তোমার দাদুকে কিন্তু দেখবার বাসনা আমার ছিল কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি বলে বাসনাটা ধামাচাপা দিয়ে তার উপর শিল-চাপা দিয়েছিলুম। ইতিমধ্যে আমার এক বন্ধু বললেন, ওহে, রাজশেখরবাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
আমার ভয়ে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি তাকে ফোন করে শুধালুম, কখন এলে দর্শন পাব।
আমার বিশ্বাস তোমার দাদু পূর্বোক্ত কোনও ইচ্ছাই প্রকাশ করেননি। আমার বন্ধু আমার মনের গতি জানতে পেরে ধাপ্পা মেরে আমার রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
সেদিন যতীনবাবুও তার ঝোলা নিয়ে বসেছিলেন। আমি দু জনারই ন্যাটাই ভক্ত অর্থাৎ এঁদের কোনও দোষ-ত্রুটি আমার চোখে পড়ে না।
আমি এমনই nervous হয়ে গিয়েছিলুম যে, সেটা ঢাকবার জন্য আপন অজানাতে জাত-ইডিয়েটের মতো বক্র করতে আরম্ভ করেছিলুম এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বেশ বুঝতে পারছিলুম, ভারি অন্যায় হচ্ছে, বড় বাঁচালতা হচ্ছে, বেহদ্দ পাগলামি হচ্ছে, অথচ কিছুতেই থামতে পারছিলুম না।
হয় তোমার দাদু পয়লা নম্বরের অভিনেতা, নয় তিনি অতিশয় সহৃদয়, সহিষ্ণু শ্ৰীকণ্ঠবাবু। বেশ হাসিমুখে আমার বকবক শুনেছিলেন, এমনকি বললে বিশ্বাস করবে না, ভাই, আমার মনে হচ্ছিল আমার বকবকানিটা তাঁর অপছন্দ হচ্ছে না। যতীনবাবুকে আমি অতটা ডরাইনি। সেটা অবশ্য তাঁরই প্রশ্ন শুধোবার সহৃদয়তা থেকে।
তার মানে তোমার দাদু একটা কিছু কট্টর হাম-বড়া লোক? আদপেই না। কিন্তু আমার এটা অহেতুক ভয়। তাঁর কাছে তো আমি কিছুই গোপন রাখতে পারব না। তিনি ধরে ফেলবেন আমার দম্ভ, আমার আত্মস্তুতি প্রচেষ্টা, আরও সাতান্ন রকমের মানসিক এবং চরিত্রগত দুর্বলতা এবং ব্যাধি আমার যা আছে। আমি জানি তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল—- একমাত্র ভণ্ডামি জিনিসটা তিনি আদপেই বরদাস্ত করতে পারেন না। শুধু ধর্মরত ভণ্ড বিরিঞ্চি বাবা নয়, মোলায়েমির ভণ্ড পেলব রায় দোদুল দে গয়রহ বিস্তরে বিস্তর– এমনকি গল্পেীর খোলাখুলি জোছুরি তিনি প্রশংসার চোখেই দেখছেন, হয়তো ভাবছেন বুদু বাঙালি ব্যবসায়ী এর কিছুটা পেলে বর্তে যেত।
আমি ভণ্ড নই। বড়ফাট্টাই করার লোভ একেবারে কখনও হয় না, সে-কথা বলব না। কিন্তু সেটা রসিয়ে বলতে পারি বলে কেউ বড় গায়ে মাখে না। পাছে অপরিচিত লোক misunderstand করে তাই আমি কারও সঙ্গে দেখা করিনে, পারতপক্ষে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিই না, মিটিঙে পার্টি-পরবে যাই না অতিশয় নিতান্ত unavoidable না হলে। কাউকে বলো না, বাজারে রটিয়েছি, আমার আনজিনা খ্রমবসিস (দুটো হার্ট ট্রাবলকে মিস্ করে এই ঘাটটি তৈরি করেছি), ডাক্তারের সখৎ মানা ভিড়ে মেশা। তৎসত্ত্বেও শুনে আনন্দিত হবে– অন্তত আমি তো বটি বাজারে আমার ভয়ঙ্কর দুর্নাম, আমি দম্ভী, বদরাগী ইত্যাদি, তাই কারুর সঙ্গে মিশিনে। যখনই খবর পাই, অমুক এসব রটাচ্ছে, অমনি তার কাছে লোক পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানাই, সে আমার উপকার করছে বলে (অর্থাৎ এই বদনাম শুনে visitor-রা আমাকে জ্বালাতন করবে না বলে) এবং আমার বইয়ের এক খণ্ড তাকে present করি!
ঠিক তেমনি যারা আপনজন তাদের সঙ্গ পেলে আমার সব দুঃখ উপশম হয়। আমার দাদাদের সঙ্গে আমি দিনের পর দিন পরমানন্দে কাটাতে পারি। আমার মেজদা অনেকটা তোমার দাদুর মতো। আমি ব করলে শুধু যে শোনেন তাই নয়, চোখ দিয়ে উৎসাহও দেন।
যতীনবাবুকে* আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ো।
[*যতীন্দ্রনাথবাবু– শিল্পী যতীনকুমার সেন। রাজশেখর বসুর দীর্ঘকালের বন্ধু ও নিয়মিত সঙ্গী।]
আমি কলকাতায় আসি অতিশয় কালে-কম্মিনে। আমি জানি, তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি সত্যই অত্যন্ত কুনো লোক। যেটুকু ভ্রমণ করেছি সেটা নিতান্ত বিপদে পড়ে, গরজের ঠেলায়। কাবুল গিয়েছিলুম সহজে টাকা রোজগার করে সেই টাকা দিয়ে জর্মনি গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। ঠিক সেই কারণেই মিশর, প্যারিস, লন্ডন যাই– অর্থাৎ পড়াশোনা research করার জন্য। একবার মাত্র স্বেচ্ছায় ভ্রমণ করেছি। ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলামের সঙ্গমভূমি প্যালেস্টাইন গিয়েছিলুম অতিশয় স্বেচ্ছায় মিশরে যখন ছিলুম। আমার ছোট বোনেরা বলে, ছোড়দার longest walk হচ্ছে তার deck Chair (আমি ডেকচেয়ারে পড়াশোনা করি) থেকে বাথরুম অবধি। ব্যবস্থা থাকলে সেখানেও taxi নিতেন। কলকাতায় এলে তোমার দাদুকে দেখতে অত্যন্ত ইচ্ছা হয়। কিন্তু বিরক্ত করতে বড় ভয় পাই। তবে এবারে ঠিক ঠিক আসব। আমি অন্তত ছটা কই মাছ খাব। দাদু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছে। তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়ো। ৪৮ ঘণ্টার নোটিশ দেবার কথা। তৎসত্ত্বে যদি বাজারে কই না পাওয়া যায় তবে চিংড়ি, season হলে তোপসে। দেখ দিকিনি, কী রকম expensive taste –বাঙালের ঘোড়া রোগ। আমাদের এখানে এর একটাও পাওয়া যায় না।
তারা ঝরা নির্ঝরের স্রোতঃপথ, =milky way, আর সাত ভাই চম্পা হল কৃত্তিকা নক্ষত্রের খাঁটি বাংলা নাম। ইংরেজিতে (আসলে গ্রিক) Pleiad অর্থাৎ milky way-এর পিছনে পিছনে পথের খোঁজে খোঁজে যেতে যেতে কৃত্তিকাও অস্ত গেছে। শরঙ্কালের প্রতি রাত্রেই হয় বেশ কিছুদিন ধরে। আর milky way-কে তারা নিৰ্ব্বর বলে রবিবাবু তাঁর physics এবং astron omy জ্ঞান দেখিয়েছেনও বটে। শুনেছি সৃষ্টির আদিতে নাকি বিস্তর তারা ঠিকরে পড়ে ছায়াপথ milky way সৃষ্টি করেছে। আসলে কিন্তু সক্কলেরই Waterloo ওই সাত ভাই চম্পা। ওটা যে কৃত্তিকা সেটা হরিবাবুর অভিধানে আছে। আমার যে গুরুর কাছে আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি তিনি ছিলেন আইরিশম্যান, নাম (ঈশ্বর) মার্ক কলিন্স। বিশ্বাস করবে না, আমি জীবনে কোনওদিন দেখিনি যে, কোনও একটা text-এর সামনে এসে বললেন, এ ভাষা আমি জানিনে।তা সে chinese-ই হোক, আর ওঁরাওঁ-ই হোক। আমাকে ইংরেজি ফরাসি জর্মন পড়াতেন। আর ইংরেজি শব্দতত্ত্ব শেখাবার সময় দুনিয়ার কুল্লে ভাষার সঙ্গে (কারণ ইংরেজি দুনিয়ার কোন ভাষা থেকে শব্দ নেয়নি বলতে পারব না) পরিচয় করিয়ে দিতেন। একদিন রাত্রের অন্ধকারে মাঠে দাঁড়িয়ে কন্সটেলেশন চিনছি এমন সময় তিনি পিছন থেকে আমার পরীক্ষা নিতে নিতে কৃত্তিকার খাঁটি বাংলা নাম শেখালেন। সে প্রায় ৪০ বছর হল। তখন ওর ফার্সি নাম পরওয়িজও শিখিয়েছিলেন। Omar Khoyyam-এর যে ইংরেজি অনুবাদ (Fitzgerald করেছেন তাতে parwiz শব্দটি আছে। সেটি The vine has struck a fibre দিয়ে আরম্ভ। পার্সিদের মধ্যে এ নামে এখনও নামকরণ হয়। এই কলিনসের মতো মহাপণ্ডিত পূর্ব-পশ্চিম কোথাও আমি পাইনি। অথচ কেউই তাকে চেনে না। কারণ যৌবনে লিখেছিলেন ডক্টরেট থিসিস, এবং বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথের চাপে একখানা চটি প্যামলেট- ব্যস। এবং দ্বিতীয়খানা পড়ে কেউই বুঝল না, ওটা সাপ না ব্যাঙ। নাম ছিল On the Octoval System of Reckoning In India, প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে প্রাক-আর্য দ্রাবিড়রা, আর্যদের মতো decimal sys tem অর্থাৎ দশের স্কেলে গণনা করত না– তাদের scale ছিল আটের। ৮ x ৮ = চৌষট্টিতে তাদের শ–তাই চৌষট্টি যোগিনী ইত্যাদি (এর বাইপ্রডাক্ট– দুর্গা আর চৌষট্টি যোগিনী অনার্যা– অবশ্য এটা মূল বক্তব্য নয়)। এই গোনার স্কেল যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়, এবং duodecimal-টাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ ১২-র স্কেল– এটা না জানা থাকলে তোমার দাদুকে জিগ্যেস করে নিয়ো। আমি এসব জানি অতি অল্পই। দেখা হলে কলিনসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ো। তাঁর পাণ্ডিত্য যে কী অতল অগাধ ছিল সেইটে সালঙ্কার শোনাব।