- বইয়ের নামঃ রচনাবলি ৮ (অষ্টম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়
একদা এক ফরাসির সঙ্গে পেভমেন্টের উপর শামিয়ানা-খাটানো কাফেতে বসে কফি খেতে খেতে রসালাপ করছি এমন সময় আমার পরিচিত এক ইংরেজ চেয়ার-টেবিল বাঁচিয়ে এগুচ্ছে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলুম। ফরাসির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললুম, ইনি অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট– অনার্স। ফরাসি পরম আপ্যায়িত হয়ে উৎসাহভরে শুধাল, কোন সাবজেক্টে, মঁসিয়ে? হকি না টেনিসে ফরাসি মাত্ররই বিশ্বাস, পড়াশুনা বাবদে ইংরেজ এক-একটি আস্ত বিদ্যেসাগর। ইংরেজ চলে যাওয়ার পর মুগ্ধকণ্ঠে বললে, ধন্যি জাত, মসিয়ো। খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেটে যেটাকে ওদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম (জাতীয় চিত্তবিনোদন) বলা যেতে পারে সেটাকে তুলে নিয়েছে শিক্ষাদীক্ষার উচ্চ পর্যায়ে। আপনাদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম কী, মঁসিয়ে? আমি ঈষৎ চিন্তা করে বললুম, আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, পা-সুদ্ধ জানু ঘন ঘন দোলানো। বাচ্চারা বেঞ্চিতে বসে দুটো পা-ই। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, ওদের জানু পা-তে দড়ি বেঁধে পাওয়ার তৈরি করলে তাবৎ দেশের বিজলি-সাপ্লাই পাওয়া যাবে। ফরাসি বললে, ওটা তো নিতান্তই হার্মলেস, নির্বিষ। শুনেছি জর্মানদের ন্যাশনাল প্যাসটাইম, বিশ-ত্রিশ বছর অন্তর অন্তর একটা বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া। আমি প্রতিবাদ মুদ্রা দেখাবার তরে ডান হাত দিয়ে এক কোণে সামনের বাতাস, দু টুকরো করে কেটে দিয়ে বললুম, নস্যি, নস্যি মঁসিয়ে, বিলকুল ধূলিপরিমাণ! আফগানিস্তানের নাম শুনেছেন? সেখানে কওমে কওমে ধনাধন্ গুলি ছোঁড়াছুড়ি করে দু দশ জনকে খতম করে দেওয়া তো নিত্যদিনের ওয়ারজিস, জিমনাসটি। আর তাবৎ মুলুক জুড়ে লড়াই, এক বাদশাহকে তখৃৎ থেকে হটিয়ে অন্য বাদশাহ বসানোযদিও তারা বিলক্ষণ জানে, তাতে করে ফায়দা হবে না আদৌ, কুল্লে পিদরসুখতেই (পিতৃদহনকারী, কুট্টি ভাষায় সব হা-ই) বরাবর, সোওয়াদ পাল্টাবার তরে একবার একটা ডাকুকে এস্তেক এস্তেমাল করে তজরুবাভি করেছে- এসব মুলুক-জোড়া প্যাসটাইমে ভদ্র আফগান মাত্রই মশগুল হয় বছর পাঁচেক অন্তর অন্তর।
ফরাসি একগাল হেসে বললে, আমরা যে রকম ৩১ ডিসেম্বরের দুপুররাতে গির্জেয় গির্জেয় ঘন্টা বাজিয়ে ফি বছর পুরনো সালটাকে ঝেটিয়ে খেদিয়ে দিয়ে নয়া একটা নিয়ে আসি। কেন, বাওয়া, পুরনোটা কীই-বা এমন অপকর্ম করেছিল? দিব্য ওই দিয়ে কাজ চলছিল না? তা-ও, মঁসিয়ে বুঝতুম, নয়াটাকে যদি বছর-বিশেকের গ্যারান্টিসহ আমদানি করত! সেটাকে ফের বেঁটা!
আমি গদগদ কণ্ঠে বললুম, তাই না বেবাক মুল্লুকের সাকুল্যে লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে হেথায় এই প্যারিসে ঝামেলা লাগায়। তোমরা সব-কুচ চটসে সমঝে যাও।
আরেক গাল হেসে বললে, তা আর জানব না? ফ্রেন্স রিভলুশনে রাজা থেকে আরম্ভ করে নিত্যি নিত্যি কত না মুণ্ডু কেটেছি– কিন্তু মাইরি, রাজারও তো মাত্র একটা মুণ্ডু, সেটা কাটা গেলে, ইতিহাস সেটা নিয়ে আসমান-জমিন ফাটায় কেন? আমরা জানব না তো জানবে কে?…ফরাসির সরেস মন্তব্য শুনে আম্বো ভাবি, কাবুলি বাদশাহর মুণ্ডুটা তো পার্মেনেন্ট এড্রেসেই রয়েছে। তবে অত ধানাই-পানাই ক্যান?
.
রইবে শুধু তাস
আর এক রাজার সর্বনাশ
(প্রাক্তন) রাজা ফারুক নাকি একদা রাজসিক একটি আপ্তবাক্য ছেড়েছিলেন, এই দুনিয়ায় একদিন টিকে থাকবেন শুধু পাঁচজন রাজা। তাসের চারটি আর ইংল্যান্ডের রাজা একুনে পাঁচ, ব্যস। জানি, রাজার কথা সব কথার রাজা। তা সে রাজার মুখ থেকে বেরুনো কথাই হোক আর রাজা নিয়ে রূপকথাই হোক।
কিন্তু, পাপ-মুখে কী করে কই, পেত্যয় যেতে মন যেন চাইছে না, মিসর রাজের ক্রমশ প্রকাশ ভবিষ্যদ্বাণী সত্যই কি কাবুলি-মেওয়ারূপে প্রকাশ পেল? কাবুলে গণতন্ত্র! ডাকুহীন, রাজাহীন কাবুল! প্রকাশ, আলা হজরত পাদিশাহ ই দীন ওয়া দুনিয়া আগা ই আগা বাদশাহ মুহম্মদ জহির শাহ, জিদ আজলালাহু দামং শওকতোহু ওয়া ইকবালোহু তাঁর গৌরব বর্ধমান হোক, তাঁর শওকৎ এবং শ্রীসৌভাগ্য চিরস্থায়ী হোক– আমি সংক্ষেপে সেরে, আশা করি কোনও অলঙ্ প্রোটোকল অমান্য করে সখৎ গুনাহ বা মোলায়েম মকরূহ-এ লিপ্ত হইনি– তাঁর তাজ ও তখৎ হারিয়েছেন। অতএব আমরা ফারুকের ভবিষ্যদ্বাণী মাফিক আখেরি পঞ্চরাজ চক্রবর্তীর আরও নিকটবর্তী হয়েছি। উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু এ তো অতিশয় পুরনো কাসুন্দি। তথাকথিত ঐতিহাসিক টয়েনবি যাকে বলেন প্যাটার্ন। না, এবারে যে গাজি- কালক্রমে ইনি কাজি উপাধি অবশ্যই পাবেন– তখৎ-তাজ কেড়ে নিলে তিনি নাকি সেগুলো এস্তেমাল করবেন না। তিনি দেশের জন্য, তাঁর কথায় ইসলামের ঐতিহ্যানুযায়ী গণতন্ত্র ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু কিঞ্চিৎ অবান্তর হলেও যে প্রশ্নটা প্রাগুক্ত ফরাসিসও আজ জিগ্যেস করতেন সেটা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, এত ল্যাটে কেন? ১৯৩৩-এ জহির শাহ উনিশ বছর বয়সে রাজা হন। তার পিতা বাদশাহ নাদির শাহ আততায়ীর গুলিতে শহিদ হন। আফগানরা সেই শেষ জাতীয় চিত্তবিনোদনের পর ঝাড়া চল্লিশটি বছর ধরে এই মহামূল্যবান প্রতিষ্ঠানটিকে এ-রকম নির্মম বেদরদ পদ্ধতিতে অবহেলা করল কেন? আফগান চরিত্র যারা কণামাত্র চেনেন তাদের কাছে এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ভুতুড়ে ব্যাপার, বেআইনি তিলিসমাৎ বলে মনে হবে।
এর মোদ্দাটা আমাদের সোনার বাংলার একটি প্রবাদে অনায়াস-লভ্য। একে তো ছিল নাচিয়ে বুড়ি, তার ওপর পেল মৃদঙ্গের তাল। পাঠান-আফগানরা নাচবার তরে হরহামেশা তৈরি, কিন্তু ওই যে মৃদঙ্গটা ওতে দু চারটে চাটিম চাটিম বোল তুললে তবে তো মৌজটা জমে এবং সে মৃদঙ্গ বাজাতেন আকছারই ইংরেজ মহাপ্রভুরা পেশোয়ারে বসে। ১৯১৭-এর পূর্বে কখনও-বা রাশার জার– আমু দরিয়ার ওপারে বসে। এনারা নাচবার তরে কড়ি ভি দিতেন, নাচের সময় শাবাশি দিতেন, নাচ শেষে আপন আপন পছন্দসই আমিরকে তখতে বসাতেন। শেষবারের মতো ডুগডুগি বাজিয়েছিল ইংরেজ ১৯২৮/২৯-এ। নাদির শাহকে মারার পিছনে কেউ ছিল কি না, সঠিক বলতে পারব না।
.
পটভূমি
আমান উল্লাহ যখন দেশের তরে লড়াই দেন, তখন তাঁর জঙ্গিলাট ছিলেন নাদির খান। স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরেই, যে কোনও কারণেই হোক, তার মনে নাদিরের মতলব সম্বন্ধে সন্দেহের উদয় হল, লোকটা আফগান ফৌজের এতই প্যারা যে, কখন যে একটা মিলিটারি কু লাগিয়ে নিজেই রাজা হয়ে বসবে না, তার কি প্রত্যয়! আমান উল্লাহ নিজেই তো রাজা হলেন সত্তাই, যুবরাজ এনায়েত উল্লাকে তার হক্কের তখুৎ থেকে বঞ্চিত করে– যদিও সমস্ত ষড়যন্ত্র বলুন, প্যান্টটাইম বলুন ব্যাপারটার পরিপাটি ব্যবস্থা করেছিলেন তার আম্মাজান, আমান উল্লাহর পেটে কতখানি এলেম ছিল সে তারিফ তার পরম প্যারা দোস্ততক করতে গেলে বিষম খেত। কিন্তু তার চেয়ে একটা মোক্ষমতর তত্ত্ব আছে, সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি বাবদে। আর্যদের ভিতর বহু প্রাচীনকাল থেকেই একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে- পিতা গত হলে বড় ছেলে পরিবারের কর্তা হবে। কোনও কোনও আর্য গোষ্ঠীতে তো সে আইন এমনি কট্টর যে, বড় ছেলে ভিন্ন অন্য ভাইরা পিতার সম্পত্তির কানাকড়িটাও পায় না, গ্রাসাচ্ছাদনও না। সর্বব্যবস্থার মতো এ ব্যবস্থাটারও সদ-গুণ বদ-গুণ দুই-ই আছে। কিন্তু আফগানদের ভিতর সে আইন খুব একটা চালু হয়নি। আমান উল্লাহ নাদিরকে বিদেশে চালান দিয়েছিলেন।
.
লাঠি যার দেশ তার
কাবুলের সিংহাসনে বসার হক্ক শেষটায় বংশানুক্রমে গিয়ে দাঁড়ায় মূলত কান্দাহারের আব্দুর রহমান, হবীব উল্লা, আমান উল্লাহর গোষ্ঠীতে। তার অর্থ ওই গোষ্ঠীর যার লাঠি তার মোষ। আমান উল্লাহ, নাদির, জহির আর আজকের জেনারেল মুহম্মদ দাউদ খান সক্কলেরই যে কেউ গায়ের জোরে একবার কাবুলের তখতে বসে যেতে পারলে, ক্রমে ক্রমে জালালাবাদ, গজনি, কান্দাহার শায়েস্তা করে তাঁবেতে আনতে পারলে তাবৎ আফগানিস্তান তাঁকে আলা-হজরত বাদশাহ বলে মেনে নেয়। কাতাখান-বদখশান মজার-ই-শরীফের বিশেষ কোনও মাহাত্ম্য নেই।
উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, জেনারেল দাউদ মাত্র কাবুলের প্রধান। সদরও বলতে পারেন। বেতার বলছে, কাবুলের বাইরে এখনও তার রাজ্যবিস্তার আরম্ভ হয়নি। তবে কাবুল উপত্যকার বাইরে উত্তর দিকে, অন্তত মাইল দশ-পনেরো দূরের একটা জায়গা (চল্লিশ বছর হয়ে গেল, নামটা ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব জাবাল উস্-সরাজ) থেকে আসে বিজলি। সেটা নিশ্চয়ই জেনারেল দাউদের বেতে। নইলে সিমলে পাহাড় থেকে কাবুল বেতারে দাউদের জয়ধ্বনি আকাশবাণীর মনিটর শুনল কী করে?
ওদিকে যদিও কাবুল বিমানবন্দর এক্কেবারে শহরের গা ঘেঁষে তবু বিলেত ছেড়ে কাবুলে যে প্লেন আসছিল সেটা সোজা দিল্লি চলে গেল কেন? লাহোর কিংবা করাচিতেই নামল না কেন? হয়তো প্লেনে রাজপরিবারের দু-চারজন কিংবা/এবং জহিরপন্থি কিছু লোক ছিলেন যাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে কাবুল যাওয়াটা মোটেই নিরাপদ নয়। পাকিস্তানে নামাটাও খুব সুবুদ্ধিমানের কাজ হত না। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনও দুশমনি নেই। ভারতই ভালো। কাবুল অ্যার-পোর্টে নামাটা টেকনিক্যালি সম্ভবপর হলেও।
বহুকাল হল কাবুল বেতার শুনিনি। একদা সন্ধে সাতটা-আটটা থেকেই বিদেশের জন্য তাদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যেত, পশতু এবং ফারসিতে। রাত এগারোটার ঝোঁকে ইংরেজিতে, এবং পিঠ পিঠ ফরাসিতে। দেখি, রাত ঘনালে পাই কি না। তবে ক্য দেতা, বা কু দ্য পালে হয়ে যাওয়ার পর নানা কারণে সচরাচর জোরদার ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা হয় না বা যায় না।
.
অর্থই পরমার্থ
কার্ল মার্কস বলেছেন, অর্থনৈতিক কারণ ভিন্ন ইহ-সংসারে কোনও বিরাট পরিবর্তন হয় না। ইংরেজ এই নীতি অবলম্বন করে তার ন্যাশনাল প্যাসটাইম জাতীয় চিত্তবিনোদন প্রতিষ্ঠান ফুটবল-ক্রিকেটকে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে সমাসন স্থলবিশেষে উচ্চাসন দিয়ে যে অত্যদ্ভুত সমন্বয় সাধন করল তারই অর্ধশিক্ষিত-অধর্মবীর সন্তানগণ স্থাপন করল বিশ্বজোড়া রাশি রাশি উপনিবেশ। কন্টিনেন্টের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়ামোদ তার চতুঃসীমানায় প্রবেশ করতে দিত না। অতএব উপনিবেশ স্থাপন ও তথায় রাজত্ব করার জন্য শিক্ষিত লোক পাঠালে তারা মরত পটাপট করে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, সে সে ফিভার ইত্যাদির নানাবিধ রোগে; পক্ষান্তরে আখড়া থেকে ধরে ধরে ডানপিটে গাঁট্টাগোট্টাদের পাঠালে তারা পট পট পটল তুলত না বটে, কিন্তু পটলক্ষেতের হিসেব-নিকেশ থেকে আরম্ভ করে উপনিবেশের বাজেট, অডিট, আইন-কানুন, এককথায় দেশ শোষণ করার জন্য যে সিভিল সার্ভিস গড়ে তুলতে হয় তার জন্য নিরঙ্কুশ অনুপযুক্ত। কেউ কেউ তো নামটা পর্যন্ত সই করতে পারত না।
তাই ইংরেজ গলফ খেলার সময়ই হোক আর রিলেটিভিটি কপচাবার ওক্তেই হোক, সবকিছু মা-লক্ষ্মীর আঁচলে বেঁধে দেয়।
পাঠানের বর্ণচোরা সংস্করণের নাম ইংরেজ। পাঠানও তার ন্যাশনাল প্যাসটাইম–দু-দুশ বছর পর পর কাবুলের তখৎ থেকে পুরনো বাদশাহকে সরিয়ে নয়া বাদশাহ সানোর জাতীয় চিত্তবিনোদনের সময় মার্কস-নির্দিষ্ট নীতি, ইংরেজ কর্তৃক হাতে-কলমে তার ফলপ্রাপ্তি, কোনওটাই ভোলে না।
বিআ ব-কাবুল, বরওম ব-কাবুল,
বিআ ব-কাবুল বরওয়িম ব-কাবুল।
আয় তুই কাবুল, আমি চললাম কাবুল,
আয় তুই কাবুল আমরা চলি কাবুল ॥
দীন দীন রবে হুহুঙ্কার চিৎকার পাঠানের কাছে বিলকুল ফজুল। কাবুল লুট করাতে কী আনন্দ কী আনন্দ!
ন্যাশনাল প্যাস্টাইমের সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তির সমন্বয়।
.
দোনলা-বন্দুক
প্রেসিডেন্ট দাউদ খানের সর্বপ্রধান শিরঃপীড়া হবে এই পাঠান ডাকুর পাল। ওদের সামলাতে হলে দরকার ফৌজ। দাউদ খান তার ভাষণারম্ভে সম্বোধন জানিয়েছেন পেট্রিয়টদের, দেশপ্রেমিকদের ফারসিতে দোস্তান-ই-মূলক বা সমাসবদ্ধ ইয়ার-উল-মুলক কিংবা আরব্য রজনীর শহর-ইয়ার-এর ওজনে মুলক-ইয়ার অথবা সাদামাটা হম্ ওয়াতুন স্বদেশবাসী যা-ই বলে থাকুন না কেন, পাঠান-হৃদয়ে আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতি কোনও প্রকারের খাস, দিল-তোড় মহব্বতের কোনও নিশান আমি দেখিনি। যে অঞ্চলে সে বাস করে অর্থাৎ কওমি এলাকার প্রতি তার টান থাকা অসম্ভব নয়– পাখিটাও তার নীড়ের শাখাঁটির মঙ্গল কামনা করে কিন্তু দেশপ্রেম! অতএব দেশপ্রেমী দাউদ দেশের দোহাই দিয়েছেন দোনলা বন্দুকের মতো। কাবুল ও কাবুলাঞ্চলের সরকারি ফৌজ যেন তার কাছ থেকে বড্ড বেশি টাকা-কড়ি না চায়। কাবুলের ভিতরকার আর্ক-দুর্গের তোষাখানায় কী পরিমাণ অর্থ তিনি পেয়েছেন সেটা তাঁর প্রথম ভাষণেই ফাঁস করে দেবেন এমনতরো দুরাশা তার নব-নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রীও করবেন না। এবং এটাও অসম্ভব নয় যে, জহির শাহ ভিনদেশ যাবার মুখে বাগ-ই-বালার (আমাদের তেজগাঁও) কেন্দ্রীয় শাহী সৈন্যদের কমান্ডান্ট আপন দামাদ জেনারেল শাহ ওয়ালি খানের হেফাজতে গ্যারিসনের মধ্যেই রেখে গিয়েছিলেন। বলা শক্ত মানুষ আপন দামাদ, না ভগ্নীপতি, কাকে বেশি বিশ্বাস করো খবর এসেছে, জেনারেল ওয়ালিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। সেটা নিশ্চয়ই গ্যারিসন জয় করার পূর্বে দাউদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করে দাউদ ওটাকে জয় করার মতো ফৌজ আর হাতিয়ার পাবেন কোথায়? এবং আর্ক-দুৰ্গই-বা তিনি কাবু করলেন কী করে? সেখানে তো তাঁর বাস করার কথা নয়।
.
দাউদের পূর্বকথা
আফগান রাজনীতিতে বলা উচিত ছিল কাবুলের রাজনৈতিক দলাদলির প্রধান নেতা রাজ-গোষ্ঠীর সরদারগণ। দাউদ এদেরই একজন। জহির রাজা হন ১৯৩৩-এ। দাউদ তার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। অনুমান করা অসঙ্গত নয়, তিনি কুড়ি বত্সর ধরে তার শক্তি সঞ্চয় করে চলছিলেন অর্থাৎ সরদারদের মধ্যে যে কজনকে পারেন আপন দলে টানছিলেন। এটা যে প্রকাশ্যে তখৎ-নশিন বাদশাহর বিরুদ্ধে করা হয় তা নয়। গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান মেনে নিয়ে প্রত্যেক পলিটিশিয়ান যে রকম আপন দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে হুবহু সেই রকম কাউকে দলের উচ্চাদর্শ দেখিয়ে, কাউকে মন্ত্রিত্বের ওয়াদা দিয়ে, কাউকে-বা উঁই ডাই কন্ট্রাক্টের লোভ দেখিয়ে ইত্যাদি। কোনও সরদার যদি সত্যই পালের মধ্যে বড় বেশি জোরদার হয়ে যান, তবে বাদশাহ যে ঈষৎ শঙ্কিত হন সেটাও জানা কথা। তখন তাঁকে নিতান্ত নিজস্ব আপন দলে টানার জন্য বাদশাহ তার বোন বা মেয়েকে সেই সরদারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হন। পাঠকের স্মরণে আসতে পারে, আমির হবীবউল্লাহ যখন দেখলেন, মোল্লাদের চিত্তজয় করে তাঁর অনুজ নসরউল্লাহ এত বেশি তেজিয়ান হয়ে গিয়েছেন যে তিনি রীতিমতো শঙ্কিত হলেন– তাঁর মৃত্যুর পর আপন পুত্র যুবরাজ ইনায়েউল্লাহ হয়তো রাজা হতে পারবেন না, রাজা হয়ে যাবেন নসরউল্লাহ। তাই তিনি যুবরাজকে বিয়ে দিতে চাইলেন নসর-কন্যার সঙ্গে। নসর হয়তো-বা আপন দামাদকে খুন করতে ইতস্তত করবেন– ওই ছিল তাঁর গোপন আশা।… এ স্থলে, যদিও টায় টায় খাটে না, তবু হয়তো-বা দাউদকে আপন দলে টানবার জন্য জহির বোনকে আদমের আপেলের মতো তার সম্মুখে ধরলেন। বস্তুত আফগান রাজগোষ্ঠীর হতভাগিনী কুমারীকুল সে দেশের রাজনৈতিক দাবা খেলায় বড়ের মতোই এগিয়ে গিয়ে ছকের মাঝখানে প্রাণ দেন, রাজার দুর্গ অভেদ্যতর করবার জন্য (কাসলিং)। কেউ কেউ আমৃত্যু কুমারীই থেকে যান– ক্রীড়ারম্ভে যে ছকে জন্মগত অধিকার বা কিস্মতবশত তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিল কিস্তিমাৎ পর্যন্ত সেখানেই অর্থহীন নিষ্কর্মার মতো অবশ অচল হয়ে থাকেন। ষাট বছরের বুড়ো সরদারের সঙ্গে চৌদ্দ বছরের কচি মেয়ের বিয়ে হওয়াটাও আদৌ বিচিত্র নয়। কিন্তু উপস্থিত থাক সে দীর্ঘ দয়াধর্মহীন কাহিনী। শুধু বাদশাহর নয়, কুল্লে সরদার-বালাদের ওই একই হাল।
.
পট বদল
১৯৪৭-এ হঠাৎ ইংরেজের পরিবর্তে দেখা দিল পাকিস্তান। আমানউল্লাহ ইংরেজ এবং রুশ দুই সপত্নের (সপত্নীর পুংলিঙ্গ বিশুদ্ধ সংস্কৃতে সপত্ন মডার্ন কবিদের ভাষায় পুং-সতীন) মাঝখানে ছিলেন মোটামুটি ভালোই। আখেরের নতিজা– সে কাহিনী প্রাচীন ও দীর্ঘ।…বাদশাহ জহির হঠাৎ দেখেন তাগড়া ইংরেজ সপত্নের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাকিস্তান সে-ও আবার কাবুলের সঙ্গে ফ্লার্ট করা দূরে থাক, ইন্ডিয়া নিয়ে সে ব্যতিব্যস্ত। খুদ বাদশাহর কী মতিগতি ছিল জানিনে, কিন্তু সরদার দাউদ হয়ে দাঁড়ালেন পয়লা নম্বরের চ্যাম্পিয়ান, পাঠানদের তাড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে কামড় মেরে এক খাবলা গোশত, ফোকটে মেরে দিতে। তাঁর দল হল আরও ভারী। বিআব-পেশাওয়ার চলি, চলো পেশাওয়ার/চে খুব উমদা সে-ভাণ্ডার।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এ রকম একটা জিগির চিত্তহারিণী হবেই। পেশাওয়ারে খাস পাঠানদের বাড়ি-গাড়ি অত্যল্পই। পাঞ্জাবিরা সেখানে বিস্তর ধনদৌলত সঞ্চয় করেছে পার্টিশনের সময় বেধড়ক লুট করে। এবারে পাঞ্জাবি মৌমাছিদের খেদিয়ে দিয়ে বাড়ি আনতে হবে ইয়াব্বড়া বড়া মধুভাণ্ড! আজ সদর দাউদ খাইবারপাস থেকে শুরু করে জালালাবাদ, সিমলা, খাক-ই-জব্বার তক সব দেশপ্রেমী পাঠানদের যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন সেটা কিঞ্চিৎ বঙ্কিম হলেও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ কাবুলে বাদশা-বদল হলে ওইসব অঞ্চলের যে পাঠানরা একজোট হয়ে ধাওয়া করে জালালাবাদ লুটতে– দাউদ তাদের বলছেন, হে দেশপ্রেমী পাঠান, তুমি আপন দেশ লুটতে যাবে কেন? তোমাকে তো বলেছি, পাকিস্তানের সঙ্গে আমার যে বোঝাপড়া এতদিন তোমাদের ওই নিষ্কর্মা জহিরের জন্য মুলতবি ছিল, এখন সে শুভ-লগ্ন উপস্থিত। তোমাদের কম্পাসের কাটাটা ঘুরিয়ে দাও। ভালো-মন্দের কথা হচ্ছে না; এটা সহজ পলিটিক্স। বেতারে শুনতে পেলুম, দাউদ প্রেসিডেন্ট হয়েই বিদেশি রাজদূতদের ডেকে পাঠান- নিদেন প্রেসিডেন্টের তখতে না বসা পর্যন্ত ওঁদের ডাকা যায় না এবং তাঁদের শান্তি শান্তি, সালাম ইয়া সালাম, সর্ববিশ্বে শান্তি এই বাণী উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে এইবারে আমার বোঝাপড়া শুরু হবে। বেতারের রিপোর্টার মন্তব্য করেছেন, প্রেসিডেন্টের বলার ধরনটা আদৌ সুলেহ্-সন্ধি সূচক ছিল না। (আমি নিজে ধরনটার গুরুত্ব অত বেশি দিইনে; কে না জানে, মানুষ রান্নার সময় যে গরমে ভাত ফোঁটায়, অতখানি গরমাগরম গেছে না)।
এই মামুলি লেখনের গোড়াতে যে দোনলা বন্দুকের উল্লেখ করেছিলুম, এই তার দোসরা নল।
কিন্তু পাকিস্তান যে ইসলামি রাষ্ট্র? আমরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান কোনও রাষ্ট্রেরই অমঙ্গল কামনা করি না। কিন্তু দাউদ কী উত্তর দেবেন সেটা কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি। জালালাবাদ অঞ্চলের পাঠানদের চাপে পড়ে যদিচ সেটাই একমাত্র চাপ ছিল না– একদা আমান উল্লাহর তখৎ যায়। এখন এরা যদি অবশ্য সেটা অনুমান মাত্র– জেনারেল দাউদকে সমর্থন না করে তবে তাঁর তো গত্যন্তর নেই। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁকে তখন কট্টরস্য কট্টর সুন্নি পাঠানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে হবে, পাকিস্তানের সদর (শব্দার্থে বক্ষস্থল), ডিক্টেটর কে, যার হুকুমে তামাম পাকিস্তান ওঠ-বস করে? স্বৈরতন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সে তো শিয়া।
নজিরস্বরূপ আরেকটা তথ্য সদর দাউদ বলবার হক্ক ধরেন। তিনি বলতে পারেন, ১৯৫৮ সালে যখন আমি প্রধানমন্ত্রী তখন পাকিস্তানের যে সদর ইসকন্দর মির্জা আমাদের সঙ্গে সুলেহ করতে চেয়েছিল, সে কথাবার্তা বলেছিল তার সঙ্গে? বাদশাহ জহিরের সঙ্গে। আমি কথাই বলিনি। কেন? সে-ও ছিল শিয়া। তারও একটুখানি পরে কেঃ ইয়াহিয়া। সে-ও শিয়া।
মুশকিল!!
***
ক্যু দে তা মূলত ফরাসি। ক্যু = আঘাত, গুঁতো; দ্য-ইংরেজি অব; এতা = রাষ্ট্র ইংরেজি স্টেট ওই একই শব্দ। অকস্মাৎ, বলপ্রয়োগ করে, সচরাচর দেশের সংবিধান বা ঐতিহ্য উপেক্ষা করে যদি এক রাজার বদলে আরেক রাজা তখতে বসে যান, কিংবা রাজাকে হটিয়ে গণতন্ত্র, অথবা গণতন্ত্রকে হটিয়ে স্বৈরতন্ত্র (ডিক্টেটরি) পত্তন করেন তবে সেই বলপ্রয়োগ (কু) দ্বারা রাষ্ট্রের (এ) রূপ বা ভাগ্য পরিবর্তনের নাম কু দে তা। দেশবিভাগের পর সর্বপ্রথম একটা কু দেতার পূর্বাভাস দেন আধ-সেদ্ধ ডিক্টেটর ইসকন্দর মির্জা, আসল সুসিদ্ধ ক্য করলেন আইয়ুব। তার পরের মাল সব ঝুট। ভুট্টো যদি মিলিটারি জুন্তাকে নির্মূল করে যা-ইচ্ছা-তাই বা যাচ্ছেতাই করতে পারেন তবে সেটা হবে তাঁর ব্যক্তিগত ক্যু।
ক্যু দ্য পালে রাজপ্রাসাদের (পালে, পেলেস, প্রাসাদ) ভিতরকার আকস্মিক পরিবর্তন। কু দ্য পালে প্রতিষ্ঠানটি অতিশয় প্রাচীন, কিন্তু বাক্যটি প্রচলিত হয়েছে হালফিল। একদা যে কোনও ব্যক্তি রাজাকে গুম-খুন করে দুম করে সিংহাসনে বসে যেতে পারলেই দেশের লোক গড়িমসি না করে তাঁকে রাজা বলে মেনে নিত। এখন অত সহজে হয় না। রাজা ফারুককে হটানোটার আরম্ভ হয় কু দ্য পালে দিয়ে, কিন্তু নজিব-নাসিরের পিছনে দেশের (এতা-র) লোক ছিল বলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে কু দে তা-তে পরিবর্তিত হয়।
অতএব কু দে তা বিরাটতর রাষ্ট্রবিপ্লব ক্যু দ্য পালের চেয়ে।
জেনারেল দাউদ যে কর্মটি সমাধান করলেন সেটা স্পষ্টত কু দ্য পালে দিয়ে আরম্ভ; এখন যদি সেটা কু দে তাতে পরিবর্তিত না হয় তবে বেশ কিছুকাল ধরে চলবে অরাজকতা, অর্থাৎ রাষ্ট্র-শক্তিধারীহীন রাষ্ট্রবিপ্লব না সিভিল ওয়ার। ইহ-সংসারে যত প্রকারের যুদ্ধ হয়, কোনও দেশের কিস্মত ভাণ্ডারে যত রকমের গজব আছে, তার নিকৃষ্টতম নিষ্ঠুরতম উদাহরণ ভ্রাতৃ-যুদ্ধ।
চাণক্য বলেছেন, যে ব্যক্তি উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে (যখন পুলিশ কাউকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়) এবং সর্বশেষে বন্ধুকে শ্মশানে বয়ে নিয়ে যায়, সে-ই প্রকৃত বান্ধব।
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শুশানে চ যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধব ॥
দোস্ত কুজা আস্ত?
মিত্র কুত্র অস্তি? দোস্ত কোথায় আছে?
অতএব, উল্লেখ নিতান্তই বাহুল্য যে, সদর দাউদকে বন্ধুর সন্ধানে– ব তলাশে দোস্ত– বেরুতে হবে। ভ্রাতৃযুদ্ধের সময় বান্ধবের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ওদিকে সম্ভাব্য বান্ধবরাও রাষ্ট্রনেতাকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকবেন কি না। পূর্বেই বলেছি, কাবুলের কর্ণধার হলেই যে তিনি তাবৎ আফগানিস্তানের প্রভু হতে পারবেন, এমন কোনও কথা নেই। অতএব, আফগানিস্তানের সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রের স্বার্থ সাক্ষাৎ বা পরোক্ষভাবে বিজড়িত তারা সদর দাউদের নতুন রাষ্ট্রকে পত্রপাঠ ঝটপট স্বীকৃতি দেবার পূর্বে কান্দাহার, গজনি, জালালাবাদ তাঁর বশ্যতা মেনে নিয়েছে কি না, না মেনে থাকলে সেগুলোকে শায়েস্তা করবার মতো তার সৈন্যবল, অস্ত্রবল, অর্থবল পর্যাপ্ত কি না তারই সন্ধান নেবে। ওদিকে, বলতে গেলে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কাবুল এইসব এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। যেসব রাষ্ট্র আফগানিস্তানের প্রতিবেশী, যেমন রুশ, ইরান, পাকিস্তান– এরাও এসব এলাকার কোনও পাকা খবর পাচ্ছেন না।
তৎসত্ত্বেও বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ রুশের মতো রাষ্ট্র, যার ওরিয়েন্টাল ধর্ম শত শত বৎসর ধরে বিশ্বময় সুপরিচিত, এস্তেক দশক দুত্তিন পূর্বে হিটলার-চেম্বারলেন উভয়কে প্রায় উন্মদাশ্রমে পাঠাবার মতো বাতাবরণের সৃষ্টি করে তুলেছিল আর এদানির কেষ্ট বিষ্ট, রাজনীতির স্কুলে নিতান্তই তিফল-ই-মক্তববৎ চ্যাংড়া, যাদের কোনওকিছুতেই তর সয় না, রাতারাতি চৌষট্টি-তলার এমার নির্মাণ যাদের কাছে ডাল-ভাত– থুড়ি, হট-ডগ-হাম বুর্গার সেই নিকসন-কিসিংজারকে পকেটে পুরেছে যারা, তারা কি না অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, প্রতিবেশী কুল্লে মুল্লককে সুপারসনিক স্পিডে তালিম দিয়ে তেরাত্তির যেতে না যেতে দুশমনি মার্কিনি কায়দায়, বহু বৎসরের হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া ভাইটির মতো সদর দাউদকে নিয়ে পাঠানি বেরাদরি কায়দায় একই বন থেকে গোশত-রুটি খেতে আরম্ভ করে দিল? আমি মূর্খ, বার বার আহাম্মুখ বনে বনে ওই তামাশায় দস্তুরমতো চ্যাম্পিয়ন, আন্মো বেবাক অবাক। ক্ষণতরে ভাবলুম, পূর্বদেশে বিজ্ঞাপিত ধারাবাহিকের ধারাটা বেলাবেলিই পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিই। পরে দেখলুম কিলটা হজম করে নেওয়াই প্রশস্ততর।
রুশের এই সৃষ্টিছাড়া আচরণের কারণটা কী?
অবশ্যই প্রথম কারণ, সতের বৎসরের পুরনো ইংরেজ সপত্ন বঁধুয়ার আঙিনাতে আজ আর নেই। সে থাকলে এই বরমাল্য দানের বদলাই নেবার তরে এনে দিত মোতির মালা। রুশকে আনতে হত লাল-ই-বদখশান– চুন। ইংরেজ আনত… গয়রহ ইত্যাদি।
অর্থাৎ দাউদ যাত্রারম্ভের পূর্বে হয়তো-বা রুশের আশীর্বাদ নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। হয়তো-বা রাজা জহিরের নিরপেক্ষ নীতি রুশ পছন্দ করত না। দাউদ হয়তো ভিন্ন ওয়াদা দিয়েছেন। জহিরের নীতি একদিন হয়তো মার্কিনকে ইংরেজের ভ্যাকুয়ামে টেনে আনত। কান্দাহার-জালালাবাদকে ঘায়েল করার জন্য রুশ আজ সদর দাউদকে যা দেবে, মার্কিন তার বদলে দাউদ বৈরীদের দিত মোতির মালা, রুশকে ছুটতে হত বদখশান… উপরে দেওয়া আড়াআড়ির বাজার দর দ্রষ্টব্য। অতএব মার্কিন নাগর রসবতীর সন্ধানে আসার পূর্বেই দাও স্বীকৃতি।
কয়েক বছর আগেও রুশ ঝটিতি দাউদকে এরকম স্বীকৃতি দিত না, কারণ কিংবদন্তি অনুযায়ী যে হিন্দুকুশ পর্বত উত্তীর্ণ হবার সময় সে পর্বত বিস্তর হিন্দুর (আর্যের) প্রাণহরণ করে (কুশৎ, তাই হিন্দুকুশ), সেটাকে অতিক্রম করে মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বেও ট্যাঙ্ক-কামান কাবুলে আনাটা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। বেশ কয়েক বছর হল বাদশাহ জহিরের অনুরোধে রাশানরা অপথে-বিপথে কয়েকটা টানেল খুঁড়ে, লেভেল রাস্তা বানিয়ে, কে জানে ক হাজার ফুট চড়াই-উত্রাই তো এড়িয়েছে বটেই, তদুপরি না জানি ক-শো মাইল রাস্তাও কমিয়ে দিয়েছে।
.
তৃতীয় পক্ষ পাকিস্তান
তদুপরি সরাসরি দুশমন না হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে রুশের ঠিক বনছে না। কারণটা অতীব সরল। পাকিস্তান নিক্সনের চতুর্দিকে সাত পাকের বদলে সত্তর পাক খাচ্ছেন। পাকিস্তানই অগ্রণী হয়ে মার্কিনের সঙ্গে তার দুশমন চীনের ভাবসাব করিয়ে দিয়েছে। এখন তার দাদ নিতে হবে। এবং এর সঙ্গে জড়িত আছে আরেকটি ফৌজি চাল। শেষ পর্যন্ত যদি চীনের সঙ্গে লেগে যায় তবে আফগানিস্তানের ঘাঁটি থেকেও চীনকে কিছুটা বিব্রত করা যাবে।
কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মনে ধন্ধ সৃষ্টি করেছে। পাঠকের স্মরণে আসতে পারে, আমান উল্লাকে বিতাড়িত করার পিছনে ছিলেন, যাকে প্রায় আফগানিস্তানের পোপ বলা যেতে পারে, সেই শোর বাজারের হজরৎ। ডাকু বাচ্চা-ই-সাঁকোও কাবুলের দিকে এগিয়ে আসার পূর্বেই তাঁর আদেশে শাহি ফৌজের সেপাইরা বাগ-ই-বালা ত্যাগ করে যে যার বাড়ি চলে যায়। আমি পূর্বেই প্রশ্ন শুধিয়েছিলুম, আর্ক এবং বাগ-ই-বালা দাউদ খান দখল করলেন কী করে? যতদূর জানা গেছে, বলবার মতো কোনওই প্রতিরোধ সেখানকার সৈন্যরা দেয়নি হয়তো-বা ক্যু-র পূর্বেই এরা আপন আপন গাঁয়ে শোর বাজারের বর্তমান-গদিনশিনের আদেশে চলে গিয়েছিল। এবং এটাও লক্ষ করেছি, সদর দাউদ সরকারি পদ্ধতিতে সাড়ম্বরে তাঁর প্রথম ভাষণেই বলেছেন, তাঁর নবীন রাষ্ট্র যদিও রিপাবলিক তবু সেটা ইসলামের ঐতিহ্যানুযায়ী গঠিত হবে। বলা বাহুল্য, সেটা সুন্নি মজহব অনুযায়ী। তদুপরি দাউদ খান যখন দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ার মতো অনেক কিছু অনেক দিন থেকেই তাঁর রয়েছে, তখন শোর বাজার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণে আনেন, স্বয়ং মরহুম জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে কোন কোন পাকনায়ক শিয়া। এমনকি শিয়া না হয়েও জফরউল্লাহ এঁদের আরেক ধাপ নিচে তিনি কাদিয়ানি। গোঁড়া আফগান সদাসর্বদা কাদিয়ানি মাত্রকেই ইসলাম-ত্যাগী মুলাহিদ বলে গণ্য করে এবং তারা ওয়াজিব উল-কৎল– যাদের কতল করা ওয়াজিব। কাবুলবাসী জাত হিন্দু বা শিখের কাছ থেকে হয়তো-বা জিজিয়া ভোলা যায়, কিন্তু তাদের ওপর অত্যাচার করার বিধান নেই। স্বয়ং আমান উল্লাহর আমলে শহর-কাজির হুকুমে একজন তথাকথিত কাদিয়ানিকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারা হয়। দাউদেরও শিয়াদের প্রতি নিজস্ব উকট জাতক্রোধ আছে। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইরানের শিয়া শাহের প্ররোচনায় জহির তাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করে সরদারদের হিসেবে না নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাদামাটা ড, ইউসুফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন।*[* ১. ড. ইউসুফ বুদ্ধিজীবী ও রবিভক্ত। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের বৎসরই শান্তিনিকেতনে এসে কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।]
শোর বাজার-যাজক-সম্প্রদায় আমানউল্লাহর বিরোধী ছিলেন বলে ধর্মবিদ্বেষী সোভিয়েত আমান উল্লাহকে যতখানি পারে সাহায্য করে সেটা অবশ্য যৎসামান্য। কিন্তু তখন সোভিয়েত রাষ্ট্র মাত্র এগারো বৎসরের বালক। ক্যুনিস্ট-বৈরীরা বলে সোভিয়েত ইতোমধ্যে ধর্মবাবদে যথেষ্ট সহিষ্ণু হয়ে গিয়েছে, এমনকি প্রয়োজন হলে যাজক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আঁতাত করতেও এখন তার বিশেষ কোনও বাধা নেই। ইতালির শান্ত সংযত কম্যুনিস্ট নেতা নাকি এ পথ সুগম করে দেন।
এ সব জল্পনা-কল্পনা যদি সত্য হয় তবে একটা অভিজ্ঞতা-জাত তত্ত্ব এস্থলে স্মরণে রাখা ভালো। কাবুল রাজদূতাবাসের একাধিক ইংরেজ কূটনীতিক আমাকে বলেন, আফগান ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের মোটা রকমের মদত নিয়ে যিনিই এযাবৎ আফগান রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছেন, তিনিই আজ হোক কাল হোক, জনপ্রিয়তা হারান এবং তাকে হটাবার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র নতুন বিপ্লববাদীর অভাব হয় না। একটা প্যাটাইম শেষ হতে না হতেই অন্য দুর্দৈবের কথা কল্পনা করতেও আমার মন বিকল হয়ে যায়। আমরা গরিব, আফগানিস্তান আমাদের চেয়েও নিঃস্ব। সেখানে অযথা শক্তিক্ষয় রক্তপাত সার্বিক দৈন্য বৃদ্ধি করার জন্য গ্রহ-কুগ্রহের যোগাযোগ।
ভারত একদা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী ছিল, এখন নয়। সে স্বীকৃতি দিয়েছে একটিমাত্র বিষয় বিবেচনা করার পর। যে কোনও কারণেই হোক, তার বিশ্বাস হয়েছে সদর দাউদের গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা সফল হবে। তদুপরি হয়তো-বা কেউ কেউ বলবে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যে বিলম্ব করেছিলে সেটার পুনরাবৃত্তি কর না। ব্যক্তিগতভাবে আমি অতি অবশ্য বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একাসনে বসাই না, যদ্যপি আমি চিরকালই আফগানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। নীতির দিক দিয়ে, মানবতার দৃষ্টিবিন্দু থেকে বাংলাদেশের দাবি বহু বহু উচ্চে।
মি. ভুট্টো পড়েছেন ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে। ওদিকে মুর্শিদ নিনও অসুস্থতা ও ওয়াটার-গেট দুই গেরোর চাপে পড়ে সদর ভুট্টোর ভেট নামঞ্জুর করেছেন, এদিকে পাকদ্বেষী শিয়াবৈরী সদর দাউদ বড় বেশি মাত্রায় ভেট করতে চাইছেন যে।
.
রাজনীতি অবিশ্বাসে
ভারতের এক প্রাচীন রাজা তার দেশের সর্বোত্তম চিকিৎসক, কামশাস্ত্রবিদ এবং রাজনীতিকে ডেকে বললেন, তোমরা সবাই যে যার শাস্ত্রে পর্বতপ্রমাণ কেতাব-পুঁথির যেসব কাঞ্চনজঙ্ নির্মাণ করেছ সেগুলোতে আরোহণ করার প্রবৃত্তি এবং শক্তি আমার নেই। তোমরা তিনজন মিলে মাত্র একটা শ্লোকে আপন আপন বিদ্যে পুরে দাও। ওই দিয়েই আমার কাজ চলে যাবে।এস্থলে অক্ষম লেখকের সঙ্কোচে নিবেদন, আসলে রাজা চার শাস্ত্রের চার সুপণ্ডিতকে। ডেকেছিলেন, আমি চতুর্থ পণ্ডিতের বিষয়বস্তু তথা শ্লোকের চতুর্থাংশ বেমালুম ভুলে গিয়েছি। অতএব আশুতোষ ও অল্পতোষ পাঠককে বক্ষ্যমাণ ত্রিলেগেডরেস দেখেই সন্তুষ্ট হতে হবে।
বৈদ্যরাজ তার বরাদ্দ শ্লোকাংশে লিখলেন : জীর্ণে ভোজনং! অর্থাৎ ইতিপূর্বে যা খেয়েছ। সেটা হজম– জীর্ণ-হলে পর তবে ভোজনং অর্থাৎ তখন খাবে। এই বিসমিল্লাতেই ডাক্তার এবং কবিরাজে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ডাক্তারের আদেশে, রুটিনমাফিক, পানকচুয়ালি, প্রতিদিন একই সময়ে ভোজনং! পক্ষান্তরে কবিরাজ বলেছেন, পূর্বাহের পূর্বান্ন হজম হলে পর আপনার থেকেই ক্ষুধা পাবে, তখন খাবে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এটা ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনের উল্টো বিধান। যেদিন শারীরিক পরিশ্রমের বাড়াবাড়ি সেদিন ক্ষিদে পায় তড়িঘড়ি। যেদিন কারফুর কানমলায় উঠান-সমুদ্র পেরোনো প্রাণের দায়, সেদিন ক্ষিদে পায় কি না পায়! অতএব পানকচুয়ালি ভোজন হয় কী প্রকারে? তদুপরি অদ্যদিনের সুপার ডাক্তার রোগ ধরতে না পারলেই বলেন, নার্ভাস একদা যেমন বলতেন এলার্জি। তা তারা যা বলুন, যা কন- পাড়ার বারিক মালিক অবধি সব্বাই জানে, হৃদয়মন বিকল থাকলে ক্ষিদে পেট ছেড়ে মাথায় চড়েন।
মমেকসদয় পাঠক ঈষৎ অতিষ্ঠ হয়ে বলবেন, কোথায় কাবুলের হানাহানি আর কোথায় তুমি করছ ডাক্তার-বদ্যি নিয়ে টানাটানি!
.
কনফেশন বা কৈফেয়ৎ
পয়লা কদম ফেলার নাম মকদ্দমা, এর হুবহু সংস্কৃত প্রতিশব্দ অবতরণিকা। মকদ্দমা বলতে আরবিতে মামলা দায়েরের পয়লা পর্ব প্রিমা ফাঁসি কেস- বোঝায়। বাংলায় সাকুল্যে মোকদ্দমাটা বোঝায় এবং তারও বেশি আগাপাশতলা মোকদ্দমা এবং তার সাথি আর পাঁচটা বিড়ম্বনা বোঝাতে হলে বলি, মামলা-মোকদ্দমা। ইতিহাসের দর্শন শাস্ত্রের আবিষ্কর্তা ইবন খলদুন তাঁর বিশ্ব-ইতিহাসের অবতরণিকা মুকদ্দমার জন্য বিশ্ববিখ্যাত।
আসলে যা বলার কথা সেটি মোকদ্দমাতেই বলে নিতে হয়। আমারও শাদির পয়লা রাতেই বেড়াল মারা উচিত ছিল, অর্থাৎ বক্ষ্যমাণ ধারাবাহিকের পয়লা কিস্তিতেই। কিন্তু সে সময় ভাই-বেরাদর পাড়ার পাঁচো ইয়ার ছোঁক ছোঁক করছেন সদ্য সদ্য তাজা কাবুলি মেওয়া চাখবার তরে। আমার ফরিয়াদ শুনবে কে?
বাংলাদেশের পাঠক আমাকে চেনেন অল্পই। এর ভিতরে অনেকেই আবার আমার ওপর রাগত ভাব পোষণ করেন। মরহুম পূর্ব পাকিস্তানের সেকেন্ডারি বোর্ড আমার সর্বনাশকল্পে মল্লিখিত প্রথম পুস্তক থেকে তাদের স্কুলপাঠ্য গ্রন্থে বেপরোয়া ঝালে-ঝোলে-অম্বলে অর্থাৎ ক্লাস সিক্স্ থেকে ম্যাট্রিক অবধি দু পাঁচ পাতা তুলে দিতেন। আর কে না জানে, এনুয়েলের আজরাইল না আসা পর্যন্ত রবি-কবির ভাষায়, অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব সামনে আছে খোলা- কোন মূর্খ পাঠ্যপুস্তককে পাঠের উপযোগী বলে মনে করে? বললে পেত্যয় যাবেন, কাবুলিওয়ালার মতো সরেস গল্প ক্লাসে পড়াতে গিয়ে আমি হিমসিম খেয়েছি? বরঞ্চ বাচ্চাটাকে জোর করে কুইনিন গেলানো যায়, কিন্তু জোর করে রসগোল্লা গেলাতে গেলে সে যা লড়াই দেয় তার সামনে যোদ্ধাও ভাবে মিঞা ওসমানীর জায়গায় একে জঙ্গিলাট বানালে ন মাস আগেই স্বরাজ আসত।
আমার লেখা ভালো না মন্দ তার সাফাই আমি গাইব কি? মোদ্দা কথা– আমার রচনা পাঠ্যপুস্তকে তুলে সেটা জোর করে জোরসে যাদের গেলানো হয়েছে তাদের বর্তমান আবাস ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন হল-এ। সাধে কি আমি ওসব পাড়া এড়িয়ে চলি।
.
সূর্যসেন হল, বাপস! নব পরিচয়
তাই আমি নতুন করে আমার পরিচয় দিতে চাই। প্রায় বিশ বৎসর ধরে আমার লেখা এ দেশে পাওয়া যেত কালে কস্মিনে। ওপার বাংলা আমায় কিছুটা চিনেছে ওই দুই দশক ধরে। পূর্বদেশের বিজ্ঞপ্তি যে আমি সনাতন আফগানিস্তান আজকের দৃশ্যপটে ফেলে ধারাবাহিকভাবে লিখব, এ খবরটা যদি পাক-চক্রে সেখানে পৌঁছায় তবে ঘটিরা যে কী অট্টহাস্য ছাড়বে সে আপনারা হাইকোর্ট দর্শনে না গিয়ে স্রেফ বুড়িগঙ্গার পারে বসেই ঘটিগঙ্গার জলমর্মরের সঙ্গে শুনতে পাবেন। ওরা এবং এ-পারে, বহু দূরের বগুড়াবাসীরা মাত্র গুহ্য তত্ত্বটি অবগত আছেন; পার্টিশনের পরেই একটি বিশেষ দ্রব্য হেথাকার নওগাঁ থেকে চালান বন্ধ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের ছেলে সরাসরি নওগাঁ যাই কী প্রকারে? তাই সেটাকে বগুড়াবাসের কামুফ্লাজে ঢেকে সেখানে কয়েক মাস কাটাই। কিন্তু কপাল মন্দ। চিফ-সেক্রেটারি আজিজ আহমদ- আহা, কী আজিজ প্যারা দোস্তই না পেয়েছিল মহাপুণ্যবান মরহুম পূর্ব পাকিস্তান– তিনি আমাকে হাতের কাছে না পেয়ে লাগলেন আমার ইষ্টিকুটুমের পিছনে। কীই-বা করি তখন আমি আর? গুটি গুটি ফের কলকাতা। মেহেরবান আজিমুশোন আজিজ আহমদ খান জান-প্রাণ ভরে তসল্লির ঠাণ্ডি সস ফেললেন! পাকের চেয়ে পাক মশরিকি পাকিস্তানকে বরবাদ পয়মাল করার তরে যে বদ বখৎ হিন্দুস্থানি এসেছিল হেথায়, সে-ইবলিস গেছে। জিন্দাবাদ সাহেবজাদ আজিজ যদিও তিনিই পুব পাক বাবদে যে পাজ-সে-পাক সব-সে পহলি পালিসির (পলিসির খাঁটি আজিজি পাঞ্জাবি উচ্চারণ) পালিশ লাগিয়েছিলেন, তারই ফলে ডজন দুই বছর যেতে না যেতেই উপরকার দুই পাকের ভাই বেরাদরি ভণ্ডামির পলকা পলেস্তরা উবে গিয়ে বেরিয়ে এল– গিল্টি, গিল্টি, নির্ভেজাল গিল্টি; আজিজের দুই চোখ, দিলজানের দুশমন রবিঠাকুরের কণ্ঠে তখন পাগলা মেহের আলীর চিৎকার তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
ব এ গর্দিশে চরখ-ই-নীলুফরি
ন আজিজ বজ-আমদ ন্ নাদরি ॥
সুনীল নীলাম্বুজের ন্যায় গভীর নীলাকাশ একটি বারের মতো পরিবর্তিত হইয়াছে কি, না– নাদির এমনকি তাহার নাদরি হুকুম পর্যন্ত লোক পাইল– অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ। আমি শুধু প্রথম নাদিরের স্থলে আজিজ লোকটাকে দিয়ে নাম পরিবর্তন করেছি; স্বাধিকারপ্রমত্ত আজিজ চোটাওয়ালা নাদিরের মতো ফরমান ঝাড়তেন বলে নাদরীর পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করিনি।
মেহেরবান সম্পাদক, কারণ অকৃপণ অভাজন-অনুরক্ত পাঠক, আজ যদি প্রাণ খুলে দুটি মনের কথা কই তবে অপরাধ নিয়োনি। সিকি শতাব্দী ধরে ট্যাঁ-ফুঁ-টি করার উপায় ছিল না। ওপার বাংলাতেও না। এপারে যে আমার শতাধিক প্রিয়ের চেয়ে প্রিয়তর জন রয়েছে।
আচ্ছা, সে নয় আরেকদিন হবে।
.
গঞ্জিকা মিশ্রণ
নওগাঁয়ের সেইসঙ্গে বিশেষ বস্তুটি গুল যোগ করে যে অনির্বচনীয় রস তৈরি হয় আমি তারই রাজা– গুলগির। আলগিরের ওজনে টায় টায়। এর পুরো ইতিহাস বারান্তরে।… নিতান্তই কপালের গেরো, গ্রহের গর্দিশে আমি দু পাঁচজন গুণীর সংস্রবে একাধিকবার আসি। তাদেরই ঝড়তি-পড়তি মাল নিজের নামে চালিয়ে বাজারে কিঞ্চিৎ পসার হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত অবিমিশ্র সত্যঃ–গুরুগম্ভীর তত্ত্ব বা তথ্য ভেজাল না দিয়ে পরিবেশন করাটা আমার ধাতে সয় না, স্যাকরা যেমন আপন মায়ের জন্যে গয়না গড়ার সময়ও সোনাতে খাদ মেশাবেই মেশাবে। আমি উভয় বাংলার ক্লাউন ভাড়। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সার্কাসের ক্লাউন হরেক বাজিকর, প্রত্যেক ওস্তাদের কিছু না-কিছু নকল করতে পারে। আমো পারি।
অতএব প্রকৃত চাণক্য, আজকের দিনের রাজনৈতিক ভাষ্যকার আলাক্টের কুক-এর অনুকরণে আমি অতি যৎসামান্য কিছু বলতে গেলেও তার সঙ্গে গাঁজাগুল মিশে যায়। আমি মূল বক্তব্যে নিজেকে কিছুতেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারিনে। কবিতৃরস রক্তে থাকলে বলতুম, নাক বরাবর মোকামের দিকে হনহন করে না এগিয়ে মোকাবেমোকায় আকছারই পথের দু পাশে নেমে ফুল কুড়োই, প্রজাপতি-স্পন্দন ভ্রমর গুঞ্জনে বার বার মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ দেখি, তপ্তদিনের শেষে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে এবং মজিলে মা দূর আস্থ। পথের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ি। পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এ যাবৎ বাঘ-সিঙ্গির পেটের ভিতর যাইনি। সেই কুড়োনো ফুলের দু চারটে পাঠকের সামনে অবরে-সবরে পেশ না করতে পারলে আমার মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।
কামশাস্ত্রে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত লিখলেন, তন্বী সকাশে মৃদ্যাচারী অর্থাৎ তন্বী-শ্যামা পবিম্বাধরোষ্ঠী তথা সর্বনারীজনকে মৃদু-আচারে জয় করবে। জর্মন দার্শনিক বলেছেন, নারী সকাশে গমনকালে বেত্ৰদণ্ডটি নিয়ে যেতে ভুলো না ফেরগিস ডি পাইশে নি; প্রাগুক্ত কাম-পণ্ডিতের একদম বিরুদ্ধ বাণী, বিরুদ্ধ উপদেশ। আমার কোনও মন্তব্য নেই। আমি হাড়-আসে জড়ভরত। তাই বেকার বখেড়া না বাড়িয়ে স্ত্রী-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
রাজনীতিবিদ পণ্ডিত দুটি শব্দেই মোক্ষমতম তত্ত্ব রাজনীতিতে অবিশ্বাস প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ রাজনীতির আগাপাশতলা অবিশ্বাসে গড়া।
রাজনীতিতে অবিশ্বাস নয়, অবিশ্বাসে রাজনীতি।
.
আমান বনাম নাদির
আমান উল্লা অবিশ্বাস দিয়ে কর্মারম্ভ করে থাকলেও আখেরে নীতিভ্রষ্ট হয়ে রাজ্য খোয়ালেন।
নাদির শাহকে নির্বাসনে পাঠালেন। কিন্তু সসম্মানে অর্থাৎ ফ্রান্সের রাজদূতরূপে। দারাপুত্রকে জামিনস্বরূপ কাবুলে আটকে রেখেছিলেন কি না, সেটা গুরুত্বব্যঞ্জক। আমি কাবুলে রাজগোষ্ঠীর অনেক বালক-কিশোরকে চিনতুম। বেশ কজন আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু জহির খানের কথা একবারও শুনিনি। হয়তো-বা কয়েক বৎসর পর নাদির যখন রাজদূত-কর্মে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন তখন স্বভাবজাত কোমল-হৃদয় আমান উল্লা নাদিরের দারাপুত্রকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিংবা হয়তো গোড়ার থেকেই আটক রাখেননি।
একটা কথা এখানে ভালো করে মনে গেঁথে নিতে হয়। নাদির ফ্রান্সে পৌঁছেই প্রথম বিশযুদ্ধজয়ী মার্শাল পেতা এবং সঁা সির-এর ফরাসি অফিসারদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন এবং আমি লোকমুখে শুনেছি, নাদির-পেতাতে দিনের পর দিন বিরাট বিরাট মিলিটারি ম্যাপ খুলে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়নে নিমগ্ন হতেন। একদিন আমান উল্লা তখৎ হারাবেন আর তিনি স্বদেশ জয় করার জন্য লড়াই লড়বেন, এহেন আকাশ-কুসুম তিনি তখন চয়ন করেছিলেন কি না, সে তথ্য নির্ধারণ করবে কে? প্রবাদবাক্য আছে, ভাগ্যলক্ষ্মী কোনও না কোনও সময়ে হাতে একটা সুযোগ নিয়ে প্রতি মানুষের দোরে এসে আগল ধরে নাড়া দেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেন, তাঁর কৃপাধন্য জন সে সুযোগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখেনি। নাদির অতি অবশ্যই ব্যত্যয়!… একদিন ফ্রান্সে খবর পৌঁছল আমান উল্লা তখৃৎ হারিয়ে দেশত্যাগী হয়েছেন। নাদির তদ্দশ্যেই স্বদেশমুখী হলেন। কিন্তু তিনি অর্থ-হীন, অস্ত্রহীন। কী করে তিনি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন সে ইতিহাস দীর্ঘ। ভারতে তখন আমান উল্লাহর প্রতি মাত্রাধিক সহানুভূতি। নাদির কিন্তু আমান উল্লাহর পক্ষে না বিপক্ষে সে সম্বন্ধে কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। তিনি বললেন, প্রথম কর্তব্য, ডাকু বাচ্চা-ই-সকাওকে খেদানো; তখন দেখা যাবে। তার পর আফগান জনসাধারণ তাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালে তিনি স্বীকৃত হলেন। অবশ্য একথা সত্য, তখন তখুতের জন্য অন্য কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা; যদিও এস্থলে অবান্তর, তবু বহুজনহিতায় বলে রাখা ভালো, উপস্থিত তিনি তদ্বিরভোগ্যা।
প্রেসিডেন্ট দাউদ খান কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর। কিন্তু তাজ্জব মানতে হয়, অবিশ্বাস-শাস্ত্রে অবিশ্বাসী হলেও জহির শার নিরেট অতি-বিশ্বাসের আহাম্মকি দেখে। তিনি কি আদৌ জানতেন না, দাউদ খান কতখানি শক্তিশালী? সেটা তো পরিষ্কার বোঝা গেল একটিমাত্র সাদামাটা তথ্য থেকে : ইহ সংসারে আর কোন্ কু দে তার নায়ক চব্বিশ ঘন্টার ভিতর কিংবা অম্লাধিককালের মধ্যে প্রথম স্বীকৃতি লাভ করার পর ঢাউশ ধামা নিয়ে বসতে পেরেছেন স্বীকৃতি লাভের কামতরুতলে। পটাপট পড়তে লাগল দুনিয়ার গোটা গোটা মোটা মোটা সরেস সব মেওয়া কাবুলি মেওয়াকে সঙ্গ দেবার তরে, একটা হপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে! এস্তেক অভিমানভরে, গোসসা করে কমনওয়েলথ বিবিকে তিনতালাক দেনেওয়ালা হি-ম্যান, হজরত আলীর তরবারি নামধারী অপিচ বাংলাদেশকে মেনে-নিতে-নিতান্তই-লজ্জাবতী নখুরা রানি সদূর-ই-আলা আগা-ই-আগা মুহম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টো।
সু-উচ্চ স্বীকৃতিতরু শাখা থেকে তাঁর বাং-মাছ-পারা মোচড় খাওয়া পতনভঙ্গির রঙ্গটা দেখতে আমার বড়ই সাধ যায়।
.
অবিশ্বাসস্য পুত্ৰা
মিস্টার ভুট্টোর অত্যধিক ভয় পাবার এখনও কোনও কারণ নেই। রুশ, মার্কিন, চীন, ইরান সবাই যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে এবং মল্লভূমিতে সুন্দুমাত্র সদর দাউদ পাকিস্তানের সদর ভুট্টোর মোকাবিলা করেন তবে ভুট্টোর বিশেষ কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি কোনও স্ট্যাটিসটিকসের ওপর নির্ভর করে এই ভাগ্যফল গণনা করিনি। ধরে নিলুম, দুই মল্লবীর লড়াই লাগার পর তাদের আপন আপন দেশে যা অস্ত্রশস্ত্র সৈন্যদল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাবেন। কোনও পক্ষই বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি কানাকড়ি কিংবা ডাড বুলেটও পাবেন না। জানি, আজকের দিনে এ রকম একটা ভ্যাকুয়ামে দুই পক্ষ বেশিদিন লড়তে পারবেন না। মার্কিন, রুশ, চীন– তিন রাষ্ট্রই যে বিশ্বের একচ্ছত্রাধিপত্য চান এ রকম একটা সিদ্ধান্ত কেউই কসম খেয়ে করতে পারবেন না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, এই তিনজনের প্রত্যেকেই প্রতিদিন ঘামের ফোঁটায় একে অন্যের কুমির দেখেন। মাঝরাতে হঠাৎ রাশা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে বসে ককিয়ে ওঠে, এইযু-যা! মার্কিন ব্যাটারা বুঝি কাজে গিলে ফেলল! হু, কাল আবার রিপোর্ট পেয়েছি, মার্কিন মুরগিটা এক ঝটকায় আরও এক ডজন এটম বোম পেড়েছে। একুনে তা হলে কত হল? আমার ভাঁড়ারে কটা? মার্কিন ওই একই দুঃস্বপ্ন দেখে, বলশি ব্যাটারা যে বড্ড বেশি গুঁড়ি গুঁড়ি জাপানের সঙ্গে দোস্তি করার তরে এগোচ্ছে। আর মাটির তলায় কিংবা ওই বহুদূর আর্কটিকের সমুদ্রগর্ভে যদি এটম বোম ফাটায় তবে হেথায় কি সেটা যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়বে? হুঁ, সত্যি বটে বাবাজি ব্রেজনেভ এসেছিলেন বোষ্টমের নামাবলি পরে, বাজালেন শ্রীখোল, কিন্তু, দাদা কিসিংজার, ভুলে যেয়ো না মাইরি, শ্ৰীযুত মলটফও বৈষ্ণবতর চন্দনের এ্যাব্বড়া তিলক কপালে একে ঘোরতর-শাক্ত শ্রীহিটলারের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে এসেছিলেন শ্রীবৃন্দাবন– বার্লিন কুঞ্জে। ফলং? সর্বশেষ ফল হিটলারের গোটা মুলুকসুদু গেলেন তেঁশে। চীন কী স্বপ্ন দেখে তার ছোট্ট একটি নমুনা বলে গেছেন সাধনোচিতধামপ্রাপ্ত জওয়াহির লাল। চীন নেতা নাকি তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, লড়াইয়ের নামে শিউরে উঠবে তোমরা, এরা-ওরা, আর-সব্বাই- সে তো বাংলা কথা! কিন্তু আমি ডরাব কোন্ দুঃখে! দু পাঁচ কোটি মরে গিয়ে তোমরা সবাই যখন চিৎপটাং, তখনও আমার আরও ক কোটি রেস্ত থাকবে, হিসাব করে দেখেছ? দুনিয়াটা দখল করতে তখন আমাদের গাদা-বন্দুকটারও দরকার হবে না। জাপানও যে কোনও স্বপ্নই দেখছে না, কে বলবে? কুল্লে দুনিয়ার ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার বেপরোয়া ডোন্টো-কেয়ার করে ওই যে হোথা ফ্রান্স পরশুদিন এটম বোম ফাটাল, সেটা কি খয়রাতি হাসপাতাল খোলার হুলুধ্বনি? … অবিশ্বাস অবিশ্বাস, সর্ব বিশ্বে অবিশ্বাস! শৃন্বন্তু বিশ্বে অবিশ্বাস্য পুত্রা।
অসকার ওয়াইডল বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকেরই বেশকিছু বেকার বাজে জিনিস আছে যেগুলো আমরা স্বচ্ছন্দে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি, কিন্তু ভয়, পাছে কেউ কুড়িয়ে নেয়! আফগান দেশে মাইলের পর মাইল শুধু পাথর আর পাথর, কিংবা সিন্ধুদেশে বালি আর বালি, কিন্তু হলে কী হবে, আমি– মার্কিন যদি দখল না করি তবে বলশি ব্যাটা যে নেবে না, তারই-বা কী পেত্যয়? ইন্ডিয়াই-বা কোন তক্কে আছে কে জানে? এই হল বিশ্বভুবনের শঙ্কা, বিভীষিকা!
অতএব এটা নিতান্তই কল্পনা-বিলাস যে, দাউদ খান আর ভুট্টোর ব্যারিস্টারে রোদের পর রোদ লড়ে যাবেন আর দুনিয়ার কুল্লে নেশন রাস্তার ছোঁড়াদের মতো শুধু হাততালি দিয়েই মজাটা লুটে নেবেন। কথাটা খুবই খাঁটি কিন্তু এই কল্পনা-বিলাসেও সুদুমাত্র যে আকাশ-কুসুম চয়ন করা হয়, তা নয়। বিজ্ঞানীরা বিস্তর এক্সপেরিমেন্টে প্রথম ভ্যাকুয়ামে সফল হলে পরে স্বাভাবিক বাতাবরণের প্রভাবদুষ্ট অবস্থায় অর্থাৎ রুশ-মার্কিন-ইন্ডিয়া-ইরানের আপন আপন স্বার্থসিদ্ধির মতলবের মাঝখানে সেই একসপেরিমেন্টের পুনরাবৃত্তি করে প্রত্যক্ষ ফল লাভ করেন।
.
যদিস্যাৎ
ভ্যাকুয়ামের লড়াইয়ে ব্যারিস্টারের বিশেষ ভয় পাবার কিছু নেই।
ধরে নিলুম, দাউদ খান প্রধানত রুশ বা/এবং যে-কোনও জাতের কাছ থেকেই হোক, অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু জমায়েত অবস্থায় পেয়েছেন তথা জহির শাহ চল্লিশ বছর ধরে যা-সব কিনেছিলেন তাই নিয়ে নামলেন লড়াইয়ে। মোল্লাদের হুকুমে সেপাই পেতেও অসুবিধে হবে না। আর সরাসরি হুকুমটাও গৌণ– শোর বাজার বারণ না করলেই হল। আসল যে যুক্তি শাহি ফৌজকে অনুপ্রাণিত উদ্বুদ্ধ করবে, তার দিল জানে জোশ পয়দা করবে সেটা অতি অবশ্যই লুট করার সম্ভাবনা কতখানি? আফগান সরকার সেপাইদের যে কী মাইনে দেন সে আমার জানা আছে। পূর্বেই ধরে নিয়েছি অন্য কোনও রাষ্ট্র সদর দাউদকে কোনও অর্থসাহায্য উপস্থিত করবে না। আর করলেও যা হবে সেটা আমরা বিলক্ষণ অনুমান করতে পারি। ইনফ্লেশন। আঁতকে উঠলে নাকি সোনার বাংলার পাঠক সিদুরে মেঘ দেখতে পেলে নাকি? কিন্তু পাঠান এই সুপ্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি চেনে না।
.
ইনফ্লেশন
ঈষৎ অবান্তর হলেও, পাঠক, তুমি উপকৃত হবে। বিশেষ উপস্থিত আমরা যখন কাবুল পেশাওয়ার নিয়ে আলোচনা করছি। আমার জানা মতে যে মহাপুরুষ এ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ইনফ্লেশন নামক গজবটা অনুমান করতে পেরেছিলেন তিনি বাবুর বাদশা। হিন্দুস্থান জয় করার পর বাবুর বাদশাহর আমিররা কাবুলে ফিরে গিয়ে লুটতরাজে বিস্তর যে সব ধন-দৌলত জমা করেছিলেন সেগুলো দু হাতে ওড়াবার জন্য বাবুরের কাছ থেকে বিদায়ের অনুমতি চাইলেন। তিনি বিস্তর যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, হিন্দুস্থানের মতো ঐশ্বর্যশালী বিরাট রাজত্ব ত্যাগ করে কাবুল-কান্দাহারের মতো নির্ধন দেশে ফিরে যাওয়াটার মতো আহামুকি তাঁর কল্পনাতীত। আমিররা পণ ছাড়েন না। শেষটায় তিনি যা বললেন (আমি স্মৃতি থেকে বলছি, পাঠক বাবুরনামাতে পাবেন) তার বিগলিতাৰ্থ : ধরুন, এখন কাবুল-বাজারে দৈনিক ওঠে এক হাজার আণ্ডা। আপনার বিস্তর টাকা-কড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হওয়ামাত্রই তো সেখানে তিন হাজার আণ্ডা হাজির হবে না। কাবুল এবং তার আশেপাশের শক্তি তো আর রাতারাতি বেড়ে যেতে পারে না। আপনারা একে অন্যের সঙ্গে লড়ালড়ি করার ফলে আণ্ডার দাম তখন যাবে চড়ে। যে আণ্ডা আগে এক পয়সা দিয়ে কিনতেন সেটা কিনবেন এক টাকা দিয়ে, যে গালিচা কিনতেন একশো টাকা দিয়ে সেটা কিনবেন এক হাজার টাকা দিয়ে। লাভটা তা হলে কী হল? আগে যে-রকম আমোদ-আহ্লাদ করতেন এখনও করবেন ততখানিই। মাঝখানে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি মোহর-দিনার ঢালাই হবে সার।
অবশ্য আমিররা এই সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক তত্ত্বটির কানাকড়িও বুঝতে পারেননি। তারা যে শেষ পর্যন্ত বাবুর বাদশাহকে বর্জন করে কাবুল চলে যাননি তার অন্য কারণ ছিল। কিন্তু আমিরদের দোষ দিলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। দুষ্টলোকে বলে বাংলাদেশে এখন ইনফ্লেশন। কেনবার জিনিস নেই, ওদিকে নোটের ছয়লাপ, ইনফ্লেশন হবে না তো কী, আসমান থেকে মন্না সলতা ঝরবে? আমি নিজে জানিনে। মার্কিন মুল্লুকে তো কোনও দ্রব্যের অভাব নেই। তবে ডলার মার্কেটের ধাক্কায় বিশ্বজোড়া ধুন্দুমার লেগে গেছে কেন? একাধিক গুণী বলছেন, নিক্সন কর্ণধার হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ইনফ্লেশন, অবশ্য আমাদের তুলনায় ধূলি পরিমাণ এবং অর্থশাস্ত্রের প্রাচীন অর্বাচীন ডাঙর ব্যাঙ্কার প্রফেসার বাণিজ্যের কর্ণধার সব্বাই বলেছেন, এ ইনফ্লেশনের কারণ এবং দাওয়াই যে মুনি বাৎলাতে পারবেন তিনি অর্থশাস্ত্রের ইতিহাসে অজরামর হয়ে বিরাজ করবেন।
.
দুশমন বাইরে না ভিতরে
মোদ্দা কথায় ফিরে আসি।
কবে সেই ১৯৫৩ থেকে দাউদ খান দাবি জানাচ্ছেন, ফ্রনটিয়ার এলাকাকে স্বায়ত্তশাসন দাও, আর (হিটলারি কায়দায়) আমাকে দাও খাইবারপাস পেরিয়ে করাচি অবধি একটা করিডর। আমাদের একটা বন্দর না হলে চলবে কেন? পাঞ্জাবিরা বুদ্ধ। তারা তখন চাইল না কেন, খাইবার গিরিপথের পশ্চিম মুখ থেকে কাবুল অবধি একটা করিডর? কাবুলের গাছপাকা আঙুর, আপেল, নাসপাতি, জরদ-আলু, আলু বালু, শফৎ-আলু, গেলাস, চিলগুজা, বাদাম, আখরোট আপন হাতে পেড়ে পেড়ে না খেলে তাদের গায়গত্তি লাগবে কী করে? স্বাস্থ্য বরবাদ হয়ে যাবে না? ইয়ার্কি পেয়েছ?
দাউদ পাকিস্তানকে আক্রমণ করবেন সঠিক কোথায়? বেলুচিস্তানের চমন অঞ্চলে না খাইবারপাস অঞ্চলে–না উভয়ত? হিটলারের পয়লা নম্বরি ট্যাঙ্ক সঁজোয়া গাড়ি পর্যন্ত রাশার দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে করতেই ঘায়েল হয়ে যেত। হ্যাঁ, এখানে অত দূরের পাল্লা নয়। কিন্তু ট্যাঙ্কগুলোও তেমন সরেস নয়। আর রাস্তার চওড়াই? না ওসব কোনও কাজের কথা নয়। বোমারু প্লেন? হঃ! ইয়েহিয়া পূর্ব পাক হারাল, তবু জাবড়ে ধরে রইল তার প্লেনগুলো।
ফ্রন্টিয়ার নো-মেনস-ল্যান্ডের পাঠানদের লেলিয়ে দেওয়া যায় না?
লুটতরাজ কোন অবস্থায়, কাকে করা যায়, কাকে করা যায় না, সেটা পুরুষানুক্রমে করে করে পাঠান এ বিষয়ে পৃথিবীর সেরা স্পেশালিস্ট। টিক্কা খান কীভাবে নিরীহ, নিতান্ত নিরস্ত্র বেলুচের ওপর বেদরদ বে-এক্তিয়ার কায়দায় বোমা ঝরাতে পারেন সে তো তারা বেলুচিস্তানে পাহারা দেবার সময় স্বচক্ষে দেখেছে, এবং এই বাংলাদেশেও তারই মদতে তারা লুট করার সময় পাঞ্জাবিদের খুব-একটা পিছনে ছিল না। তার আখেরি নতিজা কী হয়েছে, সেটা ফ্রন্টিয়ারের পাঠানরা অবগত হয়েছে।
হিটলার বার বার তাঁর জেনারেলদের বলতেন, অত সতর্ক হয়ে পা টিপে টিপে রুশ দেশে অভিযান চালাবার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই রুশ দেশটা হুবহু একটা ঝুরঝুরে কুঁড়েঘরের মতো, দরজাটার কাঠও পচাহাজা। মারো জোরসে বুট দিয়ে গোটা দুই লাথি। হুড়মুড়িয়ে বেবাক ঘর ধুলায় ধূলিসাৎ।
রাশার বেলা রোগ নির্ণয়ে হিটলার গোভলেট করেছিলেন।
ব্যারিস্টার ভুট্টোর পশ্চিম-পাক বাড়িটা দেখে সক্কলের মনে কিন্তু, কিন্তু কিন্তু না-ও হতে পারে।
.
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়– টীকা
জন্মের দিনই মানুষের নামকরণ হয় না, কিন্তু প্রবন্ধ লেখার প্রারম্ভেই শিরোনামা একটা না দিয়ে উপায় নেই। এ সুবাদে কবিগুরুর একাধিকবার বলা বিশেষ একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ল। তদুপরি বাইশে শ্রাবণ আসন্ন। প্রাচীন দিনের কথা। ১৯২১ সাল। রবীন্দ্রনাথ তখন ষাট বছরের যুবক। পূর্ণোদ্যমে বিশ্বভারতীয় সদ্যোজাত কলেজ বিভাগে ক্লাস নিতেন। নিজের কবিতা উপন্যাস এবং তাঁর প্রিয় ইংরেজ কবি শেলি কিটসের লিরিক। পাঠক হয়তো লক্ষ করেছেন, বলাকা কাব্যগ্রন্থে কবিতাগুলোর কোনও শিরোনামা নেই। তিনি নিজের থেকেই বললেন, কবিতায় শিরোনামা পড়ে পাঠক ধরে নেয়, গোটা কবিতাটা বুঝি ওই নামটা সার্থক করার জন্যই লেখা হয়েছে। তা তো নয়। কবিতা যখন উৎস থেকে বেরিয়ে যাত্রাপথে নামে তখন আপন গতিবেগে চলার সময় শিরোনামার প্রতি দৃষ্টি রেখে সোজা পথে এগিয়ে যায় না। সে ডাইনে-বাঁয়ে বাঁক নিয়ে নিয়ে তার নতুন নতুন রূপ দেখায়। (এই ভাবাংশটুকু কবি গানে বলেছেন, নতুন নতুন বাকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে/পাতার ভেলা ভাসাই নীরে)। মিশরির সুতোটা থাকে চিনির টুকরোর ঠিক মাঝখানে। তাই বলে সুতোটাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য তো ধরেই না, ওই সুতোটার অস্তিত্ব সার্থক করার জন্য মিশরি আপন সত্তারও বিকাশ করে না। কবিতার বেলা তারও বেশি। কবিতা তার শিরোনামার চতুর্দিকে ঘোরপাকও খায় না।
বলা বাহুল্য, আমি জরাজীর্ণ ছলনাময়ী স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই কবির বক্তব্যের নির্যাস নিবেদন করলুম। খোঁজা সম্প্রদায়ের লোক জামা-খানায় তাদের নামাজ শেষ করার পর যে রকম বলেন, ভুলচুক, মৌলা, বখশো আমিও উন্নাসিক পাঠকের কাছে নিবেদন জানাই, ভুলচুক যা হয়েছে বখশিশরূপে মাফ করে দিয়ে।
কিন্তু বলাকার পরের কাব্যগ্রন্থ পলাতকায় কবি পুনরায় শিরোনামা দেবার প্রথায় ফিরে গেলেন। বোধহয়, নামের পরিবর্তে কবিতাতে অঙ্ক-শাস্ত্র-সুলভ নম্বর লাগালে সেটা অপ্রিয় দর্শন তো হয়ই, তদুপরি এ সত্যও অস্বীকার করা যায় না যে, কোনও কোনও কবিতার শিরোনামা আমার মতো কবিতৃরসবঞ্চিত পাঠককে মূল বক্তব্য বুঝে নিতে সাহায্য করে–অবশ্য তাবৎ কবিতাতেই যে মিশরির সুতোর মতো মূল সূত্র থাকবে এহেন ফতওয়া কোনও আলঙ্কারিকই এ তাবৎ কবিকুলের স্কন্ধে চাপাননি।
বক্ষ্যমাণ ধারাবাহিকের জন্মদিনেই একটা নাম, নিতান্তই দিতে হয় বলে প্রথম লেখার কপালে সেঁটে দিয়েছিলুম। আজ তার ষষ্ঠী যাকে আমার দেশে ছুটি, উত্তরবঙ্গে বোধহয় ষাইটলা না কী যেন বলে। এদিনে অন্তত নামটা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলতে হয়।
আসলে পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় বাক্যটি একটি ফরাসি প্রবাদবাক্যের আবছায়া অনুবাদ। প্ল্যু সা শাঁজ, প্ল্যু সে লা ম্যাম শোজ- যতই সে নিজেকে বদলায়, ততই তার মূলরূপ একই থাকে- যতই তার পরিবর্তন হয় না কেন, ততই ধরা পড়ে, সে অপরিবর্তনীয়। এটাকেই অন্যভাবে বলা হয়, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে। তার অর্থ যতই ভিন্ন দেশে ভিন্ন বেশে কোনও একটা ঘটনা ঘটুক না কেন, আখেরে ধরা পড়ে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ ঘটনাটা এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া নতুন নয়। তাই এক শ্রেণির ঐতিহাসিক দাদা আদমের আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই বিরাট বসুন্ধরা খুঁজে বেড়ান প্যাটার্নের সন্ধানে। যেমন কাশ্মিরী শালে আমের প্যাটার্ন পশমের উপর সোনার জরি দিয়ে করা, বানারসি কিংখাপে সেই প্যাটার্নই রেশমের উপর রুপোর জরি দিয়ে করা, রাজশাহীর আম-সন্দেশে সেই প্যাটার্নই স্রেফ ছানা-চিনি দিয়ে গড়া। মালমশলা যাই হোক, নির্মিত ও-বস্তুটির চেহারাটি একই। খোলনলচে যতই পালটান– যেই হুঁকো সেই হুঁকো। কিংবা বলতে পারেন, একটা পশম আরেকটা রেশম হরেদরে হাঁটুজল। কিংবা বলতে পারেন, পাড়ার মেধো ওপাড়ার মধুসূদন। কিংবা– না থাক!
যাত্রারম্ভেই বলে রাখা কর্তব্য, আমি কট্টর মোল্লাকুলজাত পাতি মোল্লা। আমার পূর্ব-পুরুষ ছিলেন রাজহাঁস, আমি ভাগ্যবিপর্যয়ে পাতিহাঁস। প্যাটার্ন হরেদরে একই। আমার পক্ষে মোল্লাদের নিন্দাকীর্তন, যে-শাখায় বসে আছি তারই মূল কর্তন। আমি অত পাড় কালিদাস বা শেখ চিলি নই। তা সে যাই হোক, মূল কথা এই, আফগানিস্তানের ইতিহাস মোল্লা-মৌলবী ভিন্ন কল্পনা করা যায় না।
আমির হবীবউল্লা মোটের ওপর সুখেই রাজত্ব করছিলেন কিন্তু কেন জানিনে, শেষের দিকে হঠাৎ তার শখ গেল বিলিতি কায়দা-কানুন অনুকরণ করতে। খুবসম্ভব তার এবং রাজপরিবারের দু একজন রোগীকে বিলিতি ডাক্তার সারিয়ে দিয়েছিল বলে তাঁর বিশ্বেস জন্মে, বিলিতি আর পাঁচটা রীতিনীতি আমদানি করলে গোটা দেশটার ধন-দৌলত বেড়ে যাবে। সাধারণ জন ভাবে, আমান উল্লাহই বুঝি সর্বপ্রথম বিলেত-পাগলা রোগে আক্রান্ত হয়ে রাতারাতি দেশটাকে গোরা-সায়েব বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বস্তৃত দু একটা ব্যাপারে তিনি আমান উল্লাহরও একতলা উপরে বসে বসে বিলিতি খুশবাই-বিলাস উপভোগ করতেন। হবীবউল্লার হারেমটি ছিল বাছাই বাছাই সুন্দরীতে ভর্তি। কুল্লে আফগানিস্তানের তাবৎ কওমের তরো-বেতরো পরী হুরী দিয়ে তিনি হারেমটিকে করে তুলেছিলেন বহু বৈচিত্র্যময় গুল-ই-বাকাওলির গুলিস্তান। জানিনে, কী করে তার নজরে পড়ে, রাশান ব্যালে নর্তকীদের কিছু ফটোগ্রাফ এবং রঙিন ছবি। বড়ই পছন্দ হল তার হাঁটুর ইঞ্চি ছয় উপরে হঠাৎ যেন হেঁটে দেওয়া সাতিশয় শর্ট স্কার্ট। হারেমের অপেক্ষাকৃত তরুণীর পালকে তিনি সেই বেশে সাজিয়ে দিয়ে এক অজানা-অচেনা ভিনদেশি আনন্দদায়ী চিত্তচাঞ্চল্য অনুভব করলেন।
হারেমের ভিতর কী হয় না হয় সে নিয়ে মোল্লা সম্প্রদায়ের মাথা ঘামাবার কথা নয়। কিন্তু তবু এই বিজাতীয় বেশ– বেশাভাবও বলা চলে উকট পল্লবিত বর্ণনাসহ তাদের কানে পৌঁছল। মোল্লাদের ভিতর রাজদ্রোহী মনোভাব দেখা দিল। সেইটেকে প্রথম উস্কিয়ে দিয়ে নসর উল্লা হয়ে গেলেন তাদের প্রিয়পাত্র। বহু বিচিত্র কৌশলে আমান উল্লাহর মাতা নরকে হটিয়ে করে দিলেন আমান উল্লাকে তাদের প্যারা। আখেরে হবীবউল্লা আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান।
আমান উল্লাহও ওই একইরূপে রাজ্য হারালেন। তাঁর মাতা অসাধারণ বুদ্ধিমতী রমণী গোড়ার থেকেই বাবাজিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, আর যা করবার করিস, বিলিতি সং সাজিসনি। হবীবউল্লাকে তাতিয়েছিল ছবি, ফটো; আমান উল্লাহকে খেপিয়ে দিল বিলিতি সিনেমা। কাবুলের সিনেমাহলে আমি যেসব রদ্দি ছবি দেখেছি সেগুলোর অনেকগুলি, সে আমলে তো নয়ই, এ আমলেও বোধহয় উভয় বঙ্গের সদাশয় সেন্সর দেখবারই সুযোগ পান না। মঞ্জুর না-মঞ্জুরির কথাই ওঠে না।… প্যারিসের বুলভার, লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসের স্বপ্ন দেখছিলেন আমান বিলেত যাবার পূর্বেই। আচম্বিতে বাস্তবে নেবে মালুম হল, সিংহাসন নেই, তিনি পিতৃনগর কান্দাহারের পথমধ্যে দাঁড়িয়ে।
যুবরাজ ইনায়েৎ রাজা হলেন। একে তো তখৃৎ তার ন্যায্য সম্পত্তি, তদুপরি তিনি শরিয়তের এমন কোনও বিধান ভঙ্গ করেন নি যে তার বাদশাহ হতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা। কিন্তু শোর বাজারের হজরত রাজি হলেন না। ইনায়েৎ উল্লাকে কিন্তু তখৎ-মুলক ত্যাগ করে বিদেশে চলে যাবার অনুমতি দেওয়া হল। তিনি প্লেনে চড়ার সময় স্বয়ং শোর বাজার অ্যারপোর্টে হাজির ছিলেন। সে প্লেন আকাশে অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হজরত রানওয়ের উপর দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে আজান দিলেন। সময়টা কোনও নামাজের আসন্নকাল নয়। আজানটা প্রতীক; আফগানিস্তান থেকে কুফরের শেষ চিহ্ন ঝেটিয়ে বের করা হল। আমার ভালো লাগেনি।
সেই প্যাটার্নের পুনরাভিনয় হল চুয়াল্লিশ বৎসর পর। সদ্র দাউদ সিংহাসনচ্যুত জহির পরিবারের অধিকাংশ জনকে প্লেনে করে বিদেশ চলে যেতে দিয়েছেন। বিবেচনা করি, এবারে কোনও আজানধ্বনি উচ্চারিত হয়নি। এই যা তফাৎ। এই তফাৎটুকু থাকাতেই পরিবর্তনটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে অপরিবর্তনীয়ের দিকে নির্দেশ দিল। প্ল্যু সা শাঁজ–ইত্যাদি।
.
রিপাবলিক!
বাংলাদেশ-ভারত উভয়ই দাউদি সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনার-আমার বলবার আর কী থাকতে পারে, কিন্তু ওই রিপাবলিকের চেঁকিটা গিলতে আমি অক্ষম এবং অনিচ্ছুক। বলা নেই, কওয়া নেই, কাবুলির সেই কাঁঠাল-খাওয়ার কাহিনী থেকে কাঁঠাল বের করে অকস্মাৎ আমার মাথায় ফাটানো! কবেকার সেই ১৯৩০-৩১ থেকে অদ্যাবধি কেউ তো কখনও রিপাবলিকের কথা পাড়েনি। সরদারদের সবাইকে জিরোতে দিয়ে রাজা জহির যখন খানদানি ফিউডেল ঐতিহ্য ভঙ্গ করে গেরস্তঘরের ছেলে ডক্টর ইউসুফকে প্রধানমন্ত্রী করলেন তখন তো রাজা দেশটাকে গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন– কই, তখনও তো কেউ রিপাবলিকের কথা তোলেনি। দাউদও ইউসুফকে মদ দেবার তরে হিন্দুকুশ উত্তোলন করেননি। তিনি উষ্মভরে গোসসা ঘরে ঢুকে খিল দিলেন– গোড়াতে। পরে কী কী করলেন সেইটেই তো বিশ্ববাসী জানতে চায়। জানবে নিশ্চয়ই, একদিন।
রিপাবলিক, জহুরিয়া যে নামে খুশি ডাকুন, পুরনো সেই হুঁকোটা এখন অবধি সেই ডাবা-হুঁকোটাই রইল।
.
শ্রাবণ হয়ে এল ফিরে
হঠাৎ শেষরাত্রে নামল আধো-আধো বৃষ্টি–রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্। সঙ্গে সঙ্গে পুরবৈয়া হাওয়া জানালার পর্দাটাকে যেন নৌকোর ঝুলে-পড়া পালটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে করে দিল পূর্ণাঙ্গী। মাঝে মাঝে বারিপতন ক্ষান্ত দিচ্ছে, কিন্তু পুরবৈয়া হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূর দক্ষিণ সমুদ্র থেকে, তরঙ্গিত নদীধারার ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোলায় দোলায় যে-বাতাস উত্তর পানে পাড়ি দিয়েছে মানস সরোবরের তীর্থযাত্রায় সে আমারই বাড়ির এক কোণে বেণুবনে পুরবৈয়া হাওয়াকে, গত বর্ষার দীর্ঘ বিরহের পর ঘন ঘন আলিঙ্গন করছে। বেণুবনের পাতায় পাতায় মৃদু কূজন-গুঞ্জন-মর্যর আমার মর্মে যেন বিলোল হিল্লোল তোলে ক্ষণে ক্ষণে। দক্ষিণ হাওয়া বইতে শুরু করেছিল মৃদু মৃদু, ভয়ে ভয়ে, কবে সেই শীতের শেষে। হিমালয়ের হিমানী মাখা নিষ্ঠুর শীতল উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে লড়াই দিতে গিয়ে সে ভীরু হার মেনেছিল প্রথম অভিযানে–হুঁহু করে আবার দীনদরিদ্রের সর্বাঙ্গে কাঁপন তুলে ধেয়ে গিয়েছিল উত্তরী-হাওয়া দক্ষিণ থেকে দক্ষিণতর দিকে, যেন পলাতক দখিন হাওয়ার বর্জিত রাজ্যে সম্মার্জনী সঞ্চালন করতে করতে। দখিন হাওয়া কিন্তু মনে মনে সান্তুনা মানে; জানে, একা সে-ই ভীরু নয়, তার চেয়েও ভীরু আছে, একটি ক্ষুদ্র পুষ্প-মাধবী। উত্তরের বাতাসকে শেষ অভিযানে সম্পূর্ণ পরাজিত করে আবার সে যখন বনে বনে আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে ডালে ডালে তার বিজয়পতাকার কুসুম-কুসুম গরম পরশ বুলিয়ে দেবে, তখন সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠবে পারুলপলাশ পারিজাত, করবী দেবে সাড়া, বকুল পাবে ছাড়া, শিরীষ উঠবে শিউরে, চমকি নয়ন মেলি চামেলি রইবে তাকিয়ে, অপলক দৃষ্টিতে। তবু ভীরু মাধবীর দ্বিধা যায় না, দখিন পবনের প্রতি-বিজয় অভিযানের পরও আঙ্গিনায় এসে যেন থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু ওই ভীরুটি, ওই শঙ্কিতা-হিয়া কম্পিতা-প্রিয়া না এলে তো উৎসব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গেয়ে ওঠে সবাই সমস্বরে :
হে মাধবী, দ্বিধা কেন,
আসিবে কি ফিরিবে কি
আঙ্গিনাতে বাহিরিতে
মন কেন গেল ঠেকি॥
দেখেছি দেখেছি, সব দেখেছি যুদ্ধশেষের প্রথম বসন্তে।
দখিন বাতাস বসন্তে ঘুরে মরে একা একা। তার পর আকাশের শুরু হয় গুরু গুরু গ্রীষ্মের দহন দাহ সাঙ্গ হয় যখন। নেমে আসে বারিধারা আর তখন বায়ু বয় পুরবৈয়া। দুই পবনে ওই বেণুবনে হয় তাদের পুনর্মিলন।
অমা যামিনীর অন্ধকার। পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে আর কোনও শব্দ নেই শুধু মৃদু ঝঝরে ক্ষণে ক্ষণে বরিষণ– রিম ঝিম রিম ঝিম। কখন যে বর্ষণ শান্ত হয় বুঝতে পারিনে। বাঁশের পাতার ভিতর দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণের বাতাস তোলে একই মর্মরধ্বনি। এবারে এসে দেখি প্রতিবেশী তার অশথগাছটাকে কেটে ফেলেছেন। অশথের পাতা বাতাসে অতি সামান্য আভাস পেলেই আমাকে শোনাত সারা দিনমান যেন ঝরনার গান। বাশবনের চেয়েও তার পল্লবে পল্লবে হিল্লোলে থরথর কম্পন দিয়ে ক্ষীণ বরিষণ ধ্বনির অনুকরণ করে রুদ্র তৃষা-তপ্ত বৈশাখের দ্বিপ্রহরে, নিদ্রাহীন ত্রিযামা যামিনীতে পীড়াতুর জনকে ওই অশথ অকারণ ছলনা দেয় বার বার। এখানে নয়, বীরভূম, ছাপরা, আগ্রা-দিল্লিতে যেখানে দিনের পর দিন পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল কাটে তাম্ৰসম বিবর্ণ আকাশ-বাতাসের মাঝখানে নিরুদ্ধ নিশাসে নিরস্তু নিরাশায়– তার পর আসে ধূসর পয়োধরহীন আষাঢ়, জনপদবধূ তাকিয়ে থাকে মায়ামমতাহীন দিকচক্রবালের দিকে, আসে শ্রাবণ- কোথায় সে বিরহী যক্ষের মেঘ-শ্রেণি যার দাক্ষিণ্য কঠিন পাষাণপ্রায় অম্বরকে মধুর মেদুর করে দেবে?- এমন সময় বাতায়নপাশে, মৃদু পবন যখন অশথ-পল্লবে মর্মরধ্বনি তুলে বর্ষণের ঝিরিঝিরি রব অনুকরণ করে ধ্বনি মরীচিৎকার নিষ্ঠুর মোহজাল পেতে কাতরজনকে ছলনা করে, তখন কবিগুরুর সর্বশেষ কবিতা আসে স্মরণে, তার পরিপূর্ণ রুদ্র অর্থ নিয়ে—
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে।
থাকুন দিল্লি, আগ্রা, দূরেই থাকুন তাঁদের বিরাট সৌধ বিপুল বৈভব নিয়ে। আর, আর ওই মিথ্যা বিশ্বাসের বিচিত্র ছলনাজাল নিয়ে। আমার এখানে, এই নির্ধন দেশে, সেই সুধাঁধারা আবার আসুক, আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, এসো বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।
আর আমার দুই আঁখি যাক হারিয়ে সজল ধারায় ওই ছায়াময় দূরে, ধানক্ষেতের উপর দিয়ে, ভরা গাঙ্গের কূলে কূলে, দেশ থেকে দেশান্তরে, হয়তো-বা জরাজীর্ণ এ জীবনের শেষপ্রান্তে।
ওই নেমেছে; এবারে কিন্তু ঝমাঝম বিষ্টি। বিষ্টি আর বিষ্টি। বেণুবন-মর্মর, ছিন্ন কদলীপত্রের ঝঝর সব ছাপিয়ে দিয়ে। এবারে আর কোনও ছলনা নয়। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, মেঘ-ভারে নুয়ে পড়া আকাশ নীর অন্ধকারে বিলুপ্ত হয়নি। আমারই মতো নিদ্রাহীন চোখ নিয়ে রাজপথের যামিনী-জাগরিণী দিবান্ধ প্রদীপমালার বিচ্ছুরিত জ্যোতি আকাশের নিম্নপ্রান্তে আতাম্র আরক্ত মৃদু প্রলেপ দিয়ে আলোকিত করে রেখেছে। গ্রামাঞ্চলে দূর ভিন গাঁয়ে আগুন লাগলে যে রকম তার লালচে আভা পশুপক্ষীর প্রাণেও আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
হ্যাঁ, আতঙ্ক। হিটলারও এই রকমেরই এক অনৈসর্গিক চন্দ্রালোকের বিবরণ শুনে শঙ্কাতুর কণ্ঠে শুধিয়েছিলেন, কৃত্রিম চন্দ্রালোক? সে আবার কী?
নিত্যদিনের প্রথানুযায়ী দ্বিপ্রহরে সামরিক মন্ত্রণাসভার দিবসের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হয়েছে। পশ্চিম-উত্তর রণাঙ্গনে মনটগমেরি তখন হল্যান্ডের ভিতর দিয়ে হামবুর্গ পানে এগোচ্ছেন। সে রণাঙ্গনে শত্রু-মিত্রের অগ্রগতি, পশ্চাৎ অপসারণ, তাদের বর্তমান ঘাঁটি ইত্যাদি সর্বশেষ প্রতিবেদন বলে যাচ্ছেন বিরাট ম্যাপে অঙ্গুলি নির্দেশ করে করে আঞ্চলিক অ্যাদদাকা। বলতে বলতে তিনি উল্লেখ করলেন, অতিশয় অন্ধকার রাত্রি। এ রাত্রে মন্টগমেরির পক্ষে আক্রমণ করা অসম্ভব। হঠাৎ বিরাট রণাঙ্গন আলোকিত হল কৃত্রিম চন্দ্রালোকে
বিস্মিত হিটলার অ্যান্-এর কথা মাঝখানে কেটে দিয়ে শুধোলেন, কৃত্রিম চালোক! সে আবার কী? জাল, কুয়াশা বহুকাল ধরে রণ-কৌশলে সুপরিচিত কিন্তু কৃত্রিম চালোক!
অ্যাদ: পূর্বেই বলেছি, রাত্রি ছিল অত্যন্ত অন্ধকার। অমাবস্যার রাত্রেও নুয়ে-পড়া রাশি রাশি মেঘ না থাকলে নীরস্ত্র অন্ধকার সৃষ্ট হয় না। মেঘগুলো ছিল তুষারধবল। মনটগমেরি অ্যারপ্লেন-অন্বেষণকারী সবকটা সার্চলাইট মেঘের উপর তাগ করতে আদেশ দিলেন। সার্চলাইটের তীব্র রশ্মি মেঘে মেঘে প্রতিবিম্বিত হয়ে অত্যুজ্জ্বল যে-আলো সৃষ্টি করল সেটা মেঘমুক্ত পূর্ণিমার মতো।
.
এখানে বর্ষা নামে তার ঘনতম ঘনাবরণে। মাঝে মাঝে পশ্চিম থেকেও বৃষ্টি আসে– সে বৃষ্টি অতিদূর আরবসাগর থেকে বেরিয়ে এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে দুর্বল হয়ে যায়। তাই বিরহী যক্ষ যে-রামগিরি জনকতনয়ার মান-পুণ্যোদকে অভিষিক্ত হয়েছিল তারই উপরে দাঁড়িয়ে মেঘপুঞ্জকে অনুরোধ করেছিল, আমার বিরহবার্তা নিয়ে তুমি, হে মেঘ, অলকায় গমন করে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ কর। কিন্তু আমি জানি, তুমি দয়াশীল, দাতা। যেসব ভূখণ্ডের উপর দিয়ে তুমি ভেসে যাবে সেগুলো নির্মম গ্রীষ্মের অত্যাচারে বিবর্ণ শুষ্ক দঞ্চপ্রায়। কাতর নয়নে জনপদবধূ ঊর্ধ্বে তোমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করবে, বারিধারা ভিক্ষা চেয়ে। আমার অনুরোধ, নিজকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ কর না, বিরহিণী প্রিয়াকে আমার সন্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।
যে শ্যামাম্বুরাজি যক্ষের কাতরতা শুনতে পায়নি তারা অলকার দিকে না গিয়ে মধ্যভারত, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, রাঢ়ভুমিতে বিগলিত আত্মদান করতে করতে যখন দীর্ঘ যাত্রাশেষে এই পুণ্যভূমিতে পৌঁছয়, তাদের সঞ্চয় সেকালে প্রায় নিঃশেষ! কিন্তু, ভো ভো বর্ষণ-ক্লান্ত মুসাফির! আমরা অল্পেই সন্তুষ্ট। যৎ অল্পং তদ্ মিষ্টং! তোমার পদধ্বনি পূর্বাঙ্গণে, পূর্বদেশে নন্দিত হোক।
ওই, ওই যে বৃষ্টি আসে মুক্ত কেশে, আঁচলখানি দোলে। বাতাসে বাতাসে বর্ষণসিক্ত সজলভরা কণ্ঠে ভেসে আসছে ভোরের আজান। সাধ যায়, এই বর্ষণমুখরিত নগরীর উপকণ্ঠ পেরিয়ে দেখে আসি, বুড়িগঙ্গায় কতখানি জল বাড়ল।
না, আমাকে কেউ যেতে দেবে না। এ বয়সে। বয়সের শেষে।
মনে পড়ল এক জাপানি কবির করুণ শেষ প্রশ্ন। ক্ষয়রোগে তিনি যাত্রার শেষপ্রান্তে প্রায় পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল, প্রতি বৎসর বাতায়নপাশে বসে অবিরল বরফপাত দর্শন। বরফ জমে উঠছে, মাঠে-ঘাটে-বাটে, জমে উঠছে, জমে উঠছে। তিনি দেখছেন, আর দেখছেন।
কিন্তু এবারে তুষার-বর্ষণ দর্শনার্থে তার বিছানাতে উঠে বসাও কঠিন বারণ। মাঠ-বাট দেখতে পাচ্ছেন না। জাপানি তিন কলির হাইকাই পদ্ধতিতে রচা তাঁর শেষ কবিতা রেখে গেছেন তিনিঃ
শুধায়েছি বার বার, কত বার!
হায়, শুধু প্রশ্ন– এ আমার,
এবারেতে কত উঁচু হয়েছে তুষার?
হাউ অফটেন,
হ্যাভ আই আসকট
হাও হাই ইজ দি স্নো??
.
ডানপিটে দুঁদে
একাধিকবার পরাজিত হয়ে জহির উদ্দীন মহম্মদ বাবুর মনস্থির করলেন, আপন পিতৃভূমি ফরগনা পীর মানে না দেশে দেশে, পীর মানে না ঘরের বউয়ে, নীতি অবলম্বন করে তার প্রকৃত মূল্য নিতান্তই যখন সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না, তখন ভাগ্যান্বেষণে দেশান্তর অভিযানই প্রশস্ততর। এ-যুগে কিন্তু, কি দুর্কমানিস্তান, কি আফগানিস্তান সর্বত্রই ভাগ্যান্বেষণকারীর সংখ্যা কমে আসছে। তার প্রধান কারণ, সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে হলে যে গুণটি মাত্রাধিক, অপর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজন তার নাম আত্মবিশ্বাস। এ যুগের সবচেয়ে নামকরা এডভেনচারার আডলফ হিটলারের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক, কূটনৈতিক, সামবিদ, মনস্তাত্ত্বিক, অতিশয় সীমিত সংখ্যক তার অন্তরঙ্গ জন অ্যা-দকা সেক্রেটারি স্টেনো পরিচারক ভ্যালে– এমনকি তার বৈরীকুল পর্যন্ত এক বাক্যে তার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান যে বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন সেটি তার আত্মবিশ্বাস। তার অবিচল সদাজাগ্রত প্রত্যয় ছিল, নিয়তি (প্রভিডেন্স) তাকে নির্বাচিত করেছেন, জর্মনির ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য। পরাজয়ের পর পরাজয়, পুনরপি পরাজয়, তথাপি তার আত্মবিশ্বাস এবং সর্বশেষ সংগ্রামে তিনি বিজয়ী হবেনই হবেন প্রত্যয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে চলছিল তার জীবনান্ত পর্যন্ত। তাঁর অতিশয় অন্তরঙ্গ, নিত্য সহচরগণ বিস্মিত অবিশ্বাসের সঙ্গে লক্ষ করেছেন, তার কল্পনাপ্রসূত স্বকৃত অনৈসর্গিক আত্মবিশ্বাসের এই ইন্দ্রজাল। বস্তুত তিনি ঠিক কোন মুহূর্তে পরাজয় স্বীকার করে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত হলেন সেটা চিরকালই অভেদ্য রহস্য থেকে যাবে।…. জহির উদ-দীন বাবুরের আত্মবিশ্বাস হিটলারের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। কিন্তু বাবুরের সহচরদের মধ্যে সে আত্মবিশ্বাসের প্রতিনিয়ত বর্ধমান দার্চ লিপিবদ্ধ করার মতো লিপি-কৌশলী কেউই ছিলেন না, অপরঞ্চ বাবুর অতিশয় সযত্নে রোজনামচার মাধ্যমে তার আত্মজীবনী রেখে গিয়েছেন; ওদিকে হিটলার এ ধরনের অপকর্ম রীতিমতো বিপজ্জনক বলে মনে করতেন এবং তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল, যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ পরিকল্পনা একান্ত একা-একাই করে, সফলতা কামনা করতে পারে একমাত্র সেই-ই।
.
দলপতি মাত্রই আর্টিস্ট
এইসব এডভেনচারারদের সম্বন্ধে এতখানি সবিস্তর লেখার কারণ এই যে, পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় এ ধরনের লোক এখনও লুপ্ত হননি। এদের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল হতে হলে এদের ক্রমবিকাশ লক্ষ করতে হয়। এডভেনচারার হওয়া মাত্রই এঁদের সর্বপ্রথম কর্ম হয় সাঙ্গোপাঙ্গ জোগাড় করা। ঐতিহাসিক মাত্রেরই বিস্ময়ের অবধি নেই, চব্বিশ বছরের অপদার্থ যে-ভ্যাগাবণ্ড স্বদেশ অস্ট্রিয়া ত্যাগ করে মনিকে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যে পূর্ববৎ আশ্রয়-সম্বলহীন ট্রাম্প, সে কী করে তার চতুর্দিকে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যে ঝাঁকে ঝাকে হরেক রঙের চিড়িয়া জোগাড় করে ফেলল? এবং সম্পূর্ণ অবিশাস্য বলে মনে হয়, তার ভিতর ছিলেন সে যুগের দুই নম্বরের জঙ্গিলাট জেনারেল লুডেনডর্ফ। অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আমরা যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছি, দ্বিতীয় পর্যায়ে পাই তারই বাহ্য প্রকাশ। এখানে দুঃসাহসিক ভাগ্যান্বেষীকে আর্টিস্টরূপে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। আর্টিস্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঋষি তলস্তয় বলেছেন, যে ব্যক্তি আপন অনুভূতি অন্যজনের ভিতর সঞ্চারিত করতে পারে সে আর্টিস্ট। হিটলার তার আত্মবিশ্বাস যে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির নর-নারীতে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে সঞ্চারিত করবার মতো অলৌকিক শক্তি ধারণ করতেন সে সত্য তাঁর নিকটবর্তী প্রচ্ছন্ন শত্রুরা পর্যন্ত নিরতিশয় ক্ষোভ ও উম্মার সঙ্গে স্বীকার করেছেন….. বাবুরের সে টেকনিক বিলক্ষণ আয়ত্তাধীন ছিল, তদুপরি ভাগ্যান্বেষণের অরুণোদয় থেকেই তাকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামতে হয়েছে। অসিহস্তে অশ্বপৃষ্ঠে রণাঙ্গনে যেখানেই সঙ্কটময় অবস্থা সেখানেই তিনি নির্ভয়ে তীরবেগে উপস্থিত হয়েছেন, যে কারণে একাধিক পরাজয়ের পরও দূরদর্শীজন তাঁকে পরিত্যাগ করেনি।
.
সাবধান! ভেজাল চিনে নেবেন!
অদ্যকার ভুট্টো, ইরানের শাহ বাবুরের তুলনায় শিশু। নিতান্তই যোগাযোগ এবং হতবুদ্ধি মজ্জমান জুন্তার শেষ ত্রাণ-তৃণ-খণ্ডরূপে প্রথম জনের কর্তৃত্ব লাভ, দ্বিতীয়জনও দ্রুতবেগে পলায়নের পর অবশেষে রুশের সদয় নিরপেক্ষতা ও ইংরেজের প্রতি নতিস্বীকার, এই দুই গ্রহের যোগাযোগের ফলে আপন পূর্ব সত্তায় প্রত্যাগমন। আমার মন লয়, কৈশোরে চতুরঙ্গ খেলায় গজচক্র অশ্বচক্র বড়েচক্র পুনঃপুন ভেঁকিবৎ ভক্ষণ করার পর, আপন আপন দেশে যখন গেলবার মতো আর কোনও চেঁকি কোনও চাষিবউই তামাশা দেখবার তরেও দিতে রাজি হল না, তখন দু জনাই সহজতর কূটনীতি-চতুরঙ্গ-অঙ্গনে রঙ্গ-ব্যঙ্গে সঙ্গ দিলেন। একে অন্যকে।
নিক্সন আর পাঁচটা ভুইফোড় মার্কিনের মতো খানদানি মনিষিদত্ত বাদশাহি হাতের পিঠ চাপড়ানোটা পাবার তরে হামেহাল বড্ডই ছোঁক ছোঁক করেন। তদুপরি, আড়াই-তিন হাজার বছরের প্রাচীনস্য প্রাচীন রাজসিংহাসনে আসীন– জানিনে, হয়তো কুল্লে দুনিয়ার প্রাচীনতম মনার্কি, যদ্যপি বর্তমান শাহটির পিতামহ-প্রপিতামহের প্রস্তাব তুলছিনে সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করলে শাহ-ইন-শাহের অনুগতজন অকস্মাৎ সাময়িক স্মৃতিস্তম্ভন বা আংশিক বধিরতায় আক্রান্ত হন। সর্বোপরি প্রশ্ন, দেড় হাজার বছরের প্রাচীন পেহলভি (সংস্কৃতে পহলবি) খেতাব হঠাৎ করে ভুড়ভুড়ি দিয়ে উঠল কোন রসাতল থেকে? একদা যেরকম তারই অক্ষম অনুকরণে গওহরি মহিমায় আড়াই-তিন হাজার বছরের পুরনো গান্ধার (প্রাচীন পেশাওয়ার-জালালাবাদ অঞ্চল) ফান্দার আমাদের মতো গাইয়া বেকুবদের চমক লাগবার তরে মরা লাশে ভূতের মতো চাড়া দিয়ে উঠেছিল? এর খাতিম উল-খিতাব হয়, যদিস্যাৎ অকস্মাৎ সদর-ই আলা ভুট্টো তার এলাকার পঞ্চসহস্রাধিক বর্ষীয় মোন-জো-দভোর বলদ-মার্কা সিল সেঁটে কিছু একটা পাঁচহাজারি মনসব তলব করে তাবৎ পাপী-তাপী পাকিজনকে শরিফ উল্-আশরাফ খানদানে তুলে নেন।
.
প্রাণনাথ ডাকো
শ্রুতিধর পাঠক! অস্বীকার করতে পারবে না, এইমাত্র সেদিন আমি তোমাকে ফেয়ার ওয়ার্নিং দিয়েছি, গুলতানি না করতে পারলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এবং আফসোসের কথা, বর্তমান গুলটি খুব সম্ভব তোমার ন সিকে চেনা। কিন্তু পাঠক, আমরা সব্বাই চেনা জন, চেনা জিনিসকেই কি বেশি পছন্দ করিনে? মেলায় গিয়ে চেনা জনের মুখ খুঁজি, অচেনা লাইব্রেরিতে ঢুকলে তার দাম যাচাই করি চেনা বইয়ের সন্ধান নিয়ে, গোরস্তানে খুঁজি মরহুমদের চেনা নাম। তবু অতি সংক্ষেপেই সারছি। বাঙ্গাল গেছে শেয়ালদ বাজারে ঘটির তরকারি পট্টিতে। বাইগনের সের কত? ঘটি হেসে কুটি কুটি। বাইগন! কী কইলে মাইরি! বাঙ্গাল– চটিতং : ক্যান, কইছি তো কইছি, অইছে কী? ঘটি : ছোঃ! কিবা নাম, বাইগন! বেগুন–আহা, কী মিষ্টিই না শোনায়! বাঙ্গাল– উচ্চহাস্যে : হঃ! মিষ্টি নামেই ডাকবা তয় প্রাণনাথ ডাকো না ক্যান? স্যার কত প্রাণনাথের? ডাঙ্গর ডাঙ্গর প্রাণনাথ গুলাইন?
শাহ, গওহর, গদিটা আরেকটু দড় হলে মিস্টার ভুট্টোও সবাই এ নীতিতে আমাগো প্রাণনাথ নীতির প্রবর্তক প্রাণনাথ বাঙ্গালের অতিশয় অনুগত বশংবদ শাকরেদ। খানদানি খেতাবই যদি লইবা, তয় লওনা কইলজাড়া ভইরা পুরানার পুরানা, হিডারও পুরানা খানদানি খেতাব। হিটলারও বলেছেন, মিথ্যে যদি বলতেই চাও তবে পাতি মিথ্যে বল না। বল পাড় মিথ্যে–ইয়াব্বড়াবড়া কেঁদে কেঁদো মিথ্যে। মিথ্যেটা যত বিরাট কলেবর হবে, পাবলিক গিলবে সেটা তত সহজেই।
নিক্সন শাহ-এর মেহেরবানি পেয়ে বে-এক্তেয়ার। কোন চাড়াল বামুনের হাতে দৈবযোগে পৈতে পেলে– বুদু জানবে কী করে, বিটলেটা খাঁটি নদীয়ার মাল, না জিঞ্জিরা-মার্কা ভেজাল– উল্লাসে নৃত্যভারে ধানের মরাই খুলে দেয় না। অবশ্য নিক্সনের মুক্ত হস্তে ট্যাঙ্ক, প্লেন ঢালার অন্য কারণও আছে। কিন্তু তার গোড়ার গলদ, শাহকে একটা মস্ত বড় এডভেনচারার বলে ধরে নেওয়া।… বরঞ্চ সদর দাউদের যা-হোক তা-হোক একটা ক্যালিবার আছে। লোকটি এডভেনচারার এবং গ্যামবলার। অসম্ভবের আশায় তিনি সম্ভাবনীয়টাকে বাজি ধরতে রাজি আছেন।
.
ঐতিহাসিক দাবি
এবারে আমি যা বলতে যাচ্ছি, সেটা কোনও ঠাণ্ডা-মগজের লোক বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু যে সত্য আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ, যে সত্যের সমর্থন আমি দীর্ঘকাল ধরে পেয়ে এসেছি সেগুলো এই দাউদ-সুবাদে আমাকে বলতে হবে। বিশ্বাস না করলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না।
(১) ১৯২৭ সালের গ্রীষ্মকালে আফগান স্বাধীনতা দিবসে (জশন্-এ) জনগণ তথা কাবুলস্থ সর্ব রাজদূতের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য গণসভায় আমান উল্লা ঘন ঘন করতালি হর্ষধ্বনির মাঝখানে নানা কথার মাঝখানে সদম্ভে সগর্বে বলেন, সিকন্দর শাহ পাঞ্জাব জয়ের পর বিরাট ভারত দখল না করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করল কেন? কারণ, আমরা আফগানরা– তার লেজ কেটে দিয়েছিলুম বলে, অর্থাৎ আফগানরা আলেকজান্ডারের লাইন অব ক্যুনিকেশন কেটে দিয়েছিল! বিগলিতাৰ্থ : আফগান জাত সিকন্দর-বিজয়ী।
(২) আফগানিস্তানের প্রাচীন ইতিহাস কোনও আফগান লিখেছেন কি না জানিনে। যে অর্বাচীন ইতিহাস কাবুলের স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় তার পনের আনা, ভারতের গবেষণা-জাত, ভারতে লিখিত ইতিহাস থেকে আফগানাংশ কেটে বের করে, আফগান জাতির গৌরব-গরিমা শতগুণ বৃদ্ধি করে স্কুল হস্তে প্রলেপ লাগানো দম্ভোক্তি।
(৩) সাধারণ আফগান নিরক্ষর। কাবুল-কান্দাহারের স্কুলবয় সে ইতিহাসের দু পাতা পড়ে বিশ্বাস করে, ভারতে ইংরেজাধিকার না হওয়া পর্যন্ত ওই ভূখণ্ড ছিল আফগানিস্তানের কলোনি, জমিদারি– যা খুশি বলতে পারেন। মোদ্দা কথা : মুহম্মদ ঘোরির আমল থেকে, বিনয় যাদের ভূষণ নয়, তাদের মতে গজনির মাহমুদের কাল থেকে ইংরেজ কর্তৃক পাঞ্জাব বিজিত হওয়ার প্রাক্কাল পর্যন্ত আফগানিস্তান হিন্দুস্থানের ওপর রাজত্ব করেছে, সাতশো, মতান্তরে হাজার বৎসর ধরে। হ্যাঁ, কোনও কোনও আফগান রাজা দিল্লি-আগ্রায় কিছুকাল বাস করছেন বটে। যদি বলা হয় আর বলবেই-বা কোন্ উন্মাদ–বাবুর তো তুর্কোমান, তিনি তো পাঠান বা আফগান নন, তবে অতিশয় সংক্ষিপ্ত ও সরল উত্তর : বাবুর ছিলেন কাবুলের রাজা। সেই কাবুল-রাজ দিল্লি জয় করেন। কিন্তু মৃত্যুর সময় আদেশ দেন, তার মৃতদেহ যেন তার রাজধানী কাবুলে গোর দেওয়া হয়। এর পর আর কী প্রমাণ চাই? বাবুর যে কাবুলের রাজা ছিলেন, সেটা তো তর্কাতীত! পরের মীমাংসাগুলো প্রথম সিদ্ধান্ত থেকে পিল পিল করে বেরোয়।
(৪) ইংরেজ কর্তৃক ভারত শাসন একটা অতি আকস্মিক অতিশয় সাময়িক দুঃস্বপ্ন মাত্র। আফগানিস্তান পুনরায় তার হক্কের উপনিবেশ জয় করবে। ঘোরি, গজনবি, লোধি (লোদি) এ সব কওম, তাদের বাসভূমির নাম, এখনও কাবুলে নিত্যদিনের কাজকর্মে কথাবার্তায় ফিরে ফিরে আসে; হিন্দুস্থানে এসব ইতিহাসের শুষ্কপত্রে মুদ্রিত নামমাত্র। সরকারিভাবে প্রচারিত পাকিস্তানই-বা কি, আর ভারতই-বা কি, আর বাংলাদেশই-বা কি? আসলে সবকটা মিলে ওটা অখণ্ড হিন্দুস্থান (ভারতের কট্টর সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এতবণে অবশ্যই নিরতিশয় উল্লাস বোধ করবেন!)। সেইটে আমাদের প্রাপ্য।
(৫) সরদার দাউদ খান কাবুলের ওয়ারিসানের এই অতিশয় সীমিত বিনয়ভরে দাবি-দাওয়ায় কতখানি বিশ্বাস করেন, জানিনে, কিন্তু তিনি যে-দশ-বৎসর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সে সময় স্বাধীন, বিকল্পে আফগানিস্তানের প্রদেশরূপে পখতুনিস্তান এবং পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে করাচি অবধি করিডরের (পুরোপাক্কা সরকারি ওয়ারিসানসূত্রে) পুনঃপুন দাবি জানিয়ে তথাকথিত ইতিহাসপুষ্ট স্কুলবয়দের ড্যাম ফেভরিট হয়েছিলেন সেটা সর্ববাদীসম্মত। সে-সব বয়রা এখন ইসটুডিনট এবং ফৌজি আপিসর–এরাই নাকি দাউদের প্রধান সহায়ক।
আমি জানি, আসমুদ্রহিমাচল আফগানের এই দাবি, গৃহে প্রত্যাবর্ত আবুহোসেনের তখং দাবির মতো বুদ্ধির অগম্য, হাস্যকর বলে মনে করবে। তা হলে স্মরণ করিয়ে দিই প্রায় একশো বছর ধরে তৎকালীন ভারত-রাজ ইংরেজের সমুখে কাবুল-রাজ কখনও লাহোর-মুলতান, কখনও পেশাওয়ার-আটক্ অবধি দাবি করেছেন। ইংরেজের কাছে তখন ঠিক আজকের মতো ওই রকম দাবি বুদ্ধির অগম্য হাস্যকর বলে মনে হয়েছে।
আর সত্যি বলতে কী, কোন্ দেশে এ ধরনের দাবিদার একদম নেই? তারতম্য শুধু সংখ্যাতে এবং দাবির চৌহদ্দি নিয়ে। পঞ্চাশ বছর পূর্বে আমরা বুক ফুলিয়ে গিয়েছি, এখনও যে একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছি তাই-বা কিরে কেটে বলি কোন হিম্মতে–
একদা যাহার বিজয় সেনানী
হেলায় লঙ্কা করিল জয়!
হেলায়!!
.
হাইকোর্ট দর্শনস্য দর্শনং
বাঙ্গালের হাইকোর্ট দর্শনের তবু একটা অর্থ আছে। কিন্তু যখন ইউরোপীয় এবং বিশেষ করে মার্কিন-বাঙ্গাল কলকাতা বা কাবুলের হাইকোর্ট দর্শনে যায় এবং সেখান থেকে দারুণ দারুণ রগরগে রিপোর্ট পাঠায় তখন বাঙ্গালকে তসলিম জানাতে ইচ্ছে করে।
পূর্ববঙ্গবাসী একশো বছর ধরে জানত, নোয়াখালি বা সন্দ্বীপের সুদূরতম প্রান্তেও যদি খুন হয় এবং সদরের দায়রা-আদালতে যদি আসামির ফাঁসির হুকুম হয়, তবে সে হুকুম কলকাতা হাইকোর্ট থেকে মঞ্জুরি না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ঝুলতে হয় না। রাঢ়ের তুলনায় পূর্ব বাংলার গ্রামবাসী একটু বেশি গরম মেজাজের হয়, তার আত্মসম্মান জ্ঞান একটু বেশি টনটনে। উচ্চশিক্ষিত শান্তিকামী নাগরিক এটাকে স্থলবিশেষে হিংস্র বলে মনে করতে পারে, কিন্তু আমার মতো শক্তিহীন অর্থদীনকে দেশ-বিদেশে এত লাঞ্ছনা অবমাননা সক্ষোভে সহ্য করতে হয়েছে এবং হচ্ছে যে, সে রগচটা বাঙ্গালের ধৈর্যচ্যুতি এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সখা সুপকু বংশদণ্ডের অনুসন্ধান দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং অতি অবশ্যই তার মঙ্গল কামনা করে। সে কথা থাক। অতএব খুন-খারাবি দেখে দেখে অপেক্ষাকৃত অভ্যস্ত মিম্বর উল্লা বা গদাই নমশূদ্র পাকেচক্রে যখন কলকাতা যায় তখন যদি সে সেই ভবনটি দেখতে চায় যার গর্ভগৃহে প্রতিদিন স্থির করা হয়, কে ঝুলে ঝুলে লম্বমান অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করবে আর কে-ই-বা রোগশয্যায় মা-ধরণীর বক্ষ থেকে সমান্তরাল রেখাবৎ বিদায় নেবে, তখন আমি গাইয়া আশ্চর্য হব কেন? শহুরে কলকেত্তাই ব্যাপারটা আদৌ বুঝতে পারে না, কারণ তার সীমাসরহদের ভিতর তার অতি সুদূর ক্ষীণ পরিচিতজনের কাউকে কণ্ঠদেশে রজ্জবদ্ধাবস্থায় লম্ববান দেহে ইহলোক ত্যাগ করতে হয়নি কিংবা সে সম্ভাবনার সম্মুখীন হতে হয়নি। সে হাইকোর্টের মর্ম বুঝবে কী করে? তাই হাইকোর্টের প্রতি বাঙ্গালের গভীর শ্রদ্ধা, তার দর্শন-লাভ তীর্থ-দর্শনের সমতুল্য বিবেচনা করাটা নিয়ে ঘটি ঠাট্টা-মস্করা করে!… ঢাকাতে যখন হাইকোর্ট নির্মাণ আরম্ভ হয়, তখন আমার কী উল্লাস, কী নৃত্য! আমি তখন কর্তাব্যক্তিদের পই পই করে অনুরোধ উপরোধ করি– অবশ্য ফোন মেরামতির নিষ্ফল প্রচেষ্টাতে নিত্যি নিত্যি পর্বতপ্রমাণ যা করতে হয় তার তুলনায় ধূলিপরিমাণ নস্যবৎ- আমাদের হাইকোর্টটিকে যেন কলকাতার তুলনায় লাগসই জুআফিক বেশ খানিকটে উচ্চতর পর্যায়ে রূপায়িত করেন যাতে শ্যামবাজারের রকে বসে ঘটিদের সগর্বে আদেশ দিতে পারি, ঢাকা গিয়ে সেথাকার হাইকোর্ট দর্শনজনিত অশেষ পুণ্যার্জন করতে পারে! কেউ শুনল না আমার উচ্চাদর্শের প্রস্তাবটি! শুনলে কী হত? ওই যে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ দো-হুঁদো ইন্ডিয়ান সেপাই হেথায় এসেছিল তারা আমাদের হাইকোর্ট দেখবার তরে মাথা উঁচু করতেই– দ্যাখ-তো-না-দ্যাখ– তাদের টুপি, পাগড়ি এস্তেক মন্টিতক মন্তকচ্যুত হয়ে গড়াগড়ি যেত না? যে দু চারটি শেষ কুট্টিবেরাদর এখনও লিকলিক করে বেঁচে আছে তারা সরেস সরেস গণ্ডাদশেক মস্করা-কিসসা বানিয়ে টেরচা নয়নের বাঁকা টিটকিরি কেটে আপন জীবন ধন্য মেনে, স্বয়ং আপন জানাজার ব্যবস্থা করে দিয়ে কুট্টি বংশের শেষ প্রদীপটি ফুঁ মেরে নিভিয়ে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে পুলসিরাত পেরিয়ে যেত না? শুনতে পাই, কলকাতার লোক আজ নাকি আমাদের হ্যাঁনস্তা করে। করবে না? দাসীর কথা বাসি হলে ফলে। তখন যদি হাইকোর্টটা উঁচু করে বানাত তবে– যাক গে।
.
মার্কিন খট্টাঙ্গ ভুটাঙ্গ পুরাণ
কড়ি আছে মার্কিনের। পয়লা ধাক্কাতেই তারা হাজির হয়েছেন কাবুলে হাইকোর্ট দেখতে। ঝটপট একাধিক রিপোর্ট ভি তেনাদের কাগজে বেরিয়েছে। কুল্লে এক দফা চোখ বুলিয়েই পুনরায় সেই সত্য হৃদয়ঙ্গম করলুম, পৌনঃপুনিক পরিবর্তনেও অপরিবর্তনীয় খুদা-দাদ আফগানিস্তানের জিন্দাবাদ শহর-ই আলা কাবুল। অর্থাৎ কাবুল তথা আফগানিস্তান আপাতদৃষ্টিতে যতই পরিবর্তিত বলে মনে হোক না কেন, একটু ঘষলেই উপরকার গিল্টি উপে যায়, আর বেরিয়ে পড়ে আসল দস্তা খাজা মাল। তুলনা দিয়ে চোখের সামনে আনি, ফরেন মিনিস্টার ভুট্টো, হঠাৎ আইয়ুবের বিরুদ্ধে তাঁর চেল্লাচেল্পি, গণতন্ত্র চাই, পিপলস পার্টিই পিপল, তাদের হুকুমেই চলবে দেশ, তার পর অখণ্ড পাকিস্তান যে সংবিধানই তৈরি করুক না কেন (১৯৭১ শীতকাল) পিপিপি সেটা মানবে
?, তার পর ঢাকাতে হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হলে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, পাকিস্তান ইজ সেভড, তার পর ভুল বলেছিলুম, এই পোড়র দেশে গণতন্ত্র চলতে পারে না, চাই সর্বাধিকারসম্পন্ন প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্রাধিপত্য–ইত্যাদি ইত্যাদি, পাঠককে আরও উদ্ধৃতি দিয়ে বেকার বিরক্ত করব না। মোদ্দা কথা, তিনি যতবার যত তরো-বেতরো ভোল পালটান, ভেক বদলান, ক্ষণে যাত্রার দলের ইয়া দাড়ি-গোঁফওলা নারদমুনি সাজেন, ক্ষণে কামিয়ে-জুমিয়ে চাচা-ছোলা শ্রীরাধার সাজ ধরেন, একটি ভেংচি কেটেছেন কি না কেটেছেন সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ডিকটেটর ভুট্টো, যিনি তাঁর কলোনি মরহুম পূর্ব-পাকের ওপর একদিন-না-একদিন কুলি সর্দারের ডাণ্ডা বুলোবেনই বুলোবেন। একেই বলে পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়। এক্ষেত্রে তাঁর মৌলা মুরশিদ মিয়া নিক্সন। এতখানি সবিস্তর বুঝিয়ে বলার কারণ; এদানির আমার এক মিত্র, আইনকানুনে পয়লা নম্বরি খলিকে বললেন, তাঁর ঘুঘু মক্কেলরা পর্যন্ত পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় তকমাটার অর্থ সঠিক ধরতে পারেননি! এই নিয়ে তিনে কত্তি তিন, তিন দফে এফিডেভিট পেশ করা হল।
.
সেই ডাবা হুঁকো
মার্কিনি রিপোর্টে যে-সব মোক্ষম মোক্ষম খবরের উল্লেখ মাত্র নেই তার থেকেই আমি সত্য নির্ণয় করেছি।
নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কোথা পেতে।
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে।
গরুর ল্যাজটা কাটা পড়ে যাওয়ায় সেখানে যে ঘা হয়, মাছিগুলো তারই ওপর মোহব লাগিয়েছিল। মার্কিন রিপোর্টের দগদগে ঘা থেকে আমি অক্লেশে অনুমান করলুম, আদি ল্যাজটার আকার-প্রকার গড়ন-ঢং কী ছিল এবং তৎসহ যুগপৎ আরেকটি ফালতো তত্ত্ব আবিষ্কার করে বাঙ্গাল, বাঙ্গালদের সম্বন্ধে বড়ই শ্লাঘা অনুভব করলুম : মার্কিনি রিপোর্টাররা নিতান্তই সস্তা মার্কিন-কাপড়; কাবুলের হাইকোর্টটা যে কোথায়, সে তত্ত্বটাও নিরূপণ করতে পারেননি।
এনাদের এক মহাপ্রভু বলছেন, প্রশস্ত ধূলিধূসরিত কাবুল উপত্যকার হেথাহোথা এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে আছে ভাঙাচোরা বুডট কাবুল শহর, সেই আদিকালের অপরিবর্তনীয় চেহারা নিয়ে। কিন্তু বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে, মন। পরিবর্তন এসেছে আগাপাশতলা প্রকম্পিত করে।
বটে!! কী সে যুগান্তকারী খুনিয়া পরিবর্তনটি?
পূর্বে যেখানে ঢুলুঢুলু নয়নে আধো ঘুমে আধা-চেতন কাবুলি কাস্টমস্ কর্মচারী যাত্রীদের আধখেচড়া তদারকি করে না করে হাতের অলস ইশারায় বিমানবন্দর থেকে তাদের বেরিয়ে যাবার পথ দেখিয়ে দিত, সেখানে রোমহর্ষিত বিস্মিত মার্কিন বাঙ্গাল দেখলেন, হাতে টমি-গান নিয়ে ঝাঁকে ঝাকে যোদ্ধা (অশ্বারোহী কি না, বোঝা গেল না– লেখক) ট্যারমাকের উপর পাহারা দিচ্ছে, প্লেন থেকে নামবার পূর্বেই যাত্রীগণকে নিরাপত্তা-পুলিশ বাজিয়ে দেখে নিচ্ছে (ইন্সপেকট করে)।
মার্কিনের বিস্ময় দেখে আমারও বিস্ময়ে বাক্যস্ফুরণ হচ্ছে না।
আচ্ছা, পাঠক তুমিই বল, কোন্ সে মুলুক, হটেনটট বুশমেন যাদেরই হোক, যেখানে চল্লিশ বছরের সুপ্রতিষ্ঠিত রাজাকে বরখাস্ত করে কু দেতা হলে বিমানবন্দর, রেল ইস্টিশন জাহাজ বন্দর (কাবুলে এ দুটোই নেই), ছাউনি, থানা, গয়রহের সামনে তিন ডবল সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করা হয় না? পঁচিশের কথা বাদ দাও, আইয়ুব যখন মেনি-বেড়াল মার্কা কু করেছিলেন তখন রাজধানীতে না, প্রাদেশিক শহরিকা ঢাকা, তারও নিচের সিলেট-কুমিল্লায় সেপাই শান্ত্রি হৈ-হৈ রৈরৈ কাণ্ড করেনি?
আরও গণ্ডা দুই কারণ আছে যেগুলো দফে দফে বলার কী প্রয়োজন? ধুন্দুমারের সময় আন্তর্জাতিক স্মাগলারদের অবাধ আগমন, প্রাক্তন রাজা জহিরের গুপ্তচর প্রেরণ, কু-জনিত ইনফ্লেশনে টু-পাইস কামাবার তরে বিস্তর চিড়িয়ার গমনাগমন, দাউদের রুদ্রদৃষ্টিতে বিপন্ন (প্রধানত জহিরের) আত্মজনের যেটুকু সোনাদানা আছে সেটুকু সস্তায় ক্রয়করণ, বিশেষ করে জাল পাসপোর্টের সাহায্যে পাকিস্তানি চরদের অহরহ শুভাগমন, আরও কত না বহুবিচিত্র রবাহূত জনগণ অস্বাভাবিক অবস্থায় এদের সবাইকে মেকি সিকিটার মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে হয়, ডবল জালের ছাঁকনির ভিতর দিয়ে ইসপার উস-পার করতে হয়। এ কর্ম নিদ্রালু একগণ্ডা কেরানি দিয়ে হয় না। বাংলা কথা!
বাচ্চা-ই সাকাও ছিল ডাকু। তদুপরি তার আমলে কাবুলের ভিতরে-বাইরে কোনও অ্যার সার্ভিস ছিল না। তথাপি সে ফরেন অফিসের গুটিকয়েক জাঁদরেল কর্মচারীকে অ্যারপোর্টে মোতায়েন করেছিল। মার্কিন রিপোর্টার কাবুল বাজারে দু চারটি নাতিবৃদ্ধ মুরুব্বিকে শুধালেই তো জানতে পেতেন, ব্যাপারটা রত্তিভর নতুনত্ব ধরে না– তাই বলছিলুম, হাইকোর্টটা যে কোন মোকামে অবস্থিত সে খবরটাও সায়েব জোগাড় করেননি।
শেষ প্রশ্ন, এই ভোজবাজির লীলাখেলা কদিনের তরে? পাঠক, আইয়ুবি জঙ্গি চৌকিদারি এ দেশে কতদিন চলেছিল সে বাবদে তুমি স্পেশালিস্ট, আমি স্কুলবয়। টমিগান হাতে থাকলে ঘুষ খাওয়ার সনাতন সিসটেমে ঢোকার পন্থা সহজতর, প্রলোভন খরতর। আখেরে মায় আপিসার, বেবাক সেপাইকে ছাউনিতে ডেকে নিতে হয়– করাপশন আগাপাশতলা ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে। আইয়ুবের গদিতে যখন ইয়াহিয়া আসন নিলেন তখন ফিল্ড-মার্শালের প্রতি অনুরক্ত কোনও সেপাই-আপিসার উল্টো কু করল না কেন? উত্তরটি প্রাঞ্জল। সব্বাই করাপট। করাপট-জনের কোনও নেমক-হালালি থাকে না, কারও প্রতি।
.
রুটি নেই? কেক খাব
ক্যু যত নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হোক, ভোজদ্রব্যের দাম বাড়বেই। মার্কিন সংবাদদাতা সুসমাচার জানিয়েছেন, দাউদ মোটা মুনাফাখোরদের গুলি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে চালের দাম নাকি অর্ধেক কমে গিয়েছে। মার্কিন সুন্দুমাত্র চালের কথাটা তোলায় বুঝতে পারলুম তার পেটে এলেম কতখানি! কাবুলের সাধারণজন ভাত খায় না। ওটা অতিশয় বিরল বিলাসবস্তু। একশো মাইল দূরের জালালাবাদ অঞ্চল, দু-শো মাইল দূরের পাকিস্তান থেকে বিস্তর পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে তণ্ডুলকে পৌঁছতে হয় কাবুলে। পাকিস্তানি চাল কালোবাজার মারফত। সাদায় ক শো গুণ ট্যাকসো, জানিনে। কাবুলের পয়সাওলা লোকও নিত্যি নিত্যি পোলাও খায় না। বনেদি ফারসিতে প্রবাদ, প্রতিদিন ঈদ নয় যে হালুয়া খাবে– হর রোজ ঈদ নিস্ত কে হালওয়া ব-খুরিদ। কাবুলে হালুয়ার পরিবর্তে পোলাও বলে।
কথিত আছে, বাচ্চা-ই সাকাও রাজবাড়িতে পয়লা খানার সময় দেখে, সমুখে আমান উল্লাহর প্রাসাদ-পাঁচক প্রস্তুত জাফরানের ভুরভুরে খুশবাইদার পোলাও। সে নাকি লাথি মেরে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ওই খেয়েই তো আমান উল্লাহ বিলকুল বুজ-দিল (ছাগলের কলিজাওলা ভীরু) হয়ে যায়, আর রাজধানী ছেড়ে পালায় কান্দাহার। সে নাকি রুটি, কিশমিশ আর দু-চিলতে পনির– তার মামুলি খাবারই খেয়েছিল।
মার্কিন সাংবাদিকের অত্যুজ্জ্বল রিপোর্ট তথা কিশমিশের স্মরণে আমার হৃদয়ে সাংবাদিক হয়ে ফোকটে দু পয়সা কামাবার প্রলোভন জ্বলজ্বল চিতার মতো প্রজ্বলিত হয়েছে– তদুপরি পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ। ভাগ্যিস, আকছারই বিজলি মারে ফেল; তখন অন্ধকারের সঙ্গে আমার খুদাদাদ ঘোরতর কৃষ্ণ চর্মবর্ণটি অক্লেশে মিশিয়ে দিয়ে মিরপুর রোডের মোড়ে এক ইয়ারের অন্দরে দু ছিলিম তামুক খেয়ে কলিজা ঠাণ্ডা করে আসি।
ভাবছি, কালই বহির্বিশ্বে টেলিগ্রাম ঝাড়ব :
ঢাকায় কিশমিশের সের আশি টাকায় উঠেছিল। সমাজসেবীদের ভীতি প্রদর্শনহেতু কাল চড়াকসে চল্লিশে নেমেছে।
লুফে নেবে, স্যর, সব্বাই লুফে নেবে।
.
বাবুর-নাম অবহেলা বিপজ্জনক
বাবুর বাদশাহর নাম স্মরণে এলেই আমার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। একাধিক মিত্র অবশ্যই বলবেন, কটা লোকের আদৌ এই বিরল গুণটি থাকে যে, সে তোমার কিংবা এবং তোমার মতো আর পাঁচটা চুকুম-বুদাইয়ের মস্তিষ্কে ঘন ঘন আনাগোনা করবে? অথচ ইংরেজিতে এই কাণ্ডজ্ঞান সমাসটির অনুবাদ কমনসেন্স এবং স্বয়ং ইংরেজই স্বীকার করে যে নামকরণের সময় ব্যাকরণে ভুল হয়ে গিয়েছে। কমনসেন্স সর্বদেশে সর্বকালে বড়ই আনকমন। বরঞ্চ এটাকে আন-কমন-সেন্স বা রেয়ার-সেন্স বলাই প্রশস্ততর– যিনি কি না গুণীজনের চৈতন্যলোকেও নিতান্তই ওয়ান্স ইন এ ব্লু মুন, বাংলায় বলি রাঙ্গা শুক্কুরবারে অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ, অতিশয় কালে-কম্মিনে, নিতান্তই জীবনের বিরলতম শুভ মুহূর্তে। যেমন ধরুন এ বাড়ির পাশের বাড়ির, হয়তো-বা আপনার বাড়ির টেলিফোনটি। এনার বেলাতেই বোঝা যায়, ইনি মহাপুরুষ। অসাধারণ অর্থাৎ আন-কমন সেন্স দ্বারা যন্ত্রটি টুইটুম্বুর। সাতিশয় কালেভদ্রে আপনি এঁকে জাগ্রত অবস্থায় পাবেন। দুষ্টলোকে কয়, আমাদের রাজকর্মচারীরা এ বাবদে অলিম্পিক। আমি তীব্রকণ্ঠে, মৌলামুরশিদের দোহাই দিয়ে, যদি পাঠক হিন্দু হন তবে গঙ্গাজলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অবস্থায় তামা-তুলসী স্পর্শ করে, ক্যাথলিক হলে তিনবার দেহের উত্তমার্ধে ক্রুশচিহ্ন এঁকে, বৌদ্ধ হলে উচ্চকণ্ঠে ত্রিশরণ মন্ত্রের শরণ নিয়ে, জৈন হলে– থাক, ওই তো সেকুলার স্টেটের চিরন্তনী শিরঃপীড়া, সব্বাইকে আপন আপন অতিশয় ন্যায্য হিস্যে দিতে হয়, এস্তেক বেতার-প্রতিষ্ঠানেও শপথ নিয়ে বলছি, এটা অতিশয় অন্যায়। অলিম্পিকের কুল্লে গোল্ড-মেডেল পাবার গগনচুম্বী পাতালস্পর্শী কুম্ভকর্ণবিজয়ী হক্ক ধরেন আমার টেলিফোনটি। অবিচল, অবিরল, নিশ্চল, সুবিমল এর কাল-কালান্তর-ব্যাপী ড্রিাটি। সুবিমল বলার সুযুক্তি : এনার নিদ্রাতে কোনও মল নেই। যথা :
শুধু বেঘোরে ঘুম ঘোরে
গরজে নাক বড় জোরে,
বাঘের ডাক মানে পরাভব।
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ॥
(রবীন্দ্রনাথের সর্বাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্য থেকে উদ্ধৃত)
আমার টেলিফোনটি নাসিকাগর্জনের মতো ইতরজনসুলভ কুকর্মদ্বারা ধ্যান-ধারণায় নিযুক্ত প্রতিবেশীকে অযথা অত্যাচার করেন না। করলেই তো তার সর্বনাশ। তদ্দণ্ডেইতার কান দিয়ে
অনেক কথা বলে নেব
এবে তোমার কানে কানে
কত নিশীথ অন্ধকারে
ছিল কত গোপন গানে ॥
অর্থাৎ তখন তাঁকে ফের কর্মক্ষেত্রে নামতে হবে।
টেলিফোন সম্বন্ধে এতখানি বলার প্রয়োজন হল এই কারণে যে, গত রবিবার ১১-৮ তারিখে আমি লিখেছিলুম আমাদের হাইকোর্টটিকে কলকাতারটির চেয়ে উচ্চতররূপে নির্মাণ করার জন্য আমি হেথাকার কর্তাব্যক্তিদের পই পই করে অনুরোধ করি– অবশ্য ফোন মেরামতির নিষ্ফল প্রচেষ্টাতে নিত্যি নিত্যি পর্বত-প্রমাণ যা করতে হয় তার তুলনায় ধূলিপরিমাণ নস্যবৎ। ইয়াল্লা ছাপাতে বেরুল, কোন মেরামতির নিষ্ফল প্রচেষ্টাতে নিত্যি নিত্যি ইত্যাদি অর্থাৎ ফোন স্থলে কোন ছাপা হয়ে গিয়েছে। পূর্বে কিংবা পরে ফোনের কোনও ইঙ্গিত ছিল না বলে পাঠকের পক্ষে আগাগোড়া বাক্যটাই অবোধ্য রয়ে গেল। কিংবা পাঠক ভাবল, আমি একটা বুদু, কী একটা বাজে রসিকতা করেছি যার মাথামুণ্ডু কোনও অর্থ হয় না–রস তো দূরের কথা। কিন্তু এর সঙ্গে তড়িঘড়ি একটা সত্য এস্থলে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। টেলিফোন বিভাগ সরকার চালান। যদি বা সাহস সঞ্চয় করে টেলিফোনের প্রতি বক্রোক্তি করব বলে মনস্থির করেছিলুম, সরকার বাবদে আমার সতত সশঙ্কিত অচেতন মন– যার জন্ম ইংরেজের গোলামির যুগে আমার কলমের কানটি আচ্ছাসে মলে দিয়ে শাসিয়েছে, অমন কম্মটি করতে যাসনি। ফোন না লিখে ল্যাখ কোন। এবং কলমও তাই লিখেছে, ছাপাখানাও তাই ছাপিয়েছে। এর সঙ্গে এটাও বলা উচিত মনে করি, ছাপাখানা যতই ভুল করুক, সে আমাদের মতো কাঁচা লেখকের কত যে বানান সংশোধন করে দেয় সে তত্ত্ব কি কেউ জানে? ন্যাশনাল প্রফেসর সুনীতি চাটুয্যের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। একদা অর্বাচীন এক সাহিত্যিক আমাদের সম্মুখে ছাপাখানার বিস্তর কুৎসা গেয়ে চলে যাওয়ার পর বাঘা বৈয়াকরণিক সুনীতি চট্টো বললেন, হু, ছাপাখানা যে আমাদের কত না বানান-ভুল শুধরে দিয়ে সমাজে ইজ্জত বাঁচায়, তার খবর এ-চ্যাংড়া জানবে কোত্থেকে? আমি ঘন ঘন সম্মতি তথা কৃতজ্ঞতাসূচক মাথা নাড়িয়েছিলুম।
টেলিফোনের বেলাও তাই। ওই বিভাগের কর্মচারীরা ভদ্র এবং ডাক্তারের সঙ্গে এঁদের অনেকটা মিল আছে। ডাক্তার কি কখনও রোগীকে বলে, দাদা, যা গোরস্তান মার্কা নিউমোনিয়াটি ঝড়-বিষ্টিতে জোগাড় করে এনেছ, এতে নিদেন তিন হপ্তার ধাক্কা! ফোন অফিসার কী করে বলেন, ঝড়বৃষ্টিতে ফোনের তারটির যা হাল হয়েছে, সে তো দাদা নতুন তারের দাওয়াই না আসা পর্যন্ত সারবার কথা নয়– সে তত দেড় মাসের ধাক্কা। নিউমোনিয়া সারতে এক মাস লাগলেও কি আপনি ডাক্তারকে তাড়া লাগান? তবে? ফোনের বেলাই যত গোসসা?
আমার ব্যক্তিগতভাবে একটা মস্ত সুবিধা রয়েছে। ফোন মারফত আমার বেশুমার পাওনাদার আমাকে বেলা-অবেলায় আর হুনো দিতে পারে না। ওই তো মানুষ মাত্রেরই দোষ। ভালো দিকটা দেখে না; দেখে শুধু খারাপ দিকটা।
হঠাৎ মনে পড়ল, কাবুলের দূর-আলাপনী প্রতিষ্ঠানটির চেহারাটা। সে কেচ্ছা আরেকদিন হবে।
.
আহাম্মুকি
বিষয়টি গুরুতর। সমস্যাটি জটিল। আমার বিদ্যে অত্যল্প।
বাবুর বাদশাহ তার ইয়ার-আমিরদের মুদ্রাস্ফীতি বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, তোমরা কাঁড়া কাঁড়া দিনারমোহর নিয়ে কাবুল পৌঁছনমাত্রই তো কাবুলের উৎপাদন ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-ছোঁয়া লক্ষ মারবে না। বাজারে আগে যে-রকম হাজারটা আণ্ডা উঠত সেই হাজারটাই উঠবে। মাঝখানে শুধু তোমাদের দরাদরির আড়াআড়িতে এক পয়সার মাল এক টাকা দিয়ে কিনবে।
ঠিক ওই পরিস্থিতিই গড়ে তুলেছিলেন ইংরেজ কোম্পানির জাঁদরেলরা বাবুরের মৃত্যুর তিনশো বছর পর, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে। জঙ্গিলাট কিন কান্দাহার গজনি জয় করার পর বিপুল গৌরবে প্রবেশ করছেন কাবুলে এবং তাদের হাতের পুতুল শাহ সুজাকে তখতে বসিয়ে লেগে গেলেন বিপুলতর পরাক্রমে নববিজিত রাষ্ট্র আফগানিস্তানের ওপর রাজত্ব করতে।
একে তো পুতুল রাজা মাত্রই আফগানের দু চোখের বিষ, তদুপরি সুজা ইন্দ্রিয়পরায়ণ জনসাধারণ করল অসহযোগ। অর্থাৎ খুব একটা স্বেচ্ছায় সেই সতেরো-আঠারো হাজার, কাবুলে মোতায়েন, ইংরেজ সেনাদলকে খাবার-দাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কাবুল উপত্যকার লোক এবং নিকটবর্তী জনপদবাসী বেচতে চায় না। ওদিকে গোরার পাল চায়, প্রতিদিন হালুয়া খেতে! জিনিসপত্রের দাম চড়চড় করে চড়বার পূর্বেই সদাশয় ভারতস্থ ইংরেজ সরকার ইনফ্লেশন ইন্ধনের জন্য সৈন্য এবং অফিসারদের বিলাস-ব্যসনের তরে পাঠাতে লাগলেন বে-হিসাব বে-শুমার বস্তা বস্তা মোহর, টাকাকড়ি। এমনিতেই, স্বাভাবিক অবস্থাতেই সতেরো-আঠারো হাজার ফালতো, তায় শ্বেতহস্তীকে পুষবার মতো গম-যব ফসল, ভেড়ি-মুরগি কাবুল উপত্যকা ও সেই দূর হিন্দুকুশ এলাকা পর্যন্ত জনপদ উৎপাদন করে না। মুদ্রাস্ফীতি ছাড়াই, অর্থনীতির সনাতন আইনেই দ্রব্যাভাববশত বাজারে লাগল আগুন। ইতোমধ্যে আসছে, দিনের পর দিন হিন্দুস্থানের ভাণ্ডার উজাড় করে, সেখানকার তীব্র প্রতিবাদ, করুণ আর্তনাদ উপেক্ষা করে টাকার ঘি কাবুলের ইনফ্লেশন আগুনে ঢালবার তরে। গোরাদের ছাউনি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। শহরগামী গ্রামবাসী আশ্যাওলা মুরগি-ওলাকে গোরা সেপাইরা করে চোটপাট এবং লুটপাট। ফলে সাপ্লাই গেল আরও কমে যোগানদার সুদূর গ্রাম থেকে বেরুতেই রাজি হয় না।
.
গোরা মার্কা আজব ইনফ্লেশন
কাবুল শহরের কাছে ইনফ্লেশন হুমা জাতীয় আজব চিড়িয়া নয়। মাহমুদ, তিমুর নাদির বিস্তর লোক, বিস্তর না হোক, অল্প-বিস্তর ইনফ্লেশন ঘটিয়েছেন কাবুলে, লুটের টাকা ঢেলে। কিন্তু এবারের ইনফ্লেশনে মার খেল কাবুলের ফকির-আমির দুই পক্ষই। সে যা দাম– সে দাম দিয়ে রুটি, আণ্ডা, মটন, আঙ্গুর, নাসপাতি, আপেল খেতে পারেন স্রেফ গোরা রায়রাই। ২৫ মার্চের পর টিকা শুষ্ঠীরও নিত্যি নিত্যি ছিল হালুয়া। আমির মোল্লা গেরস্ত সবাই গেল একসঙ্গে ক্ষেপে।
ওদিকে ভারতের রাজকোষে মারাত্মক অর্থাভাব। রব উঠেছে, সরকার মহলেই, খর্চা কমাও, কড়ি বাঁচাও। তখন এই পাগলা-অভিযান, ইটারনেল পিকনিকের খর্চা না কমিয়ে ইংরেজ করল আরেক গো-মূর্খামি। মাসোহারা ঘুষ দিয়ে যেসব আফগান সরদার-আমিরদের একদিন কোনও গতিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল গণবিক্ষোভের আবর্ত থেকে, তাদের ভাতা দিল কমিয়ে আর সঙ্গে সঙ্গে তারা আর তাদের পুষ্যির পাল গেল ক্ষেপে। কোথায় না একদিকে গোরাদের বে-এক্তেয়ার খর্চা কমিয়ে, অন্যদিকে সরদারদের ভাতা বাড়িয়ে এবং তাদের মাধ্যমে গেরস্তদের হাতে টাকার একাংশ পৌঁছিয়ে বাজারদরে ভারসাম্য আনা হবে, তা না উল্টো দাঁড়িপাল্লার যে দিকটা হাল্কা হয়ে হয়ে হিন্দুকুশের চুড়ো ছুঁই ছুঁই করছিল তার থেকে। আচমকা থাবা মেরে সরিয়ে নেওয়া হল তিন খাবলা। ভারী দিকটা এক ঝটকায় ঠাং করে ঠেকল কাবুলের পাথরে।
.
জাহান্নামের পথে
উন্মত্ত জনতা তিনজন ইংরেজ অফিসারকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে খুন করল কাবুলের রাজপথোপরি চিৎকারে চিল্কারে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে।
এর পরের কাহিনী সবাই জানেন। অশেষ লাঞ্ছনা অবমাননার পর প্রায় সাড়ে ষোল হাজার গোরা, নেটিভ– নেটিভ যৎসামান্যেরও কম– কাবুল থেকে বেরুল ভারতের পথে। সেই ভয়াবহ জগদল-গিরিপথ, যেটাকে বাবুর পর্যন্ত সমঝে চলতেন, তারই ভিতর কচুকাটা হল শেষ লোকটি পর্যন্ত–না, মাত্র একজন ডাক্তার যখন কোনও গতিকে ছন্নের মতো টলতে টলতে জালালাবাদের ইংরেজ ছাউনিতে পৌঁছল তখন সে অর্ধোন্মাদ। এটা আমাকে আর নতুন করে বলতে হবে না, এমনকি আমি স্বয়ং, মোটর ভেঙে যাওয়ার দরুন, জগদলকে যে-এক রাত্রি কাটাই সে কাহিনী উপস্থিত মুলতবি থাক।
.
সর্বজনীন সর্বদেশের প্রশ্নমালা
কাবুল শহরে আজও যদি অকস্মাৎ একগাদা টাকা ফেলা হয় তবে ফল কী হবে? আফগানিস্তানে চিরকালই খাদ্যাভাব। বহির্বিশ্ব থেকে যে গম-ডাল আসবে মার্কিন রিপোর্টারের শৌখিন চাল মাথায় থাকুন– সেটা আসবে কোন দেশ থেকে, কোন পথ বেয়ে, সেই হঠাৎ-পাওয়া টাকার জোরে? (সে কড়ি কাবুলে ছেড়ে ইনফ্লেশন ডাকার কোনও অর্থ হয় ন)। যে দুটো পথ দিয়ে প্রধান শহর কাবুল, গজনি, কান্দাহার, জালালাবাদ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত, সেগুলোর উপর দিয়ে একদা চলাচল করত উট গাধা ইত্যাদি ভারবাহী পশু। এখনও বেশিরভাগ তাই। তবে হ্যাঁ, এখন ট্রাকও চলে। এস্থলে মনে রাখা ভালো, ট্রাকের ইসকুরু বন্দু থেকে আরম্ভ করে ট্রেলের শেষ ফোঁটা পর্যন্ত কিনতে হয় বিদেশ থেকে। এবং দুটি রাস্তার একটা জগদলক-জালালাবাদ হয়ে পৌঁছয় পাকিস্তানের পেশাওয়ারে, অন্যটিও পাকিস্তানের চমন-কুয়েটাতে।
পাকিস্তানের খুব একটা ফালত গম-ডাল আছে বলে শুনিনি। তদুপরি দুই দেশে খুব একটা দিল-জানের দোস্তি আছে এ কথা আরও কম শুনেছি। তবু পাকিস্তান হঠাৎ খামোখা দাউদ খানকে ভারতে কেনা বা মার্কিনদত্ত গম তার দেশের ভিতর দিয়ে পাস করতে দেবে না, এটা চট করে বিশ্বাস করা যায় না। পাকিস্তান খুব-একটা টাকার কুমির তালেবর মুল্লুক নয়। মধ্যবর্তী ব্যক্তি হামেশাই দু পয়সা কামায়।
কিন্তু প্রশ্ন, আজ যদি দাউদ খান রুশের সঙ্গে বড় বেশি ঢলাঢলি আরম্ভ করেন এবং মার্কিন চটে যায়, ফলে মার্কিন-পাকিস্তান-ইরান একজোট হয়ে পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিমের পথ সিল করে দেয় তবে শুধুমাত্র উত্তরের পথ দিয়ে রুশ তাবৎ আফগানকে খানা-দানা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কি, চাইবে কি? আমার জানা নেই, পাঠক বলতে পারবেন, এযাবৎ রুশ কটা দেশকে খানা-দানা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
তাই আফগানিস্তানকে আপন পায়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু তার পূর্বে প্রশ্ন, না হয় মেনে নিলুম জহির আর তাঁর ইয়ার-বখশিরা ছিলেন করা কিন্তু আমান উল্লাহ? লোকটা তো তখৎ হারাল প্রগতিশীল ছিল বলে। হবীবউল্লা ছিলেন অলস, কিন্তু তিনিও কি চেষ্টা দেননি দেশটাকে সচ্ছল করার? তার পূর্বের বাঘা বাঘা আবদুর রহমান, দোস্ত মুহম্মদ এঁদের বলবুদ্ধির তারিফ বিস্তর বিচক্ষণ বিদেশি করেছেন। এদের মূলধন ছিল না? দাউদ খান যদি পান, তবে পাবেন, একা রুশের কাছ থেকে। হবীব, রহমান, দোস্ত পেতেন দু পক্ষ থেকেই। সে সোনা-দানা তো তারা চিবিয়ে খাননি। সে-সব গেল কোথায়? যদি বলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা অনেক কিছু করা যায়, তবে শুধাই, ভারত যে ছাব্বিশ বছর ধরে কুল্লে টেকনিক্যাল কল এস্তেমাল করল তার ফলে জনগণের দরিদ্রতা ঘুচল কতখানি? তবু তো ভারত অনেক কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ধরে, উৎপাদন করে। নেই নেই করে বাংলাদেশেরও গরিবানা-সুরৎ দু একটা খুদাদাদ দৌলত আছে, শিক্ষিত লোক আছেন, নো-হাউ গুণী আছেন। আমরাই কি ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সুখ-স্বপ্ন দেখার খুব একটা সাহস পাই? আমি হাড়ে-মিষ্টি অপটিমিস্ট– আমার কথা বাদ দিন।
.
আফগানিস্তানের আছেটা কী?
হাজার বছর পূর্বে একজন চৌকশ বাদশাহ আটঘাট বেঁধে আফগানিস্তানকে আপন পায়ে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন। তার কথা আরেক দিন হবে।
***
সাধারণজনের বিশাস, বিজ্ঞানের দৈনন্দিন ব্যবহার দুনিয়াটাকে ন্যাজ-মুড়ো বদলে দিয়েছে। টেলিগ্রাফ, বেতার, বিজ্ঞান-বদৌলত নিত্যি নিত্যি নয়া নয়া দাওয়াই ইনজেকশন, খুদায় মালুম আরও কত কী! কিন্তু বিজ্ঞান যে আমাদের এই বাংলাদেশের কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ করেছে মানুষ সেদিকে নজর ফেলে না। এবং সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বলে মনে হয়, এই মুখ-পোড়া বিজ্ঞানের সাহায্যেই আমাদের সে সর্বনাশের অগ্রগতি ঠেকাতে হবে। এ ব্যাপারটা শুধু যে আমাদের বেলাই প্রযোজ্য তা নয়, কী আফগানিস্তান, কি ইরান এমনকি পূর্ব ইউরোপের একাধিক অনুন্নত দেশও বিজ্ঞানের প্রকৃতির স্বরূপটা সঠিক ধরে উঠতে পারছে না। সবাই ভাবছে, একবার কোনও গতিকে গাদা গাদা টাকা পেয়ে গেলে তাই দিয়ে কিনে নেব লেটেস্ট মডেলের যন্ত্রপাতি, তৈরি করব হুদো হুদো মাল–ইংলন্ড, জর্মনি, আমেরিকা যে রকম করেছে আর সম্বৎসরে দুধে-ভাতে থাকে, আমাদের বেলাও হবে তাই।
এই বাংলাদেশের ইতিহাস যারা পড়েছেন তারাই জানেন, এ দেশ বহু শতাব্দী ধরে অসাধারণ বিত্তশালী ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভূপর্যটক ইবনবতুতা বাংলাদেশ দেখার পর বলেছিলেন, এত সস্তায় (এত বিচিত্র) জিনিস তিনি আর কোথাও দেখেননি। চীনের মতো বিশাল ধনবান রাষ্ট্র, নানা রকমের দ্রব্য নির্মাণে সিদ্ধহস্ত বহু শত বৎসর ধরে পৃথিবীতে অন্য কোনও রাষ্ট্র ছিল না। সেই চীন দেশের লোক বহুশত বৎসর ধরে বাংলাদেশে নিত্য-নিয়ত এসেছে নিপুণ হস্তে নির্মিত বহু বিচিত্র পণ্যসম্ভারের জন্য। সেসব বস্তুর ফিরিস্তি, এদেশের সমৃদ্ধি সাচ্ছল্যের বিবরণ চীনা ভাষা থেকে অনুবাদিত হয়ে এ দেশে যখন প্রকাশিত হয় তখন আমাদের মতো অজ্ঞ লোক বিশ্বাসই করতে পারিনি, এতসব অদ্ভুত অদ্ভুত প্রয়োজনীয় তথা বিলাসবস্তু এই দেশেরই লোক একদা নির্মাণ করেছে। কিন্তু সে-দিনের ঐশ্বর্য নিয়ে আলোচনা আজ আমার বিষয়বস্তু নয়। আমার উদ্দেশ্য, ভিন্ন ভিন্ন দরিদ্রদেশ কী প্রকারে একদা ধনবান হয় এবং আবার সেই দরিদ্রতায় ফিরে যায়। পাঠক যদি বাংলাদেশের কথা মনে রেখে তাদের সঙ্গে সে-দেশ মিলিয়ে তুলনা করে নেন, তবেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়। বহু দেশের বহুবিচিত্র উত্থান-পতনের বহুরূপী ঘটনা, তাদের ধনোপার্জন-শিল্পোন্নয়ন প্রচেষ্টা ইত্যাদির প্রত্যেকটি অঙ্গ নিয়ে তার সঙ্গে এ দেশের একই প্রচেষ্টা, সাফল্য লাভ, অধঃপতন তুলনা করতে গেলে এ রচনার নির্ধারিত তনু বে-সামাল কলেবরে পরিবর্ধিত হবে? রহমান রক্ষতু!
অসামান্য মাত্র একটি বিষয়ের প্রতি এস্থলে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। একাধিক গুণীজন দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, ইংরেজ আগমনের প্রাক্কাল পর্যন্ত এ দেশ দরিদ্র ছিল না। মাত্র শতকরা ষাটজন লোক চাষবাস করত, শতকরা চল্লিশজন শিল্পদ্রব্য নির্মাণে নিযুক্ত থাকত। ইংরেজ যেমন যেমন কলে তৈরি সস্তা মাল এ দেশে ছাড়তে আরম্ভ করল–নানা কৌশলে দেশের ধনদৌলত লুণ্ঠন করে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে আনার কর্মটা অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন বেড়েই চলছিল– তেমন তেমন এ দেশের কুটির শিল্প লোপ পেতে লাগল। শিল্পীদের ধনোপার্জনের পন্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের সামনে রইল শুধু চাষের কাজ। পূর্বে যে জমি এ দেশের ষাটজনকে কাজ যোগাত, ক্রমে ক্রমে সেটা নব্বই-পঁচানব্বইয়ে গিয়ে দাঁড়াল। জমি সে-ভার, তদুপরি জনসংখ্যা-বৃদ্ধির চাপ সইতে পারবে কেন? দেশের দারিদ্র্য চরমে গিয়ে পৌঁছল।
.
রাজার এক্সপেরিমেন্ট এক্সপেরিমেন্টের রাজা
গজনির মাহমুদ বাদশাহ উত্তমরূপেই লক্ষ করেছিলেন ভারতের উৎপাদন-ক্ষমতা, শিল্পনৈপুণ্য, শিল্পদ্রব্য-বৈচিত্র্য এবং প্রাচুর্য। এসব রফতানি করে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত হয়েছিল ভারতের অতুল ধনসম্পদ। কথিত আছে, সর্বসুদ্ধ অষ্টাদশবার তিনি ভারতলক্ষ্মী-ভাণ্ডার লুণ্ঠন করেন। এই অষ্টাদশ অভিযানের চেয়ে অল্প লোমহর্ষক একটিমাত্র সংগ্রাম নিয়ে অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত লেখা হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধান্তে শূন্য শ্মশান, মাহমুদের প্রতি অভিযানান্তে গজনিতে বৃহত্তর স্বর্ণোদ্যান! পাঠান্তরে সপ্তদশ অভিযানের উল্লেখ আছে। এ পাঠও গ্রহণযোগ্য। মহাভারতের মুষলপর্ব মূল মহাকাব্যের পক্ষে সম্পূর্ণ অবান্তর, সে তত্ত্ব অনস্বীকার্য। অতএব সপ্তদশ পর্বে সম্পন্ন মহাভারত অনাসৃষ্টি নয়।
সর্ব ঐতিহাসিক সম্পূর্ণ একমত যে, মাহমুদের লুণ্ঠনের ফলে এদেশের ধনদৌলত সর্বনাশা রক্তক্ষরণের মতো বেরিয়ে গিয়ে (এপোলিং ড্রেন অব ওয়েলথ) সম্পূর্ণ দেশটাকে। হীনবল অসাড় করে দিয়েছিল। এ লুণ্ঠনের খতিয়ান, দফে দফে বয়ান দিয়ে এর পরিমাণ ও মূল্য নিরূপণ সম্পূর্ণ অসম্ভব! একমাত্র নাগরকোট-এর মতো দ্বিতীয় বা ইন্টার ক্লাস নগরিকা থেকে তিনি পান সাতলক্ষ সোনার মোহর, সাতশো মণ সোনা এবং রুপার পাত, দু মণ খাঁটি সোনার তাল, দু হাজার মণ খাঁটি রুপার তাল এবং কুড়ি মণ হীরে, পান্না, মুক্তো ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এ-ইনভেনট্রিতে হস্তী, অশ্ব, কামধেনু, অস্ত্রশস্ত্র, বহুবিধ ধাতু, বিচিত্র কারুকার্যময় পট্টবস্ত্র, কাষ্ঠদ্রব্যাদি–শতাধিক আইটেম ধরা হয়নি। একটা অভিযানে, মাত্র একটা নগরিকা থেকে যদি এতখানি সম্পদ লুণ্ঠিত হতে পারে তবে সপ্তদশ-অষ্টাদশ অভিযানে অগণ্য নগরে কতখানি পাওয়া যায় তার কল্পনাও অসম্ভব। মাত্র এই পরশুদিন ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মিত্রপক্ষ ইউরোপে কী পরিমাণ, কত বিচিত্র বস্তু, মায় গণ্ডায় গণ্ডায় সমুচা কারখানা আপন আপন দেশে বাজেয়াপ্ত-জাহাজে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারই কি লেখাজোখা হয়?
বস্তৃত মাহমুদ কী পরিমাণ সম্পদ স্বদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন সেইটেই এস্থলে প্রধান বক্তব্য নয়। কত রাজা কত লুটই না করছেন, সে সব নিয়ে আলোচনা বৃথা। এই শান্তি-কালেই যা-লুট পৃথিবীর সর্বত্র ন্যায়ত ধর্মত মায় ওয়াটারগেট হচ্ছে তারই খবর রাখে কজন? এবং সবচেয়ে সর্বনেশে লুণ্ঠন— দেশের ভিতর যখন রাজার হস্ত, করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।
আমার বক্তব্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বটে কিন্তু ঈষৎ ভিন্ন প্রকৃতির।
একবাক্যে সর্বজন স্বীকার করেছেন, সুলতান মাহমুদ ছিলেন অসাধারণ গুণগ্রাহী, সর্বমুখী গুণসম্পন্ন বিদগ্ধ পুরুষ। কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পণ্ডিত, জ্ঞানবিজ্ঞানের গুণীজনকে তিনি এমনই অকাতরে অর্থসম্পদ দান করতেন যে দেশ-দেশান্তর থেকে প্রতিভাবান অসংখ্য গুণীজ্ঞানী তত্ত্ববিদ সেই শুষ্ক কঠিন সৌন্দর্যহীন, প্রাকৃতিক সর্বসম্পদে নিরঙ্কুশ বিবর্জিত গজনি শহরে জমায়েত হয়েছেন, সমস্ত জীবন সেখানে কাটিয়েছেন। আজ থেকে বছর বিশ-ত্রিশ পূর্বে রাজা মাহমুদের সভাকবি ফিরদৌসি, সভাপণ্ডিত অল-বিরুনির সহস্র বার্ষিকী প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বিদ্বজ্জন সাড়ম্বরে উদযাপন করেছেন। অলবিরুনি সংস্কৃত জানতেন। ভারতের অপর্যাপ্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা সত্ত্বেও তিনি বা অন্য কোনও সভাপণ্ডিত অর্থনীতি নিয়ে বাদশাহর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেননি, এটা অবিশ্বাস্য।
তদুপরি মাহমুদ তো মাত্র একবার ভারতবর্ষ লুট করে সে ধন গজনিতে ছড়িয়ে দিয়ে তার কুফল-সুফল দেখেননি। অধিকাংশ লুণ্ঠনকারীরা মাহমুদের মতো, পরবর্তীকালে বাবুরের মতো পর্যবেক্ষণশীল ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানকর্মে নিয়োজিত করার মতো জ্ঞানী ছিলেন না; তদুপরি তারা বার বার পুনর্বার লুণ্ঠন করার মতো সুযোগ-কুযোগ পাননি যে আপন অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু দু একবার লুট করার পর সুলতান মাহমুদ নিশ্চয়ই অর্থ কী, ব্যবসাবাণিজ্যে অর্থের গুরুত্ব কী, অর্থের সফল ও নিষ্ফল প্রয়োগ সম্বন্ধে অনেকখানি গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, এই আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস।
লুট করা ধনদৌলত সুন্দুমাত্র সঞ্চয় করা বা নিছক উড়িয়ে দেওয়াই যদি তার উদ্দেশ্য হত, তবে তিনি প্রতিবারে প্রধানত বন্দি করে অথবা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সর্বপ্রকারের আর্টিজান, ছুতোর, তাঁতি, স্থপতি, প্রস্তর কর্তনকারী, স্বর্ণকার, তাম্রকার, বস্তুত হেন শিল্প নেই যার দক্ষ হুনুরি– পালৈ পালে তিনি সুদূর গজনিতে নিয়ে যাননি। অতি অবশ্যই তিনি প্রতিমা-নির্মাণকারীদের সন্ধানে কস্মিনকালেও বেরোননি, ওই যা একমাত্র ব্যত্যয়। তার উদ্দেশ্য বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কোথায় সে শীতল মলয় আর শস্যশ্যামলা ফুল্লকুসুমিদ্রমদল শোভিনী মাতা? সেই নির্জলা, নিষ্ফলা, সেই পোড়ারমুখো দেশটাকে তিনি চেয়েছিলেন ফলপ্রসূ করতে, কিন্তু কী সে দেশ! তবে কি না, আমি কোনও দেশ সম্বন্ধে কী বলি না বলি, কোনও দেশের কী বয়ান দিই না দিই, তারই ওপর যদি সুচতুরজন আস্থা রাখতেন তবে তো আমি এদ্দিনে বিলেত, নিদেন কাবুলের ফরেন মিনিস্টার হয়ে যেতুম! তা হলে শুনুন, সর্বশাস্ত্ৰবিচারদক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তিতে শার্লক হোমস মাসুদরানা যার কাছে নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো আবুদিয়া, সেই বাবুর বাদশাহ গজনি সম্বন্ধে কী বলেছেন, অনুবাদ প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খার।
.
গজনির স্বরূপ
গজনি একটা দরিদ্র নগণ্য স্থান। আমি ভেবে হামেশাই তাজ্জব বোধ করেছি যে, হিন্দুস্তান-খুরাসানের যারা অধীশর ছিলেন তারা খুরাসানকে বাদ দিয়ে এমন একটা নগণ্য স্থানকে কী করে রাজধানী করেছিলেন।…গজনি ছোট দেশ। এখানে কৃষিকাজ অতি কঠিন। যে জমি এক বছর আবাদ হয়, পর বছর সে জমি ফের ভাঙতে হয়। অথচ বাবুরই বলছেন, গজনি অঞ্চলে পানির অভাব নেই। তদুপরি মাহমুদ এখানে কৃষির জন্য তিনটে বাঁধ তৈরি করেছিলেন। তার একটার উচ্চতা প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ। বাবুর যখন গজনি যান তখন তার একটি বাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, অন্যটি মেরামতির জন্য বাবুর কিছু টাকা পাঠিয়ে বলছেন, আমি আশা করি আল্লাহর রহমে বাঁধটি নিশ্চয়ই আবার নির্মিত হবে। তৃতীয়টি তখনও কার্যক্ষম। তাবৎ গজনি জেলা ঘুরে বাবুর বলবার মতো যা পেলেন সে গজনির আঙ্গুর কাবুলের আঙ্গুরের চেয়েও ভালো, এখানে তরমুজের উৎপাদনও অনেক বেশি, আপেলও খুব ভালো। এবং আরও তাজ্জব লাগার কথা যে গজনির প্রধান চাষ লাল রঙ উৎপাদক এক প্রকার লতা। এটি বেশ লাভজনক কৃষি। এ লতা প্রচুর পরিমাণে হিন্দুস্তানে চালান হয়।
.
একাই এক লক্ষ
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতই পড়ি ততই সন্দেহ দৃঢ়তর হয়, যে কটি দ্রব্য বাবুরের আমলেও গজনিতে উত্তম, সেগুলো কারও না কারও চেষ্টার ফলে উকৃষ্ট পর্যায়ে তোলা হয়েছে। আমার পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন, কিন্তু আমার বিশ্বাস, মাহমুদ ভালো করেই বুঝেছিলেন, বিদেশ থেকে যত সোনা এনেই গজনিতে ছড়াও না কেন, বিদেশিরা সেই টাকার লোভে যতই উৎকৃষ্ট বিলাসব্যসনের জিনিস এমনকি খাদদ্রব্যাদিও গজনিতে এনে বিক্রি করুক না কেন, লুটের টাকাও একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে– যদি না কৃষি এবং শিল্পজাত দ্রব্য দেশ উৎপাদন করতে পারে। এই যে লতার কথা বাবুর বলছেন, এর থেকেও সন্দেহ হয়, মাহমুদ রফতানির জন্য এটার চাষ প্রবর্তন করিয়েছিলেন। হুনুরি এনেছিলেন সর্বপ্রকারের পোড়ার দেশের লোক যদি কোনও একটা শিল্প শিখে নিতে পারে! কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি ঘি ঢালছিলেন ভস্মে। ভারতের অর্বাচীন ঐতিহাসিকরা বলেন, মাহমুদের স্বর্ণভূষা ছিল অস্বাভাবিক। আমার মনে হয়, প্রতি প্রচেষ্টাতে নিষ্ফল হয়ে, লোকটা আবার বেরুত নয়া ক্যাপিটালের সন্ধানে। আমরা যে রকম এক একটা ফাইভ-ইয়ার প্ল্যান শেষে নিরাশ হয়ে ফের বেরোই ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করে।
এ কথা সত্য, গজনি শহরটাকে মাহমুদের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পর ঘোর-অধিপতিরা পুড়িয়ে ভস্মে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু এ রকম কত শহর কতবার লুট করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে–কোনও প্রকারের উৎপাদন-ক্ষমতা থাকলে সে-নগর ফের পুনর্জন্ম লাভ করে। গজনি। এক ধাক্কাতেই খতম।
হিন্দুস্তানের বিরাট স্বর্ণভাণ্ডার বার বার লুট করে, সে দেশটাকে প্রায় ফতুর করে দিয়ে, কুল্পে দৌলত পাড় দেশপ্রেমী একয়ে সুলতান মাহমুদ অকাতরে ঢাললেন ওইটুকু একচিলতে গজনি অঞ্চলে। আজকের দিনে একশো জর্মন বা রুশ নো-হাউ শ্বেতহস্তীকে পুষতে গেলে আমাদের বেল্টখানা তিন ফুটো টাইট করতে হয়! মাহমুদ এনেছিলেন হাজার হাজার নো-হাউ হুনুরি জলের দরে। পুরোপাক্কা প্ল্যানিংয়ের জন্য তাঁর সভায় বিজ্ঞজনের অভাব ছিল না।
সেই দোস্ত মুহম্মদের আমল থেকে আজকের প্রেসিডেন্ট দাউদ। অপরিবর্তনীয়তে কী এমন পরিবর্তন ঘটল, কী এমন সোনাদানা জুটল– তা-ও ধারকর্জায়– যে রিপাবলিক নামক নয়া নাম দিতেই কুল্লে আফগান মুল্লুকে মধু-দুগ্ধের ছয়লাপ লেগে গেল?
তা হলে আর ভাবনা কী? কাল থেকে ঢাকার নাম পালটে বলব লন্ডন, পূর্বদেশের নাম পালটে বলব দি টাইমস, আর, হে পাঠক, তোমারও আয়ের অঙ্ক হুশ করে উঠে যাবে লন্ডনবাসীর কাঁধ মিলিয়ে। ঘরে ঘরে টিভি, গ্যারাজে গ্যারাজে মোটর। বছরে দেড় মাস ছুটি মন্টিকার্লোতে!!
.
সাধারণ আচরণ
কাবুল থেকে ১৮ আগস্ট প্রেরিত, কলকাতায় ১৯ আগস্ট প্রকাশিত খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান জাতীয় আওয়ামী দলের নেতা গাউস বখস বিজেনজো এবং আতাউল্লা খান মেঙ্গলের গ্রেফতারিতে আফগান সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ফলে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাবুলে অবস্থিত পাক রাষ্ট্রদূতকে এত্তেলা পাঠিয়েছেন এবং গ্রেফতারির বয়ান দিতে বলেছেন।
ধরে নেওয়া যেতে পারে, আফগান পররাষ্ট্র বিভাগ শুধু যে জনসাধারণকে তাদের প্রাগুক্ত উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তাই নয়, পাক রাষ্ট্রদূতকে সর্বপ্রথম এই চিত্তবৈকল্যের দুঃসংবাদ জানিয়েই তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। কাগজে বেরিয়েছে ডেকে পাঠানো অতএব হয়তো অভ্যর্থনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
শুনেছি, এদেশে নাকি ইংরেজ আমলে হোম মিনিস্টার বা স্টেট সেক্রেটারি ফাঁসির আসামির করুণাভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করলেও পত্রশেষে পানামায় লিখতেন, মহাশয় আপনার একান্ত বশীভূত ভূত হওয়ার গৌরবপ্রাপ্ত অমুক আই হ্যাভ দি অনার টু বি, স্যার, ইওর মোস্ট অবিডিয়েন্ট সারভেন্ট লেখার পর নাম সই করতেন। প্রকৃত সত্য নিরূপণার্থে দু চারজন ইয়ারবখশিকে এই সাতিশয় সিভিল প্রশ্নটি শুধোলে তারা রীতিমতো মিলিটারি হাঁক ছেড়ে গাক গাক করে যে-সব অশ্রাব্য উত্তর দিলেন তার থেকে অনুমান করলুম, তাঁদের প্রতি কখনও সরকার এমন অনুগ্রহ করেননি যে, জনৈক সবৈতনিক রাষ্ট্রীয় কর্মচারী স্বহস্তে সসম্মানে একটি প্রয়োজনাতীত সুদীর্ঘ নেকটাই তাঁদের গলায় পরিয়ে, পায়ের নিচের টুলটি এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে, কবিবরের ভাষায় দোদুল দোলায় দোদুল্যমান করবে। তথাপি আমার মনে ধোকা রয়ে গেল, সদাশয় সরকার এবম্প্রকার দুর্লভ গৌরব দেখালে তাঁরা মহারানির জন্মদিনে প্রদত্ত খেতাবের মতো সে নেকটাই গ্রীবাদেশে পরিধান করতেন কি না। আমার প্রশ্ন, আদব-কায়দার প্রটোকল সংক্রান্ত।
সচরাচর কাবুলে এগানা-বেগানা কেউ এলেই উচ্চকণ্ঠে সংবর্ধনা জানানো হয়, আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক–ব-ফরমাইদ, তশরিফ আনয়ন করুন–তশরিফ বিয়ারিদ, আপনার কদম মবারক হোক– কদম তান মুবারক, আপনার চশম রৌশন হোক– চশমে তান রওশন। সম্পূর্ণ পাঠটি বেহদ রাজ পত্রিকায় গুনজাইশ নেহায়েত তঙ্গ। আমি মজবুর হয়ে মুখতসরে কাবুলের সিভিল প্রটোকলটি সেরে নিলুম।
কিন্তু এস্থলে কার্যকরী হবে, ডিপ্লোম্যাটিক অর্থাৎ কূটনৈতিক কিংবা, রাজদূত সমাগম-সুলভ রাজসিক প্রটোকল। সে প্রটোকল বহুরূপী। যেমন ধরুন একটি সুপরিচিত নজির : বার্লিনস্থ ফরাসি রাজদূত কুলোদ্র পূর্বাহে এত্তেলা দিয়ে গিয়েছেন জর্মন ফরেন অফিসে জর্মন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোখিম ফন রিবেট্রপকে স্বহস্তে একটি মহামূল্যবান রাজপত্র সমর্পণ করতে। রিবেট্রপ কেন, ফরেন অফিসের নগণ্য ফুট-ফরমাইশের ছ্যামড়াডাতক জানে সে দলিলটি কী।
বিঘোষক দৌবারিক দ্বার উন্মোচন করে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিবে, হিজ এক-সেলেনসি সম্মানিত ফরাসি রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ অধিকারাধার (প্লেনিপোটেনশিয়ারি) রাষ্ট্রদূত সর্বোচ্চ সম্মানাধিপতি মসিয়ো কুলোদ্র! গৃহমধ্যে উচ্চাসনে বসে আছেন একদিকে ফন রিবেট্রপ। সম্মুখে বি-টিম ফুটবল খেলার মতো বৃহৎ টেবিল। অন্যদিকে অভ্যাগতের জন্য একখানা নাতি উচ্চাসন। কুলোদ্র অন্যদিনের মতো ফরাসি ভাষায় বুজুর বা জর্মনে শুটন টাখ বলবেন না। যে চেয়ারে বসার কথা, সেটাকে উপেক্ষা করে ঋজু কঠিন মেরুদণ্ড টান টান করে খাড়া দাঁড়িয়ে সুদ্ধমাত্র গ্রীবাটি ক্ষণতরে পোয়াটাক ইঞ্চি নিচু করে বাও করবেন। রিবেট্রপও উঠে দাঁড়িয়ে সম-মেকদারে বাও করবেন, মেহমানকে অন্যদিনের মতো আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানাবেন না বা হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াবেন না। বলা বাহুল্য, দু জনারই মুখমণ্ডল দেখে মনে হবে দু জনারই দারুণ কোষ্ঠকাঠিন্য।
আমি একটি প্রকৃত ঘটনারই বিবরণ দিচ্ছি। এটা ঘটেছিল ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ। তার আগে আরেকটা ঘটনার উল্লেখ করে নিই। আজ ২২ আগস্ট। চৌত্রিশ বৎসর পূর্বে ঠিক গতকাল আমাদের প্রাগুক্ত রিবেট্রপ গিয়েছিলেন মস্কো। সেখানে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এমনই সম্মান, যেটা রাজার রাজার কপালেও কালেকস্মিনে লেখা থাকে। রিবেট্রপ তার প্রভু হিটলারের হয়ে স্তালিনের সঙ্গে বিশ্বসংসারের অপ্রত্যাশিত অকল্পনীয় এক মৈত্রীচুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর স্তালিন চেঁচিয়ে উঠলেন, প গালে, প গালে– গেলাশ গেলাশ। সঙ্গে সঙ্গে জনা ছয় কমরেড হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। সমবেত কমরেডদের জন্য সেই জার আমলের ফেনসি গেলাশ, আর ইহলোকের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যামপেন। ফটাফট বোতলের কর্ক লক্ষ মেরে ঠোক্কর দেয় ছাতে। শ্যামপেন বইতে লাগল যেন, জাহ্নবী-যমুনা, বিগলিত করুণা, নাহি তার তুলনা। স্তালিন মদ খেতে পারতেন জালা জালা! আর-সব কমরেড টেবিলের তলায় বেহেড মাতাল হয়ে অচৈতন্য হওয়ার পরও স্তালিন একা একা চালিয়ে যেতে পারতেন আরেক পাল শুষ্ক-কণ্ঠ নয়া কমরেড না আসা পর্যন্ত। তাদের অবস্থাও হত তদ্বৎ। হিটলার ছিলেন। নিরামিষভোজী, মদ্যে বিরাগ। অথচ তার দোস্ত ছিলেন পাড় পিনেওলা, ফটোগ্রাফার হফমান। তাঁকে রিবেট্রপের সঙ্গে পাঠিয়েছেন, মৈত্রী-পরবের ছবি তুলতে, আর স্তালিনের সঙ্গে সুধাপানে পাল্লা দিতে। হফমানই সে জলসার রসময় উভয়ার্থে সরেস বর্ণনা দিয়েছেন, হিটলার গত হওয়ার পর তাঁর কেতাবে হিটলার ছিলেন আমার দোস্ত। এটা হল সৌজন্যের প্রটোকল সুধাপান ম্যাচ ও সেই প্রটোকল অনুযায়ী ড্র যায়।
সে সন্ধ্যায় হিটলার তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ জর্মনিতে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আকাশে উত্তরের আলো দেখছিলেন। নৈসর্গিক এই সূর্যরশ্মি মাঝেসাঝে দেখা যায়। হিটলারের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের মন্ত্রী স্পের (যুদ্ধ চালনার অপরাধে কুড়ি বৎসর জেল খেটে বেরুবার পর) তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ স্মৃতিচারণ গ্রন্থে লিখেছেন, সমস্ত আকাশ টকটকে লালে লাল হয়ে গিয়েছে, আমাদের হাত-মুখ যেন সে লালের ছোপে লাল হয়ে গিয়েছে। লালের সেই লীলা-খেলায় আমাদের মন যেন অদ্ভুত এক চিন্তায় নিমজ্জিত। হঠাৎ হিটলার তার অন্যতম মিলিটারি অ্যাডজুটেন্টের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, গাদা গাদা রক্তের মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এবারে বিনা রক্তপাতে আমরা সফল হব না।
আমার এক বোন এবং সিলেটের আরও কে একজন বলছিলেন, তারা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে রক্তে রাঙা অস্বাভাবিক টকটকে লাল সূর্যাস্ত দেখেছিলেন। এদের দু জনাই অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ, সর্ব কুসংস্কার বর্জিত। তবু নাকি তাদের মনে এক অজানা অস্বস্তি অনেকক্ষণ ধরে জেগে রয়েছিল।
.
হিটলারি হেকমত
যাক সে-কথা। খুব একটা দূরে চলে আসিনি। আর সামনেই ৩ সেপ্টেম্বর। কুলোদ্র-রিবেট্রপ দু জনাই যেন আজন্ম মূক বধির– এতক্ষণ অবধি। অতঃপর কুলোদ্র প্রতিটি শব্দ যেন হরফ গুনে গুনে পড়ে গেলেন জর্মনির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধ-ঘোষণা। ঘোষণান্তে এস্থলে রিবেট্রপ ত্রিবিধ পন্থার যে কোনও একটা বেছে নিতে পারেন। নীরবে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করতে পারেন, কিংবা বলতে পারেন তিনি এ ঘোষণা আন্তর্জাতিক বিধিবিধান-বিরোধী বে-আইনিরূপে গণ্য করে ঘোষণাটা রিজেক্ট করছেন, কিংবা ঘোষণা সম্বন্ধে আপন মন্তব্য প্রকাশ করতে পারেন। রিবেনট্রপ কষায় বদনে, প্রকৃতিদত্ত তাঁর বেতমিজ কণ্ঠে অতি দীর্ঘ এক বিবৃতি পড়ে যেতে লাগলেন– অবশ্য দুই পালোয়ানই তখনও ঝাণ্ডার ডাণ্ডার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, নড়ন চড়ন-নট-কিছু– দফে দফে বয়ান করলেন ফ্রান্সের অগুনতি অপরাধ, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নীর নিরবচ্ছিন্ন গুনাগার হারামি একমাত্র ফ্রান্স, জর্মন গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতাটি। সর্বশেষে কণ্ঠস্বর এক পর্দা চড়িয়ে বললেন, যুদ্ধ যদি লাগে তবে ফ্রান্সই সর্বাংশে দায়ী।
মসিয়ো কুলোঁদ্র স্থিরদৃষ্টিতে রিবেট্রপের দিকে তাকিয়ে দুটিমাত্র শব্দ বললেন, লিস্তোয়ার জুজরা– বিচারিবে ইতিহাস। বৃথা বাক্য। ইতিহাসই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ বিচারক।
প্রথম দর্শনের মাথা নিচু করে বাও করা থেকে মাষা পরিমাণ কমিয়ে পুনরায় বাও করার আভাসটুকু ছুঁইয়ে কুলোদ্র ধীর পদক্ষেপে গ্ৰস্থান করলেন। ব্যস। ইরানি জবানে বলে, অতঃপর আলোচনার গালিচাখানি গুটিয়ে গুটিয়ে রোল করে বোন্দা পাকিয়ে ঘরের এককোণে দাঁড় করিয়ে রাখা হল।
এ ধরনের ঘোষণার শেষে প্রথম পাঠেই, উভয় দেশের ইলচির স্বদেশ প্রত্যাগমন ব্যবস্থাদি সম্বন্ধে দু-একটি নিতান্তই প্রতি পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় ফরমুলা থাকে। আমার টায়-টায় মনে নেই। এ দুনিয়ায় নাতিহ্রস্ব জিন্দেগির চন্দ বরাজের মুসাফিরিতে এ-তাবৎ তোকে আমি দেখে নেব চারটি মাত্র শব্দ বলে কাউকে নিরস্ত্র কথা-কাটাকাটির নির্জলা যোঝাযুঝিতেও দাওয়াত জানাতে এ ভীরু আদার ব্যাপারি ধারকর্জ করেও হিম্মঠুকু জোগাড় করতে পারেনি সে রাখবে মানওয়ারি জাহাজের খবর!
.
কাবুলি কায়দা
বেলুচিস্তানে কয়েকজন হোমরাচোমরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তা তারা যতই গেরেমভারি হন না কেন, তাই নিয়ে আফগানিস্তান হিটলারি হেকমতে তুলকালাম কাণ্ড করবে অর্থাৎ সেটাকে আন্তর্জাতিক আইনে যাকে বলে কাজুস বেল্লি- ওয়ার কজ, যুদ্ধ ঘোষণার জন্য যথেষ্ট কারণ এ কথা বলবে না। অবশ্য আমাদের সকলেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে খুন-জখমের মতো মারাত্মক ব্যাপারের মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই শেষটায় দেখি, অতি তুচ্ছ কারণে বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল। বড় বড় যুদ্ধের পিছনে আকছারই দেখা গেছে, যে কারণে আখেরে লড়াই শুরু হয় সেটা কোনও কারণই নয়, ইতিহাস বার বার সে সাক্ষ্য দেয়। উপস্থিত আফগান পক্ষ কীভাবে তাঁদের বক্তব্য, আপত্তি, প্রতিবাদ, শাসানো যেটাই হোক পেশ করবেন বা চোখ রাঙাবেন তার ওপর আখেরি নতিজা অনেকখানি নির্ভর করছে। আমরা তাই একাধিক কাল্পনিক ছবি আঁকতে পারি মাত্র;
আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বয়ং সরদার দাউদ বা তাঁর প্রতিনিধি : বেলুচিস্তানে এসব কী হচ্ছে?
মি. ভুট্টোর নির্দেশ অনুযায়ী পাক রাষ্ট্রদূত (যদি মোলায়েম হওয়ার নির্দেশ থাকে) হেঁ হেঁ হেঁ! কিছু না, কিচ্ছুটি না। (যদি গরম নির্দেশ থাকে) তোমার তাতে কী ভেটকি-লোচন?
আফগান পক্ষ : বটে! আমার তাতে কী? এসব জুলুম চলবে না। দেশ শান্ত করো।
পাক পক্ষ : ওটা আমার ঘরোয়া ব্যাপার। এই ঘরোয়া-ব্যাপারের জিগির গেয়ে গেয়ে পাকিস্তানের গলায় কড়া পড়ে গেছে।
আ প : নিতান্তই আন্তর্জাতিক, দ্বি-রাষ্ট্রীয় ব্যাপার এটা। দেশের লোককে বেধড়ক ঠ্যাঙ্গাবে, তারা শুধু বেলুচ নয়, পাঠানও বিস্তর, তারা সীমান্ত পেরিয়ে আমার দেশে ঝামেলা লাগাচ্ছে, এদেশের পাঠানকে তোমার দেশের পাঠান দিবারাত্তির তাতাচ্ছে, তোমার সঙ্গে লড়াই দিতে।
পা প : তোমার দেশ তুমি সামলাও।
আ প : ইন্ডিয়ার ঘাড়ে একবার লক্ষ লক্ষ বাঙালি চাপিয়ে যে আক্কেল সেলামিটা দিলে তার পরও তোমার হুঁশ হল না?
পা প; কেন, খারাপটা কী হল? ইয়াহিয়া গেছে, বেশ হয়েছে। আমরা নরুন দিয়ে হাঁড়ি পেলুম তাক ডুমাডুম ডুম। আমরা ইয়াহিয়া দিয়ে ভুট্টো পেলুম, তাক ডুমাডুম ডুম। জ্ঞানে লুকমান, বিচারে সুলেমান, বুদ্ধিতে
আ প : (বাধা দিয়ে) সুলেমান শব্দের সঙ্গে মিল একটা বিশেষ জনের আছে, কিন্তু
পা প : (বাধা না মেনে)
সুধা পানে এজিদ শা।
জঙ্গি লড়ায়ে কামাল পাশা ॥
ফলসফাতে আফলাতুন—
অকস্মাৎ দৌবারিকের প্রবেশ। হন্তদন্ত হয়ে বললে, বাঙ্গালা দেশ, না কী যেন নাম, সেখান থেকে কিছু লোক সেঁদরি, না কী যেন লকড়ি, না লাঠি নিয়ে এসেছে।
আ প : কী তাজ্জব! পাকিস্তানের লোকটা গেল কোথায়?
.
ঘরে বাইরে, জেলে বাইরে
বিংশ শতাব্দীর যে একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিবর্তন দেশের শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একদা চিন্তিত করে তোলে এবং আজ যেটা নিতান্ত বুড়ো-হাবড়া ছাড়া আর-সবাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়, সেটা ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে। আজ যদি ঢাকাতে কোনও একটা ঘটনা সর্বসাধারণের মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং পরদিন তারই ফলে দেখা যায়, আপিস-আদালত-দোকানপাট বন্ধ, বেতার কথা কয় না, কাগজওয়ালা কাগজ দেয়নি আর রাস্তায় রাস্তায় বিরাট বিরাট মিছিল কুল্লে শহরটাকে গিলে ফেলল, শুধু শুধু কোনও মিছিলে একটিমাত্র ছাত্র সরি- ছাত্রীছাত্র নেই, তবে আপনার-আমার মন কী ধরনের ঝাঁকুনি, বরঞ্চ বলা উচিত, কী ধরনের বিজলির শক খাবে সেটা কল্পনা করতে পারেন কি? কারণ শুধিয়ে যদি শুনতে পান, ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে হোস্টেলে দোরে খিল দিয়ে পাঠ্যবই পড়ছে এবং বলছে, প্রসেসনে যোগ দিলে লেখা-পড়া করব কখন? তোমরা মিছিল করে গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, জুন্তাতন্ত্র, যে ঢপের গবরনমেন্টই কায়েম কর না কেন, দু দিন বাদে সেটা চালাবার জন্য আমরাই তো হব মন্ত্রী, সেক্রেটারি, পার্লামেন্টের মেম্বার, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার। এখন যদি রাজনীতি, অর্থনীতি, এডমিনিসট্রেশন গয়রহ ভালো করে না শিখি, তবে সরকারের রূপটা পাল্টে কিই-বা এমন পাকা ধান ঘরে তুলবে তোমরা?
সত্যিই তো। ৪৭-এ যখন ভারত সরকার তৈরি হল, তখন দেখা গেল যেসব আত্মোৎসর্গকারী নেতারা মন্ত্রী হলেন, যারা পার্লামেন্টের মেম্বার হলেন, তাঁদের বেশিরভাগই কলেজজীবন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত কাটিয়েছেন জেলে জেলে। মাঝে-মিশেলে আম-কাঁঠালের ছুটিটা-আসটা পেয়েছেন বটে, কিংবা অতীব অকারণে হঠাৎ করে গাঁধী-বড়লাটে একটা ফয়সালা হয়ে যাওয়ার বরকতে এবং ওই সুবাদে জেলগুলোর চুনকাম-মেরামতি, তদুপরি জেল-সাম্রাজ্যের ইনসপেক্টর জেনারেল গোরা রায়দের বহুদিনের প্রাপ্য হোম যাওয়ার মুলতুবি ফার্ণো ছুটি যখন আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এহেন ত্র্যহস্পর্শ উপলক্ষে তাঁদেরও কিছুদিনের তরে নেটিভ হোম দেখার জন্য মহামান্য সম্রাটের রাজসিক অতিথিশালা থেকে ঝেটিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে– এ-সত্যটাও অস্বীকার করা যায় না। ততোধিক অস্বীকার করা যায় না, কেউ বেরিয়েছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কেউ ডিগ্রিহীন জ্বর-যক্ষ্মা নিয়ে, কেউ-বা স্ট্রেচারে শুয়ে শুয়ে বাড়ি এসেছেন, যাতে করে তার হাড্ডিগুলো বাপ-পিতেমোর হাড্ডির সঙ্গে সম্মিলিত হয় : সরকারি ইংরেজিতে বলা হয় যাতে করে হিজ বোনস আর গ্যাদার্ড আনটু হিজ ফোর-ফাদার্স, অথবা একই শোনে পিতৃপুরুষের ভস্মের সঙ্গে তাঁর ভস্ম মিলিত হবে বলে।
সুস্থই হোন আর নিম-মরাই হোন, ওই চন্দরোজের ফুরসতে তারা যে মার্শাল মার্কস কেইনস লাকি পড়ে বিদ্যাদিগগজ পণ্ডিত হয়ে যাবেন কিংবা দেশের বাজেট কীভাবে চৌকস ব্যালানস করে বানাতে হয়, অথবা নামকে-ওয়াস্তে যেসব এসেমব্লির তখনও সেশন হচ্ছে, সেগুলো নিত্যদিন এটেন্ড করে তর্কাতর্কি, নন-কনফিডেনসের ঘোল খাওয়ানোর কায়দা-কেতা রপ্ত করে নেবেন এমনতরো দুরাশা করা যায় না।
আমার পাপ-মন থেকে কেমন যেন একটা বেয়াদব সন্দেহ কিছুতেই দূর হতে চায় না, মহাত্মা গাঁধী তাই বোধহয়, স্বরাজ লাভের পর সভয়ে পার্লামেন্টের ছায়াটি পর্যন্ত মাড়াননি। হিন্দু মহাসভার হামলাতে কুপোকাৎ হয়ে যেতেন না তিনি? আপনারা বলবেন, ক্যান? বারিসডরিডা তেনার পাস করা আছিল না? হঃ! খুব আছিল! কলকাতা পার্কে বিলিতি কাপড় পোড়ানোর জন্য যখন একদিন আসামি হয়ে দাঁড়ালেন, ততদিনে বেবাক ব্যারিস্টারি বিদ্যে কর্পূর হয়ে উবে গিয়েছে– হাওয়ায় হাওয়ায়! সঠিক মনে নেই, কাকে উকিল পাকড়ে ছিলেন। আমাদের চাটগায়ের সেনগুপ্তকে? তিনি তখন জেলে না বাইরে, তা-ও ভুলে গিয়েছি। বাইরে থাকলে তাকেই ধরা উচিত ছিল। তাই বলছিলুম, আইনের এলেম যদি তার পেটে এক দানাও থাকত তবে কি তিনি নিদেন একটা ডেপুটি মিনিস্টারও হতে পারতেন না। পক্ষান্তরে স্মরণে আনুন, গাঁধী যে রকম পার্লামেন্টের মুখদর্শন করেননি, লেট ব্যারিস্টার জিন্নাও হুবহু তেমনি জেলের মুখ দর্শন করেননি। তিনি কাইদ-ই আজম, সদর-ই-পাকিস্তান হবেন না, তো হবে কে? গাঁধী?
এই জেলের কথা যখন নিতান্ত উঠলই তখন রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। তিনি তো কোনও প্রকারের দেশ-সেবা করেননি, কোনও প্রকারের বাণী রেখে যাননি, তাই বলছি। রবীন্দ্রনাথ যখনই খবর পেতেন তার কোনও প্রাক্তন ছাত্র, কোনও ছাত্র বা শিক্ষকের আত্মীয় ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে জেল থেকে বেরিয়েছে বা তার কোনও পরিচিত রুগণ যুবার পিছনে পুলিশ বড্ডবেশি তাড়া লাগাচ্ছে, সে ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে, তখন তাকে ডেকে পাঠিয়ে বলতেন, এখানে থাক। শরীরটা সারিয়ে নে। লাইব্রেরি রয়েছে। পড়াশোনা কর। যদি তার মনে হত, পুলিশ নাছোড়বান্দা, তা হলে টেগার্টকে জানিয়ে দিতেন, আমার এখানে অমুক এসেছে, রুগ্ণ শরীর সারাতে। আমি কথা দিচ্ছি, সে যতদিন এখানে আছে, অ্যাকটিভ পলিটিকস করবে না। কেন জানিনে, টেগার্ট কবির কথা শুনতেন এবং আরেকটি ঘটনার কথা আমি ভালো করে জানি। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ এক যুবা, এ-দেশে ক্যুনিজমের উদয়-কালে সে মতবাদের অত্যুৎসাহী সমর্থক ও প্রচারক হয়ে যায়। টেগার্ট যে কোনও কারণেই হোক, তাঁকে ধরতে চাননি। কবিকে জানান, অমুককে বলুন না, সে মস্কো চলে যাক। কম্যুনিজম স্বচক্ষে দেখে আসুক। আমি তাকে পাসপোর্ট দেব। হয়তো টেগার্ট ভেবেছিলেন, দূর থেকে অনেক জিনিসই সুন্দর দেখায়, কবি বায়রনের ভাষায়,
সে যেন জীর্ণ প্রাসাদ ঘেরিয়া
শ্যামা লতিকার শোভা,
নিকটে ধূসর জর্জর অতি
দূর হতে মনোলোভা।
যুবার সঙ্গে আমার বার্লিনে দেখা হয়। টেগার্টের আশা আধাআধি সফল হয়েছিল। ভদ্রলোক তখন স্তালিনের নাম শুনলে ক্ষেপে যেতেন। মস্কো থেকে সদ্য ফিরে এসেছেন। তাঁর মতবাদ হয় স্তালিনের পছন্দ হয়নি কিংবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, তাকে রাশা ছেড়ে বার্লিন চলে আসতে হয়। কিন্তু মার্কসিজমে দৃঢ়তর বিশ্বাস এবং আস্থা নিয়ে তিনি কম্যুনিজমের জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন।
.
পলিটিকস-হীন ছাত্রসমাজ?
কল্পনাও করা যায় না, কি গুমোট গরমে এই ঢাকায়, কি কাবুলের মোলায়েম ঠাণ্ডায়– আজকের দিনে।
গুন গুন করছি,
রজনী নিদ্রাহীন
দীর্ঘদগ্ধ দিন,
আরাম নাহি যে জানে।
ভয় নাহি ভয় নাহি,
গগনে রয়েছি চাহি
জানি ঝঞ্ঝার বেশে
দিবে দেখা তুমি এসে
একদা তাপিত প্রাণে ॥
রাত দুটো বাজতে চলল। আল্লা মেহেরবান। ঝঞ্ঝা থাক মাথায়। ঝঞ্ঝার শুরু সাইক্লোনের কৃপায় এ-দেশটা যায়-যায়। মোলায়েম ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। বুড়িগঙ্গা ছাড়িয়ে, বাংলাদেশ রাইফেলসের বিরাট মাঠ পেরিয়ে, চাঁদমারি টিলাটার বেণুবনের ভিতর দিয়ে। কিন্তু হায়, কোথায় সে বেণুবন– দেড় বছর আগেও যা ছিল? টিলাটার নিচ দিয়ে বারো মাস বয়ে যায় ক্ষীণ জলধারা, কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে এগোয়, ছোট্ট নালা বেয়ে সাত-মসজিদ-রাস্তার দিকে। আর বর্ষায় তার কী দাপট! এই এখন মৃদু পবনে আকাশ-ছোঁয়া বাঁশ দুলে দুলে এ ওর গায়ে পড়ে মৃদু মর্মর গানে মর্মের বাণী শোনাত, কানে কানে, কত গোপন গানে গানে। আর বর্ষার আকাশ-বাতাসের দাপটের সময় দেখেছি, অরণ্য হতাশ প্রাণে, আকাশে ললাট হানে– শহিদের মাতারা যেন আকাশে মাথা কুটছে, বিরাম না মেনে চলছে তাদের ক্রন্দন!
সে বেণুবন দেড় বছরে আজ প্রায় নিঃশেষ। যে পারে, যার ইচ্ছে কেটে নিয়ে গেল প্রথম দীর্ঘাঙ্গীদের। এমন কচি বাঁশগুলো যখন কাটে, তখন আমি দু কানে আঙ্গুল গুঁজে দাঁতে দাঁত কাটি। হাউসমানের কবিতায় পড়েছিলুম, হতভাগার ফাঁসি হবে পরের দিন ভোরে। নিরেট অন্ধকারে চোখ মেলে সমস্ত রাত ধরে শুনছে, খট খট শব্দ। বাইরে ফাঁসিকাঠ তৈরি করছে মিস্ত্রিরা– তারই পেরেক ঠোকার খট খট আওয়াজ রাতভর। ওই কাঠেই সে ঝুলবে; ঘাড়ে দড়ি বেঁধে দেবে ফাঁসুড়ে। হাউসমান কবিতা শেষ করেছেন এই বলে, যে ঘাড় খুদাতালা তৈরি করেছিলেন অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে… মট করে মটকাবার জন্য না।
শেষ বাঁশ কাটা হয়ে গেলে আমিও শান্তি পাব। কিন্তু মরবে আরেক জন। যে-টিলাটার উপর চাঁদমারির পাঁচিল, সেটা নালার সম্বৎসর বয়ে যাওয়া পানিতে, বিশেষ করে বর্ষার প্রবল আঘাতে যেন ক্ষয়ে গিয়ে ধস নেমে পাচিলটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে না পড়ে, তাই টিলাটার সানুদেশ, নালার কিনারা অবধি সমস্তটা ছেয়ে বাঁশ লাগিয়েছিলেন সেই দূরদর্শী গুণী যিনি চাঁদমারির পুরো প্ল্যানটা তৈরি করেছিলেন তিনি বাঙালি। আমার মতো মূর্খও বাঁশবনের তত্ত্বটা বুঝতে পারে। এখন অন্ধকার–কৃষ্ণা দশমী; বলতে পারব না, আর কটা কচি বাচ্চা বাঁশ অবশিষ্ট আছে। দিনের আলোতে গুনতে দেড় আঙ্গুলের বেশি লাগবে না।… লোকে বলে, যাক না কেন জোয়ার জলে। খাক না কেন বাঘে। কোন অভাগা জাগে। আমার তাতে কী ভাঙবে ব্যাটা পাঁচিলটা।
ছাত্ররা বলেন, পেশাদারি পলিটিশিয়ান দেশের কথা যত না ভাবে, নিজের স্বার্থের কথা ভাবে ঢের ঢের বেশি (নিউগেটের পর কে অস্বীকার করবে এ তত্ত্বটা?)। আমরা এখনও সংসারে জড়িয়ে পড়িনি। আমরা কপট হব না, চট করে। পারলে দু চার জন করাপট প্রফেশনালদের ঠ্যাঙ্গাতেও আমাদের বাধবে না। কথাটার মধ্যে ও বাইরে গভীর জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাস স্বপ্রকাশ। প্রাচ্যের পলিটিকসে করাপশন বেশি বলেই এ ভূখণ্ডে প্রথম ছাত্র আন্দোলন আরম্ভ হয়। কাবুল পর্যন্ত পৌঁছতে একটুখানি সময় লেগেছে। বছর দশেক পূর্বে কাবুল পার্লামেন্টে বোর্কাহীন, অবগুণ্ঠিতা একজন মহিলা সদস্যা লেকচার দিতে উঠলে, প্রাচীন-পন্থি কট্টর আরেক সদস্য ছুটে গিয়ে, তাকে আক্রমণ করে, তার জামা-কাপড় ছিঁড়তে আরম্ভ করে। নিরুপায় হয়ে তিনি পার্লামেন্টগৃহ ত্যাগ করে প্রাণপণে ছুটে গিয়ে একটা হোস্টেলে ঢোকেন।
ছাত্ররা তাকে আশ্রয় দেয়। খবর পেলুম এবারে তারা খোলা ময়দানে নেমেছে। তাদের ভিতর মাও, মস্কো, র্যাডিকাল তিন দলই আছে। ভাবছি, সিরিজের শিরোনামটা পাল্টাব কি না।
***
মোন-জো দড়োর বংশধর দড় বেলুচ
মৃত, ইংরেজি মর্টেল মার্ডার, ফরাসি মর, জর্মন মর্ড, ফারসি মুর (দন), গ্রিক ব্রতস-ইন্ডো-ইউরোপিয়ান সর্ব ভাষাতেই মরা অর্থে সংস্কৃত মৃ = মরা পাওয়া যায়। বর্তমান দিনে উত্তর ভারতের সব ভাষাতেই ওই মৃ পাওয়া যায়, বাংলায় মরা, হিন্দিতে মরণা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সিন্ধিতেও ওই মো দিয়েই মর মানুষের সর্বশেষ ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত কর্মটি প্রকাশ করা হয়। এই মো-এর সঙ্গে ন যোগ দিয়ে মৃত শব্দের বহুবচন নির্মাণ করা হয় : ফলে সিন্ধিতে মোন শব্দের অর্থ মৃতরা। উচ্চারণ করার সময় সিন্ধিরা আমাদের মতো মোন বা মন-এর মতো করেন না। আমরা, পূর্ব বাংলায় যে রকম মেঠাই মোহনভোগ উচ্চারণ করার সময় মোহন শব্দের হটি অ-এ পরিণত করে মোটা আরেকটু লম্বা করে দিই, সিন্ধিরাও ঠিক তেমনি উচ্চারণ করেন, যেন শব্দটা মোঅন। বাংলায় আমরা যে রকম বড়র পীরিতি বালির বাঁধ বাক্যটিতে বড়লোকদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পীরিতির সম্পর্ক বোঝাবার জন্য র অক্ষর যোগ দিই, কিংবা ইংরেজিতে ফুলস প্যারাডাইজ- আহাম্মুকের স্বর্গ, ডগস টেল- কুকুরের ল্যাজ বাক্যে এপসট্রফি এবং এস অক্ষর যোগ করি, হিন্দুস্তানিতে রহমতকা বেটারহমতের ছেলে বাক্যে কা জুড়ি, সিন্ধিরা তেমনি মৃতদের টিলা আপন ভাষাতে লেখেন মোন-জো দড়ো, উচ্চারণ করেন প্রাগুক্ত পদ্ধতিতে–মোঅন (কিন্তু মো আর অ-এর মাঝখানে আরবির হামজার মতো সামান্য আমরা একটুখানি থেমে যাই, সেটা করা হবে না, মা-র ও-কারটা শুধু দীর্ঘতর করতে হবে) জো দড়ো।
প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতার ভগ্নস্তূপ স্থলে আছে, তার আশপাশের আধুনিক জনগণের মধ্যে একটা বহুদিনকার কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল, ওই টিলার নিচে বিস্তর মৃতজন রয়েছে। সঠিক কিন্তু তড়িঘড়ি অনুমান করে বসবেন না যে ওই (লারকানা) অঞ্চলের জনপদবাসী সিন্ধুর চার-পাঁচ হাজার বৎসরের মৃত, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম সভ্যতার স্মরণে টিলা অঞ্চলের নাম দিয়েছিল মোন-জো দড়ো। বস্তৃত তাদের ধারণা ছিল, একদা ওখানে প্রাচীন বৌদ্ধদের বিহার-ভূমি ছিল।
আমি লোকমুখে যা শুনেছি সে অনুযায়ী পরলোকগত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এই টিলাটি প্রথম দেখেন, তখন এটাকে কোনও বৌদ্ধস্তূপের ভগ্নাবশেষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন, কারণ হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর সময়ে সিন্ধু দেশের রাজা যদিও হিন্দু ছিলেন, তবু সে দেশে যথেষ্ট বৌদ্ধবিহার সঙ্ঘারাম আছে। যতদূর মনে পড়ে, রাখালদাস টিলা খোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম পান বৌদ্ধ-নিদর্শন, আরও গভীরে যাওয়ার পর বেরুল এমন সব বস্তু, যা রাখালদাসের মতো সুপণ্ডিত প্রত্নতাত্ত্বিক পৃথিবীর কোনও যাদুঘরে বা তার দর্শনীয় বস্তুর ছবিতে দেখেননি। অর্বাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক হলে হয়তো এগুলো অবহেলা করত, এবং চিরতরে না হলেও বিশ্বজন হয়তো বহু শতাব্দী অপেক্ষা করার পর এ সভ্যতার সন্ধান পেত। রাখালদাস প্রথম দর্শনেই বুঝতে পেরেছিলেন এর অনন্যতা ও নিশ্চয়ই ইউরেকা হুঙ্কার রব ছেড়েছিলেন।
গোড়াতে বহু পণ্ডিতই ধারণা করেছিলেন, সিন্ধু সভ্যতা উত্তর সিন্ধু থেকে পাঞ্জাব (হারাপ্পা) অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরে দেখা গেল, সুদূর প্রসারিত ছিল এ সভ্যতা। তা হলে সমস্যা দাঁড়ায়, এত বড় বৃহৎ সভ্যতাকে সম্পূর্ণ নির্মূল-নিশ্চিহ্ন করাটা তো খুব একটা সম্ভাব্য সাধারণ ব্যাপার নয়। আমি কোনও সদুত্তর পাইনি, এটা না বললেও চলবে।
এ সভ্যতা অন্তত বেলুচিস্তান অবধি যে সম্প্রসারিত ছিল সেটা পরে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অদ্যকার মোন-জো দড়ো অঞ্চলের সিন্ধিদের কোনও-কিছুতেই যে-রকম প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না (ওই লারকানা অঞ্চলের অধিবাসী মি. ভুট্টো আজ সেই বিদগ্ধ অতিপ্রাচীন সভ্যতার বংশধররূপে বড়ফাট্টাই করেন কি না, সেটা দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বলতে পারবেন না। ঠিক তেমনি অদ্যকার বেলুচদের কি চিন্তা, কি জীবনধারায় সিন্ধু সভ্যতার চিহ্নমাত্র নেই। বস্তুত (ভবিষ্যতের) পখতুনিস্তান, বর্তমান আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, তুর্কমানিস্তান প্রভৃতি ভূখণ্ডে যেখানে পর পর বৌদ্ধ সভ্যতা হিন্দু সভ্যতা, সর্বশেষে হিন্দু-বৌদ্ধ মিলিত সভ্যতা প্রচলিত ছিল সেখানে এগুলোর সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না, অর্থাৎ এদের জীবনের উপর ওরা কোনও প্রভাবই রেখে যায়নি। এমনকি ইউরোপের শিক্ষিত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হিদেন গ্রিক, রোমান এমনকি বর্বর টিউটন যে গভীর দাগ কেটে গেছে তার শতাংশের একাংশও না। পরবর্তীকালে এই বাংলাদেশ যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, এ দেশের চাষা-জেলে যতখানি ইসলাম মেনে চলে, পাঠান বেলুচ উজবেক, কিজিলবাশ (ইয়েহিয়ার কওম) তার দু আনা পরিমাণও না। এবং আমার পক্ষে অট্টহাস্য সংবরণ করা বড়ই মুশকিল মালুম হয়, যখন পাঞ্জাবি সেপাই, এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত পাঞ্জাবি মুসলমান আপন ইসলাম নিয়ে দম্ভ প্রকাশ করে, ডান হাতে গেলাস বাঁ হাত সাদরে সম-রতি-সখার কাঁধে রেখে। ব্যত্যয় অবশ্যই আছে; উপস্থিত সে আলোচনা থাক।
বেলুচ-পাঠানদের মনোবৃত্তি বুঝতে হলে উজান গাঙে আমাদের চলে যেতে হবে হাজার চারেক বছর পূর্বে। পণ্ডিতরা বলেন, মোটামুটি ওই সময়েই আর্যেরা ইরান হয়ে এদেশে আসে। এদের এক অংশ ইরানে বসতি স্থাপন করে। গোড়ার দিকে জীবিকা নির্বাহের জন্য এদের প্রধান পন্থা ছিল, গবাদি পশুপালন এবং পরসম্পদ লুণ্ঠন। এবং আর্যদের দেশ-দেশান্তরে অভিযানের সময় যারা যে অঞ্চলে রয়ে গেল তারা স্থায়ী বসবাস নির্মাণ না করে যাযাবর বৃত্তিই প্রচলিত রাখল।…এ স্থলে স্মরণে রাখা উচিত, যৎসামান্য কৃষিকর্ম দ্বারা মানুষ জীবনধারণ করতে পারে না। উন্নত কৃষিকর্ম শিখতে মানুষের হাজার হাজার বৎসর সময় লেগেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ছয়শত বৎসর পূর্বে ইরানের কিছু লোক কৃষিকর্ম ও কৃষির প্রকৃত মূল্য বুঝতে পেরে গিয়েছে। এদের নেতা ছিলেন জরথুস্ত্র (ইংরেজিতে জেনোআস্তর, চলতি ফারসিতে জরতুস জরথুস– জর্মন দাশনিক নিৎশে কিন্তু জর্মন জরথুস্ত্রই লিখেছেন)। ইনি ইরানের বলখ অঞ্চলের রাজা গুশতাসপকে তাঁর ধর্মে দীক্ষিত করতে সমর্থ হন– ভারতের পারসি সম্প্রদায় এই জরথুস্ত্রী ধর্মাশ্রয়ী। কিন্তু এহ বাহ্য। প্রত্যেক ধর্মের একটা নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকে। জরথুস্ত্র রাজা গুশতাসপকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, যাযাবরবৃত্তি লুণ্ঠন ও শুধুমাত্র গো-পালন দ্বারা কোনও সমাজ চিরতরে আপন খাদ্যসমস্যা সমাধান করতে পারে না, এবং যারা প্রতি বৎসর পালিত পশুর খাদ্য ঘাস-পাতা-ভরা উর্বরা জমির সন্ধানে দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়াতে বাধ্য, অর্থাৎ যারা চিরদিনের যাযাবর, তাদের দ্বারা আপাতদৃষ্টিতেই কোনও সভ্য-সমাজ নির্মাণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। তখন আরম্ভ হল সংগ্রাম দু দলে যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে উন্নতমানের কৃষিকার্যে সক্ষম হয়ে স্থায়ী বসবাস নির্মাণ করে সভ্যতার গোড়াপত্তন করতে যাচ্ছে, অর্থাৎ জরথুস্ত্র-গুশতাসপের অর্থনীতিতে বিশ্বাসী এবং যাদের রক্তে নিত্য নিত্য স্থান পরিবর্তনের, ঘুরে ঘুরে মরার নেশা, যে নেশা পরিপূর্ণ সভ্য মানুষের শরীর থেকেও কখনও সম্পূর্ণ লোপ পায় না, যে নেশার আবেশে বিদগ্ধ নাগরিক কবি গেয়ে ওঠে,
ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুইন!
চরণতলে বিশাল মরু
দিগন্তে বিলীন।
বর্শা হাতে, ভরসা প্রাণে
সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে।
সকল বাধাহীন ॥
গৃহী এবং যাযাবরে এ দ্বন্দ্ব চিরপুরাতন তথা অতি সনাতন, নিত্য পরিবর্তনের অপরিবর্তনীয়। কথিত আছে চেঙ্গিসের মঙ্গোলরা বিস্তর রাজ্য জয় করার পরও যখন যাযাবর বৃত্তি ছাড়তে বিমুখ, তবু ছেড়ে প্রাসাদে থাকতে নারাজ তখন চেঙ্গিসের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু ঘোড়ার পিঠে বসে রাজত্ব করা যায় না। (অত্যল্প ভিন্নার্থে বলা চলে ইয়াহিয়া ট্যাংকে চড়ে বঙ্গরাজ্য জয় করতে পারেন, কিন্তু ট্যাংকে চড়ে রাজত্ব করতে পারবেন না)। ইউরোপে এখনও বিস্তর বেদে ঘুরে বেড়ায়– হিপি তাদেরই ভেজাল সয়াবিন তেল– কোনও সরকারই বিস্তর প্রলোভন দেখিয়েও ওদের কোথাও বসাতে পারেননি। … কথিত আছে জরথুস্ত্র যখন যাযাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত গৃহীদের জন্য পরম প্রভু আহুরমজদার পূজা করছেন (জরথুস্ত্রিরা অগ্নির উপাসনা করে না, অগ্নিকে সর্বাধিক পাক সৃষ্টিরূপে গভীর শ্রদ্ধা জানায়।) তখন শত্রুপক্ষ কর্তৃক নিহত হন।
বেলুচি ভাষা ও পাঠানের পশতো ভাষা দুই-ই প্রাচীন জেলে (জরথুস্ত্রীয় ইরানি ভাষা; এই ভাষায় ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা রচিত বলে একে আবেস্তান বা আবেস্তাও বলা হয়) থেকে উৎপন্ন, বা বিবর্তিত, বলা যেতে পারে। প্রাগুক্ত সংগ্রামে বেলুচ ও পাঠান হেরে গিয়েও সম্পূর্ণ হারেনি। আড়াই হাজার বছর পরও তারা গৃহী বটে, যাযাবরও বটে, কিন্তু প্রতি বৎসর তাদের বৃহৎ অংশ উর্বর চারণভূমির সন্ধানে জরু-গরু, ভেড়া-খচ্চর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, চীন কোনও দেশের কোনও সীমান্তের রত্তিভর পরোয়া তারা করে না। কারও ধড়ে দুটো মুণ্ডু নেই,- দাউদ, ভুট্টো, শাহ, কারওরই যে, ওদের কাছ থেকে পাসপোর্ট চাইবার হিম্মৎ-হেকমতি দেখাবেন। ওই অতি পুরাতন যাযাবর বৃত্তির সঙ্গে অতি অবশ্যই তারা বহু সনাতন লুণ্ঠন-ধর্মটি ন সিকে তোয়াজ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। বস্তুত ওইটেই তাদের প্রফেশন, চাষবাস নিতান্তই একটা নগণ্য হবি–স্ট্যাম্প কালেক্ট করার মতো। পাকিস্তানের শহুরে পাঠান-বেলুচ অটোনমি চায় না স্বাধীন হতে চায়– অতটা খবর নেবার মতো ফুরসত আমার নেই, অত এলেম আমার পেটেও ধরে না। কিন্তু প্রশ্ন, শহরের বাইরে যারা থাকে তারা কবে কোন রাজাকে খাজনা-ট্যাকসো দিয়েছে, শুনি। উল্টো তারা সাবসিডি পায়। খাইবারপাসের দু-পাশের পাঠানদের কারও বাচ্চা হলে প্রথম ছুট দেয় পেশাওয়ারবাগে। সেখানে নামটা পত্রপাঠ রেজিস্ট্রি করিয়ে নিয়ে তবে যায় ধীরে-সুস্থে মোল্লার বাড়িতে। তিনি ততোধিক আস্তে-ব্যস্তে একটা ভোলা নাম ঠিক করে দেন– কী যেন একখানা কেতাব থেকে, যদিও সুবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বেলুচিস্তান, পাঠানিস্তান জানে, তিনি একবর্ণও পড়তে পারেন না, আলিফের নামে ঠ্যাঙা!
এরা আরও স্বাধীন হবে কী করে? গোল মার্বেল কি গোলতর করা যায়? স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট বলেননি, লিলি ফুলটিকে রঙ মাখিয়ে আরও রঙিন করতে যায় কে?
আর যদি নিতান্তই কোনও পাঠানকে শুধোন, হে ইয়ার! পাকিস্তান-হিন্দুস্তান যদি তোমাদের নিয়ে লড়াই লাগায়, তবে তোমরা কোন পক্ষ নিয়ে লড়বে? তবে সে-পাঠান অনেকক্ষণ ধরে তার পাগড়ির ন্যাজটা দড়ি দলার মতো পাকাতে পাকাতে বলবে, আগা জান! দুটো কুকুর যদি একটা হাড়ি নিয়ে লড়ালড়ি লাগায়, হাড্ডিটা কি কোনও পক্ষ নিয়ে লড়ে?
.
ওয়াটারগেটের পানি সিন্ধুজল
ফারসিতে বলে, দের আয়েদ, দুরুস্ত আয়েদ দেরিতে যা আসে, দুরস্ত হয়ে আসে। দের–তেহরানের ফারসিতে দীর শব্দটা, ধীরে ধীরে অর্থও ধরে। ওয়াটারগেটের নোনাজল পিণ্ডিতে পৌঁছেছে ধীরে ধীরে। এমনিতেই বাংলায় বলে দেখি না, শ্রদ্ধের জল কদ্দূর অবধি গড়ায়–তাতে এসে জুটল গেট ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ওয়াটারগেটের পানি, ওদিকে সিন্ধুতে বান জেগেছে। একেবারে খাজা তেরোস্পশশ (ত্র্যহস্পর্শ), মাইরি! বলবে সামবাজারি খাস কলকাত্তাই। সিন্ধুর এই বান বার বার সাত বার মোন-জো দড়োকে নাকানি-চুবানি খাওয়ালে র ওখানকার লোক তিতিবিরক্ত হয়ে জরু-গরু নিয়ে কেটে পড়ল, কিংবা হয়তো সাত বারের বার সাত হাত পানিমে ঘায়েল হল। কিন্তু এ আন্দাজটা বোধহয় ধোপের পানিতে টেকে না। চল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর আগে মার্শাল সাহেব যখন বিরাট ডবল ইটের থান মার্কা ঢাউস তিন-ভলুমি মোন-জো দড়ো প্রকাশ করলেন তখন আর পাঁচজনের মতো আমিও পাণ্ডিত্য ফলাবার তরে তার উপর হদ্দমুদ্দ হয়ে আছড়ে পড়েছিলুম। মোন-জো আখেরে বানের জলে খতম হয়েছিল কি না, এ প্রশ্নটা তখন শুধোলে ভালোমন্দ, অন্তত এ-বাবদে লেটেসট থিয়োরি কী সেটা বলতে পারতুম; লেটেসটু বললুম এই কারণে যে, কেতাব বেরুবার আগে পত্র-পত্রিকায় সিন্ধুসভ্যতা নিয়ে এন্তের আলোচনা বাদ-প্রতিবাদ তো হয়েই ছিল, বেরোবার পর দুনিয়ার কুল্লে শুণী-জ্ঞানী তত্ত্ববিদ মাথায় গামছা বেঁধে লেগে গেলেন, হয় মার্শালকে ঘায়েল করতে, নয় তাঁকে আসমানে চড়াতে। সুচতুর পাঠককে বলে দেবার কোনও দরকার নেই, দুসরা দলেই বেশিরভাগ ছিলেন ইংরেজ। সে সময় আমার এক আইরিশ শুরু বলেছিলেন, সিলগুলোর উপর যে লিপি খোদাই করা আছে সেটা পড়তে না পারা পর্যন্ত চিত্তিরবিচিত্তির থিয়োরি গড়া বিলকুল বেকার হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতো। এর পর বৃদ্ধ শুরু তাঁর জীবনের শেষ দশ বৎসর কাটান লিপি পাঠের নিষ্ফল প্রচেষ্টাতে। সে কাহিনী আর কোনও সুবাদে না হয় বলব। কিন্তু সিন্ধুলিপির চেয়ে ঢের রগরগে লিপি ওয়াটারগেট মামলা নিয়ে মি. নিক্সন যে টেপ-লিপি যখের ধনের মতো জাবড়ে ধরে বসে আছেন। প্রকাশ পেলে সে লিপি কিন্তু অনায়াসে পড়তে পারবে, মার্কিন স্কুলবয় তক্। উঁহু, হল না। সন্দেহ-পিচেশ মার্কিন-অমার্কিন দুশমনজন বলছে, পড়তে পারবে বটে, কিন্তু কত লিপি কত পাষণ্ডই না ভেজাল ঢুকিয়ে মূল লিপি পয়মাল করেছে– যাকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বলা হয়, প্রক্ষিপ্ত, ইন্টারপলেশন। নিক্সনই লিপিটি নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলবেন না, এমনতরো সাধু মহাশয় তো তিনি না-ও হতে পারেন। বস্তুত আখেরে যখন নিঃসন্দেহে ধরা পড়ল নিক্সনের সাঙ্গোপাঙ্গর প্রায় সব কটাই ফোর টুয়েনটি ফেরেব্বাজ, তথাপি, তখনও যারা তাঁর ব্যক্তিগত সতোর কেত্তন গেয়েই চলেছে তাদের উদ্দেশে এক বিদগ্ধ ঠোঁটকাটা মার্কিন নাগরী বলেন, একটা ঘাপটি মারা ব্রথেল-বাড়ি কাল যদি ধরা পড়ে, তবে বাড়িউলী অক্ষতযোনি কুমারী কন্যা হবে– এহেন দুরাশা কর না। তাই আফসোস, হে মুশকিলপানা মাসুদ রানা, এ গজব-মুসিবতের ওক্তে তুমি কোথায় ছিলিমে দম মেরে শিবনেত্র হয়ে হুরপরীর খোওয়াব দেখছ?
সে অদেখা লিপির অজানা বাণী কিন্তু সাত সমুদ্র পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে বিশেষ করে ইরান আর তার সাকি পাকিস্তানে। নইলে মিস্টার আজিজ আহম্মদ অকস্মাৎ তার পূর্ব নীতি ত্যাগ করে বঙ্গ-প্রীতি দেখাতে আরম্ভ করলেন কেন? আমি তো শুনেছি, দুই পাকিস্তানে যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তার জন্য কার্যত মি. আহমদই দায়ী। করাচি-পিণ্ডির নেতারা গোড়ার দিকে মরহুম পুব-পাকে কী পলিসি নেবেন স্বভাবতই সে সম্বন্ধে পাকাপাকি মনস্থির করতে পারছিলেন না। তাই কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত সর্বাধিকারী আজিজই অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকারকে নীতি বাবদেও সদুপদেশ দিতেন– সে নীতি লৌহ-গোলক-নীতি। অবশ্য বর্তমান মি. আজিজ যদি প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি সেই আজিজই হন?- তবু ভালো, যার মারফতই একটা সমঝোতা হোক না কেন। দিল্লির এক বাদশাহ নাকি খারাপ জায়গা থেকে একটি সুন্দরী আনালে পর, উজির বিরক্তি প্রকাশ করেন। বাদশাহ বললেন, হালুয়া ভালো জিনিস, তা সে যে দোকান থেকেই আসুক না কেন– হালওয়া নিকু অস্ত, কে আজ হর দুকান বাশদ। এ স্থলে বলতে হবে, যেই নিয়ে আসুক না কেন।
.
লাইন অব রিট্রিট খোলা রাখো
তাই বলছিলুম সেই ভালো, সেই ভালো। আমরা চিরকালই শান্তি কামনা করেছি। তদুপরি ডানাকাটা পরী কে না ভালোবাসে? ডানাকাটা পরী পাকিস্তানকে কিয়ামততক দুশমনের নজরে দেখব, লায়লীকে মজনুর চোখে দেখব না, এমন কিরে কসম আমি কখনও গিলিনি– সাক্ষী এন্টালির মৌলা আলী। তবে কি না, অতীতের জাবর কেটে মনে ধোকা লেগে রয়, মুসলিম বেঙ্গল বুলি কপচানো আগাপাশতলা পালটে বাংলাদেশ নামক টেকি গিলতে পিণ্ডির ইয়ার-আজিজানের কতখানি সময় লাগবে? আপনারা যা ভাবতে চান, ভাবুন, আমার সন্দেহ-পিচে মন জানে, পিণ্ডির ইয়াররা অবশ্যই আরও বিস্তর ন্যাজ খেলাবেন। এতক্ষণে আলবৎ তেনাদের এডভোকেট জেনারেল, লীগের একসপারটগুষ্টি বসে গেছেন, চুক্তিটির ফস্কে গেরো, লুপ হোল, কোন শব্দে, কোন ফুলস্টপ সেমিকলোনে আছে, চুক্তিটায় সাদা কালিতে এমন কী সব লেখা আছে যাদের বদৌলতে তেনারা চটসে বেরিয়ে যাবেন খোলামাঠে, আর আমাদের বেলা দেখব, ফস্কে গেরো বক্স-বাধন, ফাঁসির গিটে টাইট হতে হতে কণ্ঠশ্বাস রুদ্ধপ্রায়। (এবং আমাদের উচিত, এই একই কর্মে লিপ্ত হওয়া। কোনও কোনও দেশ গোপনে বিদেশেও পাঠায়) তুলনায় এনে স্মরণ করাই, ইতোমধ্যে নিক্সন ক বার দিব্যি দিয়েছেন, আমার মনে নেই, সুপ্রিম কোর্ট ডেফিনিট রায় না দেওয়া পর্যন্ত তিনি টেপ-এর দলিল হাতছাড়া করবেন না, না, না। কিন্তু কুল্লে দুনিয়ার চেল্লাচেল্লি সত্ত্বেও ডেফিনিট বলতে তিনি কী বোঝেন, সে প্রশ্নটা সাফ ইনকার করে তিনি খামুশ! অথচ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওই ডেফিনিট কথাটা এ-প্রসঙ্গে বিলকুল ফজুল, বেকার। সুপ্রিম কোর্ট কেন, আমাদের মহল্লার বেকুব ছোঁড়াটা ওই যে সেদিন তৃতীয় শ্রেণির শক্তিসম্পন্ন হাকিম হল, সেও তো কখনও ইনডেফিনিট এমন কোনও রায় দেয়নি, যার তেত্রিশটা অর্থ করা যায়। হয় জেলে যাও, নয় বাড়ি যাও–মাত্র দুটো অর্থওয়ালা ইনডেফিনিট রায়ও সে কখনও দেয়নি। ছোকরাকে শুধান গিয়ে, সে যখন ট্রেনিঙে ছিল, তখন তার শুরু তাদের বলেছেন কি, রায় দেবে ডেফিনিট, সে রায়ের বিসমিল্লাতে লাল কালি দিয়ে লিখবে, ডেফিনিট জাজমেন্ট অব হাকিম অমুক। সেটা হবে ভেজা জল বলার মতো। শুকনো জল আমি কখনও দেখিনি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নিষ্কর্মা ডেফিনিট শব্দটা এস্তেমাল করা হয়েছে, রায়টা আখেরে বিপক্ষে গেলে নিষ্কর্মাটা কর্মে লাগাবার জন্য। একেই বলে আইনের ফাঁক, ল-এর লুপ-হোল। গুরু নিক্সন যে ভেল্কি দেখালেন, পিণ্ডি চেলারা কি গুরুমারা বিদ্যে দেখাতে কম যাবেন? এবং আমাদেরও এটা রপ্ত করা অতিশয় উচিত। চুক্তি ভাঙাবার জন্য নয়, যে ভাঙাতে চায়, তার মোকাবিলা করার তরে।
কিন্তু সরল পাঠক, এই পোড়াগুরুর ভা-ভাতে কান দিয়ো না। বরঞ্চ গান ধরো,
নিশিদিন ভরসা রাখিস
ওরে মন হবেই হবে।
.
পৌষ মাস কেবা কার
পাঠানের হাহাকার
অবতরণিকাটি হয়তো মেকদারমাফিক হল না।
কারণ, চিন্তাশীল পাঠক হয়তো ভাবছেন, নিরক্ষর পাঠান-বেলুচে এ-সব কথার মারপ্যাঁচ আইনের ফাঁকি ফক্কিকারির কী আর বোঝে? এমনতরো মারাত্মক ভুল করবেন না। পাঠানের বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পায়, করারনামা, করারদাদ। ওদের কওমে কওমে হর-হামেশা লড়াইফসাদ এবং নিত্যি নিত্যে সলা-সুলেহ লেগেই আছে। করার-নামা, করার-দাদ দিয়ে হয় তার অতিশয় সাময়িক তকালীন এবং ক্ষণভঙ্গুর অস্ত্রসংবরণ, আর্মিস্টস। পিস ট্রিটি চিরন্তনী শান্তি এহেন আজগবি সমাস তারা কখনও শোনেনি। করার ভাঙতে চ্যাম্পিয়ন হিটলার রিবেট্রপ পাঠানের কাছে হেসে-খেলে দু দশ বছর তালিম নিতে পারেন– করার-দাদে দফে দ েচুক্তি নির্মাণ, লুপহোল রক্ষণ, এবং তার বদৌলত চুক্তিপত্র থেকে মান-ইজ্জত বাঁচিয়ে, সসম্ভমে, একতরফা নিষ্ক্রমণ, এ-সব বাবদে যাবতীয় ফন্দি-ফিকির, সন্ধি-সুড়ুকের সম্রাট পাঠান। খাস কাবুলে কেউ কখনও এপয়েন্টমেন্ট লেটার পায় না। পায়, চুক্তিপত্র (করার-দাদ)। বেশুমার কপি সবই করতে হবে আপনাকে আপনি পাবেন কুল্লে একখানা। সরকার চাপ দিতে চাইলে দশ খানা কপি বেরিয়ে আসবে এক লহমায়। আপনি চাপ দিতে চাইলে সরকারের তাবৎ কপি গায়েব গম্ভীর কণ্ঠে বলবে শুমা শুদ, গুম হয়ে গিয়েছে। তারও বড়ড়া, হয়তো বলবে কোনও করার-দাদ নেই, ছিলও না নিস্ত-ন-বুদ– যার থেকে বাংলা নাস্তানাবুদ কথাটা এসেছে। বিশেস না হয় চলন্তিকা খুলে দেখুন।
পাঠান-বেলুচ নিরক্ষর। কিন্তু প্রত্যেকটি করার-নামা তারা জের-জবরতক মনে গেঁথে রাখে। কিন্তু এহ বাহ্য।
বললে পেত্যয় যাবেন না, শতাধিক বৎসর ধরে ব্রিটিশ, শিখ, রুশ, আফগান, ইরান, পাকিস্তান, হিন্দুস্থান– এঁদের ভিতর আপসে কী সব চুক্তিনামা তৈরি হল, কালি শুকোবার আগেই সেগুলোকে এক পক্ষ টুকরো টুকরো করল (তিক্কা তিক্কা করদনদা), এ সব সাকুল্যে সংবাদ তাদের নখের ডগায়। এরই ওপর নির্ভর করছে তার প্রধান আমদানি- লুটতরাজ। পূর্বেই বলেছি, চাষ-আবাদ তার কাছে অনেকটা আমরা যে-রকম পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করে এক খেপ রিকশাভাড়া তুলি-কি-না-তুলি গোছ। বিশেষ করে তার শ্যেনদৃষ্টি পূর্বে ছিল ব্রিটিশের প্রতি, এখন নেকনজর ফেলে পাক-সরকারের দিকে। যখনই যে-সরকার, কি আফগান, কি পাকসরকার দুশমনের হামলা বা সে-ভয়ে বেকাবু, তখনই পাঠান-বেলুচের মোকা। আর আল্লার কুদরতে আজকাল পাঠানের বারোয়ারি ড্রইংরুম, ছোটাসে ছোটা চায়ের দোকানেও বেতার। এখন হাওয়ায় যায় তাজামে তাজা খবর। অন্তত পাঁচটা দেশ পশতু জবানে পরস্পরবিরোধী খবর দেয় প্রতিদিন। আর আফগানচালিত কাবুল-বেতার এবং পাঞ্জাবি চালিত পাক-বেতারে বাক-যুদ্ধ– জংগে জবান– লেগে যায় তখন সে বেহদ আরাম বোধ করে তার দিল খুশ, জান-ত-র-র-র।
এই যে পাক, হিন্দ, বাঙ্গালায় ত্রিভুজাকৃতি করার-দাদ হতে চলল এই বে-মুবারক আখবার সুবে পাঠানিস্তানের দিল-জান কলিজা-গুর্দা তিক্কা তিক্কা করে দেবে। এতে করে পাক তার পূর্ব সীমান্ত সামলে নিল। সান্ত্বনা এইটুকু, পাক সরকারের প্রতি অপ্রসন্ন কয়েক হাজার জাতভাই পাঠান সেপাই দেশে ফিরে এলে তাদের তাড়িয়ে যদি কিছু-একটা করা যায়। সদর দাউদও সেটা হিসাবে নিচ্ছেন। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, আপন খুশিতে দাউদের হুংকারে বিব্রত পিন্ডি সরকার যুদ্ধ-বন্দিদের ফেরত নিচ্ছেন এই দুর্দিনে, বিশেষ করে নিক্সনের দুর্দিন যাদের আপন দুর্দিন– এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
পাক-পক্ষ দিল্লিতে প্রায় এক পক্ষ ধরে কেন গাইগুই, টালবাহানা করলেন, সেটা এখানে বসে আমি বলতে পারি, পাঠান জানে, তার প্রতিবেশী আফগান জানে, বেলুচ অবশ্য অতখানি ওয়াকিফহাল নয়। সে কাহিনী দীর্ঘ। বারান্তরে।
.
সেকাল একাল
ছেলেটা ডান হাত পেতে দিচ্ছে আর তার উপর পড়ছে সপাং করে লম্বা লিকলিকে কাঁটাওলা চাবুকের বাড়ি। অস্ফুট কণ্ঠে সে বলছে, বরায়ে খুদা আর এগিয়ে দিচ্ছে বা হাত। ফের চাবুকের ঘা। এবারে ছেলেটা বললে বরায়ে রসুল, এগিয়ে দিচ্ছে ডান হাত। করে করে চলত স্কুলবয়কে চাবুক মারা খাস কাবুল শহরে– একদা। ছেলেটা তসবি জপার মতো একবার বলে বরায়ে খুদা। পরের বার বলে বরায়ে রসুল বরায়ে খুদা বয়ে রসুল বরায়ে। অর্থাৎ আল্লার ওয়াস্তে (মাফ করে দিন) রসুলের ওয়াস্তে (মাফ করে দিন)। কিন্তু আমাদের মতো আর করব না, পণ্ডিতমশাই কিংবা কসম খাচ্ছি মৌলবি সাহেব, আমি তামাক খাইনি। আমি ঘুমুচ্ছিলাম, কে জানিনে হুজুর আমার হাত দিয়ে তামাক খেয়ে গিয়েছে এসব চেল্লাচেল্লি, বেকসুরির ফরিয়াদ, রেহাই পাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় আমাদের মতে, আমাদের বাপ-দাদার মতো কাবুলি ছাত্র করে না। আমাদের বেকসুরির ফরিয়াদ আমরা করেছি আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ছেলেবেলায়। কাবুলের স্কুলবয় তিফল-ই-মকতব করে তার ঐতিহ্যানুযায়ী। বরায়ে খুদা, বরায়ে রসুল ভিন্ন অন্য রা-টি কেড়েছ কি মরেছ। বেতের রেশন আরও দশ ঘা বেড়ে যাবে তৎক্ষণাতের দুলহমা আগেই–আজ ফৌরন দো লহমা পেশতার। কিন্তু হায়, ইতোমধ্যে ব্যাকরণে ভুল করে ফেলেছি, ধরতে পারেননি তো? তাইতেই তো আগা-ই-আগা সম্পাদক-চক্রের চক্রবর্তী আমার বেশুমার ভুলে ভর্তি লেখা বেদম ছাপিয়ে দিয়ে আমাকে নাচান, আপনাদেরও নাচান। বলুন, বুকে হাত রেখে বলুন, আপনারা কজন সম্পাদক সাবের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমার অগুনতি গলৎ দেখিয়ে খাট্টা জবানে শাসিয়েছেন, আমার ধারাবাহিকের ধারা বন্ধ করতে? তা সে যাক গে। না করে ভালোই করেছেন।… হ্যাঁ, ভুলটা কী করলুম, সেই কথাই হচ্ছিল। বলে ফেলেছি রেশন বেড়ে যাবে। তা কখনও হয়? কি হিন্দুস্থান, কি পাকিস্তান, কি এই সোনার বাংলা কবে মশাই, কোন মুল্লুকে রেশন বাড়ে? রেশন কমতে দেখেছি, বাড়তে দেখেছে কে, কবে কোন রাঙ্গা শুক্কুরবারে, কোন হীরের বাংলায় সে তা হলে সাপের ঠ্যাং দেখেছে, অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র দেখেছে।
.
বাস্তিনাদো
কিন্তু এ ধরনের বেত্রাঘাত কাবুলে ডাল-ভাত। দেখতেই যদি হয়, তবে দেখে নেবেন, বাস্তিনাদো। আমি কখনও দেখিনি, তবে হতভাগার গোংরানোটা শুনেছি, অতি অনিচ্ছায়।
আমাদের হোস্টেলে একজন আরেকজনের তলপেটের এক পাশে মাঝারি সাইজের একটা ছোরা ফাঁসিয়ে দেয়। প্রিন্সিপাল গয়রহ কোয়ার্টারে ছিলেন না। আমাকেই যেতে হল। যতদূর মনে পড়ছে, চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই হয়নি। বাগানে গাছতলায় ছেলেটাকে শুইয়ে রেখে তাকে ঘিরে রয়েছে কয়েকজন। তার মুখ হুবহু পচা মাছের পেটের মতো ঘিনঘিনে পাঙ্গাশ। একটা ছেলে কামিজ তুলে দেখল পেটপিঠ পেঁচিয়ে লালে লাল চওড়া ব্যান্ডেজ, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতুম না, কী জঘন্য নোংরা কাপড় ছিঁড়ে পট্টি বাধা হয়েছে। আরেকটা ছেলে বললে, নাড়িভুড়ি হড়হড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে আর তার দোস্ত দু জনাতে চেপেচুপে কোনও-গতিকে ঢুকিয়ে দিয়ে পট্টি বেঁধেছে–বুঝলুম, এক গাদা মাল যেরকম ছোট সুটকেসে যেখানে যা খুশি ঢুকিয়ে ডালার উপর দাঁড়িয়ে একজন লাফায়, অন্যজন কজা বন্ধ করার চেষ্টা দেয়, তারই অনুকরণে কর্মটি সম্পন্ন করা হয়েছে। পট্টির উপর-নিচ দিয়ে ক্রমাগত রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরুচ্ছে। আততায়ীকে একটা গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে।
ছেলেটা ভিরমি যায়নি, তবুও। বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। ভাবলুম, ভুল বকছে। না, একটা ছেলে বললে, আমাকে সে কী যেন বলতে চায়, আমি যেন কাছে গিয়ে কান পেতে শুনি। কাছে যেতে আধ-মরা গলায় বললে, আমি যেন তার সব অপরাধ মাফ করে দিই। আমি বললুম, তুমি আবার কী অপরাধ করলে? সেরে ওঠো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেটা আহ বলে চোখ বন্ধ করল।
এর পরের কাহিনী দীর্ঘ। উপস্থিত সুখবরটা জানাই। দেড় মাস পর সে হাসপাতাল ছেড়ে ফের ক্লাসে ফিরে এল। কিন্তু এহ বাহ্য।
আমাদের ফরাসি অধ্যক্ষটি ছিলেন চৌকস লোক, পুলিশকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিদায় দিয়ে, দফতরের কাবুলি হেড ক্লার্ক, খাজাঞ্চি, অনুবাদককে বললেন এ-দেশের প্রথানুযায়ী বিচার করে আততায়ীকে যেন সাজা দেওয়া হয়।
তারা স্থির করলেন পূর্ব কথিত বাস্তিনাদো। আমার কিন্তু শোনা কথা। ছেলেটাকে মাটিতে বুক রেখে টান টান করে শোয়ানো হল। হাতদুটো সামনের দিকে প্রসারিত। দু হাতের উপর মাটির সঙ্গে জোরসে চেপে ধরে দাঁড়াল মিলিটারি বুট পড়া দুই চাপরাসি, দু পায়ের গোছা সবুট চেপে দাঁড়াল আরও দু জন চাপরাসি। আরও জনা চারেক বুট দিয়ে পিঠ-কাঁধ সর্বাঙ্গ চেপে ধরে দাঁড়াল চতুর্দিকে। তার পর পায়ের তলাতে জানিনে কী ধরনের চাবুক দিয়ে বেতের পর বেতের বেদম গুনে গুনে মার। বার দশের পর পায়ের তলা দুটোতে আর এক রত্তি চামড়া অবশিষ্ট রইল না। লাল লাল ক্ষতবিক্ষত জখমের উপর আরও কত ঘা মারা হয়েছিল সেটা আমি আর শুনতে চাইনি।… দিন দশেক পরে একদিন দেখি, কুষ্ঠরোগীর মতো পট্টি দিয়ে পা দুটো সর্বাঙ্গে মোড়া অবস্থায় দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে পা দুটো মাটি ছোঁয়-কি-না-হোয় অবস্থায় প্রাতকৃত্য সারতে যাচ্ছে। মাস দুই পরে ফের ক্লাসে এল।
আর সব সহপাঠীরা মন্তব্য করেছিল, ছেলেটার দারুণ বরাত-জোর। বিদেশি অধ্যক্ষ মধ্যস্থ না হলে, নির্ঘাত জেলে পাথর ভাঙতে হত নিদেন পাঁচটি বৎসর। অন্য অত্যাচারের কথাটা সবাই জানত আসলে যে কারণে অধ্যক্ষ মধ্যস্থ হয়েছিলেন। জেলের সম-রতি-প্রবণ গার্ড-সেপাইদের হাত থেকে ছোকরার নিস্তার থাকত না।… এতদিনে এ সব পাশবিক দণ্ডদান মকুব হয়ে যাওয়ারই কথা।
.
রণাঙ্গনে নব-নায়ক ছাত্রসমাজ
আফগানিস্তানে যুগ-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খুব যে একটা আদ্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে এমত বিশ্বাস করার কারণ নেই। তবে একটা সত্য স্বীকার করতেই হবে। প্রাচ্যপ্রতীচ্যের আর-পাঁচটা দেশের মতো দু তিনটে নগরে, বিশেষ করে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা এদানি নানা বিষয়ে সচেতন হয়ে গিয়েছে। এটা অতিশয় স্বাভাবিক যুগধর্ম। বছরের পর বছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, নানা পাঠ্যপুস্তক মারফত বিশ্বসংবাদ পড়ানো হবে, আর ছাত্রেরা সেই প্রাচীন সর্বাধিকারী রাজশক্তি তখনও মেনে নেবে তা রাজা যতই মেহেরবান হন না কেন– ফল ভালো হোক, মন্দ হোক সে-বিদ্যা প্রয়োগ করার প্রলোভন তার অতি অবশ্যই হবে। যেমন, দশ-বিশ বছর ধরে সেপাই-অফিসারকে কুচকাওয়াজ, সমরবিদ্যা শেখানো হবে, আর তারা জলজ্যান্ত লড়াইয়ে নেমে সেটা কখনও কাজে লাগিয়ে পরখ করে দেখতে চাইবে, এটা নিতান্তই দুরাশা মাত্র। এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহ জহির যে যৌবনের সাম্য ঐক্য স্বাধীনতার কথা ভুলে গিয়ে রাজশক্তিকে দৃঢ়তর এবং ব্যাপকতর করতে চেয়েছিলেন সেটা ন্যায়সঙ্গত না হলেও স্বাভাবিক, এমনকি আংশিক গণতন্ত্রমূলক সংবিধান মঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পলিটিকসে একটা রাজার দল কিংস পার্টি স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন, হুবহু যে-কাজটি সিংহাসন ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ডুক অব উইনজর করতে রাজি হননি। পক্ষান্তরে ছাত্ররাও সেকুলার শিক্ষার ফলস্বরূপ এবং মক্তবের ভিতরে-বাইরে মোল্লাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার দরুন রাজনীতিতে ঢলে পড়ল পেন্ডুলামের অন্য প্রান্তে : বাইরের থেকে সাহায্য পেয়ে তারা হয়ে দাঁড়াল মার্কস, মাও এবং এককাট্টা চরমপন্থিতে। তারই ফলে ১৯৬৯ সালে তাদের বিক্ষোভ, দাবি, স্ট্রাইক গোটা আন্দোলনটা সর্বাংশে রাজনৈতিক ছিল না, ছাত্রসমাজের নিছক সুখ-সুবিধা কল্যাণকল্পে একাধিক স্ট্রাইকের আয়োজনও হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে ভীষণ সংঘর্ষে আন্দোলন এমনই মারাত্মক আকার ধারণ করল যে, কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে ছয় মাস কাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হল।
এর ফলে কিন্তু একটা তত্ত্ব জনসাধারণ, বিশেষ করে মোল্লাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল : সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রধান শক্তিমান ছাত্ররাই। পক্ষান্তরে এ কথাও সত্য যে, জনপদ অঞ্চলে কওমদের ভিতর যেমন অশিক্ষিতের সংখ্যা অধিকতর ঠিক তারই সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে তাদের ধর্মোন্মাদনা মারাত্মক এবং সর্ব প্রগতিশীল সংস্কার তারা ঘৃণা করে।
তৎসত্ত্বেও ছাত্রসমাজ তাদের মাও-মার্কস আন্দোলন আরও জোরদার করে তুলতে লাগল এবং তার বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল ১৯৭০-এ। লেনিনের বাৎসরিক জন্মদিনে একখানি ক্যুনিস্ট পত্রিকা তাঁর স্মরণে রচিত একটি কবিতাতে এমনসব প্রশস্তিসূচক হামদ ও নাৎ দোওয়াদরুদের শব্দ ব্যবহার করল, যেগুলো সচরাচর আল্লা-রসুলের স্মরণেই উচ্চারিত হয়।
তীব্র প্রতিবাদ, বিস্তীর্ণ জনপদব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলন আরম্ভ করলেন মোল্লারা। যেসব কওম তাদের সহায়তা করল তাদের সংখ্যাও নগণ্য নয়। এবং সেই কুখ্যাত শিনওয়ারি কওম, যারা সর্বপ্রথম বাদশাহ আমানউল্লাহর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে, এবারেও তারা এমনই খাণ্ডারের মতো রুদ্ররূপ ধারণ করল যে অবশেষে ট্যাংকসহ শাহি ফৌজ তাদের আক্রমণ করে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনল।
লেনিনের প্রতি এইসব উচ্ছ্বসময়ী প্রশস্তি এবং মোন্না সম্প্রদায়ের প্রবল প্রতিক্রিয়ার শেষ ফল এই দাঁড়াল যে, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম সম্বন্ধীয় একটা নতুন শাখা প্রবর্তন করা হল। এ-শাখার চালকগণ অহরহ সজাগ দৃষ্টি রাখেন, ইসলামের স্বার্থ রক্ষার্থে অর্থাৎ সাধারণ ছাত্রসমাজের সামান্যতম মতবাদ, কার্যকলাপ তাদের মনঃপূত না হলে কুফর বিদাৎ হুঙ্কাররবসহ তীব্র প্রতিবাদ তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করেন।
দাউদ খান নাকি প্রথম দিন থেকেই ছাত্রসমাজের সমর্থন পেয়েছেন। তা হলে স্বতই স্বীকার করতে হয়, ছাত্রলবৈরী মোল্লা সম্প্রদায় তারও বৈরী। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দাউদ মোল্লাদের এক বৃহৎ অংশের স্বীকৃতি পেয়েছেন। দাউদ দিবান্ধ নন। তিনি জানেন, মোল্লা ও তাদের চেলা কওমরা ছাত্রদের চেয়ে সংখ্যায় ঢের বেশি।
ছাত্ররূপ একটা ঝুড়িতে দাউদ তার কুল্লে আণ্ডা রেখে আরব্যরজনীর অননশশারের খোওয়াব দেখবেন না।
.
নামে কী করে!
গোলাপে যে নামে ডাকো, গন্ধ বিতরে
এক নিক্সন-বৈরী মার্কিনই হতাশ সুরে বলছিল, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ভালো করে বুঝতে হলে সক্কলের পয়লা এক ঝুড়ি নাম সড়গড় মুখস্ত করতে হয়। কটা লোকের সে সময়, সে উৎসাই আছে। তার পর মুখস্থ করতে হবে তাদের পূর্বকীর্তি কেরামতির ইতিহাস। কে রিপাবলিকান, কে ডেমোক্রেট; কে রিপাবলিকান বটে কিন্তু ওয়াটারগেটের কেলেঙ্কারির ঘেন্নাতে হয়ে গেছেন রিপাবলিকান দলের চাই নিক্সন-বিরোধী, কারা পয়লা নম্বরি রিপাবলিকান এবং নিক্সনের অকারণ মেহেরবানিতে কন্ট্রাক্ট-পারমিট গয়রহ পেয়ে তার প্রতি এখনও নেমক-হালাল, বিপদে পড়ে নিক্সন কাকে কাকে জল্লাদের হাতে না-হক সঁপে দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি দফে দফে নাম-কাম মুখস্থ করতে পারেন– খুদ মার্কিন-ইয়াংকি পাঠকই কজন? তবু যারা টিভিতে ওয়াটারগেট তদন্তের জলসা আণ্ডাবাচ্চাসহ গুষ্টিসুখ অনুভব করতে করতে নিত্যি নিত্যি দেখেছেন তাদের পক্ষে মামলাটার গভীরে ঢোকা খানিকটে সহজ হয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যে এত-সব বায়নাক্কা-আবদার বরদাস্ত করে আপন বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে শেষ রায় দিতে পারেন কজন স্পেশালিস্ট?
আমি সায় দিয়ে বললুম, আমরা বরঞ্চ ব্রিটিশের তরো-বেতরো নামের কিছুটা হদিস পাই, কিন্তু তোমাদের মার্কিন জাতটা ইংরেজ, জর্মন, ডাচ, ফরাসি, আরও কত বেশুমার জাত-উপজাত দিয়ে গড়া আস্ত একটা জগাখিচুড়ির লাবড়া-ঘাট। ওই ধরো মামলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী-আলিঙ্গনে বিজড়িত, নিক্সনের ঘরোয়া, হোয়াইট হাউসের চাই চাই সচিব, কর্মকর্তাদের ইসমে মোবারকের ফিরিস্তি : সক্কলের পয়লা যে দুই মহাপ্রভু এ-ফিরিস্তি ধন্য করেন, তাঁদের নাম খাঁটি জর্মন এরলিষমান, হালডেমান। অবশ্যই সাদামাটা মার্কিন নাগরিক কুল্লে ভিনজাতের নাম উচ্চারণ করে মাতৃভাষা ইংরেজি কায়দায়। এই সোনার বাংলাতেই উন্নাসিক পণ্ডিতমশাই মুকুলেশ্বর রহমান লেখেন মুখলেসুর রহমান-এর পরিবর্তে। তার পর ধরুন, রুমসফেট, ক্লাইন, কের্লি, গিলার এগুলো নিঃসন্দেহে জর্মন নাম। ফরাসি নাম অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু জাতে ভারী। খুদ ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম অ্যাগনো ফরাসি উচ্চারণ আইন্নো। এনার বিরুদ্ধেও ফৌজদারি তদন্ত চলছে, নানাবিধ নজরানা নিয়ে। এবং হাসি পায়, যখন আইন্নোর মূল অর্থ স্মরণে আসে। প্রথম অর্থ মেষশাবক, পরের অর্থ সাধু-সরল-পবিত্র! হুবহু ওই অর্থ ধরেন এরলিষমান। এ-নামের সরল অর্থ সরল! সাধু, অনারেবল! অধিকাংশ ঘড়েল জনের বিশ্বাস, ইনি ওয়াটারগেট তদন্ত কমিশনে যে সাক্ষ্য দেন তার চোদ্দ আনা ঝুট। ওই সময় জর্মনিবাসী এক জর্মন, সুদূর স্বদেশ থেকে, বিখ্যাত এক মার্কিন সাপ্তাহিকে এরলিমানের সরলার্থের প্রতি সাদা-মাটা মার্কিন নাগরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের তরে ব্যঙ্গ-রসের খোরাক যোগান।
কিন্তু এহ বাহ্য।
.
প্রেসিডেন্ট; না দেশের মঙ্গল?
ভুট্টো সাহেবের যে রকম আজিজ, হিটলারের বরমান, হুবহু ঠিক তেমনি মি. নিশ্বনের মহামান্য মি. হেনরি এ কিসিংগার। আমি জানি, একমাত্র খাস জর্মন ভিন্ন তামাম দুনিয়া উচ্চারণ করে কিসিঞ্জার। এস্তেক বিবিসি। পাঠক একটু ধৈর্য ধরুন, পরে তাবৎ গুহ্য তথ্যতত্ত্ব স্বপ্রকাশ হয়ে যাবে। এস্থলে বলা প্রয়োজনীয় যে আজিজ বরমান কিসিংগার চরিত্রে অতি অবশ্যই তফাৎ আছে; মি. ভুট্টোর দোষগুণ যাই থাক, তিনি কখনও আজিজের ম্যাড়া বনবেন না। বাকিদের কথা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু এস্থলে সাতিশয় প্রয়োজনীয়, পাঠক যেন এই কিসিংগার প্রভুর প্রতি একটু নজর রাখেন। কিন্তু এর প্রেম বাংলাদেশ কখনওই পাবে না। কারণ ইনি ধর্মে, কর্মে সর্ববিষয়ে কট্টর ইহুদি। ইহুদিজনসুলভ তার বিরাট নাসাযন্ত্র, তথা ঘন-কুঞ্চিত প্রায় নিগ্রোসম কেশ যেন পাঠক তার ফটোতে লক্ষ করেন। বিস্তর নৃতত্ত্ববিদের অভিমত, ফেরাউনের দাসত্বকালে মিসরস্থ নিগ্রোদের সঙ্গে সংমিশ্রণের ফলে ইহুদিদের মস্তকে এই কুঞ্চিত কেশের উদ্ভব।… স্বভাবতই ইহুদি কিসিংগার তথাকথিত ইজরায়েলকে জানপ্রাণ দিয়ে মহব্বৎ করেন; পক্ষান্তরে আমরা ফলস্তিনের গৃহহারা আরবদের মঙ্গল কামনা করি। তারা যেন একদিন স্বদেশে সসম্মানে ফিরে যেতে পারে আমরা সেই প্রার্থনা করি– শরণার্থী হয়ে ভিন দেশে বাস করার পীড়া আমরা জানিনে, তো জানেন নিক্সন? তিন দিন আগে তিনি এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, আরব-ইজরায়েলের মোকাবেলায় আমি নিরপেক্ষ (পাঠক বিশ্বাস করতে চান, তো করুন, সেটা আপনার মর্জি)। আমি চাই শান্তি। পাঠক লক্ষ করবেন, আমি চাই বিচার, আমি চাই জাস্টিস, ইনসাফ- এ কথা হুজুর বলেননি, কস্মিনকালেও তার মুখ থেকে শুনিনি। কিন্তু শান্তি তো অতি সহজেই হয়। মিশর, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়াকে অন্তত একশো বছরের তরে শান্ত করার জন্য যথেষ্ট এটম বোম নিক্সনের ভাণ্ডারে আছে। শান্তিভঙ্গ তো এই পাষণ্ডরাই করছে। ইজরায়েল তো শব্দার্থে নিষ্পাপ এরলিষমান অ্যাগনোর মতো! নিক্সন তো এই মতই পোষণ করেন। তার পিছনের ছায়াটি– কিসিংগার তিনি তো টুইয়ে দেবার তাতিয়ে দেবার তরে আছেনই। তবে কি না, সে শান্তিটা হবে গোরস্তানের শান্তি।
এই সুবাদে আরেকটি তত্ত্ব-কথার উল্লেখ করি। কিছুদিন পূর্বে আমি চিন্তাশীল পাঠককে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলুম, তাঁরা যেন নিক্সনের চেলা ইরানের বাদশাহর প্রতি একটু নজর রাখেন। উপস্থিত সে-নজরটাকে কিছুদিনের জন্য ছুটি দিতে পারেন। কারণ শাহ ইতোমধ্যে বিকল-ইঞ্জিনওয়ালা নিক্সন-জাহাজটি ত্যাগ করে আরেকটা উত্তম জাহাজে চড়েছেন। তিনি দেখলেন নিক্সনের ইঞ্জিন বিকল করে দিয়েছে ওয়াটারগেটের বেনোপানি হড়হড়িয়ে তার সর্বাঙ্গে প্রবেশ করে। ওদিকে সরদার দাউদ গদিতে বসতে না বসতেই রুশ তাঁকে ঈদের (আনন্দের) আলিঙ্গন জানিয়েছে। এদিকে শুধু ওয়াটারগেট না, কুচক্রীরা নিক্সন আধা-আইনি বে-আইনিভাবে তাঁর প্রাইভেট বাড়িদুটো কতখানি সরকারি পয়সায় খাড়া করেছেন সেটা ক্রমশ উপন্যাসের মতো প্রকাশ করছে। এবং কিছু কিছু অনুসন্ধান আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, ভিয়েতনাম গয়রহ ছাড়াও তিনি কারণে-অকারণে পরিপূর্ণ শান্তিময় দেশেও গোপনে টাকা, অস্ত্রশস্ত্র ঢেলেছেন কী পরিমাণ? শাহ স্পষ্ট দেখতে পেলেন, শ্রদ্ধ আখেরে যতদূরই গড়ক, না-গড়াক– প্রভু নিক্সন দুম করে আর কোম্পানির মাল বেশ কিছুকাল ধরে ইরানের দরিয়াতে ঢালবার হিম্মৎ পাবেন না। অর্থাৎ কি না, কিসিংগার মুনিব নিক্সনকে সে পরামিশ দেবেন না। মার্কিনিরা বলছে, দেশের স্বার্থের তরে তুমি যত চাও টাকা ঢালো, কিন্তু আপন প্রভুত্ব বাড়াবার জন্য না।
ইতোমধ্যে আরেকটা কাণ্ড ঘটল। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, নিক্সনের দ্বিতীয় ইলেকশনের সুপ্রিম কর্ণধার মি. মিচেলকে বাধ্য হয়ে সাক্ষ্য দিতে হয় ওয়াটারগেট তদন্তে। এক সিনেটর কিংবা ফরিয়াদি উকিল প্রশ্ন করেন, তা হলে বলুন, আপনি দেশের স্বার্থকে নিক্সনের স্বার্থের চেয়ে বড় করে দেখেন কি না? উত্তরে তিনি সগর্বে বলেন, নিক্সনের প্রেসিডেন্টরূপে জয়লাভকে আমি বৃহত্তর বলে মনে করি। (!!) এই পরশু-দিন তক বিবিসির বিশ্বালোচনার সদস্যগণ এই বিকট নীতির উল্লেখ করে বেকুবের মতো বার বার তাজ্জব মেনেছেন। অতএব যদিস্যাৎ সকল পথচারী মার্কিন প্রশ্ন শুধোয়, হুজুর তা হলে ইরানে এবং ১৯৭১-এ ইরানের মারফত (তকালীন) পশ্চিম পাকিস্তানে যে টাকা বন্দুক কামানটা ঢাললেন সেটা কি আপন লেজ মোটা করার জন্যে, না মার্কিন মুল্লুকের স্বার্থে?– এ-প্রশ্নটা তো ছিদ্রান্বেষীর না-হক প্রশ্ন নয়। অতএব শাহও তড়িঘড়ি তার। প্রধানমন্ত্রীকে পাঠালেন মস্কোবাগে– দাউদের গদি দখলের তিন সপ্তাহ যেতে না যেতে। খুদায় মালুম, দফে দফে কত দফেই না নয়া জাহাজে চড়ে প্রধানমন্ত্রী করার-দাদ করার-নামা সই করলেন। শাহ ওদিকে পিণ্ডিকে পরামর্শ দিলেন, উপস্থিত জো-সো প্রকারের একটা সমঝোতা ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের সঙ্গে করে নাও। আমাদের রাশি এখন বেহদ বদ-বখৎ কম-বখৎ! আর পারো যদি, ঝটপট রুশ-কিশুতিতে সওয়ার হও– না হয়, গলুইটাতেই দু দিকে পা ঝুলিয়ে খোওয়াব দেখ, ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল হকিয়া নয়, হাঁটিয়া। কিন্তু পিণ্ডি যে চীনা-কানুর সঙ্গে বড় বেশি পীরিতির লেটপেট করে বসে আছেন! এখন শ্যাম না কুল? তবে– আজিজ যার নাম, রুশের সঙ্গে আজিজি করতে কতক্ষণ! কুল্লে দুনিয়া তাঁর খেশ-কুটুম –বসুধৈব কুটুম্বকং–বলেছেন স্বয়ং চাণক্য! তবে কি না চন্দ্রাবতী কুঞ্জে যেতে হবে চীনা বঁধুয়ার আঙ্গিনা দিয়া।
.
সংক্ষিপ্ত কিসিংগার কাহিনী
বিশেষ করে বাংলাদেশের লোকের স্মরণে থাকার কথা শ্রীযুক্ত কিসিংগারের (ডাকনাম কি?) মূর্তিটি। ইনি খাঁটি ইহুদি। জন্ম জর্মনির ফুর্ট শহরে। নাৎসিরা তাঁর কোনও ক্ষয়ক্ষতি করার পূর্বেই পিতা-মাতা তাঁর পনেরো বছর বয়সে তাকে নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। কী করে তিনি শেষটায় নিক্সনের একমাত্র উপদেষ্টার আসন পেলেন সে কাহিনী দীর্ঘ, অতএব বারান্তরে।… ৭১ ডিসেম্বরের যুদ্ধ লাগার আগে এবং পরে এবং এখনও (যদিও ঠিক এখুনি বড়ই বেকায়দায়) ইনি পাকিস্তানের মিলিটারি জুন্টাকে যে কোনও উপায়েই থোক, খোদার খাসির মতো পোস্টাই খোরাক দিয়ে দিয়ে তাগড়া করে রাখতে চান। কেন? এইটে তার সর্ববিশ্ব সম্বন্ধে যে পূর্ণাঙ্গ দর্শন তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ– ইরান-আফগান পাক-ভারত-বাংলাদেশ নিয়ে তার বড় একটা অধ্যায়। নিক্সনকে তিনি এই মন্ত্রে দীক্ষিত করেন ধীরে ধীরে। সে-কাহিনীও দীর্ঘ, আলোচনা বারান্তরে। এই দর্শনানুযায়ী ন মাস ধরে নিক্সন বাইরে নিরপেক্ষতার ভড়ং করতেন– যদিও সেটা এতই ঠুনকো ছিল যে, সামান্য ঠোনা মারতেই চৌচির হয়েছে একাধিকবার। অন্দরমহলে কিসিংগারের নেতৃত্ব আখেরি ত্রাহি ত্রাহি যে গোপনস্য গোপন সভা ৩, ৪, ৫, ৬, ৮ ডিসেম্বরে ৭১-এ হয়েছিল, সেগুলোর চিচিং ফাঁক করে দেন প্রাতঃস্মরণীয় প্রখ্যাত কলাম-লেখক জ্যাক এন্ডারসন মার্কিন সংবাদপত্রে, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। কী নিদারুণ বেহায়া ভণ্ডামি চালিয়েছিলেন মুনিব-চাকর দু জনাতে। হন্যে হয়ে কিসিংগার সব্বাইকে শুধোচ্ছেন, কী কৌশলে গোপনে পাক-সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা যায়? বিশেষজ্ঞরা মাথা নেড়ে বলছেন, ইরান, তুর্কির মারফত ও হয় না। (পাঠানো হয়েছিল, আমরা জানি– লেখক)। শেষটায় কিসিংগার অতিষ্ঠ হয়ে বলছেন, আমরা একটা স্টেটমেন্ট দেব বই কি। আমরা, এই যেন অনেকটা সাধারণভাবে (ইন জেনরেল টার্মস অর্থাৎ ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের বলব, পুব-পাকে একটা পলিটিকাল গুনজাইশ একোমডেশন–অর্থাৎ সন্ধি না, চুক্তি না, (ছয় পয়েন্ট মাথায় থাকুন। লেখক) করে নেওয়ার পক্ষপাতী আমরা। কিন্তু কোনও ধরা-বাঁধার মতো (স্পেসিফিকস) অবশ্যই কিছু বলব না, ইঙ্গিতও দেব না– যেমন ধরো মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার মত। এটা অন্দরমহলে।
বৈঠকখানায় নিক্সনের পরিত্রাহি চিৎকার অস্ত্র সম্বরণ করো, অস্ত্র সম্বরণ করো।
ধন্য, সেই সিলেটি কবি, যিনি নিচের অমূল্য সুভাষিতটি রচেছিলেন। আমি শুধু হতীন মা-র (সত্য-র) বদলে কিসিংগার ব্যবহার করেছি :
কিসিংগারের কথাগুলিন
মধু-রসর বাণী
তলা দিয়া গুড়ি কাটইন
উপরে ঢালইন পানী ॥
.
ছায়ার কায়ারূপ
বহু দিন ধরে হের হাইনরিষ এ. কিসিংগার কলকাঠি নেড়েছেন। কোনও রকমের সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ না করে মি. নিক্সনের হয়ে ভিয়েতনাম বাবদ আলোচনা সভায় নেতৃত্ব করেছেন, বার বার। কূটনৈতিক অসুস্থতায় তিনি ভুগেছেন অর্থাৎ যেখানে কোনও অসুস্থতা প্রকৃতপক্ষে নেই, অথচ ডিপ্লোমেটকে যে কোনও কারণেই হোক কিছুদিন গা-ঢাকা দিতে হবে, তখন তিনি যে ব্যানোর ভান বা ভণ্ডামি করেন সেটাকে বছর পঞ্চাশ ধরে ডিপ্লোমেটিক ইলনেস বলা হয়। ছেলেবেলায় আমরা অনেকেই ক্লাসিক ইলনেসে ভুগেছি, অর্থাৎ ক্লাসে না যাবার জন্য পেট-কামড়ানো, দাস্ত ইত্যাদির শরণ নিয়েছি এবং দ্বিতীয়টার উভয়ার্থে বাহ্যিক প্রমাণস্বরূপ বদনা-হস্তে ঘন ঘন, কখনও-বা দ্রুতপদে, কখনও কাত্রাতে কাত্রাতে, বিশেষস্থলে গমনাগমন করেছি। হের কিসিংগার কূটনৈতিক অসুস্থতায় অকস্মাৎ ইসলামাবাদে কাতর হয়ে মারী পাহাড়ে যান, এবং তার পর তেমনি অকস্মাৎ উদয় হলেন চীন দেশে, যেন ডুব-সাঁতার কেটে, বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে হুশ করে কোঁকড়ানো চুলসুদ্ধ মাথা তুলে বিশ্বজনের বিস্ময় লাগালেন। দুনিয়ার লোক তাকে চিনে ফেলার পরও তিনি যতদূর সম্ভব পর্দার আড়ালে থাকাটা দানিশমন্দের সর্বোত্তম সিফৎ বলে মনে করেন। এ কর্মে তার গুরু বরমান– হিটলারের ছায়া। ইহুদিজ কিসিংগার নাৎসি-বৈরী জর্মনরূপে জন্ম নিয়েছিলেন ফুর্ট শহরে। কুখ্যাত রনবের্গ শহরের গা-ঘেঁষে এ শহর। নাৎসিবৈরী কিসিংগার পাড় নাৎসি বরমানের ঠিক উল্টোটা করবেন এই তো আমরা প্রত্যাশা করব, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয় না। ইংরেজ ফৌজি আপিসাররা নেটিভ পাঞ্জাবি আপিসারদের ওপর যে চোটপাট করত, তাই নিয়ে পাঞ্জাবিদের মনস্তাপের অন্ত ছিল না– যদিও তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ তারা বড় একটা করত না। তার কারণ অন্যত্র সবিস্তার বলেছি, পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। আবার এই পাঞ্জাবিরাই যখন একদিন ব্রিটিশ-রাহুমুক্ত হল তখন তারা এদেশে যা করল সে তো ব্রিটিশকে সব দিক দিয়ে লজ্জা দিতে পারে।
আমার মনে তাই নিত্য একটা আশঙ্কা জেগে আছে, পাঞ্জাবি ফৌজ এবং তাদের চেলা-চামুণ্ডারা যেসব নিষ্ঠুরতা এ দেশে করেছে আমরা যেন তারই পুনরাবৃত্তি করে না বসি। আমাদের মধ্যে যাদের চিত্ত দুর্বল, যারা একমাত্র অনুকরণ ছাড়া স্বাধীনভাবে চিন্তা করে আপন কর্মপন্থা বেছে নিতে পারে না, তাদের কিছু লোক কিছুটা নিষ্ঠুরতা করবেই, কিন্তু আল্লার কাছে বার বার করুণ আবেদন জানাই, ওটা যেন আমাদের রক্তমাংসে প্রবেশ না করতে পারে, আমাদের ঈমান যেন আচ্ছন্ন না করে তোলে। এইটেই আমার এ জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি ডরিয়েছি। অকারণে নয়। যুগে যুগে গুণীজ্ঞানীরা সাবধানবাণী শুনিয়েছেন, পাপাচার নির্মূল করো, কিন্তু সে পাপের কালিমা যেন তোমার গাত্র স্পর্শ না করতে পারে। তার চেয়ে পাপাচারীর হাতে শহিদ হওয়া ঢের ঢের ভালো।… আমি জানি, এ প্রস্তাবনাটি এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর না হলেও এতখানি সবিস্তর বলাটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু যে ভয় আমাকে আজীবন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি শঙ্কাতুর করে রেখেছে সেটা এ-জীবনে অন্তত একবার সংক্ষেপে উল্লেখ না করে থাকতে পারলুম না। বহু পরিবর্তনের ভিতর দিয়েও যুগ-যুগ ধাবিত নিষ্ঠুরতা অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে এই তো সর্বনাশ!
কিসিংগার দেশত্যাগী হন পনেরো বৎসর বয়সে। নাৎসিরা ক্ষমতা লাভের প্রায় চার বৎসর আগের থেকে, দেশময় না হলেও ফুর্ট-রনবের্গ অঞ্চলে যে নিষ্ঠুরতা দিয়ে জনগণের বিশেষ করে ইহুদিদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে, তার লক্ষণ যেন আমি কিসিংগারের কার্যকলাপে মাঝে মাঝে দেখতে পাই। খাঁটি নিষ্ঠুরতাটার কথা হচ্ছে না। মানুষ যে নিষ্ঠুর হয় সেটা সর্বাগ্রে বোঝাবার জন্য যে তার শক্তি অসীম, তোমার একমাত্র কাজ তার বশ্যতা স্বীকার করা। কবির ভাষায়–
পালোয়ানের চেলারা সব
ওঠে সেদিন খেপে,
ফেঁসে সর্প– হিংসা-দর্প
সকল পৃথ্বী ব্যেপে,
বীভৎস তার ক্ষুধার জ্বালায়
জাগে দানব ভায়া
গর্জি বলে আমিই সত্য,
দেবতা মিথ্যা মায়া।
ব্রাউন-শার্ট, এস এস, হিমলার হিটলারের গর্জন– তারাই সত্য। তাদের পশুবলেই সত্য শেষটায় একদিন লোপ পেল। কিন্তু হায়, এখনও আজও তাদের দর্প দম্ভ শুনতে পাই বহু জর্মন পলিটিশিয়ানের জলজ্যান্ত কণ্ঠে, কন্টিনেন্ট, মার্কিন মুল্লুকে। হ্যাঁ, দেশকালপাত্রভেদে অবশ্যই কখনও নিররূপে, কখনও-বা ১ দু কণ্ঠে সে স্বৈরতন্ত্র– ডিটেটরি– আত্মপ্রকাশ করে। তার কুরতম নীতিধর্মহীন স্বপ্রকাশ ইজরায়েলের গোড়াপত্তনের দিন থেকে। এই ইহুদিরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিল হিটলারের হাতে। হিটলার অবশেষে আইন পাস করলেন ইহুদিদের কোনও রাষ্ট্রাধিকার নেই, জর্মনি তাদের মাতৃভূমি নয়। এবং সবচেয়ে বড় বিস্ময়, রূঢ়তম ট্র্যাজেডি– এইসব বাস্তুহারা ইহুদিরাই ফলস্তিনে গিয়ে লেগে গেলে সঙ্গিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নর-নারী, আবাল-বৃদ্ধ-শিশুকে আরবদের আপন মাতৃভূমি থেকে বাস্তুহারা করতে। কিসিংগার পরিবার বাস্তুহারা হয়ে পেয়ে গেলেন, বিপুলতর রাষ্ট্র আমেরিকা যেন বিশ্বভুবন দু বিঘার পরিবর্তে।
ভিন দেশে আশ্রয় নেওয়ার পর কট্টর আত্মাভিমানী জন তার ঐতিহ্যগত আচার-ব্যবহার জোরসে পাকড়ে ধরে থাকে, সাধারণ জন সে দেশের জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, আর ভাগ্যান্বেষী সুবিধাবাদী জন সর্ব ঐতিহ্য, সর্ব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দেয় সুদুমাত্র সাফল্য লাভের তরে। পিতা কিসিংগার কোন পন্থি ছিলেন, বলা কঠিন। পুত্র ওসব পুরনো কাসুন্দি ঘটতে চান না, তিনি যে নিজকে একেবারে আগাপাশতলা খাঁটির খাঁটি বনেদি খান্দানি মার্কিন রূপে পরিচিত করতে চান সে বিষয়ে মার্কিন-অমার্কিন সবাই নিঃসন্দেহ।
নামটা নিয়েই শুরু করি। প্রথম নাম, হেনরি। জর্মনে বলে হাইনরিষ, ফরাসিতে বলে, আঁরি। ছেলেবেলায় নিশ্চয়ই তাঁকে সব্বাই হাইনরিষ নামে ডেকেছে, তিনিও তাই লিখেছেন। ইহুদি কবি হাইনরিষ হাইনে অধিকাংশ জীবন কাটান প্যারিসে নির্বাসনে। কিন্তু তার ছিল গভীর দেশপ্রীতি তথা আত্মাভিমান। তিনি হাইনরিষকে পাল্টে তার ফরাসিরূপ আঁরি লেখার প্রয়োজন কখনও বোধ করেননি। রোজোভেল্ট পরিবার গোড়ার থেকেই সব্বাইকে উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তারা জাতে ডাচ এবং ইংরেজি কায়দায় রুজভেল্ট উচ্চারণ তাঁরা পছন্দ করেন না। কিসিংগার উচ্চারণের বেলাও তাই। প্রাক্তন জর্মন প্রধানমন্ত্রী কিসিংগারের শেষাংশের উচ্চারণ যে –গার, এবং জার নয় সে তথ্য সবাই জানে। বক্ষ্যমাণ হাইনরিষ কিসিংগার ইচ্ছে করলেই পাঁচজনের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করে নির্দেশ দিতে পারেন, জার না করে যেন গার উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু তিনি আমাদের পাড়ার হরিশচন্দ্র সান্ন্যালের লিখিত হরস সি স্যান্ডল এবং কালিপদ মিত্রের পরিবর্তে ব্ল্যাক ফুটেড ফ্রেন্ডই পছন্দ করেছেন। এনারা খাস সায়েব হতে চেয়েছিলেন, উনি চেয়েছিলেন নির্ভেজাল মার্কিন হতে
হেনরি আর কিসিংগারের মাঝখানে একটা ইংরেজি অক্ষর এ আছে। অক্ষরটা কোন নামের আদ্যক্ষর সেটা আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি। বিবেচনা করি, খুনিয়া লোকটা বদবোওয়ালা টিপিকাল ইহুদি নামই হবে, যার অম্লত, অধৌত ইহুদি খুসবাইটি দূর-দূরাজতক ভরপুর ম ম করে। অতএব ও নামটা চেপে যাও বিচক্ষণ ঘড়িয়ালের মতো, শুদ্ধমাত্র এ দিয়ে বাকিটা রাখো।
এতখানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেবলমাত্র কিসিংগারের নামটি নিয়ে লোফালুফি করার মাধ্যমে আমি শুধু মাফ চেয়ে বলতে চাই, তুমি যে ইহুদি, তুমি যে জাত-মার্কিন নও, সেটা চেপে গিয়ে মার্কিনদের হনুকরণ করা কেন? (টু ইমিটেট-এর অনুবাদ অনুকরণ; টু এপ-এর অনুবাদ হনুকরণ)। ইহুদিদের ভিতর বেশুমার সজ্জন আছেন, মার্কিনদের চেয়ে অমার্কিনদের ভিতর ভদ্রজন বে-এন্তেহা বেশি।
এসব স্নবারি অতিশয় সাধারণ। কিন্তু অসাধারণ নাকি কিসিংগারের প্রতিভা এবং মানবিক গুণরাজির সংমিশ্রণ। –এ সত্য মার্কিন মুল্লুকে উত্তম উত্তম রাজনীতিবিদরা স্বীকার করেছেন। রবার্ট মেকনামারার মতামতের মূল্য নিশ্চয়ই বহুগুণ-গ্রাহ্য। তিনি বলেন, কিসিংগারের ভিতর তিনটি অসাধারণ গুণের সমন্বয় হয়েছে; জর্মনদের কর্ম করার সুবিন্যস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতি (সিসটেমাটিক রীতিবদ্ধতা), ফরাসিদের স্পর্শকাতরতা এবং মার্কিনদের উদ্যম (কাজকর্মে অফুরন্ত উৎসাহ, অদম্য নিষ্ঠা)। তাঁর ডক্টরেট থিসিস ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়, নাম এটম বোম এবং পররাষ্ট্র নীতি– কেনাফেন উনট আউস-ভেৰ্টিগে অলিটিক। এই পুস্তক ওই বৎসরই পরিবর্ধিত আকারে এ ওয়ার্লড রিস্টোর্ড নামে প্রকাশিত হয়।
ইউনিভার্সিটিতে কিসিংগার অতি সহজেই অধ্যাপক পদ পান। পরবর্তীকালে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টারূপে নিযুক্ত হলে এক সুরসিক গুণী তাঁকে প্রফেসর এবং প্রেসিডেন্ট দুই শব্দের সমন্বয় করে সম্বোধন করেন মি. প্রফাঁসিডেন্ট বলে। নানা গুণ থাকা সত্ত্বেও কিসিংগারের কেমন যেন জন-সমাজে নিজের ব্যক্তিত্ব ও উপস্থিতি অযথা দৃঢ়তাসহ প্রকাশ করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা লেগে থাকে এবং আপন বুদ্ধিবৃত্তি (ইনটেলেকট) সম্বন্ধে প্রকাশ পায় তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। এ মন্তব্যটা আমার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকে। নাৎসিরা যখন ইহুদিদের ওপর চোটপাট করছে সে সময়টা কিসিংগারের বারো থেকে পনেরো আয়ুষ্কাল আমি ঠিক সেই ক বৎসরেই বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার সহপাঠী ইহুদিরা যে তখন কতখানি মানসিক দুশ্চিন্তায় পীড়িত এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শঙ্কাৰিত ছিলেন সে স্মৃতি আমার কখনও ম্লান হবে না। এরা যে হীনমন্যতার (ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেকসের) সহজ শিকার হবেন, সেটা অনায়াসেই বোঝা যায়। তাই মনে আসে আবার সেই নীতিবাক্য : জালিম তার জুলুমের অনেকখানি রেখে যায় তার শিকারের (মজলুমের চরিত্রসত্তায়। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেখা যায়, তার চিন্তাধারা কার্যকলাপে অহেতুক দম্ভ, অকারণ অপমানজনক আচরণ।
নিক্সনের কর্ণধার, প্রাইভেট নয় নম্বর ডিটেকটিভ উপন্যাসের হি-ম্যান হিরো ওয়াশিংটন ০০৯; এবং সর্বশেষে প্রত্ন বিবেক স্পন্দন এই হর-ফন-মৌলা কিসিংগার। ইনি নিজের কার্যভার কমাবার তরে কখনও কোনও ডেপুটি রাখেননি বরমানও রাখতেন না– অধঃস্তন কর্মচারীদের কড়া মানা, তারা যেন কখনও সরাসরি নিক্সনের সম্মুখীন না হয়। তদুপরি তিনি কংগ্রেস, ব্যুরোক্রাটি এমনকি গণশক্তির আধার ভোটারদের অতিশয় তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন। তার মতে, সুষ্ঠু পররাষ্ট্রনীতি চালাবার পথে এরা নুইসেনস, বেকার ঝামেলাময় বাধা মাত্র।
ইনি হতে চলেছেন, কিংবা ইতোমধ্যে হয়ে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এবারে লাগবে ভানুমতির খেল অবশ্য ওয়াটারগেট-ফাঁড়াটা কাটাতে পারলে। পাঠক সেদিকে নজর রাখবেন। নইলে আমি এতখানি লিখতে যাব কেন, অথচ তার পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন সম্বন্ধে এখনও কিছু বলা হয়নি। হবে। ধীরে রজনী, ধীরে।
.
সাধু সাবধান!
প্রথম লেখাতেই যদি লেখক লম্বা-চৌড়া আত্মপরিচয় দিতে আরম্ভ করেন, তবে পাঠকমাত্রই বিরক্ত হয়। সে-পরিচয় দিতে হয় ধীরে ধীরে, টাপেটোপে, মোকামাফিক। এই বেলা তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ নিতান্তই বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে।
অস্বীকার করব না, একদা টুকলি করেই হোক, এগজামিনারকে প্রলোভন দেখিয়েই হোক, দু একটা আজেবাজে পরীক্ষা পাস করেছিলুম। তার পর মাঝে-মধ্যে দু একখানা বই, পত্র-পত্রিকাও পড়েছি। কিন্তু স্বরাজ পাওয়ার বছর দশেক পর থেকে দেখতে পেলুম, কি ভারত, কি (মরহুম) পূর্ব-পাক সরকার উঠেপড়ে লেগে গেছেন, অশিক্ষিতকে শিক্ষিত করতে এবং যেটা আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, শিক্ষিতকে অশিক্ষিত করতে। খবর এল, সরকার হার্ড-কারেসি বাঁচাতে চান। ইংরেজ আমলে এবং স্বাধীনতার গোড়ার দিকে থ্যাকার দাশগুপ্ত কোম্পানিকে নেটিভ-টাকা মেড়ে দিলেই তারা ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন যে-ভাষার যে-বই চান, আনিয়ে দিত। এখন আর সেটি চলবে না। সরকার বাছাই বাছাই কোম্পানিকে বিদেশি মুদ্রার কোটা দেবেন। আপনি কী বই চান, তাদের জানাবেন। তারা ব্যবস্থা করবেন। সরল পাঠক, উল্লাসে নৃত্য জুড়েছেন তো আমারও চিত্ত জুড়ালো! উল্লাসভরে বইয়ের অর্ডার দিই। নো রিপ্লাই। কেন? খবর নিয়ে জানলুম, পুস্তক বিক্রেতারা যে কোটা পান তাই দিয়ে জাহাজ জাহাজ টিকটিকি নভেল আর খাবসুরৎ সেকসের বই আনান ৪০ থেকে ৬০ পার্সেন্ট কমিশন! আর আমি চেয়েছি, হের ডক্টর কিসিংগারের জর্মন ভাষায় লেখা কেতাব,- এটম বমের ভয় দেখিয়ে কী প্রকারে বিশ্বশান্তি স্থাপন করা যায়, মোটামুটি কেতাবের নাম ওই। সে-বই একখানা আনালে পুস্তকবিক্রেতা কোনও কমিশনই পাবেন না, কিংবা পাঁচ পার্সেন্ট! আমার এক ক্যাপিটালিস্টি পয়সাদার কষ্যনিস্টি ইয়ার অনেক ঝুলোকুলি করার পর পুস্তকবিক্রেতা, সত্য সত্যই মোটা কমিশনের লোভ কাটিয়ে তাঁকে বললেন, আমি যদি একই কেতাবের– আবার বলছি একই কেতাব, পাঁচখানা ভিন্ন ভিন্ন বই নয়– একই কেতাবের পাঁচ কপি এক অর্ডারেই কিনি, তবে তারা বিষয়টি মেহেরবানিসহ বিবেচনা করে দেখবেন। শুনুন পাঠক, একই বইয়ের পাঁচ কপি! আচ্ছা বলুন তো, খুদ দ্রৌপদীকে যদি একই রঙ-চঙের, হুবহু একই ধরনের, পাঁচখানা কার্বন-কপির মতো পাঁচটা স্বামী দেওয়া হত তা হলে তিনি কি চা-পানা মুখ করে পাঁচ দফে কবুল পড়তেন?… এবং ভুলবেন না, তাঁকে রোক্কা টাকা ঢালতে হয়নি। তা সে যাক গে। কিন্তু এস্থলে বলে রাখি, আমি সরকারের সমালোচনা কস্মিনকালেও করিনে। বরঞ্চ না খেয়ে মরব, তবু হাঙ্গার-স্ট্রাইক করতে আমি রাজি নই। সরকার বইয়ের বদলে গোবর কিনে যদি দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে নিরন্নকে অন্ন দিতে পারেন, তবে আপত্তি করার মতো অত বড় পাষণ্ড আমি নই। আর ব্যক্তিগতভাবে আমার কীই-বা লাভ-লোকন? আমি ছিলুম অশিক্ষিত, থাকব অশিক্ষিত। পূর্বোক্ত জর্মন বই পেলে আমি কি রাতারাতি শহীদুল্লাহ হয়ে যেতুম? লাইব্রেরির চাপরাসি দিন-র হাজার হাজার বইয়ের মধ্যিখানে বাস করে শেষটায় কি শিক্ষামন্ত্রীর পদে প্রমোশন পায়? তবে প্রসঙ্গটা তুললুম কেন? বলেই ফেলি। আজ আবার শব-ই-বরাৎ! মাঝে মাঝে এই-বই সে-বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে সরল পাঠককে তাক লাগাবার কুমতলব আমার হয়। তখন যেন আমার কথা বিশ্বাস করে ফাঁদে পা দেবেন না।
.
শক্তির ভারসাম্য
হের ডক্টর ফিল হাইনরিষ কিসিংগারের চিত্তজগতের শুরু প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, তঙ্কালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ফরেন মিনিস্টার (১৮০৯-১৮২১) ক্লেমেনসে মেটারনিষ। নেপোলিয়নের পতনের পর লণ্ডভণ্ড ইয়োররাপে যখন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সুবো-শ্যাম কামড়াকামড়ি চলছে, তখন মেটারনিষ প্রধান রাষ্ট্রগুলোকে ভিয়েনাতে নিমন্ত্রণ করে একত্র করতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, তারই যুক্তিতর্ক অসাধারণ মেলামেশা করার ক্ষমতা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমা-নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়। আজকের দিনে যারা ইউনাইটেড নেশনসের কার্যকলাপ চোখ মেলে দেখেন তারা এ কর্মটি সম্পূর্ণ অবিশাস্য বলে মনে করবেন। মেটারনিষ ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় যে নীতি অবলম্বন করেন সেটা আজও মেটারনিষ সিসটেম নামে প্রখ্যাত। এ নীতির মূলে ছিল ভারসাম্য। অর্থাৎ ইউরোপকে এমনভাবে বিভক্ত করতে হবে, যাতে করে কোনও রাষ্ট্রই যেন বড় বেশি বলবান না হতে পারে, এবং শেষটায় গুণ্ডার মতো দুবলা রাষ্ট্রের কানপাকড়ে আপন স্বার্থ গুছিয়ে না নিতে পারে। অপকর্মের ভিতর ওই ভিয়েনা কংগ্রেসে সিংহলকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইংরেজের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই পাঠক, ঠিক ধরেছ–ইংরেজই সক্কলের পয়লা কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনের ডাঙ্গা ত্যাগ করে আপন চর-এ ঘাপটি মেরে বসে রইল। নীতিটার কিস্যুৎ কিন্তু ইংরেজই মালুম করতে পেরেছিল সবচেয়ে বেশি। এসব দলাদলির একশো বছর পরও প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন ইউরোপের ভারসাম্য রাখবার জন্য হিটলারকে খাইয়ে-দাইয়ে পোস্টাই করেছিলেন স্তালিনের সঙ্গে আখেরে লড়বে বলে।
.
বাংলাদেশ পাকিস্তান
…গুলি খান– খান খান
পাঠক অধৈর্য হবেন না। কারণ এ ছাড়া অন্য গতি নেই। কে বিশ্বাস করবে বলুন, সুদূর মার্কিন মুল্লুকের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির সঙ্গে এই গরিব বেচারি বাংলাদেশের–বাংলাদেশ কেন, কুল্পে বিশ্বের বরাৎ বিজড়িত। বাৎ শব্দটি ইচ্ছে করেই বললুম। কারণ শবেবরাতের রাত্রেই বেতারে শুনতে পেলুম, (পরের দিন খবরের কাগজ ছুটিতে ছিলেন বলে সে খবর পাকাপাকিভাবে জানতে পারলুম না, পাঠক আমার তরে আধেক ইঞ্চি মার্জিন বা গুঞ্জাইশ রাখবেন) যে-হের ডক্টর কিসিংগার তার মিত্র, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সকে ঠেলা মেরে সরিয়ে, আপন ছায়ারূপ পরিত্যাগ করে কায়ারূপ ধারণ করতে যাচ্ছেন, অর্থাৎ তার গদিতে বসবেন, তিনি সিনেট সদস্যদের এক প্রশ্নের উত্তরে বললেন, নাটকীয় তেমন কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেনি, তবে গত ছ মাস ধরে ভারত এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নতি লাভ করছে। কাষ্ঠসিক ফোড়ন দেবে, ওয়ার্স থেকে ব্যাড-এ এসেছে, নিকৃষ্টতর থেকে নিকৃষ্টে পৌঁছেছে। এর পরমুহূর্তেই বলবেন, কিন্তু পাকিস্তানের বড় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, তাকে সাহায্য করতে হবে। আহা, বাছা রে, পুব-পাককে পেঁদিয়ে পেঁদিয়ে তোমার হাতে বড় ব্যথা ধরেছে। এসো, যাদু, একটা গোল্ড ইনজেকশন দিই। পরে, চাই কি, এক খালুই এটম-আণ্ডা পাঠিয়ে দেবখন।
স্মরণে আসছে না, বলেছি কি না, কিসিংগার-নিক্সন গলাডা কাড্যা ফালা-ই-লেও মি. ভুট্টোকে ফৌজি জুন্তার ফি নারি পড়তে দেবেন না। হ্যাঁ, জুন্তার খুঁটি এ-দিক ও-দিক সরাও, দু-চারটেকে রাজসিক পেনশন দাও– কিন্তু হাঁক দিলে যেন পুকুরের ওপার থেকে লাঠি হাতে তড়িঘড়ি অকুস্থলে হাজির হয়। আর ওই বস্তাপচা সিস্টেমে জুতার বেশি লোককে ইলচির পাগড়ি পরিয়ে ভিনদেশ পাঠিয়ো না। কে জানে, কবে লেগে যাবে ভারত, আফগান, রুশ-চীন কার সঙ্গে। এস্তেক বেলুচ পাঠানকে ঠ্যাঙ্গাবার তরে টিক্কা খানের তো কুইনটুপ্লেট ভাই নেই! জুন্তা ভাঙলে ওদের ঠেকাবে কে?
হঠাৎ কিসিংগার এ-হিম্মৎ জোগাড় করলেন কোথা থেকে? এ্যাদ্দিন তো প্রভু-ভৃত্য অথবা ভৃত্যের বেশে প্রভু–দু জনাই তো গোরস্তানি খামুশি এখতেয়ার করেছিলেন। ঝপাঝপ স্টেটমেন্ট, দেমাতি, এস্তেক প্রেস-কনফারেন্স দিতে শুরু করেছেন হুজুর, আর ইয়ার বুক ফুলিয়ে সিনেটের সামনে বলছেন, পাকিস্তানকে মদত দিয়েছিলুম– বেশ করেছিলুম। ফের দেব। ছুঁচো জ্যাক এন্ডারসনকো মারো গুলি– সেটা বলেছেন মনে মনে। আর স্বয়ং নিন ওয়াটারগেট তদন্তের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, সিনেটরদের খেতাব দিয়েছেন, কিচিরমিচির করনেওলা সব কথাতেই না-মনজুর! না-মনজুর! চিল্লি মারার নবাব সায়েবের পাল–ইংরেজিতে ন্যাটারিং নবাবস অব নিগেটিভজম। কবি নিক্সনের তা হলে এই ন অক্ষরের অনুপ্রাসের প্রতি বিলক্ষণ দিল-চসপি আছে। আমার বাংলা তর্জমাটা বড় কুশাদা হয়ে গেল, কিন্তু পাঠক লক্ষ করবেন, মুল ইংরেজিতে নবাব শব্দটি আছে। সায়েবি উচ্চারণ নইবব। নিক্সন এখানেই ক্ষান্ত দেননি। স্বয়ং কটুবাক্যের জহবাজ নইবব নিক্সন মেহমান জাপানি প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য পান করার সময় বলেছেন, ওরা সব সামলাক তাদের গম-পেরেশানি, ফালতো হাবি-জাবির আক্রোশ–ভাবখানা এই, আমি এগিয়ে যাব ড্যাং ড্যাং করে। ইংরেজ সচরাচর এ ধরনের বিদেশীয় বড়ফাট্টাইয়ে ভর্তি বগল-বাজানোর ওপর নজর দেয় না। কিন্তু এস্থলে তাদেরই এক পয়লা নম্বরি সম্পাদক বলেছেন, উঁহু! এবার থেকে হুজুরকেই ওই গম-পেরেশানি দিয়ে নিত্যি নিত্যি লাঞ্চ ডিনার খেতে হবে। হয়তো হবে, কিন্তু আমার মনে হয়, হাওয়া যেন হঠাৎ করে উল্টো দিকে ভর করেছে।
.
রতি-বল-বর্ধক কিসিংগারি সালসা
মেটারনিষ নীতিতে শক্তির ভারসাম্যে কিসিংগারের অচল বিশ্বাস। কিন্তু এই নীতিটা হালফিল কাজে খাটাতে হবে অন্য পন্থায়। মার্কিনের হাতে আছে এটম বোমের ডাণ্ডা। সেই ডাণ্ডার ভয় দেখিয়ে দুনিয়ার কুল্লে রাষ্ট্রকে বলে দেব, কে কতখানি শক্তিবান হবার অনুমতি পেল। এইটেই ছিল ড. কিসিংগার-থিসিসের মূল বক্তব্য। বইখানা পড়ে নিক্সন তদ্দশ্যেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। ক্ষমতা লাভের পর নিক্সন ডেকে পাঠালেন কিসিংগারকে ওই শক্তির ভারসাম্য কাজে লাগাতে। এখানে দুটি তথ্য বলে নেওয়া ভালো। কিসিংগারের মতে, শক্তির ভারসাম্য তো বটেই, কিন্তু সেটা এখন আসবে এটম বোমের ভীতির ভারসাম্য রূপে, কিন্তু নিজেকে থাকতে হবে শক্তিমান। এবং তার আপন মাতৃভাষা জর্মনে কিসিংগার ঝেড়েছেন একটি লাখ কথার এক কথা : মাখট ইসট ডের গোসটে আফ্রডিসিয়াকুম–অর্থাৎ পলিটিকাল শক্তিই (মাখট ইংরেজি মাইট) সর্বোকৃষ্ট আফ্রডিসিয়াক– যে ওষুধ রতিশক্তি বাড়িয়ে দেয়, পঞ্জিকার যে সব মলম-বড়ির চটকদার বিজ্ঞাপন অন্ধেরও চোখ এড়াতে পারে না, তার ভদ্র নাম আফ্রডিসিয়াক। দ্বিতীয় তথ্য–দুশমন পরাজিত হলেও মজলুমের ওপর তার প্রভাব রেখে যায়– এটা পূর্বেই বলেছি। শক্তির উপাসক হিটলার দেখিয়েছেন, শক্তিতে ভাটার টান লাগার সম্ভাবনা দেখলেই শক্তির ভড়ং দেখাবে মাসল ফুলিয়ে, উরু থাবড়ে। এটা তো ভালো করে রপ্ত করেছেনই কিসিংগার, তদুপরি হিটলারের গুরু শক্তির মূর্তিমান প্রতীক বিসমার্ক (ইনি মেটারনিষের সদুপদেশ নিতেন আখছারই) সম্বন্ধে দীর্ঘ প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখে তাঁরই পন্থায় শক্তি সাধনায় নিজেকে বহু পূর্বে চালিত করেছেন।
.
আকস্মিক না প্ল্যান-মাফিক
এইবার কিসিংগার নেমেছেন মল্লভূমিতে। তার অন্তরঙ্গ সখা পররাষ্ট্র সচিব রজার্স, যার সাহায্য তিনি নিয়েছেন রাজনীতিতে ছায়ারূপে পদার্পণ-কালে, অকৃপণভাবে, তাকে সরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশ করেছেন প্রখর দিবালোকে। ভিয়েনা কংগ্রেসের শক্তিসাম্য নির্মাণকালে তার মানস-গুরু মেটারনিষও ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিমান অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রণাঙ্গনে নেমে কিসিংগার কোন ইন্দ্রিয়াতীত শঙ্খধ্বনি বাজিয়েছেন, জানিনে, কোন অদৃশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন বুঝিনি কিন্তু ফলস্বরূপ এ ক দিনে কী কী ঘটল লক্ষ করুন। সব কটাই কিসিংগার-নীতি অনুযায়ী।
১। ইজরায়েল অকস্মাৎ আক্রমণ দ্বারা সিরিয়ার বিমানবাহিনীর এক বৃহৎ অংশ পঙ্গু করেছে পরশুদিন। সিরিয়া রীতিমতো ধরাশায়ী।
২। জনাব আজিজ আহমদ অকুণ্ঠ তর্কাতীত ভাষায় বলেছেন, সর্বশেষ যুদ্ধবন্দিকে পাকিস্তানে পাঠাও। তাদের বিরুদ্ধে কোনও মোকদ্দমা চালাতে পারবে না। ইউনাইটেড নেশনে ঢোকার প্রস্তাব তার পর। চীন আছে সেখানে পুরো মদত দিতে– আমাকে। কোথায় গেল উভয়পক্ষের সমাসনে বসে আলোচনা-সমঝোতাটা? এই সুর-পরিবর্তন বিশ্বরাজনীতিতে ভয়ঙ্কর কিছু নয়, কিন্তু বাংলাদেশ এবং পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানের পক্ষে জব্বর গুরুত্ব ধরে।
৩। সদর দাউদ মার্কিনের চেলা না হয়েও কিসিংগারের অদৃশ্য ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছেন। তাড়াতাড়ি পাঠিয়েছেন আগা মুহম্মদ নঈমকে কমরেড ব্রেজনেভের কাছে। বৃত্তান্ত কিছুই জানা যায়নি। দাউদ যে আজিজের কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন লক্ষ করেছেন তাই নয়, কিসিংগার যে পাকিস্তানকে সাহায্য করবেন (দাউদ জানেন, সে সাহায্য গোপনে সেরা সেরা অস্ত্রশস্ত্রের রূপ নেবে) সেটা কিসিংগার সিনেটের সামনে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। নিক্সনাদির দৃঢ় বিশ্বাস রুশের সাহায্য নিয়ে দাউদ ক্যু, সমাপন করেছেন, ব্রিটিশ বলে অসম্ভব নয়, তবে রুশ যে আগের থেকেই কু-র খবর জানত সেটা সন্দেহাতীত।
৪। সবচেয়ে মারাত্মক চিলি রাষ্ট্রের কু্য। নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, চিলির ক্যু-র আগের দিনই যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনাটির খবর জানত। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটের সামনে এই সাক্ষ্যই দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ঝটপট তার দেমাতি (প্রতিবাদ) প্রকাশ করেছেন ও মৃতের স্মরণে সরকারি ব্লটিং পেপার দিয়ে আড়াই ফোঁটা কুম্ভীরাশ্রু শুষিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্বয়ংক্রিয় গোপন টেপ-রেকর্ডের জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে থাকলে সে টেপ মহাফিজখানায় সযত্নে রাখা হয়েছে কি না, সুপ্রিম কোর্ট গোঁ ধরে সেটা চেয়ে বসলে সদর নিক্সন সেটা দেবেন কি না, তা এখনও প্রকাশ পায়নি।
এতগুলো দিগ্বিজয় কি দৈবযোগে, গ্রহ-নক্ষত্রের কেরামতিতে ঘটল? এর সঙ্গে বিজড়িত আছে আরও তিনটি ঘটনা। (১) যে আদালতে ওয়াটার-গেট কমিটির পক্ষ থেকে নিক্সনের ওপর হুকুমজারি চাইছে, তিনি যেন তদন্ত সম্পর্কিত টেপগুলো কমিটিকে দিয়ে দেন, সে আদালত সরাসরি রায় না দিয়ে একটি সুলেহ প্রস্তাব করেছেন। অনেকে মনে করেন, নিক্সন-বৈরী ভাব যেভাবে দ্রুত কমে যাচ্ছে তাতে করে আদালত দেশের বিরাটতর স্বার্থের খাতিরে এটা করেছেন। কিন্তু নিক্সন গরম। পূর্বেই একাধিকবার শুধিয়েছি, কী কেরামতির বদৌলত এসব ঘটছে? এখন শুধধাই হুজুরের আকস্মিক এ গরমাইয়ের অর্থটা কী? তিনি আদালতকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু এতে করে আমার প্রশাসনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধিকার-খুদ-মুখতারি–ক্ষুণ্ণ হবে না তো? অর্থাৎ ভবিষ্যতে ফের অন্য কিছু চেয়ে বসলে আমাকে বিনা ওজর-আপত্যে সুড় সুড় করে কুল্লে চিজ ঢেলে দিতে হবে না তো? আদালত সঙ্গে সঙ্গে অভয় দিয়ে বলেছেন, আরে না, না, না। এসব প্রশ্ন, হঠাৎ এই মধুর মধুর মোলায়েমিটা আদালতের খাসলতে এল কোত্থেকে। আদালতের এহেন গুঞ্জাইশ প্রচেষ্টা যে বড়ই অভিনব ঠেকছে। আমরাও সুলেহ চাই, কিন্তু এতখানি আক্ৰা দরে।
(২) আরভিন তদন্ত কমিটি নিয়েছিলেন দুটি– ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। হঠাৎ খবর এল, আরভিন মেম্বারদের জানিয়েছেন, ছুটি বাতিল, কমিটি বসবে ২৪ সেপ্টেম্বর। কেন? অনেকেই বলছেন, যেভাবে ঝড়ের বেগে হাওয়া পাল্টাচ্ছে, তার থেকে অনুমান করা সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়, যে মোতাবেক ১৫ অক্টোবরতক আরভিন কমিটি ছুটি উপভোগ করে ওইদিন কমিটি ঘরে এলে হয়তো দেখবেন দরওয়াজা বন্ধ,পাইক-বরকন্দাজ হাওয়া, আসামি-ফরিয়াদি গায়েব।
(৩) অবস্থার অধঃপতন দেখে স্বয়ং কেনেডি আসরে নেমেছেন।
মানতেই হবে, বাবাজীবন কিসিংগারের পেটে এন্তের এলেম গিজগিজ করছে।
কী ভয় দেখালেন তিনি? তার সারাংশ এইমাত্র শুনলুম, বেতারে। অবশ্য তিনি জিভ কেটে বলবেন, তওবা তওবা। খাকসার ইহুদির পোলা দেখাবে ভয়– মহাপরাক্রান্ত আরভিন কমিটি, কংগ্রেস সিনেটকে! তওবা, তওবা!… অতএব বারান্তরে।
.
প্রেমালাপ বনাম বৈদ্য-বিমান
পাড়া-পড়শি কারও কাছ থেকে একখণ্ড মার্কিন সংবিধান লিপি জোগাড় করতে পারব এমনতরো বাতুলাশা আমরা করি না। আর, জোগাড় হলে লাভটাই-বা কী? ওয়াটারগেটের টেপরেকর্ড প্রেসিডেন্ট নিক্সন আদালতের হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য কি না, সংবিধান অ সমস্যায় কী নির্দেশ দেয়, এই নিয়েই তো যত মাথা ফাটাফাটি। তদন্ত কমিটি বলছেন, দিতে বাধ্য। নিক্সন বলছেন, না। তুলনামূলক যুক্তি দিয়ে বলছেন, প্রেসিডেন্ট তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে যে সলা-পরামর্শ করেন সেগুলো পূতপবিত্র মুকস। যেমন মক্কেল এবং উকিলে যেসব অন্তরঙ্গ আলোচনা হয়, স্বামী-স্ত্রীতে নিভৃতে যে গুফতো-গো হয় সেগুলো পবিত্র। অর্থাৎ কোনও আদালতই সেগুলো মোক্ষম হুকুম দ্বারা সংগ্রহ করতে পারেন না, জজ এগুলো একা একা গোপনে পড়তেও পারেন না, প্রকাশ্য আদালতে সর্বজনসমক্ষে ফাঁস করে দেওয়ার তো কথাই ওঠে না। জনৈক টীকাকার উত্তরে বলেন, যে-দুটো উদাহরণ নিক্সন পেশ করলেন সে-দুটো যদি আইনত মেনে নেওয়া হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি উদাহরণ অতি অবশ্যই মানতে হবে, এবং ঘড়িয়াল নিক্সন সে উদাহরণটা চেপে গেলেন কেন?– ডাক্তারে রোগীতে যে গোপন আলাপ হয় সেটাও সেক্রেড। প্লাতোর চেয়ে বয়সে বড়, ইউরোপে যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের জনকরূপে পরিচিত সেই গ্রিক বৈদ্যরাজ হিপপোক্রাতেস তাঁর শিষ্যদের দিয়ে শপথ করিয়ে নিতেন আমি যা কিছু সর্বাপেক্ষা পূত-পবিত্র (সেক্রেড) বলে স্বীকার করি, তাদের নামে শ্রদ্ধাভক্তিসহ (সলেমলি) শপথ করছি, আমি চিকিৎসাকর্ম নিষ্ঠাসহ সমাপন করব, ইত্যাদি ইত্যাদি… এস্থলে একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন কর্তব্য সম্বন্ধে শপথ নেওয়ার পর সর্বশেষে শপথ করতে হত– রোগী এবং তার সংশ্লিষ্ট জন সম্বন্ধে আমি যা-কিছু দেখতে পাব, শুনতে পাব, যেগুলো সম্বন্ধে কোনও কিছু বলা অনুচিত সেগুলো আমি অলঙ্ঘ্য গোপনরূপে রক্ষা করব (ইনভায়োলেবলি সিক্রেট)। ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পূর্বে আমাদের উপমহাদেশেও ডাক্তারদের সনদ নেওয়ার সময় এই কসম নিতে হত। এখনও কোনও কোনও বৃদ্ধ চিকিৎসকের চেম্বারে এই শপথলিপি ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় দেখা যায়। আজকের দিনে… যাক, অপ্রিয় কথা।
নিক্সনের উত্তরে যে টীকাকার রোগীর গোপন কথার পবিত্রতা সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন তিনি খুব সম্ভব আড়াই হাজার বছরের পুরনো সর্ববিশ-সম্মানিত এ শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার দোহাই দেবার কোনও প্রয়োজন অনুভব করেননি। আসল কথা, নিক্সনের দুশমন জনৈক সিনেটরকে ঘায়েল করার জন্য হোয়াইট হাউস কর্তৃক সেই সিনেটরের চিকিৎসকের দফতর থেকে রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের গোপন আলাপচারীর রেকর্ড চুরি করানো হয়– হুবহু যে-কায়দায় ওয়াটারগেট থেকে দলিল-দস্তাবেজ পেশাদারি চোর মারফত চুরি করানো হয়।
নিক্সনের বিবৃতি যিনি তৈরি করে দেন তিনি নিশ্চয়ই আস্ত একটি গর্দভ। উকিল-মক্কেল, স্বামী-স্ত্রীতে কথাবার্তার পবিত্রতা নিয়ে উদাহরণ দেবার কীই-বা ছিল প্রয়োজন? করলেই যে রোগী-বৈদ্যের পবিত্রতর কথোপকথন উদাহরণ আপনার থেকেই এসে যাবে, সেটা এক লহমার তরেও তার মাথায় খেলেনি? তাজ্জব! এবং সেই পবিত্রতা ভঙ্গ করেছেন নিক্সনের আপন খাস কর্মচারীগণ।
.
স্কুল-বয় কিসিংগারের ভাইভা
আমি কিন্তু ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন সংবিধান-লিপির তালাশ করছিলুম। কয়েকদিন ধরে ড. কিসিংগারকে মার্কিন সিনেটের একটা বিশেষ কমিটির সামনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে মার্কিন ফরেন-পলিসি নিয়ে হরেক রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। যেন ভাইভা পরীক্ষা। ইতোমধ্যে এক মার্কিন বেতারকেন্দ্র বললে, দু জন মেম্বর নাকি বলেছেন, তাঁরা কিসিংগারকে ফরেন মিনিস্টারের নোকরিটা দিতে চান না। ব্যাপারটা তবে কী? আমরা তো জানতুম, গণতন্ত্র-শাসিত রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী বা সক্রিয় প্রেসিডেন্ট তার পছন্দসই মন্ত্রী নিয়োগ করেন, খুশিমতো ডিসমিস করেন গণ-পরিষদ, এমনকি আপন মন্ত্রীমণ্ডলী-কেবিনেটের কোনও তোয়াক্কা না করে। তাই ধরে নিচ্ছি, প্রাগুক্ত কমিটি যদি কিসিংগারকে গোল্লা দিয়ে না পাস করে দেন, তবে নিক্সন ভেটো মেরে না-পাসিটা বাতিল করে দিতে পারেন। কিংবা এটাও সম্ভব যে, কিসিংগার যেহেতু জাত-মার্কিন (এমেরিকান সিটিজেন বাই বার্থ) নন, ষোল বছর বয়সে স্টেটসে এসে ডমিসাইল্ড নাগরিকত্ব পান, তাই সুদ্ধমাত্র এ ধরনের উমেদারকেই হয়তো তাদের নির্ভেজাল মার্কিনত্ব প্রমাণ করতে হয়। শুনেছি, জাত-ইতালিয়ান ভিন্ন অন্য কেউ হোলি পোপ হতে পারেন না, তথা ভিন্ন-ধর্ম থেকে দীক্ষিত খ্রিস্টান পাদ্রি সমাজে বিশেষ একটা পদের (যেমন বিশপের) উপরে যেতে পারেন না। আমার এ-খবর যদি ভুল হয়, ক্যাথলিক সমাজ দয়া করে অপরাধ নেবেন না। তা সে যাই হোক, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নির্বাচিত দেশের মুরুব্বিস্থানীয় ফরেন মিনিস্টার একটা স্কুল-বয়ের মতো ভাইভা দিচ্ছেন– এ তসবিরটা আমার কাছে কেমন যেন খাপছাড়া বদখৎ মনে হয়।
.
তাজহীন আগ্রা?
এরই সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটা খবর আমাকে আরও বেকুব বানিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মি. ভুট্টো স্টেটসে মি. নিক্সনের সঙ্গে দু বার দেখা করবেন, উনোতে বক্তৃতা দেবেন, ন্যাশনাল প্রেসক্লাবেও তাই– এবং অবশ্যই সেখানে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দেবেন, এমনকি নিক্সনের বিরুদ্ধবাদী নেতাগণ যথা হামফ্রি, ফুস্প্রাইট এবং কেনেডির সঙ্গে মোলাকাত করবেন।
সিনেটের ফরেন রিলেশন কমিটির মেম্বর এদের দু জন। কিন্তু হবু ফরেন মিনিস্টার, কার্যত সে পদে বহাল- ড. কিসিংগারের নাম কই? মি. ভুট্টো নিশ্চয়ই তাঁর ন মাস ধরে কপচানো বুলি ভুলে গিয়ে ওয়াটারগেটের মতো ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে নিক্সনের সঙ্গে দু দিন ধরে রসালাপ করবেন না। এস্তেক সিনেটের ফরেন কমিটির সঙ্গে দেখা করবেন, কিন্তু খুদে ফরেন মিনিস্টার কিসিংগারের সঙ্গে দেখা করবেন বলে কোনও উল্লেখ নেই, এটা কী করে সম্ভবপর হয়? ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইয়েহিয়াকে মদত দেবার জন্য প্রতিদিন জরুরি মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছেন যে কিসিংগার! চীনে যে লোমহর্ষক মুলাকাত হল মাও এবং নিক্সনে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান আলোচনার সময় আর দু জন মাত্র লোক চীনের প্রধানমন্ত্রী চু এবং কিসিংগার। মার্কিন ফরেন মিনিস্টার রজার্স নিতান্তই বাহাররূপে দলের সঙ্গে ছিলেন বটে কিন্তু সে সভায় তাঁকে ডাকা হয়নি। মাও যখন নিক্সনকে তার আপন বাড়িতে দাওয়াত করলেন তখন দাওয়াত পেলেন কিসিংগার কোথায় রজার্স? চীনের প্রাচীর দেখবার জন্য নিক্সন গেলেন সদলবলে; পিকিং-এ রয়ে গেলেন কিসিংগার, চুর সঙ্গে ফাইনাল কথাবার্তায় (হয়তো গোপন চুক্তির!) রূপ-রেখা দেবার জন্য! চু বলেছেন, ওই একটা লোক যার সঙ্গে তর্কাতর্কি করা যায়। সর্বপ্রথম মোলাকাতের সময় পাছে কোনও ফজুল প্রটোকলবশত কিসিংগার উপস্থিত না থাকেন, তাই মাও আগে-ভাগেই নিক্সনকে জানিয়ে রেখেছিলেন কিসিংগার অতি অবশ্যই যেন সে মোলাকাতে হাজির থাকেন। বিশ্বজন সে সময়েই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে, চীন-মার্কিন আঁতাতের একমাত্র ঘটক শ্রীযুক্ত কিসিংগার। অনেকেরই বিশ্বাস, তার সম্মতি ছাড়া নিক্সন নিশ্চয়ই ভুট্টোকে গদিতে বসাতেন না। এবং একটা তেতো হক বাৎ যদি মেনে নেওয়া হয় যে, ইয়েহিয়াকে ব্যাক করে নিক্সন মার খাননি, কিল হজম করেছেন কিসিংগার, তবে এটাও খুবই স্বাভাবিক যে, কিসিংগার পুরো মদত দেবেন মি. ভুট্টোকে, সে পরাজয়ের কালিমা যতখানি পারেন তাঁকে দিয়ে মোছাবার জন্য। একটু শঙ্কাও যে নেই, বলবে কে?– ইহুদিসন্তান কিসিংগার দাদ নেবার তালে থাকবে না, এ ভরসাই-বা দেবে কে?…. সেই কিসিংগারের নাম নেই, ভুট্টো যাদের দর্শন করতে যাচ্ছেন ওয়াশিংটনে, তার ফিরিস্তিতে তার চেয়ে পাঠক বললেই পারেন, আগ্রা যাব নামজাদা সব এমারত দেখতে–ফিরিস্তিতে? দেখি, তাজমহলের নাম নেই। হল না। বরঞ্চ বলি, সর্ব ফিল বাবদে জউরি গুণীন ঘটি বললে, চললুম ঢাকা, দেখব সরেস সরেস ফিল। তার নোটবুকে তাকিয়ে দেখি, চিত্তহারিণী তারকা কবরী দেবী যেসব ফিল্ম ধন্য করেছেন তার একটারও নাম নেই বেকুবের ফিরিস্তিতে!… ভুট্টো-কিসিংগারে দেখা হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার উল্লেখ নেই, কেন? তবে কি কিসিংগারের এখন কোনও ধরনের রাজনৈতিক ইদ্দত পিরিয়ড যাচ্ছে?
অসাধারণ মেটারনিষ বিরাট কংগ্রেসে যেরকম আপন ব্যক্তিত্বের ম্যাজিক বাঁশি বাজিয়ে দশটা নেশনকে নাচাতে পারতেন, ঠিক তেমনি বল-রুমে নিজে নাচতে পারতেন অপূর্ব লাস্য-লালিত্যসহ সমস্ত রাত। তার স্মরণে গদগদ কণ্ঠে কিসিংগার বলেছেন, কি কেবিনেটে, কি লেডিজদের অন্তরঙ্গ অভ্যর্থনা কক্ষে সঁলোতে তার চলন-বৈঠন, অনায়াস আচরণ ছিল প্রকৃত রোমান্টিকের মতো। কেবিনেট সঁলোর সম্মেলন করতে পেরেছিলেন তিনিই। অধ্যাপক কিসিংগার আজকের দিনে গুমড়োমুখো পলিটিশিয়ানদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতেন, কত না দূরে অন্তহীন সুদূরে চলে এসেছে এরা, সেই গৌরব এবং মাধুর্যময় যুগ থেকে রাজনীতিকলা আর জীবন-চালনা-কলা দুটোর সমন্বয় করতে জানে না এরা। আজ সবাই বলছে কিসিংগার এ সমন্বয় করতে সম্পূর্ণ সক্ষম হয়েছেন। আবার মেটারনিষের মতোই কিসিংগার বিশ্বাস করেন, রাজনীতি একটা আর্ট কলা-বিশেষ। সে আর্ট জ্ঞানবিজ্ঞানের ওপর নির্মিত হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু আদর্শবাদের সঙ্গে তার কানাকড়িরও সম্পর্ক নেই। পৃথিবী দূরে থাক, মানুষের ভিতরও কোনও পরিবর্তন আনার সংকল্প কিসিংগারের পরিকল্পনাতে নেই। তাঁর কাছে ন্যায়-অন্যায় বলেও কিছুই নেই। তিনি চান, উপস্থিত পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্রবল আছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ দ্বারা এমন একটা সামঞ্জস্যে নিয়ে আসা (সে নিয়ন্ত্রণ করার সময় কোনও আদর্শবাদেরই প্রশ্ন ওঠে না; নিয়ন্ত্রণটা সাধু নেবে, না অসাধু সে নির্বাচনে সম্পূর্ণ সে নিরপেক্ষ) যাতে করে রাষ্ট্রবলগুলো এমনভাবে গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয় যে যুদ্ধজনিত অশান্তির সৃষ্টি না হতে পারে।
কে জানে, তবে কিসিংগার কখনও মুখ ফুটে বলেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তিনি হয়তো আখেরি বিশ্বশান্তির প্রতিবন্ধকরূপে ধরে নিয়েছিলেন এবং সেটাকে ইয়েহিয়ার দমনপ্রচেষ্টা বলে তিনি নেকনজরে দেখেছিলেন। ঠিক ওই কারণেই, বিশ্বের ছোট-বড় সব শক্তিকে গ্রুপে গ্রুপে ফেলার জন্য বেলুচ-পাঠানের অটোনমি তিনি পছন্দ করবেন না। তার শখের ভারসাম্যের জন্য তার হাতে মেলা অস্ত্রশস্ত্র আছে।
কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রই কি শেষ সত্য?
.
গুজোরব তথা তুলনাত্মক শব্দতত্ত্ব
গুলজারব প্রতিষ্ঠানটির রাজধানী কোথায়? ওই–যা! বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম, বিশাধিক বৎসর ধরে দুই বাংলায় পুস্তক পত্র-পত্রিকার আদান-প্রদান প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে দুই বাংলার লেখার ধরন, বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ, বাংলাতে একদা সুপ্রচলিত কিন্তু বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক অব্যবহৃত যাবনিক শব্দের পুনর্জীবন লাভ, নতুন নতুন শব্দনির্মাণ ইত্যাদি দুই বাংলায়, স্বভাবতই, এক পথ ধরে চলেনি। যে গুজোরব শব্দ দিয়ে লেখাটি আরম্ভ করেছি সেটা খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। গুজোব-এর গুজো আর জনরবের রব–একুনে গুজোরব।… ইংরেজিতেও এ ধরনের বেশকিছু শব্দ ইদানীং তৈরি হয়েছে। মগ শব্দটি এক্কেবারে চ্যাংড়া না হলেও খানদানিত্ব পেতে অর্থাৎ মোলায়েম প্রেমের কবিতায়, ফুল-ডোরে বাঁধা ঝুলনায়, আসন পেতে এখনও তার সময় লাগবে। লন্ডনের কুয়াশায় পথহারা খাস লন্ডনবাসীই ল্যাম্পপোস্টটাকে পুলিশম্যান ভেবে তার কাছে পথের সন্ধান নেয়, খুদ পুলিশম্যান আপন বিট-এ পথ হারিয়ে কারও বাড়ির ঘন্টা বাজিয়ে গৃহস্থকে শুধোয়, সুমুখের রাস্তাটার নাম কী? কোনওদিন যদি বেলা তিনটে থেকে প্রায় সাতটা-আটটা অবধি কুয়াশা না কাটে তবে ষাট হাজারের কাছাকাছি ডেলি-প্যাসেঞ্জার ইয়ার-দোস্তের (যদি বরাতজোরে তাদের বাড়ি খুঁজে পায়) বাড়িতে রাত কাটায়, বেশিরভাগ হোটেলে আশ্রয় নেয়।…. তদুপরি লক্ষ লক্ষ চিমনি থেকে যে ধুয়ো ওঠে সেটা কুয়াশা ফুটো করে উপরের দিকে উধাও হতে পারে না বলে তার সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি হয় সুগ। ম্যাকের স্ম আর ফগের গ নিয়ে তৈরি হয় অগ। কলকাতায়ও স্মগ হয়, কিন্তু লন্ডনের তুলনায় একদম রদ্দি-পানসে। ঢাকার ভেজাল বে-আইনি বিয়ারের মতো। নির্জলা জল। তা সে যাকগে। কলকাতার সাগকে বলে ধুয়াশা– ধুয়া প্লাস কুয়াশার শা মতান্তরে ধুয়ার ধু প্লাস কুয়াশার আশা। হরেদরে হাটু পানি। এককালে মডার্ন কবিতায় দারুণ চালু ছিল ধূসর কথাটা–জীবনটা ধূসর, প্রেমটা ধূসর, ডাস্টবিনের পচা ইঁদুরটা ধূসর, রিকশায় চীনা গণিকাটা ধূসর, মডার্ন কবিতার বিক্রিটা ধূসর– গয়রহ। এখন ধূসর শব্দটাই ধূসর হয়ে উবে গিয়েছে। এদানির জোর কাটতি ধুয়াশার। মন্ত্রীর চাকরি দেবার ওয়াদাটা ধুয়াশা, মিলির প্রেম-নিবেদনটা ধুয়াশা, তার জিটিংটাও ধুয়াশা, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টাও ধুয়াশা- কারণ জিঞ্জিরায় তৈরি বিষটা ছিল ভেজালের ধুঁয়াশায় ভর্তি।
.
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় গুজোরব
গুজোরব জিনিসটা ধুয়াশা, তা সে মার্কিন টাইম বা নিউজ উইক পত্রিকায় ধোপদুরুস্ত কেতা-মাফিকই বেরুক, কিংবা কাবুলের বাজারে, চা-খানাতে গপ রূপে দুই পাগড়ি পাশাপাশি এসে ফিসফিসিয়েই বেরুক। এই দেখুন না, নিদেন দিন পাঁচ হবে, সম্ভ্রান্ত মার্কিনি একখানা দৈনিক একটা চিড়িয়া উড়িয়ে দিল, ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাগনো হপ্তা খানেকের ভিতর নোকরি ইস্তফা দেবেন; তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ–রিশওয়াদ খাওয়ার মোকদ্দমা উঠবে বলে তিনি খবর পেয়েছেন; সঙ্গে সঙ্গেই লেগে গেল ধুন্দুমার। দক্ষিণ আমেরিকার কুইটো বেতার থেকে শুরু করে দুনিয়ার হেন কেন্দ্র নেই যে সেটা নিয়ে লুফোলুফি করছে না। রাত দু টার সময় স্টকহলম (মাফ করবেন, আমি কিসিংগারি কায়দায় ইংরেজের অনুকরণে স্টকহোম লিখতে পারব না!) খুললাম, তাদের ইলেকশনের শেষ ফলাফল জানবার তরে, তারাও গেণ্ডেরি খেলছে ওই অ্যাগনোকে নিয়ে। বৃন্দাবনে গোপীরা একদা যেরকম বলতেন, কানু বিনে গীত নেই! এদিকে খুদ অ্যাগনো চুপ, নিক্সন খামুশ। যেন পাড়াপড়শির ঘুম নেই, বরের খোঁজ নেই।
.
কাবুলি কায়দা
কাবুল-বাজার যে গপ-এর চিড়িয়া ছাড়ে সেটা পাকড়ানো সহজ কর্ম না। কারণ, সেটা সরকারের কানে পৌঁছলে তার ডিরেক্টর চিড়িয়া ওড়ানেওলার সন্ধানে চর লাগান। অতএব কাবুলের বাজার-গপ শোনাবার তরে শাস্ত্রাধিকার চাই। মার্কিন তো পাত্তাই পাবে না, আর আজকের দিনের ইংরেজ সাংবাদিক অর্থাভাবে ডকে উঠি উঠি করছেন! রুশ পায় সরকারি সংবাদ, খাস প্যারা দোস্তই আউওয়াল হিসেবে সক্কলের পয়লা। তাই বাজার-গপের হিস্যেও সে খানিকটে পায়। তদুপরি তার আরেকটা দোসরা জরিয়াও আছে। সরদার দাউদের যে একটা গোপন মন্ত্রণাসভা থাকবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সে সভার সভ্য, ষোল থেকে আঠাশ, ক জন– সে বাবদে কাবুল বাজারও দাড়ি চুলকোয়, পাগড়ির ন্যাজ নিয়ে দড়ি পাকায়, কিন্তু মুখে রা-টি কাড়ে না। তবে কি না, একটা সত্য কেউ বড়-একটা অস্বীকার করে না। দাউদ কু্যটা যে করতে সক্ষম হয়েছেন, তার পিছনে ছিলেন বেশ একপাল মস্কোতে ফৌজি তালিমপ্রাপ্ত আফগান অফিসার।
তাদের যে ক জন মন্ত্রণাসভায় হক্কত আসন পেয়েছেন, তারা যে আফগানিস্তানকে আখেরে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্ররূপে তৈরি হবার জন্য সংস্কার বিধিবিধান প্রবর্তন করতে চাইবেন সেটাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
.
ছাত্র বনাম মোল্লা
প্রাচ্যের অনুন্নত দেশগুলোতে ছাত্র-সমাজ আজ অশেষ শক্তি ধারণ করে। ছুটিতে তারা যখন শহর থেকে গ্রামে ফিরে যায় তখন সেখানে সর্বত্র চালায় পলিটি। মোল্লাদের মল্লভূমি প্রধানত মসজিদের মক্তবে। তাদের সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন-দর্শন। দাউদ দেশের কুলে মক্তব এবং যে দু-পাঁচটা বে-সরকারি নিতান্তই জুনিয়র মাদ্রাসা আছে সেগুলো সরকারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। কাবুল থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদরা বেরিয়েছেন ক্ষুদ্র। শহর এবং গ্রামাঞ্চলে সেসব মক্তব-মাদ্রাসা পরিদর্শন করতে ও তত্ত্ব-তথ্য সংগ্রহ করতে।
দাউদ যদি সত্যসত্যই তাঁর প্ল্যান পুরোদমে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চান, তবে যেসব মোল্লা এখনও তার বিরোধিতা করেননি তারাও যে বিগড়ে যাবেন সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনও কারণ নেই। তথ্যান্বেষী যেসব শিক্ষাবিদ সফরে বেরিয়েছেন তাঁরা সৃষ্টিছাড়া কোনও নয়া তথ্য আবিষ্কার করবেন কি? মক্তব-মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক নিসাব তো কাবুল শহরে বসে বসেই জোগাড় করা যায়। সেগুলোতে আছে কী? ফারসি ভাষা শেখার কায়দা-কেতা, কুরান শরীফ পাঠ, শেখ সাদির অতুলনীয় কবিতা এবং নামাজ শুদ্ধরূপে পড়ার জন্য দোওয়াদরুদ। আর মাদ্রাসায় এ সবেরই অপেক্ষাকৃত উন্নত পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক এবং সুকঠিন আরবি শেখবার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। ইমাম আবু হানিফা সাহেবের ফিকাহ-অতি সংক্ষিপ্তরূপে পড়ানোর ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু প্রাতঃস্মরণীয় ইমামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, পরিপূর্ণ বুদ্ধিসম্মত (রেশনাল) যুক্তিতর্ক বোঝবার মতো শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন কজন আফগান মোল্লা-মুদররিস? পড়াবার তো কোনও প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু এই বাহ্য। আসলে শিক্ষাবিদরা তন্ন তন্ন করে খুঁজবেন, ওসব কেতাবে রাষ্ট্রদ্রোহ শেখায় এমন আছে কী সব শিক্ষা, আদেশ, ফতওয়া। এবং হবেন ন সিকে নিরাশ। ইমাম সাহেবের আমল ছিল ইসলামের সুবর্ণ যুগ। সে আমলে কোন ফকিহ বেকার মাথা ঘামিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহের ফতওয়া নির্মাণ করার তরে।
বস্তুত মোল্লারা যখন কোনও কওমকে কাবুলের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন তখন তারা আটঘাট বেঁধে আট গজি ফতওয়া লিখে সেইটে তাদের সামনে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে ফজুল ওয়াক্ত খর্চা করেন না। মক্তব-মাদ্রাসায় এমনিতেই খামোখা, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বা বিদ্রোহ কোনওটাই শেখান না। লুটতরাজের জন্যই হোক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, মোল্লারা যখন আফগানকে কাবুলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন তখন তারা নিতান্ত ফাউস্বরূপ মক্তবের বাচ্চাদের সামনে হয়তো-বা গরম গরম দু একটি ওয়াজ ঝাড়েন। সেগুলো সম্পূর্ণ অরিজিনাল, তাদের আপন মস্তিষ্কপ্রসূত; পাঠ্যপুস্তক বা নিসাবের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই আজকের দিনের শহুরে ভাষায় এগুলো কমপ্লিটলি একস্ট্রা-কারিকুলার।
মোল্লাদের ঘরে বন্দুক-কামান কিছুই নেই। তৎসত্ত্বেও প্রায় দেড়শো বছর ধরে তারা ইংরেজের পুরো-পাক্কা ফৌজকে কয়েকবার খেদিয়ে ঝেটিয়ে পেঁদিয়ে বের করে দিয়েছে আফগানিস্তান থেকে। আমানউল্লাহর মতো একাধিক বাদশাহকেও তারা ঘায়েল করেছে অশিক্ষিত পাঠানকে উস্কে দিয়ে।
সরদার দাউদের পক্ষে আছে ছাত্ররা। কিন্তু দাউদের দেশ বাংলাদেশের মতো নয়। কোথায় সন্দ্বীপ, কোথায় বরিশালের অজ পাড়াগা ওসব জায়গা থেকে ছাত্ররা পড়াশুনা করতে আসে সদরে, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকায়। তারাই একদিন ছড়িয়ে দিয়েছিল আপন আপন গ্রামে গ্রামে মুক্তিসংগ্রামের আহ্বান। ধন্য তারা, জয় হোক তাদের।
কিন্তু সদর দাউদের ছাত্রসমাজ তো এখনও কাবুল, জালালাবাদ ইত্যাদি কয়েকটি নগরের খাঁটি বাসিন্দা। জনপদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র নেই। সেখানে–
আমাদের মনে শংকা জেগেছে। কারণ আমরা গরিব। গরিব আফগানিস্তানের তরে আমাদের দরদ আছে। সরদার দাউদের সংস্কারপ্রচেষ্টা সফল হোক, এই আমাদের কামনা। কিন্তু এই কি তার পন্থা?…. অবশ্য তিনি যদি রাজ্যের রাজ্যির মোল্লাগণকে তনখা দিয়ে সরকারি শিক্ষকরূপে নিযুক্ত করেন তবে অন্য কথা। কিন্তু তার তরে অত কড়ি কই?
.
ক্যু দে তার দুসরা জুতা
দুসরা বুট দড়াম করে পড়েনি। বিলকুল ঠাহর করতে পারিনি। আবার গোবলেট করে ফেলেছি। ফিনসে শুরু করি।
জার আমলের খানদানি ঘরের ছেলেরা কলেজ, মিলিটারি আকাঁদেমির ছোকরারা শেষ পাস দিয়ে, কিংবা ফেল মারার পর কন্টিনেন্ট যেত আপন শিক্ষা-অশিক্ষার ওপর পালিশের জেল্লাই লাগাতে। আন্দ্রেই প্যাদ্রোভিচ জমিতফ যথারীতি বার্লিন-ভিয়েনা সমাপনান্তে পৌচেছে ফ্লোরেনসে। সেখানে চতুর্দিকে ফুলে ফুলে ছয়লাপ, কিয়ান্তি প্রভৃতি মদ্যাদি বেজায় সস্তা আর ছুঁড়িগুলোর এ্যাসন মাইরি-মাইরি চেহারা যে জানটা ত-র-র তাজা হয়ে যায়। তোমার সঙ্গে পান করবে, নাচবে, কত গোপন গানে গানে বলবে তোমায় কানে কানে, সিন্নোর, আমি তোমায় ভালোবাসি, চিরকাল তোমার হয়েই থাকব কিন্তু মুশকিল, একমাত্র তোমাকেই না, আরও পাঁচজনকে ওই একই দিব্যি দেয়। ওদের বিপদ, ওরা কাউকে কখনও না বলতে শেখেনি– পাড়াতে কারও কারও প্যারা নাম বিশ্ব-তোষক। আমাদের আন্দ্রেইকে পায় কে? প্রতি রাত্রিই বাসররাত্রি–বিনা পাত্রী। এক রাতে তিনটেয় হোটেলে ফিরে দুমদাম করে নেচে নেচে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে দ্রাম করে একখানা বুট ছুঁড়ে মেরেছে কাঠের পার্টিশনের উপর। সঙ্গে সঙ্গে পাশের কামরা থেকে হুঙ্কার, হেই জংলি, অত গোলমাল করিস কেন? ঘুমুতে দিবি না? আন্দ্রেই বড় লজ্জা পেল। চুপসে খাটের উপর বসে, বিলকুল আওয়াজ মাত্র না করে দুসরা বুটটি আস্তে আ-স-তে রেখে দিল খাটেরই উপর। তার পর অঘোরে নিদ্রা। ঘন্টা তিনেক পর তার বেঘোর নিদ্রা ভেঙে গেল, পার্টিশনের উপর জোর খটখটানি শুনে। পাশের কামরার লোকটা চেঁচাচ্ছে, ওরে মাতাল, দুসরা বুটটা ছুঁড়ে মারবি কখন? আমি অপেক্ষা করছি যে। তার পর ঘুমুতে যাব।
আমার হয়েছে তাই। এই, মাত্র গেল রোববার দিন, লিখছিলুম, দাউদ যেসব রিফর্ম শুরু করেছেন তাই নিয়ে আমার ডর-ডর করছে। দুসরা বুটটা যে কখন দড়াম করে পড়বে তারই পিতিক্ষেয় ছিলুম। হঠাৎ কাগজে দেখি, ওমা! দুসরা কু দে-তা কবে ইতোমধ্যে চুপসে হয়ে গেছে, আমি টেরটি পর্যন্ত পাইনি। রোববার দিনভর-রাত দুনিয়ার কুল্লে বেতার ম ম করছিল, কাবুলে দ্বিতীয় কু-র বাচ্চাটিকে প্রসবালয় থেকে সরাসরি গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিংবা বলতে পারেন, কাবুলি বউয়ের গর্ভপাত হয়েছে। কাবুল প্রচার করছে, সরদার দাউদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কিছু ফৌজি অফিসার এবং কিছু সাধারণ নাগরিক চক্রান্ত করার সময় ধরা পড়ে যান। তাঁদের ফৌজি বিচার হবে।
এ বিষয়ে মন্তব্য করার পূর্বে দুসরা বুটের চুটকিলাটিতে ক্ষণতরে ফিরে যাই। গল্পটি আকছারই কাছে আসে। দোস্ত শুধোলেন, কী হে, চাকরিটা পেলে?
দুসরা বুটের তরে অপেক্ষা করছি।
বুঝলে না? চাকরিটা কে পাবে তার ডিসিশন হয়ে গিয়েছে কাল সন্ধ্যায়। এনাউন্সমেন্ট হবে আজ সন্ধ্যায়। দুসরা বুট ছোঁড়া হয়ে গিয়েছে কাল সন্ধ্যায় আমি খবরটা পাব আজ সন্ধ্যায়। এ ধরনের কারবার আমাদের জীবনে নিত্যিকার।
.
খাঁটি ক্যু, না জিঞ্জিরা মার্কা?
এ জীবনে একটা তথাকথিত ক্য-কে আমি যেন অকুস্থলে, যেন বকসিঙের রিংসাইডে বসে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলুম। সে কু সত্য না ডাহা জোছুরি এ নিয়ে এখনও তর্কাতর্কির অবসান হয়নি। ২০ জুন ১৯৩৪-এ হিটলারের হুকুমে কয়েকশো লোককে বিনা বিচারে গুলি করে মারা হয়। এদের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন র্যোম। হিটলার যে একদিন জনির নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব লাভ করে তার জন্যই এই রোমের আপ্রাণ পরিশ্রমকে ক্রেডিট দিতে হয় চৌদ্দ আনা। হিটলারকে যে দু তিনটি লোক তুমি বলে সম্বোধন করতেন, রোম ছিলেন তাঁদেরই একজন। সেই র্যোম এবং তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মী সব ক জনাকেই খতম করা হয় ২০ জুন, হিটলার সর্বনায়কত্ব পাওয়ার ঠিক দেড় বছর পর। অজুহাত হিসেবে হিটলার ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে দেশের লোককে জানালেন, এসব পিশাচরা কু দ্বারা তাকে ও নাসি পার্টিকে সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছিল; তিনি পূর্বাহেই ষড়যন্ত্রের সন্ধান পেয়ে আপন দায়িত্বে তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।
রোম যে কোনও প্রকারের কু-র ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সেটা প্রচুর প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও সে সময়ে স-প্রমাণ করা যায়নি; আজ দোষটা চৌদ্দ আনা পড়ে হিটলার, গ্যোরিঙ্গ ও হিমলারের ঘাড়ে।
এটাকে বলা হয় পার্জ– জোলাপ। আকস্মিক আগাপাশতলা পালটে দিয়ে যখন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী একদল ক্ষমতা লাভ করে তখন সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মধ্যে স্বার্থে স্বার্থে লাগে সংঘাত এবং কত যে হীনতা নীচতা তখন দলের ভিতরে-বাইরে বেরিয়ে পড়ে সে বাবদে আমার মতো অগা আর নতুন করে বলবে কী? বিশেষত আমার লেখা পড়েন ক জন প্রাণী! এবং একমাত্র আমার মহামূল্যবান তত্ত্বকথা ছাড়া তারা অন্য কারও লেখা– এস্তেক গোপালভাড় তক– পড়েন না, এ হেন মিথ্যা স্বীকৃত হলে আমি এই লহমায় আমার সাদা কলমটি কালোবাজারে বিক্রি করে দেব।
চক্রান্তে চক্রান্তে যখন দলপতিকে বাধ্য হয়ে এক পক্ষ নিতে হয়, তখন বহু ক্ষেত্রেই অপর পক্ষকে খতম করা ভিন্ন ফুরারের গত্যন্তর থাকে না। এ তত্ত্বকথাটা আমার নয়। যারা শক্তির উপাসনা করেন, তাঁদের অনেকেই এ নীতিতে বিশ্বাসী। সর্ব ফুরারকেই তখন স্বভাবতই বলতে হয়, ওরা দেশের দুশমন, ওদের মতলব ছিল নয়া একটা কু করে দেশের সর্বনাশ করা।…এটা বহু বৎসর ধরে একটা প্যাটার্নে পরিণত হয়েছে। স্তালিন, মুসসোলিনি সব্বাই এটার এস্তেমাল করেছেন। কেউ বেশি কেউ কম।
তাই প্রথম প্রশ্ন, সত্যই আফগান জঙ্গি বিমানবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মেইওয়ান্দওয়ালা, গবর্নর খান মুহম্মদ একটা বিপ্লব ঘটাবার তালে ছিলেন, না দাউদ তার নবপ্রবর্তিত মোল্লা-বিরোধী আইন প্রবর্তন করার ফলে নিজেই বুঝতে পারলেন যে তার জনপ্রিয়তা দ্রুতগতিতে কমে যাচ্ছে, এবং এই তিন ব্যক্তি নিষ্ক্রিয় থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণ/মোল্লাগণ/ ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান-প্রেমীগণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অতএব বেলা থাকতেই এদের জেলে পুরে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে কিংবা অল্প খর্চায় গোটা কয়েক বুলেট দিয়ে।
.
আসলের চেয়ে ভালো কিসিংগারি ভেজাল
পাঠক, আমার পাক্কা ইরাদা ছিল, কাবুলি ক্যু– মনগড়া হোক আর জলজ্যান্তই হোক তার পিছনে কল-কাঠি নাড়াবার তরে পাকিস্তান, রাশা, শাহের মারফত আমেরিকা, কে কতখানি উৎসুক সেই নিয়ে এ লেখাটি শেষ করব। উপরের অনুচ্ছেদ সম্প্রসারিত করতে যাওয়ার এক ফাঁকে বেতারটির কর্ণমর্দন করতেই শুনি, মার্কিন কণ্ঠ মার্কিনি উচ্চারণে বলছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রীযুক্ত হেনরি কিসিংজারের বক্তৃতা শুনতে পাবেন। ফরেন মিনিস্টার হওয়ার পর এই তার প্রথম বক্তৃতা। আমি আশা করেছিলুম, আজ সোমবার, আমাদের সময়ানুযায়ী রাত দশটায় ওয়াটারগেটের মুলতুবি যে মোকদ্দমাটা ফের শুরু হওয়ার কথা, শুনব সেটা। এ মোকদ্দমাটা যে কেন ছ সপ্তাহের ছুটি না-মঞ্জুর করে তিন সপ্তাহ এগিয়ে আনা হচ্ছে তার অল্প-বিস্তর আলোচনা আমি পূর্ববর্তী সংখ্যায় করেছিলাম। আমার আশা ছিল, সেই মোকদ্দমাটা হয়তো-বা মার্কিন কণ্ঠ সরাসরি আদালত থেকে বেতারিত করবে, নইলে নিদেন একটা ধারাকাহিনী তো বটেই। পাঠক, বিবেচনা করুন, কোনটা বেশি রগরগে হত!
তবু মন্দের ভালো। আমি এ তাবৎ কিসিংগারি বক্তিমে কখনও শুনিনি। আমার প্রধান কৌতূহল : কিসিংগার জীবনের প্রথম পনেরো বছর কাটিয়েছে জর্মনির ক্ষুদে ফুর্ট শহরে। মাতৃভাষা তার জর্মন এবং ওই ক্ষুদে শহরে নিত্যি নিত্যি ইংরেজি বলার সুযোগ-সুবিধে নিতান্তই নগণ্য– বস্তুত মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার ডক্টরেট থিসিস লেখেন জর্মনে।
খলিফে ছেলে মশাই, খলিফে ব্যক্তি। যা ইংরেজি ছাড়ল– কার সাধ্যি বলে তাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। শুধু কি তাই, যদিও এই চৌকস ঘড়িয়ালটি মার্কিনত্বে খাস জাত-মার্কিনকেও ঢিট দিতে চান ঝালে-ঝোলে-অম্বলে, তবু ইংরেজি উচ্চারণের বেলা নাকি-সুরে, র অক্ষরকে ড় করে চিবিয়ে চিবিয়ে, টেনে টেনে বেটাড অ্যান্ড বিগাড় মার্কিনি ইংরেজি বললেন না। রপ্ত করেছেন মার্কিন আর খাস ইংরেজির মধ্যিখানের এমন একটি উচ্চারণ যেটা দুই দেশেই কদর পাবে। শুধু লক্ষ করলুম তাঁর চ উচ্চারণে কিঞ্চিৎ জর্মন আড় রয়ে গেছে। কারণ জর্মন ভাষায় চ ধ্বনিটি আদৌ নেই। কিন্তু আমার এই মিহিন নুখতাচুনিতে পাঠক কান দেবেন না। মোদ্দা কথা : আমি অন্য কোনও জর্মনকে এ হেন উৎকৃষ্ট ইংরেজি বলতে শুনিনি।
আর বক্তৃতার বিষয়বস্তু? সেটা বারান্তরে হবে। উপস্থিত তার একটি আজব বাৎ শোনাই। তিনি বললেন, ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নতির দিকে। খাস ঢাকায় যদি এই বচনামৃতটি ঝাড়া হত তা হলে ডাইনে বাঁয়ে চটসে তাকিয়ে নিয়ে বলতুম, আস্তে কয়েন কত্তা, ঘোড়ায় হাসবো।
.
পরলোকগত বাদাম প্যাঁচ
বহুকাল গেছে কেটে। প্যাঁচটাও গেছে উঠে। অতএব সে প্যাঁচের টেকনিক্যাল নামটাও যে ঘুড়িয়ালারা ভুলে যাবে তাতে আর তাজ্জব মানার কী আছে? সে আমলে কলকাতায় বসন্তের আকাশ ছেয়ে যেত কত না চিত্র-বিচিত্র ঘুড়িতে। কিন্তু বাচ্চাদের মাঞ্জাহীন গুড্ডির সঙ্গে প্যাঁচ লাগানোটা আমরা রীতিমতো ইতরতা বলে মনে করতুম। উপরের আকাশে চলত এ-পাড়া ও-পাড়ার ঝানুদের ভিতর উপর-প্যাঁচ, নিচের প্যাঁচ, ঢিলের প্যাঁচ, সুতো ফুরিয়ে গেল টানের প্যাঁচ, এ প্যাঁচটা কিন্তু অনেকেই ফাউল বলে বিবেচনা করতেন চলত অনেক রকমের বিমান-যুদ্ধ। এমন সময় অতিশয় কালে-কস্মিনে ঝানুদের গুরুকুলের কোনও এক ঝাণ্ডু চড়চড় করে চড়াতেন, এপাড়া ও-পাড়ার কুল্লে ঘুড়ির উপরের স্তরে, তার অতি গরিবি চেহারার সাদামাটা ঘুড়িখানা। সেখানে খাওয়াতেন ঘুড়িটাকে একটা গুত্তা বা মুণ্ডা। সমুচা দখিনা আসমান ঝেটিয়ে তাঁর ঘুড়িটা প্যাঁচে জোড়া ডবল ঘুড়ি, সিঙ্গিল ঘুড়ি সব কটার সুতো জড়িয়ে নিয়ে, দোতলার ছাত ছুঁই ছুঁই করে সোঁ সোঁ করে উঠত ফের স্বর্গপানে হাগর দিকে। ওঠার সময় একটা একটা করে কুল্লে ঘুড়ি যেত কেটে যেসব ঘুড়ি আপসে প্যাঁচ খেলছিল তারাও জোড়ায় জোড়ায় হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খেতে খেতে হয়ে যেত হাওয়া। যদুর মনে পড়ে, এটাকে বলত বাদাম প্যাঁচ- নৌকোর বাদাম পালের সঙ্গে হয়তো কোনও মিল আছে।
আজ কোথায় সে গুনিন, যিনি ভিন্ন বাদাম-এর খেল দেখাবেন? আকাশ বাগে তাকিয়ে দেখুন, বেশুমার কত না চিড়িয়া।
.
দিশি ঘুড়ি
আমরা নিকট প্রাচ্যের নিরীহ প্রাণী। আমাদের কারবার ইরান, আফগান, পাক-ভারত নিয়ে। (১) রাজা দাউদ আপন দেশের জনগণের মন কতখানি পেয়েছেন সেটা বাতলাবে কে? দুসরা কু আসছে না কি? ওদিকে বিদ্রোহী পাক-বেলুচ-পাঠান তার দিকে তাকিয়ে অছে। (২) ভুট্টো গেলেন, অগম অভিসারে ইয়াংকি সাগর পারে, লাঠি-সড়কি, রামদা-ঝাটার সন্ধানে, (৩) শাহ যেন পস্তাচ্ছেন, ভাবছেন মার্কিন না রুশ, রুশ না মার্কিন শ্রীরাধিকা চন্দ্রাবলী, কারে রাখি কারে ফেলি। (৪) মেঘমল্লারে সারা দিন-মান, শুনি ঝরনার গান, মাফ করবেন, লারকানা-গান– বেচারি গুরুজি (কলকাতা-গামীদের বলে রাখি, হোথায় শিখ মাত্রকেই সরদারজি না বলে গুরুজি সম্বোধন করলে তাদের মেহেরবানি পাবে বেশি) স্বরণ সিং মি. ভুট্টোর লাগাতার ভারতের শিকায়েৎ-জারি-মসিয়ার গান সুবো-শ্যাম শোনেন আর উত্তর প্রতিবাদ দেমাতি লিখতে লিখতে তার জানটা পানি। বস্তুত আমি ২১/১২/৭১-এর ডিসেম্বরেই গুরুগম্ভীর প্রস্তাব করেছিলুম যে, শুধুমাত্র ভারত নিয়ে মি. ভুট্টোর কটু-কাটব্য তেরি-মেরির উত্তর দেবার তরে দিল্লির ফরেন আপিস যেন একটা আলাদা দফতর খোলে। নইলে বেচারি স্বরণ সিং ফুৎ পাবেন কোথায়, তিনি যে ফরেন মিনিস্টার, কটুকাটব্য, মিথ্যা ভাষণের দেমতি প্রদান ভিন্ন দু একটা গঠনমূলক কাজও তিনি করে থাকেন, সেটা হাতে-নাতে দেখিয়ে দেবার? এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুরু স্বরণ সিং ঢাকায় তিনি এসেছেন কবার তার সম্মানিত ধর্মের একটি মহৎ শিখ-তীর্থও তো এখানে। আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিমত, তিনি তার তীর্থদর্শনে ঢাকায় আরও ঘন ঘন এলে উভয় দেশেরই মঙ্গল হত, ভুল বোঝাবুঝি কমত। পাঠক, তাই কিন্তু ঠাউরাবেন না, জনাব হাকসর চেষ্টার কোনও ত্রুটি করছেন। সম্ভ্রান্ত হাকসর গোষ্ঠীকে দিল্লি-ইলাহাবাদে কে না চেনে–আমার মতো নগণ্য ব্যক্তিও সে পরিবারে মোগলাই বদ্বান্ন ভক্ষণকালে বিস্তর ফারসি, উর্দু কাব্যরস উপভোগ করেছে। মাননীয় সম্পাদক, পাঠকমণ্ডলী যদি অপরাধ না নেন, তবে বলি, আমার মনে হয়, জনাব হাকরের মতো সর্বার্থে ভদ্রলোকের পলিটিকস ত্যাগ করাই ভালো। তা সে যাকগে; ভারত, বাংলাদেশ, গুরুজি, জনাব হাকসরকে রিফর্ম করার ভার আল্লাহতায়ালা আমার স্কন্ধে সমর্পণ করেননি– শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
.
তিন না চার
এই যে চার দফে ইরান থেকে বাংলাদেশের নিত্যদিনের পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় ঘটনার ফিরিস্তি দিলুম, তার সঙ্গে যোগ দিতে হয়, তিন মহাশক্তির বহুরূপী কার্যকলাপ চীন, রুশ আর মার্কিন দেশের নয়া নয়া খেল। বিশেষ করে তৃতীয়টির। কারণ বহু বৎসর ধরে মার্কিনরা জাপানকে বার বার বলেছে, আমরা প্রাচ্যের পুলিশম্যান, আর তোমরা স্বভাবতই, অর্থাৎ নৈসর্গিক পদ্ধতিতেই আমাদের পয়লা নম্বরি দোস্ত। অবশ্য এই মার্কিনি পুলিশম্যানের টহল মারার কায়দা বড়ই আজব! আর পাঁচটা দেশে গেরস্তজন ট্যাকসো দেয়, সে টাকায় লাঠি সড়কি, দরকার হলে বন্দুক, পিস্তল কিনে পুলিশকে দেওয়া হয়। মার্কিন পুলিশ কিন্তু উলটো গেরস্ত ইরান, পাকিস্তান গয়রহতে হুদো হুদো বন্দুক-কামান দেয়, বেয়াড়া। পাড়া-পড়শিকে ঠ্যাঙাবার জন্য। নিজের শরীরটা যতখানি পারে বাঁচিয়ে রাখে। তাই-না মৌলানা সাদির পূর্ববঙ্গীয় ভ্রাতা গেয়েছেন :
কত কেরামতি জানোরে বান্দা
কত কেরামতি জানো,
শুকনায় বইস্যারে বান্দা
পানির মাছ টানো
.
‘সব ইহুদি হো জায়গা’
এই তিন শক্তির বাইরে আরেকটি শক্তি লোকচক্ষুর আড়ালে বহু বহু বৎসর ধরে সরাসরি এবং প্রয়োজন হলে মার্কিন সরকারকে দিয়ে আপন কাজ গুছিয়ে নিয়েছে এবং জানেন জিহোভা আরও কত যুগ ধরে তাদের বিচরণভূমিতে দাবড়ে বেড়াবে তারা, কিন্তু অতিশয় সঙ্গোপনে। পাঠকের স্মরণে আসতে পারে, ১৯৭১ বসন্তে যখন শেখ (ইয়েহিয়া)-ভুট্টোতে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল তখন মি. ভুট্টো ম্যাজিশিয়ানের মতো আচানক তার হ্যাট থেকে একটি তিসরা চিড়িয়া বের করেছিলেন। তার পূর্বে তিনি সুবো-শ্যাম জপতেন আমি আছি ভুট্টো, আর তুমি আছ শেখ। হঠাৎ বলে বসলেন, আর আছে ওই তিরসা চিড়িয়া, দি আর্মি। যারা জুন্তার কেচ্ছা জানত না, তারা পড়ল আসমান থেকে। … আমার বক্তব্য– অকস্মাৎ এই যে চতুর্থ শক্তি আমদানি করলুম সেটা কিন্তু ওই আপস্টার্ট অপদার্থ গুলাম মুহম্মদ ইসকান্দার মির্জার গাফিলির ছাওয়াল মিলিটারি জুন্টা নয়। এর ইতিহাস অতি দীর্ঘ, ইনি বিশ্ব-ইহুদি শক্তি, কিন্তু আসলে এনার তাগদ বাড়ল যেমন যেমন নিগ্রো দাসদের রক্ত শুষে, রেড-ইন্ডিয়ানদের কতল করে, মার্কিন-ইয়াংকির ন্যাজ মোটা হতে লাগল, ব্লাংকো খুলিটা বদবো-দার গ্যাসে ভর্তি হতে লাগল। মার্কিনি-ইহুদিদের লুক্কায়িত শক্তির বয়ান দেবার মতো শক্তি ইহ-সংসারে কারও নেই। ইজরায়েল রাষ্ট্র নির্মাণের সময় থেকে দু পাঁচজন লোক এদের সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত নাম-করার মতো কোনও আমেরিকান তাদের গোপন বিষ নিয়ে কথা পেড়ে সেটা ফাঁস করে দেবার মতো হিম্মত দেখাতে পারেননি। সত্যি-মিথ্যে জানিনে, আমাকে এক মার্কিনই বলেন, এ শতাব্দীতে কোনও মহাপ্রভুই ইহুদিদের চটিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কিন্তু এ সত্যটা জানি, ক্ষুদ্র মাইনরিটি ইহুদিদের দাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও কোনও রাষ্ট্রে মার্চেন্ট অব ভেনিস প্রকাশ্যে মঞ্চস্থ করলে সেটা বে-আইনি কর্ম, ফলং– শীঘরবাস! অবশ্য ইহুদি শাইলক চরিত্র বাদ দিয়ে নাটকটি অভিনয় করলে হয়তো-বা আপনি ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সুপপ্লেট সাইজের একটি সোনার মেডেল পেয়ে যেতে পারেন। তবে কি না, সেটা পাকা স্যাকরাকে দিয়ে যাচাই করে নিতে ভুলবেন না।
ইহুদি কিসিংগার এখন পারলোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন মিনিস্টার। তিনি কর্মভার গ্রহণ করে সর্বপ্রথমে যে কার্যে হস্তক্ষেপ করেছেন, সেটি ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দোস্তি স্থাপন করার। ওয়াহ! ওয়াহ!! তবে কি না, আরবরা হয়তো তাদের পক্ষ থেকে আইষমানের যমজ ভাই থাকলে তাকে পাঠাতে পারে! অবশ্য তিনিও কিসিংগারের মতো নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা করবেন মাত্র! তাজ্জব ইহুদি মিনিস্টারের তর সইল না, গদিতে বসতে না বসতেই দেলেন ছুট ইজরায়েলে জাতভাইয়ের কটা এটম বোম দরকার তার তত্ত্বতাবাশ করতে। ইয়া, মালিক!
রুশদেশ কবে কোন আদিমযুগে ১৯১৭-এ কমুনিষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সাতিশয় কালে-ভদ্রে কানে এসেছে, কিছুসংখ্যক রুশদেশীয় ইহুদি প্যালেস্টাইন, পরবর্তীকালে ইজরায়েলে, চিরতরে যেতে চায়, আর জেদি বলশিরা তাদের যেতে দিচ্ছে না। তার পর বছর পাঁচ সাত আর কেউ রা কাড়ত না।
ওমা! হঠাৎ দেখি, মার্কিন কংগ্রেস, না সিনেট, না কী যেন, গোঁ ধরেছেন, রুশ যদি ইহুদিদের ছেড়ে না দেয় তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করার ব্যাপারে পয়লা সুযোগ পাবে না। এই ব্ল্যাকমেলের হুমকির পিছনে কে? মার্কিন ইহুদিরা যে অষ্টপ্রহর তওরিত তিলাওৎ করে এ দুনিয়ার মুসাফিরি খতম করে, এ সব নশ্বর ফানি বখেড়া নিয়ে দাড়ি ঘামায় না, এই নবীন তত্ত্বটি আয়ত্ত করে বড়ই উল্লাস বোধ করলুম। কিন্তু হায়, সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা খবর মনে পড়ে যাওয়াতে আমার উল্লাসটা বরবাদ হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন মিনিস্টার যে এখন এক ইহুদি মহারাজ। যার কাছে একদা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল নিতান্তই ঘরোয়া ব্যাপার, আজ রুশদেশের কোথায় কোন গোপন কোণে ক গণ্ডা ইহুদি বাস করে, তাদের খাসিস হয়ে গেল অকৃত্রিম আন্তর্জাতিক গুরুতর সমস্যা।
.
বিশালতর ইজরায়েল?
এদের বের করে আনতে পারলে আরব-ইজরায়েল ব্যাপারে নিরঙ্কুশ নিরপেক্ষ ইহুদিকুলগৌরব কিসিংগার এদের জমিজমা ঘরবাড়ি দেবেন কোথায়? নিশ্চয়ই মারাত্মক রকমের ওভার-পপুলেটে আমেরিকায় নয়। সে কী করে হয়, পাগল নাকি?
ভাবছি, ক হাজার আরব মুসলমানকে খেদিয়ে এদের জন্যে স্থান করবেন নিরপেক্ষ কিসিংগার কোথায়?– ফলস্তিনে, সিরিয়া-লেবানন জয় করে?
গোড়াতেই তাই নিবেদন করেছিলুম, নিকট-প্রাচ্যের গোটা চারেক ঘুড়ি, বিশ্বের গোটা চারেক শক্তির ঘুড়ি, কোথায় রুশের ইহুদি ঘুড়ি আর কোথায় মার্কিন ইহুদি ঘুড়ি, তার কাপ্তেন কিসিংগারের রাম-মাঞ্জাওলা অতগুলো ঘুড়ি ঝেটিয়ে, একজোট করে, বাদাম পাচে সবকটাকে কাটব, হেন এলেম আল্লা দেননি।
.
‘দূরকে করিলে নিকট বৈরী’
আমাদের বিখ্যাত সাধক কবি লালন ফকির গেয়েছেন,
হাতের কাছে পাইনে খবর
খুঁজতে গেলাম দিল্লি শহর
জার্মান কবি গ্যোটেও বলেছেন,
দূরে দূরে তুমি কেন খুঁজে মরো
সুখ সে তো সদা হেথায় আছে
শিখে নাও শুধু তারে ধরিবারে
সুখ সে রয়েছে হাতের কাছে।
সুখের বেলা হবেও-বা। কিন্তু দুঃখটা খুব সম্ভব আসে দূরের থেকে। দুঃখটার উৎপত্তি যদি হাতের কাছেই হত তবে তাকে ধরবার কায়দাটা রপ্ত করে নিয়ে টুটিটা চেপে ধরে তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতুম না?
নিকট প্রাচ্যের সর্বনাশ তো তৈরি হয় দূর বিদেশে, আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশ ভারত আফগানিস্তানের দম বন্ধ করার জন্য দড়ি পাকানো হয় দূরে বহু দূরে উজ্জয়িনীপুরে, থুড়ি, দজ্জালিনীপুরে। তদুপরি আমার ব্যক্তিগত অতি গভীর বিশ্বাস সে দুঃখ নিবারণার্থে ভিন দেশের দিকে তাকিয়ে থাকাটার মতো আকাট আহামুকি আর কিছুই হতে পারে না। আপনার-আমার আপন দেশের লোক আপন ধর্মের ভাই যেভাবে দুশমনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আপনাকে-আমাকে দুঃখ-বেদনা দিল, তার পরও ভরসা রাখব বিদেশির ওপর? কার্ল মার্কসের ওপর আমার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বিশৃপ্রলেতারিয়ার প্রতি ঐক্যবদ্ধ হতে যে আদেশ দিয়েছেন সেটা বাংলাদেশের সর্বজনের ওপর খাটে। এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে শোচনীয় জীবন ধারণ করে তার চেয়ে বিলেতের তথাকথিত প্রলেতারিয়ার জীবন শতগুণে শ্রেয়ঃ। আর এদেশে সত্যকার ধনী যারা, ফুলে উঠেছেন যারা, তাদের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানাবার রত্তির প্রয়োজন নেই। তারা বাস্তুঘুঘুর পাল। সময় থাকতেই এক লক্ষে আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে গোলে হরিবোল দেবেন। আমার শুধু আশঙ্কা আখেরে নেতৃত্বটা না তাদের হাতেই চলে যায়। যা হয়েছে শত বার হয়েছে, এদেশে, ভিন দেশে, সর্ব দেশে অতীতে। তাই থাক এ প্রসঙ্গ উপস্থিত ধামাচাপা।
.
বিশ্ব ইহুদি
বলছিলুম, আসমানে বিস্তর চিড়িয়া বাদাম প্যাঁচের করকরে মাঞ্জা লাটাইয়ে তো নেই-ই, তার ওপর একটা বিরাট বাজপাখি আসমানি রঙের সঙ্গে তার আগাপাশতলা এমনই মিলিয়ে দিয়ে আচানক ছোঁ মারে যে তার কোনওকিছুই ধরা-ছোঁওয়ার ভিতরে আসে না। নেই নেই করে তবু দু পাঁচজন মার্কিন আছেন যারা বাজটাকে চেনেন কিন্তু ওর সম্বন্ধে মুখটি খুলেছেন কি তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইন্না লিল্লাহি
বিশ্ব ইহুদি, ইহুদিতন্ত্র জায়োনিজমের কেন্দ্রভূমি এখন আমেরিকায়। একদা ছিল অস্ট্রিয়া ও জর্মনিতে। মেটারনিষের যে ভিয়েনা-কংগ্রেসের কথা কিসিংগার সুবাদে উল্লেখ করেছিলুম সে কংগ্রেসে সর্ব নেশনের উদ্দেশ্যে যেসব অনুরোধ-আদেশ জানানো হয়, তারই একটা ইহুদিদের ব্যাপকতর রাষ্ট্রাধিকার দেবার জন্য, বিশেষ করে জর্মনিতে। সাধে কি আর জর্মন ইহুদি কিসিংগার মেটারনিষকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন! সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে মনে প্রশ্ন জাগে, শিষ্য কিসিংগার কি একদিন শুরুর মতো ইতিহাসে তার নাম রেখে যেতে পারবেন? সে আলোচনা ক্রমশ আলোচ্য ও প্রকাশ্য; উপস্থিত একটি তথ্য পাঠকের স্মরণে এনে দিই– জর্মনির মহাকবি হাইনরিখ হাইনের বয়স আঠারো–ভিয়েনা কংগ্রেসের সময়। সে কংগ্রেসের সুপারিশ অনুযায়ী অধিকার লাভের ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যেই বার্লিনে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ইহুদিরা আপন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন ও যুবা হাইনে সেটিতে সোৎসাহে যোগদান করেন। সদস্যরা আনন্দে আটখানা হয়ে হাইনেকে কোলে তুলে নেন, কারণ তখন হাইনের খ্যাতি জর্মনির ভিতরে-বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শতাধিক বৎসর ধরে যে হাইনের খ্যাতি অদ্যাবধি ক্রমবর্ধমান, নবজাতকসম অম্লান পদদলিত প্রণয় নিবেদনের মর্মদাহ সরলতম ভাষায় প্রকাশ করতে আজও যার সমকক্ষ কেউ নেই, অনুভূতির ভুবনে তাঁকে প্রবঞ্চিত করতে পারবে কোন কৃত্রিম আত্মম্ভরিত্বের প্রতিষ্ঠান! ইহুদিদের এসব প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি ছিল, তারা জেহোভার নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানবসন্তান, তাদের প্রাচীন কীর্তির কাছে কি মিশর কি ব্যাবিলন বিশেষ করে গইম (অ-ইহুদি তুচ্ছার্থে, যে রকম আমাদের ভাষায় অনার্য-কাফের প্রভৃতি শব্দ আছে) গ্রিক-রোমান-ভারতীয় আর্য সভ্যতা দুগ্ধপোষ্য শিশুবৎ এবং সবচেয়ে মোক্ষমতম তত্ত্ব তাদের মসিয়া (আরবিতে মসিহ মাহদি অর্থে) একদিন ধরাতলে অবতীর্ণ হয়ে জেহোভার এই নির্বাচিত সন্তানদের চিরকালের তরে ত্রিভুবনেশ্বর করে দেবেন–গইমদের আর কোনও ভরসা থাকবে না। বলা বাহুল্য, এ ধরনের মিথ্যার সাবান দিয়ে তৈরি ভাবালু ভাপে-ভরা বুদ্বুদ হাইনেকে বিরক্ত, হয়তো-বা ক্রুদ্ধ অতিষ্ঠ করে তোলে। কয়েক মাস যেতে না যেতেই তিনি এদের সংস্রব চিরতরে বর্জন করেন। এই হাইনের আশীর্বাদ লাভের জন্য তার চেয়ে একুশ বছরের ছোট কার্ল মার্কস বিলেত থেকে প্যারিসে তীর্থযাত্রা করেন, এ হাইনের নামে স্বয়ং কাইজার পর্যন্ত শঙ্কিত হতেন। প্রতি নববর্ষে এ হাইনের নির্বাসনদণ্ড মোহককম করতেন স্বহস্তে। গরিব-দুঃখীর জন্য তার লড়াই কাইজারের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার আজীবন আমৃত্যু সগ্রাম– প্রথম যৌবন থেকে এ হাইনেকে, অতিশয় মাতৃভক্ত এই পুত্রকে, মাকে ছেড়ে দূর বিদেশের নির্বাসনে সমস্ত জীবন কাটাতে হয়, মৃত্যুবরণ করতে হয় প্যারিসে।
একেই বলি যথার্থ ইহুদি। তিনি আল্লার স্বহস্তে নির্বাচিত মহাত্মা- জেহোভা তাকে নির্বাচন করুন আর না-ই করুন। কোথায় লাগেন স্বয়ং মেটারনিষ তাঁর পাশে মেটারনিষের পরোক্ষ ভাবার্থে শিষ্য কিসিংগার, তিনি তারও কত অতল তলে! অবশ্য এটাও তর্কাতীত নয়, সাক্ষাৎ মোলাকাৎ হলে মেটারনিষ তাকে গ্রহণ করতেন কি না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, প্রথম যৌবনে, কাব্যলোকে যখন তিনি প্রথম ভীরু মৃদু পদক্ষেপে অবতরণ করছেন তখন হাইনে পড়ে তার চারটি কবিতা বাংলাতে অনুবাদ করেন। সেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভূমিতে গোরা রায়দের তাণ্ডবনৃত্যের খবর পেয়ে একদা লিখেছিলেন,
টুটলো কত বিজয়তেরণ
লুটোলো প্রাসাদ চূড়ো
কত রাজার কত গারদ
ধুলোয় হল গুঁড়ো।
আলিপুরের জেলখানাও
মিলিয়ে যাবে যবে
ভাবিস তোরা কিসিংগারী
ধাপ্পা তবু রবে!
দু কান ছুঁয়ে অপরাধ স্বীকার করছি কিসিংগারি অংশটুকুতে ইহুদি-বৈরী হিটলারের ভূত আমার হাত দিয়ে তামাক খেয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই সুবাদে একটি সত্য স্পষ্টভাষায় না বললে আমার মতো বাঙালি মুসলমানদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমি ইহুদি-বৈরী নই। ইহুদিদের নবী মুসা, নূহ আমারও নবী। নবী দাউদের বংশে জন্ম হজরত ঈসা মসীহকে আমি রূহুল্লা বলে স্বীকার করি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি একাধিক সুপণ্ডিত সহৃদয় ইহুদির কাছে তওরিত– হিব্রুতে তোওরা অধ্যয়ন করেছি, যদিও আমি সম্পূর্ণ সচেতন যে, প্রচুর প্রক্ষিপ্তাংশের দরুন তওরিৎ পরবর্তী যুগের কসুল উল আম্বিয়ারই মতো প্রামাণিক গ্রন্থ। খ্রিস্টানদের মতো আমি ইহুদিকুলকে বংশানুক্রমে চিরতরে ইল্লা বিল কিয়ামা কিয়ামত অবধি শয়তাগ্রস্ত অভিশপ্ত বলে মোটেই স্বীকার করিনি। পক্ষান্তরে আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস ইজরায়েল রাষ্ট্র অভিশপ্ত। গৃহহারা আরবদের তারা কস্মিনকালেও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে দেবে না বলে তারা চিরতরে অভিশপ্ত। বৈজ্ঞানিক হিসেবে আলবার্ট আইনস্টাইন ধন্য, কিন্তু মাতৃভূমি থেকে আরব বিতাড়নকারী, ইজরায়েল রাষ্ট্রের সমর্থকরূপে শেষবিচারের দিনে আল্লার সামনে তাকে দাঁড়াতে হবে।
নিক্সনরূপী বিরাট রসাল কিংবা ওক অবলম্বন করে অতি অল্পকালের মধ্যেই কিসিংগাররূপী লতা– স্বর্ণলতার স্বর্ণটা উপস্থিত বাদ দিলুম, মগডাল অবধি চড়েছেন। লা ফতেনের লতার মতো তার আচরণে বড়-ফাটাই ধরা পড়বে কি না, এখনও বলা যায় না। ইতোমধ্যে যদিও, যে কোনও কারণেই হোক (আমার বিশ্বাস, কারণ সন্ধানে বেশি দূর যেতে হবে না; ইহুদি কিসিংগার অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে যে বৃক্ষটি জড়িয়ে ধরতে পেরেছেন, সেটা যেন লতাসুদ্ধ মড়মড়িয়ে খুঁড়িয়ে না যায়, তার জন্য কুল্লে দুনিয়ার সাকুল্যে ইহুদি ব্যাঙ্কার প্রতিপক্ষকে খানিকটে মোলায়েম করে তুলে এনেছেন) নিক্সন দু দণ্ডের তরে দম ফেলার ফুরসত পেয়েই প্রতিপক্ষকে কটুকাটব্য ঝাড়তে আরম্ভ করেছেন, তবু ভবিষ্যত্বাণী করাতে সিদ্ধহস্ত এক মার্কিন কাগজ বলছেন, হোয়াইট হাউসের ভিতর নিক্সন যতই হাইজাম্প লংজাম্প মারুন, বাইরের ভুবনে এখনও বিস্তর মারাত্মক সব মাইন-বাঁধা ফাঁদ পাতা রয়েছে; তার পিঠ পিঠ সুপ্রিম কোর্ট যদি শেষ আদেশ দেয় এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাগনোকেও যদি অসম্মানে বিদায় নিতে হয়, তবে নিক্সনের অবস্থা হবে পূর্ববৎ–সেই ফাটাবাশের মধ্যিখানে এক-ঘরে অবস্থায়। পত্রিকাখানি আখেরি বিভীষিকা দেখিয়ে বলেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত নিক্সনকে করতে হবে শেষ সর্বনাশা (ফেটফুল) পদক্ষেপ। তখন কি ইহুদি-নন্দন কিসিংগার প্রাক্তন লাট মালেকের কায়দায় হনুমানি লক্ষে আরেকটা রসাল জাবড়ে ধরতে পারবেন?
কিন্তু আসল প্রশ্ন, অদূর ভবিষ্যতে যাই হোক, যা-ই থাক, কিসিংগার কোন পথ নেবেন? ইজরায়েল নামক অতল গহ্বরে তার বুদ্ধিতে ভালো করতে গিয়ে ইহুদিকুলকে শেষ ধাক্কা দিয়ে বিনাশ করবেন, না হাইনের সদৃষ্টান্ত অনুসরণ করে শূন্যে আলোকলতার মতো দোদুল্যমান হৃদয়তাপে ভরা ইজরায়েলি রাষ্ট্রের ফানুসটাকে ফাটিয়ে দিয়ে তার স্বজাতি ইহুদি কওমকে বাঁচাতে সক্ষম হবেন? তা যদি না পারেন– বিরাট বসুন্ধরায়, আল্লার কুশাদা দুনিয়ার নিরীহজনকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ না করলেও বিশ্বইহুদির উমদাগুঞ্জাইস হয়– তবে তিনি হাইনের খ্যাতিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। হজরত মুসা যে রকম একটা ইহুদি কওমের ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
***
একটা মজাদার দিলচসপ সার্কাসের ক্লাউন ঢঙের খবর পাঠককে না জানিয়ে লেখাটা শেষ করতে পারছিনে। যারা জানেন তারা অপরাধ নেবেন না। তেসরা রমজানের সেহরির সময় বেতার নাড়াতেই হঠাৎ শুনি সিলেটি বাংলা উচ্চারণ মোটামুটি ভালোই, খবর দিচ্ছে মি. ভুট্টোর দিগ্বিজয় বাবদ। তার পর সালঙ্কার সবিস্তর বয়ান দিলে, যেসব বাঙালি পাকিস্তান থেকে শিগগিরই বাংলাদেশ ফিরে যাবেন তাদের কেনাকাটা সম্বন্ধে তারা খবর পেয়েছেন বাংলাদেশে সব মাল বড্ড আক্রা, ইন্ডিয়ার আমদানি মাল বড্ড নিরেস।
ঠিক এই ধরনের ব্রডকাস্ট করা হয়েছিল ৭১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে, বিলাতবাসী সিলেটিদের জন্য। উদ্দেশ্যটা চটসে বোঝা যেত যদিও সেটা কামুফ্লাজের চেষ্টা জোরসে করা হয়েছিল, ভাই বিলেতবাসী সিলেটুটিগণ, পূর্ব পাকের সর্বত্র পরিপূর্ণ সালামত। তোমরা আত্মীয়স্বজনকে যে টাকা পাঠাও সেটা বন্ধ কর না। সরকারের জরিয়ায় পাঠিয়ে কিন্তু। এই শেষটাই ছিল আসল মতলব। আমি অবশ্য স্থানাভাববশত অতি সংক্ষেপে সারছি।
এবারে মতলব দুটো : যুদ্ধবন্দিদের বিচার করে কী হবে? এই তো বাঙালিরা ফিরে যাচ্ছে দেশে। বউ-বাচ্চার সঙ্গে মিলিত হবে। ওই বন্দিদেরই-বা আটকে রেখেছ কেন, তাদের কি বউ-বাচ্চা নেই? দ্বিতীয়, ভুট্টো সাব চান, বাংলাদেশের সঙ্গে দোস্তি করতে। পুরনো কথা ভুলে যাওয়াই ভালো। দুই দেশে দোস্তি হলে উপকার উভয়ত : গয়রহ গয়রহ।
তোলা হল না একটি কথা : কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে স্পিকটি নট, নট কিচ্ছ। ভারি মজার প্রপাগান্ডা। রসে টইটম্বুর। বারান্তরে হবে।
.
লন্ডনি স্বীকৃত বাংলাদেশ?
রাত পৌনে তিনটে থেকে সোয়া তিনটে অবধি সিলেটি ভাষায় পাক বেতার বিলেতবাসী সিলেটিদের জন্য প্রোগ্রাম দেয়। দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে। নিজেদের নামও বলেছে তারা, আমার মনে নেই। আমি বাড়িয়ে বলছিনে, কিন্তু মনে হল, তাদের কণ্ঠস্বর বড়ই প্রাণহীন। ১৯৭১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে যারা এই প্রোগ্রামটি আঞ্জাম করত তাদের বেশ দু তিনজন গাঁক গাঁক করে হুঙ্কার ছাড়ত, কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাসের স্পষ্ট আভাস থাকত। বেচারিরা জানত না, তাদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। ঠিক মনে নেই, ষোল-সতেরো ডিসেম্বরে সে প্রোগ্রাম উঠে গেল। ওদের সম্বন্ধে একটা কথা কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়। ওরা প্রতিদিন নিজেদের সিলেটি সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছিল এবং খাঁটি সিলেটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। যেমন, প্রথম দিন প্রোগ্রাম পরিচিতির সময় শেষ দফায় বললে, সর্বশেষ সিলেট থেকে যারা আপন আপন আত্মীয়-স্বজনকে খবর পাঠাবেন, সেগুলো আপনারা শুনতে পাবেন। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন সমাসটি আমরা বড়ই শাজবাজ ব্যবহার করি। পরের দিন ঘোষক আত্মীয়-স্বজনের পরিবর্তে বললে ভাই-বরাদর। আমি মনে মনে বললাম, লেড়কার তরক্তি অইছে। মাশাআল্লা। পরের দিন ছোকরা একেবারে বন্দর-বাজারের চৌকে পৌঁছে গেল। বললে, খেশ-কুটুমর লগে মাতিবা। আমি ফাল দিয়ে উঠে বললুম, সাবাশ! ঔতত বেটার চাকু মারি দিচ্ছে। পাঠক হয়তো তপ্ত-গরম হয়ে খাট্টা গেরাবি দেবেন, তুমি তো বড় বইতল মশায়! বাংলাদেশের খেলাফে আজেবাজে বকছে, আর তুমি বলছ, সাবাশ! আহা আমি ভাষাটার কথা বলছি, তার বক্তব্যের কিতাবের টেকনিক্যাল পরিভাষায় যাকে বলি মন, সেটার তারিফ করতে যাব কেন? সেটা তো গাছে আর মাছে ভূমা বন্দর-বাজারি গফ। তা সে যাকগে, এর পরের প্রস্তাব পাড়ার পূর্বে, ইতোমধ্যে পূর্বোক্ত গেরাবি শব্দটি খাস সিলেট-নাগরিক ভিন্ন অন্য সিলেটি এবং আর পাঁচজন আঞ্চলিক ভাষানুসন্ধানীজনকে বুঝিয়ে দিই। টিপ্পনী কাটা, গহার বা বাগার দেওয়া, ঘটিদের ফোড়ন দেওয়া আর গেরাবি দেওয়া এই ইডিয়ম। সিলেট শহরের আশেপাশে যখন ইংরেজ ম্যানেজারদের চা-বাগিচা বসল তখন বাবুর্চি-খানসামারা মেমসায়েবদের কাছে মাছ-গোস্তর মাখো মাখো ঝোল-এর পরিভাষা ঘেভি শব্দটা শিখল। তার থেকে গেরাবি। আমার জানামতে এরকম আরও গোটা ছয় ইংরেজি শব্দ সোজাসুজি সিলেটিতে ঢুকেছে। এই ধরনের একটি ভারি মজাদার শব্দের সঙ্গে সেদিন পরিচয় হল, চাটগাঁয়ের আঞ্চলিক ভাষাতে অন্তিম্যান শব্দটি প্রথমদর্শনে মনে ভীতির সঞ্চার করে। জীবনের অন্তি অবস্থা অন্তিম মান বুঝি এসে গেল! প্রখ্যাত সাহিত্যিক, আমাদের পথপ্রদর্শক মহবুবুল আলমের ভ্রাতা ওহীদুল আলম সাহেবের উস্কৃষ্ট গ্রন্থ পৃথিবীর পথিক-এর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে মমাগ্রজ মূর্তজা সাহেব আমাকে অভয় দিয়ে ছাপার হরফে লিখেছেন, অন্তিম্যান হ্যান্ডনোটের অন ডিমান্ড উক্তি থেকে এসেছে।
পাছে বিলাতবাসী সিলেটিদের (এদের সিলেটবাসীরা লন্ডনি নাম দিয়েছেন) পূর্বোক্ত শব্দ-সঙ্কটে ত্রাসের সঞ্চার হয়, তাই করাচির সিলেটি অনুষ্ঠানে ঘোষক, অনুবাদক বিকট বিকট ইংরেজি শব্দ আদৌ অনুবাদ করেননি। যেমন প্রটোকল, এটমিক এনার্জি কমিশন ইত্যাদি। কিন্তু কারখানা অর্থে প্লান্ট (মার্কিনি উচ্চারণে প্ল্যান্ট) কেন যে অনুবাদ করলেন না, বোঝা গেল না। ওদিকে জনগণ (আমরা বলি পাঁচজন, পাজ্জন), কন্যা (বান, ছয়লাব), ফসল ক্ষতিগ্রস্ত অইছে (আমরা বলি ফসলার লুকসান অইছে) এবং সবচেয়ে মজার– সিলেটি মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য সংবাদ-পাঠক বললেন মাদাউকুর ভোজ। মাদাউকুর খানা, দাওৎ বা জিয়াফত আমরা প্রায়ই বলে থাকি, আর এ স্থলে এটা আজিজ আহমদের দেওয়া দাওই ছিল– তাই মাদাউকুর ভোজ-এর মতো বিজাংগা গুরুচণ্ডালী একমাত্র করাচিতেই সুলভ।…পত্র-লেখকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘোষক ঠিকানা দিলেন পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান তো কবে মরে গিয়েছে। মৃতদেহ নিয়ে সহবাস করার একটা গল্প মোপাস লিখেছেন বটে! প্রেতাত্মা নিয়ে লিখে আমি নোবেল প্রাইজ পাব, নির্ঘাৎ।
রেকর্ড সঙ্গীতে কাফিরি কীর্তন-সুরে উদ্গীত বাজানো হল। সে এক অদ্ভুত ভুতুড়ে রসের অবতারণায় কুল্লে ঘরটা যেন ছিমছিম, মাথাটা তাজ্জিম-মাজ্জিম করতে লাগল।
আল্লা জানেন, আমি সিলেটি প্রোগ্রামের এই তিনটি প্রাণীকে নিয়ে মস্করা করছিনে। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, এরা যেন অতিশয় অনিচ্ছায় একটা অপ্রিয় কর্ম করে যাচ্ছেন এবং বার বার আমার মনটা বিকল হয়ে যাচ্ছিল। বেচারিরা! এত শত লোক দেশে ফিরে আসছে, এরা চলে আসে না কেন? হয়তো বাধা আছে।
.
ঢাকায় জনাব ভুট্টোর
আসন্ন শুভাগমন
কিন্তু পাঠক, মাত্রাধিক বিষণ্ণ হবেন না। আপনাদের জন্য একটি খুশ-খবর কোনও গতিকে জিইয়ে রেখেছি। যারা রীতিমতো পাক বেতার শুনে থাকেন, তারাও একই খবর শোনার আনন্দ দু বার করে পাবেন, বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একখানা বাকিরখানি খেলে যে রকম দু খানি খাওয়া হয়। পাকিস্তান থেকে যখন একদল বাঙালি দেশে ফেরার জন্য প্লেনে উঠছেন তখন মি. ভুট্টো তাদের উদ্দেশে উর্দুতে একটি ভাষণ দেন। নানাবিধ মূল্যবান তত্ত্বদানের পর মি. ভুট্টো বলেন, আপনাদের সঙ্গে ফের দেখা হবে। করাচিতে, লাহোরে কিংবা ঢাকা বা চাটগাঁয়।
যাদের মস্তিষ্ক উর্বর তারা তো সঙ্গে সঙ্গে বহুবিধ চিন্তাসূত্রের সম্মুখে দিশেহারা হয়ে যাবেন, কোনওটারই খেই ধরতে পারবেন না। আমার সে ভয় নেই। আমি ভাবছি মি. ভুট্টো কি বাংলাদেশ জয় করে ঢাকা-চাটগাঁয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন, না দুই দেশে রাতারাতি এমনই দহরম-মহরম হয়ে যাবে যে আমরা হরদম পিকনিক উইক-এন্ড করার জন্য ক্ষণে লাহোর ক্ষণে পিণ্ডি যাব, কনসেশন রেটে গিয়ে হব স্টেট গেস্ট! অবশ্য এটা লক্ষণীয়, মি. ভুট্টো কুয়েটা বা পেশাওয়ারে মোলাকাত হবে এ কথাটা বলেননি। বাংলাদেশ হাতছাড়া হওয়ার পর বেলুচ এবং পাঠান মুলুক এখন লাহোরের পাঞ্জাবিদের এবং করাচির খোঁজা-বোরা-সিন্ধিদের কলোনি হয়ে গিয়েছে- দুষ্ট লোকে এমন কথাও কয়। বাঙালিকে ওসব দেখানো দুলহাভাইকে তালই সাহেবের বাড়ি দেখানোরই শামিল।
.
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল
(১) সকলেই জানেন ওয়াটারগেটের জল যখন ডেনজার লেভেলে চড়েছিল তখন নিক্সন বলতে গেলে একরকম পর্দানশিন হারেমবাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর তিনি হঠাৎ বেরিয়ে এসে এমনই কর্মকীর্তি আরম্ভ করলেন যে, আমেরিকার যেসব তালেবর পত্রিকা গণ্ডায় গণ্ডায় নামে রিপোর্টার কাম ডিটেকটিভ মোটা মোটা তখমা দিয়ে পোষে তারা পর্যন্ত হদিস পায়নি, এখনও পাচ্ছে না।
(২) এমন সময় আরও একটা মারাত্মক কেলেঙ্কারির কেচ্ছা বেরিয়ে পড়ল। স্বয়ং নিক্সন কর্তৃক মনোনীত তার ভাইস প্রেসিডেন্ট (সংক্ষেপে ভিপ) অ্যাগনো সরকারি উকিলের নোটিশ পেলেন, তার বিরুদ্ধে ঘুষ মেহেরবানি করে দেওয়া কন্ট্রাকটের কমিশন গ্রহণ, খাদ্য-মদ্যাদির নিয়মিত ভেট গ্রহণ- এককথায় দুর্নীতির জন্য মোকদ্দমা দায়ের করা হবে। নিক্সন তিপকে এক ঘণ্টা ধরে ধস্তাধস্তি করলেন, তিনি যেন রিজাইন দেন। নিন্দুক বলে, ভিপকে কাবু করার জন্য নিক্সনের খাস-দফতরের নাকি কারসাজি আছে এবং আসলে তিনি নাকি অ্যাগনোকে দেখিয়ে একজন বড় মানুষকে ভিপ বানিয়ে আনতে চান, যে তার হয়ে ওয়াটারগেট মামলা যদি নিতান্তই খারাপের দিকে বেয়াড়া গুডিডর মতো মুণ্ড খেতে থাকে তবে–জব্বর লড়াই দেবে। সেই লোভে ইতোমধ্যেই নিক্সনের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক আঁদরেল চাই শিঙ ভেঙে রিপাবলিকান দলে ভিড়ে যত্রতত্র চেল্লাচেল্পি আরম্ভ করেছেন, টেপ দেওয়া না দেওয়ার পুরো এখতেয়ার একমাত্র প্রেসিডেন্টের।
(৩) এতদিন কিসিংগার থাকতেন নেপথ্যে। কিন্তু একদিন কংগ্রেসের সামনে নিক্সনের ফরেন মিনিস্টারকে দিতে হয় সাফাই। অতএব তাঁকে দাঁড় করানো হল কাঠগড়ায়। ওদিকে তিনি যে তার বন্ধু।
.
অভিশপ্ত ফলস্তিন
চল্লিশ বত্সর পূর্বে মিশরের আলআজহারে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন ফলস্তিন দেখতে যাই। তাই বলে নয়, এমনিতেই ভবঘুরে বলে আমার একটা বদনাম আছে। শতাধিকবার আমি এই অবিচারের বিরুদ্ধে যতবার দেমাতি প্রকাশ করেছি পাঠক-সাধারণ ততই মুচকি হেসে, দ্বিগুণ উৎসাহে, আমাকে ভবঘুরেমি থেকে বাউণ্ডুলে পদে প্রমোশন দিয়েছেন। তবু শেষবারের মতো, আবার বলে নিই, যে-কোনও প্রকারের স্থান পরিবর্তন শারীরিক নড়নচড়ন আমার দু চোখের দুশমন। কট্টর মরণ-বাচন সমস্যা দেখা না দিলে আমি বারান্দা থেকে রক-এ পর্যন্ত রোলস-এ চড়েও যেতে রাজি হই না। বিছানা থেকে গোসলখানায় যাবার তরে জনকল্যাণ সরকারকে একটা বাস সার্ভিস খুলতে সকরুণ দরখাস্ত পাঠিয়েছি।
অপিচ, মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করব, ফলস্তিন গিয়েছিলাম সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় সোৎসাহে। অবশ্যই, লাঞ্ছিত পদদলিত আরবদের দুরবস্থা দেখবার জন্য নয়। তখনও সে দুর্দিনের ঝড়-তুফান আরম্ভ হয়নি। কিন্তু তার ইতিহাস আমি পাঠকের ওপর এখন চাপাতে চাইনে। ওপার বাংলায় একবার চেষ্টা দিয়েছিলুম আমি আর প্রুফরিডার ছাড়া সে সিরিজ কেউ পড়েনি।
ফলস্তিনের দুর্দশার জন্য দায়ী কে?
ইহুদিদের চেয়ে আরবদের মুসলমানদের আমি দোষ দি বেশি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইংরেজও ইহুদিদের পালৈ পালে ফলস্তিনে আসতে দেয়নি। বস্তুত হজরত ওমরের আমল থেকে শেষ তুর্কি খলিফার রাজত্ব অবধি সবসময়ই কিছু কিছু ইহুদি, এমনকি জার-আমলে রুশ ইহুদিও পুণ্যভূমিতে এসে বাসা বেঁধেছে। তারা ছিল গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। আরবদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, তাদেরই মতো দু পয়সা কামিয়ে দুঃখে-সুখে দিন কাটিয়েছে। কালক্রমে তাদের মাতৃভাষাও হয়ে গেল আরবি। সঙ্কীর্ণ হলেও আরবি সাহিত্যে তাদের স্থান আছে।
.
চাষার সর্বনাশ
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যারা এল তারা সঙ্গে নিয়ে এল অফুরন্ত অর্থভাণ্ডার। যুদ্ধের সময় সারা বিশ্বজুড়ে ইহুদি সম্প্রদায় জেনে গিয়েছিল মিত্রশক্তি পুণ্যভূমি ফলস্তিন তাদের হাতে সঁপে দেবেন, তারা সেখানে, পাক্কা দু হাজার বছর নানাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর আবার জেহোভার জায়নের নবীন রাষ্ট্র নির্মাণ করবে। প্রকৃতপক্ষে মিত্রশক্তি কিন্তু আদপেই ইহুদি রাষ্ট্র নির্মাণের কোনও ওয়াদা কাউকে দেয়নি। তারা বলেছিল ইহুদিরা গড়ে তুলবে জুয়িশ ন্যাশনাল হোম- এবং এই হোম কথাটার ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছিল বার বার। কিন্তু ইহুদিরা সেটা জেনেশুনেও প্রচার চালাল সেটাকে রাষ্ট্র নাম দিয়ে। সেই রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য যে কী পরিমাণ অর্থ, পরবর্তীকালে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হয়েছিল সেটার চিন্তামাত্র করা ডাঙ্গর ডাঙ্গর ব্যাঙ্কার মহাজনদেরও কল্পনার বাইরে।
ফলস্তিন কাঠ-খোটা দেশ বটে কিন্তু সে দেশের নায়েবরা গরিব চাষা-তুষোদের লহু ফোঁটায় ফোঁটায় শুষে নেবার তরে যে কায়দাকেতা জানে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে শাইলকের চেয়েও ধড়িবাজ ইহুদি সম্প্রদায়। ওদিকে নায়েবদের হাতে সবকিছু সঁপে দিয়ে জমিদাররা ফুর্তি করতেন মধ্যপ্রাচ্যের মন্তে-কালো, বিলাস-ব্যসনের হুরীস্তান বেইরুতে। মদ্য মৈথুনের ব্যবস্থা সেখানে অত্যুত্তম এবং জুয়োর কাসিনোতে এক রাতে যুধিষ্ঠিরের চেয়েও বেশি সব হারানো যায়। কাইরো ইন্দরিয়াও এসব বাবদে সে আমলে খুব একটা কম যেতেন না। এসব বিলাসের কেন্দ্রে লেগে গেল জমিদারি বেচার হরিনট। ইহুদিরা ধীরে ধীরে কিনে নিল কখনও সোজাসুজি, কখনও বেনামিতে ফলস্তিনের বিস্তর জমিজমা।
সে দেশের একাধিক যুবক আমাকে পই পই করে বোঝালেন, না, প্রজাস্বত্ব আইন-ফাইন ওসব দেশে কস্মিনকালেও ছিল না। থাক আর না-ই থাক, প্রচুর জমি-জমা চলে গেল ইহুদিদের হাতে বিস্তর আরবদের করা হল উচ্ছেদ। সেই পরিমাণে বয়তুল মকুদ্দসে (সংক্ষেপে কুদস, চালু উচ্চারণে উদস), অর্থাৎ জেরুজালেমে বাড়তে লাগল ভিখিরির সংখ্যা।
.
আরবদের অনৈক্য ইহুদির প্রধান অস্ত্র
কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে একদিন অবস্থা এমন চরমে গিয়ে দাঁড়াল যে ফলস্তিনকে দু ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগে ইহুদি ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল, সেটা সবিস্তর বলার কণামাত্র প্রয়োজন এ স্থলে নেই। ইহুদির হাতে আছে কড়ি, তদুপরি আছে দুর্নীতিতে পাজির পা-ঝাড়া ফলস্তিনের ভিতরে-বাইরে আরব নেতারা।
এক নিগ্রো বলেছিল, গোরারায়রা যখন আমাদের দেশে এল, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমি। আজ জমি ওদের, বাইবেল আমাদের হাতে।
ফলস্তিনের মুসলিম চাষা ইহুদিদের কাছ থেকে তৌরিত তালুমুদ চায়নি, পায়নি। চাইলেও পেত না। কারণ বহুযুগ হল, ইহুদিরা দীক্ষা দিয়ে বিধর্মীকে আর আপন ধর্মে গ্রহণ করে না। আরবদের দীক্ষা দিলে আরেক বিপদ। স্বধর্মে নবদীক্ষিত জনকে তো চট করে তার বাস্তুভিটে থেকে তাড়ানো যায় না। আফ্রিকায় গোরারায়রা ধর্মের বদলে লব্ধ জমির খাজনা নিয়েই ছিল সন্তুষ্ট; নিগ্রোদের উচ্ছেদ করে সেখানে বিলিতি চাষা বসাতে চায়নি। ইহুদিরা কিন্তু চায় জমিটার দখল। ১৯৭১-এ পাঞ্জাবিরাও এ দেশে বলত, জমিন চাইয়ে। আদমি মর যায় তো ক্যা!
তখনও ঠেকানো যেত ইহুদিদের। আরব রাষ্ট্রগুলো যদি গৃহ-কলহ ভুলে গিয়ে একজোট হত। তারস্বরে প্রতিবাদ করেছে তারা, কিন্তু তার অধিকাংশই ছিল ফাপা, মিথ্যা, ভণ্ডামি।
আমাকে যদি জিগ্যেস করেন, ওহে ভবঘুরে, এ দুনিয়ার সবচেয়ে তাজ্জব তিলিসমাৎ কি দেখেছ? আমি এক লহমার তরেও চিন্তা না করে বলব, এই আরব জাতটা! ইরাক থেকে আরম্ভ করে ওই বহুদূর সুদূর মরক্কো অবধি বাস করে আরব জাত– অবশ্য সর্বত্রই কিছু না কিছু সংমিশ্রণ হয়েছে (পৃথিবীতে অমিশ্র জাত আছে কোথায়?)। এই আরবদের দেহে আরব রক্ত, এদের ভাষা আরবি, এদের ধর্ম ইসলাম। মিলনের জন্য যে তিনটে সর্বপ্রধান গুরুত্বব্যঞ্জক বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন সে তিনটেই তাদের আছে। অথচ খুদায় মালুম, তারা আজ কটা রাষ্ট্রে বিভক্ত। এবং সেইখানেই কি শেষ? মাশাল্লা, সুবানাল্লা- বালাই দূরে যাক! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের তাড়নায় তারা এখনও যা প্রাণঘাতী কলহে লিপ্ত হয়, ভবঘুরে আমি কোথাও দেখিনি, পুস্তক-কীট আমি, কোথাও পড়িনি।
আর বাইরের শত্রু-মিত্রের কথা যদি তোলেন তবে সক্কলের পয়লা স্মরণে আসেন ইহুদিশ্রেষ্ঠ হের হাইনরিষ আলফ্রেড কিসিংগার। একদা নবী মুসা নিপীড়িত ইহুদিদের রক্ষা করেছিলেন জালিম মিসরিদের হাত থেকে। ইনিও এ যুগে সেই খ্যাতি অর্জন করবেন–তবে কি না, এবার বাঁচানো হবে জালিমকে মিসরিদের হাত থেকে
.
গয়নীতি
ইংরেজ এই উপমহাদেশের ক্ষয়ক্ষতি করছে বিস্তর, একথা বলা যেমন সত্য ঠিক তেমনি এ কথাটাও সত্য যে তারা আমাদের অল্পবিস্তর উপকারও করেছে। কিন্তু অপকারের দফে দফে বয়ান দেবার সময় একথা কখনও বলা চলবে না, তারা আমাদের চাষাভুষোদের উচ্ছেদ করে সেখানে আপন জাত-ভাই গোরারায়দের বসবার চেষ্টা করছে, কিংবা এ রকম কোনও একটা কুমতলব তাদের ছিল। এ দেশে হিন্দু-মুসলমান জমিদারে ঝগড়া-কাজিয়া হয়েছে প্রচুর, কিন্তু মুসলমান চাষাদের পাইকিরি হিসেবে ঝেটিয়ে হিন্দু জমিদার তার জাত-ভাই হিন্দু চাষাকে পালে পালে পত্তনি দিয়েছে, এমনতরো বার্তা কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না এবং তার উল্টোটাও না। যদিস্যাৎ কালেকস্মিনে হয়ে থাকে তবে সেটা নিতান্তই ব্যত্যয়।
কিন্তু ইহুদিকুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যেদিন থেকে ফলস্তিনে আসা আরম্ভ করল সেদিন থেকেই তাদের পুরো পাক্কা প্ল্যান ছিল, এ দেশে তাদের কর্মপদ্ধতিটা হবে কী প্রকারের। একদিনে না, এক বৎসরে না, ধীরে ধীরে কিন্তু মোক্ষম ঘা মেরে মেরে, উঁচ হয়ে ঢুকবে এবং ফাল হয়ে বেরুবে। না, ফাল হয়ে সেখানে আস্তানা গাড়বে। সেই মর্মে স্থির করা ছিল :
(১) হোম-ফোম ওসব বাজে কথা নয়। সম্মুখে রাখতে হবে ধ্রুব উদ্দেশ্য– এ দেশে গড়ে তুলতে হবে একটি সর্বাধিকারসম্পন্ন, সর্বার্থে স্বাধীন পরিপূর্ণ রাষ্ট্র। এবং সে রাষ্ট্র হবে বিশুদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র। সম্পূর্ণ গয়-বর্জিত। পাঠকের উপকারার্থে নিবেদন, ইহুদিদের প্রচলিত ভাষায় ইহুদি ভিন্ন এ দুনিয়ার কুল্লে নরনারীকে গয় শব্দের মারফত পরিচয় দেওয়া হয়। কট্টর ধর্মান্ধ ইহুদির কাছে সব গয় বরাবর। সাধু-পাষণ্ডে, নিষ্ঠুর-সদয়ে, চোর-পুলিশে, ডাকাত-ফাঁসুড়েতে কোনও তফাৎ নেই। আমরাও শাজ-বাজ কাফির শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু অমুসলমান মাত্রই কাফির, এদের ভিতর ভালো-মন্দে কোনও তফাৎ নেই, এ রকম একটা আজগুবি তত্ত্ব কেউ এ যাবত প্রচার করেননি। তদুপরি গয় শব্দের সঙ্গে যে পাশবিক ঘৃণা মেশানো থাকে, কাফির শব্দের চতুর্দশ পুরুষ তার গা ঘেঁষতে পারবে না।
(২) রাষ্ট্রকে গয়-মুক্ত করার জন্য সর্ব আচরণ বৈধ। জনৈক ইহুদি সজ্জনই একখানি প্রামাণিক পুস্তিকা লিখে ইহুদি তথা বিশ্বজনের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখান, হিটলার যে জর্মনিকে ইহুদিমুক্ত করতে চেয়েছিলেন সে শিক্ষা তিনি পান ইহুদিদের কেতাব থেকে। গ্যাস-চেম্বার তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
একথা আমি অতি অবশ্যই বলব না, সে আমলে বা এখনও সব ইহুদিই এসব বিধানে বিশ্বাস করেন। বস্তুত আমার বিস্তর ইহুদি বন্ধু ছিলেন, এখনও আছেন। যাদের প্রতিবেশীরূপে পেলে যে কোনও মুসলিম নিজকে সৌভাগ্যবান মনে করবে। কিন্তু মানুষের বদ-কিস্মাৎ, রাষ্ট্র-নির্মাণ-কর্মে এঁদের ডাক তো পড়েই না, বরং এসব অন্যায় গোঁড়ামি, বিশ্বমানবের প্রতি অশ্রদ্ধাসূচক বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে আপত্তি তুললে তারা হন লাঞ্ছিত-বিড়ম্বিত। সভাস্থল থেকে এঁরা বহিষ্কৃত হন নানাবিধ অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে শুনতে। এ পরিস্থিতি এমন কোনও সৃষ্টিছাড়া অভিনব ঘটনা নয়। প্রভু খ্রিস্টের আমলেও ইহুদিরা চরমপন্থার অনুরক্ত ভক্ত ছিল। প্রতিপক্ষের সঙ্গে আপস করতে কিছুতেই সম্মত হত না। তাই প্রভু খ্রিস্ট তাঁর সর্বপ্রথম ধর্মোপদেশ দানকালে মুখ খুলিয়াই বলেন, ধন্য যাহারা আত্মাতে দীনহীন (অর্থাৎ আপন রূহ-এর গরিবি সম্বন্ধে সবিনয় সচেতন) কারণ তাদেরই নসিবে আছে বেহশত্।
এর পর তার সপ্তম উপদেশেই প্রভু বলছেন তারাই ধন্য, যারা (দুই বৈরী পক্ষের মাঝখানে) শান্তি-সুলেহ নির্মাণ করেন। খ্রিস্টের এ উপদেশে গোটা ইহুদি জাত তাদের মৃত সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে তাঁকে ক্রুশে চড়িয়ে মারে। রোমান গবর্নর তাঁকে বাঁচাবার জন্য কী প্রকারের চেষ্টা দিয়েছিলেন, একটার পর আরেকটা সুলেহ পেশ করছিলেন, মথি-মার্ক ইত্যাদিতে আছে কিন্তু ইহুদি জনতা শুধু চিল্কারের পর চিৎকার করেই চলেছে ক্রুশে মারো। ক্রুশে চড়িয়ে মারো ওকে। সুলেহ মাত্রই তাদের কাছে দুর্বলতার লক্ষণ। সমস্ত ঘটনাটি এমনই নাটকীয় যে এর পুনরাবৃত্তি পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে না।
শেষটায় গবর্নর পিলাতে যখন দেখলেন তিনি তার প্রচেষ্টাতে এক কদমও এগুতে পারছেন না। (হি ওয়াজ নট গেটিং এনিহোয়ার) তিনি একটা ডাবরভর্তি পানি আনিয়ে জনতার সামনে দু হাত ধুয়ে বললেন, এই নির্দোষ সাধু ব্যক্তির রক্তপাতে আমার কোনও কসুর রইল না। উন্মত্ত জনতা চেঁচিয়ে উত্তর দিল, এর লহুর দায় আমাদের ওপর পড়ুক, আমাদের বংশধরদের ওপর পড়ক।
যুগ যুগ ধরে ধর্মোন্মাদ খ্রিস্টান জনতা যখনই ইহুদিদের ওপর নির্মমভাবে খুনখারাবি চালিয়েছে তখনই ব্যঙ্গ করেছে, তোদর পূর্বপুরুষরা কসম খেয়েছিল না, প্রভুর খুনের দায় তোদর ওপর অর্সাবে? এখন আমরা বেকসুর, আমরা মানুষ বলে চাঁচাচ্ছিস কেন?
অথচ আইনত, ঈসা মসিহের শিক্ষার কসম খেয়ে অবশ্যই বলতে হবে, পিতার পাপ পুত্রে অর্সায় না। এরা বেকসুর।
.
বেদরদ প্রাক্তন বাস্তুহারা
১৯৩৪-এ ফলস্তিনে গিয়ে দেখি, বাস্তুহীন, ভিটেহারা, জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত জর্মন ইহুদিরা লেগে গেছে নতুন করে, কিন্তু নীরবে, লক্ষ লক্ষ নয়া ক্রুশ বানাতে। সর্ব প্রকারের আয়োজন চলছে সঙ্গোপনে। উত্তম উত্তম বাস্তু পাওয়ার পরও এরা বিধি-ব্যবস্থা করে যাচ্ছে, লক্ষাধিক বেকসুর আরবদের কী প্রকারে, কত সুলভ পদ্ধতিতে বাস্তুহারা করা যায়।
এইসব মাসুম চাষাভুষোদের সচরাচর আরব বলা হয়, মুসলিম বলা হয়, কিন্তু আসলে বলা উচিত ফলস্তিনি বা ফলস্তিনবাসী। ইহুদিরা মিসরের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে, ফলস্তিনে এসে একে একে যেসব আদিবাসী উপজাতিদের জয় করতে করতে ইহুদি-রাজত্ব বসায়, সেসব আদিম বাসিন্দারা ইহুদিদের ধর্ম গ্রহণ করেনি। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কওমের নাম ছিল ফিলিস্তাইন, তাদের রাজত্বের নাম ছিল ফিলিস্তিয়া। এ রকম আরও ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল অনেক। ফিলিস্তিয়া থেকেই পরবর্তীকালে প্যালেস্টাইন নামের উৎপত্তি। ইহুদিদের ছিল দুটি রাষ্ট্র জুদেয়া ও ইজরায়েল। এবং আজ প্যালেস্টাইন বলতে আমরা যে ভূখণ্ড বুঝি এই দুটি রাষ্ট্র মিলে তার দশ ভাগের এক ভাগও হবে না। সিনাই বা সিনিন কস্মিনকালেও ইহুদি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
মোদ্দা কথা এই : ইহুদিরা ফলস্তিনের আদিমতম বাসিন্দা নয়। আদিম বাসিন্দারা পরবর্তীকালে খ্রিস্টান হয়ে যায় এবং জেনারেল খালিদ সিরিয়া ও ফলস্তিন জয় করার পর ইসলাম গ্রহণ করে। আজ যখন ইহুদিরা ফলস্তিনকে আপন আদি বাসভূমি বলে হক্ক বসিয়ে প্রাচীনতম বাসিন্দাদের তাড়াতে চায়, তবে কালো দ্রাবিড়রা উত্তর ভারত দাবি করে আর্যদের খেদিয়ে দেবার হক্ক ধরে। যে কোনও রেড ইন্ডিয়ান ডক্টর কিসিংগারকে দূর দূর করে আপন দেশ থেকে বের করে দিতে পারে। তার আছে সত্যকার হক্ক।
.
ফি রোজ ঈদ ফি রোজ হালুয়া
জেরুজালেমের সর্বত্র কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। বড় বড় রাস্তার উপর নবাগত ইহুদিরা বসিয়েছে বার্লিন প্যারিস নাইয়র্কি কায়দায় ফেনসি কাফে-রেস্তোরাঁ। আরব ওগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না, তাকালে সে দৃষ্টিতে থাকে ঘৃণা আর ক্ষোভ। এসব ইহুদি রেস্তোরাঁয় খাদ্য-পানীয়ের দাম যে খুব একটা আক্রা তা নয়। খদ্দের ইহুদি, মালিক ইহুদি। এবং প্রায় সব কটাই চলে লোকসানে। তাতে কার কী? সব ইহুদি সাকুল্যে খর্চা, ফুর্তির কড়ি পাচ্ছে মার্কিন জাত-ভাইদের কাছ থেকে। তারা কিন্তু বাস্তু ঘুঘু। ধনদৌলতে ভরা, নৃত্যগৃহ, কাবারে, জুয়োর আড্ডায়, বেশ্যালয়ে আবজাব করছে যে দেশ, সে দেশ ফেলে তারা আসবে কেন এই কাঠখোট্টা প্রাচীনপন্থী প্যালেস্টাইনে পুণ্যভূমি পিতৃভূমি, আব্রাহামের দেশ বলে মুখে মুখে যতই হাই-জাম্প লং-জাম্প মারুক না কেন।
আরব জাত গরিব। তাদের রেস্তোরাঁও গরিব। আমিও গরিব।
ঢুকলুম একটা শামিয়ানা-ঢাকা রেস্তোরাঁতে। সেটা ছিল রোজার মাস। ইফতার আসন্ন। সে যুগে বেতারের খুব একটা প্রচলন হয়নি। তাই রেস্তোরাঁর লাউড স্পিকারে কুরান-পাঠ আসছে,
কাইরো বেতার থেকে, মশহুত্র কারী রেফাতের কণ্ঠে। আমরা আপন দেশে আসর-মগরীবের দরমিয়ান ওয়াক্তে সচরাচর কুরান পড়ি না। এরা দেখলুম, চুপ করে বসে আজান না হওয়া পর্যন্ত তিলাওয়াত শোনাটাই পছন্দ করে। দু চার জন ছোকরা গোছের খদ্দের ফিসফিস করে কথা বলছে। একজন দেখলুম উত্তেজিত মুখে দ্রুতবেগে কী যেন বলে যাচ্ছে আর বার বার খবরের কাগজের উপর আঙ্গুল ঠুকে, খুব সম্ভব তারই বরাত দিচ্ছে। অন্যজনের দৃষ্টি উদাস।
ছেঁড়া, তালি-মারা, জোব্বা পরা গোটা চারেক বয় টেবিলে ইফতার সাজাচ্ছে। একজন এসে ফিসফিস করে শুধাল, খাবে কী? ইতোমধ্যে লক্ষ করেছি, কাইরোর মধ্যবিত্ত শ্রেণির হোটেলে যা-খাওয়া হয়, এখানেও টেবিলে টেবিলে সাজানো হচ্ছে তাই। আমি বললুম, যা ভালো বোঝো তাই।
ইতোমধ্যে একজন জোয়ান গোছের লোক আমার সামনের চেয়ারে খপ করে বসে বয়কে দিল ইশারা। বয় আসতেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললে, সব জিনিসের রেট বাড়িয়েছ তো ফের? বয় ধবধবে সাদা দাঁত দেখিয়ে মুচকি হেসে বলে, না, এফেদ্দম। লোকটা তেড়ে শুধোল, কেন বাড়ালে না? ঠেকাচ্ছে কে? তাই সই। যাব নাকি ইহুদি রেস্তোরাঁয়? আমার গলা থেকে বোধহয় অজানতে অস্ফুট শব্দ বেরিয়েছিল। বোঁ করে চক্কর খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, বাড়বে না দাম নিত্যি নিত্যি! ওই ইহুদি ব্যাটারা মুফতের সোনাদানা ওড়াচ্ছে দু হাতে। ওরা পারে আমাদের সর্বনাশ করতে। আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, ওরা সস্তায় দেয় কী করে?
কী করে? অবাক করলেন এফেদম, ওদের লাভই-বা কী, লোকসানই-বা কী? দোকানি ইহুদি, খদ্দেরও ইহুদি! তার পর যা বললেন সেটা বাংলায় হলে প্রকাশ করতেন একটি প্রবাদ-মারফত : কাকে কাকের মাংস খায় না।
.
ইহুদির দাপট
একাধিকবার পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি ডক্টর হেনরি কিসিংগারের প্রতি। ইনি তখনও যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন মিনিস্টারের পদ লাভ করেননি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও অভাগা বাংলাদেশের লোক তাকে চট করে চিনে যায়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই যখন বিশ্বের সর্ব মিলিটারি ওয়াকিফহাল নিঃসন্দেহে বলতে থাকেন, কয়েকদিনের ভিতরেই নিয়াজি পরাজয় স্বীকার করে ফরমানকে ফরমান লেখবার হুকুম দেবেন, তার পূর্বে এবং পরেও ইসলামাবাদের সর্ব প্রভাবশালী বিদেশি ইলচিরা একবাক্যে বিশ্বজন তথা জুন্তাকে জানান যে, শেখ মুজিব সাহেবকে মুক্তি না দিলে কোনও প্রকারের স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা নেই, তখনও এই মহাপ্রভু কিসিংগার গোপন বৈঠকে একাধিকবার বিরক্তির সঙ্গে বলেছেন, না, না, না। শেখকে মুক্তি দাও, ইয়েহিয়াকে এ ধরনের কোনও সুস্পষ্ট স্পেসিফিক নির্দেশ আমরা দিতে পারব না।
কোনও সুচতুর পদ্ধতিতে এই ইহুদিনন্দন শেষটায় শূন্য-মস্তিষ্ক বুদ্বুরাজ মার্কিনের মাথায় সওয়ার হলেন সে-ইতিহাস দীর্ঘ। উপস্থিত সেটা থাক। কিন্তু একটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো। ইহুদিরা টাকা ও বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয় ঐক্য-শক্তি দ্বারা মার্কিনের মাথায় কভু যে ডাণ্ডা বুলোয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আড়াল থেকে অদৃশ্য সুতো টেনে পুতুল-নাচ নাচায়, সে-তত্ত্বটা দুনিয়ার লোক জানেন না; নিরীহ মার্কিন পদচারীরও কূজনে গুঞ্জনে গন্ধে সন্দেহ। হয় মনে, বিশেষ করে বোটকা গন্ধ থেকে ওটা যেন বড় অক্ষত ইহুদি ইহুদি বদবো-র মতো ঠেকছে। কারণ একটি প্রবাদ অনুযায়ী এ সত্য নির্ধারিত হয়েছে, ফরাসি ও ইহুদিরা নৌকাডুবি ভিন্ন জীবনে কখনও গোসল করে না। সুয়েজ কানালের পাড়েও ইহুদিরা বড়ই অস্বস্তি অনুভব করত– পালাতে পেরে বেঁচেছে।
তা সে যাই হোক, মার্কিন ইহুদিদের তাগত কতখানি প্রচণ্ড সেটা উত্তমরূপে অবগত আছেন মার্কিন রাজনীতিকরা। এডওয়ার্ড কেনেডির প্রতি বাংলা-ভারতের অনেকেই শ্রদ্ধা পোষণ করেন, কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি অকুণ্ঠ ভাষায় এ দেশের স্বাধীনতা স্পৃহার সমর্থন জানিয়ে নিক্সনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। পাঠক শুনে বিস্ময় ও বেদনা বোধ করবেন বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার তিন দিন যেতে না যেতেই সেই কেনেডি, আমার জানা মতে, গয়-দের মধ্যে সর্বপ্রথম মার্কিন সরকারকে অনুরোধ জানান, তাঁরা যেন ইজরায়েলকে যুদ্ধের অ্যারোপ্লেন দিয়ে সাহায্য করেন। তার প্রথম কারণ, তিনিই ইজরায়েলের প্লেন নাশের অবস্থাটা তড়িঘড়ি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় কারণই আসল এবং মোক্ষম। ১৯৭৬-এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি উমেদার, এবং আমার জানামতে, অন্তত এ শতাব্দীতে, ইহুদি-বৈরী কোনও ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কেনেডি বেলাবেলিই ইহুদিদের সন্তুষ্ট করে রাখতে চান।
.
ইজরায়েল! হিসাব দাও!
পাঠক কিন্তু তাই বলে এক লক্ষে হিটলারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে যাবেন না, তামাম মার্কিন মুল্লুক চালাবার কুল্লে কলকাঠি ইহুদিদের হাতে। মোটেই না। ইহুদিকুল শক্তি-উপাসক নয়। তারা করে লক্ষ্মীর উপাসনা। মার্কিন পলিটিকসে তারা শক্তিধর হতে চায় না। যদি কখনও তাদের প্রত্যয় হয়, যে অমুক প্রেসিডেন্ট হলে তাদের টাকা কামাবার পথে কাঁটা হবেন, তবেই তারা কুল্লে ধন-দৌলত দিয়ে সাহায্য করে তার দুশমনকে কিন্তু গোপনে। মাত্র একবার তারা ভুল করে শক্তির পথে নেমেছিল। জাত-ভাইদের জন্য ফলস্তিনে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র গড়ার কুবুদ্ধি তাদের মাথায় ঢোকে, এবং গত পঞ্চাশটি বছর ধরে তারা যে কী পরিমাণ মাল দরিয়ায় ঢেলেছে সেটা জানে একমাত্র তারা আর জানেন জেহোভা। এইবারে তার হিসাব নেবার পালা এসেছে! ম্যাডাম গোল্ড মেইর, মশে দায়ান, আবা এবানের টুটি চেপে ধরে মার্কিন ইহুদিরা শুধোবে, হিসাব দেখাও, টাকাটা গেল কোথায়! কে মেরেছে কত? এখন কুল্লে ইহুদি রাষ্ট্রটা যে ডকে উঠতে চলল তার জন্য দায়ী কে?
.
কভু গোপনে!
কিন্তু এটা বাহ্য। আসল গরদিশে পড়েছেন বাবাজি কিসিংগার। মার্কিনদের হনুকরণ করে (এপিং করে) নাম পর্যন্ত বদলালেন, হাইনরি কিসিংগার থেকে হেনরি কিসিংগারে! আরও কত কী না করলেন, কেরেস্তানদের সঙ্গে একদম লাইলি মজনুনের মতো দুই দেহে এক প্রাণ, হরিহরায়া হয়ে যেতে। ওদিকে ধাপ্পা দিলেন বিশ্বসুদ্ধ সবাইকে ইহুদিদের অবশ্যই বাদ দিয়ে তিনি প্রভু নিক্সনের উপদেষ্টারূপে চারটি বৃহৎ বিশ্বশক্তির সঙ্গে ফতো-গো করেন মাত্র : তারা রুশ, চীন, জাপান আর পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রপুঞ্জ (ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জর্মনি গয়রহ)। মধ্যপ্রাচ্যে? আজ্ঞে না। ওটা ডিল করছেন স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিজ একসেলেনসি রজার্স। ভাবখানা এই, আমি ইহুদির বেটা। আরব-ইজরায়েলের ফ্যাসাদে আমার নাক গলানোটা কি নিরপেক্ষ, সুবিবেচনার কর্ম হবে?
তাই দেখা গেল, কিসিংগার যখন ক্ষুদ্র-অসাধুতা (পেটি অ্যান্ড ডিজনেস্ট–ফরেন আপিসের একাধিক উচ্চ কর্মচারীর মতে) পদ্ধতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্ব ছিনিয়ে নিলেন (এ্যাবড) তখন মিসরের জনৈক সম্পাদক, অস-সঈদ ইহসান আবদুল কুদ্দুস বললেন, আশা ছাড়ব কেন? ভেবে দেখুন, ফিল আখির- আফটার অল–বছরের পর বছর ধরে আমরা মি. রজার্সের সঙ্গে লেনদেন করার পর আখেরে আবিষ্কার করলুম, তিনি ক্লীব– শক্তিধর তার পিছনে গদাধর কিসিংগার! বিগলিতাৰ্থ তা হলে দাঁড়াল এই, আর বুদু। কিসিংগারই কলকাঠি নাড়িয়েছেন ইজরায়েলের হয়ে, শিখণ্ডী ছিলেন রজার্স। এটাকে যদি ধাপ্পা, প্রতারণা না বলে তবে বঙ্গজন দয়া করে শব্দদুটোর সংজ্ঞা জানাবেন কি?
.
কভু হাটের মধ্যিখানে!
এই কি তার শেষ? কিসিংগার রুশের সঙ্গে দোস্তি জমালেন স্বয়ং খোলাখুলিভাবে। হঠাৎ দেখি, ইয়াল্লা, হুড়হুড়িয়ে বানের জলের মতো ইজরায়েলের পানে রাশ করেছে রুশের ইহুদি-পাল! এরা যে ননী-মাখনে পোষা ইজরায়েলিদের চেয়ে হাজার গুণে সখৎ মোকাবিলা করতে পারবে আরবদের, সেটা স্বীকার করেছেন ঝাণ্ডু ঝাণ্ডুজঁদরেলগণ। চীন তো চটে গিয়ে রুশকে করেছে এর জন্যে দায়ী। কিসিংগারকে ছেড়ে দিয়ে কথা কইল কেন, সে আমি জানিনে।
.
সরল প্রশ্ন
কিন্তু আজ যে উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাদের সেবক, এ মূর্খ, লেখাটি আরম্ভ করেছে সেটি ভিন্ন, কিন্তু উপরের বক্তব্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী-বিজড়িত। আমি নাদান, কিঞ্চিৎ এলেম সঞ্চয় করতে চাই আপনাদের কাছ থেকে।
(১) আশা করি সবাই স্বীকার করবেন, বাংলাদেশ বিশ্বসংসারে অসাধারণ শক্তিশালী এমন একটা রাষ্ট্র নয় যেখানে কোনও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেকে এ দেশের প্যারা করতে চাইবেন। আমার প্রশ্নটা পরে আসছে।
(২) কত রাজা, কত প্রেসিডেন্ট, কত প্রধানমন্ত্রী নিজ নিজ পদ গ্রহণ করার সময় নিত্যি নিত্যি শপথ নেন। তার কটা ফটো এই গরিব ঢাকার দৈনিকে বেরোয়, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো।
(৩) তা হলে প্রশ্ন, হঠাৎ করে মি. কিসিংগার– রাজা না, প্রেসিডেন্ট না, এমনকি প্রধানমন্ত্রী না– ফরেন মিনিস্টারি নেবার সময় যে শপথ গ্রহণ করেন তার ছবি ঢাকার কাগজে কাগজে বেরুল কেন? নিশ্চয়ই ছবিটি মি. কিসিংগার যে ফরেন আপিসের বড় সাহেব হলেন, সে আপিসের ঢাকাসহ শাখা-প্রশাখা দ্বারা বিতরণ করা হয়েছে। তা হোক, কিন্তু প্রশ্ন, এই ছবিটাই বিশেষ করে কেন?
(৪) উপরের প্রশ্নটি যত না গুরুত্বব্যঞ্জক, তার চেয়ে মোস্ট ইম্পরটেন্ট, মি. কিসিংগারের সম্মানিতা মাতা যে বাইবেল হাতে করে শপথের সময় দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা কে, কারা, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন? কত লোক কত ধর্মগ্রন্থ নিয়ে, বা কোনও ধর্মগ্রন্থ না নিয়ে শপথ করে, কই, সেটা তো আজ অবধি কোনও খবরের এজেন্সি বা ইনফরমেশন সার্ভিস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের লোকই বাইবেলের নামে গদগদ একথাও তো কখনও শুনিনি।
(৫) মি. কিসিংগার ইহুদি। বাইবেলের প্রথম অংশ, যার নাম ওল্ড টেস্টামেন্ট সেটা ইহুদিদের সম্মানিত ধর্মগ্রন্থ– খ্রিস্টানদেরও। কিন্তু তার দ্বিতীয়াংশই আসলে খ্রিস্টানদের পরমপূজ্য নিউ টেস্টামেন্ট– যাতে আছে প্রভু যিশুর জীবনী, তার খ্রিস্টধর্ম প্রচারের বিবরণ, এবং আছে তাকে যে ইহুদিরা ক্রুশে চড়িয়ে খুন করে তার করুণ কাহিনী। মি, কিসিংগার (এবং তার মাতা) কি এই কাহিনীর পবিত্রতায় বিশ্বাস করেন যে এটিকে স্পর্শ করে তিনি শপথ নিলেন? আমি যতদূর জানি, ইহুদিরা এই নিউ টেস্টামেন্টে বিশ্বাস করেন না। অতি অবশ্যই ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোওরাতে (তওরিতে) নিউ টেস্টামেন্টের স্থান নেই।
(৬) তবে কি ফটোর বাইবেল খাস ইহুদি-বাইবেল? আমাদের জানা মতে, সে গ্রন্থে থাকে শুধু ওলড টেস্টামেন্ট। তাই যদি হয়, তবে বাইবেল, বাইবেল বলে সেটা অতখানি প্রচার করা হল কেন? ঢাকা-কলকাতার জনসাধারণ তো বাইবেল বলতে ওলড এবং নিউ, দুইয়ে গড়া বাইবেলই বোঝে, সেই কেতাবদ্বয়ের সম্মিলিত গ্রন্থই দেখেছে। যারা ফটোর সঙ্গে ক্যাপশনটি বিতরণ করেছেন তারা ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললে ভালো হত না? বাইবেল শব্দটিও মূলত গ্রিক বলে ইহুদিরা ব্যবহার করেন বলে শুনিনি। তারা তোওরা, তালমুদ ইত্যাদি বলে থাকেন। হয়তো নিতান্ত গয়দের উপকারার্থে মাঝে মাঝে বাইবেল বলেন।
(৭) ইহুদি কিসিংগারের পক্ষে কি বাধ্যতামূলক ছিল, বাইবেল স্পর্শ করে, শপথ নেবার? কাল যদি মুসল্লি মুহম্মদ আলী (কেসিয়াস কে) আমেরিকার মন্ত্রী হন, তবে তাকেও কি বাইবেল ছুঁয়ে কসম নিতে হবে?
(৮) তবে কি ড. কিসিংগার ও সম্মানীয়া মাতা সনাতন ইহুদিধর্ম ত্যাগ করেছেন? এটা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব কিসিংগার চরিত্র যতখানি বুঝতে পেরেছি তার পর।…এসব বাবদে কিঞ্চিৎ এলেম হাসেল হলে উত্তম আলোচনা করা যাবে। যারা এতখানি পয়সা খর্চা করে মুফতে ফটো বিতরণ করলেন, তারা দু পয়সার কালি-কাগজ মারফত সত্যজ্ঞান বিতরণ করবেন না, এ-ও কি সম্ভব? মুফতে থোড়া বখশিশ দিয়ে বেতটার পয়সা ওনারা দেবেন না?
.
বার্লিনে
১৯২৯-এ আমি বার্লিন যাই। সে যুগে বার্লিন এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ছিল ইহুদি জগতের প্রবীণতম দুই কেন্দ্র। ইহুদি-বৈরী হিটলার এবং তাঁর গুরুমারা চেলা বৈরী-প্রধান গ্যোবেলস তখনও রাষ্ট্রশক্তি পাননি, এবং তাদের শক্তিকেন্দ্র ছিল বাভারিয়া প্রদেশের মুনিকে। তবু মাঝে মাঝে বার্লিনের রাস্তায়, পাবে, মিটিঙে, নাৎসি আর ক্যুনিস্ট পার্টিতে হাতাহাতি মারামারি হত। তাছাড়া মোকায় পেলে মশহুর কোনও নাসি-বৈরীকে পেলে তাকেও দু ঘা বসিয়ে দিত, খুনও করেছে। এ স্থলে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই, ফ্রান্স-জর্মনিতে ইহুদিদের এক বৃহৎ অংশ নিজেরা প্রগতিশীল বলে, প্রগতিশীল কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিত। কম্যুনিস্ট প্যাদাতে পারলে নাৎসিদের ছিল ডবল আনন্দ। বহুৎ ক্ষেত্রে ফালতো রিসক না নিয়ে একাধারে ক্যুনিস্ট-ইহুদি দু জনকেই ঘায়েল করা যেত। যে কারণে এ দেশের হিন্দুকে খতম করে ইয়েহিয়া পেতেন ডবল সুখ– একাধারে হিন্দু এবং বাঙালি, দুই দুশমনের জন্য লাগত মাত্র একটা বুলেটের খর্চা।
ইউনিভার্সিটি রেস্তোরাঁর টেবিলে নাৎসিদের কথা বড় একটা উঠত না। ছাত্রদের ভিতর তখন ক্যুনিস্টদের ছিল প্রাধান্য। এবং স্বভাবতই তাঁদের মধ্যে ইহুদিদের ছিল উচ্চাসন। আমি যে ওদের সঙ্গেই গোড়ার থেকে ভিড়ে গিয়েছিলুম তার কারণ ক্যুনিস্টরা আপন ধর্মে দীক্ষা দেবার জন্য নবাগতজনকে অভ্যর্থনা জানায় আর ইহুদিরা শত পরিবর্তন সত্ত্বেও প্রাচ্যদেশীয় মেহমানদারি গুণটি এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। পরবর্তীকালে ইজরায়েল ব্যত্যয়। কিংবা হয়তো যুগ যুগ ধরে খ্রিস্টানদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার সময় অখ্রিস্টান যাকে পেয়েছে তার সাহায্য পাবার আশায় তার সঙ্গে যেচে গিয়ে কথা বলেছে। অবশ্য এটা স্মরণে রাখতে হবে ইহুদি জাত যেখানে গিয়েছে, সেখানেই কিছু না কিছু মিশ্রণের ফলে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা প্রায় অসম্ভব খ্রিস্টান জর্মন বা কে, আর ইহুদি জর্মনই-বা কে। এবং নাম থেকেও বলা সুকঠিন কে কোন জাত বা ধর্মের।
.
বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদি-শাস্ত্র চর্চা
১৯৩০-এ হিটলার হঠাৎ, কী কারণে কেউ জানে না, পার্লামেন্টে অনেকগুলি সিট পেয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে আমি চলে এসেছি বন শহরে। ছোট শহর বন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল সেমিনারটি জর্মনির ভিতর-বাইরে সর্বত্র সুপরিচিত। সেখানে আরবি, সংস্কৃত ও হিব্রু চর্চা হত প্রচুর। সেই সূত্রে ডজনখানেক ইহুদি ছাত্র ও পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ হল তো বটেই, দু তিন জনার সঙ্গে রীতিমতো হৃদ্যতাও হয়ে গেল। এদের একজন ছিলেন সেই সুদূর রুশ দেশেরও দূর প্রান্ত জর্জিয়ার লোক। ভারি আমুদে, পরিণত বয়স্ক, ছাত্রসমাজের মুরুব্বি। ওদিকে ইহুদি ধর্মতত্ত্বের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে পাস করেছিলেন বলে (অর্থাৎ তিনি রাব্বি পণ্ডিত-পুরোহিতের সমন্বয়) ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রামাণিক সংস্করণের নতুন প্রকাশ নিয়ে দুনিয়ার যত প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মধ্যে দিন-যামিনী আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতেন। একদিন আরবিতে লেখা আজব উল-কবর (মৃতজনকে গোর দিয়ে চলে আসার পর ফিরিস্তা এসে তার ঈমান সম্বন্ধে যেসব প্রশ্ন করেন তার বিবরণী) পড়ে আমার মনে হল, ইহুদিদের তালমুদ গ্রন্থে এর উল্লেখ থাকাটা অসম্ভব নয়। আমার হিব্রু বিদ্যে মাইনাস ডডনং। জর্জিয়ার রাব্বির কাছে গিয়ে প্যাসেজ দেখাতেই তিনি চোখদুটো বন্ধ করে চেয়ারের হেলানটায় মাথাটা ফেলে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বিড়বিড় করে হিব্রু শাস্ত্র আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন। আমি দাঁড়িয়েই আছি, দাঁড়িয়েই আছি– তালমুদ তিলাওতের পালা আর সাঙ্গ হয় না। কুরান শরীফের শবীনা খত্ম-ই এক ঠায় বসে এ জিন্দেগিতে আদ্যন্ত শোনার সওয়াব হাসিল করতে পারেনি এই বদ-কিসৎ গুনাগার। আর এই তালমুদ গ্রন্থটি ইটের থান মার্কা পাক্কা চল্লিশটি ভলুমের নিরেট মাল। সওয়াব ভি নদারদ, কারণ তালমুদ কেতাব পাক তওরিতের অংশ নয়!… আখেরে জেহোভার রহমত নাজির হল। হঠাৎ থেমে গিয়ে এক লক্ষে পেড়ে আনলেন এক খণ্ড তালমুদ। পাশের চেয়ারটার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে হিম্বৎ হা করব (আমার নাম আজ আর মনে নেই) অনুচ্ছেদটি পড়তে আরম্ভ করলেন, আমার হাতে আরবি টেকটটি তুলে দিয়ে। এবং হুবহু এক্কেবারে আমাদের মক্তবের ছাত্রদের মতো ঘন ঘন দুলে দুলে আর সুর করে করে। আর মাঝে মাঝে ঠিক মক্তবের বাচ্চাটার মতো মাথা ডাইনে-বাঁয়ে নাড়িয়ে সুর করেই বলেন হল না, মেরামত করে ফের এগোন দ্রুততর গতিতে।
আমি তো অবাক। কবে কোন যুগে, ছেলেবেলায় আপন গাঁয়ে দেখেছি এই দৃশ্য! আর সেই দৃশ্য জর্জিয়ার তিফলিস থেকে এখানে এসে ফের হাজির! হ্যাঁ, ওখানেও একদা আরবি, তুর্কি ও ফারসিরও প্রচুর চর্চা হত। শুধু একটা অনুষ্ঠান ফারাক ছিল; রাব্বিকে বললুম, হল না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তালিব-ই-ইলম চট করে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নেয়, চাবুক হাতে মৌলবি সাহেব শুনতে পেরে তেড়ে আসছেন কি না। সদানন্দ পণ্ডিত ঠাঠা করে হেসে উঠলেন। হাসি আর থামতেই চায় না।
.
গোপন ইহুদি রেস্তোরাঁ
এ কাহিনী এতখানি বাখানিয়া বলার উদ্দেশ্য আমার আছে। ১৯৩২-এ দেশে ফিরে ফের বন শহরে গেলুম ৩৪-এ। রাব্বির সঙ্গে দেখা হল না। ভাবলুম হয়তো-বা হবু ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলে চলে গিয়েছেন। এ রকম সুপণ্ডিত রাব্বি পুণ্যভূমিতে যাবেন না তো যাবার হক ধরে কে? তাই ভারি খুশি হলুম, চিন্তিতও হলুম ৩৮-এ তাঁকে ফের বন শহরের স্টেশনের কাছে দেখে। হিটলার তখন এমনিই বেধড়ক দাবড়াতে আরম্ভ করেছে যে ইহুদিরা জর্মনি ছেড়ে পালাতে আরম্ভ করেছে দলে দলে একদা যে-রকম মিসর ছেড়ে তুরি সিনিনে পৌঁছেছিল। ওই সময়েই হের ডক্টর কিসিংগার যিনি তরশু দিন চোখ রাঙিয়ে আরব নেশনকে শাসিয়েছেন, এখন পাঠাচ্ছি স্রেফ অস্ত্র-শস্ত্র (জাতভাইকে), দরকার হলে পাঠাব সেপাই জাঁদরেল,–সেই, তখনকার দিনের চ্যাংড়া হাইনরিষ ডাকনাম হাইনৎস কিসিংগার পড়িমরি হয়ে জর্মনি ছেড়ে অদ্যকার মিলিটারি কণ্ঠটি খামুশ রেখে চড় চড় করে বীরগর্বে পালান মার্কিন মুল্লুকে।…রাব্বি আব্রাহাম আমাকে জাবড়ে ধরে নিয়ে উঠলেন একটা বাড়ির দোতলায়। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখি ইহুদি রেস্তোরাঁ। কারণ সামনেই ছোট্ট একটা টেবিলের উপর গোটা দশেক ছোট কালো কাপড়ের টুপি নিতান্ত কুণ্ডলীসুদু মাথার খাপরিটা ঢাকা যায় মাত্র। ইহুদিরা অনাবৃত মস্তকে ভোজন বা ভজনালয়ে প্রবেশ করেন না। আম্মা একটা পরে নিলুম। সুন্নৎ।
মাখনে ভাজা মাছ এল। ইহুদি শরিয়তে মাছ তেলে ভাজতে নেই। আমি বললুম, বিসমিল্লা করুন। তিনি তাই করলেন। কুশলাদি সমাপনান্তে আমি আশ-কথা পাশ-কথা দু চারটি বলে ধাম, পুণ্যভূমিতে যাবেন না।
তার মাথা আমার কানের কাছে এনে অতি চুপে চুপে বললেন, আমাকে তারা পছন্দ করবে না। কিন্তু এখানে না, রাস্তায় কথা হবে।
আহারাদি ছ বছর আগে ছিল ঢের, ঢের ভালো।
টুপি ফের টেবিলে রেখে রাস্তায়, তার পর সেমিনারে। পূর্ববৎ গুরুশিষ্যের মতো মুখোমুখি হয়ে বসার পর নিজের থেকেই বললেন, আমি রাব্বি। আমি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, শাস্ত্র মেনে চলি। ইজরায়েল যারা গড়ে তুলেছে তাদের সঙ্গে আমার বিশেষ কোনও মতভেদ নেই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বব্যঞ্জক সর্বপ্রথম সমস্যাঁতেই তারা যে পথে চলেছে সেটা ভুল পথ। আমার ব্যক্তিগত মত নয়। খুলে বলছি।
প্যালেস্টাইন থেকে চিরতরে বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ইহুদিরা পুণ্যভূমিতে তিনবার সশস্ত্র সগ্রাম করে। প্রতিবার তারা নির্মমভাবে পরাজিত হয়। একবার ব্যাবিলনের রাজা তো আক্রোশের চোটে তাদের ছেলে-বুড়ো-কুমারী-সধবাদের বিরাট এক অংশ দাসরূপে টেনে নিয়ে গেলেন প্যালেস্টাইন থেকে সেই দূর ব্যাবিলনে–সমস্ত সিরিয়া মরুভূমির উপর দিয়ে। বার বার জেনেশুনে, কারণে-অকারণে কখনও-বা পরের উস্কানিতে তারা বিদ্রোহ করে শুধু যে নিজেদের পার্থিব সর্বনাশ ডেকে এনেছে তাই নয়, ঐতিহ্যগত ধর্মের মারফত তারা যেটুকু সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়েছিল সেটারও পূর্ণ বিকাশ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রতিবার গোটা জেরুজালেম শহরটাকে পুড়ে খাক করে দিয়েছে, হাজার হাজার নারী পুত্রহীন, স্বামীহীন করেছে তারা, যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোনও প্রয়োজন ছিল না, করার মতো শক্তি তাদের আদৌ ছিল না।
তাই ইহুদিদের প্রফেটরা ধর্মগ্রন্থে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন, সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া তোমাদের পক্ষে পাপ, মহাপাপ!
হোম বানাতে গিয়ে প্যালেস্টাইনে এই নয়া ইহুদিরা আবার ধরেছে অস্ত্র আরবদের বিরুদ্ধে। বার বার আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রাব্বিরা তাদের সম্মুখে শাস্ত্র খুলে তাদের মানা করেছেন। তারা শোনেনি।
এখন বেশিরভাগ আর মুখ খোলেন না।
আমি রাব্বি। আমি বিশ্বাস করি শাস্ত্রের বচন। আরবদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ভিন্ন। এদের অন্য কোনও পন্থা নেই। কিন্তু আমার কথা শুনবে কে?
[সমাপ্ত]
বিদেশে
০১.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রাতদুপুরেই হোক আর দিনদুপুরেই হোক চট করে বলতে পারবেন না, আপনি যে হোটেলে শুয়ে আছেন সেটা কোন শহরে। টোকিও, ব্যাংকক কলকাতা, কাবুল, রোম, কোপেনহাগেন যে কোনও শহর হতে পারে। আসবাবপত্র, জানালার পর্দা, টেবিলল্যাম্প যাবতীয় বস্তু এমনই এক ছাঁচে ঢালা যে স্বয়ং শার্লক হোমসকে পর্যন্ত তাঁর সব-কটা পুরু পুরু অতসি কাঁচ মায় তার জোরদার মাইক্রোস্কোপটি বের করে, ওয়াটসনকে কার্পেটের উপর ঘোড়া বানিয়ে, নিজে তার পিঠে দাঁড়িয়ে, ছাতের উপর তার স্বহস্তে নির্মিত আ লা হোমস স্প্রে ছড়িয়ে বাকিটা থাক, ব্যোমকেশ ফেলুদার কল্যাণে আজ স্কুলবয়ও সেগুলো জানে– তবে বলবেন, হয় মন্তে কার্লোর রেজিনা হোটেল নয় য়োহানেসবের্গের অল হোয়াইট হোটেল। দূরপাল্লার অ্যারোপ্লেনের বেলাও আজকের দিনে তাই। একবার তার গর্ভে ঢুকলে ঠাহর করতে পারবেন না, এটা সুইস অ্যার, লুফট হানজা, অ্যার ইন্ডিয়া না কে এল এম। তিমির পেটে ঢুকে নোয়া কি আর আমেজ-আন্দেশা করতে পেরেছিলেন এটা কোন জাতের কোন মুল্লুকের তিমি?
ইন্ডিয়ান মানেই নেটিভ, মানে রদ্দি। আস্তে আস্তে এ ধারণা কমছে। নইলে জর্মনি এ দেশের সেলাইয়ের কল, রুশ কলকাতার জুতো কিনবে কেন?
অতএব অ্যার ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যারোপ্লেনকে একটা চানস দিতেই-বা আপত্তিটা কী? অন্য কোম্পানিগুলো তো প্রায় সব চেনা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য আরেকটা কথা আছে। ওই কোম্পানির এক ভদ্রলোক বুদ্ধি খাঁটিয়ে, তদ্বির-তদারক করে আমার সুখ-সুবিধার যাবতীয় ব্যবস্থা না করে দিলে হয়তো আমার যাওয়াই হত না। তার নাম বলব না। উপরওলা খবর পেলে হয়তো কৈফিয়ত তলব করে বসবেন, কোনও একজন ভিআইপি-কে সাহায্য না করে একটা থাচ্ছো কেলাস নেটিভ রাইটারের পিছনে তিনি আপিসের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করলেন কেন? তবে কি না তাঁর এক ভিআইপি মিত্রও আমাকে প্রচুরতম সাহায্য করেছিলেন। তাকে না হয় শিখণ্ডীরূপে খাড়া করবেন।
ভেবেছিলুম চুঙ্গিঘরের (কাস্টমসের) উৎপাত থেকে এই দুই দোস্তো কতখানি বাঁচাতে পারবেন। ইতোমধ্যে এক কাস্টমিয়া আমার কাগজপত্র পড়ে আমার দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে শুধাল, আপনিই তো আপনার বইয়ে চুঙ্গিঘরের কর্মচারীদের একহাত নিয়েছেন, না?
খাইছে। এ যাত্রায় আমি হাজতে বাস না করে মানে মানে কলকাতা ফিরতে পারলে নিতান্তই পঞ্চপিতার আশীর্বাদেই সম্ভবে। কে জানে, এই কাস্টমিয়াই হয়তো হালে কয়েকজন ভাঙর ডাঙর ভিআইপি-কাম-সরকারি কর্মচারীকে বেআইনিতে মাল আনার জন্য নাজেহাল করেছিলেন।… একদিন জলের কল খুললে যেরকম জল না বেরিয়ে শব্দ বেরুত সেই সময় আমার ব্লটিং পেপারের লাইনিংওলা গলা দিয়ে কথা না বেরিয়ে বেরুল ঘস ঘস খস খস চো ধরনের কী যেন একটা।
নাহ্। এ লোকটির রসবোধ আছে কিংবা এর বাড়িতে মাসে একদিন জল আসে বলে ওই ভাষা বোঝাতে তিনি সুনীতি চাটুয্যে মশাইকে তাক লাগিয়ে উত্তম ধ্বনিতত্ত্ববাবদে কেতাব লিখতে পারবেন। বললেন, নিশ্চিন্তমনে ওই আরাম চেয়ারটায় বসুন। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তার পর ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে কী এক অশ্রুত টরেটক্কার সংকেত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে জনচারেক বাঙালি কাস্টমিয়া আমাকে ঘিরে যা আদর-আপ্যায়ন আরম্ভ করলেন যে, হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেবীর প্রসাদে মূক যেরকম বাঁচাল হয়, আমি কেন, হরবোলাও মূক হতে পারে।
প্রতিজ্ঞা করলুম, চুঙ্গিঘর লেখাটা আমি ব্যান করে দেব। কার যেন দু-শো টাকা ফাইন হয়েছে।
কিন্তু এত সব বাখানিয়া বলছি কেন?
শুনুন। জীবনে ওই একদিন উপলব্ধি করলুম, সাহিত্যিক তা সে আমার আটপৌরে সাহিত্যিক হওয়ার মধ্যেও একটা মর্যাদা আছে।
এসব যে বাখানিয়া বলছি তার আরও একটা কারণ আছে।
আমার নিজের বিশ্বাস, প্লেনের পেটের ভিতরকার তুলনায় অ্যারপোর্টে আজব আজব তাজ্জব চিড়িয়া দেখতে পাওয়া যায় ঢের বেশি। পাসপোর্ট, কাস্টমস, হেলথ অফিসে, রেস্তোরাঁয় তাদের আচরণ কেউ-বা সংকোচের বিহ্বলতায় অতীব ম্রিয়মাণ, কেউ-বা গড় ড্যাম্ ডোন্টো কেয়ার ভাব– ওদিকে একটি বিগতযৌবনা মার্কিন মহিলা, অ্যারোপ্লেনে অর্ধন্দ্রিা যামিনী কাটিয়ে আলুথালু-বেশ, হৃত-পাউডার-রুজ, এঞ্জিনের পিস্টন বেগে পলেস্তরা পলেস্তরা ক্রিম-পাউডার-রুজ মাখছেন, এদিকে তাঁর কর্তা প্লেনে সস্তায় কেনা স্কচ স্যাঁট স্যাঁট করছেন; আর ওই সুদূরতম প্রান্তে দেখুন, দেখুন বললুম বটে, কিন্তু দেখার উপায় নেই কালো বোরখাপরা জড়োসড়ো গণ্ডা দুই মক্কাতীর্থে হজযাত্রিনীর গোঠ। এঁরা নিশ্চয়ই চলতি ফ্যাশানের ধার ধারেন না। বেশিরভাগ আঁকড়ে ধরে আছেন পুঁটুলি– হ্যাঁ, বেনের পুটুলি। গরুর গাড়িতে বা গয়নার নৌকোয় ওঠার সময় যে পুঁটুলি সঙ্গে নেন। ওঁরা ভাড়া বাবদ কয়েক হাজার টাকা দিয়েছেন নিশ্চয়ই! অনায়াসে হালকা স্যুটকেস কিনতে পারতেন। দু-একজনের ছিলও বটে। কিন্তু ওদের কাছে গরুর গাড়ি যা, হাওয়াই জাহাজও তা–এদের মক্কা পৌঁছলেই হল। হায়, এরা জানেন না, প্লেনে ভ্রমণ– তা সে যে কোনও কোম্পানিই হোক না কেন– গরুর গাড়িতে মুসাফিরি করার তুলনায় ঢের বেশি তকলিফ দেয়। এমনকি প্লেনে এঁদের পক্ষে হায়া-শরম বাঁচিয়ে চলাও কঠিন। কলকাতার বস্তিতে কী হয় জানিনে, কিন্তু এদের যখন প্লেনে করে যাবার রেস্ত আছে তখন এঁরা সেখানকার নন। আর গ্রামাঞ্চলে কেউ কখনও প্রাতঃকৃত্যের জন্য কিউ দেয় না। অথচ প্লেনে প্রাতঃকৃত্যের জন্য এঁদের কিউয়ে দাঁড়াতে হবে– মেয়েমদ্দে লাইন বেঁধে। সেকথা পরে হবে। তবে হজযাত্রীদের জন্য স্পেশাল প্লেনে যদি স্পেশাল ব্যবস্থা থাকে তবে তার তথ্য জানিনে; কোনও কোম্পানি অপরাধ নেবেন না।
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি প্লেন দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল পোর্টে সব বেরাদরি শুষ্ক চোখে।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, প্লেনের ভিতরে দেখবার কিচ্ছুটি নেই। থার্ডক্লাস ট্রেনে যা দেখতে পাওয়া যায় তার চেয়েও কম। আর সর্বক্ষণ আপনার চোখের তিন ফুট সামনে, সমুখের দুটো সিটে দুটো লোকের ঘাড়। তারও সামনে সারি সারি ঘাড়। দোস্ত আমার এ প্লেনের মালিক। অতএব আমার জন্য উইন্ডো সিটের ব্যবস্থা করেছেন অর্থাৎ বাঁ দিকে তাকালে বাইরের আকাশ দেখা যায়। বলতে গেলে পৃথিবীর কিছুই না। একে রাত্রি, তদুপরি আল্লায় মালুম, বিশ হাজার না পঁচিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে প্লেনে যাচ্ছেন, কিছু দেখতে চাইলে ত্রিনয়নের প্রয়োজন। উপরেরটা হয়তো কিছু-বা দেখতে পায়। তবে ভারতীয় প্লেনে একটা বড় আরাম আছে। যদিও অধিকাংশ যাত্রী ভারতীয় নয়। বিদেশি এবং প্রধানত ইউরোপীয়। তারা জানে, ইন্ডিয়ানরা বেলেল্লাপনা পছন্দ করে না। কাজেই অতিরিক্ত কলরোল, এবং মাঝে মধ্যে তদতিরিক্ত কলহরোল থেকে নিশ্চিন্ত মনে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
এ বাবদে এখানেই থাক। কারণ শ্রদ্ধেয় শ্ৰীযুত তারাশঙ্কর, সম্মানীয় শ্ৰীযুত বুদ্ধদেব, ভদ্র প্রবোধ ও অন্যান্য অনেকেই প্লেনের ভিতরকার হাল সবিস্তর লিখেছেন।
জাগরণ, তন্দ্রা, ঘুম সবই ভালো। কিন্তু তিনটেতে যখন গুবলেট পাকিয়ে যায় তখনই চিত্তির। এ যেন জ্বরের ঘোরে দু দিন না তিন দিন কেটে গেল বোঝবার কোনও উপায় নেই।
চিৎকার চেঁচামেচি। রোম! রোম!! রোম!!!
ক্যাথলিকদের তো কথাই নেই। প্রটেস্টানদের ঈষৎ সংযত কৌতূহল। বিশেষ করে মার্কিনদের। দেশে ফিরে বড়ফাট্টাই করতে হবে, া, তেমন কিছু না, তবে কি না, হ্যাঁ, দেয়ালের আর গম্বুজের ছবিগুলো ভালো। কী যেন নাম (ভামিনীর দিকে তাকিয়ে) মাইকেল রাফাএল, না, হল না। লেওনার্দো দা বত্তিচেল্লি। ও! সেটা বুঝি মোনালিসার লিনিং টাওয়ার।
বললে পেত্যয় যাবেন না, আমি স্বকর্ণে শুনেছি, তাজমহলের সামনে বসে একই বেঞ্চে বসা এক মার্কিনকে তার মিসিসের উদ্দেশে শুধাতে শুনেছি, কিন্তু আশ্চর্য, এই ইন্ডিয়ানরা এসব তৈরি করল কী করে– ফরেন সাহায্য বিনা, অর্থাৎ, আমাদের সাহায্য না নিয়ে।
রোমে নামতেই হল। সেখানে আমার এক বন্ধু বাস করেন। কিন্তু তার কোনও নম্বর জানা ছিল না বলে যোগসূত্র স্থাপন করা গেল না। একখানা পত্রাঘাত, তদ্দরুন স্ট্যাম্প জোগাড় করতে না করতেই অ্যার কোম্পানির লোক রাখাল ছেলে যেরকম গরু খেদিয়ে খেদিয়ে জড়ো করে গোয়ালে তোলে সেই কায়দায় প্যাসেঞ্জারদের প্লেনের গর্ভে ঢোকাল। প্যাসেঞ্জারদের গরুর সঙ্গে তুলনা করাটা কিছুমাত্র বেয়াদবি নয়। মোটা পালটা ঠিক বয়স্ক গরুরই মতো লাউঞ্জের মধ্যিখানে একজোট হয়ে বসেছে বটে কিন্তু বাছুরের পাল, অর্থাৎ চ্যাংড়া-চিংড়িরা যে কে কোনদিকে ছিটকে পড়েছে তার জন্য হুলিয়া শমন বের করেও রত্তিভর ফায়দা নেই। কেউ গেছেন কিওরিওর দোকানে। কাইরোর মতো এখানেও খাঁটি-ভেজাল দুই বস্তুই সুলভ এন্তের পড়ে আছে কিন্তু দুর্লভ, কলকাতার মাছের বাজারকেও হার মানায় গাহকের কান কাটতে। কেউ-বা গেছেন বিনমালের (ট্যাক্স ফ্রি) দোকানে। হয়তো ইতালির নামকরা একখানা আস্ত ফিয়াৎ (মোটামুটি ফ্রা বিকেশন ইতালিয়ান Automobile Turino- এই আদ্যক্ষর নিয়ে Fiat। টুরিনো সেই শহরের নাম যেখানে এ গাড়ি তৈরি হয়) গাড়ি কিনে নিয়ে আসেন! একটি হাফাহফি, আধা-আধি, অর্থাৎ পাতে দেওয়া চলে মার্কিন চিংড়ি ওই হোথা বহু দূরে বার-এ বসে চুটিয়ে প্রেম করছেন একটি খাবসুরৎ ইতালিয়ান চ্যাংড়ার সঙ্গে। খাবসুরৎ বলতেই হবে এই রোম শহরে ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে যিনি নাম করেছেন সেই মাইকেল এঞ্জেলো যেন এই সদ্য একে গড়ে চরে খাওগে, বাছা বলে ছেড়ে দিয়েছেন। আর ইতালিয়ান যুবক-যুবতীর প্রতি মার্কিনিংরেজের যে পীরিতি সেটা প্রায় বেহায়ামির শামিল। চরে খাবে না কেন? সর্বশেষে বলতে হয়, ইতালির কিয়ান্তি মদ্য দুনিয়ার কুল্লে সুধার সঙ্গে পাল্লা দেয়। সেটাও পাওয়া যাচ্ছে ফ্রি, গ্রেটিস অ্যান্ড ফর নাথিং। মুফৎমে।
প্লেনে ঢুকে দেখি, সত্যি সেটা গোয়ালঘর। মশা খেদাবার তরে গায়ের চাচার বাড়িতে যেরকম সঁতসেঁতে খড়ে আগুন ধরানো হত এখানেও সেই প্রতিষ্ঠান। তবে হ্যাঁ, এটা বিজ্ঞানের যুগ। নানা প্রকারের ডিসিনফেকটেন্ট, ডিঅডরেনট স্প্রে করা হয়েছে প্রেমসে। সায়েবদের যা বি ও বডি ওডার গায়ের বোটকা দুর্গন্ধ।
সকালবেলায় আলো দিব্য ফুটে উঠছে। ইতোমধ্যে প্লেনে পাক্কা সাড়ে পনেরো ঘণ্টা কেটেছে। দমদমা ছেড়েছি রাত নটায়; এখন সকাল আটটা। হওয়ার কথা তো এগারো ঘন্টা! কী করে হল? বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের শুধোন।
.
০২.
প্লেন যখন ছাড়ল তখন অপ্রশস্ত দিবালোক।
দিবালোকের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক আছে। যে দেশে যাচ্ছি, সেই জর্মনির বাঘা দার্শনিক কান্ট নাকি বলেছেন কাল এবং স্থান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না। (টাইম অ্যান্ড স্পেস আর আ প্রিয়রি কনসেপশন)।
কাজের বেলা কিন্তু দেখলুম, তত্ত্বটা আদৌ সরল সহজ নয়।
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেন দেশের সকালবেলার সাতটা-আটটা। কিন্তু হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে নজর পড়াতে দেখি, সেটি দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা! কী করে হয়? আমার ঘড়িটি তো পয়লা নম্বরি এবং অটোমেটিক। অবশ্য একথা আমার অজানা নয়, অটোমেটিক বেশি সময় কোনও প্রকারের ঝাঁকুনি না খেলে মাঝেমধ্যে থেমে গিয়ে সময় চুরি করে। কিন্তু কাল রাতভর যা এপাশ ওপাশ করেছি তার ফলে ওর তো দম খাওয়া হয়ে গেছে নিদেন দু দিনের তরে। আমার পাশের সিটে একটি চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে। তার পরের সিটে এক বর্ষীয়সী বাচ্চাটার ঠাকুরমা-দিদিমার বয়সী। তাঁর দিকে ঝুঁকে শুধালুম, মাদাম, বেজেছে কটা, প্লিজ? মাদামের এলোমেলো চুল, সকালবেলার ওয়াশ, মুখের চুনকাম, ঠোঁটের উপর ঊষার লালবাতি জ্বালান হয়নি। শুকনো মুখে যতখানি পারেন ম্লান হাসি হেসে বললেন,পারদো মসিয়ো, জ ন পার্ল পা লেদুস্থানি। অর্থাৎ তিনি হিন্দুস্তানি বলতে পারেন না। ইয়াল্লা। সরলা ফরাসিনী ভেবেছেন, প্লেনটা যখন হিন্দুস্তানি, হিন্দুস্তানে প্লেনে উঠেছি, চেহারাও তদ্বৎ। অতএব আমি নিশ্চয়ই হিন্দুস্তানিতে কথা বলেছি। আমি অবশ্য প্রশ্নটি শুধিয়ে ছিলুম আমার সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত অতিশয় নিজস্ব বাঙাল ইংরেজিতে। ওদিকে এ তত্ত্বও আমার সবিশেষ বিদিত যে ফরাসিরা নটোরিয়াস, একভাষী– ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিখতে চায় না। তাদের উহ্য বক্তব্য বল্লোক যখন হদ্দমুদ্দ হয়ে ফ্রান্সে আসছে, বিশেষ করে কড়ির দেমাক, বন্দুক-কামানের দেমাক, চন্দ্রজয়ের দেমাকে ফাটো ফাটো মার্কিন জাত এস্তেক– ফরাসির মতো লাজুক জবান শেখবার ব্যর্থ চেষ্টায় হরহামেশা খাচ্ছে তখন ওদের আপন দেশে আপসে তারা যে কিচির-মিচির করে সেগুলো শেখার জন্য খামোকা উত্তম ফরাসি ওয়াইনে সুনির্মিত নেশাটি চটাবে কেন? তবু মহিলাটির উক্তি শুনে আমারও ঈষৎ ন্যাজ মোটা হল। দূর-দুনিয়ার ভারতীয় প্লেন সার্ভিস না থাকলে মহিলাটি কি কল্পনা করতে পারতেন যে হিন্দুস্তানিও আন্তর্জাতিক ভাষা হতে চলেছে— মুসাফির যেরকম অ্যার ফ্রান্সে ফরাসি, কে এল এম-এ ডাচ, বি ও এ সি-তে ইংরেজির জন্য তৈরি থাকে।
তখন পুনরপি আপন ঔন অরিজিনাল ফরাসিতে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলুম। আ– আ–! বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু এই সময় সমস্যাটি ভারি কাঁপকে অর্থাৎ কমৃপ্লিকেটেড, জটিল। আমি ওটা নিয়ে মাথা ঘামাইনে।
তবু?
সব দেশ তো আর এক টাইম মেনে চলে না। ভোয়ালা–নয় কি? প্যারিসে যখন বেলা বারোটা তখন রেঙ্গুনে– আমি সেখানে বাস করি বিকেল পাঁচটা-ছটা। কিন্তু আপনাকে ফের বলছি, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি টাইম কত জেনে যাই আমার অতিশয় বিশ্বাসী মিনিস্ দ্য লেতেঁরিয়রকে (হোম সেক্রেটারি, অর্থাৎ ভিতরকার ইন্টেরিয়ের এতেরিয়র-কে) শুধিয়ে। সোজা কথায় পেটটিকে। ওখানে লা-মার্সেইয়েজ সঙ্গীত (বাংলায় পেটে যখন হুলুধ্বনি) বেজে ওঠে তখন সেটা লাঞ্চের বা ডিনারের সময়। উপস্থিত আমার এতেরিয়রেতে সে সঙ্গীত ক্রেসেন্ডতে (তার সপ্তকের পঞ্চমে)। তাই এখন রেঙ্গুনে নিশ্চয়ই দেড়টা-দুটো।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, তা এখখুনি বোধহয় লাঞ্চ দেবে।
মাদাম যদিও বলেছেন তিনি টাইম নিয়ে মাথা ঘামান না কিন্তু দেখলুম, তিনি প্রাকটিক্যাল দিকটা খাসা বোঝেন। আপত্তি জানিয়ে বললেন, রেঙ্গুনে যখন লাঞ্চ তখন এই মিত্রোপাত্রে (মিৎ = মিলা, রোপ; ইউরোপের শেষাংশ অর্থাৎ মধ্য-ইউরোপে) ব্রেকফাস্ট। জাপানে যারা এ প্লেনে উঠেছে, তাদের তো এখন ডিনারের সময় হয় হয়। সুতরাং কোন যাত্রী কোথায় উঠেছে, কার পেট কখন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ/ডিনারের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে সে হিসেবে তো আর কোম্পানি ঘড়ি ঘড়ি কাউকে লাঞ্চা কাউকে সাপার, কাউকে স্যানউইচসহ বিকেলের চা দিতে পারে না। তবে কি না এরা ব্রেকফাস্টে যে পরিমাণ খেতে দেয় সেটা কলেবরে প্রায় লাঞ্চের সমান।… তাই বলছি, এসব টাইম-ফাইম নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ট্রেনেও যদি ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িটার দিকে তাকান তবে সে জর্নি দীর্ঘতর মনে হয় না? আমি তো প্যারিসে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। বদিয়ো (দয়ালু ঈশ্বর) ঘন্টা দেড়েকের ভিতর পৌঁছিয়ে দেবেন। নাতনিটা নেতিয়ে গিয়েছে।
মহিলাটি যেভাবে সবিস্তার গুছিয়ে বললেন, সেটা ধোপে টেকে কি না বলতে পারব না, কারণ আমি যতবার এসেছি-গিয়েছি, আহারাদি পেয়েছি তখন ঘড়ি মিলিয়ে দেখিনি কোনটা লাঞ্চ, কোনটা কী? এবং আজকের দিনে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন টাইমের সালঙ্কার সটীক ফিরিস্তি দেবার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। রেডিও, ট্রান্সজিস্টারের কল্যাণে এখন বাড়ির খুকুমণি পর্যন্ত জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দেয়, বুঝিয়ে বলে গ্রিনিচ মিন টাইম, ব্রিটিশ সামার টাইম, সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান টাইম কোনটা কী। তবু যে এতখানি লিখলুম, তার কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন টাইম যে কীভাবে কসরৎ বিন মেহৎ আয়ত্ত করতে হয় সেটা ফরাসি মহিলাটি আমাকে শিখিয়ে দিলেন অতি প্রাকটিকাল পদ্ধতিতে। সেটা কী? রাজা সলমন যেটা গুরুগম্ভীরভাবে, ধর্মনীতি হিসেবে আপ্তবাক্যরূপে হাজার তিনেক বছর পূর্বে প্রকাশ করে গিয়েছেন নো দাইসেল নিজেকে চেনো (চিনতে শেখ)। শ-বছর আগে লালন ফকিরও বলেছেন আপন চিনলে খুদা চেনা যায়। ফরাসি মহিলাটিও সেই তত্ত্বটিই, অতিশয় সরল ভাষায় প্রকাশ করলেন, আপন পেটটিকে বিশ্বাস কর। তার থেকেই লোকাল টাইম, স্ট্যান্ডার্ড টাইম জানা হয়ে যাবে। ওইটেই মোক্ষমতম ক্রনোমিটার। বরঞ্চ ক্রনোমিটার মাঝে-মধ্যে বিগড়োয়। আলবৎ, পেটও বিগড়োয়। কিন্তু বিগড়ানো অবস্থাতেও সে লাঞ্চ-ডিনারের সময়টায় নিগেটিভ খবর জানিয়ে দেয় তার ক্ষিদে নেই।
ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট না কী যেন এসে গেছে। মাদাম বলেছিলেন, সেটা কলেবর। আমি মনে মনে বললুম, বপু। অ্যাব্বড়া বড়া ভাজা সসিজ, পর্বতপ্রমাণ ম্যাশট পটাটো, টোস্ট-মাখন, মার্মলেড টমাটো ইত্যাদি কাঁচা জিনিস, আরও যেন কী কী। তখন দেখি, বেশ খাচ্ছি। অতএব পেটের ক্রনোমিটার বলছে, এটা লাঞ্চ, অর্থাৎ বেলা একটা-দুটো। ঘড়ি মিথ্যেবাদী বলছে ন-টা!
.
০৩.
অজগাঁইয়া যেরকম ওয়াকিফ হবার চেষ্টা না দিয়েই ধরে নেয় দিল্লি মেলও তার ধেধধেড়ে গোবিন্দপুর ফ্ল্যাগ ইসটিশানে দাঁড়াবে এবং চেপে বসে নিশ্চিন্দি মনে তামুক টানে, আমার বেলাও হয়েছিল তাই। আমার অপরাধ আরও বেশি। আমি জেনেশুনেই অপকর্মটি করেছিলুম। আমি ভালো করেই জানতুম যে প্লেনে যাচ্ছি সেটা যদিও জর্মনির উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তবু সে দেশের কোনও জায়গায় দানাপানির জন্যও নামবে না। অবশ্য অ্যার-ইন্ডিয়ার মুরুব্বি আমার, একগাল হেসে আমায় বলেছিলেন, এ প্লেনটা কিন্তু প্যারিসে নামে। আপনি সেখানে চলে যান। দু-চারদিন ফুর্তিফার্তি করে চলে যাবেন জর্মনি। খর্চা একই। আর প্যারিসে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ সঙ্গে যে মিত্রটি ছিলেন তিনিও মৃদু হেসে সায় দিলেন। দু জনারই বয়স এই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। মনে মনে বললুম, এখন কলকাতা-দিল্লির রাস্তাঘাটেই যা দেখতে পাওয়া যায় প্যারিসের নাইট ক্লাব-কাবারে তার চেয়ে বেশি আর কী ভেল্কিবাজি দেখাবে? তদুপরি বানপ্রস্থে যাবার বয়সও আমার বহুকাল হল তামাদি হয়ে গিয়েছে। এ বয়সে নির্বাণদীপে কিমু তৈলদানং? তাই আখেরে স্থির হল আমি অ্যার-ইন্ডিয়া প্লেন থেকে সুইটজারল্যান্ডের জুরিচে (স্থানীয় ভাষায় স্যুরষি) নামব। হেথায় চেঞ্জ করে ভিন্ন প্লেনে মৌকামে পৌঁছব অর্থাৎ জর্মনির কলোন শহরে। তাই সই।
ফরাসিনীকে বিস্তর বঁ ভোয়াইয়াজ (গুড জনি, গুড ফ্লাইট) বলে জুরিচের অ্যার পোর্টে নেমে পাসপোের্ট দেখালুম। তার পর গেলুম খবর নিতে কলোনে যাবার প্লেন কখন পাব। উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ, জড়। দেশে বলে,
অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর ॥
তখন বেজেছে সকাল ন-টা। রামপন্টক বলে কি না, কলোন যাবার প্লেন দ্বি-প্রহরে। বিগলিতাৰ্থ আমাকে নিরেট তিনটি ঘণ্টা এখানে বসে বসে আঙ্গুল চুষতে হবে।
শুনেছি, যে-রোগী দশ বত্সর ধরে পক্ষাঘাতে অসাড় অবশ সে নাকি মৃত্যুর সময় অকস্মাৎ বিকট মুখভঙ্গি করে, তার সর্বাঙ্গ খিচোতে থাকে, হঠাৎ দশ বৎসরের টান-টান-হাঁটু যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে থুতনির দিকে গোত্তা মারতে চায় এবং মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বেরোতে থাকে।
আমার হল তাই। আমি হয়ে গিয়েছিলুম অচল অসাড়। স্তম্ভিত বললুম না, কারণ আজকের দিনের পয়লা নম্বরি অ্যারপোর্টে স্তম্ভ আদৌ থাকে না। যাই হোক যাই থাক, আমার মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল আতশবাজির ঝটকা, তুবড়ির পর তুবড়ির হিংস্র হিস্ হিস্ আর পটকা বোমার দুদ্দাড় বোম্-বাম। আর হবেই না কেন? যে জুরিচের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কর্ণপটহবিদারক তথা নয়নান্ধকারক আতশবাজি ছাড়ছি সেই আতসবাজিকেই আপন জর্মন ভাষায় বলে বেঙ্গালিশে বেলায়েষটুঙ অর্থাৎ বেঙ্গল রোনানি; এবং এ-দেশের ফরাসি অংশে বলে ফ্য দ্য বাঙাল অর্থাৎ ফায়ার অব বেঙ্গল।* তদুপরি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফরাসি ভাষায় বঙ্গদেশকে বাঙ্গাল রূপে উচ্চারণ করে। আমি বাঙাল বঙ্গসন্তান। আমি আমার জন্মনি, জন্মনি অধিকার অর্থাৎ বার্থরাইট ছাড়ব কেন? ফায়ার ওয়ার্কস চালাবার যদি কারও হক্ক থাকে তবে সে আমার। হুহুঙ্কার ছাড়লুম :
কী বললে? ঝাড়া দিনটি ঘণ্টা আমাকে এই অ্যারপোর্টে বসে কলোনের প্লেনের জন্য তাজ্জিম মাজ্জিম করতে হবে? আমার দেশ যে ভারতবর্ষকে তোমরা অন্ডর ডিভালাপড় কন্দ্রি– সাদামাটা ভাষায় অসভ্য দেশ- বল, সেখানেও তো তিন-তিনটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না, কনেকশনের জন্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি রেলগাড়ির কথাই বলছি। আমি যদি আজ ভারতের যে-কোনও ডাকগাড়িতে করে যে-কোনও জংশনে পৌঁছই তবে আধ ঘণ্টার ভিতর কনেকশন পেয়ে যাই। না পেলে সেটাও সাতিশয় কালে-কস্মিনে–খবরের কাগজে জোর চেল্লাচেল্লি করি (মনে মনে বললুম অম্মদেশীয় রেলের কর্তারা তার ঘোড়াই কেয়ার করেন!) অ্যারোপ্লেনের তো কথাই নেই। সে তো আরও তড়িঘড়ি কনেকশন দেয়। আমাকে যত তাড়াহুড়ো করে মোকামে পৌঁছে দিতে পারে, ততই তার লাভ। অন্যত্র অন্য প্যাসেঞ্জারের সেবার্থে যেতে পারলে তার আরও দু পয়সা হয় … অ! তোমাদের বিস্তর ধনদৌলৎ হয়ে গিয়েছে বলে তোমরা আর পয়সা কামাতে চাও না? আর শোন ব্রাদার, এ তো হল ট্রেন-প্লেনের কাহিনী, গরুর গাড়ির নাম শুনেছ? বুলক কার্ট? সেই গরুর গাড়িতে করে
[*আমার এক সুপণ্ডিত মিত্র বহু গবেষণার পর স্থির করেছেন; এদেশে গুড় তৈরি হত বলে এর নাম গৌড় (এবং গুড় থেকে রাম মদ তৈরি হত বলে তার নাম গৌড়ী– মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে যেমন মধু থেকে মাধ্বী মদ)। এবং এই গুড় সর্বপ্রথম চীন দেশে রিফাইনড হয়েছিল বলে এর নাম চিনি (পরে মিশরে তৈরি চিনির নাম হল মিসরি বা মিশ্রী)। তার মতে বারুদ প্রথম আবিষ্কৃত হয় বাঙলা দেশে আতশবাজির জন্য। চীনদেশে সেটা সর্বপ্রথম আগ্নেয়াস্ত্রে ব্যবহৃত হয় বলে চীনদেশকে বারুদের আবিষ্কারক বলা হয় এবং সেটা ভুল।]
যদি আমি দশ-বিশ মাইল যাই তবে সেখানে পৌঁছেও সঙ্গে সঙ্গে কনেকশন পাই। বোলপুর থেকে ইলামবাজার গিয়ে নদীর ওপারে তদ্দণ্ডে অন্য গরুর গাড়ির কনেকশন হামেহাল তৈরি। বস্তুত তখন ওপারের গাড়োয়ানরা গ্রাহককে পাকড়াও করার জন্য যা হৈ-হুঁল্লোড় লাগায় তার সামনে আন্তর্জাতিক পাণ্ডা প্রতিষ্ঠানের জেরুজালেম-পাণ্ডারা পর্যন্ত নতমস্তক হন। এ নিয়ে আমি অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত–থুড়ি, পাঁচখানা ইলিয়াড দশখানা ফাউসট লিখতে পারি। কিন্তু উপস্থিত সেটা স্থগিত থাক। আমার শেষ কথা এইবারে শুনে নাও। এই যে আমি কন্টিনেনটে এসেছি তার রিটার্ন টিকিটের জন্য কত ঝেড়েছি জানো? এক-একটা টাকা যেন নাক ফুটো করে কুরে কুরে বেরিয়েছে- তোমরা যাকে বল, পেইংথ দি নোজ। রোক্কা ছ হাজার পাঁচশোটি টাকা। তার পর ফরেন এক্সচেঞ্জ গয়রহ হিসাবে নিলে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো। এ ভূখণ্ডে থাকব মাত্র তিনটি মাস। এইবারে হিসাব কর তো সে বসে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম, এই যে কনেকশনের জন্য আমার তিনটি ঘণ্টা বরবাদ করলে তার মূল্যটা কী? সে না হয় গেল। কিন্তু সে সময়টা যে বন্ধুবান্ধবীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলে তার জন্য তোমার হৃদয়বনে কোনও সন্তাপানল প্রজ্বলিত হচ্ছে না? তারা—
ইতোমধ্যে আমার চতুর্দিকে একটা মিনি মাক্সির মধ্যিখানের মিডি সাইজের ভিড় জমে গিয়েছে। ফ্রি এন্টারটেনমেন্ট। আমার সোক্রোতেসপারা কিংবা দ্রৌপদী যে রকম রাজসভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন সেই ধরনের যুক্তিজাল বিস্তার এদের হৃদয়বনে যেন মলয়বাতাসের হিল্লোল, দে দোল দোল খেলিয়ে গেল। এদের বেশিরভাগই আমার বেদনাটা সহানুভূতিসহ প্রকাশ করছে। য়া য়া, উই উই, সি সি যাবতীয় ভাষায় আমাকে মিডি-সমর্থন জানাচ্ছে। আমি ফের তেড়ে এগুতে যাচ্ছি এমন সময়
এমন সময় সর্বনাশ! একটি কুড়ি-একুশ বছরের কিশোরী, আমি যাকে কেছে মুছে ইস্ত্রি মেরে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছি, কাউন্টারের পিছনের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বললে, আপনার টেলিফোন। তনুহূর্তেই সেই মহাপ্রভু তেলব্যাজ না করে, যেন সসেমিরে দে ছুট দে ছুট। লোকটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের আমারে ডাক দিলে কে ভিতর পানে গানটি জানে।
কিশোরী একগাল হেসে আমাকে শুধালে, আপনার জন্য কী করতে পারি স্যার?
দুত্তোর ছাই। আধ-ফোঁটা এই চিংড়ির সঙ্গে লড়াই দেব আমি।
নাথিং বাট ইয়োর লভ। বলে দুমদুম করে লাউঞ্জের সুদূরতম প্রান্তে আসন নিলুম।
.
০৪.
সোফাটা মোলায়েম। সামনে ছোট্ট একটি টেবিল।
বেজার মুখে বসে আছি। এমন সময় দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু হাতে দুটি ভর্তি ওয়াইনগ্লাস নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক যতখানি নিচু হয়ে অপরিচিতজনকে বাও করাটা কেতাদুরস্ত তাই করে শুধোলেন, ভু পেরমেতে, মসিয়ো–অর্থাৎ আপনার অনুমতি আছে, স্যার? নিশ্চয়, নিশ্চয়। যদিও সোফাটির যা সাইজ তাতে পাঁচজন কিংকং অনায়াসে বসতে পারে তবু দ্ৰতা দেখাবার জন্য ইঞ্চিটাক সরে বসলুম। ভদ্রলোক ফের কায়দামাফিক বললেন, ন ভু দেরাজে পা, জ ভু প্রি। এর বাংলা অনুবাদ ঠিক কী যে হবে, অতখানি ফরাসি জানিনে, বাঙলাও না। মোটামুটি না, না, ব্যস্ত হবেন না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। উর্দুতে বরঞ্চ খানিকটে বলা যায়, কফ ন্ কিজিয়ে ওই ধরনের কিছু একটা। তকলুফ কথাটা তকলিফ (বাঙলায় কিছুটা চালু) অর্থাৎ কষ্ট। মোদ্দা : আপনাকে কোনও কষ্ট দিতে চাইনে।
সেই দুটো গ্লাস টেবিলে রেখে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আরেকটা নিজে তুলে নিয়ে বললেন, আপনার স্বাস্থ্যের মঙ্গলের জন্য।
চেনাশোনা কিছুই নেই। খোদার খামোখা এ-লোকটা ড্রিংক দিচ্ছে কেন? তবে কি লোকটা কনফিডেনস ট্রিকস্টার? আমাদের হাওড়া-শ্যালদাতে যার অভাব নেই। ভাবসাব (কনফিডেনস) জমিয়ে বলবে, দাদা, তা হলে আপনি টিকিটদুটো কিনে আনুন। এই নিন আমার লিলুয়ার পয়সা, আমি মালগুলো সামলাই। …টিকিট কেটে ফিরে এসে দেখলেন, ভোঁ ভোঁ। আপনার মালপত্র হাওয়া।
কিন্তু এ লোকটা আমার নেবে কী? সুকুমার রায়(?) একদা একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। বিরাট ভুড়িওলা জমিদার টিঙটিঙে দারোয়ানকে শাসিয়ে শুধোচ্ছেন, চোর ভাগা কিও? দারওয়ান বললে, মেরা এক হাতমে তলওয়ার, দুসরেমে ঢাল। পকড়ে কৈসে? আমার এক হাতে তলওয়ার, অন্য হাতে ঢাল। ধরি কী করে?
আমার একপাশে আমার মিত্রের দেওয়া এটাচি, অন্যদিকে অ্যার ইন্ডিয়ার দেওয়া ছোট্ট একটি বাসো। দুটোই তো বগলদাবা করে বসে আছি। লোকটাকে দেখে তো মনেও হচ্ছে না, ও স্বৰ্গত পি সি সরকার (এস্থলে বলে রাখা ভালো সরকার কখনও এহেন অপকর্ম করতেন না) যে আমার দুটি বাক্স সরিয়ে ফেলবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এরকম রুচিসম্মত পোশাক-আশাক আমি একমাত্র ডিউক অব উইনডসরকে (উচ্চারণ নাকি উইনজার) পরতে দেখেছি– জীবনে একবার। ডিউকের জীবনে একবার নয়, আমার জীবনে একবার। সে বেশের বর্ণনা অন্যত্র দেব।
একখানা কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাঁর নাম আঁদ্রে দ্যুপোঁ। তার পর একগাল হেসে শুধোলেন, যদি অপরাধ না নেন তবে একটি প্রশ্ন শুধাই, আপনি কি কসটিঙে বিশেষজ্ঞ?
আমি থতমত খেয়ে শুধোলুম, কটিঙ? সে আবার কী?
দ্রলোক আরও থতমত খেয়ে কিন্তু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে কী মশাই! এইমাত্র আপনার অনবদ্য লেকচারটি শুনলুম, আপনি ক হাজার টাকা ঝেড়ে কলকাতা থেকে এদেশে আসার রিটরন টিকিট কেটেছেন, এবং কনেকশন না পেয়ে তিন ঘন্টাতে আপনার কী পরিমাণ অর্থক্ষয় হল তার পুরো-পাক্কা, করেক্ট টু দি লাস্ট সাতিম, ব্যালানস শিট। একেই তো বলে কসটিঙ। আমি ব্যবসাবাণিজ্য করি। ওই নিয়ে নিত্যি নিত্যি আমার ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু সে-কথা থাক। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি প্রস্তাব নিয়ে। আপনার যখন তিন ঘন্টা বরবাদ যাচ্ছে তখন এক কাজ করুন না? মিনিট পনেরো পরে এখান থেকে একটা প্লেন যাচ্ছে জিনিভা; আমি সে প্লেনে যাচ্ছি। আপনি চলুন আমার সঙ্গে জিনিভায়। আমার সামান্য একটি বাড়ি আছে সেখানে। আপনার খুব একটা অসুবিধে হবে না। বেড-রুম, বাথরুম, ডাইনিং রুম, স্টাডি সব নিজস্ব পাবেন। (আমি মনে মনে মনকে শুধুলুম একেই কি বলে সামান্য একটি বাড়ি?)–আমাদের সঙ্গে আহারাদি, দু দণ্ড রসালাপ করে জিরিয়ে জুরিয়ে নেবেন। তার পর আপনাকে আপনার মোকাম কলোনগামী প্লেনে তুলে দেব। তার পর একটু ইতি-উতি করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমি এ প্রস্তাবটা নিজের স্বার্থেই পাড়ছি। আমার একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। ষোল, চোদ্দ, দশ। আপনার সঙ্গে আলাপচারী করে তারা সত্যই উপকৃত হবে। এদেশে চট করে একজন ইন্ডিয়ান পাওয়া যায় না। পেলেও তিনি ফরাসি জানেন না। আর আমার বিবি খাসা রাঁধতে পারেন—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এই দশ মিনিটের ভিতর আপনি আমার জন্য জিনিভার টিকিট পাবেন কী করে?
মসিয়ো দ্যুপোঁ মুচকি হেসে বললেন, সেই ফরমুলা, ন ভু দেরাজে পা –আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা-ওটা ম্যানেজ করার কিঞ্চিৎ এলেম আমার পেটে আছে; নইলে ব্যবসা করি কী করে! কাচ্চাবাচ্চারা বড় আনন্দ পাবে। প্লেনের ভাড়াটার কথা আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না
আমি ফের বাধা দিয়ে বললুম, আপনি ও বাবদে চিন্তা করবেন না। অ্যার-ইন্ডিয়ার আমার টিকিটটি অমনিবাস, অর্থাৎ যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারি; তার জন্য আমাকে ফালতো কড়ি ঢালতে হবে না (পাঠক, এ ধরনের মোটর অমনিবাসকে কবিগুরু নাম দিয়েছেন বিশ্বস্বহ। এবং তদীয় অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ মোটরগাড়ি, অটোমবিলকে, যেটা আপন শক্তিতে চলে, তার নাম দিয়েছিলেন স্বতশ্চলশকট। অতএব এস্থলে আমার যানবাহন প্লেনের টিকিটকে স্বতশ্চল বিশ্বষহ মূল্য পত্রিকা অনায়াসে বলা যেতে পারে)।
একটু থেমে বললুম, আমি এখখুনি আসছি। অর্থাৎ সেস্থলে যাচ্ছি, যেখানে রাজাধিরাজও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না অর্থাৎ শৌচাগার।
সেদিকে যাইনি। যাচ্ছিলুম অন্য পথে! অ্যাটাচি বাকসো সোফাতেই রেখে এসেছি। এরকম সহৃদয় সজ্জনকে বিশ্বাস করে আমি বরঞ্চ এ দুটো হারাব, অবিশ্বাস করতে ঘেন্না ধরে। গেলুম বার-এ। সেখানে মসিয়ো যে ওয়াইন এনেছিলেন তারই দু গ্লাস কিনে ফিরে এলুম সোফায়! একটা গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য কামনা করে বললুম, আপনার আন্তরিক আমন্ত্রণের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা বড়ই অসুবিধে আছে। কলোন অ্যারপোর্টে আমার বন্ধুবান্ধবরা অপেক্ষা করছে। তারা খবর নিয়ে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছে, আমি তিন ঘণ্টা পরে কনেকশন পাব। আমি আপনার সঙ্গে জিনিভা গেলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তারা বড় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে।
আর মনে মনে ভাবছি, ইহসংসারে, এমনকি ইউরোপেও সেই বাগদাদের আবু হোসেনও আছে যারা রাস্তায় অতিথির সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একা একা খেতে পারে না।
মসিয়ো বড্ডই দুঃখিত হয়ে প্রথম বললেন, কিন্তু আপনি আবার আমার জন্য ড্রিংক আনলেন কেন? এ কি দেনা-পাওনা!
আমি মাথা নিচু করলুম। দ্যুপো বললেন, তা হলে দেশে ফিরে যাবার সময়ে আমার ওখানে আসবেন?
তাঁর একটি পকেট-বই বের করে বললেন, কিছু একটা লিখে দিন। ছেলেমেয়েরা খুশি হবে। আমি তৎক্ষণাৎ লিখলুম :
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু
পরকে করিলে ভাই।
হায়! ফেরার পথেও দ্যুপোঁর বাড়িতে যেতে পারিনি।
.
০৫.
জুরিকের মতো বিরাট অ্যারপর্টে কী করে মানুষ একে অন্যকে খুঁজে পায় সেটা বোঝবার চেষ্টা করে ফেল মেরেছি। তা হলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে এখানকার কর্মচারীদের পেটেপিঠে এলেম আছে। তাদেরই একজন আমার সামনে এসে বললে, আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে, স্যার। আমি সত্যই বিস্মিত হলুম। আমাকে এই সাহারা ভূমিতে চেনে কে? বললুম, ভুল করেননি তো; এজ্ঞে না। আমি জানি–সঙ্গে সঙ্গে ছোকরা আমার পুরো নামটি বলে দিল। যদিও সে এদেশেরই লোক তবু আমার মনে হল সে দেশ পত্রিকার পঞ্চতন্ত্র নিত্য সপ্তাহে পড়ে এবং তারই মারফত আমার ভোলা নামটি পুরো পাক্কা রপ্ত করে নিয়েছে। হয়তো ডাকনামটাও জানে। হয়তো ভোম্বল ক্যাবলা জাতীয় আমার সেই বিদঘুঁটে ডাকনামটা সে পাঞ্চজন্যে শঙ্খধ্বনিতে প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু এসব ভাববার চেয়ে ঢের বেশি জানতে চাই, কে আমাকে স্মরণ করলেন।
অ ৷ ফ্রলাইন ফ্রিডি বাওমান। কিন্তু ইনি জানলেন কী প্রকারে যে আমি আজ সকালে এখানে পৌঁচচ্ছি। তাঁর মেসেজ খুলে জিনিসটে পরিষ্কার হল। কলকাতা ছাড়ার পূর্বে অ্যার ইন্ডিয়ার ইয়াররা শুধিয়েছিলেন, জুরিকে আমার কোনও পরিচিতজন আছেন কি না, কেননা ওখানে আমাকে কনেকশনের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। খবর পাঠালে ওঁরা হয়তো অ্যারপোর্টে এসে আমাকে সঙ্গসুখ দেবেন। আমি উত্তরে বলেছিলুম, জুরিকে নেই, তবে সেখানে থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে লুৎসের্ন শহরে একটি পরিচিত মহিলা আছেন এবং তার নামঠিকানা দিয়েছিলুম। এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম বেবাক। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনো নারিকেল; দুই ভাণ্ড সরিষার তেল; আমসত্ত্ব আমচুর– এর মাঝখান কবিগুরু যদি তার প্রিয়া-কন্যাকে ভুলে যান তবে সাতান্নটা হাবিজাবির মাঝখানে আমি যে এটা মনে রাখিনি তার জন্য সদয় পাঠক রাগত হবেন না।
কিন্তু এই সুবাদে সেই খাঁটি জাত-সুইস মহিলাটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করে দিতে চাই। ফ্রিডি বাওমান। ১৯৪২/৪৩-এ ইনি সেই মহারাজা সয়াজি রাওয়ের বরোদা প্রাসাদে প্রবেশ করেন। আজকের দিনে ক্রিকেট কিংবা এবং পলিটিকসের সঙ্গে যাঁদেরই সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন বরোদার শ্ৰীযুত ফতেহ সিং রাও গায়কোয়াড়কে। এই ফ্রিডির হাতেই তিনি পৃথিবীতে পদার্পণ করেন। অথবা মস্তকাবতীর্ণ করেন। কিন্তু তার ওপর আমি জোর দিচ্ছিনে। রাজা মহারাজা ভিখিরি আতুর পৃথিবীতে সবাই নামেন একই পদ্ধতিতে।
আসল কথা, ফতেহ সিং রাও মানুষ হন ফ্রিডির হাতে। তিনি অসাধারণ শিক্ষিতা রমণী– সেই ছাব্বিশ বছর বয়সেই। জর্মন, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইংরেজি সবকটাই বড় সুন্দর জানতেন। এদেশে এসেছিলেন বেকারির জন্য নয়। রোমান্টিক হৃদয়; ইন্ডিয়াটা দেখতে চেয়েছিলেন। গ্যোটে তাঁর প্রিয় কবি। গ্যোটের ভারতপূজা তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। ওদিকে তার উত্তম উত্তম পুস্তক পড়ার অভ্যেস চিরকালের। রাজপ্রাসাদের কাজকর্মও শুরুভার নয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে কী করে তার প্রিয়সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণীর মর্মস্থলে পৌঁছে গেলেন সেটা বুঝলুম যেদিন তিনি আমাকে বললেন যে ছেলেবেলা থেকেই তিনি সেন্ট ফ্রান্সসিস আসিসির ভক্ত। এবং সকলেই জানেন, এই সন্তটির সঙ্গেই ভারতীয় শ্রমণ সন্ন্যাসী, সাধুসন্তের সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য। একদিকে যেমন দরিদ্রনারায়ণের সেবা, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পরমাত্মার ধ্যানে মগ্ন হয়ে প্রভু খ্রিস্টের সঙ্গে একাত্মবোধ করাতে তিনি এদেশের মরমীয়া সাধক, ইরান-আরব-ভারতের সুফিদের সঙ্গে এমনই হরিহরাত্মা যে অনেক সময় বোঝা কঠিন কার জীবনবৃত্তান্ত পড়ছি। খ্রিস্টানের, ভক্তের না সুফির?
কিন্তু আমার কী প্রগলভতা যে আমি তার জীবনীর সংক্ষিপ্ততম ইতিহাসও লিখতে পারি। দেশ পত্রিকার প্রিয়তম লেখক শ্রীযুক্ত ফাদার দ্যতিয়েন যদি বাঙলায় তার জীবনী লেখেন তবে গৌড়জন তাহা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। কুমারী ফ্রিডির কথা পুনরায় লিখব। কন্টিনেন্ট সেরে, দেশে ফেরার পথে, লুৎর্সেন শ্রীমতীর বাড়িতে সপ্তাহাধিককাল ছিলুম– সেই সুবাদে। উপস্থিত ফ্রিডি লিখেছেন, তিনি আমার (অ্যার ইন্ডিয়া মারফত) টেলে পেলেন কাল রাত্রে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জুরিকের অ্যারপোটে ট্রাঙ্ক-কল করে জানালেন, আমি জুরিতে নেবেই যেন তাকে ট্রাঙ্ক-কল করি। বরাবর তিনি বাড়িতেই থাকবেন।
মনে হয় কত সোজা। কিন্তু যারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চান তাদের উপকারার্থে এস্থলে কিঞ্চিৎ নিবেদন করে রাখি।
প্রথমত আমাকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করতে হবে। সে বুথ আবার সদু ব্রাহ্মণ। আপন দেশজ খাদ্য ভিন্ন অন্য খাদ্য খান না। অর্থাৎ তার বাক্সে আপনাকে ছাড়তে হবে এদেশের আপন সুইস মুদ্রা। অতএব গো-খোঁজা করুন, সে সাহারাতে, কোথায় সে পুণ্যভূমি যেখানে আপনার ডলার বা পৌন্ডের বদলে সুইস মুদ্রা দেবে। সবাই তো ইংরেজি বোঝে না। ভুল বুঝে অনেকেই। তারা কেউ বলে ওই তো হোথায়, কেউ বলবে তার জন্য তো শহরে যেতে হবে। শেষটায় পেলেন সেই কাউন্টার পুণ্যভূমি– আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি। পেলেন সুইস বস্তু। তখন আবার ভুল করে যেন শুধু কাগজের নোট না নেন। কারণ ফোন বুথ কাগজাৰ্থর্যাশী নন; তিনি চান মুদ্রা। সেই মুদ্রা আবার ওই সাইজের হওয়া চাই। ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে চলুন ফের ওই পুণ্যভূমিতে। আরও বহুবিধ ফাড়াগৰ্দিশ আছে। বাদ দিচ্ছি।
আহা! কী আনন্দ!! কী আনন্দ!!!
কে বলছেন? আমি ফ্রিডি।
আমি সৈয়দ।
.
০৬.
ওইয-যা! ট্রাঙ্ক লাইন কেটে গেল! পাবলিক বুথ থেকে ট্রাঙ্ক-কল করা এক গব্বযন্তনা, আমি যে দুটি মুদ্রা মেসিনে ফেলে লুৎর্সেন পেয়েছিলুম, তার ম্যাদ ফুরিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আর দুটো না ফেলার দরুন লাইন কাট অফফ। ফের ঢালো কড়ি।
অতি অবশ্য সত্য, ফোনযন্ত্রের বাকসে সুইটজারল্যান্ডে প্রচলিত তিন-তিনটি ভাষা– ফরাসি, জর্মন এবং ইতালীয়– লেখা আছে কোন গুহ্য সরল পদ্ধতিতে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হয়। লেখা তো অনেক কিছুই থাকে। ধর্মগ্রন্থে তো অনেক কিছুই লেখা থাকে। সেগুলো পড়লেই বুঝি মোক্ষলাভ হয়! জিমনাস্টিকের কেতাব পড়লেই বুঝি কিক্কড় সিঙ-এর মতো মাসল গজায়! প্র্যাকটিস করতে হয়। এবং তার জন্য খেসারতিও দিতে হয়। উপযুক্ত শুরু বিনা যোগাভ্যাস করতে গিয়ে বিস্তর লোক পাগল হয়ে যায়।… আমি ইতোমধ্যে প্রায় দেড় টাকার মতো খেসারতি দিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি। আর, এ খেসারতির কোনও আন্তর্জাতিক মূল্য নেই। কারণ জর্মনি, ফ্রান্স, ইংলন্ড প্রায় প্রত্যেক দেশই আপন আপন কায়দায় আপন আপন মেসিন চালায়। আর সেইখানেই কি শেষ? তিন মাস পরে যখন ফের সুইটজারল্যান্ডে আসব, তখন দেখব, বাবুরা এ ব্যবস্থা পালটে দিয়েছেন। নতুন কোনও এক আবিষ্কারের ফলে যন্ত্রটার ব্যবহার নাকি সরলতর করেছেন। সরলতর না কচু! তাই যারা এসব ব্যাপারে ওয়াকিফহাল নন, যারা এই হয়তো পয়লাবারের মতো কন্টিনেন্ট যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমার সরলতম উপদেশ, বিগুরু এসব যন্ত্রপাতি ঘাটাতে যাবেন না। অবশ্য শুরু পাওয়া সর্বত্রই কঠিন; এখানে আরও কঠিন। যে যার ধান্দা নিয়ে উধ্বশ্বাসে হন্তদন্ত। কে আপনাকে নিয়ে যাবে সেই বুথ-গুহায়, শিখিয়ে দেবে সে গুহায় নিহিতং ধর্মস্য তত্ত্বং!
যাক! ফের পাওয়া গিয়েছে লাইন।
তুমি লুৎর্সেন কখন আসছ?
অপরাধ নিও না। আমি উপস্থিত যাচ্ছি কলোন। তার পর হামবুর্গ ইত্যাদি। তার পর লন্ডন নটিংহাম। সেখান থেকে ফেরার পথে লুৎর্সেন। তুমি খেদিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার বাড়িতে।
দ্যৎ! কিন্তু তদ্দিনে এখানে যে বড় শীত জমে যাবে। গরম জামা-কাপড় এনেছ তো? মাখট নিষটস (নেভার মাইন্ড- আসে-যায় না)! আমার কাছে আছে।
তুমি এখনও ফ্রানসিস আসিসিরই শিষ্যা রয়ে গিয়েছ– কী করে কাতর জনকে মদৎ করতে হয়, সে-ই তোমার প্রধান চিন্তা। আমি কি তোমার স্কার্ট ব্লাউজ পরে রাস্তায় বেরুব? সেকথা থাক। আমাকে অ্যারপোর্টে আরও তিন ঘন্টাটাক বসে থাকতে হবে। চলে এসো না এখানে। আজ তো রোববার। তোমাকে অফিস দফতর করতে হবে না।
রোববার! সেই তো বিপদ। বাড়ি থেকে যেতে হবে লুৎর্সেন স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে করে জুরিক। পঁয়ত্রিশ মাইল। সেখান থেকে বাস-এ করে তোমার অ্যারপর্টে। রোববার বলে আজ ঢের কম সার্ভিস। সবকটা উঠতি-নাবতিতে টায় টায় কোথায় পাব কনেকশন–আমি মনে মনে বললুম, :। ফের সেই কনেকশন। ইলামবাজার রামপুরহাট। ফ্রিডি বললে, আচ্ছা দেখি।
আমি বললুম, কতকাল তোমাকে দেখিনি।
ফ্রিডি যদি এখানে আসেই তবে তার বাস দাঁড়ায় কোথায়? আমি বসে আছি ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের খোঁয়াড়ে। এখানে তো ফ্রিডির প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য সে এদেশের রীতিমতো সম্মানিতা নাগরিকা (সংস্কৃত অর্থে নয়) সিজেন্। কাজেই সে স্পেশাল পারমিট জোগাড় করতে পারবে। তবে সেটা জোগাড় করতে করতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? আম আনতে দুধ না ফুরিয়ে যায়। ততক্ষণে হয়তো আমার কলোনগামী প্লেনের সময় হয়ে যাবে।
বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে আমাকে খোয়াড় থেকে বেরোতে হয়। কিন্তু আমাকে বেরুতে দেবে কি? খোয়াড়ের বাইরেই স্বাধীন, মুক্ত সুইটজারল্যান্ড। তার জন্য ভিজার প্রয়োজন। আমার সেটা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখাই যাক না, কী হয় না হয়। সুকুমার রায় বলেছেন, উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায় সেইটি পড়ে আমার এক সখা ডাকপিয়নকে বলেছিল, আমার কোনও চিঠি নেই? কী যে বলছ? ফের খুঁজে দেখ। উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়।
খোয়াড়ের গেটে গিয়ে সেখানকার উর্দিপরা তদারকদারকে অতিশয় সবিনয় নিবেদন করলুম, স্যর! আমি কি একটু বাইরে ওই বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারি?
আপনি তো ট্রানজিট। না?
আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললুম, বাস-এ করে লুৎর্সেন থেকে আমার একটি বান্ধবী হায় পাঠক, তুমি সেই তদারকদারের প্রতিক্রিয়া যদি তখন দেখতে। বান্ধবী! বান্ধবী!! সেরতেমা (সার্টনলি) চেত্মানতে (ইতালিয়ানে, সার্টনলি) এবং তার পর জর্মনে জিষার জিষার (শিওর, শিওর) এবং সর্বশেষে যদি কূল না পায়, মার্কিন ভাষায় শিয়ের শিয়ে।
আমি জানতুম, আমি যদি বলতুম, আমার বন্ধু আসছেন, সে বলত, নো। যদি বলতাম আমার বিবি, উত্তর হত তদ্বৎ। যদি বলতুম, বৃদ্ধা মাতা, তখনও হত না– হয়তো কিঞ্চিৎ থতমত করে। কিন্তু বান্ধবী! আমার সাতখুন মাপ।
.
০৭.
কলোনের নাম কে না শুনেছে? বিশেষ করে হেন ফ্যাশনেবল মহিলা আছেন কি যিনি কস্মিনকালেও প্রসাধনাৰ্থে ও-দ্য-কলোন– জর্মনের ক্যলনিশ ভাষায়– কলোনের জল ব্যবহার করেননি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই তরল সুগন্ধটির। ৪৭১১ এবং মারিয়া ফারিনা এই দুটিকেই সবচেয়ে সেরা বলে ধরা হয়। এদেশেও কলোন জল তৈরি হয় কিন্তু ওটা বানাতে হলে যে সাত-আট রকমের সুগন্ধি ফুলের প্রয়োজন, তার কয়েকটি এদেশে পাওয়া যায় না– সর্বোপরি প্রাকপ্রাণালী তো আছেই। বিলেতেও কলোন জলের এতই আদর, যে হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেম্বারলেন যখন সপরিষদ কলোন থেকে মাইল বিশেক দূরে গডেসবের্গ-এর মুখোমুখি, রাইন নদীর ওপারে যে বাড়িতে ওঠেন, তার প্রতি ঘরে কলোন জল, কলোন জলের সুগন্ধ দিয়ে নির্মিত গায়ে মাখার সাবান, দাড়ি কামাবার সাবান, ক্রিম, পাউডার– বস্তুত প্রসাধনের তাবৎ জিনিস রাখা হয়েছিল। হিটলারের আদেশে। চেম্বারলেন এই সূক্ষ্ম বিদগ্ধ আতিথেয়তা লক্ষ করেছিলেন কি না জানিনে। কারণ তখন তার শিরঃপীড়া, তাঁর এ অভিসার তাঁর দেশবাসী কী চোখে দেখবে। তাঁর আপন ফরেন অফিস যে সেটা নেকনজরে দেখছে না, সেটা তিনি জানতেন, কারণ ইতোমধ্যেই তারা একটা প্যারডি নির্মাণ করে ফেলেছে :
ইফ এট ফার্স্ট ইউ কানট সাকসিড/ ফ্লাই ফ্লাই এগেন।
বলা বাহুল্য চেম্বারলেন ফ্লাই করে গিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই গডেসবের্গ-এর উপর দিয়ে কলোন পানে ফ্লাই করে যাচ্ছিই। সেই সুবাদে প্যারডিটি মনে পড়ল।
জুরিচে ফ্রিডির সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলুম। মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
কলোন শহরের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের পরিচয়।
এখান থেকে প্রায় চোদ্দ মাইল দূরে বন। সেখানে যৌবনে পড়াশুনা করেছিলুম। ট্রামে, বাস-এ, ট্রেনে, জাহাজে করে এখানে আসা অতি সহজ। আমার একাধিক সতীর্থ কলোন থেকে বন ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করত। তাদের সঙ্গে বিস্তর উইকএন্ড করেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরটাকে দেখেছি।
সেসব সবিস্তর লিখতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হবে। আর লিখতে যাবই-বা কেন? জর্মন টুরিস্ট ব্যুরো যদি আমাকে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ-বিদায় করত তবে না হয়—
যদি নিতান্তই কিছু বলতে হয়, তবে প্রথম নম্বর সম্বন্ধে বলি যে, সেটি আপনি চান কি না চান, কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। কলোনের বিরাট গগনস্পর্শী গির্জা। প্যারিসে যেরকম যেখানেই যান না কেন, অ্যাফ্যাল টাওয়ারটা এড়াতে পারবেন না, কলোনের এই কেথিড্রেলটির বেলাও তাই। তবে অ্যাফ্যাল স্তম্ভ বদখদ, কিন্তু কলোনের গির্জাচুড়ো তন্বঙ্গী সুন্দরী। যেন মা-ধরণী উপানে দুবাহু বাড়ায়ে পরমেশ্বরকে তাঁর অনন্ত অবিচ্ছিন্ন নমস্কার জানাচ্ছেন।
এ গির্জা আবার আমাদের কাছে নবীন এক গৌরব নিয়ে ধরা দিয়েছে।
বছর দুত্তিন পূর্বে কলোনবাসী প্রায় শ-দুই তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান ওই গির্জার প্রধান বিশপকে গিয়ে আবেদন জানান, এ বছর ঈদের নামাজ শীতকালে পড়েছে। বাইরে বরফ; সেখানে নামাজ পড়ার উপায় নেই। হুজুর যদি আপনাদের এই গির্জের ভিতরে আমাদের নামাজ পড়তে দেন, তবে আল্লা আপনাকে আশীর্বাদ করবেন। বিশপের হৃদয়কন্দরে কণামাত্র আপত্তি ছিল না কিন্তু…? এ শহরের লোক খ্রিশ্চান। তাদেরই বিত্ত দিয়ে, গরিবের কড়ি দিয়ে এ গির্জা সাতশো বছর আগে গড়া হয়েছে। এখনও ওদেরই পয়সাতে এ মন্দিরের তদারকি দেখভাল চলে। সে-ও কিছু কম নয়। এরা যদি আপত্তি করে? কিন্তু এই বিশপটি ছিলেন বড়ই সন্তপ্রকৃতির সজ্জন। এবং তার চেয়েও বড় কথা : সাহসী। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। মা-মেরি মালিক। তিনি সর্বসন্তানের মাতা।
কিমাশ্চর্যমতঃপরম। তাঁর কাছে কোনও প্রতিবাদপত্র এল না। খবরের কাগজের এই অভাবনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বেরোল না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!!
কিন্তু মার্কিন টাইম কাগজে বেরিয়েছে ও বিলেতেও বেরিয়েছে। তার পর সন্দ করে কোন পিচেশ!
কলোন অ্যারপোর্টে নেমে দেখি, দুটো স্যুটকেসের একটা আমার নেই। ছুট ছুট দে ছুট, সেই ঘরের দিকে যেখানে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে তড়িঘড়ি ফরিয়াদ জানাতে হয়। নইলে চিত্তির। অবশ্য এরা নিজের থেকেই হয়তো দু-পাঁচ দিনের ভিতরেই আমার বেওয়ারিশ জাদুকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি কোন মোকামে আস্তানা গাড়ব, তার ঠিকানাটা এদের না দিলে মাল হস্তগত হবে কী করে? সেটা তখন তার মালিককে হারাবে। কোনও এক গ্রিক দার্শনিক নাকি বলেছেন, একই নদীতে তুমি দু বার আঙুল ডোবাতে পারবে না, একই শিখায় দু বার আঙুল পোড়াতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটি বস্তু প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। মানলুম। কিন্তু একই স্যুটকেস নিশ্চয়ই দু বার, দু বার কেন দু-শোবার হারাতে কোনও বাধা নেই। অতি অবশ্য কবিগুরু বলেছেন, তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারাই ক্ষণে ক্ষণে ও মোর ভালোবাসার ধন। কিন্তু প্রশ্ন, এটা কি হারানো বাকসের বেলাও খাটে?
আপিসঘরটি প্রমাণ সাইজের চেয়েও বৃহদায়তন। ভিতরে একটি ফুটফুটে মেমসাহেব বসে আছেন। আমার লাগেজ টিকিট দেখাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা খোওয়া যাবে না। কিন্তু বলুন তো, ওটার ভিতর কী কী আছে?
সর্বনাশ! সে কি আমি জানি? প্যাকিং করেছে আমার এক তালেবর ভাতিজা মুখুয্যে। তার বাপ প্রতি বৎসর নিদেন তিনবার ইউরোপ-আমেরিকা যেতেন। সে নিখুঁত প্যাকিং করে দিত। আমার বেলা এবারে করেছে নিখুঁততর। কোন বাকসে কী মাল রেখেছে কী করে জানব!
কিন্তু মিসি বাবা সদয়া। পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার ঠিকানাটি টুকে নিলেন। আর ইতোমধ্যে বার বার বলছেন, অ্যার ইন্ডিয়া বলুন, লুফট-হানজা বলুন, সুইস-অ্যার বলুন কোনও লাইনেই কোনও লাগেজ খোওয়া যায় না। আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন।
আমি মনে মনে বললুম, বটে! বেরোবার সময় তাকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বললুম, গ্লেডিগেস ফ্রলাইন (সদয়া কুমারী)! একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি কি?
সুমধুর হাস্যসহ, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
আমি বললুম, তাবৎ হারানো মালই যদি ফিরে পাওয়া যায়, তবে এ হেন বিরাট আপিস আপনারা করেছেন কেন? আমি তো শুনেছি, কলোন অ্যারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা ছাড়তে হয়।
প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা না করেই একলক্ষে দফতর থেকে বেরিয়ে মালসামান নিয়ে উঠলুম বিরাট এক বাস-এ।
বাঁচলুম বাবা, বাঁচলুম। প্লেনের গর্ভ থেকে বেরিয়ে খোলামেলায় এসে বাঁচলুম। বাসটি যদিও পর্বতপ্রমাণ, সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান তবু চলছে যেন রোলস রইস রইস খানদানি গতিতে, মৃদু মধুরে। কবিগুরু গেয়েছিলেন, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে– আমি গাইলুম, বাঁচালে তুমি মোরে ভালো বাস-এর ছায়ে।
আহা কী মধুর অপরাহ্নের সূর্যরশি! কখনও মেঘমায়ায়, কখনও আলোছায়ায়। দু দিকের গাছপালার উপর সে রশ্মি কভু-বা মেঘের ভিতর দিয়ে আলতো আলতো হাত বুলিয়ে যায়, কভু-বা রুদ্রদীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড আলিঙ্গন করে। ওই হোথায় দেখছি, বুড়ো চাষা ঘাসের উপর শুয়ে আছে, চোখের উপর টুপি রেখে। তার সবুজ পাতলুন যেন ঘাসের ঝিলিমিলির সঙ্গে এক তালে যায় মিলি। এদেশের নবান্ন হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। চতুর্দিকে অল্পবিস্তর ফসল কাটা হচ্ছে। আজ রোববার। রাইনল্যান্ডের লোক বেশিরভাগই ক্যাথলিক। তাদের অধিকাংশই সেদিন সর্বকর্ম ক্ষান্ত দেয়। তাই ক্ষেতখামারে তেমন ভিড় নেই। আমিও মোকামে পৌঁছেতে পারলে বাঁচি। ইংরেজিতে প্রবাদ : এ সিনার হ্যাঁজ নো সনড়ে। পাপীর রোববার নেই। আমি তো তেমন পাপিষ্ঠ নই।
.
০৮.
বাস মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যায়। সেখানে রাস্তা নির্জন। বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়? তারা তো ক্লাইপে বা সুধালয়ে যায় না সেখানে অবশ্যই আজ জোর কারবার, বেজায় ভিড়। আমার পাশের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললুম, স্যর, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি এসব গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছেলেমেয়েরা রাস্তার উপর রোল-স্কেটিং করত, দড়ি নিয়ে নাচত- এমনকি ফুটবলও খেলত। ওরা সব গেল কোথায়?
বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একাধিক উত্তর হয়তো আছে। চট করে যেটা মনে আসছে সেটা বলতে গেলে বলি, বন্ধ ঘরে টেলিভিশন দেখছে।
আমি একটু ঘাড় চুলকে বললুম, কিছু যদি অপরাধ না নেন, স্যর তবে শুধাব, এটা কি সর্বাংশে ভালো? ফারসিতে একটি দোহা আছে :
হর চে কুনি, ব খুদ কুনি।
খা খুব কুনি, আ ব কুনি ॥
যা করবে স্বয়ং করবে
ভালো করো কিংবা মন্দই করো।
এই যে প্যাসিভভাবে বসে বসে টেলি দেখা, তার চেয়ে রাস্তায় অ্যাকটিভভাবে খেলাধুলো করা কি অনেক বেশি কাম্য নয়?
গুণী এবারে চিন্তা না করেই বললেন, নিশ্চয়ই। অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। যেমন মনে করুন, আমরা যখন মোসার্ট বা শপা শুনি তখন তো আমরা প্যাসিভ। আর তাই-বা বলি কী করে? বেটোফেনকে গ্রহণ করা তো প্যাসিভ নয়। ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ কর্ম! কী পরিমাণ কনসানট্রেশন তখন করতে হয়, চিন্তা করুন তো। কিন্তু বাচ্চাদের কথা বাদ দিন কটা বয়স্ক লোকই সে জিনিস করে?
বুঝলুম লোকটি চিন্তাশীল। এঁকে খুঁচিয়ে আরও অনেক তত্ত্বকথা জেনে নিই। বললুম, তা টেলিতে কি ভালো প্রোগ্রাম কিছুই দেয় না?
তা হলে শুনুন, আপনাকে পুরো ফিরিস্তি দিচ্ছি। যদিও আমি ওই যন্ত্রটির পূজারি নই। পুরনো ফিল্ম, নয়া থিয়েটার, গর্ভপাতের সেমিনার-আলোচনা, পাদ্রিদের বক্তৃতা (এ দুটো তিনি ঠিক পরপর বলেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে), রাজনীতিকদের সঙ্গে ইন্টারভু, খেলা, কাবারে, ইতালি ভ্রমণ, চন্দ্রাভিযান, ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন, পার্লামেন্টে হার ভিলি ব্রান্ট ও হার শেলের বক্তৃতা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই একই কেচ্ছা, একই অন্তহীন খাড়া বড়ি হোড় হোড় বড়ি খাড়া (তিনি জর্মনে বলেছিলেন একই ইতিহাস- ডি জেলবে গেশিষটে)। সর্বস্তৃ কুচি কুচি করে পরিবেশন। পরের দিনই ভুলে যাবেন, আগের দিন কী দেখেছিলেন- মনের ওপর কোনও দানা কাটে না। পক্ষান্তরে দেখুন, বই পড়ার ব্যাপারে আপনি আপনার রুচিমতো বই বেছে নিচ্ছেন।
ইতোমধ্যে আমাদের বাস কতবার যে কত ট্রাফিক জ্যামে কত মিনিট দাঁড়িয়েছে তার হিসাব আমি রাখিনি। অথচ এদেশে রিকশা, ঠ্যালা, গরুর গাড়ি এমন কোনও কিছুই নেই যেসব হ্যবরল আমাদের কলকাতাতে নিত্যি নিত্যি ট্রাফিক জ্যাম জমাতে কখনও স্বেচ্ছায় কখনও অনিচ্ছায় বিশ্ববিজয়ী প্রতিষ্ঠান।
ভদ্রলোক বাইরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, এই দেখুন, আরেক উকট নেশা। মোটর, মোটর, মোটর। প্রত্যেক জর্মনের একখানা মোটরগাড়ি চাই। জর্মন মাত্রই মোটরের পূজারি।
আমার কেমন যেন মনে হল, আমরা বোধহয় বন শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুটা চেনা-চেনা ঠেকছে, আবার অচেনাও বটে। অথচ একদা এ শহর আমি আমার হাতের তেলোর চেয়ে বেশি চিনতুম। আমি ভদ্রলোককে আমার সমস্যা সমাধান করতে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, এটা বনই বটে। তবে এ অঞ্চলটা গত যুদ্ধে এমনই বোমারু-মার খেয়েছিল যে এটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যিখানটা প্রায় পূর্বেরই মতো মেরামত করে বানানো। আসল কথা কী জানেন, বমিঙের ফলে ঘিঞ্জি পাড়াগুলো যে নষ্ট হয়ে গেল সেগুলোকে ভালো করে নতুন করে, প্ল্যান মাফিক বানাবার চান্সটা আমরা মিস করেছি। তবে এই যে বললুম, শহরের মাঝখানটা মোটামুটি আগেরই মতো হার্ট অব দি সিটি– আর জানেন তো, পুরনো হার্টের জায়গায় নতুন হার্ট বসানো মুশকিল। এই ধরুন লুটভি ফান বেটোফেন–।
আমি বললুম, ওই নামটার ঠিক উচ্চারণটা কী আমি আজও জানিনে।
হেসে বললেন, ওই তো ফেললেন বিপদে। মাঝখানের Vanটা যে খাঁটি জর্মন নয় তা তো বুঝতেই পারছেন। ওঁরা প্রাচীন দিনের ফ্ল্যামিশ। তখন তারা ভান না ফান উচ্চারণ করত কে জানে অন্তত আমি জানিনে–
আমি বললুম, থাক, থাক। এবারে যা বলছিলেন তাই বলুন।
সেই বেটোফেনের বাড়ি যদি বোমাতে চুরমার হয়ে যেত তবে সেখানে তো একটা পিরামিড গড়া যেত না।
এমনকি তাজমহলও না।
দুম করে গাড়ি থেমে গেল। এ কী? ও। মোকামে পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ বন শহরে। এবং সবচেয়ে প্রাণাভিরাম নয়নানন্দদান দৃশ্য যে পরিবারে উঠব তারই একটি জোয়ান ছেলে ডিটরিষ উলানোফঙ্কি প্রবলবেগে হাত নাড়াচ্ছে। মুখে তিনগাল হাসি। পাশে পঁড়িয়ে তার ফুটফুটে বউ। সে রুমাল দুলাচ্ছে।
.
০৯.
লক্ষ্মী ছেলে ডিটরিষ। তার মাঝারি সাইজের মোটরখানা এনেছে। আমার কোনও আপত্তি না শুনে বললে, আমি মালপত্রগুলো তুলে নিচ্ছি। তুমি ততক্ষণ বউয়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নাও। ও তো তোমাকে চেনে না। মেয়েটিকে বাড়ির কুশলাদি শুধোলুম। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে–কয়েকদিন আগে দেশ পত্রিকায় যে সিগারেট-মুখী মডার্ন মেয়ের ছবি বেরিয়েছে তার ঠিক উল্টোটি। কোনও প্রশ্ন শুধোয় না। শুধু উত্তর দেয়। শেষটায় বোধহয় সেটা আবছা আবছা অনুভব করে একটিমাত্র প্রশ্ন শুধালে, বন কি খুব বদলে গেছে। আমি অবশ্য প্রাচীন দিনের বন চিনিনে। আমার বাড়ি ছিল ক্যোনিমবের্গে।
সর্বনাশ! এবং পাঠক সাবধান!
ক্যোনিষবের্গ শহরটি এখন বোধহয় পোলাভের অধীনে। ওইসব অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী বাস্তুহারা সর্বহারা হয়ে পশ্চিম জর্মনিতে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই সেসব দুঃখের কাহিনী ভুলে যেতে চায়। কাজেই সাবধান! ও-সব বাবদে ওদের কিছু জিগ্যেস কর না।
তবে এ তত্ত্বও অতিশয় সত্য যে মোকা-মাফিক দরদ-দিলে যদি আপনি কিছু শুনতে চান তখন অনেক লোকই, বিশেষ করে রমণীরা অনর্গল অবাধ গতিতে সবকিছু বলে ফেলে যেন মনের বোঝা নামাতে চায়। বিশেষ করে বিদেশির সামনে। যে দু দিন বাদেই আপন দেশে চলে যাবে। ও যা বলেছিল সেটা নিয়ে খামোখা কোনও ঘোটালার সৃষ্টি হবে না। আমি তাই বেমালুম চেপে গিয়ে বললুম, ও ক্যোনিষবের্গ! যেখানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কান্ট জন্মেছিলেন! এবং শুনেছি তিনি নাকি ওই শহরের বারো না চোদ্দ মাইলের বাইরে কখনও বেরোননি। শহরটাকে এতই ভালোবাসতেন।… ইতোমধ্যে ডিটরিষ স্টিয়ারিঙে বসে গেছে এবং আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেছে। বললে, ভালোবাসতেন না কচু। আসলে সব দার্শনিকই হাড়-আলসে। আমি বললুম, সেকথা থাক। তোর বউ শুধোচ্ছিল, বন শহরটা কি খুব বদলে গেছে? তারই উত্তরটা দিই। বদলেছে, বদলায়ওনি—
তুমি মামা, চিরকালই হেঁয়ালিতে কথা কও।
আমি বললুম, থাক, বাবা, থাক। বাস-এ এক বৃদ্ধ বিষয়টির অবতারণা করতে না করতেই মোকামে পৌঁছে গেলাম। আর এ তাবৎ দেখেছিই-বা কী?
বন শহরের নাম করলেই দেশি-বিদেশি সবাই বেটোফেনের নাম সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করে বটে, কিন্তু এ বৎসরে বিশেষ করে। কারণ তাঁর দ্বিশতজন্মশতবার্ষিকী সম্মুখেই। ডিসেম্বর ১৯৭০-এ। এ শহর তাঁকে এতই সম্মান করে যে তার সুন্দর প্রতিমূর্তিটি তুলেছে তাদের বিরাটতম চত্বরে, তাদের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম না হলেও তারই কাছাকাছি প্রাচীন মনসটার গির্জার পাশে। হয়তো তার অন্যতম কারণ, বেটোফেন ছিলেন সর্বান্তঃকরণে ঈশ্বরবিশ্বাসী। শুধু তাঁর সঙ্গীতে নয়, তাঁর বাক্যালাপে চিঠিপত্রে সর্বত্রই তার ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রভুর পদপ্রান্তে তার ঐকান্তিক আত্ম-নিবেদন বার বার প্রকাশ।
সেখান থেকে কয়েকটি মিনিটের রাস্তা ছোট্ট গলির ছোট্ট একটি বাড়ির ছোট্ট একটি কামরায় যেখানে তাঁর জন্ম হয়। বাড়ির নিচের তলায় বেটোফেন মিউজিয়াম। সেখানে তার ব্যবহৃত অনেক কিছুই আছে, যেমন ইয়াসনা পলিয়ানাতে তলস্তয়ের–বৃহত্তর, সম্পূর্ণতর, কারণ সেটা দেড়শো বছর পরের কথা এবং অসম্পূর্ণতম রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে যদ্যপি সেটা তলস্তয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে।…
কিন্তু সেখানে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বেটোফোনের কানের চোঙাগুলো। বত্রিশ বৎসর বয়স থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমে কালা হতে আরম্ভ করলেন। বিধাতার এ কী লীলা! বীণাপাণির এই অংশাবতার আর তার বীণা শুনতে পান না। তখন তিনি আরম্ভ করলেন ওইসব কানের চোঙা ব্যবহার করতে। পাঠক, দেখতে পাবে, তার বধিরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন যেমন বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোঙার সাইজও বাড়তে লাগল। তাতে করে তার কোনও লাভ হয়েছিল কি না বলা কঠিন। তবে এটা জানি, তার কিছুকাল পরে, যখন তার সঙ্গীতপ্রেমী কোনও সহচর বলতেন, বাহ্! কী মধুর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলেটি, আর তিনি কিছুই শুনতে পেতেন না তখন বেটোফেন বলতেন, তিনি তনুহূর্তেই আত্মহত্যা করতেন যদি না তার বিশ্বাস থাকত যে সঙ্গীতে এখনও তার বহু কিছু দেবার আছে। আমাদের শ্রীরাধা যেরকম উদ্ধবকে বলেছিলেন, যদি না আমার বিশ্বাস থাকত, প্রভু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, তা হলে বহু পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়ে যেত। এবং সকলেই জানেন, বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়ার পরও বেটোফেন মনে মনে সঙ্গীতের রূপটি ধারণা করে বহুবিধ স্বর্গীয় রচনা করে গেছেন যেগুলো তিনি স্বকর্ণে শুনে যেতে পাননি। আমি যেন কোথায় পড়েছি, তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে করুণ আবেদন জানাচ্ছেন, প্রভু যেন তাকে একবারের মতো তাঁর শ্রুতিশক্তি ফিরিয়ে দেন যাতে করে তিনি মাত্র একবারের তরে আপন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনে যেতে পান। তার পর তিনি সধন্যান্তকরণে পরলোকে যেতে প্রস্তুত।
চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল। ডিটরিষ শুধাল, মামা, কথা কইছ না যে!
বললুম, আমি ভাবছিলাম বেটোফেনের কানের চোঙাগুলোর কথা। ওগুলো সত্যি কি তার কোনও কাজে লেগেছিল?
ডিটরিষ বললে, বলা শক্ত। কোনও কোনও আধাকালা একখানা কাগজের টুকরো দু পাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কাগজের বেশিরভাগটা মুখের বাইরে রাখে। ভাবে, ধ্বনিতরঙ্গ ওই কাগজকে ভাইব্রেট করে দাঁত হয়ে মগজে পৌঁছোয়, কিংবা কান হয়ে। কেউ-বা সামনের দু পাটির চারটে দাঁত দিয়ে লম্বা একটা পেনসিল কামড়ে ধরে থাকে। কী ফল হয় না হয় কে বলবে?… আচ্ছা মামু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কী রকম অদ্ভুত, প্রিমিটিভ মিনি সাইজের যন্ত্র দিয়ে তিনি তাঁর বিচিত্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন? আমার কাছে ভারি আশ্চর্য লাগে!
আমি বললুম, কেন বস, ওই যে তোমার ছোট পিসি, যার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব, লিজেল দেখেছ, ঝড়তি পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা, আড়াই ফোঁটা নেবুর রস আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে কী রকম সরেস স্যালাড তৈরি করতে পারে? মুখে দিলে যেন মাখম!!… আর তোর-আমার যত আনাড়িকে যাবতীয় মশলাসহ একটা মোলায়েম মুরগি দিলেও আমরা যা রাঁধব সেটা তুইও খেতে পারবিনি, আমিও না। পিসি লিজেল কী বলবে, জানিনে। অথচ জানিস, এই অদ্ভুত মুরগিটি তাঁকে তখন দিয়ে দে। তিনি সেটাকে ছোট ছোট টুকরো করে যাকে ফরাসিরা বলে রাও ফাঁ, রা ফ্রিকাস, অর্থাৎ লম্বা লম্বা ফালি-ফালি করে কেটে, মুরগিটাতে আমরা যেসব বদ-রান্নার ব্যামো চাপিয়েছিলুম সেগুলো রাইনের ওপারে পাঠিয়ে অ্যামন একটি রান্না করে দেবেন যে, প্যারিসের শ্যাফতক আ মরি আ মরি বলতে বলতে তারিয়ে তারিয়ে খাবে।… প্রকৃত গুণীজন যা-কিছুর মাধ্যমে যা-কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমাদের দেশে একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে। একতারা তার নাম। তাতে একটি মাত্র তার। তার দু দিকে দুটি ফ্লেকসিবল বাঁশের কৌশল আছে। সে দুটোতে কখনও জোর কখনও হালকা চাপ দিয়ে, আর মাঝখানের তারটাকে প্লাক করে নাকি বিয়াল্লিশ না বাহান্নটা নোট বের করা যায়। তবেই দ্যাখ। বেটোফেনের মতো কটা লোক পৃথিবীতে আসে আমাদের দেশেও গণ্ডায় গণ্ডায় তানসেন জন্মায় না। যদিও আমাদের দেশ তোদের দেশের চেয়ে বিস্তর বিরাটতর, এবং সেখানে কলাচর্চা আরম্ভ হয়েছিল অন্তত চার হাজার বছর পূর্বে। এবং আমাদের কলা-জগতে আমরা এখন সাহারাতে। এবং
ডিটরিষ বললে, তুমি আমাদের পার্লামেন্ট হাউসটা দেখবে না। রাইনের পারে। আমি একটু ঘোরপথে যাচ্ছি। সোজা পথে গেলে দু-পাঁচ মিনিট আগে বাড়ি পৌঁছতুম।
দ্যাখ ডিটরিষ, তোর পিসি নিশ্চয়ই বিস্তর কেক, পেসট্রি আমাদের জন্য বানিয়ে বসে আছে–
ডিটরিষের বউ বললে, মামা, শুধু কেক পেসট্রি বললেন। ওদিকে পিসি কী কী বানিয়ে বসে আছেন, জানেন? ক্যানিঃসবের্গের ক্লপসে (ক্যানিঙসবের্গ শহরের একরকম কোতা), ফ্রাঙ্কফুর্টের সসিজ, হানোফারের ষাঁড়ের ন্যাজের শুরুয়া
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে তো জানি। কিন্তু লিজেল পিসি আমার জন্যে কি ক্যাঙারু ন্যাজের শুরুয়া তৈরি করেছে।
দু জনাই তাজ্জব। আমি বললুম, ষাড়ের ন্যাজের ভিতরে থাকে চর্বি এবং মাংস। তার একটা বিশেষ স্বাদ থাকে। কিন্তু ষাঁড়ের ন্যাজ আর কতটুকু লম্বা? তার চেয়ে ক্যাঙারুর ন্যাজ ঢের ঢের বেশি। ওটা যদি পাঁচজনকে খাওয়ানো যায় তবে বিস্তর কড়ি সাশ্রয় হয়।
ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামল।
এটা কী রে? মনে হয়, গোটা আস্টেক বিরাট বিস্কুটের টিন একটার উপর আরেকটা বসিয়ে দিয়েছে। বললুম আমি।
ডিটরিষ বললে, এটাই আমাদের পার্লামেন্ট।
.
১০.
যাকে বলে মর্ডান আর্ট, পিকাসো উপস্থিত যার পোপস্য পোপ সেই পদ্ধতিটি জর্মনরা কখনও খুব পছন্দ করেনি। কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেলম, যাকে এখনও মার্কিনিংরেজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আর্ট এবং আর্টের আদর্শ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল : আর্ট হবে সুন্দর, আর্ট হবে সমাজসেবক, রাষ্ট্রসেবক, আর্ট মানুষের দুঃখদৈন্যের ছবি না এঁকে আঁকবে এমন ছবি, কম্পোজ করবে এমন সঙ্গীত, রচনা করবে এমন সাহিত্য যাতে মানুষ আপন পীড়াদায়ক পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আনন্দসায়রে নিমজ্জিত হবে। আজকের দিনে আমরা এটাকে নাম দিয়েছি এসকেপিজম– পলায়ন মনোবৃত্তি। বলা বাহুল্য জর্মন আটিস্ট-সাহিত্যিক সঙ্গীতস্রষ্টা- কাইজারের এই পথনির্দেশ খবরের কাগজে পড়ে স্তম্ভিত হন। তা হলে আর্টিস্টের কোনও স্বাধীন সত্তা নেই। সে তার আপন সুখ-দুঃখ, আপন বিচিত্র অভিজ্ঞতা আপন হৃদয়ে উপলব্ধ ভবিষ্যতের আশাবাদী চিত্র অঙ্কন করতে পারবে না। সে তা হলে রাষ্ট্রের ভাঁড়, ক্লাউন! তার একমাত্র কর্তব্য হল জনসাধারণকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানো।
কিন্তু জর্মন জনসাধারণ কাইজারের কথাই মেনে নিল। এটা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। এই পরিস্থিতিটা বোঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত জর্মন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক শ্ৰীযুত রোখিম বেসার বলেছেন, জর্মন মাত্রই উপরের দিকে তাকায়; রাজা কী হুকুম দিলেন সেই অনুযায়ী কাব্যে চিত্রে সঙ্গীতে আপন রুচি নির্মাণ করে।
১৯১৮-এ কাইজার যুদ্ধে হেরে হল্যান্ডে পলায়ন করলেন।
তখন সত্য সত্য আরম্ভ হল মর্ডান আর্টের যুগ। যেন কাইজারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য আর্টিস্টরা আরম্ভ করলেন রঙ নিয়ে নিত্য নব উন্মাদ নৃত্য, ধ্বনি নিয়ে সঙ্গীতে তাণ্ডব একসপেরিমেন্ট, ভাস্কর্যে বিকট বিকট মূর্তি যার প্রত্যেকটাতেই থাকত একটা ফুটো (তার অর্থ বোঝাতে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে পুরবে)। আমি ওই সময়ে জর্মনিতে ছিলুম। মর্ডানদের পাল্লায় পড়ে একদিন একটা চারুকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে একলক্ষে পুনরপি বেরিয়ে এসেছিলুম। একদা যেরকম কোনও এক জু-তে বোকা পাঠার আঁচার সামনে থেকে বিদ্যুৎগতিতে পলায়ন করেছিলুম। বোটকা গন্ধে।
তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে সেখানে উত্তম দ্রষ্টব্য কিছুই ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল। রাস্তার ডাস্টবিন খুঁজলে কি আর খান দুই লুচি, একটা আলুর চপ পাওয়া যায় না? কিন্তু আমার এমন কী দায় পড়েছে।
এর পর ১৯৩৩-এ এলেন হিটলার। তাঁর কাহিনী সবাই জানেন। কিন্তু আর্ট সম্বন্ধে তার অভিমত সবাই হয়তো জানেন না; তাই সংক্ষেপে নিবেদন করছি। হিটলার সর্বক্ষণ কাইজারকে অভিসম্পাৎ দিতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কাইজার যদি কাপুরুষের মতো হার না মেনে লড়ে যেতেন তবে জর্মনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করতই করত।… অথচ আর্ট সম্বন্ধে দেখা গেল, হিটলার-কাইজার সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তিনি কঠিনতর কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে বারবার বলে যেতে লাগলেন, আর্ট হবে সমাজের দাস, অর্থাৎ নাৎসিদের দাস। সূর্যনিম্নে এই পৃথ্বীতলে তারা যে ন্যায়সম্মত আসন খুঁজছে, তারই সেবা করবে আর্টিস্টরা।
কাইজারের চরম শত্রুও বলবে না, তিনি অসহিষ্ণু লোক ছিলেন। তাঁর আমলে তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও যারা মর্ডান ছবি আঁকত তাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও প্রকারেরই কোনও কিছু করেননি।
কিন্তু হিটলার চ্যানসেলার হাওয়ার পর আরম্ভ হল এঁদের ওপর নির্যাতন। উত্তম উত্তম ছবি, নব নব সঙ্গীত ব্যান করা হল। সেরা সেরা পুস্তক পোড়ানো হল– কারণ এগুলো নাৎসি সঙ্গীতের সঙ্গে এক সুরে এক গান গায় না। আমি দূর থেকে এরকম একটা অগ্নিযজ্ঞ দেখেছিলাম। কাছে যাইনি। পাছে প্রভুরা আমার রঙ দেখে, আমাকে ইহুদি ঠাউরে আমার নাকটা না কেটে দেন। যদিও আমার নাকটি খাঁটি মঙ্গোলিয়ান। খাটো, বেঁটে, হ্রস্ব। কিন্তু বলা তো যায় না।
হিটলার তার সাধনোচিত ধামে গেছেন। এখন জর্মনরা উঠেপড়ে লেগেছেন মর্ডান হতে। চোদ্দতলা বাড়ি ভিন্ন অন্য কথা কয় না।
তাই এই বিস্কুটটিনপারা পার্লিমেন্ট।
ডিটরিষকে বললুম, জানো, ভাগিনা, আমাদের দেশেও এ ধরনের স্থাপত্য হুশ হুশ করে আকাশপানে উঠছে। তারই এক আর্কিটেকট এসেছেন আমাদের সঙ্গে তাস খেলতে। ভদ্রলোক সিগার খান। বর্ষাকাল। সিগার গেছে মিইয়ে। ঘন ঘন নিভে যায়। ভদ্রলোক দেশলাই খোঁজেন।… খেলা শেষ হল। তখন কেন জানিনে তিনি তার দেশলাই আর খুঁজে পান না। আমাদের এক রসিক বন্ধ বসে বসে খেলা দেখছিল। সে দরদি কন্ঠে বলল, দাদাদের কাছে আমার অনুরোধ, আর্কিটেকট মশয়ের মডেলটি তোমরা কেউ গাপ মেরো না। ওই দেশলাইটির মডেল থেকেই তো তিনি হেথাহোথা সর্বত্র বিয়াল্লিশতলার বিলডিং হাঁকাচ্ছেন? ওটা গায়েব হলে ওঁয়ার রুটি মারা যাবে যে।
ডিটরিষ বললে, জানো মাম, আমাদের বিশ্বাস প্রাচ্যদেশীয়রা বড্ডই সিরিয়স। সর্বক্ষণ গুমড়ো মুখ করে, লর্ড বুদ্ধের মতো আসন নিয়ে শুধু আত্মচিন্তা মোক্ষানুসন্ধান করে। তারাও যে রসিকতা করে একথা ৯৯.৯% জর্মন কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। অথচ তোমার এই বন্ধুটির রসিকতাটি শুধু যে রসিকতা তাই নয়, এতে গভীর দর্শনও রয়েছে। মর্ডান আর্কিটেকচর সম্বন্ধে মাত্র ওই একটি দেশলাই দিয়ে তিনি তাঁর তাচ্ছিল্য সিনিসিজমসহ প্রকাশ করলেন কী সাতিশয় সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে। ভদ্রলোক কি তোমার মতো লেখেন-টেখেন- লিতেরাত্যোর?
আমি বললুম, তওবা, তওবা! ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের ফরেন অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার; পণ্ডিত নেহরুর সহকর্মী। খুব বেশিদিন কাজ করেননি। ওইসব দার্শনিক সিনিক রসিকতা তিনি সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করতেন তার ভিন্ন ভিন্ন সহকর্মী মন্ত্রীদের সম্বন্ধে। ঠিক পপুলার হওয়ার পন্থা এটা নয়– কী বল? কাজেই তিনি যখন ফরেন অফিস থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি বলেছিলাম, তিনি মন্ত্রিমণ্ডলী থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিদায় নেবার সময় উল্লাসে নৃত্য করলেন এবং মন্ত্রিমণ্ডলীও তার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উল্লাসে নৃত্য করলেন।
ডিটরিষ চুপ। আমি একটু অবাক হলুম। সে তো সবসময়ই জুত্মাফিক উত্তর দিতে পারে।
সে বললে, আমার অবস্থাও তাই। যে অফিসে আমি কাজ করি সেটা থেকে বেরুতে পারলে আমিও খুশি হই; ওরাও খুশি হয়।
.
১১.
ওই তো সামনে গোডেসবের্গ। ডিটরিষ শুধালে, মামু, পিসি বলছিল তুমি নাকি এই টাউনটাকে জর্মনির সর্ব জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাসা কেন বল তো?
আমি মুচকি হেসে কইলুম, যদি বলি তোর পিসির সঙ্গে হেথায় আমার প্রথম প্রণয় হয়েছিল বলে?
ডি। ধ্যত! আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করেছি, লিজেল পিসির ধ্যানধর্ম শুধু কাজ আর কাজ। ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া। এবং সে বইগুলোও দারুণ সিরিয়স। বড় পিসি বরঞ্চ মাঝে মাঝে হালকা জিনিস পড়ত। কিন্তু ছোট পিসি ওসবের ধার ধারত না। সে যেত প্রতি প্রভাতে ট্রামে চড়ে বন শহরে সেখানে সে চাকরি করত–
আমি। সেই সূত্রেই তো আমাদের পরিচয়। আমো ওই সকাল আটটা পনেরোর ট্রামে বন যেতুম। আমরা আর সবাই দু-তিনটে সিঁড়ি বেয়ে ট্রামে উঠতুম। আর লিজেল পিসি ডান হাতে একখানা বই আর বাঁ হাতে ট্রামের গায়ে সামান্যতম ভর করে সিঁড়িগুলোকে তাচ্ছিলি করে এক লাফে উঠত ট্রামের পাটাতনে। উঠেই এক গাল হেসে ডাইনে-বাঁয়ে-সমুখ পানে তাকিয়ে বলত, শুটেন মরগেন সুপ্রভাত। ওর লক্ষ মেরে ওঠার কৌশল দেখে আমি মনে মনে বলতুম, একদম ট বয়! ওর উচিত ছিল, মার্কিন মুল্লুকে কাউ বয় হয়ে জন্ম নেবার। অথবা ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন–গুরুদেবের ভাষায়।
গোডেসবের্গ তখন অতি ক্ষুদে শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু আসল কথা, ওই আটটা পনেরোর ট্রামে থাকত পনেরো আনা কাচ্চাবাচ্চা। স্কুলে যাচ্ছে বন শহরে। এরা সবাই জানত যে লিজেল পিসির, অবশ্য তখনও তিনি পিসি খেতাব পাননি, কাছে আছে লেবেনচুস, দু-একটা আপেল, হয়তো নবাগত মার্কিন চুইংগাম, মাঝেমধ্যে চকলেট। কাজেই বাচ্চারা সমস্বরে, কোরাস কণ্ঠে বলত অন্তত বার তিনেক সুপ্রভাত, সুপ্রভাত—। তার পর সবাই তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াত। সবাই বলত– প্লিজ প্লিজ, এজ্ঞে এজ্ঞে, এই এখানে বসুন।
আমি বললুম, বুঝলি ডিটরিষ, তোর পিসি লিজেল ছিল আমাদের হিরোইন অব দ্য প্লে। তবে তুই ঠিকই বলেছিস, ও কখনও প্রেম-ফ্রেমের ধার ধারত না। আমি দু-একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে প্রীতিবন্ধুত্ব ছিল গভীর। আমাকে কত কী না খাইয়েছে ওই অল্প বয়সেই বেশ দু পয়সা কামাত বলে। তখনকার দিনে ছিল– এখনও নিশ্চয়ই আছে একরকমের বেশ মোটা সাইজের চকলেট– ভিতরে কন্যা। বড় আক্রা। কিন্তু খেতে ওহ! কী বলব–মুখে ফেলে সামান্য একটু চাপ দাও। ব্যস, হয়ে গেল। ভিজে ভিজে চকলেট আর তরল কন্যাকে মিশে গিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, চলে গেল একদম পেটের পাতালে। কিন্তু যাবার সময় ওই যে কন্যাক– তোরা যাকে বলিস ব্র্যানটভাইন, ইংরেজিতে ব্রান্ডি, নাড়িভূঁড়ির প্রতিটি মিলিমিটার মধুর মধুর চুলবুলিয়ে বুঝিয়ে দিত, যাচ্ছেন কোনও মহারাজ।… আর মনের মিলের কথা যদি তুলিস তবে বলব, লিজেল ছিল বড়ই লিবরেল। তাই যদিও নাৎসিরা তখনও ক্ষমতা পায়নি কিন্তু রাস্তাঘাটে দাবড়াতে আরম্ভ করেছে পিসি সেটা আদৌ পছন্দ করত না। আমিও না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ইংরেজ যে ইতোমধ্যেই হিটলার বাবদে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আমার চিত্তে পুলক জাগাত। পিসিও সেটা জানত। ভারতবর্ষের পরাধীনতার কথা উঠলেই সে ব্যথা পেত। বলত, ও কথা থাক না। ওরকম দরদি মেয়ে চিনতে পারার সৌভাগ্য আমি ইহসংসারে অতি অল্পই পেয়েছি।
হঠাৎ লক্ষ করলুম, ভাগিনা ডিটরিষ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। শুধালুম, কী হল রে? তুই কি পরশুদিনের হাওয়া খেতে চলে গিয়েছিস?
কেমন যেন বিষণ্ণ কণ্ঠে ভেজা-ভেজা গলায় বললে, মামা, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বাবা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে ওপারে চলে গেল কী করে।
ডিটরিষের এখন যৌবনকাল। তার বাপ কেন, ঠাকুন্দাও বেঁচে থাকলে আশ্চর্য হবার মতো কিছু ছিল না। বললুম, আমি তো জানিনে, ভাই। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার হচ্ছেও না। কারণ তোর গলাটা কীরকম যেন ভারী ভারী শোনাচ্ছে–
তুমি এইমাত্র বললে না, তুমি, পিসি দু জনাই নাৎসিদের পছন্দ করতে না। বস্তুত পিসিপরিবারের কেউই নাৎসি ছিল না। যদিও আমি তোমার বান্ধবীকে পিসি বলে পরিচয় দিয়েছি, আসলে তিনি আমার মাসি। তারা তিন বোন। আমার মা সক্কলের ছোট। তিনি বিয়ে করলেন এক নাৎসিকে কট্টর নাৎসিকে। কেন করলেন জানিনে। প্রেমের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল। বাড়ি গিয়ে তোমাকে তার ডাইরিটি দেখাব। আর চেহারাটি ছিল সুন্দর–
বাধা দিয়ে বললুম, সে তো তোর চেহারা থেকেই বোঝা যায়।
থ্যাঙ্কউ। আর বাবা ছিল বড়ই সদয়-হৃদয়–
ভাগিনা, কিছু মনে কর না। আমি মোটেই অবিশ্বাস করি না যে তোর পিতা অতিশয় করুণহৃদয় শান্তস্বভাব ধরতেন– তোর দুই মাসিই সেকথা আমাকে বারবার বলেছে। কিন্তু, আবার বলছি, কিছু মনে কর না, তা হলে তিনি নাৎসিদের কনসানট্রেশন ক্যাম্প সয়ে নিলেন কী করে?
ডিটরিষ চুপ মেরে গেল। কোনও উত্তর দেয় না। আমি এবার, বহুবারের পর আবার বুঝলুম যে আমি একটা আস্ত গাড়োল। এরকম একটা প্রশ্ন করাটা আমার মোটেই উচিত হয়নি। বললুম, ভাগিনা, আমি মাফ চাইছি। আমি আমার প্রশ্নটার কোনও জবাব চাইনে। ওটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।
ডিটরিষ বললে, না, মামু। তুমি যা ভেবেছ তা নয়। আমি ভাবছিলুম, সত্যই তো, বাবা এগুলো বরদাস্ত করত কী করে? এবং আরও লক্ষ লক্ষ জর্মন? এই নিয়ে আমি অনেকবার বহু চিন্তা করেছি। তুমি জানো, মার্কিনিংরেজ রুশ-ফরাসি নরেনবের্গ মোকদ্দমায় বার বার নাৎসিদের প্রশ্ন করেছে, তোমরা কি জানতে না যে হিটলারের কনসানট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করেছে? উত্তরে সবাই গাইগুই করেছে। সোজা উত্তর কেউই দেয়নি। জানো তো, যুদ্ধের সময় কত সেনসর কত কড়াকড়ি। কে জানবে, কী হচ্ছে, না হচ্ছে। আমার মনে হয়, আবার বলছি জানিনে, বাবার কানে কিছু কিছু পৌঁছেছিল। কিন্তু বাবা তখন উন্মত্ত। তিনি চান জর্মনির সর্বাধিকার। তাঁর ডাইরিতে বার বার বহুবার লেখা আছে, ইংরেজ কে? সে যে বিরাট বিশ্ব শুষে খেতে চায় তাতে তার হক্কো কী? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানি, তারা যদি আমাদের কিংবা ফরাসিদের মতো কলচরড জাত হত তবে আমরা এ নিয়ে কলহ করতুম না। কিন্তু ইংরেজ জাতটাই তো বেনের জাত। তারা কলচরের কী বোঝে! ওদের না আছে। মাইকেল এঞ্জেলো, না আছে বেটোফেন। আছে মাত্র শেক্সপিয়ার। ওদের না আছে স্থাপত্য, না আছে ভাস্কর্য, না আছে–হঠাৎ বললে, ওই তো বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি ॥
.
১২.
ভু, হালুঙ্কে
সোল্লাসে হুহুঙ্কারে রব ছাড়ল শ্রীমতী লিজেল। তুই গুণ্ডা–
আমরা যেরকম কোনও দুরন্ত ছোট বাচ্চাকে আদর করে গুণ্ডা বলে থাকি হালুঙ্কে তাই। শব্দটা চেক ভাষাতে জর্মনে প্রবেশ লাভ করেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখা হলেই লিজেল এইভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
তার পর আমাকে জাবড়ে ধরে দু গালে দুটো চুমো খেল।
ডিটরিষ মারফত পাঠককে পূর্বেই বলেছি, লিজেল ছিল ন-সিকে টম-বয়, এবং দু-একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। তবে এটা হল কী প্রকারে? শুচিবায়ুগ্রস্ত পদি পিসিরা ক্ষণতরে ধৈর্য ধরুন। বুঝিয়ে বলছি। এই ষাট বছর বয়সে তার কি আর টমবয়ত্ব আছে? এখন আমাকে জাবড়ে ধরে আলিঙ্গন করাতে সে শুধু তার অন্তরতম অভ্যর্থনা জানাল।
আমি মনে মনে বললুম চল্লিশ বছর ল্যাটে, চল্লিশ বছর ল্যাটে। এই আলিঙ্গন-চুম্বন চল্লিশ বছর পূর্বে দিলেই পারতে, সুন্দরী। পরে তাকে খুলেও বলেছিলুম।
ইতোমধ্যে ডিটরিষ আমতা আমতা করে বললে, আমরা তা হলে আসি। রাত্রের পার্টিতে দেখা হবে। ওরা পাশেই থাকে। তিন মিনিটের রাস্তা। ওদের ভাব থেকে বুঝলুম, ওরা মনে করছে বিদ্যা ও সুন্দর যখন বহু বৎসর পর সম্মিলিত হয়ে গেছেন তখন ওদের কেটে পড়াই ভালো। আমাদের প্রেমটি যে চিরকালই নির্জলা জল ছিল সেটি হয়তো তার গলা দিয়ে নাবাতে পারেনি– হজম করা তো দূরের কথা।
লিজেল আমাকে হাতে ধরে ড্রইংরুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি বললুম, এ কী আদিখ্যেতা! চল্লিশ বছর ধরে যখনই এ বাড়িতে এসেছি তখনই আমরা বসেছি বাবা, মা, বড়দি, তুমি, ছোড়দি রান্নাঘরে। অবিশ্যি মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আজ কেন এ ব্যত্যয়? তদুপরি ওই বিরাট ড্রইংরুম! বাপস! তুই যদি এক কোণে বসিস আর আমি অন্য কোণে, তা হলে একে অন্যকে দেখবার তরে জোরদার প্রাশান মিলিটারি দুরবিনের দরকার হবে; কথা কইতে হলে আমাদের দেশের ডাক-হরকরা, নিদেন একটি ট্রাঙ্ক-কল-ফোন ব্যবস্থা, আর–
লিজেল সেই প্রাচীন দিনের মতো বললে, চোকোর চোকোর। তুই চিরকালই বড় বেশি বকর বকর করিস।
গতি পরিবর্তন হল। আমরা শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই গেলুম।
কিচেনের এক প্রান্তে টেবিল, চতুর্দিকে খান ছয় চেয়ার। অন্য প্রান্তে দুটো গ্যাস উনুন, তৃতীয়টা কয়লার (সেটা খুব সম্ভব প্রাচীন দিনের ঐতিহ্য রক্ষার্থে)। দুই প্রান্তের মাঝখানে অন্তত দশ কদম ফাঁকা। অর্থাৎ কিচেনটি তৈরি করা হয়েছে দরাজ হাতে। বস্তুত লিজেলের মা যখন রাঁধতেন তখন এ প্রান্ত থেকে আমাকে কিছু বলতে হলে বেশ গলা উঁচিয়ে কথা কইতে হত।
লিজেল একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, এটায় বস।
সত্যি বলছি, আমার চোখে জল এল। কী করে লিজেল মনে রেখেছে যে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে (তিনি গত হয়েছে, বছর আটত্রিশেক হবে) তার পিতা আমাকে ওই চেয়ারটায় বসতে বলতেন। আমি জানতুম, কেন। জানালা দিয়ে, ওই চেয়ারটার থেকে দূর-দূরান্তরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। পরে জানতে পেরেছিলুম, তিনি স্বয়ং ওই চেয়ারটিতে বসে আপন ক্ষেত-খামারের দিকে এবং বিশেষ করে তার বিরাট আপেলবাগানের দিকে নজর রাখতেন (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আমাদের যেরকম আমবাগান)। অবশ্যই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসতেন। নইলে আমাকে তার আপন আসন ত্যাগ করে, আপন অভ্যস্ত আসন ছেড়ে দিয়ে ওখানে বসতে বলবেন কেন? আমি তো সেখান থেকে তার ক্ষেতখামার, আপেলবাগান তদারকি করতে পারব না– যারা ঘোরাঘুরি করছে, তারা তাঁর আপন মুনিষ না ভিন-জন আমি ঠাহর করব কী প্রকারে? আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ? সে দিকে আমার কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। একদিন ওই শেষ কথাটি তাকে আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে–যাতে অন্যেরা শুনতে না পায় তিনি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অতিশয় সুন্দর স্মিতহাস্যে বললেন, তোমরা ইন্ডিয়ান। তোমাদের দেশে এখনও কলকারখানা হয়নি। তোমরা এখনও আছে প্রকৃতির শিশু। শিশু কি মায়ের সৌন্দর্য বোঝে না। সে শুধু তার মায়ের স্তনরস চায়– সেই স্তনদ্বয়ের সৌন্দর্য কি সে বোঝে? যেমন তার বাপ বোঝে? ঠিক ওইরকম তোমরা তোমাদের মা-জননী জন্মভূমিতে ক্ষেত-খামার করে খাদ্যরস আহারাদি সংগ্রহ কর। তোমরা এখন কী করে বুঝবে, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? সেটা শুরু হয় যখন মানুষ কলকারখানার গোলাম হয়ে যায়। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, বড় হয়ে সে মাতৃদুগ্ধের মূল্য বুঝতে শেখে।
আমি বললুম, মানছি, কিন্তু দেখুন, গ্রিস, রোম এবং আমার দেশ ভারতবর্ষেও তো কলকারখানা নির্মিত হওয়ার বহু পূর্বে উত্তমোত্তম কাব্য রচিত হয়েছিল এবং সেগুলোতে বিস্তর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনা আছে। তবে কেন?
ওইসব কথাবার্তা যেন ওই চেয়ারে বসে কানে শুনতে পাচ্ছি। কত বৎসর হয়ে গেছে। এমন সময় লিজেল আমার মাথায় মারল একটা গাট্টা। আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বিশেষ করে তার ঠাকুরমার ছবিটি।
কী খাবে বলছিলে?
আমি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলুম, আমি তো কিছুই বলিনি।
তবে চল, তুমি যে সুপ পছন্দ করতে সেই সুপই করেছি– অর্থাৎ পি সুপ (কলাইটির সুপ)- এবারে বল তুমি কী খাবে? তুমি যা খেতে চাও তার জন্য মাছ, মাংস, ক্রিম আছে।
আমি বললুম, দিদি, সুপ ছাড়া আমার অন্য কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এই জর্নিতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়।… তবে কি না আমি বঙ্গসন্তান। হেথায় ডান পাশে রাইন নদী। সে নদীর উত্তম উত্তম মাছ খেয়েছি কত বৎসর ধরে। তারই যদি একটা কিছু
বেচারি লিজেল।
শুকনো মুখে বললে, রাইনে তো আজকাল আর সে-মাছ নেই।
আমি শুধালাম, কেন?
বললে, রাইন নদে জাহাজের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছে। তাদের পোড়ানো তেল তারা ওই নদীতে ছাড়ে। ফলে নদীর জল এমনই বিষে মেশা হয়ে গিয়েছে যে, মাছগুলো প্রায় আর নেই। আমার কাছে যেসব মাছ আছে সেগুলো টিনের মাছ।
আমি বললুম, তা হলে থাক।
.
১৩.
বিনু যখন সোয়ামির সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিল তখন বললে, আহা, ওরা কেমন সুখে আছে। আমরাও ভাবি ইংরেজ ফরাসি জর্মন জাত কীরকম সুখে আছে। কিন্তু ওদেরও দুঃখ আছে। তবে আমাদের মতো ওদের দুঃখ ঠিক একই প্রকারের নয়। ওরা খেতে পায়, আশ্রয় আছে। তৎসত্ত্বেও ওদের দুঃখ আছে।
লিজেলদের বাড়ি প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সে আমলে স্টিল-সিমেন্টের ব্যাপার ছিল না। বাড়িটা মোটামুটি কাঠের তৈরি। দুশো বছর পরে ছাদটা নেমে আসছে। এটাকে খাড়া রাখা যায় কী প্রকারে।
আমি জিগ্যেস করলুম, লিজেল, এটাকে কি মেরামত করা যায় না?
লিজেল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, শুধু ছাদ নয়, দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। এ বাড়ি মেরামত করতে হলে কুড়ি হাজার মার্ক (আমাদের হিসাবে চল্লিশ হাজার টাকারও বেশি) লাগবে। বাবা গেছেন, আমার কোনও ভাইও নেই। ক্ষেত-খামার দেখবে কে? আপেলবাগানটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছি। তাই স্থির করেছি বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেব। ওরা সব পুরনো বাড়ির কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কারণ এ বাড়িটির স্টাইল এক্কেবারে খাঁটি রাইনল্যান্ডের।
আমি বললুম, এটা মর্টগেজ করে টাকাটা তোল না কেন?
লিজেল বললে, যে টাকাটা কখনও শোধ করতে পারব না সে-টাকা ধার করব কী করে!
আমার মনে গভীর দুঃখ হল। বাড়িটা সত্যিই ভারি সুন্দর। শুধু বাড়িটি নয়, তার পেছনে রয়েছে ফল-ফুলের বাগান, তরিতরকারির ব্যবস্থা, কুয়ো, হ্যান্ডপাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে উত্তম ব্যবস্থা। ক্ষেত-খামার গেছে যাক। ওদের আপেলবাগান এই অঞ্চলে বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠতমও ছিল। সে-ও গেছে যাক। কিন্তু এই সুন্দর বাড়িটা সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, এটা আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না।
ইতোমধ্যে লিজেলের ছোট বোন মারিয়ানা এল। তিন বোনের ও-ই একমাত্র যার বিয়ে হয়েছিল। যে ডিটরিষ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বন-এ এসেছিল তার মা। ছেলের বাড়ি দু-মিনিটের রাস্তা। সেখানে বউ নিয়ে থাকে।
মারিয়ানা বিধবা। প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। বরটি ছিল খাসা ছোকরা–কিন্তু…
এ বাড়ির তিন বোনের কেউই নাৎসি ছিল না। এরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে হয়তো ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, হয়তো করেনি। যাই হোক, যাই থাক– তাই বলে দীর্ঘ সুদীর্ঘ সেই ঘটনার দু-হাজার বছর পর এদের দোকানপাট, ভজনালয়, ওদের লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দেবে (মহাকবি হাইনরিষ হাইনের কবিতাও বাদ যায়নি), ইহুদি ডাক্তার, উকিল প্র্যাকটিস করতে পারবে না– এটা ওরা গ্রহণ করতে পারেনি। এটা ১৯৩৪ সালের কথা। তখনও কনসানট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভ হয়নি। যখন আরম্ভ হল তখন আমি দেশে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি-চাপাটির গমনাগমন সম্পূর্ণ রুদ্ধ। কিন্তু আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ ছিল না যে, লিজেলদের পরিবার এ প্রকারের নিষ্ঠুর নরহত্যা শুধু যে ঘৃণার চোখে দেখবে তাই নয়, এরা যে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না সেটা তাদের মনকে বিকল করে দেবে।… এসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি যখন জর্মনি যাই, তখন লিজেল আমাকে বলেছিল, ডু হালুঙ্কে, তুই তো ভালো করেই চিনিস, আমাদের এই মুফেনডার্ফ গ্রাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হোক, জর্মনির ক্ষুদ্রতম গ্রাম। সেই হিসেবে আমার প্রখ্যাততম গ্রাম। এখানে মাত্র একটা-দুটো ইহুদি পরিবার ছিল। দিদি সময়মতো ওদেরকে সুইটজারল্যান্ডে পাচার করে দিয়েছিল।
এবারে আরম্ভ হবে ট্রাজেডি।
মারিয়ানা বড় সরলা। এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। অবশ্য সে-ও ছিল আর দুই দিদির মতো পরদুঃখ-কাতর।
বিয়ে করে বসল এক প্রচণ্ড পাঁড় নাৎসকে। কেন করল, এ মূর্খকে শুধোবেন না। মেয়েরা কেন কার প্রেমে পড়ে, কেন কাকে বিয়ে করে এ নিগূঢ় তত্ত্ব দেবতারাও আবিষ্কার করতে পারেননি।
তার পর যুদ্ধ লাগল। সেটা শেষ হল।
এইবারে মার্কিন-ইংরেজদের কৃপায় দেশের শাসনভার পেলেন নাৎসি-বৈরীরা। এরা খুঁজে খুঁজে বের করলেন নাসিদের। তখন আরম্ভ হল তাদের ওপর নির্যাতন। আজ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তিন রাত্তির গারদে নির্জন কারাবাসের পর আপনাকে ছেড়ে দিল। আপনি ভাবলেন, যাক বাঁচা গেল। দশ দিন যেতে না যেতে আবার ভোর চারটেয় আপনাকে গ্রেফতার করে ঠাসল গারদে। (এই যে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু আপনার পিছনে গোয়েন্দা রেখে ধরবার জন্য কারা কারা আপনার সহকর্মী ছিল; কারণ স্বভাবতই আপনি তাদেরই সন্ধানে বেরুবেন। দ্বিতীয়ত এরা আপনার দরদি বন্ধু। আপনার দৈন্য-দুর্দিনে একমাত্র তারাই আপনাকে সাহায্য করবে– অবশ্য যদি তাদের দু-পয়সা থাকে।… এটা কিছু নবীন ইতিহাস নয়। আমাদের এই স্বদেশী আন্দোলনের সময়, পরবর্তী যুগে মহামান্য টেগার্ট সাহেবের আমলে–
বারে বারে সহস্র বার হয়েছে এই খেলা।
দারুণ রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা ॥)
সর্বশেষে মারিয়ানার স্বামীর তিন বছরের জেল হল। সেখানে যক্ষ্মা। বেরিয়ে এসে ছ-মাসের পরই ওপারে চলে গেল।
পাঠক ভাববেন না, আমি নাৎসি-বৈরীদের দোষ দিচ্ছি।
বার বার শুধু আমার মনে আসছে :–
এদেশের লোক সবাই কৃশ্চান।
এদেশের প্রভু, প্রভু খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, ক্ষমা, ক্ষমা, ক্ষমা।
জানি, মানুষ এত উঁচুতে উঠতে পারে না।
কিন্তু সেই চেষ্টাতেই তো তার খ্রিষ্টত্ব, তার মনুষ্যত্ব।
.
১৪.
হুররে, হুররে, হুররে।
কৈশোরে অবশ্য আমরা বলতুম, হিপ হিপ হুরে।
পুরোপাক্কা ক্রেডিট নিশ্চয়ই অ্যারইন্ডিয়া কোম্পানির।… দীর্ঘ হাওয়াই মুসাফিরির পর অঘোরে ঘুমিয়েছিলুম সকাল আটটা অবধি। নিচে নামতেই লিজেল চেঁচিয়ে বললে, ডু হালুঙ্কে! তোর হারানো সুটকেস ফিরে পাওয়া গিয়েছে।
কী করে জানলি?
আমাদের তো টেলিফোন নেই। চল্লিশ বছর আগে এই গডেসবের্গের যে বাড়িতে তুই বাস করতিস তার টেলিফোন নম্বরটি তুই কলোনের হারানো প্রাপ্তির দফতরে সুবুদ্ধিমানের মতো দিয়ে এসেছিলি। আশ্চর্য! সে নম্বর তুই পুত-পুত করে এত বৎসর ধরে পুষে রেখেছিলি কী করে আর সেটা যে কলোনের সেই হারানো প্রাপ্তি দফতরে আপন স্মরণে এনে ওদের দিয়েছিলি সেটা আরও বিস্ময়জনক। তোর পেটে যে এত এলেম তা তো জানতুম না। আমি তো জানতুম তোর পশ্চাৎদেশে টাইম বম রাখতে হয় (আমরা বাঙলায় বলি পেটে বোমা না মারলে কথা বেরোয় না), ফিউজের হিসহিস শুনে তবে তোর বুদ্ধি খোলে। সে-কথা থাক। কলোনের দফতর সেই নম্বরে ফোন করে, আব তোর সেই প্রাচীন দিনের ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল তুই আমাদের বাড়িতে উঠেছিস। তাছাড়া যাবি আর কোন চুলোয়। আনা-র বিয়ে হয়েছে এক যুগ আগে। ভাতার আর বাচ্চা দুটো রয়েছে। তাই সেখানে না উঠে আমাকে আপ্যায়িত করতে এসেছিস। ফের বলছি সেকথা থাক। আনা কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হবে না কেন? আমি ওদের বাড়িতে ঝাড়া একটি বচ্ছর ছিলাম। আমার সঙ্গ পেয়েছে বিস্তর।
লিজেল আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে কোনও মন্তব্য না করে বললে, সে জানে আমাদের টেলিফোন নেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার আছে। তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে, তোর সুটকেসটি পাওয়া গিয়েছে এবং কলোন দফতরে জমা পড়েছে।
আমি বললুম, সর্বনাশ। আমাকে এখন ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে যেতে হবে সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর কলোনে? আধ-খানা দিন তাতেই কেটে যাবে। হেথায় এসেছি ক দিনের তরে। তারও নিরেট চারটি ঘণ্টা মেরে দিয়েছে জুরিক। কনেকশন ছিল না বলে। আমি
লিজেল বাধা দিয়ে বললে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে প্রাথমিক পরিচয়ে তোকে যে একটা আকাট মূর্খ ঠাউরেছিলুম সেটা কিছু ভুল নয়; কলোনের দফতরে তোর প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি ব্যত্যয়। অবশ্য আমি কখনও বলিনে, একসেপশন প্রভজ দি রুল। আমি বলি, রুল ভজ দি একসেপশন। তোর সুটকেস তারাই এখানে পৌঁছে দেবে।
.
ওহ! কী আনন্দ, কী আনন্দ। কাল রাত্রে ভয়ে ভয়ে আমি আমার হারিয়ে না-যাওয়া সুটকেসটি খুলিনি। যদি দেখি, এদের এবং আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের জন্য ছোটখাটো যেসব সওগাত এনেছি সেগুলো ওই বড় সুটকেসটিতে নেই! এটাকেই নাকি বিদেশি ভাষায় বলে অসট্রিচ মনোবৃত্তি।
ইতোমধ্যে বাড়ির সদর দরজাতে ঘা পড়ল। লিজেল সেথায় গিয়ে কী যেন কথাবার্তা কইল। মিনিট দুই পরে সেই হারিয়ে-যাওয়া-ফিরে-পাওয়া সুটকেসটি নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললে, তোদের অ্যার-কোম্পানি তো বেশ স্মার্ট : কম্পিটেন্ট। এত তড়িঘড়ি হুলিয়া ছেড়ে, বাক্সটাকে ঠিক ঠিক পকড় করে তোর কাছে পৌঁছে দিল! আমার ছাতি সুশীল পাঠক, ইঞ্চি ছয়–মাফ করবেন আজকাল নাকি তাবৎ মাপ সেন্টিমিটার মিলিমিটারে বলতে হয় অর্থাৎ ১৫ মিলিমিটার (কিংবা সেন্টিমিটারও হতে পারে আমার প্রিন্স অব, ওয়েলস অর্থাৎ বড় বাবাজি যে ইসকেলখানা রেখে দিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছেন সেটাতে তার হদিস মেলে না) ফুলে উঠল।
বাকসোটা খুলে দেখি, আমার মিত্র যেসব বস্তু খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে দিয়েছিল তার সবই রয়েছে। (১) বারোখানা মুর্শিদাবাদি রেশমের স্কার্ফ, (২) উড়িষ্যায় মোষের শিঙে তৈরি ছটি হাতি, (৩) পূর্ববৎ ওই দেশেরই তৈরি পিঠ চুলকানোর জন্য ইয়া লম্বা হাতল, (৪) দশ বান্ডিল বিড়ি (এগুলো অবশ্য লিজেল পরিবারের জন্য নয়; এগুলো আমার অন্য বন্ধুর জন্য), (৫) ভিন্ন ভিন্ন গরম মশলা এবং আচার, (৬) বর্ধমানের রাজপরিবারের আমার একটি প্রিয় বান্ধবীর দেওয়া একখানি মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম স্কার্ফ (তার শর্ত ছিল সেটি যেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠা বান্ধবীকে দিই), (৭) তিনটি ফার্স্টক্লাস বেনারসি রেশমের টাই, কাশ্মিরের ম্যাংগো ডিজাইনের শালের মতো এগুলো বর্ধমানেরই দেওয়া, (৮) দুই-পৌন্ড দক্ষিণ ভারতের কফি ও পূর্ববৎ ওজনে দার্জিলিঙের চা।… এবং একখানা বই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তার এক বিশেষ পূজারিণীর জন্য, তিনি বাস করেন সুইটজারল্যান্ডে। আর কী কী ছিল ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না। বেশ কিছু কাসুলোও ছিল। এই ইউরোপীয়ানদের বড্ডই দেমাক, তাদের মাস্টার্ড নিয়ে। দম্ভজনিত আমার উদ্দেশ্য ছিল, এদেরকে দেখানো যে আমাদের বাঙলা দেশের কাসুন্দো এ-লাইনে অনির্বচনীয়, অতুলনীয়। পাউডার দিয়ে তৈরি ওদের মাস্টার্ড দু দিন যেতে না যেতেই মনে ধরে সবুজ হয়ে অখাদ্যে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের কান্দো? মাসের পর মাস নির্বিকার ব্রহ্মের মতো অপরিবর্তনশীল।
লিজেলকে বললুম, দিদি, এসব জিনিস ওই বড় টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখ। আর খবর দে ডিটরিষ ও তার বউকে। মারিয়ানা আর তুই তো আছিসই। যার যা পছন্দ তুলে নেবে।
লিজেল বললে, এটা কি ঠিক হচ্ছে এখান থেকে তুই যাবি ডুসলডর্কে– সেখানে তোর বন্ধু পাউল আর তার বউ রয়েছে। তার পর যাবি হামবুর্গে; সেখানে তোর বান্ধবীর (তিনি গত হয়েছেন) তিনটি মেয়ে রয়েছেন। তার পর যাবি স্টুটগার্ট-এ। সেখানে রয়েছেন তোর ফার্স্ট লভ। এখানেই যদি ভালো ভালো সওগাত বিলিয়ে দিস তবে ওরা পাবে কী?
একেই বঙ্গভাষায় বলে, পাকা গৃহিণী। কোন গয়না কে পাবে জানে ॥
.
১৫.
গডেসবের্গ সত্যই বড় সুন্দর। এ শহরের সৌন্দর্য আমাকে বার বার আহ্বান করেছে। রাস্তাগুলো খুবই নির্জন। এতই নির্জন যে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলে, সে সম্পূর্ণ অচেনা হলেও, আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, গুটেন টাহু। আপনিও তাই বলবেন। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট গেরস্ত-বাড়ি। সবাই বাড়ির সামনে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে ফুল ফুটিয়েছে। যদি কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফুলগুলোর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকেন তবে প্রায়ই বাড়ির কর্তা কিংবা গিন্নি কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনার সঙ্গে কথা জুড়ে বসবে। শেষটায় বলবে, আপনিও আমাদেরই একজন; কিছু ফুলটুল চাই বলুন না, কোনগুলো পছন্দ হয়েছে। তার পর একগাল হেসে হয়তো বলবে, প্রেমে পড়েছেন নাকি? তা হলে লাল ফুল। হাসপাতালে রুগী দেখতে যাচ্ছেন নাকি? তা হলে সাদা ফুল। আমি একবার শুধিয়েছিলুম, আর যদি আমার প্রিয়ায় সঙ্গে ঝগড়া হয়ে থাকে, তা হলে কী ফুল পাঠাব? যাকে শুধিয়েছিলুম তিনি দু গাল হেসে বলেছিলেন, সবুজ ফুল। সবুজ ঈর্ষার রঙ। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সবুজ ফুল তো এদেশে দেখিনি কখনও। আমাদের দেশেও সবুজ ফুল একেবারেই বিরল। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও। কিন্তু আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সবুজ ফুল আছে। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ও মশাই, দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার সবুজ ফুলের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই– ও মশাই–
কিন্তু কে বা শোনে কার কথা!
মিনিট দুই যেতে না যেতেই সেই মহাত্মার পুনরাবির্ভাব। হাতে একটি সবুজ গোলাপ। চোখে মুখে যে আনন্দ তার থেকে মনে হল তিনি যেন বাকিংহাম প্রাসাদ কিংবা কুতুবমিনার কিংবা উভয়ই কুড়িয়ে এনেছেন। আমি বিস্তর ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ডাঙ্কে শ্যোন, ডাঙ্কে রেষট শ্যোন’ বলে অজস্র ধন্যবাদ জানালুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি মহিলা ডেকে বললেন, ওগো, তোমার কফি
হঠাৎ আমাকে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন।
ভদ্রলোক বললেন, চলুন না। এক পাত্র কফি– হেঁ হেঁ-
আমি বললুম, কিন্তু আপনার গৃহিণী–?
না, না, না, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার গৃহিণী খাণ্ডারিণী নয়। অবশ্য সে আপনাকে কখনও দেখেনি। চলুন চলুন।
বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক আমাকে কফি টেবিলের পাশে সযত্নে বসিয়ে বললেন, আপনাকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে কত না দেখেছি। আমার বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরো। কিন্তু ভয়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারিনি।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী?
এজ্ঞে আমি জানতুম, আপনি ইন্ডিয়ান। আর ইন্ডিয়ানরা সব ফিলসফার। তারা যত্রতত্র যার-তার সঙ্গে কথা কয় না। তাই। আপনি ধীরে ধীরে পা ফেলে ফেলে যেতেন রাইন নদের পারে। আমি কত না দিন আপনার পিছন পিছন গিয়েছি। আপনি একটি বেঞ্চিতে বসে রাইনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন। তখন কি আর বিরক্ত করা যায়?
আমি বললুম, ব্রাদার, এটা বড় ভুল করেছ। তখন আমার সঙ্গে কথা কইলে বড়ই। খুশি হতুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির গৃহিণী কেক ইত্যাদি নিয়ে এসে আমাদের টেবিলে রাখলেন। তাঁর গালদুটো আরও লাল হয়ে গিয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে এবং তিনি হাঁপাচ্ছেন। অর্থাৎ এ পাড়ায় কোনও কেকের দোকান নেই বলে তিনি কুড়ি মিনিটের রাস্তা ঠেঙিয়ে কেক টার্ট নিয়ে এসেছেন।
এস্থলে যে কোনও ভদ্রসন্তান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাফ চাইত। বলত, এ সবের কী প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমি চাইনি। আমাকে বেয়াদব, মূর্খ, যা খুশি বলতে পারেন।
আমি শুধু আমার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তাঁর কপালটি মুছে দিলুম।
.
১৬.
হুমবলট স্টিফটুঙ
ভ্রমণকাহিনী লিখতে লিখতে মানুষ আশকথা পাশকথার উত্থাপন করে। গুণীরা বলেন এটা কিছু দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে পথিক যদি পথের ভুলে আশপথ পাশপথে না যায় তবে অচেনা ফুলের, নয়া নয়া পাখির সঙ্গে তার পরিচয় হবে কী প্রকারে? কবিগুরুও বলেছেন,
যে পথিক পথের ভুলে
এল মোর প্রাণের কূলে—
অর্থাৎ প্রণয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমি যদি মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি তবে সহৃদয় পাঠক অপরাধ নেবেন না।
আলেকজান্ডার ফন্ হুমূবটের নাম কে না শুনেছে? নেপোলিয়ন গ্যোটে শিলারের সমসাময়িক। দুই কবির সঙ্গে তার ভাবের আদান-প্রদান হত। এবং অনেকেই বলেন, ওই সময়ে পাশ্চাত্য মহাদেশগুলোতে নেপোলিয়নের পরেই ছিল হুম্বটের সুখ্যাতি। আসলে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক এবং পর্যটক ওদিকে কাব্য, দর্শন, অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গেও সুপরিচিত।
কিন্তু তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখাটি আরম্ভও করিনি।
হুমবলট গত হন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। যেহেতু তিনি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য (দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ককেশাস সাইবেরিয়া পর্যন্ত) অতিশয় সযত্নবান ছিলেন তাই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনের জর্মন পররাষ্ট্র দফতরের উৎসাহে ওই দেশের জনসাধারণ একটি প্রতিষ্ঠান এন্ডাওমেন্ট দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, ওয়াকফ, যা খুশি বলতে পারেন নির্মাণ করল : নাম আলেকজান্ডার ফন্ হুমবলট স্টিটু। তাদের একমাত্র কর্ম তখন ছিল বিদেশি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে জর্মনিতে পড়াশুনো করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমার বড়ই বিস্ময় বোধ হয়, জর্মনির ওই দুর্দিনে (ইনফ্লেশন সবে শেষ হয়েছে; তার খেয়ারি তখনও কাটেনি) সে কী করে এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করল? আমরা বলি আপনি পায় না খেতে–। অনেক চিন্তা করে বুঝেছিলুম, দয়াদাক্ষিণ্য আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর করে না। লক্ষপতি ভিখিরিকে একটা কানাকড়ি দেয় না, অথচ আমি আপন চোখে দেখেছি এক চক্ষুষ্মন ভিখিরি এক অন্ধ ভিখিরিকে আপন ভিক্ষালব্ধ দু-চার আনা থেকে দু-পয়সা দিতে। আমার এক চেলা এদানীং আমাকে জানাল গঙ্গাস্বরূপা ইন্দিরাজিও নাকি বলছেন, গরিবই গরিবকে মদত দেয়।
সে আমলে ইন্ডিয়া পেত মাত্র একটি স্কলারশিপ আজ অনেক বেশি পায়।*[* দয়া করে আমাকে প্রশ্ন শুধিয়ে চিঠি লিখবেন না, কী কৌশলে এ স্কলারশিপ পাওয়া যায়।] সেটি পেলেন আমার বন্ধু সতীর্থ বাসুদেব বিশ্বনাথ গোখলে।**[** দয়া করে গোখেল উচ্চারণ করবেন না।] ইনি সর্বজনপূজ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বর গোখলের ভ্রাতুস্পুত্র। তার চার বত্সর পর পেলুম আমি। সেকথা থাক। মাঝে মাঝে গাধাও রাজমুকুট পেয়ে যায়।..
গোডেসবের্গ শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি, একটি বাড়ির সম্মুখে মোটা মোটা হরফে লেখা,
আলেকজান্ডার ফন
হুমবলট স্টিফটুঙ
আমারে তখন আর পায় কে? লম্বা লম্বা পা ফেলে তদ্দণ্ডেই সে বাড়িতে উঠলুম।
আমি অবশ্যই আশা করিনি যে সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বেকার লোক এ আপিস চালাবেন।
কিন্তু এনারাও ভদ্রলোক। অতিশয় ভদ্রভাবে শুধোলেন,
আপনি কোন সালে হুমবলট বৃত্তি পেয়েছিলেন?
১৯২৯।
ভদ্রলোক যেন সাপের ছোবল খেয়ে লম্ফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
আমিও তাজ্জব বনে গিয়ে বললুম, কী হল?
কী! চল্লিশ বছর পূর্বে।
এজ্ঞে হ্যাঁ।
মাইন গট (মাই গড), এত প্রাচীন দিনের কোনও স্কলারশিপ-হোল্ডারকে আমি তো কখনও দেখিনি!
আমি একটুখানি সাহস পেয়ে বললুম, ব্রাদার, ইহ-সংসারে তুমিও অনেক কিছু দেখনি, আঘো দেখিনি। তুমি কি আপন পিঠ কখনও দেখেছ? তাই কি সেটা নেই?
.
যেহেতু আমি এ বাড়িতে ঢোকার সময় আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, তাই তারা ইতোমধ্যে চেক-আপ করে নিয়েছে, আমি সত্য সত্যই ১৯২৯-এ স্কলারশিপ পেয়ে এ দেশে এসেছিলুম।
হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অ– অ- অ। জানেন, আপনি আমাদের প্রাচীনতম স্কলারশিপ-হোল্ডার?
আমি সবিনয় বললুম, তা হলে আমাকে আপনাদের প্রাচ্যদেশীয় জাদুঘরে পাঠিয়ে দিন। টুটেনখামের মমির পাশে কিংবা রানি নফ্রেটাট্রর পাশে আমাকে শুইয়ে দাও।
.
১৭.
সুইটজারল্যান্ড, জর্মনি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে টাকাকড়ির এমনই ছড়াছড়ি, সে কড়ি কী করে খরচ করবে যেন সেটা ভেবেই পায় না। বিশ্বময় সঠিক বলতে পারব না, তবে বোধ হয় চীন এবং লৌহ-যবনিকার অন্তরালের দেশগুলো এখনও অপাঙক্তেয়। গণ্ডায় গণ্ডায় স্কলারশিপ ছড়ানোর পরও হুম্ব ওয়াফের হাতে বেশকিছু টাকা বেঁচে যায়।
তাই তারা প্রতি বৎসর একটা জব্বর পরব করে। তিন দিন ধরে। জর্মনিতে যে শত শত হুমবলট স্কলার ছড়িয়ে আছে এবং যারা একদা স্কলার ছিল, উপস্থিত জৰ্মনিতেই কাজকর্ম করে পয়সা কামাচ্ছে, তাদের সব্বাইকে তিন দিনের তরে বাড় গডেসবের্গে নেমন্তন্ন জানায়। যারা বিবাহিত, তাদের বউ কাচ্চাবাচ্চাসহ;- বলা বাহুল্য ওই উপরোক্ত সম্প্রদায়, যারা কাজকর্ম করে পয়সা কামায়। আসা-যাওয়ার ট্রেনভাড়া, হোটেলের খাইখর্চা, তিন দিন ধরে নানাবিধ মিটিং পরব নৃত্যগীত অনুষ্ঠানে যাবার জন্য মোটরগাড়ি– এক কথায় সব– সব। প্রাচীন দিনে আমাদের দেশে যেরকম জমিদারবাড়িতে বিয়ের সময় দশখানা গায়ের বাড়িতে তিন দিন ধরে উনুন জ্বালানো হত না।
হার পাপেনফুস্ স্টিফটুঙের অন্যতম কর্তাব্যক্তি। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে বললেন, আপনার তুলনায় জর্মনিতে উপস্থিত যেসব প্রাক্তন স্কলার আছেন তাঁরা নিতান্তই শিশু।
আমি বললুম, আমার হেঁটোর বয়স।
পাপেনফুস ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। অর্থাৎ বুঝতে পারেননি। সব দেশের ইডিয়ম, প্রবাদ তো একই ছাঁচে তৈরি হয় না। আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বললুম, আমাকে যে আপনাদের পরবে নিমন্ত্রণ করেছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাদের পরব আসছে সপ্তাহ তিনেক পরে। ওদিকে আমাকে যেতে হবে কলোন, ডর্ফ, হামবুর্গ, স্টুটগার্ট এবং সর্বশেষে স্টুটগার্ট থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে পাড়াগাঁয়ে আমার প্রাচীন দিনের এক বিধবা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। তার অর্থ আমার স্কলারশিপের মতো তিনিও চল্লিশ বছরের পুরনো- প্লাস তার বয়স।
লক্ষ করলুম, যে তৃতীয় ব্যক্তি সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তার চোখে ঠোঁটে কেমন যেন একটুখানি মৃদু হাসি খেলে গেল। এর অর্থ হতে পারে :
(১) এ তো বড় আশ্চর্য। ষাট বছর বয়সের প্রাচীনা প্রিয়ার অভিসারে যাচ্ছে এই নাগর।
কিংবা
(২) এর এক-প্রিয়া-নিষ্ঠতাকে তো ধন্যি মানতে হয়।
(রামচন্দ্রকে বলা হয় একদারনিষ্ঠ)।
ইতোমধ্যে কর্তা বললেন, সে কী কথা। আপনি আসবেন না, সে তো হতেই পারে না। আপনার ভাষায়ই বলি, আপনার মতো মিউজিয়ম পিস আমাদের কর্তাব্যক্তিদের গুণীজ্ঞানীদের দেখাতে পারব না, সে কি একটা কাজের কথা হল? ওনাদের অনেকেই ভাবেন, আমাদের আলেকজান্ডার ফন্ হুমবট স্টিফটুঙ বুঝি পরশু দিনের বাচ্চা। অথচ আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে সেই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ জর্মনি যখন তছনছ হয়ে গেল তখন কয়েক বৎসর প্রতিষ্ঠান দেউলে হয়ে রইল। এদের আমি দোষ দিইনে–সব জর্মনই তো ঐতিহাসিক মসজেন হয় না। অতএব চল্লিশ বছরের পূর্বেকার জলজ্যান্ত একজন বৃত্তিধারীকে যদি ওদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তখন হুজুরদের পেত্যয় যাবে।
আমি মনে মনে বললুম, ঈশ্বর রক্ষতু। যাদুঘরে যেরকম পেডেস্টালের উপর গ্রিক মূর্তি খাড়া করে রাখে, সেরকম নয় তো! তা করুক, কিন্তু জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণার্থে কুল্লে একখানা ডুমুরপাতা পরিয়ে দিলেই তো চিত্তির—
কর্তা বলে যেতে লাগলেন, আপনি পরবের সময় কন্টিনেন্টে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা সানন্দে আপনাকে একখানা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে দেব। এখানে হোটেলের ব্যবস্থা, যানবাহন সবই তো আমরা করে থাকি। তার পর আপনি ফিরে যাবেন আপন মোকামে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি কি মাত্র তিনটি দিনও স্পেয়ার করতে পারবেন না… আচ্ছা, তবে এখন চলুন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।
বড়ই নেমকহারামি হয়। তদুপরি এরা আমাকে দুই যুগ পরে আবার নেমক দিতে চায়। একদা যে প্রতিষ্ঠান, যে জর্মন জাত এই তরুণকে স্কলারশিপ-নেমক দিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, তাদেরকে নিরাশ করি কী প্রকারে?
আমি সকৃতজ্ঞ পরিপূর্ণ সম্মতি জানালুম।
.
রেস্তোরাঁটি সাদামাঠা, নিরিবিলি ছোটখাটো ঘরোয়া। ব্যান্ডবাদ্যি, জ্যাজু মুজিক, খাপসুরৎ তরুণীদের ঝামেলা কোনও উৎপাতই নেই। বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে এ রেস্তোরাঁতে আসেন নিকটস্থ আপিস-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। তার অন্যতম প্রধান কারণ মেনু (খাদ্যনির্ঘণ্ট) দেখেই আমার চক্ষুস্থির। ত্বরিতেই হিসাব করে দেখলুম এখানে অতি সাধারণ লাঞ্চ খেতে হলেও নিদেন পনেরো মার্ক লাগবার কথা। আমাদের হিসাবে তিনখানা করকরে দশ টাকার নোট! অবশ্য গচ্চাটা আমাকে দিতে হবে না। কারণ ওঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। এবং এ দেশের রেস্তোরাঁতে যে ব্যক্তি অর্ডার দিল সে-ই পেমেন্ট করবে– যে খেল তার কোনও দায় নেই।
কিন্তু এস্থলে সেটা তো কোনও কাজের কথা নয়।
যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন তাঁরা আমাকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, কী খাবেন, বলুন। আমি কি তখন তাদের ঘাড় মটকাব!
আমি শুধোলম, আপনারা কি এই রেস্তোরাঁতেই প্রতিদিন লাঞ্চ খেতে আসেন?
এজ্ঞে হ্যাঁ।
কী খান; মানে, কোন কোন পদ।
সুপ, মাংস আর পুডিং। কখনও-বা আইসক্রিম- তবে সেটা বেশিরভাগ গ্রীষ্মকালে। মাঝেমধ্যে শীতকালেও!
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, শীতকালে আইসক্রিম!
তখন আমার মনে পড়ল, আমরাও তো দারুণ গরমের দিনে গরমোতর চা খাই। তবে এরাই-বা শীতকালে আইসক্রিম খাবে না কেন?
আমি অতিশয় সাদামাঠা লাঞ্চ অর্ডার দিলাম। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তার গলা মটকাতে নেই।
.
১৮.
আহারাদির কেচ্ছা শুরু হলেই আমি যে বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই আমার সম্বন্ধে সে বদনাম এতই দীর্ঘকালের যে, তার সাফাই এখন বেবাক তামাদি– ইংরেজি আইনের ভাষায় টাইম-বার না কী যেন বলে–হয়ে গিয়েছে। তাই পাঠক ধর্মাবতারের সমুখে করজোড়ে স্বীকার করে নিচ্ছি আমি দোষী, অপরাধ করেছি।
কিন্তু আমি জাত-ক্রিমিনাল। আমার মিত্র এবং পৃষ্ঠপোষক জনৈক জেল-সুপারিনটেনডেন্ট তার একাধিক প্রামাণিক পুস্তকে লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে জাত-ক্রিমিনাল হয় না। হু! আমি যে জাত-ক্রিমিনাল সেটা জানার পূর্বেই তিনি এসব দায়িত্বহীন বাক্যবিন্যাস করেছেন। তাই আমি আবার সেই লাঞ্চের বর্ণনা পুনরায় দেব।
সুপ আমি বড় বেশি একটা ভালোবাসিনে।
এ বাবদে কিন্তু আমি সমুদ্রের বেলাভূমিতে সম্পূর্ণ একাকী নুড়ি নই। ডাচেস অব উইন্ডসর (উচ্চারণ নাকি উইনজার) অতি উত্তম রান্নাবান্না করতে পারেন। তা সে অনেকেই পারেন। কিন্তু তিনি আরেকটি ব্যাপারে অসাধারণ হুনুরি। ভোজনটি কী প্রকারে কমপোজ করতে হবে– এ তত্ত্বটি তিনি খুব ভালো করে জানেন।
অপরাধ নেবেন না। আমরা বাঙালি মাত্রই ভাবি, ভোজনে যত বেশি পদ দেওয়া হয়। ততই তার খানদানিত্ব বেড়ে যায়। তিন রকমের ডাল, পাঁচ রকমের চচ্চড়ি, তিন রকমের মাছ, দু-তিন রকমের মাংস, চিনি-পাতা দই আর কত হরেক রকমের মিষ্টি তার হিসাব না-ই বা দিলুম।
আর প্রায় সবকটাই অখাদ্য! কারণ, এতগুলো পদের জন্য তো এতগুলো উনুন করা যায়, গোটা দশেক পাঁচক ডাকা যায় না। অতএব বেগুনভাজা মেগনোলিয়ার আইসক্রিমের মতো হিম, চিনি-পাতা দই পাঞ্জাব মেলের এনজিনের মতো, গরম লুচি কুকুরের জিভের মতো চ্যাপটা, লম্বা–খেতে গেলে রবারের মতো। আজকাল আবার ফ্যাশন হয়েছে ঘি-ভাত বা পোলাউয়ের বদলে চীনা ফ্রাইড রাইস। চীনারা র উচ্চারণ করতে পারে না। অতএব বলে ফ্রাইড লাইস- অর্থাৎ ভাজা উকুন! তা সে যে উচ্চারণই করুক আমার তাতে কানাকড়ি মাত্র আপত্তি নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন, গোলাপে যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে। তাই ফ্রাইড রাইস বলুন বা ফ্রাইড লাইসই বলুন–সোওয়াদটি উত্তম হলেই হল। কিন্তু আজকালকার কেটারাররা (হে ভগবান, এই সম্প্রদায়কে বিনষ্ট করার জন্য আমি চেঙ্গিস হতে রাজি আছি) নেটিভ পাঁচক দিয়ে ফ্রাইড লাইস নির্মাণ করেন। সত্য সত্য তিন সত্য বলছি, যে মহামূল্য সম্পদ জিহ্বাগ্র স্পর্শ করার পূর্বেই আপনি বুঝে যাবেন এই অভূতপূর্ব বস্তু উকুন ভাজা। আলবৎ আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি, উকুন ভাজা আমি এই কেটারার-সম্প্রদায়ের অবদান মেহেরবানির পূর্বে কখনও খাইনি। তাই গোড়াতেই বলেছি, আমরা মেনু কম্পোজ করতে জানিনে।
তা সে থাক, তা সে যাক। পরনিন্দা মহাপাপ। এখানেই ক্ষান্ত দিই। বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই খিটখিটে হয়ে যায়।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। ডাচেস অব উইনজার নাকি তার লাঞ্চ-ডিনারে নিমন্ত্রিতজনকে কখনও সুপ পরিবেশন করেন না। অতিশয় অভিজ্ঞতালব্ধ তার বক্তব্য: এই যে বাবুরা এখন ডিনার খেতে যাবেন তার আগে তেনারা গিলেছে গ্যালন গ্যালন ককটেল, হুইস্কি। জালা জালা শেরি, পোর্ট। সক্কলেরই পেট তরল বস্তুতে টইটম্বুর– ছয়লাপও বলতে পারেন। ডাচেসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত সুচিন্তিত অভিমত : এর পরও যদি হুজুররা তরল দ্রব্য সুপ পেটে ঢোকান তবে, তার পর আর রোস্ট ইত্যাদি নিরেট সলিড দ্রব্য খাবেন কী প্রকারে? তাই তার ডিনারে নো সুপ? অবশ্য ডাচেস সহৃদয়া মহিলা। কাজেই যারা নিতান্তই সুপাসক্ত তাদের জন্য সুপ আসে। ওদেরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনিও মাঝে মাঝে দু-চার চামচ সুপ গলাতে ঢালেন।
অতএব আমাকেও নিতান্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য হুমবলট স্টিফটুঙ প্রদত্ত লাঞ্চে কিঞ্চিৎ সুপ সেবন করতে হল।
বাহ্! উত্তম সুপ! ব্যাপারটা তা হলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
যেসব দেশের কলোনি নেই–বিশেষ ভারত, সিংহল কিংবা ইন্দোনেশিয়ার–তারা গরম মশলা পাবে কোত্থেকে? কেনার জন্য অত রেস্ত কোথায়? শত শত বৎসর ধরে তাদের ছোঁকছোঁকানি শুধু গোলমরিচের জন্য। শুনেছি, ভাস্কো দা গামা ওই গোলমরিচের জন্য অশেষ ক্লেশ করে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, কলমবসও নাকি ওই একই মতলব নিয়ে সাপ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো পেয়ে গেলেন– অর্থাৎ ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। এর পর ইউরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় ঝাল লাল লঙ্কা আবিষ্কার করল, কিন্তু ওটা ওদের ঠিক পছন্দ না। যদ্যপি আমরা ভারতীয়রা সেটি পরামানন্দে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করলুম।
ইতিহাস দীর্ঘতর করব না।
ইতোমধ্যে জর্মনির এতই ধনদৌলত বেড়ে গিয়েছে যে, এখন সে শুধু কালা মরিচ কিনেই পরিতৃপ্ত নয়– এখন সে কেনে দুনিয়ার যত মশলা। বিশেষ করে কারি পাউডার আর লবঙ্গ, এলাচি, ধনে ইত্যাদির তো কথাই নেই। তবে কি না আমি কন্টিনেন্টের কুত্রাপি কাঁচা সবুজ ধনেপাতা দেখিনি। কিন্তু ভয় নেই, কিংবা ভয় হয়তো সেখানেই। যেদিন কন্টিনেন্টের কুবের সন্তানরা ধনে-পাতা-লঙ্কা-তেঁতুল-তেলের চাটনির সোয়াদটা বুঝে যাবেন, সেদিন হবে আমাদের সর্বনাশ। হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে কুল্লে ধনে-পাতা হিল্লি-দিল্লি হয়ে চলে যাবেন কাঁহা কাহা মুল্লুকে। এটা তো এমন কিছু নয়া অভিজ্ঞতা নয়। ভারত বাংলাদেশের বহু জায়গাতেই আজ আপনি আর চিংড়িমাছ পাবেন না। টিনে ভর্তি হয়ে তারা আপনার উদরে না এসে সাধনোচিত ধামে (অর্থাৎ কন্টিনেন্টে– সেখানে চিংড়িমাছ কেন, সর্ব ভারতীয় যুবকই যেতে চায়) প্রস্থান করেন। একমাত্র কোলাব্যাঙ সম্বন্ধেই আমাদের কোনও দুঃখ নেই। যাক, যত খুশি যাক। এটা ফরাসিদের বড়ই প্রিয় খাদ্য। তবে কি না বাঙালোর থেকে তারস্বরে এক ভদ্রলোক প্রতিবাদ করেছেন, পাইকিরি হিসেবে এভাবে কোলাব্যাঙ বিদেশে রফতানি করার ফলে ওই অঞ্চলে মশার উৎপাত দুর্দান্তরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ওই কোলাব্যাঙরাই মশার ডিম খেয়ে তাদের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্নসৃষ্টি করত।
এটা অবশ্যই সমস্যা দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমার ভাবনা কী? আমার তো একটা মশারি আছে।
.
১৯.
গুরুমে ভোজনরসিকরা বলেন, সুইটজারল্যান্ডের জর্মনভাষী অঞ্চলের খাদ্যই সবচেয়ে ভেঁতা। অথচ নেপোলিয়ন না কে যেন বলেছেন– ইংরেজ এ নেশন অব শপকিপারজ (অবশ্য ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সাকি নামক ছদ্মনামের এক অতিশয় সুরসিক ইংরেজ লেখক বলেন, আমরা এখন এ নেশন অব শপলিটার অর্থাৎ আমরা এখন দোকানের ভিড়ে চটসে এটা-ওটা-সেটা চুরি করাতে ওস্তাদ) এবং সুইসরা এ নেশন অব হোটেলকিপারস। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাবৎ ইউরোপে সুইসরাই পরিচ্ছন্নতম হোটেল রাখে কিন্তু প্রশ্ন : তোমার হোটেল-রেস্তোরাঁ যতই সাফসুরো রাখো না কেন তোমার রেস্তরার সুপে ব্লন্ড, ব্রুনেট, কালো চুল না পাওয়া গেলেও (দিনের পর দিন তিন রঙের চুল আবিষ্কার করতে করতে আমার এক মিত্র– সুইটজারল্যান্ডে নয়, অন্য এক নোংরা দেশের হোটেলে–একদিন ম্যানেজারকে শুধোলেন, আপনার রান্নাঘরে তিনটি পাচিকা আছেন, না? একজনের চুল ব্লভ, অন্যজনের ব্রুনেট এবং তেসরা জনের কালো। নয় কী? ম্যানেজার তো থ। এই ভদ্রলোকই কি তবে শার্লস হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমস। সবিনয়ে তথ্যটা স্বীকার করে শুধাল, স্যার, আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমাদের রসুইখানায় কখনও পদার্পণ করেননি! বন্ধু বললেন, সুপে কোনও দিন ব্লন্ড, কখনও-বা ব্রুনেট এবং প্রায়ই কালো চুল পাই– কালোটাই পাতলা সুপে চোখে পড়ে বেশি। এ তত্ত্বে পৌঁছবার জন্য তো দেকার্ত-কান্ট-এর দর্শন প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি ওই কালো চুলউলীকে যদি দয়া করে বলে দেন, সে যেন আর পাঁচটা হোটেলের পাঁচজন পাঁচকের মাথায় যেরকম টাইট সাদা টুপি পরা থাকে ওইরকম কোনও একটা ব্যবহার করে। আমার মনে হয় ওর মাথায় দুর্দান্ত খুসকি–পাঠক অপরাধ নেবেন না, এ কেচ্ছাটা বলার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলুম না। সুন্দুমাত্র সুইস হোটেলের সুপমধ্যে হরেকরকম্বা চুল নেই বলেই যে দুনিয়ার লোক হমুদ্দ হয়ে সে দেশে আসবে এ-ও কি কখনও সম্ভবে? আমার সোনার দেশ পূর্বপচ্ছিমওতর বাঙলায় সুপ তৈরি হয় না। অতএব প্লাটিনাম ব্লন্ড, সাদামাটা ব্লন্ড, চেসনাট ব্রাউন, মোলায়েম ব্রাউন, কালো মিশকালো কোনও রঙের কোনও চুলের কথাই ওঠে না। মোটেই মা রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা। কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার গোড়ায় রশি বাঁধার মতো।) তাই বলে কি মার্কিন-সুইস টুরিস্ট এদেশে আসে না?
বিজনেস ইজ বিজনেস–তাই সুইস এ পর্যন্ত তাদের রান্নাতে প্রাচ্যদেশীয় মশলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।
আমার কাছে একখানা সুইস সাপ্তাহিক আসে। তার কলেবর প্রায় ষাট পৃষ্ঠা। একদা কেউ ল্যাটে এলে আমরা ঠাট্টা করে বলতুম, কী বেরাদর, কেপ অব গুড হোপ হয়ে এলে নাকি?– সুয়েজ কানাল যখন রয়েছে। এখন কিন্তু এটা আর মস্করা নয়। অ্যার মেলের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ষাটপৃষ্ঠা বপুধারী পত্রিকা তো আর অ্যার মেলে পাঠানো যায় না। খর্চা যা পড়বে সেটা সাপ্তাহিকের দাম ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দিতে বলে– লড়কে সে লড়কার শু ভারী-বাচ্চাটার ওজনের চাইতে তার মলের ওজন বেশি।
সেই পত্রিকার একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগ আছে। কেউ শুধাল, মাংস আলু তরকারিসহ নির্মিত ভোজনের মেন ডিশ (পিয়েস দ্য রেজিসাস) খাওয়ার পর যেটুকু তলানি সস (শুকনো শুকনো ঝোল, কলকাত্তাইয়ারা কাইও বলে থাকে) পড়ে থাকে তার উপর পাউরুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে, কাঁটা দিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চেটেপুটে খাওয়াটা কি প্ৰতোকোলসম্মত– এটিকেট মাফিক, বেয়াদবি অভদ্রস্থতা নয় তো?
উত্তর : পৃথিবীতে এখন এমনই নিদারুণ খাদ্যাভাব যে, ওই সসটুকু ফেলে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই (অবশ্য তার সঙ্গে রুটির টুকরোগুলোও যে গেল সে বাবদে বিচক্ষণ উত্তরদাতা কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ রুটিটি পরের ভোজনেও কাজে লাগত, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলিয়ে দেওয়া যেত– এটো প্লেটের তলানি সস্ তো পরবর্তী ভোজনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যায় না, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলোনো যায় না– লেখক)। তার পর তিনি বলেছেন, কিন্তু আপনি যদি নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও যান তবে এই কার্পণ্যটি করবেন না। তার মানে আপনার বাড়ির বাইরের এটিকেট যেন বাড়ির ভিতরের চেয়ে ভালো হয়। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নমত ধরি। আমার মতে বাড়ির এটিকেট, আদব-কায়দা যেন বাইরের চাইতে ঢের ঢের ভালো হয়।
প্রশ্ন : কোহিনূর প্রস্তর কোন ভাষার শব্দ?
উত্তর : ফারসি।
(সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোহ্ = পাহাড়–ফারসিতে। যেমন কাবুলের উত্তর দিকে কোহিস্তান রয়েছে (আমার সখা আব্দুর রহমান ওই কোহিস্তানের লোক)। কিন্তু কোহ-ই-নূরের নূর শব্দটি ন সিকে আরবি। খাঁটি ফারসিতে যদি বলতেই হয় তবে নূর-এর বদলে রওশন বা রোশনি বািঙলায় রোশনাই) ব্যবহার করে বলতে হয় কোহ-ই-রওশ। শুদ্ধ আরবিতে বলতে হলে জবলুন (পাহাড়) নূর।… কিন্তু এ রকম বর্ণসঙ্কর সমাস সর্বত্রই হয়ে থাকে। দিল্লীশ্বর ইত্যাদি।)
প্রশ্ন : আমার বয়স বত্রিশ; আমি বিধবা। আমার ষোলো বছরের ছেলের একটি সতেরো বছরের ভেরি ডিয়ার ক্লাসফ্রেন্ড প্রায়ই আমাদের এখানে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা জমাবার চেষ্টা করছে। আমি করি কী?
উত্তর : আপনি ওকে সঙ্গোপনে নিয়ে গিয়ে বলুন, তুমি তোমার অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম কর। আমি তোমার মায়ের বয়সী। তোমার বয়সী মেয়ের তো কোনও অভাব নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, ছেলেটার বোধহয় মাদার কমপ্লে আছে– অতি অল্প বয়সেই তার মা গত হন। কাজেই সে একটি মায়ের সন্ধানে আছে। তার পর আরও নানা প্রকারের হাবিজাবি ছিল।
এ উত্তর যে কোনও গোগর্দভ দিতে পারত।
কিন্তু এই প্রশ্নোত্তরমালা নিতান্তই অবতরণিকা মাত্র।
কয়েক মাস পূর্বে–মনে হল– একটি প্রাচীনপন্থি মহিলা–প্রশ্ন শুধালেন : আজকালকার ছেলে-ছোকরারা এমনকি মেয়েরাও বড় বেশি মশলাদার খানা খাচ্ছে। আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি। সেদিন বাধ্য হয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। যদি জানতুম, শহরের মাই লর্ড রেস্তোরাঁওয়ালারা কী জঘন্য ঝাল, মাস্টার্ড (আমাদের কাসুন্দো– লেখক), আর মা মেরিই জানেন কী সব বিদকুটে বিকুটে বিজাতীয় মশলা দিয়ে যাবতীয় রান্না করেন, তবে কি আমি সে রেস্তোরাঁয় যেতুম। এক চামচ সুপ মুখে ঢালা মাত্রই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে লাগল। আমার কপালে, সেই শীতকালে, ঘাম জমতে লাগল। মনে হল, আমার জিভে যেন কেউ আগুন ঢেলে দিয়েছে। আমার চোখ থেকে যা জল বেরুতে আরম্ভ করল সেটা দেখে আমার কাছেরই একটি সহৃদয় প্রাইভিট শুধাল– মাদাম, আমি বহু দেশ-বিদেশ দেখেছি- যেখানে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হয়; কিন্তু আমাদের এই সুইটজারল্যান্ডে তো কখনও দেখিনি। শোকাতুরা হয়ে কান্না করলে রমণীর চোখে যে অশ্রুজল বেরোয় এটা তো তা নয়।
.
২০.
একদা সুইস কাগজে প্রশ্ন বেরুল : এই যে আমরা প্রতিদিন আমাদের রান্নাতে মশলার পর মশলা বাড়িয়েই চলেছি এটা কি আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো?
সেই সবজান্তা উত্তরিলা :
মাত্রা মেনে খেলে কোনও আপত্তি নেই, কোনও বস্তুরই বাড়াবাড়ি করতে নেই। (মরে যাই! এই ধরনের মহামূল্যবান উপদেশ পাড়ার পদি পিসি, স্কুলবয় সবাই দিতে পারে! লেখক) তার পর সবজান্তা বলছেন– ডাক্তারদেরও আধুনিক অভিমত, মেকদার-মাফিক মশলাদার খাদ্য ভোজনস্পৃহা আহার-রুচি বৃদ্ধি করে। তদুপরি আরেকটা গুরুত্বব্যঞ্জক তত্ত্ব আছে। আপনি যদি আপনার ভোজন ব্যাপারে সর্বক্ষণ এটা খাব না ওটা ছোঁব না এরকম পুতুপুতু করে আপনার ভোজনযন্ত্রটিকে নসিকে মোলায়েম করে তোলেন, (ইংরেজিতে একেই বলে মলিকড়ল করেন। তবে কী হবে? আপনি যতই চেষ্টা দিন না কেন, আপন বাড়িতে তৈরি মশলা বিবর্জিত রান্নামাত্রই খাব তথাপি ইহসংসারে বহুবিধ ফাড়া গর্দিশ আছে যার কারণে আপনাকে হয়তো কোনও রেস্তোরাঁতে একবেলা খেতে হল। কিংবা মনে করুন, আপনি নিমন্ত্রিত হলেন। শক্তসমত্ত জোয়ান আপনি। কী করে বলবেন আপনি ডায়েটে আছেন? ওদিকে রেস্তোরাঁ বলুন, ইয়ার-বখশির বাড়িই বলুন সর্বত্রই সর্বজন শনৈঃ শনৈঃ গরমমশলার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। পরের দিন আপনি কাত। অতএব–আমাদের সবজান্তা বলছেন, কিছু কিছু মশলা খেয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা করে ফেলাই ভালো।
কিন্তু মশলা পুরাণ এখানেই সমাপ্ত নয়। সেটা পরে হবে। ইতোমধ্যে আমি দুম করে প্রেমে পড়ে গেলুম।
কবিগুরু গেয়েছেন :
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তবু মনে রেখ।
কিন্তু এ আশা রাখেননি, সেই প্রথম প্রিয়াই পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসবে। আমার কপাল ভালো।
লাঞ্চ সেরে মৃদুমন্থনে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসেই দেখি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে যে মেয়েটি বসেছিল সে জ্বল জ্বল করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার দুশমনরা তো জানেনই, এস্তেক দোস্তরাও জানেন, আমি কন্দর্পকিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাইনি। তদুপরি বয়স যা হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে কাঠাকালি বিঘেকালি বিস্তর আঁক কষাকষি করতে হয়। সর্বশেষে সেটা ভগ্নাংশে না ত্রৈরাশিকে দিতে হবে তার জন্য প্লাশেত মারফত ঈশ্বর সুকুমার রায়কে নন্দনকানন থেকে এই যবনভূমিতে নামাতে হবে।
অবশ্য লক্ষ করেছিলুম, আমি ওর দিকে তাকালেই সে ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে নেয়।
রোমান্টিক হবার চেষ্টাতে বলেছিলুম, মেয়েটি। কিন্তু তার বয়স হবে নিদেন চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে! বিদগ্ধ পাঠকের অতি অবশ্যই স্মরণে আসবে, বৃদ্ধ চাটুয্যেমশাই যখন প্রেমের গল্প অবতারণা করতে যাচ্ছেন তখন এক চ্যাংড়া বক্রোক্তি করে বলেছিল চাটুয্যেমশাই প্রেমের কীই-বা জানেন। মুখে আর যে কটা দাঁত যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছে তাই নিয়ে প্রেম।
চাটুয্যে মশাই দারুণ চটিতং হয়ে যা বলেছিলেন তার মোদ্দা : ওরে মূৰ্থ, প্রেম কি চিবিয়ে খাবার বস্তু যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস!
প্রেম হয় হৃদয়ে।… একদম খাঁটি কথা। ভলতের, গ্যোটে, আনাতোল ফ্রাস, হাইনে আমৃত্যু বিস্তরে বিস্তর যারা ফট ফট করে নয়া নয়া হুরী পরীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন। এই সোনার বাঙলাতেও দু-একটি উত্তম দৃষ্টান্ত আছে। তা হলে আমিই-বা এমনকি ব্রহ্মহত্যা করেছি যে হুট করে প্রেমে পড়ব না।
বললে পেত্যয় যাবেন না, অকস্মাৎ একই মুহূর্তে একে অন্যকে চিনে গেলুম। যেন আকাশে বিদ্যুৎ বহ্নিপরিচয় গেল লেখি।
সে চেঁচাল হ্যার সায়েড!
একসঙ্গে আমি চেঁচালুম লটে।
তার পর চরম নির্লজ্জার মতো সেই প্রশস্ত দিবালোকে সর্বজন সমক্ষে আমাকে জাবড়ে ধরে দুই গালে ঝপাঝপ এক হর বা দুই টন চুমো খেল।
সুশীল পাঠক, সচ্চরিত্রা পাঠিকা, আমার দেশের মরালিটি-রক্ষিণী বিধবা পদিপিসি এতক্ষণে এক বাক্যে নিশ্চয়ই নাসিকা কুঞ্চিত করে ছ্যা ছ্যা বলতে আরম্ভ করেছেন। আমি দোষ দিচ্ছিনে। এস্থলে আম্বো তাই করতুম– যদি না নাটকের হেরোইন আমার প্রিয়া লটে (তোলা নাম সাল) হত। বাকিটা খুলে কই। ওর বয়স যখন নয়-দশ, আমার বয়স ছাব্বিশ, আমি বাস করতুম ছোট গোডেসবের্গ টাউনের উত্তরতম প্রান্তে লটেদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি। ওদের পাশে থাকত দুই বোন ঘেটে ক্যাটে। আরও গোটা পাঁচেক মেয়ে–তাদের বাড়ির পরে। কারওরই বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়।
লটে ছিল সবচেয়ে ছোট,
আমার জীবনের প্রথমা প্রিয়া।
আর সবকটা মেয়ে এ তথ্যটা জানত এবং হয়তো অতি সামান্য কিছুটা হিংসে-হিংসে ভাব পোষণ করত। ওদের আশ্চর্য বোধ হত, যে লটে তো ওদের তুলনায় এমন কিছু গুলে-বাকাওলি নয় যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে আমি এরই প্রেমে মজে যাব। এটা অবশ্য আমি বাড়িয়ে বলছি। প্রেমে মজার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স ছাব্বিশ ওর নয় কি দশ।
আসলে ব্যাপারটি কী জানেন? জর্মনদের ভিতর যে-চুল অতিশয় বিরল, লটের ছিল সেই চুল। দাঁড়কাকের মতো মিশমিশে কালো একমাথা চুল। ঠিক আমার মা-বোনদের চুলের মতো। ওর চুলের দিকে তাকালেই আমার মা-বোনদের কথা, দেশের কথা মনে পড়ত। আর লটে ছিল আমার বোনদের মতো সত্যই বড় লাজুক। সকলের সামনে নিজের থেকে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলত না।
আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একচিলতে গলি। সেখানে রোজ দুপুর একটা-দুটোয় আমরা ফুটবল খেলতুম। আমার বিশ্বাস তুমি পাঠক, আমাদের সে টিমের নাম জান না। আমিও অপরাধ নেব না। আমরা যে আইএফএ শিলডে লড়াই দেবার জন্য সে-আমলে ভারতবর্ষে আসিনি তার মাত্র দুটি কারণ ছিল। পয়লা : অতখানি জাহাজ ভাড়ার রেস্ত আমাদের ছিল না এবং দোসরা : আমাদের কাইজার টিমে পুরো এগারো জন মেম্বার ছিলেন না। আমরা ছিলুম মাত্র আষ্টো জন। তৃতীয়ত যেটা অবশ্য আমাদের ফেভারেই যায়, আমাদের ফুটবলটি ছিল অনেকটা বাতাবি নেবুর মতো। ওরকম ফুটবল দিয়ে কি সমদ, কি জুম্মা খান কখনও প্যাটার্ন-উইভিং ড্রিবলিং ডজিং, ডাকিঙের সুযোগ পাননি।
হায়, হায়। এ জীবনটা শুধু সুযোগের অবহেলা করে করেই কেটে যায়।
এসব আত্মচিন্তা যে তখন করেছিলুম তা নয়।
চল্লিশ বছর পর পুনরায়, এই প্রথম আমাদের পুনর্মিলন। লটে হঠাৎ শুধুলো, হার সায়েড! তুমি বিয়ে করেছ?
শুনেছি, ইহুদিরা নিতান্ত গঙ্গাযাত্রার জ্যান্ত মড়া না হলে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন শুধিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দেয়। আমি শুধলুম, তুই?
খল খল করে হেসে উঠল।
কেন? আমার আঙ্গুলে এনগেজমেন্ট রিং, বিয়ের আংটি দুটোই এখনও তোমার চোখে পড়েনি। আমি তো দিদিমা হয়ে গিয়েছি। চল আমাদের বাড়ি।
আমি সাক্ষাৎ যমদর্শনের ন্যায় ভীতচকিত সন্ত্রাসগত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, সে যদি আমায় ঠ্যাঙায়।
দুটি মিষ্টি মধুর ঠোঁটের উপর অতিশয় নির্মল মৃদু হাসি একে নিয়ে বললে, বটে! আমার জীবনের প্রথম প্রিয়কে সে প্যাদাবে! তা হলে সেই হালুঙ্কেটাকে আমি ডিভোর্স করব না।
তওবা, তওবা!
.
২১.
লটে ছেলেবেলায় কথা কইত কমই। এখন দেখি মুখে খই ফুটছে, তবে সেই বাল্য বয়সের শান্ত ভাবটি যায়নি। আমি বললুম, চল না কাফে স্নাইডারে। এক পট কফি আর আপফেল টার্ট (এপল টার্ট)- পঞ্চাশ বছরের কোনও মহিলা যদি বাসস্ট্যান্ডের পেভমেন্টে বসে হঠাৎ হাততালি দেয় তবে সবাই একটু বাঁকা নয়নে তাকায়। লটে বেপরোয়া। হাততালি দিয়ে উল্লাসভরে বললে, তুমি ডিয়ার, সেই প্রাচীন দিনের ডিয়ারই রয়ে গেছ। কাফে স্নাইডার অতি উস্কৃষ্ট আপফেল টার্ট বানাতো সে তোমার এখনও মনে আছে।
আমি বললুম, সোওয়াদটি এখনও জিতে লেগে আছে… অবশ্য তোমাকে যদি নিতান্তই ট্রাম ধরতে হয় তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মুফেনডর্ক
মুফ্রিকা বল। ওই অজ পাড়াগাটা এমনই প্রোহিস্টরিষ (প্রাগৈতিহাসিক) যে আমরা ওটাকে আফ্রিকার সঙ্গে এক কাতারে ফেলে মুফ্রিকা নাম দিয়েছিলুম ভুলে গেছ?
আমি তীব্র প্রতিবাদ করে বললুম, আমি এখনও লিজেন্সকে মুফ্রিকানরিন (মুফ্রিকাবাসিনী) ডাকি। সে আমায় ডাকে হালুঙ্কে (গুণ্ডা) তুমি যেরকম এইমাত্র ওই নামে তোমার বেটার-না-ওয়ার্স ৫০%-কে রেফার করলে। তুমিও আমার মতো অপরিবর্তনশীল।
লটে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললে, উপায় কী বল। এই ধর না, কাফে স্নাইডারের আপফেল টার্ট। ওটা কেন এত মধুর হত জানো। ওটা বানানো সম্পর্কে আমার এক মাসি। আর তোমার মনে আছে কি আমার ঠাকুদ্দার বাবা যখন একশো বছর বয়সে পা দিলেন তখন মা পরবের দিন আপফেল টার্ট বানিয়েছিল, মাসির চেয়েও ভালো। কার বুদ্ধিতে জান? থাক! আমি বড় লাজুক ছিলুম; তাই তোমাকে কিছু বলিনি। তুমি তো খাও চড়ুইপাখির হাফ রেশন। তাই তুমি যখন পুরো দু পিস খেলে তখন আমার ভারি আনন্দ হয়েছিল। ওমা! তার পর সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়ির লোক আমাকে যা খ্যাপাল। এস্তেক ঠাকুন্দার বাবা। ওঁর কথা তখন জড়িয়ে যেত। জন্মদিনের বিশেষ সিগারে দম দিয়ে তার খাস প্যারা ছেলেকে বয়স তখন তাঁর সত্তর– বললেন, আমাদের লটে বাঁচলে হয়। তবে হ্যাঁ, আমার ঠাকুমা লটের চেয়েও মর্ডান ছিলেন। ন বছর বয়সে প্রথম প্রেম করেন। সে হল গে ১৭৫০ কিংবা তারই কাছে-পিঠে। এবং জানো, সেই দজ্জাল হুঁড়ি আখেরে সেই ছোকরাকেই বিয়ে করে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, দ্যৎ! ন-দশ বছরে আবার প্রেম! তবে কি না, দেবতা শ্রীকৃষ্ণ নাকি ওই বয়সেই ভাব-ভালোবাসা করেছিলেন।
আখেরে ঠাকুরমার ঠাকুরমার মতো ওই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিলেন?
আমি বললুম, না। উনি বিবাহিত ছিলেন।
তার বয়স কত ছিল?
ঠিক বলতে পারব না। তবে বেশ কিছুটা সিনিয়র ছিলেন। আমাদের কাব্যে আছে :–
নিশাকাল, এ যে ভীরু, তুমি রাধে
লয়ে যাও ঘরে
হেন নন্দাদেশ পেয়ে চলে পথে
যমুনার কূলে
শ্রীরাধামাধব কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
রস কেলি করে।
অপিচ শ্রীরাধার নানা বর্ণনার মধ্যে একটি বর্ণনা আমার মনের গভীরে উজ্জ্বল হীরকের মতো চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে রেখেছে। আমাদের দেশের কাব্য নাট্যাদি আরম্ভ করার পূর্বে লেখক-নাট্যকার সরস্বতী বা ঈশ্বরের কোনও অবতারের বন্দনা তথা এবং পাঠক-দর্শক মণ্ডলীর মঙ্গল কামনা করেন। এখন হয়েছে কী, শ্রীকৃষ্ণ বাল্যে বড় দামাল ছেলে ছিলেন। প্রায়ই মায়ের তৈরি ননী–
সে আবার কী? আমার মস্তকে অনুপ্রেরণা এল। প্রিয়াকে প্রীত করার জন্য আমার মতো গণ্ডমূর্থের প্রতিও কন্দর্প সদয় হন। অবশ্য হৃদয়ে ওই অত্যাবশ্যকীয় প্রেমরসটি থাকা চাই-ই। তাই হাফিজ গেয়েছেন,
নেত্র নাই বাঞ্ছা হেরি বিধুর বদন
কর্ণ নাই চাই শুনি ভ্রমর গুঞ্জন ॥
প্রেম নাই প্রিয় লাভ আশা করি মনে।
হাফিজের মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে ॥
বললুম, এই যে তোকে কাফে মাইডারে নিয়ে যাবার জন্য এতক্ষণ ধরে ঝুলোঝুলি করছি, সেখানে আপফেল টার্টের উপর যে হুইপট ক্রিম বিছিয়ে দেয় অনেকটা সেই বস্তু।
সঙ্গে সঙ্গে লটে উঠে দাঁড়াল। চল।
আমি বললুম, তুমি না কোথায় যেন যাচ্ছিলে?
উত্তরে লটে যা বললে হিন্দিতে সেটা ভালো, মারো গোলি (গুলি)। গোল কর যাও। চুলোয় যাকগে বড্ড রূঢ়।
লটে বললে, রাধার বয়ঃসন্ধিক্ষণ না কী যেন বলছিলে?
আমার বাধো বাধো ঠেকছিল। যদিও তার বয়স এখন পঞ্চাশ তবু ক্ষণে ক্ষণে তার ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসি, কথা বলতে বলতে হঠাৎ মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকানো এসব যেন তাকে চল্লিশ বছরে উজিয়ে নিয়ে দশ বছরের ছোট্ট পরিবর্তিত মেয়েটিকে করে তুলছিল। তবু দুগগা বলে ঝুলে পড়লুম। বললুম, সেই শ্রীকৃষ্ণ পাঠক দর্শককে আশীর্বাদ করুন যিনি ছিলেন ননীচোরা। ধরা পড়ার পর নন্দপত্নী মাতা যশোদা যখন তাকে শুধালেন, তুমি কতখানি ননী চুরি করেছ? তখন তিনি শ্রীরাধার স্তনযুগল দেখিয়ে বললেন, ওই অতটুকু–সেই শ্রীকৃষ্ণ সর্বজনকে আশীর্বাদ করুন।
বলা শেষ হতে না হতেই কেমন যেন লজ্জা পেলুম। অবশ্য মোদ্দা কথাটি এই ওইটুকু আট বছরের বাচ্চা আর কতখানি ননী খেতে পারে। অর্থাৎ ব্রজসুন্দরীর তখন উঠতি বয়স মাত্র।
লটে আমার লজ্জারক্ত ভাব দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। বললে, হায়, হায়, হায়; হাস আমাদের হার ডক্টর। চল্লিশ বৎসর পূর্বে তুমি মেয়েছেলের মতো যেরকম লাজুক ছিলে এখনও তাই আছ। ইতোমধ্যে কত কী হয়ে গেল, মায় একটা বিশ্বযুদ্ধ। এখনও তোমার। চোখে পড়েনি, ছেলেমেয়ে পাশাপাশি ভিড়ে ভর্তি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একজন অন্যজনের কোমরে হাত দিয়ে মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে নাচের সময় আমরা যে পজিশন নিই– ঘাড় বাঁকিয়ে একে অন্যকে চুমো খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে ধীর পদে। তৎসত্ত্বেও মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। রাস্তার লোক নির্বিকার, পুলিশও তুরীয় ভাব অবলম্বন করেছে। আমার কুড়ি বছর বয়সে নির্জন বনের ভেতরও হেরমান যখন আমাকে আদর করত আমার আড়ষ্টতা তখনও কাটত না। রাস্তায় চলতে চলতে চুম্বন– এ টেকনিক আমি আর কখনওই রপ্ত করতে পারব না।… চল্লিশ বছর! কত পরিবর্তন হয়েছে– বাইরে ভিতরে এবং তোমার-আমার লিজেল আনার পক্ষে সে পরিবর্তন যে কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি সেটা বুঝতে তোমার বেশ কিছুদিন কেটে যাবে। তুমি কাফে স্নাইডার স্নাইডার করছিলে। আমি তোমাকে নিরাশ করতে চাইনি, ও কাফে কতকাল উঠে গিয়েছে। ওখানে এখন পঁচিশ গজি লম্বা একটা মার্কিন বার। বারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হলে ট্যাক্সি ভাড়া নেয় মার্কিনরা। সেই শান্ত সুন্দর বাড়িটি; ভিতরে বসে শোনা যেত মাসি যে ঘরে টার্ট বানাত সেখান থেকে আসছে আধমুঠো পরিমাণ ক্ষুদে ক্যানারিপাখির কাঁপা কাঁপা হুইসল, আর আসছে বেকিং-এর কেকের মৃদু গন্ধ, আরও সর্বোপরি, ভেসে আসে, মাসির রুমালের ল্যাভেন্ডার গন্ধ।
সেকথা থাক। অন্য একটা মধুর চিন্তা আমার মাথায় হৃদয়েও বলতে পার ভিনাস্ টিলার প্রজাপতির মতো– সর্বক্ষণ ঘুর ঘুর করছে যদিও আমি কথা বলছি, তোমার কথাও শুনছি। সেটা বলি; এতদিন ধরে যে সবাই আমাকে ক্ষেপাত যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানত, ছাব্বিশ বছরের ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট (জর্মনিতে যে যুগে স্টুডেন্টরা উচ্চ সম্মান পেত– ধরে নেওয়া হত এরা সব এরিস্টোক্রেট) দশ বছরের বাচ্চার প্রেমে পড়ে না। সে পীরিত করে মেয়ে-স্টুডেন্টদের সঙ্গে কিংবা বেকার কিন্তু ধনী ঝিয়ারীদের সঙ্গে। কিন্তু ওরা একটা কথা জানত না, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতুম যাকে জর্মন বলে লিবে ইংরেজিতে বোধহয় লাভ।
আমি তো অবাক। কিন্তু যেরকম গম্ভীর কণ্ঠে সিরিয়াসলি শব্দ কটি উচ্চারণ করল তাতে ওই নিয়ে পাগলামি করার মতো রুচি বা সাহস আমার ছিল না। সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বে আমার বয়স ছিল লটের আড়াই গুণ। এখন তো আর আড়াই গুণ নয়– তা হলে আমার বয়স হত ১২৫ বৎসর। আমাদের বয়স এখন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। ওর যদি আশি বৎসর হয় আর হবেই না কেন, ওর ঠাকুদ্দার বাপ তো একশো এক বছর অবধি বেঁচে ছিলেন তখন আমার ছিয়ানব্বই আর ওর আশিতে তো কোনও পার্থক্যই থাকবে না।
তুমি ভাবছ, দশ বছরের মেয়ে কি প্রেমে পড়তে পারে? পারে, পারে, পারে! অবশ্য সিচুয়েশনটা খুবই অসাধারণ হওয়া চাই।
আর তোমার যে পাকা একটি বান্ধবী ছিল– বন-এ তোমার সঙ্গে পড়ত, নাম আনামারি–
সর্বনাশ! নামটা পর্যন্ত জানত। এখনও স্মরণে রেখেছে।
.
২২.
গডেসবের্গের সবচেয়ে বড় রাস্তা দিয়ে চলেছি। এ রাস্তা দিয়ে যাবার সময় আগের প্রায় দোকানিকে চিনতুম বলে তারা রোদ পোওয়াবার তরে চৌকাঠে দাঁড়ালে শুট মর্গেন গুট টাখ কিংবা দিনের শেষে ক্লান্ত কণ্ঠে শুট অকেনট বলতুম। সুন্ধুমাত্র ফুলওলার দোকানটির কাছে আসামাত্র পা চালিয়ে দ্রুতবেগে ওটাকে পেরিয়ে যেতুম। কেন? শো-উইন্ডোর বিরাট কাঠের জানালা দিয়ে দেখা যেত কত না সুন্দর তাজা ফুল– এক্কেবারে সাক্ষাৎ শুলস্তান। অনেক কিশোর-কিশোরীই এই শো-উইন্ডোর সামনে ব্লদেভু করত। দ্বিতীয় পক্ষ সময়মতো না এলে প্রথম পক্ষ ফুল দেখতে দেখতে হেসে-খেলে দশ-বিশ মিনিট কাটিয়ে দিতে পারত। তবে কি আমি ফুল ভালোবাসিনে? খুবই ভালোবাসি। বিশেষ করে শীতকালে যখন সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ে যায়, গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত ঝরে গিয়ে উঁচু উঁচু শাখা ন্যাড়া সঙিনের মতে ভয় দেখায়। শুনেছি, তখন এ দোকানের বেবাক ফুল আসত দক্ষিণ ইতালি, মন্তে কার্লো, কোদাজুর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল চার্লস ল্যামের রুদ্র রসিকতা। এক শৌখিন ধনী ব্যক্তি তাঁকে শুধিয়েছিল, আপনার ঘরে ফুল নেই যে। আপনি কি ফুল ভালোবাসেন না? তিনি জানতেন যে ওই মব তার অর্থকতা বাবদে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েও এই বেতমিজ প্রশ্ন শুধিয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, স্যার! আমি ছোট্ট বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে তাদের মুণ্ডুগুলো কেটে নিয়ে ফুলদানিতে সাজাই না। আমি দাঁড়াতুম না অন্য কারণে। সেই প্রাচীন যুগে আমি এখানে আসার দু-তিন দিন পর যখন মুগ্ধ নয়নে ফুলগুলো দেখছি, এমন সময় দরজা খুলে দোকানি একগুচ্ছ ফুল হাতে দিয়ে মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললে, শুটন্ টাখ ঝুঙার হার (ইয়াং জেন্টলম্যান)! এই সামান্য কটি ফুল গ্রহণ করে আমাকে। আপ্যায়িত করবেন কি? আমার ভাইঝি লিসবেতের কাছে শুনলুম আপনি আমাদের এই ক্ষুদে গোডেসবের্গে ডেরা পেতেছেন। আমাদের এখানে যে কজন বিদেশি আছেন, তাঁদের সংখ্যা গোনবার জন্য হাতের একটা আঙুলই যথেষ্ট। কিন্তু জানেন, এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর পরিবেশে–সে শতাধিক বত্সরের কথা এখানে বাস করতেন রাজদরবারের এক সম্মানিত আমির*[* অধুনা বাঙলায় একাধিক লেখক একবচনে ওমরাহ লিখে থাকেন। বস্তুত ওমরাহ শব্দটি বহুবচন। একবচন আমির শব্দের বহুবচন ওমরাহ। এবং আমির-ওমরাহ সমাস কলেক্টিভ নাউন রূপে ফারসি, উর্দু, বাঙলাতে ব্যবহার হয়।]তারাই জলসাঘরে বন শহরের বেটোফেন তখনকার দিনের গ্রামেত্র (গ্রান্ড মাস্টার) ওস্তাদস্য ওস্তাদ হ্যান্ডেলকে বাজনা বাজিয়ে শোনান–
বলা বাহুল্য আমি দাম দেবার চেষ্টা করে নাস্তানাবুদ হয়েছিলুম।
ফুস করে একটি ক্ষুদ্রতম দীর্ঘশ্বাস বেরুল কিন্তু লটের কান যেন বন্দুক। শুধাল, কী হল? এরই মধ্যে আমার সঙ্গসুখ তোমার কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠল? আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললুম, না, না, না। তার পর ওমর খৈয়াম থেকে আবৃত্তি করলুম–
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি,
তোমাদের ছাড়িয়া মসজিদে গিয়ে
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
তার পর সেই ফুলওলার কাহিনী বয়ান করে বললুম, ডার্লিং লটে! আমি এসব দোকানপাট তো বিলকুল চিনতে পারছিনে। কিন্তু সেই ফুলের দোকান নিশ্চয়ই সামনে এবং নিশ্চয়ই ফের চেষ্টা দেবে আমাকে মুফতে ফুল দেবার। চল অন্য পেভমেন্টে।
লটে পুনরায় ডুকরে কেঁদে বললে, হায়, হায়, হায়! কোন ভবে আছ তুমি! সে দোকান আর নেই। তার মালিক ওটাকে বেচে দিয়ে মাইল সাতেক দূরে আলু–আলু গো, আলু ফলাচ্ছেন। প্রাচীন দিনের আর কজন দোকানি আপন আপন দোকান বাঁচাতে পেরেছে। এই ছোট্ট জায়গাটিতে যারা বংশপরম্পরায় বাস করেছে তারা হয় পালিয়েছে, নয় আপন আপন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। রাস্তায় পর্যন্ত বেরুতে চায় না। এই তোমার লিজেল– অন্তত চার মাইল না হাঁটলে অর্থাৎ মুফেনডর্ফ-গোডেসবের্গ দুবার না চষলে যার পেটের চকলেট হজম হত না (মনে পড়ল অত্যুকৃষ্ট ব্রান্ডি ভর্তি মোটা মোটা লাল আঙুরের চকলেট খেত লিজেল) সে তো এখন আর একদম বাড়ি থেকে বেরোয় না। তোমার ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা বেরোয় না, আমাদের যে একটি ক্ষুদ্র বিউটি সেলুন ছিল তার মালিক কাটেরিনা সৌন্দর্য আর যৌবন বাঁচিয়ে রাখবার জন্য বিস্তর সন্ধিসুড়ক জানত বলে এবং বাঁচিয়ে রেখেছেও এখনও তাকে দেখলে মার্কিন চ্যাংড়াদের মুণ্ডগুলো বাই বাই করে ঘুরতে থাকে, সে পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরোয় না।
তাই তো তোমাকে পেয়ে আমার এত আনন্দ। তোমার আজকের দিনের চেহারাতে আর সেদিনকার চেহারাতে আর কতখানি মিল? বার বার মনে হয়, যেন তোমাকে ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখছি। কী রকম জানো? তুমি যে বাড়িতে থাকতে সেটা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। সে-যুগে আস্তানার ভালো ব্যবস্থা ছিল না বলে আমার বাপ-মার বেডরুম সবকটা ঘর ছিল খুদে খুদে যেন বেদেদের কারাভানের গাড়িতে ক্ষুদে ক্ষুদে বেড-রুম, ডাইনিংরুম, কিংবা হা হা, মনে পড়েছে, ওয়ালট ডিজনির ম্যাজিকল্যান্ডের রাজকন্যা বনের ভিতর কাঠুরের অতি ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিয়ে জানালার পাশে বসে আপন মায়ের কথা ভাবছে।
হুবহু ঠিক ওই রকম একটি ছোট্ট জানালা ছিল তোমার ঘরে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একহাত হয় কি না হয়। তুমি আসবার আগে ওটাতে একটা সাদা মোটা পর্দা ঝুলত। কিন্তু তোমার এখানে আসা স্থির হয়ে যাওয়ার পরই আনার মা আপন হাতে ক্রুশের কাঁটা দিয়ে একটুকরো নেট বুনল। তার যা বাহার। আর তার মিহিন কাজ ডাচ লেসকেও টিঙ দেয়। আমি যখন মাখম কিনতে গেলুম আনাদের দোকানে তখন আনাকে শুধালুম, অতিথি আসছে নাকি? উত্তর শুনে আমি ভয়ে ভিরমি যাই আর কি! আমাকে একদিন ভয় দেখাবার জন্য বাবা বলছিল, তবে ডাকি একটা ইন্ডারকে! তার মাথায় পাগড়ি, ইয়াব্বড়া দাড়ি আর হাতে বাঁকা ছোরা। (আমি বুঝলুম শিখ আর গুখাতে লটের বাবা ককটেল বানিয়ে ফেলেছিল– লেখক) নাভিকুণ্ডলীর উপর সেঁধিয়ে দিয়ে এক হ্যাঁচকায় পাঁজর অবধি ফাঁসিয়ে দেয়। ওমা! তার পর কোথায় কী? সেই রাত্রে তোমার ছোট্ট জানালার বাহারে লেসের পর্দার ভিতর দিয়ে দেখি, ঠিক তাই, তোমাকে এইমাত্র যা বললুম, তোমাকে যেন তখন ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখছি, তুমি টেল ল্যাম্পের সামনে বসে কিছু একটা লিখছিলে।
আমি বললুম, কত যুগের কথা! কিন্তু জাস্ট বাই চান্স্ তোমার মনে আছে কি, সেটা কী বার ছিল?
দিব্য মনে আছে। শুক্রবার সন্ধ্যাবেলা।
অ। তাই বল। শুক্রবার রাতদুপুরে ইন্ডিয়ার জন্য লাস্ট মেল ছাড়ে। প্রতি মাসে চিঠি না। পেলে সব বড্ড চিন্তিত হয়। তোমার রাজকন্যা যেরকম বনের ভিতর কাঠুরের কুটিরে ছোট্ট জানালার পাশে বসে তার মায়ের কথা ভাবত, আমার মায়ের মনও তেমনি আমার দিকে উধাও হয়ে চলে আসে।
লটে বললে, আহা! সেই অল্প বয়সে লটে লাজুক ছিল বটে কিন্তু তার দরদি হিয়াটি সে কখনও লুকিয়ে রাখতে পারত না। বললে, একদা যেখানে কাফে স্নাইডার ছিল সেখানে পৌঁছে গিয়েছি।
আমি বললুম, না। টাকার জোরে মার্কিনরা যে প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ করেছে সে পাপালয় তো ব্রথেল। আমি ওখানে যাব না।
লটে যেন খুশি হল। বললে, ওই যে ব্রথেল বললে, সেটা একদম খাঁটি কথা। হয়তো না ভেবে বলেছ, কিন্তু পেরেকের ঠিক মাঝখানে মোক্ষম ঘা-টি মেরেছ। সেদিন একটা বইয়ে পড়ছিলুম, ইহুদিরা ঠিক এমনি ধারা কড়া কড়া টাকা নিয়ে প্যালেস্টাইন গিয়ে সেখানকার গরিব আরব দোকানদারদের দোকানপাট কিনে তো নিলই তার পর কিনল ওদের জমিজমা। আরবরা এখন নাকি ভিটেছাড়া হয়ে সর্বত্র ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেকটা বইয়ে পড়ছিলুম, কোনও জায়গায় যদি একটা নতুন বন্দর তৈরি করা হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এন্তের বার আর বিস্তর ব্রথেল হুশ হুশ করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাতে থাকে।
আমি চিরকালই অ্যাডেনাওয়ারকে ভক্তি করেছি। তারই কল্যাণে যুদ্ধে-বন্দি বিস্তর জর্মন মুক্তি পায় রুশ কারাগার থেকে, সাইবেরিয়া থেকে। ওদের মধ্যে ছিল আমার এক মাসতুতো ভাই আমার মা তাকে ভালোবাসত আপন ছেলের মতো। তা হলেই বুঝতে পারছ, আডেনাওয়ারের প্রতি আমাদের কতখানি শ্রদ্ধা। এবং সকলেই জানে এই বন্দিদের মুক্ত করার জন্য তাঁকে তাঁর মাথা অনেকখানি নিচু করত