এর পর গোলাম আলি সাহেব অভিনন্দনের উত্তরে বললেন– আলাউদ্দিন খা সাহেব। মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। দেবী সরস্বতী তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাকে মন্দিরের ছায়া দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি হতভাগ্য এতদিন সাধনা করার পরেও সঙ্গীত-মন্দিরের ছায়া দেখতে পাওয়া দূরে থাক–উপরে ওঠবার সিঁড়িটুকুও এখনও শেষ করতে পারিনি। জানি না কত সহস্র বছর আরও কঠিন কঠোর সাধনায় দেবী প্রসন্ন হবেন।
———–
১. এইসব অধ্যাপকদের সম্বন্ধে যেটুকু সামান্য বিবরণ পাঠক পাবেন সেটুকু শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীতে। কিন্তু তার মূল বক্তব্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছিল বলে, বাধ্য হয়ে অধ্যাপকদের সম্বন্ধে বিবরণ দিয়েছেন সংক্ষিপ্তরূপে।
২. সব জিনিস মূল ভাষাতে পড়তে হবে এ উন্নাসিকতার কোনও অর্থ হয় না। আমার আপন অভিজ্ঞতা বলে, বহুক্ষেত্রে অনুবাদ মূলের চেয়ে ঢের সরেস হয়েছে। তার একাধিক কারণ আছে, কিন্তু সে-আলোচনা এস্থানে অবান্তর এবং সংক্ষেপে সারবার উপায় নেই।
৩. এদেশে গগনেন্দ্রনাথ সত্যই ছবি এঁকেছিলেন ওই ঢাবিজ পদ্ধতিতে।
৪. মডার্ন মাথামুণ্ডুহীন ছবির জন্যই যেন এই মোক্ষম bizarre শব্দটি নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ আভিধানিক এর প্রকৃত অর্থ বোঝাতে গিয়ে যেন দিশা না পেয়ে অনেকগুলো কাছেপিঠের শব্দ ও তাদের সমন্বয় করেছেন : eccentric, fantastic, grotesque, mixed in style, half barbaric. কিন্তু এদেশের সুকুমার রায় বিজার শব্দটির প্রকৃত অর্থ একটি কবিতার মারফতে যা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সেটি বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। আমি কয়েক ছত্র তুলে দিচ্ছি :
কেউ কি জানে সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা
ছবির ফ্রেমে বাধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
পাউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
জোছনা রাতে সবাই কেন আলতা মাখায় চোখে?
ওস্তাদের লেপমুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা হুক্কা হুয়া বলে?
মন্ত্রী কেন কলসি বাজায় বসে রাজার কোলে?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি ইত্যাদি।
আন্ ফ্রাঙ্ক
অনেকেই জিগ্যেস করেন, নাৎসি পার্টির কি কোনও গুণ ছিল না, তারা কি সুন্দুমাত্র পাপাচারই করেছেএর উত্তরে একটি ক্লাসিক্যাল নীতিবাক্য সংবলিত ছোট্ট কাহিনী মনে আসে। এক দরিদ্র গ্রাম্য পাদ্রি গিয়েছেন শহরে বিশপের সঙ্গে দেখা করতে, সকালবেলা বিশপ তার চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন, বেচারির পেটে তখনও কিছু পড়েনি। বাটলারকে হুকুম দিলে সে রুটি মাখন আর একটি ডিম-সেদ্ধ নিয়ে এল। পাদ্রি মৃদু আপত্তি জানিয়ে খেতে আরম্ভ করলে হঠাৎ বিশপের নাকে গেল পচা ডিমের গন্ধ। চশমার উপর দিকে অর্ধোনুক্ত পচা ডিম ও পাদ্রির দিকে যুগপৎ তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আপনাকে একটা পচা ডিম দিয়েছে। পাদ্রি সাহেব তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে বললেন, না হুজুর না, ইট ইজ অলরাইট তার পর একটু থেমে বললেন, — অ্যাট প্লেসে অর্থাৎ কোনও কোনও জায়গায়।
তাই পাদ্রি সাহেবের ডিম বলতে বোঝায়, পৃথিবীতে কি এমন কোনও পচা ডিম পাওয়া যাবে, যার সর্বশেষ অণুটুকুও পচে গিয়েছে তেমন করে খুঁজলে অন্তত দু-একটি পরমাণু পাওয়া যাবে, যেগুলো সম্পূর্ণ পচে যায়নি।
নির্গলিতাৰ্থ : ইহভুবনে এমন কোনও ব্যক্তি, বস্তু, প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যার ভিতর নেই কোনও গুণ, শুধু কপালে আগুন।
বস্তৃত হিটলার তথা নাৎসি পাটির অনেক গুণই ছিল, এবং আমার ব্যক্তিগত বিষাস, গত বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শোন-মশানে পরিণত জর্মনি যে বছর-পাচেকের ভিতর আপন পায়ে দাঁড়াতে পারল, তার জন্য কিছুটা ধন্যবাদ পাবেন হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি। সবদ্ধ হয়ে কঠোর তপস্যা দ্বারা কী প্রকারে একটা দেউলে দেশকে (১৯৩৩-এর জর্মনি) মাত্র পাঁচটি বৎসরের ভিতর পরিপূর্ণ শক্তিমান বিত্তবান করা যায় (১৯৩৮-এর জর্মনি) সেই ভানুমতীর খেল দেখিয়েছিলেন স্বয়ং হিটলার। সেই সঘবদ্ধ তপস্যালব্ধ চরিত্রবল বহুলাংশে প্রয়োগ করে যুদ্ধশেষে বিধ্বংসিত-জর্মনি পুনরায় শ্রী-সমৃদ্ধি লাভ করে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভুললে চলবে না, নাৎসিরা পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদিকে নিহত করে।
আবার তার পর এটা ভুলে গেলে আরও একটা মারাত্মক প্ৰম করা হবে যে, হিটলারের দৃষ্টান্ত থেকে বিশ্বমানবের মোশ্চম শিক্ষালাভ হয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। বস্তুত রবের্গের মোকদ্দমার সময় যে-সেরা মার্কিন মনোসমীক্ষণবি, ডাক্তার কেলি প্রধান প্রধান আসামি গ্যোরিঙ, রিবেনট্রেপ, কাইটেল ইত্যাদির মনোসমীক্ষণ (সাইকো-অ্যানালেসিস) দীর্ঘকাল ধরে করেন, হিটলার সম্বন্ধে নানা দ্ব্যর্থহীন তত্ত্ব ও তথ্য এদের কাছ থেকে সগ্রহ করেন (আসামিদের সকলেই হিটলারকে বহু বৎসর ধরে অব্যবহিত অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন) এই ডাক্তার কেলি আপন সোনার দেশ, ইহলোকে গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভূ মার্কিন মুলুকে ফিরে গিয়ে প্রামাণিক পুস্তক মারফত বলেন, এই মার্কিন মুলুকেই যে কোনও দিন এক নয়া-হিটলার নয়া-তাণ্ডব নৃত্য নাচাতে পারে, নাচতে পারে।