুড়ি করে দু দশ জনকে খতম করে দেওয়া তো নিত্যদিনের ওয়ারজিস, জিমনাসটি। আর তাবৎ মুলুক জুড়ে লড়াই, এক বাদশাহকে তখৃৎ থেকে হটিয়ে অন্য বাদশাহ বসানোযদিও তারা বিলক্ষণ জানে, তাতে করে ফায়দা হবে না আদৌ, কুল্লে পিদরসুখতেই (পিতৃদহনকারী, কুট্টি ভাষায় সব হা-ই) বরাবর, সোওয়াদ পাল্টাবার তরে একবার একটা ডাকুকে এস্তেক এস্তেমাল করে তজরুবাভি করেছে- এসব মুলুক-জোড়া প্যাসটাইমে ভদ্র আফগান মাত্রই মশগুল হয় বছর পাঁচেক অন্তর অন্তর।
ফরাসি একগাল হেসে বললে, আমরা যে রকম ৩১ ডিসেম্বরের দুপুররাতে গির্জেয় গির্জেয় ঘন্টা বাজিয়ে ফি বছর পুরনো সালটাকে ঝেটিয়ে খেদিয়ে দিয়ে নয়া একটা নিয়ে আসি। কেন, বাওয়া, পুরনোটা কীই-বা এমন অপকর্ম করেছিল? দিব্য ওই দিয়ে কাজ চলছিল না? তা-ও, মঁসিয়ে বুঝতুম, নয়াটাকে যদি বছর-বিশেকের গ্যারান্টিসহ আমদানি করত! সেটাকে ফের বেঁটা!
আমি গদগদ কণ্ঠে বললুম, তাই না বেবাক মুল্লুকের সাকুল্যে লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে হেথায় এই প্যারিসে ঝামেলা লাগায়। তোমরা সব-কুচ চটসে সমঝে যাও।
আরেক গাল হেসে বললে, তা আর জানব না? ফ্রেন্স রিভলুশনে রাজা থেকে আরম্ভ করে নিত্যি নিত্যি কত না মুণ্ডু কেটেছি– কিন্তু মাইরি, রাজারও তো মাত্র একটা মুণ্ডু, সেটা কাটা গেলে, ইতিহাস সেটা নিয়ে আসমান-জমিন ফাটায় কেন? আমরা জানব না তো জানবে কে?…ফরাসির সরেস মন্তব্য শুনে আম্বো ভাবি, কাবুলি বাদশাহর মুণ্ডুটা তো পার্মেনেন্ট এড্রেসেই রয়েছে। তবে অত ধানাই-পানাই ক্যান?
.
রইবে শুধু তাস
আর এক রাজার সর্বনাশ
(প্রাক্তন) রাজা ফারুক নাকি একদা রাজসিক একটি আপ্তবাক্য ছেড়েছিলেন, এই দুনিয়ায় একদিন টিকে থাকবেন শুধু পাঁচজন রাজা। তাসের চারটি আর ইংল্যান্ডের রাজা একুনে পাঁচ, ব্যস। জানি, রাজার কথা সব কথার রাজা। তা সে রাজার মুখ থেকে বেরুনো কথাই হোক আর রাজা নিয়ে রূপকথাই হোক।
কিন্তু, পাপ-মুখে কী করে কই, পেত্যয় যেতে মন যেন চাইছে না, মিসর রাজের ক্রমশ প্রকাশ ভবিষ্যদ্বাণী সত্যই কি কাবুলি-মেওয়ারূপে প্রকাশ পেল? কাবুলে গণতন্ত্র! ডাকুহীন, রাজাহীন কাবুল! প্রকাশ, আলা হজরত পাদিশাহ ই দীন ওয়া দুনিয়া আগা ই আগা বাদশাহ মুহম্মদ জহির শাহ, জিদ আজলালাহু দামং শওকতোহু ওয়া ইকবালোহু তাঁর গৌরব বর্ধমান হোক, তাঁর শওকৎ এবং শ্রীসৌভাগ্য চিরস্থায়ী হোক– আমি সংক্ষেপে সেরে, আশা করি কোনও অলঙ্ প্রোটোকল অমান্য করে সখৎ গুনাহ বা মোলায়েম মকরূহ-এ লিপ্ত হইনি– তাঁর তাজ ও তখৎ হারিয়েছেন। অতএব আমরা ফারুকের ভবিষ্যদ্বাণী মাফিক আখেরি পঞ্চরাজ চক্রবর্তীর আরও নিকটবর্তী হয়েছি। উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু এ তো অতিশয় পুরনো কাসুন্দি। তথাকথিত ঐতিহাসিক টয়েনবি যাকে বলেন প্যাটার্ন। না, এবারে যে গাজি- কালক্রমে ইনি কাজি উপাধি অবশ্যই পাবেন– তখৎ-তাজ কেড়ে নিলে তিনি নাকি সেগুলো এস্তেমাল করবেন না। তিনি দেশের জন্য, তাঁর কথায় ইসলামের ঐতিহ্যানুযায়ী গণতন্ত্র ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু কিঞ্চিৎ অবান্তর হলেও যে প্রশ্নটা প্রাগুক্ত ফরাসিসও আজ জিগ্যেস করতেন সেটা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, এত ল্যাটে কেন? ১৯৩৩-এ জহির শাহ উনিশ বছর বয়সে রাজা হন। তার পিতা বাদশাহ নাদির শাহ আততায়ীর গুলিতে শহিদ হন। আফগানরা সেই শেষ জাতীয় চিত্তবিনোদনের পর ঝাড়া চল্লিশটি বছর ধরে এই মহামূল্যবান প্রতিষ্ঠানটিকে এ-রকম নির্মম বেদরদ পদ্ধতিতে অবহেলা করল কেন? আফগান চরিত্র যারা কণামাত্র চেনেন তাদের কাছে এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ভুতুড়ে ব্যাপার, বেআইনি তিলিসমাৎ বলে মনে হবে।