শুনেছি বাদল বসু বইয়ের দেশ-এ সুনীলকে মহামানব হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করেছেন, আমার সম্পর্কে বস্তা বস্তা মিথ্যে ঢেলেছেন। সুনীলের প্রশংসা করতে গেলে তাঁর লেখা নিয়ে কথা বলুন, তাঁর জীবনের ভালো ভালো দিক নিয়ে কথা বলুন, তাতেই তো তাঁকে বড় করা যায়। আমাকে ছোট করে তাঁকে বড় করতে হবে কেন? এত ছল চাতুরী আর মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে কেন? বাদল বসু সুনীলকে আমার চেয়েও বেশি চেনেন। হেনস্থা হয়রানির খবর তাঁর অজানা নয়। কিন্তু পুরুষ পুরুষেরই পক্ষ নেবে। যত বড় লেখকই হই না কেন, আমি তখন কেবলই মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ মুখ খুললে ওঁরা সকলেই খুব রাগ করেন।
১১. এতটা জনপ্রিয়তা আপনার প্রাপ্য ছিল না। মৌলবাদীরা আপনাকে জনপ্রিয় করেছে। কী বলবেন?
উত্তর: একেবারে উল্টো। আমি খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলাম বলে মৌলবাদীরা আমার কলম কেড়ে নিতে চেয়েছে বা আমার লেখাকে বন্ধ করতে চেয়েছে বা আমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছে। অজনপ্রিয় অনামী লেখককে নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না। ভয় জনপ্রিয় লেখককে, যদি সে লেখক মৌলবাদবিরোধী লেখা লেখে, যে দুটো পিলার মৌলবাদীরা সজোরে আঁকড়ে ধরে রাখে, ধর্ম আর পুরুষতন্ত্র, সে দুটোতে যদি ফাটল ধরিয়ে দেওয়ার মতো আঘাত করতে থাকে লেখা দিয়ে। আমি যখন বিরানব্বই সালে প্রথম আনন্দ পুরস্কার পাই, তখনও মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেনি বা ফতোয়া জারি করেনি। এর দেড় দুবছর পর করেছে। দেশে বিদেশে। জনপ্রিয় হয়ে উঠছি, এ তাদের আর সয়নি। মৌলবাদীদের কারণে আমার জনপ্রিয়তা শুধু নষ্টই হয়নি, বরং আকাশ থেকে পাতালে নেমেছে। ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, আর ওদিকে আমাকে তাড়িয়েও মৌলবাদীরা শান্ত হয়নি, তাদের অসংখ্য প্রচার মিডিয়া নিরন্তর ব্যস্ত থেকেছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কুৎসা রটাতে, আমার প্রতি মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করতে, মানুষের মন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে, আমার বই-পাঠ থেকে পাঠককে বিরত রাখতে। বছরের পর বছর ওরা মগজধোলাই করেছে সাধারণ মানুষের। আমি নাকি বিজেপির টাকা নিয়ে লজ্জা লিখেছি। আমার নাকি চরিত্র ভালো নয়। একটা অল্প শিক্ষিত, ধর্মভীরু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীবিরোধী সমাজে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার জাদুর মতো কাজ করেছে। এক এক করে আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। প্রকাশকেরা বই প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। পত্র পত্রিকা আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। যে লেখক সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নন্দিত লেখক ছিল বাংলাদেশে, কেবল মৌলবাদী, ধর্মবাদী, নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিকদের অপপ্রচারে সে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একটা নিন্দিত আর নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত হল। এত বিরোধিতা, এত বিদ্বেষ, এত আক্রমণ, এত নিন্দা, এত কুৎসা, এত অপপ্রচার, এত নিষ্ঠুরতা, এত অসভ্যতা, এত রূঢ়তা, এত অন্যায়, এত অবিচার আমার প্রাপ্য ছিল না।
১২. অন্যান্য দেশে আপনি লেখক হিসেবে কেমন সম্মান পেয়ে থাকেন?
উত্তর: লেখক হিসেবে সম্মান কোথাও প্রচণ্ড পরিমাণে পাই। কোথাও কিছুটা কম। কোথাও মাঝারি ধরনের। কোথাও চলনসই। কিন্তু কোনও দেশ বাংলার মতো, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো, এত অপমান আমাকে করে না। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ বা রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়না। কিছু উগ্রপন্থী ধর্মবাদীদের মতের সঙ্গে আমার মত মেলে না বলে আমাকে জন্মের মতো চোখের আড়াল করা হয় না, নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হয় না। এত অবিবেচক আর এত অসহিষ্ণু হতে কোনও দেশকেই দেখিনি। এত ভয়ংকর নির্মমতা কোনও দেশ আমার সঙ্গে কখনও করেনি।
১৩. অন্য দেশ থেকে উল্লেখ করার মতো পুরস্কার।
উত্তর: আছে বেশ কিছু। আমার আত্মজীবনী পড়ে দেখুন। পাবেন। নয়তো যেসব বইয়ের জ্যাকেটে পরিচিতি আছে, পড়ে নিন, ওতে লিস্ট আছে।
১৪. মৌলবাদীদের চাপে অনেক শিল্পী সাহিত্যিক দেশছাড়া হয়েছেন। মকবুল ফিদা হোসেন, সালমান রুশদি, আয়ান হিরসি আলী প্রমুখ। আপনি নিজেকে এঁদের থেকে আলাদা মনে করেন?
উত্তর: কতগুলো নাম দেখি তোতা পাখির মতো শুধু মুখস্থই করেছেন। এঁদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক মকবুল ফিদা হোসেন ছাড়া মৌলবাদীদের চাপে আর কেউ দেশ ছাড়েননি। সালমান রুশদি তাঁর দশ বছর বয়স থেকে ইংলেণ্ডে থাকেন। ইংলেণ্ডই তাঁর দেশ। মৌলবাদীদের চাপে তাঁকে ইংলেণ্ড ছাড়তে হয়নি। বরং তিনি ওখানে প্রচুর নিরাপত্তা রক্ষী পেয়েছেন। আয়ান হিরসি আলী সোমালিয়া থেকে এসে নেদারল্যাণ্ডে থেকেছেন, ওদেশের নাগরিক হয়েছেন, মৌলবাদীরা হুমকি দেওয়ার পর নেদারল্যা ণ্ডেই ছিলেন, ওখানেই নিরাপত্তা পেতেন। একসময় পুরোনা ফাইল পত্র ঘেঁটে একজন ডাচ সংসদ সদস্য বের করলেন যে নেদারল্যাণ্ডে আশ্রয় চাওয়ার সময় আয়ান নিজের সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য দিয়েছিলেন, মিথ্যে তথ্য দেওয়ার কারণে আয়ানের পার্লামেন্টের সদস্য পদটী চলে যায়। তখন তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ নামের এক ডানপন্থী সংগঠনের আমন্ত্রণ পেয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন, ওখানেই স্কলার হিসেবে আছেন।