বাঙালি-হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা লিখিত পুস্তক যে পড়েন না বা কম পড়েন, তাহার জন্য তাঁহাদের সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ মুসলমানদের ভিতর শক্তিমান লেখক বড় কম। একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, আজ যদি কোনও মুসলমান শরাবুর মতো সরল ভাষার মুসলমান চাষি ও মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকেন, তবে কোন হিন্দু না পড়িয়া থাকিতে পারিবেন। আরব্যোপন্যাসের বাংলা তর্জমা এখন হাজার হাজার বিক্রয় হয়– যদিও তর্জমাগুলি অতি জঘন্য ও মূল আরবি হইতে একখানাও এযাবৎ হয় নাই, আর সয়ীদ আইয়ুবের লেখা কোন বিদগ্ধ বাঙালি অবহেলা করেন? কিন্তু তিনি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন; মুসলমান জীবন অঙ্কিত করা বা মুসলমানি কৃষ্টি বা সভ্যতার আলোচনা তিনি করেন না। বাঙালি কবীরকে কে না চিনে?
মুসলমানদের উচিত কোরান, হদিস, ফিকাহ, মহাপুরুষ মুহম্মদের জীবনী (ইবনে হিসামের উপর প্রতিষ্ঠিত) মুসলিম স্থাপত্য শিল্পকলা ইতিহাস (বিশেষ করিয়া ইবনে খলদুন), দর্শন, কালাম ইত্যাদি ইত্যাদি–কত বলিব সম্বন্ধে প্রামাণিক, উকৃষ্ট সরল সস্তা কেতাব লেখা। লজ্জার বিষয় যে, ফারসিতে লেখা বাঙলার ভূগোল-ইতিহাস বাহার-ই-স্তানে গাইবির বাঙলা তর্জমা এখনও কেহ করেন নাই।
শুনিতে পাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামিক কালচার বিভাগ আছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু অধ্যাপকেরা নানারকম পুস্তক প্রবন্ধ বাঙলায় লিখিয়া বিশ্ব বিদ্যালয় নাম সার্থক করেন। মুসলমান অধ্যাপকেরা কি লেখেন? লিখিলে কি উজবেকিস্থানের ভাষায় লেখেন?
মুসলমানদের গাফিলি ও হিন্দুদের উপেক্ষা আমাদের সম্মিলিত সাহিত্য-সৃষ্টির অন্তরায় হইয়াছে। দুইজন একই ভাষা বলেন; কিন্তু একই বই পড়েন না? কিমাশ্চর্যমতঃপর!
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫.৮.১৯৪৫]
.
০২.
এক ইন্দো-আমেরিকান আড্ডায় ছিটকাইয়া গিয়া পড়িয়াছিলাম। আড্ডাধারীরা এ-কোণে ও-কোণে তিন-চার জনায় মিলিয়া ঘোট ঘোট দয়ের সৃষ্টি করিয়া হরেকরকম বিষয়ে আলাপচারী করিতেছিলেন। আর যে কোণে গিয়া পড়িয়াছিলাম সেখানে একজন মার্কিন দুঃখ করিয়া সেই সনাতন কাহিনী বলিতেছিলেন, গাড়িওয়ালারা বিদেশিদের কীরকম ধাপ্পা দেয়, দোকানিরা কীরকম পয়সা মারে, টিকিট কাটিতে হইলে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষটায় বলিলেন, অদ্ভুত দেশ, ফার্স্ট ক্লাস গাড়িতে পর্যন্ত মুখ ধুইবার জন্য সাবান-ভোয়ালে থাকে না; জিজ্ঞাসা করিলে রেল কর্মচারী বলে, যদি রাখা হয় আধঘণ্টার ভিতর সাবান-তোয়ালে কর্পূর হইয়া যাইবে। আমি উষ্মর সহিত একটা ঝাঁজালো উত্তর দিব দিব করিতেছি এমন সময় একটি জর্মন মহিলা বলিলেন, জর্মনিতে থার্ড ক্লাসেও সাবান-তোয়ালে থাকে ও সেগুলি চুরি যায় না। কিন্তু দুরবস্থার সময় এই নিয়ম খাটে না। ১৯১৮ সনে জর্মনির দৈন্য এমন চরমে পৌঁছিয়াছিল যে, সাবান-তোয়ালে মাথায় থাকুক গাড়ির সর্বপ্রকার ধাতুর তৈয়ারি রড, হ্যান্ডল, হক, কব্জা পর্যন্ত উপিয়া গিয়াছিল। জর্মনি হুনরি-কারিগরদের সকলেই ড্রাইভার-স্প্যানার চালাইতে ওস্তাদ। শেষ পর্যন্ত কার অভাবে গাড়িগুলির দরজা পর্যন্ত ছিল না। অথচ সেই জর্মনিতেই ১৯২৯ সালে কেউ যদি ভুলে বাথরুমে হাতঘড়ি ফেলিয়া আসিত তবে নির্ঘাৎ ফেরত পাইত। উত্তর শুনিয়া মার্কিনের চোখের উলটা দিক বাহির হইয়া আসিল। বলিলেন, কই, আমাদের দেশে তো এমনটা এখনও হয় নাই। আমি বলিলাম ব্রাদার, তোমরা আর দৈন্য দেখিলে কোথায়? মনে পড়িল হেম বাড়য্যের শেক্সপিয়ারের তর্জমা,
অঙ্গে যার অস্ত্রাঘাত হয়নি কখন,
হাসে সেই ক্ষতচিহ্ন করি দরশন।
***
বাড়ি ফিরবার সময় ওই খেই ধরিয়া অনেক কিছু ভাবিলাম। যান্ত্রিক সভ্যতা তো আমাদের হয় নাই। আমাদের যা কিছু বৈদগ্ধ্য-ঐতিহ্য-সভ্যতা এককালে ছিল তাহা বিরাজ করিত গ্রামের সরল অনাড়ম্বর জীবনকে জড়াইয়া। কৃষ্টির দিক দিয়া গ্রামগুলি তো উজাড় হইয়াছে কারণ গ্রামের কোনও মেধাবী ছেলে যদি কোনও গতিকে বিএ পাস করিতে পারে, তবে সে তো আর গ্রামে ফিরিয়া যায় না। গ্রাম তাহাকে কী চাকরি দিবে? ১২ টাকার স্কুলমাস্টারি, না ১৫ টাকার পোস্টমাস্টারি? এত কাঠখড় পোড়াইয়া, বুকের রক্ত জল করিয়া, স্বাস্থ্য বরবাদ করিয়া বিএ পাস করিল কি কুল্লে ১৫ টাকার জন্য? সে আর গ্রামে ফিরে না। সার শহরে চলিয়া যায়, তুষ ধামে পড়িয়া থাকে। অথচ একশত বৎসর পূর্বেও গ্রামের হিন্দু ছেলে নবদ্বীপ ভট্টপল্লি, কাশীতে অধ্যয়ন করিয়া দিগগজ পণ্ডিত হইয়া গ্রামেই ফিরিত; সেইখানেই বাস করিত। মুসলমান ছেলে দেওবন্দ, রামপুর পাস করিয়া ওস্তাদ-দত্ত মস্ত পাগড়ি পরিয়া সেই গ্রামেই ফিরিয়া আসিত, সেই গ্রামেই বাস করিত। তাঁহারাই গ্রামের চাষি-মজুরকে ধর্মপথে চলিবার অনুপ্রেরণা দিতেন।
গ্রামে শিক্ষাদীক্ষা আজ নাই, তবু তো চাষা-মজুর পশু হইয়া যায় নাই। আমি বহু কর্মীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু কেহই একথা বলেন নাই যে, দুর্ভিক্ষের সময় আমাদের চাষারা কুকুর-বিড়াল খাইয়াছে। কুকুরের সঙ্গে খাদ্য লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছে কিন্তু এ সমাধান তাহার মাথায় আসে নাই যে, কুকুরটাকে মারিয়া তো জঠরানল নিবানো যায়! আরও শুনিয়াছি যে, গোরা সিপাহি টিনের খাদ্য ছুড়িয়া দিলে হিন্দু-মুসলমান স্পর্শ করে নাই; পাছে গরু বা শুয়োর খাইতে হয়।