- বইয়ের নামঃ রচনাবলি ৯ (নবম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
বিবিধ – ৯
০১.
যারা ভালো করে পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন তারা খাঁটি খবর দিতে পারবেন; আমি সামান্য যেটুকু পড়েছি তার থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে মহাত্মাজির মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি।
বুদ্ধদেবকে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়নি; খ্রিস্টের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যা এসে পড়েছিল (ইহুদিদের পরাধীনতা) তিনি তার সম্পূর্ণ সমাধান করেননি; শ্রীকৃষ্ণ এবং মুহম্মদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই চার মহাপুরুষকেই কোটি কোটি লোক শত শত বছর ধরে স্বীকার করে নিয়ে জীবনযাত্রার পথ খুঁজে পেয়েছে; কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মহাত্মাজি যে বুদ্ধ এবং খ্রিস্টের অহিংস পন্থা নিয়ে কৃষ্ণ এবং মুহম্মদের মতো রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেছিলেন এ জিনিস পৃথিবীতে পূর্বে কখনও হয়নি। প্রেম দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হিংসার ওপর জয়ী হওয়া যায় এ কথা পৃথিবী বহু পূর্বেই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু অস্ত্রধারণ না করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে জয়ী হওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য প্রমাণ করে গিয়েছেন মহাত্মাজি। আমার ভয় হয়, একদিন হয়তো পৃথিবী বিশ্বাস করতেই রাজি হবে না যে, মহাত্মাজির প্রেম ইংরেজের বর্বর সৈন্যবলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। অবিশ্বাসী মানুষ আজ স্বীকার করে না যিশু মৃতকে প্রাণ দিয়েছিলেন; পাঁচশো বছর পরের অবিশ্বাসী দুটোকেই হয়তো এক পর্যায়ে ফেলবে।
***
পাঠক হয়তো জিগ্যেস করবেন, মহাত্মাজি রাজনৈতিক ছিলেন; তিনি কোনও নবীন ধর্ম প্রচার করে যাননি, তবে কেন তাঁকে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তুলনা করি।
নবীন ধর্ম কেন সৃষ্ট হয় তার সব কটা কারণ বের করা শক্ত কিন্তু একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি। কি বুদ্ধ কি খ্রিস্ট সকলকেই তাদের আপন আপন যুগের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করে নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে পিথৌরার চর্চা বড়ই অগভীর– সে কথা পাঠককে আবার জানিয়ে রাখছি।
বুদ্ধদেবের সময় উত্তর ভারতবর্ষের বনবাদাড় প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছে এবং ফলে আশ্রমবাসীগণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিলেন। সংঘ নির্মাণ করে তাদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা বুদ্ধদেবকে করে নিতে হয়েছিল। আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে— অর্থাৎ যৌথ পদ্ধতিতে বিরাট প্রতিষ্ঠান (সংঘ) নির্মাণ ভারতে এই প্রথম। দ্বিতীয়ত, তখন প্রদেশে প্রদেশে এত মারামারি হানাহানি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করে প্রসার পাচ্ছিল না। শ্ৰমণগণ এসব উপেক্ষা করে শান্তির বাণী নিয়ে সর্বত্র গমনাগমন করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অন্তরায় দূর হয়। তাই শ্ৰেষ্ঠীরা সবসময়ই সংঘের সাহায্যের জন্য অকাতরে অর্থ দিয়েছেন।
খ্রিস্ট ইহুদিদের স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে তার পন্থা ছিল ইহুদিদের নৈতিক বলে এতখানি বলীয়ান করে দেওয়া যাতে করে পরাধীনতার নাগপাশ নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। অরবিন্দ ঘোষও পণ্ডিচেরিতে এই মার্গেরই অনুসন্ধান করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু কুরু-পাণ্ডবের যোগসূত্র স্থাপনা করার জন্য কূটনৈতিক দূত তাই নন, শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডববাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদও গ্রহণ করেছিলেন।
মুহম্মদের প্রধান কর্ম ছিল আরবের যুযুধান, ছিন্নবিচ্ছিন্ন বেদুইন উপজাতিগুলোকে এক করে শক্তিশালী জাতি গঠন করা।
মহাত্মাজিকে সবাই রাজনৈতিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু পৃথিবীর মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করে নিলেই ঠিক হবে।
***
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাই যদি হয়, তবে মহাত্মাজি কোনও নবীন ধর্ম প্রবর্তন করে গেলেন না কেন?
সে তো খ্রিস্টও করে যাননি। খ্রিস্ট-তিরোধানের বহু বছর পর পর্যন্তও তাঁর অনুচরগণ বুঝতে পারেননি যে তারা এক নবীন ধর্মের প্রদীপ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রামমোহন, নানকও দেখা দিয়েছিলেন ধর্ম-সংস্কারকরূপে, তাঁরা বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন– শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হল নবীন ধর্ম পরবর্তী যুগে।
মহাত্মাজির নবীন– অথচ সনাতন ধর্ম প্রবর্তিত হতে সময় লাগবে।
সেই ধর্মং শরণং গচ্ছামি!
***
গল্প শুনেছি এক গুরু যখন বুঝতে পারলেন তার এক নতুন শিষ্য একদম গবেট, তখন তাকে উপদেশ দিলেন বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করতে। শিষ্য প্রণাম করে বিদায় নিল।
বহু বছর পরে গুরু যাচ্ছিলেন ভিন গাঁয়ের ভিতর। একটি আধাচেনা লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে গুরুকে আপন বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই গবেট শিষ্য। গুরু তার যত্ন-পরিচর্যায় খুশি হয়ে শুধালেন, তা বাবাজি আজকাল কী করো?
শিষ্য সবিনয়ে বলল, টোল খুলেছি।
গুরুর মস্তকে এটম বোমাঘাত। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে শুধালেন, তা কী পড়াও?
শিষ্য বলল, আজ্ঞে সব কিছুই; তবে ব্যাকরণটা পড়াইনে।
গুরু আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী কথা? আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি তো ব্যাকরণটাই একটুখানি বুঝতে।
শিষ্য বললে, আজ্ঞে, তাই ওটা পড়াতে একটুখানি বাধো-বাধো ঠেকে।
***
রায় পির্থেীরা যে সর্ববাবদে এই শিষ্যটির মতো, সে কথা আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী? এই দেখুন না, দিনের পর দিন সে সম্ভব-অসম্ভব কত বিষয়ে কত তত্ত্ব কথাই না বেহায়া বেশরমের মতো লিখে যাচ্ছে। কারণ? কারণ আর কী? সর্ববিষয়ে যার চৌকশ অজ্ঞতা তার আর ভাবনা কি?