আশ্চর্য প্ৰাণী (প্রোফেসর শঙ্কু)

১০ই মার্চ

গবেষণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমার জীবনে এর আগে এ রকম কখনও হয়নি। একমাত্র সাত্ত্বিনা যে এটা আমার একার গবেষণা নয়, এটার সঙ্গে আরও একজন জড়িত আছেন। হামবোল্টও বেশ মুষড়ে পড়েছে। তবে এত সহজে নিরুদ্যম হলে চলবে না। কাল আবার উঠে পড়ে লাগতে হবে।

১১ই মার্চ

আজও কোনও ফল পাওয়া গেল না। যদি যেত, তা হলে অবিশ্যি সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে যেত। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না সন্দেহ। আমি অবিশ্যি আমার হতাশা বাইরে প্রকাশ করি না, কিন্তু হামবোল্ট দেখলাম আমার মতো সংযমী নয়। আজ ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ কথা নেই বাতা নেই, ওর পোষা বিরাট গ্রেট ডেন কুকুরটার পাঁজরায় একটা লাথি মেরে বসল। হামবোল্টের চরিত্রের এ দিকটা আমার জানা ছিল না। তাই প্রথমটায় বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে রাগটা বেশিক্ষণ ছিল না। মিনিট দিশেকের মধ্যেই তুড়ি মেরে নেপোলিয়নকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নেপোলিয়নও দেখলাম দিব্যি লেজ নাড়ছে।

আজ প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকে কনকনে হাওয়া বইছে। বাইরেটা বরফ পড়ে একেবারে সাদা হয়ে রয়েছে। বৈঠকখানার ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেই আজ দিনটা কাটাতে হবে। আমি জানি হামবোল্ট আমাকে আবার সুপার-চেস খেলতে বাধ্য করবে। সুপার-চেস, অর্থাৎ দাবার বাবা। এটা হামবোল্টেরই আবিষ্কার। বোর্ডের সাইজ ডবল। যুঁটির সংখ্যা ষোলোর জায়গায় বত্রিশ, যুঁটির চালচলনও দাবার চেয়ে শতগুণে বেশি জটিল। আমার অবিশ্যি খেলাটা শিখে নিতে ঘণ্টা তিনেকের বেশি সময় লাগেনি। প্রথম দিন হামবোল্ট আমাকে হারালেও, কাল পর্যন্ত পার পর তিন দিন আমি ওকে কিস্তি মাৎ করে দিয়েছি। মনে মনে স্থির করেছি যে আজ যদি খেলতেই হয়, তা হলে ইচ্ছে করেই হারব। ওর মেজাজের যা নমুনা দেখলাম, ওকে একটু তোয়াজে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

১২ই মার্চ

আজ প্রথম একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। হয়তো বা শেষপর্যন্ত সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে প্রথম একটি প্রাণীর সৃষ্টি হবে। আজ মাইক্রোম্যাগনাস্কোপের সাহায্যে যে জিনিসটা ফ্লাস্কের মধ্যে দেখা গেল, সেরকম এর আগে কখনও দেখা যায়নি। একটা পরমাণুর আয়তনের cell জাতীয় জিনিস। হামবোল্ট দেখার পর আমি চোখ লাগানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ভাবগতিক দেখে সেটাকে প্রাণী বলতে দ্বিধা হয় না, এবং এটার সৃষ্টি হয়েছিল যে আমাদের গবেষণার ফলেই, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। হামবোল্ট প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য। সত্যি বলতে কী, যন্ত্রটা থেকে চোখ সরিয়ে নেবার পরমুহুর্তেই ও আমার কাঁধে এমন একটা চাপড় মারে যে, কাঁধটা এখনও টিনটিন করছে।

কিন্তু যেটা দুশ্চিন্তার কারণ সেটা হল এই যে, প্রাণী যদি সৃষ্টিও হয়, তার অস্তিত্ব কি হবে শুধুমাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য? তা হলো লাভটা কী হবে? লোককে ডেকে সে প্রাণী দেখাব কী করে? ইউরোপের অন্যান্য বৈজ্ঞানিকরা সে প্রাণীর কথা বিশ্বাস করবে। কেন?

যাকগে, এখন এসব কথা না ভাবাই ভাল। আমি নিজে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যে, আজ যে ঘটনা আমাদের ল্যাবরেটরিতে ঘটেছে, তার তুলনীয় কোনও ঘটনা। এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোনও ল্যাবরেটরিতে কখনও ঘটেনি।

এই প্ৰাণী তৈরির ব্যাপারে আমরা যে-রাস্তাটা নিয়েছি, আমার মতে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়, বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারেন তখন পৃথিবীর অবস্থাটা কীরকম ছিল। সেই অবস্থােটা ভারী ভয়ংকর। সারা পৃথিবীতে ডাঙা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তার বদলে ছিল এক অগাধ সমুদ্র। পৃথিবীর উত্তাপ ছিল তখন প্রচণ্ড। এই সমুদ্রের জল টগবগ করে ফুটত। আজকাল বায়ুমণ্ডল পৃথিবীকে যেভাবে ঘিরে রয়েছে এবং তার আচ্ছাদনের মধ্যে মানুষকে অক্সিজেন, ওজোন ইত্যাদির সাহায্যে যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে—তখন তা ছিল না। তার ফলে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি সোজা এসে পৃথিবীকে আঘাত করত। হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন সালফার কার্বন ইত্যাদি গ্যাস অবশ্যই ছিল, আর এইসব গ্যাসের উপর চলত বৈদ্যুতিক প্রভাবের খেলা। প্রলয়ংকর বৈদ্যুতিক ঝড় ছিল তখন দৈনন্দিন ব্যাপার। এই অবস্থাতেই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়।

আমরা আমাদের ল্যাবরেটরিতে যেটা করেছি। সেটা আর কিছুই নয়-একটা ফ্লাস্কের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে এই আদিম আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছি। আমার বিশ্বাস এই অবস্থােটা বজায় রেখে কিছুদিন পরীক্ষা চালাতে পারলে আমাদের ফ্লাস্কের মধ্যে একটি প্রাণীর জন্ম হবে, যেটা হবে মানুষের তৈরি প্রথম প্রাণী। এই প্রাণী জীবাণুর আকারে হবে এটাও আমরা অনুমান করছি, এবং জীবাণুরই মতো হবে এর হাবভাব চালচলন।

প্রোফেসর হামবোল্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে কীভাবে জড়িত হলাম, সেটা বলি। জামানির ব্রেমেন শহরে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে আমি কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ পড়ি। সভায় হামবোল্ট উপস্থিত ছিলেন। এই বিখ্যাত বায়োকেমিস্টের লেখা আমি আগে পড়েছি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল না। বক্তৃতার পর নিজে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমারই মতো বয়স, তবে লম্বায় আমার চেয়ে প্রায় এক হাত উচু। মাথায় চকচকে টাক, গোঁফ দাড়ির লেশ মাত্র নেই, এমনকী ভুরু বা চোখের পাতাও নেই।

হঠাৎ দেখলে মাকুন্দ বলে মনে হয়। কিন্তু হ্যান্ডশেক করার সময় হাতে সোনালি লোম লক্ষ করলাম।

সম্মেলনের অতিথিদের জন্য বক্তৃতার পর একটা বড় হলঘরে কফি ও কেক-বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল। ভিড় দেখে আমি একটা কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। মনটাও ভাল নেই, কারণ বক্তৃতার শেষে হাততালির বহর দেখে বুঝেছিলাম, আমার কথাগুলো শ্রোতাদের মনে ধরেনি। অর্থাৎ মানুষের হাতে প্রাণীর সৃষ্টি হতে পারে সেটা বৈজ্ঞানিকেরা মানতে চায়নি। তাই বক্তৃতার শেষে দু একজন ভদ্রতার খাতিরে প্রশংসা করলেও এগিয়ে এসে বিশেষ কেউই কথা বলছে না। এমন সময় প্রোফেসর হামবোল্ট হাসিমুখে এলেন আমার দিকে এগিয়ে। তাঁর হাতে দু পেয়ালা কফি দেখে বুঝলাম তার একটা আমারই জন্যে। কফি পেয়ে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। জামান ভাষাতেই কথাবাত হল। হামবোল্ট তাঁর প্রথম কথাতেই আমাকে অবাক করে দিলেন

আমার পেপারটা আর পড়ার দরকার হল না।

তার মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তুমি যা বললে, আমারও সেই একই কথা।

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, তাতে ক্ষতি কী? এরা যখন আমার একার কথায় গা করছে। না, সেখানে দুজনে বললে হয়তো কিছুটা কাজ হবে।

হামবোল্ট মৃদু হেসে মৃদু স্বরে বললেন, এদের কিছু বলে বোঝাতে যাওয়াটা পণ্ডশ্ৰম। এসব ব্যাপারে কথায় কাজ হয় না, কাজ হয় একমাত্র কাজ দেখাতে পারলে। তুমি যা বললে, সেটা নিয়ে কিছু পরীক্ষা করেছ কি?

আমি বলতে বাধ্য হলাম যে আমার গিরিডির ল্যাবরেটরিতে যা সরঞ্জাম আছে তাই নিয়ে এই জটিল পরীক্ষায় নামা মুশকিল।

কোনও চিন্তা নেই? হামবোল্ট বললেন। তুমি চলে এসো আমার ওখানে।

কোথায়? হামবোল্ট কোথায় থাকতেন সেটা আমার জানা ছিল না।

সুইটজারল্যান্ড। আমি থাকি সেন্ট গালেন শহরে। আমার মতো ল্যাবরেটরি ইউরোপে আর পাবে না।

লোভ লাগল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ৫ই মার্চ অর্থাৎ ঠিক সাত দিন আগে সেন্ট গালেনে পৌঁছেছি। সুইটজারল্যান্ডের সব শহরের মতোই এটাও ছবির মতো সুন্দর। কনস্ট্যান্স হ্রদের ধারে রোরশাক শহর থেকে ট্রেনে ন মাইল। প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচুতে। প্রথম দিন একটু ঘুরে দেখেছিলাম শহরটা, তারপর গবেষণার কাজ শুরু হয়ে যাওয়াতে আর বেরোতে পারিনি। হামবোল্টের ল্যাবরেটরি সত্যিই একটা আশ্চর্য জিনিস। এ ধরনের গবেষণা এখানে ছাড়া সম্ভব ছিল না। এখন এটা সফল হলেই হয়। আজ যে খানিকটা আশার আলো দেখা দিয়েছে, তার জন্য আমি অনেকটা দায়ী। প্রোটোভিট্রোমাফিজেনারাস সলিউশনে নিউট্র্যাল ইলেকট্রিক বমবার্ডমেন্টের কথাটা আমিই বলেছিলাম। আমার বিশ্বাস তার ফলেই আজ কয়েক মুহুর্তের জন্য ওই পারমাণবিক প্রাণীটির আবিভব হয়েছিল। কাল বমবার্ডমেন্টের মাত্ৰাটা আর একটু বাড়িয়ে দেব। দেখা যাক কী হয়।

নাঃ-আজ আর লেখা যাবে না। এইমাত্র হামবোল্টের চাকর ম্যাক্স বলে গেল, তার মনিব সুপার-চেসের যুঁটি সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

১৪ই মার্চ

কাল ডায়েরি লিখতে পারিনি। লেখার মতো মনের অবস্থাও ছিল না। তার মানে মনমরা অবস্থা নয়—একেবারে উল্লাসের চরম শিখর। এখনও ঘটনাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘড়িতে যদিও রাত আড়াইটা, চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বার বার মন চলে যাচ্ছে হামবোল্টের ল্যাবরেটরির টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্কের ভিতরের আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে। আমাদের যুগান্তকারী পরীক্ষার ফল। এই প্ৰাণী।

কাল সন্ধ্যা ছটা বেজে তেত্ৰিশ মিনিটে এই প্ৰাণী জন্ম নেয়। আমার বিশ্বাস আমার অনুমান অনুযায়ী বমবার্ডমেন্টের মাত্রােটা বাড়ানোর ফলেই এ প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে; যদিও এ বিষয়ে আমি হামবোল্টের কাছে কোনও বড়াই করিনি। তাই বোধ হয় তার মনটাও খুশিতে ভরে আছে। সে হয়তো ভাবছে তার কৃতিত্ব আমারই সমান। ভাবুক গিয়ে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমাদের গবেষণা সফল হয়েছে এইটেই বড় কথা।

শুধু প্রাণীর জন্মটাই যে কালকের একমাত্র আশ্চর্য ঘটনা, তা নয়। জন্মের মুহুর্তে যে সব ব্যাপারগুলো ঘটল, তা এতই অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক যে, এখনও মনে পড়লে আমার শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ঘণ্টা একটানা দুজনে ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম। বরফ পড়ছে, নেপোলিয়ন এসে ল্যাবরেটরির কাপেটের উপর বসেছে, ম্যাক্স সবেমাত্র কফি দিয়ে গেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা বাজ পড়ার মতো প্ৰচণ্ড শব্দে আমাদের দুজনেরই প্রায় হার্টফেল হবার অবস্থা। অথচ আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই; জানোলা দিয়ে বাইরে ঝলমলে রোদ দেখা যাচ্ছে। এই বজপাতের সঙ্গে সঙ্গে আবার অনুভব করলাম। একটা এক সেকেন্ডের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি। তার তেজ এত বেশি যে, ঘরের জানোলা আর টেবিলের কাচের জিনিসপত্রগুলো সব ঝনঝনি করে উঠল, আর আমরা দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম টেবিলের উপর। তারপর কোনও রকমে টাল সামলে নিয়ে ফ্লাস্কের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা আশ্চর্য জিনিস।

ফ্লাস্কের অর্ধেকটা ছিল জলে ভর্তি। প্ৰথমে লক্ষ করলাম যে, সেই জলের উপরের স্তরে একটা যেন ঢেউ খেলছে। অত্যন্ত ছোট ছোট তরঙ্গের ফলে জলের উপরটা যেন একটা সমুদ্রের খুদে সংস্করণ।

তারপর দেখলাম ইঞ্চিখানেক নীচের দিকে জলের মধ্যে কী যেন একটা চরে বেড়াচ্ছে। সেটাকে খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না, কিন্তু সেটা পরমাণুর চেয়ে আয়তনে অনেকখানি বড়। আর তার চলার ফলে জলের ভিতরে যে একটা মৃদু আলোড়নের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়।

বাতিটা নেবাও!

হামবোল্টের হঠাৎ-চিৎকারে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার হাতের কাছেই লাইটের সুইচটা ছিল। সেটা নিবিয়ে দিতেই অন্ধকারে একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। প্রাণীটির একটা নিজস্ব নীল আলো আছে, সেই আলোটা জলের ভিতরে একেবেঁকে চলে তার গতিপথ নির্দেশ করছে। আমরা দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে রইলাম।

কতক্ষণ। এইভাবে চেয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠতে বুঝলাম হামবোল্টের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটেছে। সে ঘরের এক পাশে সোফাটার উপর ধাপ করে বসে পড়ল। তার ঘন ঘন হাত কচলানি থেকে বুঝলাম, সে এখনও উত্তেজনায় অস্থির।

আমি টেবিলের সামনেই কাঠের চেয়ারটায় বসে পড়ে বললাম, এমন একটা ঘটনা বৈজ্ঞানিক মহলে প্রচার করা উচিত নয় কি?

হামবোল্ট এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে কেবল হাত কচলাতে লাগল। বোধ হয় আমাদের আবিষ্কারের গুরুত্বটা সাময়িকভাবে তার মাথাটা একটু বিগড়ে দিয়েছে, সে পরিষ্কারভাবে কিছু ভাবতে পারছে না। তবু আমি একটা কথা না বলে পারলাম না

আমাদের এই প্ৰাণী যাতে কিছু দিন অন্তত বেঁচে থাকে, তার জন্য যা করা দরকার সেটা আমাদের করতেই হবে।

হামবোল্ট বার দুয়েক মাথা নেড়ে অদ্ভুতভাবে চাপা ফিসফিসে গলায় প্রায় অন্যমনস্কভাবে

এরপর থেকে হামবোল্ট আর দাবার উল্লেখ করেনি। কাল রাত্রে খাবার সময় সে একটি কথাও বলেনি। বেশ বুঝেছিলাম যে, তার অন্যমনস্কতা এখনও কাটেনি। কী ভাবছে সে, কে জানে!

আজ সারা দিন আমরা দুজন অনেকটা সময় কাটিয়েছি ল্যাবরেটরিতে। দিনের বেলায় ল্যাবরেটরির জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছি, যাতে ঘরটা অন্ধকার থাকে। অন্ধকারের মধ্যে যতবারই ঘরে ঢুকেছি, ততবারই প্ৰথমে চোখ চলে গেছে। ফ্লাস্কের ওই নীল এঁকেবেঁকে-চলা আলোটার দিকে। কী নাম দেওয়া যায়। এই জীবন্ত আলোকবিন্দুর? এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি।

১৫ই মার্চ

আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, নিজেকে বৈজ্ঞানিক বলতে আর ইচ্ছে করছে না। হামবোল্টের ল্যাবরেটরিতে আজকে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমাদের দুজনকেই একেবারে বেকুব বানিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কোনও নিয়মই এখানে খাটে না। এটাকে অলৌকিক ভেলকি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

আমি কাল রাত্রে ঘুমিয়েছি। প্রায় তিনটের সময়; কিন্তু তা সত্ত্বেও অভ্যাস মতো আমার ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হামবোল্টও ভোরেই ওঠে, কিন্তু ছটার আগে নয়।

সটান চলে গেলাম। ল্যাবরেটরিতে।

দরজা জানোলা কাল বন্ধ ছিল। দরজার একটা ড়ুপলিকেট চাবি হামবোল্ট আমাকে দিয়ে রেখেছিল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে ফ্লাস্কের দিকে চাইতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল।

সেই নীল আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না। আমি তৎক্ষণাৎ ধরেই নিলাম যে, প্রাণীটার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাও ব্যাপারটা একবার ভাল করে দেখার জন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আলো জ্বালাতেই প্রথমেই দেখলাম যে, ফ্লাস্কে জল প্ৰায় নেই বললেই চলে। তার বদলে প্রায় অর্ধেকটা অংশ ভরে রয়েছে একটা খয়েরি রঙের পদার্থে। এই পদার্থের উপরটা প্ৰায় সমতল; তারমধ্যে কয়েকটা ছোট ছোট জলে ভরা ডোবার মতো জায়গা, আর সেগুলোকে ঘিরে সবুজ রঙের ছোপ। অর্থাৎ যেটা ছিল সমুদ্র, সেটা এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেছে। জলাভূমি।

কিন্তু আমাদের প্রাণী? এইবারে লক্ষ করলাম একটা ডোবার মধ্যে কিছুটা আলোড়ন। কী যেন একটা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে সেখানে। আমি এগিয়ে গিয়ে একেবারে ফ্লাস্কের কাচের গায়ে চোখ লাগিয়ে দিলাম।

হ্যাঁ। কোনও সন্দেহ নেই। একটা প্ৰাণী ডোবার জলের মধ্যে সাঁতার দিয়ে ডাঙায় এসে উঠল। প্রাণীটাকে খালি-চোখেই দেখা যাচ্ছে। সাইজে একটা সাধারণ পিঁপড়ের মতো বড়।

আমার মুখ থেকে একটা কথা আপনা থেকে বেরিয়ে পড়ল—অ্যামফিবিয়ান।

অর্থাৎ আমাদের সৃষ্ট জলচর প্রাণী আজ। আপনা থেকেই উভচর প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এ প্রাণী জলেও থাকতে পারে, ডাঙাতেও থাকতে পারে। পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণীর সৃষ্টি হয়, অনুমান করা হয় সে প্রাণী জলচর ছিল। তারপর প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তনে পৃথিবী থেকে জল কমে যায়; তার জায়গায় দেখা দেয় জলাভূমি। তার ফলে জলচর প্রাণীও ক্রমে নতুন পরিবেশে প্রাণধারণ করার উপযুক্ত একটা নতুন চেহারা নেয়। এই চেহারাটাই তার অ্যামফিবিয়ান বা উভচর চেহারা। এ জিনিসটা অবশ্য রাতারাতি হয়নি। এটা ঘটতে লেগেছিল। কোটি কোটি বছর। কিন্তু আমাদের ফ্লাস্কের মধ্যে ঠিক এই ঘটনাই ঘটে গেল দু দিনের মধ্যে।

টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, প্রাণীটা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ মাইক্রোম্যাগনাস্কোপ দিয়ে সেটাকে একবার ভাল করে দেখে নিলাম। কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক এই জাতীয় অ্যামফিবিয়ানেরই ফসিল আমি দেখেছি বার্লিন মিউজিয়মে। ৬০০ কোটি বছর আগে এই উভচর প্রাণী পৃথিবীতে বাস করত। মাছ আর সরীসৃপের মাঝামাঝি অবস্থা। রংটা লক্ষ করলাম সবুজ আর খয়েরি মেশানো। চেহারাটা যেন মাছ আর গিরগিটির মাঝামাঝি।

আরও একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম। ডোবার ধারে ধারে যেটাকে সবুজ রং বলে মনে হচ্ছিল, সেটা আসলে অতি সূক্ষ্ম আকারের সব গাছপালা।

হামবোল্ট বোধ হয় অনেক রাত পর্যন্ত লেখালেখির কাজ করেছে, তাই তার ঘুম ভাঙতে হয়ে গেল সাড়ে সাতটা। বলা বাহুল্য, ফ্লাস্কের ভিতরে ভেলকি দেখে আমারই মতো হতবাক অবস্থা তারও।

ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে হামবোল্ট প্রথম মুখ খুলল—আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরে কি পৃথিবীর প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের একটা মিনিয়েচার সংস্করণ ঘটতে চলেছে।

আমিও মনে মনে এটাই সন্দেহ করেছিলাম। বললাম, সেটা শুধু আজকের এই একটা ঘটনাতে প্রমাণ হবে না। এখন থেকে শুরু করে পর পর কী ঘটে, তার উপর সব কিছু নির্ভর করছে।

হুঁ।

হামবোল্ট কিছুক্ষণ চুপ। তার ঠোঁটের কোণে সেই অদ্ভুত হাসি, যেটা প্রথম প্রাণীর উদ্ভবের সময় থেকেই মাঝে মাঝে লক্ষ করছি। অবশেষে একটা সসেজের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, তার মানে এর পরে উদ্ভিদজীবী সরীসৃপ। তারপর স্তন্যপায়ী মাংসাশী জানোয়ার, তারপর।..তারপর…

হামবোল্ট থামল। তারপর কাঁটাচামচ নামিয়ে রেখে হাত দুটো কচলাতে কচলাতে বলল, আজ থেকে সতেরো বছর আগে, ওসাকায় একটা আন্তজাতিক বিজ্ঞানীবৈঠকে কৃত্রিম উপায়ে প্রাণ সৃষ্টি করার বিষয়ে একটা প্রবন্ধ পড়ে ছিলাম। সে প্রবন্ধ শুনে সভার লোক আমায় ঠাট্টা করেছিল, পাগল বলে গালমন্দ করেছিল। আজ ইচ্ছে করছে, তারা এসে দেখুক আমি কী করেছি…

আমি চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, হামবোল্ট প্রাণসৃষ্টির কৃতিত্বটা অম্লানবদনে নিজে একই নিয়ে নিচ্ছে। অথচ আমি জানি যে, যদি শেষ মুহুর্তে আমার মাথা না খেলত—বমবার্ডমেন্টের মাত্রা যদি না বাড়ানো হত— তা হলে পরীক্ষা সফল হত না। গবেষণার গোড়াতে হামবোল্টের কথাতেই কাজ চলছিল, কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি। সেটা হামবোল্টও জানে, কিন্তু তাও…

যাকগে। এ সবে কিছু এসে যায় না। বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ছোট মনের পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি। তারাও তো মানুষ, কাজেই তাদের অনেকের মধ্যেই ঈষাও আছে, লোভও আছে। এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য বা চিন্তা না করাই ভাল।

কদিন একটানা বাড়ির ভেতর থাকতে হয়েছে, তাই আজ দিনটা ভাল দেখে ভাবলাম, একটু বেড়িয়ে আসি। দু-একটা চিঠি লেখা দরকার, অথচ ডাকটিকিট নেই, তাই সোজা পোস্টাপিসের দিকে রওনা দিলাম।

রাস্তায় বরফ পড়ে আছে, শীতটাও চনমনে, কিন্তু আমার কোটের পকেটে একটা এয়ার কন্ডিশনিং পিল থাকার জন্য অতিরিক্ত গরমজামার কোনও প্রয়োজন হয়নি। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ওভারকেট পরা রাস্তার লোকেরা আমার দিকে উদ্বিগ্নভাবে বার বার ফিরে ফিরে দেখছে।

পোস্টাপিসে টিকিট কেনার সময় মনে হল যে, এইখান থেকে ইচ্ছে করলে লন্ডনে টেলিফোন করা যায়। সোজা ডায়াল করলেই যখন নম্বর পাওয়া যায়, তখন আমার বন্ধু প্রফেসর সামারভিলকে একটা খবর দিলে কেমন হয়? সামারভিল বায়োকেমিস্ট; কৃত্রিম উপায়ে প্রাণী তৈরির ব্যাপারে এককালে তার সঙ্গে আমার চিঠি লেখালেখি হয়েছিল।

সামারভিলকে টেলিফোনে পেতে লাগল ঠিক এক মিনিট।

কোনওরকমে সংক্ষেপে তাকে ব্যাপারটা বললাম। সামারভিল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একে কৃত্রিম প্রাণী, তার উপরে দু দিনের মধ্যে জলচর থেকে উভচর। শেষটায় সামারভিল বলল, তুমি কোখেকে ফোন করছ? ইন্ডিয়া নয় নিশ্চয়ই?

বললাম, না না, তার চেয়ে অনেক কাছে। আমি আছি সেন্ট গালেনে।

কেন? সেন্ট গালেনে কেন? সামারভিল অবাক।

বললাম, প্রোফেসর হামবোল্টের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছি আমি।

তিন সেকেন্ড কোনও কথা নেই। তার পর শোনা গেল—

হামবোল্ট? কর্নেলিয়াস হামবোল্ট? কিন্তু সে যে—লাইন কেটে গেল।

মিনিটখানেক চেষ্টা করেও কোনও ফল হল না। সামারভিলের বাকি কথাটা আর শোনা হল না। তবে এটা বুঝেছিলাম যে আমার সহকমীর নাম শুনে সে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছে!

কী আর করি? বাড়ি ফিরে এলাম। হামবোল্ট যে একটু গোলমেলে লোক, সে তো আমি নিজেও বুঝেছি। কিন্তু এটাও তো মনে রাখতে হবে যে তার মতো এমন ল্যাবরেটরিতে এমন একটা এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ হামবোল্টই আমাকে দিয়েছে।

আজ সারাদিন ল্যাবরেটরিতে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। আমি আর হামবোল্ট। মাইক্রোফোটোগ্রাফিক ক্যামেরা দিয়ে প্রাণীটার কয়েকটা ছবিও তুলেছি। এটা বেশ বুঝেছি যে, প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছুই করতে হবে না। তার জন্য অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনা থেকেই ফ্লাস্কের ভিতর তৈরি হয়ে রয়েছে। সেই পরিবেশ বদল না হওয়া পর্যন্ত এ প্রাণী ঠিকই থাকবে।

১৬ই মার্চ

যা ভেবেছিলাম তাই। আজ সরীসৃপ। আমার প্রাণীর তৃতীয় অবস্থা। আয়তনে আগের প্রাণীর চেয়ে প্রায় দশগুণ বড়। মাইক্রোম্যাগনাস্কোপের প্রয়োজন হবে না। এমনি চোখে দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে এর আকৃতি ও প্রকৃতি। এর চেহারা আমাদের কাছে অতি পরিচিত। পৃথিবীর অনেক জাদুঘরেই এই কঙ্কাল রয়েছে। সরীসৃপ শ্রেণীর মধ্যে আয়তনে যেটি সবচেয়ে বড় ছিল—এ হল সেই ব্ৰন্টোসরাস। সেই ষাট ফুট লম্বা দানবসদৃশ প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের একটি দু ইঞ্চি সংস্করণ দিব্যি আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরের জমিতে হাঁটছে, শুচ্ছে, বসছে, আর দরকার হলে খুদে খুদে গাছের খুদে খুদে ডাল পাতা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।

খুব আপশোস হল একটা কথা ভেবে-কাল রাতটা কেন ফ্লাস্কের সামনে বসে রইলাম না? থাকলে নিশ্চয়ই পরিবর্তনটা চোখের সামনে দেখতে পেতাম। আজ স্থির করলাম যে যতক্ষণ না ফ্লাস্কের ভিতরে একটা কিছু ঘটে ততক্ষণ ল্যাবরেটরি ছেড়ে কোথাও যাব না। এখন রাত সোয়া বারোটা। আমি ল্যাবরেটরিতে বসেই আমার ডায়রি লিখছি। হামবোল্টও সামনে বসে আছে। কেবল মাঝে একবার টেলিফোন আসাতে উঠে চলে গিয়েছিল। কে ফোন করেছিল জানি না। যেই করুক, হামবোল্ট তার সঙ্গে বেশ উত্তেজিত ও উৎফুল্লভাবে কথা বলছিল। এটা মাঝে মাঝে তার উদাত্ত গলার স্বর থেকেই বুঝতে পারছিলাম, যদিও দুটো ঘরের মধ্যে ব্যবধানের ফলে কথা বুঝতে পারছিলাম না।

ব্ৰন্টোসরাসটা এখন বিশ্রাম করছে। ফ্লাস্কের ভিতরটা কেমন জানি ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। হয়তো কিছু একটা ঘটবে। লেখা বন্ধ করি।

১৬ই মার্চ, রাত একটা বেজে ছত্ৰিশ মিনিট

দু মিনিট আগে সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে গেল। যে ধোঁয়াটে ভাবটার কথা লিখেছিলাম সেটা আর কিছুই না-ফ্লাস্কের ভিতরে উপর দিকটায় মেঘ জন্মছিল। মিনিট পাঁচেক এইভাবে মেঘ জমার পর অবাক হয়ে দেখলাম একটা মিহি বাম্পের মতো জিনিস মেঘ থেকে নীচে জমির দিকে নামছে। বুঝলাম সেটা বৃষ্টি। আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরের ভূখণ্ডটির উপর বৃষ্টি হচ্ছে।

শুধু বৃষ্টি নয়। পর পর কয়েকটা বিদ্যুতের চমকও লক্ষ করলাম-আর সেই সঙ্গে মৃদু। মেঘের গর্জন। যদিও সে গর্জন কান ফাটা কোনও শব্দ নয়, কিন্তু ফ্লাস্কটা ও টেবিলের অন্যান্য কাচের যন্ত্রপাতি সেই গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝনি করে উঠছিল।

বৃষ্টির মধ্যে আমাদের প্রাণীর কী অবস্থা হচ্ছে, সেটা দেখার কোনও উপায় ছিল না, কারণ বাম্পের জন্য ফ্লাস্কের ভিতরের সূক্ষ্ম ডিটেল সব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

আমরা দুজনেই তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে একটা সময় এল যখন বুঝতে পারলাম বৃষ্টিটা থেমে গেছে। মেঘ কেটে গেল, বাষ্প সরে গিয়ে ফ্লাস্কের ভিতরটা আবার পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখলাম জমির রং একেবারে বদলে গেছে। আগের অবস্থায় যা ছিল তামাটে, এখন সেটা হয়েছে। ধবধবে সাদা।

আমরা দুজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম-বরফ!

বরফটা সমতল নয়। তার মধ্যে উঁচু নিচু আছে, এবড়োখেবড়ো আছে, এক এক জায়গায় বরফের চাই মাটি থেকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে পাহাড়ের মতো।

আমি বললাম, আমরা কি ফ্লাস্কের মধ্যে আইস-এজের একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি!

হামবোল্ট বলল, তা হবেও বা। কিংবা যে কোনও সময়ের মেরুদেশের দৃশ্যও হতে পারে।

আইস-এজ বা তুষারপর্বের সময় হচ্ছে আজ থেকে সাত-আট লক্ষ বছর আগে। বরফ তখন মেরুদেশ থেকে নীচের দিকে সরতে সরতে প্রায় সারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছিল।

হামবোল্ট হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—ওই যে! ওই যে আমাদের প্রাণী!

একটা বরফের গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা লোমশ জানোয়ার। এক ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়। সেটা। জানোয়ারটা চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হামবোল্ট মাইক্রোম্যাগনাস্কোিপটা চোখে লাগল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল–

বুঝেছি! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাগুলো বেঁটে বেঁটে, মাথার সামনের দিকে দুটো শিং, ঘাড়ে-গদানে চেহারা। এ হল লোমশ গণ্ডার! আমাদের স্তন্যপায়ী জানোয়ার!

এবার আমি চোখে লাগালাম যন্ত্রটা। হামবোল্ট ঠিকই বলেছে। গণ্ডারের আদিম সংস্করণ-যাকে বলে Wooly Rhinoceros। বরফের দেশেই বাস করত এ জানোয়ার।

বুঝতে পারলাম, আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরে এভোলিউশন বা ক্রমবিবর্তনের ধারা ঠিকই বজায় আছে। আজকের বিবর্তনের ঘটনাটা যে আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। আমাদের ষোলো ঘণ্টা এক নাগাড়ে ল্যাবরেটরিতে বসে থাকা সার্থক হয়েছে।

কাল সকালে সামারভিলকে আরেকটা ফোন করে তাকে একবার আসতে বলব। এমন একটা অলৌকিক ঘটনা কেবলমাত্র দুটি বৈজ্ঞানিকের সামনে ঘটে চলবে, এটা অন্যায়, এটা হতে দেওয়া চলে না।

১৭ই মার্চ

আজ সাংঘাতিক গণ্ডগোল। আজ আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে এ যাত্রা বেঁচে গেছি, কিন্তু কী ধরনের বিপদসংকুল পরিবেশে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কী হল সেটা গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।

সামারভিলকে আর একবার টেলিফোন করার কথা কালকেই মনে হয়েছিল। হামবোল্ট সম্পর্কে ও কী বলতে চেয়েছিল সেটা জানার জন্যও একটা কৌতূহল হচ্ছিল। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোতে যাব, এমন সময় হামবোল্ট জিজ্ঞেস করল, কোথায় যােচ্ছ?

বললাম, গিরিডিতে আমি রোজ সকালে হাঁটতে বেরোই, তাই এখানে এসেও মাঝে মাঝে সেটার প্রয়োজন বোধ করি।

হামবোল্ট শুকনো গলায় বলল, সেদিন পোস্টাপিস থেকে কাকে টেলিফোন করেছিলে?

আমি তো অবাক। লোকটা জানল কী করে? সারা শহরে কি গুপ্তচর বসিয়ে রেখেছে নাকি হামবোল্ট?

আমার প্রশ্নটা বোধ হয় আচা করেই হামবোল্ট বলল, এ শহরের প্রত্যেকটি লোককে আমি চিনি, প্রত্যেকেই আমাকে সমীহ করে। আমার বাড়িতে একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক অতিথি এসে রয়েছে, সে খবরও সকলে জানে। তাদের যে কোনও একজনের কাছ থেকে খবরটা আমার কানে আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক?

আমি বললাম, অস্বাভাবিক নয় মোটেই। কিন্তু তোমার এভাবে আমাকে জেরা করাটা আমার অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবু-যখন জিজ্ঞেস করছ, তখন বলছি-আমার এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম।

কোথায়?

লন্ডনে।

সে কি বৈজ্ঞানিক?

হ্যাঁ।

কী বলেছিলে তাকে?

আমার ভারী বিরক্ত লাগল। লোকটা ভেবেছে কী? হতে পারে। আমি তার অতিথি; হতে পারে সে আমাকে তার ল্যাবরেটরিতে তার সঙ্গে একজোটে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু তাই বলে কি সে আমায় কিনে রেখেছে? আমার নিজের কোনওই স্বাধীনতা নেই? বললাম, দুজন বন্ধুর মধ্যে কী কথা হচ্ছিল, সেটা জানার জন্য তোমার এত কৌতূহল কেন বুঝতে পারছি না।

হামবোল্ট চাপা অথচ কৰ্কশ গলায় বলল, কৌতূহল হচ্ছে এই কারণেই যে আমার ল্যাবরেটরিতে যেটা ঘটছে, সেটা সম্বন্ধে কোনও মিথ্যে খবর বাইরে প্রচার হয় সেটা আমি চাই না।

মিথ্যে খবর বলতে তুমি কী বোঝা?

হামবোল্ট এতক্ষণ চেয়ারে বসেছিল। এবার সে চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এসে, আমার মুখের সামনে মুখ এনে সাপের মতো ফিসফিসে গলায় বলল, পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে প্রথম প্ৰাণ সৃষ্টির সমস্ত কৃতিত্ব হল কর্নেলিয়াস হামবোল্টের। এ কথাটা যেন মনে থাকে।

বুঝতে পারলাম, সামারভিলকে ফোনটা আর করা হবে না। মুখে কিছু বললাম না, যদিও লোকটাকে চিনতে আর বাকি ছিল না। কিন্তু একবার যখন বেরোব বলেছি, তখন বেরোলাম। গেট থেকে বেরিয়ে এসে বাঁ দিকের রাস্তায় শহরের দিকে না গিয়ে ডান দিকের রাস্তাটা ধরে পাহাড়ের উপর দিকটায় চললাম। এ রাস্তাটা দিয়ে প্রথম দিনই বেড়িয়ে এসেছিলাম। কিছু দূর গেলেই একটা সুন্দর নিরিবিলি বার্চের বন পড়ে। সেখানে একটা বেঞ্চিতে বসলে দুহাজার ফুট নীচে কনস্ট্যানস লেক দেখা যায়।

বার্চ বনে পৌঁছে বেঞ্চিটা খুঁজে বার করে বসতে যাব, এমন সময় কনের পাশ দিয়ে তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ করে কী যেন একটা জিনিস তিরবেগে বেরিয়ে গিয়ে আমার তিন হাত দূরে একটা বার্চ গাছের গুড়িতে গিয়ে বিঁধে গেল।

সেই মুহুর্তেই পিছন ফিরে দেখতে পেলাম একটা ব্ৰাউন কোট পরা লোক প্রায় একশো গজ দূরে এক দৌড়ে একটা ঝোপের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি প্রায় কোনও অবস্থাতেই নাভসি হই না। এখনও হলাম না। বেঞ্চি ছেড়ে গাছটার দিকে গিয়ে তার গায়ে টাটকা নিখুঁত গর্তটা পরীক্ষা করে দেখলাম। যদিও কোনও বন্দুকের আওয়াজ আমি পাইনি, এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে, গর্তটা হয়েছে গুলি লাগার ফলেই। অস্ত্রটিও যে মোক্ষম—সেটা বুঝতে বাকি রইল না, কারণ গুলি গুড়ির একদিক দিয়ে ঢুকে বেমালুম অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে।

আমি আর অপেক্ষা না করে ধীর পদক্ষেপে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

হামবোল্টের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেই দেখতে পেলাম চাকর ম্যাক্সকে। তার গায়ে একটা ব্ৰাউন চামড়ার জ্যাকেট। ম্যাক্স আমাকে দেখে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গেট দিয়ে বেরিয়ে শহরের দিকে চলে গেল।

বাড়িতে ঢুকে বৈঠকখানার দিকে যেতেই দেখলাম হামবোল্ট দুজন অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে কথা বলছেন। আমাকে দেখে নির্বিকারভাবে তিনি ডাক দিলেন—কাম ইন, প্রোফেসর শঙ্কু।

আমি নির্বিকারভাবেই বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলাম। আগন্তুক দুটি উঠে দাঁড়ালেন। একজন ছোকরা, অন্যটি মাঝবয়সি। তাদের হাতে খাতা-পেনসিল দেখে আন্দাজ করলাম তারা খবরের কাগজের রিপোর্টার। হামবোল্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাঝখানে আমি এসে পড়েছি। হামবোল্ট আমার পরিচয় দিলেন, এবং যেভাবে দিলেন, তাতে বুঝলাম যে লোকটার ধৃষ্টতা একেবারে চরমে পৌঁছে গেছে।

ইনিই হচ্ছেন আমার ভারতীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার কথা আপনাদের বলছিলাম।

আমি করমর্দন করে একটা ভদ্রতাসূচক মৃদু হাসি হেসে এক্সকিউজ মি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ল্যাবরেটরিতে চলে গেলাম।

টেবিলের কাছে পৌঁছে ফ্লাস্কের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।

বরফ আর নেই। তার জায়গায় এখন রয়েছে একটা সবুজ বন, আর সেই বনে ঘোরাফেরা করছে আর একটি নতুন প্রাণী, যার নাম বানর। যাকে বলা হয় প্রাইমেট। যিনি হলেন মানুষের পূর্বপুরুষ।

কথাটা মনে হতেই বুকের ভিতরটা কী রকম যেন করে উঠল।

এর পরেই কি তা হলে মানুষের দেখা পাব ফ্লাস্কের মধ্যে? ক্রমবিবর্তনের নিয়ম যেভাবে মেনে চলেছে আমাদের প্রাণী, তাতে তো মনে হয় বানরের পরে মানুষের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। হামবোল্ট কি দেখেছে ফ্লাস্কের এই বানরকে?

তারপরেই মনে হল, আজকে বার্চ বনে আমাকে লক্ষ্য করে মারা নিঃশব্দ বন্দুকের কথা। হামবোল্ট চাইছে না। আমি বেঁচে থাকি। ম্যাক্সের কাছে অস্ত্ৰ আছে। প্ৰভুভক্ত ম্যাক্স একবার ব্যর্থ হয়েছে বলে দ্বিতীয়বারও হবে এমন কোনও কথা নেই।

শয়তানির বিরুদ্ধে শয়তানি প্রয়োগ করা ছাড়া হামবোল্ট আমার জন্য আর কোনও রাস্তা রাখছে না।

আমি দোতলায় আমার ঘরে চলে গেলাম। আমার অমনিস্কোপটা বার করে চোখে লাগিয়ে জানালার ধারে চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। আমার এই চশমাটাকে ইচ্ছামতো মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ অথবা এক্সরেস্কোপ হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

আমার জানালা থেকে বাড়ির সামনের গোটটা দেখা যায়।

পৌনে দশটার সময় ম্যাক্স বাড়ি ফিরল। তার হাতে বাজার থেকে কিনে আনা জিনিসপত্র।

পাঁচ মিনিট পরে আমি কলিং বেল টিপলাম। এক মিনিটের মধ্যে ম্যাক্স ঘরে এসে হাজির।

আমাকে এক কাপ কফি এনে দিতে পারবে? বললাম ম্যাক্সকে।

যে আজ্ঞে বলে ম্যাক্স ঘাড়টাকে সামান্য নুইয়ে কফি আনতে চলে গেল। আমার চোখে এক্স-রে চশমা। সে চশমা ম্যাক্সের চামড়ার কোট ভেদ করে আমাকে দেখিয়ে দিল তার ভেস্ট পকেটে রাখা লোহার পিস্তলটিা।

কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাক্স কফি সমেত হাজির। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখার পর আমি তাকে বললাম, ম্যাক্স, আলমারির চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না; তোমার কোর্টের বাঁ পকেটে যে চাবির গোছোটা আছে, তার মধ্যে কোনওটা ওতে লাগবে কি?

ম্যাক্সের মুখ হাঁ হয়ে গেল, এবং সেই হাঁ অবস্থাতেই সে একদৃষ্টি আমার দিকে চেয়ে রইল। হেসে বললাম, আমি ইন্ডিয়ার লোক, জানি তো? আমাদের অনেকের মধ্যেই নানারকম অস্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে। তুমি অবাক হচ্ছি। কেন?

ম্যাক্স তোতলাতে শুরু করল। আপনি আ-মারি প-পকেটে কী আছে…

আরও জানি। শুধু তোমার বাঁ পকেটে কেন—ডান পকেটে খুচুরো পয়সাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, আর ভেতরের ভেস্ট পকেটে পিস্তলাটা-যেটা দিয়ে তুমি আমায় খুন করতে গিয়েছিলে। ভারী অন্যায় করেছিলে তুমি। দেখলে তো আমাকে মারা অত সহজ নয়। এখন কত দেবতার কত অভিশাপ পড়বে তোমার উপর, সেটা ভেবে দেখেছি?

ম্যাক্স দেখি ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। এই শীতের মধ্যেও তার কপালে ঘাম ছুটিছে। মনে মনে আমার হাসি পেলেও বাইরে একটা কঠোর গভীৰ্য অবলম্বন করে বসে রইলাম।

ম্যাক্স হঠাৎ ধাপ করে হাঁটু গেড়ে কাঠের মেঝের উপর বসে পড়ল। তারপর তার কম্পমান ডান হাত জ্যাকেটের ভিতর থেকে পিস্তলটি বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদের সুরে বলল, দোহাই আপনার-এর জন্যে আমাকে দায়ী করবেন না। আমি শুধুমানবের হুকুম পালন করেছি। না করলে নিস্তার পাব না, তাই করেছি। আমার অপরাধ নেবেন না-দোহাই আপনার! আমার মনিবকে আপনি চেনেন না। উনি বড় সাংঘাতিক লোক। আমি এ চাকরি থেকে রেহাই পেলে বাঁচি.

আমি পিস্তলটি ম্যাক্সের হাত থেকে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সেটা যে হামবোল্টেরই তৈরি, সেটা বুঝতে পারলাম। বললাম, এর গুলি নেই তোমার কাছে?

আজেজ্ঞ না। একটি মাত্র ছিল, সেটা আজ সকালে খরচ করে ফেলেছি। গুলি তো আমার মনিব নিজেই তৈরি করেন।

বললাম, তোমার মনিব আবার তোমার কাছে পিস্তল ফেরত চাইবেন না তো?

মনে হয় না। ওটা আমার কাছেই থাকে। আমি শুধু ওঁর চাকর নই। ওঁর দেহরক্ষীর কাজও আমাকে করতে হয়।

ম্যাক্স চলে গেল। আমিও হাঁপ ছেড়ে চোখ থেকে অমনিস্কোপটা খুলে পকেটে রেখে কফিতে চুমুক দিলাম। মনে মনে স্থির করলাম, এখন আর ঘর থেকে বেরোব না। হামবোল্টের মুখ দেখতেও ইচ্ছে করছিল না। সেও এখন আর আমার ঘরে আসবে না বলেই আমার বিশ্বাস। দেখা হবে সেই একেবারে লাঞ্চের সময়।

১৯শে মার্চ

গত দুদিনের ঘটনা এত বিচিত্র, এত বিস্ময়কর ও এত আতঙ্কজনক যে সবটুকু গুছিয়ে লেখা আমার মতো অ-সাহিত্যিকের পক্ষে একটা দুরূহ কাজ। ভাগ্যে সামারভিল এসে পড়েছে। একজন সহৃদয় সমঝদার বন্ধুকে কাছে পেয়ে তবু মনে একটু বল পাচ্ছি। ভাবছি, ফেরার পথে সাসেক্সে ওর কাস্ট্রি হাউসে কিছুদিন কাটিয়ে যাব। ওরাও তাই ইচ্ছে। সত্যি বলতে কী, বিষাক্ত গ্যাসের ফলে শরীরটাও একটু কাবু হয়েছে। সরাসরি দেশে না ফেরাই ऊळल!

পরশু—অর্থাৎ ১৭ই-লাঞ্চের সময় হামবোল্টের সঙ্গে দেখা হল। খেতে বসে লক্ষ করলাম, লোকটার মেজাজটা বেশ খোশ বলে মনে হচ্ছে। তার ফলে খাওয়ার পরিমাণ আর তৃপ্তিটাও যেন বেশ বেড়ে গেছে। তার কথা শুনে বুঝলাম যে, সে ভী ভেল্ট সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের শুধু তার সফল পরীক্ষার কথাই বলেনি, তাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে প্রাণীর-অৰ্থাৎ মানুষের পূর্বপুরুষের—চেহারাটাও দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। কাগজে নাকি খুব ফলাও করে হামবোল্টের কৃতিত্বের কথা লেখা হবে।

আমার পকেটে হামবোল্টের তৈরি মারণাস্ত্র; চাকর ম্যাক্স মনিবপক্ষ ছেড়ে আমার দিকে চলে এসেছে। কাজেই আমারও খাওয়ার কোনও কমতি হল না।

অন্য সব পদ শেষ করে যখন আপেলের কাস্টার্ড খাচ্ছি, তখন হামবোল্ট হঠাৎ বলল, তুমি কবে দেশে ফেরার কথা ভাবিছ?

বুঝলাম, আমার সান্নিধ্য আর হামবোল্টের পছন্দ হচ্ছে না। বললাম, প্রাণীটার চরম পরিণতি সম্পর্কে একটা স্বাভাবিক কৌতূহল আছে বুঝতেই পারছি। সেটা দেখেই ফিরে যাব।

আই সি…

এর পরে আর হামবোল্ট কোনও কথা বলেনি।

বিকেলে বার্চ বনে আর একটু বেড়িয়ে এসে সন্ধ্যা ছটা নাগাদ আবার ল্যাবরেটরিতে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি, হামবোল্ট কাঠের চেয়ারটায় চুপটি করে বসে একদৃষ্টি ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ থেকেই আকাশে মেঘ জন্মছিল। এবারে দেখলাম, জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।

ফ্লাস্কের ভিতরে এখনও আদিম বনে আদিম বানর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরিবর্তন কোন সময় হবে, বা আদৌ হবে কি না, সেটা জানার কোনও উপায় নেই। ঘরের কোণে একটা গোল টেবিলের উপর থেকে একটা ফরাসি পত্রিকা তুলে নিয়ে সোফায় বসে পাতা উলটোতে লাগলাম।

বৈঠকখানার ঘড়িতে ঢং ঢেং করে সাতটা বাজার আওয়াজ পেলাম। বাইরে অন্ধকার। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুরু হয়েছে। নেপোলিয়নটা একবার গভীর গলায় ডেকে উঠল।

বসে থাকতে থাকতে বোধ হয় সামান্য তন্দ্ৰা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বিশ্ৰী শব্দে একেবারে সজাগ হয়ে উঠলাম।

হাম্‌বোল্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্লাস্কের দিকে ঝুঁকে পড়েছে—তার বিস্ফারিত, ঠোঁট দুটো ফাঁক। আওয়াজটা তারই মুখ দিয়ে বেরিয়েছে সেটাও বুঝতে পারলাম।

আমি সোফা ছেড়ে উঠে ফ্লাস্কটার দিয়ে এগিয়ে গেলাম।

গিয়ে দেখি তার ভিতরে এখন সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য, নতুন পরিবেশ। বন নেই, মাটি নেই, গাছপালা নেই, কিছু নেই। তার বদলে আছে একটা মসৃণ সমতল মেঝে, তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটি এক ইঞ্চি লম্বা প্ৰাণী।

এই প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে বানর থেকে। অর্থাৎ এই প্রাণী হল মানুষ। কী রকম চেহারা ফ্লাস্কের এই মানুষটির?

হামবোল্টের কম্পমান হাত থেকে মাইক্র্যোম্যাগনাস্কোপটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। আমি সেটাকে নিয়ে চোখে লাগাতেই প্রাণীর চেহারাটা আমার কাছে স্পষ্ট হল।

মানুষটি বয়সে বৃদ্ধ। পরনে কোট-প্যান্ট, মাথায় চুল নেই বললেই চলে, তবে দাড়ি-গোঁফ আছে, আর চোখে এক জোড়া সোনার চশমা। প্রশস্ত ললাট, চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে মেশানো একটা শান্ত সংযত ভাব।

এ লোকটাকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি। আয়নায়। ইনি হলেন স্বয়ং ত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কুর একটি অতি-সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।

অর্থাৎ—আমার তৈরি মানুষ দেখতে ঠিক আমারই মতন।

দেখা শেষ করে মাইক্রোম্যাগনাস্কোপটা টেবিলের উপর রেখে দেওয়া মাত্র খেয়াল হল যে, হামবোল্ট আর আমার পাশে নেই। সে হঠাৎ কোথায় যেতে পারে ভাবতে না ভাবতেই দুম দুম করে দুটো প্রচণ্ড শব্দে ল্যাবরেটরির দুটো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই জানোলা দুটো। বুঝলাম যে আমি বন্দি হয়ে গেলাম।

হামবোল্টের কী মতলব জানি না। পরীক্ষার সাফল্যের জন্য যে আমিই দায়ী তার এমন জলজ্যান্ত প্রমাণ পেয়ে নিশ্চয়ই সে একেবারে উদভ্ৰান্ত হয়ে পড়েছে। হয়তো আমাকে হত্যা করার রাস্তা খুঁজছে সে। অস্ত্ৰ সংগ্রহ করে হত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে তবে সে দরজা খুলবে।

কী হবে যখন জানা নেই, তখন ভেবে কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে বরং আমার কয়েদখানার পরিবেশটিা একবার ভাল করে দেখে নিই।

একদিকে টেবিলের উপর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, তারমধ্যে ফ্লাস্ক, তারমধ্যে খুদে-আমি। তার ডান পাশের দেয়ালে দুটো বন্ধ দরজার মাঝখানে একটা বইয়ের আলমারি, তার পরের দেয়ালে দুটো বন্ধ জানালার মাঝখানে একটা রাইটিং ডেস্ক। অন্য দেয়ালটার সামনে সোফা, আর তার পাশে ঘরের কোণে একটা নিচু গোল টেবিল। পালাবার কোনও পথ নেই।

মনে পড়ল আমার সর্বনাশী ব্ৰহ্মাস্ত্র অ্যানাইহিলিন পিস্তলটিা গিরিডিতে রেখে এসেছি। আমার সঙ্গে হামবোল্টের পিস্তলটাি রয়েছে, কিন্তু সেটাও গুলির অভাবে অকেজো। কী আর করি? কাঠের চেয়ারটার উপর বসে। ফ্লাস্কের ভিতরে আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে মন দিলাম।

খুদে শঙ্কু কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর দেখলাম হাত দুটোকে পিছনে করে পায়চারি আরম্ভ করল। মনে পড়ল আমিও চিন্তিত হলে ঠিক এইভাবেই পায়চারি করি। দৃশ্যটা আমাকে আবার এমন অবাক করে তুলল যে আমি আমার বিপদের কথা প্রায় ভুলেই গেলাম।

কতক্ষণ এইভাবে তন্ময় হয়ে ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ খেয়াল হল যে আমার দৃষ্টি কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপর বুঝতে পারলাম যে সেটার কারণ আর কিছুই না—কোথা থেকে জানি ঘরের মধ্যে একটা বাষ্প জাতীয় কিছু ঢুকছে। একটা তীব্র বিশ্ৰী গন্ধ নাকে এসে প্রবেশ করছে।

চারিদিকে আর একবার ভাল করে দেখে অবশেষে বুঝতে পারলাম, কোথা দিয়ে এই গ্যাসটা আসছে। ল্যাবরেটরির দুষিত বায়ু বাইরে যাবার জন্য একটা চিমনি রয়েছে টেবিলটার পিছন দিকে। সেটা চলে গেছে বাড়ির ছাত অবধি। সেই চিমনির মুখটা দিয়েই এই দুৰ্গন্ধ গ্যাস ঘরে এসে ঢুকছে।

আমি নাকে রুমাল চাপা দিলাম। গ্যাস ক্রমে বাড়ছে। সবুজ ধোঁয়ায় ঘর ক্রমে ছেয়ে যাচ্ছে। আমার চোখে অসহ্য জ্বালা। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। তার মধ্যেই বুঝতে পারছি এটা সেই সাংঘাতিক কাবোঁডিমন গ্যাস-যাতে মানুষ পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবি খেয়ে দম আটকিয়ে মরে যায়।

আমি আর চেয়ারে বসে থাকতে পারছিলাম না। উঠে দাঁড়ালাম। রুমালে কোনও কাজ দিচ্ছে না। ঘরের যন্ত্রপাতি টেবিল চেয়ার, এমনকী আমার সামনে ফ্লাস্কটা পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে আসছে। একটা অন্ধকার পরদা নেমে আসছে আমার সামনে। আমি দাঁড়িয়েও থাকতে পারছি না। আমার সামনে টেবিল। আমি টেবিলের ওপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমার বেড়ালের কথা মনে হচ্ছে.প্রহ্লাদ…গিরিডি.আমার বাগান…গোলঞ্চ

কী যেন একটা ঝলসে উঠল আমার চোখের সামনে। এক বিঘাতের মধ্যে। সেই ঝলসানিতে স্পষ্ট দেখলাম ফ্লাস্কটা। তাতে আর খুদে-শঙ্কু নেই। তার জায়গায় পর পর তিনবার বৈদ্যুতিক স্পার্ক খেলে গেল। বুঝলাম আমি আমার দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছি, শরীরে বল পাচ্ছি, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি। ঘরের ভিতর থেকে গ্যাস দূরীভূত হচ্ছে, দুৰ্গন্ধ চলে যাচ্ছে, ধোঁয়াটে ভাবটা ক্রমশ কমে আসছে। আমার অবাক দৃষ্টি এখনও ফ্রাস্কের ভিতর। পরিবেশ বদলে গেছে। সিমেন্টের বদলে এখন একটা স্বচ্ছ কাচ কিংবা প্লাস্টিকের মাঝে যেখানে স্পার্ক হচ্ছিল, সেখানে এখন নতুন প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে।

এমন প্রাণী আমি জীবনে কখনও দেখিনি। লম্বায় দুইঞ্চির বেশি নয়, তার মধ্যে মাথাটাই এক ইঞ্চি। শরীরে রামধনু রঙের পোশাকটা পা থেকে গলা অবধি গায়ের সঙ্গে সাঁটা। নাক কান ঠোঁট বলতে কিছুই নেই। চোখ দুটো জ্বলন্ত অথচ স্নিগ্ধ আগুনের ভাঁটা। মাথা জোড়া মসৃণ সোনালি টাক। হাত দুটো কনুইয়ের কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। তাতে আঙুল আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।

আমি আরও এগিয়ে গিয়ে ভাল করে প্রাণীটাকে দেখব, এমন সময় ঘরের একটা দরজা খুলে গেল।

হামবোল্ট, আর তার পিছনে তার গ্রেট ডেন হাউন্ড নেপোলিয়ন।

হামবোল্ট আমাকে দেখেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বোঝাই গেল, সে আমাকে জ্যান্ত দেখতে পাবে সেটা আশাই করেনি।

গ্যাস? গ্যাস কী হল? সে বোকার মতো বলে উঠল।

আমি বললাম, আপনা থেকেই উবে গেছে।

সুঃ নেপোলিয়ন।

হামবোল্ট এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর। ওই বিশাল কুকুরটা একটা হিংস্র গর্জন করে দাঁত খিঁচিয়ে একটা লম্ফ দিল আমাকে লক্ষ্য করে।

কিন্তু আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাল না। শূন্যে থাকা অবস্থাতেই একটা তীব্র রশ্মি এসে তার গায়ে লেগে তাকে তৎক্ষণাৎ ধরাশায়ী করে দিল। রশ্মিটা এসেছে ফ্লাস্কের ভিতর থেকে।

এবার হামবোল্ট নেপোলিয়ান বলে একটা চিৎকার দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে কুকুরটার দিকে একবার দেখে টেবিলের উপর থেকে একটা মারাত্মক অ্যাসিডের বোতল তুলে নিয়ে সেটা আমার দিকে উঁচিয়ে তুলতেই তারও তার কুকুরের দশাই হল। ফ্লাস্কের ভিতর সদ্যোজাত অদ্ভুত প্রাণীটা ওই বিরাট জামান বৈজ্ঞানিককেও তার আশ্চর্য রশ্মির সাহায্যে নিমেষে ঘায়েল করল।

হামবোল্ট এখন তার পোষা কুকুরের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পরীক্ষা করে দেখলাম, দুজনের একজনও মরেনি, কেবল সম্পূর্ণভাবে অচেতন।

এই ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামারভিল এসে হাজির। সব শুনেটুনে সে বলল, হাম্‌বোল্ট প্রায় বছর দশেক উন্মাদ অবস্থায় গারদে কাটিয়েছিল, তারপর ভাল হয়ে ছাড়া পায় কিন্তু সেই সময় থেকেই বৈজ্ঞানিক মহলে তার সমাদর কমে যায়। গত কয়েক বছর ধরে যেখানে সেখানে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে সে আমন্ত্রিত না হয়েও গিয়ে হাজির হয়েছে। পাছে আবার পাগলামিগুলো দেখা দেয়, তাই ওকে আর কেউ ঘটায় না। তুমি ব্যাপারটা জানতে না শুনে আমার আশ্চর্য লাগছে। সেদিনই তোমাকে টেলিফোনে সাবধান করে দিতাম, কিন্তু লাইনটা কেটে গেল। তাই ভাবলাম, নিজেই চলে আসি।

দোতলায় আমার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে এই সব কথা হচ্ছিল। হামবোল্ট ও তার কুকুরকে তাদের উপযুক্ত দুটি আলাদা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের শক লেগেছে মস্তিষ্কে। কতদিনে সারবে বলা যায় না।

সামারভিল এসেই ফ্লাস্কের আশ্চর্য প্রাণীটাকে দেখেছিল। দুজনেই বুঝেছিলাম যে, এটাই হল মানুষের পরের অবস্থা; যদিও কত হাজার বা কত লক্ষ বছর পরে মানুষ এ চেহারা নেবে সেটা জানার উপায় নেই।

কফি খাওয়া শেষ করে আমরা দুজনেই স্থির করলাম যে খুদে-সুপারম্যান বা অতি-মানুষটি কী অবস্থায় আছে একবার দেখে আসা যাক। ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই আবার একটা অপ্রত্যাশিত অবাক দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল।

সমস্ত ফ্লাস্কের ভিতরটা এখন একটা লালচে আভায় ভরে আছে। সূৰ্য্যস্তের পর মাঝে মাঝে আকাশটা যে রকম একটা বিষগ্ন আলোয় ভরে যায়, এ যেন সেই আলো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মেঝের বদলে এখন দেখতে পেলাম বালি, আর সেই বালির উপর একটা চ্যাপটা আঙুরের মতো জিনিস নিজীবিভাবে পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মধ্যে একটা মৃদু স্পন্দনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে।

এটাও কি প্রাণী? এটাও কি মানুষের আরও পরের একটা অবস্থা? যে অবস্থায় মানুষের উত্তরপুরুষ একটা মাংসপিণ্ডের মতো মাটিতে পড়ে থাকবে, তার হাত থাকবে না পা থাকবে না, চলবার, কাজ করবার, চিন্তা করবার শক্তি থাকবে না, কেবল দুটি প্রকাণ্ড চোখ দিয়ে সে পৃথিবীর শেষ অবস্থাটা ক্লান্তভাবে চেয়ে চেয়ে দেখবে?

সামারভিল বলল, এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না শঙ্কু। একটা কিছু করো।

কিন্তু কিছু করতে আর হল না। আমরা দেখতে দেখতেই চোখের সামনে একটা ক্ষীণ বাঁশির মতো শব্দের সঙ্গে সেই আলো, সেই বালি আর সেই মাংসপিণ্ড, সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে ক্রমবিবর্তনের শেষ পর্ব শেষ হয়ে পড়ে রইল। শুধু একটি কাচের ফ্লাস্ক আর তার সামনে দাঁড়ানো দুটি হতভম্ব বৈজ্ঞানিক!

সন্দেশ। শারদীয়া ১৩৭৮

আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

আমার আমেরিকার গ্রিন কার্ডটি মনে হচ্ছে বাতিল হতে যাচ্ছে। কারণ কী? আমি কি মুসলিম মৌলবাদী? সন্ত্রাসী? আমেরিকার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? না। আমি বরং মুসলিম মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের পক্ষে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করা মানুষ। আমাকে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়েছিল ‘এক্সট্রা অরডিনারি অ্যাবিলিটি’ বা অসাধারণ দক্ষতার জন্য। আমার পরিবারের লোকেরা আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছে, কারণ তারা আমার পরিবার। আর এখন কিনা, আর যারাই ঢুকতে পারুক আমেরিকায়, আমি পারবো না। সুইডিশ পাসপোর্ট হাতে নিয়েও পারবো না। আমি ট্রাম্পের সমালোচক, তাই বলে? কিন্তু আমার সমালোচনা আর ক’জন শুনেছে? আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি মানুষ। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ কারা ট্রাম্পের নিন্দে করে, হোয়াইট হাউস তার হিসাব রাখে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় না, সব সমালোচকের আমেরিকায় প্রবেশ করা অথবা বাস করা নিষিদ্ধ। তাহলে কেন আজ আমেরিকায় ঢোকার অনুমতি জুটছে না আমার! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি, আমেরিকার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করিনি। কাউকে মারিনি ধরিনি। কারও পাকা ধানে মই দিইনি। নিরীহ সাদাসিধে ভালো মানুষটিকে কেন জীবনভর ভুগতে হবে একা! আমার মনে হয়, আমেরিকার সীমান্ত রক্ষীরা আমার নামটিকে পছন্দ করছে না, এই নামে, অনেকে বিশ্বাস করে, মুসলিম মুসলিম গন্ধ আছে। আমার আরও মনে হয়, ওরা পছন্দ করছে না যে দেশে আমি জন্মেছি সে দেশের নামটিকেও! পছন্দ করছে না আমার গায়ের রঙ। সে কারণে আমার গ্রিন কার্ডটিকে বাতিল করার ছুতো খুঁজছে, অবান্তর প্রশ্ন করছে, কেন তুমি তোমার গ্রিন কার্ড হারিয়ে যাওয়ার পর দূতাবাসকে সঙ্গে সঙ্গে জানাওনি! দূতাবাসকে জানাতে আমার দু’মাস দেরি হলো বলে আমি নিষিদ্ধ হয়ে যাবো! কাম অন।

ট্রাম্প ৭টি মুসলিম দেশের মানুষের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আসলে তিনি মুসলমান নামের মানুষগুলোকেই বাধা দিতে চাইছেন। যখন আমার আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হচ্ছে, ট্রাম্প তখন মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে দুলে দুলে তলোয়ার-নাচ নাচছেন। তিনি মুসলিমদের নিষিদ্ধ করেন, কিন্তু মুসলিম-মৌলবাদীদের নিষিদ্ধ করেন না। মুসলিম মৌলবাদী— যারা টাকা-পয়সা দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে টিকিয়ে রাখছেন, তাঁরা আজ ট্রাম্পের কাছের লোক। তাঁরা হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনেন, যে অস্ত্র সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর কাজে নয়, সন্ত্রাসবাদকে আরও বিস্তৃত করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ট্রাম্প সুন্নিদের দেশে গিয়ে সন্ত্রাসবাদের জন্য দোষ দিয়ে দিলেন শিয়াদের দেশ ইরানকে। এ ঠিক কেমন বুদ্ধিমানের কাজ করলেন, যখন সারা বিশ্বে সন্ত্রাস করছে যারা, তাদের প্রায় সবাই সুন্নি এবং সৌদি রাজপরিবারের ধর্ম ওহাবিবাদে বিশ্বাসী! অস্ত্র কিনেছে বলে সৌদি আরবের সবাইকে ট্রাম্প ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু সৌদি আরবের সবাই তো অস্ত্র কেনেনি, কিনেছে সৌদি আরবের রাজপরিবার। এই রাজপরিবারের সঙ্গে আমেরিকার প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর সম্পর্ক খুব মধুর। মধুর সেই ১৯৪৩ সাল থেকেই। সেই কত আগে রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ’ গত সত্তর বছরে সৌদি আরব অবিশ্বাস্য সংখ্যক অস্ত্র কিনছে আমেরিকার কাছ থেকে। ওবামাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও ওবামার আমলে ২০১০ সালে সৌদি আরব কিনেছে ৬০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র।

ট্রাম্প কী বলেছিলেন সৌদি আরব সম্পর্কে। মনে আছে সে সব? তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় সৌদি আরব সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘এরা উঁচু দালান থেকে সমকামীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরা মেয়েদের মেরে ফেলে, মেয়েদের অকথ্য অত্যাচার করে। ’ আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘হাত সৌদি আরবের’। সন্ত্রাসী হামলার পেছনে যাদের হাত, তাদের কাছে আজ ট্রাম্প অস্ত্র বিক্রি করছেন। তাহলে কি ট্রাম্পকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধের মানুষ বলা যায়? নিশ্চয়ই যায় না। আমেরিকার এই অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনের গরিবদের মারবে। এর মধ্যে দশ হাজার লোক মরেছে, অগুনতি ইয়েমেনি মানুষ উড়ে গেছে আমেরিকার বানানো বোমায়। গত দু’বছরে সৌদি আরব ইয়েমেনের ওপর ৮১ বার হামলা করেছে। হামলা করেছে আমেরিকা থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে। যত বেশি হামলা হবে আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে, মগজধোলাই হওয়া তরুণেরা তত বেশি অস্ত্র হাতে নিয়ে পাশ্চাত্যের মানুষদের হামলা করবে। ট্রাম্পের বক্তৃতার কিছু পরেই হামলা হলো ম্যানচেস্টারে। ২২ জনের মৃত্যু হলো।

আইসেনহাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমেরিকার মিলিটারি কোম্পানিগুলোর জন্য যা ভালো, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকা এবং বিশ্বের জন্য ভালো নয়। ’ একেবারে খাঁটি কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমেরিকার সরকারে প্রভাবশালী ক’জন এ কথা বিশ্বাস করে?

ট্রাম্পকে সমর্থন করার লোক প্রচুর ছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, ট্রাম্প ইসলামি সন্ত্রাস দূর করবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আশাহত এখন। সন্ত্রাসের সব দোষ ইরানের ওপর চাপিয়ে বিশ্বময় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে যারা, তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে, তলোয়ার নাচ নেচে বন্ধুত্ব আরও গভীর করে এলেন ট্রাম্প। সন্ত্রাস বিলুপ্ত করবেন এই ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে এলেন সন্ত্রাসীদের গুরুর কাছে।

আর এদিকে শুধু আমাকে নয়, মুসলিম দেশে জন্ম অনেককে অযথাই হেনস্তা করছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। আমেরিকা থেকে বের করে দিচ্ছে, অথবা আমেরিকায় ঢুকতে দিতে চাইছে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষও অনুমতি পাচ্ছে না আমেরিকায় প্রবেশের। আগের সরকার যেভাবে দেশ চালিয়েছে, এই সরকারও সেভাবেই দেশ চালাবে। মাঝে মাঝে ভাবী, আমেরিকার ডেমোক্রেট আর রিপাবলিক দলের মধ্যে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমেরিকার সরকার, সে যে সরকারই হোক, যা কিছু করতে পারে। মানবতাকে ধ্বংস করতে তাদের মোটেও অসুবিধে হয় না। এই স্বার্থপর দেশটির দিকে আমরা কি না তাকিয়ে আছি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যে এই দেশটিই শক্ত হাতে সন্ত্রাস মোকাবিলা করবে। আমেরিকা সন্ত্রাস যত নির্মূল করে, তার চেয়ে বেশি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসী তৈরিতে এক সময় তো সাহায্যও করেছে। আমেরিকার সাহায্য ছাড়া আল-কায়েদা, আইসিস জন্ম নিতো না।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

চাই ধর্ষণহীন দিন

এমন একটি দিন আছে, যে দিন ধর্ষণহীন? না এমন দিন নেই। বাংলাদেশের পুরুষদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন স্বীকার করেছেন নিজের স্ত্রী নয় এমন নারীকে তারা কোনও এক সময় ধর্ষণ করেছেন। আসলে, ধর্ষণের এই সংখ্যাটি আরও ভয়াবহ হতো, যদি ধর্ষিতারা মুখ খুলতো, বলতো যে তারা ধর্ষিতা হয়েছে। ধর্ষণ যে একটি অপরাধ তা বেশির ভাগ মানুষ জানে না। ধর্ষককে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করে ধর্ষিতাকে করা হয়। এর চেয়ে বড় লজ্জা একটি সমাজের জন্য আর কিছু নেই। পৃথিবীতে ধর্ষণই একমাত্র অপরাধ যেখানে আক্রান্ত বা ভিকটিমকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

আমেরিকার নারীবাদী লেখিকা মেরিলিন ফ্রেঞ্চ লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি পুরুষই ধর্ষক এবং তাদের এই একটিই চরিত্র। তারা আমাদের ধর্ষণ করে তাদের চোখ দিয়ে, তাদের তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে, তাদের আইন দিয়ে। অল ম্যান আর রেপিস্ট অ্যান্ড দ্যাটস অল দে আর। দে রেপ আস উইদ দেয়ার আইজ, দেয়ার ল’জ, অ্যান্ড দেয়ার কোডস। ’

আর আন্দ্রিয়া ডরকিনের কথা, ‘যতদিন ধর্ষণ নামক জিনিস পৃথিবীতে আছে, ততদিন শান্তি অথবা সুবিচার অথবা সমতা অথবা স্বাধীনতা কিছুই থাকবে না। তুমি আর হতে পারবে না তা, যা তুমি হতে চাও, তুমি আর বাস করতে পারবে না সেই জগতে, যে জগতে তুমি বাস করতে চাও। ’ আন্দ্রিয়া ডরকিন আরও বলেছেন, ‘ধর্ষণ কোনও দুর্ঘটনা নয়, কোনও ভুল নয়। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যৌনতার সংজ্ঞা হলো ধর্ষণ। যতদিন পর্যন্ত এই সংজ্ঞা বহাল থাকবে, ততদিন পর্যন্ত যৌন আক্রমণকারী হিসেবে পুরুষ এবং তার শিকার হিসেবে চিহ্নিত হবে নারী। এই সংস্কৃতিকে স্বাভাবিক যারা মনে করে, তারা ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিদিন ধর্ষণ চালিয়ে যায়। ’

কেউ কেউ বলে, ধর্ষকদের ধর্ষদণ্ডটি কেটে ফেলা উচিত। এর ফলে দ্রুত বন্ধ হবে ধর্ষকদের ধর্ষণ। বন্ধ কি সত্যি হয়? ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হওয়ার পরদিনই ধর্ষণ হয়নি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে? ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন আইন আছে, তারপরও কি ধর্ষণের কিছু মাত্র বন্ধ হয়েছে? যারা বলে মেয়েরা স্বল্প পোশাক পরে চলাফেরা করে বলেই পুরুষেরা তাদের ধর্ষণ করতে উৎসাহী হয়—সেই মোটা মাথাগুলো খুব ভালো জানে যে, বোরখা-হিজাব পরা মেয়েরাও অহরহ ধর্ষিতা হচ্ছে। পোশাক কোনও ঘটনা নয়, ঘটনা এখানে পুরুষাঙ্গ। জন্মের পর থেকে পুরুষেরা শিখে এসেছে তারা জগৎ জয় করতে পারে তাদের দু’ঊরুর মাঝখানের জিনিসটি দিয়ে। এই শিক্ষা ইস্কুল-কলেজে রাস্তাঘাটে চাকরিস্থলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, আইনে কানুনে, শহরে বন্দরে, রাষ্ট্রে রাজ্যে সমাজে সংসারে সবখানেই পুরুষেরা পেয়ে যায়। ঘরে বাইরে যে শিক্ষা এবং যে শিক্ষার চর্চা পুরুষেরা হাজার বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে ক’টা পুরুষের বুকের পাটা তা থেকে নিরস্ত হয়?

বাংলাদেশে অনেক বছর আগে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ইয়াসমিন নামের এক মেয়ে, পনেরো বছর বয়স, ঢাকা শহরের কোনও এক মধ্যবিত্তের বাড়িতে কাজ করতো। কিন্তু বাড়ির কর্তাটি ইয়াসমিনকে রাতে রাতে ধর্ষণ করতো। ইয়াসমিন একরাতে পালালো বাড়ি থেকে। যাচ্ছে সে বাপের বাড়ির দিকে। পথে পুলিশ ধরলো। ‘কোথায় যাচ্ছিস’? ‘বাপের বাড়ি’। ‘বাড়ি তো অনেক দূর, চল তোকে পৌঁছে দিই, গাড়িতে ওঠ। ’ পুলিশের গাড়ি অন্ধকার নির্জনতায় থামলো। ওখানে সাত সাতটা পুলিশ ইয়াসমিনকে মনের আশ মিটিয়ে ধর্ষণ করে, ধর্ষণ শেষে গলা টিপে মেরে ফেলে রাখলো আবর্জনার স্তূপে। এলাকার লোকেরা পরদিন মিছিল বের করলো পুলিশের বিরুদ্ধে। সেই মিছিলে গুলি ছুড়লো পুলিশ, সাতজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হলো। পরদিন সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছিল এরকম, ‘ইয়াসমিন ছিল নষ্ট চরিত্রের মেয়ে, পুলিশ যা করেছে ঠিকই করেছে। ’ এরকম ঘটনা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটে? অন্য কোথাও ঘটে না? আমরা সবাই জানি, ঘটে। রক্ষক সারাক্ষণই ভক্ষক হচ্ছে। হবে না কেন! নারী-ভক্ষণ তো কোনও অন্যায় নয়! কোথায় লেখা আছে অন্যায়! নারী তো ভোগ্য, ভোজ্য, ভক্ষণীয়। এ কথা সকলেই জানে, মানে। পুরোহিত থেকে শুরু করে পাঁচ বছরী পুত্র জানে যে পুরুষ সর্বশক্তিমান। এবং তাদের সর্বময় অধিকার যেমন খুশি নারীকে দলন করা, দমন করা, সর্বময় অধিকার যখন খুশি ধর্ষণ করা, জ্বালিয়ে মারা, পুড়িয়ে মারা। এই জানা মানাটি যেদিন বন্ধ হবে, সেদিনই হয়তো চিরতরে দুঃসময়ের সরে যাবার সময় হবে। নারীকে সম্মান জানানোর রেওয়াজ এই সমাজে নেই। সম্মানের যে সংজ্ঞা পুরুষেরা তৈরি করেছে, তাতে অসম্মান ছাড়া নারীর অন্য কিছু হয় না। বিখ্যাত নারীবাদী ম্যাগাজিন সিজ-এর সম্পাদক রবিন মরগ্যান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ধর্ষণ সম্পর্কে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, ‘যে যৌন সম্পর্কটির উদ্যোক্তা নারী নয়, নারীর সত্যিকার যৌনইচ্ছে থেকে যেটি ঘটে না, সেই যৌন সম্পর্কটি ঘটা মানেই ধর্ষণ ঘটা। ’

পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে পুরুষের ইচ্ছেয়, পুরুষের আওতায় যে যৌনসম্পর্কটি ঘটে, তাতে বৈষম্য শুধু নয়, প্রকটভাবে অকথ্য অত্যাচার না থাকার কোনও কারণ নেই। সর্বত্র যেখানে বৈষম্য এবং পুরুষাধিপত্য, সেখানে তা থাকবেই। বন্ধ ঘরে বীভৎসতা ঘটিয়ে নাম তার লাভ মেকিং দিলেই যেন সাতখুন মাফ।

রবিন মরগ্যান বলেন, ‘রেপ ইজ দ্য পারফেক্টেড অ্যাক্ট অব মেইল সেক্সুয়ালিটি ইন এ পেট্রিআর্কাল কালচার। ইট ইজ দ্য আলটিমেট মেটাফর ফর ডমিনেশন, ভায়োলেন্স, সাবজুগেশন অ্যান্ড পজেশনস। ’

না, আমাদের নারীবাদীরা এমনভাবে বলেন না। কোনওকালেই বলেননি। পশ্চিমের নারীবাদীদের হাত থেকে খুব কম ধর্ষকই বেঁচে যেতে পারে। ওখানকার নারীরা বহুকাল সংগ্রাম করেছেন এই জঘন্য ঘৃণ্য নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কাউকে ছাড় দেননি।

আজ পশ্চিমের যে দেশগুলোয় নারীরা প্রায় পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারে, সেখানে প্রেমে, যৌনতায় নারীর উদ্যোগী এবং সক্রিয় হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নারীই পুরুষকে পছন্দ করে প্রেমের জন্য, নারীই পুরুষকে শারীরিকভাবে কামনা করে, সেই কামনার কথা প্রকাশ করে এবং যৌনক্রিয়ায় নারীই সক্রিয় হয় বেশি।

এ দেশে নারী যত নিষিদ্ধ হবে, পুরুষের যৌনসাধ তত হৈ রৈ করে বাড়বে। যৌন সম্পর্কের জন্য নিষি নারীকেই পছন্দ করে পুরুষ। নারীবাদীরা বলেন, যৌন অধিকার অর্জনের কোনও দরকার নেই নারীর। দরকার শিক্ষার আর স্বনির্ভরতার। নারীবাদ দেশি ব্র্যান্ড। বটে। শিক্ষা আর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেও যে সারা জীবন নারী থেকে যায় পুরুষের যৌনদাসী, সে কি তাঁরা জানেন না, নাকি মানেন না? নাকি তলে তলে পুরুষতন্ত্রের গোড়ায় জল সার দিয়ে তাজা রাখেন তন্ত্রটি!

নারীরা এ দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। নারীদের কোনও অহংকার থাকতে নেই। সেই কবে ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘উই আর, অ্যাজ এ সঙ্গে, ইনফিনিটলি সুপিরিয়র টু ম্যান। ’ ক’টা মেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এ কথা বিশ্বাস করে এবং বলে?

আমরা নারীরা পুরুষের চেয়ে সবদিক থেকে বড়। এ কথা বললে পুরুষ যেমন কৌতুকরসে হেসে ওঠে, নারীও হাসে। কেবল লিঙ্গে নয়, বিবেকে বুদ্ধিতে, বিচক্ষণতায়, বিদ্রোহে, বিস্ফোরণে, বীক্ষণে নারী চিরকালই পুরুষের চেয়ে ঊর্ধ্বে। কিন্তু শক্তিকে শেকলে বন্দী করে রাখা হয়েছে আজ হাজার বছর। সোজা এতকালের শেকল ছেঁড়া?

আমি মনে করি পুরুষবিদ্বেষ হলো একটি সম্মানজনক রাজনৈতিক আদর্শ, যে আদর্শে অত্যাচারিতের অধিকার আছে অত্যাচারী শ্রেণির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছুড়ে দেওয়া। ক’জন বলে এমন কথা এদেশে? এখন তো লিবারেলিজমের যুগ। যত আপস করো, তত ভালো। যত মেনে নাও, তত তুমি সহিষ্ণু, তত তুমি শান্তিকামী। চিরকাল যারা অশান্তি করে, অশান্তি যাদের রক্তে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে, তাদের সঙ্গে কি সত্যিকার কোনও শান্তি চুক্তি হয়, না, হতে পারে?

সেই কতকাল আগে মেরিলিন ফ্রেঞ্চ ‘দ্য উইমেনস রুম’ বইতে লিখেছেন, ‘পুরুষের প্রতি আমার অনুভূতি পুরুষ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সত্যি কথা বলতে কী, পুরুষের প্রতি আমার কোনও সহানুভূতি নেই। ডাখাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এক ইহুদি যেমন কোনও তরুণ নািস সেনাকে পেটে গুলি খাওয়া অবস্থায় কাতরাতে দেখে নির্বিকার হেঁটে চলে যায়, তেমন করে আমি পুরুষ দেখি। আমি এমনকী প্রয়োজনও বোধ করি না কাঁধ শ্রাগের। আমি কেয়ার করি না। মানুষ হিসেবে লোকটি কী ছিল, কেমন ছিল, তার ইচ্ছে অনিচ্ছে এগুলো আমার কাছে কোনও বিষয় নয়। ’

পুরুষকে তুচ্ছ করার শক্তি এবং সাহস এ সমাজে ক’জনের হয়? তুচ্ছ না করলে পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে মুক্তি নেই কোনও নারীর। বিয়েকেও ত্যাগ করেছিল আমাদের লড়াকু পূর্বনারীরা। সাহস আছে কারও এমন কথা উচ্চারণ করার, ‘যেহেতু বিয়ে মানে নারীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করা, নারীবাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বিবাহপ্রথার গায়ে জোরে লাথি মারা। বিবাহপ্রথাকে নির্মূল না করলে নারী স্বাধীনতা কখনই অর্জিত হবে না। ’ ‘না না না আমরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছি। আমরা এগিয়ে গেছি অনেক। আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার পেয়ে গেছি কত আগে। যা বাকি আছে পাওয়ার, তার জন্য পুরুষকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই করবো। ’ ‘সচেতন’ বলে বড়াই করা নারীরাই বলছেন এমন কথা। নারী-পুরুষ উভয়কেই নারীর অধিকারের জন্য লড়তে হবে— এই মত নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলের। কিন্তু ধর্ষককে সঙ্গে নিয়ে সত্যি কি লড়াই করা যায়? দুই বা তিন ইঞ্চি জিনিসটি নিয়ে অহংকার এমন কোনও পুরুষ আছে করে না? যে পুরুষ নিজেদের নারীবাদী বলে, তারাও সময় সময় ঊরুসন্ধিতে হাত রেখে জিনিসটির উপস্থিতি পরখ করে নেয়। ধর্ষকের জাতকে বিশ্বাস করেছো কী মরেছো।

কী ব্যাপার, জাত নিয়ে কথা? হ্যাঁ জাত নিয়েই কথা। পুরুষেরা আলাদা জাত। তারা মনুষ্যজাত থেকে ভিন্ন। এমন কথা প্রচণ্ড রাগ করেও কেউ বলে না এ সমাজে। মেয়েদের রাগ টাগ কি একেবারেই গেল? রাগের মাথায় তো অনেক কিছু করছে মেয়েরা, রাগের মাথায় কেন উচ্চারণ করছে না সত্য, যে সত্য মুখে এসে গেলেও মেয়েদের গিলে ফেলতে হয়!

সূত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন
প্রকাশ : বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭

 ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক

ঢাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে পাঁচজন যুবক। ওই পাঁচ ধর্ষকের দুজন মেয়ে দুটোর বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বন্ধুকে বিশ্বাস করে বন্ধুর আমন্ত্রণে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল মেয়ে দুটো। ঘটনা শুনে আমার মনে পড়েছে ৯১ সালে লেখা আমার নিমন্ত্রণ নামের ছোট উপন্যাসটির কথা। উপন্যাসে মনসুর নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে শীলা, এক কৌতূহলী কিশোরী। একদিন মনসুর তাকে নিমন্ত্রণ করে তার বাড়িতে। সেজেগুজে উপহার নিয়ে শীলা নিমন্ত্রণ খেতে যায় প্রেমিকের বাড়ি। সেই বাড়িতে মনসুর তার সাত বন্ধু নিয়ে সারা রাত ধর্ষণ করে শীলাকে। বইটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেক মা-ই তাদের কিশোরী-কন্যাকে নিমন্ত্রণ বইটি কিনে দিয়েছেন পড়ার জন্য। পুরুষদের যেন ওরা সহজে বিশ্বাস না করে। আমার ওই বই পড়ে কজন মেয়ে সচেতন হয়েছে জানি না। পুরুষেরাও ওই বইটি পড়েছে। আদৌ কোনও পুরুষ শুদ্ধ হয়েছে কি?

বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বইটি লিখেছি বলে অনেক গালিও খেয়েছি। লোকেরা আমাকে লাঞ্ছিত কম করেনি। ধর্ষণের নৃশংসতা আর বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছি বলে আমি ‘নষ্ট মেয়ে’, আমি ‘সেক্স’-এর মতো নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছি, সমাজটাকে নষ্ট করছি, মেয়েদের বিপথে নিচ্ছি। মানুষকে নারী পুরুষের সমান অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবো, নষ্ট সমাজকে বদলাবো— এই পণ করেছিলাম। এই পথ বড় কঠিন পথ। কত যে লাঞ্ছনা আমাকে সইতে হয়েছে, কত যে নির্বাসন! তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লিখে গেছি। আজও লিখছি। আজও প্রতিবাদ করছি ধর্ষণ, নির্যাতন, নারী পুরুষের বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে। মানুষ আমার বই পড়ে সচেতন হলে ভালো লাগে, সার্থক মনে হয় লেখালেখি। আজ চব্বিশ বছর আমি দেশে নেই। আমার বইগুলো মানুষের হাতের নাগালে নেই, প্রকাশকেরা আমার বই ছাপাতে ভয় পান। জানি না, নতুন প্রজন্মের কেউ ‘নিমন্ত্রণ’ পড়েছে কি না।

সমাজের একটি গোষ্ঠী চায় না মেয়েরা সচেতন হোক, ধর্ষণ-বাল্যবিবাহ-নারী নির্যাতনের শিকার না হোক। তাদের মন রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে যে সরকার এসেছে, আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, ওই গোষ্ঠীটির বাহবা পেয়েছে, বিনিময়ে ভোট চেয়েছে। না লিখলে বা প্রতিবাদ না করলে, কেবল নিজের কথা ভাবলে একটি নিরাপদ জীবন আমি পেতাম। আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমার কণ্ঠ চেপে ধরে আমার ক্ষতি করছে না ওরা, বরং মানুষের ক্ষতি করছে, সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। যে সমাজে নারীবাদী লেখকদের ভুগতে হয়, সেই সমাজে নারীদেরও ভুগতে হয়। এটা সম্ভবত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও বুঝতে পারেননি। তাই যখন সরকার মৌলবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, নির্বাসন দণ্ড দিয়েছে, তখন বুদ্ধিজীবীরা এটাকে ‘তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে এড়িয়ে গেছে।

নারীবাদী, প্রতিবাদী লেখক হিসেবে জীবনের এতটা বছর পার করেও আমাকে শুনতে হয়, মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, আইনের মারপ্যাঁচে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। মেয়েরা যেন শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সচেতন হয়, নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সাহস অর্জন করে— আমি এই উৎসাহই মেয়েদের দিচ্ছি আমার কিশোরী বয়স থেকে।

ধর্ষণের জন্য এখনও দায়ী করা হয় নারীর পোশাককে। বহু বছর ধরে নারীবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র সবাইকে বোঝাচ্ছে, এমনকি প্রমাণও দেখাচ্ছে যে, ধর্ষণ নারীর পোশাকের কারণে ঘটে না। ধর্ষণের কারণ : ১. বীভৎস কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে পুরুষ তার পৌরুষ প্রমাণ করে, ২. নারীকে নিতান্তই যৌনবস্তু মনে করে পুরুষ। সুতরাং যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করা অপরাধ নয় বলেই বিশ্বাস করে।

নারীবাদীদের আন্দোলনের ফলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাদের দায়ী করাটা সভ্য এবং শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এখন অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এখনও বন্ধ করছে না, তাদের নিশ্চিতই চক্ষুলজ্জা বলতে যে জিনিসটা প্রায় সবার থাকে, নেই।

আবার এক শ্রেণির মানুষ মনে করেন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিলেই সমাজে আর ধর্ষণ হবে না। এটা অনেকটা ধর্ষকদের দোষ দিয়ে ধর্ষণের মূল কারণকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। এই পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, সমাজের কুশিক্ষা, ভুল শিক্ষা, নারী-বিদ্বেষ, নারী-ঘৃণা পুরুষকে ধর্ষক বানায়। ধর্ষিতাকে দোষ দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষককে ফাঁসি দিয়েও ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষণের মূল কারণগুলোকে নির্মূল করতে পারলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে।

নারীবাদীদের শত বছরের আন্দোলনের ফলে পৃথিবীতে নারী শিক্ষা শুরু হয়েছে, নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে, বাইরে বেরোবার এবং স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার পেয়েছে, কিন্তু এই অধিকারই সব নয়, নারীর যে অধিকারটি নেই এবং যে অধিকারটি সবচেয়ে মূল্যবান, সেটি নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার। নারীর শরীরকে সমাজের এবং পরিবারের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীর শরীর কোনও সমাজের সম্পত্তি বা কোনও পরিবারের সম্মানের বস্তু নয়। যতদিন নারী তার শরীরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না পাচ্ছে, নারীর শরীর নিয়ে নারী কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নারীর না হবে, যতদিন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পুরুষের, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, ততদিন নারীর সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয়। আর যতদিন এই মুক্তি সম্ভব নয়, ততদিন নারীর পরিচয় পুরুষের ‘ভোগের বস্তু’ হয়েই থাকবে ঘরে, পতিতালয়ে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে, ট্রেনে— সবখানে। ভোগের বস্তু নারীকে ভাবা হয় বলেই যৌন হেনস্তা বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাতে পুরুষের কোনও অসুবিধে হয় না। পুরুষাঙ্গ মেয়েদের ধর্ষণ করে না, ধর্ষণ করে ঘৃণ্য পুরুষিক মানসিকতা। পুরুষাঙ্গ নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র নিরীহ অঙ্গ। পুরুষিক মানসিকতা দূর করলে পুরুষেরা নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে একই প্রজাতির সহযাত্রী স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখবে। পুরুষের যৌনইচ্ছের চেয়ে নারীর যৌনইচ্ছে কিছু কম নয়। নারী যদি নিজের যৌনইচ্ছে সংযত করতে পারে, পুরুষের বিনা অনুমতিতে পুরুষকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে, পুরুষ কেন পারবে না, পুরুষ কেন চাইলে নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে না? মানুষ মাত্রই এই ইচ্ছেকে সংযত করতে পারে, কিন্তু ধর্ষকদের মধ্যে সংযত করার এই চেষ্টাটা নেই, কারণ ধর্ষকদের মস্তিষ্কের গভীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাটা অনেক আগেই ঢুকে গেছে যে নারী যৌনবস্তু আর পুরুষের জন্মগত অধিকার যখন খুশি যেভাবে খুশি যৌনবস্তুকে ভোগ করা। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি খাদ্য ও খাদকের বা শিকার ও শিকারির হয়, তবে এ কোনও সুস্থ সম্পর্ক নয়! কোনও বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে কখনও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। নারী তার সমানাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও সত্যিকার সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। সমানাধিকার কে দেবে নারীকে? যারা ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব নারীর অধিকার নারীকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দেওয়া।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ মে, ২০১৭

 ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো

পাকিস্তান তো আছেই, মালদ্বীপও বাংলাদেশ দ্বারা সংক্রামিত। ওখানেও মুক্তচিন্তক ব্লগারদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাশাল খানকে খুন করেছে একপাল ধর্মান্ধ। মালদ্বীপেও একই ঘটনা, ব্লগার ইয়ামিন রশিদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের যে বদ হাওয়াটা এখনো পাকিস্তানে আর মালদ্বীপে পৌঁছায়নি, তা হলো চুপ করে থাকা, মেনে নেওয়া, ব্লগারদের মৃত্যুর জন্য ব্লগারদের দোষ দেওয়া। মালদ্বীপেও ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, পাকিস্তানেও হয়েছে। প্রতিবাদ শুধু বুদ্ধিজীবীরাই করেননি, রাজনীতিকরাও করেছেন।

মাশাল খানের হত্যাকাণ্ড ভিডিওতে দেখার পর হাজারো মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দু’দিনের মধ্যেই ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারো মানুষ মালদ্বীপেও প্রতিবাদ করেছেন। ইয়ামিন রশিদকে হত্যার বিরুদ্ধে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ লিখেছেন, ‘একটা সাহসী কণ্ঠস্বরকে নৃশংসভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক দক্ষদের উপস্থিতিতে কোনরকম পক্ষপাতহীন নিরপেক্ষ তদন্তই একমাত্র ইয়ামিনের সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। ’ মুসলিম হয়েও  ইসলামি সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কারও অসুবিধে হয়নি মালদ্বীপে।

কিন্তু বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে জুলহাজ মান্নানসহ প্রতিভাবান লেখক সাহিত্যিক ব্লগার অ্যাক্টিভিস্টদের যে কুপিয়ে মারা হলো, এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান বা মালদ্বীপের মতো হাজারো মানুষকে পথে নামতে কিন্তু দেখিনি। বরং ওঁরা কোথায় কী লিখেছেন, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে সরকার শাসিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও ব্লগারদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি বলেছেন, তিনিও মুসলমান, ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে তার অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। এরকম কথা পাকিস্তানের বা মালদ্বীপের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বলেননি। দেখে শুনে তো মনে হয় বাংলাদেশ ওসব দেশ থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। ওসব দেশে দেশজুড়ে খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, বাংলাদেশে হয় না। বাংলাদেশে প্রতিবাদ না হওয়ার কারণ দুটো, এক দল ভয় পায়, মৌলবাদীদের হাতে যদি হেনস্থা হতে হয়, আরেক দল বিশ্বাস করে, কোনো মুসলমানের অধিকার নেই  ইসলামের সমালোচনা করার, সুতরাং মরেছে বেশ হয়েছে।

পাকিস্তান একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। মালদ্বীপও শরিয়া আইনে বিশ্বাস করা খাঁটি মুসলমানের দেশ। ওই দুটো দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও যদি গণতন্ত্রে এবং বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তবে বাংলাদেশের মানুষের এ দুটোয় বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ তো জন্মেছেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ কি এমনই একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে এখন চিহ্নিত হতে চাইছে, যে দেশ পাকিস্তানের চেয়েও বেশি মৌলবাদী? মালদ্বীপের চেয়েও বেশি অনাধুনিক?

এই কি আমার ফেলে আসা বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশে নিজের চোখে দেখেছি ’৬৯-এর গণ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ? একটি সেকুলার বাংলাদেশ গড়বো বলে মৌলবাদী পাকিস্তান থেকে আমরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছি, সেই পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ধর্মান্ধ হয়েছি মাত্র কয়েক দশকে। আজ মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে শুধু ভিন্নমত থাকার অপরাধে খুন হয়ে যেতে হচ্ছে। আজ ধর্মই বড় পরিচয় হয়ে উঠেছে সবার, শিক্ষা আর সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে গৌণ।

সন্ত্রাসী, মৌলবাদী অনেক দেশেই আছে। ধর্ম থাকলে মৌলবাদ থাকেই। মৌলবাদ থাকলে সন্ত্রাসের জন্ম হতেই পারে। কিন্তু বাক স্বাধীনতার জন্য বা মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সরকারকে সরব হতে হয়। দেশের রাজনীতিকদের, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদেরও সরব হতে হয়, যেহেতু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা। মৌলবাদী বা সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি সমাজে থাকলে সমাজ নষ্ট হয় না। সমাজ নষ্ট হয়েছে তখনই বুঝবো, যখন মানুষকে তার ভিন্নমতের জন্য সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারলেও সরকার চুপ থাকে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকে, কবি সাহিত্যিকরা চুপ থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া উচিত পাকিস্তানের কাছ থেকে। পাকিস্তানের সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী সকলে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন মাশাল খানের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। মাশাল খান  ধর্মের সমালোচনা করতেন, এ কথা জানার পরও কিন্তু সন্ত্রাসী ছাড়া আর কেউ মনে করেননি তাকে খুন করা মোটেও উচিত হয়েছে।

আজ যদি বাংলাদেশ না হয়ে দেশটি পূর্ব পাকিস্তান থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত দেশজুড়ে ব্লগার  হত্যার প্রতিবাদ হতো। ধর্মান্ধতাকে সরিয়ে আমরা আসলে দ্বিগুণ ধর্মান্ধ হয়েছি। অত্যাচারী  বৃটিশদের তাড়িয়ে নিজেরাই যেমন নিজেদের শোষণ করছি, নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে আরো বড় অত্যাচারী হয়েছি।

জুলহাজ মান্নান আর তার বন্ধুর মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো, অথচ সারা দেশ চুপ। যেন কিছুই ঘটেনি এক বছর আগে। মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবিরোধী মানুষ যদি এখনও একজোট না হয়, তবে দেশ ছেয়ে যাবে সন্ত্রাসীতে। দেশ ছেয়ে যাবে আপসকামীতে। দেশকে বাঁচাতে হলে এখনও সময় আছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দেশের শত্রু এখন দেশের বাইরে থেকে আসে না, দেশের ভেতরেই তাদের বসবাস। এখনও সময় আছে দেশটিকে যেন সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্লগার হত্যার দেশ হিসেবে চিহ্নিত না হতে দিয়ে, সবচেয়ে উত্কৃষ্ট প্রতিবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। সেই প্রতিবাদী বাংলাদেশ নিয়ে আমি গর্ব করতে চাই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা

শেখ হাসিনা আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, আমার দেশে প্রবেশে অন্যায়ভাবে বাধা দিচ্ছেন আজ বহু বছর, তারপরও দেশের কোনও রাজনীতিককে যদি সমর্থন করতে হয়, আমি শেখ হাসিনাকেই করি। কোনও দলের পক্ষে যদি দাঁড়াতে হয়, আমি শেখ হাসিনার দলের পক্ষেই দাঁড়াই। কারণ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা ছাড়া আমি আর কোনও রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিক দেখি না যাদের ওপর সামান্যও আস্থা রাখা যায়। হাসিনা আমার বিরুদ্ধে যত অন্যায়ই করুন, আমি বিশ্বাস করি তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে কোনও অন্যায় করবেন না। বিশ্বাস করি ক্রমশ অসুস্থ হতে থাকা সমাজটাকে সুস্থ করার দায়িত্ব তিনি নেবেন। দেশের মঙ্গল করার জন্য জীবন বাজি রাখতে হাসিনা ছাড়া আর কেউ পারবেন বলে আমি মনে করি না। হাসিনা প্রগতিশীল মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। তিনি দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। জঙ্গি দমন করছেন। তাঁকে গ্রেনেড ছুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা হত্যা করতে চেয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি, কিন্তু হাল ছাড়েননি। ভয় পেয়ে রাজনীতি ছেড়ে পালাননি।

কিন্তু এক পাল নারীবিদ্বেষী ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদীদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের যেভাবে সেদিন সংবর্ধনা এবং সম্মান জানিয়েছেন হাসিনা, দেখে আমি, সত্যি বলতে কী, চমকে উঠেছি। আসলে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মৌলবাদীদের সঙ্গে একই মঞ্চে আর যাকেই মানাক, হাসিনাকে মানায় না। কে শত্রু, কে মিত্র তা বোঝার বুদ্ধি হাসিনার নেই, তা আমি বিশ্বাস করি না। হেফাজতিরা এমন ক্ষুদ্র শত্রু নয় যাদের বশ করা যায়। তারা এখন হাসিনাকে ফাঁদে ফেলে দাবি আদায় করে নেবে। কিন্তু হাসিনা যদি ভেবে থাকেন, এই মৌলবাদীরা হাসিনাকে ভোটে জেতাবে, তাহলে তিনি ভুল করছেন। বঙ্গবন্ধু নিজের শত্রুদের বন্ধু ভেবে ভুল করেছিলেন, হাসিনাও কি তাই করতে যাচ্ছেন? হাসিনা নিজের আততায়ীদেরই দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন না তো! সত্যি বলছি, হাসিনার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

হাসিনা যতই আপস করুন মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে, ওরা কিন্তু নারী নেতৃত্বের বিরোধীই রয়ে যাবে। জাতশত্রুর সঙ্গে আপস করতে যাওয়া হাসিনার নির্বুদ্ধিতা, ওরা হাসিনার নির্বুদ্ধিতার সুযোগ এর মধ্যেই নিতে শুরু করেছে। হাসিনাকে দিয়েই ওরা সরিয়ে ফেলতে চাইছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য। ওরা এক এক করে সরাবে যত ভাস্কর্য আছে দেশে, সব। ওরা কালি লেপে দেবে দেশের সব শিল্পকর্মের শরীরে। হাসিনা আর কী সম্মোহিত করবেন, হাসিনাকেই বরং ওরা সম্মোহিত করে ফেলছে। মাদ্রাসায় পড়া লোকেরা হারিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বিদুষী নারীকে। আপস কিন্তু মৌলবাদীরা করছে না, তারা এসে বলছে না আমরা হাসিনার ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে মেনে নিচ্ছি। বরং হাসিনা গিয়ে মাথা নত করে তাদের বলছেন, তাদের পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতার আদর্শ তিনি মেনে নিচ্ছেন। হাসিনার কি ওই অপশক্তির কাছে হেরে যাওয়া উচিত? ওই অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই তো তাঁকে নির্বাচনে জিতিয়েছিল দেশের মৌলবাদ-বিরোধী মানুষ। আজ বন্ধু চিনতে হাসিনার অসুবিধে হচ্ছে কেন? মৌলবাদীরা চায় পাঠ্যপুস্তকের মুসলমানি করা হোক, হাসিনা তা করেছেন। মৌলবাদীরা চায় মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করা হোক, হাসিনা তাই করেছেন। ভাস্কর্য উপড়ে ফেলা হোক, হাসিনা সেটাই করতে চাইছেন। মুক্তচিন্তক ব্লগাররা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী, মৌলবাদীরা বলে। এ কথা হাসিনাও বলেন। ব্লগারদের ধরে ধরে তিনি জেলেও পুরেছেন। মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি, যে কথা জামায়াতী ইসলামী বলে, সেই একই কথা হাসিনা কেন বলছেন! হাসিনা একদিন বলেছিলেন, নারীদের অপমান করেছে যে আল্লামা শফী, তার বিরুদ্ধে দেশের নারীরা প্রতিবাদ করে না কেন! সেই হাসিনাকে যখন নারী হয়ে শফীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসে থাকতে দেখি, তখন অবাক হই। হাসিনা কী করে সম্মান করতে পারছেন এই লোকটিকে, যে লোকটি নারীকে চূড়ান্ত অসম্মান করতে দ্বিধা করে না। মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই অকৃতজ্ঞ মৌলবাদীদের ক্ষমতা এখন এত বেশি যে দেশের সর্বশক্তিময়ী প্রধানমন্ত্রীকেও পালন করতে হয় তাদের সমস্ত অসভ্য, অশোভন, অযৌক্তিক দাবি। কী হবে হাসিনা যদি পালন না করেন? তিনি প্রগতিশীলদের ভোট পাবেন, যেমন পেতেন। মৌলবাদীদের ভোট পাওয়ার জন্য যদি রাষ্ট্রের কাঠামো নষ্ট করতে হয়, শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশ করতে হয়, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ গুঁড়িয়ে দিতে হয়, নারীর সমানাধিকার বাতিল করতে হয়, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ছুট্টি দিয়ে দিতে হয়— তাহলে কী লাভ হাসিনার ক্ষমতায় থেকে! এসব কাজ তো যে কোনও জামায়াতী ইসলামীর নেতা বা হেফাজতি ইসলামের নেতারাই করবেন। হাসিনা হয়তো বুঝতে পারছেন না, ওরা যা করতে চায়, তা একশভাগ করে দিলেও ওরা হাসিনার অপসারণ চাইবে। ঠিক যেমন ওরা ভাস্কর্যের অপসারণ চায়। ইসলামে, ওরা বলে, ভাস্কর্য যেমন হারাম, নারী নেতৃত্বও হারাম। ওদের সমর্থন পাওয়ার আশায় দেশকে হাঙ্গরের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েও হাসিনা ওদের সমর্থন পাবেন না, মাঝখান থেকে প্রগতিশীল মানুষের সমর্থন হারাবেন। তারপরও আশা রাখি হাসিনার ওপরই। তারপরও বিশ্বাস করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন করছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন করছেন, ব্লগার হত্যার বিচারও তিনি তেমন করবেন। জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে দেশ, জঙ্গি উৎপাদনে বুঝে না বুঝে অনেক রাজনীতিক সহযোগিতা করেছেন, তারপরও আশা, দেশকে জঙ্গিমুক্ত হাসিনাই করবেন। তিনিই একদিন ধর্মনিরপেক্ষতার বিজয় নিশান ওড়াবেন, বাহাত্তরের সংবিধান তিনিই ফিরিয়ে আনবেন। হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর মতো খুন হয়ে যেতে আমরাই দেব না। খুনিদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমরাই নেত্রীকে অনুরোধ করবো। আশা করি নেত্রী আমাদের অনুরোধ রক্ষা করবেন। দেশকে বাঁচাবেন, নিজেকেও বাঁচাবেন।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

অপুরা যেন হেরে না যায়

মনে আছে হ্যাপির কথা? রুবেলের প্রতারণার কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল। তাতে কী হলো? রুবেল রুবেলের মতোই আছে, ক্রিকেট খেলছে, ঘটা করে বিয়েও করেছে, তার জনপ্রিয়তায় এতটুকু চির ধরেনি। আর ওদিকে হ্যাপির ক্যারিয়ারের বারোটা বেজেছে, লোকের নিন্দে শুনেছে হ্যাপি, গালাগালি খেয়েছে, শেষ অবধি বাধ্য হয়েছে মুখ লুকোতে।

অপু বিশ্বাস তাঁর স্বামী শাকিবের প্রতারণার কথাও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। অপু আর শাকিব দুজনই সিনেমা করেন। দুজনই জনপ্রিয় তারকা। কিন্তু বিয়ের পর স্যাক্রিফাইস কাকে করতে হলো? অপু বিশ্বাসকে। নিজের ধর্ম কাকে বদলাতে হলো? অপুকে। ক্যারিয়ারের কার বারোটা বাজলো? অপুর। ওদিকে শাকিব কিন্তু চমৎকার আছেন। সিনেমা করে যাচ্ছেন নতুন নতুন নায়িকার সঙ্গে। যে তাঁর সবচেয়ে বেশি ছবির নায়িকা, তিনি আউট, তাঁকে সবার আড়ালে চলে যেতে হবে, মুখ লুকোতে হবে, জনসমক্ষে বেরোলে তাঁর চলবে না। তাঁকে একা একা ভুগতে হবে, গর্ভাবস্থার যন্ত্রণা আর ঝুঁকি একা একা ভোগ করতে হবে, একা একা কাঁদতে হবে, একা একা জন্ম দিতে হবে সন্তান। অপুর সেই কষ্টের-যন্ত্রণার সন্তান হবে তাঁর স্বামীর সন্তান, সন্তানের নামের শেষে যোগ হবে অপুর নয়, শাকিবের সারনেম।

অপুকে বিয়ের খবর লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন শাকিব, তাই অপু লুকিয়েছেন। শাকিবও কাউকে বলেননি তিনি বিবাহিত। তিনি বিবাহিত, এ খবর প্রচার হলে তিনি মনে করেন, তাঁর ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, অন্য নারীদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করায় ব্যাঘাত ঘটবে!

বাংলাদেশের টেলিভিশনে দুজনের যা বক্তব্য শুনেছি তাতে মনে হয়েছে শাকিব খুব আত্মম্ভরী, উদ্ধত, ধৃষ্ট, নারীবিদ্বেষী, গোঁয়ার, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর। আর অপু বোকা, ভীতু, কনফিউজড, লস্ট। শাকিব পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আর সব পুরুষের মতো। অপুও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আর সব নারীর মতোই। অপু সংসার বলতে বোঝেন, রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো শাকিবের সাথে সংসার করেই আসছি। এক বছর আগে আমি যখন বাইরে গেলাম তার আগে আমি তো সংসারই করেই আসছিলাম। আমি প্রতিদিন শুটিং করে এসে তার বাসায় গিয়ে রান্না করতাম, ঘরদোর গুছাতাম, পরিষ্কার করতাম। আমার শাশুড়ি একবার হজে গিয়েছিলেন দেড় মাসের মতো, সেই দেড় মাসে আমি নিজে ওই বাসা সামলেছি। সকালে উঠে সমস্ত রান্না করে, ঘরদুয়ার ঝাড়ু দিয়ে, পরিষ্কার করে আমি শুটিংয়ে যেতাম। আবার বিকালে শুটিং শেষ করে এসে আমি আবার সমস্ত কিছু পরিষ্কার করতাম। আমিও সংসার করেছি, শাকিবও সংসার করেছে। ’ …শাকিব কী করে সংসার করেছেন, তা অবশ্য অপু বিশ্বাস বলেননি। শাকিবও কি ঘর ঝাড়ু দিতেন, রান্না করতেন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতেন— শাকিবও কি এভাবে সংসার করতেন? নিশ্চয়ই নয়। অপু যে এই নারীবিদ্বেষী সমাজের একজন মগজ ধোলাই হওয়া নারী, তা ওঁর কথা শুনলেই বোঝা যায়। যে সংসারে মেয়েদের দায়িত্ব টাকা পয়সা ঢালা, ঘরবাড়ি ঝাড়ু দেওয়া, বাড়িঘর সাজানো-গোছানো, রান্না করা, পরিবেশন করা, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া, সন্তান পালন করা— আর পুরুষের দায়িত্ব টাকা পয়সা ঢালা, অর্ডার দেওয়া, পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা… সেটি আসলে কোনও সংসার নয়, সেটি প্রভু-দাসির হারেম।

শাকিবের বড় রাগ অপুর ওপর। অপু কেন বিয়ের কথা, বাচ্চার কথা, সত্য কথা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন, …তার মানে অপুর কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে। অপু শাকিবের আদেশ মানেননি, চুপ করে থাকেননি, আড়ালে থাকেননি। তার মানে অপু খুব খারাপ। শাকিব বলতে চাইছেন অপু শুধু শাকিবের বউ হয়ে থাকতে চাইছেন না, নায়িকা হতে চাইছেন, সুতরাং অপু লোভী। আমার প্রশ্ন, শাকিব কি শুধু অপুর স্বামী হয়ে থাকতে চাইছেন? চাইছেন না। তিনি তো দিব্যি নায়ক হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও নায়ক হতে চাইছেন। তাহলে শাকিব কি লোভী নন? মুশকিল হলো, শাকিব লোভী, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর হলেও তাঁকে কেউ বলবে না তিনি লোভী, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর। বরং অপুকে বলবে। মেয়েরা পুরুষের জন্য যত ত্যাগ করবে, পুরুষ তত অভ্যস্ত হবে মেয়েদের ত্যাগে। তত তারা ভাববে, ত্যাগেই মেয়েদের জন্মের সার্থকতা, মেয়েরা ত্যাগ করতে ভালোবাসে, ত্যাগ তাদের ডি-এন-এ তে আছে, ত্যাগই চরিত্র তাদের। মা সন্তানের জন্য নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেবে, প্রেমিকা প্রেমিকের জন্য দেবে, স্ত্রী স্বামীর জন্য দেবে। এর অন্যথা হলেই মেয়ে বদ, মেয়ের চরিত্র নষ্ট।

অপু বিশ্বাস এই সমাজের আর সব নারীর মতো ভিকটিম। স্বনির্ভর হয়েও, স্বনামধন্যা হয়েও ভিকটিম। তিনি নারীবিদ্বেষী এই নষ্ট সমাজের করুণা পেতে চান, তাই স্বামীর বাড়ি গিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে আসেন। প্রফেশন ছেড়ে দেওয়ার জন্য স্বামীর যে আদেশ, তা মেনে নেন, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার অন্যায় আবদারও মেনে নেন। অপু সর্বস্ব ত্যাগ করেন। শাকিব তাঁকে অপমান শুরু থেকেই করছেন। কিন্তু তারপরও তিনি অপমান সয়ে গেছেন। সম্ভবত শাকিবের ভিন্ন নারীসঙ্গের কারণে তিনি এমনই চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করেছেন যে শাকিবের আদেশ অমান্য করে অন্তরাল থেকে সামনে এসেছেন। ত্যাগী হয়েও মেয়েরা সব সময় রেহাই পায় না। আদেশ অমান্য করার শাস্তি তাঁকে পেতে হবে। অপু চাইছেন সমাজে তাঁর সন্তান পিতার পরিচয় দিতে পারুক। অপু চাইছেন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করতে।

পরনির্ভর মেয়েরা যখন কাঁদে, আমি বুঝি তাদের অসহায়তা। কিন্তু প্রতারক স্বামীর জন্য স্বনির্ভর নারীদের চোখের জল আমাকে বড় বিষণ্ন করে। কেন স্বনির্ভর নারীরা অন্তত দেখিয়ে দিতে পারেন না তাঁরা পুরুষের দাসী নন, তাঁরা নারী-পুরুষের বৈষম্য মানেন না, নারীবিদ্বেষী পুরুষের কোনও স্থান নেই তাঁদের জীবনে, অপমান যারা করে বা করতে চায়, তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার শক্তি তাঁদের আছে। স্বনির্ভর মেয়েদের এও বোঝাতে হবে, তাঁরা একা বাস করতে পারেন। একা তাঁদের সন্তানদের বড় করতে পারেন। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল কতটা ভালো জানি না, তবে দুষ্ট পুরুষের চেয়ে একার সংসার ঢের ভালো।

অপুর অভিজ্ঞতা যেন মেয়েদের সচেতন করে, কাউকে যেন অপুর মতো ভুগতে না হয়। কোনও স্বনির্ভর মেয়েকে যেন কোনও অপ্রেমিক পুরুষের জন্য এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলতে না হয়। কোনও মেয়েকেই যেন শারীরিক মানসিক অত্যাচার করার সুযোগ কোনও পুরুষ না পায়। মেয়েরা যেন বোঝে, ত্যাগ মেয়েদের ধর্ম নয়, পুরুষদের মতো মেয়েদেরও সুখে সম্মানে স্বস্তিতে সানন্দে বেঁচে থাকার শতভাগ অধিকার আছে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭

কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে

যখন বাংলাদেশের আত্মঘাতী বোমারুর কথা ভাবছিলাম, তখনি শুনি সেন্ট পিটার্সবুর্গের এক মেট্রো স্টেশনে আকবরজন জালিলভ নামের ২২ বছরের এক যুবক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৪ জনকে নিহত আর ৫০ জনকে আহত করেছে। মনে আছে ১৯৯৪ সালে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন আমন্ত্রিত হচ্ছিলাম, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের দেশে কি সুইসাইড বোম্বার আছে? আমি অনেকক্ষণ হতবাক তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়তাম। না নেই। ওরা স্বস্তির শ্বাস ফেলতো। আজ আর আমি বলতে পারছি না যে বাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমারুর অস্তিত্ব নেই।

কী ঘটছে এই পৃথিবীতে? কেন এত মানুষ নিজেকে হত্যা করছে শুধু অন্যদের হত্যা করার জন্য? আত্মঘাতী হামলা নতুন কিছু নয়। তবে এককালে খুব কম ঘটতো এই হামলা। ঘটতো মূলত যুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কামিকাজে বৈমানিকেরা করেছেন আত্মঘাতী হামলা। মরবেন জেনেও শত্রুদের জাহাজের ওপর নিজের বোমা ভরা বিমান ছুড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।

কিন্তু আশির দশক থেকে আত্মঘাতী হামলা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। গত তিরিশ বছরে প্রায় চল্লিশটি দেশে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, ওতে নিহত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। আশির দশকে বছরে ৩টি হামলা হতো, নব্বই দশকে মাসে ১টি, ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সপ্তাহে ১টি, আর ২০০৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দিনে ১টি। মূলত আফগানিস্তান, ইরাক, ইসরাইল, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় হামলা হয়েছে। তালিকায় এখন বাংলাদেশ যোগ হলো। জাতীয়তাবাদ এবং জিহাদ এই দুটোই আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পেছনে কাজ করছে। নিজের দেশকে বহিরাগত শত্রু থেকে মুক্ত করার জন্য অনেকে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা করেছে। এটির কারণ জাতীয়তাবাদ। তরুণ-তরুণীদের মগজ ধোলাই করে বিশ্বাস করানো হয়েছে যে জিহাদ করতে গিয়ে কারও মৃত্যু হলে তারা জীবন ভর নামাজ রোজা ইবাদত ইত্যাদি করা ছাড়াই, আখেরাতে কোনও রকম বিচার ছাড়াই, বেহেস্তবাসী হওয়ার সুযোগ পাবে। জিহাদিরা বিধর্মীদের, ইসলামের সমালোচক এবং নিন্দুকদের এবং মুসলমান হয়েও অনৈসলামিক কাজ যারা করে, তাদেরও হত্যা করে। ১৪০০ বছর আগে যা ঘটেছে, তা এখন যে করেই হোক, আত্মহত্যা করে হলেও ঘটাতে হবে বলে অনেকের বিশ্বাস। এই ধারণা যে করেই হোক, প্রচুর মুসলমানের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটা অনেকটা ভাইরাসের মতোই। সংক্রামক রোগের মতো।

ভারতের একজন কৃষক খরার কারণে ফসল না হওয়ায় আর ধারদেনা বেড়ে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছে, অমনি তার দেখাদেখি এক এক করে লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আত্মঘাতী বোমা হামলায় শত্রু হত্যা করতে পারলে সরাসরি বেহেস্তে হাওয়ার সুযোগ জুটবে— এই তথ্যটি গভীরভাবে বিশ্বাস করে একজন আত্মঘাতী বোমারু হলো, এক এক করে তারপর অনেকেই হলো। একজন মৃত্যু ভয় কাটিয়ে উঠছে দেখলে অনেকেই ভয়টা কাটিয়ে ওঠে। কেউ একজন শহীদ হলো, আরো লোক শহীদ হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য কেউ শহীদ হতে চাইলে হতেই পারে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে যখন নিরীহ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে মরতে চায় তারা। আরো ভয়ঙ্কর, যখন শিশুদের গায়ে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে বাবা মা’ই ওদের মরতে বলে। সেদিন সিরিয়ার আট আর দশ বছরের দুটো শিশুকন্যাকে এভাবেই সাজিয়ে দিয়েছে বাবা-মা, দামাস্কাসের পুলিশ-স্টেশনে ঢুকে যেন ওরা বোমার বোতামে চাপ দেয়। শিশুদের গালে চুমু খেয়ে শেষ বিদেয় জানিয়েছে তারা। বলেছে, বেহেস্তে গিয়ে দেখা হবে তাদের। এরা কি সত্যি বাবা-মা? এরা সত্যি বাবা-মা। এরা বিশ্বাস করে জিহাদে যাদেরই মৃত্যু হচ্ছে, তাদের জন্য বেহেস্ত নিশ্চিত। বাংলাদেশেও সম্প্রতি আত্মঘাতী বোমারুদের দেখেছি নিজের সন্তানদের হত্যা করতে তারা সামান্যও দ্বিধা করে না। ধর্মীয় উন্মাদনা এদের নিষ্ঠুর, অবিবেচক, হিংস্র, নৃশংস, লোভী, স্বার্থপর, খুনি বানিয়েছে। ধর্মের উত্পত্তির কারণ যাই হোক না কেন, মানুষ ধর্মকে মানবিক হিসেবেই দেখতে চায়। কিন্তু দিন দিন যেন ধর্মকে খুন-খারাবির ধর্ম হিসেবে দেখছে কিছু মানুষ। বেশ কিছু আত্মঘাতী বোমারু তরুণ তো বলেই ফেলেছে ইহকালের ইতি ঘটিয়ে পরকালে পরমানন্দে বেহেস্তের সুন্দরী হুরদের সান্নিধ্য পেতে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত রূপকথার জগৎ তারা কল্পনা করে নেয়। অনেকে বলে যারা আত্মহত্যা করে অন্যকে হত্যা করার উদ্দেশে, যারা বিশ্বাস করে তারা এই অপকর্মটি করলে পুরস্কৃত হবে, তারা মানসিক রোগী। আমার কিন্তু ওদের মানসিক রোগী বলে মনে হয় না। মানসিক হাসপাতালের যারা রোগী, তারা কিন্তু কেউ ধর্মান্ধ নয়, ধর্মের কারণে কাউকে খুনও করে না।

এই খুনোখুনিটা বিশ্বাসের কারণে ঘটে। যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কিছুকে বিশ্বাস করলে বিপদ বাধে। ১৪০০ বছর আগে যুদ্ধ দরকার ছিল বলে যুদ্ধ এখনো দরকার, তা তো নয়। এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম, ইসলাম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। ইসলামকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে, এই সংকল্প করার কোনও কারণ নেই। পিউ রিসার্চ বলেছে ২০৫০ সালের দিকে ইসলাম পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম হয়ে উঠবে। ইসলাম নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মুসলমানদের কোনও কারণ নেই। পৃথিবীকে দারুল ইসলাম বানানোর জন্য এখনই জিহাদে নামলে এ লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই করবে। দুনিয়াতে মুসলিমদের নিয়ে অনেকের এখন ভয়। ভয় জাগিয়ে সামনে এগোনোর চেয়ে ভালোবেসে সামনে এগোনো নিশ্চয়ই ভালো। মন্দ কাজ করে অর্থাৎ খুন খারাবি করে বেহেস্তে যাওয়ার চেয়ে ভালো কাজ করে, মানুষের উপকার করে বেহেস্তে যাওয়া নিশ্চয় অনেক বেশি স্বস্তিকর। ইসলামকে একটি খুনের নিষ্ঠুরতার বর্বরতার ধর্ম হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে সন্ত্রাসীরা। ইসলামের যারা ভালো চায়, তাদের সবার আগে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ইসলামকে বাঁচাতে হবে। নাস্তিকেরা ধর্মকে ধ্বংস করে না, করতে পারে না। ধর্মের সর্বনাশ করে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা।

বাংলাদেশের মতো শান্ত স্নিগ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ দেশটি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতে, জঙ্গিতে। এই জঙ্গিদের যারাই তৈরি করেছে, কোনও ভালো উদ্দেশে করেনি। তারা দেশের এবং দেশের মানুষের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তায় বিশ্বাস করে না। যত বেশি ধর্মান্ধ হয়েছে মানুষ, তত বেশি সন্ত্রাসী হয়েছে। সন্ত্রাসের চর্চা চলতে থাকলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে আত্মঘাতী সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায়।

মানুষের অনিষ্ট করে ধর্মের সেবা করার যে নিয়ম শুরু হয়েছে, তা শুরুতেই শেষ না করলে আমরা সব মরে শেষ হয়ে যাবো, পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকবে দজ্জালের মতো কিছু খুনি। আমাদের কি তেমন এক পৃথিবীর দিকে এই পৃথিবীকে যেতে দেওয়া উচিত? রুখে দাঁড়াবার সময় কি এখনও আসেনি?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৬ এপ্রিল, ২০১৭

বাংলাদেশ বদলে গেছে

প্রাচীন চীনের একটি দর্শন ছিলো, ‘এমন কিছু তুমি অন্যের সঙ্গে কোরো না, যা অন্য কেউ তোমার সঙ্গে করলে তোমার মোটেও ভালো লাগবে না। ’ এই দর্শনটিই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। এই দর্শন মেনে চললে নীতিবান এবং আদর্শবান হওয়ার জন্য আলাদা করে ধর্মের দরকার হয় না। ধর্ম মেনে চললে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, লোক ঠকানো, মিথ্যে বলা, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, ঘুষ খাওয়া, ঘুষ দেওয়া ইত্যাদি লোকে করে না। বারবার কিন্তু মানুষ প্রমাণ দিয়েছে, ধর্মে বিশ্বাস রেখেও মানুষ সব রকম অনাচারই করে বা করতে পারে। সমাজের মানুষকে কুকর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যে নৈতিক শিক্ষা, তা যে ধর্ম থেকেই আহরণ করে সবাই তা নয়। ধর্ম না মেনেও মানুষ সৎ, উদার এবং সহিষ্ণু হয়। পাশ্চাত্যে যে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, পঙ্গুর অধিকার, পশুপাখির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কিন্তু কোনও ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া নয়। বৈষম্য এবং বর্ণবাদবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠা করার পেছনেও ধর্ম নয়, আছে বিবেকবান মানুষ।

ষাট-সত্তর দশকে যে বাংলাদেশ আমি দেখেছি, সেই বাংলাদেশে ধর্ম ছিল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা, অতিরঞ্জন, চোখ রাঙানো, ছড়ি ঘোরানো, জোরজবরদস্তি ছিলো না। মুসলমানদের মধ্যে দাড়ি রাখা, টুপি পরা আর হিজাব-বোরখা পরা জনপ্রিয় ছিল না। নামাজের চলটা অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ছিলো। এতে কিন্তু ধর্ম উবে যায়নি। ধর্ম থাকা সত্ত্বেও জোর করে সংবিধানে, সমাজের সর্বত্র, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অতিরিক্ত ধর্ম আমদানির ফল যে ভালো হবে না, আশির দশকের শেষ দিকেই অনুমান করেছিলাম। এসব নিয়ে বলেছি বলে আমি মন্দ হয়েছি। আমাকে অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, আজ ২৪ বছর পার হচ্ছে, এখনো আমাকে কোনও সরকারই দেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। সেই যে বলেছিলাম ধর্মের অতি- চাষ কিন্তু ভালো ফল দেবে না, বাংলাদেশ কিন্তু তার প্রমাণ পাচ্ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীতে এবং সন্ত্রাসী-সমর্থকে দেশ ছেয়ে গেছে। অতিরিক্ত ধর্ম কোনওকালেই ভালো কিছুর জন্ম দেয়নি। ধর্ম যখন ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আওতা থেকে বেরিয়ে রাজনীতিতে পৌঁছে যায়, তখনই ধর্ম আর ধর্ম থাকে না, তখন সেটি হয়ে যায় রাজনৈতিক ধর্ম। রাজনৈতিক ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে ফায়দা হাসিল করা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তে জানতেন না, রোজা করতেন না, মদ আর শূকরের মাংস খেতেন, সূরা-আয়াত জানতেন না। তিনি যে ভারত থেকে মুসলমানদের আলাদা করে পাকিস্তান নামের একটি দেশ বানিয়ে ফেললেন, তিনি কিন্তু ইসলাম ধর্মকে ধর্ম হিসেবে নয়, রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য। সেই থেকে পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে আর কিছু নয়, রাজনীতিই হচ্ছে। নৈতিকভাবে সৎ মানুষ হওয়া এখন আর ধর্ম নয়, ধর্ম চলে এসেছে পোশাকে-লেবাসে, হিজাবে-বোরখায়, টুপি-দাড়িতে, আলখাল্লায় অথবা পাজামা-পাঞ্জাবিতে। ধর্ম এখন আর আর্তের সেবায় নয়, ধর্ম এখন সংযমে নয়, ধর্ম এখন ধনীদের অতিভোজনে, অতিবিলাসিতায়, পাড়ায় সাতটি থাকলেও আরও দশটি মাদ্রাসা গড়ে দেওয়ায়। মানুষ এখন অন্যের জন্য কিছুই গড়ে না, যা গড়ে নিজের জন্য গড়ে। পরকালে বেহেস্ত পাওয়ার আশায় গড়ে। যারা আজ ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক বলে সম্মান পাচ্ছে, তাদের অনেকেই যদি জানে যে পরকাল বলে কিছু নেই, রাতারাতি পালটে যাবে। নামাজ রোজা বাদ দিয়ে দেবে, আল্লাহর ইবাদতে ইতি টানবে, মসজিদ-মাদ্রাসা কিছু গড়বে না, এমন কোনও অন্যায় নেই যে করবে না। এরা যদি ভালো কাজ করে, করে দোযখের ভয়ে, আর বেহেস্তের লোভে। এরা ভালো কাজ করার জন্য ভালো কাজ করে না। মানুষের উপকারের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য ভালো কাজ করার কোনও আগ্রহ এদের নেই। এদেরকে কি কোনও কারণে ভালো মানুষ বলা যায়? আসলে তারাই সত্যিকারের ভালো মানুষ, তারাই সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ, যারা কোনও কিছুর লোভে নয়, যারা ভালো কাজ করে অন্যের ভালোর জন্য। নিঃস্বার্থ মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব বেশি নেই। বেশি নেই বলেই ধর্ম নিয়ে এত অধর্ম হচ্ছে।

জঙ্গিরাও, গবেষণা করে দেখা গেছে, বেহেস্তে যাওয়ার লক্ষ্যেই জঙ্গিবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছে। এখানেও কাজ করছে লোভ। লোভ অতি বেশি হওয়ায় তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপে না, আত্মঘাতী বোমা গায়ে পরতে ভয় হয় না, মৃত্যুকে পরোয়া করছে না, মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ মারার জন্য। বিশ্বাস করছে যত বেশি কাফের আর বিধর্মী মারবে, তত পোক্ত হবে বেহেস্তে তাদের আসন। এই স্থূল বিশ্বাস ঠিক কজন মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে আমার জানা নেই।

আমার শৈশব-কৈশোরে আমি এমন বাংলাদেশ দেখিনি। এমনকি যৌবনেও দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনও বদলে গেছে। আমাদের পরিবার ছিলো আদর্শবান পরিবার। নামাজ পড়া, হিজাব পরা, টুপি পরার কোনও চল ছিলো না, কিন্তু সৎ, সভ্য, শিক্ষিত, সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ আমার বড়দা’র ভেতরে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ করছি। আমার বড়দা’র এখন মুখভরা দাড়ি। গোঁফহীন দাড়ি। আমার চিরকালের ক্লিন-শেভড-স্যুটেড-বুটেড হ্যান্ডসাম বড়দা’র মাথায় এখন টুপি, পরনে লম্বা পাঞ্জাবি। বড়দা এখন পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, সারা দিন তসবিহ জঁপে। ছেলেগুলোকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মান্ধও বানিয়েছে। বড়দা কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতো, কবিতা লিখতো, গান শুনতো, সিনেমা দেখতো, ঘুরে বেড়াতো, প্রেম করতো, ছবি তুলতো, ফ্যাশন করতো, ডিজাইন করতো। যেটুকু মানবিকতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ছিলো, সব বিসর্জন দিয়ে এখন সে ধর্মান্ধ। আগে আমাকে দেখতে, আমি যেখানেই থাকি, ছুটে ছুটে আসতো। এখন আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করে না। বাবার মৃত্যুর পর আমার ভাগে যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, তার সবই বড়দা নিজে নিয়ে নিয়েছে। আমার আপত্তিতে তার কিছু যায় আসে না। ধর্মান্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত বোধহয় স্বার্থান্ধ হওয়া। এই অন্যায়টা সম্ভবত বড়দা করতে পেরেছে ধর্মান্ধ হয়েছে বলেই। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে অপকর্মের ফল তাকে পরকালে ভোগ করতে হবে না, যেহেতু সে সুন্নত পালন করেছে, দাড়ি রেখেছে, টুপি পরেছে, নামাজ রোজা করেছে। অনেকে তো এও বিশ্বাস করে, গুনাহ করার পর একবার হজে গেলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়, তাই প্রচুর গুনাহ করার পর হজের জন্য উড়োজাহাজে ওঠে।

আমার মামারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। এই মামাদের মধ্যে কারো কারো একই হাল। যে মামাদের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে, যে মামারা ধর্মের লেবাস নিয়ে মোটেও উৎসাহী ছিলো না, সেই মামারা আজ গোঁফহীন দাড়ি রাখছে, পাঁচবেলা নামাজ পড়ছে। একজন তো জঙ্গি-আস্তানা অভিযানকে বলেই দিয়েছে নাটক। বাংলাদেশে জঙ্গি আছে বলে সে মনে করে না। তার সঙ্গে বড় সখ্য ছিল আমার। মোষের গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম আমরা। একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে নতুন পতাকা হাতে আমরা উল্লাস করেছিলাম। সেই মামা। আমার জন্য যত স্নেহ ভালোবাসা ছিলো, সব কর্পূরের মতো উবে গেছে।

কলেজের বন্ধুদের প্রায় সবাই ধর্মান্ধ। বান্ধবীদের প্রায় সবার মাথায় হিজাব। অচেনা দেখায় সবাইকে। মনে হয় গত চব্বিশ বছরে কিছু একটা ঘটে গেছে দেশে। বেহেস্তের লোভের ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের সবখানে, ভাইরাসে আক্রান্ত সবাই। ভুতুড়ে বানিয়ে দিয়ে গেছে কেউ গোটা দেশটাকে। দেশটাকে এখন চিনতে পারি না। মানুষগুলো আর মানুষ নেই, সব জঙ্গি হয়ে গেছে। বাঙালি সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে আরবের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি ভেবে নিচ্ছে, যে আরবেরা বাঙালিদের অবলীলায় শিরশ্ছেদ করছে আরবের মাটিতে। বাঙালিদের মিশকিন বলে ঘৃণা করতে সংকোচ করে না।

যে ধর্ম নিজের আরাম-আয়েশের লোভের জন্য মানুষ করে, সে ধর্ম ধর্ম নয়। ধর্ম হলো মানবতা। জঙ্গিরা যে ধর্ম পালন করছে, সে ধর্ম অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। যে ধর্ম আমার মা পালন করতো, পাড়ার সবার বিপদে-আপদে সাহায্য করতো, সে হলো ধর্ম। যে ধর্ম আমার বাবা পালন করতো, গরিবকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতো, সে হলো ধর্ম।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ মার্চ, ২০১৭

 নেপাল থেকে বলছি

নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। দারিদ্র্যটা বড় চোখে পড়ে। দেশের প্রেসিডেন্ট মহিলা। মেয়েরা ঘরের বাইরে; ইস্কুলে যাচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, ব্যবসা বাণিজ্য  করছে। দেখে ভালো লাগে। খারাপ লাগে যখন দেখি ধর্মে আর কুসংস্কারে ছেয়ে আছে দেশ। অধিকাংশ নেপালি  হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী, কিছু বৌদ্ধ ধর্মে, সামান্য ইসলামে আর ক্রিশ্চান ধর্মে। সংবিধান আর আইনের সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে নেই। কিন্তু সমাজে   কুসংস্কারের যেরকম জাঁকালো উৎসব পালন হয়, দেখে গা শিউরে ওঠে।

গান্ধিমাই উৎসবে ক্ষমতার দেবী গান্ধিমাইকে তিন লক্ষ মোষ আর  ছাগল উৎসর্গ করে  মানুষ তুষ্ট করতে চায়,   তুষ্ট হলে ভক্তদের সুখ শান্তি দেবে দেবী। কী ভয়ঙ্কর, কী নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞ। শুধু ছবি দেখলেই দিন রাত মন  খারাপ থাকে।   চোখের সামনে মোষদের কাতরানো দেখলে নিশ্চয়ই বুক ফেটে যায়। শুধু যে পশু বলি দেওয়া হয় নেপালে, তা নয়, মানুষও বলি দেওয়া হয়। বাবা মা’ই নিজেদের ছেলে মেয়েকে কোনো শুভ কাজে বলি দিয়ে দেবতাদের সুখী করতে চান। এই সেদিন  সেতু তৈরি হলো, একটা বাচ্চা ছেলেকে বলি দিয়ে দেওয়া হলো।

৯৩ বছর আগেও সতীদাহ প্রথাকে নেপালে পবিত্র প্রথা বলে ঘোষণা করা হতো। ১৯২০ সাল অবধি ডাইনি-হত্যা প্রথাকেও পবিত্র বলে মনে করা হতো। এই ডাইনি-হত্যা এখনো চলছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। এখনো চলছে দেউকি প্রথা, যে প্রথায়  মেয়েদের   উৎসর্গ করা  হয় মন্দিরে,  দেবতাদের উদ্দেশে। এখনো চলছে চৌপাড়ি প্রথা। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় বাড়ি  থেকে বের করে দেওয়া হয়,  অস্পৃশ্য অবস্থায় দিন রাত কাটায় মেয়েরা ছোট্ট কুড়েঘরে। তাদের তখন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়ারও অধিকার থাকে না। তাদের অধিকার থাকে না মাছ মাংস ডিম দুধ, অথবা কোনো পুষ্টিকর খাবার। শুধু শুকনো ফল, শুকনো ভাত খেয়ে থাকতে হবে। শীতেও তাদের অধিকার নেই শীতের কম্বল ব্যবহার করার। বড়জোর ছোট কোনো চট ব্যবহার করতে পারে, ব্যস। স্নান করার অধিকার নেই। চৌপাড়ির সময় অনেক মেয়েই কিন্তু  মারা যায়।

মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যতদিন ঋতুস্রাব, ততদিন মেয়েরা   অপবিত্র।   বিশ্বাস করে, তখন যদি মেয়েরা দুধ খায়, যে গাভীর দুধ খাবে, সেই গাভী আর দুধ দেবে না। যে গাছ স্পর্শ করবে, সে গাছ আর ফল দেবে না। যদি কোনো বই পড়ে, দেবী সরস্বতী খুবই রাগ করবে। যদি কোনো পুরুষকে স্পর্শ করে, সেই পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।

ঋতুস্রাবরত মেয়েরা  বাড়িতে থাকলে হিন্দু দেবতারা অসন্তুষ্ট হবে, পরিবারের লোকেরা সংক্রামিত হবে,  অসুস্থ হয়ে পড়বে, অসুস্থ হয়ে পড়বে বাড়ির পোষা পশুপাখিও। অসুস্থ তো হবেই, মরেও যেতে পারে। সে কারণে সবার চোখের আড়ালে তাদের চলে চেতে হয়। ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট  এই প্রথাটি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু প্রথা প্রথার মতোই চলছে। দিব্যি মানুষ পালন করছে এই প্রথা।

নেপালের  মানবাধিকার কর্মীরা, যারা এইসব নারীবিরোধী প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা এই সব প্রথাকে ‘কুরীতি’ বলেন। কুরীতি মানে খারাপ রীতি, খারাপ প্রথা। কুরীতি দূর করার জন্য সরকার থেকে খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। সরকারই নাকি সময় সময় কুরীতি পালন করে। ঘটা করে সরকারি উদ্যোগে কুমারী প্রথা পালিত হয়। কুমারী প্রথাকে নেপালের সংস্কৃতি বলে গর্ব করা হয়। ঋতুস্রাব শুরু হয়নি এমন বাচ্চা মেয়েকে পুজো করাই  কুমারী প্রথা। সরকারই যদি কুমারী প্রথায়, ডাইনি-হত্যা প্রথায় বিশ্বাস করে, তাহলে সাধারণ মানুষও পরম উৎসাহে এসবে বিশ্বাস করবে। করছেও।

কুরীতির সীমা নেই। ১২৫ রকম জাত হিমালয়ে। একটি জাততো বিশ্বাসই করে তারা জন্মেছে পতিতা হওয়ার জন্য। মা’বাবাই বাচ্চা মেয়েদের বিক্রি করে দেয় পতিতালয়ে। তারা বিশ্বাস করে এটি তাদের সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি পালন করা তাদের কর্তব্য।

পনেরোশ’ শতাব্দীতে বিহার থেকে কিছু  লোক নেপালে এসে বাসা বেঁধে ছিল। ওদের কাজ ছিলো নেপালি জমিদারদের নাচ দেখিয়ে আর গান শুনিয়ে মুগ্ধ করা। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ওদের টাকা পয়সা কমে যায়, তখন ওরা পতিতার ব্যবসায় নামে। সেই থেকে এখনো তাই চলছে। বংশ পরম্পরায় ওরা এখন পতিতাই হচ্ছে।

নেপালে বহুস্ত্রী প্রথা যেমন আছে, বহু স্বামী প্রথাও আছে। শিশু বিবাহ আছে, বলি প্রথা আছে। বিধবা প্রথা তো সাংঘাতিক নারী বিরোধী প্রথা। স্বামী মরে যাওয়ার পর রঙিন কাপড় পরা যাবে না, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া যাবে না, অলঙ্কার পরা যাবে না। বাঙ্গালিরা এই প্রথা তো এখনো পালন করে। তবে বাঙ্গালিদের না থাকলেও জলখানে প্রথা বলে একটি অদ্ভুত প্রথা আছে নেপালে। নেপালি সমাজে স্বামীকে ভগবান বলে মনে করা হয়। খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে স্বামীর পা ধুয়ে, সেই পা ধোয়া জল খেতে হয় স্ত্রীদের। কাট্টো খানে প্রথা নামেও একটি প্রথা আছে। ওখানে অভিজাত বংশের কারো মৃত্যু হলে তার সৎকারের সময় কিছুটা মৃতদেহের  মাংস ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হয়। নেপালি রাজবংশ রানা পরিবার তাই করতো। সম্ভবত এখনো করে।

কন্যাদান প্রথায় মেয়েকে ঋতুস্রাবের আগেই বিয়ে দিতে হয়। অল্প বয়সী মেয়েদের ঘরে আনা মানে স্বামীর পরিবারের মূল্য বেড়ে যাওয়া। মানুষ  বিশ্বাস করে, স্বামীর পরিবারের যা কিছু পাপ ছিল এতকাল, সব মোচন হবে। এই প্রথার চর্চা করতে গিয়ে  দেখা যায়, প্রচুর মেয়ের ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

মেয়েরা কামালারি প্রথারও শিকার। ধনীদের কাছে গরিবেরা টাকা পয়সা ধার নিয়ে যদি শোধ করতে না পারে, তবে তাদের ৬/৭ বছর বয়সী মেয়েকে ধনীর বাড়িতে ক্রীতদাসি হিসেবে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। ক্রীতদাসি হয়ে গেলে তাদের আর ইস্কুলে যাওয়া, ভবিষ্যৎ গড়া, শিক্ষা অর্জন, স্বনির্ভরতা কিছুই হয়ে ওঠে না।

ডাইনি-হত্যা প্রথাকে নেপালে বকশি প্রথা বলা হয়। এই প্রথায় নিরপরাধ মেয়েদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলে। এই প্রথাকে   বিলুপ্ত করার জন্য নারী সংগঠনগুলো চেষ্টা করছে। এই প্রথা পালন করলে শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু কিছু করেও এই  প্রথা পালন করা সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।

তিন বছর আগে কাইলাই ডিস্ট্রিকের রাজ কুমারী রানাকে ডাইনি সন্দেহে নির্যাতন করা হয়। রাজকুমারীর এক আত্মীয় গ্রামবাসীকে বলল, রাজকুমারী  মানুষ নয়, সে ডাইনি। অমনি শুরু হয়ে গেল অত্যাচার। ভোরবেলায় এক দল লোক এসে রাজকুমারীকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে আমগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। বেদম পেটায়। ন্যাড়া করে দেয় মাথা। মল মূত্র খাওয়ায়, গায়ে ঢেলে দেয়। যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয় লাঠি। সারা গ্রাম উলঙ্গ অবস্থায় ঘোরায়। সারা গ্রাম চিৎকার করতে থাকে ডাইনি ডাইনি বলে। কেউ আসেনি রাজকুমারীকে ওই অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। এই  খবরটি নেপালের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সরকার রাজকুমারীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। দেখা যাক, রাজকুমারী   তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিচার পান কি না। বিচার পেতে হলে সরকারকে পাশে দাঁড়াতে হবে।

যাবতীয় কুরীতির বিরুদ্ধে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছেন। নেপালের সেই গুটিকয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। বলেছি আমিও পাশে আছি। মানুষকে কুপ্রথা কুরীতির বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে যেতে হলে যাবো। জীবন যতদিন আছে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো। জীবনতো আমাদের একটিই, এই জীবনের পরেতো আর জীবন নেই। যে জীবনটি পেয়েছি যাপন করার, সেটিকেই অর্থপূর্ণ করে যাই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ মার্চ, ২০১৭

 নারীবাদী হওয়া সহজ নয়

চিৎকার চেঁচামেচি করার মেয়ে ছিলাম না কখনও। কিছু পছন্দ না হলে আলগোছে নিজেকে সরিয়ে নিতাম। এখনও তাই করি। মা চাইতো আমি ধর্ম-কর্ম করি। করিনি কখনও। করিনি কারণ সৃষ্টিকর্তা আছে এই প্রমাণ পাইনি। জিন ভূতে বিশ্বাস করানোর অনেক চেষ্টা চলেছে, কিন্তু ওসবেও বিশ্বাস জন্মায়নি, কারণ ওদের অস্তিত্বেরও কোনও প্রমাণ পাইনি। কিশোরী-বয়সে স্মার্ট যুবকদের ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু লজ্জায় পারতাম না। ছোট বেলা থেকেই অনাত্মীয় পুরুষের সামনে না যাওয়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে। পত্র মিতালি বলে একটা ব্যাপার তখন সবে শুরু হয়েছে, বাড়ির বারণ সত্ত্বেও পত্র মিতালি করেছি। চিঠিতেই সম্ভব ছিল যুবকদের সঙ্গে কথা বলা। চিঠিতেই বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রেম চিঠিতেই করেছি। পত্র মিতালি করি বলে বাবার মার খেয়েছি। প্রেম করি বলেও মার খেয়েছি। কিন্তু মেরে আমাকে বাগে আনা যায়নি। প্রেমিককে বিয়ে করে সুখের সংসার করতে শুরু করলাম। ওই সংসারটি করতে গিয়েই গোল বাঁধলো। দেখলাম আমিই প্রেম দিচ্ছি, আমিই উজাড় করে দিচ্ছি, বিনিময়ে যা পাচ্ছি তা হলো, স্বার্থপরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা। আমি তখন আমার পূর্ব নারীদের মতোই কোনও এক নারী। নির্যাতিত। তবে আমার পূর্বনারীরা যা পারেনি, তা আমি পেরেছি, নিজের একনিষ্ঠতা, একগামিতা নিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। পূর্বনারীদের মতো পরনির্ভর ছিলাম না বলেই সম্ভব হয়েছে।

পিতার সঙ্গে নহে, ভ্রাতার সঙ্গে নহে, স্বামীর সঙ্গে নহে, একা মেয়ে একা থাকবো। কিন্তু ঊননব্বই/নব্বই সালে ঢাকা শহরে একটি মেয়েকে, সে মেয়ে ডাক্তার হলেও, কোনো বাড়িওয়ালাই একা থাকতে দিতে রাজি ছিলেন না। শেষ অবধি পেরেছি একা থাকতে। সেই থেকে একা থাকছি। পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে, কিন্তু একা থাকার সঙ্গে আপস করিনি। একা থাকা মানে সঙ্গীহীন হয়ে থাকা নয়, একা থাকা মানে স্বনির্ভর হয়ে থাকা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া, নিজের আনন্দ নিজে খুঁজে নেওয়া। কোনও পুরুষের অভিভাবকত্ব না মানা। পুরুষকে সহযাত্রী ভাবা, বন্ধু ভাবা, অভিভাবক না ভাবা, প্রভু না ভাবা। এগুলো বলা সহজ হলেও একটা কট্টর পুরুষতান্ত্রিক আর ধর্মান্ধ সমাজে করা সোজা নয়। করে দেখিয়েছিলাম। একা থেকে। একা কথা বলে। একা যুদ্ধ করে। চিরকালই আমার অস্ত্র কলম আর কীবোর্ড। ওদের মতো ছুরি তলোয়ারে আমার বিশ্বাস নেই, গুলি বোমাতেও বিশ্বাস নেই। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে মানুষের ন্যূনতম অধিকারটুকু নিয়ে বাঁচার জন্য। নিশ্চিন্তে হাটে মাঠে ঘাটে হাঁটাচলা করার, যানবাহনে চড়ার, ইস্কুল কলেজে পড়ার, চাকরি বাকরি করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার, ভাবার এবং মতপ্রকাশ করার ন্যূনতম অধিকার। যৌন-সামগ্রী বা যৌন-দাসী না হওয়ার, ধর্মের-সমাজের-আইনের বৈষম্যের শিকার না হওয়ার, নারী বলে নির্যাতিত না হওয়ার ন্যূনতম অধিকার। শুধু আমার জন্য নয়, সব মেয়ের জন্য।

ডাক্তার হয়েছি। পুরুষের পাশাপাশি বসে রোগীর চিকিৎসা করেছি। তারপরও যতটুকু সম্মান পাওয়া উচিত, ততটুকু পাইনি, মেয়ে বলেই পাইনি। কবিতা লিখি অল্প বয়স থেকেই। যতক্ষণ শুধু প্রেমের পদ্যে ছিলাম, ততক্ষণ আমি ভালো। আমার প্রতিবাদের গদ্য যত প্রখর হয়েছে, তত শুনেছি আমি মন্দ। শুনেছি কুৎসা, নিন্দে, চরিত্র হনন। যে মেয়েকে বন্দি করা যায় না, যে মেয়ের নিজস্ব স্বর আছে, নিজস্ব ভাবনা আছে, তার বিরুদ্ধে এসব ভালো জমে। এ নতুন কিছু নয়।

নারীবাদ নিয়ে প্রচুর লোকের জ্বলুনি দেখেছি দেশে বিদেশে সর্বত্র। তারা বলতে চায়, তুমি মানবতন্ত্রে বিশ্বাস করো ওটাই তো ভালো, নারীবাদী হওয়ার তো দরকার নেই। আমি বলি, যতদিন নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন নারীবাদকে টিকে থাকতে হবে। নারীবাদী আন্দোলন না থাকলে নারী আজ ভোট দিতে পারতো না, ভোটে দাঁড়ানোর কথা না হয় বাদই দিলাম। নারীবাদী আন্দোলন ছাড়া নারীর শিক্ষাও হতো না, স্বনির্ভরতাও হতো না, সমানাধিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। নারী এ পর্যন্ত যা কিছুই পেয়েছে, শ্রদ্ধা, সম্মান, স্বাধীনতা সব কিছুই কিন্তু নারীবাদী আন্দোলনের ফলে। সে আন্দোলন নারী করুক, বা পুরুষ করুক,   বা উভয়ে মিলে করুক।

আমার পথ কখনও মসৃণ ছিল না। কাঁটার ওপর দিয়েই হাঁটতে হয়েছে আমাকে। এখনও হচ্ছে। নারীর সমানাধিকারের কথা বলতে গিয়ে ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করেছি বলে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে ডাক্তারি চাকরি ছাড়তে, এক দেশ থেকে এবং এক রাজ্য থেকে আক্ষরিক অর্থে বের করে দেওয়া হয়েছে আমাকে, বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বইয়ের প্রকাশক, ছবির পরিচালক আর পত্রিকার সম্পাদকদের আমার চৌহদ্দি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে একা করে দেওয়া হয়েছে। শারীরিক আক্রমণ চলেছে আমার ওপর, আমি মানুষটাকে নিষিদ্ধ করেছে বইমেলা, সাহিত্য উৎসব। ভেঙে ফেলা হয়েছে আমাকে, টুকরো টুকরো করা হয়েছে আমার জগেক। তারপরও উঠে দাঁড়িয়েছি। না, কেউ আমাকে সাহায্য করেনি কোনও গন্তব্যে যেতে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ আমার গন্তব্য। একটি ভায়োলেন্সহীন পৃথিবী আমার গন্তব্য। বলি স্বর্গে পৌঁছানো সহজ, এমন ইউটোপিক গন্তব্যে নয়।

ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছি ভারতে। ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েদের তো বেশি জানি আমি, তারা তো আমারই মতো মেয়ে। আমারই মতো দেখতে, আমার ভাষার মতো ভাষা তাদের, আমার পূর্বনারীদের মতো তাদেরও পূর্বনারী, আমার ইতিহাসের মতো তাদেরও ইতিহাস, আমার মতো তারাও শিকার পুরুষতন্ত্রের, ঘৃণার, হিংসের, বিদ্বেষের এই অঞ্চলের নির্যাতিত মেয়েদের যদি স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী হতে এবং পাশাপাশি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার উৎসাহ দিতে পারি। তাহলেই আমার এই দীর্ঘ কণ্টকময় পথের যাত্রা সার্থক হবে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ মার্চ, ২০১৭

উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই

সেদিন বলেছিলাম, হিন্দুরা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলছে, মুসলমানরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলছে। কত ভালোই না হতো যদি হিন্দুরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলতো, আর মুসলমান হিন্দুদের পক্ষে কথা বলতো।

নুরিত পেলেড-এলহানান একজন ইহুদি।   জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-শিক্ষার শিক্ষক। আমার মতোই তিনি ইউরোপীয় সংসদ থেকে মুক্তচিন্তার জন্য সাখারভ পুরস্কার পেয়েছেন। নুরিত পেলেডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনি তাঁর সংগ্রামের কথা যখন বলেছেন, আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় বসেছিলাম। নুরিতের মেয়ে স্মাদার ১৩ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী বোমায় জেরুজালেমের রাস্তায় নিহত হয়। নুরিত ইজরাইলি হয়েও, ইহুদি হয়েও, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন। তিনি এক জিওনিস্ট পরিবারের মেয়ে। তাঁর ঠাকুরদা ইজরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা মাটিনিয়াহু পেলেড ছিলেন ইজরাইলের মেজর জেনারেল। নুরিতের মতো নুরিতের ভাই মিকো পেলেডও ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন।

নুরিত তাঁর ‘Palestine in Israeli Books : Ideology and Propaganda in Education’ বইটিতে লিখেছেন ইজরাইলের ইস্কুল-বইয়ে আরবদের সম্পর্কে লেখা হয় তারা বর্ণবাদী। লেখা হয়, ‘আরবরা মূলত শরণার্থী, সন্ত্রাসী আর আদ্দিকালের কৃষক’। অনেকে অবশ্য নুরিতের এই দাবি মানেন না। ইজরাইলি লেখক এবি ইয়েহোশুয়া বলেছিলেন আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দূরত্ব এত বেশি যে ওরা কখনও একসঙ্গে বাস করতে পারবে না। নুরিত এ কথা মানেননি। ইউরোপীয় সংসদে দেওয়া নুরিতের বক্তৃতা আমি শুনেছি, ইজরাইলের মাটিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী আর ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর যে কী পরিমাণ নির্যাতন হয়— তা বর্ণনা করেছেন। প্রতিকার চেয়েছেন। ইজরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। নুরিতকে আমি বলেছি, ‘ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছে তোমার মেয়ে, তারপরও তুমি ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য দিনরাত খেটে চলেছ, ইজরাইলি শাসকের বর্বরতার বিরুদ্ধে তুমি। তোমাকে নমস্কার’। নুরিত সস্নেহে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও সংখ্যালঘুদের পাশে তুমিও তো দাঁড়িয়েছো। তুমিও তো লিখেছো ‘লজ্জা’ নামের বই। আমরা আসলে একই কাজ করছি, যে কাজ পৃথিবীকে আমাদের সবার বাসযোগ্য করার জন্য খুব জরুরি।

কিছু দিন আগে ভারতের গুরমেহার কাউর নামে ২০ বছর বয়সী এক মেয়ে তার এক ভিডিও প্রকাশ করেছে সোশাল মিডিয়ায়। এটি নিয়ে ভারত এখন উত্তাল। মেয়েটির বাবা মানদীপ সিং ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের মিলিটারি ক্যাম্পে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। গুরমেহারের তখন ২ বছর বয়স। গুরমেহার বলছে, তার বাবাকে পাকিস্তান মারেনি, মেরেছে যুদ্ধ। বলেছে যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোনও যুদ্ধ না থাকতো, তাহলে তার বাবাকে মরতে হতো না। গুরমেহার যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। চায়, পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যত কলহ কোন্দল আছে, সব ঘুচে যাক, প্রতিষ্ঠা হোক শান্তি। গুরমেহার এরপর তার কলেজের উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের কাছ থেকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি তো আছেই, ধর্ষণের হুমকিও পেয়েছে। গুরমেহারকে সবাই আশা করেছিল ভীষণ পাকিস্তান-বিরোধী এক মেয়ে হবে সে। পাকিস্তানকে ঘৃণা করবে। উল্টে মেয়ে হয়ে উঠেছে উদার এবং সহিষ্ণু। যে পাকিস্তান সন্ত্রাসী পাঠিয়ে তার বাবাকে হত্যা করেছে, সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার কোনও ক্ষোভ নেই। হত্যার প্রতিশোধ সকলে নিতে চায়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চারদিক থেকে প্রেরণা আসে। সমাজে হিংসে, ঘৃণা এসব খুব সহজ এবং স্বাভাবিক। প্রতিশোধ না নিয়ে, ঘৃণা না ছড়িয়ে, হিংসেয় উন্মত্ত না হয়ে আমি যদি সভ্য উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য বলি, আমি যদি শান্তির কথা বলি, আমি যদি সহনশীলতা আর সহমর্মিতার কথা বলি— তাহলে আমি কোনও না কোনওভাবে জাতীয়তাবাদবিরোধী, দেশদ্রোহী! এমনিতো হচ্ছে। গুরমেহারকেও ভারতবিরোধী বলা হয়েছে, নুরিতকেও বলা হয় দেশদ্রোহী, আমাকে তো বলাই হয়। দেশের ভালো যারাই করতে যায়, তাদেরই দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। আখ্যা দেয় তারাই, যারা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করে, যারা রক্তপাতে আর মৃত্যুতে বিশ্বাস করে।

কত যে অমসৃণ পথে হাঁটতে হয় আমাদের। কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হতে হয়।   কিন্তু তারপরও আমরা যেখানে আছি, সেখানে থাকবো বলে ঠিক করেছি। ঘৃণা কখনও কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ভালোবাসাই দিতে পারে মুক্তি, উদারতাই আনতে পারে শান্তি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ মার্চ, ২০১৭

ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা

অদ্ভুত একটা দিন বটে। ছোটবেলায় এরকম দিনের নাম শুনিনি। হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলো। জুড়ে বসে ভালো কাজ যদি করতে পারে করুক। ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সবচেয়ে যেটা গ্রহণযোগ্য, সেটা হলো, লুপারকালিয়া বলে প্রাচীন রোমে এক উৎসব ছিলো, যেটি ফেব্রুয়ারির ১৩ থেকে ১৫ তারিখ অবধি হতো। যে উৎসবে নারী-পুরুষ প্রচুর মদ্যপান করতো, আর সঙ্গমের জন্য সঙ্গী বেছে নিতো। রোমের মানুষ তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছিলো যত বেশি, প্রাচীন রোমের দেবীর নামে লুপারকালিয়া উৎসবকে তত তারা মানতে পারছিলো না। উৎসবটি খুব জনপ্রিয় ছিল বলে পুরো ছেড়েও দিতে পারছিলো না। শেষে এমন হলো, উৎসবটি করতে লাগলো, কিন্তু উৎসবটিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করে, তবে। সেই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তৃতীয় শতকে যার গর্দান কেটেছিলেন। ইতিহাসবিদ নোয়েল লেন্সকি বলেছেন লুপারকালিয়া উৎসবে পুরুষেরা দেবী লুপারকাসের উদ্দেশে একটি ছাগল আর একটি কুকুর বলি দিতো। তারপর মৃত ছাগল বা কুকুরের চামড়া দিয়ে উৎসবের মেয়েদের বেদম মারতো। তারা বিশ্বাস করতো, এই মার খেলে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে। লুপারকালিয়া উৎসব ছিলো সকলের মদ খাওয়ার উৎসব, মদ খেতে খেতে মাতাল হওয়ার উৎসব, মাতাল হতে হতে ন্যাংটো হওয়ার উৎসব, ন্যাংটো হতে হতে লটারির উৎসব, লটারির কৌটো থেকে যে পুরুষ যে মেয়ের নাম ওঠাতো, তার সঙ্গে সেই পুরুষ সঙ্গম করতো সে রাতে। শুধু সে রাতে নয়, ইচ্ছে হলে আরও কিছু রাতে, কেউ কেউ বিয়ে করে নিতো। রোমের মানুষেরা খ্রিস্টান হওয়ার পর ওই উৎসবের নাম যেমন বদলে দিয়েছে, ন্যাংটো শরীরে কাপড়ও পরিয়েছে। পোপ প্রথম জেলাসিয়াস পঞ্চম শতাব্দীতে এটিকে খ্রিস্টানদের ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন।

মধ্যযুগের ইংরেজ কবি জেফ্রি চশার, আর উইলিয়াম শেকসপিয়ার ভ্যালেন্টাইন ডে’কে রোমান্টিক দিন বলেছেন, এ নিয়ে পদ্য রচনাও করে গেছেন। চশার যদি ভ্যালেন্টাইন ডে’কে রোমান্টিক আখ্যা না দিতেন, যদি কাব্য করে না বলতেন সঙ্গী পছন্দ করার জন্য নানা রঙের পাখি ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসত, তাহলে দিনটির সঙ্গে হয়তো ভালোবাসা এসে মিশতো না এমন। ন্যাংটো হয়ে মেয়েদের ওপর নির্যাতন করার ওই প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক উৎসবটিকে ‘রোমান্টিক’ না বলা হলে আমার মনে হয় না দিনটি প্রেমের দিন হিসেবে এভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো। যে দুজন ভ্যালেন্টাইন নামের সন্তকে মেরে ফেলা হয়েছিল মধ্য ফেব্রুয়ারিতে, তাঁদের কেউই কিন্তু রোমান্টিক লোক ছিলেন না। রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস রোমের সৈন্যদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, জানি না কেন, বিবাহিত পুরুষেরা ভালো সৈন্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। রোমের এক পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন দাঁড়িয়েছিলেন সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে, গোপনে বিয়ে করেছিলেন তিনি, সৈন্যদের বিয়েও দিয়েছিলেন। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর গর্দান কাটা যায়, গর্দান কাটার আগে নাকি জেলারের মেয়ের প্রেমে পড়েন তিনি, একটি চিঠির শেষ ছত্রে লিখেছিলেন, ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন।

আজ একবিংশ শতাব্দীতেও সেই ভ্যালেন্টাইনের নামে দিবস পালন হচ্ছে। তবে দিবসটি এখন ব্যবসায়ীদের জন্য বিশাল দিন। আমেরিকায় এ বছর ১৮.২ বিলিয়ন ডলারের ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার ক্যান্ডি, ফুল, কার্ড আর ডিনার বিক্রি হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।

ভ্যালেন্টাইন ডে’র বিপক্ষে হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদীরা বেশ সরব। তারা মনে করে এই দিবসটি আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী। আশ্চর্য, প্রেম কি সংস্কৃতির অংশ নয়? যে সংস্কৃতিতে প্রেম নেই, সেই সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি। যারা প্রেম দিবসের বিরুদ্ধে মিছিল করে, তারা কি কখনও ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ঘৃণা আর বর্বরতার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে? নিশ্চিতই করেনি।

ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস যত কুিসতই হোক, যত বর্বরই হোক, যত উদ্ভট হোক, দিনটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা যত ব্যবসা করুক না কেন, দিনটির সঙ্গে ভালোবাসা জড়িয়ে আছে, ভালোবাসাটা জেফ্রি চশারের কারণেই জড়াক, জড়িয়েছে তো! মানুষ তো ইতিহাস জানে না, সে কারণেই দিনটিকে নিখাদ ভালোবাসার দিন হিসেবেই বিচার করছে। না হয় করুক। চারদিকে যখন ঘৃণা আর অবিশ্বাস, চারদিকে যখন স্বার্থপরতা আর হিংসে, চারদিকে যখন যুদ্ধ আর অশান্তি— তখন কোনও এক নামে কোনও এক দিবস যদি আসে, যে দিবস মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা-স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, এর চেয়ে সুখবর আর কী আছে পৃথিবীতে? মানুষ জন্মেই শিখে যাচ্ছে কী করে নিজের জন্য সব নিতে হয়, ছলে বলে কৌশলে মানুষ শুধু নিতে শিখে যায়, কিন্তু দিতে শেখে না, দিতে কেউ কাউকে শেখায় না, ভ্যালেন্টাইন নামের দিনটি এসে যদি শেখায়, ক্ষতি কী? ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই তো হিংসে বিদ্বেষ নিয়ে আছে, বছরের একটি দিনও যেন ভালোবাসা নিয়ে থাকে।

দিনটি যদি ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্তি পেতো, সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্যবসায়ীরা দিবসটির নামে ব্যবসা করে নিচ্ছে বলে গোটা দিবসটিকে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তার চেয়ে দিবসটিকে আর কী কী উপায়ে সুন্দর এবং সমৃদ্ধ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। দিবসটির বিবর্তন সেই আদিকাল থেকে হচ্ছে। আজ মানুষ শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাকে নয়, বাবা মা ভাই বন্ধু এবং পোষা কুকুর বেড়ালকেও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন জানাচ্ছে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করার আর তো সময় সুযোগ নেই কারোর। যদিও আমি মনে করি, ভালোবাসা এক দিনের জন্য নয়, ভালোবাসা নিত্যদিনের জন্য, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করি না, কিন্তু সমাজটা যেহেতু স্বার্থান্ধ, এই সমাজটাকে চাই ভালোবাসা শিখুক, ভালোবাসার চর্চা করুক। ঘৃণা প্রদর্শন নিয়ে জড়তা নেই, কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে যেহেতু জড়তা আছে, চাই আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের জন্য মানুষ ভালোবাসা প্রকাশ করুক। মানুষ প্রকাশ্যে মানুষকে চড় নয়, কিল নয়, লাথি নয়, বরং চুমু খাক। একটি দিন ভালোবাসার চর্চা করলে মানুষ প্রকাশ্যে প্রেম করাকে আর চুমু খাওয়াকে মন্দ বলে ভাববে না, নিষিদ্ধ বলে ভয় পাবে না, মানুষের দ্বিধা কেটে যাক। আজ এই দিনে ভায়োলেন্স নিষিদ্ধ হোক।

নারীর ওপর নির্যাতন অন্তত একটি দিনের জন্য বন্ধ করবে কি পুরুষ? ভায়োলেন্স অন্তত বছরের একটি দিনে না করুক পুরুষ। ভ্যালেন্টাইন দিবসে যদি ভায়োলেন্স বন্ধ না হয়, তা হলে কোনও মানে নেই এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের। তুমি ভালোবাসতে না পারো, অন্তত ঘৃণা করো না। তুমি ফুল দিতে না পারো, অন্তত কাঁটা দিও না। তুমি চুমু খেতে না পারো, অন্তত চড় মেরো না। ভায়োলেন্স বন্ধ না করলে ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করার অধিকারই হয়তো পুরুষের থাকা উচিত নয়! ভ্যালেন্টাইন ডে’তে যেন একটি মেয়েকেও যৌন দাসী হতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেন পুরুষের নির্যাতন সইতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেন মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর স্বনির্ভরতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হতে হয়। রাজি?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?

সেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বললেন, হোয়াইট হাউসে যে মেয়েরা কাজ করবে, তাদের সবাইকে ‘মেয়েদের মতো পোশাক’ পরতে হবে। মেয়েদের মতো পোশাক বলতে ট্রাম্প বুঝিয়েছেন যে পোশাক পরলে মেয়েদের যৌনাবেদন বাড়ে। এদিকে উল্টো ঘটনা ঘটেছে ভারতে। মুম্বাই-এর গভরমেন্ট পলিটেকনিক কলেজের প্রিন্সিপাল স্বাতী দেশপান্ডে বলেছেন, ‘আমি শুনেছি কেন মেয়েরা অল্প বয়সে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে ভোগে। পুরুষের পোশাক পরলে মেয়েরা পুরুষের মতো চিন্তা করে, পুরুষের মতো আচার ব্যবহার করে। নিজেকে পুরুষ বলেই মনে করতে থাকে। এ কারণেই, অল্প বয়স থেকেই তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার স্বাভাবিক ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যায়, তারা ভুগতে থাকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে। ’ স্বাতী দেশপাণ্ডে এর মধ্যে ‘ইভ টিজিং’ বন্ধ করার নামে কলেজ ক্যান্টিনে ছাত্র আর ছাত্রীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা করেছেন। ছাত্রীদের ‘সুইটেবল’ পোশাক পরার অর্থাৎ সালোয়ার কামিজ পরার আদেশ দিয়েছেন। পুরুষের পোশাক পরলে কী ক্ষতি হয় তা তো বলেই দিয়েছেন। এখন, আমার প্রশ্ন, এত অজ্ঞতা নিয়ে কী করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন, আর কী করে স্বাতী দেশপান্ডে একটি কলেজের প্রিন্সিপাল হন? প্রিন্সিপালের উদ্ভট মন্তব্যের প্রতিবাদে টুইটারে আর ফেসবুকে মানুষ নানা রকম পোশাক পরা মেয়েদের ছবি পোস্ট করছে। ভারতীয় মেয়ে— যারা বিজ্ঞানী, বৈমানিক, সাঁতারু, ফুটবলার, রেসলার, রানার, হাইকার, পুলিশ, মিলিটারি তাদের ছবি। মেয়েদের এসব পোশাক পুরুষের পোশাকের চেয়ে পৃথক নয়। ড্রেসলাইকএনইন্ডিয়ানউওম্যান হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে মেয়েরা শর্টস আর টিশার্ট পরা নিজেদের ছবিও প্রচুর পোস্ট করছে। এসব পোশাক পরা মেয়েরা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে ভুগছে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনও ইচ্ছে এই রোগের কারণে নষ্ট হয়ে যায় না। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম বলে একটি রোগ আছে, এই রোগে মেয়েদের হরমোনের গণ্ডগোল দেখা দেয়। পরীক্ষা করলে দেখা যায় জরায়ুর পাশে যে ডিমের থলি থাকে, সেখানকার ডিমগুলো বেশ ফুলে উঠেছে। এই সিন্ড্রোমটা কী কারণে হয়, তা এখনও সঠিক জানা যায়নি, তবে দেখা গেছে ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ থাকলে, প্রচুর ইনসুলিন নিলে, ওজন খুব বেড়ে গেলে, জরায়ুতে ক্যান্সার হলে এটি হয়। হলে ঋতুচক্র স্বাভাবিক থাকে না, গোঁফ দাড়ি গজাতে থাকে, ব্রণও। গর্ভবতী হওয়াও কঠিন হয়ে ওঠে। এটির চিকিৎসা আছে। অনেক মেয়েই এই রোগে ভোগে, আবার সেরেও ওঠে। এই রোগের সঙ্গে কিন্তু মেয়েরা কী পোশাক পরলো, কী চিন্তা করলো, কী ভাবলো— তার সম্পর্ক নেই। একেবারেই নেই।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কলেজের প্রিন্সিপালের এমন অদ্ভুত বিশ্বাস কী করে এলো যে, মেয়েরা পুরুষের পোশাক পরলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমে ভুগবে এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে! সম্ভবত তিনি কোনও মেয়েকে ওই রোগে ভুগতে দেখেছিলেন, যে মেয়ের পরনে পুরুষের পোশাক ছিল। তাই তিনি ভেবে নিয়েছেন, পুরুষের পোশাক পরলে ওই রোগ হয়। যে মেয়েকে ওই রোগে ভুগতে দেখেছিলেন, সেই মেয়ে যদি মার্সিডিজ গাড়ি চালাতো, তাহলে জানি না বলতেন কিনা, মেয়েরা মার্সিডিজ গাড়ি চালালে ওই রোগ হয়। আসলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম কোনও বিষয় নয়, মেয়েদের পোশাক নিয়েই প্রিন্সিপালের আপত্তি। আপত্তিটার কারণ তাঁর মানসিক সমস্যা অথবা তাঁর মূর্খতা।

মূর্খতা প্রচুর মানুষের মধ্যে দেখি। মূর্খতা ট্রাম্পের মধ্যেও। ট্রাম্প ভাবেন, মেয়েরা যৌনবস্তু ছাড়া খুব বেশি কিছু নয়, যৌনবস্তুদের এমনভাবে পোশাক আশাক পরতে হবে যেন তাদের দেখে পুরুষের যৌন উত্তেজনা জাগে। ট্রাম্পের মতো স্বাতী দেশপাণ্ডেও মেয়েদের যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক পরার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। স্বাতী দেশপান্ডের মতো মানুষেরাও ভাবেন মেয়েরা যৌনবস্তু, তাই মেয়েদের তাঁরা এমন পোশাক পরাতে চান, যে পোশাক পরলে মেয়েদের শরীর প্রদর্শিত হবে না, পুরুষদের যৌন উত্তেজনা জাগবে না। স্বাতী দেশপাণ্ডে আর মৌলবাদী যারা মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করেন— একই মানসিকতার লোক। একই উদ্দেশে তাঁরা মেয়েদের শরীর আবৃত করেন। তাঁরা নিশ্চিত মেয়েদের শরীরের খাঁজভাঁজ দেখলে পুরুষেরা এমন উত্তেজিত হবে যে সমাজে ভয়ানক বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাঁরা নিশ্চিত পুরুষেরা নিজেদের যৌন উত্তেজনা শামাল দিতে অক্ষম। আর ওদিকে মেয়েদের শরীর অনাবৃত করতে চান ট্রাম্প। ট্রাম্পের মতো লোকেরা ভেবেই নিয়েছেন যৌন উত্তেজনা জাগানোই মেয়েদের কাজ।

ওঁরা ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। কিন্তু দু’পক্ষের মানসিকতাই মেয়েদের ভোগায়। ওঁরা কেউই মেয়েদের মানুষ হিসেবে সম্মান করে না। ওঁদের এক পক্ষ মেয়েদের আবৃত করে, আরেক পক্ষ অনাবৃত করে। দু’পক্ষই সমান নারীবিদ্বেষী। মেয়েরা যারা আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়, তাদের উপায় একটিই, ওই দু’পক্ষকেই গ্রাহ্য না করা, নিজের মতো চলা, নিজের যা করতে ভালো লাগে তা করা, নিজের যা পরতে ভালো লাগে তা পরা। যদি শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়, শাড়ি; সালোয়ার, কামিজ, শার্ট, প্যান্ট, শর্টস টিশার্ট, বিকিনি, স্কার্ট যা কিছু। এখন অনেকে বলতে পারেন, যদি বোরখা পরতে ইচ্ছে হয় বোরখাও। হ্যাঁ বোরখাও। তবে বোরখা পরতে আদৌ কোনও মেয়ে চায় কিনা এই ব্যাপারে আমার কিন্তু যথেষ্ট সংশয়। বোরখা মেয়েরা পরে, পরতে বাধ্য হয় বলে পরে। ভালোবেসে, শখ করে কেউ বোরখা পরে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিছু না পরতে ইচ্ছে হলে কিছু না পরার স্বাধীনতাও কি মানুষের থাকা উচিত নয়? হ্যাঁ সেটিও থাকা উচিত।

যে পোশাকগুলোকে এক সময় পুরুষের পোশাক বলে চিহ্নিত করা হতো সে পোশাকগুলো এখন আর শুধু পুরুষের পোশাক নয়, ঠিক যেমন যে কাজগুলোকে এক সময় পুরুষের কাজ বলে চিহ্নিত করা হতো, সেগুলো আর শুধু পুরুষের কাজ নয়। মেয়েরা প্রমাণ করেছে পুরুষেরা যে কাজ করতে পারে, সে কাজ মেয়েরাও করতে পারে। মেয়েরা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে পারে, মেয়েরা পুলিশ হয়ে চোর ডাকাত ধরতে পারে, মেয়েরা বিমান চালাতে জানে, মহাশূন্যে ভাসতে পারে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, বড় বড় বিজ্ঞানী হতে পারে, মেয়েরা শ্রমিক হতে পারে, কেরানিগিরিও করতে পারে। যে কোনও পেশার নির্ধারিত পোশাকই মেয়েদের পোশাক। মেয়েরা যেহেতু সর্ববিদ্যায় পারদর্শী, মেয়েদের পোশাকও তাই সর্বরকম। মেয়েদের পোশাক কোনও নির্দিষ্ট পোশাকে সীমাবদ্ধ নয়। তারা যে কোনও পোশাক পরার অধিকার জন্মগতভাবে রাখে, পেশাগতভাবেও রাখে।

মেয়েদের পোশাককে পুরুষেরা তাদের রাজনীতির বিষয় করেছে। মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হলে তারা মেয়েদের পোশাককে দোষ দেয়। সমাজ যে সভ্য হয়নি, শিক্ষিত হয়নি, সমাজ যে এখনও মেয়েদের দ্বিতীয় লিঙ্গ বলে বিচার করে, মেয়েদের যৌনবস্তু বলে মনে করে— এ কথা স্বীকার করে না, এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হয় না। বরং মেয়েদের আদেশ বা উপদেশ দেয় ছোট পোশাক ছেড়ে বড় পোশাক পরার, এ পোশাক না পরে সে পোশাক পরার। জিন্স না পরে সালোয়ার পরার, সালোয়ার না পরে শাড়ি পরার। বিশেষজ্ঞরা এই যে এত বলছেন যে মেয়েদের পোশাকের কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটে না, তারপরও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে মেয়েরা বা মেয়েদের পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়, দায়ী ধর্ষক, দায়ী ধর্ষকের নারীবিদ্বেষ, দায়ী ধর্ষকের অজ্ঞতা, মূর্খতা, পুরুষতান্ত্রিকতা।

আচ্ছা, পুরুষের ওপর ঘটা কোনও যৌন হেনস্থার দায় কি পুরুষের কোনও পোশাকের ওপর দেওয়া হয়? দেওয়া হলে পোশাক বদলানোর উপদেশ কি মুহুর্মুহু বর্ষণ করা হয় পুরুষের ওপর? মেয়েদের ওপর চলা অন্যায়ের, সত্যিই, কোনও সীমা নেই, শেষ নেই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

ভারতে অসহিষ্ণুতা

কিছুদিন আগে পদ্মাবতী ছবির শুটিং এ বিখ্যাত পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভান্সালিকে শারীরিক আক্রমণ করেছে ‘রাজপুত কারনি সেনা’ নামের একটি দল। ছবিতে পদ্মাবতীর সঙ্গে আলাউদ্দিন খিলজির ঘনিষ্ঠতা দেখানো হচ্ছে, এটা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। সঞ্জয় ইতিহাস বদলে দিচ্ছেন, অভিযোগ এখানেই। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে বই লিখতে গেলে, বা ছবি আঁকতে গেলে, বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে লেখক, শিল্পী, চিত্রপরিচালকরা খানিকটা নিজের কল্পনা মেশানই। এ নতুন কিছু নয়। দোষ সঞ্জয় লীলার নয়।   শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করে নিলে আর যাই তৈরি হোক, শিল্প তৈরি হয় না। পদ্মাবতীর কথা ইতিহাসে আছে, কিন্তু পদ্মাবতী নামে বাস্তবে আদৌ কেউ ছিল কি না এ নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কয়েক মাস আগে চিত্র পরিচালক করন জহরের ওপরও হামলা হয়েছে। কেন তাঁর ‘এ দিল হ্যায় মুশকিল’ ছবিতে ফওহাদ খান নামের এক পাকিস্তানি অভিনেতাকে নেওয়া হলো, এ নিয়ে আপত্তি ‘মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা’ নামের একটি দলের। দেশি অভিনেতা থাকতে পাকিস্তানের মতো শত্রু দেশ থেকে কেন অভিনেতা আনতে হয়, যখন পাকিস্তানের হামলায় ভারতের সেনারা মরছে? করন জহরের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ওরা। করন জহর প্রতিজ্ঞা করেছেন তাঁর ছবিতে তিনি আর পাকিস্তানি অভিনেতা নেবেন না। জানি না সঞ্জয় লীলা ভান্সালিও আতঙ্কে ডুবে আছেন কিনা, তিনিও তাঁর ছবির গল্প বদলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কিনা।

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফান্দাবিস তাঁর অফিসেই করন জহর আর ‘মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা’র দল-প্রধান রাজ থেকারের সঙ্গে একটি মিটিংএর ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই মিটিং-এ রাজ থেকারে করন জহরকে বলেছেন ভারতীয় সেনার তহবিলে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে। এসব হামলার জন্য রাজপুত কার্নি সেনার বা মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনার কেউ গ্রেফতার হয়নি। না হিন্দু কট্টরপন্থী, না মুসলিম কট্টরপন্থী— কাউকে তাদের অপকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া হয় না। আমার ওপরও হামলা হয়েছে, হামলা করেছে মুসলিম কট্টরপন্থী। তারাও শাহেনশাহর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কট্টরপন্থীরা মানুষের বাক স্বাধীনতায় এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে যে রাজনীতিকরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা কী করে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করার স্পর্ধা করেন? ভারতের বেশ কজন মুখ্যমন্ত্রী তাই করছেন। মুখ্যমন্ত্রীরাই যদি ধর্মীয় মৌলবাদীদের বা কট্টরপন্থীদের, যতই তারা অন্যায় করুক, সমর্থন করেন, ভিন্ন মতের মানুষেরা তবে যাবেন কোথায়? শিল্পী সাহিত্যিকরা করবেন কী? আমার ব্যাপারেই দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের কিছু ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী ‘তসলিমা গো ব্যাক’ বলে চেঁচালো, অমনি মুখ্যমন্ত্রী তসলিমাকে বের করে দিলেন রাজ্য থেকে, শুধু তাই নয়, বাক-স্বাধীনতা বিরোধী কট্টরপন্থীদের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু মালা পরানো বন্ধ হয়নি।

এর আগেও ২০১০ সালে শাহ্রুখ খানের ‘আমার নাম খান’ ছবি নিয়েও ঝামেলা করেছিল কট্টরপন্থী হিন্দু দল ‘শিব সেনা’। শাহ্রুখ তাঁর আই পি এল-এ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নিতে চেয়েছিলেন, সে কারণেই রাগ। এম এফ হুসেনকে হিন্দু মৌলবাদীদের অত্যাচারে পালিয়ে যেতে হয়েছে দেশ ছেড়ে। হুসেনের দোষ, সরস্বতীর ছবি আঁকার সময় তাঁর গায়ে তিনি কাপড় পরাননি। নারীর সম্ভ্রম নিয়ে যাদের এত মাথাব্যথা তারা কিন্তু এত যে ধর্ষণ আর খুন খারাবির শিকার হচ্ছে মেয়েরা, তার প্রতিবাদে মোটেও ঝাঁপিয়ে পড়ে না। দেবীর কাপড় কোনও শিল্পীর অধিকার নেই খোলার, কিন্তু পুরুষের অধিকার আছে রক্তমাংসের নারীর কাপড় ঘরে বাইরে খুলে ফেলার এবং ধর্ষণ করার!

জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে আমি গিয়েছি এ খবর শুনেই এই সেদিন কিছু মুসলিম মৌলবাদী জড়ো হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল ‘তসলিমা গো ব্যাক’ বলে। তাদের দাবি তসলিমা তার ‘লজ্জা’ নামের বইয়ে ইসলামকে, ইসলামের নবীকে অপমান করেছে। সুতরাং লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে তসলিমার যোগ দেওয়া চলবে না। আমার লেখা কোনও বই-ই যে রাজস্থানী মুসলিম মৌলবাদীরা পড়েনি, এ আমি নিশ্চিত। লজ্জা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কাহিনী, তাদের নিরাপত্তাহীনতার আর দেশত্যাগের কাহিনী।

লজ্জায় ইসলাম নিয়ে কোনও বাক্য নেই, ইসলামের নবী নিয়ে তো নেইই। লজ্জা না পড়েই, লজ্জার গল্প না জেনেই লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসা মুসলমানেরা ভণ্ড তো বটেই, পাঁড় মিথ্যুকও। এদের কাছেই ভারতের অসৎ রাজনীতিকদের মতো মাথা নোয়ালেন লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের পরিচালক। বলে দিলেন, যেহেতু মুসলিমরা চান না তসলিমা ফেস্টিভ্যালে আসুক, তসলিমাকে তাঁরা আর কখনও আমন্ত্রণ জানাবেন না। ব্যস, সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু সমস্যা কি এভাবে মেটে? এভাবে বাক স্বাধীনতা আরও বেশি লঙ্ঘিত হয়, এভাবে মৌলবাদীদের বাক স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে বিস্তর আস্কারা দেওয়া হয়। জয়পুর লিট ফেস্টে কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী দল ‘আর এস এস’-এর ডাকসাইটে দুই নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন, ওঁরা হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চান, যে রাষ্ট্রে মুসলমানদের জায়গা নেই, জায়গা থাকলেও অধিকার খুব বেশি নেই। এই হিন্দুত্ববাদী আর এস এসের নেতাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা প্রতিবাদ করেনি, করেছে আমার উপস্থিতির বিরুদ্ধে। হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে যেমন আমি হিন্দুর পাশে দাঁড়াই, মুসলমানরা অত্যাচারিত হলেও একইভাবে মুসলমানদের পাশে দাঁড়াই। ওই মৌলবাদীদের মানবাধিকারের জন্য আমিও লড়বো। কিন্তু কেন মৌলবাদীরা মুসলিমদের শত্রুর বিরুদ্ধে স্লোগান না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে দেয়? এর উত্তর খুব সোজা। কারণ আমার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে তাই করলেও, আমাকে তাড়ালে, আমার মাথার দাম ঘোষণা করলে কারও কোনও শাস্তি হয় না, কেউই তাদের বর্বরতার প্রতিবাদ করে না, সবাই মেনে নেয় বর্বরদের দাবি, দাবি না মানলেও মুখ বুজে থাকে। সঞ্জয় লীলা ভান্সালির ওপর হামলার প্রতিবাদ প্রায় সব শিল্পী সাহিত্যিকই করেছেন, কিন্তু তসলিমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে কেউ দাঁড়ায় না। সম্ভবত এর একটিই কারণ, হিন্দু মৌলবাদীদের চেয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের মানুষ ভয় পায় বেশি। রাজনীতিকদের অবশ্য মুসলিমদের ভোট আদায় করার জন্য মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে হাত পাতার অভ্যেস আছে, তাদের খুশি করার জন্য রাজনীতিকরা হেন কাজ নেই করেন না।

হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদী— দুটোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ভারতবর্ষে। চিরকালই তাদের অস্তিত্ব ছিল, কখনও কখনও ভয়ঙ্করভাবেই ছিল, তবে শিল্পী সাহিত্যিকদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা আজকাল ত্রিশূল আর তলোয়ার হাতে বেপরোয়া দাঁড়িয়েছে। এদের যদি পরাস্ত করা না হয়, তবে সমাজ পরাস্ত হবে। ধর্মের শাসন কায়েম হবে। ক্রমশ পেছনে হাঁটবে ভবিষ্যৎ, ক্রমশ অতীতের দিকে যাবে। অন্ধকার যুগের দিকে যাবে।

মনে হচ্ছে পৃথিবীজুড়েই ধর্মান্ধ আর মৌলবাদীদের জয়জয়কার! আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তো বলেছেন, তিনি বিবর্তনে বিশ্বাস করেন না, বিশ্বাস করেন বাইবেলের রূপকথায়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন এবার ছ’জন ক্রিশ্চান ধর্মগুরু ভাষণ দিয়েছেন। আমেরিকার অন্য কোনও প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনীতে এত বেশি ধর্মগুরুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমন নারীবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, আগাগোড়া ব্যবসায়ী কোনও লোক কোনওদিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন করেননি, জেতেনওনি। ক্ষমতায় এসেই সাতটি মুসলিম দেশের মানুষের জন্য আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই মুসলিম দেশগুলোতে প্রচুর সেক্যুলার, প্রগতিশীল মানুষ আছেন, নিরীহ মুসলমান আছেন। তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা কেন নষ্ট করবেন ট্রাম্প? দুর্নাম হচ্ছে ট্রাম্পের।   কিন্তু মনে হচ্ছে না এতে কিছু তাঁর যায় আসে।

ইউরোপেও জনপ্রিয় হচ্ছে কট্টর ডানপন্থী।   অসহিষ্ণুতা চারদিকে। কিন্তু সভ্যতা বজায় রাখতে গেলে চরমপন্থী সব মতবাদকে অবজ্ঞা করতে হবে বা অগ্রাহ্য করতে হবে। চরমপন্থীর সঙ্গে উদারপন্থীর বন্ধুত্ব চলে না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে

সবকিছুর একটা সীমা আছে। আমাকে নিষিদ্ধ করার, মনে হয়, কোনো সীমা নেই। দেশ নিষিদ্ধ করে, রাজ্য নিষিদ্ধ করে, রাজনীতিক নিষিদ্ধ করে, প্রকাশক নিষিদ্ধ করে, সম্পাদক নিষিদ্ধ করে, বইমেলা নিষিদ্ধ করে, সাহিত্য উৎসব নিষিদ্ধ করে। চারদিকে নিষিদ্ধ আমি। অনেক কাল আমি একঘরে, অনেক কাল যুদ্ধ করছি বাক স্বাধীনতার জন্য। বারবার হেরে যাচ্ছি। যদিও বলি তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী, কিন্তু শেষ অবধি দেখি জয় তলোয়ারেরই হয়, কলমের নয়।

জয়পুর সাহিত্য উৎসব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাহিত্য উৎসব। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ অংশ নেয় এই উৎসবে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক নামিদামি লেখকও ভিড় করেন। বিশাল বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উৎসবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ধন্য হয়, উৎসব উদ্বোধন করে সরকার ধন্য হয়। হারপারকলিন্স পেঙ্গুইন জমকালো পার্টি দিয়ে ধন্য হয়। এই উৎসবে আমাকে এ বছর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু আমার উপস্থিতি নিয়ে পাঁচটা অজ্ঞ, অসভ্য, অশিক্ষিত মৌলবাদী আপত্তি করার পর শুনেছি উৎসবের পরিচালকেরা বলেছেন ‘মাথা পেতে মেনে নিচ্ছি আপনাদের ডিমান্ড, প্রতিজ্ঞা করছি আমরা আর কখনও তসলিমাকে জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভেলে আমন্ত্রণ জানাবো না’। ব্যস আমি নিষিদ্ধ। পৃথিবীতে বোধহয় আর কাউকে এত সহজে নিষিদ্ধ করা যায় না, যত সহজে করা যায় আমাকে। সম্ভবত আমি একা বলেই করা যায়। আমাকে নিষিদ্ধ করলে কারও কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

একবার যদি তুমি মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করো, তোমাকে বারবার মাথা নত করতে হবে। ২০১২ সালে রুশদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জয়পুর লিট ফেস্ট। জয়পুরের মৌলবাদীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিল রুশদির বিরুদ্ধে, বলেছিল জয়পুরে তারা ঢুকতেই দেবে না রুশদিকে। লিট ফেস্টের পরিচালকেরা মেনে নিয়েছিলেন মৌলবাদীদের দাবি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, রুশদির শারীরিক উপস্থিতির দরকার নেই। স্কাইপে তিনি কিছু বলবেন, লিট ফেস্টে অংশগ্রহণকারীরা মনিটরে তা দেখবে, কিন্তু তাতেও বাধা দিয়েছিল ওই অসভ্যগুলো। শেষ পর্যন্ত ওই প্রোগ্রামও বাদ দিতে হয়েছে।

আমাকে কখনও জয়পুর লিট ফেস্টে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ বছরই প্রথম আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও প্রোগ্রাম লিস্টে  নিরাপত্তার কারণে আমার নাম উল্লেখ করা হয়নি, শুধু উল্লেখ করা হয়েছে আমার বইয়ের নাম একজাইল, নির্বাসন, আমি জানতাম আমার অনুষ্ঠান, বিকেলে, ৩.৪৫ এ। সেদিন সোমবার, সকালে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করলাম, ভাবলাম গরম জলে স্নান করে, হোটেলেই লাঞ্চ করে নিয়ে পৌনে তিনটেয় বেরিয়ে যাবো, ফেস্টিভেলে যেতেই লাগে চল্লিশ মিনিট মতো। আগের রাতেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমি যেন ঠিক আমার অনুষ্ঠানের দু মিনিট আগে ফেস্টিভেলে যাই, এবং অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার জিরো মিনিটের মাথায় ফেস্টিভেল থেকে বেরিয়ে যাই। আগের দিনেই আমাকে বের করার এক সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করেছিলেন ওঁরা। সেই সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই আমাকে মঞ্চে উঠে যেতে হবে। এই তো কথা ছিল, কিন্তু দুপুর বারোটায় ফোন এল কর্মকর্তাদের, বললেন আমার ৩.৪৫-এর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে, আমি যদি আদৌ কোনও অনুষ্ঠান করতে চাই, তাহলে আমাকে এক্ষুনি ফেস্টিভেলে পৌঁছুতে হবে, সাড়ে বারোটায় আমাকে মঞ্চে উঠতে হবে, না পৌঁছুতে পারলে এই সম্ভাবনাও বাতিল করতে বাধ্য হবেন তাঁরা। ক্ষিধে পেট, চান না করে, শুধু শাড়িটা দ্রুত পরে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাক স্বাধীনতার মূল্য দিতেই বেরিয়ে গেলাম, মৌলবাদীদের অন্যায় দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতেই বেরিয়ে গেলাম। মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করার কোনও আকর্ষণ না থাকা সত্ত্বেও বেরিয়ে গেলাম।   তখনও আমার নিরাপত্তারক্ষীরা কেউ হোটেলে আসেননি, কিন্তু বেরিয়ে গেলাম। আমাকে শুধু একবার জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা যে মৌলবাদীরা নাকি আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই আমাকে উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে, অনুমান করি। আমার উপস্থিতিটা বাক স্বাধীনতার পক্ষে এক রকম প্রতীকী উপস্থিতি, এ বুঝেই আমি কর্মকর্তাদের উপদেশ মেনে নিই। ওঁরা যে লোক আর গাড়ি পাঠিয়েছিলেন তা নিয়েই দ্রুত ফেস্টিভেলে চলে যাই। সলিল ত্রিপাঠি আমার সঙ্গে কথা বললেন মঞ্চে। শুধু সময় বদলানো হয়নি, ডিউরেশনও বদলে গেছে, এক ঘণ্টার জায়গায় আধ ঘণ্টা কথোপকথন হলো। মঞ্চ ঘিরে ছিল প্রচুর পুলিশ, ছিল ফেস্টিভেলের কর্মকর্তা। মঞ্চের কথোপকথন শেষ হলে দ্রুত আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সোজা হোটেল। প্রায় চার দিন ছিলাম জয়পুরে, কিন্তু ফেস্টিভেলের কিছুই প্রায় উপভোগ করা হয়নি। হোটলেই বসে থাকতে হয়েছে। প্রথম দিন অবশ্য দিব্যি বিভিন্ন সেশনে উপস্থিত হয়ে আর সব দর্শকের মতো লেখকদের ভাষণ শুনছিলাম, এক সময় কর্মকর্তারা আমাকে সরিয়ে নিলেন, কোথায় কার সঙ্গে কার ঝগড়া লেগেছে, সে কারণে। ঝগড়াটা মোটেই আমাকে কেন্দ্র করে নয়, তারপরও। আমাকে পরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি যেন ফেস্টিভেলে ঘোরাঘুরি না করি, কোনও অনুষ্ঠানও না শুনি। কেন? জাস্ট ইন কেইস। আমার নিরাপত্তার জন্য, প্লাস ফেস্টিভেলের নিরাপত্তার জন্য। এত অবাঞ্ছিত কখনও অনুভব করিনি কোনও ফেস্টিভেলে। জীবনে তো অনেক সাহিত্য উৎসবেই অংশগ্রহণ করেছি।

রাতে জাঁকালো সব উৎসবের কথা শুনি, কিন্তু সেসবে যাওয়ার জন্যও আমাকে সংগঠকদের কেউ কিছু বলে না। এক রাতে আমি একা একাই চলে গেলাম ডিনারে, গিয়ে দেখি লাইভ মিউজিক, অঢেল খাবার দাবার, হাজারো লেখক এবং পাঠক আনন্দ করছে, না সেই আনন্দে আমি বুঝি আমি অনাহুত। সোমবার রাতে ছিল লেখকদের জন্য গালা ডিনার। না, সেদিনও আমাকে ডাকা হয়নি। সন্ধে বেলায় বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি আমার ফ্লাইট রাত বারোটায়। এয়ার লাইন্সের লোকেরা অবাক, এলেন কেন, এসেমেস পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বিকেলেই যে ফ্লাইট দেরিতে যাবে। কিন্তু সংগঠকরা যেহেতু টিকিট কিনেছিলেন, সংগঠকরা পেয়েছেন এসেমেস, আমি পাইনি। হয়তো ওঁরা চেয়েছিলেন অন্যান্য লেখকের সঙ্গে গালা ডিনারে বসার চেয়ে আমার এয়ারপোর্টেই বসে থাকা ভালো। জাস্ট ইন কেইস। ঝামেলাহীন পরব কাটাতে হলে ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ কাউকে কেউ আশেপাশে দেখতে চায় না।

পুরোটা লিট ফেস্টেই আমি অনুভব করেছি আমার উপস্থিতি কোথাও কাঙ্ক্ষিত নয়। আমি জানি নারী-বিদ্বেষীদের, মৌলবাদীদের, রক্ষণশীলদের অঞ্চলে আমার উপস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই উদারপন্থীদের অঞ্চলেও আমি অস্পৃশ্য।

পরদিন সব খবরের কাগজে পড়ি, দশ বারোটা মৌলবাদী, যারা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনওদিনই আমার বই পড়েনি, আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে। ওরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যত টাকা সাহায্য করেছি গুজরাতের রায়টে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিমদের জন্য, তত টাকার এক ভাগও ওরা সাহায্য করেনি।

২০১২ সালে মৌলবাদীদের দাবি মেনেছিলেন বলে ২০১৭ সালেও তাদের দাবি মানতে বাধ্য হলেন লিট ফেস্টের পাওয়ারফুল লোকেরা। ৫ জনের কাছে হেরে যায় ৫ লক্ষ। কেন, ৫ জন অতিকায় দানব? আর ৫ লক্ষ সবাই ভীরু কাপুরুষ? নাকি অন্য কিছু?

আমি জানি আমাকে নিষিদ্ধ করার মতো সহজ কিছু নেই। কারণ আমাকে নিষিদ্ধ করলে  ডানপন্থী হোক বামপন্থী হোক, চরমপন্থী হোক, নরমপন্থী হোক, পুরুষ হোক নারী হোক— কেউ প্রতিবাদ করে না। অনেক তো দেখা হলো এ জীবনে, মুখোশের আড়ালের মুখও অনেক দেখা হয়েছে।

যত আমার ভাবনা চিন্তার পরিসর বাড়ছে,  আমার শরীরী অবস্থানের জায়গা তত কমে যাচ্ছে। আমি যত বেশি মানুষের কথা ভাবছি, তত বেশি আমি একা হয়ে যাচ্ছি। যত আমি পৃথিবীকে নিজের গ্রাম বলে ভাবছি, তত আমি এক-ঘরে হয়ে যাচ্ছি। বাক স্বাধীনতার কথা মানুষ বলে বটে, খুব কম মানুষই এই স্বাধীনতাকে মানে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭

 দঙ্গলের মেয়ে

ভারতবর্ষের মানুষ সিনেমার লোকদের জন্য পাগল। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা মারা যাওয়ার পর ৭০ জনেরও বেশি আত্মহত্যা করেছে। জয়ললিতা কোনও এককালে তামিল সিনেমায় অভিনয় করতেন। আগের মুখ্যমন্ত্রী অভিনেতা এমজিআর রামাচান্দ্রানের মৃত্যু হলে ৩০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তামিল অভিনেতা রজনীকান্ত মারা গেলে, শুনেছি, হাজারও লোক নাকি আত্মহত্যা করবে। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের জন্য এই অদ্ভুত আবেগ তামিলদেরই আছে।

সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পলিটিক্সের কিছু না জেনে রাজ্যসভার সদস্য বনে যাচ্ছেন। জয়া ভাদুরি, হেমা মালিনি, জয়াপ্রদা, গোবিন্দ, মিঠুন চক্রবর্তী, রেখা, শাবানা আজমী, শত্রুঘ্ন সিনহা— কে নয়? ওদিকে পশ্চিমবঙ্গেতর মমতা ব্যানার্জি রুপোলি পর্দার মানুষকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, পাকা পলিটিশিয়ানদেরও হারিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। দেবশ্রী, তাপস পাল, দেব, মুনমুন সেন, আরও কত কেউ।

দঙ্গল আমির খানের ছবি। ব্যাপক জনপ্রিয়। ভারতের সর্বত্র দঙ্গলের ভূয়সী প্রশংসা। হরিয়ানার পিছিয়ে থাকা সমাজের দুটো মেয়ে গীতা ফোগাট, আর ববিতা ফোগাট দেশ বিদেশ থেকে কুস্তি লড়ে সোনার মেডেল নিয়ে এসেছে। লোকেরা বলছে, দেখেছো মেয়েরা কী ভীষণ সাহসী হতে পারে, গাঁয়ের মেয়ে হয়েও অলিম্পিকে গিয়ে কী রকম সোনা ছিনিয়ে আনতে পারে! মেয়েদের সাহস আর মনোবল অবশ্য বাস্তবে পছন্দ না হলেও সিনেমায় পর্দায় সেটি মানুষের বেশ পছন্দ। মেয়েদের অত বাড় বাড়লে চলে না— এ কথা শতবার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা লোকগুলোই দঙ্গল দেখে হাততালি দেয়। মেয়েদের যৌনদাসী ভাবা লোকেরাও দঙ্গল নিয়ে উচ্ছ্বসিত।

গীতা আর ববিতা ফোগাটের বাবা মহাবীর সিং ফোগাটকে প্রায় ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করছে দঙ্গলের দর্শককুল। কারণ, দুটো মেয়েকে তিনি কুস্তি শিখিয়ে সফল কুস্তিগীরে পরিণত করেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। হরিয়ানার মতো মহা পিতৃতান্ত্রিক মহা নারীবিরোধী সমাজে মহাবীরকে সকলে এক মহা নারীবাদীই ভেবে নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহাবীর কি তাঁর পুত্র সন্তান থাকলে কন্যাদের কুস্তিগীর বানাতে চাইতেন? উত্তর আমরা জানি, চাইতেন না। আর সব মেয়েকে যেমন অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন বাবারা, তেমনই বিয়ে দিয়ে দিতেন। মহাবীরের স্ত্রী যেমন সংসারের জন্য খেটে আর রেঁধে বেড়ে জীবন পার করেন, মহাবীরের কন্যাদেরও তাই করতে হতো। মহাবীরের পুত্ররা মহাবীরের মতো পালোয়ান হতেন। যেহেতু পুত্র নেই, অগত্যা মহাবীর তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতেই মেয়েদের পালোয়ান বানালেন। পুত্র নিয়ে যে স্বপ্ন ছিলো তাঁর, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মরিয়া হয়ে ওঠার ভুল অনুবাদ করেছি আমরা। আমরা ভেবে সুখ পেয়েছি মহাত্মা মহাবীর নারী পুরুষে কোনও পার্থক্য করেন না।

দঙ্গল ছবিতে যে মেয়েরা অভিনয় করেছে, তারা এখন দেশের হিরো। তারা এখন বাস্তবের গীতা আর ববিতা ফোগাটের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। গীতা আর ববিতাকে নয়, তাদের চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েদেরই ভাবা হচ্ছে অসম সাহসী মেয়ে, তাদেরই ভাবা হচ্ছে ইয়ং মেয়েদের রোল মডেল। এর মধ্যে জাইরা ওয়াসিম নামের এক কাশ্মীরি মেয়ে, যে গীতা ফোগাটের চরিত্রে অভিনয় করেছিল, দেখা করেছে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে। মেহবুবা মুফতি আবার জাইরাকে প্রকাশ্যে ‘রোল মডেল’ বলার পর কাশ্মীরিদের অনেকে রেগে আগুন হয়ে গেছে। কয়েক মাস যাবত্ ভারতীয় সেনার গুলিতে, বোমায়, কাশ্মীরি তরুণেরা মরেছে, আহত হয়েছে, অন্ধ হয়ে গেছে— আর সেসব দেখেও যে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনও বিকার নেই,— সেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা কেন! জানি না কী ধরনের হুমকির সামনে পড়েছিলো জাইরা। তড়িঘড়ি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নিজের ফেসবুক পোস্টও ডিলিট করে দিয়েছে। বলেছে আমি যা করেছি ভুল করেছি, এমনটি আর হবে না, আমি কারও রোল মডেল নই ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে— তা আমরা জানি না। অনুমান করছি জাইরাকে শাসিয়েছে লোকে। বাঁচার জন্য সম্ভবত ক্ষমা চেয়েছে সে। চারদিক থেকে এখন সব শুভাকাঙ্ক্ষী বলছে— ‘জাইরা তুমি খুব সাহসী মেয়ে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। ’ রামের চরিত্রে অভিনয় করলে লোকে অভিনেতাকে মনে মনে ভগবান রামকে যেমন শ্রদ্ধা করে, তেমন করে। জাইরাকেও মনে মনে লোকে গীতা ফোগাট ভেবে নিয়েছে, তাই ভেবে নিয়েছে জাইরা অসম্ভব সাহসী মেয়ে। গীতা ফোগাট যেভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিলো মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো সে কুস্তিগীর হবে, দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে মেয়েরাও পারে, সেভাবে সবাই হয়তো ভাবছে জাইরাও কিছু একটার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছে। মুসলমান মেয়ে হয় সিনেমায় নেমেছে— এতে হয়তো সাহসের পরিচয় মেলে। কিন্তু মুসলমান মেয়েদের সিনেমায় নামা তত অসম্ভব নয়, যত অসম্ভব হরিয়ানার নারীবিদ্বেষী সমাজে মেয়েদের কুস্তিগীর হওয়া। জাইরা যদি সাহসী হতো, সে এভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভুল করেছে, অভিনয়ে নেমে ভুল করেছে বলে বলে কাঁদতোও না, ক্ষমাও চাইতো না। মুখ্যমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার দেখা না করার কোনও কারণ নেই। জাইরা রাজনীতির মেয়ে নয়। কাশ্মীরে যে অন্যায় ঘটছে তার দায় জাইরার নয়। মুখ্যমন্ত্রী যদি ভুল করে থাকেন, তাহলে সে ভুল জাইরার নয়, মুখ্যমন্ত্রীর। জাইরার বয়স ১৬। এই বয়সটা এটুকু বোঝার এবং দুষ্ট লোকের চোখ রাঙ্গানোতে ভয় না পাওয়ার এবং সামান্য হলেও আত্মবিশ্বাস অর্জন করার বয়স। এই বয়সেই তো মানুষ রুখে ওঠে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে।

কোনও একটা সাহসী চরিত্রে অভিনয় করলে সে সাহসী, কোনও একটা ভীতুর চরিত্রে অভিনয় করলে সে ভীতু, হাসির খোরাক দেয় এমন কারও চরিত্রে অভিনয় করলে সে বাস্তব জীবনেও কমেডিয়ান, ভগবানের চরিত্রে অভিনয় করলে সে ভগবান— এরকমই সাধারণ মানুষের যুক্তিহীন আবেগ। আমার মনে আছে, কলকাতার টেলিভিশনে যখন আমার লেখা একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে বানানো সিরিয়াল চলছিলো এক মাসব্যাপী, ওই সিরিয়ালের অভিনেত্রী কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল বেলা একটা পার্কে হাঁটতে গিয়েছিল, দেখে ছুটে এসেছিলো লোকজন। কী, ও কী করে বাড়ি থেকে বেরোলো, শাশুড়ি কি তাকে বেরোতে দিল? সিরিয়ালের ঝুমুরকে শাশুড়ি বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না, কিন্তু কনিনীকা তো ঝুমুর নয়, ঝুমুর চরিত্রে সে শুধু অভিনয় করছে। দর্শক প্রায়ই দুটো মানুষকে এক করে ফেলে।

যেমন জাইরা ওয়াসিম আর গীতা ফোগাটকে এক করে ফেলে। সিনেমা পাগল মানুষেরাই হয়তো করে। দুটো মানুষ এক নয়। রবিন উইলিয়ামস ফিল্মে লোক হাসানোর অভিনয় করতেন, ব্যক্তিজীবনে তিনি কিন্তু ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। পশ্চিমের দেশগুলোয় এভাবে অভিনেতা আর চরিত্র— দুটোকে এক করতে দেখিনি। একবার অবশ্য এক করেছিল একজন। সে বাস্তবে নয়, ফিল্মেই। ‘দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্টস উওম্যান’ উপন্যাসের চার্লস আর সারা’র চরিত্রে অভিনয় করছিল অ্যান আর মাইক। চার্লস যেমন করে ভালোবাসতো সারাকে, সেভাবেই মাইক ভালোবাসতে থাকে অ্যানকে। একসময় অ্যান যখন শুটিং শেষে তার স্বামীর সঙ্গে চলে যেতে থাকে, মাইক ছুটে এসে অ্যানকে পেছন থেকে ডাক দেয়, ডাক দেয় সারা বলে। নিজের ডাকেই নিজে চমকে ওঠে মাইক। চরিত্রের সঙ্গে খুব বেশি একাত্ম হয়ে গেলে এভাবেই ডাকা সম্ভব!

কথা হচ্ছিল জাইরাকে নিয়ে। আমি গীতা ফোগাটকে সাহসী মেয়ে বলতে পারি, কিন্তু জাইরাকে নয়। জাইরা সেইসব মেয়ের মতো, যারা ভয়ে পিছিয়ে যায়, আশঙ্কায় মুখ বন্ধ করে রাখে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ রচনা করে না। জাইরা এরকমই রয়ে যাবে, অথবা নিজেকে বদলাবে- জানি না। তবে বলিউডে স্পষ্টভাষী সাহসী মানুষের বড় অভাব, সে কারণে মনে হয় না সিনেমার জগতে এসে বলিউডের পরিবেশে থেকে তরুণীদের রোল মডেল বনে যাবে জাইরা। শুনেছি জাইরাকে তার বাবা মা সিনেমায় নামতে দিতে চাননি। হয়তো তাকে আর অভিনয়ই করতে দেবেন না তার বাবা মা। অভিনয় করুক না করুক, তাকে রাজনীতির শিকার করাটা মোটেও উচিত হচ্ছে না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭

পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন

স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কোন লেখক বা কবির লেখা আমরা পড়ছি, সে লেখক হিন্দু বা মুসলমান- এ নিয়ে কোনো আলোচনা কোনও দিন আমার ছোটবেলায় শুনিনি। লেখাটি ভালো, লেখাটি শিশুদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করবে, সেটিই সবাই দেখেছে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে যখন পৃথিবীর আরো সভ্য হওয়ার কথা, আরো পরিণত হওয়ার কথা- পাঠ্যবইয়ের লেখা হিন্দুর লেখা নাকি মুসলমানের লেখা- এ নিয়ে মানুষ  কথা বলছে, মুসলমানের দেশে হিন্দুর লেখা কবিতা বা গল্প পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে দিতে হবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের এসব শিশুতোষ কাণ্ডকারখানা আমাকে বড় আহত করে। না, অবাক করে না। মানুষের অপকর্ম, অত্যাচার, অনাচার, নিষ্ঠুরতা, নির্বুদ্ধিতা জীবনে এত দেখেছি যে কোনও কিছুতে আজকাল আর অবাক হই না। তবে আহত হুই।

সেদিন আজম খান নামের এক লোক ফেসবুকে লিখেছেন- ‘পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু, অজ্ঞেয়বাদী লেখকদের বই বাদ দেয়া হইলে জগদীশ চন্দ্র বসু কেন থাকবে? উচ্চ মাধ্যমিকে ইহুদি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নাসারা বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড, নিউটন, হালের স্টিফেন হকিংস এদের আবিষ্কার, লেখালেখিও বাদ দেয়া হোক। এসবের বদলে তাবিজ তুমার, পানি পড়া, জিন প্রেত, শয়তান আত্মা দূর করার সূরা কেরাত পড়ানো হোক। দেশের সমস্ত হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হোক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ৯৯ ভাগ বই এই হিন্দু, ইহুদি, নাসারা, নাস্তিকদের। হাসপাতালে ডাক্তারদের জায়গায় মাদ্রাসা থেকে মৌলভী নিয়োগ দেয়া হোক। সূরা কেরাতের মাধ্যমে তারা মানুষ সুস্থ করুক। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের প্রতি যখন এতই ঘৃণা তখন তাদের আবিষ্কার, পরিশ্রমের সুবিধা ভোগ করার দরকার নাই। ঘৃণা করলে পুরাটা করেন। আধাআধি করার কোন দরকার নাই। ’

আজম খান কিন্তু সঠিক কথা বলেছেন। এর উত্তর কি সরকার দেবেন? হিন্দুদের মেরে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। ভারত ভাগের সময় ছিল শতকরা তিরিশ ভাগ হিন্দু, আজ সেই সংখ্যা তলানিতে। হিন্দুর ওপর অত্যাচার রোধ করতে সরকার যদি উদ্যোগ নিত, কোনও হিন্দু মাতৃভূমি ত্যাগ করতো না।   সময় আসছে, একজন হিন্দুও বাংলাদেশে বাস করবে না। এ কি কোনও গৌরবের কথা? পাকিস্তান থেকেও হিন্দু সংখ্যা কমছে। মুসলমান হলেই কি হিন্দুবিদ্বেষী, ইহুদিবিদ্বেষী, ক্রিশ্চানবিদ্বেষী বা বিধর্মী বিদ্বেষী হতেই হয়?  তা না হলে ভালো মুসলমান হওয়া যায় না? মুসলমানদের এখন সময় আত্মসমালোচনা করার। তাদের ভাবতে হবে পনেরোশ’ বছর আগের চিন্তাভাবনায় নিজেদের আবদ্ধ রাখবে, নাকি নিজেদের যুগোপযোগী করবে? সব ধর্মকেই সব ধর্মের মানুষই কিছু না কিছু পরিবর্তন করে নিয়েছে। সব কিছুর মতো ধর্মেরও বিবর্তন হয়। ক্রিশ্চানরা এখন আর গির্জার শাসনে চলে না, তাদের সেই কুখ্যাত ইনকুইজিশানও আর নেই, ঈশ্বরকে কটাক্ষ করলে কাউকে আর খুন করা হয় না। ভারতেও হিন্দু নারীদের ওপর ধর্মের যে অত্যাচার ছিল, তা বন্ধ হয়েছে। নারী বিদ্বেষী ইহুদিরাও এখন বদলে গেছে, তারাও নারীর সমানাধিকারের পক্ষে এখন কথা বলে। যে কোনও সভ্য শিক্ষিত সচেতন মানুষই পরিবর্তন বা বিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু আমরা সামনের দিকে না হেঁটে পেছনের দিকে হাঁটবো কেন? আমরা কেন সভ্যতার দিকে না এগিয়ে পেছনে বর্বরতার দিকে যাবো? হিন্দু বিদ্বেষ বা বিধর্মী বিদ্বেষ বাংলাদেশে শুধু মৌলবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা ঠিক নয়। সরকারের মধ্যেই এর অস্তিত্ব বহাল তবিয়তে বিরাজ করতে দেখি। বাংলাদেশও কিন্তু ইসলামি আইনের কিছুটা পরিবর্তন করেছে। আরো পরিবর্তন দরকার, অথবা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আওতায় রেখে সমানাধিকারের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন তৈরি করা উচিত। কত কিছুই তো উচিত। কিন্তু কত কিছুই তো আমরা দেখেও না দেখার, বুঝেও না বোঝার ভান করি। ভানটা, হিপোক্রেসিটা আজকাল বড় বেশি ।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক সময় রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল এবং ভুল ছিল, তা শাসকগোষ্ঠী অচিরেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। আশা করি বাংলাদেশের সরকারও বুঝতে পারবে কোনও কবিকে মুসলমান না হওয়ার অপরাধে বা ইসলামে বিশ্বাস না করার অপরাধে পাঠ্যপুস্তক থেকে বের করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। একজন লেখক, সে যে-ধর্মের, যে-লিঙ্গের, যে-আদর্শের, যে-ভাষার, যে-দেশেরই হোক না কেন, তিনি যদি তাঁর লেখা দিয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, প্রাণিত করতে পারেন, চেতনাসমৃদ্ধ করতে পারেন, তবে তাঁর লেখা আমি যে করেই হোক পড়বো। তাঁর লেখা শুধু আমার নয়, সবার জন্যই প্রয়োজন। সরকারকে সাম্প্রদায়িক হওয়া মানায় না। যে জিন্নাহ ভারত ভাগের উদ্যোক্তা ছিলেন, মুসলমানদের হিন্দু থেকে আলাদা করেছিলেন, তিনিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনিও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপক্ষে বলেছিলেন।

পাঠ্যপুস্তকে, শুনেছি, ঢোকানো হয়েছে মুসলিম ধর্মগুরুদের জীবনী। এসব জীবনী পড়ে কিশোর-কিশোরীরা ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হবে, নিশ্চিত। মানুষকে ধার্মিক বানানোই কি মূল উদ্দেশ্য, নাকি মানুষকে সৎ, নিষ্ঠ, আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাটাই প্রধান? ধর্ম সম্পর্কে সবারই জানা উচিত, শুধু নিজের ধর্ম নয়, অন্যের ধর্ম সম্পর্কেও। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কোনও রকম চেষ্টা কি আমরা করবো না? শুধু ধর্মগুরু ও তাদের বিবিদের জীবনী কেন, নিউটন, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, ভার্জিনিয়া উলফ, মেরি ওলস্টনঙ্ক্রাফট, সিমোন দ্য বোভোয়া- এদের জীবনী পড়াও তো দরকার। শুধু বাঙালি মনীষী কেন, বিশ্বের বড় বড় মনীষীর কথাও, তাঁরা কী বলেছেন, কী লিখেছেন, কী রকমভাবে জীবনযাপন করেছেন- সে সবও তো জানতে হবে। ছোট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে বিরাট পরিসরে, শুধু বাংলাদেশের নয়,  হতে হবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সন্তান।

সারা পৃথিবীতে কট্টর মুসলমান আর সন্ত্রাসী মুসলমানের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষেপে উঠেছে। সাধারণ নিরীহ মুসলমানও মানুষের ঘৃণার শিকার হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের মুসলমানকে কট্টর বা সন্ত্রাসী হওয়ার প্রেরণা না দিয়ে দিতে হবে সহিষ্ণু মানুষ হওয়ার প্রেরণা। বিশ্বের সবাইকে নিয়ে আমাদের বাস করতে হবে, বিধর্মীদের নিয়েও; শুধু মুসলমানদের নিয়ে বাস করার ইচ্ছে করাটা বোকামো। মুসলমানরা বিপদে পড়লে মুসলমানরা এগিয়ে আসে না, নিজের চোখেই তো দেখা হলো, সিরিয়ার শরণার্থীদের কোনও মুসলমান দেশ আশ্রয় দেয়নি, দিয়েছে বিধর্মীদের দেশ। মুসলমানদের দেশগুলোতে কী দেখছি? মুসলমানরা মুসলমানদের হত্যা করছে। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে যেন দূরে থাকি। আমরা যেন সন্ত্রাসী না হই, সন্ত্রাসীদের শিকার না হই।

দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ করা, সহনশীল করা, মানুষকে মানবিক করা, মানুষের প্রতি মানুষকে সমমর্মী করা ছাড়া আর কোনও বড় কাজ আপাতত নেই। সমাজকে সুস্থ এবং সুন্দর করতে চাইলে শিশুদের সত্যিকার শিক্ষিত করা সবার আগে দরকার। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করলে শিশুদেরও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ জানুয়ারি, ২০১৭

যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত

‘যে-বই তোমায় দেখায় ভয়, সেগুলো কোনো বই-ই নয়, সে-বই তুমি পড়বে না। যে-বই তোমায় অন্ধ করে, যে-বই তোমায় বন্ধ করে, সে-বই তুমি ধরবে না’— এই ছড়াটি চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে, শুনেছি, বাদ দেওয়া হয়েছে এ বছর। কারণ, অভিযোগ উঠেছে, এই ছড়ায় ধর্মগ্রন্থের কথা বলা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। বিজ্ঞানের বই যেহেতু আলো দেয়, জ্ঞান ছড়ায়, সুতরাং বিজ্ঞানের বই, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি পড়তে বলা হয়েছে।

আমি কিন্তু মনে করি যে বই তোমায় অন্ধ করে, সে বইও তোমার পড়া উচিত। সব রকম বই-ই, এমন কী ধর্মের বইও, সবার, এমন কী শিশু-কিশোরদেরও, পড়া উচিত। তাদের জানা উচিত কোন ধর্ম কী বলে। জানা উচিত ধর্মের খুঁটিনাটি, ধর্মের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুধু নিজের বাবা মা’র ধর্ম নয়, অন্যের ধর্ম সম্পর্কেও জানা উচিত। একই সঙ্গে ধর্মের বিকল্প বা বিপরীত মত সম্পর্কেও, যেমন, অস্তিত্ববাদ, যুক্তিবাদ, মানববাদ সম্পর্কেও জানতে হবে। তারপর এক সময় বয়স হলে, বুদ্ধি হলে মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে কোনও ধর্ম সে আদৌ পালন করবে কি না, করলে কোন ধর্ম, অথবা কোন বিশ্বাস।

ধার্মিকেরা যতই বোঝাতে চাক ধর্মে এবং বিজ্ঞানে কোনও বিরোধ নেই, আসলে কিন্তু ধর্ম আর বিজ্ঞান দুটো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী মতবাদ। একটিতে বিশ্বাস থাকলে আরেকটিতে বিশ্বাস থাকার কথা নয়। কিন্তু অনেকেই দুটোতেই বিশ্বাস করে বলে দাবি করে। বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলে ঠিক কী করে সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস সম্ভব জানি না। কোনও কোনও বিজ্ঞানী বলেন, মস্তিষ্কের এক এক কোঠায় এক একটা বিশ্বাস ভরে রাখা হয়, তাতে দুই পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসের মধ্যে কোনও সংঘর্ষ বাধে না।

ছোট বেলায় ইস্কুলের বর্ণ পরিচয় বইয়ে পড়তাম অ তে অজগর, আ তে আম, ও তে ওল। ওল খেয়ে দাও ছুট, গলা করে কুটকুট। এখন শুনছি ও তে ওড়না চাই লেখা হচ্ছে। ওড়না চাই, বোরখা চাই, হিজাব চাই- এসব একটি নির্দিষ্ট মতবাদের প্রচার। একটি গণতন্ত্রে সব ধরনের মতবাদের স্থান থাকা উচিত। কোনও একটি মত, সে মতটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বলেই সেটিকে ইস্কুলের বইয়ে প্রাধান্য দিতে হবে- তা ঠিক নয়। ওড়না পরতে বলা হচ্ছে মেয়েদের, ছেলেদের নয়। বর্ণ পরিচয় বইটি কিন্তু ছেলে মেয়ে উভয়ে পড়ছে। প্রথম শ্রেণিতেই ছেলে মেয়েদের পড়তে হচ্ছে মেয়েদের ওড়নার কথা। মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখার কথা। যৌনতার বোধ শুরু হওয়ার আগেই চালান করার চেষ্টা হচ্ছে যৌনবোধ এবং শরীর নিয়ে লজ্জা, সংকোচ এবং শঙ্কা। শিশুর জীবন থেকে শৈশব কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ছাড়া এ আর কী?

মেয়েদের ওড়না পরার যেমন অধিকার আছে, ওড়না না পরারও অধিকার আছে। অক্ষর শেখাতে গিয়ে ওড়না পরতে চাওয়া শেখানো মানে শিশুদের মস্তিষ্কে ওড়না জিনিসটা ঢুকিয়ে দেওয়া, ওড়নাকে পোশাক হিসেবে উচ্চস্থানে বসানো, অথবা এটিকে বাধ্যতামূলক একটি পোশাকে পরিণত করা। হিজাব বা বোরখার বেলায়ও একই তত্ত্ব খাটে। কোনও একটি নিয়মকে ইস্কুলের বইয়ে তুলে ধরার অর্থ দাঁড়ায়— এই নিয়মটি শ্রেষ্ঠ নিয়ম, এই নিয়মের বাইরে যাওয়াটা অনুচিত। যারা ওড়না পরতে চায় না, তাদের কি তাহলে নিয়ম ভঙ্গকারীর দলে ফেলা হলো না? যে মেয়েরা ওড়না পরে না, তারা তো আসলে নিয়ম ভঙ্গকারী নয়, তারা ওড়না না পরার নিয়ম মানে। ওড়না পরা এবং ওড়না না পরা- দুটো নিয়মের মধ্যে ওড়না না পরার নিয়মটিকে যে কেউ বেছে নিতে পারে। এতে তাদের মান বা সম্মান সামান্যও বিঘ্নিত হওয়ার কথা নয়।

শিশুরা যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে, যা কিছু পড়ে, শেখে। জগতে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে- সেই সব মত সম্পর্কে প্রথম থেকেই শিশুদের শিক্ষা দেওয়া উচিত। শুধু একটি নির্দিষ্ট মতবাদ সম্পর্কে জানা এবং এক মতবাদকেই প্রাধান্য দেওয়া বা এর পক্ষেই গীত গাওয়া শিশুদের অধিকার পরিপন্থী। শিশুদের যদি শেখানো হয় কোনো মতবাদ, তাহলে সেই মতবাদের বিপরীত মত সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান দিতে হবে। পুরুষতন্ত্র শেখালে চলবে না, পুরুষতন্ত্রের বিপরীত মত নারীবাদ সম্পর্কেও জানাতে হবে। তা না হলে সব কিছু জানার অধিকার থেকে শিশুদের বঞ্চিতই করা হবে। শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করার স্পর্ধা প্রাপ্তবয়স্ক কারোরই থাকা উচিত নয়।

ইস্কুলে শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় মতবাদ শেখানোর জন্য মৌলবাদীরা চিৎকার করছে বেশ অনেকগুলো মাস বা বছর। কয়েক মাস আগে তাদের ৫ দফা দাবি এরকম ছিল। এক, অনতিবিলম্বে শিক্ষা সংস্কৃতির অনৈসলামিকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। দুই, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ভাবধারা পুনঃস্থাপন করতে হবে। তিন, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ভাবধারা মুছে ফেলার সাথে জড়িত মহল এবং প্রশ্নপত্রে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চার, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। পাঁচ, একই সাথে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতি বাতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে এবং বর্তমান ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে।

মৌলবাদীদের দাবি মেনে ইসলামি ভাবধারা পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন কি সরকার? যে ভাবধারা বিএনপি-জামায়াত আমলে ছিল, সেই ভাবধারা আওয়ামী লীগের আমলেও থাকবে এ নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই। দুই সরকারের মধ্যে অনেকে পার্থক্য দেখলেও আমি বিশেষ কিছু দেখি না। বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, থাকুক, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দেশকে কি মৌলবাদী দেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তারা গড়ে তুলতে চান। মৌলবাদীদের আশকারা দেওয়ার কুফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মৌলবাদ থেকে যে সন্ত্রাসী জন্ম নিচ্ছে, তারা দেশের প্রতিবাদী-প্রগতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কী করে হত্যা করেছে আমরা দেখেছি, কী করে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুক্তচিন্তার, কী করে সর্বনাশ করে সম্ভাবনার, দেখেছি।

তার চেয়ে সত্যিকার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার কাজই চলুক না কেন। গণতন্ত্র শুধু ভোটের নির্বাচনে নয়, গণতন্ত্রকে থাকতে হবে সমাজে, সংসারে, সর্বত্র। গণতন্ত্র কায়েম হলেই নারী পুরুষের সমানাধিকার কায়েম হবে। গণতন্ত্রে সবাই সমান, গণতান্ত্রিক আইনে কেউ বৈষম্যের শিকার হয় না। সত্যিকার গণতন্ত্রে দরিদ্রের, নীচু জাতের, নারীর, সমকামীর, রূপান্তরকামীর অধিকার ধনী, উঁচু জাত, পুরুষের অধিকারের চেয়ে এক ফোঁটা কম নয়। সত্যিকার গণতন্ত্রে ঘুচিয়ে ফেলা হয় সব বৈষম্য। জাতের ভেদ থাকে না। গণতন্ত্রে সবাই আমরা হয়ে যাই এক জাত, মানুষ জাত।

নিজেকে মানুষ জাত ভাবলে ভিন্নধর্মী কাউকে, ভিন্ন লিঙ্গের কাউকে, ভিন্ন বর্ণের কাউকে, ভিন্ন দেশের-ভাষার-সংস্কৃতির কাউকে ভিন্ন কেউ বলে মনে হয় না। আমরা তো আসলেই আজ অবধি মানুষেরই জাত। ভালো-মন্দ, লোভী-নির্লোভ, দুশ্চরিত্র সত্চরিত্র, হিংস্র দয়ালু— সব মিলিয়েই মানুষ। আমরা কেউ কেউ চেষ্টা করে যাই যেন নিজেদের ধর্ষণ না করি, নিজেদের হত্যা না করি, নিজেদের না ভোগাই, নিজেদের নিজেরা না ঠকাই, যন্ত্রণা না দিই। আমরা যদি আমাদের সংশোধন না করি, সুস্থ না করি, কে করবে? আমাদের কে আছে আমরা ছাড়া?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৫ জানুয়ারি, ২০১৭

বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী

বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী? বছর বছর তারা জাতীয় বইমেলায় বইয়ের প্রকাশকদের বই বিক্রি অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে! তাঁদের অধিকার নেই মেলায় বই বিক্রি করার যাঁরা সারা বছর অপেক্ষা করেন একটি মাস বই বিক্রি করবেন বলে। এই মেলায় যোগ দেবেন বলেই যাঁরা বই প্রকাশ করেন, তাঁরা হঠাত্ শুনছেন, তাঁরা নিষিদ্ধ। হাবিজাবি কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৬ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে করেছে নিষিদ্ধ।   বই লেখার অপরাধে ব-দ্বীপের লেখক-প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককে জেলে পোরা হয়েছে। কত ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অপরাধী জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়, বেরোনো হয় না মানিকের। পর পর দু’বছর দুটো প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করে ধিকৃত হওয়ার পর তারা ফের নতুন উদ্যমে নিষিদ্ধ করেছে আরও একটি প্রকাশনীকে। ২০১৭-২০১৮ সালের জন্য বেচারা শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ। কী দোষ শ্রাবণ প্রকাশনীর? এর কর্ণধার নাকি নানা ছুঁতোয় মত প্রকাশের বিরুদ্ধে যাওয়ার সমালোচনা করেছিলেন। এসব দেখে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে বাংলা একাডেমি একটি আদর্শ বিচ্যুত একাডেমি, যে একাডেমির দাঁড়ানোর কথা মুক্তচিন্তার পক্ষে, দাঁড়াচ্ছে মুক্তচিন্তার বিপক্ষে।

বাংলা একাডেমি যে আগেও লেখকদের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ছিল, তার সাক্ষী আমি। স্মৃতি ঘেঁটে বলছি—

“১৯৯১ সাল। বইমেলা শুরু হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা। সেদিন সতেরোই ফেব্রুয়ারির সন্ধেবেলা। মেলায় একটি চাপা উত্তেজনার গন্ধ পাওয়া যায়। উত্তেজনা কেন, কিসের জন্য, আমার জানা হয় না কিছু। বিশাল একটি ব্যানার নিয়ে একটি মিছিল বিদ্যাপ্রকাশের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। মেলার মধ্যে ব্যানার নিয়ে মিছিল! এ আবার কেমন! এমন তো দেখিনি আগে কোনও দিন! কি সেই মিছিল কেন সেই মিছিল প্রশ্ন করে কারও কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না। হঠাত্ দেখি খোকা টেবিল থেকে আমার বইগুলো দ্রুত তুলে ফেলছেন, বইয়ের তাক থেকে খোকার শালা আমার বই নামিয়ে নিচ্ছেন। তখনই হঠাত্ মুহম্মদ নূরুল হুদা আর রফিক আজাদ আমাকে বের করে নিলেন স্টল থেকে। আমাকে নিয়ে বাংলা একাডেমির মূল দালানের ভেতর ঢুকে গেলেন। একেবারে মহাপরিচালকের ঘরে। ঘটনা কি! ঘটনা যা জানা গেল, তা হলো, আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হয়েছে। তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি এই মিছিলটি করছে, আমাকে পিষে মারার জন্য এই মিছিল। মেলার বইয়ের স্টলগুলোয় কমিটির লোকেরা হুমকি দিয়ে এসেছে আমার বই যেন না রাখা হয় কোথাও। রাখলে ওরা স্টল ভেঙে ফেলবে নয়তো পুড়িয়ে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার বই যে স্টলগুলোয় ছিল, সরিয়ে ফেলা হলো। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। ঘরে আরও লেখক বসে ছিলেন। ফজলুল আলমও উঠে এসেছিলেন আমার পেছন পেছন। আশঙ্কায় তাঁর মুখ চোখ সব গোল গোল হয়ে আছে। মহাপরিচালকের ঘরে এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। মিছিল কেন হয়েছে, কারা করেছে, মেলার অস্থিরতা কি করে বন্ধ করা যায়। ব্যানারে কী লেখা এই নিয়ে ফিসফিস চলছে লেখকদের মধ্যে। মহাপরিচালক হঠাত্ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এই মিছিল হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ওদের?’

‘তা তো আমি জানি না কি অভিযোগ। ’ আমি বলি।

মহাপরিচালক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘খুব অশ্লীল কথা লেখা আছে ব্যানারে। কী মনে হয় আপনার, কেন এসব করছে ওরা?’

‘সম্ভবত আমার লেখার কারণে। ’

‘লেখে তো অনেকেই। এই যে এখানে যত লেখক আছেন, সকলেই বই লেখেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তো মেলায় মিছিল হয় না। আপনার বিরুদ্ধে হয় কেন?’

ফজলুল আলমের কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠল, ‘হয় কেন মানে? উনি কি করে জানবেন হয় কেন! যারা হওয়ায় তারা জানে, কেন। আর তসলিমা নাসরিনের লেখা সকলে গ্রহণ করতে যাবে কেন! তাঁর লেখা তো আর সবার মতো আপোসের লেখা নয়!’

গুঞ্জন ওঠে লেখকদের মধ্যে। তবে কি তিনি তাঁদের বলছেন আপোস করে লেখেন তাঁরা। গুঞ্জন থামিয়ে মহাপরিচালক ভুরু কুঁচকে চাইলেন আমার দিকে, আমাকে বললেন, ‘মেয়ে হয়ে আপনি পুরুষের মতো লিখতে যান কেন? সে কারণেই তো ঝামেলা হচ্ছে। ’

আমি ঝটিতে উত্তর দিই, ‘আমি পুরুষের মতো লিখব কেন! আমি আমার মতো করে লিখি। ’

বসে থাকা লেখকরা একটু নড়ে চড়ে বসেন।

‘সবাইকে সব কিছু মানায় না। তা কি বুঝতে পারেন না?’ মহাপরিচালকের ঠোঁটের কোণে একটি হাসি ঝিকমিক করে। লেখকদের নিঃশ্বাসের টানে কিছু ঝিকমিক তাঁদের ঠোঁটের কোণেও আশ্রয় নেয়।

‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। কোনও মেয়ে কি আপনি যে ভাষায় লেখেন, সে ভাষায় লেখে?’

আমি চুপ।

‘না, লেখে না। ’

মহাপরিচালকের মন্তব্যে লেখকদের মাথাও নড়ে, না লেখে না।

আমার চোয়াল শক্ত হচ্ছে।

‘আপনার লেখা খুব অশ্লীল। ’

এবার দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে বলে, ‘আমার লেখা কারও কাছে তা অশ্লীল মনে হয়, কারও কাছে মনে হয় না। ’

মুহম্মদ নূরুল হুদা বাইরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আসেন যে মেলার মধ্যে কোনও মিছিল যেন না হয়, এতে মেলার পরিবেশ নষ্ট হয়। কারও যদি কোনও অভিযোগ থেকে থাকে তবে যেন তা মেলা কমিটির সদস্যদের জানানো হয়। শান্ত হতে বলেন তিনি মিছিলের জনতাকে।

আগুন আগুন বলে একটি রব ওঠে মেলায়। ঘরে বসা লোকগুলোর কেউ কেউ জানালার দিকে ছুটে যান ঘটনা দেখতে। বই পোড়ানো হচ্ছে মেলার মাঠে। আমার বই মিছিলের লোকেরা যে যেখানে পেয়েছে মাঠের মাঝখানে জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছে।

খোকা দাঁড়িয়ে আছেন মহাপরিচালক হারুন উর রশীদের ঘরের বারান্দায়। আমি উঠে যাই খোকার কাছে। খোকা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে আছেন, ঘামছেন তিনি। চোয়াল খোকারও শক্ত হয়ে আছে।

‘কারা এই মিছিল করছে খোকা ভাই? জানেন কিছু?’

খোকা মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।

মহাপরিচালক মেলা কমিটির সদস্য বাংলা একাডেমির উপপরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানালেন, ‘আপনি মেলায় না এলে ভালো হয়। ’

‘এ কেমন কথা, কেন আমি আসব না?’

ফজলুল আলম বলে ওঠেন, ‘কেন তিনি আসবেন না? তাঁর কি দোষ?’

‘উনি এলে মেলায় গণ্ডগোল হয়, তাই তিনি আসবেন না। ’

জানিয়ে দিলেন, মেলায় যদি আমার ওপর কোনও আক্রমণ হয়, সেই দায়িত্ব মেলা কমিটি নিতে পারবে না। সুতরাং আমার নিরাপত্তার জন্য বইমেলায় আমার না আসাই ভালো। আমার জন্য মেলার পরিবেশ নষ্ট হোক, মেলা পণ্ড হয়ে যাক, তা তাঁরা চান না।

ফজলুল আলম চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আপনারা মেলা কমিটির লোক, আপনারা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন। ’

ফজলুল আলমের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান মহাপরিচালক। চোখের ভুরুতে প্রশ্ন, লোকটি কে এখানে চিত্কার করছে! একে তো চিনি না!

কিছু ছেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করছে বলে আমার মেলায় আসা বন্ধ হবে কেন! অনেকে তো আমার লেখা পছন্দ করে, তারা…

আমার কোনও যুক্তিই মহাপরিচালক মেনে নেন না। মীমাংসা শেষ অবধি কিছুই হয় না। মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যে স্থির থাকেন। তাঁর পরামর্শ আমার আর মেলায় আসা উচিত নয়। যেহেতু আমি মেয়ে হয়ে পুরুষের মতো লিখি, যেহেতু আমি অশ্লীল লেখা লিখি, যেহেতু আমার লেখা আদৌ কোনও ভালো লেখা নয়, সেহেতু আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমাকে লোকে পেষণ করতে চাইবে, এও অবাক করা কোনও ব্যাপার নয়। সুতরাং আমি যেন মেলা থেকে দূরে থাকি, এ যত না আমার নিরাপত্তার জন্য, তার চেয়ে বেশি মেলার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার জন্য।

পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এর কিছু দিন পর আমার প্রকাশক জানি না কোত্থেকে কিছু পেশিবহুল লোক জোগাড় করলেন, যাদের কাজ আমাকে মেলায় নিয়ে যাওয়া আর মেলা শেষ হলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। অচেনা পেশি পরিবেষ্টিত হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মেলায় যাই বটে আমি, আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ জোটে না কিছুতে তবে খোকার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। কোনও লেখক তো এগিয়ে আসেনি কোনও সাহায্য করতে, মেলা কমিটি মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, এ সময় খোকা এই মীমাংসাটি না করলে আমাকে এক ঘোর হতাশার মধ্যে ঘরে বসে থাকতে হতো। যে দুটো দিন মেলায় গিয়েছি, বিদ্যাপ্রকাশের স্টলেই বসে ছিলাম। মেলার মাঠে হাঁটাহাঁটি বা চায়ের স্টলে গিয়ে চা খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হলেও যেতে পারিনি। স্টলেও বেশিক্ষণ বসা হয়নি, ঘণ্টা দুঘণ্টা পর বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে আমি যে যে করেই হোক গিয়েছি মেলায়, সেটিই ছিল বড় ঘটনা। যদিও আশঙ্কা নামের কুিসত একটি জিনিসকে কোনও আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে পারিনি, যদিও খোকার চোখ সারাক্ষণই অস্থির ছিল উদ্বেগে তবু বিজয়ের প্রশান্তি অল্প হলেও কিছু ছিল তাঁর মনে। ফজলুল আলম উত্কণ্ঠা এবং উচ্ছ্বাস দুটো নিয়েই নিরাপদ একটি দূরত্বে হাঁটাহাঁটি করেন। বইমেলা কমিটির লোকেরা আমাকে ভুরু কুঁচকে দেখেছেন। জ্বলজ্যান্ত উপদ্রুবটিকে দেখতে তাঁদের ভালো লাগেনি। আমার মতো আস্ত একটি সমস্যা মেলায় উপস্থিত হলে কী না কী অঘটন ঘটে কে জানে! মেলায় যদি জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে যায়, তবে! তার চেয়ে একা আমাকে কোথাও নিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিলে মেলাটা অন্তত বাঁচে। মেলার স্টলগুলোয় আমার বই নেই। বেশির ভাগই ছিনিয়ে নিয়েছে পেষণ কমিটির লোকেরা। বেশির ভাগই পুড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও স্টলে বই আছে, সেসব বই লুকিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের তলায়। প্রতি বছরের মতো বাংলা একাডেমি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান করছে। আগের বছরের অনুষ্ঠানগুলোয় কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এবার আমি আমন্ত্রিত নই। ”

—-এভাবেই আমাকে ব্রাত্য করেছিল বাংলা একাডেমি। তারপর তো গোটা দেশই ব্রাত্য করলো। লেখকরা তখন চুপ ছিলেন। তাঁরা এখনো চুপ। চুপ থাকার কালচার তৈরি হয়ে গেছে দেশটিতে। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে এই কালচারটি বেশ জনপ্রিয়, যাঁদের রুখে দাঁড়ানোর কথা মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে। তাঁরা সম্ভবত পাওয়ারফুলদের ভাষায় কথা বলেন বলে, নিজের কোনো ভিন্ন মত নেই বলে, জানেন যে তাঁদের মত নিয়ে কোথাও কোনো রকম অসুবিধেয় পড়তে হবে না। নিজের সুবিধে হলেই হলো, অন্যের অসুবিধেয় তাঁদের কিছু যায় আসে না।   দেশ কতটা নষ্ট হলে বাংলা একাডেমির মেলায় কোনো প্রকাশনীর স্টল নিষিদ্ধ করা হয় এবং লেখক কবিরা চুপ থাকতে পারেন— তা নিশ্চয়ই আমরা অনুমান করতে পারছি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়

গত সোমবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তুরস্ক আর জার্মানির আংকারা আর বার্লিন শহরে ঘটে গেল আবারও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। আংকারায় এক পুলিশ অফিসার গুলি করে মেরে ফেলেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে, বার্লিনের রাস্তায় ক্রিসমাসের বাজার ভর্তি মানুষের ওপর এক লোক চলন্ত ট্রাক তুলে দিয়ে ১২ জনকে পিষে মেরেছে, আর ৪৮ জনকে আহত করেছে।   ওদিকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে এক লোক একটি মসজিদে আচমকা ঢুকে কয়েকজন মুসলমানের দিকে গুলি ছুড়েছে।

জুরিখের মসজিদে যে লোকটি গুলি ছুড়েছে, তার সঙ্গে, বলা হচ্ছে, কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী দলের যোগ ছিল না। মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে নিজেকেই সে শেষ অবধি হত্যা করেছে। কেন সে মানুষ মারতে চেয়েছিল, কেন সে আত্মহত্যা করেছে, তা এখনো কেউ স্পষ্ট করে জানে না।

বার্লিনে এক পাকিস্তানি শরণার্থীকে ট্রাক ড্রাইভার বলে ভাবা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সন্ত্রাসী সে নয়, আসল সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে। এখনো আমরা জানি না বার্লিনের সন্ত্রাসীটি কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী কি না। আইসিস বলেছে, সন্ত্রাসীটি তাদের দ্বারা প্রভাবিত। জার্মানির কেউ কেউ বলছে ফ্রান্সের নিস থেকে ট্রাক-হামলা শিখে জিহাদিরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বার্লিনে, আবার কেউ কেউ কিছু একটা সন্ত্রাস ঘটামাত্রই কে করেছে তার কোনো প্রমাণ পাওয়ার আগেই মুসলিম শরণার্থীদের দিকে সন্দেহের আঙ্গুল না তুলতে অনুরোধ করছে।

আংকারায় যে পুলিশটি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছে, জিহাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্য নিয়েই সে হত্যাটি করেছে। আল-কায়দার বই পড়ে পড়েই জিহাদে হাতেখড়ি তার। জীবনকে বড় তুচ্ছ মনে করে জিহাদিরা। মৃত্যুর ভয় টয় সব উবে যায়। ২২ বছর বয়সী মেলভুত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভকে নিজের পকেট থেকে অস্ত্র বের করে খুন করেছে, খুন করার পর একটি আঙ্গুল শূন্যে তুলে বলেছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘মনে রেখো আলেপ্পো, মনে রেখো সিরিয়া’। অর্থাৎ আলেপ্পোতে মুসলমানদের মেরে যে অন্যায় করেছে রাশিয়া, তার শাস্তি আজ তাকে পেতে হলো। আল-কায়দা মেলভুতকে হত্যার বদলে হত্যা করতে শিখিয়েছে।

‘আল্লাহু আকবর’— এই দুটো শব্দ আমি ছোটবেলায় শুনতাম আমার নানার মুখে। নানা খুব ভোর বেলায় উঠে সশব্দে নামাজ পড়তেন। তাঁর উচ্চারণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো পবিত্রতা, সততা, সম্ভ্রম, সমর্পণ। এই ‘আল্লাহু আকবর’ এখন শুনি সন্ত্রাসীদের মুখে। মানুষকে জবাই করতে করতে, খুন করতে করতে, চিৎকার করে তারা বলতে থাকে, আল্লাহু আকবর। গা কেঁপে ওঠে আমার। সব ধর্মেই তো হিংসে দ্বেষ, খুনোখুনির কথা আছে, তাই বলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এক জিহাদি ছাড়া কোনো ঈশ্বরের নামে কেউ মানুষ খুন করে? আল্লাহু আকবর— আমার ছোটবেলায় ঘুম ঘুম চোখে শোনা মধুর শব্দদ্বয় কবে যে হাইজ্যাকড হয়ে গেছে।

ওদিকে জর্দানেও কিছু নিরাপত্তা পুলিশকে মেরে ফেলা হয়েছে। আইসিসের সেনারা কাজটা করে বেশ বুক ফুলিয়েই ঘোষণা করেছে যে এ কাজ তাদেরই। জর্দানের সরকার ইরাক আর সিরিয়ার মুসলমানদের ওপর বোমা মারছে, তাই প্রতিবাদ। ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট পেয়ে তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করেছেন সন্ত্রাসী হামলার। ভয় হয় প্রতিবাদ আবার বুশের মতো না হয়ে যায়, এদেশ ওদেশ থেকে দুর্নীতিবাজ একনায়ক সরকার হঠাতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে না আবার খুন করে ফেলেন। কেন মুসলমানদের খুন করা হলো এই রাগে, দুঃখে বা এই ছুতোয় আবার কট্টরগুলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বানিয়ে না ফেলে।

সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগে, তা হলো, জিহাদিদের সন্ত্রাসী কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। যে মুসলমান সন্ত্রাসের সাতে নেই, পাঁচে নেই। তাকে কেন ভুগতে হবে! পৃথিবীর বেশির ভাগ মুসলমান সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়, তবে কেন বেশির ভাগ মুসলমানকে মানুষ আজ অবিশ্বাস করছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ভালো। আমাকে কালই একজন বললো, ‘কে জিহাদি, কে জিহাদি নয়, তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, তাই সব মুসলমানকেই প্রত্যাখ্যান করি। ’ মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকছে, চারদিকের জিহাদি কাণ্ডকারখানা দেখে তারাও অপ্রস্তুত, তারাও লজ্জিত।

দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সন্ত্রাস করছে, পারমাণবিক শক্তি বোমা ফেলছে, নিরীহ মুসলমান মারা পড়ছে, ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে ইসরাইল, কাশ্মিরে মুসলমানদের নির্বিচারে খুন করছে ভারতীয় সেনা— এসব কারণে মুসলমানরা নাকি জিহাদি দলে নাম লেখাচ্ছে। কিন্তু জিহাদিরা কি মুসলিম সমাজের কোনো উন্নতি করতে পারে? ক্ষতি ছাড়া এ পর্যন্ত লাভ কি তারা করেছে কারোর? মুসলমানদের সবচেয়ে যেটা প্রয়োজনীয় কাজ, যেটা করলে বা গড়লে মুসলমানদের উন্নতি হবে, সেটা আর যা কিছুই হোক, জিহাদ নয়। সেটা শিক্ষা এবং সচেতনতা। সেটা সমানাধিকারের আর সমতার সমাজ। সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা। কিন্তু ক’জন জানে বা মানে সে কথা?

আমরা আইসিসকে তো দেখলাম, বিশাল পরাশক্তির বিরুদ্ধে কিছু ছুরি আর বন্দুক নিয়ে নেমে গেছে মাঠে, বছর ভর মুসলমানদেরই গলা কেটেছে, মেয়েদের ধরে বেঁধে যৌনদাসি বানিয়েছে— এই সমাজ কি কোনো কাঙ্ক্ষিত সমাজ?

ইহুদিরাও অত্যাচারিত হয়েছিল, কিন্তু ওরা অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে দলে দলে মানুষের গলা কাটতে নেমে যায়নি। ওরা নিজেদের শিক্ষিত করেছে, সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেছে, অর্থনৈতিক শুধু নয়, নৈতিক উন্নতির কথা ভেবেছে, বিজ্ঞানের কথা ভেবেছে, আজ পৃথিবীর বড় বড় শিক্ষাবিদ, বড় বড় চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক। বছর বছর নোবেল পাচ্ছে। মানুষ খুন করে, রক্তপাত ঘটিয়ে স্বর্গে যাওয়া যাবে বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব করা যাবে— এসব মনে হয় না কোনো বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধি এত লোপ পাওয়া কি ভালো? অনেকে বলছে, মুসলমানরা হয় বোকা, নয় বর্বর। যারা বোকা নয় বা বর্বর নয়— তাদেরও শুনতে হচ্ছে এই অপবাদ।

সন্ত্রাস কোনো সমাধান নয়। কোনো সম্প্রদায়ের জন্য নয়। আজকের মুসলিম সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞেস করো, সকলেই বলবে, আমেরিকার সন্ত্রাস তাদের পছন্দ নয়, আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই তারা আজ সন্ত্রাসী হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ‘তুমি যদি বন্দুকের বিরুদ্ধে, তবে তুমি নিজেই কেন বন্দুক হাতে নিচ্ছ? তুমি যদি খুনের বিরুদ্ধে, তবে তুমি খুন করো কেন?’ আসলে সন্ত্রাসীরা কিছু একটা ছুঁতো খোঁজে সন্ত্রাস করার জন্য, সন্ত্রাস তাদের ভালো লাগে, ভালো লাগে বলেই শত্রুদের সন্ত্রাস দেখে তাদেরও সন্ত্রাসী হতে ইচ্ছে করে, শত্রুরা তো অনেক ভালো কিছু করে, সেসবের প্রতি কেন আকৃষ্ট হয় না তারা? কেন তারা যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য, বিজ্ঞানী বা নভোচারী বা আরো হাজারো ভালো কিছু হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখে না?

মুসলমানরা যদি নিজেদের ভালো চায়, নিজেদের সভ্য এবং শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তবে নিজেদের সংবিধান থেকে, নিজেদের আইন থেকে, শিক্ষা এবং সংস্কার থেকে ধর্মটাকে তুলে নিয়ে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডিতে রেখে দেবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডি থেকে একে বের করলেই বিপদ বাধে। ইতিহাস বলে বিপদ বাধে। আমরাও সচক্ষে দেখছি বিপদ বাধে। ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে খুনোখুনি করে বর্বর লোকেরা। সভ্য দেশগুলোয়, যে দেশগুলোয় মানবাধিকার, সমানাধিকার, নারীর অধিকার, সমতা আর শান্তি সবচেয়ে বেশি, সেখানে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডির মধ্যে রাখা হয়, রাষ্ট্রের কোনো কাজকর্মে নাক গলাতে দেওয়া হয় না।   পৃথিবীতে নানা মতের, নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির, নানা লিঙ্গের, নানা রঙের মানুষকে একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে বাস করতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

বুদ্ধিজীবী দিবস

বয়স অল্প ছিল একাত্তরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি নতুন পতাকা হাতে নিয়ে হাটে মাঠে ঘাটে স্বাধীনতার উৎসব করতাম। প্রতিবছর  ষোলোই ডিসেম্বর এলে ভোররাত্তিরে উঠে বাড়ির ছাদে পতাকা উড়িয়ে দিতাম, আমার দেশের পতাকা। দেশটিকে একাত্তরের পর থেকে নিজেরই ভেবেছি। আমার দেশটি এখন আর আমার নয়। মনে মনে যদিও একে আমার বলেই ভাবি। খুব গোপনে, সন্তর্পণে ভাবি একে আমার বলেই। দেশের শত্রুরা আমাকে দেশ থেকে সেই দু’দশক আগে তাড়িয়ে ঘোষণা করে দিয়েছিল এ দেশ আমার নয়। এরা দেশের সেই শত্রুদেরই বান্ধব অথবা সন্তান যে শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি, যে শত্রুরা একাত্তরে ধর্ষণ করেছে আমাদের নারী, যে শত্রুরা হত্যা করেছে দেশের বুদ্ধিজীবী, হত্যা করেছে অগণিত নিরপরাধ মানুষ।

বর্বর শত্রুসেনা নির্যাতন করেছে আমাদের পরিবারের সবাইকে। লুট করেছে আমাদের বাড়িঘর, সহায় সম্পদ। শুধু প্রাণটুকু বাঁচাতে একাত্তরের ন’মাস এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছি। গভীর অন্ধকারে মোষের গাড়িতে চেপে অনাত্মীয় অপরিচিত বাড়িতে গিয়েছি, আশ্রয় চেয়েছি। শত্রুদের আগুনে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে যেতে  দেখেছি। যে শত্রুরা পাকিস্তানি বর্বর সেনা দিয়ে আমাদের বাড়ি লুট করিয়ে ছিল, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়েছিল আমাদের— তারাই আজ দেশের আপনজন। আর আমি এবং আমার মতোরা আপাদমস্তক নিষিদ্ধ।

ওরা চট জলদি হত্যা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের। আজ ওরা নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, ভেবেচিন্তে বুদ্ধিজীবী হত্যার ছক আঁকে এবং এক এক করে বুদ্ধিজীবী হত্যা করে। ওরা ধরা পড়ে না, ওরা ধিকৃত হয় না, লাঞ্ছিত হয় না। সত্য বলতে কী, ওদের কোনও শাস্তি হয় না। আমি যদি দেশে থাকতাম, অনেক বছর আগেই ওরা আমাকে কুপিয়ে মেরে ফেলত। বাংলাদেশ যখন প্রতিবছর চৌদ্দই ডিসেম্বরে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস’ পালন করে, তখন আমি ভাবি এই দিবস শুধু একটি দিনে বা দিবসে  কেন সীমাবদ্ধ? মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির মানুষদের দেশের সর্বত্র প্রায়ই হত্যা করা হচ্ছে কুপিয়ে। নৃশংসতার সাধারণত সীমা থাকে, এই নৃশংসতা সীমাহীন। বছরের যে কোনো দিনেই খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, আমাদের মুক্তচিন্তকরা। শুধু  মৌলবাদীরাই যে আমাদের নির্যাতন করছে তা নয়, বাকস্বাধীনতা-বিরোধী আইন বানিয়ে মুক্তচিন্তকদের গ্রেফতার করছে সরকার, জেলেও পুরছে।

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে, লক্ষ করছি, তারাও আজ কাঁদছে, যারা এখনকার মুক্তচিন্তকদের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। এর নাম ভণ্ডামো নয়তো? একাত্তরে মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম আমরা বাঙালিরা। যুদ্ধ করেছিলাম পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করেছিলাম, বাংলাদেশ তার নাম। বাংলাদেশ— এই নামটি উচ্চারণ করলেই এক সময় ময়ূরের মতো নাচতো মন। সেই মন কোথায় আজ? সেই মন কিন্তু ভিনভাষী ভিনদেশি কেউ এসে নষ্ট করেনি, নষ্ট করেছি আমরাই। আমরাই স্বাধীনতার শত্রুদের আদর আপ্যায়ন করেছি। আমরাই আমাদের ধর্ষক আর খুনিদের বড় আসন দিয়েছি বসতে। প্রতিদিনই তো আমরা আমাদের অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেখছি, কিন্তু কিছু বলছি না। যে সন্ত্রাসীরা আমাদের হত্যা করেছিল, তাদের পুনর্বাসন আমরাই করেছি, আমরাই এখন ওদের হাতে নিজেদের খুন হয়ে যাওয়া দেখছি। দেখছি কিন্তু কিছু বলছি না। বলছি না কারণ আমরাও ভেতরে ভেতরে একটু আধটু  মৌলবাদী, আমরাও ভেতরে ভেতরে একটু আধটু সাম্প্রদায়িক। এই ‘আমরা’টা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি মাননীয় মন্ত্রীবৃন্দ।

সাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্রটি নিজেকে অনেকটাই বদলে নিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার দিকে বলে কয়েই যাত্রা শুরু করেছে। আজ তার একটি রাষ্ট্রধর্ম আছে। স্বাধীন আর পরাধীন রাষ্ট্রের শাসকে আজ আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে, শাসকেরা জানে,  মৌলবাদীদের আশীর্বাদের প্রয়োজন। আমাদের ক্ষমতালোভী শাসকেরা গদি রক্ষার্থে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে ওলামা লীগ, হেফাজতে ইসলাম নামক ভয়ংকর মৌলবাদী দলগুলোকে। এর শুরুটা অবশ্য হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। আমার বিরুদ্ধে যখন লাখো মৌলবাদীর মিছিল হল, আমার মাথার মূল্য নির্ধারণ করা হল, প্রকাশ্যে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হল তখন সরকার মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করল। সরকারের না হয় গদির লোভ ছিল। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলাম তখনকার সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ তো করেননি উল্টো ‘কী দরকার ছিল ওভাবে লেখার’ জাতীয় মন্তব্য করে বিষয়টিকে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা ভেবে এড়িয়ে গেছেন। আজকের বাংলাদেশ সেই এড়িয়ে যাওয়ারই ফল। একের পর এক প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক, শিক্ষক, ছাত্র হত্যার পরও তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। দেশ মৌলবাদীদের দখলে যাচ্ছে যাক, তাতে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসে না। তাঁরা মেতে আছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক এবং নানা পদক পুরস্কার নিয়ে। অঢেল অর্থ থাকার পরও তাঁরা চিকিত্সার জন্য সরকারি অর্থের আশায় থাকেন। এঁদের বুদ্ধিজীবী বলতে আমার বাঁধে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, গুলশান ক্যাফেয় ভয়ংকর সন্ত্রাসী ঘটনার পর সরকারের তত্পরতা দেখে ভেবেছিলাম এবার অন্তত তারা মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ তোষণ বন্ধ করবে। অথচ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই অন্যতম আসামি হাসনাত ও তাহমিদ মুক্তি পেয়ে যায়। নিজেদেরকে জিম্মি দাবি করলেও ঘটনার বিভিন্ন ছবি ভিডিওতে তাদের হাতে অস্ত্র ও জঙ্গিদের সাথে নিশ্চিন্তে হেঁটে বেড়াতে দেখা গেছে। এরকম ভয়ংকর অপরাধীদেরও জামিন মঞ্জুর হয়ে যায়। অথচ বই সম্পাদনার দায়ে রোদেলা প্রকাশনীর মালিক শামসুজোহা মানিকের এখনও জামিন মঞ্জুর হয় না। হত্যাকাণ্ড মেনে নিচ্ছে সরকার, কিন্তু ভিন্নমত মানছে না। কতটা অসভ্য হলে, অজ্ঞ হলে, অশিক্ষিত হলে এ সম্ভব, তা অনুমান করতে পারি।

কাল বাংলাদেশে বিজয় দিবস পালন করা হবে। যে মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা ন’মাস লড়াই করে জয়ী হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীন দেশে সেই মৌলবাদী অপশক্তিই আজ স্বাধীনতা উপভোগ করছে। তাদের আছে শতভাগ বাকস্বাধীনতা। আর আমরা যারা সমাজকে সুস্থ করতে চাই, নারী পুরুষের সমানাধিকার চাই, মানবাধিকার চাই, মানুষে মানুষে সমতা চাই, তারা আজ দেশের শত্রু, আমাদের বাকস্বাধীনতা নেই বললেই চলে। আমাদের পুরনো শত্রুরাই আজ দেশের হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে বসে আছে, তারাই আজ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট। তারা আজ বুদ্ধিজীবীদের গালি পাড়ুক, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করুক, তাদের সাত খুন মাফ।

তাদের বাকস্বাধীনতায় কেউ বাধা দিয়েছে? এই যে সগৌরবে  লেখকের মাথার দাম ঘোষণা করছে ওরা, কেউ বলেছে ওদের যে এ অন্যায়, কেউ ওদের গ্রেফতার করেছে? আমার মাথার দাম যে লোকটি  ঘোষণা করেছিল প্রথম, তাকে আওয়ামী লীগ আমন্ত্রণ জানিয়ে দলে ভিড়িয়েছে, বড় নেতা বানিয়েছে। আর কত অকল্যাণ দেখতে হবে বেঁচে থেকে? এ দেশকে এখন আমার দেশ বলতে লজ্জা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস, আর বিজয় দিবস নিতান্তই অর্থহীন দুটো দিবস আজ।

আমরা দেশটির আদর্শই ধরে রাখতে পারিনি। যারা সেই আদর্শকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তারাই আজ সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি কোন পথে যাবে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা কী লিখবেন, কী লিখবেন না, কী বলবেন, কী বলবেন না। দেশটিতে কে বাস করবেন,  কে করবেন না। কে বাঁচবেন, কে বাঁচবেন না। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাদের সিদ্ধান্তের বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদেরও নেই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র

পতিতাদের জন্য যত সরকারি-বেসরকারি সংগঠন কাজ করছে, সেগুলোর বেশির ভাগই পতিতাবৃত্তি নামক ভয়াবহ নারী নির্যাতনকে টিকিয়ে রাখার জন্য, এ থেকে অসহায় মেয়েদের মুক্ত করার জন্য নয়। বেশির ভাগ নারীবাদীই পতিতাদের যৌনকর্মী বলেন। পতিতাদের তাঁরা শ্রমিকের স্বীকৃতি দিতে চান। তাঁরা মনে করেন, অধিকাংশ মেয়েই এই ‘পেশা’টি পছন্দ করে বলে এই পেশায় স্বেচ্ছায় আসে।   অল্প কিছু নারীবাদী সংগঠন এবং কিছু নারীবাদীই পতিতাপ্রথাকে নারী নির্যাতন প্রথা বলে মনে করে এবং এই কুিসত প্রথাটির বিলুপ্তি চায়। তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের পতিতালয় থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে।

মেয়েরা স্বেচ্ছায় পতিতা হয় না। কোনও মেয়েই শখ করে, পছন্দ করে, সংগ্রাম করে পতিতা হয় না। অন্য কোনও বৃত্তিতে যাওয়ার জন্য যত সংগ্রাম আছে, সবকটি সংগ্রামে ব্যর্থ হয়েই পতিতা হয়। এরকম নয় যে একটি মেয়ের সামনে ডাক্তার হওয়ার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, শিক্ষক হওয়ার, ব্যাঙ্কার হওয়ার, পতিতা হওয়ার পথ খোলা ছিল, সে পতিতা হওয়াটাকে বেছে নিয়েছে। তা যদি হতো, তাহলে আমরা বলতে পারতাম ও স্বেচ্ছায় পতিতা হয়েছে। পছন্দ করার আর কিছু থাকে না বলেই পতিতা হতে মেয়েরা বাধ্য হয়। পতিতা বানাতে মেয়েদের বাধ্য করে পুরুষেরা। যদি মেয়েরা চায় পতিতা হতে, নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কারণে বাধ্য হয়ে চায়। বাধ্য হয়ে চাওয়া আর স্বেচ্ছায় চাওয়ার মধ্যে এক সমুদ্র ব্যবধান। মেয়েরা স্বেচ্ছায় অসম্মানিত, অপমানিত আর অত্যাচারিত হতে চায় না। মেয়েরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না যৌন নির্যাতন। কোনও মেয়ে শখ করে আগুনে ঝাঁপ দেয় না। সতীদাহের আগুনে মেয়েদের ছুড়ে দিয়ে বলা হতো মেয়েরা স্বেচ্ছায় ওই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে।

পতিতাপ্রথাকে বৈধ করার জন্য বিভিন্ন নারী সংগঠন তো আছেই, মানবাধিকার সংগঠনগুলোও চিৎকার চেঁচামেচি কম করে না। পতিতাপ্রথাকে বৈধ করার মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতাপ্রথা বৈধ, সেই রাষ্ট্র কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র শুধু শাসক বানানো নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করাও, নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করাও। কোনো সভ্যতা বা কোনো গণতন্ত্র নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের নির্যাতনকে ছলছুঁতোয় মেনে নেয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

বাংলাদেশের দৌলতদিয়া পতিতালয়ের ভেতরের জীবনগুলো দেখছিলাম সেদিন ইউটিউবে। দু’হাজার পতিতার বাস সেখানে। শতকরা ষাট ভাগ মেয়ের বয়স আঠারো বছরের নিচে। ওই পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে বাস করতে করতে জীবন যে আবার বদলাতে পারে— এ ভাবনাটা কারও মস্তিষ্কের ধারেকাছে উঁকি দেয় না। বাংলাদেশে মোট কত সহস্র মেয়েকে পতিতা বানানো হয়েছে জানি না। অভাবের তাড়নায় বাবারা বিক্রি করে দিয়েছে মেয়েকে। প্রতারক প্রেমিকরা বিক্রি করেছে, স্বামীরা জোর করে পতিতালয়ে পাঠিয়েছে যেন শরীর বেচে টাকা রোজগার করে স্বামীর মদের আর সংসারের খরচ চালায়। পতিতাবৃত্তির সঙ্গে নারী পাচার আর শিশু পাচার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এরা একে অপরের পরিপূরক। যারা দাবি করে পতিতালয়ের সব মেয়েই প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, স্বেচ্ছায় এই পেশায় নাম লিখিয়েছে, তারা মিথ্যে বলে। পতিতালয়ের মেয়েদের বেশির ভাগই শিশু, বেশির ভাগকেই জোর করে বা ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা অপহরণ করে এনে বিক্রি করা হয়েছে। পতিতার জীবন সাধারণত মেয়েরা বারো/তেরো বছর বয়সে শুরু করে, ওই বয়সে নানা রকম বয়স্ক পুরুষের ধর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা থাকে না মেয়েদের।

পতিতাবৃত্তি কোনো অর্থেই পেশা নয়। এটি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। এই পতিতাবৃত্তিতে মেয়েদের দারিদ্র্য ঘোচে না। কোটি কোটি টাকা যা আয় হচ্ছে যৌন ব্যবসা থেকে, সেসব টাকা নির্যাতিত মেয়েদের হাতে পৌঁছোয় না। মেয়েদের প্রতিদিন নারী পাচারকারী, আর দালালের ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়। মেয়েরা এই যৌন নির্যাতন থেকে বেরোতে চায়, কিন্তু তাদের বেরোতে দেওয়া হয় না। কারাগারের চেয়েও ভয়াবহ পতিতালয়। কারাগার থেকে এক সময় মুক্তি পায় মানুষ, কিন্তু পতিতালয় থেকে মৃত্যু অথবা মৃত্যুর কাছাকাছি না পৌঁছোনো পর্যন্ত পায় না।

দরিদ্র বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা মূলত দারিদ্র্য আর প্রতারকের কবলে পড়ে পতিতালয়ে আসে। কচি মেয়েদের শীর্ণ শরীর খদ্দেরদের আকর্ষণ করবে না আশঙ্কা করে, গরু বিক্রি করার আগে যেমন গরুকে মোটাতাজা করার জন্য ওরাডেক্সন নামের স্টেরোয়েড খাওয়ানো হয়, মেয়েদেরও মোটাতাজা করার জন্য তেমন স্টেরোয়েড খাওয়ানো হয়। ওরাডেক্সন স্টেরোয়েড মেয়েদের মোটাতাজা করে বটে, কিন্তু এ ওষুধ শরীরের ক্ষতি করে। পতিতাবৃত্তি জীবনের এত ক্ষতি করে যে মেয়েদের কাছে স্টেরোয়েডের ক্ষতিকে আর ক্ষতি মনে হয় না। এত যে মোটাতাজা হয় তারা, তারপরও কিন্তু গরুর মতো দাম ওঠে না মেয়েদের। মেয়েরা গরুর চেয়েও অনেক সস্তায় বিকোয়। মোদ্দা কথা, মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশের গরু অনেক মূল্যবান। অদ্ভুত শোনালেও বাস্তব পৃথিবীর চিত্র এটিই।

এই পৃথিবীতে মেয়েদের বিরুদ্ধে একটা যৌনযুদ্ধ চলছে। দীর্ঘ দীর্ঘকাল এই যুদ্ধটা চলছে। এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে এটা কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে ‘পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন’। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিরুদ্ধে বলাটা ঠিক নয়, মেয়ে-শিশুদের বিরুদ্ধেও বটে। আজ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র শিশুদের জোর-জবরদস্তি করে, ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করে, মেরে আধমরা করে যৌনক্রীতদাসী বানানো হচ্ছে। পুরুষের যৌনক্ষুধা মেটাতে, পুরুষের শরীরকে কিছুক্ষণের জন্য পুলক দিতে লক্ষ কোটি অসহায় মেয়ে ও শিশুকে বেঁচে থাকার সর্বসুখ বিসর্জন দিতে হচ্ছে, মানুষ হয়েও মানুষের ন্যূনতম অধিকার থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতে বাধ্য হচ্ছে। পতিতাপ্রথার সহজ সংজ্ঞা হলো, ‘মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষের যৌন নির্যাতন’। আরও একটু খুলে বললে পতিতাপ্রথার মানে ‘মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষের যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, মেয়েদের ওপর পুরুষের অবাধ আধিপত্য, মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন’। এসব যদিও যে কোনো গণতন্ত্রে আইনগত নিষিদ্ধ, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতিতালয়ের ভেতরে এসব বহাল তবিয়তে চলছে। যতটা ঘৃণ্যতম, কুৎসিততম, জঘন্যতম, উৎকটতম, কদর্যতম, নিকৃষ্টতম ব্যবহার কোনো মেয়ের সঙ্গে করা সম্ভব পুরুষের, তা নির্দ্বিধায় পুরুষেরা করে পতিতাদের সঙ্গে। যদিও এই ব্যবহার করলে আইনের চোখে তারা অপরাধী, কিন্তু পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করলে এইসব অপরাধকে আপনাতেই বৈধ বলে মেনে নেওয়া হয়।

মানুষের ওপর ঘৃণ্য আর অমানবিক নির্যাতনের কারণে ক্রীতদাসপ্রথা আজ বিশ্বে নিষিদ্ধ। কিন্তু কী কারণে পতিতাপ্রথাকে আজো পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না! যে কারণগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো কিন্তু সত্যিকার কারণ নয়। ‘এই প্রথাটি টিকে ছিল, সুতরাং টিকে থাকবেই’, অথবা ‘বাজে চরিত্রের মেয়েরা এই পেশা চালিয়ে যাবেই। ’ সত্যি কথা বলতে, এই প্রথাটি টিকে আছে মেয়েদের মন্দ চরিত্রের জন্য নয়, ক্ষমতাবান এবং বদ পুরুষরা এই প্রথাকে ছলে বলে কৌশলে টিকিয়ে রাখছে বলে টিকে আছে। টিকিয়ে না রাখলে এটি টিকে থাকত না। ক্রেতা আছে বলেই ব্যবসা টিকে আছে।

আজ পতিতাপ্রথা বা যৌন নির্যাতন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তো বটেই, সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠা সফল বাণিজ্যশিল্প। এই শিল্পের কাঁচামাল দুর্ভাগা, অনাথ শিশুদের শরীর, দরিদ্র আর প্রতারিত মেয়েদের শরীর।

যতদিন পুরুষেরা যৌন সামগ্রী বলে মনে করবে নারীকে, ততদিন পর্যন্ত তারা নারীকে পতিতা বানাবে, টিকিয়ে রাখবে পতিতালয়। যৌন দাসিত্বকে বলবে যৌনকর্ম। আমার বা আপনার প্রতিবাদে খুব কি পরিবর্তন আসবে? সরকারকেই নিতে হবে পতিতাপ্রথা নির্মূল করার দায়িত্ব।   সরকার কবে নেবে এই দায়িত্ব।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

শিশুদের জন্য লোভের জিভ

বিয়ের জন্য আগের মতোই মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ দিচ্ছে এই আইন। ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বিবাহের জন্য ২১ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো ছেলে এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো মেয়ে”।

এই আইনটি খুব সভ্য আইন হতে পারতো যদি ওই বিশেষ প্রেক্ষাপটের ব্যাপারটি না থাকতো। বিশেষ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বলেন, “অবিবাহিত মাতা, কিন্তু তার বাচ্চা আছে- এ রকম কেইস যদি হয়, এসব ক্ষেত্রে তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য এই বিধান করা হয়েছে। কত ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, এজন্য বিয়েগুলো হয়ে যায়। ওটাকে লিগালাইজ করার জন্য এই প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে তো ১০-১১ বছরেও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো আছে তো, এটার জন্য এই ব্যবস্থা। ”

মন্ত্রিপরিষদ বলতে চাইছেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, তাদের বিয়ে, এই আইনটি থাকলে অবৈধ বলে গণ্য হবে না। এই আইনটি বাল্যবিবাহকে ছলে কৌশলে বৈধ করছে, কিন্তু এটি বাল্যবিবাহ কী করে রোধ করবে, তা আমার বোধগম্য নয়। আইনটিতে বিশেষ প্রেক্ষাপটের উল্লেখ আছে, কিন্তু কোনো বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ৫০ বছর বয়সী কোনো পুরুষ ৬ বছর বয়সী কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেও সেই বিয়েকে এই আইন বৈধ ঘোষণা করতে পারে। আদালতের অনুমতি না নিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্করা বিয়ে করলে সামান্য জেল-জরিমানা ছাড়া শাস্তি এমন কিছু নয়।

মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থেকে কমানো যায় কি না- তা নিয়ে ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রথম আলোচনা উঠলে বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করে, যাতে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার প্রস্তাব করা হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সে সময় ‘বিশেষ পরিস্থিতির’ ব্যাখ্যায় বলেন, “মেয়ে প্রেমঘটিত কারণে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেলে বা মেয়ে ছেলের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানালে বা বিয়ের আগে গর্ভবতী হলে- এরকম পরিস্থিতিতে ১৬ বছর করা যায় কি না, তা সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। ” এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগে মাতৃমৃত্যু রোধ ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ক্ষমতাসীন দলের দুই সংসদ সদস্যও বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, কোনো ধরনের শর্ত রেখেও মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮-এর নিচে আনা উচিত হবে না। এক অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো হলে তা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করবে। সেইভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে মেয়ে শিশুদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এত বাধা এসেছে, তারপরও মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮-এর নিচে করার জন্য বাংলাদেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। আমি আশঙ্কা করছিলাম ১৮-কে আচমকা একদিন ১৬ করে ফেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন এমন একটি আইন করা হয়েছে যেটি আরো ভয়ঙ্কর। যে কোনো বয়সী মেয়েরই বিয়ে হতে পারবে এই আইনে। বাংলাদেশের মতো দেশে ‘আদালতের অনুমতি’ নিতান্তই বাক্যালংকারের জন্য ব্যবহৃত হয়।

মানুষ যত সভ্য হয়, মেয়েদের বিরুদ্ধে বর্বরতা তত কমিয়ে ফেলে। যে দেশে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার, সে দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোটা সে দেশের সভ্য হওয়ার লক্ষণ। বাংলাদেশেও তাই করা হয়েছিল, কিন্তু এখন আবার কমানো হচ্ছে সেই বয়স। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ যেসব দেশে ঘটছে, যেসব অনুন্নত বর্বর দেশগুলোতে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি তিনটে বিয়ের একটি বিয়েই বাল্যবিবাহ। শতকরা ৬৮ ভাগ মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ ঘটে মাত্র তিনটে দেশে। আফ্রিকার নাইজের, চাদ আর মালিতে।

আমরা সকলেই জানি, আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তারা শিশু। বাংলাদেশও আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করে না। তাহলে জেনেবুঝে বাংলাদেশ কেন শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে! কচি কুমারী মেয়েকে যেন আইনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই পুরুষেরা ভোগ করতে পারে বা ধর্ষণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করছে?

এ কথা কে না জানে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হলে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও উপকার তো হয়ই না, বরং অপকার হয়! অল্প বয়সী মেয়েরা স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় অতি সহজেই। অশিক্ষিত থেকে যায় জীবনভর, কারণ বিয়ের পর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হয়। যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকাটাও বেশি। গর্ভবতী হওয়ার জন্য শরীর এবং মন প্রস্তুত হওয়ার আগেই তাদের গর্ভবতী হতে হয়। অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়া এবং সন্তান প্রসবের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়ের মৃত্যু ঘটে। সত্যি কথা বলতে কী, কোনও মেয়ের বাল্যবিবাহ হওয়া মানে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া।

এই আইনের ভুক্তভোগী হবে মেয়েরাই। শিশুর জন্য লোভের জিভ দিন দিন লম্বা হবে পুরুষের। শিশুধর্ষকদের হাত থেকে মেয়েদের রেহাই নেই। শিশু পাচারকারীর হাত থেকেই রেহাই নেই। এই আইনের মাধ্যমে সরকার আসলে ধর্ষণকে বৈধ করবার ব্যবস্থা করছে। দরিদ্র মেয়েরা এমনিতে নানা নির্যাতনের শিকার, প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত, তাদের নির্যাতনকে এখন আইনি বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। যে বয়সটায় একটা মেয়ে খুব অসহায়, সেই বয়সটায় তার বিয়েটা বৈধ করা হচ্ছে। এ অনেকটা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো। বিনা অপরাধে যাবজ্জীবন। অথবা অপরাধ একটিই, মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়ার অপরাধ। পতিতালয় থেকে অসহায় মেয়েরা যেমন বেরোতে পারে না, নারী-পুরুষের বৈষম্যের সংসার থেকেও তেমনি বেরোতে পারে না। সে কারণে একটি মেয়ের শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়েরা অশিক্ষিত এবং পরনির্ভর মেয়েদের চেয়ে সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে অনেক বেশি ভালো অবস্থায় আছে। একটা মেয়ের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে হওয়া মানে, তার স্বাস্থ্য, তার শিক্ষা, তার সম্ভাবনা সব নষ্ট করে দেওয়া। জেনেশুনে বাংলাদেশ সরকার কার বা কাদের স্বার্থে এই আইনটি তৈরি করতে চাইছে?

বাংলাদেশে আঠারো বছর বয়স ছিল মেয়েদের জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স। তারপরও আইনটিকে না মেনে অসাধু লোকেরা নিজেদের শিশুকন্যাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। এই সমস্যার সমাধান কিন্তু বিয়ের বয়স আঠারো থেকে কমিয়ে এনে হয় না। এর সমাধান হয় ওই অসাধু লোকদের সাধু বানানোয়। এর সমাধান হয় মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দেশব্যাপী মানুষকে সচেতন করিয়ে। যখন মানুষকে সচেতন করার কাজটি পরিশ্রমের বলে মনে হয়, তখনই সরকার দুষ্ট লোকদের তুষ্ট করতে মন্দ কাজটি করে।

একটা সমাজ কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে ওই সমাজে মেয়েদের অবস্থাটা কেমন, তার ওপর। বাংলাদেশে একগাদা আইন রাখা আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সমাজ নারী-বিদ্বেষী সমাজ, এই সমাজ মেয়েদের যৌন বস্তু, পুরুষের দাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছু মনে করে না। এই নারী-বিদ্বেষী মানসিকতা যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন, যখন নারী পুরুষের সকল বৈষম্য দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তখনই সরকার কি না হায়েনার মুখে হরিণ ছুড়ে দেওয়ার মতো শিশুধর্ষকদের বিকৃত যৌনলালসা মেটাতে শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে।

ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে বা গায়ে গতরে বাড়লেই যে মেয়েরা বিয়ের জন্য মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো, তা নয়। ঠিক যেমন ছেলেদের দাড়িগোঁফ গজালেই বিয়ে করার যোগ্য হয়ে ওঠে না। বিয়ে শুধুই দৈহিক সম্পর্ক নয়, বিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। বিয়ে খুব বড় দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে সন্তানের।

শৈশব যাপনের অধিকার প্রত্যেক শিশুরই আছে। মেয়েদের শৈশব আর কৈশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে হুটহাট যৌবন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অচিরে মেয়েরা বার্ধক্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের জীবনকে এভাবে নষ্ট করে দেওয়ার কোনও অধিকার কোনও সরকারের নেই।

শিশু-সঙ্গমে আর শিশু-ধর্ষণে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। শরীরে যৌনতার বোধ শুরু না হতেই, নিতান্তই কৌতূহলে বা বাধ্য হয়ে শিশুরা সঙ্গমে রাজি হতেই পারে, কিন্তু সে রাজি হওয়া সত্যিকার রাজি হওয়া নয়।

সমাজের বেশির ভাগ মেয়েরা সুখী নয়, অথচ সুখী হওয়ার ভান করে। অথবা দুঃখকেই, না পাওয়াকেই, পরাধীনতাকেই সুখ বলে, পাওয়া বলে, স্বাধীনতা বলে ভাবে। ভাবতে শিখেছে ছোটবেলা থেকেই। নতুন করে এর বিপরীত কিছু শেখা সম্ভবত অধিকাংশ মেয়ের পক্ষেই আর সম্ভব নয়। পুরুষ যা শিখেছে ছোটবেলা থেকে তা হলো, তারা প্রভু, তারা জানে বেশি, বোঝে বেশি, তাদের জন্য সমাজ, তাদের জন্য জগৎ, তারা শাসন করবে, তারা ভোগ করবে। এই শিক্ষাটা না শিখতে এবং এর বিপরীত কিছু শিখতে অধিকাংশ পুরুষই রাজি নয়।

জাতি হিসেবে সভ্য হতে চাইলে শিশুর প্রতি পুরুষের লোভের জিভকে সংযত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব এই জিভকে সংযত করার জন্য উৎসাহ দেওয়া। কিছুতেই ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ জিভ অসংযত করা যেতে পারে বলে অসংযত করায় উৎসাহ দেওয়া নয়।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০১ ডিসেম্বর, ২০১৬

হাতে টাকা নেই

ব্যাঙ্কে টাকা আছে, কিন্তু হাতে টাকা নেই। কারণ লম্বা লাইন পেরিয়ে এটিএমে যখন পৌঁছই তখন মেশিনের টাকা ফুরিয়ে যায়। ব্যাঙ্কের দীর্ঘ লাইনে সকালে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায় সপ্তাহের বরাদ্দ টাকা তুলতে শুধু মনের জোর থাকলে চলে না, পায়েও জোর থাকা চাই। চারদিকে সব আছে, শুধু টাকা নেই। কার্ডে জিনিসপত্রের দাম দিচ্ছি, চেকে দিচ্ছি। কিন্তু খুচরোর তো দরকার আছে। মাছওয়ালার কাছ থেকে বাকিতে বেশ ক’দিন মাছ কিনেছি। মাছওয়ালা ক্যাশ ছাড়া কিছু নেয় না। কিন্তু সেদিন তার হাতে অনেকটা জোর করেই ব্যাঙ্কের চেক ধরিয়ে দিলাম। এ ছাড়া আমার উপায় কী!

প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষ ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াচ্ছে। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে হতাশায়-আশঙ্কায় আত্মহত্যা করছে, কারো কারো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারপরও মানুষ কিন্তু অখুশি নয়। খুব বেশি কেউ বলছে না হঠাৎ করে পাঁচশ আর এক হাজার টাকার নোট বাতিল করার কাজটা মোদিজি ভালো করেননি, বা এভাবে দুর্নীতি দমন করা যায় না। ভারতের মানুষ দুর্নীতি দমন করার জন্য কোনো সরকারকে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে, যে পদক্ষেপ দেশকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, দেখেনি আগে। তাই সকলেই ভেবে নিচ্ছে চমৎকার দমন হচ্ছে দুর্নীতি। মাঝে মাঝেই খবর পাচ্ছে কোথাও রাস্তার ধারে বস্তা ভরা বাতিল টাকা পাওয়া যাচ্ছে, কোনও খালে বা নদীতে বাতিল হয়ে যাওয়া বিস্তর টাকা ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে, টাকা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সকলেই ধরে নিচ্ছে ধরা পড়ে গেছে দুর্নীতিবাজরা। সাধারণ মানুষ এই ভেবে খুশি হচ্ছে যে কালো টাকা যাদের কাছে ছিল, তাদের ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছেন মোদি, তারা এখন কালো টাকা ফেলে দিচ্ছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, ডুবিয়ে দিচ্ছে। মানুষ ভেবে নিচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিতে যাচ্ছে দুর্নীতি। নিজেদের দুর্ভোগ নিয়ে তাই তারা মোটেও দুঃখিত নয়। সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলা যাবে না। এটিএম থেকে আড়াই হাজারের বেশি নয়। পুরনো নোট চার হাজারের বেশি বদলানো যাবে না। একশ’ পঁচিশ কোটি লোকের দেশ। বিয়ের মরশুম এখন। মানুষের হাতে টাকা নেই। অন্য কোনো দেশ হলে এমন সরকারকে বিদেয় নিতে হতো বা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। ভারতবর্ষই বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েও একই রকম জনপ্রিয় থাকা যায়।

ভারতবর্ষের ভাববাদী আদর্শে আত্মত্যাগ থাকতেই হয়। মানুষ শুনতে শুনতে বড় হয়েছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। দীর্ঘ দুর্গম পথ হেঁটে তারা তীর্থস্থানে যায়। দুর্ভোগ যত হবে, তত নাকি পুণ্য হবে। ধর্মে আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ দেশ থেকে দুর্নীতি বিদেয় করতে নিজেদের অশান্তি হাসিমুখেই মেনে নিচ্ছে। তবে দুর্মুখ যে নেই তা নয়, বলছে, ‘যে জনগোষ্ঠী টাকাকে আক্ষরিক অর্থে পুজো করে তারা টাকা ওভাবে পোড়াবে না, ডোবাবে না, রাস্তায় ফেলবেও না। কালো টাকাকে সাদা করার যেসব পদ্ধতি আছে, সবগুলোই চেষ্টা করবে। বাতিল টাকা রাস্তায় ফেলেছে সরকারি দলের লোকেরা। নিউজ এজেন্সির লোকদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে নিয়ে তারাই দেখাচ্ছে এই দেখ কালো টাকা রাতের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে ওরা, পুড়িয়ে দিচ্ছে ওরা। ওরা কারা? ওরা কালোবাজারি, কালো ধনের মালিক। ’

মানুষ কালো ধনের মালিকদের শাস্তি দিতে এক পায়ে খাড়া। ভারতের রাজনীতিতে এর চেয়ে জনপ্রিয় আর কোনো বিষয় নেই যে, ভারতীয়দের কালো টাকা তুমি তাদের সুইস ব্যাঙ্ক থেকে উঠিয়ে দেশে ফেরত নিয়ে আসবে। ওই টাকায় দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে, সব মানুষের সচ্ছলতা আসবে। এই কাজটি করার প্রতিশ্রুতি দিলে এ দেশে ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হওয়া যায়।

অরভিন্দ কেজরিওয়াল ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন রাজনীতির লোক না হয়েও লোককে কী কথা শোনালে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় রাজনীতিক হয়ে যেতে পারেন। হয়েছেনও তাই। কংগ্রেসের নেতারা দুর্নীতি করে কালো টাকা জমিয়েছেন, লক্ষ কোটি টাকার স্ক্যাম হয়েছে কংগ্রেসের আমলে। এই প্রচারই যথেষ্ট ছিল কংগ্রেসকে গত নির্বাচনে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতে। বিজেপি এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল যে তারা দেশকে দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করবে। সুইস ব্যাঙ্কে জমানো ভারতীয়দের সব কালো টাকা সরকার গঠন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে আসবে। কয়েক বছর হয়ে গেল, বিদেশে জমানো কালো টাকা এখনও দেশে ফেরত আনার কোনো লক্ষণই নেই। মানুষ কিন্তু অপেক্ষা করছে। এমন সময় আচমকা এলো টাকা বাতিলের ঘোষণা। মানুষ ভেবে নিচ্ছে, প্রথম পদক্ষেপে কালোবাজারিরা অর্ধেক মৃত, এর পর এদের বিদেশের টাকা ঘরে নিয়ে এলে, অর্থাৎ দ্বিতীয় পদক্ষেপে এরা হবে পুরোটাই মৃত।

সাধারণ মানুষ হয়তো তলিয়ে দেখে না, ধরা যদি কেউ পড়েও থাকে, ক্ষতি যদি কারো হয়েই থাকে এই টাকা বাতিল করার সিদ্ধান্তের কারণে, সে রাঘব-বোয়ালদের নয়, চুনোপুঁটিদের, যারা সামান্য কালো টাকা জমিয়ে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল বিপদে আপদে বাঁচার জন্য, ছেলে মেয়ের প্রাইভেট ইস্কুলে পড়াশোনা, বা তাদের বিয়েটিয়ের জন্য। যারা রাঘব-বোয়াল, যাদের ধন দৌলতের কোনো কূল কিনার নেই, তারা নোট রাখে না কোথাও, তারা রিয়েল এস্টেটে ঢেলে দেয়, সোনা কিনে রাখে, অথবা সুইস ব্যাঙ্কে রেখে দেয়। তাদের সঙ্গে সব রাজনীতিকদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায়, সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। তারা নির্বাচনের সময় দু’হাতে কালো টাকা ঢেলে পছন্দের দলকে জেতানোর ব্যবস্থা করে, শত শত কোটি টাকা দলের দানবাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর তারা যখন সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে বাণিজ্য উদ্দেশ্যে লক্ষ কোটি টাকা লোন নেয়, বছরের পর বছর পার হলেও সেই লোনের টাকা পরিশোধ করার কোনো তাগিদ তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এই রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে।

হাজার বা লক্ষ কোটি কালো টাকা বিদেশের ব্যাঙ্কে যারা লুকিয়ে রেখেছে, তাদের লিস্ট আগের সরকারের কাছেও আছে, এই সরকারের কাছেও আছে। কিন্তু কেউ সেই কাজটি করছেন না, যে কাজটির জন্য জনগণ দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছে। কোনো সরকারই কথা দিয়েও সেই টাকা ফেরত আনছেন না। অপ্রিয় সত্য কথাটি হলো, সেই লিস্টে অনেক রাজনীতিক আছেন। সব দলেরই রাজনীতিক। এক দল ফেঁসে গেলে আরেক দলও ফেঁসে যাবে। তাই দুর্মুখরা বলে, ‘এ অনেকটা দলে দলে ‘পলিটিক্যাল ডীল’, তুমিও যাবে না, আমিও যাবো না, বুঝলে নটবর?’

এ দেশের পাবলিককে বোকা বানানো খুব সহজ। তারা হিসেব চাইছে না টাকা বাতিল করে দেশজুড়ে যে টাকার অভাব তৈরি করা হলো, জনগণকে যে ভোগানো হলো, এখনো হচ্ছে, আখেরে কতটা লাভবান হলো দেশ! বাণিজ্যে যে মন্দা দেখা দিচ্ছে, কতদিনে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে, তা জানতেও চাইছে না সরকারের কাছে। পাবলিক যে কোনো উপায়ে দুর্নীতি রোধের পক্ষে। তোমার পদ্ধতিটি কার্যকরী নাও হতে পারে, কিন্তু কিছু করার জন্য তুমি যে চেষ্টা করেছ, এতেই তারা খুশি।

এত খুশি যে দুর্নীতি দমনের সরকারি এই সিদ্ধান্তে ভুল ধরাটাও কারো সহ্য হচ্ছে না। যদি ভরা মাঠে কেউ টাকা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বলে, তবে সে মার খেয়ে মরবে। দেশদ্রোহী বলে তো গালি দেওয়াই হবে। আজকাল কেউ যদি ভারতের সিনেমায় পাকিস্তানি অভিনেতাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে, বা পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব চায়, বা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের খুন খারাবির কোনোরকম সমালোচনা করে, তাহলেই দেশদ্রোহী আখ্যা পেয়ে যায়। অনেক ভিন্ন মতের মানুষ দেশদ্রোহী আখ্যা পাওয়া নিয়ে এতই ভীতসন্ত্রস্ত যে মনের কথা কোথাও তারা প্রকাশ করছে না। দেয়ালেরও কান আছে, তারাও জানে।

দুর্নীতি রোধের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা তো দূরের কথা, এ নিয়ে প্রশ্ন করাও চলবে না। মানুষ সত্যিই অন্তর থেকে চাইছে দেশ থেকে দুর্নীতি সরাতে। এ সময় সৎ রাজনীতিকদের চেষ্টা করা উচিত দুর্নীতি রোধের টোপটা পাবলিকের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে না রেখে সত্যিকার কিছু একটা করা, জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, কিন্তু দুর্নীতি রোধ হয়, এমন কিছু। এমন কিছু পদ্ধতির অস্তিত্ব যে নেই, তা তো নয়।

কে সৎ আর কে সৎ নয়, এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেদিন কথোপকথন শুনলাম। তারা বলছে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল কালাম আজাদ সৎ লোক ছিলেন, কারণ তাঁর পরিবার ছিল না, সন্তানাদি ছিল না, তিনি একা মানুষ ছিলেন, কারো জন্য তাঁর চুরি ডাকাতি করার দরকার পড়েনি। মোদি সৎ, কারণ তিনিও একা মানুষ। সৎ আর অসতের এই ব্যাখ্যা যারা দেয়, তাদের বোকা বানানো সহজ বলেই চতুর রাজনীতিকরা বোকা বানায়। আমি একবার ভেবেছিলাম বলবো, পরিবার আর বাচ্চাকাচ্চা না থাকলেই কেউ সৎ হয়, আর না থাকলেই অসৎ হয়, তা ঠিক নয়। শেষ পর্যন্ত বলিনি, বললে হয়তো মার খেতে হবে, অথবা ভারতের ভাল চাই না আমি, আমাকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত— এমন কথা শুনতে হতে পারে।

বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা মানুষকেও সময় সময় মুখ বুজে থাকতে হয়।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

সাঁওতালদের কথা

সাঁওতালদের ওরকম আলাদা করে রাখা হয় কেন? ওরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু? জন্তু না হলেও পর্যটন বাণিজ্যের পণ্য অথবা দর্শনীয় বস্তু নিশ্চয়ই।   কেউ কেউ বলে, ‘মেইনস্ট্রিম সমাজে ওদের না থাকাই ভালো, থাকলে ওদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকাচার, ভাষা সব  হারিয়ে যাবে’। কিন্তু দল বেঁধে বাস করলেই ঐতিহ্য রক্ষা করা হয় না।    দারিদ্র্য ওদের জীবন থেকে সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। বারো মাসে ওদের তেরো পার্বণ। পার্বণ পালনের জন্য যে কড়ির দরকার হয়, সে কি আছে ওদের ঝোলায়? ওরা তো এর মধ্যে নিজেদের পোশাক ছেড়ে আর সবার মতো পোশাক পরছে। ওরা তো বাংলা ভাষাটাকেও বলতে শিখেছে। মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার জন্য বাকি আর কী আছে?

ভারতের আন্দামানের একটা জায়গায় জারোয়াদের বন্দি করে রাখা হয়। পর্যটকরা ওদের দূর থেকে দেখে। চিড়িয়াখানার জন্তুদের যেমন দেখে, তেমন দেখে ন্যাংটো ন্যাংটো মানুষগুলোকে। ওদেরও মূলস্রোত থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে, দর্শনীয় বস্তু হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। মনে পড়ছে ইংরেজরা যখন আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পিগমিদের—ছোট ছোট মানুষদের—ধরে এনেছিল, ওরা মানুষ কিন্তু ওদের মানুষ নয়, বরং ‘মানুষের মতো দেখতে এক ধরনের জন্তু’ বলে রায় দিয়েছিলেন তখনকার বিজ্ঞানীরা, ওদের রাখা হয়েছিল খাঁচায় বন্দি করে, ঠিক যেমন জঙ্গলের হিংস্র জন্তুকে খাঁচায় বন্দি করা হয়।   আন্দামানের জারোয়াদের জন্যও তো তেমন অদৃশ্য খাঁচা নির্মাণ হয়েছে! সাঁওতালদেরও জন্যও  হয়তো  অদৃশ্য কোনো খাঁচা  আছে। সাঁওতালদের জন্য    একটা নির্দিষ্ট এলাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আমেরিকার নেটিভ আমেরিকানদের জন্য যেমন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ এলাকাগুলোই দেওয়া হয়েছে ওদের, যারা দেশটার আদিবাসী, মানে আদি থেকে বাস করছে যারা। বহিরাগতরা আদিবাসীদের দেশ দখল করে আদিবাসীদেরই একরকম  ‘একঘরে’ করে। আদিবাসীদের এভাবেই ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে পৃথিবী থেকে।

মনে পড়ছে ইংরেজরা যখন আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পিগমিদের—ছোট ছোট মানুষদের—ধরে এনেছিল, ওরা মানুষ, কিন্তু ওদের ‘মানুষের মতো দেখতে এক ধরনের জন্তু’ বলে রায় দেওয়া  হয়েছিল, রাখা হয়েছিল খাঁচায় বন্দি করে। আন্দামানের জারোয়াদের জন্যও তো তেমন অদৃশ্য খাঁচা নির্মাণ হয়েছে! সাঁওতালদেরও হয়তো  অদৃশ্য কোনো খাঁচা  আছে।

বাংলাদেশে সম্ভবত দুলাখ সাঁওতাল বাস করে। বেশি বাস করে ঝাড়খন্ডে, পশ্চিমবঙ্গে। উড়িষ্যায়, বিহারে, আসামেও সংখ্যা কম নয়। নেপালেও কিছু আছে। সাঁওতালদের জন্য তো সাঁওতাল পরগণা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক ধরনের খাঁচাই তো!  অবশ্য সাঁওতালরাও নিজেদের জন্য একটা রাজ্য চেয়েছিল। আর নির্যাতিত হতে চায় না বলেই চেয়েছিল। সমাধান তো আলাদা রাজ্যে, বা আলাদা গ্রামে, বা আলাদা খাঁচায় নেই। সমাধান একটা বৈষম্যহীন সমাজ। তেমন একটি সমাজ আমরা না দিতে পেরেছি সাঁওতালদের, না দিতে পেরেছি আমাদের।

বাংলাদেশে আমি ৩১ বছর কাটিয়েছি, কোনোদিন দেখিনি আমার পাশের বাড়িতে এক সাঁওতাল পরিবার ভাড়া থাকেন, অথবা নাটক দেখছি, পাশের সিটে একজন সাঁওতাল, বাজার করছি, একজন সাঁওতালও করছেন, অথবা হাসপাতালে ডাক্তারি করছি, একই হাসপাতালে একজন সাঁওতালও ডাক্তারি করছেন। স্কুল-কলেজে আমি গারো আর চাকমা সহপাঠী পেয়েছি, কিন্তু সাঁওতাল পাইনি। ওরা শিক্ষা-দীক্ষা আর  চাকরি-বাকরি কতটুকু চায়, আর এতে বাধা কতটুকু পায়, আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে।

সাঁওতালদের নাচ গান পরব উৎসব বেঁচে থাকুক, কিন্তু ওদের কট্টর পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি বেঁচে থাকার দরকার কী? ওদের ভূত প্রেতের বিশ্বাস, পাহাড় পুজো, সূর্য পুজো  এসব  একশ রকম কুসংস্কারকে সম্মান করার, শ্রদ্ধা করার আমি কোনো কারণ দেখি না। শুধু সাঁওতালদের নয়, কোনো গোষ্ঠীর কুসংস্কারকেই সম্মান করা উচিত নয়। মানুষের অধিকারকে যেহেতু মানি, সেহেতু অলৌকিকে বিশ্বাস করার যে অধিকার মানুষের আছে, তাকেও মানি।   মানি বলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও ঈশ্বরে বিশ্বাস যারা করে, তাদের বিশ্বাস করার অধিকারের জন্য মিছিলে নামি।

সাঁওতালরা দরিদ্র। তাদের দারিদ্র্য ঘোঁচাবার জন্য কোনো সরকার কি উদ্যোগ নিয়েছেন কখনো? আমার তো মনে হয় না। শুনেছি সরকার উলটে উচ্ছেদ করতে চাইছেন সাঁওতালদের। সরকারের বন্দুকবাহিনী গাইবান্ধার সাঁওতাল এলাকায় গিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, গুলি করে মেরেছে ওদের। সাঁওতালদের খুন করতে বন্দুক হাতে নিয়েছিল ইংরেজরাও। সেই ১৮৫৫ সালে জমিদার, মহাজন, আর ইংরেজদের অত্যাচারে ষাট হাজার বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল তীরধনুক হাতে নিয়ে সশস্ত্র ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা পনেরো হাজারেরও বেশি সাঁওতালকে হত্যা করেছিল। সাঁওতালদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ২০১৬ সালেও সাঁওতালদের গ্রাম জ্বালানো হয়। ঔপনিবেশিক সরকার আর দিশি সরকারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? শাসকের চেহারা ভিন্ন হলেও শোষণের চেহারা এক।

১৮৫৫ সালে  সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু মাঝি আর কানু মাঝিকে হত্যা করা হয়েছিল।   সাঁওতাল বিদ্রোহ ভেঙেচুরে দিয়েছিল ইংরেজরা। একজন ইংরেজ আর্মি অফিসার বলেছিলেন, ‘ওটা যুদ্ধ ছিল না। সাঁওতালরা  পরাজয় স্বীকার করতে জানতো না। যতক্ষণ তাদের ড্রাম বাজতো, ততক্ষণ তারা দাঁড়িয়ে থাকবে, আর গুলি খাবে। তাদের তীর আমাদের লোকদেরও খুন করেছে, সে কারণেই আমরা ওদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছি, যতক্ষণ ওরা দাঁড়িয়ে ছিল, গুলি চালিয়েছি। ওদের ড্রাম বাজা বন্ধ হলে ওরা সিকি মেইল হেঁটে যেত, কিন্তু বাজনা শুরু হলে আবার ওরা দাঁড়িয়ে যেত। তখন আমরাও নিশ্চিন্তে ওদের বুকে গুলি চালাতাম। আমাদের এমন কোনো সৈন্য নেই, যে কিনা এই যুদ্ধে অপরাধবোধে ভোগেনি। ’     চার্লস ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের সম্মানবোধটা বেশ ভালোই ছিল।   তারা তাদের তীরে বিষ লাগাতো যখন শিকার করতো, কিন্তু কোনো শত্রুর দিকে বিষাক্ত তীর ছোড়েনি। তারা আমাদের শত্রু রাশিয়ানদের চেয়েও নিশ্চয়ই অনেক সভ্য। রাশিয়ানরা তো নিশ্চয়ই সাঁওতালদের  কাজকে বোকার কাজ বলতো, আর বলে দিত, এটা কোনো যুদ্ধই নয়। ’ সাঁওতাল বিদ্রোহের পর  একশ ষাট বছর পার হয়েছে, এখনো   সাঁওতালরা  আগের মতই হতদরিদ্র, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যে মামলা, জাল দলিল,  বৈষম্য আর  হেনস্থার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। নিজের দেশেই, নিজের স্বাধীন মাটিতেই তারা চরম অবহেলার শিকার হয়ে বেঁচে আছে। আমি বুঝি না, একশ’ ষাট বছরে সাঁওতালদের অবস্থার তো কোনো উন্নতি হয়নি, তবে কেন সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেনি আর? ওদের কি আত্মবিশ্বাস নাশ হয়ে গেছে!  আবার মনে হয়, এই যে সেদিন সরকারি রিলিফ ফিরিয়ে দিল, এতে তো মনে হয় এখনও চাইলে মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়াতে পারে, এখনো তীরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদি নিশানা করতে পারে। দারিদ্র্য মানুষকে যেমন বিদ্রোহী করে, তেমন দুর্বল করে। সাঁওতালদের সম্ভবত দুর্বলই করেছে  দারিদ্র্য। তা না হলে যে লোকেরা সাঁওতালদের নির্যাতন করছে বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে ওরা  রুখে উঠছে না কেন? ওরা নিশ্চই এর মধ্যে বুঝে গিয়েছে তীর আর গুলির মধ্যে যুদ্ধ বাধতে পারে না। আমার খুব ইচ্ছে করে দেখতে যে তীর ওরা ওদের অত্যাচারীর দিকে  ছুড়ছে, সেই তীরের ডগায় বিষ মাখিয়ে নিয়েছে।   কিন্তু এও বুঝি এ কোনো সমাধান নয়। সমাধান যার হাতে, সেই সরকারই তো রাতের অন্ধকারে রক্ত নেয়।   ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে পারেনি সাঁওতালরা, বাঙালি সরকারের বিরুদ্ধেও পারবে না। মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীরধনুক হেরে যায়, ধনীর বিরুদ্ধে গরিবেরা হেরে যায়। সমতার, সমানাধিকারের, সহানুভূতির, সমমর্মিতার আওয়াজগুলো কত যে ফাঁপা, তা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে কৃষি কাজ করে বাঁচে সাঁওতালরা। বাঙালির কোনো অনিষ্ট  করে না। কিন্তু তারপরও বাঙালিরা ওদের ঘৃণা করে। কালো বলে ঘৃণা করে, গরিব বলে ঘৃণা করে। ওদের ভাষা ভিন্ন বলে, ধর্ম ভিন্ন বলে, সংস্কৃতি ভিন্ন বলে  ঘৃণা  আমি নিজে বাঙালি হয়ে বলছি, সারা পৃথিবী ঘুরে নানা রকম জাত দেখেছি, বাঙালির মতো এত অসহিষ্ণু, বর্ণবাদী, লোভী, গরিবকে ঘৃণা- দুর্বলকে মারধর-ধনীকে সম্মান করা, হিংসুক, নিষ্ঠুর জাত কমই দেখেছি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬

বায়ু দূষণ

বায়ু দূষণ যে কী ভয়ঙ্কর তা দিল্লিতে বসবাস শুরু করার আগে আমি বুঝতে পারিনি। দিল্লির রাস্তাঘাটেও যখন ঘুরে বেরিয়েছি, তখনো খুব একটা লক্ষ করিনি ফুসফুসে কী নিচ্ছি। বাতাস নিচ্ছি নাকি বিষ নিচ্ছি। প্রতিবারই পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকা থেকে ভারতে নামলেই টের পাই আবহাওয়াটা গুমোট। হাওয়াটা ভারি। ডিজেলের, আবর্জনার, ধুপের আর লোবানের গন্ধ মিশে কী একটা নাম না জানা গন্ধ তৈরি করে। ওই গন্ধটাই আমার কাছে ভারত। কারণ ভারতে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওই গন্ধটাই গত দু’দশকের বেশি আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে।

আমি কেন দিল্লিতে থাকি? কলকাতায় ছিলাম, ও শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ন’বছর আগে। আর কোনো শহরে ঠাঁই মেলেনি, তখন দিল্লিতে এনে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার, ভারত ছাড়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু ভারতের রেসিডেন্ট পারমিটটা বিদেশ থেকে এসে এসে নিতে হতো, দিল্লি থেকেই দিত ওই পারমিট। কেন থাকি দিল্লিতে? কেন্দ্রের সরকার ছাড়া ভারতের কোনো রাজ্যের সরকারই আমাকে বসবাসের অনুমতি দেবে না বলে, ভারতে এই দিল্লি শহর ছাড়া অন্য কোনো শহর নেই বলে আমার থাকার? নাকি কলকাতা থেকে আমার এক বাড়ি সংসার গুটিয়ে এনে এখানে এক বন্ধুর বাড়িতে রাখা হয়েছিল বলে? যেখানে বইপত্র, যেখানে কাপড়-চোপড়, যেখানে থালাবাসন, সেখানটাকেই বাড়ি বলে মনে হয় বলে?

চোখের সামনেই সেদিন হলো দীপাবলির বাজি-পটকা ফাটানো। কত কোটি টাকা যে আকাশে পোড়ালো মানুষ। ওই রাত থেকেই শুরু হলো বায়ু দূষণ। দিল্লির বাতাস স্তব্ধ হয়ে রইলো কয়েক দিন। বায়ু দূষণ হতে হতে এমনই চরমে পৌঁছলো যে বুকে চাপ অনুভব করছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার বুঝি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমি বায়ু দূষণ সম্পর্কে যা জেনেছি, তা ভয়াবহ। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরে কেন আমি মরতে বাসা বাঁধতে গেলাম!

বায়ু দূষণ মাত্রা যদি শূন্য থেকে পঞ্চাশ অব্দি থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ঝুঁকি নেই, অবস্থা মোটামুটি ভালো। যদি ৫১ থেকে ১০০ থাকে, তবে ফসফুস আর হৃদপিণ্ডে অসুখ যাদের আছে, তাদের অসুবিধে করবে এই দূষণ। যদি ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে থাকে, তবে বুঝতে হবে এটি অস্বাস্থ্যকর, সবার জন্য না হলেও অনেকের জন্য অবশ্যই। ১৫১ থেকে ২০০? রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর, সুস্থ-অসুস্থ সবাই ভুগবে। যারা স্বাস্থ্য দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হয়, যারা সেন্সিটিভ, তারা সিরিয়াস রোগে ভুগবে। লেভেল ২০১ থেকে ৩০০ হওয়া ভীষণই অস্বাস্থ্যকর, সবাই সিরিয়াস রোগে ভুগবে। এই লেভেল হলো ইমারজেন্সি ওয়ারনিং। আর ৩০০’র একটু বেশি হওয়া তো ভীষণই সিরিয়াস। বায়ু দূষণ-ই সবাইকে মরবে ।

বায়ু দূষণ যেসব জিনিস দ্বারা হয়, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পারটিকুলেট ম্যাটার। পারটিকুলেট ম্যাটার দু’ধরনের আছে, পিএম ২.৫ মাইক্রোমিটার, পিএম ১০ মাইক্রোমিটার। বাতাসে এই সূক্ষ্ম জিনিসগুলো জলীয়বাষ্পের সঙ্গে মিশে থাকে, এগুলো এত সূক্ষ্ম যে শ্বাস নিলে ফুসফুসে চলে যায়, ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সার করে। এত সূক্ষ্ম এগুলো যে রক্তেও চলে যায়। রক্তে গিয়ে ধমনীর দেয়ালগুলো এত পুরু করে দেয় যে রক্ত চলাচলের রাস্তা হয়ে যায় সরু, এর কারণে হয় হার্ট অ্যাটাক। তাছাড়াও এই পার্টিক্যালগুলো ডিএনএর মিউটিশন করে, জিনের চরিত্র পাল্টে দেয়। এর কারণে রক্তের ক্যান্সার, লিভারের ক্যান্সার— আরও নানা রকম ক্যান্সার হয় শরীরে। স্নায়ুর সমস্যাও করে।

দিল্লির বায়ু দূষণ মাত্রা ইদানীং ৯৯৯। সবাই মাস্ক পরছে। ঘরে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো ব্যবহার করে কি দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে? সোজা উত্তর, যাবে না। তবে মনের সান্ত্বনা পাওয়া যাবে। বাতাসে ভয়ঙ্কর পার্টিক্যাল। কোনো না কোনোভাবে সেগুলো যাচ্ছে শরীরে, বেইজিং এক সময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর। চীন শহরটাকে এখন বাসযোগ্য করে ফেলেছে। কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে শহরটি দূষিত, সেই দিল্লিকে দূষণ থেকে উদ্ধার করতে খুব বেশি পদক্ষেপ নিতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এখানেই বোধহয় ভারত এবং চীনের পার্থক্য। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এক সময় জোড়-বেজোড় সংখ্যার গাড়ি নিয়ে পড়েছিলেন, আজ জোড় চালাবে, কাল বেজোড় চালাবে। না, ওতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। কথা ছিল দশ বছরের পুরনো ডিজেল গাড়িগুলো নিষিদ্ধ করার। কিন্তু সেটি ঠিকঠাক করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ডিজেল গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ি দিল্লিতে চালাবে না, দুর্নীতি এখন উপমহাদেশের রাজনীতির অংশ। দুর্নীতি যতদিন আছে, ততদিন দূষণ আছে।

শুধু পার্টিক্যাল নয়, দূষিত পদার্থ আরও আছে। সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, লেড, মার্কারি, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এবং আরও অনেক। ভাবা যায়, কত বিষ আমরা শ্বাসের সঙ্গে শরীরে গ্রহণ করছি প্রতিদিন। প্রতিদিন কত ক্যান্সারের জীবাণু, বীজানু, পদার্থানু ঢোকাচ্ছি শরীরে। কিছু দূষণ আছে প্রাকৃতিক, যেমন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। এসব থামানো যায় না। গ্যাস বা কয়লা জ্বললে দূষণ হয়, গাড়ি চললে দূষণ হয়, অনেক দূষণই হয় মানুষের দোষে। এসব বন্ধ করা কঠিন নয়। বন্ধ করার নিয়মটা হওয়া চাই। দিল্লিতে গাড়ি গিজগিজ করছে, রাস্তায় সাইকেল চালানোর পথ নেই। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত লোকেরা ধরেই নিয়েছে যে পাবলিক বাসে বা মেট্রোয় চড়লে তাদের মানসম্মান যাবে। সম্ভবত তাদের কাছে জীবনের চেয়ে ওই মানসম্মান-ই বড়। অনেকের একাধিক গাড়ি। দামি গাড়ি। মানসম্মান বাড়ানোর জন্য গাড়ি। যে সমাজে টাকার ঝনঝন শুনিয়ে মানসম্মান অর্জন করতে হয়, সে সমাজ থেকে দূষণ যাওয়া সহজ নয়।

মনে আছে একবার স্টকহোম শহরে আমি এক বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি, আমি পুলিশের বুলেটপ্রুফ গাড়ি চড়ে গিয়েছি, আমার সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি, দশ-বারো জন পুলিশ সঙ্গে। আর সুইডেনের আইনমন্ত্রী ওই বাড়িতেই নেমন্তন্ন খেতে গেছেন সাইকেল চালিয়ে। পরে পরিচয় হওয়ার পর আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি মন্ত্রী হয়ে সাইকেলে এলেন, আর আমি এলাম বুলেটপ্রুফ গাড়িতে! আইনমন্ত্রী আমার অবাক হওয়া দেখে অবাক হলেন, বললেন, আপনার জীবনে থ্রেট আছে, আমার নেই। সুতরাং পুলিশ আপনার দরকার, আমার নয়। আমি প্রশ্ন করলাম, তাহলে গাড়িতে না এসে সাইকেলে এলেন কেন? উনি বললেন, বায়ু দূষণ এড়াতে। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি বায়ু দূষণ কী মারাত্মক ব্যাপার। মানুষের এই সচেতনতার কারণে কলকারখানার দেশ হয়েও বায়ু দূষণ নেই সুইডেনে।

আমি এক সময় সিগারেট খেতাম। সিগারেট ছেড়েছি অকাল মৃত্যু চাই না বলে, ছেড়েছি দীর্ঘকাল বাঁচার জন্য। এখন মনে হচ্ছে এই দিল্লি শহরেই যদি থাকি, তবে সিগারেট ছেড়ে লাভ কী হলো! ওই পলুশান-ই তো খাচ্ছি। সিগারেট খেলে যত খেতাম পলুশান, তার চেয়ে বেশি খাচ্ছি এই দূষিত বাতাস থেকে।

বাঁচতে হলে দিল্লি ছাড়তে হবে। এই শহরে সুইডিশ আইন মন্ত্রীর মতো মানুষ একটিও নেই। এরা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে গর্ব করে, দেশপ্রেমিক বলে গর্ব করে, কিন্তু দেশকে দূষণমুক্ত করতে নিজেদের আরাম-আয়াশে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। আমি একা ছাড় দিয়ে এ শহরের বাতাসকে বিশুদ্ধ করতে পারব না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর, ২০১৬

লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?

 

‘লজ্জা’ বইটি লিখেছিলাম ২৩ বছর আগে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কবে থেকে অত্যাচার হচ্ছে, কী করে হচ্ছে, কেন হচ্ছে— লিখেছিলাম। বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছিল, বলেছিল হিন্দুদের ওপর কোনো অত্যাচার হয় না, কিন্তু অত্যাচার হয় দাবি করে যা লিখেছি, তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। খালেদা জিয়ার সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করেছিল, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সাধারণত খালেদা যা করেন, তার উল্টোটা করেন, কিন্তু লজ্জা থেকে নিষেধাজ্ঞা তিনি তোলেননি। লজ্জায় কি আমি ভুল কোনো তথ্য দিয়েছি? লজ্জা তথ্যভিত্তিক উপন্যাস। বইটির কোনো একটি তথ্য ভুল, তা আমার কোনো ঘোর শত্রুও কোনোদিন বলেনি।

লজ্জা আজো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো মানবাধিকার সংগঠন, কোনো লেখক সংস্থা, কোনো ব্যক্তি—কেউই এই বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য আদালতে যায়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে লেখা এই বইটি কেন একটি ‘নিষিদ্ধ বই’ হিসেবে চিহ্নিত হবে? যারা বইটি নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৯৩ সালে, তারা এই সত্যটির সামনে দাঁড়াতে চায়নি যে তারা দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা এই সত্যটি শুনতে চায়নি যে তাদের পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল যখন সন্ত্রাসীরা হামলা করেছিল নিরীহ মানুষের ওপর।

‘লজ্জা’য় যেসব লজ্জাজনক ঘটনার কথা লিখেছি, সেসব আজো ঘটছে। আজো হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, মন্দির ভাঙা হয়, আজো হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে থাকে নিজ-দেশে, আজো তারা দেশ ত্যাগ করে ভয়ে।

দু’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় তিনশ’ হিন্দু-বাড়িতে হামলা চালিয়েছে মুসলিম মৌলবাদীরা, শতাধিক হিন্দুকে আহত করেছে। নিরীহ অনেকের যা কিছু সম্বল ছিল নিয়ে গেছে। যে হিন্দুরা মার খেলো, আহত হলো, কী অপরাধ তারা করেছিল? শতাধিক হামলাকারী যখন হিন্দুদের বাড়িঘরের দিকে এগোচ্ছিল, হিন্দুরা আশঙ্কায় কুঁকড়ে ছিল। তারা কী অপরাধ করেছিল? কেন এদেশের মানুষকে তটস্থ থাকতে হবে এদেশেরই মানুষের ভয়ে? শুধু ধর্ম-বিশ্বাসটা ভিন্ন বলে কেন বছরের পর বছর তারা নির্যাতিত হবে? ভিন্ন তো মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাসও, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শৈল্পিক বিশ্বাসও। এই ভিন্নতার কারণে কাউকে তো এত ভুগতে হয় না যত ভুগতে হয় ধর্মের ভিন্নতার কারণে। ধর্ম মানুষকে ভালবাসা না শিখিয়ে তবে কি ঘৃণা শেখায়? এরকম কি কোনো ব্যবস্থা আছে যে ধর্ম যা কিছুই শেখাক, আমরা মানুষকে ভালবাসতে শেখাবো! জগতের সব মানুষের আদর্শ, আকাঙ্ক্ষা, রুচি, স্বপ্ন এক নয়। সমাজের বিভিন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন বিশ্বাস। কিন্তু বছর যায়, যুগ যায়, শতাব্দী যায়— তারপরও কেন ধর্ম-বিশ্বাস ভিন্ন হলে মানুষ ঘৃণা করে, ক্ষতি করে, হত্যা করতেও দ্বিধা করে না? মানুষ কি চিরকালই এমন বর্বর? বর্বর হলেও বর্বরতার তো শেষ হয় একদিন। একদিন তো মানুষ সভ্য হয়। কেন সভ্য, শিক্ষিত, সচেতন হতে বাংলাদেশের মানুষের এত দীর্ঘ সময় লাগে!

শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছি যে কিছু হামলাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরকম আশা করতে ভালো লাগে যে তারা বিনা বিচারে ছাড়া পাবে না।

‘লজ্জা’ বইটি যদি নিষিদ্ধ না হতো, এটি পড়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষই গত তেইশ বছরে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। বইটি নিষিদ্ধ থাকায় সেই সম্ভাবনাটা নষ্ট হয়েছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু মৌলবাদীরা ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর মুসলিম মৌলবাদীরা যে অত্যাচার চালিয়েছিল বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের ওপর, হিন্দুদের বাড়িঘরের ওপর, দোকানপাটের ওপর, সে চোখে-দেখা দৃশ্যই বর্ণনা করেছি ‘লজ্জা’য়। কত নিরপরাধ দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কত সহস্র মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে- তাদের একটিই অপরাধ, তারা মুসলমান নয়। মানবতার মুখ থুবড়ে এমন পড়ে থাকা দেখে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বর্বর হওয়ার বদলে উদার হতে পারতো, হিন্দুদের শত্রু ভাবার বদলে বন্ধু ভাবতে পারতো, করতে পারতো ঘৃণার বদলে শ্রদ্ধা— যে শ্রদ্ধাটি মানুষের প্রতি মানুষের থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক হওয়া খুব সহজ নয়। বাংলা ওয়াজগুলোয় মোল্লা-মৌলানারা সারাদিন মুসলমানদের উপদেশ দেয় হিন্দুদের ঘৃণা করতে, তাদের মন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলতে। উপদেশ শুনতে শুনতে খুব অজান্তেই মগজ ধোলাই হয়ে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী ঘটেছিল যে মানুষকে হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করতে হয়েছে, মন্দির ভাঙতে হয়েছে? ঘটনাটি হলো, রসরাজ দাস নামে এক ছেলে তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে একটা ফটো শেয়ার করেছে, যে ফটো দেখে মুসলমানের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। আসলে ওই ফটো নেহাতই ফটোশপ করা ফটো। ফটোশপ করে কাবা শরীফের ছাদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শিবের ছবি। রসরাজের দাবি, ফটোটি সে নিজে পোস্ট করেনি। তার অজান্তে কে বা কারা তার একাউন্ট থেকে পোস্ট করেছে সে জানে না। এজন্য সে সবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। রসরাজকে কেউ ক্ষমা করেনি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। রসরাজের ফেসবুক ভরে গেছে খুনের হুমকিতে।

কে রসরাজের আইডি হ্যাক করে ওই ছবি পোস্ট করেছিল তা সরকার চাইলে বের করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার চাইবে কি? রসরাজই বা কবে জেল থেকে মুক্তি পাবে? রসরাজের নিরাপত্তাই বা কে নিশ্চিত করবে? বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা। সেই মসজিদ ভাঙার দায়ে বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের অপরাধী বানানো হয়েছিল। রসরাজের একাউন্ট থেকে কোনও এক হ্যাকার একটি ফটোশপ করা ছবি পোস্ট করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের সব হিন্দুকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হলো। মৌলবাদীরা এখন যে কোনও হিন্দুর ঘর ভেঙে দিতে পারে, যে কোনও মন্দির গুঁড়ো করে দিতে পারে, যে কোনও হিন্দুকে নির্যাতন করতে পারে। যে বা যারা অপরাধ করে, তারা শুধু নয়, তাদের ধর্মীয় গোষ্ঠীর সবাইকে শাস্তি পেতে হবে, এমনই যেন নিয়ম।

কয়েকজন মুসলমান সন্ত্রাসী সন্ত্রাস করলে সকল মুসলমানকে দোষ দেওয়া উচিত নয়— এ কথা বিশ্বের প্রায় সবাই বলে, এ কথা তারাও বলে যারা বলে একজন বা কয়েকজন হিন্দু দোষ করলে তার দায় সব হিন্দুকেই নিতে হবে।

ছাতকে, হবিগঞ্জে, গোপালগঞ্জের মন্দিরেও আক্রমণ হয়েছে। এই বৈষম্য দেখেই আমরা বড় হয়েছি, আমাদের নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুর সংখ্যা দ্রুত কমছে। কট্টরপন্থিরা এ সংখ্যাটি সম্ভবত শূন্য না বানিয়ে ছাড়বে না। দেশে হিন্দু থাকবে না, শিয়া থাকবে না, আহমদীয়া থাকবে না, বৌদ্ধ থাকবে না, খ্রিস্টান থাকবে না, শুধু সুন্নি মুসলমান থাকবে। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও বাছাই করা হয়। যারা ধর্মান্ধ নয়, তারা থাকবে না। যারা কোনও প্রশ্ন করবে তাদের জেলে ভরা হবে, মেরে ফেলা হবে অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না, নারীর অধিকার থাকবে না, মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না। আমরা নিশ্চিতই এমন একটি ঘোর অন্ধকার সময়ের দিকে যাচ্ছি।

যেদেশে মুক্তচিন্তকের, যুক্তিবাদীদের স্থান নেই, যেদেশে নারীবাদীদের লাঞ্ছিত হতে হয়, যে দেশ নারী-বিদ্বেষী অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকদের দখলে চলে গেছে, সেদেশে রসরাজ দাস ফটোশপের ছবি পোস্ট করলেও মার খাবে, না করলেও মার খাবে। কারণ সে রসরাজ দাস। রসরাজ দাসকে যদি মুক্তি না দেওয়া হয়, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা হয়, যদি হামলাকারীদের সবাইকে শাস্তি না দেয়া হয়, তবে আরও মানুষকে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে এভাবে নির্যাতিত হতে হবে। হামলাকারীরা উৎসাহ পেতে থাকবে, তাদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে।

মানুষ মানুষকে মারছে। এসব দেখে এখন আর দুঃখ কষ্ট হয় না, এখন আর রাগও হয় না, এখন আশঙ্কা হয় এই বর্বর মানুষজাতিকে বোধ হয় একদিন বিলুপ্ত করবে ধর্মান্ধতা।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৩ নভেম্বর, ২০১৬

এরা কি মানুষ!

১. বাংলাদেশে পূজা নামের এক মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। পূজার বয়স পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণ করেছে সাইফুল ইসলাম নামের বিয়াল্লিশ বছর বয়সী এক চার বাচ্চার বাবা। এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। লোকটিকে শিশুটি ‘বড় বাবা’ বলে ডাকতো। প্রতিবেশী ছিল লোকটি। হয়তো শিশুটি সাইফুল ইসলামের কন্যাদের খেলার সাথী ছিল। যতদূর জানি শিশু-ধর্ষণের সত্তরভাগই ঘটায় পরিবারের পুরুষ, নিকটাত্মীয়, অথবা পাড়াতুতো কাকা-জ্যাঠা-ঠাকুরদা, অথবা চেনা কোনো লোক। সাইফুল ইসলাম পাড়াতুতো জ্যাঠা ছিল পূজার। এই লোকটি, আমার আশঙ্কা, তার কন্যাদেরও ধর্ষণ করেছে, ধর্ষণ করার সুযোগ যদি না পেয়েও থাকে, তাহলে ধর্ষণ করার সুযোগ খুঁজেছে, সুযোগ না পেয়ে মনে মনে প্রতিদিনই ধর্ষণ করেছে। মেয়েদের ‘নিরাপত্তা’ বলতে কিছু আর নেই পৃথিবীতে।

বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়নি এমন শিশুদের প্রতি যদি কারো যৌন আকর্ষণ থাকে, তাহলে তাকে ইংরেজিতে ‘পিডোফাইল’ বলা হয়। পিডোফাইলের কোনো বাংলা আছে কিনা জানি না, আমিই বাংলাটা আপাতত করে নিচ্ছি— শিশুধর্ষণেচ্ছুক। নারীর চেয়ে পুরুষেরাই বেশি শিশুধর্ষণেচ্ছুক।

শুধু পিডোফাইল-ই নয়, সমাজে হেবেফাইল, এফেবোফাইল-ও আছে। হেবেফিলিয়া মানে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ। এফেবোফিলিয়া মানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ। হেবেফিলিয়াকে না হয় বাংলায় ছোট কিশোরী ধর্ষণেচ্ছা, আর এফেবোফিলিয়াকে বড় কিশোরী ধর্ষণেচ্ছা বলছি। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে পুরুষেরা শিশু কিশোরীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, কেন করে, এবং এরা কারা?

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এরা আমাদের আশেপাশেই, আমাদের সঙ্গেই বাস করে। এরা যে কোনো সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখতে। আমাদেরই বাবা, ভাই, আমাদেরই মামা, কাকা, আমাদেরই বন্ধু, প্রতিবেশী। শিশু কিশোরীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে অনেক, তবে সবাই যে উদ্যোগ নেয় যৌন ক্রিয়া বা ধর্ষণ করতে তা নয়। অধিকাংশ পুরুষই চেষ্টা করে সমাজের কথা ভেবে নিজেদের সংযত করতে। তারা জানে তাদের কামনা বাসনা মানবতাবিরোধী। কিছু পুরুষ তো রীতিমত ডাক্তারের পরামর্শে নিজেদের অতিরিক্ত বা অবাধ যৌন-ইচ্ছে কমাতে ওষুধ সেবন করে। তারা টেস্টস্টেরন হরমোন শরীর থেকে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। যারা নিজেদের সংযত না করে, তারা সুযোগ পেলে শিশু কিশোরীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু লোক আছে শিশুদের ধর্ষণ করে, শিশু ছাড়া তারা আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না। আবার আরেক দল শিশু ধর্ষণ করে, কারণ শিশু ধর্ষণের সুযোগ পেয়ে যায় বলে, শুধু শিশু নয়, প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিও তাদের সমান যৌন আকর্ষণ। যারা শিশু ছাড়া আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না, তারা, কিছু মনোবিজ্ঞানী বলেন, মানসিক রোগী। তাদের মস্তিষ্ক অন্যান্য মানুষের মস্তিষ্কের মতো নয়। আবার অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, শিশু ছাড়া আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ না থাকা কোনো মানসিক সমস্যা নয়, এ নিতান্তই রুচির তফাত। এদের মধ্যে যারা সৎ, দায়িত্ববান, তারা নিজেদের যৌনাকাঙ্ক্ষা সংযত করে, আর যারা তা নয় তারা চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করে, অন্যায় করে, তারা ধর্ষণ করে।

এখন যেহেতু মস্তিষ্কের ওপর কারো হাত নেই, যেহেতু তারা জন্মই নেয় শিশুকামী হয়ে, অথবা যে কোনো কারণেই হোক তারা শিশুকামী, আমরা তাদের উপদেশ দেব, শিশু ধর্ষণ বন্ধ করার সব রকম উদ্যোগ নিতে। শিশুদের আঘাত করার, নির্যাতন করার কোনো অধিকার তাদের নেই, শিশুদের ধর্ষণ করার কাজ যেন তারা কখনও না করে। তারা যদি একা সামলাতে না পারে তাদের সমস্যা, যেন শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানিয়ে দেয় যে তারা শিশুকামী, এই কাম দূর করার জন্য সবার সহযোগিতা চায়।

অনেকের ইচ্ছে করে কিছু লোককে খুন করার। কিন্তু তারা খুন করে না। খুন করা ভাল নয় বলে করে না। তেমনি যাদের ইচ্ছে করে ধর্ষণ করতে, তারাও যদি ভেবে নিতো, ধর্ষণ করার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু করব না, কারণ ধর্ষণ করা ভাল নয়।

আমরা তাদের দোষ দিতে পারি না, কেন তাদের ধর্ষণ করার ইচ্ছে হয়? মস্তিষ্ক বড় জটিল, সমাজের ভাল মন্দ বুঝে এ গড়ে ওঠে না, আমরা একে ভাল মন্দের শিক্ষা দিয়ে বড় করি।

২. যে সব দেশে ধর্ষণ সবচেয়ে কম, সেসব দেশে পুরুষাঙ্গ কর্তন বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নেই। তবে সেসব দেশে মেয়েদের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকার সেসব দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, সেসব দেশে মেয়েরা শিক্ষিত, মেয়েরা স্বনির্ভর, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ ছাড়াই সংসদ সদস্যের পঞ্চাশ ভাগই মেয়ে।

নাবালিকা-সাবালিকা সব ধর্ষণই বহাল তবিয়তে চলে সেসব দেশে, যেসব দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের ভোগের বস্তু, দাসী-বাঁদি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন প্রাণী, নিচুজাতের জীব ইত্যাদি হিসেবে বিচার করে; যেসব দেশে পতিতালয় গিজগিজ করছে, শত শত বাচ্চা-মেয়েকে যৌনপাচারের শিকার করা হচ্ছে; যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, স্বামীর অত্যাচার, পণের অত্যাচার, পণ অনাদায়ে খুন— এই দুর্ঘটনাগুলো প্রতিদিন ঘটছে, ঘটেই চলছে।

ধর্ষণের সঙ্গে যৌন সঙ্গমের সম্পর্ক আছে। কিন্তু ধর্ষণ মানেই যৌন সঙ্গম নয়। অধিকাংশ ধর্ষক যৌন-ক্ষুধা মেটানোর জন্য ধর্ষণ করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আরেক নাম ধর্ষণ।

ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে অথবা কী করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নটির সবচেয়ে ভালো উত্তর, ‘যেদিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সেদিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ’। কবে কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। সম্মিলতভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এইসব নির্যাতন তারা আর করবে না।

৩. পূজা হিন্দু পরিবারের মেয়ে। পূজার জীবনে যা ঘটলো, তা দেখে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অনেক হিন্দু পরিবার তাদের কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

» আমরা আর তারা

আমরা সবাই দেখেছি বদরুল কী করে কুপিয়েছে খাদিজাকে। যখন কোপাচ্ছিল, বদরুলের মনে হয়নি সে কোনো অন্যায় করছে। বদরুল কি মানসিক রোগী? না, বদরুল কোনো মানসিক রোগী নয়। বদরুল সুস্থ মস্তিষ্কেই কোপানোর কাজটি করেছে। সুস্থ মস্তিষ্কে সে চাপাতি কিনেছে, সুস্থ মস্তিষ্কে সে ভেবেছে ওই চাপাতি দিয়ে সে কুপিয়ে মারবে খাদিজাকে, কারণ খাদিজা তার আদেশ এবং উপদেশ কোনোটিই মেনে নিচ্ছে না। কোপানোর দৃশ্যটি দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও ওটিই সমাজের চিত্র। সমাজের সত্যিকার চিত্রটি ভয়ঙ্কর। এভাবেই পুরুষ নারীকে কোপায়, পেটায়, লাথি মারে, চাবুক মারে, জুতো মারে, প্যান্টের বেল্ট খুলে মারে,  উঠোনে ফেলে হাতের কাছে বাঁশ ডাল লোহা লাকড়ি যা পায় তা দিয়েই মারে, পাথর ছুড়ে মারে, অ্যাসিড ছুড়ে মারে। এভাবেই পুরুষ নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারে, কড়িকাঠে ঝুলিয়ে মারে, জলে ফেলে দিয়ে মারে, সাততলা থেকে ধাক্কা দিয়ে মারে। খাদিজা ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছে, আমরা নারীরাও পুরুষের এই সমাজে ‘লাইফ সাপোর্টে’ আছি। আমরা মৃত। কারণ পুরুষেরা আমাদের মৃত দেখতে ভালোবাসে। আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো নড়লে চড়লে, আমাদের খুশিমতো বাঁচলে পুরুষেরা আমাদের হত্যা করে, তাই আমাদের ইচ্ছেগুলোর ডানা কেটে দিয়ে আমরা মৃত হয়ে থাকি, পুরুষেরা আমাদের ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়ে রাখে, ‘লাইফ সাপোর্ট’, তারাও জানে এবং আমরাও জানি, যে কোনো সময় বন্ধ করে দিতে পারে তারা। পুরুষেরা যদি আমাদের মেরে ফেলতে চায়, মেরে ফেলতে পারে। তারা যদি আমাদের হেনস্থা করতে চায়, অপদস্থ করতে চায়, করতে পারে। তারা চাইছে বলেই করছে। আজো তারা প্রতিদিন আমাদের হত্যা করছে, হেনস্থা করছে, অপদস্থ করছে। পুরুষেরা তাদের প্রয়োজনে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমরা আমাদের প্রয়োজনে বেঁচে থাকতে পারি না। পুরুষের এই  পৃথিবীতে সে অধিকার আমাদের নেই।

আমি জানি পুরুষেরা বলবে, ‘সব পুরুষ এক নয়’। আমি নিশ্চিত বদরুলও বলেছে এমন কথা। বলেছে সব পুরুষ এক নয়। তা ঠিক সব পুরুষ এক নয়, সব পুরুষ রাস্তাঘাটে ধর্ষণ করছে না বা খুন করছে না। অনেকে যে ইচ্ছে করেই করছে না তা নয়। অনেক পুরুষই ধর্ষণ করার বা খুন করার সুযোগ পাচ্ছে না বলেই করছে না। কিন্তু যদি রাগ ওঠে, বদরুলের মতো হঠাৎ রাগ, তাহলে কিন্তু অনেকেই করে ফেলতে পারে। কে ফেলবে, কে ফেলবে না কেউ বলতে পারে না। আমরা পারি না। আমরা পারি না বলে আমরা চাই না আমাদের ওপর কোনো পুরুষ রাগ করুক। সব পুরুষকেই খুশি রাখতে চাই আমরা। ঘরের পুরুষকে তো বটেই, বাইরের পুরুষকেও। পুরুষদের খুশি না রাখলে আমাদের লাইফ সাপোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা তাই নারীর ওপর বিভিন্ন কারণে অখুশি হলেও পুরুষদের ওপর কোনো কারণেই অখুশি হই না। আমরা নারীকে গালি দিলেও পুরুষকে গালি দিতে ভয় পাই। গালি দিলে পুরুষেরা আমাদের জীবন পুরো নরক করে দেবে। নারীদের নরক করার শক্তি অতটা নেই বলে নারীর বিরুদ্ধে প্রায়ই খড়গহস্ত হই।

পুরুষেরা যা চায়, আমরা তাই করি। তারা যখন চায় না আমরা লেখাপড়া শিখি, আমরা লেখাপড়া শিখি না, তারা যখন চায় আমরা ইস্কুলে যাই, আমরা ইস্কুলে যাই, তারা যখন চায় না আমরা চাকরি-বাকরি করি, আমরা চাকরি-বাকরি করি না, তারা যখন চায় করি, আমরা করি। যা কিছুই আমরা করি, পুরুষেরা রাজি বলেই করি। যা কিছুই করা থেকে আমরা নিজেদের বিরত রাখি, পুরুষেরা চায় না বলেই রাখি। আমরা তাদের ক্রীতদাসী। ক্রীতদাসী শব্দটা শুনতে খারাপ শোনায় বলে আমরা বিভিন্ন নামে নিজেদের ডাকি, নিজেদের আমরা পুরুষের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, বান্ধবী, প্রতিবেশী,পরিচিতা ইত্যাদি বলে ডাকি।

পুরুষেরা আমাদের কাছে যা চায়, তা যদি আমরা না করি, তাহলে আমাদের কী হাল হয়, তা নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি। আমরা নির্যাতিত হবো, আমরা নির্বাসিত হবো। আমরা ধর্ষিতা হবো, খুন হবো। অথবা আমাদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হবে। আমি আজ নির্বাসিত, কারণ পুরুষের এঁকে দেওয়া সীমা আমি লঙ্ঘন করেছি। আমি সেসব কথা বলেছি, যেসব আমার বলার কথা নয়। আমি নারীর অধিকারের দাবি করেছি, পুরুষের তৈরি ধর্মগুলো মানবো না বলে ঘোষণা দিয়েছি। আমি আজ নির্বাসিত, কারণ আমি পুরুষের অবাধ্য হয়েছি।

আমি জানি অনেকে বলবে, কই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো নারী, বিরোধী দলের প্রধানও নারী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও নারী।   কে বলেছে নারীর সুযোগ-সুবিধে নেই? আমি কিন্তু বলি, ওঁরা নারী নন। যে যাই বলুক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম আসলে শেখ মুজিবুর রহমান, বিরোধী দলের প্রধানের নাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাম জিয়াউর রহমান।

আমি যখন খাদিজাকে কোপানোর ভিডিওটা দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল খাদিজাকে নয়, আমাকে কোপানো হচ্ছে।   বদরুল নামের ছেলেটির প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হইনি বলে আমাকে কুপিয়ে মেরে ফেলছে বদরুল। যদি রাজি হতামও, যদি বদরুলের সঙ্গে প্রেম করতাম অথবা তাকে বিয়ে করতাম, তাহলেও কোপাতো। আমাকে সংসারের খাঁচায় বন্দী করতো। প্রতিদিন আমার ইচ্ছেগুলোর ওপর কোপ পড়ত।

বদরুল জানে মেয়েদের মারলে শাস্তি পেতে হয় না, তাই মেরেছে। প্রতিদিন মেয়েরা মার খাচ্ছে পুরুষের হাতে, কোনও পুরুষই শাস্তি পাচ্ছে না। স্বয়ং ঈশ্বরই বলে দিয়েছেন মেয়েদের ঘাড়ের রগ একটু ত্যাড়া, ওদের শাসন করতে হয়, কথা না শুনলে মারতে হয়। মেয়েরা ঘরে বাইরে প্রতিদিনই মার খাচ্ছে। মার খাওয়াটা তাদের অনেক আগেই গা সওয়া হয়ে গেছে। বদরুল ঈশ্বরের উপদেশ মেনেই মেরেছে। অথবা সমাজের প্রথা মতোই মেরেছে। কিন্তু মারটা নিয়ে মিডিয়া চিৎকার করেছে বলেই মারের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। এটা নিয়ে মিডিয়া চুপ হয়ে গেলে মানুষ ভুলে যাবে খাদিজাকে, বদরুল মুক্তি পেয়ে আরও মেয়েদের কোপাতে থাকবে, শারীরিক না হলেও মানসিক। কত শত মেয়েকে কত শত পুরুষেরা নির্যাতন করেছে, এখনো করছে। পৃথিবীর কত কিছু ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে, শুধু মেয়েদের ওপর পুরুষের আধিপত্যেরই কোনো হেরফের হয়নি। সম্ভবত এটি থেকেই যাবে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত। অথবা একটা সময় আসবে, যখন মেয়ে বলে কিছু আর থাকবে না। পৃথিবীজুড়ে শুধু থাকবে পুরুষ, পুরুষ আর পুরুষ।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ অক্টোবর, ২০১৬

সত্য বললে বিপদ

সৈয়দ শামসুল হক মারা যাওয়ার পর আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম,— “সৈয়দ শামসুল হক মারা গেছেন ৮১ বছর বয়সে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মান, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রচার, জনপ্রিয়তা, সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার— সবই পেয়েছেন তিনি। একজন লেখকের যা যা কাঙ্ক্ষিত থাকতে পারে, তা পাওয়া হয়ে গেলে তাঁকে সফল বা সার্থক লেখকই বলা যায়। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আটের দশকের শেষদিকে ভালো যোগাযোগ ছিল আমার। মাঝে মধ্যে ময়মনসিংহে গেলে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। একবার আমার সাহিত্য সংগঠন ‘সকাল কবিতা পরিষদ’-এর অনুষ্ঠানে তাঁকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি গিয়েছিলেন। ভালো বক্তৃতা করেছিলেন। সেসময় আমার সাহিত্যচর্চার বেশ খবর নিতেন তিনি। আমার লেখা কবিতাগুলো মন দিয়ে পড়তেন, মন্তব্য করতেন। তিরিশ বছরের বড় ছিলেন, আমাকে কন্যার মতো স্নেহ করেন বলতেন।

‘খেলারাম খেলে যা’র বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে একসময় যোগাযোগ সম্পূর্ণই বন্ধ করে দিই। সে অনেক গল্প। ‘ক’ বইটিতে সেইসব ভালো-মন্দের স্মৃতি অনেকটাই আছে।

আজ তিনি চলে গেলেন, কাল আমরা যাবো। জীবনের এই তো নিয়ম। এক এক করে আমাদের সবাইকে যেতে হবে। আমাদের মধ্যে ক’জন আশি পার করে যেতে পারবো সেটাই প্রশ্ন। এখন যে জরুরি বিষয়টি আমি জানতে ইচ্ছুক সেটি হলো, তিনি যে ঢাকা হাইকোর্টকে দিয়ে ‘ক’ বইটিকে নিষিদ্ধ করিয়েছিলেন, সেটির কী হবে? বারো বছর পার হয়ে গেছে, এখনও কি বইটি নিষিদ্ধ রয়ে যাবে? নাকি বাদীর অনুপস্থিতিতে বইটি এখন মুক্তির স্বাদ পেতে পারে! ‘ক’ বইটি লিখেছি বলে সৈয়দ হক ১০০ কোটি টাকার মামলা করেছিলেন আমার বিরুদ্ধে। এই মামলাই বা কী অবস্থায় আছে কে জানে । এটির কোনও শুনানি হয়েছে বলে শুনিনি। তিনি কি পাওয়ার অব এটর্নি দিয়ে গেছেন কাউকে? যদি দিয়ে থাকেন, তাহলে পাওয়ার অব এটর্নি কি মামলা চালিয়ে যাবেন, এবং বইটি নিষিদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করবেন?

মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে গত তিন দশক লড়ছি। মনে হচ্ছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়তে হবে। ”

আমার ওই লেখাটি পড়ে অনেকে বেশ রুষ্ট হয়েছে। তারা মনে করছে সৈয়দ হকের আত্মার শান্তি আমি ঘটতে দিচ্ছি না। বলেছে, ‘এখনই কি এসব বলার খুব দরকার ছিল? আর সময় পেলে না?’ আসলে আমি ঠিক বুঝি না কোন সময়টাকে সত্য বলার জন্য উপযুক্ত সময় বলে ধরা হয়। আমি মনে করি না, অপ্রিয় সত্য বলার জন্য কোনও সময়কে কেউ উপযুক্ত সময় বলে মনে করে। যারা অপ্রিয় সত্য কথা শুনতে পছন্দ করে না, তাদের কাছে কোনও সময়ই উপযুক্ত নয়, এবং অধিকাংশ মানুষই অপ্রিয় সত্য কথা শুনতে পছন্দ করে না। শুধু মৃত্যুর পরই কেন, জীবিত থাকাকালীন বললেও সকলে রুষ্ট হয়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেলাতেও লক্ষ করেছি একই ঘটনা। তিনি অনেক ভালো কবি, ভালো লেখক, ভালো মানুষ— এটুকু বললে ঠিক আছে। কিন্তু যেই না বলেছি উনি অনেক মেয়েকে এক্সপ্লয়েট করেছেন। অমনি সকলে রুষ্ট হলো। কেন, এই কথা এখন কেন? যেন এ কথা বলার জন্যে এ সঠিক সময় নয়। আমি মনে করি যে কোনও সময়ই, সত্য কথা সে প্রিয় হোক অপ্রিয় হোক, বলার জন্য উপযুক্ত এবং সঠিক সময়। কিন্তু আমি মনে করলে কী লাভ। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই তা মনে করে না।

সত্য কথা বললে যে বিপদ বাঁধে, তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না হয়তো। যাদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তারা বিপদ ভালো করে বোঝার আগেই মরে গেছে। আর যাদের ঘাড়ে এখনও কোপ পড়েনি, তারা বছরের পর বছর প্রতিদিনই অদৃশ্য কোপ খাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে। যেমন আমি। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে আমার আশেপাশের মানুষের কথা বলেছি, কিছু বিখ্যাত মানুষও ছিল পথচলায়। অখ্যাত মানুষের ভালো মন্দ নিয়ে লিখেছি, ওতে অসুবিধে নেই কারওর। যেই না বিখ্যাত মানুষের ভালো মন্দ নিয়ে লিখেছি, অমনি গোল বাঁধলো। বিখ্যাত মানুষের শুধু ভালোটাই বলা যাবে, মন্দটা নয়, মন্দটা গোপন করে যেতে হবে।

বিখ্যাত মানুষ সম্পর্কে তাঁদের জীবিত থাকাকালীনও বললে দোষ, মরলেও বলা দোষ। আমি কিন্তু এককালে বিখ্যাত ছিলাম, এখনও সামান্য আছি। আমার সম্পর্কে সেই কতকাল যাবৎ যে নোংরা আর মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে লেখা হচ্ছে, কতকাল যাবৎ করা হচ্ছে অবিরাম নিন্দে— তা নিয়ে অবশ্য কারওর আপত্তি কখনও ছিল না, এখনও নেই। বিখ্যাত মানুষগুলো পুরুষ বলেই আপত্তি।

বিখ্যাত পুরুষদের এই সুবিধে, তাঁদের সাত খুন মাফ। কেন আমাদের সমাজে বিখ্যাত পুরুষের মুখোশ খোলার রেওয়াজ নেই? এরা যাকে একবার বড় মানে, তাকে বড়ই মানে। ঈশ্বর ভক্তি বেশি যে সমাজে, সেখানেই ভক্তি চর্চার প্রকোপ, মানুষকেও অবচেতনে ঈশ্বর বানিয়ে ফেলে।

সত্য কথা বললে নিন্দে শুনতে হয়, একঘরে হতে হয়, দুর্নাম রটে, জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়, বই বিক্রি কমে যায়— এসব জেনেও সত্য বলি। যতদিন বেঁচে আছি বলবো।

অধিকাংশ পুরুষেরা পলিটিশিয়ান হলে যা করে, গায়ক নায়ক লেখক শিল্পী হলেও অনেকটা তাই করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে। কিন্তু এসব নিয়ে মুখ খুলতে সকলেই নারাজ। পুরুষের যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার আছে, কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার অধিকার কোনও মেয়ে মানুষের নেই।

নারী পুরুষ উভয়ে জোর গলায় বলে আমরা সুনীল ভক্ত, আমরা আজাদ ভক্ত, আমরা ছফা ভক্ত, আমরা হক ভক্ত। এতে ভক্তদের কোনও দুর্নাম হয় না। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, আমার ওপর অন্যায় আচরণ করা হলে কেউ যদি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, কেউ যদি ডিফেন্ড করে আমাকে, তাহলে তাকে গালাগালি করা হয়, বলা হয় সে আমার ‘অন্ধ ভক্ত’। ভক্ত হওয়া বা অন্ধ ভক্ত হওয়া যে মোটেও ভালো কাজ নয়, আমার দোষগুলো যে তুলে ধরা উচিত, তা বারবার করে বলে দেওয়া হয়। তারাই বলে যারা কোনও পুরুষ-লেখকের অন্ধ ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিতে কোনও গ্লানি বোধ করে না, বরং ভালোবাসে। পুরুষ লেখকের ভক্ত হওয়া সম্মানের কাজ আর নারী লেখকের ভক্ত হওয়া অসম্মানের কাজ— এটাই মূল কথা। অনেক পাঠক পাঠিকা যারা আমার লেখা খুব পছন্দ করে, তারাও জনসমক্ষে বলতে সাহস পায় না তারা আমার লেখা পছন্দ করে। অপদস্থ হওয়ার ভয়ে চেপে যেতে হয় সত্যটা।

যে সমাজ সত্যকে আড়াল করে, সত্যকে সহ্য করে না, সে সমাজ মিথ্যের আবর্জনার ওপর খুব শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মিথ্যে থেকে তুলে এনে সুস্থ এবং মুক্ত পরিবেশে রাখা সহজ নয়। কিন্তু এটুকুই আশা, কঠিন কাজ তো সংখ্যায় অল্প হলেও কেউ কেউ করে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৬ অক্টোবর, ২০১৬

নির্বাসন

১. গোথেমবার্গে বইমেলা হচ্ছে। এর বিষয় ‘মত প্রকাশের অধিকার এবং নির্বাসন’। বিষয়টি আমার বিষয়। কিন্তু আমি আমন্ত্রিত নই মেলায়। ১৯৯৪ সালে গোথেমবার্গ বইমেলা উদ্বোধন করেছিলাম আমি। মনে আছে আমার জন্য কী বিশাল নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন। আগের দিন থেকেই নাকি মেলা ভরে গিয়েছিল কুকুরে। বোমডগগুলো শুঁকে শুঁকে যাচ্ছিল স্টল। কোথাও আবার কেউ বোমা রেখে গেল কি না। পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ঘটা করে নিরাপত্তার কাহিনী প্রচার হয়েছিল। এ বছর বইমেলায় গেলে সাধারণ দর্শকের মতো হেঁটে বেড়াবো। কেউ হয়তো চিনবেও না আমি কে। ২২ বছরে অনেক পাল্টে গেছে চারদিক। তখন আমি ছিলাম সবার চেনা নির্বাসিত লেখক। আজ আমি একা নির্বাসিত নই। অনেক লেখকই নানা দেশ থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন। শুধু আমার দেশে নয়, অন্য অনেক দেশেও লেখকের মত প্রকাশের অধিকার নেই। ধর্মান্ধদের মতের চেয়ে বা সরকারি মতের চেয়ে ভিন্ন কোনও মত প্রকাশ করলে তাদের জেলে ভরা হয়, অথবা চাবুক মারা হয়, অথবা কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়। যতদিন ধর্মান্ধতা, বর্বরতা রয়ে যাবে, ততদিন মুক্তচিন্তকদের নির্বাসন হতেই থাকবে। আজ আমি, কাল আরেকজন।

২. নির্বাসন শুধু লেখকদের ঘটছে না, সাধারণ মানুষও নির্বাসিত হচ্ছেন। সিরিয়া থেকে তুরস্ক এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকো ভাসিয়ে দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। নৌকোয় চড়ে যারা ইউরোপে ঢুকেছে, তাদের প্রায় সবাই এখন জার্মানি আর সুইডেনে। জার্মানিতে ষোলো লাখ। সুইডেনে এক লাখ। সুইডেনে প্রতি সপ্তাহে দশ হাজার শরণার্থী ঢুকছে। এদের জায়গা দেওয়ার জায়গা নেই। পুরোনো ইস্কুলঘর, পুরোনো স্টেশন, গির্জা সব ভর্তি হয়ে গেছে। তাঁবু ফেলেও কাজ হচ্ছে না। মানুষ বিরক্ত। ডানপন্থীরা তো বিরক্তই। পাশ্চাত্যের উদার বামপন্থীদের অনেকেই বিরক্ত। তারা জানে না এই শরণার্থীদের কী করে তারা দীর্ঘকাল খাওয়াবে পরাবে। জার্মানির কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে, যে বন্ধুরা সাধারণত শরণার্থীদের বিপদ-আপদে দাঁড়ান। তাঁরাও বলছেন, এত বেশি শরণার্থী নেওয়া জার্মানির উচিত হয়নি। সুইডেনে আমি এখনও কাউকে বলতে শুনিনি, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে অতি উত্তম কাজ করেছে সুইডিশ সরকার। এক বামপন্থী লেখক-বন্ধু দু’দিন আগেই আমাকে বললো, ‘আফগানিস্তান থেকেও অনেক শরণার্থী এসেছে। সিরিয়া থেকে তো বটেই। অনেক তরুণ শরণার্থীর সঙ্গে পরিবারের কেউ নেই। তারাই হয়তো সুইডিশ মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ‘সুইডিশ মেয়েরা ফ্রি সেক্সে বিশ্বাসী’। এরকম একটা অদ্ভুত যুক্তিহীন বোধহীন কথা তারা বিশ্বাস করে। সুইডেনে থাকে এমন এক বাঙালিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সিরিয়ান রিফিউজিদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি?’ বাঙালি বললো, ‘ওরা তো চুরি করে। ওদের কারণে সুইডিশরা অতিষ্ঠ’। শুধু সুইডিশ কেন, মনে হচ্ছে বাঙালিও অতিষ্ঠ। সবচেয়ে বেশি অতিষ্ঠ চরম ডানপন্থী দল। ইউরোপের দেশে দেশে তারা এখন অতি বীভৎস দৈত্যের মতো হাওমাওখাও বলে মাথা তুলছে। শরণার্থীরা এক দৈত্যের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক দৈত্যের কবলে পড়বে না তো!

৩. সুইডেনের শরণার্থীদের পঁচাত্তর ক্রোনোর করে প্রতিদিন দেওয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে তিন বেলা খাবার জোটানো সহজ নয়। কিন্তু এখনও ওদের কাজ করার কোনও অনুমতি নেই। সুইডেনের রাস্তায় আমি এখনও কোনও সিরিয়ার শরণার্থীকে ভিক্ষে করতে দেখিনি। ভিক্ষে করছে রুমানিয়া থেকে আসা জিপসিরা। জিপসিরাও নির্বাসিত। তাদের প্রায় সব দেশ থেকেই তাড়ানো হয়। কোনও এক কালে ভারতের রাজস্থান থেকে তারা চলে এসেছিল ইউরোপের দিকে। আজও তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশ করছে। কেউ কেউ বলে, জিপসিরা এক জায়গায় বাস করতে পারে না, থিতু হওয়া ওদের চরিত্রে নেই। জিপসিদের জিজ্ঞেস করলে বলে, আমরা থিতু হতে চাই, কিন্তু আমাদের থিতু হতে দেওয়া হয় না, যে দেশেই যাই সে দেশ থেকেই আমাদের তাড়ানো হয়।

৪. অক্টোবরে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া প্রকাশ করছে আমার বই ‘নির্বাসন’। নির্বাসন বইটি কলকাতা থেকে আমাকে কী করে প্রথমে দিল্লি তারপর ভারত থেকেই বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেটার বর্ণনা। জীবনে নির্বাসন আমার কতবার যে হলো। কত দেশ থেকে, রাজ্য থেকে, শহর থেকে আমাকে নির্বাসন দেওয়া হলো। কত প্রিয় প্রিয় অঞ্চল ছেড়ে আমি চলে যেতে বাধ্য হলাম। গত কয়েকদিন সুইডেনে এক বন্ধুর বাড়িতে বহু বছর যাবৎ পড়ে থাকা আমার বইপত্র ভারতে আমার অস্থায়ী ঠিকানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ব্যবস্থাটি করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ সুইডেনের বন্ধুটি তার বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু আমি ভারতে ছাড়া আর কোথায় নেবো আমার জিনিসপত্র? ভারতে আমার বসবাসের কোনও নিশ্চয়তা নেই, পায়ের তলায় সামান্য মাটি নেই। পৃথিবীর একটি দেশেই আমার একটি স্থায়ী ঠিকানা আছে। সেটি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আমাকে অন্যায়ভাবে ঢুকতে দেয় না সরকার, তাই আমার ঢোকা হয় না। ভারতে এই যে টন টন বই নেবো আমি, বইয়ের তাকে বইগুলো সাজিয়ে রাখবো, তারপর একদিন ভারত সরকার আর ভিসা দেবে না, তারপর একদিন ভারত সরকার মুখের ওপর বলে দেবে তোমাকে দেশ ছাড়তে হবে। তখন? তখন কোথায় যাবো না জেনেই আমাকে ভারত ত্যাগ করতে হবে। আমি যেখানেই কদিন বাস করি, সেখানেই আমার সংসার শেকড় ছড়াতে থাকে। শেকড় উপড়ে নিয়ে বার বার আমাকে দেশান্তরী হতে হয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন হবে। আমি নির্বাসন থেকে দূরে থাকতে চাইলেও নির্বাসন আমার থেকে মোটেও দূরে সরতে রাজি নয়। বয়স তো অনেক হলো। এই বয়স দেখে অনেক মানুষের মায়া হয়, কিন্তু সরকারের মায়া হয় না। সরকারদের হয়তো মায়া মমতা বলে কিছু থাকে না।

৫. বার্লিন লিটারেচার ফেস্টিভেলে আমন্ত্রিত হয়ে বার্লিন ঘুরে এলাম। আমার খুব দেখার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের ব্লগাররা যারা জার্মানিতে নির্বাসন জীবন কাটাচ্ছে, তারা আছে কেমন। সুইডেনেও বেশ ক’জন ব্লগার আশ্রয় নিয়েছে। দেশে বসে কেউ কেউ অপেক্ষা করছে আইকর্নের সাহায্য নিয়ে নরওয়ে চলে যাওয়ার জন্য। দেশে দেশে লেখক সাহিত্যিকদের সংস্থা ‘পেন’ অনেককে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে। ঝুঁকিহীন নির্বাসন জীবন সকলেই কাটাতে চাইছে। সবাই ভাষা শিখছে। সবারই ইচ্ছে বিদেশ বিভূঁইয়ে বাকি জীবন বাস করার। আমিই পারিনি। আমারই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন সয় না। যেখানে যে কেউ যে কোনও সময় আমাকে খুন করতে পারে, যেখানে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, যেখানে কথা বলার স্বাধীনতা নেই, যেখানে মত প্রকাশের কোনও অধিকার নেই, যেখানে অত্যাচার অনাচার অন্যায় নির্যাতন একটি দিনের জন্যও ছুটি নেয় না, যেখানে দারিদ্র্য, যেখানে অশিক্ষা— সেখানে আমি বাস করতে চাই, সেটিই আমার দেশ। সেটিই আমাকে প্রেরণা দেয় প্রতিবাদ করার। সেখানেই আমি সাম্যের জন্য, সমতার জন্য, সমানাধিকারের জন্য, সুশিক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে পারি। আমার সংগ্রাম রাস্তায় নেমে নয়। আমার সংগ্রাম লেখায়। জীবনে খুব বেশি আর সময় নেই। এভাবেই কেটে যাবে বাকিটা জীবন। প্রাচুর্য আর নিশ্চিন্তির লোভ ছিল না কখনও। এখনও নেই। আমার দীর্ঘ নির্বাসন জীবনে আমি সেই কাজটিই করতে চাই, যেটি আমি করছিলাম। জীবনকে যেভাবে অর্থপূর্ণ করছিলাম, সেভাবেই করতে চাই বিরুদ্ধ স্রোতে অনড় দাঁড়িয়ে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মেয়েদের কাপড় চোপড়

কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছে। বন্ধুটি উচ্চশিক্ষিত। বিহারের বেগুসরাইয়ে তার পৈতৃক বাড়ি। বাড়ির কাছে গঙ্গা, সেই গঙ্গার ধারে এক শ্মশান ঘাটে সে তার বাবার মুখাগ্নি করলো, বাবার ছাই ভাসালো গঙ্গা আর যমুনার মিলনস্থলে, ত্রিবেণী সঙ্গমে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন বন্ধুটি নানা রকম কুসংস্কার পালন করছে। সেলাই নেই এমন কাপড় গায়ে পরেছে।   এমনই নাকি পরতে হয়। ফল আর দই ছাড়া কিছুই খাচ্ছে না। কিছু দিন আগেই পুরো এক মাস মাছ মাংস খায়নি। শ্রাবণ মাসে নাকি মাছ মাংস খেতে হয় না। এছাড়া প্রতি সপ্তাহেই তিন দিন মাছ মাংস খায় না, শনিবার, মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার। বাবা মারা যাওয়ার পর শুধু খাওয়াই বন্ধ করেনি, বিছানাতেও শুচ্ছে না সে। ধাড়ির ওপর শুচ্ছে। মাথার চুলও বললো ফেলে দেবে।

আমার মনে আছে ছোটবেলায় দেখতাম পাশের বাড়ির হিন্দু ছেলেরা বাবা মারা যাওয়ার পর এক টুকরো সাদা কাপড় গায়ে পরতো আর হাতে একটা মলিন মাদুর নিয়ে হাঁটতো। যেখানেই বসতো, ওই মাদুরখানা পেতে বসতো। ওদের দেখে আমার খুব মায়া হতো। উঠোনে কাকের জন্য খাবার ছড়িয়ে কা কা কা কা বলে সারা দুপুর ডাকতো, কাক এসে খাবার খেয়ে গেলে তবেই নিজে খেতে পারতো। যেদিন কাক খেতো না, সেদিন ওরা নিজেরাও খেতো না। এই নিয়মগুলো আমার ভালো লাগতো না কখনও। শুনতাম ওরা বিশ্বাস করে, ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর কাক হয়ে গেছে, তাই নিজের খাওয়ার আগে বাবাকে খাওয়ায়। ছেলেগুলো কী করে বিশ্বাস করতো ওদের বাবারা এখন কাক হয়ে গেছে, আমি ঠিক বুঝে পেতাম না। শত সহস্র যুক্তিহীন সংস্কার চারদিকে, অধিকাংশরই ব্যাখ্যা আমি জানি না।

ভারতবর্ষ কুসংস্কারে টইটম্বুর। কুসংস্কারই এখানকার সংস্কৃতি। আমার বন্ধুটির সঙ্গে প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এই কষ্টগুলো করছো, সামান্য যুক্তিবুদ্ধি থাকলেই তো বোঝা যায় যা করছো সবই অর্থহীন! বন্ধুটি বললো যা কিছু করছে সে— বাবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে করছে, অথবা বাবা এসব মানতো বলে করছে। আমার কিন্তু মনে হয় বন্ধুটি নিজেই এসব বিশ্বাস করে। নিজে বিশ্বাস না করলে নিজেকে এমন শারীরিক কষ্ট দেওয়া যায় না।

আমার বন্ধুকে কাক খাওয়াতে হয় না। তবে ব্রাহ্মণ খাওয়াতে হয়। গোয়ায় পিন্ডিদান করতে যাবে সে। চালের গুঁড়ো, গমের গুঁড়ো, তিল, আর মধু দিয়ে এক পিন্ড বানিয়ে সেটির ওপরই দুধ ঢেলে, ফুল রেখে পুজো করা হয়, এইভাবেই পিন্ডিদান করে লোকে। তার বাবার আত্মা নাকি পৃথিবীতে থেকে ছটফট করছে, যা করতে চাইছে, পারছে না করতে, কারণ আগের মতো শরীরটি তো তার নেই। আত্মাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই পিন্ডিদান। যতই অর্থহীন হোক, ধর্মীয় প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানই মেনে চলছে বন্ধুটি। সে শ্রাদ্ধ করবে। পিতৃ ঋণ, দেব ঋণ, ঋষি ঋণ সবই সে শোধ করবে।

বন্ধুটি অনেক কিছুতে বিশ্বাস করে, জ্যোতিষি, ভূত প্রেত। আমার এক বাঙালি বন্ধুরও এসবে প্রচণ্ড বিশ্বাস। যখনই প্রমাণ চাই, তখনই একগাদা ভূতের গল্প সে করে, নিজের অভিজ্ঞতার অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প। সবগুলোর যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু কিছুই সে মানবে না। বিশ্বাস এমনই ভয়ংকর। বাঙালি বন্ধুও উচ্চশিক্ষিত। সরকারি উচ্চপদে চাকরি করে। আসলে সমাজের সব স্তরের মানুষ, নারী পুরুষ, উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত, উঁচুজাত নিচুজাত সবাই বিশ্বাস করে কুসংস্কারে। কেউ কেউ ডাইনি সন্দেহে মানুষ পুড়িয়ে মারে। ভারতবর্ষে খুব কম লোককেই পেয়েছি যাদের কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই। উচ্চশিক্ষিত কেউ এসবে বিশ্বাস করলে আঁতকে উঠি। হতাশা গ্রাস করে। যে দেশে স্পেস রিসার্স প্রোগ্রামের বিজ্ঞানী পরিচালক মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে মহাশূন্যে রকেট পাঠিয়ে মন্দিরের ভিতর রকেটের মূর্তি নিয়ে ঢোকেন ভগবানের আশীর্বাদ নিতে, সেই দেশে সাধারণ মানুষ যে কুসংস্কারে বিশ্বাস করবে, এ তো খুব স্বাভাবিক। এখনও এ দেশে ঠিকুজি কুষ্ঠি বিচার হয়, এখনও কাজ শুরুর শুভ অশুভ দিন, বিয়ে কোন মাসে ভালো কোন মাসে মন্দ- দেখা হয়, এখনও হাতের আঙুলে আঙুলে কুসংস্কারের পাথর। এখনও জাদু-টোনা, ডাব পড়া, সুতো পড়া, পানি পড়া, বাটি চালান, চাল পড়ায় লোকের বিশ্বাস অগাধ।

জন্মের সময় মঙ্গলের কোনও প্রভাব থাকলে তাকে মাঙ্গলিক বলা হয়। মাঙ্গলিক মেয়েদের নাকি বিয়ে করতে নেই। বিয়ে করলে সংসার ভেঙে যায়, স্বামী মারা যায়। অনেকে বলে ঐশ্বর্য রাই মাঙ্গলিক ছিলেন, সে কারণে পরিবারের লোকেরা প্রথমে তাঁকে একটা গাছের সঙ্গে বিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিয়ে অভিষেকের সঙ্গে। কালো বিড়াল দেখলে নাকি যাত্রা অশুভ। ময়ূর দেখলে শুভ। তিনটে টিকটিকি দেখলে বিয়ে হবে, চারটে দেখলে মৃত্যু। যে কোনও টাকার অংকের সঙ্গে এক টাকা জুড়ে দিলে সেটি নাকি মঙ্গলময়। কলকাতার গাড়িগুলোয় দেখেছি লেবু আর কাঁচা লঙ্কা ঝোলানো। এতে নাকি অশুভ দৃষ্টি থেকে বাঁচা যায়। অশুভ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর কপালে টিপ পরানো হয়। কিছু কিছু গাছ আছে ওসবে ভূত থাকে বলে অনেকের বিশ্বাস। শনিবারকে অশুভ দিন ভাবা হয়। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে অমঙ্গল। সেদিন এক ছেলে আমার বাড়িতে এসেছিল। আম কাটার ছুরিটা চাইলে ছুরিটা বাড়িয়ে দিলাম, সে নিল না, বললো ছুরি হাতে দিতে হয় না। শেষ পর্যন্ত টেবিলের ওপর রাখলাম। তবে সে নিল। এই ছেলেটি কিন্তু সমাজে প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত।

ঋতুস্রাবের সময় মেয়েদের অপবিত্র বলে মনে করা হয়। শুভ কাজে তাদের কিছু ধরতে-ছুঁতে দেওয়া হয় না। বিধবা মেয়েদেরও তাড়ানো হয়। মেয়েরা সিঁদুর খেলে স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য। করভা চৌউথ পালন করে, সারাদিন উপোস থাকে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য। ভাইফোঁটা ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য। রাখি, সেও ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য। সিঁথির সিঁদুর, হাতের শাঁখা সবই ওই একই কারণে, পুরুষের মঙ্গল, সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু। একসময় সতীদাহ প্রথা ছিল। স্বামী মরলে স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। দেবতার উদ্দেশে মানুষ বিসর্জন আজকাল দেওয়া না হলেও হঠাৎ হঠাৎ কোথাও কোথাও দেওয়া হয়। উত্তর প্রদেশে দশ বছর আগেও দেখা গেছে দু’শ জন মানুষকে বলি দেওয়া হয়েছে। নানা কারণে এই বলি। বৃষ্টি হওয়ার জন্য, গর্ভবতী হওয়ার জন্য। কুসংস্কারের শেষ নেই। সূর্য গ্রহণের সময় কিছু খেতে হয় না, গর্ভবতীদের ওই সময় বাইরে বেরোতে হয় না। বাস্তু শাস্ত্র বলে আরও এক কুসংস্কার বাঙালিরা বেশ মানছে আজকাল। দিন দিন এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

এগুলো তো আছেই, আরও নানারকম কুসংস্কার প্রতিদিন পালন করে শিক্ষিত অশিক্ষিত বিজ্ঞানী অবিজ্ঞানী প্রায় সকলে। হাতেগোনা কিছু বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী লোককেই দেখি কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, হাতে গোনাই। মানতে ইচ্ছে না করলেও এটা সত্য যে, ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চেয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র বেশি জনপ্রিয়।

এত কুসংস্কারে পৃথিবীর আর কোনও জাতি বিশ্বাস করে বলে আমার মনে হয় না। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কুসংস্কার নির্মূল হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। ২০০৭ সালে ভারতের ১৩০টি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ১১০০ জন বিজ্ঞানীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ২৪% বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন ধর্মীয় গুরুরা বা বাবারা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন, ৩৮% মনে করেন ভগবান অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন। ৫০% হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন, ৪৯% বিশ্বাস করেন প্রার্থনায় উপকার পাওয়া যায়।

আমার বিহারি বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমার মা মারা যাওয়ার সময় আমি কী কী ধর্মীয় আচারাদি পালন করেছিলাম? বললাম, কিছুই না। মা’র লাশ নিয়ে বাড়ির পুরুষেরা বেরিয়ে গেছে, কবর দেওয়ার আগে জানাজার নামাজে শামিল হয়েছে। মেয়েরা বাড়িতে ছিল। এক নানীই সম্ভবত সেদিন মা’র জন্য নিজের মতো করে নিভৃতে প্রার্থনা করেছে। আমি নামাজও পড়িনি, প্রার্থনাও করিনি। বোধহয় চল্লিশ দিন পর কিছু গরিব লোককে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু হয়নি। বাবার বেলাতেও এর বেশি কিছু হয়নি। আমি ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর কুসংস্কার পালন করে বাবা মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি না, বা তাঁদের ঋণ শোধ করি না। আমি তাঁদের স্মরণ করি নীরবে সরবে, তাদের ভালোটা থেকে শিক্ষা নিই।   মা’কে নিয়ে একটি বই লিখেছি, বইটির নাম ‘নেই কিছু নেই’। বইটি পড়ে, অনেকে বলেছে, তাদের মা’কে অবহেলা, অপমান না করার, বরং শ্রদ্ধা করার, ভালোবাসার, প্রেরণা পেয়েছে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মেয়েদের কাপড় চোপড়

ভারতের পর্যটনমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশি মেয়েরা যেন ছোট স্কার্ট পরে ঘোরাঘুরি না করে, তাদের নিরাপত্তার জন্যই এটি দরকারি। এ কথা বলে তিনি ভারতের পুরুষদের চরিত্র সম্পর্কে একরকম বুঝিয়ে দিলেন যে ভারতের পুরুষদের চরিত্র খারাপ, মেয়েরা ছোট পোশাক পরলে পুরুষরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যৌন নির্যাতন করে।

সৌদি আরবে ঢুকলেও বিদেশি মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয়। ওখানেও এরকম বিশ্বাস যে মেয়েরা চুল ঢেকে না রাখলে পুরুষরা এত উত্তেজিত হবে যে নিজেদের ধর্ষণেচ্ছাকে বাগে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

ভারত কি সৌদি আরব হতে যাচ্ছে? ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ, সৌদি আরব মূলত মুসলিম দেশ। ধর্মে মিল না থাকলেও মেয়েদের দাবিয়ে রাখার বেলায় দু’পক্ষে বেশ মিল। আসলে নারী-বিরোধ সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। অন্য কোনও বিষয়ে মতের মিল না থাকলেও নারী-বিরোধিতায় সব ধর্মের মানুষের মত প্রায় এক। নারীর শরীর নিয়ে, পোশাক নিয়ে, আচার ব্যবহার নিয়ে, চরিত্র নিয়ে তারা প্রায় একই মত প্রকাশ করে। মতটি পুরুষতান্ত্রিক। কোনও ধর্মই পুরুষতন্ত্রের বিপরীত কোনও কথা বলে না। পুরুষতন্ত্র আছে বলেই সর্ব ধর্মের সমন্বয় হওয়া সম্ভব। ধর্মের চেয়ে পুরুষতন্ত্র ঢের শক্তিশালী। পুরুষতন্ত্রই পারে সব ধর্মের মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করতে।

মেয়েদের ওপর পুরুষের যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। পুরোনো কালে পুরুষরা যৌন নির্যাতন করতো না, একালেই হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করেছে পুরুষ— আমার মনে হয় না এই তথ্যটি সঠিক। পুরোনো কালে যৌন নির্যাতনকে যৌন নির্যাতন বলে মনে হয়নি মানুষের। যৌন নির্যাতনকে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেওয়া হতো। স্বামী পেটালে, মারলে, ধর্ষণ করলে ভাবা হতো এসবে স্বামীর অধিকার আছে। দীর্ঘ বছরব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনের ফলে মানুষ এখন জানে কোনও নারীকেই কোনও রকম নির্যাতন করার কোনও রকম অধিকার কোনও পুরুষেরই নেই, সে পিতা হোক কী স্বামী হোক কী ভাই হোক কী পুত্র হোক। না, কোনও নারীরও সে অধিকার নেই। একসময় নারীরা সব নির্যাতন চুপচাপ সইতো, চুপচাপ সওয়াটাকেই নারীর গুণ বলে মনে করা হতো। এখনও যে হয় না তা নয়। রাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও ‘পুরুষরা একটু ওরকমই হয়’, ‘পুরুষদের সেক্সটা একটু বেশি’- এসব ভেবে পুরুষের সব অন্যায়কে, সব অপকর্মকে, সব অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সব অপরাধীকে দেখাটাকেও নারীর গুণ বলে ভাবা হতো, এখনও হয়। নারীবাদী আন্দোলনের ফলে নারীরা নিজের অধিকারের ব্যাপারে এখন খানিকটা সচেতন। তাই পুলিশে রিপোর্ট করে অনেকেই। সব নির্যাতিতাই রিপোর্ট করে না। এই যে কিছু রিপোর্ট করা হয়, এই যে মিডিয়া লেখালেখি করে বা বলাবলি করে এ নিয়ে, এতেই অনেকে মনে করে নারী নির্যাতনের হার বুঝি আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সত্য কথা হলো, নারীবিরোধীরা আগেও ছিল, এখনও আছে। আগেও নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে দেখা হতো, এখনও দেখা হয়।

বিদেশি মেয়েরা ছোট স্কার্ট না পরলে কি তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হবেন না? এ কথা কি হলফ করে বলতে পারবেন পর্যটনমন্ত্রী? ষাট বছর বয়সী যে বিদেশি মহিলাকে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছিল, সেই মহিলা কি মিনি স্কার্ট পরেছিলেন? না, তিনি মিনি স্কার্ট পরেননি। বিদেশি নারী- যারা যৌন নির্যাতনের এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে এ যাবৎ, তাদের অধিকাংশই ছোট স্কার্ট পরা ছিলেন না। দোষটা স্কার্টের নয়, দোষটা পুরুষের নারীবিদ্বেষের, নারীকে যৌন বস্তু ভাবার মানসিকতার, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, পাশ্চাত্যের মেয়েরা ‘যার তার সঙ্গে সেক্সে আপত্তি করে না’- এই বিশ্বাসের।

ভারতে গত বছর নারী নির্যাতনের রিপোর্ট হয়েছে তিন লাখ সাতাশ হাজার। আমরা অনুমান করতে পারি, রিপোর্ট না হওয়ার সংখ্যাটা আরো বেশি। যে হারে ভারতীয় নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, সে হারে বিদেশি নারী পর্যটক যৌন নির্যাতনের শিকার হয় না। জরিপে দেখা যায়, গত বছরে বিদেশি মহিলাদের ধর্ষণ করার হারটা আগের বছরের চেয়ে বরং কিছু কমেছে। কিন্তু এ তথ্য প্রমাণ করে না যে ভারত ধীরে ধীরে বিদেশি মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ হয়ে উঠছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটবেই, দেশি মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে বিদেশি মেয়েরাও শিকার হবে। দেশ নিরাপদ হলে দেশি বিদেশি সব মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে, নিরাপদ না হলে কারও জন্যই হবে না।

দেশ যদি মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয় মেয়েরা শরীরে কিছু না পরলেও নিরাপদ। উলঙ্গ মেয়ে রাস্তায় হেঁটে গেলেও কেউ কটু কথা বলবে না, কেউ যৌন হেনস্থা করবে না। যে দেশ স্কার্ট পরা মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, সে দেশ বোরখা পরা মেয়েদের জন্যও নিরাপদ নয়। মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ- মেয়েরা যা কিছুই পরুক, অথবা কিছু না পরুক- নিরাপদ। আর যে দেশ মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়- সে দেশে কোনও কাপড় চোপড় পরে নিরাপত্তা আনা যায় না। স্কার্ট বা লুঙ্গি তো পুরুষও পরে। উত্তর ভারতের গ্রামে গঞ্জে পুরুষরা স্কার্ট বা লুঙ্গি পরে। ভারতের তামিলনাড়ু আর কেরালার পুরুষরা ঘরে বাইরে তাদের জাতীয় পোশাক মুন্ডু পরেই থাকে। মুন্ডু আর লুঙ্গিতে পার্থক্য নেই। মুন্ডুটাকে ফোল্ড করে ছোট করেও পরে ওরা। ছোট করা মুন্ডু দেখতে অনেকটা ছোট স্কার্টের মতো। কই ছোট স্কার্ট পরে বলে তাদের নিরাপত্তার কোনও অভাব হয়নি তো! কোনও নারী তো ধর্ষণ করার জন্য তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে শুনিনি। দোষটা তাহলে স্কার্টের নয়। দোষটা নারীর নয়, কারণ নারীরা স্কার্ট পরা পুরুষকে যৌন নির্যাতন করে না। দোষটা নিশ্চিতই পুরুষের, কারণ স্কার্ট পরা এবং না-পরা মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে পুরুষরাই। এই পুরুষদের মানুষ করার উপায়টা কি? কী করে মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ বানানো যায় একটি দেশকে?

যত নারীবিদ্বেষ পুরুষ জন্মের পর থেকে শিখেছে- তা সবার আগে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে হবে। ওসব আবর্জনা মস্তিষ্কে রেখে নতুন বপন করে সুস্থ কিছু ফলানো সম্ভব নয়। নারীকে শ্রদ্ধা করো- এই শিক্ষা কোনও কাজে আসবে না, কারণ নারীকে ঘৃণা করো—এই শিক্ষা পেয়েই বেড়ে উঠেছে অধিকাংশ পুরুষ। আসলে ‘নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীও মানুষ’ ইত্যাদি যত না মাথায় প্রবেশ করানো দরকার, তার চেয়ে মাথা থেকে ‘নারী যৌন বস্তু, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের আছে’— এই ধরনের বিশ্বাস মাথা থেকে বের করে দেওয়া বেশি দরকার।

মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে পুরুষের মাথা ঘামানো কিছু নতুন নয়। মেয়েদের কাপড় চোপড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চায় ধর্ষক পুরুষ। অচেনা কারও সঙ্গে কোনও অনুমতি ছাড়াই যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে হতেই পারে পুরুষের, কারও ওপর পেশির জোর দেখানোর ইচ্ছে হতেই পারে তাদের, কাউকে খুন করার ইচ্ছে হতেই পারে- কিন্তু এসব বদ ইচ্ছেগুলোকে সংবরণ করতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। সভ্য মানুষ হতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ সভ্য না হলে দেশটিরও সভ্য হয়ে ওঠা হয় না। আমি অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের, যে দিন একটিও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মেয়েরা সেরা

বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ছাত্রদের পাসের হার ৭৩.৯৩, ছাত্রীদের পাসের হার ৭৫.৬০। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলেরা একটু দুষ্টু, তাই রেজাল্ট খারাপ করেছে’।

মেয়েদের পাসের হার কম হলে লোকে কী বলতো? বলতো, ‘মেয়েরা একটু ডাল, তাই রেজাল্ট খারাপ করেছে’।

ছেলেরা ‘দুষ্টু’ মানে পড়াশোনায় মন নেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে, খেলাধুলো নিয়ে পড়ে থাকে। মেয়েরা ‘দুষ্টু’ মানে সেক্সি পোশাক পরে ছেলেদের সিডিউস করার চেষ্টা করে, ছেলেদের সঙ্গে শুয়ে বেড়ায়।

মেয়েরা বার বার প্রমাণ দিচ্ছে মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু তারপরও মেয়ে-বিরোধী সমাজ কিন্তু যেমন ছিল, তেমনই আছে। কারওরই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি।

খুব বেশিদিন হয়নি মেয়েরা ইস্কুলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। ঘরের বাইরে বেরোনোরও অধিকার ছিল না মেয়েদের। থাকতে হতো পর্দার আড়ালে। ইস্কুলে যাওয়ার, বইপত্র পড়ার, ডিগ্রি নেওয়ার, উপার্জন করার অধিকার রীতিমত দীর্ঘ আন্দোলন করে অর্জন করতে হয়েছে। কত কুসংস্কারই যে রচনা করা হয়েছে মেয়েদের বিরুদ্ধে, মেয়েরা ইস্কুলে গেলে নাকি স্বামী মারা যাবে, মেয়েরা আপিসে গেলে সংসার ভেঙে যাবে। এত প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে মেয়েরা পড়াশোনা করলো আর দেখিয়ে দিল ছেলেদের চেয়ে তারা ভালো। এখন কি সব মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে শুরু করবে! চাকরির উঁচু পদগুলো মেয়েরা পাবে! আমার বিস্তর সংশয়।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষার চেয়ে, স্বনির্ভরতার চেয়ে, মেয়েদের বিয়ে হওয়া, পরনির্ভর হওয়া, বাচ্চা কাচ্চার মা হওয়াকেই প্রাধান্য দেয় পরিবার আর সমাজ। অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা না থাকলেও সামাজিক পরনির্ভরতা যেন যে করেই হোক মেয়েদের থাকে। এই সমাজ নিয়ে প্রায়ই আমি হতাশ হই। তাই সমাজ বদলের আশায় থাকি।

আজকালকার পুরুষরা মেধাবী মেয়েদের বিয়ে করতে ইচ্ছুক। সম্ভবত বাইরে বলে বেড়ানোর জন্য, ‘বউ তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট’, ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’! বিয়ের পরও বলা যায়, ‘ওকে একটা বাচ্চাদের ইস্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছি বা মেয়েদের জন্য ভালো এমন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি’, বা ‘অবসর সময়টায় কিছু একটা করতে চাইছে তাই একটা চ্যারিটি অরগানাইজেশনে জয়েন করতে বলেছি’। সন্তান হওয়ার পর বলে বেড়ানো যায়, ‘বাচ্চাদের সুবিধে, ঘরে মায়ের কাছেই পড়ছে। ’ মেধাবী মেয়ে বিয়ে করতে চাওয়ার আরও কারণ আছে, কারণ ওরা চাকরি করলে বেতনের টাকাটা স্বামীর হাতে দেবে অথবা না দিলেও সংসার খাতেই খরচ করবে। রোজগেরে মেয়ে বিয়ে করার চল শুরু হয়েছে বাংলায়। পরনির্ভর মেয়েদের শাসিয়ে যতটা সুখ পাওয়া যায়, স্বনির্ভর স্বাবলম্বী সচেতন মেয়েদের শাসিয়ে তার চেয়েও বেশি সুখ পাওয়া যায়। আত্মবিশ্বাসও ভীষণ বেড়ে যায়।

আমরা জানি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে মেয়েদের চেয়ে বেশি ছেলেরাই। কারণ অনেক মেয়ে এর মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হবে। অনেক মেয়েই স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ির উপদেশ বা আদেশ মানতে বাধ্য হবে, পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে বা চাকরি ছেড়ে দেবে। অনেক মেয়েই গর্ভবতী হবে, অথবা সন্তান প্রসব করবে। তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না মেধার মূল্য দেওয়া।

সংসার এবং চাকরি কী করে একসঙ্গে সামলাবে এই প্রশ্নের সামনে মেয়েদেরই পড়তে হয়। পুরুষদের পড়তে হয় না। কেউ কোনও পুরুষকে জিজ্ঞেস করে না, এই যে চাকরিতে ঢুকেছেন, সংসার কী করে সামলাবেন, দুটো একসঙ্গে অসুবিধে হবে না? সংসার সন্তানের জন্য মেয়েরা নিজের স্বনির্ভরতা ত্যাগ করলে লোকে খুশি হয়। সংসার সন্তানের জন্য পুরুষরা নিজের স্বনির্ভরতা ত্যাগ করলে লোকে ছি ছি করে।

মেয়েদের খেলাধুলো করাও তো একরকম বারণ ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা মায়েরা মেয়েদের বড়জোর পুতুল খেলতে দিত, দৌড়ঝাঁপের মধ্যে উঠোনে ওই দড়ি লাফানো, এক্কা দোক্কা, অথবা গোল্লাছুট। খেলা মূলত ছেলেদের জন্য। হৈ হল্লা ছেলেদের জন্য। আনন্দ উল্লাস ছেলেদের জন্য। সতীচ্ছদ ছিঁড়ে যাবে এই ভয়ে মেয়েদের সাইকেল চালাতে দিতেও অনেক লোক আপত্তি করতো। সত্তর দশকে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছি। মেয়েদের জন্য তখনও রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হওয়া বা লেকে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। আমি আজও সাইকেল চালাতে জানি না। সাঁতার শিখেছি যখন বার্লিনে ছিলাম।

ভারত এত বড় দেশ। অথচ অলিম্পিকে সোনা রুপো তেমন জোটে না। এবার বিজয়ী বলতে কিছু মেয়ে। কুস্তিতে সাক্ষী, ব্যাডমিন্টনে সিন্ধু। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে দীপা কর্মকার। প্রথম দুজন ব্রোঞ্জ আর সিলভার জিতলেও তৃতীয়জন কিছু জেতেনি, কিন্তু চতুর্থ হয়েছে। হয়েছে তো চতুর্থ। প্রোদুনোভার মতো কঠিন ঘটনা তো অনেকটাই ঘটিয়ে দেখিয়েছে। প্রশিক্ষণে অঢেল টাকা ঢেলে ছেলেদের খেলোয়াড় বানানো হয়। মেয়েদের খেলোয়াড় বানাতে ঠিক কত যায়? খুব বেশি যায় কি? দীপাকে তো দেশের বাইরে পাঠানো হয়নি প্রশিক্ষণ নিতে। দেশি কোচ দিয়েই কাজ সারতে হয়েছে মেয়েকে।

কী আশ্চর্য তাই না? মেয়েদের দক্ষ খেলোয়াড় বানাতে যে দেশের, সমাজের, সংস্কৃতির অবহেলা, সেই দেশের মেয়েরাই অলিম্পিকের পদক জিতে দেশকে গর্বিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। মেয়েরা পারে না, পারবে না, মেয়েদের ঘটে বুদ্ধি নেই, পেশিতে জোর নেই— সেই কতকাল থেকে শুনে আসছি। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, অপমানিত মেয়েরাই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে।

মানুষের তবু শিক্ষা হয় না। কন্যায় আপত্তি বলে অনেকে কন্যার ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলে, কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলে অথবা অনাদরে বড় করে। পুত্র জন্ম দিয়ে ধন্য হয় লোক। অথচ অনেক সময় দেখা যায় হেলাফেলা করে বড় করলেও বাবা মা’কে দেখভাল অধিকাংশ সময় কন্যাই করে, ননীটা ছানাটা খেয়ে বড় হওয়া পুত্র বরং দায়িত্ব এড়ায়।

মেয়েদের হাজারো কিছু করার স্বাধীনতা নেই। যদি থাকতো, তবে দক্ষতা দেখাতে পারতো আরও। পৃথিবীর অর্ধেকই নারী। এই অর্ধেককে আবৃত করে, অনাবৃত করে, অশিক্ষায় মুড়িয়ে, অত্যাচারে ভুগিয়ে মারছে পুরুষ আর তার তৈরি সমাজ ব্যবস্থা। যদি একবার সমান সুযোগ পেত মেয়েরা, একবার যদি সমান সুযোগ পেতাম আমরা, পৃথিবী বদলে দিতে পারতাম। ছেলেরা যে সুযোগ পায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে, যেখানে খুশি সেখানে যেতে, জগৎ জানতে, জ্ঞানার্জন করতে— একই সুযোগ মেয়েদের দেওয়া হোক। একই অধিকার, একই স্বাধীনতা মেয়েদের একবার দিয়ে দেখুক সমাজ। সোনার মেডেল কারা নিয়ে আসে দেখুক। বিজয় নিশান কারা ওড়ায় দেখুক।

কেউ যেন ভাববেন না আমি ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে দেখছি। আসলে, আমি নই, আলাদা করে সমাজ দেখছে। আমি এক করতে চাইছি। এই বলে এক করতে চাইছি যে ছেলেরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে দক্ষ, মেয়েরাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ। যে খেলাগুলো ছেলেরা খেলে, সেসব মেয়েরাও খেলে। মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ম্যারাথন, বাস্কেটবলও খেলে। মেয়েরাও পারে। উড়োজাহাজ কেন, মহাকাশযানও চালাতে পারে। হাতিয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতেও পারে। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা প্রমাণ করেছে মেয়েরাও তা পারে। কিন্তু মেয়েরা আরও যা পারে, ছেলেরা এখনও প্রমাণ করতে পারেনি, ছেলেরাও সেসব পারে। একটি যেমন শিশু পালন।

মেয়েরা কম বোঝে, কম জানে, কম পারে— এসব তো নতুন নিন্দে নয়। এসব শুনে শুনে বড় হয়েছে প্রায় প্রতিটি মেয়ে। ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ বলে মেয়েদের পেছনে মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে মজা দেখে পুরুষ। মেয়েদের বোকা বানিয়ে, দাসী বানিয়ে, ঠকিয়ে, নিঃস্ব করে পুরুষ আনন্দ পায়। এ তো হাজার বছরের ইতিহাস।

মেয়েরা পুরুষকে যে সম্মান দেয়, একই সম্মান যদি পুরুষরাও মেয়েদের দিত, তা হলে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য বলে কিছু থাকতো না। পুরুষ তৈরি পিতৃতন্ত্র বহাল না থেকে যদি মানবতন্ত্র বহাল থাকতো, তবে ধর্ষণ, বধূহত্যা, পণ প্রথা, নারী নির্যাতনও বন্ধ হতো।

নারীবিরোধী আইন যতদিন সমাজে আছে, যতদিন নারীবিরোধী ওয়াজ চলবে, যতদিন পিতৃতন্ত্র ছড়ি ঘোরাবে, যতদিন ধর্মান্ধতা বিরাজ করবে সমাজে— ততদিন নারী সেই সম্মান পাবে না যে সম্মান তার পাওয়া উচিত।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

বিরুদ্ধ স্রোত

ঢাকার সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ভারতের কিছু মিডিয়া আমার মতামত জানতে চেয়েছিল। ওদের জন্য লিখেছি, বলেছি। কথা প্রসঙ্গে ইসলাম এসেছে। আসাটা খুব স্বাভাবিক। আমি যথারীতি আমার মত প্রকাশ করেছি। এতে ক্ষুব্ধ কংগ্রেসের বড় বড় নেতা। গোলাম নবী আজাদ রাজ্যসভায় সেদিন বললেন, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছি। কাশ্মীর নিয়ে বলছিলেন, হঠাৎ আমাকে নিয়ে কেন পড়লেন কে জানে। আমি কি কাশ্মীর সমস্যার জন্য দায়ী? বোধহয় তাই বলতে চাইছিলেন যে, দায়ী। কাশ্মীরের প্রেস ফ্রিডম দাবি করছেন আবার দিল্লির প্রেস ফ্রিডমের নিন্দে করছেন। এ নিয়ে রাজনীতির কোনও দলের কোনও নেতাই মুখ খুললেন না। আমি কিন্তু ইসলাম নিয়ে কোনও মিথ্যে কথা বলিনি। ইসলামকে গালাগালি করিনি। বলেছি, মেয়েদের সমানাধিকার দরকার, অন্যান্য ধর্মের কানুন প্রথা অনেক পাল্টেছে। মুসলমানের শত্রু ছাড়া আর কেউ বলবে না, ইসলামি আইনের কোনও বদল -পরিবর্তন চাই না।

কংগ্রেসের আরও একজন বড় নেতা সালমান খুরশিদ দেখলাম টুইট করছেন, আমি নাকি পুরো জাতিকেই ধ্বংস করে দিয়েছি। এত বড় ক্ষমতা আমার? এত বড় ভারতকে ধ্বংস করে দেওয়ার? ছ’মাস আগে আইন বিষয়ক একটি বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম, ওখানে সালমান খুরশিদ গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কেউ আমার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। কিন্তু মঞ্চ থেকে দর্শকের আসনে বসা আমাকে দেখে উনি তাঁর ভাষণের শুরুতে বললেন যে আমার উপস্থিতি নাকি অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়িয়েছে, তাঁর ভাষণ শুনে আমার মনে হয়েছিল তিনি খুব শিক্ষিত, সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী একজন মানুষ। তিনি যে সময়ে বদলে যেতে পারেন, একটুও তো মনে হয়নি। এই মানুষটাই এখন আমার সম্পর্কে কী ভীষণ বাজে বকছেন।

গোলাম নবী কটাক্ষ করছিলেন, ইসলাম নিয়ে লিখে এমন অন্যায় করেছি যে আমাকে আমার দেশের সরকার দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। বলতে চাইছেন, আমি যে নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছি, দোষটা আমার, দোষটা আমার দেশের সরকারের নয়। যে লেখে তার দোষ, লেখককে যে বের করে তার নয়? আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম, মুসলমান সমাজের রিফরমেশনের কথা বলাতেই কী ভীষণ রাগ করতে পারেন ভারতের বাঘা বাঘা নেতা! এঁরাই কি মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী? এঁরা পলিটিক্স করবেন বলেই কি মুসলমানদের আফিম খাইয়ে অন্ধকারে রেখে দিচ্ছেন? আলোকিত হতে দিতে এত আপত্তি কেন? এঁরা নিজেরা আধুনিক জীবনযাপন করেন। কিন্তু জাকির নায়েককে ফিরিয়ে আনতে চান। জাকির নায়েক জনগণকে চমত্কার আফিম খাওয়াতে পারেন বলেই কি ফিরিয়ে আনতে চান?

কয়েকজন ভারতীয় পরিচিত নারী-পুরুষকে জিজ্ঞেস করেছি যে শিক্ষিত মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা তো আধুনিক মানুষ, ওঁরা কেন মুসলিম সমাজের কোনও বিবর্তন চান না?

পরিচিতরা যা উত্তর দিল, তা বলছি—

১. ইসলামে এমন কোনো বাধা আছে বলে আমি মনে করি না, যার জোরে মুসলিম সমাজের সংস্কারকে আটকে বা স্তব্ধ করে রাখা যায়। তবু মুসলিম সমাজের সংস্কার তেমন হচ্ছে না তার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নির্লজ্জ নেতিবাচক ভূমিকা। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের মানুষ করেন আধুনিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে। কিন্তু তাঁরাই আবার মুসলিম সমাজকে আটকে রাখতে চায় মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে। এসব করেন ভোটে জিতে ক্ষমতা হাসিল করার জন্যে। আর মূলতঃ তাদের জন্যে মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পড়ে রয়েছে সংস্কারের অভাবে।

২. কেউ কি কারো অধিকার ছাড়তে চায়! এত বছর ধরে দাবিয়ে রেখেছে, তুমি তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে চাইছ, তোমাকে শত্রু বলবে না তো কি মিত্র বলবে? হিন্দু ধর্মের অত্যাচার, অনাচারগুলোকে দূর করার জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে কম গালাগাল, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে?

৩. গোলাম নবী আজাদ, সালমান খুরশিদ প্রথমে মুসলিম তারপর ভারতীয়। আধুনিক পোশাক পরলে, আধুনিক জীবনযাপন করলেও একজন জঙ্গি মুসলিমের সাথে এদের তফাত একটাই, এরা বিধর্মীকে নিজে হত্যা করে না কিন্তু জঙ্গিদের সবরকম সাহায্য করে বিধর্মীকে হত্যা করার জন্যে।

৪. এটা রাজনীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকার ঋণাত্মক সংগ্রাম।

৫. এঁরা পলিটিক্স করবেন বলেই মুসলমানদের আফিম খাইয়ে অন্ধকারে রেখে দিচ্ছেন।

৬. ভারতের মুসলমান ইস্যু হচ্ছে রাজনৈতিক। কংগ্রেসের রাজনীতিতে মুসলমান ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হচ্ছে কিছুটা প্রগ্রেসিভ রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ঘুঁটি। এটাই বর্তমানের রাজনৈতিক মানবাধিকার ইস্যু। কংগ্রেস তার রাজনৈতিক প্রয়োজনে আপনার ধর্ম বিরোধিতাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানাবে। এসব তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলো এটা বুঝতে চায় না পৃথিবীর সব রকম মানবাধিকার ইস্যুতে সব ধর্মই বিরাট বাধা।

৭. ভারতে সব কিছুই তো ভোটমুখী, নেতারা তো চায় না সমাজ বদলে যাক।

৮. এরা কূপমণ্ডূক, এরা ইসলামের শত্রু, এরা ভারতেরও শত্রু।

৯. ভারতের পলিটিক্স এর ট্রাম কার্ড হলো ইসলাম।

১০. “মুসলমান সমাজের রিফরমেশনের কথা বলাতেই কী ভীষণ রাগ করতে পারেন ভারতের বাঘা বাঘা নেতা! এঁরাই কি মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী?”— হ্যাঁ। এরাই দায়ী। এরা হলেন রাজনৈতিক মৌলবি…

১১. এটাই পলিটিশিয়ান আর লেখকদের মধ্যে পার্থক্য দিদি। তোমরা সমাজের মঙ্গলের জন্য কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাও আর ওরা নিজেদের স্বার্থে মানুষদের আফিমখোর বানিয়ে রাখে।

১২. ভারতের ডান বাম প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই ভোটের রাজনীতির নামে মুখে মুসলিম তোষণের যে সহজ পথটি ধরেছেন তাকে মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও বাহবা দিচ্ছেন। আর এতেই মুসলিম ধর্মের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে।

১৩. ইসলামের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তো ইসলাম ধর্মকে আঁকড়ে থাকা লোকদের বুকে ব্যথা হবেই। ঠিক সেরকম হিন্দু ধর্ম কিংবা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললে সেই ধর্মকে আঁকড়ে থাকা লোকেরা চ্যাঁচামেচি করে। এ আর এমন কি! তারপর, তুমি যাদের কথা বলছো এরা তো আবার রাজনীতিক। এরা তো এসব নিয়ে রাজনীতি করবেই। ধর্মান্ধদের নাচানো তো রাজনীতিকদের কাজ-ই। তুমি ওসব নিয়ে চিন্তা করো না দিদি। এঁদের যা বলার আছে, তা বলতে দাও; আর তোমার যা বলার তুমি বলতে থাকো। বুদ্ধিমানেরা ঠিক বুঝতে পারবে, কার বলাটা সঠিক আর কারটা বেঠিক।

চিরকাল মানুষের মঙ্গল চাইলাম, চিরকাল মানুষ ভুল বুঝলো। সমাজের ভালো চাইলাম, সমাজপতিরা গালি দিল। নারীর সমানাধিকার চাইলাম, নারীবিদ্বেষীরা কুৎসা রটালো। এভাবেই বেঁচে আছি।

মনে আছে তিয়ানানমান স্কোয়ারের কামান-লোকটির কথা?            মাঝে মাঝে নিজেকে সেই লোকটির মতো মনে হয়। জানি ওই লোকটির মতো হওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীতে প্রায় কারওরই নেই। আমারও নেই। তারপরও কিছু কিছু সময় মনে হয় আমার অবস্থা বোধহয় ওরকমই। কতকাল যে যুদ্ধ করছি। এখনও দাঁড়িয়ে আছি বিরুদ্ধ স্রোতে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ জুলাই, ২০১৬

কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি

তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আজকাল আমার উৎসাহ নেই বললেই চলে। অমিতাভ বচ্চনকে ভীষণ ভালোবাসতাম। তাঁকে মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে স্মার্ট পুরুষ। তারপর তাঁর ব্যক্তিজীবন ঘেঁটে যখন দেখলাম কিছু হলেই তিনি তিরুপতি মন্দিরে দৌড়োন, শুভ কিছু ঘটানোর জন্য কোটি কোটি টাকা মন্দিরে দান করেন, তখন মন ভেঙে গেলো। প্রিয় মানুষদের, ভেবেই নিয়েছিলাম, যুক্তি-বুদ্ধির অভাব নেই। বাস্তবটা বড় অচেনা আর অন্যরকম। প্রিয় মানুষদেরও তাই বড় দূরের মনে হয়। পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়াকে শুনেছি অমঙ্গল কাটাতে গাছের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। ঐশ্বরিয়া অত্যন্ত ভালো অভিনেত্রী, কিন্তু প্রতিবাদ করেনি। সুচিত্রা সেনকে তো কম ভালোবাসিনি, শুনেছি উনিও নাকি বেলুড় মঠে যেতেন প্রায়ই। পুজো আচ্চা নিয়ে থাকতেন। রাজ্জাকও দেখেছি ধর্মকর্মে ডুবেছেন, ববিতা বোরখা পরছেন, শাবানা তো শরীরে বোরখা চাপিয়েছেনই, এতকাল সিনেমা করাকে পাপ করেছেন বলে মনে করছেন। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি তারকারা একেকটা কুসংস্কারের ডেঁপো।

কিছুদিন হলো কিছু তারকা মেয়ের কথায় চমকে উঠছি। দিপিকা পাদুকোনের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল টাইমস অব ইন্ডিয়ায়, ছবিটায় দিপিকার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছিল। তাই নিয়ে তুলকালাম। চারদিকে ছি ছি চলছে। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। দিপিকা সোজা বলে দিল, ‘আমার স্তন আছে, আমার ক্লিভেজও আছে, এ দেখা গেলে আমার তো কোনো অসুবিধে নেই, তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে কেন?’ শুনে তো আমি ব্রাভো বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সেদিন বলেছে, ‘সন্তান জন্ম দিতে হলেই শুধু পুরুষকে প্রয়োজন, তাছাড়া জীবনে পুরুষের কোনো প্রয়োজন নেই। ’ বাহ, এমন কথা একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়া মেয়ের মুখে, বিশেষ করে তারকার মুখে শুনবো, আশা করিনি। তারকারা বিজ্ঞান পড়ে না, বিবর্তন সম্পর্কে কিছুই পড়ে না, নারীবাদীদের বইও পড়ে না, তারা দেশভর্তি অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষকে খুশি করতে ব্যস্ত থাকে এবং এমন কোনো কথা তারা বলে না, যা শুনে তাদের দর্শক আহত হয়। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা তার দর্শকদের খুশি করতে ব্যস্ত নয়। কে কী ভাববে তার পরোয়া করেনি।

ওর কথা শুনে আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ। এমন মেয়ের দেখা তারকাজগতে মেলে না বললেই চলে। তারকা মেয়েরাও এই সমাজেরই মানুষ, তাদেরও এই সমাজের মেয়েদের মতোই বিয়ে করতে হবে, ঘরসংসার করতে হবে, বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করতে হবে, স্বামী সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে— এই বিশ্বাস প্রায় সব তারকা এবং তাদের অনুরাগী দর্শকদের। এই বিশ্বাসের গায়ে আঘাত দিয়ে কথা বলা সহজ নয় খুব। প্রিয়াঙ্কা কঠিন কাজটিই করেছে। সেদিন সানিয়া মির্জাও আমাকে চমকে দিল। খবরটা এরকম : সানিয়া মির্জা তার আত্মজীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে সানিয়ার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন রাজদীপ সরদেশাই। রাজদীপ ভারত টেলিভিশনের বড় সাংবাদিক। নানা প্রসঙ্গের পর হঠাৎই তিনি জিজ্ঞেস করে বসেন, সানিয়া মির্জা কবে ‘থিতু’ হচ্ছেন? মা হওয়ার কথা ভাবছেন কি? বইয়ে কেন তিনি এ সব নিয়ে কিছু লেখেননি?

উত্তরে সানিয়া বলে, ‘আপনি মনে করেন না আমি সেটল্ড?’ শুনে রাজদীপ বলেন, তাঁর বইয়ে সানিয়া অবসরোত্তর জীবন নিয়ে লেখেননি। লেখেননি, মা হওয়ার পরিকল্পনা বা পরিবার গড়ার প্ল্যান নিয়েও। যা শুনে সানিয়া সোজাসুজি বলেছে, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মা হওয়ার কথা না ভেবে আমি যে বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার বিকল্পটা বেছে নিয়েছি, তাতে আপনি প্রচণ্ড হতাশ!’ সঙ্গে যোগ করে, ‘তবু আমি এটার উত্তর দেব। বাকি মেয়েদের মতো আমাকেও বারবার এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে। প্রথমে বিয়ে, তার পর মা হওয়া। এগুলো না হলে আমরা নাকি থিতু হই না! হতাশার ব্যাপার হলো, যতগুলো উইম্বলডনই জিতি, যতবার বিশ্বের এক নম্বর হই, আমরা থিতু হই না!’ সানিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন রাজদীপ। পরে যখন সানিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কীভাবে মানুষের মনে থাকতে চান, তখনো তাঁকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি সানিয়া। বলেছে, ‘আমি যেন এমন কিছু করতে পারি যাতে ২৯ বছরের কোনও বিশ্বসেরা মেয়েকে কেউ না জিজ্ঞেস করতে পারে, সে কবে মা হচ্ছে!’

সানিয়ার এই সাক্ষাৎকার দেখে আমি এমনই উত্তেজিত ছিলাম যে রাজদীপ সরদেশাই-এর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক থাকার পরও আমি টুইটারে লিখেছি, ‘রাজদীপ স্টুপিড প্রশ্ন করেছে সানিয়াকে’। সানিয়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছি, কারণ সানিয়া খুব সত্য কথা বলেছে। এমন সত্য কথা ভারতীয় উপমহাদেশের তারকাদের মুখে আমরা শুনে অভ্যস্ত নই। তারকা মেয়েরা সাধারণত বলে সমাজের রীতিনীতি তারা খুব মেনে চলে। বিয়ের পর তারা স্বামী সন্তানে মন দেবে, তারা আর খেলবে না বা সিনেমা করবে না। বিয়ের পর কোনো পুরুষ তারকা কী করবে, থিতু হবে কিনা, সন্তান জন্ম দেবে কি না, এ ধরনের প্রশ্ন কিন্তু কেউ করে না। কেবল মেয়ের বেলায় কেরিয়ার ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে। সফল অভিনেত্রী, গায়িকা, চিত্রপরিচালিকা, খেলোয়াড়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী মেয়েরাও নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে না, তারা কার স্ত্রী, কার মেয়ে, কার মা, কার বোন— এসবের খোঁজখবর সবসময়ই চলে।

সানিয়া মির্জার স্বামী শোয়েব মালিকও একজন তারকা খেলোয়াড়। তাকে কিন্তু কেউ, কোনো মেয়ে-সাংবাদিক, কোনো পুরুষ-সাংবাদিক প্রশ্ন করবে না শোয়েব ঘর সংসারে মন দেবে কবে, বাবা হবে কবে, থিতু কবে হবে। পুরুষেরা যত নিশ্চিন্তে নিজেদের কেরিয়ার গড়তে পারে, মেয়েরা তত নিশ্চিন্তে পারে না। পারে না বলা উচিত হবে না। মেয়েদের পারতে দেওয়া হয় না। সংসারটাকে মেয়েদের সবচেয়ে বড় কাজ বলে আজো অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে। মেয়েদের এক সময় ঘরবন্দী হতে হয়, বন্ধ করতে হয় বাইরের কাজ। অবশ্য পুরুষেরা চালিয়ে নিয়ে যায়। অমিতাভ বচ্চন চালিয়ে যান, জয়া ভাদুড়ি বন্ধ করেন। সুচিত্রা সেন বন্ধ করেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চালিয়ে যান। কাজল বন্ধ করেন, অজয় দেবগণ চালিয়ে যান। এরকম অনেক উদাহরণ আমাদের চারদিকে। বয়স হয়ে গেলে মেয়েদের আর পাতে তোলা যায় না, কিন্তু বয়সটা পুরুষের জন্য কোনো বিষয় নয়। ঠিক না? ঠিক, কারণ সমাজের মানুষগুলোকে এই বৈষম্যের ধারণা নিয়ে আমরা বড় হতে দিই, এভাবেই তাদের হাতে সমাজকে আমরা গড়তে দিই এবং এভাবে এখনো সমাজকে চলতে দিই।

হ্যাপি নামের এক মেয়েকে দেখতাম ক্রিকেটার রুবেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বেশ সাহসী কথাবার্তা বলছে ফেসবুকে। সমাজ ছি ছি করে বলে যে কথাগুলো মেয়েরা সাধারণত লুকোয়, কিছুর তোয়াক্কা না করে হ্যাপি সে কথাগুলোই জোরেশোরে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে। তারপর কী হলো কে জানে, হঠাৎ সে উধাও। ক’দিন পর দেখি আপাদমস্তক বোরখায় ঢেকে মুখে ধর্মীয়তত্ত্ব আওড়াচ্ছে। লোকে তাকে খারাপ মেয়ে ভেবেছিলো, তাই লোকের চোখে ভালো হওয়ার জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে সে। বড় মায়াই হয়, নিজের সকল প্রতিভা, সকল সম্ভাবনা সব বিসর্জন দিতে হলো তাকে। হ্যাপি যে এদিকে রুবেলের গোপন সব কথা ফাঁস করে দিল, তার পরও কিন্তু কেউ রুবেলকে খারাপ ছেলে মনে করেনি, আর নিজেকে লোকের চোখে ভালো প্রমাণ করার জন্য রুবেলকে আপাদমস্তক আবৃত করতেও হয়নি। সে দিব্যি তার জীবনযাপন করছে, যেমন করছিল। শুধু হেরে যেতে হলো হ্যাপিকেই।

মেয়েদেরই হেরে যেতে হয়। সেদিন পাকিস্তানের সেই মডেল-মেয়ে কান্দিল বালোচকে হারিয়ে দিল পাকিস্তানের সমাজ। তার আপন ভাই তাকে বিষ খাইয়ে, শ্বাসরোধ করে হত্যা করলো। কান্দিল নাকি সমাজের রীতিনীতি মেনে চলছিল না। যে সমাজ মেয়েদের স্বাধীনতার পথে বাধা, সেই সমাজকে মেনে চলার কোনো যুক্তি নেই। যে মেয়েরা শত ধিক দেবে সেই পুঁতিগন্ধময় সমাজকে, সেই সমাজের রীতিনীতিকে পায়ে মাড়িয়ে যাবে, সে মেয়েরাই সামনে এগোবে, সেই মেয়েরাই আমাদের গর্ব, সেই মেয়েরাই ভবিষ্যৎ।

সব মেয়ে হেরে যায় না। দিপিকা, প্রিয়াঙ্কা, সানিয়ারা কিন্তু হেরে যাচ্ছে না। এদের দেখেই আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখুক মনোবলহীন তারকা-মেয়েরা।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ জুলাই, ২০১৬

জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা

আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমার চরম শত্রুর মত প্রকাশের অধিকারের জন্যও আমি লড়ি। জাকির নায়েকের মত প্রকাশের অধিকারেও আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি যেটাতে বিশ্বাস করি না, সেটা হলো ভায়োলেন্স। হিংস্রতা, বর্বরতা, সন্ত্রাস, নির্যাতনে আমি বিশ্বাস করি না। খুনোখুনিতে আমার বিশ্বাস নেই। জাকির নায়েক কি মুসলমানদের সরাসরি সন্ত্রাসী হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন? উপদেশ হয়তো দেননি, কিন্তু তিনি ওসামা বিন লাদেনকে সন্ত্রাসী বলতে রাজি নন, তিনি নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসীদেরও মনে করেন না সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে সন্ত্রাস করার পক্ষপাতী তিনি, সুতরাং মুসলমানদের সবারই সন্ত্রাসী হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। যে মুসলমানরা মুসলমানদের দেশে আমেরিকার বোমা ফেলা, ইসরায়েলের সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্ব করা— ইত্যাদির ঘোরবিরোধী তারা খুব পছন্দ করে সন্ত্রাস বিষয়ে জাকির নায়েকের এই মন্তব্যগুলো। এদের মধ্যে ক’জন সত্যি সত্যি অস্ত্র হাতে নেয় আমি জানি না। রোহান, ইমতিয়াজ আর নিবরাস ইসলাম জাকির নায়েকের ভাষণ শুনতো কিন্তু তারা কি সন্ত্রাসী হয়েছে ওই ভাষণের কারণেই? ভাষণ যদি কিছুটা ভূমিকা রেখে থাকে তবে কতটা ভূমিকা রেখেছে? ঠিক জানি না, দুনিয়ার ক’জন তরুণ জাকির নায়েকের ভাষণ শুনে জঙ্গি হওয়ার আর গণহত্যা করার পরিকল্পনা করছে। যদি সন্ত্রাস তৈরিতে নায়েকের কোনো ভূমিকা না থাকে, তবে জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি। আমি তো নয়া নািসদের বাকস্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। তারা কী বলতে চায় বলুক, ভায়োলেন্সের আহ্বান না দিয়ে বলে যাক। তাদের নীতি-আদর্শ যদি কারও পছন্দ হয়, গ্রহণ করবে।

তসলিমা-বিরোধীদের বাকস্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে হত্যা করার, বা আমার শরীরে আঘাত হানার জন্য ওরা আহ্বান না জানায়। মানসিক আঘাতের পরোয়া করি না আমি। অন্যের নিন্দে সমালোচনা শোনার মনের জোর সবার আছে, থাকে। ওটি নেই বলে যারা চিৎকার চেঁচামেচি করে, তারা অসৎ উদ্দেশে চিৎকার চেঁচামেচি করে। জাকির নায়েকের ভাষণ আমি শুনেছি। তিনি মূলত কোরআন থেকেই উদ্ধৃতি দেন। কোরআনকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের, উদারতা-মানবতার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেন। ইসলামে পুরুষের জন্য বহুবিবাহ, বহুগামিতা, বধূ নির্যাতন, ক্রীতদাসী-সঙ্গমের অনুমতি আছে, এসবকেও নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে তিনি মেনে নেন। জাকির নায়েকের চেয়েও হাজার গুণে ভয়ঙ্কর মোল্লা-মৌলানা আছেন, ভাষণ দিচ্ছেন বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায়, মসজিদে মাদ্রাসায়, ওয়াজ মাহফিলে, ইসলামী জলসায়। ওসব শুনে নির্ঘাত মাথা নষ্ট হচ্ছে প্রচুর মানুষের। ওইসব মোল্লা-মৌলানা অধিকাংশই নারীবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী। জাকির নায়েক যত না মুসলমানদের নষ্ট বানান, তারও চেয়ে বেশি বানান ওইসব মোল্লা-মৌলানা। জাকির নায়েকের পিস টিভি বন্ধ হলে মৌলানাদের মুখ তো বন্ধ হচ্ছে না। ওইসব মুখ তো চলবেই একুশ শতকের সমাজকে সপ্তম শতকে ঠেলে দেওয়ার জন্য, পেছনে, অন্ধকারে, টেনে নেওয়ার জন্য, বদ্ধ ঘরে বন্ধ করার জন্য। সরকারের কাজ ওদের ভাষণের দিকে লক্ষ রাখা, ওরা মানুষকে বর্বর হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে কিনা দেখা। জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা যে কারণে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সে কারণে এদের বাকস্বাধীনতাও কেন কেড়ে নেওয়া হবে না, তার উত্তরও চাই। নায়েক ইংরেজিতে বলেন, অন্যরা অন্য ভাষায় বলেন বলে শ্রোতা কিন্তু নেহাত কম নয়। আসলে শ্রোতা যত বেশি, বিপদ তত বেশি। বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলাকারীরাও নিরীহ শ্রোতা হয়ে ঢুকেছিল বোস্টনের মসজিদে, বের হয়েছিল জঙ্গি হয়ে। মসজিদে কী শিক্ষা দিচ্ছে ইমামরা, খুতবায় কী বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসের পক্ষে মগজধোলাই হচ্ছে কি না— কেউ কি আছে দেখার? আজকাল তো মাদ্রাসা মসজিদকে এককভাবে দায়ী করাও ঠিক নয়, যখন বড়লোকের প্রাইভেট ইস্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকেই বেরোচ্ছে জঙ্গি!

জাকির নায়েক যদি বলেন তিনি সন্ত্রাসের পক্ষে আর মদদ দেবেন না, তিনি সৌদি আরব থেকে সালাফি ইসলামের আমদানি করবেন না, তিনি সুফি ইসলামের মাটিতে কট্টরবাদের চাষ করবেন না, যদি নিজের ভুল শুধরে নেন তিনি, তবে তার অধিকার থাকা উচিত আবার পিস টিভি ফিরে পাওয়ার। মুসলিম বিশ্বে যে হারে সন্ত্রাস চলছে, সতর্ক তো হতেই হবে। পিস টিভি বন্ধ করা যত না বাকস্বাধীনতা লঙ্ঘন করা, তারও চেয়ে বেশি সন্ত্রাসের লাগাম ধরা। মানবতার স্বার্থে এই কাজটি ভারত বাংলাদেশ দু’দেশের সরকার করেছে। এর আগে যুক্তরাজ্য আর কানাডাও নায়েককে নিষিদ্ধ করেছে। বাকস্বাধীনতার পক্ষের অত বড় দুটো দেশ যখন কাউকে নিষিদ্ধ করলো, তার পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো কারণ আছে।

সব সন্ত্রাসীকে হাতে নাতে ধরা সম্ভব নয়। গোপনে কে কোথায় কার মাথায় কী ঢুকিয়ে কাকে সন্ত্রাসী বানাচ্ছে, তাও জানা সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব এবং জঙ্গি দমনে যেটা করা উচিত সেটা হলো জঙ্গি কার্যকলাপ কোথায় চলছে না চলছে তার খবরাখবর রাখা, জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। অবশ্য আমি মনে করি জঙ্গিদের শাস্তি দিয়ে সত্যিকারের জঙ্গি দমন হয় না, জঙ্গিরা কেন জঙ্গি হচ্ছে— কী কথা, কী ভাবনা, কোন বই, কোন আদর্শ, কার মতবাদ, কার উৎসাহ তরুণদের জঙ্গি বানাচ্ছে তা জানতে হবে এবং সেই উৎসগুলোকে নির্মূল করতে হবে, সেগুলো টিকে থাকলে জঙ্গির জন্ম হতেই থাকবে। উৎস একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলে অন্তত বদল বা বিবর্তন ঘটাতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের ভার সব সময় সময়ের হাতে ছেড়ে দিলে কাজ হয় না। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পরিবর্তনগুলো ঘটিয়ে ফেলতে হয়।

কোরআন হাদিস বোঝার জন্য কেন জাকির নায়েকের কাছে যেতে হয়। আরবি যাদের মাতৃভাষা নয়, তারা তো অনুবাদ পড়লেই পারেন। নিজেরা যেভাবে ধর্ম বুঝবেন, সেভাবে বোঝাই তো ভালো। নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করলে অন্যের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হয় না। যার ধর্ম তার কাছে। আমার মা মনে করতেন ধর্ম মানেই ভালো কথা, ভালো কাজ, দরিদ্রকে দান, আর্তের সেবা, ধর্ম মানেই সাম্য, সমতা, সমানাধিকার, ধর্ম মানেই সুস্থতা, সততা, সৌন্দর্য। আমার মায়ের মতো করে সবাই যদি ধর্মের ব্যাখ্যা করে, তবে সমাজে ধর্ম দ্বারা কোনো অশান্তি সৃষ্টি হবে না। এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ জুলাই, ২০১৬

আমার চোখের জলের ঈদ

আমার ধর্মের নাম সোজা ভাষায় মানবতা। আমি বলি মানববাদ। বুদ্ধিজীবীরা বলেন মানবতন্ত্র। অনেকে ভাবেন আমি বুঝি ধর্মগ্রন্থ পড়ি না। সত্য কথা হলো, অনেক ধার্মিকের চেয়ে আমি ধর্মগ্রন্থ বেশি পড়ি। অনেক মুসলমানের চেয়ে কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস বেশি পড়ি। অনেক মুসলমানই জানেন না কোরআন হাদিসে কী লেখা আছে। আমি কিন্তু জানি কী লেখা আছে।   আমার ধর্ম তারপরও ইসলাম নয়, আমার ধর্ম মানবতা। আমি নামাজ পড়ি না, রোজা রাখি না, কিন্তু মানুষের সেবা করি। ছোটবেলা থেকেই করি। কোনো ভিক্ষুককে কোনো দিন ফিরিয়ে দিইনি। কোনো গরিব লোক যখনই সাহায্য চেয়েছে, দিয়েছি। বিনে পয়সায় চিকিৎসা দিয়েছি। ওষুধ কেনার পয়সা নেই, কিনে দিয়েছি। জামা নেই কারো, নিজের জামা দিয়ে দিয়েছি।

বই নেই, বই দিয়েছি। এভাবেই বড় হয়েছি আমি। বড় হয়েও একই কাজ করেছি। এখনো অন্যের কষ্ট দেখে কষ্ট পাই, অন্যকে খাইয়ে আনন্দ পাই, অন্যের সুখে সুখী হই। নিজের কথা ভাবার সময়, নিজের স্বার্থ দেখার সুযোগ আমার হয় না বললেই চলে। তাই বা বলি কী করে, সময় আর সুযোগ হলেই কি আমি নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকতাম! আমার তো মনে হয় না।

নামাজ রোজা না করলেও ঈদের সময় ঈদ করেছি। ছোটবেলার মতো ঈদের আনন্দ বড়বেলায় আর জোটেনি। রোজার ঈদকে আমরা বলতাম ছোট ঈদ, আর কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ। ছোট ঈদের সময় বাড়ির কাজের মেয়েরা জামা জুতো পেতো, এই ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দিতো খুব। সারা বছর কী ভীষণ পরিশ্রম করতো, মলিন কাপড় পরতো, এক ঈদের দিনটায় দেখতাম ওদের হাসিমুখ। ছোটবেলায় আমারও যে খুব কাপড় চোপড় ছিল তা নয়, কিন্তু কাজের মেয়েদের নতুন কাপড় দেখে আমার যে আনন্দ হতো, তা নিজের নতুন কাপড় পাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি ছিল। শাড়ি লুঙ্গি বিলোতাম গরিবদের, এও বড় আনন্দের— বড় ঈদে বড্ড কষ্ট হতো গরুগুলোকে জবাই করা হতো বলে, কিন্তু গরিবদের মাংস বিলোনোটা আমাকে আবার প্রচণ্ড আনন্দ দিতো।

যতদিন বাবা-মা ছিলেন, যতদিন ‘অবকাশে’ আমাদের বাড়িতে ছিলাম, ততদিনই ঈদের সময় আনন্দ হতো। মা যে কত কিছু রান্না করতেন, কত পদের যে রান্না, কী যে সুস্বাদু! কিছুই খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। কত মানুষ যে খেত আমাদের বাড়িতে!

আমাদের ময়মনসিংহের ওই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার জীবনে ঈদের সেই উৎসব আর নেই। ঈদ আসে, ঈদ যায়, কিন্তু আগের মতো আনন্দ নেই। আগের মতো বাবা-মা কাছে নেই, আগের মতো মাংস বিলোনো নেই। গরিবদের শাড়ি লুঙ্গি বিলোনো নেই। ঈদ আমার কাছে অবকাশ, বাবা মা ভাই বোনের সম্মেলন, নতুন কাপড় চোপড়, দানের উৎসব।

দিন দিন অনেক কিছু পাল্টে গেছে। রোজা বলতে আমরা ছোটবেলায় সংযম বুঝতাম। এখন চারদিকে যা দেখি, তা নিতান্তই ইফতার পার্টির রাজনীতি। দুর্নীতিবাজ লোকেরা ইফতার পার্টির আয়োজন করে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য নাকি গুছিয়ে নেন। শুনেছি এইসব হয়। আমি রাজনীতি বুঝি কম। যদিও চিরকালই রাজনীতির শিকার। আসলে মানুষকে অসৎ আমি ভাবতে পারি না, সবাইকেই ভাল মানুষ ভাবি। মন্দ কাজ করলেও ভাবি ভুল করে ফেলেছে, নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হয়েছে পরে।

রোজা-নামাজকেও রাজনীতির শিকার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য রোজা-নামাজ করেন। নিরীহ মুসলিমদের ধোঁকা দিচ্ছেন তিনি। হিন্দু হয়ে মুসলিমদের ধর্ম কর্মের প্রতি তাঁর যদি আকর্ষণই এতো, তাহলে তিনি নিজের ধর্ম বদলে ইসলাম ধর্মই গ্রহণ করতেন। রোজা নামাজ যারা স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে, তারা ভাল লোক নয় বলেই আমার বিশ্বাস। ধর্মটা কারো কাছে নৈতিক শিক্ষা, কারো কাছে রাজনীতি, কারো কাছে পাপ মোচনের অস্ত্র। ধর্মকে কে কিভাবে কী কারণে ব্যবহার করছে তা বুঝতে পারলে আমরা মানুষের চরিত্রও ঠিক ঠিক বুঝতে পারবো। ধর্ম এবং ধার্মিক নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়, গবেষণা হলে আমরা বক ধার্মিকদের মুখোশটাও উন্মোচন করতে পারতাম। সারা জীবন পাপ কাজ করে, মানুষ নির্যাতন করে, চুরি ডাকাতি করে পাড়ায় একটা মসজিদ গড়ে দিলেই তার সাতখুন মাফ হয়ে যায়। এ বড় ভয়ংকর— এ যেন না হয়।

ইসলামের যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তা হলো জাকাত। জাকাতের নিয়ম আছে বলে গরিব দুঃখীরা কিছুটা খেতে পরতে পায়। অবশ্য আমি দারিদ্র্য সম্পূর্ণ ঘুচে যাক চাই, দরিদ্র বলতে কোনও শ্রেণিকে চাই না। কাউকে যেন অন্যের সাহায্য নিয়ে, জাকাত নিয়ে বাঁচতে না হয়। সকলের যেন থাকে অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের অধিকার। সকলের যেন থাকে মত প্রকাশের অধিকার, থাকে বাক-স্বাধীনতা।

ঈদ আসছে। মনে পড়ছে আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িটির কোলাহল। বাড়ির কেউই ধর্মান্ধ ছিল না, মা ছাড়া আর কেউ ধার্মিকও ছিল না। কিন্তু ঈদে দরিদ্রকে সাহায্য করার কাজটি সকলে খুব সিরিয়াসলি করতো। বাবা তাঁর গ্রামের গরিব লোকদের জন্য ট্রাক ভরে নতুন কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিতেন। আমি খুব ভাল করেই জানি, বাবা কোনও প্রতিদানের আশা করে ওসব করতেন না। ডাক্তার ছিলেন, বিনে পয়সায় গরিব রোগী দেখতেন। না, কোনো স্বার্থের জন্য নয়। পরকালে আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করবেন— সে কারণে তো করতেনই না। যদি বেহেস্তের লোভ থাকতো, তাহলে তো তিনি নামাজ পড়তেন পাঁচ বেলা। আমার বাবা নামাজ পড়তে জানতেন না। সুরাও জানতেন না। জীবনে দু’বারই নামাজে দাঁড়াতেন, সে দুই ঈদের সময়। বাবার জন্য ও নামাজ পড়া ছিল না, ছিল মহৎ উদ্দেশে কোথাও শামিল হওয়া। ঈদগাহ মাঠে যেতেন, যেতেন মূলত সামাজিকতার জন্য। মাঠের ওই নামাজ পড়াটা যত না ধর্মের কারণে, তারো চেয়ে বেশি ভ্রাতৃত্বের কারণে।

সম্ভবত আজো যে আমি ঈদ এলে মানুষকে দান করতে, মানুষকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠি, সে আমার বাবার কাছ থেকেই শেখা। কেউ ধর্মের জন্য দান করে, কারও জন্য দান করাই ধর্ম। আমার বাবার কাছে দানটাই ছিল ধর্ম। ঈদ আসছে, বড় বেশি মনে পড়ছে আমার বাবাকে। মনে পড়ছে ছোটদাকেও, আমরা দু’জন তো বড় বড় বালতিতে করে মাংস নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির মাঠে জমা হওয়া গরিবদের বিলোতাম দু’হাতে। সারাবছর যারা মাংস পায় না খেতে, তারা সেদিন কিছু পেতো।   পাওয়ায় কত আনন্দ জানি না, দেওয়ায় অনেক আনন্দ।

আজ আমার বাবা নেই, ছোটদা নেই। মা’ও নেই। ওদের ছাড়া আমার ঈদ ঠিক ঈদ নয়।   যদি ঈদ-ই, এ আমার চোখের জলের ঈদ।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ জুন, ২০১৬

যদি পুরুষ হতাম

‘পুরুষ হলে বেশ হতো। মরে গেলে বছর বছর আমার প্রয়াণ দিবস পালন হতো। এতকাল খেটেখুটে যে ৪৩টা বই লিখেছি তা না লিখলেও চলত। কিছু কবিতা লিখতাম রাজনীতি নিয়ে, কিছু দেশ নিয়ে, কিছু কবিতা ধনী আর পুঁজিবাদীদের গালাগালি করে, কিছু কবিতা প্রেম প্রীতি নিয়ে। একখানা গান লিখতাম। ব্যস। ব্যক্তি হিসেবে যেমনই হই না কেন, যত মিথ্যুকই হই না কেন, যত চরিত্রহীনই হই না কেন, স্ত্রীকে যত এক্সপ্লয়েটই করি না কেন, যত অত্যাচারই করি না কেন, কেউ এসব নিয়ে কথা বলত না। বরং ভালবাসত আমাকে, মাথায় তুলে রাখত। আমার নামে মেলা করত বছর বছর। স্রেফ আমি পুরুষ বলে। পুরুষ হলে যৎসামান্য ট্যালেন্ট থাকলেই সেলেব্রিটি হওয়া যায়। মেয়ে হলে পাহাড় সমান ট্যালেন্ট দেখাতে হয় জাস্ট একটু রিকগনিশন পাওয়ার জন্য’।

উপরের ওই কথাগুলোই কাল আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। আর তাতেই দেখছি কমেন্টসের ঘরে উপচে পড়ছে মানুষের রাগ। আমার ওপর রাগ। কেন বিনয় নেই আমার লেখায়! কেন এত হীনমন্য আমি! কেন মনে মনে এত হিংসে আমার! আমাকে গালি দিতে কখনো কারওর কোনো অসুবিধে হয়নি। আজও হচ্ছে না। আমিই বোধহয় জগতে একজন মানুষ, একজনই লেখক, যাকে গালি দিলে, যার সম্পর্কে অকথ্য ভাষায় মিথ্যে বললে, যার সঙ্গে চরম অন্যায় আর অশোভন আচরণ করলেও কেউ আপত্তি করে না, কেউ অসন্তুষ্ট হয় না। আসলে সত্যি কথা হলো, আমার নিন্দেমন্দ করলে জাতে ওঠা যায়। মানুষ জাতে উঠতেই চায়। জাতে ওঠার এত মসৃণ সিঁড়ি বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। বুদ্ধিজীবী হতে গেলেও কিছুটা তসলিমা বিরোধী না হলে হয় না। এ তো আজ থেকে দেখছি না। পঁচিশ বছর হলো। নারীর আত্মবিশ্বাস কোনোকালেই কেউ পছন্দ করেনি। শত্রুর প্রতিও নারী মায়া দয়া দেখাক, অত্যাচারীকে ভালবাসুক, মানুষ চায়! রুখে ওঠা পুরুষকে মানায়, নারীকে নয়। চোখের জল ফেলা নারীকে মানায়, চোখের জল মুছে চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ানো আর যাকেই মানাক, নারীকে নয়। এ আমরা সকলেই মনে মনে জানি। আমার জানাটা মাঝে মাঝে প্রকাশ করে ফেলে বিপদ বাঁধাই।

আমি কি ভুল কিছু লিখেছি? যদি পুরুষ হতাম, আমাকে কি বাধ্য হতে হতো দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে? নব্বই দশকের শুরুতে দেশে তো আরও নাস্তিক লেখক ছিলেন, তাঁরা তো দিব্যি ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে লক্ষ লোকের মিছিল হয়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়নি, তাঁদের মাসের পর মাস আত্মগোপন করে থাকতে হয়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে সুইসাইড স্কোয়াডও গঠন হয়নি। আমি পুরুষ নই, অথচ আমি ধর্ম নিয়ে কথা বলেছি, আমি নারীর অধিকারকে মানবাধিকার বলে রায় দিয়েছি, আমার ধৃষ্টতা কারওর সহ্য হয়নি। সেই যে সহ্য হয়নি। আজও সহ্য হয় না। বাইশ বছর পার হল, আজও না।

যদি পুরুষ হতাম, আমাকে নিয়ে উৎসব হতো। হ্যাঁ, হতো। নারী নিয়ে একখানা মাত্র অনুবাদ জাতীয় বই লিখলেই হতো। নারী হয়ে নারীর যন্ত্রণা আর পরাধীনতা উপলব্ধি করে নারীর অধিকারের পক্ষে বইয়ের পর বই লিখলে যা হতো, তার চেয়ে বেশি হতো। পুরুষের প্রতিভার প্রচার ততটাই হয়, যতটা হয় নারীর রূপের প্রচার, অথবা তার বদ-চরিত্রের প্রচার। পুরুষ হওয়ার আনন্দ যে কী তা পুরুষ-লেখকদের দেখলেই বুঝি। তাঁদের চরিত্র নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। অতি বদ-পুরুষকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ অভ্যস্ত। দুশ্চরিত্র পুরুষ দ্বারা এক্সপ্লয়েটেড হয়েছি আমি, তারপরও আমাকেই লোকে নিন্দে করেছে, দুশ্চরিত্র পুরুষকে বরং ভালবেসে আলিঙ্গন করেছে, শ্রদ্ধায় নত হয়েছে। এই দৃশ্যের আজো কোনও বদল হলো না।

আমার চরিত্র নিয়ে প্রচুর লোকের মাথাব্যথা। যাদের মাথাব্যথা, তারা আমার সম্পর্কে নানারকম অপপ্রচার বাজারে চালু রেখেছে। এসব অপপ্রচার দিয়ে তরুণ তরুণীদের মগজধোলাই করা খুবই সহজ। আমার বই পড়ে কারও চেতন যদি জেগে ওঠে, তবে যেন অপপ্রচার শুনে চেতনকে হটিয়ে দিতে পারে দ্রুত, এরকম একটি অশুভ চক্র বরাবরই বড় সক্রিয়। একের অধিক পুরুষ আমার জীবনে এসেছে, এ নিয়ে পুরুষের সমাজে নিন্দের ঝড় ওঠে। দুশ্চরিত্র পুরুষ থেকে বাঁচার জন্য কী কঠিন সংগ্রাম আমাকে করতে হয়েছে, কীভাবে একা একা জীবনভর একা থেকেছি— এসব নিয়ে কারও উৎসাহ উত্তেজনা নেই। কোনোদিন শুনিনি কোনও দুশ্চরিত্র পুরুষ-লেখক নিয়ে কোনও নিন্দে। পুরুষ সে ভালো লিখুক কী মন্দ লিখুক, তাকে বিচার করা হয় তার লেখার প্রতিভা দিয়ে। নারী সে ভালো লিখুক কী মন্দ লিখুক, তাকে বিচার করা হয় সে ক’টা পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করলো, তা দিয়ে। যেহেতু তসলিমা তার স্বামীকে ডিভোরস করেছে, তসলিমা খারাপ। আর যেহেতু তসলিমা দ্বিতীয় কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে, তসলিমা খারাপ। এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন নারীর বিরুদ্ধে যাবতীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ হয় সারা পৃথিবীতে, তখনও নারীবিদ্বেষী আচরণের সামান্যও হেলদোল দেখছি না বাংলাদেশে।

প্রশ্ন ওঠে, আরও তো নারী-লেখক আছে, তাদের তো ঘৃণা করা হয় না। ঘৃণা করা হয় না, তার পেছনে নানারকম কারণ নিশ্চয়ই আছে। ওই নারী-লেখকরা নিশ্চয়ই পুরুষ-লেখকদের বা পুরুষ-কর্তাদের আশীর্বাদ পান। ওই নারী-লেখকরা তসলিমার মতো খামোকা অপ্রিয় সত্য কথা লিখতে যান না, সেলেব্রিটিদের গোপন কথা ফাঁস করে দেন না। একের অধিক পুরুষ তাদের জীবনে নেইও। তসলিমা পলিগ্যামাস না হলেও তার সিরিয়াল মনোগামিটাও সহ্য হয় না। কত যে পুরুষের ইচ্ছে করে আমাকে বিবস্ত্র করে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, আমাকে ধর্ষণ করতে। ফেসবুকের ইনবক্সে হাজারো মেসেজ পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু পড়ি। আমাকে নোংরা ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে অথবা আমাকে ধর্ষণ করলে মনের সাধ মিটত, তা লিখছে। ওদের প্রোফাইলে গিয়ে দেখি প্রায় সকলেরই দেওয়ালে প্রার্থনার আহ্বান জানানো। যদি পুরুষ হতাম, আমার ফেসবুক ইনবক্স এসব উপদ্রব থেকে অন্তত বাঁচত।

যুগ বদলেছে। মানুষ আগের চেয়ে আরও নৃশংস হয়েছে। আজকাল পুরুষ-ব্লগারও দিনে দুপুরে খুন হচ্ছে। ধর্মীয় রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ আমরা স্বচোখে দেখছি। গোটা পৃথিবীটা মনে হচ্ছে হাজার বছর পেছনে চলে গেছে। গণধর্ষণও করা হচ্ছে, শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। নারীর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার, পুরুষতান্ত্রিকতার, নারীবিরোধী আইনের আর কুসংস্কারের, মানুষের নারীবিদ্বেষী আচার-আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করছি আজ তিন যুগেরও বেশি। একসময় বলা হত আমি বাড়াবাড়ি করছি, নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার যা পাওয়ার তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে। হ্যাঁ, বলা হত। আমাকে বারবারই একঘরে করা হত। পুরুষবাদি পুরুষরাই শুধু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না, পুরুষবাদি নারীরাও করত। যা ঘটছে চারদিকে, তা দেখেও কি মনে হচ্ছে আমি কখনো কিছু বাড়িয়ে বলেছিলাম?

পুরুষকে চিরকালই আমি সহযাত্রী ভেবেছি। মুশকিল হলো, পুরুষ কখনও আমাকে সহযাত্রী ভাবেনি। ভেবেছে প্রতিপক্ষ, নয়তো অকিঞ্চিৎকর কিছু, নেহাত যৌনবস্তু ছাড়া কিছু নয়। এখনও মানুষের আগ্রহের সীমা নেই ঠিক ক’জনের সঙ্গে আমি শুয়েছি এ নিয়ে। কোনও পুরুষ-লেখক নিয়ে এই আগ্রহ কিন্তু একেবারেই জনসাধারণের মধ্যে নেই। যদি কখনও জানাজানি হয় পুরুষ-লেখকের দ্বিচারিতার কথা, তাতে বরং পুরুষ-লেখককেই হিরো হিসেবে দেখে সবাই। তার ক্যারিশমার বিস্তর প্রশংসা হয়।

যদি পুরুষ হতাম, জীবন অন্যরকম হতো। এভাবে নির্বাসনে কাটাতে হতো না বাকি জীবন। যদি পুরুষ হতাম, আমার সাহিত্য-কর্মের সাহিত্যমূল্য নিয়ে কারও সংশয় হতো না। যদি পুরুষ হতাম, প্রতিভার সঠিক অথবা অধিক মূল্য পেতাম, যদি পুরুষ হতাম, আমাকে লেখক হিসেবে দেখা হত, যৌনবস্তু হিসেবে নয়। যদি পুরুষ হতাম, আমার বই একের পর এক নিষিদ্ধ হতো না, নিষিদ্ধ হলেও বাকস্বাধীনতার পক্ষের লোকেরা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করত। পুরুষ হলে এভাবে যুগের পর যুগ আমার বই জাল হতে পারত না। অন্য কারও নোংরা বই আমার নামে ছাপা হত না। পুরুষ হওয়ার সুবিধে অনেক।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ জুন, ২০১৬

চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন

ওমর মতিন যদি সিরিয়ায় গিয়ে অন্য আইসিস জঙ্গিদের মতো মানুষ জবাই করতো, মেয়েদের যৌনদাসী বানাতো, ধর্ষণ করতো, শেকলে বেঁধে বাজারে বিক্রি করতো তাহলে নিশ্চয়ই আপনারা বলতেন- ও ব্যাটা আমেরিকার সৃষ্টি। আমেরিকাই ওমর মতিনদের আইসিস বানিয়েছে, ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আর ওমর মতিন যখন আমেরিকায় বসেই সন্ত্রাস করে, গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে- তখন কিন্তু আপনারা অন্য কথা বলছেন। আপনারা বলছেন- আমেরিকা, ইরাক, আফগানিস্তানে বোমা ফেলেছে বলে, এখনও সিরিয়ায় ড্রোন আক্রমণ করছে বলে, মুসলমানদের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে একজন মুসলমান। দোষটা আপনারা কিছুতেই সন্ত্রাসীদের দেবেন না, যারা হত্যাযজ্ঞে মেতেছে।

অরলান্ডো ইসলামিক সেন্টারের ধর্মগুরু তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, সমকামীদের খুন করা উচিত। খুন হওয়া ছাড়া সমকামীদের আর কোনও শাস্তি প্রাপ্য নয়। সম্ভবত ওমর মতিন ওই ধর্মগুরুর দ্বারা প্রভাবিত। প্রভাবিত না হলেও মতিন আইসিসের আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশ তো করেছেই।

সমকামীবিরোধী অন্যান্য খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মৌলবাদীদের মতো নয় মতিন। তার ঘৃণাটা অন্যদের চেয়ে বেশি। তার ঘৃণা তাকে গণহত্যাকারী বানিয়েছে। যে ঘৃণা, যে বর্বরতা, আমরা আইসিসদের মধ্যে দেখি এ সেরকম। ওমর মতিন নিজের গায়ে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে ছিল, এ কিন্তু যে কোনও সমকামী বিদ্বেষীদের আচরণ নয়। আত্মঘাতী বোমা আমরা মুসলিম সন্ত্রাসীদের মধ্যেই দেখেছি। নিজেকে হত্যা করে হলেও অন্যকে হত্যা করবো। এমন ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত সকলে নিতে পারে না। তারাই সাধারণত নেয়, যারা একটি ভয়ঙ্কর মতবাদে বিশ্বাস করে। যারা মনে করে অন্যকে হত্যা করলে তার কিছু প্রাপ্তির যোগ আছে।

সন্ত্রাসী উৎপাদনের কিছু কারখানায় তো যুবকদের রূপবতী যৌনদাসীর লোভ দেখানো হয়। ওমর মতিনের সাথে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। স্ত্রীর অভিযোগ, স্বামী তাকে মারতো। এই লোক সমকামীদের মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না। নারীর মানবাধিকারেও তার কোনও বিশ্বাস নেই। যারা অবলীলায় মানুষ খুন করতে পারে, তারা স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও মানুষেরই বাঁচার অধিকারে বিশ্বাস করে না।

যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে এরা, তবে কেন আল্লাহর ওপরই ভরসা করে না যে আল্লাহই এদের শাস্তি দিবেন শেষ বিচারের দিনে? আল্লাহর বিচারে যাদের আস্থা নেই তাদের কোনও মুসলমান বলে ভাবা হয়? আজকাল কট্টরপন্থি কোনও মুসলমানকেই দেখছি না আল্লাহর বিচারের প্রতি আস্থা রাখতে! কেন বাপু, শাস্তিটা সর্বশক্তিমান আল্লাহই দিক।

দেখে শুনে মনে হচ্ছে, এরাই নিজেদের সর্বশক্তিমান বলে মনে করে। এরাই শিরক করছে। আল্লাহর সমকক্ষ ভাবছে নিজেদের। শিরক কিন্তু কবিরা গুনাহ। জঙ্গি সন্ত্রাসীগুলো শিরক করে চলছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কোনও সত্চরিত্র মুসলমানদের দেখা পাওয়া যায় না কেন? আবু বকর আল বাগদাদী এখন মৃত, এমন খবর শোনা যাচ্ছে। যদি আবু বকর আল বাগদাদীর মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে কি তার সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিসও মৃত? আমার মনে হয় না। কারণ আল বাগদাদী প্রচুর আল বাগদাদী তৈরি করে গিয়েছেন। সেই বাগদাদীর জন্ম দেওয়া বাগদাদীরা এখন সন্ত্রাস করে যাবে পৃথিবীর সর্বত্র। যারা সরাসরি বাগদাদীর সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসের দীক্ষা নিয়েছে, তারা তো করবেই। যারা দূর থেকে বাগদাদীর সন্ত্রাস দেখে মুগ্ধ হয়েছে, তারাও করবে সন্ত্রাস। যেমন ওমর মতিন। ওমর মতিন দূর থেকেই বাগদাদীকে আদর্শ বলে মেনেছে। দূরে বসেই সন্ত্রাস করছে। সে নিজেই মানুষ খুন করার আগে বলে নিয়েছে সে আইসিসকে সমর্থন করে। ওমর মতিনের সন্ত্রাসকে তাই আইসিসের সাথে সম্পর্ক নেই বা মৌলবাদীদের সাথে সম্পর্ক নেই বলা ঠিক নয়।

বাগদাদীদের জঙ্গি কার্যকলাপ কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশে, নির্দিষ্ট সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত হবে এরকম ভাবা প্রচুর ভুল। জঙ্গিরা সবখানে। আমাদের আশপাশেই। আমরা জানি না। ওমর মতিনকে দেখে কেউ কখনও ভেবেছিল ১২০ মাইল গাড়ি চালিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে ও মেরে ফেলতে পারে ঠাণ্ডা মাথায়? এরকম খুনি হয়তো আমার আপনার প্রতিবেশী। যাদের আমরা কল্পনাও করি না যে ট্রিগার টিপতে পারে বা হাসতে হাসতে মানুষকে জবাই করতে পারে।

জানি না এই পৃথিবী কোথায় যাচ্ছে, কোথায় যাবে। অনেকে বলে ইসলামী সন্ত্রাস ছাড়াও অন্যান্য সন্ত্রাসে বেশি খুন হয় মানুষ। তা হয়তো ঠিক। ক্ষুধায়, পিপাসায়, দুর্ঘটনায়, দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু হয় অনেক। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও এ যাবৎ মানুষ হত্যা কম করেনি।   কিন্তু এক মন্দ আছে বলে আরেক মন্দ থাকতে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। সব মন্দের বিরোধী পক্ষ আছে। তবে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদের প্রতিপক্ষ কেন থাকা চলবে না? কেন প্রতিপক্ষকে ইসলাম বিদ্বেষী বলে আখ্যা দেওয়া হবে, ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইসলামোফোব’। এই শব্দটি সম্প্রতি রেসিস্ট বা বর্ণবাদী শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে কারণে মানুষ ইসলামবিদ্বেষী শব্দটি শুনতে পছন্দ করে না, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে।

ওমর মতিনের সংখ্যা মুসলিম দেশে প্রচুর। বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিজীবী হত্যা করছে, তাদের সঙ্গে ওমর মতিনের পার্থক্য কী? ওরা দিনে বা সপ্তাহে বা মাসে একজন মানুষ হত্যা করে। আর ওমর মতিন একই দিনে একই সঙ্গে পঞ্চাশজনকে মেরে ফেলে, বাকি পঞ্চাশকে হাসপাতালে পাঠায়। ওমর মতিন নিশ্চয়ই প্যারিসের কনসার্ট হলের খুনিদের কাছ থেকে অথবা শার্লি হাবদোর খুনিদের কাছ থেকে শিখেছে কীভাবে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়তে হয়। প্যারিসের গণহত্যাকারীদের দেখে ওমর মতিনের আগ্রহ জন্মেছে গণহত্যা করার। ওমর মতিনের গণহত্যা দেখে বোধহয় আরও অনেকের গণহত্যায় আগ্রহ জন্মাবে। তারপর দলে দলে যোগ দিবে নির্বিচার গণহত্যায়।

মুসলমানদের জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে পারে মুসলমানরাই। পাশ্চাত্যের মসজিদে যেমন মগজধোলাই চলে, এখানেও খুত্বায়-ওয়াজে একই রকম মগজধোলাই চলে। মগজধোলাই যতদিন থাকবে, সন্ত্রাসবাদ থাকবে। মগজধোলাই ততদিন থাকবে, যতদিন মগজে কোনও মগজ না থাকবে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ জুন, ২০১৬

রোজা রাখার স্বাধীনতা

মুসলমানের রোজার সঙ্গে স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতার সম্পর্ক বেশি। সম্প্রতি চীনের সরকার চীনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে রোজা নিষিদ্ধ করেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, কর্মী ও শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কারও বেলায় অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। স্বাস্থ্যের কারণে শিক্ষার্থীদের রোজা রাখা ঠিক নয় বুঝি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কমিউনিজমে এবং নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হওয়ার শর্ত যেহেতু আছে, তাদেরও রোজা রাখাটা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলে তো নাস্তিক নয়, তারা যদি রোজা রাখতে চায়, তবে রোজা রাখতে তাদের কেন বাধা দেওয়া হবে? সরকার নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইছে, রোজা রাখলে যেহেতু শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করে, দিনের বেলায় আপিস-টাইমে সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু অনেকে যারা রোজা রেখেও দিব্যি ক্লান্তিহীন কাজ করে যেতে পারে, তাদের রোজা রাখার অধিকার কেন থাকবে না? সব রোজদার তো অফিসে বসে ঝিমোয় না! চীনের সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার নিন্দে করছি আমি।

চীনে, এমন নয় যে, মুসলিমদের শুধু রোজা রাখারই স্বাধীনতা নেই। ধর্মবর্ণলিঙ্গ নির্বিশেষে কারোরই বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার নেই চীনে। সরকারের সমালোচনা করার কোনও অধিকারই নেই কারোর। লেখক সাংবাদিকরাও মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। চীনের পত্রপত্রিকা কোনওটিই সরকারি মতের বাইরে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারে না। গণতন্ত্রবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য চীনকে বিশ্বের লোক নিন্দে করে। মুসলিমদের রোজা রাখার অধিকার হরণ করার কারণেও নিন্দে করে। চীন অবশ্য বলে দিয়েছে, মুসলিম জঙ্গি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেই মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোয় রোজার সময় কড়া নজর রাখে চীন-সরকার। রমজান মাসে ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ না রাখার পক্ষে আমি। চীনের সরকার এই কাজটি কিন্তু মন্দ করেনি। ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ করলে অমুসলিমদের মুশকিল হবে।

রোজা নিয়ে মুসলিম দেশগুলো চীন যা করছে তার উল্টোটা করছে। রোজা না রাখলে বাইরে কিছু খাওয়া, বা কিছু পান করা নিষেধ। মুসলমানদের মধ্যে অনেকে রোজা রাখতে চাইলেও অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারে না, তাদের ওষুধপত্র খেতে হয়, নিয়মিত খাবার খেতে হয়, ঘরে হয়তো রান্নাবান্নার আয়োজন নেই, তারা কোথায় খাবে যদি বাইরে খাবারের দোকান সব বন্ধ থাকে? মুসলিম দেশে তো শুধু মুসলিম বাস করে না, অমুসলিমও বাস করে। নাগরিক হিসেবে বা বসবাসকারী হিসেবে তাদের কেন অধিকার থাকবে না ক্যাফে-রেস্তোরাঁয় খাওয়ার? রাষ্ট্র কিন্তু সবার জন্য, শুধু সংখ্যাগুরুদের জন্য নয়, সংখ্যালঘুদের জন্যও। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু— সবাইকে সমান চোখে দেখা সরকারের দায়িত্ব।

যারা রোজা রাখতে চায় তাদের অধিকার আছে রোজা রাখার। যারা রোজা রাখতে চায় না, তাদেরও অধিকার থাকা উচিত রোজা না রাখার। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে ধার্মিক হওয়ার, অধিকার আছে ধার্মিক না হওয়ার। সারা পৃথিবীতেই দেখি ধর্মকর্ম করার সব রকম অধিকার মানুষের আছে। শুধু তাই নয়, ধর্মে যাদের অবিশ্বাস, তাদের নিন্দে করার অধিকারও ধার্মিকদের আছে। কিন্তু ধর্মে অবিশ্বাসীদের, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই, ধর্মবিশ্বাসীদের নিন্দে করার অধিকার নেই। নিন্দে করলে খুন হয়ে যেতে হয়, অপদস্থ হতে হয়, মামলায় ফাঁসতে হয়, জেল খাটতে হয়, নির্বাসনে যেতে হয়।

ইসলামের যারা পণ্ডিত, তারা সব সময় বলেন, ‘কোরআন বলেছে, ‘ধর্মে কোনও জোর জবরদস্তি নেই। ’ ইসলামের পক্ষে, আমার মনে হয়, এটিই শ্রেষ্ঠ বাক্য। কিন্তু রোজার বেলায় কেন এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয় না? কেন বলা হয় না ‘রোজার ব্যাপারে কোনও জোর জবরদস্তি নেই?’ ধর্মে যদি জোর জবরদস্তি না থাকে, নামাজ রোজাতেও জোর জবরদস্তি নেই। তবে কোরআন যা বলেছেন বলে মুসলিমরা গৌরব করে, সেটির চর্চা কেন মুসলিমরা করে না? ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই, আল্লাহ বলেছেন। আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর উপদেশকে মেনে চলবে, এ তো সকলেই আশা করে।

বাংলাদেশে এক হিন্দু পুরোহিতকে জবাই করে সন্ত্রাসীরা তাদের রমজান শুরু করেছে। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরও খুন করা হচ্ছে। সেদিন বোরখা পরা এক হিজাবি মেয়েকে খুন করা হলো, কারণ তার স্বামী মৌলবাদ-বিরোধী। কারও নিরাপত্তা আজ বাংলাদেশে নেই।

ইসলাম যদি আরও উদার না হয়, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি মুসলিমদের। আজ বিশ্বের অগুনতি মানুষ মুসলিমদের নিন্দে করছে। অনেকে তাদের আর বিশ্বাস করছে না। মুসলিম নাম শুনেই ছিটকে সরে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে। মুসলিমরা দুনিয়া জুড়ে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে অসহিষ্ণু, ঘাতক, বর্বর বলে চিহ্নিত হচ্ছে। ইসলামকে উদার করার দায়িত্ব নিতে হবে মুসলিমকেই। বিশ্বের কাছে মুসলিমদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা সন্ত্রাসী আর অসহিষ্ণু নয়, তারা জঙ্গিদের সমর্থন করে না, তারা ক্ষমায়, উদারতায়, স্বাধীনতায় এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, তারা মানুষের মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে। মানবাধিকার আর গণতন্ত্রকে সম্মান না করলে বিশ্বের বিবেকবান মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার কোনও পথ খোলা নেই।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম না হয়েও নামাজ পড়েন, রোজা করেন। যদিও আমরা সবাই বুঝতে পারি এসব তিনি মন থেকে করেন না, মুসলিমদের ভোট পাওয়ার জন্য করেন, কিন্তু তারপরও আমি মনে করি না তার নামাজ রোজায় কারও বাধা দেওয়া উচিত। তার অধিকার আছে যে কোনও ধর্ম পালনের। একসঙ্গে একাধিক ধর্ম পালনের অধিকার কে বলেছে কারও নেই? কোনও ধর্ম পালন না করার অধিকার যেমন মানুষের আছে, এক এবং একাধিক ধর্ম পালনের অধিকারও মানুষের আছে। তবে একটি কথা কেউ যেন ভুলে না যায় যে, রাষ্ট্রের চোখে ধর্ম পালন যে করছে এবং যে করছে না— দুজনের গুরুত্বই সমান, দু’ব্যক্তির অধিকার সমান।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ জুন, ২০১৬

দেশের ভবিষ্যৎ

কত যে শুনেছি সেকালের চেয়ে একালের ইস্কুলে পড়াশোনার মান উন্নত। একালের ছাত্রছাত্রী সেকালের ছাত্রছাত্রীর চেয়ে চালাক-চতুর। একালের ছেলেমেয়েরা জানে বেশি, বোঝে বেশি। এরা যেভাবে কমপিউটারের নাড়িনক্ষত্র বুঝতে পারে, যেভাবে মোবাইল চালাতে পারে, ভিডিও গেইম খেলতে পারে, সেভাবে আমাদের জেনারেশন পারে না। একালের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, আমরা সেকালের মানুষ একটু বুদ্ধিদীপ্ত কথাই বলতে চেষ্টা করি। কারণ, লক্ষ করেছি, আমরা বোকা বোকা প্রশ্ন করলে বা তাদের প্রশ্নের বোকা বোকা উত্তর দিলে তারা একবাক্যে আমাদের গবেট বলে তুচ্ছাতিতুচ্ছ করে, আড়ালে হাসাহাসিও করে। তা করুক, এখনকার শিশু কিশোরদের জ্ঞান আমাদের, আমরা যখন শিশু কিশোর ছিলাম, তার চেয়ে বেশি— ভাবতে আমার ভালো লাগে। যে বয়সে আমরা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বেশি কিছু জানি না, সেই বয়সে এরা অনেক জানে। ছেলেমেয়েরা দিন দিন স্মার্ট হবে, এই তো চাই। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্মার্ট হওয়া মানে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া।

সেদিন বাংলাদেশের জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছ’জন ছাত্রছাত্রীর টিভি-ইন্টারভিউ দেখে আমি রীতিমত থ। অতি সোজা কিছু প্রশ্নের উত্তরও কেউ দিতে পারেনি, দিলেও ভুল দিয়েছে। আমার বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল যে এই ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশের ভালো ছাত্রছাত্রী। যদি বাংলায় না হয়ে ইংরেজিতে প্রচার হতো অনুষ্ঠানটি, তাহলে দুনিয়া জানতে পারতো বাংলাদেশ কী পয়দা করছে বছর বছর। অনেকে হয়তো পুরো ব্যাপারটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো। ভাবতো, জঙ্গি পয়দা করার চেয়ে গাধা পয়দা করা অনেক ভালো।

কিন্তু গাধা পয়দা করে কী লাভ হচ্ছে দেশ ও দশের! গাধাদের মানুষ করার দায়িত্ব তো কাউকে না কাউকে নিতে হবে! কে নেবে! আজকাল ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে ছেলেরা, ননীটা ছানাটা খেয়ে মানুষ। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীকে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়, ইস্কুল থেকে তাদের নিয়েও আসা হয়। দামি দামি প্রাইভেট টিউটর দিয়ে পড়ানো হয়। বাবা মা আত্মীয় স্বজন তাদের নিয়ে তাবড় তাবড় সব স্বপ্ন দেখেন।

সেকালে আমাদের ঘরভর্তি ভাইবোন ছিল। কারও ওপর বিশেষ নজর দেওয়ার সময় আমাদের অভিভাবকদের ছিল না। আমরা ভাইবোনেরা হেঁটে হেঁটে নিজেরাই ইস্কুলে গিয়েছি। নিজেরাই ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি। আমাদের মুখে তুলে কেউ খাইয়ে দেয়নি, নিজেরাই খেয়েছি। টিউটর ছিল না, আর থাকলেও ইস্কুলের কোনও শিক্ষকই সস্তায় পড়িয়ে যেত। এভাবে হেলা ফেলায় পড়েও মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাস করেছি। যে প্রশ্নগুলো জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের করা হয়েছে, সেই মানের প্রশ্ন যদি সেকালে আমাদের করা হতো, আমার বিশ্বাস, আমরা অনায়াসে সেসবের উত্তর দিতে পারতাম। তাহলে কি একালের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে বেশি মেধা, বেশি ধীশক্তি আমাদের ছিল? হ্যাঁ বা না ধরনের সাদামাটা উত্তর এখানে মানায় না।

অনেকে মাছরাঙা টিভিকে দোষ দিচ্ছে। কারণ মাছরাঙাই ছাত্রছাত্রীদের বোকা-বোকা-কথা সারা দেশকে দেখিয়েছে। এখন অপমানে লজ্জায় যদি ছাত্রছাত্রীরা আত্মহত্যা করে, তার দায় কে নেবে! মাছরাঙা নেবে? ওদের নাকি কঠিন প্রশ্ন করাই উচিত হয়নি, ওদের মুখও নাকি টিভিতে দেখানো উচিত হয়নি! ননীটা ছানাটা খেয়ে বড় হওয়া ছাত্রছাত্রীরা যে কিছু সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর জানে না, তা প্রচার হলে অসুবিধে কী! আমার তো মনে হয় প্রচার হলেই বরং ভালো। ছেলেমেয়েরা এমনিতে অহংকারে মাটিতে পা ফেলতে চায় না, প্রচার হলে লজ্জিত হবে। প্রচার হলে অহংএর ধারটা একটু কমবে। মাধ্যমিকে গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া ছাত্রী ইত্তিলা রায় কিন্তু জিপিএ প্লাসদের ডিফেন্ড করছে, বলছে, “কিছু প্রশ্ন মানুষ নার্ভাস হয়ে ভুল করে ফেলে। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের প্রায় সবার জীবনেই ঘটে থাকে। এ নিয়ে আমরা পরে মনে মনে হাসি। কিন্তু এই ছাত্রদের তো নিজেদের ভুলের কথা মনে করে নিজের মনে হাসার কোন উপায় নেই, সমগ্র দেশ তাদের নিয়ে হাসছে। আমাদের অঙ্ক বইয়ে উপপাদ্য ২৪ ছিল সম্ভবত পীথাগোরাসের উপপাদ্য। সেটা উপপাদ্য ২৪ হিসেবেই লেখা ছিল। অঙ্ক বইয়ের কোথাও পীথাগোরাস কে, এ সম্পর্কে কোন তথ্য ছিল না। সেক্ষেত্রে কোন ছাত্র যদি জানতে না পারে যে সে, যে উপপাদ্য ২৪ লিখে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছে, সেটা আসলে পীথাগোরাসের সৃষ্টি তবে তাকে কিন্তু দোষ দেয়া যায় না। হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলবেন অনেকেই। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম না জানাটা কোন অপরাধ না। বর্তমান বাংলাদেশের বিরোধী দল কোনটি জানতে চাইলে ৮০ ভাগ মানুষ বলবে বিএনপি। অথচ বর্তমান বিরোধী দল হল, জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলের নেতার নামটি ক’জন বলতে পারবে এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, বাংলাদেশে রওশন এরশাদকে ক’জন চেনে?’

ইতু বলেছে, ইস্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে বিশ্রামের তার সময় হতো না, হোমওয়ার্ক করতে হতো, একের পর এক প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হতো। আরও বলেছে, ‘বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার প্রতিটি স্টুডেন্টের ডেইলি রুটিন। রেজাল্ট যাই হোক, সেটার পিছনে ছুটতে গিয়ে বর্তমানে স্টুডেন্টরা তাদের শৈশব-কৈশোরকে হারিয়ে ফেলছে। এক ধরনের বিশ্রী প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখে প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে রয়েছি আমরা। এরজন্য মোটেই স্টুডেন্টরা দায়ী নয়, দায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা। দায়ী আমাদের শিক্ষকেরা, আমাদের বড়রা। তাই স্টুডেন্টদের ভুল নিয়ে হাসাহাসি না করে বরং এ থেকে পরিত্রাণের কার্যকরী কোন উপায় বের করাই আমাদের গুরুজনদের দায়িত্ব’।

ইতুর বক্তব্যের সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ মানুষ একমত হবেন। আমিও মনে করি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার, শিক্ষকদেরও পরিবর্তন আনতে হবে পড়ানোর পদ্ধতিতে। কিন্তু ছাত্রদের কোনও উপদেশই দেবো না, এ কেমন কথা! ছাত্ররা হুটহাট আত্মহত্যা করে ফেলে বলে ভুলটাকে ভুল বলা যাবে না? সত্যটাকে প্রকাশ করা যাবে না?

টিভিতে প্রশ্নোত্তর প্রচার হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের কেউ আত্মহত্যা করুক, বা আত্মহত্যার কথা সামান্যও চিন্তা করুক, তা আমি চাই না। কিন্তু ওরা সব জানে, সব বোঝে, ওরা জ্ঞানের ভাণ্ডার— এমন মিথ্যেও আমি চাই না শুনতে। নিজের ভুল দেখার পর মানুষ শুধরে নেয় ভুলগুলো। কিন্তু নিজের ভুল নিজে না দেখলে, বা কেউ চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে নিজেরা শুধরোবে কী করে! আমার তো মনে হয়, সাক্ষাৎকারটি প্রচার হওয়ার পর অনেক ছাত্রছাত্রীই শুধু পরীক্ষা-পাসের জন্য পড়া মুখস্থ করবে না, যা পড়বে বুঝে পড়বে, পড়ার বাইরেও চোখ কান খোলা রাখবে, নানা বিষয়ে কৌতূহলী হবে, জানবে, শিখবে। অন্তত উৎসাহ তো পাবে। খানিকটা কুণ্ঠিত আর লজ্জিত হওয়ার কারণে যদি বড় সুফল পাওয়া যায়, তবে নয় কেন?

তরুণদের মনোবল বাড়া উচিত। ইস্কুলের দিদিমণি ধমকেছে, গলায় দড়ি দাও, রেজাল্ট ভালো হয়নি, গলায় দড়ি দাও, পড়া পারিনি, গলায় দড়ি দাও। এভাবে ক’দিন! যত যা কিছুই ঘটুক, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হলে বা দিদিমণি বকলে, গলায় দড়ি দেওয়ার কথা আমার তো মনে হয় না আমরা সেকালে ভেবেছি। আত্মহত্যার হার আজকাল ভয়ঙ্কর রকম বাড়ছে। মাছরাঙার সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া ছাত্রছাত্রীরা, আশা করি আত্মহত্যা না করে, হতাশায় না ভুগে, প্রমাণ করবে তাদের মনোবল প্রচণ্ড। আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগছে, দ্বিতীয়বার কোনও সাংবাদিক ওদের কোনও প্রশ্ন করলে ওরা সব প্রশ্নের, অথবা অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর সঠিক দেবে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ জুন, ২০১৬

এই বাংলাদেশ আমার অচেনা

আজ বাইশ বছর নেই দেশে। দেশের অবস্থার কথা যা শুনছি, যা পড়ছি তা ভয়ঙ্কর। দিন যত যাচ্ছে, ততই যুক্তিবাদী আর প্রগতিশীল মানুষ খুন হচ্ছে। একসময় ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বললে মৌলবাদীরা পথে নামতো, যুক্তিবাদীদের ফাঁসি দাবি করতো। এখন ধারালো ছুরি দিয়ে কোরবানির গরু ছাগল যেভাবে জবাই করে, সেভাবে যুক্তিবাদীদের জবাই করে। গরু ছাগল যেমন সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে জবাই করে, মানুষগুলোকেও তাই করে। খুনির সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকম বেড়ে গেছে দেশে। মানুষ কী করে বাংলাদেশে নিজেদের নিরাপদ মনে করে, আমি জানি না। আপস করে চললে অথবা মুখ বুজে চললে অথবা সন্ত্রাসে সমর্থন জানালেই সম্ভবত নিরাপত্তা মেলে। দেশে যখন ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, ব্লগার একের পর এক খুন হচ্ছে, তখন মানুষ কিন্তু খুনের প্রতিবাদ করছে না, রুখে দাঁড়াচ্ছে না, বরং যে যার জীবনযাপন করে যাচ্ছে, যেমন করছিল। না, এই বাংলাদেশকে আমি চিনি না।

আমার বরং চেনা মনে হয়েছে অন্য একটি বাংলাদেশকে যে বাংলাদেশে শত শত মানুষ শ্যামলকান্তি ভক্ত নামের এক ইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এই প্রতিবাদ দেখে দেশ নিয়ে আমার মরে যাওয়া আশাগুলো ফের জীবন ফিরে পেয়েছে। শাহবাগের আন্দোলন যেমন আমার দীর্ঘ বছরের হতাশাকে বাঁচিয়েছিল একবার। কিন্তু এই যে প্রতিবাদ, তা কি নির্যাতিত প্রধান শিক্ষকটিকে বাঁচাতে পারবে? ভয়ঙ্কর আরও যেসব খবর পাচ্ছি, আমার তো মনে হয় না বাঁচাতে আদৌ পারবে। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা হচ্ছে শ্যামলকান্তির। মেডিকেলে ঢুকে শ্যামলকান্তিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে কিছু জঙ্গি দল। এবং করছে প্রকাশ্যেই। ফেসবুকে। সবাইকে জানিয়েই। এখন হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাতে সন্ত্রাসীরা আর রাতের আঁধারের জন্য অপেক্ষা করে না। ঝাড় জঙ্গলও খোঁজে না। ছুরি ধারিয়ে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়েই কারও বাড়িতে ঢুকে কাউকে কুপিয়ে বুক ফুলিয়েই হেঁটে হেঁটে সবার সামনে দিয়ে চলে যায়। তাদের রোধ করে কার সাধ্য বাংলাদেশে?

খবরে পড়লাম, “নারায়ণগঞ্জ ইস্কুলের লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তর বিরুদ্ধে ‘ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামকে গালিগালাজ’ করার অভিযোগ এনে তাকে হত্যার টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে তার প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ফেসবুকে একাধিক পেজ থেকে দেওয়া হয়েছে উস্কানিমূলক পোস্ট। শুধু তাই নয়, ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ ও ‘নবী-সা. এর কটূক্তির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ নামের পেজ ইভেন্ট খুলে শ্যামলকান্তিকে হত্যার টার্গেট লক করে দেওয়া হয়েছে এবং ঘোষণা দেওয়া হয়েছে— শ্যামলকান্তি ভক্ত এখন ঢাকা মেডিকেলে আছে। কে আছো শ্যামলকে ঢাকা মেডিকেলের ভিতরই বিজ্ঞানী বানাবে? ঢাকা মেডিকেলের ভিতর বিজ্ঞানী বানালে লাশ পরিবহনের জন্য সরকার ও পুলিশের সময় ও খরচ অনেক কমে যাবে। ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ নামের পেজ থেকে শ্যামলকান্তিকে হত্যা করার ১১টি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়। ‘নবী-সা. এর কটূক্তির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ থেকে শ্যামলকান্তির নাম পরিচয় দিয়ে অপরাধ হিসেবে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামকে গালিগালাজকারী উল্লেখ করা হয় এবং তাকে বিজ্ঞানী বানানো হোক। তারা হত্যা করার সংকেত-শব্দ হিসেবে ‘বিজ্ঞানী বানানো’ ব্যবহার করে থাকেন। ”

আমার আশঙ্কা, শ্যামলকান্তিকে এক দিন কুপিয়ে মেরে ফেলা হবে। এ কিন্তু এই কারণে নয় যে ইসলাম নিয়ে শ্যামলকান্তি কটূক্তি করেছেন। শ্যামলকান্তি ইসলাম নিয়ে কোনও কটূক্তি করেননি। রিফাত নামের যে ছাত্রটির সামনে কটূক্তি করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেই ছাত্রই বলেছে শিক্ষক কটূক্তি করেননি। অবশ্য রিফাত তার মত বদল করেছে হেফাজতিদের অনুষ্ঠানে। মত বদল না বলে বরং মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছে বলা চলে। শ্যামলকান্তিকে মেরে ফেলা হবে কারণ শ্যামলকান্তিকে হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাসীরা খুনের জন্য টার্গেট করেছে। বাংলাদেশের মৌলবাদীদের শক্তি এবং সাহস বাংলাদেশের সরকারের চেয়েও অনেক বেশি। সরকারও সন্ত্রাসীদের সমীহ করে চলতে বাধ্য হয়।

এই বাংলাদেশটি আমার অচেনা, যে বাংলাদেশে কোরবানির গরু ছাগল জবাই করার মতো বুদ্ধিজীবী জবাই করা হয়, যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের ছাড়া আর কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। আমার এক পরিচিত ব্লগার জুলিয়াস সিজারের কিছু কথা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। উনি লিখেছেন, ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে হত্যা করা যাবে তার পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়েছে। এখন সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কি ভূমিকা নিয়েছে এই ব্যাপারে? আইসিটি অ্যাক্ট ৫৭ ধারা নীরব কেন?— এই ব্যাপারে সরকার নীরবই থাকবে। কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। এই প্রসঙ্গে কিছু পুরনো বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি।

নয়ন চ্যাটার্জি, অনিমেষ রায়, বখতিয়ারের ঘোড়া, সালাহউদ্দিনের ঘোড়া, দস্তার রাজদরবার, বাঁশেরকেল্লা এরকম ডজনখানেক পেইজ ফেসবুকে আছে যেগুলো থেকে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী উসকানি দেওয়া হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য এসব পেইজ থেকে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তাঁদের সবাই-ই খুন হয়েছেন। বাঁশেরকেল্লা পেইজ থেকে অভিজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তিনি ইসলাম বিদ্বেষী বলে। প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলি দেবীকে নিয়েও। এই দুইজনকেই নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসলামী মৌলবাদীরা। এই কাজটি ফারাবিও তার আইডি থেকে করেছিল। ফারাবি যে কাজগুলো করতো যেমন- কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া; ঠিক একই কাজ বর্তমানে করছে ‘নয়ন চ্যাটার্জি’ এবং ‘অনিমেষ রায়’ নামের পেইজ দুইটি।

সম্প্রতি অনিমেষ রায় পেইজটি থেকে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া হয়। তার পরপরই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু খুন হন।

কি জানি এইসব পেইজের সাথে এই হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পর্কিত কি না। সব সম্ভবের বাংলাদেশে সবই সম্ভব।

এরকম নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার পরেও, কোনো ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া কিংবা হত্যার জন্য প্ররোচিত করার পরেও এই পেইজগুলোর বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উপরন্তু মৌলবাদীদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকারীদের ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ আখ্যা দিয়েছে সরকার এবং প্রশাসন।

বিপরীতে আল্লাহ কিংবা নবী-রসুল নিয়ে দেশের কোন গলিতে বসে কে পেইজ চালাচ্ছে তাঁদের ঠিকই গ্রেফতার করা হয়েছে। এমনকি ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্যও গ্রেফতার হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। স্রেফ পাশের বাড়ির শয়তানকে ঢিল মারার কথা লিখে ৫৭-ধারায় গ্রেফতার হয়েছেন মোহন কুমার মণ্ডল। ‘শয়তান’ এবং ‘ঢিল’ লিখলেও অপরাধী! অথচ প্রকাশ্যে মানুষকে হত্যার হুমকি দেওয়া, সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া, নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর পেইজগুলোর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

জুলিয়াস সিজার প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশ তুমি কার? এই প্রশ্নটি আমারও। অবশ্য প্রশ্ন করার কোনও হয়তো প্রয়োজন নেই। উত্তরটি, আমরা আশঙ্কা করছি, আমরা হয়তো জানিই। বাংলাদেশ যদি ওই সন্ত্রাসীদের, ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করছে, তাদেরই হয় শেষ অবধি, সেই বাংলাদেশকে আমি চিনি না। চিনতে চাইও না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ মে, ২০১৬

কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা

১.

বাংলাদেশের একজন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা সন্ত্রাস করে, খুন করে, জঙ্গিবাদ করে, দুর্নীতি করে, চাঁদাবাজি করে তারা প্রতিবন্ধী। ’

সাধারণত ভ্রূণের বেড়ে ওঠায় কোনও ব্যাঘাত ঘটলে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়। মানসিক প্রতিবন্ধীদের বুদ্ধিশুদ্ধি সাধারণ মানুষের চেয়ে কম। প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধী হওয়ার পেছনে নিজেদের কোনও হাত নেই। এ তাদের    দোষ নয় যে তারা প্রতিবন্ধী। নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয় ওরা। আমরা প্রতিবন্ধীদের করুণা করি, দয়ামায়া করি, দেখভাল করি। ওরা নিরীহ। মানুষের জটিলতা, ঘৃণা, ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন খারাবি শিখতে মানসিক প্রতিবন্ধীরা অপারগ। সন্ত্রাসী, খুনি, জঙ্গিদের প্রতিবন্ধী আখ্যা দেওয়া মানে প্রতিবন্ধীদের অপমান করা। প্রতিবন্ধীরা সন্ত্রাস করে না, খুন করে না, দুর্নীতি করে না, চাঁদাবাজি করে না। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী; প্রতিবন্ধী নয়। তারা সন্ত্রাসী হয়েছে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে নয়। তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী হলে তাদের সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে রাজনীতি একটা কারণ। সন্ত্রাসীরা জেনে বুঝেই সন্ত্রাসী হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা দোষী। সন্ত্রাসীদের মানসিক প্রতিবন্ধী বলার মানে তাদের নির্দোষ বলা।

প্রতিমন্ত্রী, শুনছেন?

২.

বাংলাদেশের কাণ্ডকারখানা দেখে বড় দুঃখ হয়, বড় রাগ হয়। সেদিন নারায়ণগঞ্জের এক ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে যখন একপাল লোক অসৎ উদ্দেশে হেনস্থা করছিল, সরকারি এক প্রতিনিধি এসে ওই লোকগুলোকে শাস্তি না দিয়ে শাস্তি দিলেন শিক্ষককে। শিক্ষককে তাঁর ছাত্র এবং গ্রামবাসীর সামনে কান ধরে ওঠবস করতে হলো। শিক্ষকের এই অপমান, এই লাঞ্ছনা কোনও সুস্থ সচেতন মানুষের ভালো লাগার কথা নয়। অনেকেই কান ধরে শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করেছে কিছু শিক্ষার্থী। শিক্ষক শ্যামল কান্তির কাছে জাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছে তারা। নিরীহ নির্দোষ নিরপরাধ মানুষের ওপর লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অন্যায়, অত্যাচার— আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ খুব একটা চোখে পড়ে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রী, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, একটুও নড়ছে না। মন ভরে গেল দৃশ্যটি দেখে। সত্যি বলছি, প্রতিবাদের দৃশ্যের মতো সুন্দর দৃশ্য আর নেই।

৩.

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই মিথ্যে অভিযোগে এক ইস্কুলের শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে, তাঁকে লাঞ্ছনা করা হয়েছে বলে, বাংলাদেশের অনেকে আজ প্রতিবাদে মুখর। ব্যাপারটি চমৎকার। কিন্তু চমৎকার এই ব্যাপারটি এটি প্রমাণ করে না যে বাংলাদেশের সকলে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান করে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই সত্য অভিযোগে যখন কাউকে হত্যা করা হয়, যখন কাউকে লাঞ্ছনা করা হয়, তখন যদি দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ করে, অপরাধীদের বিচার হয়, বুঝবো দেশ নিয়ে আশা করার কিছু আছে। বুঝবো দেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারকে মানুষ সম্মান করে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার পরও যদি কেউ হুমকি না পায়, শাস্তি না পায়, কোপ না খায়, গুলি না খায়, তখন বুঝবো দেশে গণতন্ত্র আছে, বাকস্বাধীনতা আছে, মত প্রকাশের অধিকার আছে। সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি আমি।

৪.

এদিকে একই সময়ে আরও একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। মেহেরপুরের এক ইস্কুলের সহকারী শিক্ষিকা সেই ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। মেহেরপুর থেকে নিবন্ধন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন শিক্ষিকা, সঙ্গে এসেছিলেন প্রধান শিক্ষক। কুষ্টিয়া শহরের আল আমিন হোটেলে পাশাপাশি দুটো রুমে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। পরদিন ভোরবেলায় প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন দেওয়ার নাম করে দরজা খুলতে বললে শিক্ষিকা দরজা খোলেন। প্রধান শিক্ষক তাঁকে বলা নেই কওয়া নেই ধর্ষণ করেন। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললে শিক্ষিকাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে পালিয়ে যান প্রধান শিক্ষক।

নারায়ণগঞ্জের প্রধান শিক্ষকের পক্ষে আজ সারা দেশ দাঁড়িয়েছে। কুষ্টিয়ার প্রধান শিক্ষকের বিপক্ষেও তো সারা দেশের দাঁড়ানো উচিত। কানে ধরে ওঠবস করলেই অসম্মানিত বা অপমানিত বোধ করে মানুষ? ধর্ষণ কি অসম্মান বা অপমান বোধ জাগায় না? নাকি পুরুষের অপমান নারীর অপমানের চেয়ে বড় হয়ে বাজে।

৫.

শুনেছি স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আন্দোলন চলছে। পাঠ্যবইয়ে ইসলাম বিদ্বেষী কবিতা, গল্প ও রচনাবলি রয়েছে এমন অভিযোগ তুলে সংশোধনের দাবিতে সংগঠিত হচ্ছে কওমিপন্থি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো। এমনকি ‘শিক্ষানীতি ২০১০’ এবং প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা আইন ২০১৬’ বাতিলের দাবি তুলে আন্দোলন      করছে এসব সংগঠন। ইতিমধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। পাঠ্যবই সংশোধন না হলে আরও তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যদিও এনসিটিবি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘কোনও ধর্মকে বিন্দুমাত্র হেয় করা হয়েছে, এমন একটি শব্দও পাওয়া যাবে না পাঠ্যবইয়ে। এমন কিছু যদি কেউ দেখাতে পারেন আমরা সংশোধন করবো। ’

ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এসব পাঠ্যবইয়ে যোগ করা হয়েছে ধর্মহীন নাস্তিক ও হিন্দুত্ববাদের দীক্ষা। আশা করি দেশে এখনও ভালো মানুষ আছেন, যাঁরা দেশটাকে বাঁচাবেন, দেশটাকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাবেন।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯ মে, ২০১৬

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ

বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা না করে বরং পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা উচিত। পাকিস্তানেও বাংলাদেশের মতো হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। গত শনিবার রাতে পাকিস্তানের করাচি শহরে এক সেক্যুলার ব্লগার খুন হয়েছেন। নাম খুররাম জাকি। খুররাম তার এক বন্ধুর সঙ্গে একটি  ক্যাফেতে বসে ডিনার করছিলেন। তখন  দুটো মোটরসাইকেলে চারজন লোক এসে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। অন্য কারও দিকে অস্ত্র তাক করা হয়নি। আশেপাশের কয়েকজন আহত হয়েছেন। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল খুররাম জাকিকে হত্যা করা। বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, মুক্তচিন্তক, বুদ্ধিজীবী  একের পর এক খুন হচ্ছেন। পাকিস্তানে এই হত্যাকাণ্ড সবে শুরু হয়েছে। অনুমান করছি ইসলামী মৌলবাদীরাই খুনগুলো করছে। খুন করেছে এই দাবি তো তারাই করছে।

খুররাম, আমার মন বলছে, নাস্তিক ছিলেন। খুররাম জাকির দোষ অনেক, তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সুন্নি মৌলবাদের নিন্দে করতেন। লাল মসজিদের ইমাম আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন খুররাম জাকি। লাল মসজিদ সুন্নি মৌলবাদীদের আখড়া, মনে আছে ২০০৭ সালে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লাল মসজিদে মোশাররফের মিলিটারি অপারেশন? আবদুল আজিজ বড়ই কট্টরপন্থি সুন্নি। তিনি কারও অনুরোধেই ২০১৪ সালে তালিবানিদের ঘটানো হত্যাযজ্ঞের নিন্দে করেননি।   তালিবানরা পেশোয়ারের এক স্কুলে ঢুকে ১৩২ জন  স্কুলছাত্রকে খুন করেছিল, সেই তালিবানি হত্যাযজ্ঞের নিন্দে করতে আবদুল আজিজ অস্বীকার করেন। তখন খুররাম জাকি ইমামের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। ‘সিপাই সাহাবা’ নামের এক নিষিদ্ধ জঙ্গি দলের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন খুররাম। সম্প্রতি লন্ডনের নতুন মেয়র সাদিক খানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, যে  সাদিক খান পাকিস্তানে জন্ম নিয়েও শুধু ইওরোপের শিক্ষা সংস্কৃতি গ্রহণ করে আধুনিক তো হয়েছেনই, খাঁটি  সেক্যুলারও হয়েছেন। খুররাম জাকি পাকিস্তানের নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিয়া, সুফি, আহমদিয়া, খ্রিস্টান, হিন্দুর মানবাধিকারের পক্ষে লিখতেন।   মানবাধিকারের পক্ষে কলম ধরার এবং  মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করার কারণে মৌলবাদীরা খুররাম জাকিকে খুন করেছে।

বাংলাদেশের মৌলবাদীরা কুপিয়ে মারে, পাকিস্তানেরগুলো গুলি করে। কুপিয়ে মারলে নাকি পুণ্য হয় বেশি। এক নম্বর বেহেস্তে স্থান জোটে। বাংলাদেশের  সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসীদের থেকে তুলনায় তাহলে পুণ্যবান। মৌলবাদ আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বললে বাংলাদেশে আর পাকিস্তানে আজকাল খুন হয়ে যেতে হয়। করাচিতে দু’বছর আগে  আর্ট সেন্টারের ডিরেক্টর সাবিন মাহমুদকে খুন করেছে মৌলবাদীরা। বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে— এই নিয়ে তিনি একটি তার সেন্টারে আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। অপরাধ সেটিই। পারভিন রহমান নামের একজন মানবাধিকার কর্মীকেও খুন করেছে ওরা।

‘লেট আস বিল্ড পাকিস্তান’ নামের ব্লগের সম্পাদক ছিলেন খুররাম জাকি। ওই ব্লগের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান আলী আব্বাস তাজ বলেছেন, তালিবান আর সুন্নি মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে খুররাম জাকিকে খুন হতে হয়েছে।

খুররাম জাকির মরদেহ পাকিস্তানের পতাকায় মুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়েছে। শত শত মৌলবাদবিরোধী মানুষের ভিড় ছিল সেখানে। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য  দেখা যায় না। খুন হওয়ার পর চুপচাপ সরিয়ে ফেলা হয় মুক্তচিন্তক ব্লগারদের মৃত শরীর। গোপনে সৎকার করা হয়। মরদেহ পতাকায় মোড়ানো, শত শত মানুষের জমায়েত!— এসব হওয়ার মতো পরিবেশ এখন আর বাংলাদেশে নেই, এখনো পাকিস্তানে আছে।

বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে যে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, মুক্তচিন্তক হত্যার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা বড়ই ভয়ংকর। আর কোনও দেশ যেন বাংলাদেশের এই সংস্কৃতি অনুসরণ না করে। পাকিস্তানকে লোকে মৌলবাদী দেশ বলে। পাকিস্তানেও কিন্তু অন্যায়ের বিচার হতে দেখি। বাংলাদেশে এতগুলো  সেক্যুলার ব্লগারকে সন্ত্রাসীরা মেরে ফেললো, কোনও খুনিকেই ধরা হলো না, শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা। আর পাকিস্তানে সালমান তাসিরকে যে ইসলামী সন্ত্রাসী খুন করেছিল, তার কবে ফাঁসিও হয়ে গেছে। পাকিস্তানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করা মানুষের বিচার হতে পারে, বাংলাদেশে কেন পারে না? পাকিস্তান যদি মৌলবাদী  দেশ, তবে বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের চেয়েও বড় মৌলবাদী দেশ? আমরা কি একাত্তরে পাকিস্তানের  চেয়েও বড় মৌলবাদী দেশ হওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ মে, ২০১৬

সমাজ কি থেমে আছে?

১.

কোনও বায়োডাটা ফর্ম পূরণ করতে গেলে নাম বয়স ও জন্মতারিখের পর পিতা/স্বামীর ঘরে আমার দৃষ্টি থমকে দাঁড়ায়। বিবাহিত পুরুষেরা পিতা এবং স্বামীর মধ্যে পিতাকে বেছে নেন, কারণ তাদের ‘পিতা আছে, স্বামী নেই; বিবাহিত নারীদের কিন্তু খানিকটা মুশকিল হয়, কারণ তাদের পিতাও আছে এবং স্বামীও আছে। তাদের বেছে নিতে হয় যে কোনও একজনের ‘অভিভাবকত্ব’। সাধারণত স্বামীর অভিভাবকত্ব বরণ করতে হয় তাদের।

স্বামী ও স্ত্রীকে যদি একে অপরের পরিপূরক বলে ধরে নিই— স্ত্রী যদি স্বামীর নাম উল্লেখ করেন তার জীবনবৃত্তান্তে, তবে স্বামীরও নিশ্চয়ই স্ত্রীর নামই উল্লেখ করা উচিত। আর তা না হলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই তাদের পিতা-মাতার পরিচয়ই উল্লেখ করতে হবে। আমার মনে হয় পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে সে বিবাহিত কী অবিবাহিত— অভিভাবক হিসেবে পিতা ও মাতাকে স্বীকার করাই উচিত।

ধরা যাক, দেশের কোনও এক নাগরিক তার পিতা-মাতাসহ ময়মনসিংহে বসবাস করে, তার পিতার জন্ম এবং আদি বাড়ি রাজশাহী জেলায়, তার মায়ের জন্ম এবং আদি বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। এই নাগরিককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার বাড়ি কোথায়, তবে সে কিন্তু ময়মনসিংহ নয়, চট্টগ্রাম নয়, বলবে রাজশাহী। ধরা যাক রাজশাহী পিতার বাড়ি বটে, তবে রাজশাহীতে সে কখনও যায়নি, তার পিতা চট্টগ্রামের মেয়েকে বিবাহ করে কর্মসূত্রে ময়মনসিংহে চলে আসেন এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করেন, তবু তার নিজের ‘গ্রামের বাড়ি বা দেশের বাড়ি’ রাজশাহীকেই মানতে হবে। এ এক অদ্ভুত ব্যবস্থা বটে। পিতার জন্মস্থানকে নিজের উৎসস্থল বলে চিহ্নিত করা। এটির কারণ ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা’— পিতাই যেখানে পরিবারের প্রভু। সংসারে পিতার যদি কোনও অর্থনৈতিক অবদান না থাকে— পিতা যদি অথর্ব, অক্ষম, অসৎ ও অত্যাচারী হয় তবুও সন্তানকে পরিচিত হতে হয় পিতার পরিচয়ে। মাতা যদিও একটি ভ্রূণকে ন’মাস সাত দিন জরায়ুতে লালন পালন করেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা প্রসব করেন, তবু তার পরিচয় সমাজে মুখ্য নয়। আমি বলছি না মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই সমাজকে ফিরে যেতে হবে। বলছি না রোকেয়ার নারীস্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। আমার একটিই প্রস্তাব, যে গ্রাম বা শহরে তুমি বাস করো, তোমার বাড়ি কোথায় প্রশ্ন করা হলে সেই গ্রাম ও শহরের নাম উল্লেখ করো। সেই সঙ্গে পিতার বাড়ি এবং মাতার বাড়িরও আলাদা উল্লেখ প্রয়োজন। অন্তত এই নিয়মটি শীঘ্র চালু করলে পিতৃতন্ত্রের নাগপাশ থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। মুক্তি পাওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে, নারীর সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়া, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটে যাওয়া, নারীর রাজনীতি করবার, শিক্ষিত হবার, স্বনির্ভর হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাওয়া, অন্ধকার ঘুচে যাওয়া। খুলে যাওয়া তার সামাজিক সকল শৃঙ্খল।

এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসুখ। এই অসুখ দূর করা সহজ কথা নয়। তবু সুস্থতার সামান্য যেটুকু চর্চা চলছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে, আমি তারই বিস্তার চাই। মানুষ সজাগ হোক, মূলোত্পাটন করুক দুরারোগ্য ব্যাধি বৃক্ষের।

২.

‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’— এ কথা অনেকেই বলে। আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। কোনও মেয়ে যখন অন্য মেয়ের শাশুড়িতে পরিণত হয়, আমরা সাধারণত লক্ষ্য করি শাশুড়ি-মেয়ে বউ-মেয়ের ওপর ভীষণ মারমুখো, বাপ তুলে গালাগাল করছে, দিনভর খাটাচ্ছে, সময়ে অসময়ে গায়েও হাত তুলছে, কোথাও কোথাও তো এমনও হচ্ছে যে ননদ-শাশুড়ি মিলে বউকে একেবারে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে নয়তো দায়ে কুপিয়ে মারে। এক্ষেত্রে, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে অর্থাৎ তার ছেলের প্রতিনিধি হিসেবে সেই মেয়ে উপনীত হয় এবং অবিকল পুরুষেরই মতো অত্যাচার করে আরেক মেয়েকে। ঠিক একইভাবে সেই মেয়ে যখন অন্য এক ছেলের শাশুড়ি তখন ছেলে-জামাই-এর সঙ্গে তার আচরণ বড় চমত্কার, তখন সে নম্র, ভদ্র, পাতে তুলে দিচ্ছে মাছের মুড়ো, আস্ত মুরগি, চিতল মাছের কোপ্তা। কারণ সে তখন মেয়ের পক্ষ, মেয়ে মানেই সহায়হীন, অসহায়, দুর্বল।

এ ছাড়া আরও একটি কারণে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু বলে মনে হয়, সে হলো ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। এটি একটি রোগ। এই রোগে অধিকাংশ মেয়েই ভোগে। ভোগে না বলে ভোগানো হয় বলা উচিত। মেয়েদের ‘ইনফিরিওর’ করে রাখা সমাজের যেন নৈতিক দায়িত্ব। মেয়েরা ‘ইনফিরিওর’ না হলে, অধিকাংশ মানুষই ভাবে যে সংসার টেকে না। তাই বিয়ে করতে হলে দৈর্ঘ্যে কম, প্রস্থে কম, বিদ্যায় কম, বুদ্ধিতে কম, এমন মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসে ঘর ব্যালেন্স করা হয়। এতে করে সংসারের মূল উপার্জনের দায়িত্বের মতো, যে কোনও সিদ্ধান্ত এবং গুরুদায়িত্ব একা ছেলেকেই বহন করতে হয়। এ অবশ্য সুপিরিওর হবারও একটি চমত্কার কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে সব ছেলেই অনায়াসে সুপিরিওর বনে কিন্তু মেয়েরা ইনফিরিওরটি কমপ্লেক্স রোগে মুহুর্মুহু আক্রান্ত হয়।

এই কমপ্লেক্স থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। পরনির্ভর ‘গৃহবধূ’ ঈর্ষা করে চাকরিজীবী স্বনির্ভর মেয়েকে, স্বামী দ্বারা নির্যাতিত মেয়ে ঈর্ষা করে স্বামীকে তালাক দেওয়া ব্যক্তিত্বশালী মেয়েকে, নিচু ক্লাস অবধি পড়া মেয়ে ঈর্ষা করে বিদুষী মেয়েকে; অক্ষমতার এই ক্রোধ কি ভয়ঙ্কর হিংসের রূপ নেয় তা ওই হিংসের অনলে একবার না পড়লে বোঝা যাবে না। মেয়েদের জাত কিন্তু পুরুষের চেয়ে আলাদা নয়। মনুষ্য চরিত্র সব এক। হিংসে পুরুষের কম নয়। আসলে সত্যি বলতে কী, হিংসের কারণে এ পর্যন্ত খুন জখম মেয়েদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি করেছে। নারীর চেয়ে পুরুষের ঈর্ষাটা বরাবরই বেশি। ঈর্ষায় পুরুষ কি না করেছে, দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়েছে, ঘরে ঘরে ভায়োলেন্স করিয়েছে।

শিক্ষিত মেয়েরা হাতে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার বড়াই করে। কিন্তু শিক্ষা তো কোনও একাডেমিক পড়াশোনায় অর্জিত হয় না। মেয়েরা, কিছু মেয়েরা, পরীক্ষায় পাস করছে বটে, শিক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষিত হওয়া অন্য জিনিস। শিক্ষিত হলে মানুষ ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে না, সেই কমপ্লেক্স থেকে হিংসের আগুনে সেও পোড়ে না, অন্যদেরও পোড়ায় না। আর পুরুষদের বেলায়ও একই কথা খাটে। সত্যিকার শিক্ষিত পুরুষরা হীনমন্যতায় ভোগে না।

লোকে এও বলে, মেয়েরা মেয়েদের যত হিংসে করে, ছেলেরা তত করে না। মেয়েদের মধ্যে এই নীচতা, হীনতা, কূটকচাল, হিংসে, লোভ ইত্যাদি বেশি। মেয়েরাই মেয়েদের সম্ভ্রম নষ্ট করে, মেয়েরাই মেয়েদের অগ্রসর ইচ্ছের গলা টিপে ধরে, মেয়েরাই মেয়েদের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। এই ক্ষতি কিন্তু একটি অশিক্ষিত, নির্বোধ মেয়ে যতটা করে, তার চেয়ে সহস  গুণ বেশি করে একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত (!) বুদ্ধিমান মেয়েরা; এই শিক্ষিতরা যদি একবার কমপ্লেক্সে ভোগে, সে বড় মারাত্মক ভোগা, তাদের দূষিত দীর্ঘশ্বাসে চারপাশ সংক্রামিত হয়; তাদের ধ্বংসযজ্ঞে মেয়েরাই সুযোগ্য বলি হিসেবে ধৃত হয়।

আমার বড় করুণা হয়। আহা নারী! আহা হতভাগ্য নারী! লেখাপড়া করে ‘বুদ্ধি’ হবে বলে বলে তাকে লেখাপড়াই শেখানো হয় না, আর লেখাপড়া করে যাদের ‘বুদ্ধি’ হয়েছে, তারা এমন হতভাগ্য যে নিজেদের বুদ্ধির অপব্যবহার তারা এভাবেই করে যে দুর্বলের ওপর তারা খগড়হস্ত হয়, তারা অসহায়কে দাঁত খিঁচোয়, তারা দুর্গতদের ভাত কেড়ে নেয় এবং নিগৃহীতদের গালাগাল করে। যে ‘বুদ্ধি’ দ্বারা মানুষের ক্ষতি হয়, নারীর যে বুদ্ধি আরেক নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে— আমি তাকে বুদ্ধি বলি না। বলি ছোবল, বিষধর সাপের ছোবল।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৫ মে, ২০১৬

আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…

জার্মান প্রটেস্টান্ট প্যাস্টরের মার্টিন নিয়েমুলারের কথা নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। মার্টিন হিটলার বিরোধী ছিলেন। এবং সাত বছর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন। মার্টিনের বিখ্যাত কবিতাটি বার বার আওড়ালাম বাংলাদেশে নাজিমুদ্দিন সামাদ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী আর জুলহাস মান্নান খুন হওয়ার পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে নািসরা এক এক করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল জিপসিদের, কমুনিস্টদের, ইহুদিদের, তখন যারা জিপসি নয়, কমুনিস্ট নয়, ইহুদি নয়— তারা প্রতিবাদ করেননি। মার্টিন লিখেছিলেন :

‘ওরা যখন সোশালিস্টদের জন্য এলো,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি সোশালিস্ট ছিলাম না।

তারপর তারা এলো ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ছিলাম না।

তারপর তারা এলো ইহুদিদের জন্য,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।

তারপর তারা আমার জন্য এলো, এবং কেউ ছিল না আমার জন্য কথা বলার…। ’

নাজিমুদ্দিন, রেজাউল, জুলহাস— কেউ নাস্তিক ছিলেন না, ইসলামের সমালোচক ছিলেন না, ব্লগারও ছিলেন না। অথচ তাঁদের নৃশংসভাবে খুন হতে হলো। মানুষ জানতো সন্ত্রাসীরা শুধু ইসলামের সমালোচকদের খুন করবে, শুধু নাস্তিক ব্লগারদের খুন করবে। কিন্তু কেউ জানতো না তারা একসময় প্রগতিশীল মুসলমানদেরও খুন করবে। ধর্ম বিশ্বাসীদেরও খুন করবে, শুধু প্রগতিশীল হওয়ার অপরাধে। নাজিমুদ্দিন সামাদ কোনও নাস্তিক ব্লগার ছিলেন না, ছাত্র ছিলেন, প্রগতির পক্ষে ছিলেন, ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে ছিলেন। রেজাউল করিম সিদ্দিকী সেতার বাজাতেন, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সাংস্কৃতিক কাজকর্মে উৎসাহী ছিলেন। তিনি ধর্মকে গালি দেননি। কিন্তু তাঁকে খুন হতে হলো সংস্কৃত মনা হওয়ার অপরাধে। জুলহাজ মান্নানকে খুন হতে হয়েছে উদার হওয়ার অপরাধে। জুলহাজ সমকামীদের সমর্থনে ‘রূপবান’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেটিই ছিল তার অপরাধ।

যখন ব্লগারদের এক এক করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করেনি। হয়তো মনে করেছিল, ‘আমরা ধর্মের সমালোচনা করছি না, আমরা নিরাপদে আছি। যারা সমালোচনা করেছে, তাদের মারা হচ্ছে, এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই’।

ব্লগাররা অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। দেশে যাঁরা আছেন, লুকিয়ে আছেন, লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন, অথবা লিখলেও ছদ্মনামে লিখছেন। সন্ত্রাসীদের পক্ষে ব্লগার পাওয়াও এখন মুশকিল। তাই এখন ব্লগার নয়, কিন্তু গান গায়, কবিতা লেখে, উদারপন্থী মানুষকেই তারা বেছে নিয়েছে খুন করার জন্য। এখনও যদি মানুষ চুপ থাকে, এখনও প্রতিবাদ না করে, এখনও খুনের শাস্তি না জোটে খুনির, তাহলে কিন্তু খুন আরও বাড়বে, এবং সেই খুন শুধু প্রগতিশীল উদারপন্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আস্তিকরাও খুন হবেন। সাধারণ মুসলমানরাও খুন হবেন। খুন হবেন কট্টরপন্থী না হওয়ার অপরাধে।

মার্টিনের কবিতার মতো আমার লিখতে ইচ্ছে করছে নতুন একটি কবিতা।

‘ওরা যখন হিন্দুদের জন্য এলো,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি হিন্দু ছিলাম না।

তারপর তারা এলো নাস্তিকদের জন্য,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি নাস্তিক ছিলাম না।

তারপর তারা এলো সমকামীদের জন্য,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি সমকামী ছিলাম না। প্রগতিশীল ছিলাম না।

তারপর তারা এলো প্রগতিশীলদের জন্য,

আমি কথা বলিনি—

কারণ আমি প্রগতিশীল ছিলাম না।

তারপর তারা আমার জন্য এলো, এবং কেউ ছিল না আমার জন্য কথা বলার…। ’

এ-ই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইসিস যেভাবে খুন করছে মুসলমানদের, সেভাবে খুন করতে শুরু করেছে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আমার বক্তৃতায় গত সপ্তাহে আমি বলেছি এই সমস্যার কথা। মানুষ খুন হচ্ছে ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে, কিন্তু কারও বিচারের ব্যবস্থা হচ্ছে না। এতে সন্ত্রাসীরা পরম উৎসাহে নতুন খুনের দিকে এগোচ্ছে। পার্লামেন্ট সদস্যারা আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘সিভিল সোসাইটি কী করছে?’ কিছুক্ষণ আমি কিছু বলতে পারিনি। একবার মনে হচ্ছিল বলি, ‘বসে বসে আঙুল চুষছে’। এত যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, আমি তো কোনও প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং এর কথা শুনিনি! আসলে একটা সমাজ ভয়ংকর নয় যদি সেই সমাজ ভয়ংকর সন্ত্রাসীর জন্ম দেয়, অথবা সেই সমাজ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কোনও সরকারকে জন্ম দেয়— কিন্তু ভয়ংকর হয় তখনই যখন নাগরিক সমাজ সন্ত্রাস দেখেও বা নৈরাজ্য দেখেও চুপ থাকে। যখন হত্যাযজ্ঞ দেখেও কোনও কথা বলে না। যখন অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে গোটা দেশকে, দেখেও শব্দ করে না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা

১.

ভারতের মধ্যপ্রদেশে একটি ছোট গ্রামের নাম খাজুরাহো। খেজুর হতো বলেই হয়তো খাজুরাহো নাম গ্রামটির। খাজুরাহোর জঙ্গলের  মন্দিরগুলো চান্দেলা রাজপুত রাজারা বানিয়েছিলেন ৯৫০ সালের দিকে। ওরা রাজত্ব করেছিল দশম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত। মহারাজা রাও বিদ্যাধরের সময় শুরু হয়েছিল খাজুরাহোর মন্দির নির্মাণ। খাজুরাহোর জঙ্গলে ৮৫টি মন্দির ছিল। এখন আছে সাকুল্যে ২৫টি। বাকিগুলো ধ্বংস করেছে শত্রুসৈন্য। গজনির সুলতান মাহমুদ ছিলেন ধ্বংসকারীদের একজন।

সেই প্রাচীনকালে যৌনতার যে চর্চা ছিল ভারতবর্ষে, তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাই মন্দিরগুলোর গায়ে। আমি তো মুগ্ধ দেখে নারীপুরুষের কামশিল্প। কোনও সংকোচ নেই কারওর। নারীও পুরুষের মতো যৌনশিল্পে দক্ষ। কবে যে রক্ষণশীলতা গ্রাস করে ফেলেছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ, জানি না। সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার পর। মানুষের মগজধোলাই তো অনেকটাই হয়েছে। তা না হলে যৌনতার যে চিত্র আমরা ধর্মের মন্দিরে দেখি, সেই যৌনতা এত শীঘ্র এই অঞ্চলে ট্যাবু হয়ে যায় কী করে! আজকাল তো হিন্দু আর মুসলিম— দুই ধর্মীয় মৌলবাদীই নারী স্বাধীনতাবিরোধী, খাজুরাহো মন্দিরের যৌনশিল্পের ঘোরবিরোধী তারা।

কামসূত্রের অনেক আসনই দেখি মন্দিরের গায়ে। কামসূত্র ভারতবর্ষে লেখা হলেও জনপ্রিয় ভারতবর্ষের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। ভারতবর্ষের মানুষ কামসূত্রের চর্চা করে না বললেই চলে। যৌনতা, এখনকার সাধারণ হিন্দুরাও মনে করে, পাপ। গান্ধীও তো বলেছিলেন সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছাড়া সুখভোগের উদ্দেশে যে সেক্স করে, সে পাপ করে।

মন্দিরে নারী পুরুষের যৌনশিল্প আমাকে মুগ্ধ করলেও, পশুর সঙ্গে পুরুষের সঙ্গম আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছে। পশু-ধর্ষণ তাহলে প্রাচীনকাল থেকেই ছিল! পশুরা নিশ্চয়ই মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে চায় না, মানুষকে সঙ্গমের অনুমতি নিশ্চয়ই দেয় না তারা। তাহলে এই সঙ্গম সঙ্গম নয়, এ নিতান্তই ধর্ষণ। সেই প্রাচীনকাল থেকে পশুপাখিদের নির্যাতন করে আসছে মানুষ। তাদের হত্যা করেছে, বন্দি করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে। পশুপাখিরাও পুরুষের যৌন-নির্যাতনের শিকার।

এখনও সব বয়সের নারী তা আছেই, দুধের শিশুরা, এমনকী পশুও পুরুষের যৌন নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না। পুরুষ যে কবে মানুষ হবে! জানি সব পুরুষই মন্দ নয়, সব পুরুষই ধর্ষক নয়, কিন্তু ভালো পুরুষের ওপর তো দায়িত্ব বর্তায় পুরুষ জাতটাকে মানুষ করার। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভালো পুরুষরা কেন সংগঠিত হচ্ছে না। তারা কিভাবে আন্দোলন করার দায়িত্ব শুধু ভিকটিমদের, তাদের নয়? সমাজটাকে কলুষমুক্ত করার, বৈষম্যমুক্ত করার, শুদ্ধ করার দায়িত্ব শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়?

২.

খাজুরাহোর আমার সঙ্গে পুলিশ ছিল। পুলিশ সবসময়ই থাকে। একবারই শুধু ছিল না হায়দারাবাদে, যখন একপাল মুসলিম মৌলবাদী এসে আমার ওপর চড়াও হয়, অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করে। হাতের কাছে যা পায়, এমনকী লোহার চেয়ারও ছুড়ে মারতে থাকে আমার শরীরে। আমি মাঝে মাঝে নিজেও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করি। খাজুরাহোয় অনেকে জিজ্ঞেস করে আমি তসলিমা কি না। আমি না বলে দিই। জানি যারা জিজ্ঞেস করে, তারা শত্রু নয় আমার। তারপরও অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফের ঝামেলায় সবসময় যেতে ইচ্ছে করে না। একটি প্রশ্ন তো করেই অধিকাংশ মানুষ, ‘এখন কী লিখছেন?’ এই একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নটির সামনে আমার নিরুত্তর থাকতে ইচ্ছে করে।

খাজুরাহোর পুলিশদের একজনের নাম বিধু বিশ্বাস। আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছেন। পূর্ববঙ্গে ছিল তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি, ১৯৬৫ সালে বাবা মা চলে আসেন ভারতের মধ্যপ্রদেশে, এখানেই বাবার চাকরি হয়ে যায়, এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। বিধু বিশ্বাস কোনও দিন পূর্ববঙ্গে যাননি, ঢাকায় তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিও দেখেননি। নচিকেতার গান শুনেছেন? জিজ্ঞেস করে টের পেলাম নচিকেতার নামই শোনেননি কখনও। বাংলাটা বলতে শিখেছেন বাড়িতে বাবা মা বাংলা বলতেন বলে, আর প্রতিবেশীদের অনেকে ছিলেন বরিশাল থেকে আসা, তাদের কাছ থেকেও শিখেছেন বাংলা। বাংলা পড়তে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে আমার আশঙ্কা হয় বিধু বিশ্বাস বলবেন যে তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। এই উত্তরটি শুনতে ভালো লাগবে না বলেই জিজ্ঞেস করিনি। তাঁর বাবা নাকি একবার বলেছিলেন, ‘দেশের গাছ থেকে আম খেতাম, এত বড় বড় কাঁঠাল হতো কাঁঠাল খেতাম, পেয়ারা খেতাম, লিচু খেতাম, পুকুরের মাছ খেতাম, আহা কী সুখেই না ছিলাম! এ কোন দেশে এলাম, এখানে তো মাটি নেই, চারদিক শুকনো, কিছুই ফলে না, চারদিকে শুধু পাথর, শুধু পাথর। ’ বিধু বিশ্বাস আমার মনে হয় তাঁর বাবার কথাগুলো শুধু শুনে গেছেন, অনুভব করতে পারেননি। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সব মধ্যপ্রদেশে। মধ্যপ্রদেশের বাইরেও কোথাও যাননি। জানেন না বাংলা ঠিক কাকে বলে, কেমন দেশকে বাংলা দেশ বলে। তাঁকে বলি একবার ঢাকা ঘুরে আসতে। একবার দেখে আসতে তাঁর বাপ দাদার ভিটেমাটি, দেখে আসতে গাছগাছালি, পুকুর নদী। মনে আছে নচিকেতা কেমন কেঁদেছিলেন পূর্বপুরুষের মাটিতে গিয়ে! জানি না বিধু বিশ্বাস সেভাবে কাঁদবেন কি না। ধর্মের কারণে মানুষের উদ্বাস্তু হওয়াটা আমাকে কাঁদায়। ‘ফেরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম অনেক আগে, ওই উপন্যাসে লিখেছিলাম নিজের দেশের মাটি ত্যাগ করার কষ্টের কথা। আমার নিজের কিন্তু তখনও নির্বাসন দণ্ড হয়নি। তার আগেই মানুষের নির্বাসনের কষ্টটা কী করে অনুভব করেছিলাম জানি না।

ধর্মের কারণে মানুষ নিষ্ঠুর হয়েছে, স্বার্থান্ধ হয়েছে। নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থান্ধতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বিধু বিশ্বাসের বাবার মতো কত মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে সরতে বাধ্য হয়েছে! বিধু বিশ্বাসের ছেলে মেয়েরা কি নিজেদের বাঙালি বলে? হয়তো বলে না। কিন্তু বিধু বিশ্বাস ইচ্ছে করলে যেতে পারেন বাংলাদেশে, ঘুরে বেড়াতে পারেন ও দেশে। আমি পারি না। আমারই অনুমতি নেই বাংলাদেশে ফেরার। মাঝে মাঝে ভাবি ওরা অমুসলিম হয়ে যত অপরাধ করেছে, আমি অধার্মিক হয়ে তার চেয়েও বেশি অপরাধ করেছি। আসলেই কি আমরা অপরাধ করেছি? নাকি তারাই অপরাধী যারা আমাদের আদর্শ বা বিশ্বাসের কারণে আমাদের অত্যাচার করে, আমাদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে, আমাদের জেলে পোরে, নির্বাসনে পাঠায়?

৩.

খাজুরাহো গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে পান্না ন্যাশনাল পার্ক। ওখানে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েকবছর আগে ৪০টিরও বেশি বাঘ ছিল ওখানে। এখন একটি বাঘও নেই। সবকটা বাঘকেই মেরে ফেলেছে মানুষ। মানুষের মতো হিংস্র প্রাণী, সত্যিই, দ্বিতীয়টি নেই। এখন শাকাহারি কিছু প্রাণী পড়ে আছে। হরিণ টরিণ। পুরো এলাকা ধূসর, কোনও ঘাস নেই, গাছগুলোও শুকনো। কী খেয়ে ওরা বেঁচে থাকে জানি না। এই পৃথিবী তো ওদেরও। অথচ আমরা কাউকে বাঁচতে দিতে চাই না। গরু ঘোড়া মোষ হাতি উট এসবকে তো নিজেদের ভারি ভারি মাল টানতে বাধ্য করছি। বরফের দেশে কুকুরকে দিয়েও স্লেজগাড়ি টানাচ্ছি। পৃথিবীর কত প্রাণীকেই যে আমরা আমাদের দাস বানিয়েছি!

সেই পেঙ্গুইনের কথা শুনে সেদিন ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম, যে পেঙ্গুইনটি ৫০০০ মাইল সাঁতার কেটে প্রতিবছর ডি সুজা নামের এক ব্রাজিলিয়ান লোককে দেখতে আসে। ডি সুজা কোনও একদিন তেলে ডুবতে থাকা পেঙ্গুইনটির জীবন বাঁচিয়েছিল। আমরা তো জীবন বাঁচিয়েছে এমন মানুষদের কিছুদিন পরই ভুলে যাই। একটি পেঙ্গুইন কেন ভোলে না! নিজেদের কী কারণে যে আমরা শ্রেষ্ঠ জীব বলি!

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৭ এপ্রিল, ২০১৬

আমার প্রথম সংসার

মিটফোর্ড হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে পোস্টিং আমার। রক্ত বিক্রি করার জন্য দরিদ্র কিছু লোক আসে, সেই লোকদের শরীর থেকে রক্ত কী করে নিতে হয়, কী করে রক্তের ব্যাগে লেবেল এঁটে ফ্রিজে রাখতে হয় তা ডাক্তারদের চেয়ে টেকনিশিয়ানরাই জানে ভালো। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত খামোকা বসে থাকতে হয় আমার। মাঝে মধ্যে কিছু কাগজে সই করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। এরকম কাজহীন বসে থাকা আমার অসহ্য লাগে। ব্লাড ব্যাংকের পাশেই স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগ। ওখানে ডাক্তাররা দম ফেলার সময় পায় না এমন ছুটোছুটি করে কাজ করে। দেখে আমার বড় সাধ হয় ব্যস্ত হতে। দিন রাত কাজ করতে। একদিন গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়ার কাছে একটি আবেদন পত্র লিখে নিয়ে যাই। ‘আমি গাইনি বিভাগে কাজ করতে আগ্রহী, আমাকে কাজ করার অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন। ’ অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়া আমাকে বাধিত করেন।

হাসপাতালের কাছেই আরমানিটোলায় আমার বাড়ি। বাড়িটি ভাড়া নিতে আমাকে সাহায্য করেছেন বিদ্যাপ্রকাশের মালিক মজিবর রহমান খোকা। খোকার প্রকাশনায় আমার কবিতার বই খুব ভালো চলছে। আরও লেখার প্রেরণা দিচ্ছেন তিনি। হাসপাতাল থেকেই ব্লাড ব্যাংকের অকাজের সময়গুলোয় মিটফোর্ডের কাছেই বাংলাবাজারে গিয়েছি বইয়ের খবর নিতে, দু-এক দিন যাওয়ার পর এক দিন তাঁকে বলি, যে করেই হোক একটি বাড়ি যেন তিনি আমার জন্য খোঁজেন, ভাড়া নেব। ইতিমধ্যে হাসপাতালের আশপাশে বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে মাথায় টু লেট লেখা যে বাড়িতেই গিয়েছি, বাড়ি, বাড়িভাড়া সবই পছন্দ হবার পর, বাড়িঅলা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কে কে থাকবে বাড়িতে?’

‘আমি থাকব। ’

‘আপনি সে তো বুঝলাম, কিন্তু পুরুষ কে থাকবে আপনার সঙ্গে?’

‘কোনও পুরুষ থাকবে না, আমি একা থাকব। ’

বাড়িঅলা চমকে উঠেছেন, ‘একা আবার কোনও মেয়েমানুষ কোনও বাড়িতে থাকে নাকি!

আপনার স্বামী নাই?’

‘না। ’

‘না, কোনও একা মেয়েমানুষকে আমরা বাড়ি ভাড়া দিই না। ’

মুখের ওপর দরজাগুলো ধরাম করে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও আশা ছেড়ে দিই না। খোকাকে বলে কয়ে সঙ্গে নিয়ে বেরোই বাড়ি দেখতে। যে বাড়িই পছন্দ হয়, সে বাড়িতেই, যেহেতু খোকা পুরুষ মানুষ, বাড়িঅলা তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন, কে কে থাকবে বাড়িতে? খোকা বলেন, ‘উনি থাকবেন, উনি ডাক্তার, মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকরি করেন। ’

‘উনার স্বামী নাই?’

খোকা খুব নরম কণ্ঠে বলেন, ‘না, উনার স্বামী নাই। মিটফোর্ড হাসপাতালে নতুন বদলি হয়ে এসেছেন। হাসপাতালের কাছাকাছি থাকলে সুবিধা। আপনারা ভাড়ার জন্য চিন্তা করবেন না। উনি যেহেতু ডাক্তারি চাকরি করেন, বুঝতেই তো পারছেন, মাস মাস বাড়িভাড়া দিতে উনার কোনও অসুবিধে হবে না। ’খোকাকে নিয়ে এসে এইটুকু অন্তত কাজ হয় একজন ডাক্তার যে বাড়িভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তা তিনি নিজমুখে ব্যাখ্যা করে বাড়িঅলাদের রাজি করাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যতই মধুর কণ্ঠে মধুর হেসে বলা হোক না কেন, সত্যিকার কোনও কাজ হয় না। কেউই বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না কোনও একলা ‘মেয়েমানুষ’কে। অত্যন্ত অমায়িক কিছু সজ্জন বাড়িঅলা পেয়েছি, যাঁরা মুখের ওপর ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দেননি, বা যান ভাই রাস্তা মাপেন, বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে না বলে দূর দূর করে তাড়াননি, খোকার সবিশেষ অনুরোধে রাজি হয়েছেন বাড়ি ভাড়া দিতে তবে মেয়ের বাবা বা ভাইকে সঙ্গে থাকতে হবে। এর অর্থ স্বামী যদি না থাকে, কী আর করা যাবে, পোড়া কপাল মেয়ের, তবে কোনও একজন পুরুষ আত্মীয়ের থাকতেই হবে সঙ্গে। কেন একটি মেয়ের একা থাকা চলবে না তা বিশদ করে কেউ বলেন না। আমার অভিভাবক একজন কেউ থাকতেই হবে। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ, আমিই আমার অভিভাবক— এ কথা কেউ মানেন না। বাবা ভাই মামা কাকা কাউকেই যে সম্ভব নয় তাদের জীবন থেকে তুলে এনে আমার সঙ্গে রাখার, তা খোকাকে বলি। খানিক পর মা’র কথা মনে হয়, এক মা’কেই আনা যেতে পারে। কিন্তু মা তো পুরুষ নন, বাড়িঅলারা পুরুষ চান। একজন ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে যদি তার মা বাস করেন তবে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কি না তার খোঁজও নেওয়া হলো, এতেও লাভ হলো না। খুঁজে খুঁজে ঘেমে নেয়ে রাস্তা মাপতে মাপতে আশা ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা করে দেখার মতো যে বাড়িটিতে ঢুকি সেটি আরমানিটোলার এই বাড়িটি। বাড়ির মালিকের সামনে খোকা যতটা বিনীত হতে পারেন হয়ে ঘণ্টা দুয়েকের প্রশ্নোত্তরে পাস মার্ক জুটিয়ে মা আর মেয়ের থাকার ব্যাপারে অনুমতি লাভ করেন। জাহাজের মতো এই বিশাল বাড়িটির মালিক একটি অশিক্ষিত লোক, লোহা লক্কড়ের ব্যবসা করে টাকার পাহাড় হয়েছেন। টাকার পাহাড় হলে যা করে বেশির ভাগ লোক, তিনি তাই করেছেন, দাড়ি রেখেছেন, মাথায় টুপি পরেছেন আর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে চারটে বিয়ে করেছেন। চার বউকে পৃথক পৃথক চারটে বাড়িতে রেখেছেন। জাহাজ-বাড়িটির দোতলায় চার নম্বর বউ নিয়ে বাস করেন। বাড়িভাড়া তিন হাজার, আর আমার মাইনে কচ্ছপের মতো হেঁটে হেঁটে সাকুল্যে আড়াই হাজারে দাঁড়িয়েছে। এই পার্থক্য সত্ত্বেও বাড়ির পাঁচতলায় দুটো ঘর আর লম্বা টানা বারান্দার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিই। একা আমি নিজের বাড়িতে থাকব, অন্যের বাড়িতে অন্যের আদেশ মতো নয়, এই আনন্দ এবং উত্তেজনায় আমি কাঁপি। জীবনের প্রথম কারও ওপর ভরসা না করে জীবনযাপন করার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সস্তায় একটি খাট, সস্তায় তোশক বালিশ চাদর, একটি ইস্পাতের আলমারি আর কিছু প্রয়োজনীয় বাসন কোসন কিনে আপাতত বাড়িটি বাসযোগ্য করি। ময়মনসিংহ থেকে মা’কে নিয়ে আসি, লিলিকেও। আলাদা একটি বাড়ি ভাড়া করে সম্পূর্ণ নিজের পছন্দ মতো থাকায় মাও খুব খুশি। মা এসেই লিলিকে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে গুছিয়ে রান্নাবান্না করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরমানিটোলার মাঠে ছেলেপিলেদের ফুটবল খেলা, রাস্তার গাড়িঘোড়া আর খোলা আকাশ দেখেন। ধীরে ধীরে জানালার পর্দা কিনি, বিস্তর দরদাম করে বড় একটি লাল সবুজ রঙের তক্তির ডিজাইন করা লাল কার্পেট কিনি, রং মিলিয়ে কয়েকটি কুশনও। কোনও সোফা বা চেয়ার টেবিল কেনার টাকা নেই, তাই কুশনেই হেলান দিয়ে কোনও অতিথি এলে যেন বসতে পারে। সোফা যে কিনতে পারিনি, সে জন্য মনে কোনও দুঃখ থাকে না। নিজের প্রথম সংসারটি বড় সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছে করে, সুন্দর সুন্দর জিনিসের দিকে চোখ যায়, কিন্তু আমার সামর্থ্যের বাইরে বলে সুন্দর থেকে চোখ ফিরিয়ে কম দাম কিন্তু দেখতে অসুন্দর নয়, তেমন জিনিস খুঁজি। তেমন জিনিসই নিজের উপার্জিত টাকায় কিনে নিজের সংসারে এনে যে আনন্দ হয় তার তুলনা হয় না। যে মাসে কার্পেট কেনা হয়, সেই মাসে অন্য কিছু কেনার জো থাকে না। পরের মাসের জন্য অপেক্ষা করি। এই অপেক্ষাতেও এক ধরনের সুখ আছে। মাইনের টাকায় বাড়ি ভাড়াই যেহেতু দেওয়া সম্ভব নয়, ভরসা লেখার ওপর। সাপ্তাহিক পূর্বাভাস আর পাক্ষিক অনন্যায় কলাম লিখি। খবরের কাগজ আর আজকের কাগজেও লিখতে শুরু করি। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে আরও একটি কবিতার বই বেরিয়েছে অতলে অন্তরীণ নামে। বই চলে ভালো। বই চললেও রয়্যালটির টাকা আমি দাবি করি না। লজ্জা হয় টাকা চাইতে তাছাড়া আমার স্বনির্ভর জীবনে খোকার আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে বড় কৃতজ্ঞ করে রেখেছে। বাজার করতে যাব, কোথায় বাজার দেখিয়ে দিচ্ছেন। আসবাবপত্র কিনতে যাব, থাল  বাসন কিনতে যাব, কোথায় যেতে হবে, নিয়ে যাচ্ছেন, দরদাম করে দিচ্ছেন। ডাল ভাত খাচ্ছি অনেকদিন, দেখে একদিন তিনি দুটো মুরগি কিনে নিয়ে এলেন। আমার টাকা ফুরিয়ে আসছে দেখলে মা ময়মনসিংহে চলে যাচ্ছেন, বাবার ভাণ্ডার থেকে নিয়ে বস্তা ভরে চাল ডাল আনাজপাতি নিয়ে বাসে করে চলে আসছেন ঢাকায়। আমার দারিদ্র্য আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে আনন্দও আছে। আমার জীবনে আমি এত দরিদ্র অবস্থায় কাটাইনি এবং এত আনন্দও এর আগে আমি পাইনি। ভাইএর মতো, বন্ধুর মতো খোকা আছেন পাশে। মা আছেন তাঁর উজাড় করে ভালোবাসা নিয়ে। লিলিও খুশি অবকাশের গাধার খাঁটুনি থেকে এসে অল্প কাজ আর শুয়ে বসে অনেকটা আকাশের কাছাকাছি থাকার আনন্দে। আমার হিসেবের সংসার অথচ সুখে উপচে পড়া জীবন। হাসপাতালে গাইনি বিভাগে প্রচণ্ড ব্যস্ততা আমার। রোগীতে সয়লাব হয়ে যায় বিভাগটি। ময়মনসিংহের হাসপাতালে গাইনি বিভাগে ইন্টার্নশিপ করার সময় যেমন উত্তেজনা ছিল, যেমন দম ফেলার সময় ছিল না, এখানেও তেমন। ডেলিভারি করাচ্ছি, এপিসিওটমি দিচ্ছি, এক্লাম্পসিয়ার রোগী ভালো করছি, রিটেইন্ড প্লাসেন্টা বের করছি, ফরসেপ ডেলিভারি করছি, কারও এক্ষুনি সিজারিয়ান, দৌড়োচ্ছি অপারেশন থিয়েটারে, ঝটপট মাস্ক গ্লবস পরে সিজারিয়ানে অ্যাসিস্ট করতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি, আবার গাইনি আউটডোরেও রোগী দেখতে হচ্ছে, সারাদিনে শত শত রোগীর ভিড়, সময়ের চেয়ে বেশি সময় চলে যায় রোগীর চিকিৎসা করে। সারাদিন এসব কাজ করার পর আবার রাতেও ডিউটি পড়ছে। সারারাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে। অল্প যেটুকু সময় হাতে থাকে নিজের জন্য, তখন কলাম লিখি। বাড়তি টাকা রোজগার না করলে বাড়িভাড়া দেওয়া যাবে না, উপোস করতে হবে। হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তাররা আমি জানি না কেন, আমার বেশ ভক্ত হয়ে পড়ে, অনেকটা বন্ধু-মতো। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ফারাক থাকলেও এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমার পরিচয় ওরা সকলেই জানে। আমাকে বলতে হয় না আমি কে। পরিচয় জানার অসুবিধে এই, আমি কাজ করলেও মনে করা হয় আমার মন বুঝি ডাক্তারিতে নেই, মন কবিতায়। আমি প্রেসক্রিপশান লিখতে থাকলে দূর থেকে দেখে কেউ ভেবে বসে আমি হয়তো প্রেসক্রিপশান লিখছি না, কলাম লিখছি। আমার বয়সী ডাক্তাররা এফসিপিএস পাস করে অথবা পুরো পাস না করলেও ফার্স্ট পার্ট পাস করে এসে রেজিস্টার হয়ে বসেছে নয়তো সিএ, ক্লিনিক্যাল এ্যাসিস্টেন্ট। এই বয়সে আমার মতো কেবল মেডিকেল অফিসার হয়ে যারা কাজ করছে বিভিন্ন বিভাগে, তাদেরও এফসিপিএস পরীক্ষা দেওয়ার ধান্ধা। আমারই কোনও ধান্ধা নেই। মোটা মোটা বই নিয়ে বসে যাব, বছরের পর বছর কেটে যাবে বইয়ে ঝুঁকে থেকে, এর কোনও মানে হয়! দেখেছি দশ বছরেও অনেকের পাস হয় না, অথচ বছর বছর ক্লান্তিহীন দিয়েই যাচ্ছে পরীক্ষা, ফেলই করছে প্রতিবছর। টাকাঅলা বাপ যাদের তারা পিজির এফসিপিএস-এ ফেল করে লন্ডনে গিয়ে কোনও রকম ফেল টেল ছাড়াই এফআরসিএস ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশের এফসিপিএস পাস করার চেয়ে বিলেতের এফআরসিএস পাস করা সহজ, এ কথা বিশ্বাস না হলেও কথা সত্য। এসব দেখে ইচ্ছে উবে গেছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকরি করছে এরকম যে ডাক্তারকেই দেখি আমার কাছাকাছি বয়সী, সকলেই চাকরি করার পাশাপাশি এফসিপিএসএর পড়াশোনা করছে। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে, আমি পরীক্ষা দিচ্ছি কি না। আমি সোজা না বলে দিই। অবাক হয় হবু এফসিপিএসরা। হাসপাতালে বসে তাহলে কী ঘোড়ার ডিম করছি, মনে মনে বলে তারা। খানিক পর হেসে, আবার মনে মনেই বলে, কদিন পর তো ঘাড় ধরে বের করে দেবে পোস্টিং দিয়ে কোনও গাঁও গেরামে। শহরের বড় হাসপাতালে চাকরি করতে আসবে যারা পড়াশোনা করছে, এফসিপিএসের মাঝপথে অথবা শেষের পথে। তা ঠিক, হবু এফসিপিএসরা পড়ার ঘোরেই থাকে, তাদের কাজে কোনও অনিয়ম হলে কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু আমার মতো ছোট ডাক্তারদের ওপর ইন্টার্নি ডাক্তারদের মতো খাটনি যায়। আমার আপত্তি নেই খাটনিতে। কিন্তু কবি বলে নাম থাকায় আমাকে উদাসীন বলে মনে করা হলে আমার বড় মন খারাপ হয়। আর কেউ উদাসীন না বললেও প্রফেসর রাশিদা বেগম বলেন। তিনি আমাকে প্রথম দিন থেকেই মোটেও পছন্দ করতে পারছেন না। প্রথম দিন বিভাগে যেতে আমার দু’মিনিট দেরি হয়েছিল বলে। রাশিদা বেগমের মাথার কোষে কোষে গেঁথে গেছে সেই দু’মিনিটের কাহিনী। এমনিতে খিটখিটে মেজাজ তাঁর। গাইনি বিভাগের তিনটি শাখার মধ্যে তিন নম্বর শাখার তিনি অধ্যাপিকা। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো মহাশয়ার অবস্থা। মেজাজ ছাড়া তাঁর বিশেষ কিছু সম্পদ নেই। রোগী সামলাতে নাস্তানাবুদ হন, কারও গোচরে এলে তিনি অবস্থা সামাল দিতে চোখের সামনে যাকেই পান তাঁর ওপর রাগ দেখান, এতে যেন তাঁর গলার স্বর সকলে শোনে এবং তাঁকেও যেন খানিকটা মান্যগণ্য করে তাঁর সহকারীরা, যেমন করে বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়াকে। বায়েস ভুঁইয়া চমৎকার মানুষ। তাঁর কাউকে ধমক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর কাজই তাঁর মূল্য নির্ধারণ করে। দেখা হলেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেমন আছি, ইতিবাচক উত্তর ছুঁড়ে দিয়ে খুব দ্রুত সরে যাই তাঁর সামনে থেকে। প্রথমত আমার একটু কুণ্ঠাও থাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছি না বলে। অধ্যাপকের আশপাশে যারাই ভিড় করে থাকেন, সকলেই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের অর্ধেক নয়তো পুরো ডিগ্রি নিয়েছে। আমি তাই সংকোচে দূরে থাকি। এই সংকোচই আমার ইচ্ছের অংকুরোদগম ঘটায় মনে, এফসিপিএসএর জন্য লেখাপড়া শুরুই না হয় করে দিই। মাও বলেন, ‘বিসমিল্লাহ বইলা শুরু কইরা দেও, তোমার বাপও খুশি হইব’। বায়েস ভুঁইয়া বিভাগের অধ্যাপক হয়েও আমাকে বেশ খাতির করেন, কারণটি আমার ডাক্তারি বিদ্যে নয়, আমার লেখা। পত্রিকায় আমার লেখা পড়েন তিনি। মাঝে মধ্যে আমাকে ডেকে আমার এই লেখাটি কিংবা ওই লেখাটি তাঁর খুব ভালো লেগেছে বলেন। লেখালেখির বিষয়টি হাসপাতালের চৌহদ্দিতে উঠলে আমার বড় অস্বস্তি হয়। হাসপাতালে আমি যে কোনও ডাক্তারের মতো ডাক্তার। আমার অন্য পরিচয়টি হাসপাতালে এসে আমার হাসপাতালের পরিচয়টি সামান্যও গৌণ করবে তা আমার মোটেও পছন্দ নয়। অ্যাপ্রোন পরে হাতে স্টেথোসকোপ নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি, দেখে মা খুব খুশি হন। আমাকে মুখে তুলে খাওয়ান। আমার পরিচর্যা করতে মা সদাসর্বদা ব্যস্ত। টাকা জমিয়ে একদিন স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ছোট একটি লাল রঙের রেফ্রিজারেটর কিনে আনি। ফ্রিজটি মা দিনে দুবেলা পরিষ্কার করেন নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে। লিলিকে হাত দিতে দেন না ফ্রিজে, কিছু যদি কোথাও দাগ লাগিয়ে ফেলে লিলি। বাইরে থেকে গরমে সেদ্ধ হয়ে এলে মা দৌড়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি এনে দেন। রান্না করে করে ফ্রিজে রেখে দেন যেন অনেকদিন খেতে পারি, যেন বাজার করতে না হয় ঘন ঘন। আমাদের সুখের সংসার অভাবে আনন্দে চমৎকার কাটতে থাকে। ইন্টার্নি ডাক্তাররা বেড়াতে আসে বাড়িতে, খেয়ে দেয়ে হল্লা করে ডাক্তারি ভাষায় আড্ডা পিটিয়ে চলে যায়। আমার এই একার সংসারটি সকলের বেশ পছন্দ হয়। খাওয়া দাওয়া প্রথম প্রথম কার্পেটে বসেই হতো, এরপর বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটতে থাকায় ছোট একটি টেবিল আর দুটো চেয়ার রান্নাঘরে বসিয়ে দিই। ছোট একটি টেলিভিশন, ছোট একটি গান শোনার যন্ত্রও কিনি। আর কিছুর কি দরকার আছে? মা বলেন, না নেই। মা আমাকে বাধা দেন টাকা খরচ করতে। টেবিল চেয়ারগুলো যদি অবকাশ থেকে আনা যেত, তিনি খুশি হতেন। বাপের সম্পদে তো মেয়েরও ভাগ আছে। অথচ বাপ তো কোনওরকম সাহায্য করছে না, মা গজগজ করেন। বাপ সাহায্য না করলেও বাপের প্রতি ভালোবাসা আমাকে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথ থেকে হলেও বাপের জন্য শার্ট কেনায়, জুতো কেনায় ময়মনসিংহে যাওয়ার আগে। ছুটিছাটায় দু-এক দিনের জন্য ময়মনসিংহে যাওয়া হয়। বাপকে দেখতেই যাওয়া হয়। বাপের কোনও সাহায্য নিতে আমার ইচ্ছে করে না বরং বাপকে সাহায্য করতে ইচ্ছে হয়।

সাধ আছে অনেক, সংগতি তত নেই। সংগতি বাড়াতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি আরমানিটোলার বাড়ির সদর দরজায়। ডাক্তার তসলিমা নাসরিন, এম বি বি এস। রোগী দেখার সময় এতটা থেকে এতটা। মাইনের টাকা, রোগী দেখার টাকা, লেখালেখির টাকা সব মিলিয়ে যা হয় তা পই পই হিসেব করে ইস্পাতের আলমারিতে রাখি। বাপের শার্ট জুতো এসব হিসেবের বাইরে। হোক না! বাড়তি খরচের জন্য শাক ভাত খেতে হয়। না হয় খেলামই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ মার্চ, ২০১৬

ভারত এবং গরু

বছর দুই আগে বৃন্দাবন গিয়েছিলাম বেড়াতে। রাস্তাঘাটে, মাঠে গাছে, দালানে মন্দিরে বাঁদর দেখে আমি তো মুগ্ধ। আমি ওদের কলা কিনে খাওয়াতে ব্যস্ত। সেদিন ছিল গোবর্ধন পুজো। গোবর্ধন পুজোর আমি কিছুই জানতাম না আগে। সেদিনই দেখলাম গোবরকে পুজো করছে ওরা। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি, আশেপাশের কিছু লোককে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, পুজোটা কি গোবরকে করা হচ্ছে? ওরা বারবারই কনফার্ম করলো, হ্যাঁ গোবরকেই করা হচ্ছে। গোবরকে পুজো করার কারণটা জিজ্ঞেস করলাম। ওরা বললো কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বত তুলে নিয়ে পৃথিবীবাসী এবং গরুদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। রক্ষা করেছিলেন বলে কৃষ্ণের পুজো করবে, গোবরের কেন! আমাকে ওরা ইংগিতে বুঝিয়ে দিল, গোমাতার কথা আমার ভুললে চলবে না।

এক বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল বন্ধুদের, যাদের সঙ্গে গিয়েছি বৃন্দাবনে। তারা আমাকে সঙ্গে নিলো। বিশাল বাড়ি, দেখি বাড়ির ভেতরেও গোবর্ধন পুজো হচ্ছে, মেঝেয় গোবর রেখে তার চারদিকে অনেকগুলো পুরুষ ঘুরছে আর গান গাইছে। গোবরের সামনে বাড়িতে যত খাবার রান্না করা হয়েছিল সব দেওয়া হলো, গোবর পুজো হলো, পরিক্রমা হলো, এবার খাবারগুলো ভেতরে নিয়ে গিয়ে সবাইকে খাওয়ানো হলো। খেতে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমরা তো জানিই, ক্ষিধে পেলে গু-গোবরও খায় লোকে।

হিন্দুদের কাছে অনেক পশুপাখির মতো গরুও পবিত্র। গোবরকে পুজো করা হয়, গরুর প্রস্রাব খাওয়া হয়। গরুর প্রস্রাব খেলে নাকি নানা অসুখ বিসুখ সেরে যায়। শিক্ষিত লোকরাও দেখেছি মূত্রপান করছে। আমি হাঁ হয়ে যাই এমন অদ্ভুত কুসংস্কারের চর্চা দেখে। কুসংস্কার আছে জানি, কিন্তু এ যখন মানুষ খুন করতে শুরু করে, তখন তো প্রতিরোধ গড়ে না তুলে কোনও উপায় থাকে না।

গরুর জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আটজন হিন্দু গো-ভক্ত গুজরাটের একটি সরকারি ভবনের বাইরে ক’দিন আগে আন্দোলন করতে বসেছিল, ওখানে বসেই কীটনাশক পান করেছিল। অসুস্থ হয়ে পড়লে সবক’টাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, ওখানেই একজনের মৃত্যু হয়েছে। গরুকে রাষ্ট্রমাতার মর্যাদা দেওয়া এবং সারা ভারতে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার দাবিতে ওই ‘গো-ভক্তরা’ আন্দোলন করছেন। তাঁদের অভিযোগ, দেশের অনেক স্থানেই গরু হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে গরু জবাই ও এর মাংস খাওয়া চলছে।

এ তো আত্মহত্যা। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ঘটনাও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের দাদ্রিতেই তো মোহাম্মদ এখলাসকে খুন করা হলো। তারপর হিমাচলে হলো, গরু বাছুর নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল লোকেরা, তাঁদের থামিয়ে মারা হলো। দু’দিন আগে ঝাড়খণ্ডে হলো। গরু নয়, মোষ নিয়ে দুটো মুসলমান লোক বাজারে যাচ্ছিল বিক্রি করতে। ওদের পিটিয়ে আধমরা করে মুখের ভেতর কাপড় ঠেসে, গলায় ফাঁস দিয়ে, গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হিন্দু মৌলবাদীদের এহেন আচরণে তোলপাড় শুরু হয়েছে পুরো ভারতবর্ষে। অসহিষ্ণুতার বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। অনেকে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দোষ দিচ্ছেন, বলছেন, মোদির শিষ্যরাই এই খুনোখুনি করছে। মোদি ক্ষমতায় আছেন বলেই এরা আস্কারা পাচ্ছে। মোদি কিন্তু নিজে কখনও মৌলবাদীদের বলছেন না, গোমাংস যারা খাবে তাদের খুন করাটা খুব ভালো কর্ম। এই কর্মটি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তিনি কাউকে দিচ্ছেন না, বরং তিনি খুনিদের, অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে বলছেন।

তাহলে কেন গো-ভক্তরা এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে! নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা খুন খারাবি করে যাচ্ছে। মানুষ বিশ্বাস করে, হিন্দুরা কখনও গোমাংস খায়নি, গরু হত্যাও করেনি। কিন্তু বেদেই আছে যে হিন্দুরা একসময় গরু হত্যা করতো এবং গো-মাংস খাওয়া হত। অধিকাংশ হিন্দু জানেই না যে ব্রাহ্মণরাও বৈদিক সমাজে গো-মাংস খেত। পণ্ডিতরা বলেন, যেহেতু গরু মানুষের কৃষিকাজে লাগতো, তাই এই প্রাণীটিকে খেয়ে নির্বংশ না করার পরামর্শ দেওয়া হতো। তার মানে কিন্তু এই নয় যে হিন্দুদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার চল ছিল না। ছিল, ধীরে ধীরে চলটি উঠে যায়।

আমি গরুর মাংস খেতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু ভারতে বসে গরুর মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। মাংসের দোকানীদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, বিফ বলে যে মাংস এখানে পাওয়া যায়, তা আসলে গরুর নয়, মোষের মাংস। শুনেই আমার মাংস খাওয়ার ইচ্ছে উবে গিয়েছে। ভারতের কোনও ম্যাকডোনাল্ডসে বিফ নেই। যত রেস্তোরাঁয় এ পর্যন্ত গিয়েছি, কোথাও বিফ পাইনি। গো-মাংস খেতে হলে আমাকে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে হয়।

আর কত মানুষকে গরু খাওয়ার, গরু নিয়ে হাটে যাওয়ার, গরু বিক্রি করার কারণে হেনস্থা হতে হবে, মার খেতে হবে, খুন হতে হবে আমার জানা নেই। চল শুরু হওয়া সহজ, চল অচল করা সহজ নয়, বিশেষ করে সেই চল-এ যদি ধর্মের গন্ধ থাকে।

দিন দিন মানুষ সভ্য হচ্ছে, ধর্মের গোঁড়ামি থেকে নিজেদের মুক্ত করছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার ছুড়ে ফেলে আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু কিছু কট্টর মুসলিম দেশের মতো ভারতবর্ষ ধর্মকে আঁকড়ে ধরছে। সামনের দিকে না হেঁটে পেছনের দিকে হাঁটছে, অতীতের দিকে হাঁটছে। মাঝে মাঝে আমার আশংকা হয়, বিশ্বের মুসলিম আতংকবাদীদের মতোই হয়তো হয়ে উঠছে হিন্দু আতংকবাদীরা। হতে না পারলেও চেষ্টা করছে। কী জানি, চেষ্টা করতে করতেই একদিন হয়তো ওদের স্বপ্ন পূরণ হবে। মুসলিম আতংকবাদীরা সারা বিশ্বে আতংক ছড়াচ্ছে। হিন্দু আতংকবাদীরা ভারতবর্ষে আতংক ছড়াচ্ছে। মুসলিম আতংকবাদীদের উদ্দেশ্য সারা বিশ্বকে ইসলামী বিশ্ব বা দারুল ইসলাম বানানো। হিন্দু আতংকবাদীদের উদ্দেশ্য সারা ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। দুটো হয়তো সমান ভয়ংকর নয়, তবে দুটোই ভয়ংকর।

ভারতবর্ষের বাইরে গো-মাংসের মূল্য এবং জনপ্রিয়তা আর সব মাংসের চেয়ে বেশি। আর সব দেশ ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হলেও ভারতবর্ষ হতে পারছে না। মুসলমান শূকরের মাংস খাবে না, হিন্দু গরুর মাংস খাবে না। না খাওয়ার পেছনে কারণ ভিন্ন, কিন্তু কুসংস্কারটা একই রকম অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, একই রকম অসার।

তারপরও বলবো, হিন্দুরা আগের চেয়ে উদার হয়েছে। একসময় হিন্দু-বাড়িতে মুরগি ঢুকতো না। মুসলমানরা মুরগি পুষতো, মুরগি খেতো। তাই দেখে হিন্দুরা অনেক ছি ছি করতো। একসময় হিন্দু-বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন খেতো না কেউ। এখন মাংসাশি হিন্দুরা পেঁয়াজ রসুন দিয়ে মুরগি রান্না করে খায়। হয়তো আজ গরুর মাংস খেতে ভয়ানক আপত্তি, ভবিষ্যতে এই আপত্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মুসলমানদের জন্য তো মদ হারাম। মুসলমানরা কি মদ খাচ্ছে না? অনেকেই খাচ্ছে। আরাম আয়েশ আর ভোগ বিলাসের জন্য মানুষ ধর্ম খোয়াতে রাজি। অনেক খুইয়েছে এ যাবৎ। হারাম জিনিস বেশিদিন হারাম থাকে না। প্রয়োজনে হারামকে হালাল করে নেওয়ার চল সমাজে চিরকালই ছিল, এখনও আছে। ইসলাম বলে কুকুর নাপাক জিনিস, কিন্তু মুসলমানের বাড়িতে কি কুকুর পোষা হচ্ছে না? ঠিকই হচ্ছে। চোর তাড়ানোর জন্যও হচ্ছে, ভালোবেসেও হচ্ছে।

যে গরুর জন্য জীবন নিতে প্রস্তুত হিন্দু সম্প্রদায়, সেই গরুকে দেখেছি শাহানশাহ-এর মতো রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। গাড়ি থেমে আছে, অথবা চলছে ধীরে। এই স্বাধীনতা আর সম্মান ক’টা গরুর ভাগ্যে জোটে। কিন্তু এই গরুই আবার নিজেদের সামান্য খাদ্য জোটাতে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। কোথাও খাবার নেই। পার্কে কিছু সবুজ ঘাস ছিল, কিন্তু পার্কে কোনও গরুর ঢোকা বারণ।

খাবার না পেয়ে গরুরা ডাস্টবিন ঘেঁটে যা পায়, তাই খায়। তারা পলিথিনের ব্যাগ খায়, হ্যাঁ দিব্যি খেয়ে ফেলে। গরু রক্ষা সমিতিরা এসব অসহায় গরুদের কেন দেখতে পায় না, জানি না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ মার্চ, ২০১৬

নারী দিবস

১.

নারী দিবসের সকালে কিছু ফোন পেলাম। সকলে বললো, ‘হ্যাপি উইমেন’স ডে’। ঠিক যেমন করে তারা বলে ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইন’স ডে’ অথবা ‘হ্যাপি মাদারস ডে’। ভ্যালেনটাইন’স ডে বা মাদারস ডে-তে হ্যাপিনেসের বা সুখের ব্যাপার থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকা বা মায়েদের আনন্দ উৎসব করার জন্য মূলত ওই দুটো দিন। কিন্তু নারী দিবসের তো একই উদ্দেশ্য নয়। নারী দিবস শুরুই হয়েছিল নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যগুলো দূর করার আন্দোলনের জন্য। এখনও একই কারণে নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবস নারীর আনন্দ উৎসবের দিবস নয়। এই দিবসের উপস্থিতি প্রমাণ করে নারী আজও অত্যাচারিত, অসম্মানিত, নারী আজও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। সে কারণেই এই দিবসে আজও নারীরা প্রাপ্য অধিকারের জন্য দাবি জানায়।

‘নারী দিবস’ জিনিসটি আমাকে কখনও আনন্দ দেয় না। আনন্দ দেয় না কারণ দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখের দিন। দুঃখের দিন কারণ মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য আজও আমাদের কাঁদতে হচ্ছে, চিৎকার করতে হচ্ছে, সভা-সেমিনার করতে হচ্ছে, রাস্তায় নামতে হচ্ছে, মিছিলে যেতে হচ্ছে।

সেই কতকাল আগে, সম্ভবত ১০৫ বছর আগে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও অসম্মানিত না হওয়ার অধিকার চেয়েছিল নারী। সেই থেকে আজও বছর বছর এই দিনটিতে একই অধিকার চাওয়া হয়, চাওয়া হয় কারণ আজও নারীরা নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত, অসম্মানিত। আজও আমরা নারীরা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। যেদিন সমানাধিকার পেয়ে যাবো, সেদিন থেকে এই দিবসটির অস্তিত্ব আর থাকবে না। সর্বান্তকরণে দিবসটির বিলুপ্তি চাই আমি।

২.

আমি তো সবসময় বলি, বছরের ৩৬৪ দিন পুরুষ দিবস, ১ দিন নারী দিবস। নারী আর পুরুষের মধ্যে যে হাজারো বৈষম্য, সেগুলো হটিয়ে দিলেই নারী দিবস করার প্রয়োজন পড়বে না। নারীবিদ্বেষী কিছু পুরুষ যে ‘পুরুষ দিবস’ পালন করার আয়োজন করছে, সেটিও রোধ করতে হবে। নারী পুরুষ উভয়ে যেন ঘটা করে ‘মানব দিবস’ উত্যাপন করতে পারি।

৩.

নারী দিবসে কি ধর্ষণ ঘটেনি? নারীর ওপর অত্যাচার বন্ধ ছিল একদিনের জন্যও? মেয়েশিশু পাচার হয়নি, শিশু কিশোরীদের যৌনদাসী বানাবার জন্য পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়নি? নারী দিবসে নারী-হত্যা বন্ধ ছিল? নারীকে কি পুড়িয়ে মারা হয়নি নারী দিবসে? সত্যি কথাটা খুলেই বলি, বিশ্বজুড়ে নারী-নির্যাতন চলেছে নারী দিবসে।

১টি দিনের জন্যও নারীকে রেহাই দেওয়া হয় না। জানি না বছরের ৩৬৫ দিন কী করে রেহাই পাবে নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের, এ সমাজে পুরুষের গায়ে ফুলের টোকা পড়ে না তা নয়। পুরুষও এই সমাজে অত্যাচারিত, তবে পুরুষরা পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অত্যাচারিত নয়। যেসব কারণে পুরুষ ভোগে, সেসব কারণে নারীও ভোগে। দারিদ্র্য নারী পুরুষ উভয়কেই ভোগায়। কিন্তু নারী হওয়ার কারণে নারীকে বাড়তি ভুগতে হয়। পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষকে ভুগতে হয় না। বরং যেসব আরাম আয়েশ, আর বাড়তি সুবিধে পুরুষ পায়, সে পুরুষ হওয়ার কারণেই পায়।

৪.

আমার নারী দিবসটা কেটেছে অন্য সাধারণ দিনের মতোই। এই দিন আমি কোনও আনন্দ উৎসবে যোগ দিই নি। কোনও বক্তৃতা বিতর্কও করি নি। মনে অর্ধেক দিন কষ্ট দিচ্ছিল বড় একটি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর। খবরের শিরোনাম : ‘মহিলাদের গোপনাঙ্গের দুর্গন্ধের ৮টি কারণ’। নারী দিবসে নারীদের জন্য পুরুষের প্রতিষ্ঠান থেকে চমৎকার এক উপহার বটে!

নারীকেই চিহ্নিত করা হয় ডাইনি বলে, অপয়া বলে, অমঙ্গল বলে, নরকের দ্বার বলে, নোংরা আর দুর্গন্ধের আধার বলে। যেন নারীরা লজ্জায় সংকুচিত হয়, ভয়ে সিটিয়ে থাকে, যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যেন নিজেকে ঘৃণা করতে শেখে।

এ তো গেল অর্ধেক দিনের কথা। আমার মন খারাপের কথা। বাকি অর্ধেক দিন নিজেকে লজ্জা আর ভয় থেকে মুক্ত করেছি, আত্মবিশ্বাস যতটুকু হারিয়েছিল, ততটুকু ফেরত এনেছি, নিজেকে ঘৃণা করার বদলে নিজেকে ভালোবেসেছি। বাকি অর্ধেক দিন আমি ভালো ছিলাম। যে মেয়েরা নিজেকে ঘৃণা করছে, যেহেতু সমাজ শিখিয়েছে মেয়েদের ঘৃণা করতে, তাদের বলছি ঘৃণা বন্ধ করতে। ঘৃণা করলে সামনে যেতে নিজেরাই নিজেদের বাধা দেয়। ঘৃণা করলে পিছু হঠতে থাকে মানুষ। ষড়যন্ত্র করে মেয়েদের পেছনে রাখা হয়েছে, তারপরও মেয়েদের আরও পেছনে যাওয়ার ঝোঁক। অনেক আগেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাদের।   দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ সামনে যায়। সামনে যা কিছু থাক, ভেঙেচুরে আরও সামনে যায়। নিরাপদ দূরত্বে যায়। মেয়েরা কবে মানুষ হবে?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ মার্চ, ২০১৬

খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী

১৯৯৩। দেশজুড়ে চলছেই আমার মুণ্ডুপাত। ময়মনসিংহে আমাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে পোস্টার পড়েছে, বাবার আরোগ্য বিতানের দেওয়ালেও। অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেওয়া পোস্টার। আসলে, তসলিমাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে রঙ্গ করা যায়, এতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাধা কে দেবে, আমি তো কোনও দল করি না যে আমার দলের লোক গিয়ে ওদের মাথাটা ফাটিয়ে আসবে। এমন সময় একটি খবর বেরোয়, প্রকাশ্য জনসভায় সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের সভাপতি মাওলানা হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমার মাথাটি কেটে নিয়ে হাবীবুর রহমানের হাতে যে দেবে, সে পাবে এই টাকা। পঞ্চাশ হাজার টাকা নেহাত কম টাকা নয় বাংলাদেশে। শুরুতে মোটেও আমি গা করিনি। প্রতিদিন তো কতই খবর বেরোচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। খবরটি বাংলাবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি চারকোণা বাক্সের মধ্যে ছাপা হয়েছে। না, এ কোনও উড়ো খবর নয়, প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর। হঠাত্ আমার বুকের মধ্যিখানটায় অনুভব করি হিম হিম কিছু। আন্দোলন হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, মসজিদে প্রতি শুক্রবার আমাকে গালিগালাজ করা হয়, লিফলেট বিতরণ হয়, পোস্টার ছাপা হয়, দেয়ালে সাঁটা হয়, মিছিল-মিটিংএ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে, ওয়াজ মাহফিলে, ইসলামি জলসায় আমায় চিবিয়ে খাওয়া হচ্ছে, হচ্ছে হোক, সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার যাকে খুশি গালি দেওয়া, কিন্তু মাথার মূল্য ধার্য হবে কেন! এ অধিকার কে কাকে দিয়েছে!

আমার ফাঁসির দাবিতে মাওলানা হাবীবুর রহমান সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল ডেকেছেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, কোথাকার কোন সাহাবা সৈনিক পরিষদের ডাকে হরতাল হবে না। কোনও বড় রাজনৈতিক দল ছাড়া হরতালের ডাক দিলেই তো আর হরতাল হয় না! কিন্তু আমাকে অতি বিস্মিত হতে হয়, যখন খবর বেরোয় যে অতি শান্তিপূর্ণভাবে সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল পালন হয়েছে। শহরে কোনও দোকানপাট খোলেনি, গাড়ির চাকা ঘোরেনি। কী কারণ হরতাল পালনের! কারণ সিলেটের মানুষ আমার ফাঁসি চায়। ফাঁসি যদি সরকার না কার্যকর করে, তাতে ওদের অসুবিধে নেই। মাথার মূল্য ঘোষণা করা আছে। যে কেউ মাথাটি কাটার ব্যবস্থা করতে পারে। ঘরের গা- কাঁপা আঁধারে আমি রুদ্ধশ্বাস বসে থাকি। জানালা দরজার পর্দা টেনে দেওয়া, যেন বাইরে থেকে কেউ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি না ছোড়ে। এই ব্যবস্থায় যে কাজ হবে না, তা আহমদ শরীফ বলেন। তিনি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছেন?’

‘কিছু না, বসে আছি। ’

আহমদ শরীফ ধমক লাগালেন, ‘বসে থাকলে হবে? কী কাণ্ড হচ্ছে, টের পাচ্ছেন না! এক্ষুনি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেন। ’

‘পুলিশ পাহারা? কী করে করব?’

‘মতিঝিল থানায় একটি চিঠি লিখে দেন। লেখেন যে আপনার মাথার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার জন্য যেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমি লোক পাঠাচ্ছি, আমার লোক আপনার চিঠি নিয়ে থানায় দিয়ে আসবে। ’

আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাত্ত্বিক সাহিত্যিক, তাঁর ফাঁসির দাবিতেও মোল্লারা একসময় পথে নেমেছিল। কিছু কিছু বিজ্ঞ বিদগ্ধ মানুষ আছেন, যাঁদের বিরাটত্বের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া পেলে, যাঁদের বিচ্ছুরিত বিভায় স্নাত হতে পারলে সমস্ত বিভ্রান্তি বিদায় হয়। আহমদ শরীফের মত এমন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির প্রশ্রয় আমাকে প্রসন্ন করে। গজনবী নামের এক লোককে পাঠালেন আহমদ শরীফ। গজনবী আমার নিরাপত্তা চাওয়ার চিঠি মতিঝিল থানায় দিয়ে এলেন। এরপর দুই দিন যায়, তিন দিন যায়, সপ্তাহ চলে যায়, থানার লোকেরা মোটেও রা শব্দ করেন না। কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর টিকিটি দেখতে পাওয়া যায় না। সকাল বিকাল হাত পা ঠাণ্ডা হচ্ছে। বাড়িতে বলে দিয়েছি কোনও অচেনা কেউ এলে যেন দরজা কেউ না খোলে। নিচে দারোয়ানদেরও বলা আছে ইন্টারকমে যেন কথা বলে নেয় কেউ আমার খোঁজে এলে। এখানকার নিয়মই এই, তারপরও বিশেষভাবে সচেতন থাকার জন্যও অনুরোধ করি। কী কারণ এই বাড়তি সতর্কতা তা অবশ্য ভেঙে বলি না। ভাল যে বাড়ি কেনার পর পরই একটি গাড়ি কিনে ফেলেছিলাম, এখন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা রিক্সায় চড়তে হয় না। গাড়িতে চড়ে কোথায়ই বা আমার যাওয়া চলে! কোনও দোকানে? কোনও মেলায়? কোনও অনুষ্ঠানে? নাটক সিনেমা দেখতে? কোনও পার্কে? কোনও সভায়? না। কোথাও না। কোথাও আমার যাওয়া চলে না। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার চলাচলের সীমানা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠল। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমি ঘরবন্দী হলাম। কবিবন্ধুরাও আমাকে কোথাও আর আমন্ত্রণ জানান না। কবিতার অনুষ্ঠান থেকে কবিতা পড়ে এসে জানান অনুষ্ঠান চমত্কার হয়েছে। লেখকদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে, অনুষ্ঠান শেষে জানান কেমন হল, কী হল। শিল্পী সাহিত্যিকদের র্যালি হচ্ছে, র্যালি থেকে ফিরে এসে জানান কেমন জমজমাট হয়েছে সে র্যালি। সকলে ব্যস্ত উচ্ছল উত্সবে, মৌসুমি মেলায়, মঞ্চে। নাটক হচ্ছে, গান হচ্ছে। সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। কেউ একবারও আমি যে যেতে পারিনি সে জন্য দুঃখ করেন না। আমি যেতে পারব না, এটি যেন চিরন্তন সত্য। হঠাত্ যদি কোনওদিন বলে বসি, আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তখন চমকে ওঠেন বন্ধুরা, বলেন, ‘বল কী বল কী, পাগল নাকি তুমি? বাইরে বের হয়ো না। কখন কী বিপদ হয় বলা যায় না। ’ সুতরাং নিরাপদে থাকো। ঘরে বসে থাকো চুপটি করে। লক্ষ্মী মেয়ের মত। আমরা আনন্দ করে বেড়াবো। আমরা হৈহল্লা করব। তোমার জন্য এসব নয়। নিরাপত্তা তোমার জন্য জরুরি। আনন্দ স্ফূর্তি নয়। উত্সব নয়। ঘরে বসে থাকতে মন খারাপ লাগে? কিন্তু বেঁচে তো আছো। বেঁচে থাকাটা প্রয়োজন। কথা ঠিক বটে। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে তা সম্ভবত কেউই অনুমান করতে পারেন না। তবে ওঁরা আসেন আমার বাড়িতে। আমিও যাই মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়িতে। বাড়িতে বাড়িতে আমাদের দেখা হয়। ওঁরা যখন আসেন, খানিকটা ভয়ে ভয়েই আসেন, এসবির লোকদের ভয়। আমার বাড়িতে আসা মানে সরকারি খাতায় লেখা হয়ে যাওয়া নাম ঠিকানা। নিচে নিরাপত্তা প্রহরীর ঘরে খাতায় নাম লিখে আসতে হয়। সেই খাতা থেকে এসবির লোকেরা প্রতিদিনই নাম টুকে নিচ্ছে। ওঁরা এলে অল্প স্বল্প গল্প হয়, খাওয়া হয় দাওয়া হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, রাত হয়। কিন্তু যা হয় সব ঘরে হয়। বাইরে নয়। বাহির আমার জন্য নয়। খোলা হাওয়া আমার জন্য নয়। মুক্তাঙ্গন আমার জন্য নয়। মৌলবাদীরা জোট বাঁধছে, খবর পাই। মসজিদ মাদ্রাসাগুলোয় ডাক দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনের। সভার আয়োজন হচ্ছে। বড়সড় মিছিলের জন্য জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। এক বিকেলে বাড়িতে আমি আর কাজের মেয়ে রীনা কেবল আছি। এমন সময় দরজায় শব্দ। দরজায় ছিদ্র দিয়ে দেখি ছ’জন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কী চায় ওরা! রীনাকে বলি, দরজা না খুলে জিজ্ঞেস করতে, কাকে চায়। রীনা চেঁচিয়ে শুধায়, কারে চান?

—দরজা খোলেন।

—কারে চান কন?

—দরজা খোলেন আগে। তারপরে বলি, কারে চাই।

রীনাকে আমি ইঙ্গিতে বলে দিই যেন দরজা না খোলে, যেন বলে দেয় কেউ নেই বাড়িতে। রীনা বলে। কিন্তু চলে যায় না ওরা, থাকে, থেকে দরজায় বিকট শব্দে লাথি দিতে শুরু করে। কলিং বেল চেপে ধরে রাখে। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট পার হয়ে যায়, দরজায় লাথি কষা কলিং বেল চেপে রাখা কিছুই থামছে না। আমি কুলকুল করে ঘামছি। ইন্টারকম কাজ করছে না। ফোন ডেড। এই ন’তলা থেকে চিত্কার করে কাউকে ডাকলে কেউ শুনবে না। দরজায় যত রকম সিটকিনি আছে কব্জা আছে সব লাগিয়ে রীনাকে নিয়ে আমার লেখার ঘরটিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। ওদিকে সদর দরজাটি ভেঙে ফেলতে চাইছে ওরা। ভেঙে ফেলবে, তারপর যে ঘরে বসে আছি, সে ঘরের দরজাটিও ভেঙে ফেলবে, তারপর! তারপর পাঁচজন আমার হাত পা মাথা চেপে ধরে থাকবে, একজন তার পাঞ্জাবির তল থেকে রামদা বের করে আমার গলাটি কাটবে। আমি দু’হাতে গলাটি আড়াল করে রাখি। শরীর শিথিল হতে থাকে। শিথিল হতে হতে নুয়ে পড়তে থাকে, কুঁকড়ে শুয়ে থাকি মেঝেয়ে। রীনা আমার মাথার কাছে নিঃশব্দে বসে থাকে। আমরা কেউ কারও শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাই না। প্রচণ্ড ঘুম পেতে থাকে আমার।

ঘণ্টা দুয়েক পর লোকগুলো চলে যাওয়ার পর নিচের নিরাপত্তা প্রহরীদের জিজ্ঞেস করি কেন তারা ছটি অচেনা লোককে আমার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দিল। প্রহরীরা জানিয়ে দেয় ছ’জন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে তা বলেনি তাদের কাছে। দু’নম্বর দালানের কোনও এক বাড়িতে যাচ্ছে বলেছে। এর মানে যে কেউই আবদুল জলিল বা মান্নান তরফদারের বাড়িতে যাচ্ছে বলে আমার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতে পারে। ইন্টারকমে তো নিচ থেকে খবর দিতে হয় আগে, কিন্তু যদি ইন্টারকম কাজ না করে, যেমন অকেজো হয়ে যায় মাঝে মধ্যে! প্রহরীদের বলে দিই, আমার বাড়িতে কেউ যদি আসতে চায়, যদি ইন্টারকম কাজ না করে, তবে প্রহরীদের কেউ যেন আগন্তুককে একা আসতে না দিয়ে সঙ্গে আসে। ‘ওপরে যাবে যে, আমাদের তো এত বাড়তি লোক নাই ম্যাডাম। ’ নেতাগোছের এক প্রহরী আমাকে জানিয়ে দেয়।

‘এখনও সময় আছে, তওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যা, নয়ত ঘোষণা দিয়ে হিন্দু হয়ে যা। এ দুটোর কোনও একটি না হলে বিপদ হবে। ’ চিঠির বাক্সে কেউ ফেলে রেখে গেছে কাগজটি। খোলা কাগজের হুমকি তো আছেই, উড়ো চিঠিও আসছে। ‘ধর্ম নিয়ে যদি আর একটি কথা লিখিস, তবে সেই দিন থেকে তোর বেঁচে থাকা হারাম হয়ে গেল মনে রাখিস। ’ ফোনেও অচেনা কর্কশ কণ্ঠ মাথা ফাটাবো, হাত কেটে দেব, পা ভেঙে দেব, রগ কেটে দেব, রাস্তায় ফেলে গণধর্ষণ করব, মুণ্ডু কেটে হাতে ধরিয়ে দেব বলে যাচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি খুব কাছে কোথাও ওত পেতে আছে আততায়ী।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৩ মার্চ, ২০১৬

ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প

রুদ্রকে নিয়ে যে যৌথজীবনের চমৎকার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে স্বপ্ন-পোড়া-ছাই আমার সর্বাঙ্গে ত্বকের মত সেঁটে থাকে। জানি রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয়। জানি যার যার জীবনের দিকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। জানি এখন সব ধুলোকালিছাই ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন হওয়ার সময়। তবু সময় গড়াতে থাকে, দিন পুড়তে থাকে নির্জন রোদ্দুরে, রাতগুলো অন্ধকারে তক্ষকের মত ডাকতে থাকে আর উঠোনের উচ্ছিষ্ট কাঠের মত বসে থাকি আমি নিজেকে নিয়ে। এই জীবনকে নিয়ে ঠিক কোনদিকে যাব, কোথায় গেলে নেই নেই করা হু হু হাওয়া আমার দিকে বদ্ধ উন্মাদের মত ছুটে আসবে না বুঝে পাই না। জীবনটিকে একবার পালক আরেক বার পাথর বলে বোধ হতে থাকে। এই যে জীবন, যে জীবনটি খুঁড়োতে খুঁড়োতে এসে শেষ অবদি বসেছে আমার গায়ে, কখনও মোটেও টের পাই না, আবার আমার ঘাড় পিঠ সব কুঁজো হয়ে যায় এই জীবনেরই ভারে। এই জীবনটিকে আমি ঠিক চিনি না, জীবনটি আমারই ছিল অথচ আমার ছিল না। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে আমি এর যা কিছু পানীয় সব ঢেলে দিয়েছি একটি আঁজলায়, নিজের তৃষ্ণার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি। পরে কাতর হয়ে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখছি জলহীন শুষ্ক মরুর মত পড়ে আছে জীবন। আমারই ঘড়ায় আমার জন্য কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রতিদিন সেই আগের মত আবার ঠিক আগের মতও নয়, ডাকপিয়নের শব্দে দৌড়ে যাই দরজায়। কারও কোনও চিঠির জন্য আমি অপেক্ষা করে নেই, জানি। কিন্তু চিঠির ভিড়ে চিঠি খুঁজি, একটি চেনা চিঠি খুঁজি, যে চিঠির শব্দ থেকে একরাশ স্বপ্ন উঠে ঘুঙুর পরে নাচে, যে চিঠির শব্দ থেকে রুপোলি জল গড়িয়ে নেমে আমাকে স্নান করায়। জানি যে আগের মত তার কোনও চিঠি আমি আর কোনওদিন পাবো না, তারপরও ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা ইচ্ছেরা অবাধ্য বালিকার মত হুড়মুড় করে কী করে যেন বেরিয়ে আসে। আসলে এ আমি নই, আমার ভেতরের অন্য কেউ একটি চেনা হাতের লেখা খোঁজে চিঠির খামে। আমি নই, অন্য কেউ চেনা হাতের লেখার চিঠি না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রতিদিন ডাকপিয়নের ফেলে যাওয়া চিঠি হাতে নিয়ে সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি আমি। আমার নয়, অন্য কারও। কোথাও কোনও গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা সেই অন্য কাউকে ঠেলে সরাতে চাই দূরে, পারি না। রুদ্রর চিঠি আমি আর কখনও পাবো না জানি, তবু বার বার ভুলে যাই, প্রতিদিন ভুলে যাই যে পাবো না। ছাইএর ওপর উপুড় হয়ে অপ্রকৃতস্থের মত খুঁজতে থাকি তিল পরিমাণ স্বপ্ন কোথাও ভুল করে পড়ে আছে কি না।

ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলায় প্রতি বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চেনা কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, এমনকী কারও কারও সঙ্গে মেলার ভেতর চায়ের দোকানে বসা হয়, আড্ডা হয়, কিন্তু চোখ খুঁজে ফেরে একটি চেনা মুখ, একজোড়া চেনা চোখ। চোখের তৃষ্ণাটি নিয়ে প্রতিরাতে ঘরে ফিরি। তবে একদিন দেখা মেলে তার, আমার ভেতরের আমিটি আমাকে পা পা করে তার দিকে এগিয়ে নেয়। ইচ্ছে করে বলি, ‘তুমি কি ভাল আছ? যদি ভাল আছ, কী করে ভাল আছ? আমি তো ভাল থাকতে পারি না! এই যে আনন্দ করছ, কী করে করছ? আমি তো পারি না, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পারি না। ’ কোনও কথা না বলে তাকে দেখি, বন্ধু বেষ্টিত রুদ্রকে অপলক চোখে দেখি। ইচ্ছে করে বেষ্টন ভেদ করে রুদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, হাত ধরে তাকে নিয়ে আসি, সেই আগের মত দু’জন পাশাপাশি হাঁটি মেলার মাঠে। ইচ্ছেগুলো নাড়ি চাড়ি, ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি। ইচ্ছের চোখে কালো রুমাল বেঁধে দিয়ে দৌড়ে পালাই, জিতে গেছি ভেবে অট্টহাসি হাসি। আমার হাসিই, নিজের কানে শুনি কান্নার মত শোনাচ্ছে। রুদ্রর নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে, তার আনন্দ আমি কেবল দূর থেকে অনুভব করি। ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’, তার নতুন বইটি কিনে যখন বাড়িয়ে দিয়েছি তার দিকে অটোগ্রাফ নিতে, রুদ্র কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে আমাকে দেখে প্রথম পাতায় লেখে, যে কোনও কাউকে।

হ্যাঁ, আমি এখন রুদ্রর কাছে যে কোনও কেউ। বইটি হাতে নিয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপর ইচ্ছেগুলো বাঁদরের মত লাফাতে থাকে। ছিঁড়তে থাকে আমাকে। রুদ্র কি জানে কী ভীষণ রকম আমি চাইছি যেন সে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে কেমন আছি আমি, কবে এসেছি ঢাকায়, কতদিন থাকব। চেনা মানুষগুলো সকলেই তো আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। রুদ্র কি আমার কম চেনা ছিল! কী করে এমন নিষ্পৃৃহ হতে পারে সে! কেউ কি এত শীঘ্র ভুলে যেতে পারে তার সবচেয়ে আপন মানুষটিকে। প্রশ্নগুলো আমার ইচ্ছেগুলোর কাঁধে সওয়ার হয়ে উৎসবমুখর মেলা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

মেলার শেষদিকে রুদ্রর সঙ্গে কথা হয়, চা খাওয়া হয় মুখোমুখি বসে। জিজ্ঞেস করি পায়ের কথা। বলে আগের চেয়ে কম দূরত্ব সে ডিঙোতে পারছে এখন। সিগারেট ছেড়েছো? হেসে বলে, ও ছাড়া যাবে না। আর কিছু ছেড়েছে কি না জিজ্ঞেস করি না। আমার শুনতে ভয় হয় যে বাকি নেশাগুলোও তার পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। রুদ্র অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে গভীর করে তাকিয়ে থেকে ভারী কণ্ঠে বলে, চল ঝিনেদা চল, কাল ভোরবেলা। আমি যাব কি না, যেতে চাই কি না, কোনও জানতে চাওয়া নয়। তার যেন দাবি আছে আমার ওপর, সেরকমভাবেই বলে। যেন রুদ্র জানেই যে আমি যাব। একবার স্পর্শ করলে কেঁদে উঠব অবুঝ বালিকা। কাল ময়মনসিংহে ফেরার কথা আমার, আর হঠাৎ কিনা ঝিনাইদহ যাওয়ার প্রস্তাব। ঝিনাইদহে কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, ওখানে আরও কিছু কবি যাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত নিই আমি যাব ঝিনাইদহ, এ যাওয়া কোনও উৎসবের আনন্দে শরিক হওয়ার জন্য নয়। এ কেবলই রুদ্রর পাশে থাকার জন্য। তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে আমার, আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নই, কিন্তু এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছের মানুষ কে আছে আমার রুদ্র ছাড়া! বন্ধু কে আর আছে! দীর্ঘ বছর ধরে এক রুদ্রকেই আমি আপন করে তুলেছি, তাকেই আমি আমার জগৎ করে তুলেছি। রুদ্র আমাকে দুঃখ দিয়েছে জানি, কিন্তু আমি তো এ কথা অস্বীকার করতে পারি না তাকে যে ভালোবাসি।

ঝিনাইদহ যাওয়ার বাস ছাড়ে বাংলা একাডেমি থেকে। পথে আমাদের আলাদা জীবনে যা ঘটছে ছোটখাটো ঘটনা দুর্ঘটনা সব বলি পরস্পরকে। একটি কথাই আমি কেবল লুকিয়ে রাখি, আমার কষ্টের কথা। রুদ্র হঠাৎ বলে, কবিতা শুনবে? প্রিয় কবির কবিতা শুনব না, এ কেমন কথা। রুদ্র, বাসে বসে পাশে বসে, পড়ে, দূরে আছো দূরে। বাইরের কৃষ্ণচূড়ার লালের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ, উদাসীন আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় লু হাওয়া। রুদ্র তার কবিতার কথা শোনাতে থাকে, ইদানীং সে দুহাতে লিখছে, প্রচুর রাজনৈতিক কবিতা, পাশাপাশি একটি কাব্য নাটকও। কবিতার খাতা বের করে নতুন লেখা কবিতাগুলো আমাকে পড়তে দেয়। লক্ষ্য করি, নিপাত যাক ধ্বংস হোক জাতীয় কবিতা ছাড়া ব্যক্তিগত অনুভবের কবিতাগুলো অন্যরকম, নতুন ধরনের। নতুন ধরনটি ধারণ করতে সময় নেয়, কিন্তু সে যে পুরোনো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, তা অনুভব করে প্রশান্তি আসে। নতুন ধরনটি ধীরে ধীরে একটি স্নিগ্ধ মনোরম জগতে নিয়ে দাঁড় করায়, যে জগতে ব্যক্তি রুদ্র অনেক বেশি আন্তরিক, অনেক বেশি গভীর।

ঝিনাইদহে আমরা যে যার কবিতা পড়ি মঞ্চে, অসত্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচার অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবিতা। মঞ্চ থেকে নেমে ধীরে হেঁটে, থেমে থেমে হেঁটে রুদ্র পিছিয়ে পড়ে যখন সবাই মিলে আমরা যাচ্ছি কোথাও! অল্প দূর হেঁটেই পায়ের যন্ত্রণা তাকে বারবারই দাঁড় করিয়ে দিলে কাঁধখানা বাড়িয়ে দিই যেন ভর দিয়ে দাঁড়ায়। বড় অসহায় দেখতে লাগে রুদ্রকে। ইচ্ছে করে তার অসুখগুলো এক ফুঁয়ে ভাল করে দিই, ইচ্ছে করে হাত ধরে দৌড়ে যাই দুটো উদ্দাম, উচ্ছল, উষ্ণ হৃদয়, সবার আগে, সামনে।

রাতে অতিথিদের ঘুমোবার আয়োজন হচ্ছে যখন, আমার আর রুদ্রর জন্য আলাদা দুটি ঘরের ব্যবস্থা করা হল, কারণ অতিথিদের একজন বাড়ির কর্তার কানে কানে আমাদের বিয়ে-বিচ্ছেদের খবরটি পৌঁছে দিয়েছেন। রুদ্র আর আমি দুজনই আলাদা ঘরের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে এক বিছানায় ঘুমোই। অনেক অনেকদিন পর রুদ্র আমাকে স্পর্শ করে গভীর করে। অনেক অনেক দিন পর রুদ্র আমাকে চুমু খায়। অনেক অনেক দিন পর দুজনের শরীর একটি বিন্দুতে এসে মেশে। একবারও আমার মনে হয় না রুদ্র কোনও পরপুরুষ। মনে হয় না যে আমরা এখন পরস্পরের অনাত্মীয় কেউ, অবন্ধু কোনও। পরদিন ঝিনাইদহে সকাল হয়, লোকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কী করে পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোতে রুদ্রর না হোক, আমার দ্বিধা হল না! আমার হয়নি। যে পাপবোধের কথা অন্যরা ভাবে, সেই পাপবোধের লেশমাত্র আমার মধ্যে নেই। কারও ভ্রুকুঞ্চন আমাকে স্পর্শ করে না। আমি রুদ্রকে কাগজেপত্রে ত্যাগ করেছি তা ঠিক, তবে কোনও পুরুষকে যদি আমার সবচেয়ে কাছের বলে মনে হয়, সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়, সে রুদ্র। এর মধ্যে এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই, এক ফোঁটা মিথ্যে নেই। ভালবাসি এক রুদ্রকেই, যতই তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকুক না কেন। এই ভালবাসার বোধটি আমি খুব গোপনে গোপনে লালন করি। এই বোধটি আমার একটি হাত নিয়ে রাখে রুদ্রর উষ্ণ কৃষ্ণ হাতে। এই বোধটি একা নিভৃতে বসে থাকে, সংসার যাপনের পরিকল্পনা করে না, ভবিষ্যতের কথা সামান্যও ভাবে না, বোধটি বোধহীন বটে।

ঝিনাইদহ থেকে যখন ঢাকা ফিরছি, রুদ্র শিমুল নামের একটি মেয়ের কথা বলে, মেয়েটিকে সে গত বছরই প্রথম দেখে বইমেলায়, মেয়েটিকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছে। কবিতাগুলো শোনায় আমাকে।

হঠাৎ কী হয় জানি না, চোখ ভিজে ওঠে কী! বাসের জানালায় তাকিয়ে আড়াল করি ভেজা চোখ। খোলা জানালা গলে হাওয়ার সঙ্গে ধুলো আসছে উড়ে, যেন সেই ধুলো চোখে পড়েছে বলে দ্রুত মুছে নিচ্ছি, এমন করে মুছি জল। রুদ্রকে বুঝতে দিই না আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে। আমার তো কোনও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কেন হবে! রুদ্রর আর আমার জীবন এখন আলাদা। এখন সে কারও প্রেমে পড়তেই পারে, কাউকে সে বিয়ে করতেই পারে।

হেসে, যেন রুদ্রর এই প্রেম আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে, সুখে আমি ফেটে পড়ছি, এমন স্বরে এবং ভঙ্গিতে বলি, জীবন বদল করতে রাজি মেয়েটি?

রুদ্র বললো, হ্যাঁ।

ভালোবাসো ওকে? —জিজ্ঞেস করি। রুদ্র তাকায় আমার চোখে। চোখে ফুটে আছে অসংখ্য শিমুল। চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালায়, বাইরের ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখতে দেখতে, কী জানি কোথাও সে শিমুল খুঁজছে কি না, সুখ-সুখ গলায় বলে, বাসি।

আমি জানালার ওপারে ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বলি, না এমনি। রুদ্রকে হঠাৎ করে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। বন্ধু সে আমার, কিন্তু যেন কাছের কোনও বন্ধু নয়। আপন সে আমার, কিন্তু তত যেন আপন নয়।

গভীর রাতে ঢাকা পৌঁছোলে রুদ্র তার বাড়িতে নিয়ে যায় বাকি রাতটুকু কাটাতে। ইন্দিরা রোডেই রুদ্র একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। দোতলায় রুদ্রর পেছন পেছন উঠে সোজা তার ঘরে ঢুকি। অচেনা ঘর, অচেনা ঘরটি অচেনারকম করে সাজানো। তবে আমাদের সেই আগের বিছানাটিই আছে, বিছানায় আগের চাদর, আগের নীল মশারি। সব চেনা। কিন্তু কোথায় যেন খুব অচেনা কিছু। বাকি রাতটুকু ঘুমন্ত রুদ্রর পাশে নির্ঘুম কাটাই। রুদ্রর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অনেকের ছিল, ওদের সঙ্গে মনের সম্পর্ক কখনও হয়নি, সবসময় সে বলেছে ওদের কাউকে সে ভালবাসে না। এখন কী নির্দ্বিধায় রুদ্র বলে, কাউকে সে ভালবাসে, কী অবলীলায় তার ভালবাসার গল্প আমাকে শোনায় সে! আলো-অন্ধকারে ঢেকে থাকা ঘরটিকে আবার দেখি, এ ঘরে নিশ্চয়ই শিমুল এসে বসে, শিমুলের চোখের দিকে রুদ্র তার ভালবাসায় কাঁপা চোখ দুটো রাখে।

সকাল হলে শুয়ে থাকা রুদ্রর পাশে বসে কপালে দুটো চুমু খেয়ে, ঘন চুলগুলোয় আঙুলের আদর বুলিয়ে বলি, ভাল থেকো। রুদ্র মাথা নাড়ে, সে ভাল থাকবে। বলে, তুমিও ভাল থেকো। রুদ্রকে বিছানায় রেখেই আমি যাই বলে বেরিয়ে যাই। আমার তো যাওয়ারই কথা ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে একটি রিকশার জন্য হাঁটতে থাকি। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া আমাকে স্পর্শ করছে, অথচ মনে হচ্ছে বৈশাখী কালো ঝড় আমার ভেতরের সবকিছু ওলোট পালোট করে দিচ্ছে, সব বুঝি ভেঙে দিচ্ছে আমার যা ছিল, নিঃস্ব করে দিচ্ছে আমাকে। বড় একা লাগে, কী জানি কেন, বড় একা লাগে। মনে হয় রাস্তায় একটি প্রাণী নেই, আমি একা হেঁটে যাচ্ছি কোথাও, কোথায় যাচ্ছি তা জানি না, কেবল হাঁটছি, পেছনে দৌড়োচ্ছে স্মৃতি, ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি। ময়মনসিংহের সেই দিনগুলো দৌড়োচ্ছে, কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, প্রেসক্লাব, বোটানিক্যাল