- বইয়ের নামঃ রচনাবলি ১০ (দশম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে শেষপর্যন্ত বাংলা ভাষাই হবে সে সম্বন্ধে আমাদের মনে কখনও কোনও সন্দেহ ছিল না এবং একথাও নিঃসন্দেহে জানি যে যদিও এখনকার মতো বাংলার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে তবু উর্দুওয়ালারা আবার সুযোগ পেলেই মাথা খাড়া করে উঠতে পারেন। আমরা যে এতদিন এ-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিনি তার প্রধান কারণ বাংলা-উর্দু-দ্বন্দু রাজনৈতিক রঙ ধরে নিয়ে দলাদলির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল; সে অবস্থায় সুস্থ মনে, শান্ত চিত্তে বিচার করার প্রবৃত্তি কোনও পক্ষেরই ছিল না। আবহাওয়া এখন ফের অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে; এইবেলা উভয়পক্ষের যুক্তিগুলো ভালো করে তলিয়ে দেখে নিলে ভবিষ্যতের অনেক তিক্ততা এবং অর্থহীন দ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।
উর্দুওয়ালাদের প্রথম ও প্রধান যুক্তি এই : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান অভিন্ন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের কেন্দ্রে যে ভাষা প্রচলিত পূর্ব পাকিস্তানে যদি সে-ভাষা প্রচলিত না থাকে তবে রাজনৈতিক ও কৃষ্টিগত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
উত্তরে আমরা বলি, পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণকে বাংলা ভুলিয়ে উর্দু শিখিয়ে যদি কেন্দ্রের সঙ্গে এক করে দেওয়া সম্ভবপর হত তা হলে যে এ বন্দোবস্ত উত্তম হত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন, এ কাজ কি সোজা? উত্তরে আমরা বলি এ কাজ অসম্ভব।
কেন অসম্ভব এ প্রশ্ন যদি শোধান তবে তার উত্তর দু রকমের হতে পারে। প্রথমরকমের উত্তর দেওয়া যায় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দিয়ে। আমরা যদি একথা সপ্রমাণ করতে পারি যে পৃথিবীর ইতিহাসে কস্মিনকালেও এহেন কাণ্ড ঘটেনি এবং যতবার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই সে চেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে তবে হয়তো অনেকেই স্বীকার করে নেবেন যে, অসম্ভব কর্ম সমাধান করার চেষ্টা করে মূর্খ, বলদকে দোয়াবার চেষ্টা সেই করে যার বুদ্ধি বলদেরই ন্যায়।
ইয়োরোপ আমেরিকা থেকে উদাহরণ দেব না। উর্দুওয়ালারা এসব জায়গার উদাহরণ মেনে নিতে স্বভাবতই গড়িমসি করবেন। তাই উদাহরণ নেব এমন সব দেশ থেকে যেসব দেশকে সাধারণত পাক অর্থাৎ পবিত্র অর্থাৎ ইসলামি বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এসব দেশের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি উর্দুওয়ালাদের জানার কথা, না জানলে জানা উচিত।
আরব ও ইরানের (পারস্যের) মানচিত্রের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন যে এ দু দেশের মাঝখানে কোনও তৃতীয় দেশ নেই। অর্থাৎ আরবদেশের পূর্ব সীমান্তে যেখানে আরবি ভাষা এসে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই ফারসি ভাষা আরম্ভ হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তেও যেখানে আরবি ভাষা শেষ হয়েছে সেখান থেকেই তুর্কি ভাষা আরম্ভ হয়েছে।
সকলেই জানেন খলিফা আবু বকরের আমলে মুসলিম আরবেরা অমুসলিম ইরান দখল করে। ফলে সমস্ত ইরানের লোক আগুন-পূজা ছেড়ে দিয়ে মুসলিম হয়। মুসলিম শিক্ষাদীক্ষা মুসলিম রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রভূমি তখন মদিনা। কেন্দ্রের ভাষা আরবি এবং যে ভাষাতে কুরান নাজিল অর্থাৎ অবতীর্ণ হয়েছেন, হজরতের বাণী হাদিসরূপে সেই ভাষায়ই পরিস্ফুট হয়েছে। কাজেই আমরা অনায়াসে ধরে নিতে পারি যে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র দৃঢ় করার বাসনায় ইরানে আরবি ভাষা প্রবর্তিত করার ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা জানি বহু ইরানবাসী ইসলাম গ্রহণ করে, আরবি শিখে, মুসলিম জগতে নাম রেখে গিয়েছেন। আরও জানি পরবর্তী যুগে অর্থাৎ আব্বাসিদের আমলে আরবি রাষ্ট্রকেন্দ্র ইরানের আরও কাছে চলে এসেছিল। ইরাকের বাগদাদ ইরানের অত্যন্ত কাছে ও আব্বাসি যুগে বহু ইরানি বাগদাদে বসবাস করে উচ্চাঙ্গের আরবি শিখতে সমর্থ হয়েছিলেন। সমস্ত ইরানদেশে তখন আরব গবর্নর, রাজকর্মচারী, ব্যবসাদার, পাইক-বরকন্দাজে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ইরানের সর্বত্র তখন আরবি মক্তব-মাদ্রাসার ছড়াছড়ি, আরবিশিক্ষিত মৌলবি-মৌলানায় ইরান তখন গমগম করত।
তবে কেন তিনশত বৎসর যেতে-না-যেতে ফারসি ভাষা মাথা খাড়া করে উঠল? দশম শতাব্দীর শেষভাগে দেখতে পাই, ফারসি ভাষার নবজাগরণের চাঞ্চল্য সমস্ত ইরানভূমিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। গল্প শুনি, ফিরদৌসিকে নাকি ফরমাইশ দেওয়া হয়েছিল ইরানের প্রাকমুসলিম সভ্যতার প্রশস্তি গেয়ে যেন কাব্য রচনা করা হয়, এবং ততোধিক গুরুত্বব্যঞ্জক (মুহি) ফরমাইশ, সে কাব্য যেন দেশজ ফারসি কথায় রচিত হয়, তাতে যেন আরবি শব্দ বিলকুল ঢুকতে না পারে। গল্পটি কতদূর সত্য বলা কঠিন। কারণ ফিরদৌসির মহাকাব্যে অনেক আরবি কথা আছে কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আর আরবি ভাষা যে কোনও কারণেই হোক, দেশের আপামর জনসাধারণকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলেই ফারসির অভ্যুত্থান হল।
তার পর একদিন ফারসি ইরানের রাষ্ট্রভাষা হয়ে গেল।
উর্দুওয়ালারা হয়তো উত্তরে বলবেন যে ইরান শিয়া হয়ে গেল বলেই সুন্নি আরবের সঙ্গে কলহ করে ফারসি চালাল। এ উত্তরে আছে লোকঠকানোর মতলব। কারণ ঐতিহাসিকমাত্রই জানেন ফিরদৌসির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন গজনির সুলতান মাহমুদ এবং তিনি ছিলেন এতই কট্টর সুন্নি যে তিনি সিন্ধুদেশের হাজার হাজার করামিতাকে (ইসমাইলি শিয়া) কতল-ই আমে অর্থাৎ পাইকারি হননে–ফিনারিজহান্নম বা পরলোকে পাঠিয়েছিলেন। কাজেই বোঝা গেল যে এই আরবিবিরোধী ফারসি আন্দোলনের পশ্চাতে শিয়া-সুন্নি দুই সম্প্রদায়ই ছিলেন।