দাউদ পাকিস্তানকে আক্রমণ করবেন সঠিক কোথায়? বেলুচিস্তানের চমন অঞ্চলে না খাইবারপাস অঞ্চলে–না উভয়ত? হিটলারের পয়লা নম্বরি ট্যাঙ্ক সঁজোয়া গাড়ি পর্যন্ত রাশার দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে করতেই ঘায়েল হয়ে যেত। হ্যাঁ, এখানে অত দূরের পাল্লা নয়। কিন্তু ট্যাঙ্কগুলোও তেমন সরেস নয়। আর রাস্তার চওড়াই? না ওসব কোনও কাজের কথা নয়। বোমারু প্লেন? হঃ! ইয়েহিয়া পূর্ব পাক হারাল, তবু জাবড়ে ধরে রইল তার প্লেনগুলো।
ফ্রন্টিয়ার নো-মেনস-ল্যান্ডের পাঠানদের লেলিয়ে দেওয়া যায় না?
লুটতরাজ কোন অবস্থায়, কাকে করা যায়, কাকে করা যায় না, সেটা পুরুষানুক্রমে করে করে পাঠান এ বিষয়ে পৃথিবীর সেরা স্পেশালিস্ট। টিক্কা খান কীভাবে নিরীহ, নিতান্ত নিরস্ত্র বেলুচের ওপর বেদরদ বে-এক্তিয়ার কায়দায় বোমা ঝরাতে পারেন সে তো তারা বেলুচিস্তানে পাহারা দেবার সময় স্বচক্ষে দেখেছে, এবং এই বাংলাদেশেও তারই মদতে তারা লুট করার সময় পাঞ্জাবিদের খুব-একটা পিছনে ছিল না। তার আখেরি নতিজা কী হয়েছে, সেটা ফ্রন্টিয়ারের পাঠানরা অবগত হয়েছে।
হিটলার বার বার তাঁর জেনারেলদের বলতেন, অত সতর্ক হয়ে পা টিপে টিপে রুশ দেশে অভিযান চালাবার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই রুশ দেশটা হুবহু একটা ঝুরঝুরে কুঁড়েঘরের মতো, দরজাটার কাঠও পচাহাজা। মারো জোরসে বুট দিয়ে গোটা দুই লাথি। হুড়মুড়িয়ে বেবাক ঘর ধুলায় ধূলিসাৎ।
রাশার বেলা রোগ নির্ণয়ে হিটলার গোভলেট করেছিলেন।
ব্যারিস্টার ভুট্টোর পশ্চিম-পাক বাড়িটা দেখে সক্কলের মনে কিন্তু, কিন্তু কিন্তু না-ও হতে পারে।
.
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়– টীকা
জন্মের দিনই মানুষের নামকরণ হয় না, কিন্তু প্রবন্ধ লেখার প্রারম্ভেই শিরোনামা একটা না দিয়ে উপায় নেই। এ সুবাদে কবিগুরুর একাধিকবার বলা বিশেষ একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ল। তদুপরি বাইশে শ্রাবণ আসন্ন। প্রাচীন দিনের কথা। ১৯২১ সাল। রবীন্দ্রনাথ তখন ষাট বছরের যুবক। পূর্ণোদ্যমে বিশ্বভারতীয় সদ্যোজাত কলেজ বিভাগে ক্লাস নিতেন। নিজের কবিতা উপন্যাস এবং তাঁর প্রিয় ইংরেজ কবি শেলি কিটসের লিরিক। পাঠক হয়তো লক্ষ করেছেন, বলাকা কাব্যগ্রন্থে কবিতাগুলোর কোনও শিরোনামা নেই। তিনি নিজের থেকেই বললেন, কবিতায় শিরোনামা পড়ে পাঠক ধরে নেয়, গোটা কবিতাটা বুঝি ওই নামটা সার্থক করার জন্যই লেখা হয়েছে। তা তো নয়। কবিতা যখন উৎস থেকে বেরিয়ে যাত্রাপথে নামে তখন আপন গতিবেগে চলার সময় শিরোনামার প্রতি দৃষ্টি রেখে সোজা পথে এগিয়ে যায় না। সে ডাইনে-বাঁয়ে বাঁক নিয়ে নিয়ে তার নতুন নতুন রূপ দেখায়। (এই ভাবাংশটুকু কবি গানে বলেছেন, নতুন নতুন বাকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে/পাতার ভেলা ভাসাই নীরে)। মিশরির সুতোটা থাকে চিনির টুকরোর ঠিক মাঝখানে। তাই বলে সুতোটাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য তো ধরেই না, ওই সুতোটার অস্তিত্ব সার্থক করার জন্য মিশরি আপন সত্তারও বিকাশ করে না। কবিতার বেলা তারও বেশি। কবিতা তার শিরোনামার চতুর্দিকে ঘোরপাকও খায় না।
বলা বাহুল্য, আমি জরাজীর্ণ ছলনাময়ী স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই কবির বক্তব্যের নির্যাস নিবেদন করলুম। খোঁজা সম্প্রদায়ের লোক জামা-খানায় তাদের নামাজ শেষ করার পর যে রকম বলেন, ভুলচুক, মৌলা, বখশো আমিও উন্নাসিক পাঠকের কাছে নিবেদন জানাই, ভুলচুক যা হয়েছে বখশিশরূপে মাফ করে দিয়ে।
কিন্তু বলাকার পরের কাব্যগ্রন্থ পলাতকায় কবি পুনরায় শিরোনামা দেবার প্রথায় ফিরে গেলেন। বোধহয়, নামের পরিবর্তে কবিতাতে অঙ্ক-শাস্ত্র-সুলভ নম্বর লাগালে সেটা অপ্রিয় দর্শন তো হয়ই, তদুপরি এ সত্যও অস্বীকার করা যায় না যে, কোনও কোনও কবিতার শিরোনামা আমার মতো কবিতৃরসবঞ্চিত পাঠককে মূল বক্তব্য বুঝে নিতে সাহায্য করে–অবশ্য তাবৎ কবিতাতেই যে মিশরির সুতোর মতো মূল সূত্র থাকবে এহেন ফতওয়া কোনও আলঙ্কারিকই এ তাবৎ কবিকুলের স্কন্ধে চাপাননি।
বক্ষ্যমাণ ধারাবাহিকের জন্মদিনেই একটা নাম, নিতান্তই দিতে হয় বলে প্রথম লেখার কপালে সেঁটে দিয়েছিলুম। আজ তার ষষ্ঠী যাকে আমার দেশে ছুটি, উত্তরবঙ্গে বোধহয় ষাইটলা না কী যেন বলে। এদিনে অন্তত নামটা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলতে হয়।
আসলে পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় বাক্যটি একটি ফরাসি প্রবাদবাক্যের আবছায়া অনুবাদ। প্ল্যু সা শাঁজ, প্ল্যু সে লা ম্যাম শোজ- যতই সে নিজেকে বদলায়, ততই তার মূলরূপ একই থাকে- যতই তার পরিবর্তন হয় না কেন, ততই ধরা পড়ে, সে অপরিবর্তনীয়। এটাকেই অন্যভাবে বলা হয়, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে। তার অর্থ যতই ভিন্ন দেশে ভিন্ন বেশে কোনও একটা ঘটনা ঘটুক না কেন, আখেরে ধরা পড়ে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ ঘটনাটা এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া নতুন নয়। তাই এক শ্রেণির ঐতিহাসিক দাদা আদমের আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই বিরাট বসুন্ধরা খুঁজে বেড়ান প্যাটার্নের সন্ধানে। যেমন কাশ্মিরী শালে আমের প্যাটার্ন পশমের উপর সোনার জরি দিয়ে করা, বানারসি কিংখাপে সেই প্যাটার্নই রেশমের উপর রুপোর জরি দিয়ে করা, রাজশাহীর আম-সন্দেশে সেই প্যাটার্নই স্রেফ ছানা-চিনি দিয়ে গড়া। মালমশলা যাই হোক, নির্মিত ও-বস্তুটির চেহারাটি একই। খোলনলচে যতই পালটান– যেই হুঁকো সেই হুঁকো। কিংবা বলতে পারেন, একটা পশম আরেকটা রেশম হরেদরে হাঁটুজল। কিংবা বলতে পারেন, পাড়ার মেধো ওপাড়ার মধুসূদন। কিংবা– না থাক!