- বইয়ের নামঃ নির্বাচিত কলাম
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০১. আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’
বয়স তখন আমার আঠারো উনিশ। ময়মনসিংহ শহরের একটি সিনেমা হলে দুপুরের শো ভেঙেছে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা। আমি একটি রিক্সায় উঠে বসলাম। ভিড়ের কারণে রিক্সা খানিক থেমে আছে, খানিক চলছে। ওই থেমে থাকবার সময় আমার ডান বাহুতে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম। দেখি, একটি আধ-খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট আমার বাহুতে চেপে ধরেছে বারো-তেরো বছর বয়সের একটি ছেলে। পরনে শার্ট, লুঙ্গি। ছেলেটিকে আমি চিনি না, কোনওদিন দেখিনি। আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলাম। ছেলেটি দিব্যি হাসতে হাসতে চলে গেল। ভাবছিলাম চিৎকার করব, কাউকে ডাকব, অথবা দৌড়ে ছেলেটিকে ধরব, লোক ডেকে তার বিচার চাইব। মেয়েদের একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে, সম্ভবত সে কারণেই ছেলেটিকে শাস্তি দেবার জন্য সেদিন কোনও চেষ্টা করিনি। আমি ওই বয়সেই চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি ছেলেটিকে ধরব অথবা ধরবার জন্য লোকজনের সাহায্য চাইব, সবাই আমাকে ভিড় করে দেখবে, আমার শরীরের বাঁক দেখবে, উজ্জ্বলতা দেখবে, যন্ত্রণা দেখবে, আমার আর্তস্বর, আমার ক্রোধ, আমার কান্না দেখবে। কেউ আহা উহু করবে, কেউ গায়ে পড়ে জানতে চাইবে ব্যাপারটি কী, কেউ ছেলেটিকে ধরে এনে কষে দুই থাপ্পড় মারবার কথা বলবে, কেউ আমার বাড়ি কোথায়, বাবা কে ইত্যাদির খোঁজখবর নেবে। আসলে সবাই তারা আমাকে উপভোগ করবে। আমার অসহায়ত্ব উপভোগ করবে। পোড়া বাহু দেখবার নাম করে আসলে আমার সুডোল খোলা বাহুটিই দেখবে। আমি চলে গেলে পেছনের শুভার্থীরা সমস্বরে সিটি দেবে। এসব ভেবেই আমি আমার সমস্ত যন্ত্রণা নিজের ভেতরে চেপে রেখেছিলাম।
আমার ডান বাহুতে এখনও পোড়া দাগ, আমি সেই নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে চলেছি। আমি ওই অশিক্ষিত ছেলেটিকে দোষ দেব কী, শিক্ষিতরাই যেখানে নির্দোষ নয়। আমার চোখের সামনে বান্ধবীর উরুতে চিমটি কেটে দৌড় দিয়েছে একটি ছেলে, আমার বোনের ওড়না টেনে পালিয়েছে একটি অচেনা যুবক, ভিড়ের মধ্যে স্তন ও নিতম্ব স্পর্শ করবার জন্য ওত পেতে থাকে একশ একটা অন্ধকার হাত। সেই হাতগুলো সব অশিক্ষিতের নয়, আমি জানি, ওখানের অনেক হাতই শিক্ষিত হাত।
এসবের কোনও প্রতিবাদ আমি করি না। বরং আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, এইজন্য যে, এখনও এসিড ছুঁড়ে কেউ আমার মুখ পোড়ায়নি, আমার দু’চোখ অন্ধ করেনি। এখনও আমার সৌভাগ্য যে একপাল পুরুষ আমাকে ধর্ষণ করেনি। আমার সৌভাগ্য যে, আমি এখনও বেঁচে আছি। আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি ‘মেয়েমানুষ’। আমার শিক্ষা, আমার মেধা আমাকে ‘মানুষ’ করতে পারেনি, ‘মেয়েমানুষ’ করেই রেখেছে। এই দেশে মেয়েরা কোনও যোগ্যতা বলেই ‘মানুষে’ উর্ত্তীর্ণ হতে পারে না। অনেকে, এই সমাজের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, বোধবুদ্ধি সম্পন্ন রুচিবান মানুষ, সকলেই, আমি জানি, এক বাক্যে মেনে নেবেন সিনেমা হলের কাছে সিগারেটের আগুনে বাহু পোড়ার ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত। ‘ব্যক্তিগত’ বলে তাঁরা আসলে দায়িত্ব এড়াতে চান। কিন্তু যে মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে পা ফেলে, সেই মেয়েরা- আমি একা নই- সবাই প্রস্তুত থাকে রাস্তায় যে কোনও অশ্লীল মন্তব্য নীরবে সহ্য করার জন্য। প্রতিটি মেয়ে জানে, তার জামায় একমুখ পানের পিক ফেলে দেঁতো হাসি উপহার দিয়ে নির্বিকার চলে যাবে একটি অপরিচিত যুবক। সে প্রস্তুত থাকে এসিড, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি, যে কোন দূর্ঘটনার জন্য। রাস্তায় বেরোলে গায়ে দু’তিনটে ঢিল এসে পড়া বিরল কোনও ঘটনা নয়। ছুঁড়ে ফেলা সিগারেট থেকে রিক্সায় বসা কিশোরীর কাপড়ে আগুন ধরে যায়, এবং অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বাড়ি ফেরা- মাত্র দু’মাস আগে এই শহরের অনেকেই বেশ উপভোগ করেছে। মানুষ একদা গুহায় বাস করত, কন্যা সন্তান জন্মালে জ্যান্ত কবর দিত। সেই থেকে সময় অনেক এগিয়েছে কিন্তু মানসিকতা খুব একটা এগোয়নি।
ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মেয়েদের স্কুল, কলেজ, সিনেমা হলের পাশে কাঠের থামের উপর এক ধরনের সাইনবোর্ড ঝুলত, ওতে লেখা ছিল ‘বখাটেদের উৎপাতে টহল পুলিশের সাহায্য নিন’। এই ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। সম্ভবত বখাটেরা ওর গুঁড়িসুদ্ধ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। যতদিন সাইনবোর্ড ছিল, মেয়েদের স্কুলে যাওয়া-আসার সময় বখাটে ছেলেরা ওই থামে হেলান দিয়েই শিস দিত। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, টহল পুলিশের উৎপাতে একবার স্কুলের মেয়েরা বখাটেদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছিল।
০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই
কলকাতা সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অভিধানগুলো বিগত ৩০ বছর ধরে বাংলাভাষী সহৃদয় পাঠকের অনিকূল্য লাভ করে আসছে। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ‘সমার্থ শব্দকোষ ‘একটি ভিন্ন ধরনের বাংলা অভিধান। এই সমার্থক শব্দকোষ বাংলাভাষার থিসরাস। কোনও শব্দ, তার প্রতিশব্দ, সেই শব্দের আনুশাংগীক,সমশ্রেণীভুক্ত এবং সমবর্গীয় শব্দ কে এই অভিধানে একত্রিত করা হয়েছে। সমার্থ শব্দকোষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একটি অতুলনীয় সংযোজন। এই মূল্যবান অভিধানে ‘পুরুষ’ শব্দের সমার্থ শব্দ -পুরুষ মানুষ, বেটাছেলে, ছেলে, মরদ, মদ্দ, মদ্দা, মর্দ, পুমান, মিনসে, নর, মানব,মানুষ, মনুষ্য,আদমী, এবং নারীর সমার্থ শব্দ-স্ত্রী, মেয়ে, মানবী, মানবিকা, কামিনী, অবলা, আওরত, জেনানা, যোষিৎ, যোষিতা, যোষা, জনি, বালা, প্রমদাজন, বনিতা, ভামিনী, শর্বরী, প্রতিপদর্শিনী লেখা হয়েছে। নারীর সমার্থ শব্দ সংখ্যা এখানে অধিক কিন্তু লক্ষ্যনীয় এই, ‘মানুষ’ শব্দটি পুরুষের সমার্থক শব্দ হিসেবে উল্ল্যেখিত অথচ নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে কোথাও মানুষ অথবা মনুষ্য লেখা নেই। সুধীজন সমাদৃত গ্রন্থটিকে পুরুষ ও নারীর অদ্ভুত অর্থ আমাকে স্তম্ভিত করেছে।
আমি এইরকম স্তম্ভিত হই,যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রী নিবাসগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়,হাঁস-মুরগীর খোঁয়ার যেমন বন্ধ হয়।অচিরেই এইসব গৃহপালিত জন্তুর নাম নারীর সমার্থ শব্দ তলিকায় স্থান পাবে,এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। একটি ছাত্র তার প্রয়োজন মত হলে বা হোষ্টেলে যাওয়া আসা করে,সেক্ষেত্রে ছাত্রীর প্রয়োজন অপ্রয়োজন জরুরি কোন বিষয় নয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার একইরকম অনুশীলন ও প্রতিযোগিতায় দুজনেই অংশগ্রহণ করেছে; ছাত্রীর জন্য কিছু দুর্বল, কিছু সহজ,কিছু নিচু স্থরের শিক্ষাব্যাবস্থা সেখানে নেই। নির্দিষ্ট একটি সময়ে হলে ফিরবার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ যে বাণী দিবেন,তা শুনে যে কোন দুর্বল স্নায়ু ও অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সহজে কাবু হয়ে যাবে,কিন্তু নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন মেয়েরা এই অবৈধ ও অশ্লীল নিয়মটি মেনে নিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করেছে -তারা অশহায়, দুর্বল, তারা পুরুষের ভোগের সামগ্রী, প্রাচীর এবং প্রহরী ছাড়া তারা নিরাপদ নয়। (ছাত্রীদের হল সন্ধ্যায় বন্ধ হয় বলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাঁদের প্রবচনে-কথনে ছাত্রীদের পতিতা বলেন না? বলেন। বলবেন।)
আসলে রাত কিছু নয়, অন্ধকার কিছু নয়, দুর্ঘটনা কিছু নয়, সকল কিছুর উদ্দ্যেশ্য নারীকে দমন করা। যাবতীয় বিপর্যয়, বিঘ্ন, দুর্যোগ, সঙ্কট ; যাবতীয় দু:সময়, দু:শাসন, সন্ত্রাস, অতিক্রম করে সে আবার না স্বাবলম্বী হয়ে উঠে, স্বছন্দ হয়ে উঠে, সবল ও দুর্লভ হয়ে উঠে।
আর তা যদি হয়ে উঠে তাহলে তো ভীষন অসুবিধে। কারণ বিদ্যাধরী মেয়ে ‘আধুনিক ক্রীতদাসী’ হওয়ার জন্য চমৎকার।স্বামীকে মুগ্ধ ও তুষ্ট করবার জন্য এদের নিরলস রুপচর্চা,এদের সভা সমিতি, শিল্প সংস্কৃতি, নারী আন্দোলন -সবই হচ্ছে ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি বাংগালী মেয়েদের বালিশের ওয়াড়ে রংগীন সুতোয়, ‘সতীর দেবতা পতি’ চর্চার আধুনিকরণ।
জার্মেইন গ্রীয়ারের লেখা ‘ফিমেল ইউনাক’ গ্রন্থে মেয়েদের হাইহিল জুতো আবিষ্কারের একটি চমৎকার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। পুরুষ যখন একটি মেয়েকে আক্রমন করে,মেয়েটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রথমে দৌড় দেয়, সে যেন ভাল দৌড়াতে না পারে, হাইহিলের ব্যবস্থা সেজন্যই।
০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
আমি ভারত বেড়াতে গিয়েছি। কলকাটা, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর, সিমলা, কাশ্মীর ঘুরে এসেছি শুনে প্রথম যে প্রশ্নটি লোক করে, সে হোল -সঙ্গে কে ছিল? কাশ্মীর এর বরফাচ্ছাদিত গূলমার্গ, বানিহাল টাণেল, হিমালয়ের উপর ঝুলন্ত চেয়ার, ডাল থেকে সিকারা হাউজবোট সম্পর্কে আমি উচ্ছ্বসিত হই। কিন্তু তাদের ওই এক প্রশ্ন- সঙ্গে কে ছিল?
আমি উত্তরে বলি -একা।
একা? একা একটি মেয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে পারে নাকি? কার ও বিশ্বাস হয় না।এরপর কেউ আমার শান্তিনিকেতন, দীঘার সমুদ্র, কন্যাকুমারী বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রতি আগ্রহ দেখায় না । যে চিন্তাটি তাদের মস্তিষ্ক জুরে ঘেটি পাকায় , তা হল সঙ্গে কে ছিল। আমি একবার বলেছিলাম, সঙ্গে অতসী, কৃষ্ণকলি আর মল্লিকা ছিল।
আর?
আর কেউ না।
কেন? পুরুষ মানুষ কেউ ছিল না?
না।
লোকে অবাক চোখে তাকায়। পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা।
এক্ষেত্রে আমার বয়সী একটি ছেলে যদি একইভাবে দার্জিলিং, সিমলা, কাশ্মীর ঘুরে আসত, একা, তবে বিমোহিত সকলেই বলত, আহা কি পবিত্র মন! কি চমৎকার রুচি ! কি অগাত সৌন্দর্য বোধ ! কি অপূর্ব জীবন !
ধরা যাক আমার খুব সমুদ্র দেখতে ইচ্ছা করছে, আমার খুব সীতাকুণ্ড পাহাড়ে যেতে ইচ্ছা করছে, আমার খুব যেতে ইচ্ছা করছে শালবন বিহার, কাপ্তাই লেকে স্পীডবোট নিয়ে সারা বিকেল ঘুরতে ইচ্ছে করছে, সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে পদ্মায়, তখন কি করতে হবে? একজন পুরুষ জোগাড় করতে হবে।
পুরুষ ছাড়া মেয়েরা দূরে কোথাও যেতে পারে না। সে যে বয়সের ই হোক না কেন। বাসে চরলে কন্ট্রাক্টর জিজ্ঞাসা করে, আপনার সঙ্গের লোক কই? তারা নিশ্চিত সঙ্গে একজন লোক অর্থাৎ পুরুষ আচেই। নানা জায়গায় পুরুষ থাকা না থাকা নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় মেয়েদের। সঙ্গে যদি পুরুষ থাকে, সে যদি স্বামী অথবা নিকটাত্মীয় না হয়, তাহলে অসুবিধে- কে এই লোক? কি সম্পর্ক? আর যদি সঙ্গে পুরুষ না থাকে তাহলেও অসুবিধে নেই কেন? অত্যন্ত সচেতন ভাবে পুরুষের উপর মেয়েদের নির্ভর করানো হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পিতার কন্যারা অথবা স্বামীর বধূরা দুচার টে আত্মীয় বাড়ি আর মার্কেট ঘরাঘুরি করেই ভাবে ‘ নারী স্বাধীনতা’ হয়ে গেল।
আসলে তা হয় না। মেয়েদের পায়ের শৃঙ্খল খুব শক্ত শৃঙ্খল। হাত-পা ছেড়ে বসে থাকলে কেউ তার শিকল খুলে দিয়ে বলবে না বেরিয়ে আয়। রূপকথায় শুভার্থী পাওয়া যায় বাস্তবে নয়।
মেয়েরা এমন শখ করে পায়ে মল পরে। এই মল জিনিসটি আবিস্কারের এবং মেয়েদের পরানোর পেছনে একটি উদ্দেশ্য আছে। মল পরলে মেয়েদের গতিবিধি- তারা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, শব্দ শুনে জানা যায়। আর বোকা মেয়েরা সেই মল, যা একটি সিমানার ভেতরে তাদের বন্দী রাখে,তা পরে, ভাবে যে তাদের পায়ের সৌন্দর্য বুঝি বেড়েছে।
০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি
দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি, আমার পিতার বয়সী, আমার কবিতার খুব প্রশংসা করেন কেবল আমার কাছে। জনসমক্ষে করেন না, কাগজেও লেখেন না, কারণ কবিতা যতই ভাল লিখি না কেন, আমি তো মেয়ে, একটি মেয়ের প্রশংসা কি ফলাও করে করা যায়, চরিত্র যাবে যে!
এ দেশের চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবিরা গোপনে মেয়ে নিয়ে ঘোরাফেরা পছন্দ করেন, শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে কোনার টেবিলে বসে চৈনিক খেতে খেতে গল্প করতে ভালবাসেন, কারণ তাঁদের মধ্যে তো কুৎসিত সংস্কার নেই, তাঁদের জীবন নিস্তরঙ্গ পুকুর নয়, উত্তাল সমুদ্র; জীবনের বিচিত্র সব আনন্দ আহরণে তাঁরা ব্যস্ত। মেয়েদের কানে তাঁরা ঘন ঘন বলেন-‘ভালবাসি’। কিন্তু প্রকাশ্যে বলেন না, চেপে যান। কারণ জাতে উঠে গেলে মেয়ে নিয়ে কথাবার্তা ভাল শোনায় না।
আমার এক ঔপন্যাসিক বন্ধু সেদিন বললেন, ‘তোমার কলাম বেশ ভাল হচ্ছে।’ আমি ধন্যবাদ জানাবার পর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে যে বাক্যটি উচ্চারন করলেন, আমি তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, বললেন-‘সেলিনা হোসেনের চেয়ে তোমার গদ্য ভাল।’
–হঠাৎ সেলিনা হোসেনের প্রসঙ্গ কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি বললেন-মেয়েদের মধ্যে সেলিনা হোসেনের লেখাই ভাল কিনা। ‘মেয়েদের মধ্যে’ কথাটি আমাকে উপহার দিয়ে আমার ঔপন্যাসিক বন্ধু চলে গেলেন এবং আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন আমার লেখা যতই চমৎকার হোক না কেন, বিচার হবে ওই ‘মেয়েদের মধ্যেই,’ কারণ মেয়েরা তো আলাদা। জাতীয় দৈনিকগুলোয় ‘ছোটদের পাতা’র মত ‘মেয়েদের পাতা’ নামেও একটি আলাদা বিভাগ থাকে। ডাকসাইটে কাব্য-সমালোচকগণ আমি ভাল কবিতা লিখি, নাকি নাসিমা ভাল লেখে, নাকি সুহিতা ভাল, নাকি বিলোরা ভাল এই নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু কখনও জাহিদ ভাল লেখে নাকি আমি ভাল লিখি নাকি শাহ্রিয়ার ভাল লেখে এই নিয়ে কথা উঠে না। কারণ আমি তো মেয়ে, আমার বিচার হবে ‘মেয়েদের মধ্যে’।
এই দেশের একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার প্রায়ই বলে বেড়ান, মেয়েরা তাঁর কাছে প্রচুর চিঠি লেখে, কারণ মেয়েরা তাঁর প্রেমে বদ্ধ উন্মাদ, কিন্তু তিনি তাদের বিশেষ পাত্তাটাত্তা দেন না। একবার তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলেন, এক মেয়ে তাঁকে বুকের রক্ত ঢেলে চিঠি লিখেছে। পরে অবশ্য জানা যায়, রক্তটক্ত কিছু নয়, রঙে ডোবানো একটি নববর্ষের কার্ড নিয়ে তিনি ওই গল্প ফেঁদেছেন। মেয়েদের নিয়ে এ ধরনের মুখরোচক গল্প বলে এঁরা একধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করেন।
আমার এক বন্ধু, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক, সেদিন অত্যন্ত উদ্বেগ এবং কিছুটা অসন্তোষসহ বললেন, শাহ্বাগের মোড়ে দুটো ছেলে তোমার নামে এই বলেছে সেই বলেছে। শুনে আমি তুমুল হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি-এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ওরা কি আবুল কালাম সম্পর্কে বলবে?
আবুল কালাম বলতে আমার সম্পাদক কি বুঝেছেন আমি জানি না, তবে আমি বলতে চেয়েছি, ‘এই বলা সেই বলা’ বলতে যা বুঝায় তা আবুল কালাম অথবা আবদুর রহমান অথবা শামসুল ইসলামদের মানাবে না। এক্ষেত্রে মেয়ে হলে জমে ভাল।
মেয়েরা, যারা লেখে, সাধারণের মধ্যে তাদের তাদের সম্পর্কে এমন একটি ধারনা আছে যে, তারা লেখে, নিশ্চয়ই তাদের জীবনে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। জীবনে কোনও না কোনও বিপর্যয় ঘটলে মেয়েরা কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ বেশ্যাপাড়ায় আশ্রয় নেয়, অথবা কেও সাহিত্যে আশ্রয় নেয়। একটি মেয়ে লিখতে শুরু করলে লেখার চেয়ে তার নাড়ি নক্ষত্রের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ জন্মায়। প্রেমে পড়া অথবা প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, সংসারে অশান্তি অথবা সংসার-বৈরাগ্য ইত্যাদি ঘটনাগুলো না ঘটলে একটি মেয়ে অযথা সাহিত্য রচনা কেন করবে তা অনেকের বোধগম্য নয়। সাহিত্য তো বহু দূরের বিষয়, লেখাপড়া জিনিসটিই তো মেয়েদের জন্য নয়। মেয়েদের কোরান শিক্ষা দেওয়া হত স্বামীর মঙ্গলের জন্য যেন সে দোওয়া দরুদ পড়তে পারে। এরপর সামান্য অক্ষর জ্ঞান দেওয়া হল যেন ঘরে বসে ‘ভুলো না আমায়’ জাতীয় সূচকর্ম করতে পারে এবং প্রবাসী স্বামীকে ভুল বানানে পত্র লিখতে পারে। বর্তমানে মেয়েদের বিদ্যা শিক্ষা তো অধিকাংশই সন্তান পালনের জন্য। তাছাড়াও আজকালকার স্মার্ট স্বামীরা ‘ঘরে শিক্ষিত বউ’ নিয়ে এক ধরনের গর্ববোধ করার সুযোগ পায়। যেন কৃতিত্বটা তাদেরই, আর শিক্ষিত মেয়েদের সেবা পাওয়ার আলাদা একটি মজাও তো আছে। তো, এই মেয়েরা সাহিত্য করবে কেন? বড় জোর যৌতুক ও বিয়ে শাদির কিছু সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার ‘মহিলা অঙ্গনে’ লেখালেখি করে পাতা ভরাবে। এর বেশি কিছু করতে চাইলে; একেবারে ছেলেদের সঙ্গে গদ্যে, পদ্যে, ভাষা-সাহিত্যে, পাণ্ডিত্যে মেয়েদের তুলনা যদি চলে, ছেলেদের লজ্জা লাগে না বুঝি? ছি!
০৫. সমাজের চোখে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা
ছোটবেলা গাছের তল দিয়ে যাতায়াতের সময় ‘গেছো ভূত’-এর ভয়ে গা ছমছম করত, এখন শুনি পুরুষের নাকি গা ছমছম করে ‘গেছো মেয়ে’র ভয়ে। বৃক্ষারোহণপ্রিয় ছেলে নিয়ে নয়, মেয়ে নিয়েই যত বিপত্তি। প্রকৃতি পুরুষ ও নারীকে আলাদা করে দেখে না, কিন্তু সমাজ দেখে। গাছে যখন একটি পেয়ারা পাকে, সেটি প্রথম হাতে নেবার জন্য বালকের চেয়ে বালিকার আগ্রহ কম থাকে না। সম্মান যদি কচুপাতা, মেয়ে তার উপর একফোঁটা জল। সম্মান নড়ল চড়ল, তো মেয়ে গেল। সম্মানকে আশ্রয় করে, সম্বল করে মেয়েরা বেঁচে থাকে।
সেই দুরন্ত কৈশোরে একটি ফলবতী বৃক্ষেও মা আমাকে আরোহণ করতে দেননি, বলেছেন-‘মেয়েরা গাছে উঠলে গাছ মরে যায়।’ বড় হয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান ঘেঁটে নারী-স্পর্শের সঙ্গে বৃক্ষ বাঁচা-মরার কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাইনি।
‘গেছো’ বলতে একধরনের দস্যিপনা বোঝায় যা মেয়েদের ঠিক মানায় না। মেয়েরা লজ্জাবনত না হলে, পরনির্ভর, ভীতু ও দিধান্বিত না হলে, স্বল্পভাষী ও নিচুকন্ঠী না হলে সমাজ ভাল চোখে দেখে না। কোনও পুরুষের চরিত্রে উপরোক্ত দোষগুলো দেখা দিলে তাকে ‘মেয়েলি’ বলে দোষারোপ করা হয়। অন্যদিকে দুঃসাহস, দর্প, দম্ভ, ক্রোধ, চাঞ্চল্য, স্বয়ম্ভরতা, অকুণ্ঠচিত্ততা ইত্যাদি গুনাবলি কোনও মেয়ের মধ্যে থাকলে ‘পুরুষালি’ বলে দোষ দেয়া হয়। অথচ ‘মেয়েলি’ এবং ‘পুরুষালি’ বৈশিষ্ট্য কারও শারীরিক গঠন বা চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যে মানুষ তার আগ্রহকে দমন করতে শেখে, যে তার দৃষ্টিকে নত করতে শেখে, যে তার পদক্ষেপকে সীমাবদ্ধ করতে, বাহুকে সঙ্কুচিত করতে, জিহ্বাকে সংযত করতে শেখে, সে অবশ্যই তার শারীরিক বৈশিষ্টের সঙ্গে প্রতারণা করে। করে, কারণ শরীর নয়-সমাজ দ্বারা নির্ধারিত মেয়েলি স্বভাব তার শরীরে আরোপ করতে হয়, তা না হলে সম্মান যায়।
বাঙালি মেয়েদের জন্য ‘সতীত্ব রক্ষা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ একগামিতা শুধু নারীর জন্য অবশ্য পালনীয়, পুরুষের জন্য নয়। পরপুরুষ সঙ্গমে পাতিব্রত্য ধর্মের লোপ হলে সতীত্বনাশ হয়। সামাজিক বৈধতা অতিক্রম করলে নারীকে ‘পতিতা’ হতে হয়, কিন্তু পুরুষ যথেচ্ছাচারী হলে তাকে ‘পতিত’ হতে হয় না। একটি পুরুষ যত বহুগামী হোক না কেন, বিয়ে করার বেলায় কুমারী ছাড়া নৈব নৈব চ। আমি কিছু প্রগতিশীল শিক্ষিত পুরুষের কথা জানি, যারা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে গিয়ে বিছানায় সাদা চাদর বিছিয়েছে স্ত্রীর কুমারীত্ব প্রমান করার উদ্যেশ্যে। চাদরে রক্তের দাগ না পাওয়ায় তারা স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নারীর যোনিমুখে একটি অসম্পূর্ণ পাতলা আবরণ থাকে, গ্রিকদের বিয়ের দেবতা ‘হাইমেন’-এর নাম অনুসারে আবরণটির নাম হাইমেন (সতীচ্ছেদ) রাখা হয়েছে। বিখ্যাত গাইনোকোলোজিস্ট স্যার নরম্যান জেফকট বলেছেন-‘প্রথম সঙ্গমে হাইমেন বিদীর্ণ হয়, এর ফলে সামান্য রক্তপাত হতে পারে অথবা নাও হতে পারে। হাইমেন বিদীর্ণ ছাড়াও সঙ্গম সম্ভব। সুতরাং কুমারীত্ব প্রমান করবার জন্য এটি একটি চিহ্ন বটে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
সৎ এবং সততার সঙ্গে ‘সতী’ শব্দটির যদি সামান্য সম্পর্ক থেকে থাকে তবে আমি মনে করি একটি মেয়ে দশটি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেও ‘সতী’ থাকতে পারে এবং একটি মেয়ে কেবল একটি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেও ‘অসতী’ হতে পারে।
‘নষ্ট’ শব্দটি পুরুষের জন্য নয়, মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। ডিম নষ্ট হয়, দুধ নষ্ট হয়, নারকেল নষ্ট হয় এবং মেয়ে নষ্ট হয়। যে কনও বস্তুর মত আমাদের সমাজ একটি মেয়েকে ‘নষ্ট’ বলে চিহ্নিত করে। এদেশের শিক্ষিত রুচিশীল মেয়েরা এইসব ‘নষ্ট মেয়ে’ থেকে নিজেদের আলাদা করবার ব্যপারে বড় সতর্ক। আলাদা হতে চাওয়াটা আসলে বোকামি। কোনও না কোনওভাবে সকল নারীই যেখানে নির্যাতিত, সেখানে শ্রেণীভেদের প্রশ্ন আসে না। এই নষ্ট সমাজ ওত পেতে আছে, ফাঁক পেলেই মেয়েদের ‘নষ্ট’ উপাধি দেবে। সমাজের নষ্টামি এত দূর বিস্তৃত যে, ইচ্ছে করলেই মেয়েরা তার থাবা থেকে গা বাঁচাতে পারে না।
গত ২০ অক্টোবর’ ৮৯ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে ‘বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ’ বিষয়ক একটি সেমিনারে অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করেন এইজন্য যে, বইয়ের প্রকাশকরা বইকে ‘মাল’ বলে উল্লেখ করেন। এটি অবশ্যই একটি অন্যায় উচ্চারন। আমি ভেবে অবাক হই তবে কতটুকু অন্যায় হয়, যদি মানুষকে ‘মাল’ বলে? মাল একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ পণ্যদ্রব্য। মুসলিম হাদিস শরীফে লেখা-‘দুনিয়ার সবকিছু ভোগের সামগ্রী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে মেয়েমানুষ।’ বিনিময় পণ্য হিসাবে, মুল্যবান দাসী হিসাবে, দামি সামগ্রী হিসাবে সমাজে নারীর অবস্থান বলেই নারীকে ‘মাল’ বলে ডাকতে কারও দ্বিধা নেই। ওরা ডাকে, কারণ ধর্ম ওদের ইন্ধন জোগাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্র ওদের আশকারা দিচ্ছে।
০৬. মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি
১. মহাভারতে একটি শ্লোক আছে-ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি; অর্থাৎ স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।
২. ‘রূপচর্চা’ বলে একটি জিনিস আছে, তা মেয়েদের গুলে খাওয়াবে বলে কিছু রসালো পত্রিকা পণ করেছে। কে কত দামি এবং বিদেশি প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করছে-মেয়েদের মধ্যে তার জোর প্রতিযোগিতা চলে। গালের রঙ, চোখের কালি, চুলের ঢং-চর্চায় মেয়েদের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখবার অভিনব কৌশল দিন দিন আবিষ্কার হচ্ছে। যেন কিছু রঙ না হলে, কিছু প্রলেপ যুক্ত না হলে মেয়েরা যথেষ্ট নয়, মেয়েরা সম্পূর্ণ নয়। মেয়েদের বিষয়-আশয় নিয়ে যে পত্রিকাগুলো বেরুচ্ছে, তার অধিকাংশ সম্পাদকই পুরুষ। তারা, মেয়েরা কি করে গালে পউডার মাখলে, কত রকম ঢেউ খেলানো খোপা করলে, ব্লাউজের কাট্ কেমন হলে, কখন কি রঙের শাড়ি পরলে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয়া হবে-ইত্যাদি ব্যপারে নিরলস জ্ঞান দান করে যাচ্ছেন। এসব পত্রিকা ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য’ নামক কিছু অশ্লীল বইয়ের শ্লীল সংস্করণ ছাড়া কিছু নয়।
৩. নারীর প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে ‘ভার্যা’ একটি। ভার্যা শব্দটির অর্থ ভরনীয়া অর্থাৎ যাকে ভরণ করতে হয়। ভৃত্য এবং ভার্যা শব্দ দুটোর বুৎপত্তিগত অর্থ একই। বৃত্তিমূলক যে কোনও শিক্ষাই নারীর জন্য নিষিদ্ধ ছিল, তাই ভাত কাপড়ের জন্য স্বামীর উপর স্ত্রীকে নির্ভর করতে হত। মধ্যযুগে, বিলেতে, স্বামীকে লর্ড বলবার রীতি ছিল। স্ত্রী ও ভৃত্য গৃহকর্তাকে লর্ড বলত। লর্ড, ভাতের জন্য যার কাছে মানুষ আশ্রিত।
৪. অরকিড এমন এক উদ্ভিদ, যে অন্য একটি উদ্ভিদ আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। আমি সেই মেয়েদের অরকিড বলতে ভালবাসি-যে মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার এবং পরে স্বামীর নামের লেজ ধরে বেঁচে থাকে। সুবর্ণা হক হঠাৎ একদিন হয়ে যায় সুবর্ণা চৌধুরী। সে যে ঘর পাল্টাল, সে যে এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ে গেল, কারুকে অবলম্বন করে সে যে বেঁচে রইল, নিজের নাম দিয়ে সে তা প্রমান করে। ধরে নিচ্ছি, সুবর্ণা নামের মেয়েটি সকল অর্থেই স্বনির্ভর। তবু এই যে তার নামের মধ্যে পিতা এবং স্বামীকে ধারন করার প্রবণতা, এটি বহু বছর ধরে নারী নির্যাতনের কুফল। বোকা মেয়েগুলো এই ব্যবস্থাটি মেনে নিয়ে প্রমান করেছে, শিক্ষা কোনও সংস্কার অতিক্রম করতে পারে না।
৫. ঢাকা শহরে ট্রাক ভর্তি করে গরু নিয়ে যাওয়া একটি পরিচিত দৃশ্য। এই দৃশ্যটি দেখে সেদিন এক বন্ধুকে বললাম-এরকম আমরাও, স্কুলের মেয়েরা একবার ট্রাকে করে বনভোজনে গিয়েছিলাম।
বন্ধু অসন্তুষ্ট হয়, ছিঃ গরুর সঙ্গে মেয়েদের তুলনা? আমি বলি-নয় কেন? প্রবাদ তো আছেই ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু।’ এর অর্থ, সম্পত্তি হিসেবে স্ত্রীর স্থান গরুরও নিচে। কারণ গরু কিনতে টাকা লাগে আর নতুন বউ আনলে টাকা পাওয়া যায়।
৬. চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘হিস্ট্রি অভ এক্সপোজার’ বলে একটি কথা আছে। এই বিষয়টি জানবার জন্য রোগীকে কিছু প্রশ্ন করতে হয়। বাইরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করেন কি না জিজ্ঞেস করলে রোগীটি প্রথমে আকাশ থেকে পড়ে। ছি ছি কি লজ্জার কথা, রোগীটি সজোরে মাথা নেড়ে অস্বীকার করে-না, সে কস্মিনকালেও কোনও খারাপ কাজ করেনি। চিকিৎসার স্বার্থে এই জোরটা শেষ অব্দি আর থাকে না, আশেপাশে তাকিয়ে খুব খুব নিচু গলায় তাকে বলতে হয়-হ্যাঁ, মেলামেশা করি।
ঘরে বউ আছে?
আছে।
তবে?
কোনও উত্তর নেই। রোগীটিও দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসে। এইসব রোগীর বয়স বারো থেকে বাহাত্তর। এরা ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বেকার, শ্রমিক, পুলিশ, উকিল, প্রকৌশলী, ছোট চাকুরে, বড় চাকুরে, শিল্পপতি, আমলা-কে নয়? এরা নিয়মিত পতিতালয়ে যায়। এরা পতিতার শরীর থেকে নিজ শরীরে জীবাণু (ট্রিপোনেমা পেলিডাম) বহন করে নিয়ে আসে। এরা সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়-এতে আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি কেবল আপত্তি করি তখন, যখন এরা তাদের স্ত্রীকে সংক্রামিত করে। একটি সুস্থ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে দেয় নিজের বিলাসিতার বিষ।
তিরিশ বছর বয়সের একটি মেয়ে, স্বামী তাকে সংক্রামিত করেছে, সিফিলিসে তার স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত, অবশ শরীর নিয়ে দুঃসহ দিন যাপন করছিল। আত্মীয়-স্বজন পড়শি ও শুভার্থীরা বলে যায়-জ্বীনের আছর ছাড়া এটি অন্য কিছু নয়। ফকির কোবরেজ এসে জ্বীন তাড়ানোর খেলা দেখিয়েছে পুরো দু’মাস। অতঃপর, সকলে এরকমই জানে যে, স্ত্রীটি একদিন অকারণে জ্বীনের বাতাস লেগে বিছানা নিল, দু’মাস পর বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ মরে গেল।
এই তো ঘটছে চারিদিকে। কেউ জানে না, এত ঘন ঘন এবরশন হচ্ছে কেন, এত মৃত শিশু জন্মাচ্ছে কেন, কেন জন্ম নিচ্ছে এত বিকলাঙ্গ শিশু। এর কারণ সিফিলিস। বড় ভয়ঙ্কর রোগ এই সিফিলিস। নিভৃত বাসরঘরে একটি অনাঘ্রাতা মেয়ে স্বামীর কাছ থেকে প্রথম উপহার নিচ্ছে সিফিলিস। রোগ সারাবার জন্য গোপনে পেনিসিলিন ইনজেকশন নিচ্ছে সমাজের ‘ভাল মানুষেরা’।
প্রতিটি সচেতন মেয়ের কাছে আমার অনুরোধ, বিয়ের আগে ছেলের রক্ত (সেরোলোজিক্যাল টেস্ট ফর সিফিলিস) পরীক্ষা করুন। ফলাফল নেগেটিভ হলে নির্দ্বিধায় বিয়ে করুন। আর পজেটিভ হলে আমি বলব, সম্পর্ক ত্যাগ করুন।
৭. সেদিন এক ভদ্রলোক অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে আমাকে বললেন,-এই যে আপনি মেয়েদের পক্ষে এত লিখছেন, মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কিছু লিখুন।
ত্রুটি-বিচ্যুতি মানে?
তিনি অতি সোৎসাহে হাত-পা নেড়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাকে বোঝালেন। আমার তখন মনে পড়ে গেল আমার এক ছোট ভাই পোকা-মাকড় নিয়ে খেলা করতে বড় পছন্দ করে; একদিন সে পায়ের তলায় একটি টিকটিকি পিষে মারছিল আর আমাকে বলছিল-‘দেখ্ বুবু, টিকটিকিটা কত বদমাশ, লেজ নাড়ছে।’
যে পিষে মারে সে না জানলেও যে পিষ্ঠ হচ্ছে সে জানে সে লেজ নাড়ে আনন্দে নাকি বেদনায়।
০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
অনেকের ধারণা করেন বৈদিক যুগে ভারতবর্ষের নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা ছিল, ইসলাম আবির্ভাবের পর সেই মর্যাদা আকস্মিক লোপ পায়। আমি তা মনে করি না। প্রত্নতত্ত্ব, শিলালিপি, তাম্রশাসন, প্রথম যুগের পুরান, বৌদ্ধ সাহিত্যের পাশাপাশি বৈদিক সাহিত্যই বহন করে বৈদিক যুগের সকল ইতিহাস। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও সুত্রসাহিত্যিই ( শ্রৌত, গৃহ, ধর্মসুত্র) প্রধানত বৈদিক সাহিত্য। খৃষ্ট পূর্ব দ্বাদশ থেকে ক্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত এই সাহিত্য সমাজের যে চিত্র গ্রহণ করি, তাতে নারী আদৌ মানুষ হিসেবে গন্য হয় না।
ঐতবেয় ব্রাহ্মণ সেই নারিকেই উত্তম বলে যেই নারী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর কথার উপর কথা বলে না (৩/২৪/২৭)। যে নারী স্বামীকে সন্তুষ্ট করে না এবং স্বামীর কথার উপর কথা বলে তাকে নিশ্চয়ই অধম বলা হয়। নারী উত্তম হবে কি অধম হবে তা নির্ভর করে পুরুষের সন্তুষ্টির উপর।
শতপথ ব্রাহ্মণে লেখা, সুন্দরি বধূ স্বামীর প্রেম লাভ করে (৯/৬)। কিন্তু যে বধূ সুন্দরি নয়, সে নিশ্চয়ই স্বামীর প্রেম থেকে বঞ্চিত হয়। অসুন্দরি বধুকে পবিত্র বৈদিক সাহিত্যেও ক্ষমা করেনি। এই পক্ষপাতদুষট শ্লোক লোকে খূব শ্রদ্ধার সংগে উচ্চারণ করে।
শতপথ ব্রাহ্মণ নারীকে অবরোধের কথা বলেছে, তা না হলে তার শক্তি ক্ষয় হবে (১৪/১/১/৩১)। অবরোধে থাকলে শক্তি বৃদ্ধি হয়, এ কি আশ্চর্য নয়? তবে অবরধহীন পুরুশকে শক্তিমান বলি কি করে?
যজ্ঞে একটি দণ্ড কে বেষ্টন করে রাখে দুটি বস্ত্রখণ্ড, তাই পুরুষ দুটি স্ত্রী গ্রহণে অধিকারী। একটি বস্ত্রখণ্ডকে যেহেতু দুটি দণ্ড বেষ্টন করে না, তাই নারীর দ্বিপতিত্ব নিষিদ্ধ ( তৈত্তিরিয় সংহিতা ৬/৬/৪/৩, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১/৩/১০/৫৮)- যজ্ঞের দণ্ড ও বস্ত্রখণ্ডের সাথে স্বামি- স্ত্রীর সম্পর্ক কি? দণ্ড ও বস্ত্রের সংখ্যার সংগে স্ত্রী বা স্বামী সংখ্যায় বা কি কারণে যুক্ত হয়? একি কোন যুক্তি না গায়ের জোর? গায়ের জোরে পুরুষের পক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন যুগানো!
নারী কখনও একটির বেশি স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না। এক স্বামীর বহু স্ত্রী থাকলেও একটি স্বামিই তাদের জন্য যথেষ্ট ( ঐতেবেয় ব্রাহ্মণ ৩৫/৫/২/৪৭)। বহু স্ত্রী তো থাকবেই ,তার উপরে পুরুষের আছে পতিতালয়ে যাবার অবাধ স্বাধীনতা, কিন্তু নারীর জন্য ‘ পতিত-আলয়ে’ যাবার কোন ব্যবস্থা নেই। পতিত অর্থ পতিত পুরুষ। পতিতার বিপরীত।
বশিষ্ঠ ধর্মসুত্রে আছে- পিতা রক্ষিত কৌমারে, ভর্তা রক্ষিত যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা, ন স্ত্রী স্বাতমন্ত্রমর্হতি । এর অর্থ নারীকে কুমারী বয়সে রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা, নারী স্বধিনতার যোগ্য নয় (৫/১-২, ২/১,৩, ৪৪, ৪৫) পিতা স্বামী, ও পুত্রের খাঁচায় নারীকে বন্ধী রাখবার কৌশল শাস্ত্র খূব চমৎকার জানে।
শতপথ ব্রাহ্মণ নারীকে পুরুষের অনুপথগামিনী হতে বলে (১৩/২/২৪০। ব্রিহদারন্যক উপনিষদে আছে পতিং বা অনু জায়া, স্ত্রী স্বামীর প্রশ্চাতে (১/৯/২/১৪)। পুরুষ সামনে, নারী পেছনে;, নারী ‘সবার পিছে, সবার নিচে সবহারাদের মাঝে’। সামনে এগিয়ে যাবার যোগ্যতা থাকলেও শাস্ত্রের দড়ি তাকে পেছনে টেনে রাখে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে বর কে বলতে হয়, এস আমরা মিলিত হই,যেন পুত্র সন্তান উৎপন্ন হয়,যে সন্তান দ্বারা সম্পত্তি বৃদ্ধি পাবে। শেষে প্রার্থনা করা হয় পুত্র , পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্র,কম্বল, ধাতু, বহু ভার্যা, রাজা,অন্ন, ও নিরাপত্তা (হিরন্যকেশী গৃহসুত্র ১/৬/১২/১৪)। নতুন বধুর সামনে বহু ভার্যার প্রার্থনা করলে বরের হয়তো সম্মানহানি হয় না কিন্তু বধূর হয়, বধূর সম্মান সমাজে জরুরি নয় বলে বহু ভার্যাও কাঙ্ক্ষিত ধন বলে বিবেচিত হয় বর – পুরুষের কাছে।
প্রার্থিত পুত্র, পৌত্র, শিষ্য, রাজা সকলেই বংশ , জীবিকা ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন কিন্তু ভোগের জন্য প্রয়োজন বস্ত্র, কম্বল, ধাতু,দাস ও বহু ভার্যা । বস্ত্র, কম্বলের মতো নারীও ব্যবহার্য বস্তু।
স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়া ( আপতম্ব ধরমসুত্র ১/১০-৫১-৫৩০)। নিঃসন্তান বধূকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে বার বছর পর, মৃত বৎস কে ১৫ বছর পর এবং কলহপরায়ণা কে তৎক্ষনাৎ ত্যাগ করা যায় ( বৌধায়ন ধরমসুত্র ২/৪/৬) । শতপথ ব্রাহ্মনেও আছে যে অপুত্রা পত্নী, সে পরিত্যক্তা(৫/২/৩/১৪) এবং পুত্রসন্তান না জন্মালে স্বামী আবার বিয়ে করবে ( বশিষ্ঠ ধর্মসুত্র ২৮/২-৩)।
পুত্র সন্তানের প্রয়োজন বংশগতি বৃদ্ধির জন্য, সেইসংগে পুরুষ তন্ত্রের শ্রী বৃদ্ধির জন্যও। নিঃসন্তান থাকা ।কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া অথবা মৃত সন্তান জন্ম দেয়া নারীর জন্য একই রকম অপরাধ। এই জন্ম এবং অজন্মের পাপে নারী পরিত্যক্ত হয় সমাজ ও সংসার থেকে।
নারী হোম করতে পারবে না ( আপস্তম্ব ধর্মসুত্র ২/৭/১৫/১৭)। উপনয়নে নারীর অধিকার নেই। ব্রহ্মচর্য নারীর জন্য নিষিদ্ধ। কেবল স্বামিকে রুপে ও গুনে সন্তুষ্ট করা ও পুত্র সন্তানের জননী হওয়াতেই নারীর স্বার্থকথা। প্রাচীন ভারতে গণিকারা সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। পুরুষেরা ঘরের মূর্খ কুল বধূকে ভোগ করতো, আবার শিক্ষিত গনিকাকেও। রাষ্ট্রই পুরুষের জন্য ভোগের দুয়ার সব খুলে রেখেছিল।
বৃহদারন্যক উপনিষদে আছে স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ কমনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হয় তবে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে কিনতে চেষ্টা করবে, আর তাতেও কাজ না হলে হাত বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে( ৬/৪/৭)। নারীকে যেমন ইচ্ছা শাসন ও ভোগ করার অধিকার শাস্ত্রই পুরুষকে দিয়েছে। পুরুষের জন্য বহুপত্নি উপপত্নী, ও গণিকা সম্ভোগের অবাধ অধিকারের কথা বার বার বলা হয়েছে।
নারীর জন্য দুটো বৃত্তিই সমাজে স্বীকৃত ছিল, দাসীবৃত্তি এবং গণিকাবৃত্তি নারীর নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিল না । পিতা বা স্বামীর ধনে তার অধিকারও স্বীকৃত ছিল না।
কোন ও শিক্ষা পাবার , ধন অর্জন করার, এবং তা ভোগ করার এমনকি নিজের শরীরকে অবাঞ্চিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবার ও অধিকার নেই(মৈত্রায়নী সংহিতা ৩/৬/৩,৪/৬, ৪/৭/৪, ১০/১০/১১, তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
নারীর জন্য শিক্ষা নয়, ধন নয়, এমনকি নিজের শরীর ও নারীর জন্য নয়। নারীর নিজস্ব কিছু থাকতে নেই, কোন ও পার্থিব বা অপার্থিব কিছু। নারীকে নিঃস্ব করে দেবার নানারকম মন্ত্র তৈরি হয়েছে, আর সে সবই লোকে বড় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে।
মৈত্রায়নি সংহিতা বলেছে নারী অশুভ (৩/৮/৩) । যজ্ঞকালে কুকুর, শুদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না ( শতপথ ব্রাহ্মণ ৩/২/৪/৬)। অতিথি সৎকারে ,উৎসবে, যুদ্ধে, যজ্ঞে, যৌতুকে দানে ও দক্ষিনায় গাভি- স্বর্ণ- রথ- গজ- অশ্বের সংগে অগণন নারী দান করা হত। নারীকে ভোগ্য বস্তু ভাবা হতো বলেই গরু ঘোড়ার নারী উল্ল্যেখে কেউ বিব্রত হয়নি। কুকুর শুদ্র, নারী- সবই অস্পৃশ্য। সবই সমাজে নিগৃহীত ঘৃণিত বস্তু।
কন্যা অভিশাপ ( ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/৭/১৩)। তাই সন্তান সম্ভবা নারীর একটি অবশ্য করনীয় অনুষ্ঠান হল ‘পুংসবন’, যেন গর্ভের সন্তানটি পুত্র হয়। নারী মিথ্যাচারিণী, দুরভাগ্যস্বরুপিনী্ সুরা বা দ্যুতক্রিরার মত একটি ব্যসন মাত্র (মৈত্রায়নী সংহিতা ১/১০/১১, ৩/৬/৩)। সর্ব গুণান্বিত শ্রেষ্ঠ নারী ও তাই অধমতম পুরুষের চেয়েও হীন ( তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
আসলে সব কথার সারকথা নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে স্ত্রী স্বামীর পরে খাবে। কারণ ভুক্তেবাচ্ছিষ্টং বধ্বেই দদাৎ , খেয়ে এটোটা স্ত্রীকে দেবার বিধান শাস্ত্রে আছে। বাড়ির কুকুর বিড়াল, এবং স্ত্রী একই জাতের জীব বলে এঁটো দিয়েই প্রতিপালন আছে। আপস্তম্ব ধর্মসুত্র এ (১/৯/২৩/৪৫) বলা হয়েছে কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, ও কুকর হত্যা করলে যে প্রাইশ্চিত্ত, নারিহত্যা, শুদ্রহত্যার সেই একই প্রায়শ্চিত্ত, মাত্র একদিনের কৃচ্ছ্রসাধন।
শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শুদ্র ও নারীর মধ্যে শাস্ত্র কোন ও পার্থক্য করেনি। শাস্ত্র করে বলে সমাজও করেনি। বৈদিক ভারতবর্ষ নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয়নি।খৃষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের সমাজ নারীকে যতটুকু অসম্মান করেছে , তিন হাজার বছর পর ও বর্তমান খ্রিস্টাব্দের সমাজ ভিন্ন কৌশলে, ভিন্ন ব্যবস্থায় নারীকে একই রকম অসম্মান করে যাচ্ছে।
০৮. বিয়ের বয়স
১. ‘বিয়ের বয়স’ বলে একটি কথা আছে, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভিন্ন হুলের আকারে কৈশোর অথবা কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েদের গায়ে ফোটানো হয়।আসলে মেয়েদের মনের উপর এটি একটি সামাজিক চাপ,যে চাপের ফলে মেয়েটি খামোকা প্রমে পড়তে, পালিয়ে যেতে এবং আত্মহত্যা করতে উদ্যোগী হয়। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের অভিভাবক রা এরকম রেহাই পান। উচ্চবিত্তের অধিকাংশ ‘মেয়ে বিয়ে’ অনেকটা কেনা বেচার ব্যবসার মত। মেয়ের চেয়ে আকর্ষনীয় মেয়ের সম্পদ।সম্পদ যার যত বেশি সে ততো বিকোয় ভাল।
একসময় পাঁচ বছর বয়সে মেয়েরা ঘোমটা মাথায় শশুরবাড়ি আসতো; কি অভিজাত কি অনভিজাত সকলেই। এখনো গ্রামের মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করলে,যারা নিজের বয়স বলবার জ্ঞান রাখে না, জিজ্ঞাসা করতে হয় বিয়ের বয়সে তার মাসিক রজ:স্রাব হয়েছিল কি হয়নি, আর যদি হয়েই থাকে ক’বার রজ:স্রাবের পর তার বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ের ক:মাস কী ক’বছর পর তার রজ:স্রাব হয়েছে। (মেয়েদের রজ:স্রাবের হিসেব দিতে পারলেই বিয়ের বয়স বের করা যায়, কারণ রজ; দর্শনের একটি নির্দিষ্ট বয়স আছে। বিয়ের বয়স জানা গেলে পরবর্তি দাসত্বের বছর হিসেব করলেই পাওয়া যায় মেয়ের বয়স)।
এখনো গ্রামে, শুধু গ্রামেই বা বলি কেন, শহরের আশেপাশে, এবং শহরে যারা শিক্ষা চিকিৎসা, পুষ্টি ও সুস্থ বসবাস থেকে সর্বতোভাবে বঞ্চিত, মেয়েরা তিন হাত লম্বা হলেই তারা বিয়ের খেলা শুরু করে। বাংলাদেশে পনের থেকে উনিশ বছরের মেয়েদের শতকরা ৭৫ ভাগই বিবাহিত অথচ প্রাশ্চাত্য ইউরোপে ওই বয়সি মেয়েদের শতকরা এক ভাগও বিবাহিত নয়।মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বলে-স্ত্রীর বয়স যদি ষোল বছরের নিচে হয় এবং স্বামীর যৌনাঙ্গ যোনিমুখ স্পর্শমাত্র করলে যে ঘটনাটি ঘটে তাকে ধর্ষন বলা হয় এবং ধর্ষন আইনত একটি অপরাধ।
এমন এক সময় ছিল রজোদর্শনের আগেই মেয়েরা বিধবা হয়েছে, পুতুল খেলার বয়সেই নিরামিষ আর এলাদশী ব্রত নিয়ে নারী জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। এখনো, ক্রমাগত সন্তান ধারনে এবং পালনে কৌশোর পার করে যৌবন যখন মেলে দেবে তার পাপড়ি, সে মেয়ে তখন বহন করে সামাজিক বার্ধক্য।
যে মেয়ে লেখাপড়া করে সে মেয়ে বিধবা হয়;এ ধরনের একটি বিশ্বাস বাংগালীরা বহু বছর লালন করেছে।অনেকে বলে যুগ বদলেছে,যুগ কতোটুকু বদলেছে? ক’টি মেয়ে খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যায়,ক’জন মেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে আসে,আর যারা আসে তারাই বা সামাজিক সংস্কার কতটুকু অতিক্রম করে শিক্ষিত হয়?
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী প্রাপ্ত অনেক মেয়েকে আমি বলতে শুনেছি -‘আমার সাহেব এখনো ঘরে ফিরেননি,’ ‘আমার কর্তা গতকাল দেশের বাইরে গেছেন।’ সাহেব শব্দটির মূল অর্থ শাসনকর্তা, সম্রাট। নবাব সাহেব,জর্জ সাহেব, মেজিস্ট্রেট সাহেব ইত্যাদি সাহেব শব্দের সম্মানসুভক ব্যাবহার। মান্য ইউরোপীয় বা বিদেশি পুরুষের বেলায় এই শব্দ ব্যবহার হয়, যেমন লাট সাহেব, চীনা সাহেব, জাপানী সাহেব।
স্বামী কে সাহেব বা কর্তা ডাকবার রীতি কবে থেকে,তা আমার সঠিক জানা নেই। একসময় স্বামীর নাম উচ্চারণ করা স্ত্রীর জন্য নিষিদ্ধ ছিল, বাংলাদেশের গ্রামে -গঞ্জে এখনো এই অদ্ভুত নিয়ম প্রচলিত। শহরে বা নগরের বেলায় এই নিয়িমটি সামান্য আধুনিকীকরণ হয়েছে,অল্প শিক্ষিত বা বেশি শিক্ষিত দু ধরনের স্ত্রীই স্বামীর নাম উচ্চারণ না করবার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সাহেব বা কর্তা ব্যবহার করেন।
এদের জীবনে এদের সাহেবের আদেশ ছাড়া কোন কিছুই কার্যকর হয় না।আমি অনেক চিকিৎসক মেয়ের কথা জানি,এরা স্বামীর বিদেশে চাকরির নিসচয়তা এবং নিজের চাকরির অনিসচয়তা নিয়ে কেবল স্বামীর সংগী হিসেবে বিদেশে পাড়ি দেন। এরপর যে ঘটনাটি ওখানে ঘটে তা হলো,স্বামী সাহেবটি দিব্যি চাকরি করেন এবং স্ত্রী বেচারা রান্না ঘরে পেঁয়াজ কাটেন অথবা ফিরনি রান্না করেন। চিকিৎসার বদলে রন্ধন শিল্পের পিছনে পাঁচ ছ’ বছর খাটা-খাটনি করলে এদের বর্তমান জীবন অধিকতর আনন্দময় হতো সন্দেহ নেই।
কোনও কোনও মেয়ে বড় আহ্লাদ করে বলেন আমার স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না।তাঁর স্বামী মাছ খেতে পছন্দ করে না সুতরাং তার মাছ রান্না করা বারণ,তার স্বামী বেড়াতে পছন্দ করেননা তাই তার বেড়াতে যাওয়া বারণ,তাঁর স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না তাই স্ত্রীর চাকরি করা বারণ। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পছন্দ অপছন্দের তোয়াক্কা কিন্তু কেউ করে না।
৩.দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি এবং তাঁর স্ত্রী বিলেতে বার বছর থাকার পর দেশে এসেছেন এমন এক দূর আত্মিয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা শেষে আত্মীয়টি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন এবং বিলেতি অভ্যেস মত করমর্দন করলেন ভিসির সঙ্গে এবং হাত বাড়ালেন ভিসির স্ত্রীর দিকে।আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমি স্পষ্ট দেখলাম ভিসির স্ত্রী , যার নাম আমি জানি না , ভিসির স্ত্রী বলেই তিনি পরিচিত,সম্ভবত নিজের নামের চেয়ে এই পরিচয় টিই তাকে অধিক আনন্দ দেয়, তাঁর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কুঁকড়ে এমন এক অবস্থা করেছেন যেন এই পাপ কাজে হাত বাড়াতে তাঁর মোটেও ইচ্ছা নেই,দু’বার তিনি আড়চোখে দেখলেন তাঁর সাহেব বা কর্তাটি তাঁর উপর অসন্তুষ্ঠ হচ্ছেন কিনা। তারপর ভিসির বাড়িতে কি ঘটেছে আমি জানি না। আমি কেবল আন্দাজ করতে পারি, আন্দাজ করতে পারি অপর পুরুষের করস্পর্শ স্ত্রীর জন্য কি পরিমান গর্হিত একটি কাজ।
৪. ডিসেম্বর মাস চলছে। আঠারো বছর আগে ন’মাস যুদ্ধের পর যে মাসে বাঁশের কঞ্চিতে গাঢ় সবুজের উপর লাল, লালের মধ্যে হলুদ মানচিত্র আঁকা একটুকরো কাপড় বেঁধে একঝাক শিশু সারা উঠোন জয় বাংলা বলে মিছিল করছি , সে মাস ডিসেম্বর মাস।
ময়মনসিংহ শহরে একাত্তরের মার্চ থেকে নভেম্বর অব্দি বড় মসজিদের ইমাম সাহেব নিজের হাতে মানুষ জবাই করে কুয়োয় ফেলেছে, এই মাসে কুয়ো থেকে অগণিত লাশ তুলে শহরবাসী খুঁজছে চেনা মুখ , আমার আত্মীয়রা খুঁজতে গিয়েছে যুদ্ধে যাওয়া , হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া স্বজন ।পাকিস্থানি সৈন্য আমাদের টাকাকড়ি লোট করেছে। যাবার আগে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়ী ,আমার বাবাকে ধরে নিয়ে বুট ও বেয়নেট এ পিষছে, দুই কাকাকে গুলি করে ফেলে রেখেছে রাস্তার মোড়ে , আমার ভাইয়ের ডান চোখ উপড়ে নিয়ে গেছে। এই মাসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া তিন মামার দুজন ফিরে এসেছে, ষোল দিন পর ক্যাম্প থেকে ফিরে এসেছে আমার একুশ বছর বয়সের খালা। পড়শি যারা যুদ্ধ করেছে , কারও হাত নেই , কারও পা। তবুও আত্মীয়রা ওদের ফেরার আনন্দে যে মাসে আত্মহারা হয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।
কেবল আমার খালার ফিরে আসা কেউ চায়নি। যেন ফিরে না এলেই সকলে স্বস্তি পেত। এতকাল গর্ব করে বলেছি আমার বাবা, ভাই, কাকা, মামার কথা, গর্ব করেছি আমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। কিন্তু আমার খালার কথা এতটুকু উচ্চারণ করিনি। আজ সকল নিষেধের আওতা থেকে বেরিয়ে আমি গর্ব করে বলছি ক্যাম্পের অন্ধকার ঘরে আমার খালাকে দশজন পশুস্বভাবী কামুক একটানা ষোল দিন ধর্ষণ করেছে।
আমাদের সমাজ আমার খালাকে নিয়ে গর্ব করেনি। বড় বড় লোকজন কাগজপত্রে, সভাসমিতিতে ধর্ষিতা নারী নিয়ে বড় বড় কথা বলেছে। বীরঙ্গনা খেতাব দিয়ে উদারতার নামে এক ধরনের ফাজলামো করেছে।
যুদ্ধের সকল ভাঙ্গন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মত বীভৎসতা সকলে গ্রহন করলেও ধর্ষণ নামক দুর্ঘটনাটি গ্রহন করেনি।
বাইরে যখন ধর্ষিতা মা বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনীতির নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসি নিয়েছে, সে মাস ডিসেম্বর মাস।
০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
১. কবি অসীম সাহা মাঝে মধ্যেই আদিলা বকুলের প্রশংসা করে বলেন—আদিলার লেখার অভ্যোস ছিল। কিন্তু স্বামী রফিক আজাদকে আদিলা এত বেশি ভালবাসেন যে নিজের লেখালেখি পর্যন্ত ছেড়ে দেন। অসীম সাহা আদিলার এই সাহিত্য-ত্যাগের কথা বেশ গুছিয়ে বর্ণনা করেন। আদিলা বকুল রফিক আজাদকে ভালবাসেন, কিন্তু এতে তার লেখা ছেড়ে দেবার এবং লেখা ছেড়ে দিলে ভালবাসার ওজন বৃদ্ধি পাবার কোনও কারণ আমি দেখি না।
আসলে মেয়েদের কিছু ত্যাগ দেখলে ছেলেরা বড় খুশি হয়। একটি ছেলের জন্য মেয়ে তার আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করলে ছেলের আনন্দ আর ধরে না। স্বামী গান গাওয়া পছন্দ করে না বলে মেয়ে গানের সকল সম্ভাবনার ইতি ঘটালে ছেলে বড় আহ্লাদিত হয়।
যে মেয়ে নাচে কিংবা ছবি আঁকে তার নাচ-ছবি আঁকা বন্ধ করে স্বামী বড় গর্ব করে বলেন যে তার স্ত্রীকে বিয়ের পর তিনি আর নাচতে কিংবা ছবি আঁকতে দেন না। স্বামী লেখেন বলে আদিলার না লেখার মধ্যে কবি অসীম সাহা ভালবাসার তীব্রতা খুঁজে পেয়েছেন।
ছেলে সংক্রান্ত কোনও কারণে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলেও ছেলেটি মুখে যত শোক প্রকাশ করুক, মনে মনে খুব একটা অখুশি হয় না। ছেলে উপার্জনে, ব্যক্তিত্বে এবং নানান প্রতিভায় পরিপূর্ণ হােক এবং মেয়ে তার গতি ও প্রতিভার সকল পথ রুদ্ধ করে ক্রমশ নিঃস্ব হােক, নিঃসঙ্গ হােক, নির্ভরশীল হােক তা সমাজের সকলেই কামনা করে। এই একপক্ষীয় ত্যাগকে সমাজ বড় গুরুত্ব দিয়ে দেখে, কারণ তার হাতে প্রচুর ধর্মীয় কালাকানুন আছে যা সময় সুযোগ মত মেয়েদের অপদস্থ করবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তার হাতে আছে প্রাচীনকাল থেকে বয়ে আনা সামাজিক নীতি ও নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিছু অন্যায় এবং অত্যাচার, কিছু বৈষম্য ও বিভেদ। তার হাতে রাষ্ট্রীয় অবাধ সুযোগ।
অপর্ণ সেনের ছবি ‘পরমা’য় স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় পরমা নামের মেয়েটি ভুলে যায় সে একদিন সেতার বাজাত, কবিতা আবৃত্তি করত। পরমা তার মধ্যবয়সে সেতার বাজাবার যে মিজোরাবটি খুঁজে পায় তাতে জং ধরে গেছে। শাশুড়িকে ওষুধ খাওয়ানো আর বাচ্চাদের হােমওয়র্ক করানোর বাইরে যদি কোথাও সে বেরোয়, বড় জোর নিউমার্কেট, মিনুর বাসা, নয়ত শীলার ফ্ল্যাট। পরমার স্বামীও জানেন তার স্ত্রীর দৌড় ওই পর্যন্তই।
আসলে মেয়েদের দৌড় ওই পর্যন্তই বেঁধে দেওয়া হয়, যদিও স্বামীরা নিজেদের দৌড়ের জন্য সামনে কোনও লাল ফিতে রাখতে রাজি নন। পরমার স্বামী হােটেলের ঘরে পি এ-কে ডিকটেশন দেবার পর অভ্যোস অনুযায়ী আমন্ত্রণ করেন রাতের খাদ্য গ্রহণের, যে আমন্ত্রণ কেবল খাদ্য গ্রহণের নয়, যুবতীর শরীর নামক খাদ্যবস্তু ত্যাগেরও।
অথচ ওদিকে পরমা প্রেমে পড়লেই যত অসুবিধে, কোনও অপর পুরুষ তার শরীর স্পর্শ করলেই সে আপাদমস্তক অশুচি হয়। সংসারের গণ্ডির বাইরে কাউকে ভালবাসবার স্বাধীনতা কোনও মেয়ের নেই। কারণ মেয়ে মাত্ৰই স্বামীর ইচ্ছের অধীন। এই অধীনতা অপর্ণ সেন স্বীকার করেননি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন একটি মেয়ে তার জীবনের যে কোনও সময়ে প্রেমে পড়তে পারে, এতে অপরাধবোধের কিছু নেই। জীবনটা যার যার, তার তার। অপর্ণ সেন জীবনের সবচেয়ে সত্য কথাটি উচ্চারণ করেছেন—’কোনও মানুষই কোনও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সামাজিক সম্পর্ক থাকলেও।’ ক’জন মানে সে কথা !
চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত একটি মেয়ে, তার গান শুনেই একটি ছেলে তার প্রেমে পড়ে। এবং প্রেমে পড়বার কারণে ছেলেটি যখন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তখন প্রথম শর্ত থাকে বিয়ের পর গান গাওয়া চলবে না। মেয়েটি এখন গানের প্রসঙ্গ উঠলে সলজ্জ কণ্ঠে বলে—বাইরে গাই না, ঘরে গাই। এরপর সে স্বামীর কানে কানে গাইবে, অবশেষে মনে মনে। মেয়েদের দৌড় কমতে কমতে এত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে যে একসময় তার স্থির হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না ।
উপায় থাকবেই বা কেন, অনাকাঙ্খা দিয়েই যার জন্মের শুরু। প্রসবকক্ষের বাইরে অপেক্ষমাণ শতকরা এক ভাগ পুরুষও চায় না তার সন্তান কন্যা হােক। একজন উচ্চশিক্ষিত পুরুষও একটি সুস্থ সন্তানের চেয়েও আশা করে একটি পুত্র সস্তান | আমাদের দেশে, হাসপাতালের প্রসবকক্ষে স্বামীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা উচিত। দীর্ঘ নয় মাস স্ত্রী তার শরীরের ভেতর ধারণ করে আরেক শরীর, এই বহনের এবং প্রসবের চূড়ান্ত শারীরিক যন্ত্রণা চােখের সামনে দেখে স্বামীর অন্তত এইটুকু যেন উপলব্ধি হয় উভয়ের সন্তান যে জন্ম দেয়, জন্মদানের সবটুকু কুঁকি যে একই বহন করে, তাকে অত হেলাফেলায় তালাক বলা যায় না। তালাক বলবার সময় কণ্ঠনালীতে স্ত্রীর যন্ত্রণার সহস্র অংশের এক অংশও যদি অনুভূত হয়, তাহলে কোনও পুরুষই সহজে তালাক শব্দটি উচ্চারণ করবে না।
২. অনেকে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং লেনিনের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে বলেন—সমাজতন্ত্র ছাড়া নারীমুক্তি অসম্ভব। দেশে সমাজতন্ত্র না এলে নারীমুক্তির জন্য অযথা চিৎকার করে লাভ নেই। তাই নারী আন্দোলনের হােতারা নাকে সর্ষের তেল ঢেলে ঘুমোচ্ছেন, সমাজতন্ত্র এসে দরজায় কড়া নাড়লে তারা উঠে বসবেন।
সমাজতন্ত্র অতি সহজলভ্য নয়। তা আনবার এবং ধরে রাখবার ক্ষমতা আগে অর্জন করা চাই।
১০. নিজ সংসারেও মেয়েদের অভিনয় করতে হয়
১. স্বামী স্ত্রী দু’জনই উচ্চশিক্ষিত, সুন্দর সাজানো সংসার, প্রসাদোপম বাড়িটিতে অত্যাধুনিক ফার্নিচার থেকে শুরু করে সামান্য ঘটিবাটি পর্যন্ত টিপটপ। বসবার ঘর থেকে শোবার ঘর, শোবার ঘর থেকে খাবার ঘর রান্না ঘর ঘুরে ফিরে দেখি আর অবাক হই, দামি বিদেশি জিনিসপত্রে গোছানো সারাবাড়ির শরীর থেকে ঐশ্বর্যের আলো ঠিক্রে বেরুচ্ছে। আমি অবাক হই, অভাব বলে পৃথিবীতে একটি অপদার্থ জিনিস আছে, তা এই পরিবার কখনও উপলব্ধি করে না। আমি আরও অবাক হই, বাড়িটিতে এত কিছু আছে, এত বাসনপত্র, দামি সোফা, খাট পালঙ্ক, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, ডেকোরেশন পিস, পারফিউম, মেকআপ বক্স, টিভি, ভিসিআর-কেবল একটি বস্তুরই অভাব। প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে আমি মাত্র একটি বই পেয়েছি। ওই একটিমাত্র বই-ই বাড়িটিতে আছে। বইটির নাম আধুনিক রন্ধন প্রণালী। ভাবতেই আমার দম আটকে আসে যে, সারাদিন রান্নার তদারকি সেরে দুপুর বা বিকালে বিছানায় গা এলিয়ে যদি হাতে একটি বই নিয়ে বাড়ির মেয়েটির পড়বার ইচ্ছে করে, তবে একমাত্র যে বইটি তাকে পড়তে হবে তা ওই রান্না সংক্রান্তই, পিঁয়াজের পর আলু নাকি আলুর পর পিঁয়াজ।
অথচ এতে তার কনও মন্দ লাগা নেই। শিক্ষা আজকালকার মেয়েদের বইপত্র নয়, আসবাব ও তৈজসপত্রের প্রতিই অধিক আকর্ষণ জন্মাতে সাহায্য করে। আমি বেশ কিছু বাড়িতে দেখেছি তারা কিছু ইংরেজি অপাঠ্য আর সস্তা কিছু বাংলা উপন্যাস দিয়ে বুকশেল্ফ সাজিয়ে রেখে বেশ একটা জাতে উঠার ভাব করে। আর ভাল কিছু হৃষ্টপুষ্ট বই দিয়ে বুকশেল্ফ ভরে রেখে তারা, যতটা না পড়বার তাগিদে তারও বেশি বুকশেল্ফ ভরবার লক্ষ্যে।
মেয়েদের লেখাপড়া আমি এখনও যা দেখি অধিকাংশই ভাল বিয়ে হবার জন্য। তাই একবার ভাল বিয়ে হয়ে গেলে পড়াশোনার ধারে কাছে দিয়ে সে মেয়ে এগোয় না। বিদুষী মেয়ে নিয়ে আবার কি না কি জ্ঞানের ঝামেলায় পড়তে হয় তাই বাড়তি লেখাপড়ার বিষয়ে স্বামী উৎসাহ তো জোগায় না বরঞ্চ অযথা সময় নষ্ট বলে নিরুৎসাহিত করে। অবশ্য এদেশের বাজার ছেয়ে যাওয়া সস্তা উপন্যাস পড়বার চেয়ে চিকেন কালিয়ায় মসলার পরিমাণ মুখস্ত করা ঢের ভাল।
২. সস্তায় আর কিছু না পাওয়া গেলেও মেয়ে পাওয়া যায়, রূপোপজীবিনী থেকে শুরু করে দিনমুজুর, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির নিম্নবিত্ত শ্রমিক এদেশে বেশ সস্তায় মেলে। ওজন করলে খাসির মাংসের চেয়ে মেয়ে মাংসের দাম কম।
৩. নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবি নিয়ে সারাদিন যে ছেলেটি মিছিলে চিৎকার করে, ঘরে ফিরে সেই বিবাহযোগ্য ছেলে তার মা’কে খুব কড়া কণ্ঠে বলে-ফর্সা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করব না। মেয়ে শিক্ষিত কিনা, রুচিশীল কিনা, মেয়ের আচার ব্যবহার শোভন কি না ইত্যাদি দেখবার আগে ছেলে এবং তার অভিভাবক প্রথম দেখে মেয়ের চামড়া সাদা কিনা। মানুষের শরীরের চামড়া সম্পূর্ণ ক্রোমোজোমের চরিত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জল-খাদ্যের উপর নির্ভর করে। এদেশি মানুষের স্বাভাবিক ত্বকের রঙ বাদামি। অথচ একটি মেয়ের সৌন্দর্য বিচার হয় তার ব্যক্তিত্বে নয়, তার ত্বকের উজ্জলতায়, তার নাক চোখ ঠোঁটের আকার আকৃতিতে। খুব খুদ্র পরিসরেও বর্ণবাদ চলে। শুধু আফ্রিকা নয়, তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি ঘরে ঘরেই গোপনে বর্ণবাদ চলছে।
মেয়েমানুষ অনেকটা পোশাকের মত। একে সোডা সাবান দিয়ে কেচে ফর্সা করতে পারলে অনেকের আনন্দ হয়। পুরনো পোশাক ফেলে দিতে মানুষের মায়া নেই, নতুন পোশাকের দিকে ঝোঁকও খুব বেশি। একে প্রয়োজনে গায়ে চড়াতে হয়, পোশাকটি যত সেলাইয়ে নিখুঁত, বুননে ঠাসা, ঝকঝকে তকতকে, তত পরতে আরাম। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পোশাকের যায়গায় পোশাক, মানুষের জায়গায় মানুষ। পোশাক যেমন হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকে, স্বামীর সংসারে মেয়েরাও তেমন বায়বীয় হ্যাঙ্গারে ঝুলে আছে, ব্যবহৃত হওয়াই তার প্রধান কাজ।
৪. আমি বেশ কিছু সংসারে দেখেছি, স্বামী তার রুমাল, মোজা, টাই, নিজেই খুঁজে নিলে স্ত্রী বড় রাগ করেন। কারণ স্ত্রী আশা করেন, স্বামীর যে কনও কাজেই যেন স্ত্রীর প্রয়োজন হয়, স্ত্রী কাছে না থাকলে স্বামীর স্বাভাবিক জীবনযাপন যেন বাধাগ্রস্ত হয়, স্বামীর দৈনন্দিন জীবনে যেন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং স্বামী যেন স্ত্রীর অভাব অনুভব করেন তাই জীবনযাপনের সকল ক্ষেত্রেই স্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামীকে তার উপর নির্ভরশীল করাতে চান।
তাই স্বামী যদি দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো একাই মিটিয়ে ফেলেন, তার নাওয়া-খাওয়া, তার জামা-কাপড়, জুতো-মোজা ইত্যাদির ব্যাপারে স্ত্রীর প্রয়োজন না পড়ে তবে স্ত্রীর তো ভীষণ বিপদ। কারণ ভালবাসার তাগিদ যদি স্বামীর না থাকে, অন্তত কাজকর্মের তাদিগে যেন স্ত্রীকে তিনি কাছে রাখেন। কাছে থাকার জন্য, স্বামীর ঘরে নির্ঝঞ্চাট বসবাসের জন্যে স্বামীকে নিজের ওপর নির্ভরশীল করানো অসহায় মেয়েদের এক ধরনের দুর্বল চাতুর্য।
আমাদের সমাজ মেয়েদের এত হেয় করে রেখেছে যে নিজ সংসারেও তাকে অভিনয় করতে হয়। একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সংসার নামক মঞ্চে প্রতিনিয়ত তার অভিনয়ের পরীক্ষা চলে। ফলাফল সামান্য এদিক ওদিক হল তো মেয়েটির সমূহ সর্বনাশ।
১১. প্রোসটেটনামা
প্রোসটেট নামে পুরুষের শরীরে একপ্রকার গ্ল্যান্ড থাকে। পঞ্চাশের অধিক বয়স বিশেষত ষাট সত্তর বছর বয়সে পুরুষের প্রোসটেট গ্ল্যান্ড আকারে বড় হয়। প্রোসটেট গ্ল্যান্ড, দুটো হরমোনের গতিবিধি পরিচালনা করে। একটি এন্ড্রোজেন, অপরটি এস্ট্রোজেন। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে এন্ড্রোজেন হরমোন ক্রমশ কমে আসে কিন্তু এস্ট্রোজেন একই অনুপাতে কমে না। এস্ট্রোজেন হরমোনের আধিক্যে প্রোসটেট গ্ল্যান্ড বড় হয়ে যায়, মোদ্দা কথা এন্ড্রোজেন এবং এস্ট্রোজেন হরমোন দুটোর পরিমাণগত অসামঞ্জস্যই প্রোসটেট বড় হওয়ার মূল কারণ। এই রোগের প্রধান উপসর্গ ঘন ঘন পস্রাবের বেগ, প্রথমে রাতে, এরপর রাত এবং দিন উভয় সময়ে। পুনঃ পুনঃ এবং দু’তিন ফোঁটা পস্রাবের অস্বস্তি, তার উপর পস্রাব করার সময় বিষম জ্বালাপোড়াও অনুভূত হয়। নিজ ইচ্ছায় পস্রাবের আরম্ভ, গতি ও সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে কিডনি আক্রান্ত হলে পস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। পস্রাব শুরু ও শেষ হওয়ার সময় কিছু রক্ত যাওয়াও এসময় বিচিত্র কিছু নয়।
প্রোসটেট বড় হওয়ার প্রথম দিকে পুরুষের যৌন উত্তেজনা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় যদিও শেষদিকে পুরুষত্বহীনতাই স্থায়ী হয়। মজার ব্যপার হচ্ছে, বুড়ো কুকুরের মধ্যেও প্রোসটেট বড় হওয়ার লক্ষন খুব দেখা দেয়। প্রোসটেট উপরের দিকে ঠেলে বড় হওয়ার কারণে কুকুরের মলনালী সঙ্কুচিত হয়। এর ফলে মলনালী সারাক্ষণ ভরা ভরা ঠেকে এবং মলত্যাগের যে চেষ্টা বুড়ো কুকুরেরা করে যায় তা অর্থহীন এবং যন্ত্রণাদায়ক।
প্রোসটেটের পরিবর্ধন এবং প্রতিকার আমার বিষয় নয়। আমার বিষয় প্রোসটেট হঠাৎ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে ষাট-সত্তর বয়সের সেইসব বুড়ো পুরুষ, যারা কামোদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। অনেকে এই বিয়েকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য নানারকম যুক্তি তৈরি করেন। যেমন বুড়ো বয়সে যত্ন করবার কেও নেই অথবা আমাদের রসুলুল্লাহ নবী, দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন-ইত্যাদি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তাই তারা কোনও বয়স্ক মহিলা নয়, কিশোরী থেকে যুবতী পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে করবার আগ্রহ প্রকাশ করে। পৃথিবীর যত বুড়ো রোগী এই অবস্থায় বিয়ে করে, সাময়িক কামোত্তেজনা নির্বাপিত হলেই তারা পুরুষত্বহীনতায় ভোগে। তখন সেইসব বালিকা, কিশোরী এবং যুবতীর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা এমন কেউ নেই যে না জানে।
এমন কে আছে যে জানে না একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে সচ্ছলতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, শেষ অবধি সেই মেয়ে জীবনের দায়ভার অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেবল দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য কি নির্মম ভাবে বেঁচে থাকে!
আমাদের দেশে পীরের প্রকোপ খুব বেশি। পীর একটি ফরাসি শব্দ, যে শব্দটার আবিধানিক অর্থ বৃদ্ধলোক। এদেশে নানা জাতের অসাধু পুরুষ আছে, এদের মধ্যে পীর অন্যতম। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী কাজ আমার জানা মতে এমন কোনও পীর নেই যে করেনি। দেশের আনাচে কানাচে হঠাৎ গজিয়ে উঠা ‘পীর’ নামে পরিচিত মানুষগুলোর মূল পেশা অসাধুতা, লম্বা চুল-দাড়ি-জোব্বার আড়ালে অর্থ ও নারী লিপ্সাই পীর চরিত্রের প্রধান দিক।
পাবনার পীর খাজাবাবারে নিয়ে বছর কয়েক আগে দেশসুদ্ধ বড়রকম হইচই হয়ে গেল। নারী সংক্রান্ত তার অশ্লীলতার খবর সকলেই জানে। শুনেছি সেই খাজাবাবা নাকি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরনো পীর ব্যবসায় আবার ফিরে যাচ্ছে। শিমুলিয়ার পীর মতিউর রহমানের বহুবিবাহ এবং লাম্পট্য মুখরোচক আলোচনার বিষয়। শর্ষিনার পীর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। আজকাল অধিকাংশ পীর রাজনীতির খবরদারি করছে, আটরশির পীর স্বাধীন দেশে বসে স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই বড় গলায় কথা বলছে। ধর্মভীরু মুরিদদের নজরানা নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল অট্টালিকা ও শিল্প কারখানা গড়া কোনও সৎ মানুষের কাজ নয়। শুনেছি আটরশির পীরের অনুমতি মিললে দেশের মন্ত্রী হওয়া যায়। পীর বলতে এখন আর মুসলমান সিদ্ধ সাধু পুরুষের ভাবমূর্তি মনে ভাসে না-পীর মাত্রই ঝাঁক ঝাঁক যুবতী বেষ্টিত প্রচণ্ড কামুক পুরুষ।
শিমুলিয়ার পীর মতিউর রহমানের চতুর্থ স্ত্রীর বয়স তের। মতিউর রহমানের প্রোসটেট এনলার্জড্ কি না জানি না, অশ্লীলতা করবার জন্য সকল বুড়োর প্রোসটেট এনলার্জড্ হতে হয় না। পুরুষ হিসেবে অবাধ ধর্মীয় এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গেলে বয়স বিষ পঁচিশ কি সত্তর আশি, কিছু যায় আসে না।
সকলের প্রোসটেট এনলার্জড্ হয় না। প্রোসটেট এনলার্জড্ ছাড়াও লাম্পট্য চলে। লাম্পট্যের জন্য সমাজের সকল পথ খোলা, নারী নিয়ে যথেচ্ছাচার এদেশে নিন্দনীয় নয়; বরং এতে পুরুষের বীরত্বই নাকি অনেকাংশে প্রকাশ পায়।
১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
ঘটনাটি ঘটে চট্রগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায়। মধ্য জানুয়ারীর দুপুর তখন বিকেলের দিকে সামান্য ঝুঁকেছে। আমি ওই এলাকায় নতুন, কোনও নতুন এলাকায় গেলে আমি শুয়ে বসে দিন কাটাতে পারি না যতক্ষন না ওই নতুন আমার কাছে পুরনো হয়। পুরনো মানে এই নয় যে আমার সকল আগ্রহ উবে গেল। ব্রহ্মপুত্র আমার জন্মের চেনা, এত চেনা যে মনে হয় ব্রহ্মপুত্রের সকল বাঁক আমি চিনি, সকল স্রোত আমি চিনি, তীরের বালুতে আঁকা সকল পদচ্ছাপ আমি চিনি। তবু যে নদী আমাকে এখনও সবচেয়ে বেশি টানে সে ব্রহ্মপুত্রই।
আগ্রাবাদ এলাকাটি তখনও ঘুরে ফিরে দেখা হয়নি। সাদামাটা যা দেখেছি তা ভাঙা রাস্তার দু’পাশে দোতলা, তিনতলা কিছু দালান। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে এমন কোনও বিকেলও নয়, কিছু গা ম্যাজম্যাজ করা সময় থাকে, কোথাও মন বসে না অথচ কিছু একটা করবার জন্য সকলে কিছু একটা খোঁজে, আমিও তেমন খুঁজছিলাম এমন সময় বিকট চিৎকারটি এল। প্রথমে ঠাহর করতে পারিনি জন্তু না মানুষ। কান পেতে থেকে টের পেলাম মানুষ। এবং মানুষ বোঝার আরও মিনিট দশেক পরে বোঝা গেল চিৎকারটি নারীকণ্ঠের কান্না থেকে উদ্ভূত। আমি কণ্ঠস্বরের দিকে এগোলাম।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলতেই বসবার ঘরটিতে কাঠের সোফা, কার্পেট, টেলিভিশন, দেয়ালে দু’একটি বাঁধানো চিত্রকর্ম অথবা ফটোগ্রাফ, একপাশে বই, কাঁচের বাসন ও পুরষ্কারের সিল মনোগ্রাম সাজানো কাঁচবন্ধ কাঠের তাক। কিছু মুসলমানের আবার নতুন একটি অভ্যেস হয়েছে মখমল কাপড়ে আঁকা কাবাশরিফ বাঁধাইয়ে রাখে ঘরে। যে যত বড় কাবা ঝোলাতে পারে, সমাজে তার কদর তত বেশি। কণ্ঠস্বরটি একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা, অন্তত স্বর অনুসরণ করে আমি যে ঘরে এসে পৌঁছি সে ঘর আমাকে তাই বলে।
দরজা খোলা। তিন-চারজন মানুষ, আমি অনুমান করি তারা ঘরের কেও নয়, আমার মত খোঁজ নিতে এসেছে। চিৎকারের তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা আমার কাছে অপ্রতুল মনে হয়। যেন এমনই ঘটে, এমন ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং আমি ছাড়া যারা দেখতে এসেছে তারা প্রায়ই আসে এবং তাদের নির্লিপ্ত মুখ আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে, যে বিষয়টি নিয়ে চিৎকারের সূচনা সেটি কোনও মারাত্মক কিছু নয়।
দর্শনার্থীর মধ্যে ঘরের ঘটনাটির চেয়ে আমার কোথায় থাকা হয়, কোত্থেকে আসা হয়েছে, কি করা হয় ইত্যাদি জানবার আগ্রহই ছিল বেশি। আমার সম্পর্কে যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে দিতে আমি এই প্রলম্বিত কান্নার কারণ যেটুকু জানতে পারি তা আমার জানবার ইচ্ছাকে মোটেও তৃপ্ত করে না। আমি এই ভেবে ফিরে আসি যে আমি এই ক্রন্দনরতা নারীর সঙ্গে নিভৃতে একদিন কথা বলবই।
পরদিন বলেছি। মেয়েটির বয়স আঠারো বছরের বেশি হবে না। পাশের বাড়িতে বেড়াতে আসা অন্য শহরের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্তরঙ্গ হওয়া এই বয়সে বড় মানায়। ঘরে তখন মেয়েটি ছাড়া কেউ নেই, স্বামী সরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন, প্রায়ই ফিরতে রাত হয়। শহর, বন্দর, বাড়িভাড়া, স্কুল-কলেজ, পড়াশোনা ইত্যাদি ব্যাপারে দীর্ঘক্ষণ কথা বলবার পর আমি গতকালের ঘটনায় ফিরি। মেয়েটি কোনও সঙ্কোচ করেনি, শরীরের নানা স্থানে আঘাতের সকল চিহ্ন একটু একটু করে উন্মুক্ত করে।
আমি ঘটনায় ঢুকতে চাই। আঠারো বছর এবং একটি নতুন মানুষ-এই দুটোর দ্বিধা এবং লজ্জা কাটিয়ে মেয়েটি আমাকে যা বলে তা হচ্ছে মেয়েটি স্কুল পার হয়ে কলেজ কলেজ করছে এমন সময় পরিবার থেকে পছন্দ করে বিয়ে। বিয়ের পর স্বামীটি চব্বিশ ঘণ্টায় পাঁচ-ছ’বার শারীরিক মিলন চায় কিন্তু মেয়েটিকে এই সংখ্যাধিক্য বড় অপ্রতিভ করে। প্রথম প্রথম স্বামীর মনোতুষ্টির জন্য সে শরীর মেলে দিত, দাঁতে ঠোঁট চেপে সহ্য করত বাড়তি অত্যাচার।
এখন মেয়েটির যৌনাঙ্গে যন্ত্রণা এত তীব্র হয় যে সে বাধা না দিয়ে পারে না। আর বাধা দেবার কারণে চলে অশ্লীল অত্যাচার। পুরনো ইলেক্ট্রনিক তার ঘন করে পেঁচিয়ে রাখা আছে, স্বামী নিজ হাতে এগুলো চাবুক হিসেবে ব্যবহার করে মেয়েটিকে তার আদেশ মানতে বাধ্য করে। কখনও কখনও মেয়ে আবার বেঁকে বসে, ফুঁসে উঠে, চিৎকার করে, কাঁদে।
আমি জিজ্ঞেস করি-তোমার কি একেবারেই ইচ্ছে করে না? মেয়েটি লজ্জায় শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচায়, বলে-করবে না কেন? করে। যখন আমার সঙ্গে ও আদর করে কথা বলে, তখন করে।
মেয়েটির চোখে শৈশবের সরলতা উপচে পড়ে।
ধমক দিলে, মারলে আমার ওসব ইচ্ছে করে না।
তোমাকে মারে কেন?
ডাকলে যাই না যে!
তাই মারে?
হ্যাঁ।
মারলে তোমার রাগ হয় না? চলে যেতে ইচ্ছে করে না?
যাব কেন? মারার কথা তো হাদিসে আছে।
এই কথা কে বলেছে তোমাকে?
আমার স্বামী।
তোমার স্বামী সঠিক কথা বলেনি। কোনও হাদিসে স্ত্রীকে মারধোর করবার কথা লেখা নেই।
মেয়েটির বিশ্বাসের দেয়ালে একটি কালো আঁচড় পড়ে। আমার মুখের দিকে অবাক তাকিয়ে থেকে বলে-তবে যে সবাই বলে।
ওরা ভুল বলে, মিথ্যে কথা বলে, রতন।
মেয়েটির মান রতন। আমি শেষ পর্যন্ত রতনকে একরকম বোঝাতে পেরেছি, ওরা মিথ্যে বলে। ওরা বলে কারণ তোমার শিক্ষা নেই, তোমার উপার্জন নেই, তোমার স্বাধীনতা নেই, স্বামী তোমাকে ঠকাচ্ছে, সমাজ তোমাকে ঠকাচ্ছে, দেশ তোমাকে ঠকাচ্ছে। ঘরে বসে ভাত রান্না করে স্বামীর রসনা ও বিছানায় তার শরীর তৃপ্ত করা ছাড়া তোমার মূল্যবান কোনও কাজ নেই। পিটিয়ে তোমার হাড় গুঁড়ো করে ফেললেও, অধিকাংশ লোক, যারা কোনও কুকুর মারতে দেখলেও আহা করে, তারাও, কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে মারলে একবার ফিরেও দেখে না।
দিন দুই পর চলে আসবার দিন আমার বড় ইচ্ছে করে রতনের সঙ্গে একবার দেখা করি। সকালবেলা, সেদিন সরকারি ছুটির দিন, দরজায় কড়া নাড়লে রতনের স্বামী এসে সামনে দাঁড়ায়। নিজ পরিচয় বলবার পর তার কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে, নাক সামান্য কুঞ্চিত হয়; সে ভেতরে যায়, ভেতর ঘরে দু’জনের কথাবার্তা ক্রমশ নিচু থেকে উপরে উপরে ওঠে এবং উপর থেকে নিচে নামে। আমি অপেক্ষা করি, ভেতর ঘরে বাক্যালাপের একটি মীমাংসা হবার পর আমার সামনে এসে দাঁড়ায় প্রথমে রতন, পেছনে তার স্বামী। আমি রতনের স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখি সেই জি জিহ্বা-যে জিহ্বা স্ত্রীর প্রতি অশ্রাব্য ভাষা উচ্চারণ করে, সেই হাত-যে হাত স্ত্রীর শরীরে নির্মম আঘাত করে। আমি দেখি এবং মনে মনে সেই জিব্বা ও হাতের প্রতি, সেই শরীর ও মনের প্রতি ছুঁড়ে দিই তীব্র ঘৃণা। আমি অবাক হই আমার সামনে যে পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে এ পুরুষটিই এক দুপুরে স্ত্রীকে কাঁদিয়ে পাড়া জাগিয়েছিল। আমি বিস্মিত হই, এই মানুষটিকে সমাজের প্রত্যেকে ভাল মানুষ হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য কারণ অযথা তার চুল বড় নয়, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজায়নি, পরনের কাপড়ে ময়লা নেই, শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে, লোকের সঙ্গে হেসে কথা বলে।
আমি রতনকে বলি-আজ চলে যাচ্ছি। রতন ম্লান হাসে। তার স্বামী পেছন থেকে সামনে আসে, এদিক ওদিক হাঁটে এবং বলে-আপনি সেদিন রতনকে যা বুঝিয়ে গেছেন তা ঠিক নয়। এইভাবে মানুষকে ভুল শিক্ষা দেবেন না।
কি রকম ভুল শিক্ষা?
এই যেমন হাদিসের কথা অস্বীকার করা।
লোকটি সোফায় বসে এবং আমাকেও বসবার আহ্বান করে বিরক্ত কণ্ঠে বলে-আপনি বোধ হয় হাদিস কোরান পড়েন না।
এরপর সেই লোক দ্রুত উঠে চলে যায়, ফিরে আসে বেশ কিছু, অন্তত পাঁচ ছ’টি স্বাস্থ্যবান বই এবং জিতে যাওয়ার এক প্রকার হাসি নিয়ে, যে হাসি একবার ঠোঁটে ঝুলে গেলে নামতে কঠিন হয়।
এই কিতাবগুলো পড়লেই আপনি বুঝবেন। এইভাবে আজেবাজে কথা বলে মেয়েমানুষ নষ্ট করবেন না। আপনারও তো আখেরাত বলে কিছু আছে। এই দেখুন-এই বলে কিছু চিহ্নিত পৃষ্ঠা উল্টে সে নিজেই পড়ে-যদি কোনও ব্যক্তি সঙ্গম করার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তার নিকট উপস্থিত হয় যদিও সে উনানের উপর রন্ধনের কাজে লিপ্ত থাকে। মুসলিম হাদিস। শুধু কি এই? সে আবার পড়ে-যখন কোনও ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তার শয্যায় আহ্বান করে, তাতে সে অস্বীকার করার জন্য যদি স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত কাটায় তবে প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রীলোকের প্রতি অভিসম্পাত করে। এটিও মুসলিম হাদিস। এবার তিরমিজি হাদিস শুনুন, যে স্ত্রী লজ্জাহীনতার কাজ করে তাকে আপন বিছানা থেকে পৃথক করে দাও এবং এইরুপ স্ত্রীকে সাধারণভাবে কিছু মারপিট কর।
আমার বিশ্বাস হয় না। আমি বইগুলো হাতে নিই এবং স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, রতনের স্বামী যা পড়ে শোনাল। আমার তবু বিশ্বাস হয় না এই সভ্যযুগে ছাপার অক্ষরে পৃথিবীর কোথাও নারীর প্রতি এই অবিচার, এই অমর্যাদা প্রচারিত হয় এবং এই অন্যায়গুলোই সাদরে গৃহীত হয় সমাজে, সমাজের ভদ্র লোকেরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন যাবতীয় ধর্মীয় বর্বরতা।
১৩. নারীর শরীর
যুগে যুগে পুরুষের কাছে নারীর আবেদন তার রহস্যময়তার। সেই রহস্যের আড়ালে যে রক্তমাংসের নারী সে আসলে কেমন? কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ১৯৯০ সংখ্যা সানন্দার প্রচ্ছদে একটি নারীমূর্তি এবং এই প্রশ্ন এইটুকু বুঝতে সাহায্য করে যে, রক্তমাংসের নারীকে যারা বর্ণনা করতে চায়, আর যাই হোক নারী নিয়ে তারা সস্তা রসিকতা করে না।
নারীর শরীর, শরীর নিয়ে নারীর উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা, শরীর সমস্যার সমাধান–প্রচ্ছদ কাহিনিতে আলোচিত হয়েছে এই সব মৌলিক বিষয়। এই সংখ্যার নারী সম্পর্কিত প্রতিটি রচনাই শিক্ষামূলক ও অত্যন্ত মূল্যবান। এই সংখ্যায় কাব্যে, সমাজে মহিলা কবিদের স্থান কোথায় তাই নিয়ে আছে বিশেষ নিবন্ধ। আছে আর যা থাকে, ফ্যাশন, ধারাবাহিক, গল্প, বিতর্ক, খেলা, রান্নাবান্না, বাবুবিবি সংবাদ, সংস্কৃতি ইত্যাদি।
এই সানন্দা নারী সংখ্যাটি বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি পায়নি। কেনো এই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ হয়েছে, কোন রচনায় অশ্লীলতার দোষ পড়েছে জানতে গিয়ে আমি যে কারনটি শুনেছি তা আমাকে অবাক করেছে। নারীর শরীর সম্পর্কিত ছবি ও আলোচনায় নাকি দেশের পত্র-পত্রিকার ভালো মন্দ লক্ষ্য রাখবার কর্তাব্যক্তিরা বড় নাখোশ হয়েছেন তাই এই পত্রিকাটি দেশে ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি। যদিও এর আগে পুরুষ সংখ্যাটির ব্যাপারে কোনো বাধা ছিলো না।
নারীর শরীরের গঠন, শারিরীক বিকাশের প্রথম পর্যায়, প্রতিটি ধাপ বয়:সন্ধি রিতুস্রাব, যৌন প্রক্রিয়া গর্ভাধান,গর্ভধারণ, রজ:নিবৃত্তি, রজ:নিবৃত্তের পরে সমস্যা ও চিকিৎসা, বার্ধক্য, বার্ধক্যের বাহ্যিক চিহ্ন, মানসিক চাপ ইত্যাদির আলোচনা যদি নিষিদ্ধ হয়, তবে বিজ্ঞান নিষিদ্ধ হবে, চিকিৎসাশাস্ত্র নিষিদ্ধ হবে, নারীর জীবনযাপন নিষিদ্ধ হবে।
নারী নিয়ে নানা রস রচনা, ব্যংগ, কৌতুক, অশ্লীলতা যৌনসংগম এর নোংরা বর্ণনা সম্বলিত পত্র পত্রিকা এদেশে বড় জনপ্রিয়। কাতারে সাজিয়ে রাখা অভিসারিকা, জলসা, কামনা, বাসনা, যৌবন মধু, প্রেমতরংগ, রসের হালুয়া ইত্যাদি দেদার বিক্রি হচ্ছে। আমাদের শ্লীল-অশ্লীল যাচাইয়ের কর্তাব্যক্তিরা এ জাতীয় অসুস্থ জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেন না।
তাঁরা প্রতিবাদ করেন সুস্থতা ও সুন্দরের বিরুদ্ধে, জ্ঞান ও রুচির বিরুদ্ধে, জীবন ও শিল্পের বিরুদ্ধে। নারী সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যাপারে সকলে সচেতন হয়ে উঠলে সম্ভবত আমাদের কর্তাব্যক্তিদের সমুহ ক্ষতি। এখনও যারা বিশ্বাস করে নারী শরীর অস্তিমজ্জায় দুর্বল, তারা আবার মানসিক দিকে সবল না হয়ে উঠে, কিভাবে ডিম্বাণুর ক্রোমোজোম শুক্রকীটের এক্স ক্রমোজম এর সংগে মিলিত হয়ে নারী ভ্রুণ এবং ওয়াই ক্রোমোজোম এর সাথে মিলিত হয়ে পুরুষ ভ্রুণ গঠন করে তা জেনে বুঝে বন্ধ্যাত্বের এবং নারী পুরুষ সন্তান জন্মানোর দায় দায়িত্ব যদি নারী তার কাঁধে না নেয় তবে কি হাল হবে কুসংস্কারের, অসম্মানের ও নির্যাতনের?সন্তান এবং পুরুষ সন্তানের উদ্দ্যেশে শাহজালাল থেকে খাজা মইনুদ্দিন পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ যদি না করতে হয় তবে দেশ সুদ্ধ গজিয়ে উঠা সহস্র মাজার ব্যবসারই বা কি গতি হবে?তাবিজ, মাদুলি,পানি-পরা,যদি নাই প্রয়োজন হয় তবে রাজনৈতিক পীর ব্যবসাই বা কোথায় দাঁড়াবে?
অধিকাংশ নারী যারা মনে করে রজ:নিবৃত্তি যৌনমিলনের অন্তরায়, তারা যদি জেনে ফেলে রজ:নিবৃত্তির পর একজন নারীর শুধু বন্ধ্যাত্বই আসে,যৌনক্ষমতা লোপ পায় না তবে তারা প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবে; যে সমাজে নারীর শারিরীক মুক্তি নেই, সেই সমাজ কেন দিবে নারীকে মানসিক মুক্তি?
যৌন-প্রক্রিয়ায় এমন অনেকেই আছে যারা জানে যে এতে নারীর চূড়ান্ত সম্ভোগের কোন ব্যবস্থা নেই।তারা কেবল পুরুষের ব্যবহারের জন্য তৈরি, তারা সানন্দার ওই নারী সংখ্যা থেকে নারীর শীর্ষসুখ যদি সচেতন হয়,শিক্ষিত হয়,তবে নিশ্চই কতিপয় পুরুষের বিপদে পরবার আশংখা আছে। আর তাতে সানন্দার ছাড়পত্র দেবার কর্তা ব্যক্তিদেরও বিপদ কম নয়।
নারী সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মন্তব্য করেছেন। সত্যজিৎ রায় বলেছেন-মেয়েদের সম্বন্ধে আমার অবচেতনে একটি বিশ্বাস আছে যে তারা মূলত বেশি সৎ বেশি স্পষ্টভাষী। বীর সাংভি বলেছেন পুরুষের খুব গর্ব যে তারা সবজান্তা। এমনকি তারা নারীর ও নাড়িনক্ষত্র সব জানে।তাই বদান্যতা করে জানাতে চায় যে তারা মেয়েদের খুব ভালবাসে, তাদের দেখবাল করে, তারাই মেয়েদের রক্ষাকর্তা। হায়! যদি তারা একটু ও জানতো যে আসলে তারা খুব বেশি কিছু একটা জানে না। সবচেয়ে কম বুঝে নারীকে।
মেয়েরা রাঁধবে, বাড়বে,সন্তান ধারণ করবে। কবিতা লেখা নারীর কম্ম নয়। সমাজের প্রায় সকল মানুষের এই ধরনের সংস্কারের ভিতরে বাস করে যারা কবিতা লেখে, সেই কবিরা নিজ নিজ ক্ষোভ ও বিশ্বাসের কথা লিখেছেন,লিখেছেন-কবি, সে যদি পুরুষ হয় তবে বলা হবে কিঞ্চিৎ লাজুক আর নারী হলে কিঞ্চিৎ বেহায়া। নারীর শরীর চিরদনেই নারীর পক্ষে সামাজিক বিঘ্নের কারণ হয়ে এসেছে।তাই মধ্যযুগের ভারত বর্ষের নারী কবিরা ছিলেন তাপসী। তাঁরা সকলেই চেস্টা করেছেন নারী দেহকে যেকোন উপায়ে উত্তীর্ণ হয়ে একটা লিংগ চিহ্নবিহীন ব্যাক্তিত্ব অর্জন করতে। পুরুষকে তো তার লিংচিহ্ন গুছিয়ে তবে শিল্পির স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় না? আমরাই বা কেন নারীত্বের পূর্ণ পরিচয়ে অহংকৃত হয়ে কলম ধরব না?
লিখেছেন–পুরুষ বন্ধুরা চায়, আমি চা- জলখাবার করি, জলের বোতল এগিয়ে দিই। তারা আমার তৈরী চায়ের এবং সংরক্ষিত চেহারার সুখ্যাতি করবে কিন্তু প্রতি-কবিতা বা উত্তর আধুনিক কবিতা বিতর্কে আমার আংশগ্রহণ মানবে না। নির্বাচনের গতি, প্রকৃতি বিষয়ে অভিমত কিংবা কবিতার সংগে অডিও ভিস্যুয়ালের সম্পর্ক নির্ধারন তারা আমার মুখে শুনতে মোটেও রাজি নয়।
লিখেছেন–আমার মনে হয় আমি সেই মেয়ে, চার হাজার বছর আগে যার হাত থেকে বেদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল,বাধ্য করা হয়েছিল সংস্কৃতের বদলে প্রাকৃত বলতে। ধিক সেই পূর্বপুরুষ কে যিনি একটি মেয়েকে গৃহবন্দি বধু করে অন্যকে করেছিলেন জনভোগ্য দেবদাসী। একজনকে নগরনঢী অন্যজনকে সেবাদাসী।
স্তনের অসুখ হলে সানন্দায় স্তন পরীক্ষার করবার নিয়মাবলী দেখে ছি ছি করেছেন যে ভদ্রলোকেরা আমি নিশ্চিত সেখানে উপস্থিত নারীটির স্তনের দিকে তাঁরা আড়চোখে তাকিয়েছেন এবং তৃষ্ণার্ত হয়েছেন।
১৪. ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খেলা ‘তাহারুশ’
১. একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেলে বাংলা একাডেমির গেটে প্রতি বছর খুব নীরবে ঘটে যাচ্ছে অশ্লীল সব ঘটনা। একাডেমির পরিচালক এই অশ্লীলতার খবর জানেন না এমন নয়, জানেন, কিন্তু প্রতিরোধের কোনও উদ্যোগ তাঁর নেই।
গেটের ভিড়ের মধ্যে মূলত যারা ভিড় তৈরি করে, মনে হয় তারা ঢুকছে কিংবা বেরোচ্ছে, আসলে তারা একাডেমিতে ঢোকেও না, একাডেমি থেকে বেরও হয় না। কেবল গেটের কাছে ভিড় পাকায়। হঠাৎ ধাক্কায় গায়ে গায়ে গড়িয়ে পড়ে সকলে, আবার উঠে দাঁড়ায়, ভিড়ের চাপে ও তাপে এক একজন মথিত হতে হতে যদি ছিটকে বেরোতে পারে তো সে যাত্রা সে বাঁচল। কিন্তু বাঁচে না ওই মেয়ে মানুষেরা। কিছু ছেলের, ওরা দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে, এই ভিড় সৃষ্টির পেছনে একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। ভিড়ের মধ্যে কোনও মেয়ে পড়লে, আমার বলতে বাধে না যে সেই মেয়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসে অসংখ্য হাত এবং মেয়ের স্তন, তলপেট, উরু ও নিতম্বে যে থাবা পড়ে তা তাকে শারীরিকভাবে তো অসুস্থ করেই, মানসিকভাবেও আর সুস্থ রাখে না।
শরীরে শাড়ি নেই, ব্লাউজ ছেড়া, এই অবস্থায় সেদিন ভিড় থেকে বেরিয়েছে একটি একুশ-বাইশ বছরের মেয়ে; এইমাত্র ধর্ষিতা হয়ে অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে আসা নারীর মত তাকে মনে হয়—দেখে আমি আমূল শিহরিত হই, এই যদি হয় একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেল, এই যদি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তবে যারা এই ভিড়ের বিকৃত যৌন-আনন্দ শেষে ভাল মানুষের মত মিশে যায় বই মেলায়, বই দেখে, কেনে, গান গায় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো—ধিক সেই বাঙালি, ধিক সেই মুখে একুশে ফেব্রুয়ারির গান।
এমন মেয়ে নেই, যে মেয়ে ভিড় পার হয়ে মেলায় ঢুকেছে অথচ তাঁর নারী অঙ্গে কারও অসৎ থাবা পড়েনি। আমি অনেক মেয়েকে ভিড়ের ভয়ে ফিরে যেতে দেখেছি, তারা ফিরে যায় কারণ জানে নিগ্রহের প্রকৃতি ওখানে কি রকম। যারা ভিড় পেরিয়ে যায়, তারা কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, কেউ লজ্জায় নত হয়, যেন সমস্ত গ্লানি তারই যেন নারী অঙ্গ ধারণের পাপ তার, যেন নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই হয়, একুশের চেতনায় উদ্দীপিত পুরুষ এভাবেই সহযাত্রী নারীকে স্বাগত জানায়।
বেশ কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হচ্ছে, ব্যাপারটিকে কেউ তেমন আমল দেয়নি। একটি মেয়েকে যদি প্রতিরোধ এবং প্রতিঘাতের দায়িত্ব দেওয়া হয় তবু কোনও মীমাংসা হয় না কারণ প্রথমত ভিড়ের মধ্যে চিহ্নিত করা যায় না প্রতিপক্ষ কে এবং এক মেয়ের উপর আক্রমণ হয় কম করে হলেও বিশ থেকে তিরিশ ছেলের। একা কোনও মানুষের পক্ষে এই সংখ্যাধিক্যের আক্রমণ প্রতিহত করবার প্রশ্ন ওঠে না।
যদি একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই বিশেষ দিনটির দায়িত্ব না নিতে পারেন তবে সকল নারী একযোগে ঘোষণা করুক তারা ফেব্রুয়ারির বই মেলায় যাবে না। নিগৃহীত হয়নি বলে যে নারী পিছিয়ে যায়, তাঁর মত দুর্ভাগা আর কে আছে কারণ তাকে নিগ্রহ করবার জন্য সময় এগিয়ে আসছে। যে সমাজে নারীকে সম্মান করবার রীতি নেই, সেই সমাজের সকল দুনীতি আগলে বসে আর যাই হোক, নীতির আশা করা চলে না।
২. বাংলাদেশ টেলিভিশনে রজতজয়ন্তী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অভিনেতা আফজাল হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছেন—আফজাল হোসেন সেই খবর জানেন কি না যে তাঁর জন্য বাংলাদেশের তাবৎ ললনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই অরুচিকর প্রশ্ন শুনে আফজাল হোসেন হেসেছেন, হাসতে হাসতে বলেছেন—ললনাদের দীর্ঘশ্বাস নীরব না হয়ে সরব হলে তাঁর অর্থাৎ আফজালের আশেপাশে একটি ভূমিকম্প ঘটে যেত। নারী নিয়ে এ ধরনের স্থল রসিকতা করা একজন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক, শিল্পের নানা শাখায় যাঁর অবাধ বসবাস, তাকে মানায় না। একজন শিল্পী যদি নারীকে রঙ্গরস করবার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন, নারীকে যদি সেই শিল্পী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করতে না জানেন তবে তাঁর শিল্পের প্রতি, তাঁর শিল্পীতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতি আমি আশংকা প্রকাশ করি।
১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না
কাপড় ব্যবহার করেন। অনেকটা ওড়নার মত, কিন্তু ওড়না নয়। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি, এই বস্ত্রখণ্ডটি বোরখার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরে এই বস্ত্রখণ্ডটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলে এটিকে ‘শহুরে বোরখা’ বলা যায়; এখনও গ্রামাঞ্চলে, আপাদমস্তক আবৃত করা বোরখার প্রচলনই বেশি।
এই কাপড়টি দিয়ে শরীরের যে যে অংশ আবৃত করা যায়, তা শাড়ির আঁচল দিয়েই করা সম্ভব, সুতরাং এটি বাড়তি একটি প্রলেপ ছাড়া কিছু নয়। আর যে কোনও বাড়তি বস্তুই বিলাসিতার নামান্তর। যে দেশের অধিকাংশ নারীই বস্ত্রহীনতায় ভোগে, সে দেশে কাপড়ের ওপর কাপড় পরিধান দৃষ্টিকটু তো ঠেকেই, বৈষম্যের ব্যবস্থাগুলোও আরও বেশি প্রকট হয়।
ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্র—কোনও দিক থেকেই নারী তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। মানুষ হিসেবে পুরুষ ও নারীতে অসাম্য ও বিভেদ সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে ধর্ম। সুরা আহজাবে লেখা—‘হে নারীগণ, তোমরা তোমাদের গৃহসমূহে অবস্থান কর এবং সজ্জিত হয়ে গৃহের বাইরে যেয়ে নিজেদের সৌন্দর্য ও বেশভূষা পর-পুরুষকে প্রদর্শন করবে না—যেমন অন্ধকার যুগের নারীগণ প্রদর্শন করত।‘
ঘরের বাইরে বের হওয়ার অর্থ পর-পুরুষকে সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রদর্শন করা নয়। যে বস্তু ঢেকে রাখা হয়, সেই বস্তুর প্রতি আকর্ষণ তীব্র হয়—এই সত্যটি মানুষের জীবনে বিভিন্নভাবে পরীক্ষিত।
যে জিনিস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, সেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি, অদৃশ্য ও আবৃত বস্তুর প্রতি, গুপ্ত ও গোপন সত্যের প্রতি মানুষের দুনিবার আকর্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে এ যাবৎ কোন ধর্ম পারেনি। মানুষ উন্মোচন করে, উন্মুক্ত করে মৃত্তিকা, জল, আকাশ ও মানুষ। মানুষের প্রকৃতিই এই মানুষ ক্রমশ গভীরে ও গহনে প্রবেশ করে। মানুষের প্রকৃতিই এই মানুষ যে কোনও বন্ধন এবং আচ্ছাদন থেকে ক্রমশ মুক্ত হয়।
সৌন্দর্য শুধু নারী-শরীরে নয়, পুরুষ-শরীরেও থাকে; বেশভূষা নারীর চেয়ে পুরুষের কম নয়। তবে আবৃত করবার দায় কেবল নারীর একার কেন ? পুরুষের সৌন্দর্য ও বেশভূষার প্রতিও নারীর দৃষ্টি যায় (বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ পুরুষ এবং নারীর শারীর-বিজ্ঞান মতে সমান)। নিজেকে আড়াল করা তবে পুরুষের জন্যও বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। মানুষের হিংস্রতার কারণে মানুষ যখন মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে, তখনই সেই যুগকে নিদ্বিধায় বলা যায় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার কেটে গেলে মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। পুরুষ ও নারীর সহাবস্থানে জীবন হয়ে ওঠে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিপূর্ণ। তখন পুরুষের যেমন সর্বাঙ্গ আচ্ছাদনের প্রয়োজন হয় না, নারীরও নয়।
আরব দেশের বর্বরতার যুগ এখন নেই। অন্ধকার কেটে গেছে। বিজ্ঞানের আলোকিত যুগে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার শীর্ষে মানুষকে এখন অযথা আচ্ছাদিত হওয়া উচিত নয়। আচ্ছাদনের অর্থই শরীর নিয়ে ব্যস্ত হওয়া, সচেতন হওয়া, সতর্ক করা, শরীরকে লোভনীয় করা। শরীরের চেয়ে এখন কাজকর্ম বড়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে ব্যক্তিত্বই প্রধান।
পর-পুরুষের যদি কু-প্রবৃত্তি থাকে, তবে পর্দাপ্রথা দিয়ে সেই কু-প্রবৃত্তি সংবরণ করা যায় না। প্রবৃত্তি উত্তরণের জন্য অন্য কোনও প্রথার প্রয়োজন। পর্দা প্রথায় পৃথিবীর কোথাও নারী-হরণ, নারী-ধর্ষণ, নারী-হত্যা রোধ হয়নি। পুরুষের যৌন-উন্মাদনার সকল দায়-দায়িত্ব নারীকে বহন করতে হবে, নারীর শরীরে ধারণ করতে হবে ধর্মীয় বস্ত্রাদি, তা মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্ট কোনও আধুনিক ব্যবস্থা নয়।
তিরমিজি হদিস শরীফে লেখা—স্ত্রীলোক গোপনীয় বস্তু, যখন সে পর্দার বাহির হয়, শয়তান তাহাকে পুরুষের চক্ষে মনোমুগ্ধকর করিয়া দেখায়।‘
স্ত্রীলোক মানুষ। পুরুষ যেমন মানুষ, স্ত্রীলোকও মানুষ। স্ত্রীলোক যদি মনোমুগ্ধকর হয়, তাকে মনোমুগ্ধকর দেখানোর জন্য শয়তানের প্রয়োজন হয় না। পুরুষের চরিত্রে যদি দোষ থাকে, স্ত্রীলোকের পর্দা থাকুক বা না থাকুক—সে স্ত্রীলোককে আক্রমণ করে। দোষ এখানে পুরুষের, শয়তানের নয়। অভিযুক্ত পুরুষের কোনও অধিকার নেই নারীর পর্দাহীনতার দোহাই দেবার।
মানুষ শিক্ষিত না হলে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সংস্কার না হলে কুচক্ৰী মৌলবাদরা ধর্মের নামে মানুষকে কেবল পেছনে ঠেলবে, সামনে নয়। মানুষ সভ্য হয়েছে, বস্ত্র ব্যবহার করছে। এই বস্ত্রের ভাল এবং মন্দ দুরকম ব্যবহার হয়। অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় কোনও ব্যবহারই মঙ্গলজনক নয়। একদিকে বাড়লে আরেকদিকে কমে। একদিকে যদি বস্ত্রাধিক্য, অন্যদিকে বস্ত্রহীনতা। একদিকে যদি অঢেল খাদ্য, অন্যদিকে ক্ষুধা। একদিকে সুরম্য অট্টালিকা, অন্যদিকে বস্তি, উদ্বাস্তুর প্লাটফরম, ফুটপাত।
বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে কারণ ধর্মে বৈষম্য আছে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই বৈষম্যের বিপরীত কোনও কথা বলে না। অন্যায়ের গোড়ায় জল ঢাললে অন্যায়ের কোনও শক্তি নেই মরে যাবার।
১৬. বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন
আমি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী, এমন কোনও বয়স নয় যে মাঠে খেলতে যাব না, এমন কোনও বয়স নয় যে মেয়েদের আড্ডায়–অধিকাংশ সময় যেখানে সমবয়সী ছেলেছোকরা নিয়ে নানা আবেগ ও অনুভূতির গল্প হয় সেখানে যোগ দিয়ে আমিও টেবিল চাপড়ে হেসে উঠব না। সেই বয়সে আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিভার দশ দিক নিয়ে বয়সের চেয়ে গম্ভীর আলোচনায় ডুবে যেতাম, সেই সহপাঠীর নাম আমি বলব না, কেন বলব না তা এই রচনার শেষে বলব। তখন, আমার যদি রবীন্দ্রনাথ শেষ হয় তার হয় শেক্সপিয়র, ফরাসি চিত্রকলা নিয়ে কোনওদিন, কোনওদিন জার্মান চলচ্চিত্র, কোনওদিন রুশ সাহিত্য, বিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তি। পাঠ্য বইয়ের নিচে রেখে লুকিয়ে পড়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যা পল সাত্রে। বাবার পায়ের শব্দ শুনে রসায়নবিদ্যা বইয়ের পাতা নেড়েছি দ্রুত। মেয়েটি আমার ঘরে প্রায়ই আসত, অঙ্ক করবার নাম করে সারা বিকেল মুখস্থ করতাম সুধীন দত্ত, টি.এস. এলিয়ট।
মেয়েটি স্কুল শেষ করে অধ্যাপক বাবার বদলির কারণে আরেক শহরে চলে গেল কলেজে ভর্তি হতে। সেই থেকে দীর্ঘ বছর একা ছিলাম। খবর পাই, কলেজ পাস করে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। মেয়েটির এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, পরিশীলিত রুচি, মেধা ও মননের অগাধ সৌন্দর্য—আমি যে এত মেয়ে দেখেছি, এমন দেখিনি। একদিন এও খবর পাই, মেয়েটি বিয়ে করেছে। মনে মনে আমি ওই প্রেমিক পুরুষটির সৌভাগ্যকে ঈর্ষা না করে পারি না, যে ওই মেয়েটির জীবনের এত নিকটে এসেছে—যে নিকট থেকে তাকে সম্পূর্ণ দেখা যায়।
একাডেমিক পরীক্ষার পাট চুকেছে, ঘরের শাসন কিছু কমেছে তখন, বাবা-মা দুহাতে আমন আগলে রাখে না। তাই একদিন মেয়েটির সুখ দেখব বলে যাই এক শহর পেরিয়ে আরেক শহরে, তার ঘরে। ঘর বলতে একটি পাকা মেঝে, চারপাশে দেয়াল, ওপরে টিনের চাল। একটি বিছানা, একটি টেবিল, মেঝেয় কিছু থালাবাসন—এসব দেখবার আগে আমি মেয়েটিকে দেখি। তার গায়ের ফর্সা রং ময়লা হল কি না, তার ডাগর চোখের নিচে কালি পড়ল কি না, চুলে তার অযত্নের জট লাগল কি না, তার শরীরের অলঙ্কার এবং শাড়ি সস্তা ও মলিন কি না সেটি আমার দেখবার বিষয় নয়, অথবা একটি সচ্ছল পরিবার থেকে এসে তার এমন অসচ্ছল জীবনযাপন নিয়ে আমি সামান্য দুঃখিত নই। আমার দৃষ্টি যায় টেবিলের দিকে, দুটো মোমবাতি, একটি পানির জগ, আর একটি বাংলাদেশের ডায়রি ছাড়া কিছু নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনা করিস না ?
সময় পাই না।
সময় পাই না কথাটি এমন শোনাল যে সময় না পাওয়ার জন্য তার কোনও আক্ষেপ নেই। আর সময় পেলেই সে ওই কাজটি করবে কি না এ ব্যাপারে মনে হয় তারও সন্দেহ আছে।
ছেলেটি কী করে ?
একটা দোকান নেওয়ার চেষ্টা করছে।
দোকানে কী বিক্রি হবে ?
ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি।
মেয়েটি চায়ের পানি দিল চুলোয়। আমি কিছুতেই কৈশোরের সেই মেধাবী মেয়েটিকে মেলাতে পারি না, মেয়েটি গল্প করে পাশের গলিতে আর একটি ভাল বাড়ি দেখেছে—সেই বাড়ি এবং ভাড়ার গল্প, গল্প করে কোনও এক শুক্রবারে সে নিউমার্কেট যাবে, বেশ কিছু কাচের বাসনপত্র কিনবে।
মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন দেখে আমি ফিরে আসি। আসবার আগে একবার ভেবেছি জিজ্ঞেস করব—তোর রবীন্দ্রনাথ মনে আছে ? জীবনানন্দ দাশ ? জিজ্ঞেস করি না। এই লজ্জায় জিজ্ঞেস করি না যদি সে বলে এসব কবেকার কথা মনে নেই, মনে নেই। এই মনে নেই-এর জন্য তার স্বরে যদি কোন কষ্ট না থাকে, এই ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করি না।
এর পর বছর গেছে, খবর পাই তার স্বামী ছেলেটি—যে ছেলেটি একটি ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির দোকান দেবে বলেছে, রাতে মদ খেয়ে এসে মেয়েটিকে পেটায়। মেয়েটির শরীরে কারও চড়, কারও লাথি এসে পড়ছে—আমি টের পাই মেয়েটি কাঁদছে, মাতাল স্বামীর বমি পরিষ্কার করছে আর কিছু থাল-বাসনের স্বপ্ন দেখছে।
একদিন এও খবর পাই, মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি একটি বিয়ে করেছে। এসবের কোনও কারণ নেই, এসব হল জীবন নিয়ে মজা করা। ছেলেটি মজা চায়, মজা করে। আমার ছেলেবেলার এই বন্ধুটি সমস্ত প্রতিভা ও বৈভব বিসর্জন দিয়ে একটি সংসার চেয়েছিল, পায়নি। আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় দেয়, নির্ভরতা দেয় না। আত্মীয়-স্বজন সাত্বনা দেয়, বুকের উত্তাপ দেয় না, আত্মীয়-স্বজন সমাজের কথা বলে, সংসার, সন্তান ও ভবিষ্যতের কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে না, মেধা ও প্রতিভা সম্পর্কিত কোনও কথা উচ্চারণ করে না কারণ আমাদের সমাজে শিল্প-সাহিত্য দিয়ে মেয়েদের প্রতিভা বিচার হয় না। ঘরদের পরিষ্কার করা, নিয়মিত কাপড় কাচা, আলনা গোছানো, রান্নায় মসলার পরিমাণ ঠিক হওয়ায় যে সাংসারিক প্রতিভা লক্ষ্য করা যায়, লোকে সেটিকেই মেয়েদের প্রতিভা বিবেচনা করে।
এর মধ্যে মেয়েটি চাকরি নিয়েছে। ভাল চেয়ার, ভাল বেতন কিন্তু স্বস্তি নেই। অফিসের লোকেরা মেয়েটির অতীত নিয়ে চমকপ্রদ সব গল্প তৈরি করে। সে কারও অনিষ্ট করছে না কিন্তু সকলে তাকে নিয়ে মজা করছে, এই মজা একদিন লোকেরা প্রকাশ্যে করে। একা একটি মেয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করলে সমাজের ভাল মানুষগুলো বেশ আশ্কারা পায়। তারা ছুঁতো খোঁজে কিছু না কিছু অঘটন ঘটিয়ে আনন্দ নেবার। এদেশে নির্মল আনন্দের এত অভাব, মানুষ কেবল আনন্দ খোঁজে, বিকৃত আনন্দ।
শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আবার বিয়ে করল বলব না, বিয়ে করতে বাধ্য হল। লোকটির বউবাচ্চা আছে এক অফিসের কেরানি। একটি ঘর ভাড়া করে মেয়েটিকে তুলেছে। সপ্তাহে তিন দিন কাটায় এখানে, বাদবাকি দিন প্রথম সংসারে। লোকটি সকালবেলা গরম ভাত খেয়ে মাথায় সর্ষের তল মেখে অফিসে যায়, বাইরে চা-পান শেষ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে, রাতের খাবারের পর ঘন্টাখানেক ঝাটার কাঠি দিয়ে দাঁতের ফাঁকে ঢুকে থাকা মাছ-মাংস বের করে, তারপর বউ নিয়ে শুতে যায় বিছানায়।
পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে যে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে, পরীক্ষায় ভাল ফল দেখে শিক্ষকেরা যে মেয়েটিকে উচ্চ শিক্ষার কথা বলত, সেই মেধাবী মেয়েটি—যে আমার বোধ এবং বিশ্বাসকে সমৃদ্ধ করেছে, সেই মেয়েটির, আমি জানি, এই বিয়ের পর সমাজ তাকে দুয়ো দেয় না, পঁড়শিরা বাকা চোখে তাকায় না, নিন্দুকেরা ফোড়ন কাটে না। যেন একটি আবর্জনা সদর রাস্তা থেকে এখন ডাস্টবিনে গেছে, সকলে তাই শান্ত হয়েছে।
এরপর আমি আর ইচ্ছে করেই মেয়েটির খোঁজ রাখিনি। সেদিন রাস্তায় বড় চেনা চেনা লাগে একটি মেয়েকে দেখে আমি দাঁড়াই। মেয়েটির নির্লিপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আবিষ্কার করি অন্য এক চোখ, এই চোখ চেনে মানুষের ভেতরের সব কদাকার মানুষ। শরীর নিয়ে ওর আড়ষ্টতা দেখে আমি বুঝতে পারি শরীরে সে সন্তান বহন করছে। জিজ্ঞেস করি—চাকরিটা করছিস তো ?
না।
আমি তখন বুঝতে পারি একটি কেরানির ঘরে কর্মকতার ব্যক্তিত্ব বড় বেমানান লাগে বলে গৃহকতার আদেশ এবং সামাজিক কটাক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের চাকরি ছেড়ে দাম্পত্য জীবনকে মেয়েটি মানানসই করেছে।
আমার একবার ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি তোর যোগ্য কি এই দেশে কেউ ছিল না ? আসলে ছিল, ছিল না কে বলে, তারা এসেছে, চমৎকার সব ভালবাসার কথা বলেছে, কিন্তু কেউ বিয়ের কথা বলেনি। সংসার-ভাঙা একটি মেয়ে নিয়ে সারাদিন আড্ডা দেওয়া যায়, রেস্তোরায় চা-পান করা যায়, সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে বিকেল-সন্ধ্যা পার করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করলে যেন কেমন এঁটো এঁটো লাগে, তার চেয়ে শিক্ষা নেই, রুচিফুচির বালাই নেই এমন এক কুমারী কন্যা এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারলেই লোকে বাহবা দেয়। যোগ্য ছেলে নিয়ে তাই আমি আর প্রশ্ন করি না।
মেয়েটি তার স্ফীত শরীরের লজ্জায় দ্রুত চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার আবারও বড় এক লাগে।
শুরুতে মেয়েটির নাম আমি বলতে চাইনি, কেন বলতে চাইনি তা বলব বলেছি। বলতে চাইনি কারণ মেয়েটির নাম দিলরুবা, শাহানা, দিলারা, সুলতানা, নমিতা, পারভিন, মারিয়া, শ্যামলী, চন্দনা, ফরিদী, শিপ্রা, অর্চনা কী না হতে পারে ?
মেয়েটিকে তাই কোনও নামে ডাকতে ইচ্ছে করেনি কারণ জুলেখা, সুফিয়া, মার্গারেট, আয়শা, হাসিনা, মমতা ও নাসিমা থেকে মেয়েটিকে আমি পৃথক দেখিনি।
» ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১. বস্তির মেয়ে। বয়স, বয়সের চেয়ে বেশি মনে হয়। কী কারণে আমি জানি না, দ্বিগুণ বয়সের একটি লোক মেয়েটিকে প্রথম হ্যাঁচকা টান দিল। তারপরই দিল ঘাড় ধরে ধাক্কা, মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘরের বেড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে দুটো লাথি । চুলের মুঠি ধরে মেয়েটিকে এরপর ঘরে নিয়ে গেল লোকটি, তার স্বামী।
ঘটনাটি দেখে আমি বিস্মিত হইনি। হইনি, কারণ আমিও, আমি একজন চিকিৎসক, দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, আমিও কি এভাবে অত্যাচারিত হই না? আমারও ঘাড় ধরে ধাক্কা দেওয়া হয়, আমিও উপুড় হয়ে পড়ি দেয়ালে, আমারও কপাল ফেটে রক্ত বেরোয়। সরকারী কাগজপত্রে আমি একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা, তাতে কী, আমি তো মেয়ে।
বস্তির ওই মেয়েটির জন্য এবং একইভাবে আমার জন্যও বিবাহ আইন একই রকম। মেয়েটির স্বামী যেমন ইচ্ছে করলেই বলতে পারে তালাক তালাক তালাক, আমার স্বামীও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার স্বামীও এক এক করে এক ঘরে চার বউ তোলার ধর্মীয় আহ্লাদ দেখাতে পারে।
আমি পারি না। বস্তির মেয়েটি যেমন কেবল একবেলা ভাত আর বছরে গা ঢাকার দুটো কাপড়ের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, সন্তানকে কেঁচো-কেন্নোর মত বড় হতে দেয়, আমিই বা এর চেয়ে আলাদা কিসে? আমার আছে সমাজের লজ্জা, আছে মধ্যবিত্ত সংস্কার। আমিও দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকি সংসার নামক কিছু থাল-বাসন আর খাট-আলনার মধ্যে।
বস্তির ওই মেয়েটির ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমিও বেদনায় নীল হই, আমার কোমরেও এসে পড়ে পুরুষ তৈরি আইনের লাথি। বিত্তবান কোনও মেয়ে এবং বস্তির এই মেয়েটির মধ্যে, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই।
স্বামী অর্থ প্রভু। যে কোনও শ্রেণীর মেয়ের জন্য স্বামী তার প্রভু। সে তার অর্ধাঙ্গিনী হলেও স্বামী তার অর্ধাঙ্গ নয়। অভিধানে ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘সহধর্মিণী’ শব্দগুলোর কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। ইংল্যান্ডের একজন বুদ্ধিজীবী জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) তাঁর দি সাবজেকশান অভ ওম্যান (১৮৬৯) গ্রন্থে লিখেছেন–‘আজকের দিনে বিবাহই হল একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে আইনত দাসপ্রথা বজায় আছে। আমাদের বিবাহ-আইনের মাধ্যমে পুরুষেরা লাভ করে একটি মানুষের উপর সর্বময় অধিকার। লাভ করে প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, লাভ করে তালাক ও বহু বিবাহের অবাধ অশ্লীলতা।‘
২ পিতৃকুলে জন্ম নিয়ে শ্বশুরকুলে যার জীবনযাপন, উত্তরাধিকার প্রশ্নে তারা যদি সম্পত্তির ভাগ পায় তবে উভয়দিকের অংশ পেয়ে তাদের প্রাপ্য যদি আবার বেশি হয়ে পড়ে তাই আপত্তি ওঠে। দুই স্থানে তাদের দাবি বলে কোনও দাবিই আর কোনও কুলে টেকে না। প্রবাদ আছে ধোপার যে কুকুর, সে না-ঘাটের, না-ঘরের।
মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৬.৪) বলে—‘কন্যা জন্মিলে সবাই তুচ্ছ করে, সে ফেলনা। পুত্র তো ফেলনা নহে, তাই কন্যা উত্তরাধিকার পায় না, পুত্র পায়। কন্যা পরের ঘরে যায়, তাই সে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর।‘
তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬.৫.৮.২৭) আছে—‘নারীদের দ্বারা গৃহ্যমান হইতেছে ইহা সোম সহ্য করিতে পারিল না। তাই ঘৃতকে বজ্র করিয়া মারিল। যখন তাহা শক্তিহীন হইল তখন তাহারা গ্রহণ করিল। তাই নারীগণ নিরিন্দ্রিয় অর্থাৎ শক্তিহীনা, তাহারা নিচ-পুরুষ হইতেও নিচ, এজন্যই তাহারা আদায়াদী অর্থাৎ দায়প্রাপ্তির অযোগ্য।’
আচার্যদের মতে—‘কন্যাকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে, পুত্রকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে না, তাই পুরুষ দায়াদ, স্ত্রীলোক দায়াদ নহে।‘
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ (যা ধর্মীয় বিধানের ওপর ভিত্তি করে রচিত) অনুযায়ী একটি মেয়ে পৈতৃক সম্পত্তির যে অংশ পায় তা একটি ছেলের অর্ধেক। একই পিতা-মাতার সন্তানের মধ্যে যদি আইনের এমন বৈষম্য থাকে, তবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ১/৮ অংশ, সন্তানের সম্পত্তিতে ১/৬ অংশ, পিতার সম্পত্তিতে কন্যা হিসেবে পুত্রের অর্ধেক। যারা বলে মেয়েরা পিতা ও স্বামীর সম্পত্তি দুই-ই পেয়ে গেলে অধিক লাভবান হবে, তারা ভুল বলে। কারণ একটি পরিবারে যদি মা, দুপুত্র ও দু’কন্যা থাকে তবে মা পায় মোট সম্পত্তির ১/৮ অংশ অর্থাৎ ২ আনা (ষোল ভাগের দুভাগ) বাকি ১৪ আনাকে মোট তিন ভাগ করা হয় কারণ দু ভাইয়ের দু ভাগ এবং দু বোন মিলে এক ভাগ। প্রত্যেক ভাই পায় ৪-৬ আনা আর প্রত্যেক বোন পায় ২-৩ আনা, এরপর এক বোন স্বামীর সম্পত্তির ২ আনা পেলেও কোনওভাবেই তার ভাইয়ের সম্পত্তির চেয়ে তা বেশি হয় না।
এদেশে মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ চাওয়া লোকে ভাল চোখে দেখে না। শেষ অব্দি এই দাঁড়ায়—পিতা, স্বামী, পুত্ৰ—কারও সম্পত্তিতেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
পিতার ঘরে চলে স্বামীর সংসারে যাবার নিরলস প্রশিক্ষণ এবং স্বামীর সংসারে স্বামীর মুখের একটি কথা তিনবার উচ্চারিত হলেই ঘর ভেঙে যায়—সেই পিতা এবং স্বামীর ঘর কোনওটিই বিশ্বাসযোগ্য নয়, নিশ্চিত বসবাসযোগ্য নয়। জন্মের পর থেকেই এই ভাসমান জীবনে নারী না পায় সুষম উত্তরাধিকার, না পায় বিবাহ-আইনে সামাজিক সমতা।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান যথেষ্ট হলেও পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করবার প্রধান কারণ—সম্পত্তিতে নারীর অধিকারে বৈষম্য। অধিকার সামান্য যা আছে তা সামাজিক সংস্কারের বাধায় অর্জন করাও দুষ্কর। আর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে নারীর এই সামাজিক অবস্থায় নিজ সম্পত্তি গ্রহণ এবং ব্যবহারের সুযোগ নারী কতটুকু পাবে অথবা আদৌ পাবে কি না—এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ হয়।
১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
১. সত্যজিৎ রায়ের যত ছবি আমি দেখেছি, পথের পাঁচালীর মত ভাল আর কোনওটিই লাগেনি। যদিও সত্যজিৎ রায় বলেন পথের পাঁচালীতে প্রচুর টেকনিক্যাল ক্রটি রয়ে গেছে, পরবর্তী ছবিগুলোয় সে ক্রটি কাটিয়ে উঠেছেন, আমার তবু ভাল লাগে পথের পাঁচালীই। পথের পাঁচালী আমি বারবার দেখি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় ছাড়াও আমার কিছু প্রিয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা, যাদের কাজ আমাকে মুগ্ধ করে, উদ্বেলিত করে, আলোড়িত করে—তারা শ্যাম বেনেগাল, রবীন্দ্র ধর্মরাজ, মোজাফফর, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, গোবিন্দ নিহালিনি, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গিরিশ কাসরভল্লী, আদুর গোপাল কৃষ্ণন ও গিরিশ কারনাড।
শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক অবলম্বনে গিরিশ কারনাড ‘উৎসব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারীকে প্রেমের বাতাবরণে ছাড়া অন্য ভাবে দেখা হয়নি। সে-ও যে একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি, পারিবারিক ভূমিকার বাইরে সে-ও যে একজন নাগরিক, তারও যে নিজস্ব সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন ও ব্যর্থতা বোধ থাকতে পারে সংস্কৃত-সাহিত্যে এই চেতনাই নেই। কিন্তু শূদ্ৰক (যদিও মৃচ্ছকটিকের রচয়িত শূদ্রক কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে) বসন্তসেনার চরিত্রে অন্য এক মাত্রা এনেছেন, সে শুধু প্রেমিকা নয়, সে প্রভু, নাগরিক, গৃহকত্রী ও সখী। অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যে প্রেমিক ছাড়া অন্য পরিচয়েও নারী দেখা দেয়, যেমন গ্রিক নাটকে। অবশ্য একথাও সত্য যে অন্য যে ভূমিকাতেই নারী অবতীর্ণ হোক না কেন সেটিও পুরুষ পরিকল্পিত পূর্বনিরূপিত একটি ছক, তার সীমার মধ্যেই নারীর সঞ্চরণ। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রেমই একমাত্র বাতাবরণ বলে গুপ্তপ্রণয়, দূতী, সংকেতস্থল ও অন্তঃপুরের কুঞ্জ কাননের মধ্যেই তার বিচরণ। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে নারী সত্তার অন্য কিছু দিক স্বীকৃত, শুধু দেহমাত্রসার নায়িকার যান্ত্রিক ভূমিকাতে ভোগ্যবস্তুরূপে সে দেখা দেয়নি।’
গিরিশ কারনাড ‘উৎসব’-এর শেষ দৃশ্যে দেখিয়েছেন নায়িকা বসন্তসেনা আবার তার গণিকা বৃত্তিতে ফিরে যায়, দুশ্চরিত্র সংস্থানক বসন্তসেনার ঘরের দরজায় আছড়ে পড়লে বসন্তসেনা তাকে নিজ ঘরে তুলে নেয়। অথচ ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে রাজা চারুদত্তের সঙ্গে বসন্তসেনার বিয়ের কথা হয়। গিরিশ কারনাড কেন মূল নাটকের এই বিষয়টি পরিবর্তন করলেন জানি না। সম্ভবত এই কারণে যে, কোনও গণিকাকে কোনও রাজার বিয়ে করবার সুসংবাদটির চেয়ে পুরনো গণিকাবৃত্তিতেই তার ফিরে যাওয়া অধিক যৌক্তিক। সাধারণত যা ঘটে, গিরিশ কারনাড তাই করলেন, গণিকা বসন্তসেনাকে সমাজে তুললেন না। কিন্তু যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মৃচ্ছকটিক রচিত, সে সময়ে নগরীর রূপ-গুণ ও ধনবতী বসন্তসেনাকে রাজা চারুদত্তের বিয়ে করা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। প্রখ্যাত নাট্যকার ও চলচ্চিত্র-পরিচালক গিরিশ কারনাড বসন্তসেনার সামাজিক অবস্থার কোনও উন্নতি না ঘটিয়ে সুধীজনের বাহবা পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু আমি মনে করি মূল নাটকের প্রতি গিরিশ কারনাডের বিশ্বস্ত থাকা উচিত ছিল।
২. ঘর করা বলতে বোঝায় গৃহস্থতা করা, সংসারধর্ম করা। এই কমটি পুরুষেরা কখনও করে না। ঘর করে নারী। একটি নারী একটি পুরুষের ঘর করে। কিন্তু একটি পুরুষ কখনও একটি নারীর ঘর করে না।
অথচ পুরুষ নারীর মতই ঘরে খায়-দায়, ঘুমোয়। কিন্তু ঘর করা ব্যাপারটি নারীর জন্য বাঁধা। আমাদের অভিধানে, শব্দ ব্যবহারে নারীকে নিচু করবার প্রবণতা প্রচলিত। বিয়ে বিষয়টি পুরুষ ও নারী দুজনের জীবনেই ঘটে। দুজনই একটি নতুন জীবনে প্রবেশ করে। কিন্তু ঘটনাটিতে দু’জনের জন্য ক্রিয়াপদের ব্যবহার ভিন্ন। মেয়ে বিয়ে বসে, ছেলে বিয়ে করে। অর্থাৎ যে বসে সে নিক্রিয়। যে করে সে কর্তা। তাই গৃহকর্তা শব্দটি পুরুষের। এবং ঘর করা বলতে রান্না করা, ঘর গোছগাছ করা, ঝুল পরিষ্কার করা, সন্তান লালন করা ইত্যাদিকেই বোঝায়। এই কাজগুলো কোনও রকম যুক্তি ছাড়াই নারীর জন্য নির্ধারণ করা, নারী অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর হোক—তবু, নারী জ্ঞানে-বিদ্যায়-ব্যক্তিত্বে পুরুষের চেয়ে অগ্রসর হোক—তবু। এই পৃথিবীতে পুরুষ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু কথা তৈরি করেছে। ওই কথার মধ্যে কিছুর নাম দিয়েছে ‘ধর্ম’, কিছুর নাম ‘আইন।‘
৩. গত ২৮ মার্চ দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি এই–‘মহিলাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত সকল শাড়ির (প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের জন্য) বহর ও দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১.২২ মিটার (৪৮ ইঞ্চি) ও ৫.৫৪ মিটার (৬ গজ) হতে হবে। সকল উৎপাদনকারীকে শাড়ির এই মাপ আগামী ৭ দিনের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। এই আদেশ অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
অর্থাৎ ধরে নিতে হয় এতকাল মহিলাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ ছিল না। তাই শাড়ির বহর ও দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে সেই মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখতে হবে। একটি মহিলা কি মাপের, কি ছাপের শাড়ি পরবে তা তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন, রুচি ও আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। এখানে সরকারের গজ ফিতে নিয়ে ধর্মের নামে বহর মেপে দেওয়া অশোভন তো বটেই, অবৈধও। উৎপাদনকারী বিভিন্ন মাপের শাড়ি তৈরি করেন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। আমি নিজে বারো হাত শাড়ি ছাড়া পরতে পারি না, তাই বলে আমি কোনও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বারো হাত শাড়ি পরি না, এ আমার নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার। একইভাবে গ্রামের এবং শহরের অসচ্ছল পরিবারের যে মেয়েরা ঘরে বাইরে পরিশ্রম করছে এক প্যাঁচে শাড়ি পরে—তাদের জন্য বারো হাত শাড়ি মোটেও স্বস্তিদায়ক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। তারা দশ হাত শাড়িতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এই দরিদ্র দেশের অধিকাংশ নারী একটি শাড়িকে তিন টুকরো করে ব্যবহার করে। কেউ ভিজে শাড়ি গায়ে শুকোয়, কেউ বাড়ি বাড়ি ন্যাকড়া ভিক্ষে করে লজ্জা ঢাকবার জন্য, তাদের কাছে শাড়ির ৪৫ ইঞ্চি ও ৪৮ ইঞ্চি বহরের মধ্যে, ৫ মিটার ও ৫.৫৪ মিটারের মধ্যে পার্থক্য কী ?
সরকার শেষ পর্যন্ত ধর্মকে মেয়েদের শাড়ির দৈর্ঘ্য ও বহরের মধ্যে এনে নামিয়েছে। এবং সরকারই ধর্মকে এভাবে সবচেয়ে বেশি অপদস্থ করছে।
১৯. হুদুদ-কিয়াস সমাচার
পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র আছে। পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমা, আয়তন, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, জনসংখ্যা, জলবায়ু, আমার বিষয় নয়—আমার বিষয় সরকার মনোনীত কিছু আইন ও অধ্যাদেশ। যে আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় অমর্যাদা পেয়েছে।
১৯৭৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে হুদুদ অধ্যাদেশের প্রবর্তন হয়, যে অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয় চুরি, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, ধর্ষণ ও মিথ্যা সাক্ষ্য। প্রচলিত ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী ব্যভিচার মানুষের ব্যক্তিগত অপরাধ, অথচ এই অধ্যাদেশের ফলে ব্যভিচারকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যভিচার, বিবাহপূর্ব যৌনাপরাধ, ধর্ষণ ও বেশ্যাবৃত্তিকে ‘জেনা’ বলা হয়। অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক নেই এমন দু’জন নর-নারীর মধ্যে যৌন মিলন ঘটলেই জেনা সংঘটিত হয়। ব্যভিচার ও বিবাহপূর্ব যৌনাপরাধের মধ্যে এই অধ্যাদেশ কোনও পার্থক্য করে না।
জেনার সর্বোচ্চ শাস্তি ‘হদ’। যা বিবাহিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পাথর মেরে মৃত্যু এবং অবিবাহিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে একশ বেত্ৰাঘাত। হদের জন্য প্রয়োজন চারজন পুরুষ মুসলমানের সাক্ষ্য। নারী বা অমুসলমানের সাক্ষ্য দ্বারা হদের শাস্তি দেওয়া যায় না। ধর্ষণকারীকে শাস্তি দেবার জন্য চারজন পুরুষ মুসলমাদের সাক্ষ্য প্রমাণের বিধান রাখবার অর্থ—অপরাধীকে রক্ষা করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করা।
এটা খুবই অস্বাভাবিক যে, কোনও পুরুষ চারজন পুরুষের সামনে ধর্ষণ করে এবং তারা সাক্ষ্য দেয়। চারজন নারীর সামনে একজন নারীকে ধর্ষণ করবার ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু নারী সাক্ষ্য দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি হদ প্রযোজ্য হয় না। এবং আইনের বিধান অনুযায়ী ধর্ষণকারী রক্ষা পায়।
নারী গর্ভধারণ করলে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। অথচ যে পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চার হয় সে রেহাই পেয়ে যায়। জারজ সন্তান জন্ম দেবার জন্য অনেক নারীকে বেত্ৰাঘাত, জেল ও জরিমানার শাস্তি দেওয়া হয় কিন্তু কোনও পুরুষ জারজের জন্মদাতা হবার অপরাধে শাস্তি পায় না। কারণ গর্ভধারণের মত জলজ্যান্ত প্রমাণ তাদের থাকে না।
এই হুদুদ অধ্যাদেশ ব্যভিচার ও ধর্ষণের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ফলে কোনও নারী নিজের উদ্যোগে ধর্ষণের অভিযোগ করলে নারী নিজে ব্যভিচারের শাস্তি ভোগ করে। আর ধর্ষণকারী সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে মুক্তি লাভ করে।
পাকিস্তানের ইসলাম মতাদর্শ পরিষদ ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে কিসাস ও দিয়াত আইনের খসড়া প্রস্তুত করে। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত হত্যা, শারীরিক ক্ষতি ও গর্ভপাতের সকল দিক এ আইনের আওতাধীন।
আইনের ২৫(বি) অনুচ্ছেদে বলা হয় কাতেল-ই-খাতা (অনিচ্ছাকৃত খুন) অপরাধের শিকারী নারী হলে দিয়াতের শাস্তি হবে একজন পুরুষ হলে যা হত তার অর্ধেক। একইভাবে শারীরিক ক্ষতির জন্য সব রকম ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে একজন ক্ষতিগ্রস্ত অথবা পঙ্গু নারী পাবে একই রকম ক্ষতির জন্য একজন পুরুষ যা পাবে তার অর্ধেক। অন্যদিকে কোনও নারী খুন বা শারীরিক ক্ষতির অপরাধে অপরাধী হলে তার শাস্তি একজন পুরুষের সমানই হবে।
আইনের চোখে একজন শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম নারী একজন অশিক্ষিত ও উপার্জন অক্ষম পুরুষের চেয়ে কম মূল্যবান।
কিসাস এই আইনের আরেকটি অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের ১০ ধারায় কিসাসের শাস্তির জন্য খুনের প্রমাণে দুজন পুরুষ মুসলমানের সাক্ষ্য দরকার হয়। তাজির বা কম শাস্তির জন্য নারী সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়। এই আইনের আওতায় নারীর সামনে খুন হলে খুনীর শাস্তি হয় না। কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তি অমুসলমান না হলে কোনও অমুসলমানের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা যায় না। এভাবে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য কোনও নারী বা অমুসলমান-সাক্ষ্যই অগ্রাহ্য করা হয়। এই আইনের ৯৬ এবং ৯৭ ধারায় যে কোনও অবস্থায় (ইসকত-ই-হামাল) গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় যার শাস্তি সাত বছরের জেল। যে গর্ভপাত ঘটায় এবং যার গর্ভপাত ঘটানো হয় দু’জনকেই শাস্তি পেতে হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রচলিত কঠোর আইনও কোনও মেয়ের শারীরিক বিপদের আশঙ্কা থাকলে গর্ভপাত ঘটানো সমর্থন করে। কিন্তু পাকিস্তানের এই কিসাস আইন তা করে না। এই আইন কোনও ধর্ষণের শিকারকেও রেহাই দেয় না।
১৯৮৪ সালের ৩ জুন জারি হয় আরও একটি অধ্যাদেশ। দক্ষিণ পাঞ্জাবে নওয়াবপুর শহরের একটি ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে অপরাধ অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশের প্রবর্তন হয়। নওয়াবপুরের এক জমিদার তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবার অপরাধে এক মিস্ত্রিকে তার বাড়িতেই পিটিয়ে হত্যা করে। মিস্ত্রির বাড়িতে মিস্ত্রি হত্যার সাক্ষী যে নারীরা ছিল তাদের উলঙ্গ করে বাড়ির বাইরে নেওয়া হয়, এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় মার্চ করতে বাধ্য করা হয়।
জমিদারের এই হিংস্রতার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ নারী সংস্থা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে। এই আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর অপরাধ অধ্যাদেশ জারি হয়। অধ্যাদেশে বলা হয় একজন নারীকে আঘাত করা অথবা তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা, তাকে উলঙ্গ করা এবং ঐ অবস্থায় তাকে জনসমক্ষে আনবার জন্য শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে নারীকে ঘরের ভেতর পেটালে, উলঙ্গ করলে, ধর্ষণ করলে এবং হত্যা করলে এ অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না অর্থাৎ শুধু প্রকাশ্যের বেলায় প্রযোজ্য হবে।
১৯৮৩ সালের ১০ জুন জেনারেল জিয়া কর্তৃক আনসারী কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের রিপোর্ট মতে রাষ্ট্রপ্রধানের অফিসকে নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয় যে একজন পুরুষের আমীর হওয়া উচিত। কমিশনের মতে নারী আমীর অনৈসলামিক।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২নং অনুচ্ছেদ মজলিস-ই-সুরার (নির্বাচিত পরিষদ) নারীদের সদস্যপদ সম্পর্কিত। ওতে বলা হয়েছে সুরার সকল পুরুষের যে যোগ্যতার প্রয়োজন, সকল নারীর জন্য সেইসব আবশ্যকীয় যোগ্যতা ছাড়াও অতিরিক্ত শর্ত হচ্ছে ৫০ বছরের কম বয়স হলে চলবে না এবং স্বামী জীবিত থাকলে স্ত্রীর সদস্যপদের জন্য স্বামীর লিখিত অনুমতি লাগবে। এসব শর্ত পূরণের পর নারী যে কোনও সাধারণ আসনে নির্বাচন করবার যোগ্য বলে গণ্য করা হবে। এই কমিশনের উদ্দেশ্য নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবার অধিকারকে অস্বীকার করা এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক করা।
পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র এইসব আইন ও অধ্যাদেশ নিয়ে ভূমণ্ডলে টিকে আছে। আমরা শুনছি, আমরা দেখছি, আমরা ঘৃণায় থুতু ফেলছি—তাতে কার কী আসে যায়। যারা আইন বানায়, অধ্যাদেশ তৈরি করে তারা এত উঁচুতে বসে থাকে যে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের তোয়াক্কা করে না।
২০. একা হলেও মেয়েরা অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে
আমি খুব ভাল করেই জানি মানুষ আসলে খুব একা। সে একটি দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পড়শি এবং ঘর নিয়ে দলবদ্ধ বেঁচে থাকবার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কারণ সে ভয় পায়। জাগতিক সমস্ত কিছুকে ভয় পায় বলে পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের কোমর আঁকড়ে থাকে, আঁকড়ে রাখে সন্তানের হাত। ভয় দলছুট হওয়ার। ভয় একা হওয়ার। খুব গোপনে গোপনে মানুষ বড় একা, তাই আর এক হতে চায় না।
আমার যখন দশ বছর বয়স, ডান হাতে একটি সন্ধিবেত আর বাম হাতে একটি ইংরেজি গ্রামার বই নিয়ে আমার বাবা আমাকে রোজ রাতে পড়াতে বসতেন। বাবা খুব যত্ন করে টেনস্ শেখাতেন। বুঝতে সামান্য দেরি হলেই পিঠে পড়ত সপাং সপাং বেত। রাতে বিছানায় শুয়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কাঁদতাম। বাবাকে কত রকম অভিশাপ দিতাম। এখন মাঝে মধ্যেই আমার সেই পিঠে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে, সেই সন্ধিবেতের মুছে যাওয়া দাগে স্পর্শ রেখে স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে আশীর্বাদের। ছোটবেলায় ওই ভয়ঙ্কর এক একটি বেতের আঘাতে কী ভীষণ ভালবাসা ছিল আমি তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। ঘরে বাইরে আমার বাবার খুব দাপট ছিল। দিনে অন্তত বত্রিশবার বাবা আমাদের বলতেন ‘ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ’, ভোরবেলায় সে গ্রীষ্ম হোক, কনকনে শীত হোক, ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে জুতোর মচ্মচ্ শব্দ তুলে বেরিয়ে যেতেন, ফেরার সঠিক কোনও সময় ছিল না। কোনওদিন দুপুরে হয়ত এক হাঁটু ধুলো মেখে উঠোনের মাটিতে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলছি, বাবা হঠাৎ এসে জুতোর তলায় এক্কা দোক্কার দাগ মুছে খেলা ভেঙে দিতেন, কোনওদিন রান্নাঘরে মা’র পাশে গিয়ে বসলে বাবা ধমকে তুলে আনতেন, মা যদি বলতেন—বসে যদি রান্নাটা শেখে, শিখুক। বাবা চোখমুখ লাল করে বলতেন—ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনও কিছু—খেলা, ঘুম, আড্ডা কিংবা বেড়ানোর অনুমতি আমাদের ছিল না। নাওয়া এবং খাওয়া ছাড়া বাদবাকি সময় লেখাপড়ার, পায়খানা প্রস্রাবের জন্যও বাবা খুব অল্প সময় ব্যয় করতে বলতেন। রাতের বেলাটা ছিল বাবার নিজস্ব নিয়মে গড়া, নিজের তোশকের নিচে যত্ন করে রাখা সন্ধিবেতটা নিয়ে আসতেন, বলতেন বই নিয়ে এস। বাবার খুব প্রিয় বিষয় ছিল ইংরেজি গ্রামার। পড়া মুখস্থ না হলে কোনও কোনও রাত মধ্যরাত পার করে যেত, ঘুমে চোখ ছোট হয়ে আসত, শরীরের হাত পা জোড়া খুলে নরম হয়ে আসত, তবু ছাড়পত্র মিলত না ঘুমোতে যাবার। কোনও কোনও দিন পড়া খুব চমৎকার বলতে পারলে বাবা সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতেন, মাছ বা মাংসের সবচেয়ে বড় টুকরোটা তুলে দিতেন পাতে, সেদিন আমার সকাল সকাল ছুটি।
এখন বাবার আগের সেই দাপট নেই। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। স্থবির পড়ে থাকেন একলা ঘরে। বাবার মত ভয়ঙ্কর মানুষটিও বড় একা।
আমার মাও একা। কারা যেন আমার মাকে বুঝিয়েছে ধর্ম কর্মে মন দিলে হবে অপার শান্তিলাভ। মা একটি ভুল বিশ্বাস নিয়ে গভীর রাত্তিরে তাহাৰ্জ্জুদের নামাজ পড়েন, শেষরাতে সুর করে দুলতে দুলতে পড়েন—‘ফাবিআইয়ে আলা-ই-রাববুক’। মা-ও খুব একা।
আমার একটি চমৎকার ছোট বোন ছিল। ও কথা বললেই সারা বাড়ি হেসে উঠত। ও গা দোলালেই সারা বাড়ি রিনরিন করে বাজত। এত সুন্দর গান গাইত মেয়েটি, এমন দিন নেই ওর গান শুনে চোখে জল আসেনি আমার। বড় বড় বিয়ের ঘর আসত ছোট বোনটির জন্য। বাবা রাজি হতেন না, বলতেন—ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ।
বোনটি এখন আর গান গায় না। আমার সেই আশ্চর্য সুন্দর বোনটি এখন খুব যত্ন করে আলনার কাপড় গোছায়, রোদে ডালের বড়ি শুকোতে দেয়, সারা দুপুর রান্না করে কই মাছের ঝোল। বিকেল হলে কানে সোনার দুল পরে স্বামীর সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যায়। আমার বোনটিও বড় একা।
আমিও। এখন আমি আর ছোটবেলার মত টেনস্ ভুল করি না। আমাকে প্রচুর লিখতে হয়। টেবিলে স্তুপ হয়ে থাকে এত বই পড়ে পড়ে রাত পার হয়ে যায়, ছোটবেলার মত আমার চোখে রাজ্যির ঘুম নামে না।
বাবা বলতেন বড় হও। যত বড় হই, বাবা বলেন আরও বড় হও। আরও বড় হওয়া আমার আর হয়নি। এখনও বছরে দু’বার বাবার সামনে দাড়ালে বাবা আরও বড় হতে বলেন। আমার আর বড় হওয়া হবে না জানি তবু বাবার সেই এককালের দাপুটে শরীরের সামনে দাড়ালে আমিও নরম হয়ে আসি, বলি—হব। কবে আর হব! তসবিহু জপতে জপতে মার আঙুলে কড় পড়ে গেছে, মা আমাকে দেখলে বুকের কাছে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন—তুই যেখানে থাকিস, সুখে থাকিস তো? শুনে আমার এত কান্না পায়, মনে মনে বলি—সুখী সবাই হয় না, মা। চোখের জল গোপন করে আমি এমন সশব্দে হেসে উঠি যে মা কিছু বুঝতেই পারেন না। বুঝলে আর রক্ষে আছে ? সারারাত ঘুমোবেন না, নানারকম নামাজ পড়বেন।
২. এই সমাজে মেয়েদের বেঁচে থাকবার জন্য অন্য একটি মানুষ দরকার হয়। কিছু লতা গাছ আছে ওরা অন্য এক বৃক্ষ আশ্রয় করে বেঁচে থাকে, কিছু দুর্বল গাছকে আবার বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে ঠেস দিয়েও রাখতে হয়। আমাদের সমাজ মেয়েদের লতা বা দুর্বল গাছের মত মনে করে—যারা আশ্রয় এবং অবলম্বন ছাড়া বাঁচে না।
আসলে কিন্তু বাঁচে। বেশ অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে। কিন্তু মাটি নেই—মাটি তেমন উর্বর নয় যে স্বচ্ছন্দে বেড়ে ওঠা যায়, মাটিতে কাঁকড় বাকড়, নুড়ি খোয়া এত বেশি যে জল নেই, পুষ্টি নেই—বৃক্ষ বাড়ে না।
তেমন আমিও বাড়ছি না। আমার চারপাশের এই ছোট্ট গণ্ডিতে মাঝে মধ্যে আমার এমন দম বন্ধ হয়ে আসে যে সারা শহর সাত চক্কর দিলেও মনে হয় ছোট্ট, একটা ম্যাচ বাক্সের মত মনে হয় শহরটাকে, কখনও দেশটাকে।
এখন আর বলে না। স্বামীর মা, বোন এসে চুক্ চুক্ করে দুঃখ করে যায়। ওদের চোখে অন্য এক স্বপ্ন খেলা করে। স্বামীও সেই স্বপ্নের নদীতে বড় সাতরাতে চায়।
আমার হাত ভিজে যায় নীতার চোখের জলে। নীতা আমাকে বড় আপন ভাবছে বলে প্রতিদিন এসে বসে থাকে, কিছু একটা বলা দরকার আমার। রফিকের আত্মীয়রা বন্ধ্যা মেয়ে বিয়ে করবার জন্য রফিকের ভাগ্যকে দোষ দেয়। দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলে। আমি জানি নীতা একদিন এসে আমাকে এও বলবে রফিক বিয়ে করেছে।
এই চমৎকার মেয়েটি, মগরার পর থেকে এক নদী স্রোতস্বিনী স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে একটি সংসার সাজিয়েছে, আমি তাকে কোনও সম্ভাবনার কথা শোনাতে পারি না।
২১. মেয়েদেরকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়
স্ত্রৈণ শব্দটির অর্থ স্ত্রীর অতিশয় বাধ্য। অর্থাৎ যে ছেলে স্ত্রীর অতিশয় বাধ্য, সে ছেলেকে স্ত্রৈণ বলা হয়। একই ভাবে পতিপরায়ণা শব্দটির অর্থ পতির প্রতি একান্ত অনুরক্তা, আরও এক পা এগিয়ে গেলে পতিব্ৰতা, যার অর্থ পতিসেবাকে পুণ্যব্রত রূপে গ্রহণ করেছে এমন মেয়ে।
পত্নীসেবাকে পুণ্যব্রত রূপে গ্রহণ করবার বিধান মনুষ্য সমাজে নেই বলে পত্নীব্রত বলে কোনও শব্দও অভিধানে নেই।
যে মেয়েটিকে সমাজ ‘পতিপরায়ণা’ অথবা ‘পতিব্ৰতা’ আখ্যা দেয়, তাকে সকলেই খুব ভাল বলে, কিন্তু যে ছেলে ‘স্ত্রৈণ’ তাকে কেউ ভাল চোখে দেখে না বরং তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসে।
পতিপরায়ণা হিসেবে একটি মেয়ে যতটুকু মর্যাদা পায় স্ত্রৈণ হিসেবে একটি ছেলে এই সমাজে ততটুকু অমর্যাদা পায়।
২. সূরা নিসার পঞ্চম পারায় লেখা ‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাহদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহদের ধনসম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধবী স্ত্রীরা অনুগত এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাজতে উহারা উহাদের সতীত্ব ও স্বামীর আর সব অধিকারের হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাঁদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও তারপর তাহদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর।’
যেহেতু পুরুষ তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাই বলা হয়েছে স্ত্রীরা যেন অনুগত থাকে। এক্ষেত্রে স্ত্রীও যদি উপার্জন করে এবং ধনসম্পদ ব্যয় করে তবে নিশ্চয়ই স্বামীরও উচিত স্ত্রীর অনুগত থাকা। কিন্তু এ ধরনের কোনও বাণী ধর্মগ্রন্থে নেই বলে স্ত্রীরা ধনসম্পদ ব্যয় করলেও স্বামীর অনুগত থাকতে হয় স্ত্রীদেরই। কারণ বিধান –বিধান একবার সৃষ্টি হয়ে গেলে আর নাকি খণ্ডানো যায় না। –
৩. ঘরে পুত্রবধুর সন্তান হয়েছে, বাইরে অপেক্ষমাণ বৃদ্ধ কন্যা-জন্ম শুনে উল্টোপথে চলে গেলেন আবার সেই বাড়ির গাভীটি যখন বকনা বাছুর জন্ম দিল, ‘ঠাকুর এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন’ বলে সে কী আনন্দ বৃদ্ধার!
অপর্ণা সেনের ‘সতী’ ছবিতে এই দৃশ্যটি দেখে আমি আপাদমস্তক স্তম্ভিত হই। মেয়ে মানুষ জন্ম নেওয়ায় সংসারের লোকেরা দুঃখ পায় কিন্তু মেয়েজন্তু জন্ম নিলে আনন্দে হাততালি দেয়। সংসারে জন্তুর চেয়েও মেয়ের মূল্য কম।
৪. আমার এক স্কুলের বন্ধু পড়াশোনার পাট শেষ করে চাকরি করছে। ঢাকায় তার আত্মীয়, যার বাড়িতে থেকে চাকরি করা যায়—কেউ নেই। অগত্যা তাকে কর্মজীবী হোস্টেলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমার এই বন্ধুটি ছুটি-ছাঁটায় আমার সঙ্গে দেখা করত। একদিন আমার অভিভাবক অবসর বুঝে আমাকে জানালেন মেয়েটির এত ঘন-ঘন আমার বাড়ি আসা উচিত নয়।
জিজ্ঞেস করলাম–কেন ?
ওঁরা বললেন—মেয়ে ভাল নয়।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম—কেন ?
উত্তর এল—ওইসব হোস্টেলে ভাল মেয়েরা থাকে না।
একটি মেয়ে ভাল না খারাপ তা মানুষ খুব সহজেই বিচার করে ফেলে। বাজারের একটি শসাকে যেমন ভাল না খারাপ দাঁড়িয়েই রায় দিয়ে দেওয়া যায়। মেয়েরা যখন পরাশ্রয়ী লতার মত অভিভাবক-বৃক্ষকে আঁকড়ে থাকে এবং এই ব্যবস্থাকেই সমাজ সুষ্ঠু ও সুস্থ ব্যবস্থা বলে মত দেয় তখন আমার ছেলেবেলার এই বন্ধু পিতার মৃত্যুর পর মায়ের এবং নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে।
ক’জন মেয়ের স্নায়ু এমন সবল হয় ? আমি জানি খুব কম মেয়েই পারে দূর-আত্মীয়ের গলগ্ৰহ হয়ে বেঁচে থাকবার বদলে বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে।
যেহেতু মেয়েটি কোনও অভিভাবক নামক তথাকথিত ছাতার তলে বসে থাকেনি, তাই দীর্ঘ পাচ বছর যে ছেলেটি তাকে ভালবাসার কথা শুনিয়েছে, বিয়ের প্রসঙ্গে সেও একদিন এটা সেটা বলে বিয়ের কথা এড়িয়ে যায়। মেয়েটি কারও অনুগ্রহের জন্য হাত পেতে রাখেনি বলে আমার বড় গর্ব হয়।
আমার এই বন্ধুটিকে গলাধাক্কা দিয়ে পুলিশ হোস্টেল থেকে বের করে দিয়েছে, অনশনরত মেয়েটিকে লোকসমক্ষে পিটিয়েছে। রাষ্ট্রই যদি এই মেয়েদের গলাধাক্কা দেয়, সমাজ কেন দেবে না ?
৫. সেদিন, খুব বেশি দিন আগে নয়, ধানমণ্ডির এক ক্লিনিক থেকে নয়াপল্টন ফিরছি একা, ক্লিনিকের কাজ শেষে রাত বেজেছে সাড়ে আট। এই পথটুকু পার হতে আমার রিকশার সামনে গতি শ্লথ করেছে ছটি রিকশা, তিনটি গাড়ি, দুটি স্কুটার ও চারটি মোটর সাইকেল। আমি মোট পনেরোটি লোভের দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছি।
আমি জানি আমার পথ মসৃণ নয়। আমাকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়। শুধু আমাকে কেন, প্রতিটি মেয়েকেই।
২২. আমার বন্ধু হাবিবুল্লাহ
হাবিবুল্লাহ নামে আমার এক বন্ধু ছিল মেডিকেল কলেজে। সে আমার তুই-তোকারি বন্ধু ছিল। দেখতে চমৎকার একটি ছেলে। আমরা ক্লাসে, ক্যান্টিনে, ওয়ার্ডে, করিডোরে যখন পাশাপাশি চলতাম, ছাত্ররা দেখে বলত—‘বন্ধুত্ব না ছাই!’
সবাই ভাবত দুজন ছেলেমেয়ে সারাদিন হাঁটছে, কথা বলছে, পড়ছে, তাদের মধ্যে প্রেম না হয়ে যায় না। কেউ বিশ্বাসই করত না ছেলে ছেলেতে যেমন বন্ধুত্ব হয়, আমাদেরও তেমন। আমরা পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েছি, এই পাঁচ বছরে হাবিবুল্লাহ্ কখনও আমার আঙুল স্পর্শ করবার লোভ করেনি।
সঙ্গে যেমন ঠাট্টা করতাম, হাসতাম, হাবিবুল্লাহর সঙ্গেও ঠিক তেমন তেমন করতাম। ডালিয়া যেমন আমার বাড়ি আসত, ভাত খেত, হাবিবুল্লাহও আসত, খেত।
আমার কেমন গর্ব হত। সবাইকে তুড়ি মেরে আমার বড় দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করত—হয়, ছেলে-মেয়েতেও বন্ধুত্ব হয়।
পাঁচ বছর পর একদিন হাবিবুল্লাহ আমাকে প্রথম চিঠি লেখে। চিঠির কথাগুলো এই ছিল যে, আমরা তো এতদিন কেবল বন্ধুই ছিলাম—আমরা পরস্পরকে এত ভালবাসি যে, যে কোনও বিচ্ছিন্নতা আমাদের বড় কষ্ট দেবে। একমাত্র বিয়েই আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে পারে। তুই কি খুব রাগ করবি যদি বিয়ের কথা বলি ?
মনে আছে সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম এই কারণে যে, আমার কেবল মনে হচ্ছিল–পাচটি বছর যাদের কাছে আমি বন্ধুত্বের সংজ্ঞা দিয়েছি অন্যরকম, যারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে ‘প্লেটোনিক লভ বলেও কিছু আছে জগতে, তাদের কাছে আমি কী ভীষণ হেরে গেলাম। হাবিবুল্লাহর ওপর আমার বড় রাগ হয়েছিল।
পরদিন থেকে তার সঙ্গে আমি কোনও কথা বলিনি, আজও না। সে পরে অনুতপ্ত হয়েছে, ক্ষমা চেয়েছে। বন্ধুত্বটিই আবার ফিরে চেয়েছে। আমি অনড়, তার সঙ্গে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে আমার ঘৃণা হয়েছে।
সেই সুদৰ্শন মেধাবী যুবক হাবিবুল্লাহর কথা আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। মা মাঝে-মধ্যে বলেন–হাবিবকে ফিরিয়ে দিয়ে তুই খুব ভুল করেছিস। মা হয়ত ঠিকই বলেন। তবু আমি যা ইচ্ছা করিনি, যা স্বপ্ন দেখিনি, জীবনে তা আমি মেনে নিইনি। তবে দীর্ঘদিন না মানলেও একটি সত্য পরে আমাকে স্বীকার করতেই হয়েছে ছেলে-মেয়েতে আসলে বন্ধুত্ব হয় না। এরও আরও পরে, এখন আমি নিশ্চিত যে, ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে আসলে কোনও স্থায়ী সম্পর্ক হয় না। আত্মীয়তা এক ধরনের সংস্কার মাত্র।
পিতা তার পুত্রকে যে চোখে দেখে, কন্যাকে সেই চোখে দেখে না। যে অতিথি কোনও লাভে আসে না, তার কদর আর কতদিন । কন্যার সঙ্গে পিতার সম্পর্ক সামাজিক ক্ষয়-ক্ষতির। কন্যা একটু ঘোমটা খুলল তো পাড়ার লোক বাপের বদনাম করল, কন্যা একটু পা বাড়িয়ে সংস্কৃতিচর্চা করল তো পাড়ায় নির্লজ্জ মেয়ে নিয়ে টি টি পড়ে গেল। কন্যা কারও সঙ্গে প্রেম করল তো পিতা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারল না। পিতা ও কন্যার সম্পর্কে থাকে লোক-দেখানো আদিখ্যেতা, যা আদৌ আন্তরিক নয়।
স্বামী স্ত্রীর যে সম্পর্ক তা অনেকটা লটারির মত ব্যাপার। চোখ বুজে যারা জুয়ো খেলায় নামে, না জানি ভাগ্যে কী আছে—একটি মেয়ের জন্য স্বামী জিনিসটি সেরকমই। বাসরঘর থেকে জুয়ো খেলার ফল সে পেতে থাকে। স্বামী মদ্যপ কী মদ্যপ নয়, স্বামী বহুগামী কী একগামী, স্বামী মিতব্যয়ী কী অমিতব্যয়ী, স্বামী মেজাজী কী আমেজাজী—ইত্যাদি সম্পর্কে অত্যন্ত্র ধারণা অথবা ধারণা ছাড়াই একটি মেয়ে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে পা বাড়ায়। সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত স্বামী স্ত্রীর এই সম্পর্ক।
ভাইবোনের সম্পর্ক বাল্যকালের আবেগ যতদিন জিইয়ে থাকে ততদিন। শৈশবে কোনও পুতুল নিয়ে খেললে সেই পুতুলের প্রতি মায়া জন্মে, কৈশোরে কোনও সহপাঠী অথবা পুরনো স্কুল-ঘরের জন্য যেমন মায়া জন্মে, বোনের জন্য ভাইয়ের মায়াও তেমন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাইদের মধ্যে বোনের মায়ার চেয়েও বোনের জমির মায়া বেশি। আর মা মাত্রই পুত্রকে কোলের কাছে আঁকড়ে রাখে বেশি, কন্যার পাতে না দিয়ে পুত্রের পাতে তুলে দেয় মাছের মুড়ো, দুধের সর। সেই পুত্রকে মায়ের চেয়ে জগতের অন্যান্য মোহই টানে বেশি। পুত্ৰ যত বড় হয়—মা পুত্রের সম্পর্কটি ততই সাধারণ সৌজন্যবোধে গিয়ে দাঁড়ায়।
আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে তো প্রশ্নই ওঠে না। পাশ্চাত্য দেশে যৌনসম্পর্ক নিয়ে কোনও রক্ষণশীলতা নেই। আর নেই বলে বন্ধুত্বের মধ্যে প্রধান বাধাটিই নেই। আমাদের দেশে যেখানে এখনও বৃহত্তর পরিসরে ছেলে-মেয়ের মেলামেশাটি একটা গৰ্হিত কাজ বলে মনে করা হয়, সেখানে দুতিনটে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউন্ডারির ভেতরে ছেলে-মেয়ে চলাফেরা করলেই বন্ধুত্ব নাম দিয়ে দেওয়া যাবে–বন্ধুত্ব অত সহজ জিনিস নয়। কারণ বিদ্যায়তনগুলোর বাইরে আমাদের যে সমাজ তা ধর্মান্ধতা, হাজার বছরের কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ইত্যাদিতে ঠাসা। এই সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে কোনও ছেলে কোনও মেয়ের পাশাপাশি হেঁটে চলে ভেতরের যৌনবোধ সংযত করতে পারবে—তা সম্ভব হয় না।
এই দেশে সামগ্রিক শিক্ষার মান অত উঁচু নয় যে মানসিকতা উন্নত হবে, এই দেশের সংস্কৃতির জোর এত নেই যে বোধে পরিচ্ছন্নতা আসবে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে গোটা সমাজে যেখানে অশালীনতা আর অশ্লীলতার ইঙ্গিত, সেখানে কেবল কিছু-কিছু জায়গায় শ্লীলতার দোহাই দিয়ে গোটা সমাজের গোড়ায় ঘা সারানো যায় না। বন্ধুত্বটি বিয়ে পর্যন্ত না গড়ালে লোকে ছিছি বলে। এ ক্ষেত্রে ছেলের নয়, হলে মেয়ের পরিণামটিই অশুভ হয়। বন্ধুত্ব বলে শেষ পর্যন্ত আসলে কিছুই থাকে না।
হাবিবুল্লাহর সঙ্গে বিয়ে হলে আমি জানি সুন্দর একটি গোছানো সংসার হত আমার। না হয়ে লাভ কিছুই হয়নি। ক’জন বলে তোমরা দুজন কি চমৎকার বন্ধু ছিলে; রুহুল যেমন ইকবালের ছিল, আরজু যেমন মার্শালের ছিল, রিজওয়ান যেমন টিপুর ছিল, কেউ বলে রানু যেমন হাবিবার ছিল, মণি যেমন লিলির ছিল? কেউ বলে না। বরং মাঝে-মধ্যে আমার এবং হাবিবুল্লাহর বন্ধুত্ব নিয়ে এক ধরনের রসিকতা করে, ব্যর্থ প্রেম বলে উল্টো মজা করে।
বিজ্ঞান আমাদের প্রগতিশীল কতটা করে জানি না তবে অবৈজ্ঞানিক কম করে না। এ দেশের শিক্ষা আমাদের সংস্কার মুক্ত কতটা করে জানি না, তবে অশিক্ষিতও কম করে না।
২৩. আজ না হোক, দুদিন পর
আমার ছোট বোন খুব সাজতে পছন্দ করে। সেদিন নতুন একটি শাড়ি পরবার পর কপালে পরেছিল লাল টিপ, দুহাতে অনন্ত বালা, কানে ও গলায় নানা অলঙ্কার। আমরা দুজন কথা বললেই লোকে বলে চারদিকে অলৌকিক বেজে ওঠে একশ তানপুরা, আমরা হাসলেই পৃথিবীর সব শিশু হেসে ওঠে, বৃক্ষ গা দোলায়, পাতায় পাতায় নেচে ওঠে হলুদ রঙের পাখি।
সেদিন আমরা দুবোন ধানমণ্ডি থেকে গ্রীন রোডের দিকে যাচ্ছিলাম, রিকশায় আসছিলাম, তখন দুপুর সাড়ে বারো। বৈশাখের রোদেলা দুপুরে রিকশার পাল তুলে বসেছি দুজন (রিকশার হুড তোলাকে পাল তোলা বলতেই আমার ভাল লাগে বেশি)। তখন হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ, আমাদের রিকশার সামনে এসে হাত উঁচু করে দাঁড়াল একটি ছেলে, বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। হাত উঁচু করবার অর্থ রিকশা থামানো। চাদ চাইবার জন্য কিছু ছেলে এরকম রিকশা থামায়, বলে—ফুটবল খেলব চাঁদা চাই, মোহরমের উৎসব হবে চাঁদা চাই, অথবা মসজিদ বানাব, মিলাদ পড়াব চাঁদা চাই। আমরা অনুমান করি চাঁদা চাইবার জন্যই আমাদের গতি রোধ করা হল।
অথচ যে ছেলের চাঁদা চাইবার কথা, আমাদের কাছে যে ছেলের বিনীত প্রস্তাব রাখবার কথা—সেই ছেলের হাতে আমরা দু’জনই যুগপৎ লক্ষ্য করি ছাঁইঞ্চি লম্বা একটি ছোরা। যে ছোরা রান্নাঘরে পিঁয়াজের ডালায় অসহায় পড়ে থাকে—ঠিক সে ছোরাই যখন রাস্তায় কোনও মানুষের হাতে উঠে আসে, যে মানুষ পথ আটকায়—তখন সেই সামান্য ছোরাই যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, আমি সেই মুহুর্তে টের পেলাম। পথ রোধ করেছিল একটি ছেলে, হরণের বেলায় দৌড়ে এল একই রকম ছোরা হাতে একই বয়সের আরেকটি ছেলে। আমাদের তখন অনুমান করবার সময় নেই দ্বিতীয় ছেলেটি কোথায় দাঁড়ানো ছিল অথবা কেথেকে ছুটে এল। কারণ ওদের মুখ থেকে মদের ঝাঁঝাল গন্ধের সঙ্গে ‘যা আছে সব দে’ জাতীয় বাক্য যখন নির্গত হল, আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাদের যাবতীয় টাকা-পয়সা, ঘড়ি ইত্যাদি খুলে দিতে। আমার চোখের সামনে আমার ছোটবোন এক এক করে খুলে দিল তার শখের সমস্ত জিনিস।
তখন সময় এমন নয় যে রাস্তায় মানুষজন নেই, খুব ফাঁকা; দিব্যি মানুষ হাঁটছে, চলছে—এমন কোনও সরু গলি নয় যে ধু ধু দুপুরে কেবল কাক ছাড়া আর কিছু ডাকে না। ধানমণ্ডি থেকে গ্রীন রোডে যাবার রাস্তা খুব একটা জনাকীর্ণ না হলেও নির্জন নয়। তখন আমাদের সেই ঘটনার সময় কাছে পিঠে কম করে হলেও বারো জন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ দাঁড়ানো ছিল।
ছেলে দুটো পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্কুটারে উঠে দ্রুত চলে গেল। আমি হতবাক ওই দুটো হতভাগ্য ছেলের জন্য নয়, রাস্তায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা ওই বারো জন পুরুষের জন্য। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি নাটক উপভোগ করেছে মাত্র। আর কিছু নয়। আজকাল মানুষ বোধহয় আর মানুষের প্রয়োজনে আসে না।
যদি ওই দুপুরে ডজনখানেক লোকের চোখের সামনে ওই ছেলে দুটো এসে বলত—আয়, ওই স্কুটারে উঠে আয়, আমি জানি খুব বাধ্য মেয়ের মত ধারাল ছোরার মুখে আমাকে উঠে বসতে হত স্কুটারে। স্কুটার সাঁ করে চলে যেত সকলের নাকের ডগা দিয়ে। কেউ কিছুই বলত না।
যদি ওই দুটো ছেলে, রাস্তায় একশ লোকের সামনে বলত— খোল, কাপড় খোল, যদি প্রকাশ্য রাস্তায় কেউ আমাদের চরম অসম্মান করত কে রুখে দাঁড়াত, কে আসত প্রতিবাদ করতে ? কেউ না ।
এতগুলো জলজান্ত মানুষ সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখল। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ এগিয়ে আসে না। নারী নিয়ে ঘরে বাইরে যা কিছুই ঘটে সবই হয় মজার ঘটনা। কেউ মজা করে, কেউ মজা দেখে। নারীর কোনও দুর্ঘটনা মানুষকে যত মজা দেয়, সম্ভবত আর কোনও দুর্ঘটনা মানুষকে অত মজা দিতে পারে না।
কেউ হয়ত মুখে আহা বলে, কেউ হয়ত চিৎকার করে দাবি তোলে কিছু একটার। আসলে কিন্তু সকলেই মজা পায়। পত্রিকাঅলারা হত্যা ও ধর্ষণের খবর ছেপে যত আনন্দ পায়, তত আর অন্য কিছুতে পায় না। অধিকাংশ পাঠক নারী অপহরণ ও নির্যাতনের নিখুঁত বর্ণনা পড়ে যত আনন্দ পায়, তত আর অন্য কিছুতে পায় না। – রাস্তায় সেদিন আমাদের দুরবস্থা দেখে মানুষ কেবল হাততালি দিতে বাকি রেখেছে, এ হাততালি আজ না হোক, দুদিন পর দেবে। এখনও ধর্ষণ ঘটে লুকিয়ে-চুরিয়ে, দুদিন পর প্রকাশ্য রাস্তায় ঘটবে। আজ যারা এ্যাসিড ছেড়ে আড়ালে-আবডালে, দুদিন পর তারা প্রকাশ্যে ছুঁড়বে। আজ হত্যাকাণ্ড ঘটে নির্জন অন্ধকারে, দু’দিন পর ঘটবে প্রকাশ্য দিবালোকে। আজ দর্শক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। কাল দর্শক উল্লাস করবে, সিটি বাজাবে।
২৪. মেয়েদের পরিচয়
১. এই শহরে আমি একটি ঘর খুঁজছি। রাতে ঘুমোবার একটি ঘর। এই শহরের একটি হাসপাতালে নটা পাঁচটা কাজ করে আমার ক্লান্ত পা যখন যেতে চায় একটি গন্তব্যে, আমার অবসন্ন শরীর যখন একটি আশ্রয় চায়—তখন হন্যে হয়ে একটি ঘর খুঁজতে হয় আমাকে। যে ঘরে অতীত ভবিষ্যৎ না ভেবে এমন কিছু করতে পারি যা আমার ইচ্ছে করে—যেন আমি গা খুলে স্নান করতে পারি, গলা ছেড়ে গান গাইতে পারি, অথবা নিজের বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লিখতে পারি। অথচ এখন আমার সারা শহরে সামান্য একটু জায়গা খুঁজে বেড়াতে হয় বসবার, কারও সঙ্গে কথা বলবার। এ অদি আমার চেনাজানা এমন কেউ বাদ নেই যাকে বলিনি আমার জন্য একটি ঘর খুঁজতে। এত অল্প বেতনের চাকরি করি, আমার পক্ষে দুতিনটে ঘর ভাড়া নিয়ে একটিতে শোব, একটিতে খাব, একটিতে বসব—এমন সম্ভব নয়। যদিও ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্নের ভেতরে একটি বাড়ি সাজাই—খুব সুন্দর একটি বাড়ি।
আমি মোট পঁচিশজনকে বলেছিলাম একটি ঘর খুঁজতে। পঁচিশজনের মধ্যে বিশজনই আমার সঙ্গে আর দেখা করেনি। পাঁচজন জানিয়েছে বাড়ি ভাড়া আজকাল খুব বেড়ে গেছে, মহল্লায় টাউট-বাটপারের সংখ্যা খুব বেশি।
আমি নিজে সেদিন অন্তত ছ’টি বাড়িতে গিয়েছি। সকলেই জিজ্ঞেস করেছে পরিবারের সদস্য ক’জন। আমি বলেছি আমি এবং আমার সঙ্গে এগারো বছরের একটি মেয়ে, লিলি–ও আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। ছিমছাম মানুষ, কোনও বুট-ঝামেলা নেই, বাড়িঅলাদের খুশি হওয়ার কথা, অথচ তারা খুশি হয় না। তারা আরও কিছু যেন চায়। তাদের আরও একজন কাউকে দরকার হয়। নিঝঞ্ছাট একটি ভাড়াটে তারা মোটেও পছন্দ করেন না। আসলে তাদের দরকার একজন পুরুষলোকের। আমার সঙ্গে যেন-তেন একটি পুরুষলোক হলেই বাড়িঅলা খুশি। পুরুষলোকের যদি আমার কোনও প্রয়োজন না থাকে, যদি পুরুষলোক দ্বারা আমার স্নায়ুর অত্যাচার হয়, তবে ? আমার না হোক, পুরুষলোক বাড়িঅলার প্রয়োজন, সমাজের বাঘা বাঘা লোকের জন্য প্রয়োজন।
এই ঢাকা শহরে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে আমার দিন কাটাতে হয়। আমার কোনও নিজস্ব ঘর নেই। যে ঘরে আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারব, যে ঘরে আমার বাবা এসে আমাকে পাশে নিয়ে পুরনো দিনের গল্প করবে, যে ঘরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বোন গেয়ে উঠবে—‘এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয় হরণ’, যে ঘরে আমার দাদা হঠাৎ এসে বলবে—‘আজ সারাদিন তোর ঘরে ঘুমোব, আজ আমার মন ভাল নেই।’
ভার্জিনিয়া উল্ফের ‘A Room of One’s Own’ বইটি পড়তে পড়তে আমার রাত কাটে। ওতে লেখা—‘নারী সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং অক্ষমতার জন্য দায়ী হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, মহিলা লেখককে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তাকে অবশ্যই পুরুষশাসিত সমাজের শক্তিশালী পুরুষের শোষণ, কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার মত দুর্বার প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। ন্যূনতম পক্ষে একান্ত নিজস্ব একটা ঘর শুধুমাত্র এই অবস্থা থেকে নারীকে মুক্ত করতে পারবে—এই ঘরের চাবিটা তার হাতেই থাকবে এবং ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে তার স্বাধীনতা থাকবে তার সহোদর ভাইদের যেমন তাদের ঘরে বিচরণের স্বাধীনতা আছে, তারই সমতুল্য।’
২. সেদিন এক অনুষ্ঠানে আমার পাশে এসে বসলেন এক মহিলা, আমার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, পরিচয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কিছু কথাবার্তার প্রয়োজন হয়। তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, যেমন—১। আপনার স্বামী কী করেন ? ২। আপনার স্বামীর নাম কী ? ৩। স্বামীর পদবী কী ? ৪। স্বামীর বাড়ি কোথায় ? ৫। স্বামীর ভাই-বোন ক’জন ? ৬। ভাইরা কী করে ? ৭। বোনদের বিয়ে হয়েছে কি না ? ৮। তাদের সন্তান ক’জন এবং কেউ কোথাও পড়াশোনা করে কি না আর পড়াশোনা করলে কে কোথায় পড়ছে? ৯। ভগ্নিপতিরা কে কী করে ? ১০ স্বামীর বাবা কোথায় কী করছেন? ১১। স্বামীর পদোন্নতির সম্ভাবনা আছে কি না ? ১২। স্বামীর কাকারা কে কোথায় কী করছে ? ১৩। স্বামীর মামারা কে কোথায় কী অবস্থানে আছে ? ১৪। স্বামীর খালা ও ফুপারা বিয়ের পর কে কোথায় কেমন আছে ? ১৫। স্বামীর মাসোহরা কত ? ১৬। স্বামী এই অনুষ্ঠানে আসেনি কেন ? ১৭। তার কোথাও কী কোনও কাজ আছে কী নেই? ১৮। স্বামীর স্বাস্থ্য ভাল না খারাপ ? ১৯। স্বামী সাধারণত কী খেতে পছন্দ করে? ২০। স্বামী কি দুপুরে ঘুমোয় ? ২১। স্বামী রাত কটা পর্যন্ত জেগে থাকে ২২। স্বামীর মেজাজ-মর্জির অবস্থা কেমন? ২৩। স্বামী কী ধরনের গান পছন্দ করে ? ২৪। স্বামী টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসে ? ২৫। স্বামী সাধারণত কী ধরনের পোশাক পরে ?
প্রায় দেড় ঘণ্টা তার নানা প্রশ্নের উত্তর দেবার পর তিনি সন্তুষ্ট হলেন যে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল। কিন্তু পাঠক, আমাকে বিশ্বাস করুন আমি এক বর্ণ বানিয়ে বলছি না—সেই মহিলা আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি আমি কে, আমার বাড়ি কোথায়, আমার বাবা-মা কে, আমি কী কাজ করি, আমার নামই বা কী। যে মহিলা আমার সঙ্গে পুরো দেড় ঘণ্টা কথা বললেন তিনি আমার নাম পর্যন্ত জানেন না অথচ তিনি বড় পরিতৃপ্ত যে আমার সঙ্গে তিনি পরিচয় পর্ব সারলেন।
২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
পতি ধর্ম, পতি কর্ম পতি সারাৎসার।
পতি ভিন্ন রমণীর গতি নাহি আর।
পতি আজ্ঞা, সতী পক্ষে, বেদের সমান।
পতি তুষ্ট হলে, তুষ্ট প্রভু ভগবান।’
বাঙালি গৃহস্থ ঘরের দেওয়ালে এক সময় এ জাতীয় সচিত্র ‘সতীর সার কথা’ সযত্নে শোভা পেত। মেয়েরা রঙিন সুতোয় লিখে রাখত—‘পুরুষ তমাল তরু প্রেম অধিকারী, নারী যে মাধবীলতা আশ্রিতা তাহারি।’ পৃথিবী বার বার আবর্তিত হচ্ছে, তবু পতি প্রাণ, পতি মান, পতিই ভূষণ সেই যে কবে মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেথে ছিল তা আজও অমলিন।
‘রমণীর পতি বিনা গতি নাই।
পতির বিষয়ে বিশেষ জানাই।
পতি যা বলেন তাহাই করিবে।
পরম যতনে পতিকে সেবিবে।
পতি খেলে খাবে, না খেলে খাবে না।
পতি শুলে শোবে, না শুলে শোবে না।’
এ ধরনের হিতোপদেশ মেয়েরা ধর্মের বাণীর মত মুখস্থ করত। নতমুখে বলত—‘পতির মহিমা আমি কী বণিতে পারি। না পারেন ভাগীরথি, আমি ক্ষুদ্র নারী।’ নারী নিজে মানে সে ক্ষুদ্র। নারী এই কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করে যে সে ক্ষুদ্র, অতিশয় ক্ষুদ্র। যে স্বামীভক্তি বা পাতিব্ৰত্য চিত্র সেকালের নারীরা লালন করত, একালের নারীরা তাদের থেকে কোনও অংশে কম যায় না। কত সংস্কার ভাঙে, বদলায়—কিন্তু নারী নিয়ে যে সংস্কার তার কেবল বিস্তার আছে, বিলুপ্তি নেই। স্বামী শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক ইত্যাদি। স্বামী শব্দটি বাংলা ভাষায় যতদিন ব্যবহৃত হবে পুরুষ ততদিন সঙ্গত কারণেই কর্তা, প্রভু, মনিব ও মালিক। বেগম রোকেয়া যুক্তি দিয়েছিলেন–‘দাসী শব্দে অনেক শ্ৰীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, স্বামী শব্দের অর্থ কী? দানকর্তাকে দাতা বলিলে যেমন গ্রহণকর্তাকে গ্রহীতা বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর বলিলে অপরকে দাসী না বলিয়া আর কী বলিতে পারেন?’
মানুষকে দ্বিচক্র শকটের সঙ্গে তুলনা করে রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না—সে কেবল একই স্থানে (গৃহ কোণেই) ঘুরিতে থাকে।’
এদেশে বংশ নির্ধারণ হয় পৈত্রিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। পৈত্রিক পরিচয়ই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নারীর সতীত্বের উপর রাখা হয় কড়া নজর তাই যৌন শুচিতা পুরুষের জন্য না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। এইসব যুক্তি দেখিয়ে সমাজের ধূর্ত লোকগুলো নানা রকম সুবিধে নিচ্ছে, যারা সুবিধে নিচ্ছে তারা ‘স্বামী’ দলভুক্ত।
ধর্ম তাদের যথেচ্ছাচারী করেছে। আদিম থেকে আধুনিক সমাজ–সব সমাজই তাদের বিস্তর সুবিধে দিয়েছে। কারণ এ সবের রচয়িতা এবং নির্মাতা স্বামীদলভুক্ত পুরুষ। ইসলাম তাদের চার বিয়ে করবার অধিকার দিয়েছে। অনিতা নামে পাকিস্তানের এক মেয়ে সেদিন মেয়েদের চারটি বিয়ের কথা বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছে স্বামীদলভুক্তরা। স্বরচিত আসন আবার টলে যায় কী না কে জানে।
শুধু ইহকালই নয়, পরকালেও নিজেদের ব্যবস্থা আরামপ্রদ করে রেখেছে তারা। সত্তর জন হুর বেষ্টিত জীবন শুধু তারাই ভোগ করবে, আর মেয়েদের কপালে ইহকালের স্বামীটিই জুটবে। যে কোন সচেতন মানুষের জন্য এই পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু মানুষ সচেতন নয়। মানুষ সুবিধাভোগী, মানুষ স্বার্থপর। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এখন শুভ কাজে নয়, অশুভ কাজেই বিকশিত হয় বেশি। আর কিছু মানুষ, যাদের মেয়ে মানুষ’ বলতেই মানুষেরা পছন্দ করে, ওরা কেবল হাততালি দেয়। সবার নিচে, সবার পিছে, সবহারাদের কাতারে দাড়িয়ে ওদের কাজ শুধু হাততালি দেয়া। যে যা-ই বলে মেনে নেয়া।
ওরা আসলে মানুষ নয়। ওরা ভোগ্যবস্তু। ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হইয়াছে। এইসব ইহ জীবনের ভোগ্যবস্তু।’ এই কথা আমার নয়। এই কথা সূরা আল ইমরানের চৌদ্দ আয়াতের কথা। আয়াতের উল্লিখিত মানুষ—যারা কখনও নারী নয়—যারা পুরুষ, নারী তাদের ভোগ্যবস্তু। নারী শুধু ভোগ্যবস্তুই নয়। নারী শস্যক্ষেত্রও বটে। ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতঃপর তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিবে।’ (সূরা বাকারা ২২৩ আয়াত)
বাংলাদেশে একদিকে চলে ইসলাম চর্চা, অন্যদিকে নারীমুক্তি আন্দোলন। অনেকে বলে দুটোতে বিভেদ নেই। বলে, ইসলাম নারীকে যত সন্মান দিয়েছে, আর কোনও ধর্ম নারীকে তত সম্মান দেয়নি। সূরা নিসার ৩৪ আয়াতে আছে—‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাহদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহদের ধন সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধবী স্ত্রীরা অনুগত, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে উহারা স্বামীর অনুপস্থিতিতে সতীত্ব ও স্বামীর আর সব অধিকারের হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাহদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর।’ সম্মানের মাত্রা সম্ভবত এটুকুতেই বেশ অনুমান করা যায়।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ নামক গ্রন্থ বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছে। আমাদের অর্ধশিক্ষিত ছেলেরা ভালবেসে স্ত্রীকে উপহার দেয় ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য’। শিক্ষিতরা হয়ত হাতে হাতে কিছুই দেয় না, মনে মনে কিন্তু দেয়। আর সেই দেওয়া হাতে দেওয়ার চেয়ে কম মারাত্মক নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর কারণ, ঘরের পুরুষদের খাবার পর উচ্ছিষ্ট যা থাকে, মেয়েরা তাই খেয়ে উদর পূর্তি না হলেও হৃদয় পূর্তি করে।
স্বামীর এঁটো উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সংস্কার বাঙালি সমাজে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের যে সামাজিক চিত্র বৈদিক সাহিত্য বহন করছে তাতে দেখি–‘ভুক্তোচ্ছিষ্টং বধৈব দদাৎ’ অর্থাৎ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে (গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১)। জীর্ণ জুতো কাপড় দাসকে দেবার এবং খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবার বিধান শাস্ত্রে আছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। আর এ কথা স্বীকার্য যে, অশিক্ষিত মানুষ ভাল মন্দ শিক্ষা নেয় ধর্ম থেকে। আর আমাদের ধর্ম যেখানে নারীর বিরুদ্ধে খড়গ উচিয়ে আছে, সেখানে নারী স্বাধীনতা নিয়ে এই সব লেখালেখি পুরুষ পাঠকদের জন্য অবসরের মজাদার খোরাক জোটানো ছাড়া আর কিছু নয়।
২৬. রামায়ন-মহাভারত
গত বছরের শেষদিকে কলকাতা গিয়েছিলাম। সকাল দশটার দিকে রাস্তায় হাঁটছি আর অবাক হচ্ছি কলকাতাকে এত ফাঁকা লাগেনি তো কখনও ! যেন পুরো কলকাতা কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। বিকেলে তারাপদ রায়ের বাড়ি গিয়ে শুনলাম রোববার সকালে কলকাতা কলকাতাতেই থাকে, তবে ঘরের বাইরে বেরোয় না, কারণ দূরদর্শনে তখন ‘মহাভারত’ দেখায়। সারা শহরে তখন আলোচনা তুঙ্গে কবে হবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। যুবকেরা গোপনে অপেক্ষা করে বস্ত্রহরণ দৃশ্যে রূপা গাঙ্গুলীর শরীরখানা দেখে নেবার। বস্ত্রহরণের চিত্রায়ণ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় তখন তুমুল হইচই।
অ্যান্টেনা উঁচু করে এদেশে আমিও কিছুদিন রামায়ণ দেখেছি। কিছু দেখলে তার আগাগোড়া না জেনে আমার স্বস্তি হয় না। রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনায় সীতা বলে, ‘হে নরব্যাঘ্ৰ, তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গেও রুচি নেই (২/২৭/২১)। তোমার বিরহে, রাম, আমাকে প্রাণত্যাগ করতে হবে (২/২৮/৫)। তুমি পরিত্যাগ করলে আমার মৃত্যুই ভাল (২/৩০/২০)’। এ কি কেবলই প্রেম ? প্রেমে অন্ধ হয়ে সীতার স্বর্গত্যাগ ? প্রেমের অতল জলে ডুবে যদি কেউ মৃত্যুর কথাও বলে, মন্দ শোনায় না। কিন্তু সীতার উপর পতিব্ৰতাধর্ম আরোপ করে ব্রাহ্মণেরা যখন বলে—স্বামীই পরম দেবতা (২/১৯/১৬), ইহজগতে ও পরলোকে সর্বদা পতিই হল নারীর একমাত্র গতি (২/২৭/৬); সে প্রাসাদের উপরে, বিমানে, আকাশে যেখানেই হোক স্বামীর পদচ্ছায়ার বিশিষ্ট স্থান (২/২৭/৯)—তখন নিশ্চয়ই একে আর যা-ই বলা যাক, প্রেম বলতে বাধে।
সীতা কৌশল্যাকে বলে তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না। চক্রহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না (২/৩৯/২৯)। সীতা রামকেও বলে নারীর একটি গতি স্বামী, দ্বিতীয় পুত্র, তৃতীয় আত্মীয়রা, চতুর্থ কোনও গতি তার নেই (২/৬১/২৪)।
নারীর জন্য স্বামী জিনিসটি অর্থাৎ পুরুষ জিনিসটি খুব মূল্যবান। পুরুষ যদি বৃক্ষ হয়, নারী তার গায়ে জড়ানো পরজীবী লতা। বৃক্ষের আশ্রয় ছাড়া পরজীবী লতা যেমন বাচতে পারে না, তেমনি পুরুষের আশ্রয় ছাড়া নারীর বাঁচাও অসম্ভব।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর রাম সীতাকে প্রথম দেখেই বলে—যুদ্ধ করে যে জয়লাভ করেছি সে তোমার জন্য নয় (৬/১১৫/১৫)। নিজের বিখ্যাত বংশের কলঙ্ক মোচনের জন্য (৬/১১৫/১৬)। রাম আরও বলে—যাও, বৈদেহি, তুমি মুক্ত। যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। আমাক স্বামীরূপে পেয়ে তুমি রক্ষসের গৃহে জরাগ্রস্ত যাতে না হও তাই আমি রাক্ষসকে হত্যা করেছি। আমার মত ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন লোক পরহস্তগতা নারীকে কেমন করে এক মুহুর্তের জন্য ধারণ করবে ? তুমি সচ্চরিত্রই হও বা দুশ্চরিত্রই হও মৈথিলি, তোমাকে আমি আজ ভোগ করতে পারি না, তুমি সেই ঘিয়ের মত যা কুকুরে লেহন করেছে (রামায়ণ ৩/২৭৫/১০-১৩)।
রাম খুব সহজেই সীতাকে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। সীতার প্রতি ভালবাসার কারণে সে রাবণকে হত্যা করেনি, করেছে রামের স্ত্রী হয়ে সীতা যদি রাবণের প্রাসাদে জরাপ্রাপ্ত হয়, রামের তবে শৌর্যহানি ঘটে, তাই। রাম নিজের শৌর্যহানি চায়নি বলেই রাবণকে হত্যা করেছে। রাম সূক্ষ্মধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি পরপুরুষ-ছোঁয়া নারীকে সে কী করে ধারণ করবে? তাই সীতা সৎচরিত্র অথবা দুশ্চরিত্র হোক, রামের পক্ষে তাকে ভোগ করা সম্ভব নয়। কুকুরে চাটা ঘি যেমন যজ্ঞে ব্যবহার করা যায় না, তেমনি পরপুরুষ-ছোঁয়া নারীও তার স্বামীর ‘ভোগে’ লাগে না।
আমার মনে হয়, রামই সীতার প্রতি সবচেয়ে অবিচার করেছে, এত অন্যায় পাষণ্ড রাবণও করেনি। রাম কখনও জানতে চায়নি রাবণ সীতাকে ধর্ষণ করেছে কি না, কেবল সন্দেহের বশে রাম সীতাকে অপবাদ দিয়েছে। কেবল নারীর সতীত্ব নিয়ে তুমুল হইচই, অথচ সতী শব্দের কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। তাই দীর্ঘ বিচ্ছেদের সময় রাম কি করেছে, কাকে ছুঁয়েছে বা কেউ তাকে ছুঁয়েছে কি না এ প্রশ্ন করবার স্পর্ধা কারও ছিল না।
নিজের সতীত্ব বা শুচিতা প্রমাণের জন্য সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রজাদের সন্দেহ ঘোচাবার জন্য বাল্মিকী সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষার কথা বলে। বেঁচে থাকলে সীতাকে সারাজীবন অগ্নিপরীক্ষাই দিয়ে যেতে হত, তার মুক্তি নেই কিছুতে, অসহায় নারীকে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে—এই অমার্জনীয় অপরাধ থেকে তার মুক্তি নেই।
সীতা পৃথিবীর কাছে আশ্রয় চেয়েছে। কোনও পুরুষ তাকে আশ্রয় দেয়নি। যোগ্য সম্মান দেয়নি। তাই কোনও পুরুষের কাছে, পুরুষশাসিত সমাজের কাছে সীতা আশ্রয় চায়নি। নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষা করবার জন্য সে চরম সত্যক্রিয়ার শপথ গ্রহণ করে নিজেকে বাঁচিয়েছে। তাবৎ অসত্য ও অন্যায় থেকে, অসম্মান থেকে এ তো এক ধরনের বেঁচে যাওয়াই।
পতি নারীর একমাত্র গতি। তার আছে স্ত্রীকে সন্দেহ করবার, ত্যাগ করবার এবং শাস্তি দেবার অবাধ অধিকার। সকল পুরুষের আছে নারীর চরিত্রে সন্দেহ করবার অধিকার, আছে সেই সন্দেহে নিরপরাধ নারীকে দণ্ড দেবার অধিকার। রামায়ণ নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয়নি, বরং এ শিক্ষাই দিয়েছে যে পুরুষের একনিষ্ঠতার দাবি সমাজ করে না, আর নারীর একনিষ্ঠতা দিয়ে, সতীত্ব বা শুচিতা দিয়েও সে সমাজে সম্মান পায় না—তাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে বারবার প্রমাণ দিতে হয় যে তার ‘সতীত্বনাশ’ হয়নি।
যেহেতু ‘সতীত্ব’ শব্দটি কেবল নারীর জন্য বাধা, যেহেতু সতীত্ব শব্দটি পুরুষের জন্য নয়, তাই পুরুষকে অগ্নিপরীক্ষার ঝামেলায় যেতে হয় না। নারীকে কেবল একা সতী হতে হয়, শুদ্ধ হতে হয়, এবং স্বামীর ভোগের জন্য নিজেকে যোগ্য করতে হয়।
সীতার সতীত্ব দেখে লোকে মুগ্ধ হয়। সীতার অগ্নিপ্রবেশে লোকে তৃপ্ত হয়। সীতার সত্যক্রিয়ায় লোকে প্রমোদিত হয়। নারীর চূড়ান্ত অবমাননা নির্লজ্জ অসঙ্কোচে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে রামায়ণ মহাভারতে। এই রামায়ণ মহাভারত দেখতে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সভ্যতা বলে পৃথিবীতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে লজ্জায় তারও সীতার মত উচ্চারণ করা উচিত–‘মাধবী দেবী (পৃথিবী) আমাকে বিবর (আশ্রয়) দিন। আমি যদি সত্য হই মাধবী দেবী আমাকে বিবর দিন ।’
২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
মহাভারতের প্রথম অংশের সঙ্গে শেষ অংশের ব্যবধান অন্তত আটশ’ বছরের। এই দীর্ঘ সময়ের সামাজিক বিবর্তন-চিত্রও ওতে বেশ স্পষ্ট। আদি ক্ষত্রিয় কাহিনী রচনার পর কিছু নৈতিক কাহিনী রচিত হয় যা সার্বজনীন, শেষতম সংযোজনের কর্তা ভৃগুবংশীয় ঋষিরা। এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে খ্যাত। নারীর অবনমনের চিত্র এই অংশে নগ্নরূপে উপস্থিত।
মহাভারতের এই অংশে খুব স্পষ্ট করে লেখা আছে নারী অশুভ, সমস্ত অমঙ্গলের হেতু, কন্যা দুঃখের (১/১৫৯/১১)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন–নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই। নারীর প্রতি পুরুষের কোনও স্নেহ মমতা থাকা উচিত নয় (১২/৪০/১)। পূর্বজন্মের পাপের ফলে এ জন্মে নারী হয়ে জন্মাতে হয় (৬/৩৩/৩২)। নারী সাপের মত, পুরুষের তাকে কখনোই বিশ্বাস করা উচিত নয় (৫/৩৭/২৯)। ত্রিভুবনে এমন কোনও নারীই নেই, যে স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/২০)। প্রজাপতির ইচ্ছা যে, নারী স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/১৪)। যে ছ’টি বস্তু এক মুহুর্তের অসতর্কতায় নষ্ট হয় তা হল–গাভি, সৈন্য, কৃষি, স্ত্রী, বিদ্যা এবং শূদ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ (৫/৩৩/৯০) ।
মহাভারতে সতী ও কর্তব্যপরায়ণ নারীর প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারী জন্মের চূড়ান্ত চরিতার্থতা হচ্ছে সেবা ও শুশ্রুষায় স্বামীকে তুষ্ট করা এবং তার সন্তান ধারণ করা, বিশেষ করে পুত্রসন্তান। বিবাহিতা নারীর যশ, চরিত্র ও গুণ নষ্ট হয়ে যায়, যদি সে নারী দীর্ঘদিন পিতার বাড়ি কাটায় (১/৭৪/১২)। পিতার বাড়ি দীর্ঘদিন কাটালে নারী কলঙ্কিনী হয় (৫/৩৯/৮০)। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেছেন—নারীর দ্বারা বংশ কলঙ্কিত হয় (১২/৪-৮)। কৃষ্ণ বলেছেন—নারী কলঙ্কিতা হলে বর্ণসংকর হয়, তার থেকে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয় (৬/২৩/৪১)।
নারী যেন সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান, গৃহকর্মে নিপুণ হয়। সে যেন স্বামীর জন্য, শ্বশুরকুলের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে এবং পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, এবং সেই সন্তানের লালনপালন করে। নারীর কোনও পৃথক মন, পৃথক ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই। মহাভারত আমাদের তো তা-ই বলে।
নারীর উপনয়ন হবার নিয়ম নেই। উপনয়ন হলে বিদ্যা অর্জন করতে হয়, নারীর বিদ্যা অর্জনের অধিকার নেই। নারীর জন্য বিবাহই হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস আর পতিসেবা হল বেদাধ্যয়ন (মনুসংহিতা ২/৬৭)।
মোদা কথা, নারীর কোনও অধিকার নেই শিক্ষা ও সম্পত্তিতে। নারী ব্যক্তি নয়, বস্তু এবং ভোগ্যবস্তু। তাই হাতি, হিরণ্য, রথ, অশ্ব, ভূমি ইত্যাদির সঙ্গে নারীও যোগ হয় দানের তালিকায়। এই দান চলে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, যজ্ঞে ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে। নারী হচ্ছে প্রলোভন, নারীর কামবৃত্তি স্বভাবতই পুরুষের চেয়ে অধিক (১৩/৩৮)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন—আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তারা তখন নারী সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করবার জন্য (১৩/৪২)।
নারী কেবল অমঙ্গলের জন্যই। এমন এক বিশ্বাস প্রচার করবার বড় এক দায়িত্ব নিয়েছে মহাভারত।
পাঁচ স্বামীকে তুমি কি করে তুষ্ট ও বশীভূত করেছ ? সত্যভামার এই প্রশ্নের উত্তরে দ্রৌপদী বলেছিল স্বামী এবং ভূত্যদের ভোজন শেষ না হলে আমি আহার করি না। স্নান শেষ না হলে আমি স্নান শেষ করি না। তিনি না বসলে আমি বসি না। স্বামীই দেবতা, স্বামীই গতি, আমি স্বামীদের চেয়ে বেশি শয়ন, ভোজন ও অলঙ্করণ করি না। শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করি না। সব সময় বশবর্তিনী হয়ে থাকি (২০/২৩/২৮/৩৫/৩৬)।
স্ত্রীর জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গ নিষিদ্ধ করবার কারণ স্বামীর ঔরসজাত সন্তান-সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এই কামনা কী ভীষণ উৎকট ও উদগ্র হলে একথা বলা হয় যে—যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনও চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন করে না সে-ই ধর্মচারিণী (১২/১৪৬/৮৮)। পরপুরুষ তো নয়ই, প্রকৃতির আলো হাওয়াও যেন নারীর গায়ে না লাগে, নারীর জন্য এমনই অন্ধকার সংসার কূপকেই বলা হয়েছে সবচেয়ে পবিত্র।
নারীর বশবর্তিনী রূপ সকলে বেশ উপভোগ করে। কুকুর বা বেড়াল পোষ মানলে তাকে ঘরে স্থান দেওয়া হয়, একই রকম নারীকেও।
আসলে রামায়ণ মহাভারত সব গল্প শেষে একটি সিদ্ধান্তে এসে স্থির দাঁড়ায়—তা হল—ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি, স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।
২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
মসজিদের গেটে এক ধরনের সাইনবোর্ড থাকে। দূর থেকে এতকাল ভেবেছি সাইনবোর্ডে নিশ্চয় লেখা ‘গরু ছাগলের প্রবেশ নিষেধ।’ আসলে তা নয়। একদিন কাছ থেকে দেখেছি ওতে লেখা–মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। সম্ভবত জন্তু ও মহিলাদের ব্যাপারেই যাবতীয় নিষেধ জারি হয়।
একটি ছোট্ট শহরে জন্ম আমার। শহরের কিনার ঘেঁষে চলে গেছে ক্ষীণাঙ্গী ব্ৰহ্মপুত্র। নদীতীরে কেটেছে আমার অপরূপ শৈশব। সারা বিকেল বালুর ঘর বানিয়ে সন্ধের মুখে সেই খেলাঘর ভেঙে বাড়ি ফিরেছি সবাই। তখন ন-দশ বছর বয়স, মা রান্না করছেন, হঠাৎ আদা নেই, লবণ নেই-বাড়ির কাছের দোকানে আমাকেই যেতে হত। সকালে মুড়ি খাব, দুপুরে তেঁতুল, বিকেলে বাদাম—সবই দৌড়ে দৌড়ে আমাকেই কিনতে যেতে হত। দিন যাচ্ছে, হঠাৎ একদিন কোনরকম কারণ ছাড়াই আমাকে মোড়ের দোকানে যাওয়া নিষেধ করা হল। কেন নিষেধ, কেন নিষেধ–খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, আর বড় হয়ে গেলে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঘরে বসে অবসর সময়ে ধর্মের বই পড়তে হয়, ঘরের টুকটাক কাজকর্ম করতে হয়। তখন থেকেই নিষেধ শুরু হল আমার ওপর। শুধু আমার কেন, তখন থেকেই নিষেধের লাল বৃত্ত আঁকা হয় প্রতিটি মেয়ের চারদিকে।
একটু একটু করে বড় হচ্ছি। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিষেধ, বিকেলে ছাদে ওঠা নিষেধ, কখনও কখনও আদা ছাড়া পিঁয়াজ ছাড়াই রান্না হচ্ছে তবু আমার মোড়ে যাওয়া নিষেধ। একদিন ঘরে পরবার জন্য দেখি আমার জন্য তিনটে পায়জামা তৈরি হচ্ছে। এত পায়জামা অথচ আমাকে না জানিয়েই, আমি আনন্দ এবং বিস্ময় দুইই প্রকাশ করলাম। মা বললেন তোমার জন্য আজ থেকে হাফপ্যান্ট নিষেধ। নিষেধ বাড়ছে। একদিন দুপুরে মা তার একটি শাড়িকে চার টুকরো করে এক টুকরো আমার দু’কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন, বললেন এখন থেকে ঘরে পরবে। অর্থাৎ আমাকে ওড়না পরতে হবে। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। মা নির্বিকার।
একবার রজঃস্রাবের সময় আমি কোরান শরীফ ছুঁয়েছিলাম বলে মা আমার গালে কষে দুটো চড় লাগালেন। বললেন–নাপাক শরীরে পবিত্র জিনিস ছুঁতে হয় না। মা প্রায়ই বলতেন কুকুর হচ্ছে নাপাক জিনিস। সেদিন বুঝলাম মেয়েরাও সময়ে নাপাক হয়।
আমাদের বাড়ির মাঠে ছিল আম, জাম, কাঠাল, পেয়ারার বিশাল বাগান। ছোটবেলায় গাছে চড়বার অদম্য এক শখ ছিল আমার। যতদিন শিশু ছিলাম ; গাছে ঝুলেছি, খেলা করেছি, সবাই মেনে নিয়েছে। যখন থেকে বড় হয়ে গেছি বলে মনে হল তখন থেকে আমার গাছে চড়া নিষেধ। মেয়েদের নাকি গাছে চড়তে নেই। মেয়েরা গাছে-চড়লে গাছ মরে যায়।
গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে মামাবাড়ি গিয়ে আমার ছোট মামার ঘরে একদিন ক্যাপস্টেন সিগারেটে দুটান দিয়েছিলাম, ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে বড়দের কিল-চাপড় থেকে আমার পিঠের কোনও অংশও বাদ পড়েনি। সকলে বললেন—মেয়েদের সিগারেট ছোঁয়া বারণ।
আমি যখন স্কুলে উপরের ক্লাসে পড়ি, এক সকালে স্কুলে যাবার পথে আমার হাতে একটি চিঠি গুজে দিয়েছিল সমবয়সী এক ছেলে। চিঠিতে লেখা আমাকে খুব ভাল লাগে তার। তাই প্রতিদিন সে সকাল বিকাল দাঁড়িয়ে থাকে পথে। আমার অভিভাবকবৃন্দ এর পরদিন থেকে আমার সঙ্গে বাড়তি একটি লোক দিলেন, সে আমাকে স্কুলে দিয়ে যায় আবার ছুটি হলে নিয়ে যায়। স্কুলে এক যাতায়াতে নিষেধ শুরু হল।
আমাদের কলেজে গগন নামে এক দারোয়ান ছিল। ছেলেদের কলেজ থেকে যে যখন ইচ্ছে ক্লাস করে রেরিয়ে আসত, আর আমাদের গগনচন্দ্র একটি টুল পেতে সারাদিন বসে থাকত গেটে, বেরোতে গেলেই বাধা দিত। অনুযোগ করতাম—আনন্দমোহন থেকে তো ছেলেরা বেরুচ্ছে! গগন বলত—মেয়েদের কলেজে ওই নিয়ম নেই। অর্থাৎ ভাল লাগুক না লাগুক দশটা থেকে পাঁচটা তাকে কলেজে বসে থাকতে হবে। গগন দারোয়ান এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। সে তার চাকরিজীবনে বিকেল পাঁচটার আগে কোনও কলেজ ছাত্রীকে গেটের বাইরে যেতে দেয়নি। সেও বুঝত মেয়েদের অত স্বাধীনতা থাকতে নেই—যখন ইচ্ছে বেরোবার, যখন ইচ্ছে ঢুকবার।
একবার বড় একটি গানের দল এসেছিল আমাদের শহরে। তখন আমিও বেশ বড়। বাড়িতে প্রস্তাব করলাম এই অনুষ্ঠানে আমি যাব। অনুষ্ঠানটি রাতে হবে বলে আমার যাবার অনুমতি মিলল না। কারণ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য একটি পুরুষ দরকার। কারণ সন্ধের পর নাকি এক কোনও মেয়ের ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
একদিন কী একটি বিষয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার তর্ক হচ্ছিল। দুজনের স্বর একসময় সপ্তমে ওঠে। কিন্তু অভিভাবক এসে আমাকেই প্রথম থামতে বললেন, কারণ আমি যে খুব অযৌক্তিক কথা বলেছি তা নয়—আমাকে থামাবার কারণ মেয়েদের অত উচ্চকণ্ঠ হতে নেই। যে কোনও আবেগ ও উত্তেজনার মাত্রা মেয়েদের কিছু কম থাকতে হয়। যে কোনও ব্যাপারেই মেয়েদের অধিক সংযত হতে হয়।
এক আত্মীয়ের কাছে কোনও এক দুপুরে তাস খেলা শিখেছিলাম। বাড়িতে মাঝে-মধ্যে যখন তাসের আসর বসত আমাকে ধারে-কাছে আসতে দেয়া হত না। অথচ এই খেলাটি আমি জানি এই দাবি জানালেও আমাকে কাছে আসতে দিত না কেউ। কারণ খেলাটি জানলেও এবং সকলের চেয়ে ভাল খেললেও আমি মেয়ে বলে আমাকে তাস খেলায় কেউ রাখত না। খেলাটি মেয়েদের জন্য নিষেধ। একবার আমাদের বাড়িতে আমার পরিচিত দুজন ছেলে বেড়াতে এসেছিল। ভদ্রতার খাতিরে দু’কাপ চা দেব ভেবেছিলাম, সম্ভব হয়নি কারণ ভেতর ঘরে তখন আমার অতিথি নিয়ে ঝড়ঝঞ্জা শুরু হয়ে গেছে—কারা এরা, কেন এসেছে, কি চায় ইত্যাদি প্রশ্নবাণে আমাকে আহত হতে হচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঠিক তার পরদিনই আমার দাদার দুই বান্ধবী যখন বাড়িতে এল বাবা নিজে বসে মেয়ে দু’জনের নাম জিজ্ঞেস করলেন, মা নিজ হাতে ডিমের হালুয়া রাধলেন। দাদার ঠোঁটের কিনারে একটি হাসির রেশ তিনদিন পর্যন্ত ঝুলে ছিল।
কি কি কাজ মেয়েদের জন্য নিষেধ, এবং কি কি নিষেধ নয় তার নির্ধারক কখনও মেয়ে নয়। সমাজপতি বলতে যাদের বোঝায় তারা পুরুষ। মেয়েরা যে কাজ করতে এগোয় অথবা পেছোয় সবই তাদের পছন্দ অনুযায়ী। তাদের পছন্দ হল না তো মেয়েরা মরল। সামাজিক নীতিবাক্যে মেয়েদের জন্য যত নিষেধ বর্তমান, তুলনায় পুরুষের জন্য শতকরা এক ভাগ নিষেধও নেই। ধর্মে মেয়েদের জন্য যত নিষেধের বাণী উচ্চারিত হয়েছে, কোনও পুরুষের জন্য তার সহস্ৰ ভাগের এক ভাগও উচ্চারিত হয়নি।
আমার কৈশোর ও তারুণ্য যে সব নিষেধের মধ্যে কেটেছে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত মেয়েই এইসব নিষেধের মুখোমুখি হয়। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মেয়েদের নিষেধের ধরন আলাদা। ধরন আলাদা হলেও নিষেধ নিষেধই। লোকে বলে তা পালন করা প্রতিটি মেয়ের নাকি ‘অবশ্য কর্তব্য’ ।
২৯. নারী এবং খাদ্য-বস্তু
পদার্থ তিন প্রকার, কঠিন, তরল ও বায়বীয়। নারীরও কিন্তু প্রকার আছে। নারী চার প্রকার। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্ৰিণী, হস্তিনী। এই প্রকারগুলো নারী-শরীরের আকৃতির ওপর ভিত্তি করে রাখা। নারীর আকৃতি বহু মূল্যবান একটি বিষয়। পুরুষেরা একেকটি আকৃতি নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। শরীর দ্বারা নারী যত পরিচিত, অন্য আর কিছু দ্বারা নয়। মানুষের অর্থাৎ পুরুষের স্বায়ুতন্ত্র যখন প্রথম কাজ করতে শুরু করে সম্ভবত তখন থেকেই নারীকে অতি সুস্বাদু একপ্রকার ফলের মত ব্যবহার করবার ইচ্ছে জাগে। তাকে যেন তেঁতুলের মত চোষা যায়, পেয়ারার মত কামড় দেওয়া যায়, আনারসের রসের মত চুমুক দেওয়া যায়। নারী যদি চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় না হল—তবে আর নারী কেন ?
নাট্যকার এস.এম. সোলায়মানের একটি নাটকে এক মৌলবাদী নারীকে কলার সঙ্গে তুলনা করেছে। কলা যখন খোসা দ্বারা আবৃত থাকে, তখন সে সুন্দর, খোসা খুলে গেলে কলার মত নারীও বেপর্দা হয়।
ভিয়েতনামের এক কবি হে চুয়ান হুয়োং নারীকে কাঁঠালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন, কাঁঠালের রস যেমন মিষ্টি নারীও তেমনি মিষ্টি। কিন্তু তাকে খেতে গেলে হাতে যে আঠা লাগে তা এত বিশ্রী যে তা খেতে যাবার আগে সাবধান থাকতে হয়। পুরুষেরা তাদের পছন্দমত নাম দিয়েছে নারীর। নাম দিয়েছে রম্ভোরূ—যার অর্থ কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর উরু বিশিষ্ট রমণী। নাম দিয়েছে পীনোস্তনী—অর্থাৎ সুউচ্চ স্তনবিশিষ্ট নারী। নাম দিয়েছে বরারোহা—যার অর্থ সুডৌল ও সুস্পষ্ট নিতম্ব বিশিষ্ট সুন্দরী। সুগঠিত নিতম্বধারীর আরেক নাম সুশ্রোণী। নাম দেওয়ার ধরন দেখলে আমাদের অনুমান করতে অসুবিধা হয় না মূলত যৌন সম্ভোগের বস্তুরূপেই নারীর পরিচয়। তাকে তার স্তন, নিতম্ব, উরু দ্বারা পরিমাপ করা হয় এবং নামকরণ করা হয়। নারীর বর্ণনাত্মক সম্বোধনগুলোর অধিকাংশই দেহের অনুষঙ্গ বহন করে।
‘পুর’ শব্দটির অর্থ গৃহ। গৃহের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ করা হয়েছে যে নারীর বিভিন্ন নামে ‘পুর’-এর আধিক্য দেখি–যেমন, অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পুরস্ত্রী, পৌরস্ত্রী, পুরমহিলা, পুরবালা, পুরবাসিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, পৌরাঙ্গনা, পুরন্ধি (পতি-পুত্রবতী স্ত্রী)।
‘It’s a man’s world, woman’s place in the home’—এটা খুব পুরনো কথা। পুরনো জিনিস আজকাল আর খাটে না, চারদিকে নতুনের জয়জয়কার। কিন্তু নারী সম্পর্কিত আদিবচনগুলো দিন দিন শান্ দিচ্ছে শব্দে।
গৃহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নারীর আরও একটি নাম দেওয়া হয়েছে—গৃহিণী। কবি ফরহাদ মজহার বলেন, তারা গৃহে গৃহে আসবাবপত্রের মত শোভা পায় বলে তাদের নাম গৃহিণী। (দ্রষ্টব্য : আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিপ্লবের সামনে)। নারীর সঙ্গে রমণের সম্পর্কও খুব গভীর, পুরুষেরা নারীকে যৌন সামগ্ৰী হিসেবে অধিক বিবেচনা করে, তাই নিদ্বিধায় তার নাম দেওয়া হয়েছে রমণী।
মহিলার সঙ্গে মহল, অঙ্গনার সঙ্গে অঙ্গন (আঙ্গিনা)-এর সম্পর্ক বড় নিবিড় বলে ভাবা হয়। তাই মহিলা বা অঙ্গনার সীমানা মহল এবং অঙ্গন পর্যন্তই বেঁধে দেওয়া হয়। বসবাস এবং বিচরণের সীমাবদ্ধতা নিয়েও নারীর নামকরণের কৌতুক চলে।
নারীদেহ শুধু মানুষ কেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কোরানে বর্ণনা করেছেন—তাহদের জন্য থাকিবে পানপত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ-নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা; তাহদের পছন্দমত ফলমূল, তাহদের ঈঙ্গিত পাখির মাংস; আর তাহদের জন্য থাকিবে আয়তলোচনা হুর, সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ (সূরা ওয়কি’আ ১৮/২১/২২/২৩)।
তাহারা যেন প্রবাল ও পদ্মরাগ (সূরা রাহমান ৫৮)। স্বর্গের নারীদের চোখ বড় ও সুন্দর—তারা আয়তলোচনা। তারা সুরক্ষিত, মানুষ এবং জীন পূর্বে তাদের স্পর্শ করেনি, তারা মুক্তার মত গৌরবর্ণ। প্রবাল, পদ্মরাগ, মুক্ত মূল্যবান রত্নবিশেষ। নারীকে এইসব ধাতুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নারীকে সুরা, ফলমূল ও মাংসের কাতারে উপস্থিত করা হয়েছে। শুধু স্বর্গে কেন, মর্ত্যের নারীকেও রত্ন উপাধি থেকে নিস্তার দেওয়া হয়নি। পুরুষ বড় আহ্লাদ করে নারীকে রমণীরত্ন, নারীরত্ব, স্ত্রীরত্ব ইত্যাদি নানা নামে ভূষিত করেছে। রত্ন হচ্ছে মূল্যবান বস্তু, নারীও এ জগতের ভোগ্যবস্তু হিসেবে বড় মূল্যবান।
পুরুষ শব্দের সঙ্গে যে শব্দের ব্যবহার হয় তা শক্তি ও শৌর্যের প্রতীক। যেমন—পুরুষোত্তম, পুরুষসিংহ, নরশার্দুল, নরপুঙ্গব, পুরুষপুঙ্গব, পুরুষপ্রধান, পুরুষপুণ্ডরীক, নরকেশরী ইত্যাদি। উল্লিখিত সম্বোধনে সিংহ, শার্দুল (বাঘ), পুঙ্গব (ষাড়), কেশরী (সিংহ), শ্রেষ্ঠ, প্রধান ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বোঝানো হয় পুরুষ পরাক্রমশালী, বীর্যবান। ওদিকে অবলা অর্থ বলহীনা, অবলা অর্থ নারী। এই সম্বোধনে স্পষ্ট হয় নারী দুর্বল।
পরস্পরের সহযোগিতায় অবস্থানকারী মনুষ্য সংঘকে সমাজ বলে। আবার প্রাণীর দলকেও বলা যায়, যেমন পশুসমাজ, পক্ষিসমাজ। মানবজাতি ও মানবসমাজের মত স্ত্রীজাতি, নারীজাতি, মহিলাসমাজ, নারীসমাজ, নারী সম্প্রদায় ইত্যাদিও বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এই ব্যবহারের একটিই কারণ তাকে পৃথক করা। জাতি বলতে বুঝি জন্ম, উৎপত্তি। মানুষের ভ্রূণ থেকে যদি নারীর জন্ম হয়ে থাকে তবে সে কেন স্ত্রীজাতি ও নারীজাতি বলে মানবজাতির বাইরে পৃথক একটি জাতি হিসেবে পরিচিত হবে ? যেন স্ত্রীরা মানবের বাইরে, যেন নারী আদপে মানুষ নয়। সে আলাদা জাতি, আলাদা সমাজ ।
অভিধান থেকে যদি এই বিভেদ মোচন করা না যায় তবে মানুষের সংস্কার থেকে কেন যাবে, রক্তমাংস থেকে কেন যাবে ? এইসব বৈষম্য জলজান্ত রেখে যে নারী দাবি তোলে নারী স্বাধীনতার, তার মত নিবোধ আর কে আছে! আভিধানিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি কে দেবে তাকে, যদি না সে নিজে এসব অশ্লীল অভিধানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবার সাহস অর্জন করে।
৩০. মেয়েদের ‘চরিত্র’
ছেলের দুর্নামের চেয়ে মেয়ের দুর্নামের প্রকৃতি ও পরিণতি খুব ভয়ঙ্কর হয়। ধরা যাক একটি ছেলে খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির, যেমন নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই, ঘরে মন বসে না, বাইরে টো-টো করে ঘোরে। এই শব্দাবলি একটি ছেলের চরিত্র বর্ণনে ব্যবহৃত হলে ছেলেটির জন্য মানুষের মায়া হয়, কিন্তু একটি মেয়ের বেলায় তা ব্যবহৃত হলে অধিকাংশ মানুষ নাক সিঁটকোয়।
মেয়ে মাত্রই সময়মত নাওয়া-খাওয়া করতে হবে। গায়ের ময়লা ঘষে-মেজে সাফ করতে হবে। খেতে বসে বড় বড় মাছ-মাংস পাতে তুললে খারাপ দেখায়। লক্ষ্মী মেয়ের মত অল্প খেয়ে উদর পূর্তি না হোক, হৃদয় পূর্তি করতে হবে। মন বসাবার উপাদান না থাকলেও ঘরে মন বসাতে হবে। নিয়মিত রান্নাবান্না, সেলাই-কর্ম ইত্যাদির পাশাপাশি সংসারের সৌন্দর্য বর্ধনে সক্রিয় হতে হবে। এই না হলে কী মেয়ে।
একটি ছেলের যদি ঘরে মন না বসে, তাতে অন্যায় নেই, কিন্তু একটি মেয়ের যদি তা হয়—তবে আর মুখরক্ষা হয় না। ছেলেদের বিকেল-সন্ধ্যা আড্ডা দেওয়া খুব গ্রহণযোগ্য ঘটনা। একটি মেয়ের যদি সারা বিকেল আড্ডা দেবার অভ্যাস হয় তবে ঘরে বাইরে তার আর সম্মান থাকে না।
প্রায় ছেলেই ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ে দেখে। আমি একবার রাস্তায় একটি সুদর্শন ছেলেকে বার বার পিছন ফিরে দেখছিলাম। আমার সঙ্গের আত্মীয়টি এতে ছিছি করে উঠল, বলল—মেয়েদের এমন ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলে দেখতে হয় না। লোকে খারাপ বলে। আমি বললাম—ছেলেরা যে আমাদের দেখে ?
আমার আত্মীয় বলল—ওরা দেখলে ক্ষতি নেই। ওরা ছেলে।
ওরা ছেলে বলে সাত খুন মাফ। আমি মেয়ে বলে চমৎকার সুদর্শন একটি ছেলের দিকে বার কয়েক তাকাতে পারব না।
ছাদে দাঁড়িয়ে যে কিশোরী পাশের ছাদের ছেলের সঙ্গে হেসে কথা বলে, পাড়ায় সেই ছেলের নামে নয়, কিশোরীর নামে টি-টি পড়ে যায়। ছেলের কাছ থেকে দু’দিস্তা কাগজের চিঠি পেয়ে যদি মেয়ে একটি চিরকুট লেখে, সেই লেখার জন্য ছেলে হয়ত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়, কিন্তু মেয়ের কপালে জোটে অভিভাবকের চড়-থাপড়। উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করে ছেলে যে উদ্যমে ঘরে ফিরতে পারে, মেয়ে তা পারে না। তার পদক্ষেপ হ্রস্ব ও নিঃশব্দ হয়, তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, কারণ জানাজানি হয়ে গেলে পাড়ায় আর মুখ দেখানো যাবে না।
ছেলে এবং মেয়ের কোথাও রাত্রিবাস ঘটলে ছেলে খুব সহজেই নিস্তার পায়, মেয়ের দুর্নাম কলের কালো ধোয়ার মত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মেয়ের তখন সমাজ-সংসার সব যায়।
ছেলে ও মেয়ে যদি আবেগে ঘনিষ্ঠ হয়, তবে সামাজিক দুর্ভোগ তো আছেই শারীরিক দুর্ভোগও ওই মেয়েকে একাই ভোগ করতে হয়। অর্থাৎ মেয়েটি গর্ভবতী হয়। ঘটনার সঙ্গী তখন ঝাড়া হাত-পা। কোনও দায় নেই, দায়িত্ব নেই।
দু’জনের একই কর্মে, একই ঘটনায় হয় ভিন্ন ফলাফল। ছেলের গায়ে ধুলোবালির মত যা লেগে থাকে তা ঝেড়ে ফেললেই পরিষ্কার, আর দুর্নামের যে কালি মেয়ের মুখে পড়ে, সামাজিক কোনও সাবান নেই তা ধোবার।
প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে তা জানি। প্রতিক্রিয়ার পার্থক্য হয় বিভিন্ন বস্তুতে। কিন্তু সে যদি জড় না হয়ে জীব হয়, যদি সে পশু না হয়ে মানুষ হয়—তবে মানুষে মানুষে প্রতিক্রিয়ার এত পার্থক্য কেন। দুর্নাম কেন মেয়ের একার, ছেলের নয় ?
একবার এক মাতাল ও বহুগামী স্বামীর সংসার ত্যাগ করে চলে আসে এক মেয়ে, মেয়েটি ভেবেছিল সমাজ তাকে আশ্রয় দেবে। অভিভাবকেরা মেয়েটিকে খাবার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সংসার ত্যাগের জন্য যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি, বক্রোক্তি, ব্যঙ্গোক্তি—এসব থেকে তাকে রেহাই দেয়নি। মেয়েদের ঘর থেকে ঘর বদলানোই একরকম নিরাপত্তা বলে ভাবা হয়। তাই নিরাপত্তার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সকল কর্তাব্যক্তিরা তাকে কায়দা করে দ্বিতীয়বার ঘর করতে পাঠায়।
মেয়েদের বিয়ে লটারির মত একটি ব্যাপার। স্বামী একগামী কি বহুগামী, স্বামী মদ্যপ কি মদ্যপ নয়, স্বামী বউ পেটাবে কি পেটবে না, স্বামী সন্তান জন্মে সক্ষম কি অক্ষম ইত্যাদি কিছুই না জেনে একটি মেয়ে সারা জীবনের জন্য তাকে গ্রহণ করে। ওই মেয়েটির দ্বিতীয় স্বামী অর্থলোলুপ, বর্বর, হীনমন্য নপুংসক এক লোক। মেয়েটি বেরোতে চায় সকল শৃঙ্খল ভেঙে। মেয়েটি বাইরের আলো-বাতাসে এসে বাঁচবার নিঃশ্বাস নিতে চায়। নারকীয় জীবন থেকে মেয়েটি মুক্তি চায়। কিন্তু পারে না। পারে না দুর্নামের ভয়ে। কারণ ঘর থেকে বেরোলেই দুর্নাম হবে মেয়ের, ছেলের নয়।
কোনও পশু-স্বভাবী পুরুষ নারীকে যত অত্যাচার করুক, দোষ হয় না। দোষ হয় অত্যাচারিতের। কারণ পুরুষ যত অত্যাচারীই হোক, তার সাত খুন মাফ।
৩১. ‘মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়’
পুরুষ পাঠককে বলছি, ধরুন কোনও এক মেয়ে আপনার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছে বলে আপনার মনে হল অথবা করেনি, দেখে শুনে আপনার বোধ হল মেয়েটির বড় অহঙ্কার, মাটিতে পা পড়ে না, উটে হেঁটে বেড়ায়, কোথাও ফিরে তাকায় না, কারুকে পাত্তা-টাত্তা দেয় না—তখন প্রতিশোধ নিতে চাইলে ভাল একটি উপায় আপনার হাতে আছে। মেয়েটি আপনাকে গ্রাহ্য করে না, না করুক—এতে আপনার কিছু অসুবিধে নেই। আপনি মোটেও এ নিয়ে ভাববেন না। আপনি পুরুষ–পৌরুষ আপনার রক্তে টগবগ করে ফুটছে। আপনার হাতে মারাত্মক একটি অস্ত্র আছে যা ব্যবহার করে মেয়েটির সমস্ত অহঙ্কার অথবা সারল্য যা-ই বলুন না কেন একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারেন। শুধু তাই নয়, মেয়েটির মেরুদণ্ড যদি দৃঢ় হয়, তবে তা গুঁড়িয়ে দেবার এবং মেয়েটির মাথা যদি উঁচু হয় তবে তা নত করবার ক্ষমতাও আপনি রাখেন।
কোনও রামদা বা ছোরার দরকার নেই, ওসবের ঝামেলায় যাবেন না, কারণ কুপিয়ে মারলে আবার কি সব মামলা-মোকদ্দমা শুরু হবে, খামোক কিছু গাটের পয়সা খরচা পিস্তলেও বিপদ কম নয়। গুলির শব্দে একশ একটা লোক এসে হাজির হবে। আজকাল নাকি এসিডও তেমন ভাল ফল দিচ্ছে না। চোখ ঠিক অন্ধ হচ্ছে না—গালটা জুতসই মত পুড়ছে না—হাতের টিপ ভাল না হলে ওতে কোনও ফায়দা নেই।
নিশ্চয় খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি সেই মোক্ষম অস্ত্ৰ ! কি সেই অস্ত্র—যে অস্ত্র আধুনিক কোনও আয়ুধ নয়—যা সচরাচর ব্যবহৃত হয়। ফাঁসির দড়ি নয়, শক্ত কব্জির যে দুই হাত—যে হাতে সুযোগ মত টিপে ধরা যায় কণ্ঠদেশ–তাও নয়। নাকি গলা কাটার ব্লেড, নাকি জুতো–ফাঁক বুঝে ছুঁড়ে মেলা যায় ? না, ওসবের কিছু নয়। আমি নিশ্চিত, পুরুষ পাঠক যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের শতকরা একশ জনই জানতে চাচ্ছেন হাতের মুঠোয় আছে অস্ত্রটি কি। আসলে হাতের মুঠোয় বলা ঠিক হবে না, অস্ত্র আপনার জিভের ডগায়। বেশি নয়, আপনাকে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করতে হবে। কেবল একজন কারও সামনে আপনি বাক্যটি উচ্চারণ করবেন। ওই বাক্যটিই আপনার অস্ত্র, যে অস্ত্র দ্বারা আপনি আপনার গন্তব্যে অগ্রসর হবেন। যে বাক্যটি ঘটনার চূড়ান্ত সাফল্য ডেকে আনবে তা হল— মেয়েটির চরিত্র ভাল নয়। ব্যস, কেল্লা ফতে। এবার আপনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরুন কি দরজা বন্ধ করে নিরিবিলি ঘুমিয়ে পড়ুন—আপনার আর দরকারই পড়বে না ওমুখে হবার কারণ বাক্যটি একই বাকি কাজ সেরে নেবে। যাকে বলে ‘একাই একশ’ । যে কোনও পার্থিব অস্ত্ৰ-বস্তুর চেয়ে সে অধিক ধারালো, অধিক তীক্ষ্ণ।
বাক্যটি একই সঙ্গে এত সুমিষ্ট যে, মানুষ তাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় এক ঘর থেকে আরেক ঘরে, এক উঠোন থেকে আরেক উঠোনে, এক আড্ডা থেকে আরেক আড্ডায়, এক শহর থেকে আরেক শহরে। চরিত্ৰ—যদি সে নারীর চরিত্র হয় তবে তার মত ঠুনকো কাচ আপনি কোথাও পাবেন না। সে এত ঠুনকে যে তার উদ্দেশ্যে ফুঁ দিলেই তা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে। আপনার চিন্তিত হবার কিছু নেই। কারণ এর জন্য কোনও সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার হয় না, কোনও কাঠগড়া নেই, কোনও জেল জুলুম নেই।
পুরুষ পাঠক, ধরুন, আপনি অস্ত্রটি ব্যবহার করলেন। এবং এর ফলে মেয়েটিকে কি কি অসুবিধে ভোগ করতে হচ্ছে তা কেবল আপনি তখনই উপলব্ধি করবেন, যদি আপনি নতুন করে মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তা না হলে আমার কোনও সাধ্য নেই আপনাকে বোঝাই মেয়েটি এখন সামাজিকভাবে এই এই অবস্থায় আছে। একেবারে যে আপনার বুঝবার কোনও উপায় নেই তা নয়—উপায় একটি আছে, যদি কোনও পরিবারে আপনি বসবাস করেন এবং আপনার একটি বোন সেই পরিবারে বড় হয় তবে তার নামে এরকম একটি বাক্য আপনি নিজে ছড়িয়ে দিয়ে বেশ চমৎকার উপভোগ করতে পারেন এই বাক্য কোথায় এবং কতদূর যায় এবং কী কী ঘটায়। বাক্যটির পেছনে আপনি লেজের মত লেগে থাকুন এবং লক্ষ্য করুন, নিশ্চয় আপনি নিশ্চিত হবেন যে, যে অস্ত্রটির কথা আজ আপনাকে শোনালাম তা নেহাত মন্দ নয়।
‘চরিত্র’ খুব মূল্যবান একটি জিনিস। পুরুষের জন্য তা আগলে রাখবার প্রয়োজন না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজন। নারী তাকে সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখলে গচ্ছিত জিনিসটি চড়া দামে বিক্রি হয়। চরিত্র এখন একটি লাভজনক বাণিজ্যের ব্যাপারে দাড়িয়েছে। আর তা নিয়ে বাণিজ্য করছে আমাদের সমাজের ধুরন্ধর সওদাগরেরা।
পুরুষ পাঠকের সঙ্গে কথা আপাতত শেষ। এবার মেয়ে পাঠককে বলছি—পুরুষদের যে কায়দা-কানুনগুলো শেখালাম আসলে কিন্তু তারা আমার চেয়েও এর প্রয়োগ প্রক্রিয়া ভাল জানে। তবু শেখালাম এই কারণে যে তারা জানুক যে তাদের প্রক্রিয়া আমি অর্থাৎ মেয়েরাও জেনে গেছি। যে রহস্যটা ফাঁস হয়ে যায় তার ধার আপনাতেই কিছু কমে আসে।
সবশেষে মেয়ে পাঠকের উদ্দেশ্যে চরিত্র নামের একটি কবিতা নিবেদন করছি—
‘তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখ
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে,
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে,
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।’
৩২. ওড়না
১. আমার বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সুবাদে ছোটবেলায় আমি তিন চারটে স্কুলে পড়েছি। প্রতিটি স্কুলেই স্কার্ফ থেকে শুরু করে পায়ের কেডস পর্যন্ত ছিল টিপটপ। এক রঙ জামার উপর ভাঁজ করা সাদা ওড়না। বেশ স্মার্ট লাগত নিজেকে।
স্কুল কলেজ পার করে খুব বেশি বড় হয়ে যাওয়া আমি, যখন রাস্তায় দেখি ঝাঁক ঝাঁক মেয়েরা আমার বালিকা-বেলার মত স্কুলে যায় আসে–দেখে আমার মন নেচে ওঠে। ধারণা করি টিফিন পিরিয়ডে ওরা নিশ্চয় দৌড়ে যাবে মাঠে; আমাদের সময় টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই মাঠের দাড়িয়াবাধা কোট দখল করত একদল, একদল বৌচি খেলার মাঠ, একদল পুকুর পাড়, একদল গাছের ডাল।
কিন্তু প্রায়শ আমি বিস্মিত হচ্ছি, বিস্মিত হচ্ছি এই লক্ষ্য করে যে, কোনও কোনও স্কুলের মেয়েরা স্কুল-পোশাকের ওপরও একটি বড় ওড়না বা কাপড় ব্যবহার করে। শরীরের উর্ধাংশ তারা ওই বাড়তি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। অশিক্ষিত এবং অল্প শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহিলারা ইদানীং এইসব চাদর ব্যবহার করছেন–কিন্তু স্কুলের কিশোরীর গায়ে এই বাড়তি জিনিস চাপানোর উদ্দেশ্য কি এবং উপদ্রবটি কেন ? আমার প্রশ্ন শুনে একজন বুদ্ধিজীবী উত্তর দিলেন–ইসলামিক দেশ তো তাই এই ব্যবস্থা।
সেদিন ঢাকা সিটি কলেজের মেয়েদের দেখি জামাকাপড়ের ওপর গোলাপি অ্যাপ্রোন চাপানো। কেন ? তারা কি সকলে বিজ্ঞানের ছাত্রী, ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা ? জানতে পারলাম সে কারণে নয়, রাষ্ট্রধর্মের কারণে মেয়েরা পর্দার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
একজন মানুষ, সে যদি মানুষ হয় তবে সে কি বস্ত্র পরবে বা না পরবে, তা সে-ই নির্ধারণ করবে। এতকাল যে পোশাকে মেয়েরা স্কুলে গেছে, তা কিছু অশালীন পোশাক ছিল না। এখন কেন ওপরে একটি চাদর চাপানো! লাহোরের রাস্তায় এই সেদিন পাকিস্তানের মেয়েরা তাদের বাড়তি কাপড় আগুনে পুড়িয়েছে।
অশিক্ষিত মেয়েরা কাপড়ের ওপর কাপড় চাপিয়ে নিজের জড়বুদ্ধি, স্থলদর্শিতা ও অনুর্বর মস্তিষ্ক ঢেকে রাখে। ধর্ম তাকে কুৎসিত বানিয়েছে, তাই ধর্ম তাকে ঢেকেছে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল না, এই অধিকার তারা অর্জন করেছে—এই অর্জিত অধিকার নিয়ে তারা বইখাতা হাতে দল বেঁধে লেখাপড়া করতে যায়, তারা আলোর পথে বেরিয়েছে—যেহেতু এখন আলো থেকে ফিরে যাবার উপায় নেই, তারা তাদের অন্ধকার করবার জন্য চাদর টানানো হচ্ছে।
মানুষ এগোলে, সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেই যারা তাকে পেছনে টানে। ধর্মীয় চাদর বা অ্যাপ্রোন দিয়ে তারা অগ্রসর মানুষকে পেছনে টানছে। কারণ, কেন এই জিনিসটি মেয়েদের পরতে হবে, তার কারণ খুঁজতে গেলে এমন কিছু উত্তর বেরোবে, যেগুলোর পেছনে প্রশ্নও কম নয়, আর প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তরই কোনও মেয়ের পক্ষে যায় না। মানুষ শিক্ষিত হলে সাধারণত সচেতন হয়। সচেতন মানুষ যে কোনও অন্যায় ও অসুন্দরের বিপক্ষে কথা বলবার যোগ্যতা অর্জন করে। যদি মেয়েরা সচেতন হয়ে ওঠে, যদি প্রতিবাদ করে নারীর ওপর রাষ্ট্র সমাজ ও ধর্মের নানা পীড়নের বিরুদ্ধে তাই নারীকে সংযমনের নতুন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।
ঘাসে পাথর চাপা দিয়ে রাখলে ঘাসের রং আর সবুজ থাকে না। বিবর্ণ হয়ে যায়। আর হলুদ বিবর্ণ মেয়েদের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্য বোধের আশাই করা যায় না।
মার্জিত পোশাক পরে মেয়েরা যখন স্কুল কলেজে যায়—তা যদি দৃষ্টিকটু হয়, তার চেয়ে দৃষ্টিকটু কতটুকু—যখন মসজিদে বালিকারা ইমাম দ্বারা ধর্ষিত হয়, যখন মাদ্রাসার ছাত্র দ্বারা কিশোর লাঞ্ছিত হয়, টুপি ও আলখাল্লা পরা আল্লাহর নেকবান্দা ঘরে পাঁচ বউ রেখে নিজের নাতনিকে পাটক্ষেতে ডেকে এনে ধর্ষণ করে। সারাদেশে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মহাদাপটে তাদের ব্যবসার শ্ৰীবৃদ্ধি করছে, অট্টালিকা তুলছে নানা রঙের বাণিজ্য করছে। রাষ্ট্র এবং সমাজের স্বনামধন্য বিত্তবান ব্যক্তিরা এইসব চটকদার ব্যবসা মহাসমারোহে টিকিয়ে রাখে এবং এই অশিক্ষিত, ভণ্ড, লোভী ও কামুক ব্যবসায়ীরা নারীকে ধর্মের নামে ভোগ ও বিলাসিতায় ব্যবহার করে।
এই যদি ধর্মের চর্চা দেশ জুড়ে, তবে ধর্মের এমন বোঝা নারী তার ঘাড়ে চাপাবে কেন? কোন অন্যায়ের জন্য তার স্বাধীনতা, তার রুচি ও ব্যক্তিত্ব, তার সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তা রোধ করা হবে? মানুষের প্রধান প্রয়োজন স্বাধীনতা। নারীর এই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র অবরোধ করছে। নারীর স্বাভাবিক বিকাশে ধর্ম এখন প্রধান অন্তরায়। ধর্ম মানুষকে পেছনে টানে, ধর্ম বিজ্ঞান ও প্রগতির বিপক্ষে কথা বলে। ধর্ম মানুষকে একটি অলৌকিক ভীতির ভেতরে ডুবিয়ে রাখে, ধর্ম মানুষকে হাসতে দেয় না, যেমন ইচ্ছে চলতে দেয় না। ধর্ম নারীকে অমানুষে পরিণত করে, ধর্ম নারীকে করে পুরুষের ক্রীতদাসী।
২. ‘দুনিয়ার সবকিছু ভোগের সামগ্ৰী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী নেক চরিত্রের স্ত্রী।’
‘যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম তবে নিশ্চয় সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহদের স্বামীকে সেজদা করে।’
‘তিন ব্যক্তির নামাজ বন্দেগী কিছুই কবুল হইবে না (১) যে গোলাম মনিবের নিকট হইতে । পালাইয়া গিয়াছে, সে মনিবের নিকট হাজির না হওয়া পর্যন্ত। (২) যে স্ত্রীর স্বামী তাহার উপর অসন্তুষ্ট, সে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত। (৩) নেশাখের নেশা ছাড়িয়া না দেওয়া পর্যন্ত।’
‘যদি কোনও ব্যক্তি সঙ্গম করিবার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তাহার । নিকট উপস্থিত হয়—যদিও সে উনানের উপর (রন্ধনের কাজে লিপ্ত) থাকে।’
‘যদি কোনও পুরুষের শরীর হইতে সর্বদা পূঁজ-রক্ত বাহির হইতে থাকে, আর তাহার স্ত্রী ঐ সমস্ত পুঁজ-রক্ত নিজের জিহ্বা দ্বারা চাটিয়া সাফ করিয়া দেয়, তথাপি পুরুষের হক আদায় হইবে না।’
‘যে স্ত্রীরা সর্বদা স্বামীদিগকে সন্তুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা করে, স্বামীর হক আদায় করিতে থাকে, স্বামীর সন্তোষ তলব করে ও স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী তাহার পায়রবি করে তবে সেই স্ত্রীরা পুরুষের জুম্মা, জামাত, হজ্জ ও ওমরার তুল্য সওয়াব পাইবে।’
‘যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহ শহীদের তুল্য সওয়াব দান করিবেন।’
‘যখন কোনও স্ত্রী তাহার স্বামীকে বলিবে যে, তোমার কোনও কার্যই আমার পছন্দ হইতেছে না, তখনই তাহার ৭০ বছরের এবাদত বরবাদ হইয়া যাইবে। যদিও সে দিবসে রোজা রাখিয়া ও রাত্রে নামাজ পড়িয়া ৭০ বছরের পুণ্য কামাই করিয়াছিল।’
‘বেহেশতবাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিম্ন পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরও আশি হাজার দাস এবং বাহাত্তর জন স্ত্রী থাকিবে।’
‘যদি স্বামী স্ত্রীকে আদেশ করে, তবে সে জরদ পর্বত হইতে কালো পর্বতের দিকে এবং কালো পর্বত হইতে সাদা পর্বতের দিকে ধাবিত হোক, তথাপি সেই আদেশ প্রতিপালন করা তাহার কর্তব্য।’
‘যখন কোনও ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তাহার শয্যার দিকে আহ্বান করে এবং স্ত্রী সেই আহানে সাড়া না দেবার জন্য যদি স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করিয়া থাকে, তবে প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রীলোকের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করিতে থাকেন।’
‘স্বামী তাহার স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, (১) স্ত্রীকে সাজসজ্জা করিয়া তাহার নিকট আসিতে বলার পর স্ত্রী তাহা অমান্য করিলে। (২) সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামীর আহ্বান পাওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করিলে। (৩) স্ত্রী ফরজ গোসল ও নামাজ পরিত্যাগ করিলে। (৪) স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারও বাড়িতে বেড়াইতে গেলে।’
উপরের উদ্ধৃতিগুলো মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর বাণী, যা পবিত্র হাদিস হিসেবে সন্মানিত। এরপরও যে নারী ধর্মের যাবতীয় বোঝাকে তার শরীরে এবং হৃদয়ে সাদরে বরণ করে, আমি সেই নিবোধ ও নির্লজ্জ নারীকে ধিক্কার না দিয়ে পারি না।
৩৩. সাতটি পয়েণ্ট
১. আমি ক’জন কমিউনিস্টকে চিনি তাঁরা ঘরের বউকে দুটো থালাবাসন আর শাড়ি-গয়নার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। প্রলেতারিয়েতের স্বাধীনতার কথা জোর গলায় বলে বেড়ান। আমি জানি না, তারা জানেন কি না যে লেনিন বলেছেন নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা না করে প্রলেতারিয়েত কখনও নিজেদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না।
২. কলকাতার এসটর হোটেল থেকে আমার এক বন্ধু অতসীকে ফোন করে বলেছিলাম–চলে এস। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শেক্সপিয়র সরণী। অতসী নানারকম কাজের কথা বলে আমার কাছে আসবার প্রসঙ্গটি সেদিন এড়িয়ে গেল। দিন পাঁচেক পর মুখ ফুটে বলেছে—আসলে বাসে চড়ে আমাদের অভ্যেস। আমরা ট্যাক্সি চড়ি না। ওতে ম্যালা পয়সা খরচা।
কলকাতার মোড়ে মোড়ে মেয়েরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাসে বসে, দাঁড়িয়ে, ঝুলে তারা চলাফেরা করে। পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই মেয়েরা বাসে চড়ে নিজের গতিকে দ্রুত করে। পৃথিবীতে একটিই শুধু অসভ্য দেশ আছে যে দেশের বাস মেয়েদের নেয় না। ‘লেডিস নাই’ বলে অপেক্ষমাণ মেয়েদের চোখে মুখে ধুলো উড়িয়ে বাস চলে যায়। অচ্ছুৎ প্রাণীদের বাস নেয় না। নেয় না বলে তারা হেঁটে পার হয় মহাখালি থেকে রায়ের বাজার, গুলিস্তান থেকে মোহাম্মদপুর, কমলাপুর থেকে শ্যামলি। অচ্ছুৎদের পক্ষে কে কথা বলবে, কে মিনতি করে বলবে—নাও, এই পাপ গ্রহণ করে নিজেকে মহৎ করো। চারদিকে সামান্য হই হট্টগোলে বাস পুড়ছে। অচ্ছুৎদের বুকের ভেতর আগুন নেই বলে ওরা বাস পোড়াতে পারে না। বুকের ভেতর আগুন থাকলে শুধু বাস কেন, বাসের ভেতরকার লাটসাহেবদেরও পোড়ানো যেত।
৩. সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতার অর্থ এখন উল্টো বোঝে। নারীর গৃহে ফিরে যাওয়াকে তারা এতকাল পর যৌক্তিক ভাবছে। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা—যে প্রতিযোগিতা নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করবার একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম—সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে তারা নারীর মুক্তি বলে রায় দিচ্ছে। মোহ মানুষকে কতটা অন্ধ করে, উন্মাদ এবং অবিবেচক করে—সোভিয়েতের এই অধঃপতন থেকে আমরা তা উপলব্ধি করি।
৪. পশ্চিমা নারী ও শিশুদের ইরাক থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ এরা অসহায়, অসহায় মানুষকে জিম্মি হিসেবে রাখা বীরত্বের লক্ষণ নয়। অসহায়দের ক্ষমা করে দিলে লোকে খুশি হয়। তাই সাদ্দাম হোসেন নারী ও শিশুদের নিরাপদে ঘরে পাঠিয়ে বিশ্ববাসীকে খুশি করেছেন।
নর্দমায় পড়ে থাকা পঙ্গু লোককে দয়া করে টেনে তুললে মহৎ কাজ করা হয়। আতুর খোঁড়াকে সময় সুযোগ মত সাহায্য করবার কথা ধর্মগ্রন্থও বলে। ‘লেডিস ফার্স্ট’ বলে একটি কথাও বেশ প্রচলিত। এর কারণ–অন্ধ ও পঙ্গু যেমন অসহায়, বৃদ্ধ ও শিশু যেমন অসহায়, সুস্থ সবল ‘লেডিস’কে সেই অসহায়ের কাতারে ফেলা হয়। তাকে সেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যা একজন পঙ্গুকে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের বাসে লেখা থাকে—মহিলা আসিলে সিট ছাড়িয়া দিবেন। যেন মহিলাদের পায়ে বল নেই, দাঁড়াবার শক্তি নেই। অনেকে সিট ছেড়ে দিয়ে দুর্বলকে রক্ষা করবার গৌরব বোধ করে। মহিলাদের এইসব তুচ্ছ সুবিধা দিয়ে সমাজ তাদের পঙ্গু বানাচ্ছে। আর যারা এই সুবিধা নিচ্ছে, তারা জানে না এইসব সুবিধার আড়ালে তারা নিজেদেরই অবলা-অসহায় জীব হিসেবে চিহ্নিত করে।
৫. প্লেটোর নারী অধিকারবাদ নিয়ে অনেকে চিৎকার করেন। তিনি নাকি নারী মুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর এই সংলাপটি একেবারে ফেলনা নয় যে—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাকে ধন্যবাদ–তিনি আমাকে মুক্ত পুরুষ করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করেননি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রীস স্ত্রীলোক ও ক্রীতদাসের মধ্যে কোনও পার্থক্য করেননি, প্লেটোও করেননি। Republic-এর Book v-এ তিনি নিচু মনের তুলনা দিতে গিয়ে বলেছেন—স্ত্রীলোকের মনের মতই নিচু। Meno [71 e, 73a] তে বলেছেন মেয়েদের কর্তব্য হল ভাল গৃহকর্ত্রী হওয়া আর স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলা। Laws [802 e]-এ বলেছেন—স্ত্রীজাতি নিরহঙ্কার এবং সকল অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে যেখানে পুরুষরা সাহসী এবং অহঙ্কারী। Timaeus [42e]-এ প্লেটো বলেছেন–মানব চরিত্র দুটো ভাগে বিভক্ত, উচ্চতর ভাগটি পুরুষ চরিত্র। তিনি আরও বলেছেন—দুষ্ট ও ভীত পুরুষ পরজন্মে নারী হয়ে জন্মায়।
৬. প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে ডায়রি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই ডায়রিগুলো একটিও আমার জন্য নয় বলে আমি সেগুলো ব্যবহার করতে পারি না। প্রতিটি ডায়রির Personal Memoranda-য় Blood group-এর চারটি ঘর থাকে Self, Wife, Child I, Child II, অর্থাৎ এই ডায়রিগুলো পুরুষের জন্য তৈরি। অথচ আমরা মেয়েরা–বোকা এবং নির্লজ্জ মেয়েরা বড় বড়াই করে ডায়রির পাতায় নিজের নাম লিখে ফেলি। অন্যের জিনিস ব্যবহার করবার অভ্যেস আমার নেই। আশা করি তাদেরও নেই, ব্যক্তিত্ব বলে সামান্য কিছু যাঁদের মধ্যে আছে।
৭. ১৬৬২ সালে মার্গারেট লুকাস নামের এক ওলন্দাজ নারী লিখেছিলেন–পুরুষ আমাদের বিরুদ্ধে দারুণ বিবেচনাহীন ও নিষ্ঠুর আচরণ করে, ওরা সব ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে কিন্তু আমাদের বেলায় অবরোধ সৃষ্টি করে। আমরা বাদুড় অথবা পেঁচার মত বেঁচে থাকি। পশুর মত ভারবাহী জীব যেন আমরা। আমরা প্রতিনিয়ত পোকামাকড়ের মত মৃত্যুবরণ করি।
৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ
১. ‘মেয়েছেলে’ শব্দটি বাঙালি গৃহস্থঘরের বহু ব্যবহৃত একটি শব্দ। মেয়েছেলে মানে নিতান্তই মেয়ে। তাহলে ‘মেয়ে’ শব্দের সঙ্গে ‘ছেলে’ শব্দটি জুড়ে দেবার তাৎপর্য কি ? তবে কি এই ধরে নিতে হয় যে ছেলের পিঠে ভর ছাড়া মেয়ে নামক মানুষ তো নয়ই ‘মেয়ে’ নামক শব্দও ঠিক দাঁড়াতে পারে না। কিছু একটার ঠেকা না হলে তার চলে না। দুর্বল চারাগাছকে যেমন একটি বাশের কঞ্চি হলেও সোজা রাখে।
‘ছেলেপিলে’ বা ‘ছেলেপুলে’ অর্থ ছোট ছেলেমেয়ে, সন্তান-সন্ততি। ‘ছেলেমানুষ’ মানে অল্পবয়স্ক, অপরিণত বুদ্ধি এমন কেউ–সে ছেলে বা মেয়ে যে কেউ হতে পারে। আর ‘ছেলেমানুষী’, ‘ছেলেমো’ বা ‘ছেলেমি’ বলতে বালসুলভ আচরণ বোঝায়। ‘ছেলেধরা’ কেবল ছেলেই ধরে না, মেয়েও ধরে। ছেলেভুলানো ছড়া বা গল্পে ছেলেমেয়ে দু’জনই আকৃষ্ট হয়। ‘ছেলেবেলা’—মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের বাল্যকাল বা শৈশব। ‘ছেলেখেলা’ও উভয়ের বাল্যক্রীড়া। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই যখন জড়িত, তখন শব্দে কেবল ‘ছেলে’র প্রাধান্য কেন?
জগতে মেয়েরা এত নগণ্য যে দৈনন্দিন শব্দ-ব্যবহারে ‘মেয়ে’ উল্লেখেও মানুষের কার্পণ্য হয়।
২. ‘অসূর্যম্পশ্যা’ শব্দটি নারীর জন্য বাঁধা। অসূর্যম্পশা শব্দের অর্থ সূর্যকে পর্যন্ত দেখতে পায় না এমন। পুরুষ কখনও অসূর্যম্পশ্যা হয় না। কারণ তারা আলোর মানুষ, আর যারা অন্ধকারের, যারা নারী—তাদের রোদ স্পর্শ করবার বিধান নেই। যেহেতু সূর্য উজ্জ্বল, যেহেতু সূর্য প্রখর এবং প্রচণ্ড, তাই সে পুরুষ—আর পুরুষ-সূর্যের আলো নারীর শরীর ছুঁয়ে দিলে নারীর নারীত্ব কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়। নারীত্ব যত বেশি ঘরের খিল এঁটে, অন্ধকারে মুখ বুজে পড়ে রইবে—তত সে ফুটবে ভাল।
পুরুষেরা পুরুষের জন্য ‘অসূর্যম্পশ্যা’ শব্দ তৈরি করেনি। করেনি, কারণ এই শব্দের কারণে কখন আবার ঘরবন্দি হতে হয় বলা যায় না। তাছাড়া তারা নিজেরা সূর্যের যত কাছাকাছি হবে, শক্তিকে যত নাগালের ভেতর আনবে তত তাদের বীরত্ব বেশি। আর নারী অন্ধকার খুপরিতে বড় হলে উত্তরোত্তর নারীত্ব বৃদ্ধি পায়। নারী এই ধারণা ধারণ করে নিজের নারীত্ব বাড়াচ্ছে। বিষ যদি একবার মধুর লাগে, সে বিষ খাবেই। নারীত্বওয়ালা নারীকে পুরুষেরা বাহবা দেয়। এই বাহবা কার না মধুর লাগে।
‘অনাঘ্ৰাতা’ শব্দটিও নারীর জন্য নির্ধারিত। নারীকে ফুলের মত ভাবা হয়, ফুল দেখতে সুন্দর, রঙিন, পাপড়ি ও রেণুর সমাহার। নারীকেও তেমনি সুন্দর ও রঙিন হতে হয়, বিভিন্ন রূপ ও গুণের সমাহার হতে হয়। তাই পুরুষের খুব শখ এমন এক নারীফুলের, যে ফুলের ঘ্রাণ কেউ নেয়নি। সে একাই ফুলটির ঘ্রাণ নেবে, তার রেণু মাখবে গায়ে, পাপড়িগুলো একটি একটি করে ছিঁড়বে—এও এক ভয়ঙ্কর আনন্দ পুরুষের! ‘অনাঘ্ৰাত’ শব্দের অর্থ ঘ্রাণ লওয়া ও ভোগ করা হয়নি এমন। পুরুষ ভোগের জিনিস নয়, ভোগের জিনিস নারী। অনাঘ্ৰাত বা অনাঘ্ৰাতা শব্দটি পুরুষের জন্য খাটে না। খাটে নারীর জন্য। তাই ‘অনাঘ্ৰাতা’ শব্দটি আভিধানিক স্বীকৃতি তো পেয়েছেই, পুরুষ-প্রিয়তাও বেশ পেয়েছে।
৩. ভাঙা বাসনে নাকি বেশিদিন মানুষ ভাত খেতে চায় না। এই প্রবাদ বাক্যটি বাসন এবং ভাতের চেয়ে নারী এবং সতীত্বের দিকে বেশি ইঙ্গিত করে। এই ভাঙা –নারীর হাত, পা, চোয়াল ইত্যাদি ভাঙা নয়। নারীর ভাঙা আবার অন্য রকম। সতীত্ব বলে একটি জিনিস আছে মেয়েদের, সেটি যাদের আছে, তারাই কেবল আস্ত, বাকিরা ভাঙা। মেয়েরা হচ্ছে বাসনের মত, পুরুষেরা নারীকে ব্যবহার করেই যাবতীয় আহার গ্রহণ করে। বাসনটি যত চকচকে হবে, খেতে তত আনন্দ। সতীত্ব হচ্ছে বাসন প্রস্তুতের কাচামাল, সতীত্ব ভাল হলে বাসন মজবুত, সতীত্ব নেই তো বাসনও ভাঙ। খেতেও মজা নেই।
তাই পুরুষের খাবার-দাবারে মজা জোগাবার জন্য নারীকে ঝকঝকে, মসৃণ ও অভঙ্গুর পাত্র হতে হয়। সম্প্রতি একটি টিভি নাটকে বেশ রসিয়ে বলা হল ‘ভাঙা বাসনে মানুষ বেশিদিন খেতে চায় না’—এদেশের প্রগতিশীল পুরুষেরা এ জাতীয় আদিম ও কুৎসিত প্রবাদ জোগাড় করে রেডিও টিভি-তে প্রচার করছেন (প্রবাদের প্রতি কোনও প্রতিবাদ ছাড়াই) মানুষকে আরও বেশি অশিক্ষিত ও কদাকার বানাবার জন্য।
৩৫. সংসার
আমার বড় সংসারের সাধ ছিল। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির ছাদে ইট জড়ো করে ঘর বানাতাম, বসবার ঘর, শোবার ঘর, বারান্দা। আমার একটি পুতুলের খাট ছিল, ভারি সুন্দর। মা ওই খাটের তোশক-বালিশ এত চমৎকার বানিয়ে দিয়েছিলেন যে, মাঝে-মধ্যে ইচ্ছে করত হাত পা গুটিয়ে ছোট হয়ে ওই খাটের ওপর ঘুমিয়ে পড়ি। একবার আমাদের বাড়িতে ট্রাক ভর্তি ইট এসেছিল দেওয়াল উঁচু করবার জন্য। আমি আর আমার ছোটবোন সারা বিকেল ওই ইট ছাদে তুলতাম। তুলে ঘর বানাতাম। আমাদের বাড়িটি ছিল পুরনো জমিদার বাড়ি। জলছাদ চুঁয়ে বৃষ্টির জল নামত ঘরে। ফাটল সারাতে বাবা যখন ছাদে উঠে আমাদের ঘরবাড়ি দেখতেন—ইটগুলো আবার একটি একটি করে নামাতেন। আমরা তখন ঘরে বসে টের পেতাম আমাদের ছাদের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। ছোটবোনটি দুঃখ করে বলত—এই বুঝি রান্নাঘরটি উঠিয়ে নিয়ে এল। এক একটি ইট ফেলার শব্দ শুনে আমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতাম—না জানি আমার শোবার ঘরটি ভেঙে তছনছ।
এ রকম প্রায়ই ঘটত। আমরা নির্মাণ করি আর অভিভাবক এসে ভেঙে দেয়। একবার মনে আছে আমাদের খেলাঘর নানা আসবাবে, তৈজসে বড় সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। তখন একাত্তর সাল। প্রতিবেশিরা ভারতে পালিয়ে গেছে। কেউ নেই, দরজায় শুধু একাকী একটি তালা। আমরা এক উঠোন থেকে আরেক উঠোনে খেলা করতে করতে প্রফুল্লদের উঠোন থেকে শঙ্খ, সিদ্ধেশ্বরীদের বারান্দা থেকে ঠাকুরঘরের বাটি, গ্লাস, সমাপ্তিদের কলতলা থেকে ভাঙা কাচ, লক্ষ্মীমূর্তি, পুরনো ব্যাটারি এত পেয়েছিলাম যে সব সাজিয়ে আমাদের খেলার ঘরকে বেশ মূল্যবান করে তুলেছিলাম।
একাত্তরে বাবা খুব কম উঠতেন ছাদে আর আমাদের স্কুল ছুটি, দিনে দুবেলা রান্না করছি, ইটের গুড়ো পিষে মসলা বানাচ্ছি, থালাবাসন একবার নামাচ্ছি, একবার ওঠাচ্ছি, তখন সংসার নিয়ে আমাদের দুবোনের চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ততা। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন, যেদিন একটি উড়োজাহাজ আমাদের মাথার ওপর সাত চক্কর দিয়ে শহরের বড় হাসপাতালে বোমা ফেলে গেল, সেদিনই আমরা সবাই মোষের গাড়ি করে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। গ্রামে বসে শহরের ছাদে ফেলে আসা সংসারটির জন্য বড় মন কাঁদত।
সংসারের সাধ আমার বহুদিনের। বড় হয়ে যখন সত্যিকার সংসার করতে চাইলাম, যখন আমার স্বপ্নকে অল্প অল্প করে পল্লবিত করলাম, তখন আমি বুঝিনি, যে মানুষটি আমার সঙ্গে ছিল সে ছিল মূলত প্রতারক। সে আমার স্বপ্নের একবিন্দু কিছু বোঝেনি। কেবল শরীর ভরে মেয়ে মানুষের মাংস চেয়েছে ব্যস।
কোনও পুরুষ আমাকে সংসার দেয়নি। দশটা পাঁচটা চাকরি করে আমি যে ঘরে এসে ঢুকি সে ঘর আমার ঘর। আমার নিজের হাতে গড়া আমার বসবার ঘর, শোবার ঘর, বারান্দা… ৷ কোনও প্রতারক পুরুষের কাছে সংসারের অপেক্ষায় আমি বসে থাকিনি। স্বপ্নের ভাঙন নিয়ে হাপিত্যেশ করিনি। কে বলে মেয়েরা পারে না একা বেঁচে থাকতে, একা দাঁড়াতে? আমার সর্বস্ব লুটে আমাকে নিঃস্ব করে যখন প্রতারক পুরুষেরা যে যার মত পালিয়ে গেছে কই আমি তো ধুলো ঝেড়ে ঠিক দাঁড়িয়েছি। আমি যে এই হাঁটছি, দৌড়োচ্ছি, সিঁড়ি ভেঙে উঠছি, নামছি আমার তো কই কোনও কষ্ট নেই। বরং এই ভেবে আনন্দ হয় যে, কোনও লম্পটের নাগালের মধ্যে থেকে আমি সেই জীবন যাপন করছি না যে জীবনে আমার দেবতা-পুরুষ গণিকা সম্ভোগ সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘরে ফিরবে আর আমার উরুতে হাত রেখে স্বভাবদোষে বলে উঠবে ভালবাসি। আমাকে সেই জীবন যাপন করতে হচ্ছে না যে জীবনে গভীর রাত্তিরে মাতাল স্বামীকে নর্দমা থেকে তুলে আনতে হয়। যে জীবনে পিঠ পেতে রাখতে হয় কর্তার প্রহর গ্রহণ করবার জন্য।
ঘরে ফিরে আমি আমার মা’কে যখন জড়িয়ে ধরে গল্প করি সারাদিনের, তখন এই ছোট ঘরদুয়োরকেই স্বপ্ন মনে হয়, মনে হয় সেই আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ির ছাদ থেকে আমার সবটুকু ভালবাসা তুলে পুরনো ঢাকার এক বাড়ির মধ্যে পুরেছি। আমার বাবা এখন আগের মত আমার ঘর ভেঙে দেন না। তাঁর বাড়ির ছাদে ইট চুরি করে কেউ এখন আর সংসার সাজায় না। বাবা খুব মনে মনে বুঝতেন আমার বড় সংসারের শখ। ছোটবেলায় বার বার আমার খেলার সংসার ভেঙে দেওয়ার সেই যমদূত-বাবা এখন আমার সত্যিকার সংসারের জন্য জিনিসপত্র, টাকাকড়ি এর-ওর হাতে পাঠিয়ে দেন। দেখে আমার বুক ফেটে যায়—বাবা হয়ত ভাঙনের কোনও কষ্ট আমাকে আর বুঝতে দিতে চান না।
বেশ বেঁচে আছি, একদিন হয়ত দেখব দেশের ওই পার কুতুবদিয়া কিংবা সাতক্ষীরায় বদলি হয়ে গেছি। এ তো আর এমন নয় যে সবকিছু ফেলে ছোটবেলার মত মোষের গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে গোপনে শহর পেরিয়ে গ্রামে চলে যাব। বদলির আদেশ হলে পুরো সংসার মাথায় করে নিয়ে যেতে হবে—সে যত অরণ্য কিংবা পাহাড় হোক না কেন।
আমার বুদ্ধিবিদ্যা, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বকে আমি সবচেয়ে মূল্যবান মনে করি। আমার অহঙ্কারকে আমি কখনও তুচ্ছ করি না। আমার স্বপ্নকে ফুলচন্দন না পরাতে পারি, অসম্মান করি না। আমি যে পদক্ষেপ রচনা করি তা আমার নিজস্ব পদক্ষেপ। কারও নির্দেশিত বা প্রভাবিত পদক্ষেপ নয়। আমি যা ইচ্ছা করি তা আমার নিজস্ব ইচ্ছা, আমার স্কোপার্জিত স্বাধীনতা থেকে উৎপতিত ইচ্ছা।
শাস্ত্র এবং সমাজ আমাদের এমন শিক্ষাই দেয় যে নারীর কোনও স্বাধীনতা থাকতে নেই। কিন্তু সেই নারী অবশ্যই মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ নয় যে নারী মনে এবং শরীরে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।
৩৬. সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
১. মেয়েদের চোখের নিচ টেনে ধরে কী দেখ বুবু?
এনিমিয়া দেখি ।
এনিমিয়া কী বুবু?
রক্তশূন্যতা।
পেটের চামড়া টেনে কী দেখ তুমি?
ডিহাইড্রেশান দেখি।
ডিহাইড্রেশান কী জিনিস বুবু?
জলশূন্যতা।
মেয়েদের হাত পা টিপে টিপে কী দেখ এত?
ঘোড়ার ডিম দেখি বলে ছোটবোনকে প্রায়ই সরিয়ে দিতাম। আমার সেই ছোটবোন এখন বড় হয়েছে। তাকে এখন বলতে ইচ্ছে করে আমি মেয়েদের ম্যালনিউট্রিশন দেখিরে বোন। অপুষ্টি দেখি। তোরা খেয়ে-পরে আর ক’জন খুব ভাল বেঁচে আছিস, কত লক্ষ নারী অপুষ্টিতে ভোগে তার খবর কে রাখে। কেন ভোগে, তাদের ঘরের পুরুষেরা তো এত অপুষ্টিতে ভোগে না, যত ভোগে ঘরের মেয়েরা!
স্বামীর পদতলে তারা তাদের বেহেস্ত বলে জানে, স্বামীর এঁটোকাঁটা খেয়ে তারা তাদের পুণ্য হয় বলে জানে—আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী সেই পুণ্য সংগ্রহের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করছে।
সমাজের রীতি রক্ষার তাগিদে বাড়ির পুরুষ-ছেলেরা খেয়ে ঢেকুর তোলার আগে মেয়েরা খাবার স্পর্শ করে না, দুপুরের খাবার খেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হোক, তবু পুরুষ-ছেলেরা আমিষ-নিরামিষ খাবার পর যা থাকে, তা উঠোনের হাস-মুরগি পায় কিছু কিছু পায় ঘরের মেয়েরা, আর বাকি যদি কিছু থাকে, তা বাসি করে রাখা হয় পরদিনের জন্য (অবশ্য তা মেয়েদের জন্যই)–এই হচ্ছে সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র।
২. ছোটবেলা থেকেই আমার এক আত্মীয়ার মাথা ভর্তি উকুন ছিল। একবার ওষুধ দিয়ে তার মাথার উকুন সব মারা হল। উকুন মরে ভালর চেয়ে বরং খারাপ হয়েছিল সেই আত্মীয়ার। রাতে ঘুম হয় না, চোখে অন্ধকার দেখে, খাবারে রুচি নেই। শেষ অব্দি আত্মীয়াটি আবিষ্কার করল মাথায় উকুন নেই বলেই তার এই অবস্থা। দু’মাস চরম অস্থিরতায় ভোগার পর মাথায় নতুন করে উকুন ছাড়তে সে বাধ্য করল। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
আসলে উপদ্রব পোহাতে পোহাতে মেয়েদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উপদ্রব ছাড়া মেয়েরা বাঁচতে পারে না।
প্রতি রাতে বউ না পিটিয়ে ঘুমোয় না এমন পুরুষ খুঁজে বের করলে সংখ্যায় খুব কম হবে না বলে আমার মনে হয় না। তো সেদিন এ ধরনের নির্যাতনে অভ্যস্ত এক বউকে বলেছিলাম–উল্টে আপনি ওকে মারুন, নয় ওই পাষণ্ডকে ত্যাগ করুন।
শুনে আঁতকে উঠল ঘোমটা ঢাকা বউ। তাঁর শরীরের কালশিরাগুলোও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সম্ভবত মেয়েদের রক্তে-মাংসে গভীর এক বিশ্বাসের অঙ্কুরোদগম হয়েই গেছে যে মেয়েমানুষ জন্মই নিয়েছে লাঞ্ছিত হতে, যাবতীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ পোহাতে। তাই যথেচ্ছ নির্যাতিত হতে তাদের মোটেই অপমান লাগে না।
৩. শাস্ত্ৰে বলে—‘অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা তু রোহিনী/ দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা উর্ধ্বং রজঃস্বলা’ ইত্যাদি। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়–আট বছরের কন্যাকে গৌরী বল, নয় বছরের কন্যাকে রোহিনী, আর দশ বছরের কন্যাকে–কন্যা। দশের ওপর যাদের বয়স তাদের বলে রজঃস্বলা।
বারো বছর হয়ে গেলেও যে পিতা কন্যাদান করেন না তাঁর পিতৃলোকের আয়ীয়রা মাসে মাসে সেই কন্যার ঋতুকালীন শোণিত পান করেন। কন্যাকে রজঃস্বলা দেখলে মা, বাবা এবং বড় ভাই নরকে যান। যে ব্রাহ্মণ অজ্ঞানতাবশত অন্ধ হয়ে সেই কন্যাকে বিয়ে করেন, তিনি সম্ভাষণের অযোগ্য, তাঁর সঙ্গে এক পাতে বসে ভোজন করতে নেই।
সেকালে মেয়েরা মায়ের কোল থেকে নামতে না নামতে শুরু হয়ে যেত দৌড়াদৌড়ি–কার আগে কে মেয়েকে বলিদান করতে পারেন।
একালে বলিদান কমেছে এই কথা গত এক মাসে দেশের পঁচিশটা গ্রাম ঘুরে না এলে আমিও হয়ত বিশ্বাস করতাম। একেবারে পাঁচ ছয় বছর না হােক বারো থেকে পনেরো বছরের অধিকাংশ মেয়েকেই আমি বিবাহিত দেখেছি। সতীদাহর চেয়ে এই বাল্যদাহ কম মারাত্মক নয়।
সেকালে এবং একালে সময়ের শুধু দীর্ঘ ব্যবধানই দেখি, সংস্কারের এক তিল ব্যবধান দেখি না।
৪. নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজ তাকে নারীত্বের নানা কলাকৌশল শিখিয়েছে। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ যে সমাজে এই পুঁথিকাব্য রচিত হয়— পতিভক্তি কর সদা থাকিতে জীবন।
পতিভক্তি সতী সাধণী করে প্রাণপণ।।
সতী সাধ্বী অবলার এইত ধরম।
পতিকে সেবিয়া করে সার্থক জীবন।।
পতি সেবা রমণীর আদরের ধন।
লভিয়ে সে ধন করে সার্থক জীবন।।
সতীর লক্ষণ ইহা জানিতে একীনে।
জানে না সে আর কিছু পতি সেবা বিনে।।
শয়নে স্বপনে ধ্যানে আর জাগরণে।
জীবন সার্থক করে পতির চরণে।।
কেমনে উজ্জ্বল হবে পতির সংসার।
দিবানিশি এ ভাবনা অন্তরে তাহার।।
পতির আনন্দ ছাড়া শান্তি নাহি চায়।
সতীর মরম ব্যথা পতির ব্যথায়।।
পতির সুখেতে সুখী দুঃখেতে দুঃখিনী।
পতির সোহাগে কাটে দিবস রজনী।।
সাধ্যের অতীত চাপ পতিকে না দেয়।
যাহা কিছু দেয় পতি খুশি মনে নেয়।।
পতি-হিতে পতি স্বার্থে নশ্বর জীবন।
বিলাইয়া দেয় সদা করি সম্ভাষণ।।
এবং এ জাতীয় গাথাই ঘরে ঘরে তুমুল জনপ্রিয় হয়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজের নীতি ও নিয়মের কাঁধ খামচে ধরে তলপেটে কষে দুটো লাথি দিতে গেলে হই রই করে তেড়ে আসে সাত কোটি বুনো ষাঁড়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজে অতঃপর হাত-পা-মাথা গুটিয়ে তাকে শামুকের মত সামাজিক খোলসে আবৃত হতে হয়।
৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু
১. কিছু বোকা আছে, ওরা বলে মেয়েরাই মেয়েদের শক্র, কারণ বাঙালির বউ-শাশুড়ি বিবাদ দীর্ঘদিনের। শাশুড়িরা বউদের অত্যাচার করে সুখ পায়। আমরা ভেবে দেখতে পারি, কোনও নারী—সে যখন ছেলের বউ-এর শাশুড়ি হয় তখন সে উচ্চকণ্ঠ নাকি সে যখন মেয়ের জামাইয়ের শাশুড়ি হয়, তখন? মেয়ের বেলায় অবশ্যই সে বিনম্র এবং আপসকামি, কিন্তু ছেলের বেলায় ঠিক তার বিপরীত। কারণ মেয়েমাত্রই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার; বিয়ের মাধ্যমে ছেলের হাতে মেয়েকে ন্যস্ত করা, এবং ছেলের সংসার ও বংশ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করা দ্বারাই একটি মেয়ে পুরুষতন্ত্রের জালে আটকা পড়ে।
ছেলের বউ-এর শাশুড়ি যখন ছেলের বউ ছিল, একই নিগ্রহ সে ভোগ করেছে। ছেলেকে বিয়ে করানোর ফলে সে যদি ছেলে পক্ষের একজন প্রতিনিধি হয়, নিশ্চয় সে প্রতিনিধি, এবং ছেলে যেহেতু সঙ্গত কারণেই পুরুষতন্ত্রের ধারক, সে-ও অর্থাৎ ছেলের মাও পুরুষতন্ত্রের ধারক। এ কথা অনস্বীকার্য যে নারী নিজেই পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক।
অপরদিকে নিজের মেয়েকে যখন সে বিয়ে দেয়, পুরুষতন্ত্রের কাছে মেয়েকে সে অর্পণ করে, সে তখন পুরুষতন্ত্রের ধারক নয়। সে তখন নারীপক্ষ, নির্যাতিত নারীর প্রতিনিধি; তাই সে বিনত, অনুদ্ধত, শ্লীল, সংযত ও বশংবদ। ওদিকে মেয়ের শাশুড়ি আবার তারই মত দাপুটে, অপ্রসন্ন, অমর্ষপরায়ণ ও খড়গহস্ত—সে তার ছেলের বউ-এর কাছে যে চরিত্রে উপস্থিত।
তাই, নির্দ্বিধায় আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে নারী একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক। পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে নারীকে নারীর ওপর নির্যাতনের হাত প্রসারিত করতে হয়—একই নির্যাতন সে ভোগ করেছে, তার মেয়ে ভোগ করছে, এবং পুরুষতন্ত্র যখন তার হাতের মুঠোয়—সে আরেকজনকে ভোগ করাচ্ছে। এ হচ্ছে একটি আবর্ত। এই আবর্তের ভেতর মানুষের সঞ্চরণ। সময় এবং পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতন্ত্র দ্বারা নারী নানা কায়দায় আবর্তিত হয়।
সে যখন নারী, যে নারী পুরুষতন্ত্রের ধারক কেবল তখনই সে দ্বিতীয় কোনও নারীকে নিগ্ৰহ করবার পরিবেশে পতিত হয়, সে তখন পৃথক কোন নারী-অস্তিত্ব নয়। সে তখন পুরুষতন্ত্রের নির্জলা প্রতিনিধি ছাড়া একবিন্দু অন্য কিছু নয়। সে তখন সেই নারী, যে নারী পুরুষ অধিকৃত সমাজের শোষণ ও পীড়নের শিকার এক শরীর মাংসপিণ্ড মাত্র।
২. কিছু বোকা বলে, মোল্লারা যেমন বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহার পছন্দ করে না, তেমন পছন্দ করে না প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের কর্মীরাও। অতএব দু’পক্ষের মধ্যে পার্থক্য আর কি রইল।
মৌলবাদরা বলে নারীর স্থান ঘরে, সে সর্বদা পর্দার ভেতরে থাকবে, তার বাইরে এসে বিজ্ঞাপন করা বারণ। আমার সিদ্ধান্ত মোটেও তা নয়। আমি বলি নারীকে স্বাবলম্বী হতে, বলিষ্ঠ হতে, তার ব্যক্তিত্বকে প্রধান করতে। নারীর মনোমুগ্ধকর শরীর ব্যবহার করে বাহবা পাওয়ার পক্ষপাতি আমি নই; আমি চাই সে তার রূপ নয়, গুণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি নিশ্চয় বিজ্ঞাপনে নারীর অংশগ্রহণ অনুমোদন করি—কিছুতেই অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক অংশগ্রহণ নয়। কিন্তু মৌলবাদরা নারীকে উপার্জনক্ষম, স্বনির্ভর ও গতিময় দেখতে চায় না। তারা চায় বন্দিত্ব, অন্ধকারে আচ্ছন্ন সামাজিক গুহার ভেতরে তার বসবাস। তারা নারীর মুক্তি চায় না, চায় শৃঙ্খল। যেহেতু পুঁজিবাদিরা নারী-স্বাধীনতার নামে গোপনে নারীকেই পণ্য করে তোলে, নারীকে পণ্য করেই নারীকে শৃঙ্খলিত করে, নারীর কল্যাণকামিরা তাই বাজারের পণ্য বানাবার পুঁজিবাদি শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করতে চায়। মৌলবাদিদের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা নারীকে আলোয় আসতে দেবে না, তারা নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেবে না। তলিয়ে দেখলে পুঁজিবাদি ও মৌলবাদির অন্তর্নিহিত সাযুজ্য বেশ ধরা পড়ে। পুঁজিবাদির নারীকে যে শৃঙ্খল পরায় তা রঙচঙে, বাহারি। আর মৌলবাদিদের শৃঙ্খল সূরা-কলমা পড়া, ফুঁ দেওয়া, ফ্যাকাসে। সাযুজ্য এই কারণে যে তারা উভয়ে একটি জিনিস দিয়েই নারীর জীবন শক্ত করে বাধে—তা ওই শৃঙ্খল।
আর আমি, আমি যদি সামান্যও নারীর কল্যাণ কামনা করে থাকি—আমি কোনও শৃঙ্খল চাই না। নারী যতদিন যাবতীয় শৃঙ্খল ছিড়ে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ যেমন ইচ্ছে ভোগ করবার অধিকার অর্জন না করে, ততদিন তাবৎ শৃঙ্খলবাদিদের জন্য আমি নিক্ষেপ করব ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা।
৩৮. বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
১. অধিকাংশ বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে আমি পনেরো সেকেন্ডের বেশি কথা বলতে পারি না। কারণ এরা কথা বলবার শুরুতেই সাধারণত স্বামী কি খেতে এবং পরতে পছন্দ করে তা-ই শোনায়। এছাড়া এদের নিজস্ব কোনও গল্প নেই। এসব গল্প করে এরা সমাজে টিকে থাকতে চায় কারণ এরা মনে করে টিকে থাকবার মত অন্য কোনও ব্যবস্থা এদের জন্য নেই।
সুতরাং স্বামী যদি ভালবেসে দামি শাড়ি কিনে দেয় কি সোনার গহনা গড়িয়ে দেয় কি আরও ভালবেসে জমির একটি দলিল ধরিয়ে দেয় হাতে—তবে আর রক্ষে নেই। এইসব বৈষয়িক সম্মোহনের কাছে দুর্বল মেয়েরা ক্রমশ পরাজিত হয়। কেউ পরাজিত হয় খুব দ্রুত, কেউ ধীরে। আসলে সংসারের এই সুখ নামক মোহটি একটি পাতকুয়োর মত। ব্যাঙ যেমন কুয়োটিকেই বিশাল দীঘি ভেবে আনন্দে লাফায় তেমন দুটো শাড়ি আর কানে নাকে ঝোলাবার কিছু ধাতব পদার্থ পেলেই নিজের সংসার কুয়োকেই এরা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ভেবে ভুল করে। মানুষ ভুলে যায় যে স্বাধীনতা মানুষের সর্বপ্রথম অধিকার। নারী তার স্বাধীনতা বিক্রি করে একটি ঘরের কাছে। যদিও মানুষ । জানে ঘর কারও জগৎ নয়, ঘর হচ্ছে বিশ্রাম এবং নিতান্ত ব্যক্তিগত কাজকর্মের জন্য মানুষের । একটি নিজস্ব আড়াল। অথচ কোনও পুরুষ যখন বিয়ে করে, স্ত্রীকে সংসার এবং শেকল দুই-ই । উপহার দেয়। আসলে পুরুষ এককভাবে তা দেয় না। দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
সংসার কারও কর্ম হতে পারে, কারও বর্মও হতে পারে কিন্তু কারও ধর্ম হতে পারে না। যারা কারও ওপর এ জাতীয় ধর্ম চাপাতে চায় তারা আর যাই হোক ধামিক তো নয়-ই প্রকৃত মানুষও নয়।
২. বিজ্ঞাপনে নারীরা ব্যবহৃত হয়। কারণ কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারী তার আকর্ষণীয় দেহবল্লর ও সাজসজ্জা নিয়ে এমনভাবে উপস্থিত হয় যে পণ্যের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে নারীই। আর সেই নারীর কারণে জনপ্রিয় হয় পণ্য। এতে ব্যবসায়িক লাভ হয় বটে কিন্তু যে নারী পণ্যের বিজ্ঞাপনের নামে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার কী হয়? এদেশের যে কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনের নারীও এক ধরনের পণ্য। তার চোখ, ভুরু, চুল, নাক, ঠোঁটের হাসি, পীনোন্নত পয়োধর, তার সাত-পাক নৃত্যকে বাজারের পণ্যের চেয়েও বড় পণ্য হিসেবে বিচার করা হয়। এই বিজ্ঞাপনদাতা পণ্য-ব্যবসায়ীরা পণ্যের চেয়ে নারীকেই প্রধান করে তুলবার চেষ্টা চালায়। পুরুষের শেভিং-এর ব্লেড, সিগারেট, শার্টিং সুটিং, জুতো মোজা, শ্যাম্পু সাবান সব কিছুতেই অনাবশ্যক নারী এনে হাজির করা হয়। সেই নারীরা আসলে কোনও কাজ করছে না, তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ সমাজে সম্ভবত ব্যবহৃত হওয়াই তার প্রধান কাজ।
৩. সেদিন এক কবরস্থানে ঢুকতে গিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। এতকাল জেনে এসেছি প্রবেশ নিষেধ সাধারণত গরু ছাগলের জন্য হয়। এখন দেখি মহিলাদের জন্যও। সম্ভবত জন্তু ও মহিলাদের ক্ষেত্রেই যাবতীয় নিষেধ জারি হয়।
মৃত্যুই নারীকে কবরস্থানে ঢুকবার স্বাধীনতা দিতে পারে। তবে কি এই-ই সত্য যে নারীর না মরে মুক্তি নেই?
৪. এ নিয়ে দুবার তারা আমাকে জবেহ্ করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য আলেম, ইসলামী রাজনীতির নেতৃবৃন্দ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ। একবার সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস প্রসঙ্গে লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দেবার কারণে এবং দ্বিতীয়বার মেয়েদের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশের কারণে তারা জাতীয় দৈনিকে বিবৃতি দিয়েছেন যে আমাকে কতল করা ওয়াজিব।
এ আমি একেবারে অবিশ্বাস করি না যে, যে কোনওদিন তারা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আমাকে জবেহ্ করতে পারেন। না, আমি এতটুকু ভয় পাচ্ছি না। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে জেনেও কি আমি সড়কে নামি না? বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটে বলে আমি কি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি না? করি। আমাকে এই সমাজের ভেতরই বাস করতে হবে, সমাজ আমাকে ফণা তুলে বারবার ছোবল দেবে জেনেও। আমি জানি না তাঁরা কেউ আছেন কি না যাঁদের কণ্ঠে এখনও মরচে ধরেনি, যাঁদের কলম এখনও আপসের ভাষা শেখেনি—নাকি তাঁরা আছেন, অনেকেই আছেন, কেবল আমি নারী বলে আমার পক্ষে দাঁড়াতে তাঁদের সঙ্কোচ হয়, যদিও তা সত্যের পক্ষে ।
সম্ভবত নিজেকে নিঃশব্দে কতল হতে দিয়ে আমাকে নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
৫. ইটালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসি বলেন—‘আমার ভেতরের ভ্রূণটিকে আমি বলেছি, প্রিয় শিশু জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধ, নিরন্তর যুদ্ধ। জানতে চেয়েছি এই পুথিবীতে সে জন্ম নিতে চায় কি না। সে বলেছে, “নরকে যাও তুমি মা। আমি আর জন্ম নিচ্ছি না”।’
৩৯. নারীর শ্লীলতা
১. ‘শ্লীলতা’ শব্দের অর্থ ভদ্রতা, শিষ্টতা। ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দের অর্থ ভদ্রতানাশ বা শিষ্টতানাশ। ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দটি উচ্চারণ করলে যে মানুষের মুখ মনে আসে তা পুরুষ নয়—নারী। শ্লীলতাহানি পুরুষের হয় না, হয় নারীর। কারণ শিষ্টতা পুরুষের বজায় না রাখলেও চলে, নারীর যদি শিষ্টতা, শুদ্ধতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য না থাকে তবে আর থাকে কী?
নারীর গুটিকয় মাত্র সম্পদ—এই সম্পদ আগলে না রাখলে জগতে নারী আর আগলাবে কী?
২. এক সপ্তাহে আমার বাড়ির পাশের দুই বাড়িতে ছয় বছরের দুটো শিশু ধর্ষিতা হয়েছে। ওদের অভিযোগের ধরন একই দূর আত্মীয় অথবা প্রতিবেশী বয়স্ক লোকটি (বয়স তেতাল্লিশের উপর) চকলেট মিমি দিয়ে ভুলিয়ে ফুলিয়ে বাচ্চাদের প্যান্টি খুলেছে। আমি আন্দাজ করতে পারি না, ছয় বছরের বাচ্চার শরীরে উপগমনের ইচ্ছায় ওই প্রৌঢ় শরীরগুলো কী করে উত্তপ্ত হয়।
৩. সতীত্ব, মমতা, বাৎসল্য প্রভৃতি গুণকে নারীধর্ম বলে। ‘পুরুষধর্ম’ বলতে অভিধানে কোনও শব্দ নেই। কারণ পুরুষের তো সতীত্ব রক্ষার বালাই নেই, মমতা বাৎসল্য না হলেও চলে। উদ্যম ও তেজ হলেই পুরুষত্ব টিকে থাকে। কোনও নারীর ভেতরে যদি তেজ ও উদ্যমের প্রকাশ হয় তবে তাকে ভাল গুণ না বলে বদগুণ বলা হয়। এতে এই ধারণা স্পষ্ট হয় যে নারী নরম এবং পুরুষ কঠিন প্রকৃতির। তাই নরম জাতীয় গুণগুলো নারীর জন্য ধার্য করা হয়েছে। শারীরিক পার্থক্যের কারণে গুণের কোনও হেরফের হয় না। কার কি গুণ এবং কি ধর্ম হবে তা নির্ধারণ করে সমাজের গুটিকয় পুরুষ। তারা শৌর্য-বীৰ্য ইত্যাদি প্রধান গুণগুলো নিয়ে বাকি যা অনর্থক কিছু গুণ থাকে তা নারীর ভাগে দিয়েছে।
আসলে যে ধর্মটি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য দরকার তা কোনও নারী বা পুরুষধর্ম নয়—তা ‘মানবধর্ম’। যাদের ‘মানবধর্ম’ নেই তারাই নারী ও পুরুষের মধ্যে ধর্ম ভাগাভাগি করে।
৪. এদেশের চিকিৎসকরা সুযোগ পেলে ইরান চলে যান। আমার বেশ ক’জন চিকিৎসক বন্ধু ইরান থেকে ফিরে এসে ওখানকার গল্প বলেছেন। তাঁরা যে কথাটি সবচেয়ে বেশি বলেন তা হল ইরানী মেয়েরা পা থেকে মাথা অবধি ঢেকে রাখে বটে তবে চিকিৎসকের কাছে অসুখ দেখাতে এসে নিজে থেকেই পুরো কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে ওদের শরীরে বিশেষ কোনও অসুখ খুঁজে পান না। ওদের অসুখ আসলে মনে। চার দেওয়ালে আবদ্ধ থাকা মেয়েগুলো আসলে বেরোতে চায়, তাই অসুস্থতার ছুতোয় ওরা বেরিয়ে পড়ে–মূলত বের হওয়াই ওদের উদ্দেশ্য। এবং বিদেশি মানুষ পেলে ওরা দেশি নিয়ম ভেঙে মনের অসুখ দূর করে।
চিকিৎসকের কাছে এসেই যারা গায়ের কাপড়চোপড় খুলে ফেলে, তারা এবারের একাদশ এশিয়াডে কেবল মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখায়নি। কালো বোরখায় আবৃত হয়ে তারা মার্চ পাস্ট করেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল—প্রতিটি দলের নামফলক নিয়ে চীনা মেয়েরা মিনিস্কার্ট পরে হেঁটেছে। কেবল ইরানীদের বেলায়—যেহেতু মিনিস্কার্ট পরা ইসলাম-বিরুদ্ধ কাজ তাই নামফলক নিয়ে হাঁটবার জন্য তারা একটি পুরুষ বেছে নিয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করেছে ইরানী মেয়েরা কি এশিয়াডের লম্ফ বাফ, দৌড়, সাঁতার বোরখা পরেই সারবে, না কি ইসলামকে খেলার প্রয়োজনে গা থেকে শেষ অদি নামাবে?
আমার চিকিৎসক বন্ধুরা ইরানী মেয়েদের চমৎকার শরীরের বড় প্রশংসা করেন। কড়ে আঙুলে ব্যথার কথা বলে পুরো উলঙ্গ হয়ে যাওয়া মেয়েদের গা টিপে টিপে দেখতে হয় আর কোথাও ব্যথা আছে কিনা, না হলে ওরা বড় রাগ করে। পরাধীনতা মানুষকে অসুস্থ করে, বিকৃত করে, মন এবং শরীরকে পঙ্গু করে। পরাধীন শরীরকে ওরা সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে স্বাধীন করতে চায়। এতে ওদের স্বাধীনতা সামান্যও অর্জন হয় না, বরং বিদেশি পুরুষের চোখের খানিকটা আরাম হয়।
৫. ঢাকা শহরে বিভিন্ন রকম চুল কাটার দোকান আছে। ফুটপাতে পিঁড়িতে বসে নাপিত চুল কাটে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে দেশি বিদেশি মেয়েরা মেয়েদের চুল কাটে, চুল বাঁধে। আর কিছু আছে মাঝারি মাপের দোকান। ওতে ছেলেরা ছেলেদের চুল কাটে।
ইদানীং এইসব মধ্যবিত্ত সেলুনে কিছু মেয়ে-নাপিতের আবির্ভাব হয়েছে। অবশ্যই এটি একটি ভাল লক্ষণ—মেয়েরা কাজ করছে, উপার্জন করছে। কিন্তু একই সেলুনে কাজে সমান পারদর্শি ছেলে এবং মেয়ের পারিশ্রমিক দুরকম। ছেলে চুল কাটলে বিশ টাকা, মেয়ে কাটলে চল্লিশ টাকা। ফার্মগেটের একটি সেলুনে এই মূল্য তালিকা টাঙানো দেখলাম সেদিন। আমার প্রশ্ন—মেয়ের কেন চল্লিশ টাকা, কেন তার বেলায় বিশ টাকা বেশি?
এই দোকানগুলোয় চুল কাটার বাইরে আর একটি অলিখিত জিনিস বিক্রি হয় তা হল—নারীস্পর্শ। চুল কাটার দাম বিশ টাকা, নারীম্পর্শের দাম বিশ টাকা। মোট চল্লিশ টাকা। শেষ বিশ টাকা তার অসৎ উপার্জন। পারিশ্রমিকের পার্থক্য দেখে এই নারী শ্রমের প্রতি আমার আর শ্রদ্ধা থাকেনি।
মেয়েরা যে কাজেই নামে, যে কাজেই তারা অগ্রসর হয়—কিছু না কিছু নারীত্ব তাদের উৎসর্গ করতে হয়। কোথাও দৃষ্টি, কোথাও স্পর্শ, কোথাও কণ্ঠস্বর, কোথাও ভঙ্গিমা, কোথাও হাসি, কোথাও আহ্লাদ।
যেদিন এই সমাজ নারীর শরীর নয়—শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়—নারীর মেধা ও শ্রমের মূল্য দিতে শিখবে, কেবল সেদিনই নারী মানুষ বলে স্বীকৃত হবে।
৪০. চুড়ি আর সস্তার জিনিস
১. পুরুষ যদি কোনও শক্ত কাজে অপারগ হয়, তবে সেই পুরুষকে অপদস্থ করবার একটি পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়—হাতে চুড়ি পরতে বলা। এতে অপারগ পুরুষটি পুরোমাত্রায় অপদস্থ হয় এবং অপদস্থকারীরা প্রভূত আনন্দ লাভ করে।
পুরুষের মান-মর্যাদা ধুলোয় লুটোবার জন্য এই হাতে চুড়ির প্রসঙ্গটি সবচেয়ে কার্যকর। হাতে চুড়ি পরবার অর্থ সে পুরুষ নয়, যেহেতু পুরুষ নয়—সে শক্তিমান নয়, শৌর্যশালী নয়; যেহেতু সে পুরুষ নয়—সে নারী, সে নারী কারণ সে ব্যর্থ, কারণ সে দুর্বল। নারীমাত্রই অক্ষম, অসমর্থ, অপদার্থ ও অকৰ্মণ্য। তাই নারী-বেশ পুরুষকে ধিকৃত করে, কলঙ্কিত করে।
অকথ্য গালিগালাজের চেয়ে, শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে হাতে চুড়ি পরবার কথা উচ্চারণ করাই বেশি অপমানকর। পুরুষেরা হাতে চুড়ি পরাকে অসম্মানজনক মনে করে। পুরুষেরা তিলার্ধ নারী হওয়াকেও ঘৃণা করে। তাই বীর্যবন্ত শরীরে নারীর সজ্জা পুরুষের খ্যাতি নাশ করে, পুরুষকে নিন্দিত করে। নারী হবার মত চরম লজ্জা আর কিছুতে নেই।
একবার এক ছেলেকে ভীষণ এক অপরাধের কারণে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। শাণিত বুদ্ধির কিছু ছেলে শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে মেরে লাশ বানাবার বদলে তার গায়ে শাড়ি পরিয়ে, ঠোটে-কপালে লিপস্টিক মেখে দেওয়াকে সর্বোচ্চ শক্তি বিবেচনা করে। এতে অপমানের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে ছেলেটি আত্মহত্যা করে। নারী-সাজ ছাড়া অন্য কোনও শাস্তিই, আমি নিশ্চিত, ওই ছেলেকে অন্তত আত্মহত্যা করাত না। নারী-রূপে এত অসম্ভ্রম, এত গ্লানি—তা সেই রূপ অঙ্গে না নিলে বোঝা দুরূহ।
কই, পুরুষের পোশাক পরলে তো নারীর সন্মান যায় না, নারী অপমানিত হয় না, আত্মহত্যা করে না। নাকি নারী অধম বলে, অকিঞ্চিৎকর বলে নারীর পোশাককে পুরুষেরা হীন ও নীচ চরিত্রের পোশাক মনে করে তাই ওই পোশাকের আবরণে তারা লজ্জিত হয়, তাই তারা মুখ লুকোয়। তাই তারা ক্লাউন হয়, লোক হাসাবার লোক হয়। নারী হওয়ার মত লজ্জা আর কোথায় আছে। নারী জন্মের মত ঘৃণ্য জন্ম শুয়োর-শকুনদেরও নয়।
প্রাচীনকালে পাপী-পুরুষদের অভিশাপ দেওয়া হত, যেন পরজন্মে তারা নারী হয়ে জন্মায়। ছাগল-ভেড়া হয়ে জন্মাবার চেয়ে নারী হয়ে জন্মানোটিই অভিশাপ হিসেবে অধিক মারাত্মক ছিল।
২. ‘মূলধারা’ নামে এদেশে একটি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক সাপ্তাহিকী ছিল। চলেনি। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবার বদলে মূলধারা এখন নারীদেহে ফিরে গেছে। চলচ্চিত্র নায়িকাদের ক খ গ অর্থাৎ তাদের চুল, চোখ, নাক, ঠোঁট নিয়ে গবেষণা, রাঁধা-বাড়া, গৃহকোণ, টেলিভিশন-তারকাদের চেহারা ছবি, সাজগোজ, নারীর বক্ষ উন্নত ও কটিদেশ সরু করবার উপদেশ বর্ষণই এখন মূলধারার মূল কাজ। এখন মূলধারার বাজার হবে রমরমা। দেশে নারী দেহের ব্যবসা যেমন ভাল, নারী দেহ সম্পর্কিত খবরা-খবরের বাণিজ্যও সমান তালে ভাল।
আমাদের পাঠক মুখরোচক খাদ্য ও দেহরোচক নারী পেলে ব্যস, আর কিছুই চায় না। তাই পাঠকের সুবিধার্থে মূলধারা তার অধঃযাত্রাকেই কবুল করেছে।
৩. লোকে বলে, নারী মুখে সাদা রঙের ক্ষো পাউডার বুলোয় আর চোখে কালো কাজল পরে। আমি বলি নারী নিজের মুখে নিজে চুনকালি মাখে। নারী নিজের হাতে নিজের গালে চুন মাখে, নিজের হাতে নিজের চোখে কালি মাখে।
মুখে চুনকালি পড়লে মানুষ লজ্জিত হয়। নারীর লজ্জা নেই। নারীর নিজের প্রতি ঘৃণা নেই। দিব্যি হেঁটে বেড়ায় আপাদমস্তক সামাজিক সঙ।
চোখে কালি পড়তে পড়তে নারীর চোখ এখন অন্ধ। ত্বকে চুন পড়তে পড়তে নারীর ত্বক এখন বোধহীন, নিস্তেজ। তাই গায়ে আঘাত লাগলে নারী চিৎকার করে না, সম্মানে ঘা পড়লে নারী টের পায় না। তাই চোখের সামনে নারীর সর্বস্ব লুঠ হলেও নারী চোখে দেখে না।
৪. মাঝে মাঝে কবিতার জলে আমি আকণ্ঠ ভুবি। সেদিন একটি কবিতা আমাকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে এমন একাকার করল যে আমি দাঁড়াবার কোনও কিনার পেলাম না। কবিতাটির নাম ‘সস্তার জিনিস’।
বাজারে এত সস্তায় আর কিছু মেলে না, যত সস্তায় মেয়ে মানুষ মেলে
ওরা একটা আলতার শিশি পেলে আনন্দে তিনদিন না ঘুমিয়ে কাটায়।
গায়ে ঘষার দুটো সাবান আর চুলের সুগন্ধী তেল পেলে
ওরা এমন বশ হয় যে ওদের গায়ের মাংস খুলে
সপ্তাহে দু’বার হাটে-বাজারে বিক্রি করা যায়।
একটা নাকছবি পেলে ওরা সত্তর দিন পা চাটে
ডুরে একখানা শাড়ি হলে পুরো সাড়ে তিন মাস।
বাড়ির একটা নেড়িকুত্তাও সময়ে ঘেউ ঘেউ করে
আর সস্তার মেয়ে মানুষের মুখে একটা কুলুপ থাকে
সোনার কুলুপ।
৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি
আমি যখন আমার দিকে তাকাই—আমার শরীরের দিকে, আমি অনুভব করি আমার শরীরের কিছু অংশ নিয়ে আমি মাত্রাতিরিক্ত সচেতন। এই সচেতনতা আজ এই বয়সে হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এই বোধ তখন থেকে—যখন আমার তেরো বছরের ভাই গরম লাগছে বলে এক উঠোন মানুষের সামনে গায়ের জামা খুলে ফেলেছিল। তার চেয়ে অধিক গরমে কাতর হয়েও, আমি তার সমবয়সী বোন, আমি পারিনি অবলীলায় আমার গায়ের জামা খুলে ফেলতে।
একবার দূরপাল্লার যাত্রায় খুব প্রস্রাবের প্রয়োজন হয় অধিকাংশ যাত্রীর। পুরুষ যাত্রীরা রাস্তার পাশে নর্দমা বা গাছের আড়ালে প্রাকৃতিক কাজটি সেরে ফেলে। বাসের মেয়ে-যাত্রীরা প্রচণ্ড বেগ থাকা সত্ত্বেও সেদিন জল বিয়োগ করবার জন্য নামতে পারেনি। যদি কেউ একজনও এই কাজে অগ্রসর হত আমি জানি দৃশ্যটি চমৎকার উপভোগ্য হত বাসের আর সকল যাত্রীর চোখে। এই লজ্জা এবং সঙ্কোচের চাকু নারী-শরীরকে একশ’ ভাগে কেটেছে বলে ওরা কেউ বিষম প্রয়োজনেও বাসের আসন ছেড়ে দাঁড়ায়নি। আমার জামার বোতাম খুব শক্ত করে এঁটেছি সেই তেরো বছর বয়স থেকে। গরমে সেদ্ধ হলেও আমার জামা খুলতে আড়াল লাগে। আমি খোলা হাওয়ায় গা খুলে স্নান করতে পারি না।
যে মানুষ এত বন্ধন, এত প্রতিবন্ধকতা বহন করে জীবন শুরু করে, সে খুব কম বিপত্তি, কম গলি ঘুপচি, কম অন্ধকার, কম পর্বত, কম অরণ্য পেরিয়ে বয়স্ক হয় না। যে কোনও নারীই গায়ে একটি বেড়ি অনুভব করে, নারীত্বের বেড়ি। (যেহেতু সে নারী এবং তার সারা অঙ্গে নারীত্বের বেড়ি—তার পথ মাপা এবং গন্তব্য নির্ধারিত।) সে তার সীমিত অঙ্গনে পদচারণা করে পদক্ষেপকে সংযত এবং সংক্ষিপ্ত করে। যত সে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় তত তার অভিজ্ঞতা ও অনুভবের ভেতর আবিষ্কার করে নতুন চৈতন্য। নারীকে তাই মানুষের অধিক মানুষ বলতেই আমি পছন্দ করি।
নারীর ধারণ করবার ক্ষমতা এত বেশি যে আমি নিজে নারী হয়ে বিস্ময় বোধ করি। নিজের শরীরের ভেতর অন্য এক শরীর ধারণ করবার অভিজ্ঞতা যে একবার অর্জন করেছে তার কাছে পৃথিবীর সকল নির্মাণই তুচ্ছ হতে বাধ্য। সে নিজ অস্তিত্বের অনুরূপ এক অস্তিত্বকে নিজের ভেতর লালন করতে পারে, একইভাবে অসংখ্য অস্তিত্বকে। আমি এই ধারণের তুলনা অন্য কিছুর সঙ্গে দেবার সাহস করি না।
সেদিন আমার চোখের সামনে এক তরুণী অপর তিনজন সহ, সম্ভবত তার আত্মীয়, এক মেলায় হাঁটছিল। হেঁটে হেঁটে এক সময় আমার একেবারে কাছে খানিক থেমেছে, আমি লক্ষ্য করি পাশে একটি হোন্ডায় ভর রেখে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ছেলে, বয়স কুড়ি একুশ, আমড়া খেয়ে আমড়ার আঁটি মেয়েটির দিকে ছুড়ে দেয়। সেই আঁটি গিয়ে মেয়ের চুলে আটকায়। মেয়েটি চারপাশে তাকায়, চারপাশের চেয়ে সে বেশি তাকায় তার আত্মীয় তিনজনের দিকে। তার চোখ লজ্জায় ও শঙ্কায় অবনত। চুল থেকে দ্রুত আঁটি খুলে এমন তাকায় যেন সে এইমাত্র একটি মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছে এবং যেন ছেলে-ছোকরাদের অসভ্যতা গায়ে এসে পড়বার কারণ সে, সে নিজে, যেহেতু সে নারী, তাই নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত সে এভাবেই করে যে সে লজ্জিত হয়, আড়ষ্ট হয়, সে অপরাধী হয় এবং ওই স্থান থেকে নিজেকে সে দ্রুত বিতাড়িত করে। যারা এই দুষ্কর্ম করেছে, ঘৃণা বা ধিক্কার সেই দিকে যায় না, দৃষ্টি যায় মেয়ের দিকে। কেন, চারদিকে এত মাথা, আমড়ার আঁটি এসে অন্য মাথা রেখে এই মাথায় পড়ে কেন? মাথাটিরই নিশ্চয় দোষ। সকল দোষ, সকল অপবাদ, পুরুষের অপকর্মের সকল ফলাফল সে একই ধারণ করে। ধারণ করে পুরুষের যাবতীয় অস্থিরতা, অসুস্থতা, স্বৈরাচার। ধারণ করে সে পরিবেশ সুস্থ রাখে, সংসার সমাজ সুস্থ রাখে। যে নারীর স্বামীরা প্রকাশ্যে ভিন্ন রমণীতে উপগত হয়—সে নারী কি ধারণ করে না দাম্পত্যের সকল স্থলন? তেরো বছর বয়সে জামার বোতাম যারা এঁটেছিল শক্ত করে—জীবনের সকল কষ্ট তারা তেমন শক্ত করে বুকের মধ্যে এঁটে রাখে।
পুরুষেরা নারীর এক শরীরে আরও বহু কিছুর ধারণ দেখতে চায়। স্ত্রীকে মাতারূপে ভগ্নীরূপে, প্রিয়ারূপে দেখলে পুরুষের বড় সুখ হয়। একের ভেতরে তিনের বড় কাঙাল তারা। তাদের খুব সাধ—তারা যখন ঘরে ফিরবে—স্ত্রীরা যেন সুস্বাদু খাবার রান্না করে নিজেরা না খেয়ে মায়ের মত অপেক্ষা করে। বড় বোনের মত যেন তারা জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, কাপড়চোপড় কেচে রাখে। প্রেমিকার মত যেন তারা বিছানায় মেলে ধরে অনিন্দ সুন্দর দেহ।
পুরুষেরা ঘরের বিভিন্ন কাজে নিজেদর সুবিধা অনুযায়ী স্ত্রীকে বিভিন্ন রূপে পেতে আগ্রহী। স্ত্রীকে বিভিন্ন অভিনয় করিয়ে তারা বাহবা দিচ্ছে, তালি দিচ্ছে। যত বেশি বহুমাত্রিক অভিনয়ে স্ত্রীরা পারদর্শি হয়, পুরুষের লাভ তত, আনন্দ তত শরীর এবং মনের।
বন্ধন কি সেই থেকে শুরু, গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে তেরো বছর বয়সের মেয়েরা যখন জামা খুলে ফেলতে পারে না? প্রাকৃতিক বিভেদ ছাড়া নারী ও পুরুষে আসলে কোনও বিভেদ নেই। আর প্রাকৃতিক বিভেদই—এই সমাজের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এই পুঁজি খাটিয়ে তারা ব্যবসা করছে, মুনাফা লুটছে।
যে মাটিকে মানুষ পায়ে পিষে মারে, খোদাই করে, খুবলে তোলে—সেই মাটির নাম দিয়েছে জননী। মাটিকে নারীর মত ভাবা হয়, যেহেতু সে ধারণ করে, যেহেতু সে নিষ্পেষিত হতে—যেহেতু সে কর্তিত, বিদীর্ণ ও চূর্ণ হতে দ্বিধা করে না।
নারীকে এমন এক খেলনা বানানো হয় যে, চাবি দিলেই পুরুষের বেষ্টনির মধ্যে একবার সে ঢোল বাজাবে, একবার বাশি। মূলত পুরুষকে সে স্বস্তি দেবে, একই সঙ্গে রকমারি আনন্দ।
৪২. পৌরুষিক অত্যাচার
১. ওরা আমাদের বাড়িতে বেলপাতা নিতে আসত পুজোর জন্য। ওদের লক্ষ্মীপুজোয় খেতে গিয়েছি তিলের নাড়ু, নারকেলের বরফি। খুব ভোরে ওরা ফুলের ঝুড়ি ভরে নিয়ে গেছে আমাদের লাল মাধবীলতা। দুর্গোৎসবে আমরাও দল বেঁধে সন্ধেয় বেরিয়েছি পুজো দেখতে। বিসর্জনের রাতে দেবীকে আরতি দিয়েছি। ওরা আমাদের ঈদের দুপুরে পোলাও কোর্মা খেয়েছে। কই, কারও কোনও অসন্তোষ তো দেখিনি।
মানিকগঞ্জে কালিগঙ্গার ধারে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। স্কুলের মাঠে সরস্বতীর পূজোমণ্ডপ। ওই স্কুলে দল বেঁধে মুসলমান ছেলেরা পড়তে আসে। কই, কেউ তো ঢ়িল ছুড়ে সরস্বতীর কপাল ফুটো করেনি।
ভারতের অযোধ্যায় মসজিদ নিয়ে গণ্ডগোল হয়, আর এদেশে মুসলমান নামের কাফের নিরীহ হিন্দুদের অবলীলায় জবাই করে, দোকানপাট ঘর-বাড়ি লুঠ করে। আমার বাড়ির পাশের মন্দিরগুলো গুড়ো হয়ে গেছে, মন্দিরের একটি ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে এনেছি—দেখে আমার মা আঁতকে উঠেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি এটি মসজিদ না মন্দিরের টুকরো।
(ধর্মের দালান কোঠা যদি মানুষে মানুষে ভালবাসা নষ্ট করে তবে এই পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাক মন্দির, মসজিদ, গির্জা ও প্যাগোডার সকল অস্তিত্ব। ইট-সুরকির চেয়ে মানুষ বড়। ইট-সুরকির চেয়ে ভালবাসা বড়।)
২. চার-পাঁচজন পুরুষের একের পর এক একটি মেয়েকে ধর্ষণ করবার ঘটনাকে লোকে ‘পাশবিক অত্যাচার’ বলে। আমি এই ক্ষেত্রে পাশবিক শব্দটিতে বড় আপত্তি করি। পশুর মত আচরণকে পাশবিক বলা হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত, চার পশু একত্র হয়ে যত নিচেই নামুক, এত নিচে নামে না—যত নিচে পুরুষেরা নামে। তাই এ ধরনের অত্যাচারকে ‘পৌরুষিক অত্যাচার’ বললে অত্যাচারের নির্মমতা ভাল আন্দাজ করা যায়।
৩. তৃতীয় বিশ্বে পিতা ও স্বামীর উত্তরাধিকার ছাড়া নারীরা রাজনীতির নেতা হতে পারে না। নারী, সে যদি মানুষ হয়, সে যদি শক্তিমান হয়, তবে কোনও উত্তরাধিকার ছাড়া সে রাজনীতি করুক, আর সেই রাজনীতি নারীকে স্বতন্ত্র করুন, অন্যের জনপ্রিয়তার লেজ ধরে তৃতীয় বিশ্বের নারী আর এগোবে কতদূর? এবার সময় এসেছে থামার। নারী নিজ কণ্ঠে তুলে নিক নিজের শ্লোগান, নারী নিজ হাত মুষ্টিবদ্ধ করুক, তর্জনী যদি তোলে একবার নিজস্ব তর্জনী তুলুক।
৪৩. উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
আমি মধ্যবিত্ত সংসারে মানুষ। উচ্চবিত্তের জীবনযাপন খুব কম দেখেছি। সেদিন আমার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য কি না জানি না এক উচ্চবিত্তের বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। বাড়ি গুলশান। ভদ্রলোক এককালে মন্ত্রী ছিলেন, এখন বাণিজ্য করছেন; ভদ্রমহিলা একটি কোম্পানির পরিচালক জাতীয় কিছু। ওঁরা আমাকে প্রথম যে ঘরে নিয়ে বসলেন, ওটি মদ খাবার ঘর। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল আমি কি খাব অর্থাৎ কোন নামের মদটি আমার পছন্দ। আমি কোমল পানীয়ের কথা বলতে সম্ভবত ওঁরা আমাকে অতিথি হিসেবে খুব উঁচুদরের ভাবলেন না।
এক-এক করে অভ্যাগত আসছেন। আমরা বড় একটি হলঘরে বসলাম। যেহেতু মানুষ আমার প্রিয় এবং প্রধান বিষয়—আমি ওঁদের বাক্য এবং আচরণের প্রতি মনোযোগী হলাম। আর খুব অবাক হয়ে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, বাড়ির ভদ্রমহিলা—বয়স পঞ্চাশের কাছে আমি জানি, যদিও তার শরীর এবং সৌন্দর্য সেই বয়সকে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে—তিনি আঁটসাঁট পরা শাড়িটি বারবারই বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন, বিশেষ করে যখন পুরুষ অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। আমি এই আচরণের কোন অনুবাদ জানি না। কেন এই বিত্তবান ভদ্রমহিলার হাত অত্যন্ত সজাগ থাকে যেন শাড়ির আঁচল এসে তার পীনোন্নত পয়োধর আড়াল না করে? অতিথিরা পরপরের সঙ্গে ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠছেন, চোখ নাক বন্ধ করে, কাঁধ শ্রাগ করে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করছেন, এক দম্পতি আরেক দম্পতির গালে চুমু খাচ্ছেন অর্থাৎ এর স্ত্রী ওঁর স্বামীকে অথবা এর স্বামী ওঁর স্ত্রীকে। আমি ক্রমেই বিস্মিত হচ্ছিলাম এবং খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এই দম্পতিদের বিচিত্র জলসায় আমি এক একটি মানুষ বড় বেশি দৃষ্টিকটু ঠেকছি। আমার হাতে কোমল পানীয়ের গ্লাস, আমি ওঁদের দেখছি, এবং অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছি গ্লাসে। আমার জন্য সে এক আশ্চর্য সন্ধ্যা বটে।
আমার সঙ্গে অতিথিরা যখন নিজ দায়িত্বে পরিচিত হতে চাইলেন সকলেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি মিসেস?’ ওঁরা যেমন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে যে আমি মিসেস আলম, আমি মিসেস মহিউদ্দিন, আমি মিসেস সাদেক—তেমন মিসেস জাতীয় কোনও পরিচয় না দিয়ে আমি বললাম, আমার নাম নাসরিন । ওঁরা কিছুটা বিস্মিত হলেন এবং কিছুটা মৰ্মাহতও বোধ হয়।
ফারুক, আমানুল্লাহ, সফিউদ্দিনের বিত্তের ওপর ভেসে বেড়ানো এই দ্বিপদী জীবগুলো গা ভর্তি প্রদর্শন করার জন্য শাড়ি এবং শাড়ির আঁচলকে গা থেকে প্রায় ফেলে দিতে পারলেই যেন ওঁরা বাঁচেন ।
কেন এই বিকৃতি? কেন ‘মিসেস’ শব্দের কালিতে নিজের নামকে ওঁরা মুছে ফেলেন? আর অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে অঢেল বিত্ত মিশিয়ে এমন এক উদ্ভট সংস্কৃতি তৈরি করেন যা ঠিক বাঙালির নয়, আবার ইংরেজেরও নয়। বাংলা বলতে গেলে আমি লক্ষ্য করেছি ওঁদের জিহ্বা আচমকা ভারি হয়ে যায় এবং স্বরধ্বনির সঙ্গে মোটেও সহযোগিতা করে না। ওঁরা কেউ নিজের নামে পরিচিত নন। ওঁরা স্বামীর সঙ্গী হিসেবে দেশে অবস্থান করেন এবং বিদেশ ভ্রমণ করেন। ওঁরা নিজ নিজ ঘরের পার্টিতে একটি পৃথক সংস্কৃতি লালন করেন, ওঁরা হাই হ্যালো বলে এর ওঁর গায়ে গড়িয়ে পড়েন। ওঁরা শরীরকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে মনে করেন বলে শরীরকেও রঙে ও রেখায় এমন প্রকট উপস্থিত করেন যেন সকলে শরীরের তারিফ করেন। ওঁরা অনর্গল ঐর ওঁর প্রতি অশ্লীল বাক্য নিক্ষেপ করে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করেন।
একসময় আমার চোখও ক্লান্ত হয়, আমার শ্রবণযন্ত্রও বিরক্ত হয়। আমি হঠাৎ ঘর ভর্তি ওই অসুস্থ মানুষগুলোকে চমকে দিয়ে বলি আমি যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি বলে কারও কোনও উদ্বেগ নেই। কারণ আমার গা ভর্তি অলংকার নেই, বাংলায় কথা বলতে আমার জিহা আড়ষ্ট হয় না, আমার গায়ে আঁটসাঁট পোশাক নেই, আমি কোনও মিসেস নামে পরিচিত নই, আমার গল্পে আজ ইউরোপ কাল আমেরিকার গন্ধ নেই। আমি চলে আসতে বাধ্য হই কারণ এই মেয়েরা যাঁরা নিজেদের খুব আধুনিক বলে দাবি করেন, স্বামীর ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কাগজপত্রে পরিচালক হিসেবে যাঁরা বহাল আছেন, যারা অন্য পুরুষকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়াকেই নারী স্বাধীনতা বলেই ভাবেন হয়ত—ওঁদের গা থেকে ভুর ভুর করে টাকার গন্ধ বেরিয়ে ঘরকে এত ঠেসে ধরেছিল যে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
এই নির্বোধ মেয়েরা কঠিন পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে শরীর দুলিয়ে বিত্ত এবং বৈভবের গল্প বলেন। লোকে ওঁদের শিক্ষিত এবং সন্ত্রান্ত বলে জানে। আর আমি ওই অন্ধকারে পড়ে থাকা অশিক্ষিত মেয়েদের বিকৃত সভ্যতার গালে দুটো চড় কষাতে চাই। জানি ওঁরা সভ্যতার শিকার, ওঁরা পুরুষ তৈরি সমাজের নিয়মে আক্রান্ত নিরীহ প্রাণী মাত্র।
মিসেস নামের আড়ালে আমি নাজমা, শাহানা, ডালিয়া, চিত্রা, নিপা, শিখা, ফেরদৌসী, নুপুর, কুসুম নামের মানুষগুলোকে অন্তরে অনুভব করি। ওঁরা কি ইচ্ছে করলেই পারেন না নিজ নামে পরিচিত হতে, ওঁরা কি হীরে সোনার কাছে নিজেকে বিক্রি না করে, নিজেকে এমন ফাঁপা এবং অন্তঃসারশূন্য আনন্দদায়িনী শরীর না করে একবার মানুষ করতে পারেন না, পূর্ণাঙ্গ এবং সম্পূর্ণ মানুষ—যে মানুষ এক দাঁড়াতে পারে, একা এক ব্যক্তি সুস্থ মেরুদণ্ড নিয়ে এমন যে ইবসেনের মত বলা যায়–The strongest man in the world is the man who stands most alone.
একটি দরিদ্র দেশে বিত্ত নিয়ে যে ব্যভিচার চলে গুটিকয় সংসারে, তা দেখবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। গুলশান থেকে ফিরে আসবার পথে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের কথা ভাবি, এবং কিলবিল করে হেসে ওঠা ওই পঙ্গু নারীদের কথা ভেবে গায়ে কঁকিয়ে ওঠে তীব্র শোক। এই দুর্ভাগা দেশ এবং দেশের দুর্ভাগা নারীর জন্য শোকে ও সন্তাপে আমার মাথা নুয়ে আসে।
৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা
২৮-১১-৯০
–গত রাতে বি-বি-সি কী বলেছে?
—আমি ঠিক জানি না। দাঁড়া, কামালকে জিজ্ঞেস করি।
–কেন, খবরের সময় কোথায় ছিলি?
—কাজের কি শেষ আছে, সামনে সুহৃদের পরীক্ষা।
—তোদের বাড়ির কাছে দুটো ছেলে গুলি খেয়েছে শুনলাম!
–কী জানি, কামাল জানে বোধহয়।
–গুলির শব্দ পাসনি?
—ঠিক খেয়াল করিনি। তবে গতকাল না পরশু বোধহয় খুব শব্দ হচ্ছিল।
–কিসের শব্দ? বন্দুক, পিস্তল, ককটেল, পটকা? কিসের?
—আমার ভাসুর বলছিলেন…
—কি বলছিলেন?
–ঠিক মনে নেই।
—কারা গুলি করেছে? পুলিশ না কি সরকারি সন্ত্রাস বাহিনী?
–তাও জানি না।
–তুই জানিস কী বকুল?
–দেখ এসব আমি খবর রাখব কখন? আমার সংসার আছে না?
–সংসার থাকলে জানা যায় না তোর ঘরের কাছে কোন দুটো ছেলে মরে গেল, কারা মরল, কেন মরল? কোথায় গুলি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, দেশে কারফিউ কেন?
বকুল, আমার বান্ধবী। বকুলের মেধা ও মনন তার স্বামী কামালের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির খবর রাখবার দায়িত্ব কামালের। বকুলের নয়। বকুল ঘর গোছায়, বকুল ছেলেকে স্কুলে নেয়, বকুলের ছেলের পরীক্ষা সামনে। বকুল তার ছেলেকে ইংরেজি রাইম মুখস্থ করায়। বকুলের বাড়ির পাশ দিয়ে তখন মিছিল যায়, ছাত্রদের মিছিল। সেই মিছিলে গুলি হয়। বকুল তখন পায়েস রান্না করে। বকুল তখন স্বাদ বাড়াবার জন্য পায়েসে কিছু এলাচ ও কিসমিস দেয়।
২৯-১১-৯০ সকাল
—কারফিউ-এ আছ কেমন?
—আর ব’লো না, ফ্রিজ একেবারে খালি।
—তোমাদের ওদিকে কোনও ঘটনা ঘটছে?
—কী আর ঘটবে, সকালে মুদি দোকানের ঝাঁপি খুলে ডিম এনেছি দুহালি।
—বড় রাস্তায় কিছু দেখেছ? মিছিল, পুলিশ, ছাত্র ঐক্যের ছেলেপিলেদের?
–ডিম কি আমি কিনেছি যে দেখব? গেছে কাজের মেয়ে।
—বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকছ। ওখানকার পরিস্থিতি…
–সবার একই অবস্থা। আমার মত। আমাদের ফ্ল্যাটে মিসেস আলম ছাড়া আর কারও ফ্রিজে মাছ মাংস নেই।
—হলগুলোর কি অবস্থা? রোকেয়া হলে শুনেছি কিছু মেয়ে থেকে গেছে?
—হুমায়ুন দেখছি এসব নিয়ে টিচারদের সঙ্গে আলাপ করছে। আমি আলাপে ছিলাম না।
—তো, ভালই আছ, তুমি, কী বল?
—যে খারাপ এলাকায় থাকি, কখন কী হয়, দোয়া করো।
আমার এই বোনের নাম মমতা। মমতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে খারাপ এলাকা বলে। মমতা অপেক্ষা করছে কারফিউ ভাঙবার। কারফিউ ভাঙলেই সে ঝুড়ি ভরে বাজার করবে। কাটাবাছা করবে, রান্না চড়াবে। দেশ রসাতলে গেলে মমতা কী করবে আমি জিজ্ঞেস করিনি। সম্ভবত তখনও সে হুমায়ুনের কাছে জিজ্ঞেস করবে তার কী করা উচিত।
২৯-১১-৯০ সন্ধে
—আপনার ছোট ভাই তো সেই মিছিলে ছিল যে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়ছে?
—হ্যাঁ ভাই, কী আর বলব। এত বারণ করি এসবে যেতে। এসব মিছিল, মিটিং-এ গিয়ে কোনও লাভ আছে, বল? আববা-আম্মা কেঁদে কেটে আকুল।
–কেন?
–ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল!
–ছোটটি করছে কী, রত্না! ওকে দিন না!
–এই দিচ্ছি।
–কেমন আছ?
—সারাদিন ভি-সি-আর-এ ছবি দেখেছি, কী মজা!
—টি-ভি-ও তো খোলা তাই না?
—টি-ভি-অলারা কিসব খেলাফেলা দেখাচ্ছে, ছাই। কাম সেপ্টেম্বর দেখেছ? রক হাডসন কি সুইট না গো? কেন যে মরে গেল!
–সামনে তোমার পরীক্ষা না?
—আরে পরীক্ষা হবে না। পুরো ডিসেম্বর তো স্কুল বন্ধ। ইস্ আজ যদি আফজাল-সুবর্ণার একটা নাটক হত!
এরা আমার আত্মীয়। এই মেয়েরা। এরা এভাবেই বড় হয়ে উঠছে। এভাবে গা বাঁচিয়ে এবং তুচ্ছ আমোদ-আহ্লাদে।
৩০-১১-৯০
–কিগো মেয়ে, হল ত্যাগ করেছ?
—না করে উপায় আছে?
—বাড়ি যাবে কবে?
—কারফিউ ভাঙলেই আর এক মুহুর্ত দেরি নয়।
—কেন ঢাকায় থেকে যাও। মামার বাড়ি। অসুবিধা কী?
–না ভাই, দেশে যে গণ্ডগোল।
–তুমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মেয়ে। তোমার গণ্ডগোলে ভয় কেন?
—কী যে বলছেন দিদি। রুমের মধ্যে আয়াতুল কুরসি পড়ে দিন কাটিয়েছি।
—মিছিলে যাওনি।
—মাথা খারাপ?
—সূর্যসেন-মোহসিন হলের ঘটনার সময় কোথায় ছিলে?
–রুমে |
–বের হওনি কেন?
–ওই যুদ্ধক্ষেত্রে?
—কেন যুদ্ধক্ষেত্রে তো ক্লাসের ছেলেরাই ছিল, তোমার বন্ধুরাই—তবে?
—যদি কিছু হত?
—‘যদি কিছু’ তো ওদের বেলায়ও ঘটতে পারত।
—ছেলেরা এদিক ওদিক দৌড়-টোর দিতে পারে।
—মেয়েদের কি হাত-পা ভাঙা?
এই মেয়ের নাম দীনা। ইউনিভার্সিটির চৌকস মেয়ে। এই মেয়ে মিছিলকে ভয় পায়। বাইরে আন্দোলন, বাইরে সংঘর্ষ, বাইরে এক-সমুদ্র বিপদের মধ্যে ডুব-সাঁতার দিচ্ছে সচেতন মানুষ, আর দেশের শিক্ষিত মেয়েরা নিজেদের বিপদ এড়াতে ঘরে বসে আয়াতুল কুরসি পড়ছে।
২.
গত ১-১২-৯০ তারিখে তিন জোটের যৌথ আহ্বান ও নির্দেশাবলি প্রচারিত হয়েছে। ওই নির্দেশাবলির এগারো নম্বরে লেখা—বীর ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, নারীসমাজ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিসেবী, টি.ভি ও বেতার শিল্পী ও কলাকুশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের গৃহীত সকল আন্দোলনের কর্মসূচী সফল করুন।
নারী কি সাংবাদিক নয়, চিকিৎসক নয়? নারী কি শিক্ষক হয় না? আইনজীবী হয় না? প্রকৌশলী, সংস্কৃতিসেবী, বা টি.ভি বেতারের শিল্পী নয় তারা? তবে আলাদা করে নারীসমাজ লিখবার কারণ কি? নারীকে সকল সমাজ থেকে দূরে নিক্ষেপ করবার উদ্দেশ্য কী? যদি বলি, এই পৃথক হওয়ার কারণেই নারী মিছিলে নামে না। গুলিবিদ্ধ হয় না, আন্দোলনের খবর রাখে না, নারী ভয়ে পিছু হটে, ভি.সি.আরে ছবি দেখে পার করে বিক্ষোভের উত্তপ্ত দিন।
নারী ভিন্ন এক সমাজে চিহ্নিত হবে কেন, যে সমাজ কোনও পেশাকে নয়, লিঙ্গকে চিহ্নিত করে? নারী যদি এভাবেই নিক্ষিপ্ত হয়, তবে এর চেয়ে ঢের ভাল তার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
৪৫. মিস্টার বনাম মিস এবং মিসেস
বিয়ে দুজনেরই ঘটে, নারী এবং পুরুষ, দুজনেরই কিন্তু বিবাহিতের যাবতীয় চিহ্ন নারীকেই এক বহন করতে হয়, পুরুষকে নয়। অবিবাহিত এবং বিবাহিত পুরুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই; নামে নেই, কাপড়-চোপড়ে নেই, চুলের ফাকে নেই, হাতের আঙুলে নেই। বিবাহিত এবং বিপত্নীক পুরুষকেও আলাদা করবার কোনও উপায় নেই। অথচ অবিবাহিত ও বিবাহিত নারীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিবাহিত এবং বিধবা নারীর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা।
পাশ্চাত্যে এই নিয়মটি খুব প্রচলিত, কোনও নারী যখন কোনও পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট হয়—নারী তার আঙুলে একটি অঙ্গুরি পরে, এবং বিবাহিত হবার পরও একটি অঙ্গুরি। নারীর হাতের অঙ্গুরিই তার বিবাহিতের চিহ্ন বহন করে। নারী তার বিবাহের সকল সংস্কার একাই এক অঙ্গ জুড়ে লালন করে। শুধু পাশ্চাত্যে নয়, প্রাচ্যেও এই অঙ্গুরি নারীর কুমারীত্ব ঘুচে যাবার চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিবাহিত, অবিবাহিত ও বিধবা নারীর সজ্জা বিভিন্ন রকম। তবে পৃথিবীর সকল দেশের সকল সম্প্রদায় পুরুষের জন্য একই রকম সজ্জা এবং সম্বোধন তৈরি করেছে। অবিবাহিত নারী তার নামের আগে মিস এবং বিবাহিত নারী মিসেস শব্দ ব্যবহার করে নিজের বৈবাহিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। কিন্তু পুরুষ তার ‘মিস্টার’ সম্বোধনটিকেই আগাগোড়া লালন করে মিস্টার সৌমেন এবং মিস্টার মিলনের মধ্যে কে বিবাহিত এবং কে বিবাহিত নয় তা নির্ণয় করবার সাধ্য আছে কারও?
কিন্তু মিস লীনা এবং মিসেস বীণার বৈবাহিক পরিচিতি সম্বন্ধে আমরা মোটেও সন্দিগ্ধ নই। নারী বিবাহিত কি বিবাহিত নয়, তা তার নামের মধ্যে নিহিত—বিবাহ নিশ্চয়ই নারীর জন্য অধিক গুরুত্ববাহক কিছু, যা পুরুষের জন্য নয়। বিবাহ একটি নারীর জীবনযাপনে এমন পরিবর্তন ঘটায়, তার ঘর দরজা পরিবর্তিত হয়, তার পোশাক-আশাক পরিবর্তিত হয়; তার নিরাভরণ হাত, নাক ও সাদা সিথিও পরিবর্তিত হয়; পুরুষের জীবনযাপনকে বিবাহ কোনও পরিবর্তন দেয় না।
নারী এয়োতির চিহ্ন বহন করে, হাতে শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর, নাকে নোলক, গায়ে গয়না, কাতান বেনারসী পরে নারী প্রমাণ করে সে বিবাহিত। এই সজ্জার অর্থ সে একটি পুরুষের কাছে বাঁধা, সে তার অঙ্গুরি ও সম্বোধন দিয়ে বাঁধা, সে তার ঝলমলে পোশাক ও শাখা-সিদুর দিয়ে বাঁধা। পুরুষেরাও চুলে সিঁথি করে, সেই সিঁথিতে তারা সিঁদুর পরে না, পুরুষেরও দুটো হাত আছে, সেই হাতে তারা শাঁখাও পরে না। তাদের সজ্জায় কোনও পরিবর্তন নেই, তারা নানা ধাতুদ্রব্য দ্বারাও অলংকৃত হয় না।
বিধবা এবং বিপত্নীক-এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিধবার গা থেকে যাবতীয় অলংকার খুলে ফেলতে হবে। বিধবার পরিধেয় বস্ত্র হবে কাফনের মত সাদা। অন্য এক সম্প্রদায়ে বিধবার আমিষ খাওয়ার বিধান নেই, বিধবা মাছ মাংস ডিম দুধ খেতে পারবে না। কিন্তু বিপত্নীক পুরুষের জন্য কিছুই বাধা নয়। তাকে নিরাভরণ এবং নিরামিষাশী হতে হয় না।
আমিষ শরীরের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় খাদ্য। এই খাদ্যকে নিষিদ্ধ করবার কারণ, বিধবা নারীকে অপুষ্টি এবং নানা রোগব্যাধির দিকে ঠেলে দেওয়া। বিধবাকে শারীরিক ও মানসিক জরার শিকার করা এক ধরনের গোপন অভিসন্ধি পুরুষ এবং পুরুষ তৈরি সমাজের।
নারী ও পুরুষ যদি মানুষ হিসেবে সমান মাপের হয়, তবে বিবাহের সঙ্গীটির মৃত্যু হলে নারীকে যে আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, পুরুষকে তা যেতে হয় না কেন? কেন পুরুষের শরীরে জড়াতে হয় না সাদা কাফনের মত কাপড়, পুরুষকে নানা ব্রত পালন করতে হয় না, আমিষ বর্জন করতে হয় না?
আমরা কি একবার ভেবে দেখতে পারি, মানুষে মানুষে এত বৈষম্য কেন? সঙ্গীলাভের এবং সঙ্গীহীনতার আচার কেন দুজনের ক্ষেত্রে দুরকম? নারীকে নানা কিছু অর্জন এবং বর্জন করতে হয়। আর পাশাপাশি পুরুষেরা ঝাড়া হাত পা। অবিবাহিত, বিবাহিত এবং বিপত্নীক অবস্থায় পুরুষেরা কোনও সংস্কার স্পর্শ করে না; পুরুষ তার শরীরে-স্বভাবে কিছু অর্জন করে না, এবং শরীর ও স্বভাব থেকে কিছু বর্জনও করে না।
কেবল নারীকেই হতে হয় অলংকৃত এবং নিরলংকৃত। কারণ, সামাজিক এই নিয়মের একটিই কারণ, পুরুষের জীবনে নারী খুব তুচ্ছ একটি ঘটনা, কিন্তু নারীর জীবনে পুরুষ অতি মূল্যবান, অতি উৎকৃষ্ট, অতি কাঙিক্ষত, অতি আরাধ্য বিষয়—তাই নারীর শরীরে ধারণ করতে হয় সধবার ঔজ্জ্বল্য এবং বৈধব্যের বিষাদ। শরীরে ধারণ করবার কারণ—শরীরই নারীর একমাত্র সম্পদ। শরীরের ত্বক যদি মসৃণ এবং উজ্জ্বল হয়, শরীরের অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গ যদি সুডৌল ও সুছাদ হয় তবে পুরুষ নারীকে ভোগের জন্য নির্বাচন করে। আর যে নারী পুরুষের ভোগে আসে না, সে নারী সমাজে উপেক্ষিত, অপকৃষ্ট, অপাঙক্তেয় ও অস্পৃশ্য।
পুরুষের ভোগের যোগ্য হলেই নারীকে সাজানো হয় মূল্যবান বস্ত্র ও ধাতুতে। পুরুষের ভোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই তাকে নিক্ষেপ করা হয় সমাজের আস্তাকুঁড়ে, নারীর প্রধান যোগ্যতা পুরুষের যোগ্য হওয়া। নারীর প্রধান যোগ্যতা পুরুষকে তৃপ্ত ও তুষ্ট করা।
কী এই সমাজ এবং কেন এই সমাজ–নারী যদি সমাজের অন্তঃসারশূন্য চেহারা একবার অনুভব করতে পারে, নারী যদি নিজেকে মানুষ হিসেবে একবার উপলব্ধি করতে পারে; তবে একটি পুরুষ তার জীবনযাপনের সঙ্গী হওয়ার কারণে তার গায়ে কোনও ধাতব-পদার্থের বৃদ্ধি ঘটবে না, তার পোশাকে কোনও পরিবর্তন আসবে না, তার নাকে, হাতে, হাতের আঙুলে ও সিথিতে কোনও উপদ্রব উপস্থিত হবে না। এবং তার সম্বোধনেও নয়।
একটি সম্পূর্ণ ও একক মানুষ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করবার প্রথম উপায়—নারী তার নাম থেকে, অঙ্গ থেকে বিবাহ ও বৈধব্যের বেশ খুলে ফেলবে। নারী যদি নিবোধ না হয়, তবে নিশ্চয় অলংকার তাকে আর কলংকিত করবে না, মিস ও মিসেসের চিহ্নিতকরণ তাকে আর জড় বস্তুতে পরিণত করবে না, সাদা বৈধব্য তাকে আর স্থবিরতা দেবে না নিরামিষ আহার তাকে চিতার দিকে ঠেলবে না।
নারী, তুমি সকল মিথ্যে সংস্কার ভেঙে এবার মানুষ হও।
৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না
একবার এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম—সমস্যা কী? ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, ওর বাচ্চা হয় না। স্ত্রীর সারা মুখে অপরাধের শ্যামল ছায়া। তাদের বিয়ে হয়েছে সাত বছর। ভদ্রলোক নিদ্বিধায় স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে সকলকে এমনই বুঝিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম। কিন্তু আমি স্বামী-স্ত্রী দুজনের পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম ভদ্রলোক নিজে অক্ষম, স্ত্রী তার সম্পূর্ণ সুস্থ। দুঃসংবাদটি পরিবেশন করবার পর দু’জনে বিস্মিত হলেন, অর্থাৎ তারা যতদূর জানেন এরকম হওয়ার কথা নয়। আমি সহজ করবার জন্য প্রশ্ন করলাম ভাত রাধতে হলে পাতিলে কি শুধু পানি হলেই চলে?
মেয়েটি মাথা নাড়ল—না।
চাল থাকলে হয়, তাই না?
মেয়েটি হ্যাঁ বলল। আমি এবার তাদের সন্দেহ মুক্ত করবার জন্য বললাম—আর যদি চাল না থাকে তবে তো কেবল পানি ফুটে আর যাই হোক ভাত হবে না।
ভদ্রলোকের Semen analysis-এ কোনও Sperm ছিল না। অথচ কত দীর্ঘ বছর নিরপরাধ স্ত্রীটি আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-পড়শির সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনি। সকলে জানে সতী শব্দের যেমন কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, তেমন ‘বন্ধ্যা’ শব্দেরও নেই। নারীকে একাই মাথা পেতে নিতে হয় ‘বন্ধ্যা’ শব্দের যাবতীয় কলঙ্ক।
‘বন্ধ্যা’ শব্দের একটি পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ কিন্তু আছে, ‘বন্ধ্য’। একথা কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না। কারণ পুরুষ যে বন্ধ্য হতে পারে—এ বিশ্বাস আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। তাই খুব সহজে পুরুষেরা সন্তান না হবার ছুতোয় বউ-তালাক এবং নতুন বিবাহের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে।
প্রখ্যাত স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ স্যার নরম্যান জেফকট বলেছেন, সন্তানের জন্য পুরুষের তুলনায় নারীর আগ্রহ বেশি। নারী নিজের সৌন্দর্য ও শারীরিক গঠনের চেয়ে, নারী নিজের প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিভার চেয়ে অধিক আগ্রহ বোধ করে সন্তানের প্রতি। কিন্তু পুরুষের ঐ আগ্রহ নারীর তুলনায় অত্যন্ত কম, যৎসামান্য। তাই একজন বিবাহিত নারীকে সন্তানহীনতার কষ্ট নাছোড়বান্দার মত আঁকড়ে ধরতে পারে কিন্তু পুরুষকে কখনও নয়। সন্তানহীনতার জন্য পুরুষের যে আম্ফালন দেখি, তা মেকি, বানানো। অসৎ উদ্দেশ্যেই পুরুষেরা সন্তানের তৃষ্ণায় বুক চাপড়ায়।
নারীর ওপর বন্ধাত্বের দোষ দেওয়া হয় সেই প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকে। সেকালে বীর্য পান, মন্ত্রপূত কবচ, প্রার্থনা এবং বিসর্জন দ্বারা বন্ধ্যাত্ব রোগের চিকিৎসা হত। স্ত্রীকে, কেবল স্ত্রীকেই তখন বন্ধাত্ত্বের জন্য দায়ী করা হত। তখন বিজ্ঞান নারী ও পুরুষের শরীর খুঁড়ে বুঝতে শেখেনি অক্ষম কে, তখন নারীই বন্ধ্যা হিসেবে চিহ্নিত হত এবং এখনও কি নয়—যখন শরীর খুঁড়লে পুরুষের অক্ষমতার খবর পাওয়া যায়। এবং এখনও কি নারীকেই বন্ধাত্বের জন্য এককভাবে দায়ী করা হয় না—যদিও বিজ্ঞান অণুবিক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখে পুরুষের শুক্ৰকীট ভাঙা, পুরুষের শুক্ৰকীট স্থির, অচঞ্চল, অসুস্থ?
তবু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনও পুরুষকে অক্ষম বলে না। অক্ষম পুরুষেরা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বিবাহ দ্বারা বার বার নারীকে অপরাধী বানায়। এই সমাজে নিঃসন্তান নারীর কোনও অধিকার নেই একটির পর একটি পুরুষ পাল্টানো। পুরুষ বদল করে তার বন্ধ্যাত্ব ঘোচানো।
পুরুষের বন্ধ্যাত্বের সকল দায় নারীকেই বহন করতে হয়। নারীকেই বহন করতে হয় সকল অপূর্ণতার দায়। পুরাকাল থেকেই জগতে যা কিছু দোষাবহ তার জন্য নারীকে দায়ী করে নির্বিচারে শাস্তিদান করা হয়েছে এবং এখনও, এই পুরুষ প্রধান সমাজ তা থেকে নিরস্ত হয়নি।
এ কথা ক’জন জানে যে একশজন অনুর্বর দম্পতির মধ্যে পঁয়ত্ৰিশ জন পুরুষই নির্বীর্য? এককালে নারীকে আশীর্বাদ করবার ভাষাই ছিল শতপুত্রের জননী হও । নারীকে গাভীর মত ভাবা হত। কোনও মান নেই, মর্যাদা নেই, গর্ভধারণের যন্ত্র ছাড়া সে কিছু নয়। এখন কি ভাবা হয় না–একথা কত জোর দিয়ে বলতে পারি যে—না, দিন বদলে গেছে?
পারি না। কারণ মাতৃত্বকেই এখন নারী জন্মের সার্থকতা বলে বিবেচনা করা হয়; কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত সকল সমাজে। বুদ্ধিবিদ্যা, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব নাকি পুরুষকে মানায়, নারীকে নয়। নারীকে মাতৃত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা এবং স্নেহময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা এক ধরনের কুৎসিত ষড়যন্ত্র।
সন্তান-জন্মদানে এক অক্ষম পুরুষের স্ত্রীকে আমি একবার উপদেশ দিয়েছিলাম দ্বিতীয় বিবাহের। শুনে আঁতকে উঠেছিল সেই স্ত্রী, স্ত্রীর অক্ষম স্বামী এবং আত্মীয়স্বজন সকলে। তারা বিস্মিত হয়েছে আমার এই স্পর্ধায়। কিন্তু অক্ষম স্ত্রীর বেলায় স্বামীকে এই উপদেশ দিলে আমি জানি স্বামী এবং স্বামীর সকল স্বজন লাফিয়ে উঠত আনন্দে।
দিন বদলায়নি। দিন কেন বদলায় না? কেন বন্ধ্য পুরুষ বন্ধ্যা নারীর মত একই নিগ্রহ ভোগ করে না? কেন বন্ধ্য পুরুষদের গ্লানি ও কলঙ্কের বোঝা বইতে হয় না, কেন বন্ধ্য পুরুষেরা পার পেয়ে যায় সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে, বন্ধ্যা নারীর তো মুক্তি নেই কিছুতে।
যদি নারীর মুক্তিই নেই তবে মাতৃত্বের মত পিতৃত্বই হোক এখন পুরুষের প্রধান সাফল্য। এবং পুরুষের বন্ধত্বের সকল দায় পুরুষই ভোগ করুক। অমঙ্গল যদি হয় তবে এক নারীর হবে কেন–পুরুষেরও হোক।
৪৭. কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
‘প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষা নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা ইহার দ্বারা পুত্রপ্রসবযোগিনী শক্তিগুলো হ্রাস পায়। বিদুষী নারীর বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায় এবং তাহদের স্তনে প্রায়ই দুগ্ধের সঞ্চার হয় না। তদুপরি লেখাপড়া শিখিলে বিধবা হওয়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।‘ উনবিংশ শতাব্দীতে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এ জাতীয় বাণী কম সমাদৃত ছিল না। পরন্তু নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তও কেউ অস্বীকার করেনি যে ‘বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংঘটনের আশঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎ পুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িয়া দিবে না, কারণ খাদ্য-খাদক সম্পর্ক।‘
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এখন কেবল এই পরিবর্তন হয়েছে যে নারীশিক্ষার জন্য কিছু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে কিন্তু খাদ্য-খাদক সম্পর্কের কোনও উন্নতি হয়নি। এখনও নারী-পুরুষের মধ্যে এই খাদ্য-খাদক সম্পর্কটিই প্রধান এবং অবিচ্ছেদ্য।
এক পুরুষ কবি লিখেছেন—স্বয়ং বিধাতাও বুঝি পুরুষ। তিনি স্ত্রীলোককে সৃষ্টিই করেছেন এমন করে যে তার এমন কোনও প্রত্যঙ্গই নেই যা পঞ্চশরের আসন বলে চিহ্নিত না হতে পারে। শঙ্কাকুল কবিচিত্ত শেষে স্বস্তি পেয়েছে এই ভেবে যে ভাগ্যিস বিধাতা স্ত্রীলোকের যোনিদেশ পাদমূলের অতি গোপন স্থানে সঙ্কুচিত করে রেখেছেন, যদি তা না করে স্ত্রী দেহের অন্য কোনও স্থানে যোনি সংস্থাপন করতেন তবে সমস্ত জগতই এককালে গ্রস্ত হয়ে পড়ত। কথাটি শ্রুতিকটু অবশ্যই কিন্তু পুরুষের কামুকতার কথা মনে রাখলে এই শ্লোকের বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়।
শুনেছি গৌতম মুনি অহল্যা-কামুক ইন্দ্রকে নাকি শাপ দিয়েছিলেন যে তার সর্ব অঙ্গ স্ত্রী চিহ্নে ভরে যাবে। এটি অভিশাপ বলে গ্রহণযোগ্য হয় কারণ শরীরের একটি বা দুটি স্ত্রী চিহ্নের কারণে একজন নারীকে জীবনভর যে দুৰ্গতি পোহাতে হয়, সারা অঙ্গ স্ত্রী চিহ্নে ভরে গেলে কী ভীষণ দুর্ভোগ তার ভাগ্যে আছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। তাই শাপ হিসেবে স্ত্রীলোক সম্পর্কিত শাপই অধিক উপযোগী।
নারীকে নারী-অঙ্গের বাইরে কল্পনা করবার অভ্যেস কারও গড়ে ওঠেনি। অঙ্গই নারীর জন্য প্রথম এবং প্রধান বিষয়। এই অঙ্গকে পুরুষেরা বরাবরই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। যেন এই অঙ্গ নির্মিত হয়েছে পুরুষের প্রসাদ উপলক্ষে। এই অঙ্গ নিবেদিত হতেই হবে পুরুষের যুপকাষ্ঠে। এক নবজাত শিশুর শরীরে স্ত্রী-চিহ্ন দেখে ওই শিশুরই পিতা দা উঠিয়েছিল শিশুকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে। পিতাটি শুধু শিক্ষিতই নয়, উচ্চশিক্ষিত। স্ত্রী-চিহ্নের শরীরগুলোকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করবার ইচ্ছে সকল পুরুষের মধ্যে বর্তমান, কিন্তু ননিটা ছানাটা খাইয়ে আদর যত্ন করবার অযথা আকাঙক্ষা কারও থাকে না। তার চেয়ে একটি লাউগাছকেই জল সার দিয়ে ডাঙর করা ভাল যেহেতু গাছটি মৌসুমে গিয়ে উপাদেয় ফল দান করবে।
নারী কিছু দান করবার ক্ষমতা রাখে না, কেবল গ্রহণ করে—এই ধারণা সাধারণের কাছে স্পষ্ট। তাই সংসারের ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে তাকে বিবেচনা করবার রীতি এই সমাজে প্রচলিত। কন্যার চেয়ে বাড়ির কুকুরটিকেও মূল্যবান মনে করা হয় যেহেতু কুকুরটি চোর ছেচড় তাড়ায়, বাড়ির গরুটিকেও মূল্যবান মনে করা হয় যেহেতু গরুটি হালচাষে গতর খাটায় এবং বাড়ির গাভীটিকেও অধিক মূল্যবান ভাবা হয় যেহেতু সে পুষ্টিকর দুধ নিঃসৃত করে।
নারীর নিঃসরণের কিছু নেই। সমাজ রায় দিয়েছে, মাসে মাসে ঋতুস্রাবের রক্ত ছাড়া নারীর নিঃসরণের কিছু নেই। নারীকে আদিম যুগে ভাবা হত সংসারের বর্জ্য পদার্থ, মধ্যযুগেও তাই ভাবা হয়েছে, আধুনিক যুগেও তাই। নারীকে অবর্জ্য করবার জন্য সামনে আরও কত সহস্ৰ বছর দরকার, কতগুলো যুগ দরকার আমার সাধ্য নেই তা হিসেব করি।
বুদ্ধিজীবিরা বেশ মাথা ঝাকিয়ে মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়ে যায় নারীর কী করে অগ্রগতি হবে। কী করে সে শিক্ষিত হবে, কী করে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে এবং তারপরই কী তালে ও লয়ে তার নারীমুক্তির বাদ্য বাজবে।
মিথ্যে কথা। আমি একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীর কথা জানি, যাঁকে সমাজের শেয়ালেরা ছিঁড়ে খেয়েছে। খাদক যদি এসে খেয়েই যায়, যদি শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা নারীকে খাদ্যের তালিকা থেকে রেহাই দিতে না পারে তবে যারা যাবতীয় নীতিফীতির ধুয়ো তুলে নারীকে মুক্তির কথা বলে তারা বাকরুদ্ধ হোক, তারা উত্থানরহিত হোক।
হ্যাঁ, আমি অভিশাপ দিচ্ছি। আমার পূর্বপুরুষ পুরুষদের শরীরে নারী-অঙ্গের অভিশাপ দিয়েছিল। নারীও অভিশাপ দেবার নতুন ভাষা আবিষ্কার করুক। আর খাদ্য নয়, নারী এবার খাদক হোক। পুরুষকে খাদ্য হবার অভিশাপ দিক সকল নারী কণ্ঠ। নারী যতদিন ছিড়ে-খুঁড়ে পুরুষ না খাবে, নারী যতদিন পুরুষ শরীরকে একদলা মাংসপিণ্ড হিসেবে ভোগের নিমিত্ত গ্রহণ না করবে ততদিন নারীর রক্তে-মাংসে-মজ্জায় নিহিত পুরুষকে প্রভু ভাববার সংস্কার দূর হবে না।
শিক্ষা, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার রদবদল করবার কথা বলা পুরুষেরই এক ধরনের গোপনে পাতা ফাদ। নারী যদি স্বাধীনতা নামক শব্দটি একবার উচ্চারণ করে তাকে ওই শত ব্যবস্থার নকশা দেখিয়ে নিশ্চুপ রাখা হয়। তারপর নানা রকম ব্যবস্থার নিয়ম অনিয়ম বুঝতে সময় লাগে অর্ধেক জীবন, বাকি জীবন যায় তাবৎ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাষা-ব্যবহার শিখে। এতে অবশ্য কোনও ব্যবস্থারই কিছু যায় আসে না। মাঝখান থেকে নির্দেশক পুরুষেরা বেশ লাভবান হয় আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনে দরিদ্র দেশের শাখা-কর্মী নিযুক্ত হয়ে। আন্দোলন সফল হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক সাহায্য আবার বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে এমন এমন যুক্তি ও প্রসঙ্গ নারী আন্দোলনে দাড় করানো হয় যা কেবল পথের মত দীর্ঘ হয়—কোনও গন্তব্য যার নেই, খুঁজে দেখলে অধিকাংশ পথই দেখা যায় শেষ হয়েছে এক গভীর খাদে।
পতিতালয় তুলে দিলে সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাবে এই বাক্য আউড়ে সমাজের বুদ্ধিমানেরা আসলে দুটো মজা নিতে চায়। পতিতাভোগ এবং অপতিতা ভোগ। দেশে পতিতালয়ের সংখ্যা কম নয় এবং ধর্ষণের সংখ্যাও কম নয়। ব্যবহৃত এবং অব্যবহৃত দুই শরীরই ভোগ করবার একটি আলাদা আনন্দ আছে। তাই রাষ্ট্রের কোনও নীতি যেমন পতিতালয়ের বিপক্ষে যায় না, তেমন অবাধ ধর্ষণের বিপক্ষেও নয়।
নারী ধর্ষণ করতে শিখুক, ব্যভিচার করতে অভ্যস্ত হোক। নারী খাদকের ভূমিকায় না এলে তার খাদ্য নামের কলঙ্ক ঘুচবে না। এখন ভাল কথার যুগ নয়, নীতিবাক্যের সময় নয়। কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়।
৪৮. একটি গন্তব্যের দিকে
একাত্তরের ডিসেম্বরে জনতার জয় দেখেছিলাম, কেবল দেখেইছিলাম, বুঝিনি। এবার ডিসেম্বরে মানুষের সমুদ্রে যে আনন্দের জোয়ার উঠেছে, তা যেমন দেখবার জিনিস, তেমনি অনুভব করবার। আমি এই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করিনি।
ডাঃ মিলনের মৃত্যুর কথা সকলে বলছে—সকল মৃত্যু ছাপিয়ে একটি মৃত্যুই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে সকলের কাছে। ময়মনসিংহের স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ফিরোজ ও জাহাঙ্গীর, ডাঃ মিলনের চেয়ে মানুষ হিসেবে কোনও অংশে কম নয়। কম নয় মনোয়ার, জেহাদ, জাকির, নিমাই–এরকম আরও অনেকে—সকলের নাম আমি জানি না। সরকারি হত্যাকাণ্ডের শিকার সব নাম ঠিকানার প্রচার প্রয়োজন। না হলে সময়ের ট্রাক এসে চাপা দিয়ে যাবে আদ্যোপান্ত ইতিহাস। হুজুগে বাঙালি স্মরণ করতে যেমন পারদর্শি, ভুলতেও তার সময় লাগে না। মৃত্যুগুলো লিখিত হওয়া দরকার, দুঘর্টনার স্থানগুলোয় শহীদ মিনার হওয়া জরুরি।
একইভাবে জরুরি—দালাল চিহ্নিত হওয়া। দালালদের নাম প্রচার হচ্ছে বিভিন্ন কায়দায়। এই নামগুলোর মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন, আবেগের আতিশয্য কিছু আছে, যা নিতান্তই অশোভন। বেশ কিছু মেয়ের নাম প্রচার হচ্ছে এবং সেই নামগুলোর পাশে দেহপসারিণী, রক্ষিতা ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে অবলীলায়। দেহপসারিণী এই দেশে অবৈধ নয়, রক্ষিতাও নয়। তাই যে মেয়ে দেহপসারিণী এবং রক্ষিতা, তাকে দোষ দেওয়া কিংবা কাগজে তার নাম ছেপে বেড়ানো বোকামো ছাড়া কিছু নয় |
ধিকৃত রাষ্ট্রনায়ক সারাদেশে দেহপসারিণী ছড়িয়েছে সহযোগী কামুকদের ভোগের জন্য, নিজেও যথেচ্ছ ভোগ করেছে। তার অনুগত মন্ত্রিদের, ক্ষমতাসীন আমলাদের নানাবিধ যৌন সমস্যা ছিল, স্পীকারের যৌনবিকৃতির গল্প জানেন না এমন লোক কমই আছেন।
এই ধিক্কার আমরা নারীকে দেব কেন, দেব তাদের–যারা নারীকে তুচ্ছ সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ব্যবহার করে। চিহ্নিত করব তাদের, নারীকে আমূল গ্রাস করে যারা তুড়ি বাজিয়ে রাজ্যের সৎ লোক সাজে। যারা দুনীতির পাহাড় গড়ে সেই পাহাড়ের চুড়োয় বসে দেশকে ডুবিয়ে দেয় অতল জলে।
শোষককে চিহ্নিত করতে গেলে মনে রাখতে হবে সেই দলে যেন কখনও শোষিতকে না ফেলি। পরে এই লজ্জা ঢাকবার জায়গা আমরা পাব না। লক্ষ্য যদি স্থির না থাকে, লক্ষ্যবস্তুর চেয়ে যখন প্রাধান্য পেয়ে যায় পরিপাশ্বের নগণ্য বিষয়-আশয়, তখন প্রধান ছাপিয়ে অপ্রধানই এত এগিয়ে আসে সামনে যে, মানুষ ভুলে যায় কোনদিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া উচিত; মানুষের তখন সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা দিগভ্রান্ত হওয়ার।
যে দেশে বহুবিবাহ দোষের নয়, যে দেশে লাম্পট্য দোষের নয়, সে দেশে বহুবিবাহের ছবি ছেপে লাম্পট্যের অনুপুঙ্খ বর্ণনা করলে মানুষ আহত হয় না বরং বিকৃত আনন্দ লাভ করে। তার চেয়ে এই দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করাই কি ভয়ঙ্কর অপরাধ নয়? সংবিধান লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই কি অপরাধের চূড়ান্ত নয়?
একজন স্বাধীন মানুষের কখনও অন্যায় নয় বিলিওনারদের ক্লাবে ভিনদেশি বান্ধবীর গালে চুমু খাওয়া, কখনও অন্যায় নয় পরকীয়া প্রেমে নিমজ্জিত হওয়া–কিন্তু সেই ব্যক্তির জন্য অবশ্যই এটি নিষিদ্ধ কাজ যে ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ ধর্ম নির্বাচন করে এবং সেই ধর্মের নাম হয় ইসলাম ।
একটি মানুষ কোনও একটি গোত্রের, কোনও একটি ধর্মের অর্থাৎ কোনও একটি বিশ্বাসের অন্তর্গত। এ সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যে রাষ্ট্রে বাস করে সেই রাষ্ট্রকে টুপিদাড়ি পরানো হীন স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে ধর্মের সাগরে ভাসিয়ে নিজেই করেছে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ। অর্থ আত্মসাৎ ও যৌন-বিকৃতির জন্য নিজের পাতা ধর্মের ফদে সে নিজেই পড়েছে। তার ইসলামই তাকে ধিক্কার দিক। –
মানুষ এগিয়েছে, মানুষ এগোবে। এই অভু্যত্থান মানুষকে যে বিজয় দিয়েছে, এই বিজয়কে আরও ব্যাপক এবং মহৎ উদ্দেশ্যে অগ্রসর না করলে মানুষ সামনে এগোবার শক্তি ও উদ্দীপনা দুই-ই হারাবে। মেরী, জিনাত, নাশিদ, মুনমুন, সিলভিয়া, ডালি, রোজী, পপি প্রসঙ্গ আজ থেকে বন্ধ হোক। মূল প্রসঙ্গ হোক এরশাদ। মূল প্রসঙ্গ হোক তার অমার্জনীয় অপরাধ এবং সে কারণে অচিরে তার প্রাপ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা। বাঙালির মন বড় নরম, নরম হওয়া নিশ্চয় ভাল লক্ষণ কিন্তু অপাত্রে নরম হলে সর্বনাশ হয়। একাত্তরের রাজাকারে এখনও দেশ ছেয়ে আছে, সেই সব রাজাকারের বাচ্চ রাজাকারে দেশ এখন কিলবিল করে। কুখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক ও তার সহযোগিরা যদি এ যাত্রা ক্ষমা পেয়ে যায়, তবে কিলবিল করা রাজাকারের অনুজ ও বন্ধুতে দেশে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়াবে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া মানুষের আর বাচবার পথ থাকবে না। যারা এই গণআন্দোলনের স্রোতে মিশে যেতে চাইছে, মিশে যেতে চাইছে ঘাতকের প্রচুর সহযোগী—এ সময় তাদের পৃথক করা বড় জরুরী।
যৌন সামগ্ৰী হিসেবে যে নারীরা রাষ্ট্রের উচ্চপদে-আসীন দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে তাদের আবার দ্বিতীয়বার নিগ্রহ করবার কোনও কারণ নেই। এই আন্দোলন সকল সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে, কোনও নিগৃহীতের বিরুদ্ধে নয়। কোনও ব্যবহৃত-বস্তুর বিরুদ্ধে নয়।
আসুন, আমরা আমাদের লক্ষ্য আরেকবার স্থির করি। আমরা আমাদের দৃঢ়তা আরেকবার পরীক্ষা করি। এবং আমরা অনড় হই একটি বৃহৎ উদ্দেশ্যে। আমরা একত্ৰ হই একটি সম্ভাবনার জন্য এবং আমরা যাত্রা করি একটি গন্তব্যের দিকে এবং একটি গন্তব্যের দিকেই।
৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক
১. বিভিন্ন ধর্মে মানুষের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন রকম। এক বিবাহের অনুষ্ঠানে কুশণ্ডিকার হোমকুণ্ডের উত্তর-পশ্চিম ভাগে একটি পেষণীযুক্ত শিলার দিকে আমার নজর পড়েছিল। সেই শিলার সামনে বর বধূকে পেছন দিক থেকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বধুর অঞ্জলির নিচে আপন অঞ্জলি স্থাপন করলেন এবং বধূ তার পায়ের অর্ধেক তুলে দিলেন শিলের উপর। বর বললেন–এই শিলের উপর ওঠ—ওঁ ইমম অশ্মানম্ আরোহ। তুমি ঠিক এই শিলপাটার মত স্থির হয়ে থাকবে—অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব। আর শিলায় পা রাখা বউ বললেন—এই আমি মেয়ে, আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি—আমার স্বামী যেন দীর্ঘায়ু হন—শতং বর্ষানি জীবতু।
যে শিলপাটার ওপর বধুটি পা রাখলেন, সেটি পেষণীযুক্ত শিলা। শিলায় ওঠবার মন্ত্র আছে–অশ্লেব ত্বং স্থিরা ভব। এক্ষেত্রে পেষণীটির কাজ কি? পেষণীটি যদি পুরুষ চিহ্নের প্রতীক হয় তবে স্বামী দেবতা বরারোহ বধূশিলায় নিজের উচ্চাবচ ইচ্ছেগুলো বাটবেন। তাতে পুং নাম নরক থেকে বাঁচবার অছিলায় পুত্র যেমন জন্মাবে, তেমনি হবে ইচ্ছেপূরণ। শুধু স্বামী নন, বধূশিলায় বাটনা বাটবার পেষণী আছেন আরও, শ্বশুরকুলের সবাই, কারণ তাদেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে বধূকে সংসার-শিলায় পেষণ করা হবে, আর তাই বর মন্ত্র পড়েন—তুমি এই সংসার যাত্রায় পাথরের মত স্থির হয়ে থেক—অশ্লেব ত্বং স্থিরা ভব। কারণ বাটনা বাটায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, বাটবার শিল নড়বড় করলে বা এদিক ওদিক ঘটাং ঘটাং করলে বাটনা বাটা যায় না। অতএব বধু! তুমি অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব, এদিক ওদিক ন’ড়ো না চ’ড়ো না।
ভিন্ন ধর্মের আরেক বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। অলঙ্কারাবৃত বন্ধুকে নতমুখে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তার নির্বাক নতমুখ এবং সাজসজ্জা অনুষ্ঠানের প্রধান একটি বিষয়। আমার ধারণা হয়েছে বধূকে পরবর্তী জীবনে নির্বাক ও নতমস্তক হবার এটি একটি মহড়া বটে।
কাজী এলে ‘অমুকের পুত্র অমুকের সঙ্গে এত টাকা দেনমোহরের বিবাহে সম্মতি আছে কি না’ জিজ্ঞেস করতেই বধূ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাজী বললেন–আলহামদুলিল্লাহ। এরপর বধূর পিতা বরের হাতে কন্যা সমৰ্পণ করলেন এবং বর তা গ্রহণ করলেন। এই অনুষ্ঠানে আমার এও ধারণা হয়েছে যে, সাজানো পুতুল-বধূর কাছে গিয়ে সম্মতির কথা জিজ্ঞেস করা এবং না করা সমান কথা। এই বিবাহে দেনমোহরের টাকা নিয়ে দর কষাকষি চলে। কন্যাপক্ষ চান টাকা বাড়াতে—বরপক্ষ চান কমাতে। এই টাকা আদপে দৃশ্যমান নয়, কেবল উচ্চারিত। বরপক্ষ টাকার পরিমাণ কমান কারণ কন্যাকে তালাক দিলে দেনমোহরের টাকা ফেরত দিতে হয়। কন্যাপক্ষ বাড়ান কারণ অন্তত টাকা দেবার অসামর্থ্যের জন্য হলেও যেন বরপক্ষ কন্যাকে ত্যাগ না করেন। । বরপক্ষ হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর দৃষ্টান্ত দেন, হযরত বলেছেন–নিশ্চয়ই এই ধরনের বিবাহে বরকত বেশি হয়, যে বিবাহের মোহর কম হইয়া থাকে। মুহম্মদ এও বলেছেন—ঐ স্ত্রীলোক অতি উত্তম, যে দেখিতে সুন্দরী এবং যাহার মোহর অতি নগণ্য (দেখতে অসুন্দরী স্ত্রীলোককে মহানবীও অপছন্দ করতেন)।
এই দর কষাকষির বিবাহ আমার কাছে লেগেছে মাংসের হাটের মত। মেয়েমানুষের এক-শরীর মাংস ভোগ করতে নিয়ে যায় এক কামুক পুরুষ। মাংস সে এটো করলে কিছু ক্ষতিপূরণ দাবি করেন মাংসওয়ালা কন্যাপক্ষ। ক্ষতি হচ্ছে এটোর ক্ষতি। কিছু ডিসপোসেবল জিনিস আছে, একবার ব্যবহারের পর দ্বিতীয় ব্যবহার অস্বাস্থ্যকর ও অমর্যাদাকর। স্যানিটারি ন্যাপকিনও একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। আমাদের সমাজে মেয়েমানুষ হচ্ছে ডিসপোসেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত। এক-পুরুষ দ্বারা ব্যবহৃত হলেই সে অস্পৃশ্য হয়ে ওঠে, আপাদমস্তক অযোগ্য হয়ে ওঠে।
২. একবার নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক অগ্রসর পুরুষ তাঁর হবু স্ত্রীকে বললেন–‘বিয়ের পর তোমাকে আমি পূর্ণ স্বাধীনতা দেব।‘
এই বাক্যটি শুনে হবু স্ত্রী এবং উপস্থিত শুভার্থীরা সকলে চমকিত এবং হরষিত হলেন। কেবল আমার বুকের মধ্যে বিধে রইল ‘দেব’ শব্দের কাটা। কারণ পুরুষটি তার উদারতার আড়ালে একটি ঘটনা বেশ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে স্বাধীনতা দেবার মালিক পুরুষেরা, স্ত্রীকে স্বাধীনতা দান করবেন স্বামী।
যেন স্বাধীনতা নামক জিনিসগুলো পুরুষের হাতের মুঠোয় থাকে। তারা ইচ্ছে করলে নারীকে তা দেন, ইচ্ছে না করলে দেন না। আমাদের এই উদার পুরুষটি বড় ইচ্ছে করেছেন স্ত্রীকে তিনি স্বাধীনতা দেবেন। স্ত্রীও তাই খুশিতে আটখানা। এ কথা অনস্বীকার্য যে পুরুষেরা স্বাধীনতা দিলে নারী বাধিত হয়, পুরুষেরা দয়া করলে নারী পুলকিত হয়, পুরুষেরা দক্ষিণ দিলে নারী কৃতাৰ্থ হয়।
আমি ওই ‘দেব’ শব্দটি বর্জন করতে বলি সকল শ্রেণীর পুরুষকে। নারীকে বোকা বানাবার যাবতীয় কূটকৌশল আমি নিষিদ্ধ করতে বলি।
নারী সম্পূর্ণ একটি মানুষ। পৃথিবীতে তার বাঁচবার অধিকার, চলবার, বলবার ভালবাসবার, ঘৃণা করবার অধিকার জন্মগত। নিজের অধিকারের দায়িত্ব কেউ কারও হাতে অপর্ণ করে না। যে সম্পর্ক মানুষের অধিকার হরণ করে, সে সম্পর্ক কখনও কল্যাণকর নয়। যে সম্পর্ক মানুষের স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সে সম্পর্ক কখনও মঙ্গলজনক নয়।
আর অকল্যাণ নয়, আর উৎপীড়ন নয়, নারী সচেতন হোক। নারীকে যেন নিজের স্বাধীনতা ভিক্ষে করতে না হয়। নারী যেন পুরুষের হাট-বাজারে নিজের ব্যক্তিত্ব না বিকোয়।
মানুষ ক্ষুধার্ত হলে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয় কেড়ে খাবার। নারী ক্ষুধার্ত হোক, নারী তার থাবা বসাক আগ্রাসীদের উদরে। নারী মানুষ হোক। নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক।
৫০. কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে অপিয়াম খেয়ে মরে যেতে। অপিয়াম খেলে আকাশে ভাসব, মেঘের ভেতর খেলা করব—ওই খেলা করতে করতেই হঠাৎ কখন শরীরের কলকজা থেকে নাটবটু খুলে আকেজো হয়ে পড়ে থাকব—আমি নিজে তো বুঝবই না, কেউ এসে নাড়ি ধরলেই আঁতকে উঠবে।
ইদানীং আমার খুব মরতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় একবার ইলেকট্রিক সকেটে পেরেক ঢুকিয়ে পরখ করেছিলাম মৃত্যু দেখতে কেমন। সমুদ্র দেখলেই আমার খুব গভীরে গিয়ে সাঁতরে দেখতে ইচ্ছে করে ঢেউয়ের কামড় শরীরে কেমন লাগে। হাতের কাছে নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ পেলে চোখ কান বন্ধ করে এক্সিলেটরে চাপ দিতে ইচ্ছে করে।
আমি মরে গেলেও পৃথিবীতে ভোর হবে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। আমি মরে গেলে আমার নিন্দুকেরা নিতম্বে তালি বাজিয়ে হাসবে। আমার শুভার্থীরা ক’দিন আর একলা দুপুরে ভাল না লাগায় ভুগবে? বেশিদিন নয়।
এই শহরে আমার কল্যাণকামী অনেকেই আছে, নিন্দুকও কম নয়। ওরা আমার পান থেকে চুন খসলেই হই রই করে তেড়ে আসে, ওরা আমার পদক্ষেপে জোর দেখলেই পায়ের তলার মাটি খুঁড়তে আসে। আমি কি কারও তিলাধ ক্ষতির কারণ? না, তা নয়। আসলে আমি যে কারও বাহু বেষ্টন করে ইটি না, মধ্যরাতে হঠাৎ দুঃস্বপ্নে কারও বুকের আড়ালে মুখ লুকোই না—এ কারও সয় না। সয় না বলে ঝুড়ি খুলে কালসাপ লেলিয়ে দেয় আমার ঘরে, সূচাগ্র সুযোগে সাপ বেহুলা আমাকেই শতবার রক্তাক্ত করে। আমার একটিই দোষ, আমি অবশ্য এটিকে গুণ বলেই বিবেচনা করি যে, আমি কোনও উদ্যত ফণা দেখে তিলমাত্র বিচলিত হই না। আমার সুস্থ স্বায়ুতন্ত্রের কাছে আমি বড় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
আমি আজ খুব স্বার্থপরের মত আমার কথা বলছি। আমি কারও কাধে ভর দিই না বলে প্রশস্ত এবং অপ্রশস্ত দুরকম কাঁধওয়ালা পুরুষই কম দুশ্চিন্তা, কম অপমান এবং কম লাঞ্ছনায় ভোগে না। এবং একইভাবে সেই মেয়েরাও কী ওদের ভোগায় না যারা কারও কাধে ভর দেবার হাতকে সঙ্কুচিত করে?
দীর্ঘ একটি জীবন একা হাঁটব বলে আমার জুতোর সুখতলা পুরু করে মোটা সুতোয় গেঁথেছি। আমার জুতোর দিকে তাকিয়ে পুরুষদের গা কেমন জ্বালা করে—আমি বেশ বুঝতে পারি। এবং সেই মেয়েদের জুতোর দিকেও কী ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ হয় না যারা কোনও কিছুতে পরোয়া করবার ব্যাপারটি একেবারেই তুচ্ছ করেছে। পরোয়া করব না—সে আমার ব্যাপার। পরোয়া না করলে আমার যদি ক্ষতি বৃদ্ধি না হয় তবে তুমি পুরুষ হয়েছ বলে কত বড় ঈশ্বর বনে গেছ বাবা তুমি আমাকে দেখে নিতে চাও ! সুযোগ বুঝে অপবাদ আওড়াতে চাও !
আমার নিরীহ বাবা-মা আমাকে নিয়ে নানা রকম দুশ্চিন্তায় ভোগেন। ভোগেন, কারণ তাদের ষোল গোষ্ঠীর কোনও নারী শেকল ছিড়ে কখনও উঠে দাঁড়ায়নি। এবং দাঁড়িয়ে তাবৎ প্রতারক পুরুষের মুখে থুতু ছিটোয়নি। আমার নিরীহ আত্মীয়রা মনে মনে আমার মৃত্যু কামনা করে যাবতীয় দুঃসংবাদ থেকে মুক্তি পেতে চান কি না আমি সঠিক জানি না। হতেও পারে। না, এই বলে যে আমি মরে যাবার কথা ইদানীং ভাবছি তা নয়। মরে যাবার ইচ্ছেটা আমার এইজন্য হয় যে, আমি যদি আমার মত করে বাচতে না পারি, তবে আমি বাঁচব কেন? আমাকে কেন অন্যের ইচ্ছের মত বেঁচে থাকতে হবে, জীবনযাপন করতে হবে। অন্যে যাকে পছন্দ করে তাকে আমার অপছন্দ সত্ত্বেও হাই হ্যাঁলো বলে আমার সারা বিকেল মাটি করতে হবে। কেন, আমি মেয়ে বলে? আমি মেয়ে বলে চিৎকার করে জানান দিতে পারি না আমি ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি! নাকি ঘৃণা জাতীয় নিকৃষ্ট ব্যাপারগুলো মেয়েদের মধ্যে থাকতে নেই! মেয়েরা হবে পূত পবিত্র সর্বংসহা।
আমি একথা খুব স্পষ্ট করেই জানি যে এই শহরে আমার যোগ্য একটি পুরুষও নেই। যে পুরুষের দিকে আমি তাকাই, কোনও না কোনও দিক থেকেই তারা আমার তুলনায় তুচ্ছ, অপকৃষ্ট। এই শহরে একটি পুরুষও নেই যার করতলে আমি দ্বিধাহীন রাখতে পারি আমার বিশ্বাসের সব কটি আঙুল। এই শহরে একটি সামান্য পুরুষও নেই যাকে আমি হৃদয়ের শেকড়-বাকড় উপড়ে বলতে পারি ভালবাসি। এই শহরে আমার প্রতিভা ধারণ করবার যোগ্যতা কোনও পুরুষের নেই। আমার মেধা ও মননের অগাধ সৌন্দর্য গ্রহণ করবার শক্তি নেই কারও। আমার বোধের নাগাল পাবার মত দীর্ঘ বাহু কারও নেই।
আমার স্বাধীনতা ছুঁতে পারে এমন সাহস আমি কারও দেখি না। আমাকে ভালবাসবার দুঃসাহস যেন কোনও কাপুরুষের না হয়। বারবার কেবল নিজের কথায় ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাবার একেবারে যে কারণ নেই তা নয়। কারণ আমি একজন নারী। আমি নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের বোধ ও বিশ্বাস থেকে সকল নারীকে স্পর্শ করি। যেন প্রতিটি নারী প্রচণ্ড বেঁচে থাকে। যেন বেঁচে থাকবার যোগ্য জল-হাওয়ার এতটুকু কোথাও অভাব না হয়।
আর যদি হয়ই, তবে আর বেঁচে থাকা কেন, অধোমুখে বেঁচে থাকা কী এমন লোভনীয় জিনিস যে নারী তবুও নিলজের মতন বাঁচে!
আমার বাবা মেডিকেল কলেজের ক্লাসে পড়াতেন অপিয়াম খেলে ডেথ খুব পিসফুল হয়। চোখ বুজলেই আমার বাবার সেই কণ্ঠস্বর কানের কাছে শুনি অপিয়াম ইজ দ্য কজ অফ পিসফুল ডেথ আমার বাবা খুব ভাল শিক্ষক ছিলেন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি এইটুকু বুঝিয়েছিলেন যে অপিয়াম খেলে মনে হয় মেঘের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছি, সামনে অনন্ত নীল আকাশ।
হঠাৎ হঠাৎ আমার ভেতর এরকম মৃত্যু-বাসনা ঘটে, তবে একথা সত্য নয় যে কুচক্রীদের গালে চড় কষাবার শক্তি আমার কব্জিতে কিছু কম, কিছু কম নয় আমার মত আরও নারীরও, কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়। আমি যদি দাঁড়াতে পারি, দেশের আর সকল নারী কেন দাঁড়াবে না?
৫১. ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ
তসলিমা নাসরিন মরে গিয়েছিল। হ্যাঁ, মরেই গিয়েছিল সে। এখন বেঁচে উঠেছে। এখন সে ফুসফুস পূর্ণ করে নিতে পারছে নির্মল বাতাস। এখন সে ঘ্ৰাণ নিতে পারছে সবুজের, এখন সে ভিজতে পারছে রোদে, জলে, পূর্ণিমায়। সে দেখেছে মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, কত কুৎসিত। সে দেখেছে মৃত্যু কত বীভৎস, কত কদাকার। যে মানুষ একবার মরণ থেকে উঠে আসে, সে জানে বেঁচে থাকা কী সুন্দর, বেঁচে থাকা কী ভীষণ আনন্দের।
আমি বেঁচে আছি। ফুটপাতে টায়ার জ্বালিয়ে ভাত ফুটোয় যে অর্ধনগ্ন নারী, তাকেও বলি বেঁচে থেক। মুখে ক্ষো পাউডার মেখে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকা উৎসুক রমণীকে বলি বেঁচে থেক। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের অলস্কৃত দুঃখিতাকে বলি বেঁচে থেক। মধ্যরাতে ঘরে ফেরা পাড় মাতালের অনঙ্গ বধূকে বলি বেঁচে থেক। বেঁচে থাক নারী, নারী তুমি বেঁচে ওঠ। প্রচণ্ড বেঁচে ওঠ ।
ওদের কথা ভেব না। ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ। ওরা তোমার বিকেলের চায়ে গোপনে বিষ মিশিয়ে দেবে। ওরা কৃষ্ণপক্ষ রাতে তোমার গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেবে আমগাছের ডালে, ঘরের সিলিং ফ্যানে, কড়ি বরগা কাঠে, ওরা পাল বেঁধে তোমাকে ধর্ষণ করবে উপযুপরি, ওরা কাচপুর ব্রিজের কাছে তোমার বুকে ছুরি বসাবে, ওরা ধাবমান ট্রেনের নিচে তোমাকে ধাক্কা দেবে, ওরা তোমার কণ্ঠদেশ চিরে দেবে ধারালো রেডে, ওরা তোমার সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে দেবে। ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ।
ওরা জেরুজালেমে, হিমালয়ে, হেরা পর্বতে বসে ধর্ম রচনা করেছে। এই ধর্মকে ওরা পবিত্র ঘোষণা করেছে। এই পবিত্রতার দোহাই দিয়ে ওরা তোমাকে পাকে ফেলছে। ওরা তোমাকে পায়ের নিচে স্থান দিচ্ছে, ওরা তোমাকে রন্ধনশালায় পাঠাচ্ছে, ওরা তোমাকে সাজসজ্জা করাচ্ছে, ওরা তোমাকে শয্যায় ওঠাচ্ছে, শয্যা থেকে যখন ইচ্ছে নামাচ্ছে। ওরা তোমাকে আবৃত করছে, প্রয়োজনে অনাবৃত করছে। ওরা তোমাকে পদাঘাত করছে, পরিহার করছে। ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ।
নারী তুমি বেঁচে ওঠ। নিঃশ্বাসে নাও অমল হওয়া। এই আকাশ তোমার, আকাশের সব নক্ষত্র তোমার। এই ঝাউপাতা তোমার, এই নদী, কাশবন, অরণ্য তোমার, এই মেঘপুঞ্জ, এই জল-হাওয়া তোমার। এই মাটি, এই ঘাস, ঘাসফুল, পাখি, এই সমুদ্র তোমার। ওরা তোমার কেউ নয়, ওরা পুরুষ। ওরা তোমাকে গ্রাস করবে, ওরা তোমাকে শত টুকরোয় ছিড়বে। ওরা তোমাকে পিষে পিষে নিশ্চিহ্ন করবে। করবে, কারণ ওরা মানুষ নয়, পুরুষ।
যে তুমি মুখ থুবড়ে পড়ে আছ নারী, তোমার সারা শরীরে পুরুষের কামড়, তোমাকে শুকতে এসে একটি কুকুরও বেদনায় নীল হবে, তোমাকে দেখতে এসে কাক শকুনও লুকিয়ে রাখবে নখর, সেই তোমাকেই যদি কেউ পুনরায় কামড় বসায় সে কোনও শূকর নয়, সে কোনও কালকেউটে নয়, সে পুরুষ। তুমি উঠে দাঁড়াও নারী। মেরুদণ্ড সোজা করে একবার দাঁড়াও। তুমি হাঁটো। এই পথ তোমার। এই মাঠ তোমার। এই শস্যখেত তোমার, আলপথ তোমার। দিগন্ত অদি যতদূর দেখ তুমি, সব তোমার।
আমি মৃত্যু দেখেছি। আমি আগুন দেখেছি। সাপের ছোবল দেখেছি। আমি অন্ধকার দেখেছি। খাদ দেখেছি, ফাঁদ দেখেছি। আমি দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ সমৃদ্ধ জীবনের দিকে। আমি দেখতে দেখতে পার হচ্ছি রেলসেতু, পার হচ্ছি কাচপুর ব্রিজ, আমতলা, পার হচ্ছি ঘোর অন্ধকার। আমি নারী বলে আজ আমার অহঙ্কার হয়। আমি নারী বলে আমার রক্তের প্রতি কণাকে আমি শুদ্ধ বলে ভাবি, নারী বলে শরীরের প্রতি লোমকূপকে পবিত্র বলে ভাবি, নারী বলে আমার স্নায়ুতন্ত্রকে সৎ ও সরল বলে ভাবি।
তুমি যদি নারী হও, তুমি এইভাবে মৃত্যুকে অতিক্রম করে বেঁচে ওঠ। ওরা তোমাকে সতীত্ব শেখাবে, ওরা তোমাকে চিতায় ওঠাবে, ওরা তোমাকে নারীত্ব বোঝাবে, ওরা তোমাকে মাতৃত্বের মাহাত্ম্য বর্ণনা করবে। এইসব ভুল শিক্ষা, এইসব পাপ, এইসব পাতা ফাঁদে একবার পা দিলেই ওরা তোমাকে চুমু খাবে, ওরা তোমাকে পাজাকোলা করে ধী ধা নৃত্য করবে, ওরা তোমাকে চার দেয়াল দেবে, সোনার শেকল দেবে, ওরা তোমাকে পোষা টিয়ার খাচায় যেমন আহার দেওয়া হয়, তেমন আহার দেবে। তুমি যদি মানুষ হও শেকল ছিড়ে একবার দাঁড়াও। দুহাতে শেকল ছেড়, এই হাত তোমার। দুপায়ে দৌড়ে যাও, এই পা তোমার। দু’চোখে জীবন দেখ, এই চোখ তোমার। তুমি ঠা ঠা করে হাস, তোমার ঠোঁট, চোখ, গ্রীবা তোমার। তুমি আদ্যন্ত তোমার। তুমি আমূল তোমার।
ওই দেখ, ওরা তোমাকে খুবলে খেতে আসছে, ওরা তোমাকে চাখতে আসছে, ছিড়তে আসছে, ওরা মৃত্যুর আরেক নাম। ওরা বীভৎসতার আরেক নাম, ওরা তোমাকে পান করতে আসছে, লেহন করতে আসছে, ওরা তোমাকে দলিত করতে আসছে। ওরা পুরুষ। ওরা মানুষ নয়।
নারী তুমি সতর্ক হও । তোমার দিকে ধেয়ে আসা পুরুষেরা মূলত আসে অবাধ কাম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে, কর্তৃত্বের ক্রোধ।
এই জগৎ তোমার নারী, এই জগতে তুমি যেমন ইচ্ছে বাঁচ। এই জগৎ যদি একটা নদী হয়, তুমি নদী জুড়ে সাতার কাটো। এই জগৎ যদি একটা আকাশ হয়, তুমি আকাশ জুড়ে ওড়। জীবন যদি তোমার হয়, যা আসলেই তোমার, তবে সেই জীবন তুমি যেমন ইচ্ছে যাপন কর। তোমার কর্তৃত্ব তুমি নাও নারী।
আমি মৃত্যু দেখেছি। আমি পাপ দেখেছি, পঙ্ক দেখেছি। আর যেন কোনও নারীকে এত কাটাতার পেরোতে না হয়, শত ছিন্ন হতে না হয়। আর যেন কোনও নারীকে কেবল গন্তব্যে পৌছোবার জন্য পেরোতে না হয় এমন দুর্গম অরণ্য। আর যেন কোনও নারীকে বুনো মোষ এমন না তাড়ায়, আর যেন পুরুষের গুহা থেকে রক্তাক্ত বেরোতে না হয় কোনও নারীকে।
পুষ্টিহীনতায় ভুগছে যে নারী, তাকে বলি বেঁচে থেক। রক্তশূন্যতায় ভুগছে যে নারী, তাকে বলি বেঁচে থেক। যে নারী বন্ধ্যাতে ভুগছে, প্রসব কষ্টে ভুগছে, তাকে বলি বেঁচে থেক। খুব ভোরে দল বেঁধে হেঁটে যাওয়া বস্ত্র বালিকাদের বলি বেঁচে থেক, ঘুটে কুড়োনো কিশোরীকে বলি বেঁচে থেকু, বেঁচে ওঠ নারী। চমৎকার বেঁচে ওঠ।
এই আমি সকল দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। এই আমি কোনও অশ্লীলতা ও অসুস্থতার সঙ্গে আপস করিনি। নারী তুমি হাত ধর সুন্দরের, নারী তুমি হাত ধর স্বপ্নের।
৫২. পূর্বাভাস
অনেকে বলে পূর্বাভাস পত্রিকাটি তোমার সঙ্গে এত শক্রতা করল, তারপরও এতে লেখ! ‘শক্রতা’ শব্দটির ব্যাপারে আমি অবশ্য আপত্তি করি না, কারণ একথা সত্য যে একজন লেখককে যে ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়া উচিত—পূর্বাভাস তা দেয়নি—যদিও আমি পূর্বাভাসেরই নিয়মিত লেখক বা কলামিস্ট ছিলাম। এই শক্রতার বিরুদ্ধে আমার করণীয় কিছুই ছিল না, আমার পক্ষে সম্ভব নয় লোক লাগিয়ে পূর্বাভাসের কব্জির হাড় ভেঙে ফেলা, অথবা কষে দুই থাপ্পড় লাগানো। সম্ভব নয় এইজন্য বলছি যে, আমাকে তা মানায় না, আহিরিটোলা থেকে মস্তান জোগাড় করা কোনও মেয়েমানুষের কৰ্ম্ম নয়।
আমি কোথাও কোনও মিত্রতার আশা করি না। আমি যদি পথচারী হই, পথে নয়; আমি যদি বধু হই, গৃহে নয়। আমি যদি কর্মী হই, কর্মক্ষেত্রে নয়। আমি যদি লেখক হই, পত্রিকায় নয়। মিত্রতার আশা করা নেহাত বোকামো ছাড়া কিছু নয় জানি। কারণ মেয়ে জাতীয় মানুষগুলো নিতান্তই ব্যবহারের জিনিস। যতক্ষণ এরা ব্যবহার উপযোগী, ততক্ষণ কদর। কাঠে ঘুণ ধরলে, লোহয় মরচে ধরলে—সেই কাঠ বা লোহার কদর আর তেমন থাকে না। তেমনি মেয়ে নামক দ্রব্য যখন অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে ব্যবহারের, সেও কাঠ বা লোহার মত, জুতো বা জামার মত নিক্ষিপ্ত হয়।
নিক্ষিপ্ত হওয়াই সম্ভবত মেয়েদের নিশ্চিত নিয়তি। আর তাই হলে মান-মর্যাদা, শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি দামি ব্যাপারগুলো যত প্রতিভাবান মেয়েই হোক, দাবি করতে পারে না। তাই পূর্বাভাসের আশোভন আচরণেও আমি নীরব থেকেছি। নীরব থাকবার একটিই কারণ যত বড় কলামিস্টই হই না কেন, আমি মেয়ে। আমার মেয়ে নামের পরিচয়টিই সব ফুড়ে, সব ভেঙে উজিয়ে ওঠে। যেহেতু মানুষের ইতিহাসে নেই, চরিত্রে নেই, নীতি ও নিয়মে নেই যে মেয়েরা মূলত মানুষ, সে যখন আইনজীবী—আইনজীবীই, সে যখন চিকিৎসক—চিকিৎসকই, সে যখন লেখক–লেখকই। তাই ওই উজিয়ে ওঠা ‘মেয়ে’, ওই প্রধান এবং একমাত্র ‘মেয়ে’ পরিচয় নিয়ে সকলে ধুন্ধুমার নেচে ওঠে। পূর্বাভাস সকলের চেয়ে পৃথক কিছু নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, বাইরে নেই। যতক্ষণ অন্যের সম্পদ হিসেবে সে অন্যের স্বার্থসাধন করবে—ততক্ষণ তার স্তুতি গাইবে লোকে, নিরাপত্তার নামে তাকে আবৃত করবে, আড়াল করবে। মুঠো খুলে বেরোতে চাইলেই ফুসে ওঠে স্ততিকারিরাই, মুখোশ ছিড়ে বেরিয়ে পড়ে তাদের আসল আদল।
নারী এই মুখোশগুলো চেনে না। নারী এই মুখোশগুলোকে বার বার প্রকৃত মুখ বলে ভুল করে। কারও ছায়ায় নারী নিজেকে নিরাপদ ভেবে ভুল করে। নারী ভুলে যায় পুরুষ কোনও বৃক্ষ নয়, যে কেবল ছায়াই দেবে। পুরুষের ছায়ার ছুতোয় শেকড় বাড়িয়ে নারীর রূপরস শোষণ করে, নারীর গুণগন্ধ শোষণ করে।
অনেকে বলে—আপনার লজ্জা হয় না পূর্বাভাসে লিখতে, যে পূর্বাভাস আপনাকে এমন ডোবাল। ডুবিয়েছে যে একথা অস্বীকার করি না। এ জগতে নারী হচ্ছে জীবন্ত খড়কুটো, কেউ ইচ্ছে করলে তাকে ডোবাতে পারে, ইচ্ছে করলে ভাসাতেও পারে। আজ তাকে এ ডোবাবে, কাল ও ডোবাবে, কেউ আবার করুণা করে একদিন তাকে হঠাৎ ভাসাবে। নারী তো নিজের নিয়ন্ত্রক নয়। ডুবে-ভেসে তাকে পার করতে হয় জলজ জীবন। হ্যাঁ লজ্জা হয় আমার, তবে নিজের জন্য নয়, লজ্জা হয় ওদের জন্য যারা যখন খুশি নারীকে ডোবায়-ভাসায়, মূলত নারীকেই। লজ্জা হয় ওই প্রগতিবাদিদের জন্য, যারা সামাজিক শৃঙ্খল ছিড়ে বেরিয়ে আসা প্রগতির পক্ষের নারীকেই পুনরায় পণ্য করে তোলে, লজ্জা হয় ওদের জন্য, যারা নিজেরাও একবার নিজেদের কৃতকর্মে লজ্জিত হয় না।
আমাকে কেউ সম্মান দেবে কি না দেবে সে আমার ভাববার বিষয় নয়। এই সমাজ-প্রদত্ত ঠুনকো সম্মানের জন্য যদি আমি প্রাণ পেতে বসে থাকি—সে আমারই ক্ষতি। এ শুধু আমারই ক্ষতি নয়, সকল নারীর ক্ষতি—যে নারী দাঁড়ায়, যে নারী পথ হাটে, সিড়ি ভাঙে, যে নারী সত্য ও সাম্যের পক্ষে স্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করে। এ শুধু আমার ক্ষতিই নয়, সকল নারীর ক্ষতি।
নারীর জন্য যে সম্মান রক্ষিত থাকে, তা কথিত ওই মাতৃত্বের সন্মান, বার্ধক্যের সন্মান, পুরোমাত্রায় সামাজিক রীতিমাফিক নারীত্ব অর্জন করবার সম্মান, সৌন্দর্যের সম্মান। এছাড়া নারীকে অন্য সম্মান দিতে মানুষের কাপণ্য হয়, কাপণ্য হয় কারণ অভ্যেস নেই, রীতি নেই, প্রচলন নেই। ওদের আমি দোষ দিই না। ওরা ওদের পিতাকে দেখেছে, পিতার পিতা তস্য পিতাকে দেখেছে। ওদের রক্তে, ওদের হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে পূর্বপুরুষের সংক্রামক অসুখ, যে অসুখে অন্ধ হয়ে ওরা নারীকে মানুষ বলে দেখে না, যে অসুখে স্নায়ুবিকৃতি ঘটিয়ে ওরা নারীকে ‘মানুষ’ বলে চেনে না। ওদের আর দোষ দেব কী?
৫৩. সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন
আপনাকে আমি ডলি বলেই ডাকছি। ডলি ইব্রাহিম নয়, ডলি আনোয়ার নয়, স্রেফ ডলি। আপনার সঙ্গে আমার কখনও আলাপ ছিল না, কিছু মানুষ আছে ওদের সঙ্গে আলাপের কোনও দরকার হয় না, বুকের মধ্যে এমনি ওরা অনুভূত হয়। স্মিতা পাতিলের সঙ্গে আমার কোনও আলাপ ছিল না, অথচ স্মিতা মারা গেলে এত দীর্ঘদিন আমি বিষণ্ণ ছিলাম যে আমার কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মারা গেলেও এত বিষগ্নতা আমাকে গ্রাস করত বলে মনে হয় না।
পত্রিকায় আপনার ‘পারিবারিক অশান্তি’র কথা লেখা হয়েছে। পত্রিকায় নানারকম কথাই লেখা হয়। আমি সরাসরি অথবা কোনও বিশ্বস্ত সূত্রে আপনার পারিবারিক কোনও সুখ বা অসুখ সম্পর্কে অবগত নই। যদি পত্রিকার কথাই সত্য বলে মেনে নিই, তবে সত্য এই যে আপনি গত সোমবার ডাকে আসা একটি রেজিস্টার্ড চিঠি গ্রহণ করেননি, কারণ আপনি বেশ বুঝতে পেরেছেন ওটি আপনার স্বামীর তালাকনামা। আপনার স্বামী একজন সফল ব্যবসায়ী কি একজন ডাকসাইটে প্রকৌশলী কি প্রখ্যাত আলোকচিত্রী সে আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার বিষয় আপনি । আপনি ডলি, আপনি শিল্পের একটি শাখায় ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন, আপনার প্রতিভাকে সম্মান করব না এত স্পর্ধা আমার নেই। অথচ এই স্পর্ধা আপনার নিজেরই হল, নিজের প্রতিভাকে আপনি নিজেই অসম্মান করলেন। প্রতিভার চেয়ে পরিবার যখন বড় হয়ে ওঠে, প্রতিভার চেয়ে তালাকনামা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন হতভাগ্য প্রতিভাবানের জন্য দুঃখ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।
আপনার লজ্জা হল না ডলি, কীটনাশক ওষুধ গলায় ঢালতে? ছিঃ! ডলি ছি! আমি সকল নারীর পক্ষ থেকে আপনাকে ধিক্কার দিচ্ছি। ছি! আপনার স্বামী ঘর থেকে তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছেন, আপনাকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। তাই এত শোক আপনার, এত? শোকে আপনার আত্মহত্যা করতে হয়?
আপনাদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না, তাতে কি? মানুষ নানা সম্পর্কের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই এগোয়। মানুষ এক স্রোতস্বিনী নদীর মত, সম্পর্ক গড়বে ভাঙবে, নদীর পাড় ভাঙার মত। এত যে ভাঙে নদী, তবু কি থেমে থাকে? মানুষ তো স্থবির কোনও জলাশয় নয় ডলি যে কারও আঘাত এতই তাকে শোকাচ্ছন্ন করবে যে সে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগোবে! মানুষ তো কারও সম্পদ নয়, সম্পত্তি নয়—কারও অভাবে তার অযত্ন হবার কথা নয়। মানুষ তো কারও ব্যক্তিগত বাগান নয় যে কারও পরিচর্য ছাড়া সে আগাছাপূর্ণ এক অদ্ভূত অরণ্যে পরিণত হবে।
আপনি নিজেকে এত তুচ্ছ, এত নিকৃষ্ট, এত অকিঞ্চিৎকর কিছু ভাবতেন কেন, জীবনে দু-একটি ব্যর্থতা ছিল বলে? সাফল্যও কি আপনার কিছু কম ছিল ডলি?
দুঃখ পেয়েছেন জানি। দুঃখ কে না পায়? আপনার মত শিক্ষিত, প্রতিভাবান মেয়ে যখন এইসব জাগতিক দুঃখে কাতর হয় তখন দুঃখ জিনিসটি এত শক্তিমান হয়ে ওঠে যে সাধারণ মানুষেরাও দুঃখকে সন্ত্রম করতে বাধ্য হয়। এ কি অন্যায় নয় ডলি? এ কি অন্যায় নয় একটি তুচ্ছ তালাকনামার কাছে আপনার মূল্যবান জীবন বলি দেওয়া? এ কি অন্যায় নয় ডলি এইসব নিতান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতির কাছে পরাজিত হওয়া?
আত্মহত্যা করে কী লাভ হয়েছে আপনার? কি ক্ষতি হত আত্মহত্যা না করলে? আপনার বেঁচে থাকা খুব দুর্বিষহ হত তাই? মানুষ যে এই ঘরে ঘরে সংসার সাজিয়ে বেঁচে থাকে, খুব কি সহনীয় জীবন তাদের? তবে একলা জীবন কি এমন দুঃসহ জীবন যে যাপন করা যায় না? সমাজকে ভয় পান? এই নষ্ট সমাজের মুখে থুথু যদি আপনি দিতে না পারেন, আপনি সূর্যদীঘল বাড়ির জয়গুন চরিত্রের সম্মানিত অভিনেত্রী, তবে কে পারবে? কী লাভ হল আত্মহত্যা করে? জীবন তো আপনার আর ঘুরে ফিরে আসবে না যে চমৎকার একটি চরিত্রে আবার অভিনয় করে আপনি তৃপ্ত হবেন? একটিই মাত্র জীবন মানুষের, ফুটপাতের নুলো ভিখিরিও চায় বেঁচে থাকতে, ক্যান্সারে মরো-মরো রোগীরও বেঁচে থাকবার কি আকুলতা! অথচ একটি সুস্থ সুন্দর জীবনকে আপনি নিজের হাতে হত্যা করলেন? আপনার জন্য আমার বড় রাগ হয় ডলি ।
আপনি নারী হয়ে জন্মেছেন। নারীকে তার জন্মের প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই করতে হয়, এভাবেই, যে, তাকে পেরোতে হবে দীর্ঘ বাশের সাকো, পেরোতে হবে এবড়োখেবড়ো পথ, কাদাজল, পেরোতে হবে গহন অরণ্য কিংবা পর্বত। নারীর পথ কখনও মসৃণ নয়। এই অমসৃণ পথ আপনাকে এত কেন আক্রান্ত করবে, যেখানে আমরা, বাকি নারীরা এই অমসৃণতায় অভ্যস্ত, গতিময় এবং প্রাণবান?
জীবন আপনার। এ জীবন আপনার বাবার নয়, মা’র নয়, ভাইয়ের নয়, স্বামীর নয়, কেবল আপনারই। নিশ্চয়ই আপনি জীবনকে এত টুকরোয় ভেঙেছেন, এত দ্বিধায় বিভক্ত করেছেন যে নিজের জীবনকেও শেষ অদি আর নিজের রাখেননি। অন্যের ভালবাসা-অবহেলা, প্রেম ও অপ্রেম নিয়ন্ত্রণ করত আপনাকে । নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আপনার ছিল না। আপনার জন্য আমার বড় রাগ হয় ডলি!
আত্মহত্যা যদি সকল সমস্যার মীমাংসা হয়, তবে ঘরে ঘরে আত্মহত্যা করে সকল নারীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। শিক্ষা মানুষকে বেঁচে থাকবার প্রেরণা দেয়। শিল্প মানুষকে বেঁচে থাকবার সাহস জোগায়। গ্রামে গঞ্জে শহরে প্রতিদিন অসংখ্য ফাতেমা, জহুরা, খালেদা, সরস্বতী আত্মহত্যা করছে। আপনি কি তাদের চেয়ে কিছু পৃথক নন ডলি? আপনাকে কি ওই দলে ফেলব স্বামী ছাড়া তাদের কোনও অবলম্বন নেই, আশ্রয় নেই বলে যারা মনে করে?
আপনি খুব আবেগপ্রবণ ছিলেন। কিছু কিছু পাথরস্বভাবী মানুষ আছে, ওদের চেয়ে আবেগসমৃদ্ধদের আমার পছন্দ বেশি। কিন্তু আপনার আবেগ কেন আপনার মস্তিষ্ক বিকৃত করবে—যে কারণে আপনি আত্মহত্যার মত একটি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? আপনার আবেগ কেন আপনার ব্যক্তিত্বকে খাটো করবে, অমর্যাদা করবে? আপনার আবেগ কেন আপনারই আততায়ী হবে? ধিক আপনাকে ! শত ধিক আপনার অসহিষ্ণু হৃদয়কে।
সকল নারীর পক্ষ থেকে আমি আপনাকে ধিক্কার দিচ্ছি ডলি। আপনার মত ভীরু, দুর্বল ও পুরুষকতর মানুষ যেন এ জগতে আর না জন্মায়।
৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়
চিকিৎসা শাস্ত্রে ‘কসমেটিক স্টিচ নামে এক ধরনের স্টিচ আছে। অস্ত্রোপচারের পর রোগীর চামড়ায় এই স্টিচ বা সেলাই দেওয়া হয়। এই সেলাইয়ের ধরন এমন যে চামড়ার বাইরে একেবারেই সুই না ফুটিয়ে ভেতরের দিক থেকে সুইয়ের ফোড় দিয়ে সেলাই সারা হয়। এর ফলে সেলাই শুকিয়ে আসলে দেখতে এমন দাঁড়ায়, ওখানে যে আদৌ অস্ত্রোপচার হয়েছে, ধারালো ব্লেডে যে জায়গাটি কখনও কাটা হয়েছে এ মনেই হয় না।
আমাদের দেশে দু’ ধরনের চামড়া সেলাইয়ের ব্যবস্থা আছে। গরু ঘোড়ার চামড়া নয়, মানুষের শরীরের চামড়া। এই চামড়া সাধারণত চার ফোঁড়ে সেলাই করা হয়, সে সেলাইয়ের দাগ—যদি দশটি সেলাই পড়ে তবে দশ দুই-এ কুড়ি সুতোর দাগ ফুটে ওঠে এবং মানুষ বাকি জীবন তা বহন করতে বাধ্য হয়। আর অন্য সেলাইটিকে বলা হয় কসমেটিক স্টিচ। সেটির দাগ একেবারেই যে নেই, তা নয়। খুঁজে দেখলে দেখা যাবে একটি সরু সুতোর ছায়া। সেলাই যত দীর্ঘই হোক, বারো সেলাই কি আঠারো সেলাই, তবু ওই এক সুতোরই ছায়া। অবশ্যই কসমেটিক স্টিচ অত্যন্ত উন্নতমানের সেলাই। উন্নত দেশে এর চেয়েও উন্নতমানের সেলাই-এর চর্চা চলে। আমাদের দেশে চার ফোড়ের সেলাই-এর চল বেশি, কসমেটিক সেলাই খুব কম ব্যবহার হয়। তবে ব্যবহার হয় নির্দিষ্টি কিছু ক্ষেত্রে, মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অবিবাহিত। অবিবাহিত মেয়ের শরীরে সকল রকম অস্ত্রোপচারের পর কসমেটিক স্টিচ দেওয়া হয়। অথচ বিবাহিত, অবিবাহিত কোনও ছেলের বেলায় এই সেলাই দেওয়া হয় না। কসমেটিক সেলাই দেওয়ার কোনও অনুরোধ মেয়েরা না করলেও শল্য চিকিৎসকরা আপন উৎসাহে মেয়েদের এই বিশেষ আন্তরিকতা দেখিয়ে থাকেন।
পাশাপাশি দু’ টেবিলে ষোল-সতেরো বছরের একটি মেয়ে এবং একটি ছেলের অ্যাপেনডিসেকটমি অপারেশন হচ্ছিল। মেয়েটির জন্য কসমেটিক স্টিচ এবং ছেলেটির জন্য চার ফোড়ের সেলাই দেওয়া হল, সেলাইয়ের এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক বললেন—মেয়ের বিয়ে নামক ঘটনাকে সুগম করবার জন্য এই দাগহীন সেলাই-এর ব্যবস্থা। শরীরে কোনও দাগ বা ক্রটি থাকলে ছেলেদের কোনও অসুবিধে নেই। অসুবিধে মেয়েদের। বিয়ের বেলায় মেয়ের শরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু ছেলের নয়। মেয়ের শরীর নিখুঁত না হলে বিয়ের বাজারে মেয়ের দাম পড়ে যায়। ছেলের যেহেতু এ জাতীয় কোনও সমস্যা নেই, শল্য চিকিৎসকরাও ছেলের ব্যাপারে এই সেলাই আদৌ প্রয়োজন মনে করেন না।
শরীরকে মেয়েদের মূল সম্পদ বলে ভাবা হয়। তাই বাল্যবেলা থেকে মেয়েদের চুলের যত্ন ও ত্বকের যত্নের ব্যাপারে এত বেশি জ্ঞানদান করা হয় যে, মেয়েরা বিদ্যা নয়, বুদ্ধি নয়, কেবল । শরীরকে প্রধান এবং একমাত্র বিবেচনা করে। তাই ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য প্রসাধন সামগ্রীতে যেমন বাজার ছেয়ে গেছে, মোড়ে মোড়ে বিউটি পারলারেরও তেমন হিড়িক লেগেছে। সেদিন নিউমার্কেটের এক বইয়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—বিক্রি কেমন হয়। দোকানি বলল, আমরা কি আর স্নো পাউডার বিক্রি করি যে বিক্রি ভাল হবে?
ছেলের ত্বক রুক্ষ হলে, চুল উড়োখুড়ো হলে তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু মেয়ের বেলায় এই উদাসিনতায় আপত্তি ওঠে। মেয়েদের শরীরকে ঘষে মেজে পরিষ্কার রাখতে হয়। চোখে কাজল, গালে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলপলিশ লাগাতে হয়, কানে, নাকে, গলায়, পায়ে, কব্জিতে অলঙ্কার পরতে হয়। মেয়েদের শরীর এবং একমাত্র শরীরকেই প্রধান সম্পদ বলে ঘোষণা করা হয়। শরীর যাদের প্রধান এবং একমাত্র, তারা কালো কুৎসিত হলে, কদাকার হলে, যত বিদূষীই হোক, যত গুণবতীই হোক বিয়ে এগোয় না। আর শরীর যার ভাল, মুখ যার সুন্দর, শরীরের কাঠামো যার দৃষ্টিনন্দন, তার বিবেক বুদ্ধির তোয়াক্কা কেউ করে না, বয়সে পৌঁছার আগেই তার বিয়ের ধুম শুরু হয়। যেহেতু বিয়েকেই মেয়েদের একমাত্র গন্তব্য বলে ভাবা হয় তাই সুপাত্রে মেয়ে সমপিত হলে মেয়ে এবং মেয়ের অভিভাবকবৃন্দ মেয়ের জন্মের পর যে শ্বাস প্রায় রোধ করে থাকে, সেই শ্বাস যথাসম্ভব উন্মুক্ত করে।
শল্য চিকিৎসকরা কেবল মেয়েদের বেলায় কসমেটিক স্টিচের নিয়মটি রক্ষা করেন বলে সম্ভবত মেয়েরা খুব উল্লসিত হয়। আসলে বিষয়টি কোনও সচেতন মেয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কথা নয়। যেহেতু কসমেটিক স্টিচ উন্নততর সেলাই, এই উন্নত চিকিৎসা থেকে কেন পুরুষ রোগীদের বঞ্চিত করা হয়? যদি এই সেলাই প্রয়োগ করা হয়—তবে নারী পুরুষ সকল রোগীর । ক্ষেত্রে একই সেলাই, চিকিৎসার একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হোক।
পক্ষপাত কি সকল সময় মঙ্গলময়? পক্ষপাত সকল সময়ই কি কল্যাণকর? এই পক্ষপাত কি আমি নারী বলে আমাকে সমর্থন করতে হবে যেহেতু এই পক্ষপাত বিশেষ এক শ্রেণী কর্তৃক নারীর প্রতিই বিশেষ পক্ষপাত? নারীর প্রতি এই সহানুভূতিকে আমি কখনও সমর্থন করি না, নারীর প্রতি বিশেষ এই আচারকে আমি অনাচার না ভেবে পারি না।
আপাত এই অতিযত্ন আসলে কোনও যত্ন নয়। আপাত এই অতি আদর আসলে কোনও আদর নয়। আপাত এই অতি শুশ্ৰুষা আসলে কোনও শুশ্ৰুষা নয়। নারীর প্রতি এই অতির আতিশয্যই খুলে দেয় নারীর পতনের সকল দরজা।
» ৫৫. নারী দায়মুক্ত হোক
আমি একবার এক লোকের কাছ টাকা ধার করেছিলাম। টাকা ধার করবার অভ্যেস আমার একেবারেই নেই। এরকম দিন গেছে দুবেলা না খেয়ে কাটিয়েছি, দারিদ্র্যের একেবারে তল অবধি পৌঁছেও নিজেকে আমি অনড় রেখেছি—এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার। তবু নিতান্ত বাধ্য হয়ে একবার আমি টাকা ধার করেছিলাম। লোকটি আমাকে বোন বলে ডাকতেন। সম্পর্কটি, আমি মনে করি যথাসম্ভব মার্জিত ও নির্বিঘ্ন।
শর্ত ছিল সাতদিন পর টাকা ক’টি আমি ফেরত দেব। অথচ আশ্চর্য সেই লোকটি পরদিনই আমাকে ফোন করলেন। ফোন কিন্তু টাকার জন্য করেননি। জিজ্ঞেস করলাম টাকা কি আপনার আজই দরকার? আমার পক্ষে আজ দেওয়া কিন্তু সম্ভব নয়। আমি যে তারিখের কথা বলেছি, অবশ্যই সেই তারিখে দেব। এর পরদিন লোকটি আমার অফিসে এলেন। অফিসে তাকে দেখে আমি অবাক হলাম। বললাম টাকা কিন্তু ওই তারিখের আগে আমি দিতে পারছি না ভাই। লোকটি হেসে বললেন–না, না তাতে কোনও অসুবিধে নেই। এরও পরদিন লোকটি আমার বাড়ি এলেন। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার। লোকটি হাসলেন–না তিনি টাকার জন্যে আসেননি। এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন, তো ভাবলেন যে দেখে যাই। এই দেখে যাওয়ার ব্যাপারটি পরদিনও ঘটল এবং এর পরদিনও ।
এদিকে সাতদিনের আগে টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এবং লোকটির এই যাতায়াতও আমার পক্ষে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠল। আমি একটি ব্যাপার তখন স্পষ্ট করে বুঝলাম—দায়বদ্ধতা আমার কণ্ঠস্বরকে এত স্নান করে রেখেছে যে লোকটিকে আমি ইচ্ছে করলেও ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। দায়বদ্ধতা আমার মেরুদণ্ডকে এত দুর্বল করে রেখেছে যে আমি ইচ্ছে করলেই ঘাড় শক্ত করে দাঁড়াতে পারছি না। এই সাতদিন, যে সাতদিন আমি টাকা ক’টি লোকটিকে ফেরত দিতে না পেরেছি—ঘরে বাইরে এক অসুস্থ আবহাওয়ায় আমাকে নিঃশ্বাস নিতে হয়েছে, অনিচ্ছার সঙ্গে আমাকে আপস করতে হয়েছে। লোকটি ঘন ঘন আমার বাড়ি এসেছেন। না, টাকা নিতে নয়, লোকটি অযথাই এসেছেন। এসেছেন, চা খেয়েছেন, দু-চারটে সাদাসিধে কথা বলে চলেও গিয়েছেন। লোকটি সম্ভবত এরকমই চেয়েছিলেন যে এই দায় থেকে যেন আমি সহসা মুক্ত না হই এবং কখনোই যদি এই মুক্তিটি আমার না ঘটত আমি এখন স্পষ্ট বুঝি যে লোকটি তাতে মোটেও অসন্তুষ্ট হতেন না।
যে কোনও দায় মানুষকে শেষ অবধি কতদূর নিয়ে যায় বা যেতে পারে সে আমি কেবল অনুভব করতে পারি। কিছু টাকার জন্যে আমি দায়বদ্ধ ছিলাম, তাও মাত্র সাতদিন। এই সাতদিনে আমি হাড়েমজ্জায় টের পেয়েছি দায় জিনিসটি কী মারাত্মক পরিণতির দিকে মানুষকে ক্রমশ এগিয়ে নেয়। আর যারা জীবনের দায়বদ্ধতায় ভোগে? আমি জানি, আমি খুব গভীর করে জানি, অনেকেই এই দায়বদ্ধতায় ভোগে, বিশেষ করে মেয়েরা। খাদ্যের দায়, বস্ত্রের দায়, বাসস্থানের দায় নেই এমন মেয়ে ক’জন আছে। এ সংসারে? সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠই হোক, দায় তাতে কিছুমাত্র তরল হয় না। দায় দায়ই। যেহেতু অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনও স্বাধীনতা মেয়েদের নেই–তাই জীবনযাপনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপকরণের জন্যও তারা দায়বদ্ধ হয়, কেউ পিতার কাছে, কেউ স্বামীর কাছে, কেউ পুত্রের কাছে। এই পিতা, স্বামী ও পুত্রকে মেয়েদের বিভিন্ন বয়সে মেয়েরা সহায় বলে জানে।
যদি দায় না থাকে কিছুর? যদি যাবতীয় দায় থেকে নারী একবার মুক্ত হতে পারে? যে মুক্তি নারীর জন্য অবশ্য প্রয়োজন। তবে কি শক্তি হবে কারও, নারীর পথ রোধ করে কখনও দাঁড়ায়, তবে কি শক্তি হবে কারও নারীকে সোনার শেকলে বাঁধে?
নারী সকল দায় থেকে মুক্ত হোক। এই দায়ই নারীর মানুষ হবার একমাত্র অন্তরায়। নানা দায়ে নারীকে জড়িয়ে অমানুষ করে রাখা সমাজের দীর্ঘকালের সংঘবদ্ধ চক্রান্ত। নারী দায়মুক্ত হোক।
নারী একবার নিজেকেই নিজের সহায় বলে জানুক। যদি জাল ছিঁড়তে হয়, নারী জাল ছিঁছুক। যদি বদ্ধঘরের খিল ভেঙে টুকরো করতে হয়, নারী তাই করুক। লোকে তাকে থুতু দেবে, লোকে তাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে। তাতে কী? লোকের কথায় কী এসে যায়। এই লোকের মুখেই থুতু দেবার অভ্যেস করুক নারী। এই লোকের মুখেই চুনকালি মাখবার অভ্যেস করুক নারী।
আমরা অভ্যেস করি না বলেই পারি না। শিশুকে দাঁড়াবার, দৌড়েবার অভ্যেস করানো হয় বলেই শিশু দাঁড়ায়, দৌড়োয়। নারী তো একপ্রকার শিশুই, যাকে কেবল গায়ে-গতরে ছাড়া আর কিছুতেই বাড়তে দেওয়া হয় না। এই প্রতবন্ধি নারীরা পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক বোধ ও প্রজ্ঞার পুরুষ্ট্র বিকাশে। নারী একবার নিজেকেই নিজের সহায় বলে মানুক।
৫৬. নারী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়
বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা হচ্ছিল এক বিদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে। এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী শুনে তিনি বিষম উচ্ছসিত, বললেন—তোমাদের দেশে নারী-স্বাধীনতা এত বেশি যে নারীও এখানে প্রধানমন্ত্রী হয়! লোকটির কথায় আমি আচমকা বোকা বনে গেলাম। নারী-স্বাধীনতা আছে বলেই কি দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেত্রী নারী? এর অর্থ কি এই যে, দেশে নারী-পুরুষে আর ভেদ নেই, অধিকারে কোনও হেরফের নেই?
তা নয়। মোটেও তা নয়। আমি ভিনদেশি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বললাম রাজনীতির উঁচু পদ ওঁরা পিতা ও স্বামীর গুণে পেয়েছেন, নিজের গুণে নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কী বলেন, এবং একই সঙ্গে বিরোধী দলের নেত্রী? আপনিও কি একথা অস্বীকার করবেন? আপনারা যদিও পিতা এবং স্বামীর নাম ভাঙিয়ে ওপরতলায় উঠেছেন, দেশের শাসনতন্ত্র এখন আপনাদেরই হাতের মুঠোয়, আমি তবু গর্বিত। গর্বিত এইজন্য যে আপনারা নারী। কিন্তু নারী হয়ে কী লাভ, যদি আইন নাড়লেন কিন্তু পাল্টালেন না, যদি রাষ্ট্রের নানা অব্যবস্থার ভেতর দিয়েই এগোলেন কিন্তু কিছুরই পরিবর্তন হল না, সকল নিয়মই অশিষ্ট এবং অসুস্থই রইল। সংবিধান সংশোধনী বিল, ইনডেমনিটি বিল, ভাট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি সমস্যার কথা আমি বলছি না। আমার সমস্যা নারী। তৃতীয় বিশ্বের ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, জীর্ণ, রুগ্ন, মূখ, অন্ধ, বধির নারী।
রাজনীতিতে নেমেই আপনারা মাথায় আঁচল তুলে দিয়েছেন। পুরুষ-নেতারা কিন্তু মাথায় টুপি লাগাননি। ইসলাম যদি মেয়েদের মাথায় কাপড় দেবার কথা বলে, ইসলাম পুরুষের টুপি দাড়ির কথাও বলে। কিন্তু এদেশে নারীকে যতটা ধর্ম পালনে বাধ্য করা হয়, পুরুষকে ততটা নয়; কী বলেন প্রধানমন্ত্রী এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের নেত্রী? আমি জানি, মাথা ঢাকতে আপনারা কেউই অভ্যস্ত নন। যে মেয়ে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছে, যে মেয়ে একজন লেফটেনেন্ট জেনারেলের স্ত্রী, সে নিশ্চয় শাড়ির আঁচলে চুল ঢেকে চলাফেরা করে না। আপনারা এখন চলছেন কারণ আপনাদের সহযাত্রী পুরুষেরা শিখিয়ে দিয়েছে মাথায় ঘোমটা না দিলে এদেশের সাধারণ মানুষের মন পাওয়া যাবে না। তাই ঘোমটায় মস্তিষ্ক আড়াল করে আপনারা সাধারণের পক্ষপাত কামনা করছেন।
এ কি নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া নয়, যেমন আপনারা দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আপনারা একথা ভুলে যাননি, আর এ তো ভুলবার নয়, কারণ মেয়ে হয়ে জন্মালে এ সমাজ তাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয় যে সে মেয়ে, সে মেয়ে বলে তার ডানে নিষেধ, তার বামে নিষেধ, তার ঈশানে নিষেধ, তার নৈঋতে নিষেধ—এ কথা তো ভুলে যাবার কথা নয় যে তারা সেই নানা নিষেধের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ। এবং একবারও কি যাবতীয় নিষেধের জন্য আপনাদের ক্ষোভ হয়নি? আমি জানি, হয়েছে। মেয়েমাত্রই হয়। যদি হয়েই থাকে, তবে এখন কি করণীয় কিছু নেই তাবৎ নিষেধের বিরুদ্ধে, কর্তৃত্ব তো আপনাদের হাতে, ক্ষমতা এখন আপনাদের হাতের মুঠোয় নারী। এ যদি সত্য না হয় গুটিকয় পুরুষ-নেতার অঙ্গুলি নির্দেশে আপনারা চলছেন, ফিরছেন, কথা বলছেন তবে নারীকে অবদমনের নানা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপনারা একবার রুখে উঠন না কেন? আপনাদের কি লজ্জা হয় না, সাক্ষী দিতে দাঁড়ালে কলিমুদ্দিন অথবা রইসউদ্দিন একাই যে কথা বলতে পারে, আপনাদের যে কোনও একজনের সে কথা খাটবে না, দুজন লাগবে। অর্থাৎ খালেদা হাসিনা দু’জন মিলে একজন আবুল কালাম হয়।
আজ এসিড, কাল ধর্ষণ, পরশু খুন—এ কিন্তু এদেশের নিত্যদিনের ঘটনা। আর এ জাতীয় ঘটনার নানা ফাক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আসল অপরাধী। এই ফোকরগুলো এখনও কি তেমন খোলাই পড়ে থাকবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বীরাঙ্গনা বলে আমাদের খুব গর্ব হয়। আপনার জন্য এ মুহুর্তে নিবেদন করছি সর্বোত্তম শ্রদ্ধা।
সামনে পেছনে পুঁ পুঁ বাজিয়ে গাড়ি যায় আপনার জন্য। আমাদের ওসব পাহারার ব্যবস্থা নেই। একবার আসুন না শহরের রাস্তায়, সন্ধ্যার অন্ধকারে ফুটপাতে একবার হাঁটতে আসুন—গণিকা ভেবে আপনাকে কেমন খামচে ধরে পুরুষের লোভাতুর থাবা দেখুন, আমি আপনাকেও বলছি বিরোধীদলের নেত্রী। এই শহরের ফুটপাতে কত অসংখ্য নারী দশ বিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে নিজ চোখে দেখেছেন কখনও? দেখে কি মনে হয় না এ আসলে নিজেদেরই জলের দরে বিক্রি হয়ে যাওয়া? মনে হয় না নারী আসলে পটল কুমড়ো আলু জাতীয় কিছু? এবং আপনারাও, যত ওপরেই উঠুন না কেন, আসলে এর বাইরে নন।
দেশ থেকে পতিতালয় উঠিয়ে মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা যদি নারী হয়ে না নিন, তবে নেবে কে? আপনার প্রতিনিধিত্ব করছেন একজন স্বামীর, একজন পিতার। যদি ও দু’জনের মৃত্যুর শোধ নিতেই ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, সে আলাদা কথা। যদি আরও কিছু বোধের জন্ম হয়, আরও কিছু চেতনার সঞ্চার, যদি মনে হয় এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে—বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বধূহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী-পাচার রোধ করা প্রয়োজন—তবে আমার গভীর বিশ্বাস এই যে, এ বিষয়ে যতটা না পুরুষ শাসক উদ্যোগী হবে, তার চেয়ে অধিক উদ্যোগী হবেন আপনারা, এবং সেটিই সঙ্গত।
সম্পদ এবং সম্পত্তি জীবনযাপনের জন্য অবশ্য প্রয়োজন, এবং মানুষের মর্যাদা বাড়াবার জন্যও । মুসলিম উত্তরাধিকারী আইন মেয়েদের অসম্মান করবার নানাবিধ ব্যবস্থা নিয়েছে। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী তার সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পান, তাদের কোনও সন্তান না থাকলে স্বামী দুই ভাগের এক ভাগ পান—অথচ স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ পান, তাদের কোনও সন্তান না থাকলে স্ত্রী চার ভাগের এক ভাগ পান। স্ত্রী এবং স্বামীর ক্ষেত্রে সম্পত্তি বণ্টনের এমন অসাম্য কেন? অসাম্য কেন সন্তানের ক্ষেত্রে? ছেলে ও মেয়ে থাকলে মেয়ে ছেলের অর্ধেক সম্পত্তি পান। মৃত বাবা ও মায়ের অন্যান্য উত্তরাধিকারীর অবর্তমানে একমাত্র ছেলে তার বাবা ও মায়ের সব সম্পত্তির মালিক হন এবং এ ক্ষেত্রে একমাত্র মেয়ে হলে তিনি মৃত বাবা মায়ের সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ পান। স্বামী এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে, ছেলে এবং মেয়ের ক্ষেত্রে সম্পত্তির এমন অসম বণ্টন কেন, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেত্রী? ধনী দরিদ্রে পার্থক্য ঘোচানো যেমন প্রয়োজন, পুরুষ এবং নারীতেও কি নয়? যদি এই ব্যবধান, এই অসাম্য ঘোচানো সম্ভব না হয় তবে জমিজমার রাষ্ট্ৰীয়করণই করুন না কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যেটি সবচেয়ে মঙ্গলময়। নাকি এ সম্ভব নয় যেহেতু চারপাশের পুরুষ-উপদেষ্টার চাপ, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মের চাপ, সাম্রাজ্যবাদের চাপ, বিদেশি সাহায্যের চাপ আপনাকে ক্ষমতায় আসীন রাখবে। এবং আপনি নেহাতই আপনার স্বামীর নির্জলা প্রতিনিধি—আপনার নিজস্ব কোনও বিচারণ নেই, বিবেচন নেই, বোধ নেই, ধর্ম নেই, আদেশ নেই, অধ্যাদেশ নেই!
৫৭. যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
১. দেলমিরা আগুসতিনি উরুগুয়ের মেয়ে। দশ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখেন। দেলমিরা তাঁর ‘সুদূর থেকে’ কবিতায় লিখেছেন—‘তুমি দূরে গেলেই আমার কান্না উপচে পড়ে/তোমার পায়ের শব্দ শুনে ঘুমের ভেতর সুখে নেচে উঠি,’ নিশ্চয় আমরা ভাবতে পারি, তিনি একজনকে বড় গভীর করে ভালবাসেন, যার নৈকট্য তিনি প্রার্থনা করেন। দেলমিরা লিখেছেন—‘আমার হৃদয় আর তুমি মুখোমুখি দাঁড়ানো, সমুদ্র এবং আকাশের মত/এদের মাঝখানে উড়ান মেঘের মত চলে যাচ্ছে স্রোত ও সময়, জীবন ও মৃত্যু।‘
দেলমিরা যাকে ভালবাসতেন, ভালবেসে যাকে তিনি জীবনের সঙ্গী করেছিলেন, সে-ই তাঁর লেখার একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেলমিরা এই প্রতিবন্ধকতা শেষ অদি মেনে নিতে পারেননি, তিনি স্বামীর কাছে তালাক চেয়েছিলেন। বিনিময়ে স্বামী তাকে হত্যা করে এবং নিজেও আত্মঘাতী হয়। ১৮৮৬ সালে জন্মে মাত্র আঠাশ বছর বেঁচে ছিলেন কবি দেলমিরা আগুসতিনি। পাঠক, আমরা আজ দেলমিরা আগুসতিনিকে চলুন সর্বোত্তম শ্রদ্ধা জানাই এবং তার হত্যাকারী স্বামীকে অভিসম্পাত ।
২ জুলিয়া দ্য বারজোসের একটি কবিতার শিরোনাম জুলিয়া দ্য বারজোসকে। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জুলিয়া বলছেন… ‘যে কণ্ঠস্বর আমার কবিতায় কথা বলে, সে তোমার নয়, আমার কণ্ঠস্বর/তুমি যদি পোশাক, আমি তার সুগন্ধ/আমাদের মাঝখানে শুয়ে আছে গভীর গহ্বর/তুমি সামাজিক মিথ্যের উপর দাঁড়ানো একটি ফ্যাকাসে পুতুল/আমি সত্য, আমি বীর্যবান অগ্নিকণা তুমি, তোমার পৃথিবীর মত স্বার্থপর, আমি নই/আমি আমার মত হতে আমার সকল কিছু নিয়ে জুয়োয় বসতে পারি/তুমি একজন নিপুণ সংসারী মেয়ে, শ্রীমতি জুলিয়া/আমি নই। আমি জীবন। আমি শক্তি। আমি নারী/তুমি তোমার স্বামী, তোমার মালিকের অধিকৃত দ্রব্য। আমি নই/আমি কারও সম্পত্তি নই, আমি সকলের, আমি সকলের জন্য, সকলের আমি/নিজেকে আমি শুভ্ৰ চিন্তা ও অনাবিল ভাবনা দিয়েছি। তুমি তোমার চুল কাল কর, মুখে প্রসাধন মাখো, আমি নই/আমার চুল কাল করে বাতাস, আমার মুখ রঙিন করে সূর্য তুমি ঘরের বধু বশ্যতা স্বীকার করা বিনীত বধ/নানা গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে ক্লান্ত, আমি নই/আমি দ্রুতগামী অশ্ব, পৃথিবী ঘুরে খুঁজে ফিরি সামান্য সমতা।‘
১৯১৪ সালে জুলিয়া দ্য বারজোস পুয়েরতো রিকোয় জন্মেছেন, বড়ও হয়েছেন ওখানে। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নানা অসুখে ভুগে জীবনের অধিক সময় তার হাসপাতালেই কেটেছে। নুইয়র্ক শহরের রাস্তায় অজ্ঞাতপরিচয় জুলিয়া দ্য বারজোস একদিন মরে পড়ে ছিলেন (১৯৫৩)। বেঁচে থাকতে যৎসামান্য পরিচিতি পেলেও জুলিয়া এখন পুয়েরতো রিকের প্রধান কবি হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছেন।
৩. কবি জুয়ানা, জুয়ানা ফেরনানদেজ জন্ম নিয়েছেন ১৮৯৫ সালে। ক্যাপটেন ডি. লুকাস ইবারব্যুরোকে বিয়ে করে নাম নিয়েছেন জুয়ানা দ্য ইবারব্যুরো। উরুগুয়েরর নানা রাজ্যে ঘুরে মনটেভিডিও শহরে এসে জুয়ানা স্থায়ী হন। ১৯১৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোয় এবং তার প্রতিভার খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ১৯২৯ সালে লাতিন আমেরিকা ও স্পেন জুড়ে তার অগাধ খ্যাতি ও ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতে জুয়ানা নিজের নাম রাখেন জুয়ানা দ্য আমেরিকা । বন্ধন নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন–‘আমি প্লাবিত হয়েছি তোমার জন্য/আমাকে পান কর/স্ফটিকও আমার ঝরনার স্বচ্ছতাকে ঈর্ষা করে/আমি ডানা মেলেছি তোমার জন্য/আমাকে হানো/রাতের প্রজাপতি আমি, তোমার অধীর আগুনের চারদিকে ঘুরে মরি/—আমার চুলে পুতির মালার বদলে দোলে দীর্ঘ কণ্টক,/কানের দুলে দুটুকরো পদ্মরাগ মণির বদলে দুটো গনগনে কয়লা/আমাকে দেখে/আমার যন্ত্রণা দেখে তুমি হাসছ/একদিন তুমিই কাদবে/এবং তারপর তুমি আমার হবে/এর আগে যা তুমি হওনি কখনও ।’
৪ ম্রিরিদা নাইত আতিক মরক্কোর কবি। ম্রিরিদা ছিলেন আজিলাল শহরের একজন গণিকা। চমৎকার গান গাইতেন তিনি, তার এই গানের খ্যাতি ছিল খুব। বাড়ির অভ্যাগতদের গান শোনাতেন ম্রিরিদা। তিনি গান লিখতেন পাহাড়ের সাদাসিধে মেয়েদের জীবনযাপন নিয়ে। যুদ্ধের পর, ম্রিরিদার তখন তিরিশ বছরও হয়নি তাকে আর গণিকালয়ে, মাকদাজে, এবং তার গ্রামের বাড়ি মরক্কোর এটলাস পাহাড়ের তাসাউকেও পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ সালে রেলে ইয়লোগ নামের একজন ফরাসী সৈনিক (যাঁর সঙ্গে ম্রিরিদার ভাল বন্ধুত্ব ছিল) তার কবিতার ফরাসী অনুবাদ প্রকাশ করেন।
ম্রিরিদার একটি কবিতার নাম ‘ধোঁয়ার মত’। কবিতাটি এরকম–পরিত্যক্ত মেয়েদের তুমি রক্ষা করো লাললা হালিমা (একজন মুসলমান সন্ন্যাসীর নাম লাললা হালিমা, তিনি অবিবাহিত মা’দের আশ্রয় দিতেন।)/কাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো কৃপালু ঈশ্বর? এই আমি, আমি কোনও পুরুষকে কখনও বিশ্বাস করব না তাদের প্রতিজ্ঞা ধোঁয়া এবং হাওয়ার মত/গোশাবক নিয়ে যখন চরাতে যাই মাঠ/সঙ্গীতজ্ঞের ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল/একটা খচ্চরও কিন্তু অধিক পিপাসার্ত না হলে/অধিক জলও আর পান করে না।/সৈনিক লোকটি তার গুণের পদক নিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে/যতটা সে পেতে চায়, পেয়ে যায় অনেকের মত/শুধু ওই খচ্চরটি তৃষ্ণার্ত না হলে/কিছুতেই জল পান করতে চায় না/দশজন যুবক/দশজন বিপত্নীক/দশজন প্রৌঢ়/সবাই দিয়েছে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি/কেউ কথা রাখেনি তাদের/তাদের সকল তৃষ্ণ মিটিয়েছি আমি/আর তারা পুনর্বার পান করতে গিয়েছে অন্য কোথাও/ককে তুমি বিশ্বাস করবে, কৃপাময় ঈশ্বর আমার / এই আমি, আমি কোনও পুরুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি না/তাদের সকল অঙ্গীকার ধোয়ার মত/ধোয়ার মত/ধোঁয়ার মত।
৫. কবি এডিথ সোডারগ্রাঁ ১৮৯২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে জন্মেছেন। সেখানে তার বাবা-মা সুইডিশভাষী জনগণকে নিয়ে একটি বিশাল দল গড়ে তোলেন। রাশিয়ার বিপ্লবের পর, এডিথ ও তার মা রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নেন, সেখানে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের দিন কাটে। হেলসিঙ্কিতে তার কবিতা প্রথম প্রকাশিত হবার পর হাতেগোনা ক’জন সমালোচক ছাড়া সবাই এর নিন্দ করে। এসময় এডিথ বিষম একা হয়ে পড়েন, কেবল তরুণ বিপ্লবী লেখিকা হ্যাঁগার অলসেন ছাড়া তাকে কেউ সঙ্গ দেয়নি। এই হ্যাঁগারই তরুণ ফিনিশ কবিদের কাছে এডিথের কবিতা পৌঁছে দেন। ১৯২৩ সালে যক্ষ্মা রোগে ভুগে এবং না খেতে পেয়ে কবি এডিথ সোডারগ্রা মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে তিনি সুইডিশ কবিতার একজন সংস্কারক হিসেবে অভিনন্দিত হন এবং তার খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
এডিথ সোডারগ্রাঁর একটি কবিতার নাম—‘দুঃখ’ । সুখের কোনও সঙ্গীত নেই, সুখের কোনও ভাবনা নেই, সুখের কিছু নেই/সুখকে স্পর্শ করলে সুখ ভেঙে যায়, নষ্ট হয়/গহন ঘুমের মধ্যে ভোরের গুঞ্জনে ভেসে সুখ আসে/গাঢ় নীল ভাবনার ওপর তুলো মেঘের মত উড়ে যায় সুখ/ সুখ হল দুপুরের পোড়া রোদে ঘুমিয়ে থাকার অবারিত মাঠ/সুখের কোনও শক্তি নেই, সে কেবল ঘুমোয় এবং বেঁচে থাকে/ আর কিছুই জানে না, কিচ্ছু না…/তুমি কি দুঃখকে চেন? সে তার বজমুঠিসহ কিরকম শক্তিমান এবং বিশাল?/তুমি কি দুঃখকে বোঝ? সে তার রক্তাভ চোখ এবং চোখের জলসহ আশান্বিত হাসে/আমাদের যা যা প্রয়োজন, দুঃখ সকলি দেয়/মৃত্যুকুঠুরীর চাবি দেয়/সে দরজার দিকে ঠেলে দেয় আমাদের দ্বিধান্বিত দেহ/ …সে লোভী মেয়েমানুষের গলার অলঙ্কার খামচে ধরে/সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যখন পুরুষ তার ভালবাসা ফেলে রেখে চলে যায়…/সে মুক্তো এবং ফুল দেয়, সে গান এবং স্বপ্ন দেয়/ সে আমাদের সহজ চুম্বন দেয়, সকলই অদৃশ্য চুম্বন/সে আমাদের একটি কেবল চুম্বন দেয়, যেটি সত্যি/ সে আমাদের আশ্চর্য একটি হৃদয় এবং প্রচণ্ড আকাঙক্ষা দেয়/সে দেয় জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন/ভালবাসা, একাকীত্ব এবং মৃত্যুর সাদা মুখ ।
৬ রানী এলিজাবেথও (১৫৩৩-১৬০৩) কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন–আমার কাছ থেকে আশা করা হয় অনেক কিছুই/অথচ আমার দ্বারা কোনও কিছু করা হয় না/রানী এলিজাবেথ তো বন্দিনী।
বন্দিনী কে নয়? জুয়ানা, ম্ৰিরিদা দেলমিরা, জুলিয়া, এডিথ কে নয়? গণিকা, গৃহিণী, ভিখিরি থেকে শুরু করে ইংলন্ডের রাণীও বন্দিনী। রাণী? যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই!
৫৮. শব্দের অপচয়
সাহিত্য করতে এসে ভালর চেয়ে আমার মন্দ কিছু কম হয়নি। অবশ্য সকল মন্দ অতিক্রম করে । যাবার সাহস আমার ছিল বলে সম্ভবত এখনও বেঁচে আছি, এবং বেশ স্পর্ধা করে এও বলতে পারি যে বেঁচে থাকব।
আমার বাবা, মা বরাবরাই আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট। আমার প্রতাপশালী বাবা কবিতার চেয়ে স্ট্যাটিক্স ডিনামিক্সের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাতেন, মেডিসিন সার্জারি মুখস্ত হলে আমার জন্য বুড়ি ভরে আঙুর আপেল কিনে আনতেন। আমার ধর্মান্ধ মা কবিতার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন নামাজ রোজা। বিকেলটা অনর্থক লেখালেখিতে নষ্ট না করে কোরানের কিছু আয়াত পড়তে বলতেন।
একটি সাদা কাগজে কবিতা লিখে আমার বড় ভাইকে একদিন পড়তে দিয়েছিলাম। বড় ভাই বললেন—কাগজ দিয়ে এরোপ্লেন বানাতে জানিস? এই দেখ। বলে কাগজটিকে ভাঁজ করে এরোপ্লেন বানিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।
আমার ছোটবোন খুব চকলেট পছন্দ করত। একবার তার হাতে দু’ প্যাকেট চকলেট গুঁজে দিয়ে বলেছিলাম—দেখ তো কবিতাখানা কেমন হয়েছে? ছোটবোন মুখে চকলেট পুরে, গালের একদিকটা উঁচু বানিয়ে খুব গম্ভীর কণ্ঠে বলল—রবীন্দ্রনাথের মত লিখতে পার না?
তবু থামিনি। গোপনে লিখে গেছি। গোপনেই পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছি। পত্রিকায় ছাপা হলে বাড়ির সকলে উল্টেপাল্টে বলেছে—না, মন্দ হয়নি।
লিখতে লিখতে ছিয়াশিতে প্রথম খুব সাহস করে কবিতার বই বের করলাম। বইটি ছাপবার দায়িত্ব ছিল আমার, কথা ছিল নসাস প্রকাশনী বইটির বাঁধাই ও পরিবেশনার দায়িত্ব নেবে। সে বছর ফেব্রুয়ারি প্রায় পেরোয় পেরোয়, এমন সময় কাঁচা বই মেলায় এল, তাও আটচল্লিশ পৃষ্ঠার জায়গায় চল্লিশ পৃষ্ঠা। তখন আকাশ কালো করে ঝড় নামছে, রাত অনেক, সেই ঝড়জলের রাত পেরিয়ে পুরানো ঢাকায় বাঁধাইওয়ালার বাড়ি খুঁজে বের করলাম। বাঁধাইওয়ালা প্রায় ধমকে উঠল—যা হয়েছে, হয়েছে। নতুন বাঁধাই হবে না। শুনে কী ভীষণ কেঁদেছিলাম সে রাতে!
এরপর মাঝে-মধ্যে খুব ভয়ে ভয়ে নসাসে যেতাম বিক্রি-টিক্রির টাকা পয়সা কিছু পাওয়া যায় কিনা। প্রকাশনীর মালিক প্রতিবারই বলতেন—মাস দুই পর আসুন। এরপর বছর দুই পর বইয়ের প্রায় সবগুলো বাণ্ডিল ফেরত নিয়ে এলাম, বই সব পোকায় কাটা।
তিন বছর গেল, আবার গাঁটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশের শখ চাপল। বইয়ের ছাপা প্রায় শেষ। খালিদ আহসান প্রচ্ছদ করে দিচ্ছেন। একদিন খালিদ আহসান এবং কবি হেলাল হাফিজ দুজনই অনিন্দ প্রকাশনীর নাজমুল হককে অনুরোধ করলেন আমার বইটির দায়িত্ব নিতে। আমিও উপস্থিত ছিলাম, নাজমুল হক প্রথম কিছুটা ইতস্তত করলেও পরে রাজি হয়েছিলেন। অথচ আমিই সকলকে স্তম্ভিত করে বলেছিলাম—বইটি আমি অনিন্দ্যকে দেব না। নিজেই ছাপব।
আমি এখন জানি না, গোপনে গোপনে অত অহঙ্কার আমার কোথেকে জন্মাল। আমি সেই অহঙ্কারে ভর করেই দেখেছি মাত্র তিন মাসে আমার সাড়ে বারো শ’ বই বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর অন্য এক প্রকাশনী বইটির চতুর্থ মুদ্রণও শেষ করে এনেছে। এখন নানা প্রকাশনী বই ছাপতে বাড়ি অবধি ধর্না দেয়।
আমার কবিতা নিয়ে নানা জনের নানা মত। কেউ খুব উচ্ছসিত, কেউ আবার বলে অনুভূতিগুলো ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত অথবা সমষ্টিগত যা-ই হোক না কেন, অনুভূতিগুলো স্পষ্ট, আমি নিজের অথবা অপর কারও জীবন থেকে যদি এই অনুভূতি ধার নিয়েই থাকি—আমার সাফল্য ওখানেই যে, যে কবিতাগুলোকে আমার ব্যক্তিগত বলে অভিযোগ করা হয়েছে, সে কবিতাগুলোর জন্য অন্তত হাজার দুই চিঠি এসেছে, চিঠি যারা লিখেছে অধিকাংশই নারী, লিখেছে কবিতাটিতে তাদের জীবনের কথা লেখা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারটি যখন আর অনেকের ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়ায়—তখন সম্ভবত সেটি আর ব্যক্তিগত থাকে না। দু’হাজার চিঠি সংখ্যা হিসেবে বেশি নয়। কিন্তু ওরা প্রতিনিধিত্ব করছে আরও অনেকের। সব মিলিয়ে সমষ্টি যা দাঁড়ায় তা একেবারে হতাশ করবার মত কিছু নয়। আর শুধু চিঠিই বা বলি কেন, সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে আমি কি তাদের বেদনার নাগাল পাইনি?
বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে এগোতে হয়। প্রতিবন্ধকতা এ জীবনে যেমন জুটেছে, ভালবাসাও পেয়েছি কিছু কম নয়। গত ফেব্রুয়ারিতে সিলেট থেকে এসেছে একটি আঠারো উনিশ বছর বয়সের ছেলে। বই মেলায় আমাকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল কেবল আপনাকে একটিবার দেখতে সিলেট থেকে ঢাকা এলাম। আমার বাবা-মা-বোন আপনার লেখা এত বেশি পছন্দ করে যে আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি সিলেটে বেড়াতে যাবার, আমাদের বাড়িতে। আপনি একদিন আসুন, এই আমাদের ফোন নাম্বার, আপনি যাবেন জানালে আমি এসে রিটার্ন টিকিট দিয়ে যাব। এই বিনীত ছেলেটি আমার বইগুলোয় অত্যন্ত আগ্রহ করে অটোগ্রাফ নিল। এর কিছু পর, একই বয়সের আরেকটি ছেলে এসে ‘বিপরীত খেলা’ নামে আমার একটি কবিতা দেখিয়ে বলল—আমি দশ টাকায় বিক্রি হতে চাই।
আমি চমকে বললাম–মানে?
ছেলেটি বলল—এই কবিতায় আপনি দশ পাঁচ টাকায় ছেলে কিনতে চেয়েছেন।
আমি খুব গম্ভীর হয়ে বললাম–ওটি কবিতা।
ছেলেটি বলল—কেবল কবিতা?
আমি বললাম–হ্যাঁ, কেবল কবিতা।
ছেলেটি চলে গেল। ওর দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হলাম। তাই বলি, কবিতা লিখতে এসে চারদিক দেখে শুনে আমি কম বিস্মিত হইনি। বিস্মিত হবার আরও একটি গল্প আছে। সেদিন, এক ভদ্রলোক প্রায় ঘণ্টাখানেক আমার কবিতার প্রশংসা করলেন এবং উপসংহারে বললেন—আপনার ন’ বছর বয়সে যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা খুব চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—আমার ন’ বছর বয়সে মানে?
ভদ্রলোক বললেন—আপনার ‘দুরারোগ্য আঙুল’ কবিতাটির কথা বলছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম–ওতে কী আছে?
—সেই যে আপনি শশিকান্তর রাজবাড়ি দেখতে চেয়েছিলেন, আর সেই বুড়ো…
এরপর আমি হাসব কি কাঁদব ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বললাম—আপনাকে কে বলল ওটি আমার নিজের গল্প?
ভদ্রলোক চুপসে গেলেন। আমি বুঝিয়ে বললাম—এই সমাজে মেয়ে-বাচ্চারাও কী করে অপদস্থ হয় আমি তার একটি সরল বর্ণনা করেছি মাত্র। ‘আমি’ নামে লেখার মানে—সকলের বেদনাগুলো আমি আমার ভেতর ধারণ করি বলে ‘আমি’ নামে লিখতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বাট দিস ইজ নট মাই অটোবায়োগ্রাফি।
ওরকম কোনও ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি বলে আমি কিন্তু কোনও গর্ব করছি না। ঘটতেও পারত, কিন্তু এই সমস্যাগুলো আমার বা তার সমস্যা হিসেবে কেন বিবেচিত হয়, একবার সকলে মিলে এই কথাটি ভাবে না কেন যে এ সমস্যা আমাদের। আমাদের সকলের।
পাঠক বাড়ছে, কিন্তু এই পাঠক বেড়ে কি লাভ, যে পাঠক কোনও সমস্যাকে সকলের করে ভাবে না। আর সকলের অনুভূতিগুলো নিজের ভেতর ধারণ করে না। এও তো তবে এক ধরনের ক্ষতি, শব্দের অপচয়।
৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে
১. রোগ নিরূপণের জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি এখন বেশ জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। ধরা যাক পেট ফুলে উঠেছে, পেটে চাকা, ব্যথা ইত্যাদি যে কোনও উপসর্গ নিয়ে রোগী কোনও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হল, তখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি কিছু অনুমান করা না যায়, অথবা অনুমান করা গেলেও যদি সামান্যও দ্বিধা থাকে তবে সোজা আলট্রাসনোগ্রাম।
আলট্রাসনোগ্রামই বলে দেবে পেটে সরল টিউমার না ক্যানসার, বলে দেবে এর অবস্থান, গঠন, আকার আকৃতি, স্বভাব চরিত্র সকলই। আগে এ সুবিধাটি এদেশে ছিল না, বেশ ক’বছর থেকে আলট্রাসনোগ্রামের সুবিধে পাওয়াতে চিকিৎসা ব্যবস্থাও বেশ অগ্রসর হচ্ছে।
গর্ভে ভ্রূণোদগম হলে আলট্রাসনোগ্রামে ভ্রূণের আকার প্রকার সন্তরণ সকলই প্রত্যক্ষ হয়। এবং বিজ্ঞানের কাছে কৃতজ্ঞ হতে হয় আরও এইজন্য যে, ষোলো সপ্তাহের পর ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করবার ক্ষমতাও সে রাখে। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতা শেষ অবধি কোথায় দাঁড়ায়—যদি শুনতে হয় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের এই চমৎকার সুযোগের অপব্যবহার করছে মানুষ, যদি দেখতে হয় ভূণ মেয়ে হলে গর্ভপাত করানো হচ্ছে!
হ্যাঁ, ভারতে অগণন গর্ভপাত হচ্ছে, আলট্রাসনোগ্রামের সুবিধে মানুষ এভাবেই নিচ্ছে যে, কোনও মেয়েকে তারা জন্মাতে দিচ্ছে না। মেয়ে-জন্ম রোধের সুবিধে পাওয়ায় আলট্রাসনোগ্রাম প্রতিবেশী ভারতে এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় নির্ণায়ক। আমাদের দেশে এই জন্ম রোধের মহামারি শুরু হতে খুব একটা দেরি হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ মানুষ কোনও কন্যা জন্ম কামনা করে না। অধিক পুত্র জন্মের পর কন্যা জন্মে হয়ত কেউ বিরক্ত হয় না। কিন্তু কেউ সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় কন্যা জন্মের রোধ ছাড়া ফুরণ চায় না।
মানুষ এখন সুখ ও স্বপ্নের জলে নিশিদিন সাতার কাটতে পারে। কন্যা জন্মের কোনও দুঃসহ লজ্জা, যন্ত্রণা, অতুষ্টি, অসন্তোষ, সঙ্কট, দুর্ভোগ পোহাতে হবে না কোনও বধূকে। আহা কি আনন্দ। গর্ভবতী নারীরা এখন উল্লাসে নৃত্য করুন। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান রোধের ব্যবস্থা নিন। আরবের লোকেরা যখন গুহায় বাস করত, কন্যা জন্মালে তারা জ্যান্ত পুঁতে ফেলত। আর এ হচ্ছে গর্ভের জ্যান্ত কন্যাকে গর্ভেই হত্যা করা। আমরা দিব্যি দালান-কোঠায় বাস করি, গুহায় নয়, লেখাপড়া শেখা সভ্য মানুষ আমরা, এই আমরাই এখন গর্ভহত্যায় মেতেছি।
আর কেনই বা মাতব না, সতীদাহর আগুন মাত্র কদিন হল নিভেছে, পোড়া দাগ কি তার নেই অন্তরে এবং সংস্কারে? পণপ্রথার আগুন, নির্যাতনের আগুন, ধর্মের নানা বিধি ও বিধানের আগুন—কোন আগুনে নারী পোড়ে না? সতীদাহ না হয় নিভেছে, কিন্তু এই ধর্মদাহ এবং সমাজদাহর আগুনে কে সাধ করে পুড়তে আনে আত্মজাকে।
২. ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে’—প্রবাদটি প্রবাদ হিসেবে পুরনো, কিন্তু এখনও, এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও কিছুমাত্র বেমানান নয়। বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, গরু গেলে গরু পাওয়া যায় না, নতুন গরু পেতে গেলে গাটের কিছু পয়সা যায়, আর ঘরে বউ এলে গাঁটে কিছু পয়সা নতুন করে আসে। এ ক্ষেত্রে বউকে হেলাফেলা করা গেলেও গরুকে করা যায় না। যে কোনও বউ বা নারীর চেয়ে গরুকে মূল্যবান বলে ভাবা হয়। সম্প্রতি এদেশের এক মেয়ে এবং ভারতের ছয় গরুর বিনিময় হচ্ছে চোরা পথে। খবরটি শুনে অনেকে আঁতকে উঠেছেন। ছি ছি করেছেন। আমি কিন্তু উল্টো খুব অবাক হয়েছি। কারণ একটি মাত্র মেয়ের বিনিময়ে ছয় গরু পাওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা না করে পারিনি। এ তো অভাবনীয় অভিবাদ্য একটি ব্যাপার, যে এক মেয়ের বদলে ছয় গরু পাচ্ছে সে অধিক লাভবান নিশ্চয়ই।
ভারতের বিশাল ছয়টি গরু বাংলাদেশের একটি কৃষকায় মেয়ের তুলনায় অধিক আকর্ষণীয়, অধিক উৎপাদনীয় এবং নিঃসন্দেহে অধিক মূল্যবান। আমার মনে হয় মেয়ে নিয়ে ওরা বরং ঠকেই যাচ্ছে। মেয়ে মানুষের যেখানে দু পয়সা মূল্য নেই, সেখানে ছয় গরু দিয়ে তাকে যারা সম্মান জানাল, আমি তাদের, সেই চোরাচালানিদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মেয়েমানুষের দাম ভদ্র সমাজ দেয় না, তারা গর্ভেই মেয়েদের হত্যা করে, সেক্ষেত্রে চোরাচালানিরা মাত্র একটি—তাও দীনহীন অকুলে ভাসা মেয়ের বিনিময়ে আস্ত ছয়টি গরু দিয়ে দিচ্ছে। সেই মেয়েকে ওরা দেহব্যবসায় খাটাবে; এই তো! ওরা ওখানে মেয়েদের অভদ্র বানাবে, আর ভদ্রলোকেরা যেমন ইচ্ছে ওদের ব্যবহার করবে। এ আর এমন কি জিনিস, সমাজের ভদ্রমেয়েরা কি ব্যবহৃত হচ্ছে না ভদ্রলোকদের খেয়াল খুশিমত ! এ আর নতুন কি প্রতারণা, এ আর নতুন কি বিভ্রম, এ আর এমন কি নতুন জগত। আমাদের ভদ্রমেয়েরা তো বিনে পয়সায় ৰিক্রি হয়, আর সমাজছাড়াগুলোর জন্য কম হলেও ছ’-সাতটা গরু তো যাচ্ছে। ভালই তো, এ যাত্রায় যদি নারীর মূল্য কিছুটা বাড়ে।
৩. আমার বড় কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমার একবার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। জগতের সকল নারীকে বলছি, আসুন আমরা আমাদের জন্য একবার কাঁদি। আমাদের জন্য একবার আমরা কাঁদি। একবার চলুন চিৎকার করে কাঁদি আমরা, ধুলোয় গড়িয়ে কাঁদি। আমরা তো এক-একটা নির্বাক পাথর, আমরা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে খেলা দেখছি। আমাদের নিয়ে মানুষ মজাদার খেলা খেলছে, আমরা কেউ রা শব্দ করছি না! আমাদের জন্মের জন্য, আমাদের এঘর থেকে ওঘর, এদেশ থেকে ওদেশ চালানের জন্য একবার আমরা খুব কাঁদি।
৬০. মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জী
‘মকছুদোল মো’মেনীন’ নামে একটি বই আছে, বইটি আমাদের অশিক্ষিত, মূর্খ ও বর্বর মুসলমানদের অতি প্রিয় একটি বই, বইটি এ অবধি সম্ভবত কয়েক লক্ষ কপি ছাপা হয়েছে। মুসলমান হিসেবে জন্ম নেবার প্রমাণ হিসেবে খৎনা করা এবং ঘরে একটি ‘মকছুদোল মোমেনীন’ রাখা অবশ্য কর্তব্য বলে অধিকাংশ মুসলমানই মনে করে।
মকছুদোল মোমেনীন বা বেহেশতের কুঞ্জীর প্রথম পাতায় লেখা স্বৰ্গসুখ, শান্তি যদি চাহ দোজাহানে, মকছুদোল মোমেনীন কিনে দাও বিবিগণে। পতি ভক্তি করি যদি নিতে চাও পুঞ্জি। স্বামীকে কিনিতে বল বেহেশতের কুঞ্জী।
বইটির সাড়ে চারশ’ পৃষ্ঠা জুড়ে রচিত বাক্যাবলি যে কোনও সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করবার জন্য যথেষ্ট। বইয়ের ৩৪৩ থেকে ৩৫৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত রচিত হয়েছে স্ত্রীলোকদের জন্য ৩৫টি নছিহত।
এই নছিহতগুলো পড়লেই বিবিগণের মান মর্যাদা সম্বন্ধে প্রভূত জ্ঞান লাভ করা যায়। আমি কিছু নছিহতের নমুনা দিচ্ছি— –
স্বামীকে কখনও নিজের উপর অসন্তুষ্ট হইতে দিবেন না। তিনি যে ইশারায় চালাইতে চাহেন, সেই ইশারাতেই চলিতে থাকুন। আপনার স্বামী যদি আপনাকে বলেন, তুমি দুই হাত বাঁধিয়া সমস্ত রাত্রি আমার সামনে দাঁড়াইয়া থাক, তথাপি তাহাতে বাধ্য হোন। তাহা হইলে খোদা ও রসুল আপনার উপর সন্তুষ্ট থাকিবেন। (৭ম নছিহত)
আপনাদের স্বামী আপনাদের নিকট থাকিতে কখনও তাহদের বিনা হুকুমে নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল এবাদত ইত্যাদি কার্য করবেন না এবং তাহদের অগ্রে খানা খাইবেন না, করিতে হইলে তাহার হুকুম লইয়া তাহাদিগকে সন্তুষ্ট রাখিয়া করিতে থাকিবেন। কেননা নফল এবাদতের চেয়েও স্বামীর খেদমতেই ছওয়াব অত্যন্ত বেশি পাইবেন। (১০ম নছিহত)
স্বামীর বিন হুকুমে তাহার ঘরের কোনও মালপত্র টাকাকড়ি কাহাকেও দিবেন না, দান খয়রাতও করবেন না, প্রতিবেশীর বাড়ি বা কুটুম্বালয়ে যাইবেন না। কারণ স্বামীর বিনা হুকুমে ঐ সমস্ত কাজ করা মহাপাপ | (১১শ নছিহত )
স্বামীর কোনও দোষের কথা কখনও অন্যের নিকট প্রকাশ করিবেন না। সর্বদাই আপন স্বামীর সুখে সুখী হইবেন ও তাহার দুঃখে দুঃখী হইবেন। (১২শ নছিহত)
সকল সময়ে স্বামীর মেজাজ বুঝিয়া ব্যবহার করিতে থাকুন। যখন দেখিবেন যে, স্বামী হাস্যবদনে আছেন তখন হাসিয়া হাসিয়া ব্যবহার করুন। আর যখন দেখিবেন যে, গম্ভীর হইয়া আছেন, তখন হাসিয়া হাসিয়া ব্যবহার করিলে চলিবে না। হয়ত রাগিয়া উঠিয়া মারও দিতে পারেন, কিংবা কোনও কটু বাক্য বলিয়া দিতে পারেন, কোনও সন্দেহ নেই। অতএব পূর্বেই সাবধান হইয়া ব্যবহার করা উচিত। (১৮শ নছিহত) –
স্বামী যদি কোনও সময় কোনও ক্রটি পাইয়া আপনাদিগকে মারেন বা গালাগালি করেন তজ্জন্য চুপচাপ গাল ফুলাইয়া মনের রাগে দূরে সরিয়া থাকিবেন না। বরং হাতে পায়ে ধরিয়া অনুনয় করুন। (১৯শ নছিহত)
অতি চালাকির সহিত আপন আপন স্বামীর সঙ্গে মিলেমিশে জিন্দেগি কাটাইতে থাকুন। যদিও কোনও কোনও সময় তাহারা মহব্বতে পড়িয়া আপনাদের হাত-পা টিপিয়া দিতে অথবা অন্য কোনও খেদমত করিয়া দিতে চাহেন, শক্তি থাকিতে তাহা কখনও করিতে দিবেন না। কারণ আপনাদের পিতা-মাতা ঐরূপ করিতে চাহিলে তাহা ভাল মনে করিবেন কি? না, না, না। তবে বুঝিতে গেলে পিতা-মাতার চেয়েও স্বামীর সম্মান বেশি। (২০শ নছিহত)
আপনাদের স্বামীগণ আপনাদিগকে যেইরূপ চালাইতে চাহেন, সেইরূপই চলিতে থাকুন এবং তাহারা যেইভাবে চলিতে থাকেন আপনারা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুন। কোনও কাজে ও কোনও কথায়ই তাহদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। (২৯শ নছিহত)
খোদার নিবন্ধনে যাহার যেরূপ অদৃষ্ট ফলিয়াছে তাহার উপরই শোকর করা একান্ত কর্তব্য যাহার স্বামী পাগল, বুদ্ধিহীন বা মূখ, তাহার পক্ষে সেই-ই আকাশের চাঁদ মনে করিতে হইবে। তাহার পদতলে মাথা নিচু করিয়া দিয়া জিন্দেগি কাটাইয়া লইলেই পরকালে বেহেসতের সুখ-শান্তি ভোগ করিতে পারবেন। (৩৪শ নছিহত)
মুখ হোক, অন্ধ হোক কি কানা হোক, খঞ্জ হোক কি আতুর হোক, সুশ্ৰী হোক কি কুত্ৰী হোক, সর্বদাই সন্তুষ্ট চিত্তে তাহার পদতলে জীবনখানিকে লুটাইয়া দিতে থাকুন এবং সর্বদাই উভয় মিলেমিশে মহব্বতের সহিত জিন্দেগি কাটাইতে চেষ্টা করুন। (৩৫শ নছিহত)
মুসলমান পুরুষেরা তাদের বিবিগণের জন্য স্বৰ্গ-সুখ ও শান্তি’র বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন মকছুদোল মোমেনীন-এর মাধ্যমে। এবং আমাদের ততোধিক মুসলমান বিবিগণ সাদরে বরণ করে নিচ্ছেন পুরুষ রচিত তাবৎ নছিহত।
ধিক্ ‘বিবিগণ’ ধিক্। যদি লজ্জা বলে সামান্য কিছু অবশিষ্ট থাকে, যদি একবারও মানুষ বলে নিজেকে মনে হয় তবে আসুন—সমস্বরে নিষিদ্ধ করতে বলি মকছুদোল মোমেনীন নামক একটি অশিষ্ট, অসংহত, অমার্জিত, অযৌক্তিক ও অশ্লীল প্রকাশনা।
আমাদের সংবিধানে নাকি নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা লেখা আছে। একদিকে সমান অধিকারের ধুয়ো, আরেক দিকে ধর্মের নামে নারীকে অমানুষ বানাবার কায়দা কৌশল। নিষিদ্ধ করতে বলবার কেবল একটি কারণ নয়—এই বইয়ে যে অদ্ভুত চিকিৎসাপ্রণালী বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে একটি বিজ্ঞান নির্ভর উন্নয়নশীল সভ্য দেশের লজ্জিত হওয়া উচিত। ঘরে আগুন লাগলে উচ্চস্বরে আল্লাহ আকবর বললে খোদার কৃপায় আগুন নিভে যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে ফোড়ার জন্ম হয় এবং সেই ফোড়াকে নির্মুল করতে হলে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। শরীরের কোনও স্থানে ফোড়া হলে শাহাদাৎ অঙ্গুলিকে মাটির ওপর কিছুক্ষণ ধরে রেখে কোনও একটি দোয়া পড়লে সেই ফোড়া নিরাময়ের কোনও কারণ নেই। চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি ও নানারকম চোখের রোগ, অন্ধত্ব ইত্যাদি দূর করতে কোনও আয়াত বা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকের সন্তান হওয়ার জন্য একটি তদবীর লিখে গলায় বুলিয়ে দিলে এবং ৪০টি লবঙ্গের মধ্যে ৭ বার করে একটি দেওয়া পড়ে প্রতি রাতে খেলে নাকি গর্ভে সন্তান হয়। ধরা যাক জরায়ুর নালী (ফ্যালোপিয়ান টিউব) বন্ধের কারণে কোনও স্ত্রীলোকের সন্তান হচ্ছে না, কোনও ডিম্বাণুই ওই নালীপথে জরায়ুতে পৌঁছুতে পারছে না, যেখানে তার সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন হবে। তবে কি কোরানের সবকটি আয়াত গুলে তাকে খাওয়ালে সে সন্তান জন্ম দিতে পারবে? আমি জানি পারবে না, এবং পাঠক, আপনারাও নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন।
জ্বর হলে, বসন্ত হলে, কলেরা হলে, অতিরিক্ত রক্তস্রাব হলে হাতে ও নাভির নিচে যে সমস্ত তাবিজ লাগাবার বর্ণনা আছে, এবং সুস্থ হয়ে যাবার নিশ্চয়তা আছে তা দেখে আমি বিস্মিত হই। জ্বর কোনও রোগ নয়, রোগের উপসর্গ, রোগের কারণ খুঁজে বের করে যে জীবাণু দ্বারা রোগের উৎপত্তি সেই জীবাণুনাশক ব্যবহার করলেই জ্বর সেরে যায়। কলেরা হলে শরীর থেকে জলীয় পদার্থ যে পরিমান বের হয়, একই পরিমাণ জলীয় পদার্থ রোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে হয়, সঙ্গে কলেরার জীবাণু নাশ করবে এমন পরীক্ষিত জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হয়। অতিরিক্ত রক্তস্রাব জরায়ুতে এক ধরনের টিউমারের কারণে সাধারণত হয়, রক্তস্রাবের কারণ বের করে সেই কারণের সেবন-চিকিৎসা অথবা শল্য-চিকিৎসা করতে হয়। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ ঝাড়ফুক, তাবিজ কবচের উপর ভরসা করে বেঁচে থাকে। আর বিশ্বাসে ভুগতে ভুগতে অধিকাংশই মরে, বাকিরা প্রায় মরো-মরো অবস্থায় উপস্থিত হয় অগত্যা চিকিৎসকের কাছে।
এই অশিক্ষা, এই ধর্মীয় কুসংস্কার, এই সর্বগ্রাসী অসুস্থতায় মানুষ আক্রান্ত হতে হতে এখন এমন এক মহামারী শুরু হয়েছে যে খুব শীঘ্র মকছুদোল মোমেনীন এবং এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর প্রকাশনা বন্ধ না করা হলে আমরা একটি কঙ্কালসার অসুস্থ জাতিতে পরিণত হব, বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও শেষ অদি এই মহামারীকে ঠেকাতে পারবে না।
৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
এ শহরে যে সামান্য ক’জন মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলতে পছন্দ করি, কবি ফরহাদ মজহার তাদের মধ্যে একজন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার এবং গায়ক। তার সকল পরিচয় স্বীকার করে কবি পরিচয়টিকেই অগ্রগণ্য বলে মানি। ফরহাদ মজহার বাংলা ভাষা সম্পর্কে নিজস্ব একটি মত প্রকাশ করেন, যেমন, সাদাসিধে করে বলতে গেলে, যে বাংলা ভাষাটি পশ্চিমবঙ্গ এবং আমাদের দেশে প্রচলিত তা নিরেট পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, আমাদের নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে আরবি-ফারসি শব্দসমৃদ্ধ আমাদের জবানের ভাষাকে লেখালেখিতে তুলে আনা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি ইসলামি সংস্কৃতিকেও বেশ নতুন চোখে দেখেন, কারণ এই সংস্কৃতি নাকি আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষার জোগান দেবে।
ভাষার ক্ষেত্রে ফরহাদ মজহারের এই বোধ, এই যুক্তি আমি কখনও মেনে নিইনি। এর কারণ, আমি মনে করি না এ পারের বাঙালিদের কথ্য ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের প্রয়োগ খুব বেশি। মৌখিক ব্যবহার আছে, এমন শব্দের লিখিত ব্যবহার এদেশে অপ্রচলিত নয়, যেমন নাস্তা, গোসল, পানি যা পশ্চিমবঙ্গে জলখাবার, স্নান ও জল বলে পরিচিত। আমাদের নাটকে, উপন্যাসে ‘এয়েচো, খেয়েচো, করলুম, বললুম, দোবো’ শব্দের চল নেই। এ ছাড়া বোধে ও বিশ্বাসে যে স্বাতন্ত্র্য আছে, যেমন কৃষ্ণচূড়ার লাল বলতে আমরা ফাগুনের আরেক রঙ বুঝি, ফাগুন বলতে বায়ান্ন বুঝি, রক্তপাত বুঝি। এ ধরনের দেশ, কাল, পরিবেশ, প্রতিবেশ, রাজনীতিজনিত কিছু স্বাতন্ত্র্য বাদ দিলে যা থাকে, তাকে যদি ‘পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা’ বলে অভিযোগ করা হয়, তবে খুব অন্যায় হবে। এবং এও অন্যায় যদি এই শুদ্ধ বাংলার মধ্যে অনর্থক আরবি-উর্দু শব্দ মিশিয়ে ভাষাটির খৎনা করা হয়।
প্রচলিত কোনও মৌখিক শব্দ, যে শব্দ, লিখিত ভাষায় এখনও প্রবেশ করেনি বলে মনে করা হয়, সে শব্দের চলন প্রচলনে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে পুরনো ঢাকার গুটিকয় উর্দুভাষীর উর্দুকে প্রচলিত জ্ঞান করা মোটেও সমীচীন নয়।
সেদিন কবি শামসুর রাহমানকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম—আপনার গদ্যে উর্দু শব্দের আধিক্য কেন?
শামসুর রাহমান বললেন—শব্দগুলো প্রচলিত।
আমি বললাম—অধিকাংশ শব্দের অর্থ আমি জানি না। অথচ আপনি বলছেন প্রচলিত, নাকি আপনার কাছে প্রচলিত মনে হবার কারণ আপনার স্ত্রী একজন উর্দুভাষী, আপনার ঘরে উর্দু-চৰ্চা চলে।
শামসুর রাহমান নম্র হেসে বললেন–ও তো এখন বাংলায় কথা বলে।
বললাম–নাকি আপনিও একটি ইসলামি বাংলা ভাষা তৈরি করতে চাচ্ছেন যা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে আলাদা?
শামসুর রাহমান বললেন—একটা সময় ছিল যখন আমি পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায় গদ্য লিখেছি, তখন আমাদের ওপর সরকারের নিষেধ ছিল ওই ভাষায় না লিখবার। এখন কোনও নিষেধ নেই বলে উর্দু-আরবি শব্দ মেশাচ্ছি। তা ছাড়া আমাদের অনেক শব্দই তো বিদেশি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম যে শব্দগুলো ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে—চেয়ার, টেবিল, স্কুল, কলেজ, সোয়েটার, দাওয়াত, পোশাক, পালিশ, পেনশন—এ নিয়ে তো কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি নতুন করে যে শব্দগুলোর প্রয়োগ চাচ্ছেন এর কারণ কি ওই শব্দগুলোর বাংলা প্রয়োগ নেই বা থাকলেও খুব দুর্বল?
শামসুর রাহমান বললেন–না, তা নয়। আছে। তবে ভাষায় নতুন কিছু শব্দ এলে খারাপ কী? ভাষা আরও সমৃদ্ধ হল!
আমি শামসুর রাহমানের এই যুক্তিকেও মানতে পারি না। ভাষাকে নতুনত্ব দেবার বা সমৃদ্ধ করবার জন্যে, এই বাংলা ভাষা এত ভিখিরি হয়ে যায়নি যে অন্য ভাষা থেকে শব্দ হরণ করবার বা ধার করবার কোনও প্রয়োজন আছে। আমাদের যা আছে, তাই নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি না কেন। বরং শব্দভাণ্ডারকে পরিমাণে সমৃদ্ধ করবার চেয়ে সাহিত্যকে গুণগত সমৃদ্ধি দেবার আগ্রহ থাকা উচিত সকল সৎ সাহিত্যিকের।
কবি শামসুর রাহমানকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি এবং এখনও করি, যদিও এই একটি ব্যাপারে তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবার সাহস বা স্পর্ধা আমি দেখিয়েছি। শ্রদ্ধা করি কবি ও কলামিস্ট হুমায়ুন আজাদকেও। শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন রেখেই আমি মনে করছি হুমায়ুন আজাদ এদেশের অশিক্ষিত মুর্খ জনগণের কাছে রবীন্দ্রনাথকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করছেন যে জনগণ ‘রবীন্দ্রনাথ’কে একজন ‘হিন্দু’ ছাড়া আর কিছু জানে না, রবীন্দ্র-উৎসবে রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের নিয়ে গল্প লিখলেন না তা নিয়ে অভিযোগ করে এবং কিছু বিশেষ শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেই দেশের জনগণের জন্যে রবীন্দ্রনাথের নারী বিষয়ে মতবাদের নিন্দা করে হুমায়ুন আজাদ কলাম লিখছেন। তাঁর মূল্যবান রচনায় লিখেছেন–‘রবীন্দ্রনাথের সারকথা হচ্ছে নারীর রূপের মূল্য নেই, জ্ঞানের মূল্য নেই আরও, নারীর মহিমা তার গৃহকাজে বা দাসীত্বে এবং তাকে বন্দি করে রাখতে হবে গৃহে।‘
রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় গল্পে, উপন্যাসে নারী এত বিশাল স্থান অধিকার করে আছে, তখনকার সমাজে ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তখন নারী ছিল শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতিতে এত পিছিয়ে থাকা মানুষ যে রবীন্দ্রনাথ সেই শ্লথ সমাজকে অতিক্রম করে বেশি এগিয়ে ছিলেন বলে ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা স্বামীর বন্ধুর প্রতি আগ্রহ প্রকাশে কোনও অন্যায় দেখেন না, ‘নষ্টনীড়ে’র চারুলতা মোটেও সঙ্কুচিত নন অমলের প্রেমে পড়তে। ‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল যে যুক্তিতে ঘর ত্যাগ করেছেন, আমার মনে হয় আজ থেকে দেড়শ বছর পরও এদেশের মানুষ মনে ও শরীরে অতটা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না, যতটা ‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল অর্জন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময় ও সমাজ থেকে অনেক অগ্রসর—এ কথা রবীন্দ্রনাথের শত্রুরাও স্বীকার করবে। আমি আশঙ্কা করি এক স্বৈরাচারী সরকার এই দেশের জন্যে একটি রাষ্ট্রধর্ম তৈরি করেছে, যে ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানুষ ভারত-বিরোধিতায় ভোগে এবং দেশে একটি ইসলামতন্ত্র চালু করতে চায়—তাদের এই স্বপ্নে মদত জোগাচ্ছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি এবং একই সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ফরহাদ মজহার, শামসুর রহমান এবং হুমায়ূন আজাদও তাদের অশুভ হাতকে আরও শক্তিশালী করছেন।
‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথ’কে অবজ্ঞা করে যারা ‘মুসলমান কাজী নজরুল ইসলাম’-এর ইসলামি গজলে বুঁদ হয়ে থাকে তারা নিশ্চয়ই হুমায়ুন আজাদকে এবার আদর্শ বিবেচনা করবে এবং বুদ্ধিজীবিদের দলে ভিড়িয়ে দলকে আরও পাকাপোক্ত করবে। তারা একটি স্বতন্ত্র ইসলামি ভাষাও দাবি করে—যে ভাষা তৈরির একটি দায়িত্ব নিয়েছেন কবি ফরহাদ মজহার এবং কবি শামসুর রাহমান। এবার তাদের আর ঠেকায় কে, রাজাকার আলবদরগুলো এই নতুন ভাষায় পাকিস্তান পাকিস্তান গন্ধ পেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠবে। জামাত-শিবিরেরা বন বন করে রামদা ঘুরিয়ে প্রগতিবাদীর কল্লা কাটবে। রাষ্ট্রধর্ম তৈরি করে যারা একটি মহৎ কাজ করেছে বলে মনে করে তারা এবার দেশের শিক্ষিত সচেতন সম্মানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নিজেদের সার্থকতা প্রমাণ করবে।
৬২. দর্জির স্পর্শ
বড় হবার পর, একটি মেয়ে যতই রেডিমেড পোশাক পরুক না কেন, দর্জির কাছে মাঝেমধ্যে তাকে যেতে হয়, হয়ত কিছু কাপড় কেনা হল অথবা কেউ দিয়ে গেল—সেই কাপড় নিয়ে ঘরে সেলাই মেশিন না থাকলে দর্জি অবধি যেতেই হয়। আর যারা রেডিমেড তেমন পছন্দ করে না, তারা সচরাচর যায়ই, আবার শাড়ি পরতে অভ্যস্ত মেয়েরাও শাড়ির ব্লাউজ পিস নিয়ে সেলাইয়ের জন্য দর্জির দোকানে যায়। সব মেয়েরই কিছু না কিছু দর্জি-অভিজ্ঞতা আছে। দর্জি মাপ নেয়, মাপ লেখে, কাপড়ের কোণা কেটে স্লিপে স্টেপল করে। দর্জি কিন্তু আরও কিছু করে।
দর্জি আরও যা করে তা শুধু মেয়েরাই জানে, মেয়ের একথা কারুকে বলে না, কারণ এ বড় লজ্জার কথা, এ কোনও বলবার কথা নয়। দর্জি একটু আড়ালে বা নিভৃতে দাঁড়িয়ে একটি ফিতে দিয়ে হাতের মাপ, গলার মাপ, কোমরের মাপ, নিতম্বের মাপ এবং বুকের মাপ নেয়। এই মাপ দিতে গিয়ে মেয়েরা একটি সমস্যার প্রায়ই মুখোমুখি হয়, তা হল বুকের মাপ নিতে গিয়ে পুরুষ দর্জিরা মেয়ের বুকে অশোভন কিছু করে; ফিতে দিয়ে মাপ নিতে গেলে শরীরে আঙুল স্পর্শ করবার কথা নয়, কিন্তু খুব কম দর্জিই এই স্পর্শ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। দর্জির কাছে কাপড় তৈরি করে অথচ এই স্পর্শ এবং চাপের যন্ত্রণা ভোগ করেনি—এমন মেয়ে খুব কমই আছে এদেশে।
পুরুষের নানা রকম বিকৃতি আছে, এটিও একরকম বিকৃতি। দিনে ত্রিশটি জামা বা ব্লাউজের মাপ রাখতে গিয়ে সে ত্রিশটি স্তন স্পর্শ করবার সৌভাগ্য অর্জন করে—পুরুষেরা এই সংখ্যাধিক্যকে সৌভাগ্য বলেই মনে করে। নিজেদের বিকৃত আঙুলকেই সুখের বাহক বলে জানে।
পুরুষের লজ্জা নেই, সে একটি অবৈধ এবং অভব্য কাজ অবলীলায় করে যায়, এ দেখে লজ্জা হয় উল্টে নারীরই। সে লজ্জায় লাল হয়, সে অপমানে নীল হয়, সে ক্ষোভে বেগুনি হয়। মেয়েদের কেবল মুখের রঙ বদলই হয়, এই নানা বর্ণ নিয়ে তার নির্বাক প্রস্থান ছাড়া অন্য কিছু সাধারণত ঘটে না। অথচ দোষী ব্যক্তিই মনে মনে তুড়ি বাজিয়ে হেসে ওঠে।
সেদিন এক দোকানে কিছু কেনাকেটা করতে গিয়ে দেখি পাশের দর্জির দোকানে হঠাৎ কোলাহল হচ্ছে ভিড় সরিয়ে দেখি একটি পচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে দর্জির নাক বরাবর কাটা ঘুসি দিয়েছে। দর্জি চুপ, মেয়েটি বলছে কেন মেরেছি সে আমাকে নয়, তাকেই জিজ্ঞাসা করুন। মেয়েটি যে কাপড়ের জন্য মাপ দিচ্ছিল, সেটি উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। না, কাপড় কাটায় বা সেলাইয়ে কোনও ক্রটি হয়নি, মেয়েটি প্রথম বানাতে এসেছে জামা। সে মাপ দিচ্ছিল শরীরের, দর্জি বুকের মাপ নিতে গেলেই ঘুসিটি এসে দর্জিকে হকচকিয়ে দেয়। আমি মেয়েটিকে মনে মনে সাব্বাস বলেছি।
মেয়েদের বলছি, এটি বড়সড় কোনও সমস্যা নয় হয়ত, কিন্তু এটি সমস্যা। এইসব স্পর্শে শরীরের কোনও ক্ষয় হয় না। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা চাপ আপনি গ্রহণ করবেন কেন? আপনি প্রতিবাদ করুন, মুখের প্রতিবাদে কেবল লোকই জড়ো হয়, এতকাল যা হয়ে এসেছে—তাতে লাভ কিছু হয় না। আপনি জুতসই আঘাত করুন, তাতে মানুষ জানবে মেয়েরাও আঘাত করতে জানে, মেয়েরা চড়, লাথি, ঘুসি ইত্যাদিও ছুড়তে জানে, যে কাজগুলো কেবল ছেলেদের জন্যই ছিল বাধা। এগুলো জায়গা মত ছুঁড়তে শিখলে নানারকম অবাঞ্ছিত স্পর্শ চাপ, ঢিল, থুথু, ধাক্কা ইত্যাদির মীমাংসা হবে। সমাজ আপনা-আপনি বদলে যায় না, একে বদলাতে হলে এখন নিজেদেরও এরকম এগিয়ে আসতে হবে। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখতে হবে। এ হয়ত ক্ষুদ্র এক অন্যায়, অনেকে বলবে কত বড় বড় অন্যায় হচ্ছে দেশে, নির্যাতন হচ্ছে, আগে সেসব সামলাও–বড় অন্যায় দূর হলে ছোট অন্যায়ের সাধ্য আছে থাকে?
না, কোনও অন্যায়কে ভদ্রতা করে এড়িয়ে যাওয়া, অথবা অপরাধীকে লজ্জিত হতে না দিয়ে নিজে লজ্জা পাওয়া, অথবা সকল নির্যাতনের জন্য মনে মনে সমাজ ব্যবস্থাকে দোষ দিয়ে মাথা নিচু করে সরে যাওয়া মেয়েদের জন্য আর উচিত নয়। মেয়েরা এখন ঘুরে দাঁড়াতে শিখুক, গায়ে কোনও ঢিল বা অশ্লীল উক্তি যদি কেউ ছুঁড়ে দেয়, যা অহরহই ছুঁড়ে দিচ্ছে, যে কোনও বয়সের মেয়ের দিকে যে কোনও বয়সের পুরুষ—মেয়েরা যেন ঘুরে দাঁড়ায়, অবিনীত, ধৃষ্ট এবং উদ্ধত। মেয়েরা এখন ছোবল দিতে শিখুক।
ঘুরে দাঁড়াবার অভ্যেস মেয়েদের নেই। তারা পথ-চলতি সকল বিপদ বাড়ি অবধি বহন করে নিয়ে যায়, সকল কিছুর জন্য নিজেকে অথবা নিয়তিকে দোষী করে এবং কাঁদে। মেয়েদের সকল ক্ষোভ মেয়েরা কেঁদে গলিয়ে ফেলে। ক্ষোভগুলোকে জমাট বেঁধে বেঁধে বিস্ফোরণে রূপ নিতে দেয় না। অথচ এখন বিস্ফোরণ দরকার। কোনও বিস্ফোরণ ছাড়া টনক নড়বে না কারু। এখন সকলের ভোতা চেতনায় লক্ষ্যভেদী ঢিল ছুড়তে হবে—আর এ দায়িত্ব যত বেশি মেয়েদের, তত আর কারুর নয়।
৬৩. ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
আমার শহরের নাম ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ আমার শৈশবের নাম, উদাম কৈশোরের নাম। আমি যখন সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরি, একটি মেট্রোপলিটন সিটির যানজট, ভিড় অতিক্রম করে আমি যখন একলা আমি—কেউ নেই কথা বলবার, কেউ নেই পাশে বসবার, তখন আমার বুকের মধ্য থেকে একজন খুব নরম করে আমাকে ডাকে, বলে—ঘুমোও। আমি জানি কে আমাকে ডাকে, বড় চিনি তাকে, তার দীর্ঘ একটি নদী চিনি, তার পথ চিনি, তার ঘরদুয়োর চিনি, তার কাশবন, তার বৃক্ষ, তার সবটা আকাশ আমি চিনি। সে আমার ময়মনসিংহ। ওই এক টুকরো শহর, ওই শহর কেন এত প্রিয় আমার; ছ’মাস কি বছর পেরোয় আমি শহরটির মুখ দেখি না। অথচ প্রতিরাতে ওই শহর আমাকে ডেকে বলে—লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমোও। ওই শহর আমার ঘুম ভাঙায়। আমি ব্যস্ততার জন্য আদ্যন্ত তৈরি হয়ে উঠি।
ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম। ওখানের ধুলো কাদায় গড়িয়ে আমি দৈর্ঘ্যে বেড়েছি, ওখানের জল হাওয়ায় ঘুরে আমি মননে বেড়েছি। ময়মনসিংহ আমাকে ভেতরে বাইরে মানুষ করেছে। আমাকে মানুষ করেছে আরও একজন, সে আমার বাবা। আমার বাবার সঙ্গে আমি জানি না কত সহস্ৰ বছর আমার কথা হয় না। শুনেছি বাবার আগের সেই দাপট নেই, আগের মত জুতোর হুঙ্কার তুলে সারা শহর হেঁটে বেড়ান না, বাজারের সবচেয়ে বড় রুই মাছটি এনে উঠোনে ফেলেন না, বাবা আগের মত আমন অহঙ্কার করে বলেন না—এর পেটিগুলো সব ভাজা হবে, সবচেয়ে বড় পেটিটা দেবে আমার বড় মেয়েকে। বাবা কি এখন জানেন তার বড় মেয়ে রুই মাছের গন্ধ ভুলে গেছে, স্বাদ ভুলে গেছে!
ছোটবেলায়, যখন ধীরে ধীরে ‘মেয়ে’ হয়ে উঠব বলে জানি, চারদিক থেকে আমনই হয়ত শিখছিলাম, মা একদিন আমাকে কোনও এক বাড়ি নিয়ে কান ফুটো করে আনলেন। দেখে বাবা রেগে আগুন হয়ে সারা বাড়ি চিৎকার করলেন। মা’র ওপর সে কি তুফান গেল ক’দিন। বাবার সোজাসাপটা কথা—আমার মেয়ে লেখাপড়া করবে। তার অত সাজগোজের দরকার নেই। আমার কানের ফুটো অব্যবহারে ধীরে ধীরে বুজে গেল। আমিও তো বড় মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। স্কুলের মেয়েরা হাত দোলালে হাত ভরা কাচের চুড়ি রিন রিন করে বাজে। লাল সবুজ নীল—কত রঙের চুড়ি। স্কুলের মাঠে চুড়ি নিয়ে এক বেদেনী বসত। স্কুল ছুটি হলে মেয়েরা চুড়ি কিনতে ভিড় জমাত। একদিন আমারও ইচ্ছে হল চুড়ি কিনি, একদিন আমারও বড় ইচ্ছে হল রিন রিন করে হাত দোলাই, দু’হাত ভরে চুড়ি পরে সেদিন বাড়ি গেলাম। বাবা অফিস থেকে এসেই আমাকে কাছে ডাকেন, রোজ ক্লাসে কী কী পড়ানো হল তার হিসেব নেন। সেদিন কাছে যেতেই আমি টুং টাং বেজে উঠলাম। বাবা খাচ্ছিলেন, খাবার রেখে উঠোনে গেলেন, উঠোন থেকে বড় এক পাথর নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন–হাতে কী ওগুলো?
বললাম–সবাই পরে।
বাবা জ্বলে উঠলেন, বললেন–হাত রাখ টেবিলে। হাত রাখলাম। বাবা পাথর মেরে দু’ ডজন চুড়ি টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিলেন। বললেন—ফের যেন এসব পরতে দেখি না, সাবধান।
সেই না পরতে পরতে না পরাটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন পরলেও বাবা আর ভাঙতে আসেন না, তবু পরি না। কেমন অস্বস্তি লাগে, যেন অকারণ বাড়তি একটি জিনিস গায়ে চাপিয়েছি, ভার ভার লাগে, খুলে ফেলি।
ঠোঁটে কখনও লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না। যখন একটু একটু করে কৈশোর পেরোচ্ছি, বড় খালা বোনদের দেখে সাজতে ইচ্ছে হত, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দিলে বাবা হাতের তালু দিয়ে বা সামনে কাপড় রুমাল যা-ই পেতেন তা দিয়ে মুছে দিতেন। বলতেন—এসব রঙ লাগিয়েছিস কেন? ফের মুখে কোনও রঙ দেখলে আস্ত রাখব না বলে দিচ্ছি।
আমার সেই ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী বাবা, যাকে দেখে বাড়ির যেখানেই থাকি দৌড়ে গিয়ে পড়বার টেবিলে বসেছি, সামনে যে বই-ই পেয়েছি ভূগোল হোক পাটিগণিত হোক সশব্দে পড়েছি। যে বাবা আমাকে চোখে কাজল লাগাতে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না, যে বাবা আমাকে কানে দুল পরতে, হাতে চুড়ি পরতে দিতেন না—সেই বাবার দিকে মনে মনে কত রাগ করেছি ছোটবেলায়।
মেয়েরা যে কোনও পরবে-উৎসবে সেজেগুজে হেঁটে যেত। আমি সাদামাঠা একটি জামা পরে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কী যে দুঃখ হত নিজের জন্য।
আসলে আমি তখন বুঝিনি বাবা আমাকে কী অমূল্য জিনিস আমার চেতনার ভেতর প্রবেশ করিয়েছিলেন। বড় হবার পর সোনাদানা হীরে আমার কাছে অনেক এসেছে, আমি সব নিয়ে হেলাফেলা করেছি। আমার কাছে একটি সুতোর মূল্য যেমন, এক তোলা হীরের মূল্যও তেমন, আমি কোনও ধাতব অলঙ্কারকে আজও ভালবাসতে পারিনি। বাবা আমাকে ওই তুচ্ছতিতুচ্ছের মোহ থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাবা কি এখন জানেন—তিনিই আমাকে মানুষ করেছেন সবচেয়ে বেশি!
বলতেন–পড়াশুনা কর। জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমি খেলতে শিখিনি আমি নাচতে শিখিনি, আমি বেড়াতে শিখিনি, আমি রাঁধতে শিখিনি, আমি কেবল পড়তে শিখেছি। বাবা আমাকে পড়াতে পড়াতে এমনই পড়বার অভ্যেস করালেন যে না পড়লে আমার অস্থিরতা বেড়ে যায়, রাতে ঘুম হয় না। বাবা কি আমার মন্দ করেছেন কিছু?
এই যে এত ময়মনসিংহ ভালবাসি, এই যে আমার শহর আমার শহর বলে উষ্ণ হয়ে উঠি মধ্যরাতে, এই যে এক আশ্চর্য ভালবাসা আমাকে ডেকে বলে–লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমোও ! সে কি বাবার কারণে নয়? ওই শহরে আমার একজন বাবা বাস করেন বলে শহরটি এত প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। ওই শহর জানে আমার মানুষ হবার গল্প। ওই শহর জানে আমার বাবার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের গল্প। ওই শহর জানে ওই শহর থেকে আমার হঠাৎ হারিয়ে যাবার গল্প। ওই শহরই কেবল জানে একজন ভালবাসার বাবা বাস করেন বলে ওই শহরটিকে বুকে নিয়ে এই দূর পরবাসে প্রতি রাতে আমি ঘুমোতে যাই।
আমার বাবা কি জানেন আমার এই ঘুম এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার গল্প?
৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
শারদীয় ‘দেশ’-এ প্রকাশিত সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ করবার অনুরোধ জানিয়ে মামলাটি করেছিলেন অমল মিত্র নামের এক তরুণ অ্যাডভোকেট। প্রজাপতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে সরকার পক্ষও তাকে সমর্থন জানিয়েছিল। সমরেশ বসুর পক্ষে প্রথম ও প্রধান সাক্ষী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
সে বছর ষোলই নভেম্বর ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কুমারজ্যোতি সেনগুপ্তর আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেন বুদ্ধদেব বসু। কোর্টরুম তখন জ্যাম প্যাক্ড। উপস্থিত ছিলেন ‘দেশ’-এর তখনকার সম্পাদক অশোককুমার সরকার, মুদ্রাকর ও প্রকাশক সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত, অভিযুক্ত সমরেশ বসু, সঙ্গে সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, কবি নরেশ গুহ এমন অনেকে। বুদ্ধদেব বসু ‘প্রজাপতি’র অভিযুক্ত অংশগুলো সম্পর্কে বলেন ওখানে তিনি অশ্লীলতার কিছুই পাননি। ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ২০০ পৃষ্ঠার কথিত অশ্লীলতাকে বুদ্ধদেব বসু তুখোড় যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ওগুলো অশ্লীলতা নয়, যদি নরনারীর মিলনের সম্পর্ককে অশ্লীল বলা হয় তবে প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পে এই মিলনের কথা অবাধে এসেছে। কেউ তার ওপর কোনও নিষেধবিধি জারি করেনি। মহাভারতে বা কালিদাসের কাব্যে কিংবা কোনারক, খাজুরাহে বা পুরীর মন্দিরে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এগুলো মহৎ শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা সাহিত্যে ও ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর এবং বহু বৈষ্ণব কবিতায় এই সম্পর্কের কথা বেশ খোলখুলিই আছে। মনে রাখতে হবে জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের দেশে ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। যে কারণে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-কে অশ্লীল বলা হয়েছে, বুদ্ধদেব বসু বলেন সেই ধুয়া তুললে তো আগে মহাভারত, বাইবেল এসবই নিষিদ্ধ করে দিতে হবে।
অভিযোগকারী অ্যাডভোকেট জানালেন, ‘প্রাচীন পুরাকীর্তি, মহাকাব্য ও ধর্মগ্রন্থের জন্য আলাদা আইন আছে। সেই আইনে সেগুলো সুরক্ষিত। পুরী, কোনারক, খাজুরাহ, অজন্তা, ইলোরার স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা ও ধর্মও ঐতিহাসিক কারণে আইনে সংরক্ষিত। সেই আইনে চিকিৎসাশাস্ত্রের বইয়েরও ঠিক একই রক্ষাকবচ আছে।’
রক্ষাকবচ না থাকলে মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেলের মত হাদিস কোরানও নিষিদ্ধ করতে হয়। সব দেশেই একটি আলাদা আইনে পুরাকীর্তি ও ধর্মগ্রন্থ সুরক্ষিত থাকে। অশ্লীলতার দোষ দিলে এর বাইরের নানা কীর্তি ও শিল্পের বিরুদ্ধেই দিতে হয়। রক্ষাকবচ বা সংরক্ষণের আলাদা আইন না থাকলে অশ্লীলতার দোষ এগুলোকেও দেওয়া যেত, যেমন—সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হইয়াছে (সূরা বাকারা আয়াত ১৮৭)। পাদটীকা—প্রথম দিকে রামযানের রাতে ঘুমাইয়া গেলে পর পুনরায় জাগিয়া খাদ্য গ্রহণ এবং স্ত্রী গমনের নিয়ম ছিল না। সাহাবীদের কেহ কেহ এই বিধি কখনও কখনও লঙ্ঘন করিয়া ফেলিতেন ও ইহাতে অনুতপ্ত হইতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়।
‘তোমরা মসজিদে ই’তিকাফরত অবস্থায় তাহদের সহিত সঙ্গত হইও না।‘ (প্রাগুক্ত) লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বল—‘উহা অশুচি’ । সুতরাং তোমরা রজঃস্রাবকালে স্ত্রী-সঙ্গ বর্জন করিবে; এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী-সঙ্গম করিবে না। সুতরাং তাহারা যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হইবে তখন তাহদের নিকট ঠিক সেইভাবে গমন করিবে যে-ভাবে আল্লাহ তোমাদিগকে আদেশ দিয়াছেন। (সূরা বাকারা আয়াত ২২২)
তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্য ক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিতে পার। (সূরা বাকারা আয়াত ২২৩)
অতঃপর যদি সে তাহাকে তালাক দেয় তবে সে তাহার জন্য বৈধ হইবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সঙ্গে সঙ্গত না হইবে। (সূরা বাকারা আয়াত ২৩০)
নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হইয়াছে। এইসব ইহজীবনের ভোগ্যবস্তু। (সূরা আল ইমরান আয়াত ১৪)
সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হইল তখন আমি তাহাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করিলাম। এবং এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি। সে যে স্ত্রীলোকের গৃহে ছিল সে তাহা হইতে অসৎকর্ম কামনা করিল এবং দরজাগুলি বন্ধ করিয়া দিল ও বলিল—‘আইস’ (সূরা ফুসুফ আয়াত ২২/২৩)
নগরে কতিপয় নারী বলিল, আযীযের স্ত্রী তাহার যুবক-দাস হইতে অসৎকর্ম কামনা করিতেছে, প্রেম তাহাকে উন্মত্ত করিয়াছে। (সূরা য়ুসুফ আয়াত ৩০)
নারী শয়তানের আকৃতি ধরে নিকটে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে ফিরে যায়। যখন তোমরা কেউ নারী দেখে সুখানুভব কর এবং তোমাদের অন্তরে সে পতিত হয়, তখন সে যেন তার স্ত্রীর দিকে মন আকৃষ্ট করে নেয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গম করে। কেননা, তার অন্তরে যা আছে, তা সঙ্গম দ্বারা বিদূরিত হয়ে যাবে। (বোখারি হাদিস)
অতিরিক্ত গরমের দিনে, ভরা পেটে, ঘর্মাক্ত কলেবরে এবং গোসলের পরক্ষণে সঙ্গম করবে না। কারণ এতে সন্তান মুর্খ ও বোকা হতে পারে। (বোখারি হাদিস)
স্বামী তাঁর স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করতে পারেন। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে আহ্বান করেন এবং স্ত্রী সেই আহানে সাড়া না দেয়। (তিরমিজি হাদিস)
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, সোমবারের সহবাসের সন্তান খোদাভক্ত ও কোরানে হাফেজ হয়। মঙ্গলবারের সহবাসের সন্তান মুমিন ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হয়। বৃহস্পতিবার দ্বিপ্রহরের পূর্বে সহবাসের সন্তান বিজ্ঞপণ্ডিত হয়। তার উপর জাদুমন্ত্রের বাণও কার্যকর হবে না। শুক্রবার দ্বিপ্রহের পূর্বে সহবাসের সন্তান হয় অত্যন্ত উত্তম ও সৎ চরিত্রবান। (তিরমিজি)
ধর্মগ্রন্থ কখনও অশ্লীলতার দোষে দূষিত হয় না। এসব সংরক্ষণের আলাদা আইন আছে, রক্ষাকবচ আছে। তাই মহাভারত, রামায়ণ, গীতা, বাইবেল, কোরান, হাদিস সকল ধর্ম এবং ধর্ম-সংক্রান্ত গ্ৰন্থই রক্ষাকবচের গুণে পার পেয়ে যায় এবং আমরা তা মাথায় তুলে রাখি।
৬৬. নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
আমি কোনও দল করি না, আমি একা। আমার কোনও সংগঠন নেই, সংস্থা নেই, সমিতি নেই, পরিষদ নেই, আমি যা লিখি নিজ দায়িত্বে লিখি। একা লিখি। আমার পেছনে বিশাল কোনও পেশীশক্তি নেই, যা আমাকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করবে। আমি কোনও স্তাবক পুষি না।
এই ব্ৰহ্মাণ্ডে একটি বিন্দুর মত আমি একা। আমার মত এত একা, আর যারা লেখেন, তারা নন। আমি একজন নারীবাদী পুরুষকে জানি, তিনি তার সংস্থা থেকে নারীর জন্য কল্যাণকর প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। কল্যাণকর যে কোনও কিছুকে আমিও সমর্থন করি। কিন্তু সেই সংস্থাই যখন নারীর কল্যাণকামী অন্য শক্তিকে প্রতিরোধ করে তখন সংস্থাটির কল্যাণ কামনা নিয়ে আমার বড় সংশয় হয়। আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তিনি বা তার সংস্থা আসলে নারীর নয়, নিজেদের কল্যাণ কামনা করেন। নিজেদের খ্যাতি এবং বিত্তের বাইরে আর যা কিছু তা নেহাত লোক-দেখানো ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে রোধ করতে, আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় এমন শক্তির অভাব এদেশে নেই। জামাত-শিবির সরকারের কাছে আমার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছে। ওরা করবেই, এ নিয়ে আমি বিস্মিত নই, কারণ ধর্মসংক্রান্ত অমূলক ও অযৌক্তিক কথার প্রতিবাদ আমি করি, আর যেহেতু ওরা ধর্মকে ওদের নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করে—ওরা আজ শাস্তি, কাল ফাসি’, আমি যতদিন বেঁচে থাকি, আমার জন্য দাবি তুলবেই। এ নিয়ে আমি সামান্যও বিস্মিত নই। কিন্তু প্রগতির পক্ষের কথিত শক্তি যখন নামে এবং বেনামে আমাকে আক্রমণ করে, এদের কদাকার এবং হিংস্র চেহারা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমি বিস্মিত হই, বিস্মিত হই এবং বিস্মিত হই।
আমি সামান্য একজন লেখক মাত্র। সমাজের পীড়িত, নিগৃহীত, দলিত, দংশিত নারীর জন, লিখি। নরম কথায় এ যাবৎ কিছু হয়নি বলে আমি কড়া কথা বলি। নিন্দুকেরা এর নাম দিয়েছে পুরুষ-বিদ্বেষ। এদেশে আমার প্রশংসা যদি একজন করে, নিন্দা করবে একশ জন। এই আকটমুখ, মূঢ় ও নির্বোধের দেশে আমি বেশি প্রশংসা আশাও করি না। আমার অসংখ্য নিন্দুকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীবাদী নামধারী সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা, মার্কিন মদতপুষ্ট অগণন পেশী-শক্তি।
হোক, হবে না কেন, আমি তো একা, একা একজন মানুষকে চূর্ণ করতে সময় এবং শক্তির তেমন অপচয় হয় না। একা একজন মানুষকে গালি ছুড়তে কারও কোনও ভয় হয় না, কারণ সে তো কোনও দলের নয়, সংগঠনের সদস্য নয়, আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় কোনও প্রতিঘাতের আশঙ্কা নেই। একা একজন মানুষের কুৎসা রটালে সেই কুৎসা যখন প্রবল ধাবিত হয়, কোনও বিরুদ্ধ বাতাস থাকে না তাকে ফেরাবার। একা একজন মানুষের কণ্ঠনালী চেপে ধরতে তেমন দুঃসাহসেরও দরকার হয় না।
মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ অসংখ্যের অনুগত হয়, বিশাল-এর বাধ্য হয়। মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ নিজেকে এত দুর্বল ভাবে যে একটি সবলের কাছে সে সমর্পিত হয়, আশ্রিত হয় একটি ‘ছত্রছায়ায়’।
আমি একা। একা বলে আজ আমার অহঙ্কার হয়। আমি কোনও দল বা সংঘের ভাড়াটে লেখক নই। আমি কোনও পেশী বা স্তাবক পুষি না, পোষা সংখ্যাধিক্য, আমাকে মোহিত করে না। আমি একা। একা একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তাবৎ নিন্দার মুখে থুথু দিয়ে অশুভ সকল শক্তির বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়েছি। যেন কারও কাধে ভর দিয়ে নয়, এমন একাই একটি তুমুল শক্তি দাঁড়াতে পারে—এমন দাঁড়াতে পারে বিড়ম্বিত, বিপন্ন, দুর্গত, নিরাশ্রয় নারী।
নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়। তার পায়ে পরানো আছে দ্বিধার শেকল, তার মস্তিষ্কে পিঁড়ি পাতা আছে ভয়ের। দ্বিধা এইজন্য যে, কে না জানি তার নিন্দা করে। নারী দ্বিধার চাকুতে নিজেকে শত টুকরো করে। নারী ভয়ে নীল হয়। এই নীল হওয়াকে লোকে মুগ্ধ চোখে দেখে, নানান ব্যাখ্যা করে তার নীলাভ সৌন্দর্যের । আহা নারী, ভয়ের কামড় থেকে গা বাঁচিয়ে একবার সে কেন এমন দাঁড়ায় না, এমন ঋজু এবং উদ্ধত? পরাশ্রয়ী লতার মত নয়, একটি বৃক্ষের মত? যার আছে একটি শক্তিমান শেকড়? নারী একাই তো হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য। একাই তো হয়ে উঠতে পারে বিপুল এবং বিস্তৃত।
৬৭. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
প্লেবয়-এর জেফ কলিন্স এখন উল্লাসে নৃত্য করছেন। কারণ মিশন তার সাকসেসফুল। মস্কোর মেয়েদের তিনি উলঙ্গ করে ছেড়েছেন। সূক্ষ্ম পোশাক পরে মস্কোর মেয়েরা রেড স্কোয়ারে ছবি তুলেছে। জেফ কলিন্স মস্কোর মেয়ে সম্পর্কে বলেছেন—‘সারা ইউরোপের মত তারা দ্বিধাহীন, শরীর নিয়ে লজ্জিত নয়। একঘর লোকের মধ্যে ঝটপট কাপড় খুলে ফেলতে তাদের মোটেই সঙ্কোচ নেই।‘
জেফ কলিন্স ভেবেছিলেন, আগ্রাসী পাঠকের খাদ্যতালিকায় নতুন মেনু হিসেবে চমৎকার হবে রুশ-সুন্দরীরা। তিনি এতটা আশাও করেননি যে, হুড়মুড় করে এক ডাকে মডেল হবার জন্য দাঁড়িয়ে যাবে এতদিনকার সমাজতন্ত্রী মেয়েরা, যারা অন্তত নিজের শরীর নিয়ে ব্যবসা করতে শেখেনি। গর্বাচেভ ও ইয়েলেৎসিনের ধ্বংসযজ্ঞকে পুঁজি করে জেফ কলিন্স স্রেফ সুযোগ নিতে মস্কো গিয়েছিলেন। তার গোপন ইচ্ছে ছিল, এই ফাঁকে কায়দা করে কিছু রুশ-সুন্দরীকে ভজানো যায় কি না।
না কোনও ছল-চাতুরির দরকার হয়নি। মেয়েরা প্লেবয়-পত্রিকার মডেল হবার জন্য রীতিমত লাইন দিল। শুধু রেড স্কোয়ারে নয়, সেন্ট বাসিলস-এর সামনে, স্পা-টাউন সোচিতে, পুশকিন ফাউন্টেইনে, রোসিয়া হোটেলের সুইমিং পুল, করিডোর, রেস্তোরায় অর্ধনগ্ন রুশ-সুন্দরীর ছবি তোলা হল। লেনিনের ছবির সামনে নগ্ন সুন্দরীরা নিতম্ব দেখিয়ে ছবি তুলল। যেন লেনিন নয়, লেনিনের চেয়ে মহান হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ রুশ-নারীদের নিতম্ব। জেফ কলিন্স জয় গ্লাসনস্ত, জয় ইয়েলেৎসিন বলে দেশে ফিরেছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে পণ্য করতে চাননি, নারীকে গার্হস্থ্য বাদিগিরি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে মানুষ বলে ভেবেছেন, পুঁজিবাদীর শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে নারীকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। লেনিন নিশ্চয় সেই মহান মানুষ, নারীকে যে মানুষ ধর্ম ও সামাজিক সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। নারীকে রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘর থেকে কলে এনেছেন, কারখানায় এনেছেন, মিছিলে এনেছেন, পাঠশালায় এনেছেন। সেই লেনিনকে সামনে রেখে আজ রুশ-নারীরা উরু উদোম করে ছবি তুলবার পোজ দিচ্ছে। ধিক, ধিক্ এই পশ্চিমী মোহে, ধিক এই নারী-দেহের বীভৎস বাণিজ্যে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রামে-গঞ্জেও এখন ডিস্কো চলে, চলে মিস সুন্দরী প্রতিযোগিতা । রাশিয়ার মেয়েরা এখন মেধার অনুশীলনের চেয়ে শরীরের সৌন্দর্য প্রদর্শনকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। তারা বুক, কোমর ও নিতম্বের মাপ নিয়ে এখন ভীষণ ব্যস্ত। রাস্তাঘাটে পর্ণে-পত্রিকার স্তৃপ, ঘরে ঘরে ব্লু-ফিল্ম চলছে।
বার্লিন-প্রাচীর ভেঙে ফেলবার পর পূর্ব জার্মানীর তরুণেরা প্রথম ঢুকেছে পশ্চিম জার্মানীর ব্রেথেলে। স্বাধীনতার স্বাদ ওরা ব্রেথেলে ঢুকেই পেয়েছে, এবং দুঃখ এই যে, অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে। রাশিয়ায় এখন নারীকে পণ্য বানাবার পশ্চিমী কায়দাকানুন চলছে। নারী এখন আর মানুষ নয়, ভোগের বস্তু, নারী-সম্ভোগ এখন স্বাধীনতার অন্য নাম।
এই যদি হয় গ্লাসনস্তের চূড়ান্ত ফলাফল, তবে ধিক্ গ্লাসনস্তে, ধিক্ তাদের স্বাধীনতায়। কম্যুনিজমকে ধূলিসাৎ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমি ক্লেদই তারা ঘরে নেবে—এর বেশি কিছু নয়। এর বেশি প্রাপ্তি তাদের নেই।
সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বার পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে নারী-দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়। নারীকে পণ্যের শেকলে বেঁধে বোকা নারী-পুরুষ উভয়েই এখন উল্লাস করছে। ধুন্ধুমার নৃত্য করছে। নারী এখন ওদেশে, অবিকল পুঁজিবাদী দেশের মত, সুস্বাদু খাদ্য। খাদকেরা লেনিনের আদর্শ আগুনে পুড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিকৃত সভ্যতার দিকে।
হায় পতন! হায় দানবীয় উচ্ছাস! লেনিন, আপনি ক্ষমা করুন। আপনার এই নির্বোধ উত্তরাধিকারিদের ক্ষমা করুন। যে গার্হস্থ্য বাদিগিরি থেকে নারীকে আপনি মুক্ত করেছিলেন, সেই নারীই এখন সাধ করে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াচ্ছে, সেই নারীই শখ করে এখন নিজের শরীরকে প্রলোভনের বস্তু বানাচ্ছে। লেনিন, আপনি লজ্জায়, ঘৃণায় আপনার চোখ বন্ধ করুন। যেন এই বিকৃতি, যেন এই নোংরা সভ্যতা আপনাকে দেখতে না হয়।
৬৮. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
গত ১ রবিউল আওয়াল ১৪০২ হিঃ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখে চট্টগ্রামের ইসলামি ঐক্যজোট ও হিযবে ইসলামী ‘ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব’ সম্পর্কে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে। প্রচারপত্রটি লিখেছেন ইসলামি ঐক্যজোটের আহ্বায়ক মুফতি মুহাম্মদ ইজহারুল ইসলাম। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন ‘আমাদের বদ আমলের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ একদলীয় শাসন এ জাতির কাঁধে চাপানো হয় এবং ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের জনসাধারণের চেতনায় এক বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং ফলত মুজিবের পতনের পরে পর্যায়ক্রমে জাতর ইতিহাসের পর্দায় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটে’। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার কারণে কখনও এই দেশে কোনও ধর্মীয় উচ্ছঙ্খলতা সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল মসজিদ মাদ্রাসা, তারা অবাধে নামাজ পড়েছে, রোজা করেছে, ঈদুল আযহার উৎসবেও মুসলমানরা কখনও বাধাগ্রস্ত হয়নি। এই অপার স্বাধীনতা পাবার পরও জনসাধারণের চেতনায় বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল এবং এ কারণে মুজিবের পতন ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এই মিথ্যাচার আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু মুজিব আমলের জনরোষ সম্পর্কে র্যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, তারা নিশ্চয় একথা স্বীকার করবেন যে জনরোষের কারণ আর যা কিছুই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।
প্রচারপত্রে আরও দাবি করা হয়েছে—‘জিয়াউর রহমান রাজনৈতিকভাবে জাতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে মুক্ত করে সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করেন। শতকরা নববই ভাগ মুসলমানের এ মাটি ও আবহাওয়া ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহিতার নাগপাশ থেকে বাহ্যিকভাবে মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।‘ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহিতা এদেশে ঘটেনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যা ঘটেছে তা ধর্মনিরপেক্ষতা থাকাকালীন নয়, বরং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার পর।
১৯৭০ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সরকার বদলের যে রাজনৈতিক কারণ এই প্রচারপত্রে বর্ণনা হয়েছে, তা মিথ্যে, ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এইজন্য বললাম, কারণ উদ্দেশ্য এখানে এসে স্পষ্ট হয়— জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত দুষ্ট আচরণ থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আটরশি ভিত্তিক সকল ভাওতাবাজি দীর্ঘ নয়টি বুছর ওলামায়ে কেরামসহ সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা একটিমাত্র কারণেই হজম করেছিল যে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে রয়েছেন দু’জন মহিলা।
তা-ই যদি হয়, তবে আমার প্রশ্ন তৌহিদী জনতা যখন এরশাদের পতন ঘটাল এবং দেশে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা হল, তখন এই জনতা কেন মহিলা এবং তার দলকে নির্বাচিত করল? মহিলা ছাড়াও এবং এরশাদ ছাড়াও, পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক দল তো এদেশে ছিলই এবং মহাসমারোহে নির্বাচনের প্রার্থীও হয়েছিল। তৌহিদী জনতার মূল আপত্তি নাকি মহিলা নেতৃত্বে। মুফতি তার উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট করেছেন কোরান হাদিসের উদাহরণসহ, যেমন মহিলা নেতৃত্বে কোনও কিছুর সুরাহা হবে না। বরং আমাদের আশঙ্কা, এতে নেমে আসবে আরও অসংখ্য অমঙ্গল ও গজব। কারণ আল্লাহর রাসুল এরশাদ করেছেন– ‘কখনও ঐ জাতির মঙ্গল সাধিত হয় না যাঁরা নিজেদের নেতা নির্ধারণ করেন কোনও মহিলাকে’ (বোখারি শরীফ হাদিস ৪৪২৫)। মুফতি ইজহারুল ইসলাম আরও লিখেছেন–‘মুসলিম মিল্লাতের নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী যিনি, তাকে ইমাম, খলিফা, সুলতান বা আমিরুল মুমেনীন বলা হয়। সেই ইমাম ও খলিফা বা রাষ্ট্র সরকার প্রধান মহিলা হওয়ার কোনও অবকাশ ইসলামী শরিয়তে নেই। বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কগুলোতে ইসলাম নামটি মাথাব্যথার কারণ হলেও এদেশের শতকরা নববইভাগ মুসলমান এখনও পর্যন্ত আল্লাহ রাসুল ও পরকালে বিশ্বাসী বিধায় ইসলামী শরিয়ত ও খোদায়ী শাসন অনুশাসনের অনুরাগী। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান মহিলা হওয়ার কোনও রকমের যৌক্তিকতা আছে বলে আজ পর্যন্ত কোনও বিজ্ঞ আলেম মত প্রকাশ করেননি।‘
কিন্তু মুফতি ইজহারুল ইসলামের দুর্ভাগ্য এই যে, দেশের সরকার প্রধান এখন একজন মহিলা। কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেমের তোয়াক্কা না করেই দেশের অধিকাংশ জনগণ এই মহিলাকেই নির্বাচিত করেছে।
মুফতি ইজহারুল ইসলাম যুক্তি দিয়েছেন, যেমন পুরুষরাই মহিলাদের তত্ত্বাবধায়ক শাসক, কারণ আল্লাহ তাঁদের এককে অপরের উপর (পুরুষকে নারীর উপর) প্রাধান্য দান করেছেন এবং এ কারণে যে, পুরুষরাই (নারীদের জন্যে) তাদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করেন। (সূরা নিসা আয়াত ৩০)
আর যখন তোমাদের দুষ্টু লোকেরা আমীর শাসক আর মালদার ব্যক্তিরা কৃপণ হবে এবং তোমাদের যাবতীয় কার্যাবলি নারীদের হাতে সোপর্দ হবে, তখন এ পৃথিবীর পেট তার পিঠের তুলনায় (অর্থাৎ দুনিয়াতে না থাকাই) তোমাদের জন্য উত্তম হবে (তিরমিজি শরীফ, ২য় খণ্ড, ৫২ পৃষ্ঠা)
পুরুষরা যখন মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করবে তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। (মুসতাদরক আল হাকীম ২৯১ পৃঃ ৪ৰ্থ খণ্ড)
উদ্ধৃত অংশগুলোকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে মুফতি বলেছেন–ইসলামের এইসব মৌলিক বিধানগুলোর আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান ও নামাজের ইমাম হওয়া উভয়টি সমানভাবেই মহিলাদের জন্য হারাম। শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ পরিচালনা ও দেশ পরিচালনা উভয়টিকেই ইমামত বলা হয়। এই ইমামত কখনও পুরুষ ছাড়া নারীদের জন্যে বৈধ নয়। নামাজের ইমামতিতে পেশ মসল্লায় যেমন কোনও মহিলা দাঁড়িয়ে গেলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া মুসল্লীদের জন্য ফরজ ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্র নামক বড় মসজিদের পেশ মসল্লায় কোনও মহিলা অধিষ্ঠিতা হয়ে গেলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া সমস্ত মুসলিম জনসাধারণের জন্য ফরজ। খোদাদ্রোহিত না করে বি এন পি দেশ পরিচালনা করলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়, তবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহিলা আমরা কখনও মেনে নিতে পারি না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম, পীর মোর্শেদ মাশায়েখ ও ইসলামি বুদ্ধিজীবিসহ সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণের কর্তব্য হল মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশে যাবতীয় নারী নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি সত্যিকারের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জানমাল দিয়ে অংশগ্রহণ করা। তাহলে মূল কথাটি এই দাঁড়ায় যে, দেশে একটি হারাম নেতৃত্ব বিরাজমান। আজ পুরো একটি দেশের ইমামতি করছে নারী, এ হিসেবে নামাজের ইমামতি করা নেহাত তুচ্ছ ব্যাপার, দেশ পরিচালনা করছে নারী, একইভাবে দেশের মসজিদগুলোয় নামাজ পরিচালনার দায়িত্বও নারী নিতে পারে, গত মিলাদুন্নবীতে প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের পুরুষ ও নারী এক কাতারে দাঁড়িয়ে এবং বসে মিলাদ পড়েছে, এমন দৃশ্য এর আগে কল্পনাতীত ছিল, কল্পনার অতীত ঘটনাগুলোই এখন ঘটছে, ঘটবে। হারাম-হালালের সংজ্ঞাও সেই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে।
নারী এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পুরুষরা মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করায় মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল কিছু হয়নি। ওইসব ধ্যান-ধারণা এখন অমূলক, অচল, অযৌক্তিক। দেশের মানুষ ধর্মকে অন্তরে স্থান দিতে চায়, শাসন ব্যবস্থায় নয়, শরিয়তকে পুঁথির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়, শরিয়ত যদি উঠে এসে রাষ্ট্রনীতিতে আসন গাড়ে তবে জনগণ এত বোকা নয় যে এতে তাদের সমূহ বিপদের আশঙ্কা তারা করবে না। আশঙ্কা করে বলেই দেশের আশি ভাগ মানুষ ধর্মভীরু হয়েও আশি ভাগ ভোট কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ভাগে পড়ে না। পড়ে শরিয়ত বিরোধী মহিলা নেতৃত্বের দিকে। শরিয়ত-এর কথা বলে জনগণকে বোকা বানাবার দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। তারা এখন নিজেরাই নিজেদের মঙ্গলের জন্য নীতি তৈরি করতে পারে, শরিয়তের সাহায্য ছাড়াই।
তারা ধর্মকে হেলা করছে না, কিন্তু শরিয়তকে মানছে না, তবে কেন এ-ই ধরে নিচ্ছি না যে ধর্ম আসলে চৌদ্দশ বছর আগের নানাবিধ তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা ও তাবৎ আরবীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার উর্ধের্ব উঠে এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে, সততা ও মহত্ত্বের কথা ছাড়া বাকি অসততা ও অধর্মকে বর্জন করবার ক্ষমতা অর্জন করেছে মানুষ। এই সচেতন মানুষই এক সময় বিদ্যমান সকল শরিয়তি আইন বাতিল করে রাষ্ট্রে, সমাজে ও জীবনে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।
৬৯. স্মৃতিতে লেনিন
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ ধনী ও দরিদ্রের, নারী ও পুরুষের কোনও অসাম্য দেখতে চাননি। পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, প্রাতঃকালে স্মরণযোগ্য মানুষ–সে মানুষ বলেছিলেন–‘নারী-শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য শুধু নারীদের আনুষ্ঠানিক সমতা নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জন্যও সংগ্রাম। প্রধান কর্তব্য হল মেয়েদের সামাজিক উৎপাদনশীল শ্রমে আকর্ষণ, ‘গার্হস্থ্য বাঁদিগিরি’ থেকে তাদের উদ্ধার, রান্নাঘর ও শিশুঘরের চিরন্তন আবহাওয়ার কাছে বিদঘুটে ও হীন আত্মসমপণ থেকে মুক্তি।‘ (প্রাভদা ৮ মার্চ, ১৯৯০)
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘পৃথিবীর সমস্ত পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, স্বাধীনতা—এই সব জাকালো কথার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষদের জন্য বিশেষ সুবিধা, মেয়েদের জন্য হীনতা ও লাঞ্ছনার সব আইন অনুসারে জড়িয়ে থাকা নারীদের প্রতি আসাম্যের অভূতপূর্ব রকমের পৈশাচিক, জঘন্য রকমের নোংরা, পাশবিক রকমের কদর্য সব বিধি।‘
সে মানুষ আরও বলেছিলেন– এই মিথ্যা ধ্বংস হোক। যতদিন পর্যন্ত নারী-জাতি নির্যাতিত, যতদিন পর্যন্ত অত্যাচারী শ্রেণী বর্তমান, যতদিন পুঁজি ও শেয়ারের ওপর থাকছে ব্যক্তিগত মালিকানা, আর যতদিন ভূরিভোজিরা বাড়তি শস্যের জোরে ক্ষুধার্তদের গোলামি খতে বেঁধে রাখছে, ততদিন পর্যন্ত যারা সকলের জন্য স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে, সেই মিথ্যাবাদিরা নিপাত যাক। চাই নিপীড়িত নারীজাতির স্বাধীনতা ও সমান অধিকার চাই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে পুঁজিপতির বিরুদ্ধে, চোরাবাজারী কুলাকের বিরুদ্ধে লড়াই।‘ (প্রাভদা ৬ নভেম্বর, ১৯৬৯)
পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, সে মানুষ বলেছিলেন–‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু গালভরা কথার, জমকালো বুলির, সাড়ম্বর প্রতিশ্রুতির আর স্বাধীনতা ও সাম্যের বড় বড় ধ্বনির গণতন্ত্র। কিন্তু কাজের বেলায় এই গণতন্ত্র মেয়েদের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্য, মেহনতী ও শোষিতের স্বাধীনতা-হীনতা ও অসাম্যকে আড়াল করে। ধ্বংস হোক এই জঘন্য মিথ্যা ! অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যে, শোষক ও শোষিতের মধ্যে কখনও সাম্য হতে পারে না, নেই, হবে না। যতক্ষণ না পুরুষের আইনগত বিশেষ সুবিধা থেকে মেয়েরা স্বাধীনতা পাচ্ছে, যতক্ষণ পুঁজির কবল থেকে শ্রমিকের, এবং পুঁজিপতি, জমিদার ও বণিকের জোয়াল থেকে মেহনতী কৃষকের স্বাধীনতা না থাকছে, ততক্ষণ প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না, নেই, হবে না।‘ (প্রাগুক্ত)
পৃথিবীর কিছু অসভ্য ও উন্মাদ মানুষ আজ সেই প্ৰণম্যকে পায়ের তলায় ফেলে নৃত্য করছে। প্রাচুর্য ও জৌলুসের মোহে অন্ধ উন্মাদের আজ সেই মহান মানুষের ভাস্কর্য ছড়ে ফেলে দিচ্ছে। গলায় দড়ি বেঁধে ওরা নামিয়ে ফেলছে সকল সন্মানিত স্মৃতি। ওরা ‘সমতাকে’ ছুঁড়ে নামাচ্ছে, ওরা ‘স্বাধীনতা’ নামাচ্ছে। ভুলুষ্ঠিত লেনিন, আপনি বলেছিলেন, ‘মেয়েদের সামাজিক জীবনের প্রত্যেকটি জাগরণ ও ক্রিয়াকলাপকে সাহায্য করা চাই যাতে তারা তাদের কুপমণ্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক, ঘরোয়া ও সাংসারিক মনস্তত্ত্বের সঙ্কীর্ণতা ছাড়িয়ে উঠতে পারে। ভলাদিমির ইলিচ লেনিন, আপনি বলেছিলেন–দিয়াবতী মাসিমার মত মিউমিউ করা চলবে না, কথা বলা চাই জোর গলায়, যোদ্ধাদের মত, কথা চলা চাই পরিষ্কার করে। দেখিয়ে দিন যে আপনারা লড়াই করতে পারেন।‘ (ডঃ ক্লারা সেৎকিনের ‘আমার স্মৃতিতে লেনিন’)
আমরা তো লড়াই করতে শিখছিলাম মহামতি লেনিন। যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘সাংসারিক বাঁদিগিরি’-তে ঠেলে দেয়, যে পুঁজিবাদ নারীকে ‘গণিকাবৃত্তি’-তে ঠেলে দেয়—আমরা সেই পুঁজিবাদের বিপক্ষে কথা বলছিলাম। ‘ঘরোয়া দাসত্ব’ থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিলাম, একই আদর্শ সামনে রেখে আমরা আপনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম— ‘মেয়েদের দাবিয়ে রাখছে, শ্বাসরুদ্ধ করছে, বিমূঢ় করছে, হীন করে রাখছে খুঁদে সাংসারিক গৃহস্থালি, বেঁধে রাখছে তাকে পাকশালায় তার শিশুপালন-ঘরে, অমানুষিক রকমের অনুৎপাদক, তুচ্ছ, পিত্তি-জ্বালানো, মন ভোতা করা, হাড়-গুড়ানো কাজে অপচয় হচ্ছে তার শ্রম।‘ আমরা এই শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাদের সব স্বপ্ন, সব সাধ সব স্বাধীনতার গলায় দড়ি বেঁধে হেঁচকা টানে টানছে উন্মাদ শাসকেরা আর তাদের অসংখ্য লোভাতুর অনুসারী।
একদা সমাজতন্ত্র নামে পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে একপ্রকার রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি ছিল। সমাজতন্ত্র এখন বিপর্যন্ত, বিকলাঙ্গ—এতে সভ্যতা ও মানবতার ক্ষতি কতটুকু হয়েছে, এতে তৃতীয় বিশ্বের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের আশঙ্কা কতটা ভয়াবহ হল, তা হিসেব করে দেখিনি; কেবল একথা স্পষ্ট জানি নারীর বড় ক্ষতি হল। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য কল্যাণকর একটি নীতি বা আদর্শের নির্মম মৃত্যু হল।
এখন ধুলোয় লুটোচ্ছে লেনিন, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। এখন চুড়ো থেকে খসিয়ে ফেলা হচ্ছে তার আপাদমস্তক। নারীকে পণ্য করবার বিরুদ্ধে, নারীর গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে, নারীর ক্ষুদ্র তুচ্ছ সাংসারিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ইতিহাসে যে কণ্ঠটি সবচেয়ে সোচ্চার ছিল সে লেনিনের কণ্ঠস্বর, যে হাতটি সবচেয়ে কর্মঠ ছিল, সে লেনিনের হাত। অপদার্থ মানুষেরা আজ সেই ইতিহাসকে দলিত করছে—এতে ক্ষতি কার কত জানি না,তবে নারীর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।
আমরা, নারীরা আজ পতিত লেনিনের জন্য, পতিত আদর্শের জন্য, পতিত সাম্যের জন্য শোকস্তব্ধ মাথা নত করছি।
৭০. ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
সভ্যতার শুরু থেকে সমাজ ও ধর্ম মানুষকে পরিচালিত করেছে, আর সমাজ ও ধর্মের পরিচালক হিসেবে যুগে যুগে পুরুষরাই কর্তৃত্ব করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তো বটেই, নারীকে সবচেয়ে বেশি অমর্যাদা করেছে ধর্ম। কোনও ধর্মের আশ্রয়ে নারীর ওপর অত্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন কিছুটা সহনীয় করে বিধিনিষেধ আরোপ করবার জন্য নতুন ধর্মের আহ্বান আসে। বৌদ্ধ ধর্মের শুরুতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবার তাগিদে লক্ষ লক্ষ নারী ভিক্ষুণী সংঘে আশ্রয় নিয়েছিল। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আগুস্ট বেবেল তার উওম্যান ইন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার গ্রন্থে লিখেছেন–খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব হলে অন্য সব দুর্ভাগাদের মত নারীরাও তাদের দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এই ধর্মের প্রতি খুব আগ্রহী ও অনুরক্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম নারীর জীবন থেকে দুর্দশা দূর করতে পারেনি। এই ধর্ম নারীকে পুরুষের বশবর্তী হয়ে থাকতে বাধ্য করল। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বলেছেন– ‘জেসাস ক্রাইস্ট নারীর অধিকার বলতে কিছু দেননি। দাসীবৃত্তি ছাড়া নারীর আর কোনও কাজই সমাজে ও ধর্মে নির্দেশিত হয়নি।‘
সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির অত্যাচারে বহু নারী ধর্মান্তরিত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম থেকে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ইসলাম ধর্মে শিশু হত্যা নিষিদ্ধ, স্ত্রীর মোহরানা, খোরপোষ বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেকেই এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু কোনও ধর্মই নারীকে মানুষের সন্মান দেয়নি।
বিজ্ঞানের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং ভ্রণের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেও আমরা মানুষের অস্থি থেকে মানুষের উৎপত্তি বিষয়ক বিশ্বাস নিমূল করতে পারি না। ধর্ম নারীকে বিনিময় পণ্য হিসেবে, দামি সামগ্ৰী হিসেবে, মূল্যবান দাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ধর্মগ্রন্থে লেখা—‘দুনিয়ার সব কিছু ভোগের সামগ্ৰী আর দুনিয়ার । সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।‘
মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বলে—কোনও পুরুষ যদি অনুমতি নিয়েও পনেরো বছরের কম বয়সের কোনও নারীর (সে স্ত্রীও হতে পারে) অথবা অনুমতি ছাড়া পনেরো বছরের বেশি বয়সের । কোনও নারীর অথবা অনুমতি ছাড়া নিজ স্ত্রীর যোনিমুখ তার যৌনাঙ্গ দ্বারা স্পর্শমাত্র করে, তবেই ধর্ষণ সংঘটিত হয় এবং ধর্ষণ আইনত একটি অপরাধ। কিন্তু তিরমিজি হাদিস শরীফে স্পষ্ট লেখা আছে ‘যদি কোনও ব্যক্তি সঙ্গম করার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তার নিকট উপস্থিত হয়—যদিও সে উনানের উপর (রন্ধনের কাজে লিপ্ত) থাকে।‘ এক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি কোনও বিচার্য বিষয় নয়। মুসলিম হাদিস শরীফে লেখা—‘যখন কোনও ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তার শয্যার দিকে আহ্বান করে, তাতে সে অস্বীকার করার জন্য যদি স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত কাটায় তবে প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রী লোকের প্রতি অভিসম্পাত করে।‘ নারী কত ঘৃণ্য হলে, কত নিকৃষ্ট হলে এই বাক্য উচ্চারিত হতে পারে যে, যে স্ত্রী লজ্জাহীনতার কাজ করে তাকে আপন বিছানা থেকে পৃথক করে দাও এবং এইরূপ স্ত্রীকে সাধারণভাবে কিছু মারপিট কর।’ (তিরমিজি)
ধর্ম নারীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধেছে, ধর্ম নারীকে পুরুষের ভোগের সামগ্ৰী ছাড়া মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি তাই ‘যদি স্বামী স্ত্রীকে আদেশ করে, তবে সে জরদ পর্বত থেকে কালো পর্বতের দিকে এবং কালো পর্বত থেকে সাদা পর্বতের দিকে ধাবিত হোক, তথাপি স্বামীর আদেশ প্রতিপালন করা তার কর্তব্য।‘ (আহমদ)
আমাদের দেশে নামাজ, রোজা, ধর্মোৎসব ইত্যাদি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়, কিন্তু ধর্মগ্রন্থ এবং নানা ধর্মীয় পুস্তক সম্পর্কে বিশদ কোনও আলোচনা হয় না। হওয়া উচিত। ধর্মচর্চা সঠিকভাবে হলেই দেশসুদ্ধ ধর্মব্যবসার প্রসার যেমন কমবে, তেমনি ধর্মীয় কুসংসারাচ্ছন্ন মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
নারী তো মানুষ নয়। ‘নারী শস্যক্ষেত্ৰ। তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমত সেই শস্যক্ষেত্রে চাষাবাদ কর।‘ সূরা বাকারার ২২৩ আয়াত থেকে এই অনুমতি পেয়ে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন–‘স্বামী স্ত্রী যদি উটের পিঠের উপর একই হাওদায় ভ্রমণ করতে থাকে আর সেই অবস্থায় যদি স্বামী তার সঙ্গে সঙ্গম করার ইচ্ছে প্রকাশ করে তাতেও স্ত্রীর কোনরূপ আপত্তি করা চলবে না। স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোজা রাখা স্ত্রীর পক্ষে জায়েজ নয় এবং স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়া বা কোনও জিনিস কাউকে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ এ নির্দেশ অমান্য করে তবে ফেরেশতাগণ তার প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করে।
নারী একটি মাংসপিণ্ড মাত্র, যে মাংসপিণ্ড নিয়ে পুরুষ খেলা করে, এবং তার খেলার আনন্দের জন্য মাংসপিণ্ডটিকে নানা রকম আকার ধারণ করতে হয়। নারী কতটা নিরেট মাংসপিণ্ড হলে হযরত আলী (রাঃ) বলতে পারেন যদি কোনও স্ত্রীলোক নিজের একটি স্তনের দ্বারা কাবাব ও অপর স্তনের দ্বারা কালিয়া প্রস্তুত করে স্বামীর সম্মুখে উপস্থিত করে, স্বামী যদি তাতেও তার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়, তবে সেই স্ত্রীলোক যতই পুণ্যবতী হোক না কেন, সে দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।’
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে রূপ কানোয়ারকে চিতার আগুনে নিক্ষেপ করে আমাদের পুরুষেরা সতীদাহের মজা লুটেছে। স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেস্ত জাতীয় তসবিহ জপে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র দ্বারা অত্যাচারিত নির্যাতিত নারীদের মনে রাখতে হয় ধর্মের পবিত্র বাণী—‘আমি যদি কোনও ব্যক্তির ওপর কারও জন্য সিজদা করার আদেশ প্রদান করতাম, তবে প্রত্যেক স্ত্রী লোককে আদেশ করতাম যে সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা স্ত্রী লোকদের উপর স্বামীর হক নির্ধারিত করে দিয়েছেন।‘ (আবু দাউদ)
সতেরো দশক থেকে পৃথিবীতে নারী আন্দোলনের শুরু। ইউরোপ আমেরিকায় সেই আন্দোলন কিছুটা সফল হলেও এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যে হারে নারী নির্যাতিত হচ্ছে তাতে পুরো সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া যেমন নারীর মুক্তি নেই, তেমনি ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়াও নারীর মুক্তি অসম্ভব।
৭১. বহুবিবাহ
আজ থেকে একশ বিশ-পঁচিশ বছর আগের কথা। এই উপমহাদেশের পুরুষ মানুষেরা সত্তর-আশিটি করে বিয়ে করত। শাস্ত্র তাদের এ ব্যাপারে কেবল ইন্ধনই জুগিয়েছে, সেই সঙ্গে বাহবা দিয়েছে সমাজ। কেবল একজন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আজকাল কোনও নারী যদি এমন রুখে দাঁড়ায়, তবে সকলেই এক বাক্যে তাকে পুরুষ-বিদ্বেষী আখ্যা দেবে—কিন্তু একশ একুশ-বাইশ বছর আগে যে মানুষ যাবতীয় শাস্ত্রীয় ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে ভীষণ এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, সৌভাগ্য যে তিনি একজন পুরুষ ছিলেন। তাই যত তাকে শাস্ত্রদ্রোহী, ধর্মদ্বেষী, নাস্তিক ও নরাধম বলে ডাকা হোক, ‘পুরুষ-বিদ্বেষী’ বলে কেউ ডাকেনি। যদিও তিনি বলেছিলেন, ‘স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সামাজিক নিয়মদোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাহারা পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালহরণ করিতেছেন। প্রভূতাপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন, তাহারা নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সর্ব প্রদেশেই স্ত্রী জাতির ঈদৃশী অবস্থা। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশে, পুরুষজাতির নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, অবিশৃশ্যকারিতা প্রভৃতি দোষের আতিশয্যবশত, স্ত্রীজাতির যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহ অন্যত্র কুত্ৰাপি লক্ষিত হয় না। অক্ৰত্য পুরুষজাতি, কতিপয় অতিগর্হিত প্রথার নিতান্ত বশবর্তী হইয়া, হতভাগা স্ত্রীজাতিকে অশেষবিধ যাতনা প্রদান করিয়া আসিতেছেন।‘
মূলত বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ ও ‘বহুবিবাহ’ প্রথাকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘অতিগর্হিত’, ‘অতিজঘন্য’ ও ‘অতিনৃশংস’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। হিন্দু ধর্মের সর্বত্র বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের পক্ষে নানারকম আদেশ ও উপদেশ বর্ণিত, যেমন, কাশ্যপ বলেছেন—যে কন্যা অবিবাহিত অবস্থায় পিতৃগৃহে রজঃস্বলা হয়, তাহার পিতা ভূণহত্যা পাপে লিপ্ত হন। সেই কন্যাকে বৃষলী বলে। যে জ্ঞানহীন ব্রাহ্মণ সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করে, সে অশ্রাদ্ধেয় (যাহাকে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্ৰণ করিয়া ভোজন করাইলে শ্রাদ্ধ পণ্ড হয়) ও অপাঙক্তেয় (যাহার সহিত এক পঙক্তিতে বসিয়া ভোজন করিতে নাই) ও বৃষলীপতি (উদ্ধাহতত্ত্ব)।
যমসংহিতায় এও বলা হয়েছে—কন্যাকে অবিবাহিত অবস্থায় রজঃস্বলা দেখিলে মাতা, পিতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এই তিনজন নরকগামী হয়। যে ব্রাহ্মণ, অজ্ঞানাদ্ধ হইয়া, সেই কন্যাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য (যাহার সহিত সম্ভাষণ করিলে পাতক জন্মে), অপাঙক্তেয় ও বৃষলীপতি।
জীমূতবাহন প্রণীত দায়ভাগ-এ আছে—‘স্তনপ্রকাশের পূর্বেই কন্যা দান করিবেক। যদি কন্যা বিবাহের পূর্বে ঋতুমতী হয়, দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে নরকগামী হয়, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ বিষ্ঠায় জন্মগ্রহণ করেন। অতএব ঋতুদর্শনের পূর্বেই কন্যা দান করিবেক।‘
যদিও অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋতুদর্শন ও ঋতুমতী কন্যার পাণিগ্রহণ, শাস্ত্র অনুসারে, ঘোরতর পাতকজনক, তবু, এ কথা সত্য যে, ঋতুদর্শনের আগে বিবাহ অর্থাৎ বাল্য-বিবাহ এখন আইনত নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ধর্ম দ্বারা মানুষ পরিচালিত নয়, ধর্মই মানুষ দ্বারা পরিচালিত। বহুবিবাহরোধের ক্ষেত্রেও নানা রকম আপত্তি উঠেছিল। যেমন অনেকে বলতেন বহুবিবাহ শাস্ত্রানুমত ও ধর্মানুগত ব্যাপার। এই প্রথা নিবারিত হলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধর্মলোপ ঘটবে। কুলীন ব্রাহ্মণদের জাতিপাত ও ভঙ্গ কুলীনদের সর্বনাশ হবে। এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করতে না পারলে তাদের কৌলিন্য মর্যাদার সমূলে উচ্ছেদ ঘটবে। কায়স্থজাতির আদ্যরসের ব্যাঘাত ঘটবে ইত্যাদি।
‘যে ব্যক্তি তিন বিবাহ করিয়া চতুর্থ বিবাহ না করে, সে সাত কুল পাতিত করে, তাহার ভূণহত্যা প্রায়শ্চিত্ত করা আবশ্যক’ (উদ্বাহতত্ত্ব) অথবা ‘ধর্মকর্মোপযোগী ব্যক্তিদের এক ভাৰ্য স্বীকার করা কর্তব্য, কিন্তু উপযাচিত হইয়া কেহ কন্যা প্রদানেচ্ছ হইলে অথবা রতিবিষয়ক সাতিশয় অনুরাগ থাকিলে তাহারা অনেক ভাৰ্যাও গ্রহণ করিবেন’–শাস্ত্রের এই প্রশ্রয় পেয়ে সমাজের প্রসিদ্ধ কুলীনেরা নিদ্বিধায় বহুবিবাহ প্রথার সযত্ন চর্চা করছিলেন। কিন্তু সকল নীতি ও নিয়মের, সকল বিধি ও বিধানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যেহেতু, এদেশের অনেকে শাস্ত্রের ব্যবস্থা উল্লম্বন করে চলেন না, তাদের যাবতীয় ব্যবহার শাস্ত্রীয় বিধি ও শাস্ত্রীয় নিষেধ অনুসারে নিয়মিত—তাই স্ববিরোধী শাস্ত্রের এ কথাগুলো বিদ্যাসাগর কৌশলে উল্লেখ করেছেন– যে পরিবারে স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখে, দেবতারা সেই পরিবারের প্রতি প্রসন্ন থাকেন। আর যে পরিবারের স্ত্রীলোকদিগের সমাদর নাই, তথায় যজ্ঞদানাদি সকল ক্রিয়া বিফল হয়, যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ না পায়, সে পরিবারের সতত সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয়। স্ত্রীলোক অনাদৃত হইয়া যে সমস্ত পরিবারকে অভিশাপ দেয়, সেই সকল পরিবার, অভিচারগ্রস্তের ন্যায়, সর্বপ্রকারে উৎসন্ন হয়। (মনুসংহিতা) এবং যদি প্রথম বিবাহিত স্ত্রী শ্রতিবিহিত ও স্মৃতিবিহিত অগ্নিসাধ্য ধর্মকার্য নির্বাহের উপযোগিনী ও পুত্রপৌত্ৰাদি সন্তানশালিনী হয়, তাহা হইলে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। অন্যতরের অভাবে অর্থাৎ ধর্মকার্য অথবা পুত্ৰলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধনের পূর্বে বিবাহ করিবেক। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র)
এছাড়া শাস্ত্রের নানা ফাঁকফোকর আবিষ্কার করে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধের ব্যাপারে উৎসাহী ও উদ্যোগী করেছিলেন বারানস, বর্ধমান, নবদ্বীপ প্রভৃতির রাজা, দেশের অন্যান্য ভূম্যধিকারিগণ ও বহুসংখ্যক সাধারণ মানুষকে। বিরুদ্ধাচরণ যাঁরা করেছিলেন তাঁরা মূলত ধর্মশাস্ত্র ব্যবসায়ী, তাঁরাই শাস্ত্রে অবমাননা ও ধর্মলোপের আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁরাই হিতকর কাজের প্রতিপক্ষ হয়ে সর্বাগ্রে দাঁড়িয়েছিলেন।
সে সময় বহুবিবাহ নিষেধক যে বিলটির খসড়া প্রস্তুত হয়েছিল, সেটি এরকম—‘Whereas the institution of marriage among Hindus has become subject to great abuses, which are alike repugnant to the principles of Hindu Law and the feelings of the people generally; and whereas the practice of unlimited polygamy has led to the perpetration of revolting crimes; and whereas it is expedient to make Legislative provision for the prevention of those abuse and Crimes, alike at variance with some policy, justice and morality; it is a enacted as follows—
No marriage, contracted by any male person of the Hindu religion, Who has a Wife alive…’
ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্য চারটি পর্যন্ত বিয়ে করবার নিয়ম প্রচলিত। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) চৌদ্দটি বিয়ে করেছিলেন। মহানবীর আদর্শ ইসলাম ধর্মমতাবলম্বীদের অনুপ্রাণিত করে।
কিন্তু যে অন্ধকার যুগে, যে বর্বরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ব্যভিচারের যুগে হযরত মুহম্মদ বহুবিবাহ ব্যবহারে বাধ্য হয়েছিলেন, তা উল্লেখ করে এ যুগের বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবিগণ বহুবিবাহ রোধকল্পে অনায়াসে উদ্যোগী হতে পারেন। মানবতার পক্ষে যে কোনও আইন তৈরি করতে প্রায় দেড়শ বছর আগে একদিন মানুষ এগিয়ে এসেছিল, আজ কেন এগোবে না? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন শাস্ত্রবিরোধী বিধবা-বিবাহের কথা বলেছিলেন–শাস্ত্রবিরোধী বহুবিবাহ রোধের পক্ষে অনেকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তখন বিপক্ষের শক্তি (শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, গঙ্গাধর রায়, কবিরাজ কবিরত্ন উল্লেখযোগ্য) প্রচণ্ড হলেও পক্ষের শক্তি নেহাত কম ছিল না।
এখন, এই একবিংশ শতাব্দীর দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা প্ৰণম্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে কেন এই বিলটি উত্থাপন করছি না, যে –No marriage, contracted by any male person of the Muslim religion, who has a wife alive। আমরা কেন আমাদের পক্ষের শক্তি একত্রিত করছি না বিদ্যাসাগরের মত, কেন আমরা কেবল স্মরণ করছি, দীক্ষা নিচ্ছি না? এ আমাদের ‘অতিজঘন্য’ চাতুর্য নয়?
ধর্মের যুগোপযুক্ত, বিজ্ঞানোপযোগী ব্যাখ্যা দাড় করাতে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার জাগোধ্যাত্মিক পণ্ডিতেরা নিরলস পরিশ্রম করছেন। এই পরিশ্রম একেবারেই নিরর্থক হবে, যদি না বহুবিবাহের মত একটি ঘৃণাকর, অনর্থকর ও অধর্মকর ব্যবহারকে উচ্ছেদ করা যায়। এবং আমরা বিদ্যাসাগরের কৃপায় স্ত্রী শিক্ষা প্রাপ্ত (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন এবং প্রসার করেছিলেন) নারীরা একটি ‘অতিগর্হিত’, ‘অতিজঘন্য’ ও ‘অতিনৃশংস’ একটি প্রথাকে (যে প্রথাকে বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন) বাঁচিয়ে রাখি, তবে আমরাই বা আমাদের ক্ষমা করব কোন যুক্তিতে?
বহু বিবাহ প্রথার নষ্ট শেকড় সমাজের রন্ধে রন্ধে বিস্তারিত, মুসলমান ধর্মাবলম্বী নারীরা পুরুষের নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, বিলাসিতা ও অবিমূশ্যকারিতার শিকার। ঘরে ঘরে বহু বিবাহের অনাচার ও উচ্ছঙ্খলতা নারীকে ‘ভোগ্যবস্তু হিসেবে নিরূপণ করছে এবং মানুষ’ হিসেবে নারীর মর্যাদা তিলার্ধও অবশিষ্ট রাখছে না। স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়ে করবার যে উদার আইনটি প্রচলিত, তা নেহাত আইনের নামে ফাজলামো ছাড়া কিছু নয়। যে পরিবারে পুরুষই সর্বময় কর্তা হিসেবে বিবেচিত, সেখানে পুরুষের কোনও ইচ্ছেকে ‘অনুমতি’ না দেবার ক্ষমতা বা কণ্ঠস্বর কোনও নারী অর্জন করে না।
এই সময় চলুন, আমরা আমাদের ব্যাপারে সচেতন হই, উচ্চকণ্ঠ হই, এবং এরকম সংগঠিত হই যে আমাদের সম্মিলিত প্রস্তাবকে রাষ্ট্র যদি আইনসিদ্ধ না করে তবে এই রাষ্ট্রকেও আমরা ছেড়ে কথা কইব না।
৭২. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
নারায়ণগঞ্জের ‘অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ বেশ একটা কাণ্ড করছে বটে। তারা পতিতাদের উচ্ছেদ চাইছে। ‘উচ্ছেদ’ অর্থ যদি উৎপাটন বুঝি, উন্মূলন বা বিনাশ বুঝি তবে আমিও মিছিলে নামব, আমি শ্লোগান দেব, আমিও অনৈসলামিক কার্যকলাপ কমিটির অন্যতম সদস্য হব। কিন্তু এই উচ্ছেদ অর্থ যদি স্থানচ্যুতি হয়, যদি এক স্থান থেকে একই রকম আরেক স্থানে নিতে হয় তবে আমি প্রতিরোধ কমিটির সকল কার্যকলাপ সবলে রোধ করতে চাই।
‘পতিতা’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা এবং ‘পতিত’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্ট, স্থলিত, অধোগত, পাপী ও কুচরিত্র। দেশে ‘পতিতা’র চেয়ে ‘পতিত’র সংখ্যা কম নয় বরং বহুগুণে বেশি। অথচ পতিতাদের চিহ্নিত করবার ব্যবস্থা আছে, যেমন নির্দিষ্ট একটি বাড়ির মধ্যে তাদের জড়ো করা হয়। আর পুরুষ পতিতরা থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তাদের পতিত হিসেবে চিহ্নিত করবার কোনও ব্যবস্থা নেই। গোয়ালের গরুর নামও গরু, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাঠ-ঘাটের গরুর নামও গরু। সুতরাং সমাজে বাস করে বলে এবং খাতায় নাম রেজিস্ট্রি হয়নি বলে ‘পতিত’রা যে ‘পতিত’ নয়, তা নয়; ‘পতিত’ পতিতই। আমরা কেবল তাদের পতিত বলে ডাকি না। কারণ ডাকবার চল নেই।
চল তো অনেক কিছুরই থাকে না। আগে তো মেয়েদের লেখাপড়া করবারই চল ছিল না, এখন চল হয়েছে। আচলেরও প্রচলিত হতে দেরি হয় না। দেশে লক্ষ লক্ষ পতিত রেখে পতিত শব্দটিই যোগ্য পুরুষের জন্য প্রচলিত হচ্ছে না, (যেমন পতিতা শব্দটি নারীর বেলায় প্রচলিত) এ কি কম দুঃখ! ‘পতিত’ কোথায় নেই? অফিসে, আদালতে, খবরের কাগজে, জাহাজে, লঞ্চে, কলে-কারখানায়—কোথায় নেই?
সর্বত্র বিরাজমান ‘পতিত’ পুরুষদের ‘পতিত’ বলবার রীতি শুরু হোক আজ থেকে। ‘পতিত’দের চিহ্নিতকরণ এসময় খুব জরুরী। কারণ ‘পতিত’রা নির্মুল না হলে ‘পতিত’ জন্মাবেই। মূলত ‘পতিত’র স্বার্থেই ‘পতিতা’র প্রয়োজন হয়।
‘পতিত’রা সমাজে ঘোরাফেরা করে। তারা তাদেরই স্বার্থে পতিতা পল্লীগুলো বাঁচিয়ে রাখে। আর দোষ হয় কেবল পতিতার, পতিত’র নয়। অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি পতিতা উচ্ছেদ চাইছেন, পতিতারা তা হতে দিচ্ছে না। সরকার যদি পতিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেন, তবে পতিতরা এই পতিতাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানেই কেবল সরাবে, স্থানান্তর ছাড়া কোনও উৎপাটন বা বিনাশ ঘটবে না। তাই উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। সরকার যদি পতিত না হন, উদ্যোগী হবেন। উদ্যোগী হবেন পতিতাদের সামাজিক পুনর্বাসনে। আর এই প্রতিরোধ কমিটিকে কেবল অনৈসলামিক নামেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। ‘অমানবিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ নামেও মিছিলে নামতে হবে।
সামাজিক পতিত-পুরুষেরা চিরকালই পতিতা উচ্ছেদ বা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার শিশু-পতিতা উদ্ধারের মহত্ত্ব দেখিয়েই উচ্ছেদ অভিযান স্তিমিত করে। কেউই পতিতা-প্রথার উৎপাটন, উন্মলন বা বিনাশ চায় না। নারায়ণগঞ্জে গাড়ি পুড়েছে, পুলিশ আহত, উচ্ছেদ কমিটির সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে—শেষ অবধি হবে কি? পতিতা প্রথার বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন কতদূর অগ্রসর হবে?
জানি, খবর বেরোবে—আন্দোলন থিতিয়ে আসছে। প্রতিরোধ কমিটি তাদের দাবি তুলে নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আপস করেছে। প্রশাসন যদি পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে পতিতাদের এবং কোনও প্রতিরোধ কমিটির কি শক্তি আছে ‘পতিতা’ নিমূলের?
কেউ কেউ যুক্তি দেখায়—পতিতাবৃত্তি না থাকলে সমাজে অনাচার বাড়বে, অপহরণ বাড়বে, ধর্ষণ বাড়বে। এগুলো হচ্ছে শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য মামদো ভূতের ভয় দেখাবার মত। পতিতা ব্যবস্থা আছে বলে কি দেশে সন্ত্রাস নেই? অবাধ ধর্ষণ নেই, অনাচার নেই, অপহরণ নেই?
মামদো ভূতের দেশে আমরা আর মামদো ভূতের ভয়ে কাতর হতে চাই না। সামাজিক নিগ্রহের শিকার ওইসব মেয়েদের–আমি ওদের পতিতা বলতে চাই না, কারণ পতিতা শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা—আমি এই শব্দগুলোর একটিকেও ওদের জন্য যোগ্য মনে করি না, আমি ওদের নারী বলতে চাই, এবং ‘মানুষ’ বলতে চাই। আমি ওদের জানাতে চাই আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা।
৭৩. ফুলের মত পবিত্র
‘ফুলের মত সুন্দর এবং পবিত্র’—এই উপমাটি প্রায়শই ব্যবহার হয়, ব্যবহার হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে। যে মেয়েটি ছেলেপিলের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, ছাদে ওঠে না, হাসে না, পোশাক-আশাকে পর্দানশিন, হাঁটাচলায় মন্থর, কণ্ঠস্বর অনুচ্চ, সাধারণত সেই মেয়েকেই ‘ফুলের মত পবিত্র’ বলে রায় দেওয়া হয়।
পবিত্রতার গাঢ় অর্থ নারীকে কোনও পুরুষের স্পর্শ না করা, বিশেষ করে পর-পুরুষ। ফুলের সঙ্গে কখনও কোনও পুরুষের উপমা হয় না, হয় নারীর। ফুল দেখতে বাহারি, সুগন্ধ ছড়ায়। নারীকে দেখতে নানা রঙের হতে হয়। গোলাপের পাপড়ির মত ঠোট, ভ্রমর কালো চোখ, গোলাপি গাল, ঘনকালো রেশমি চুল, দুধে আলতা অথবা কাচা হলুদ রঙের ত্বক, মুক্তোর মত সাদা দাঁত। মেয়েদের চুল ও ত্বক থেকে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ না বেরোলে মেয়েদের ঠিক মেয়ে বলে মানায় না। তাই প্রতিদিন ঘষে মেজে গায়ের দুর্গন্ধ দূর করবার জন্য সাবান তৈরি হচ্ছে, সেসব সাবানে কমনীয় রমণীরা সৌন্দর্য রক্ষার বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। নানা রকম সুগন্ধিতেও বাজার ছেয়ে গেছে। মানুষেরা ফুলের সুগন্ধ নেয়, এক্ষেত্রে ফুল যদি নারী হয়, মানুষ তবে পুরুষ। মানুষরূপী পুরুষেরা ফুলরাপী নারীর ঘ্রাণ গ্রহণ করে, নানা রঙে মুগ্ধ হয়। ফুলকে কেউ ছলে-ছিড়লে ফুল যেমন নেতিয়ে পড়ে বা মরে শুকিয়ে যায়, নারীকে তেমনি পুরুষ স্পর্শ করলে নারীর পবিত্রতা নেতিয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। নারীকে সুগন্ধি ফুল ভাবা হয় বলেই তাকে ভ্রাত বা অনাঘ্ৰাতা বিশেষণে চিহ্নিত করা হয়। অনাঘ্ৰাতা নারী অর্থ যে নারীর ঘ্রাণ কেউ নেয়নি। নারী যে কোনও সুগন্ধি উদ্ভিদ বা সুগন্ধি দ্রব্য—যা একই সঙ্গে বর্ণে ও গন্ধে মানুষ’-কে মুগ্ধ করে, মোহিত করে, তুষ্ট করে ও তৃপ্ত করে।
আজ অবধি কোনও পুরুষকে এরকম বর্ণ গন্ধযুক্ত উদ্ভিদের উপমায় অলস্কৃত করা হয়নি। আজ অবধি কোনও নারী চিত্রকর বা ভাস্কর পুরুষের শরীরকে নানা ঢংয়ে, রঙে ও রেখায় স্পষ্ট করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ চিত্রকর বা ভাস্কর নারী-শরীর নিয়ে। আজ অবধি কোনও নারী-কবি বা ঔপন্যাসিক পুরুষের শরীরের নানা প্রত্যঙ্গের লোভনীয় বর্ণনা করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ কবি বা ঔপন্যাসিক নারী-শরীর নিয়ে। এর কারণ পুরুষ-শরীরের প্রতি নারীর আকর্ষণ কিছু কম–তা কিন্তু নয়। এ হচ্ছে এক ধরনের লজ্জার অনুশীলন—যে লজ্জা নারীকে মোহনীয় করে তোলে বলে মনে করা হয়।
পুরুষের চুল, চোখ, বাহু, বুক, নিতম্ব দেখে নারীও মুগ্ধ হয়, যেরকম নারীর কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরুষের মুগ্ধতা ও কামের কারণ। কিন্তু নারীর মুগ্ধতার কোনও স্বচ্ছন্দ প্রকাশ নেই, না সমাজে, না সাহিত্যে। বিয়ে করতে গেলে ছেলে এবং ছেলের জ্ঞাতিগোষ্ঠী টিপে-টুপে পরখ করে মেয়ে নিয়ে আসে ঘরে। মেয়ের ত্বক, দাঁত, চুল, চোখ, আকার, আকৃতি, কোমর, নিতম্ব কিছুই পরখ করতে বাকি রাখা হয় না। কিন্তু ছেলেকে পরখ করবার নিয়ম নেই। অথচ ছেলের শরীর যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় কোনও মেয়ের কাছে—তা কিন্তু নয়। এও হচ্ছে সেই লজ্জার নিরলস চর্চা। মেয়েরা জন্মেই সবটুকু ‘মেয়ে’ হয় না, এইসব লাজ ও লজ্জার সফল চর্চার পর পূর্ণাঙ্গ ‘মেয়ে’ হয়ে ওঠে। পুরুষের লোমশ বাহু, কাল গভীর চোখ, ঘন ভ্রু, খাড়া নাক, ঘন কালো চুল, প্রশস্ত কাঁধ, মসৃণ পিঠ, লোমশ বুক—ইত্যাদির আকর্ষণ নারীর কাছে ঠিক তেমন—যেমন নারীর লম্বা কালো রেশমি চুল, আয়ত চোখ, খাড়া নাক, পাতলা ঠোট, উন্নত বুক, সরু কোমর ও ভারী নিতম্বের প্রতি আকর্ষণ পুরুষের। নারীও পুরুষের নিতম্ব ও উরুর প্রতি একই আকর্ষণ অনুভব করে, যে আকর্ষণ নারীর নিতম্ব ও উরুর প্রতি পুরুষের।
নারীর মোহ আছে, কিন্তু মোহের বর্ণনা নেই। পুরুষের অঙ্গ দেখে নারীর শিহরণ লাগছে—এই সত্য উচ্চারণ আমি কোনও নারীর মুখে শুনিনি। কিন্তু নারীর কোনও অঙ্গ দেখে বা ছয়ে পুরুষের কী ধরনের পুলক লাগে–তা এত ভাষায়, এত বিশদ বর্ণনায়, এত নিদ্বিধায় উচ্চারিত হয়েছে এতকাল যে নির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করবার দরকার হয় না।
আমি নারী চিত্রকরকে দেখি নারীর কামময় ছবি আঁকছে, আমি নারী ঔপন্যাসিককে দেখি নারীর রূপ বর্ণনায় অবিকল পুরুষের মতই সিদ্ধহস্ত। তবে পুরুষের রূপের বর্ণনা করবে কে? পুরুষের শরীর থেকে দুৰ্গন্ধ দূর করবার পরামর্শ দেবে কে? পুরুষের শরীরকে এমনই আকর্ষক দ্রব্যে তৈরি করা উচিত, যেন তারা রোজ সাবান মেখে শরীর পরিচ্ছন্ন রাখে, যেন নারী তাদের শরীরে কোনও ধুলো ময়লার অস্তিত্ব না দেখে। যেন তারা চুলের চাষে ও চর্চায় মনোনিবেশ করে, যেন তার ত্বককে সতেজ ও কোমল রাখে, উরুকে সুঠাম ও নিতম্বকে সুগঠিত রাখে, যেন তারা বুককে লোমশ ও প্রশস্ত রাখে, যেন তারা পা ও পায়ের গোড়ালিকে মসৃণ ও তাজা রাখে। পুরুষের শরীরকে পণ্য করে তুললে পুরুষের ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রিও বেশ জমজমাট হবে।
ক্রেতা কেবল চিরকাল এক পক্ষই কেন? ক্রেতা এবং বিক্রেতা তাদের পণ্য নিয়ে উল্টো দিকে বিক্রেতা ও ক্রেতাও বটে। তা না হলে এই বাণিজ্যের জগতে এক পক্ষেরই কেবল লাভ, ক্ষতি অন্য পক্ষের।
নারীর জন্য এখন চমৎকার চাহিদা হোক কামরাঙার মত পুরুষের ঠোঁট, মরিচ-চেরা কালো চোখ, করমচার মত জিভ, কাঠালের কোষের মত গায়ের রঙ, নাশপাতির মত দাঁত, মাচার লাউ-এর মত সুঠাম উরু, রজনীগন্ধার মত গায়ের ঘ্রাণ। নারীর চাহিদামাফিক পুরুষ এখন সর্বাঙ্গে উপযুক্ত হয়ে উঠুক। সম্পূর্ণ হয়ে উঠুক। নারীর শরীরের প্রতি তৃষ্ণ যদি পুরুষের জন্য বৈধ হয়ে থাকে—তবে কেন একইভাবে নারীর জন্যও বৈধ নয় পুরুষের সর্বাঙ্গ? কেন নারী উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে এই কথা–তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাদে প্রতি অঙ্গ মোর? পুরুষ তো এ কথা লিখতে লজ্জা করেনি।
ফুল ও ফলের সঙ্গে নারী অঙ্গের তুলনা চলে। ফুল ও ফলের আয়ু খুব অল্প, ঘ্ৰাণ নিলে, খেলে ফুল ও ফল দুটোই আবর্জনার ঝুড়িতে চলে যায়, একই রকম নারীও। নারীকেও খেয়েদেয়ে এঁটো-কাটার মতই ফেলে দেওয়া হয়। পুরুষকে কেউ শত খেলেও ছিবড়ে হয় না, কারণ সে ফুল বা ফল নয়, সে মানুষ। এক্ষেত্রে নারীও যে ফুল বা ফল নয়, সেও যে মানুষ তা বোঝাতে গেলে মানুষ নামের পুরুষকেও একই কাতারে নামিয়ে এনে তাকেও ফুল বা ফলের উপমায় দাঁড় করতে হবে, যেন প্রমাণ হয়—ফুল ও ফল যদি কারুকে বলা যায় তবে নারী ও পুরুষ দু’জনকেই বলা যায়। আর না হলে কারুকেই নয়।
৭৪. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
এ কথা আমি বিশ্বাস করি না যে রুদ্র নেই। রুদ্র মিঠেখালির চিংড়ি খামারে নেই, মোংলা বন্দরে নেই, রাজাবাজারে নেই, বিকেলে অসীম সাহার প্রেস, সন্ধ্যায় রামপুরার সঙ্গীত পরিষদ–কোথাও রুদ্র নেই। আমি বিশ্বাস করি না রুদ্র আর মঞ্চে উঠবে না, কবিতা পড়বে না। কাঁধে কালো ব্যাগ নিয়ে রুদ্র আর হাঁটবে না, রুদ্র আর কথা বলবে না, হাসবে না, কবিতা পরিষদ–সাংস্কৃতিক জোট নিয়ে ভাববে না, নতুন কোনো সংগঠন গড়বে না। এ আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র নেই, একুশের মেলায় নেই, চায়ের স্টলের আড্ডায় নেই, বাকুশায় নেই, সাকুরায় নেই।
রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে–সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে–সে রুদ্র। করতলে আঙুলের স্পর্শ রেখে রুদ্র আমাকে প্রথম বলেছে–ভালোবাসি। বলেছে–আমরা জ্বলাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘষে অপরূপ হৃদয়ের আলো।
রুদ্র আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। যে আমি কেবল নদীই দেখেছি, সেই আমাকে উথল সমুদ্র যেমন দেখিয়েছে, ঘোলা জলাশয়ও কিছু কম দেখায়নি। রদ্র আমাকে পূর্ণিমা দেখিয়েছে জানি, অমাবস্যাও কিছু কম নয়। রুদ্রর হাত ধরে আমি খোলা মাঠে হাওয়ায় হাওয়ায় নেচেছি, গহন অরণ্যে হেঁটেছি আর আঠারো, উনিশ, বিশ, একুশ করে বয়স পেরিয়েছি।
আমি এক অমল তরুণী, রুদ্রর উদোম উদগ্র জীবনে এসে স্তম্ভিত দাঁড়িয়েছিলাম। যে কবিকে আমি নিখাদ ভালোবাসি, যে প্রাণবান যুবককে ভালোবেসে আমি সমাজ সংসার তুচ্ছ করেছি, হৃদয়ের দুকূল ছাওয়া স্বপ্ন নিয়ে যাকে প্রথম স্পর্শ করেছি–তাকে আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে শেষ অব্দি ফেরাতে পারিনি; নিরন্তর স্খলন থেকে, স্বেচ্ছাচার থেকে, অবাধ অসুখ থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারিনি। তার প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল আমার, প্রচন্ড ক্ষোভও ছিল তাই। আর রুদ্র সেই মানুষ, সেই প্রখর প্রশস্ত মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার আবেগ এবং উষ্মা, আমার ভালোবাসা এবং ঘৃণা ধারণ করবার ক্ষমতা রেখেছে। রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকেও। রদ্র সেই মানুষ, রুদ্রই সেই মানুষ, যে কোনো দূরত্ব থেকে তাকে ভালোবাসা যায়।
যৌথ জীবন আমরা যাপন করতে পারিনি, কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রর সামান্য স্খলন আমি একদিন মেনে নেইনি, রুদ্রর দু’-চারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপোস করিনি–পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন ছেনে, জীবন ঘেটে আমি দেখেছি রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রর ঔদার্য, রুদ্রর প্রাণময়তা, রুদ্রর অকৃত্রিমতার সামনে যে কারুকে দাঁড় করানো যায় না।
রুদ্রর পায়ের আঙুলে একবার বার্জার্স ডিজিজ হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন পা’টাকে বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। পা এবং সিগারেটের যে কোনো একটিকে ডাক্তার বেছে নিতে বলেছিলেন। রুদ্র সিগারেট বেছে নিয়েছিল। জীবন নিয়ে রুদ্র যতই হেলাফেলা করুক, কবিতা নিয়ে করেনি, কবিতায় সে সুস্থ ছিল, নিষ্ঠ ছিল, স্বপ্নময় ছিল। পাকস্থলীতে ক্ষত নিয়েও সে খাওয়ায় অনিয়ম করতো। কোনো অসুখই রুদ্রকে বশে রাখতে পারেনি, রুদ্র উড়েছে, ঘুরেছে, নেশায় মেতেছে। এই বয়সে রক্তচাপ সাধারণত বাড়ে না, রদ্রর বেড়েছে, তবু সবচেয়ে বিস্ময় এই যে, কোনো রোগই রুদ্রকে রুগ্ন করেনি, রুদ্র সকল অসুস্থতা আড়াল করে অমলিন হেসেছে।
কাগজে এখন লেখালেখি হচ্ছে রুদ্র সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রুদ্রর ভূমিকা এক ছিল সেই ছিল, রুদ্র আপসহীন ছিল, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। হ্যাঁ ছিল, রুদ্র কত কিছুই ছিল। রুদ্রর কবিতা শুনলে লোকে হাততালি দেয়, অগ্রজ কবিরা বাহবা দেয়, কিন্তু কেউ খবর নেয়নি__এই ঢাকা শহরে রুদ্রর অর্থ উপার্জনের কোনো পথ ছিল না, কোনো কাজ জোটেনি রুদ্রর, পত্রিকা অফিসগুলোয় কিছু একটা কাজের জন্য রুদ্র ঘুরেছে, কেউ তাকে কাজ দেয়নি। চিত্রনাট্য লিখতে দেবে বলে এ শহরের এক বিত্তবান কবি রুদ্রকে আশা দিয়েছিল, সেও প্রতারণা করেছে। জীবিকার তাড়ায় রুদ্রকে ঢাকার বাইরে যেতে হতো, রুদ্রর এই অনুপস্থিতির সুযোগে কবিতা পরিষদে থেকে, জোট থেকে রুদ্রকে ওরা প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেদিনও কবিতা পরিষদের তলবি সভা ডাকতে সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে রুদ্র অনুরোধ করেছে, কেউ তার আহবানে সাড়া দেয়নি। চারদিকে সকলেই ব্যস্ত, কেবল রুদ্রই ছিল পৃথক একটি মানুষ, তারই ছিল কেবল না ফুরনো দীর্ঘ অবসর। শিল্পের, সাহিত্যের অনেকে ইচ্ছে করলেই পারতো রুদ্রকে কোনো একটা কাজ দিতে, দেয়নি, এই প্রচন্ড ব্যক্তিত্বশালী যুবকটি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নম্র হয়েছে, কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয়নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বাঁপাশে রুদ্রকে একটি চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।
রুদ্র তার কাব্যসমগ্র বের করবার জন্য গত দু মাস বড় ব্যাকুল ছিল। শুনে আমি বারবার বলেছি–সমগ্র তো মরবার পর বের হয়। তুমি শ্রেষ্ঠ করো, নির্বাচিত করো, রাজনৈতিক কবিতা করো। না, রুদ্রর ঐ এক জেদ, সে সমগ্র করবে। হ্যাঁ, রুদ্র সত্তর দশকের শ্রেষ্ঠ কবি, তার কবিতা মঞ্চে, ক্যাসেটে চমৎকার আবৃত্তি হয়, কিন্তু এ অব্দি রুদ্র তার কোনো বইয়ের সুষ্ঠু পরিবেশনা দেখেনি এবং কোনো রয়ালটিও পায়নি। আমাকে বলেছিল, তুমি বিদ্যাপ্রকাশ’কে একবার বলো। আমি বলেছিলাম। রুদ্র একদিন সেই প্রকাশককে নিমন্ত্রণও করলো। খাওয়া-দাওয়া হাসি আড্ডা শেষে রুদ্র বিনীত প্রস্তাব করলো কাব্যসমগ্র প্রকাশের, কাগজ কলমে হিসেব নিকেশ করে এও বুঝিয়ে দিল যে প্রকাশকের অর্থনাশ হবে না। প্রকাশক তবু মৌন ছিলেন। আমি জানি, এই অভিমানী কবিটি, যে কোথাও কোনো সহযোগিতা পায়নি সে ভেতরে ভেতরে তখন কি চূর্ণ হয়েছিল। রুদ্র কি তার তীব্র ইচ্ছেকে পূর্ণতা দেবার জন্যই মরে গেল? মরে গিয়ে তাবৎ পুস্তক প্রকাশককে ‘সমগ্র’ করবার সুযোগ করে দিল?
অসীমদার কাছে রুদ্রর অসুখের খবর পেয়ে আমি হলিফ্যামিলির দুশ’ একত্রিশ নম্বর কেবিনে রুদ্রকে দেখতে গিয়েছি। অসুখ তেমন নয়, শতকরা তিরিশজন যে অসুখে ভোগে, পাকস্থলীতে না খাওয়ার ক্ষত। রুদ্রর খুব নিকটে বসে আমি বলেছি, রুদ্রর চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমি ব্লেছি–ভেবো না, তুমি খুব শিগগির সেরে উঠবে। শুনে রুদ্র বলেছে–কি জানি এ যাত্রাই শেষ যাত্রা কিনা। আমি হেসেছিলাম। আমি তখনো হেসেছিলাম যখন একুশে জুন সকালে ক্যারোলিন রাইট আমাকে টেলিফোনে বললো, কে একজন তাকে জানিয়েছে যে রুদ্র মারা গেছে। ক্যারোলিনকে আমি খুব স্পষ্ট করে বলেছি–ক্যারোলিন, যে তোমাকে বলেছে ভুল বলেছে, রুদ্রর অসুখ মরে যাবার অসুখ নয়। আমি তাকে সেদিন মাত্র দেখে এলাম। তবু টেলিফোন রেখে হলিফ্যামিলিতে তক্ষুণি গিয়েছি, দু’শ একত্রিশ খালি, রোগী গত রাতে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে। ঘরে ফিরে যাওয়া সুস্থ মানুষটিকে দেখতে গিয়ে দেখি ঘর ভর্তি মানুষ, লেবানের ঘ্রাণ, রুদ্র চোখ বুজে শুয়ে আছে, রুদ্রর সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। আমি দূর থেকে দেখলাম আমার সেই সতেরো বছর বয়স থেকে বড় গভীর করে চেনা তার চুল, চোখ, চোখের ভুরু, তার ঠোঁট, চিবুক, চিবুকের গাঢ় ভাঁজ। আমার এই এত চেনা মানুষটিকে, সকলের এত চেনা কবিটিকে কেউ আর ‘রুদ্র’ নামে ডাকছিল না, সকলেই তাকে ‘লাশ’ বলে ডাকছিল। লাশ ওঠাও, লাশ নামাও।
সকল অসুখ অতিক্রম করে এসে রুদ্র তার নিভৃত রক্তচাপ–যে রক্তচাপ তার হৃদপিন্ডে আঘাত হানবার জন্য ক্রমশ বেগবান হচ্ছিল, তাকে শেষ অব্দি ঠেকাতে পারেনি। তবু এ একেবারেই অবিশ্বাস্য যে কামাল, নিশাত, জাফর, ইকতিয়ার, আজগর, শামীম, সালাউদ্দিন, রেজা সকলেই থাকবে–কেবল রুদ্র থাকবে না। প্রতি বছর জাতীয় কবিতা উৎসব হবে, রুদ্র থাকবে না, একুশের মেলা হবে–ধুম আড্ডা হবে–রুদ্র থাকবে না। এ কি আশ্চর্য নয় যে রুদ্র আর শাহবাগে আসবে না, ‘ইত্যাদি’তে না, রামপুরায় না! রুদ্র নিশ্চয়ই আসবে, হঠাৎ একদিন ফিরে আসবে। টি.এস.সি-তে দাঁড়িয়ে চা খাবে, লাইব্রেরির মাঠে বসে আড্ডা দেবে, বিকেলে অসীমদার প্রেসে সকলকে অবাক করে দিয়ে রুদ্র বলবে, বাড়ি গিয়েছিলাম, এই এলাম। রুদ্র তবু ফিরে আসুক। এক বছর, দু’ বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর পর হলেও রুদ্র ফিরে আসুক। রুদ্র তার অসুস্থতার মত মৃত্যকেও অতিক্রম করে সত্যিকার ফিরে আসুক। কাঁধে কালো ব্যাগ, রুদ্র হেঁটে যাক মঞ্চের দিকে, সম্মিলিত মানুষের দিকে, কবিদের তুমুল আড্ডায় রুদ্র তার তাবৎ মৃত্যকে আড়াল করে দুর্বিনীত হেসে উঠুক।
৭৫. দাসী ছহবত
সমাজের এক বিশিষ্ট ভদ্রলোকের কথা বলছি। ভদ্রলোক ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ইহকাল এবং পরকাল বিষয়ে সামান্যও অতৃপ্ত নন। তিনি সকালবেলা নাস্তা করে অফিসে যান, এক টেবিলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুপুরের খাবার খান, বিকেলে মাঝে মধ্যে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি বেড়াতেও যান, ভদ্রলোক তাঁর অতীত ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন নন।
ইদানীং এই ভদ্রলোকের একটি অঘটন ঘটে। অঘটনটি প্রথম ঘটে আসরের নামাজ প্রায় শেষ হবে হবে, তখন। ভদ্রলোক জায়নামাযে বসে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতউল্লাহ’ বলে যে-ই ঘাড় ফিরেয়েছেন ডানদিকে, তখনই চোখে পড়ে একলা জরিনা—পনেরো বছরের সরল কিশোরী, বাড়ির কাজকর্ম করে, বিকেলে বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে খানিক জিরোচ্ছে। ভদ্রলোকের চোখ ও ঘাড় ডানদিকেই পড়ে থাকে, বায়ে তো ফেরেই না, মোনাজাতও শেষ হয় না ।
এরপর বাড়ির সকলকে আড়াল করে ভদ্রলোক জরিনাকে দেখেন, দেখেন আর তার শরীরের আগুনে কে যেন লোভের পেট্রল ঢেলে দেয়। ভদ্রলোক তার অদম্য ইচ্ছেকে দিনের পর দিন শাসন করে চলেন। ঘরে সুন্দরী শিক্ষিত বউ, তবু তার মন পড়ে থাকে সারাদিনের ঘাম ও ক্লান্তিমাখা দুৰ্গন্ধ শরীরে। মন তাঁর শাসন মানে না।
একদিন তাঁর দুর্দমনীয় ইচ্ছের বিস্ফোরণ এভাবেই ঘটে যে, সেদিন, ভর দুপুরবেলা, বাড়ির সকলে যার যার প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে, আর সময়ের কিছু আগেই ভদ্রলোক বাড়ি ফেরেন, বাড়ি জুড়ে একটি কেবল প্রাণী—জরিনা। ভদ্রলোক প্রথমেই জরিনার হাতে একশ’ টাকা গুজে দেন এবং বলেন কেউ যেন না জানে। ভদ্রলোকের শরীরের ভেতর একটি সাপ কেবল গোঙরায়।
অঘটন তো একরকম আগুনই, ছাই চেপে একে রাখা যায় না। একদিন জানাজানি হয়ে যায়। বউ কাঁদে, ছেলেমেয়ে কাঁদে। পাড়াপড়শি সকাল বিকেল ভিড় করে। ভদ্রলোক এই ভিন্ন স্বাদের আকর্ষণে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, তিনি জরিনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কঠোর হাতে দমন করেন।
একসময় আত্মীয়স্বজন আসেন, গুরুজন আসেন। বৈঠক ঘরে সকলে মিলে শলা-পরামর্শ হয়। শেষ অবধি সিদ্ধান্ত হয়—এ তো একেবারে জাত যাওয়ার কাণ্ড কিছু নয়, হাজার হলেও পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষের নানা রকম সাধ আহ্লাদ থাকতেই পারে। বাইরে এত খাটাখাটি করে এসে ঘরে যদি নীতির বাইরে দু-একটা ঘটনা তারা ঘটানও, এমন কোনও অন্যায় তাতে নেই। আর নীতির বাইরেই বা বলি কেন, পবিত্র কোরানেই তো দাসী-বাদীকে ভোগ করবার কথা লেখা আছে।
শেষে এমনই সাব্যস্ত হয় যে, যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে এতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করিতে পারবে না, তবে বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাহাকে তোমাদের ভাল লাগে; দুই, তিন অথবা চার, আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করিতে পারবে না তবে একজনকে এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে (সূরা নিসা ও আয়াত ১ রুকূ) এবং নারীর মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত সকল সধবা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের জন্য ইহা আল্লাহর বিধান। (সূরা নিসা ২৪ আয়াত ৫ রুকু)
অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে দাসী নিষিদ্ধ নয়। সূরা আহযাবের ৫২ আয়াতে লেখা ‘তোমার জন্য কোনও নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদিগের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদিগের সৌন্দর্য তোমাকে বিস্মিত করে, তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে।‘
‘এবং যাহারা নিজদিগের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। তাহাদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ক্ষেত্র ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না।‘ (সূরা মাআরিজ আয়াত ২৯/৩০ রুকু ১)
অর্থাৎ দাসী বৈধ। দাসীকে ভোগ করায় কোনও পাপ নেই। যুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদের ঘরবাড়ি-অর্থ-শস্য-অশ্ব-নারী বিজেতার দখলে আসে এবং সকলই তাদের ভোগের জন্য বৈধ। শুধু তাই নয় আল্লাহতায়ালা এও বলেছেন ‘আমি তোমার জন্য বৈধ করিয়াছি তোমার স্ত্রীগণকে, যাহাদিগের মাহর তুমি প্রদান করিয়াছ এবং বৈধ করিয়াছি ‘ফায়’ (যে সম্পদ যুদ্ধ ব্যতীত হস্তগত হয়) হিসেবে আল্লাহ তোমাকে যাহা দান করিয়াছেন তন্মধ্যে হইতে যাহারা তোমার মালিকানাধীন হইয়াছে, তাহাদিগকে।‘ (সূরা আহ্যাঁব আয়াত ৫০ রুকু ৬)
এই যদি হয় আইন তবে সে আইনে পুরুষের জন্য ক্রীতদাসী বা ভাড়াটে দাসী কোনও দিক থেকে অসঙ্গত বা অবৈধ নয়।
ভদ্রলোক সমাজের উঁচুমাথাদের সায় পেয়েছেন। তাই এ ব্যাপারেও তাঁর কোনও অতৃপ্তি নেই। এখনও তিনি সকালবেলা নাস্ত করে অফিসে যান, এক টেবিলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দুপুরের খাবারও খান, বিকেলে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বন্ধুর বাড়ি সকলই সারা হয়। এবং ইচ্ছে হলে জরিনা হোক ফাতেমা হোক, আয়শা কিংবা সেলিনা হোক সকলকেই তার নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। ভদ্রলোক তার এই বর্তমান নিয়ে সামান্যও উদ্বিগ্ন নন।
ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রতিবাদ করতে চান, ক্ষোভে কষ্টে তিনি কাঁদেন। কিন্তু তাতে কী? একসময় তার নিজেকেই সান্তুনা দিতে হয় এভাবে যে কোরানের কথা তো অমান্য করা যায় না। পুরুষমানুষকে আল্লাহ যে সুবিধা দিয়েছেন সেই সুবিধা তারা নেবেন না কেন, আর সুবিধা তো দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহই।
৭৬. মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। গা হাত পা ঢিলে করে ঘুমের মত পড়ে ছিলাম বিছানায়। একটি টর্চের আলো আমার মুখের ওপর পড়ল প্রথম, আলো ও মুখের ওপর রেখেই ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলল—কী কথা বলল আমি বুঝতে পারিনি, ওদের ভাষা ছিল উর্দু।
আমি তখন জানি না ওরা বাড়ির সদর দরজার কাছে একটি নারকেল গাছের সঙ্গে আমার বাবাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। আমি তখনও জানি না আমার মা বাড়ির উঠোন পেরিয়ে চলে গেছেন অন্য আশ্রয়ে। ওরা এসেছে এই দুঃসংবাদ আমার কাছে আগে পৌঁছেনি। আমি কেবল বারান্দা ধরে হেঁটে আসা চার জোড়া বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এবং ভিন্ন ভাষার কথোপকথন আমাকে—যদিও আমার বয়স অল্প, এইটুকু বুঝিয়ে দিল—ভীষণ এক দুর্ঘটনা ঘটছে আজ। আজ আমাদের বড় দুঃসময়। আমার বয়স অল্প বলেই আমাকে উঠোনের অন্ধকার পেরিয়ে পাড়া-পড়শির ঘরে উঠতে হয়নি। অচেতন পড়ে থাকতে হয়েছে দক্ষিণের ঘরের একটি পুরনো পালঙ্কে। বুটের শব্দ এক সময় আমার ঘরে এসে থামল। পাশে আমার ছোট বোন ঘুমোচ্ছিল। শব্দগুলো ঘরের মধ্যে পুরো চক্কর দিয়ে আমার শিয়রের কাছে এল। আমি সেই প্রথম অভিনয় করলাম ঘুমের, যেন ঘুমিয়ে আছি, আমি কিছু শুনছি না, আমি কিছু দেখছি না, আপনারা যা ইচ্ছে তাই করুন, ঘুমের মানুষকে জাগাবেন না। ওরা আমার মুখে টর্চ ফেলল, আলো পড়লে চোখ কেঁপে ওঠে, আমার কেপেছিল কি না জানি না।
ওরা আলোর নিচে কী দেখছিল—আমার বয়স? বয়স পছন্দ হয়নি বলে ওরা ঘুরিয়ে নিল আলো, পাশের বিছানায় ছিল রেহেলে রাখা খোলা কোরান শরীফ, কোরান শরীফের ওপর মা’র হাতের দুটো অনন্ত বালা। ওরা মা’র অনন্ত বালা নিল, ঘরের আলমারি খুলে আমাদের সোনা রুপা যা পেল, নিল। ওরা কথা বলছিল, হাসছিল, আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় ওরা আমার বয়সের জন্য নিশ্চয় দুঃখ করছিল। বয়স কেন আমার আরও খানিকটা বেশি হল না!
আমি স্থবির পড়ে ছিলাম বিছানায়। ওদের ক্রুর হাসি, ওদের বিদঘুটে ভাষা, ওদের ভয়ঙ্কর বুট আমাকে আশ্চর্য স্থবিরতা দিয়েছিল, আমি এখনও শীতল এক সাপ দেখি আমার শরীর বেয়ে উঠছে। আমার যদি আরও খানিকটা বয়স বেশি হত ! ওই একটি অন্ধকার ঘরে, ওই একটি ভয়ার্ত শ্বাস স্তব্ধ করা রাতে আমার যদি বয়স হত পনেরো ষোল সতেরো আঠারো উনিশ ।
ওরকম বয়স ছিল না-কি কারও? ছিল। ওরকম বয়সের কারও বাড়িতে মধ্যরাতে অতর্কিতে আক্রমণ কি হয়নি? তা-ও হয়েছে। তুলে নিয়ে গেছে ওরা অগণন তরুণীকে। ওদের বিকৃত লালসার শিকার আমার খালা, আমার পড়শি বোন, আমার চেনা, অল্পচেনা, অচেনা আত্মীয় অনাত্মীয়। এ কথা নতুন নয়। সকলেই জানে। জানে একাত্তরে এদেশের নারীর উপর পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের অবাধ ধর্ষণের খবর। জানে, কেবল জানেই, আর কিছু নয়।
এত বড় একটি যুদ্ধ ঘটে গেল দেশে। এত হত্যা, গণহত্যা, এত লুঠ, ধর্ষণ ঘটল—তবু ধর্ষণের সংজ্ঞা বদলাল না। একটি ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ যখন নিঃস্ব, পঙ্গু, সর্বস্বাস্ত, স্বজন হারানোর বেদনায় নীল—সেই মানুষই তখন ধর্ষিতার দিকে পুরনো চোখে তাকাল, পুরনো আঙুলই তুলল। হায়, মুখ বাঙালি! হায় দুর্ভাগা, দুশ্চরিত্র, দুর্গত বাঙালি!
যে দেশে এমন এক মুক্তিযুদ্ধ ঘটে, যে মুক্তিযুদ্ধে এমন অবাধ নরহত্যা হয়, অবাধ নারী-ধর্ষণ হয়—সে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা কেন নতুন কিছু হয় না? সে দেশে ধর্ষণ কেন বুট ও বেয়নেটের অত্যাচারের মত এক ধরনের অত্যাচার বলে বিবেচিত হয় না? কেন ধর্ষিতাদের জন্য সামাজিক স্বীকৃতির অভাব হয়? কেন ধর্ষণ গ্রহণীয় হয় না আর দশটা অত্যাচার যেমন সমাজে গ্রহণীয়?
মুক্তিযুদ্ধ যদি আমাদের নতুন একটি বোধের জন্ম না দিতে পারে, তবে কী পেরেছে দিতে—যা নিয়ে আমরা বিজয় দিবসের উৎসব করি, স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে আলোকসজ্জায় মেতে উঠি, চেতনার ভেতরে গাঢ় এক অন্ধকার রেখে এই আলোকসজ্জা আমাদের সামান্যও কি আলোকিত করে?
একটি যুদ্ধই পারে যুদ্ধের সকল ক্ষতি মেনে নেবার সাহস ও শক্তি জোগাতে। একটি যুদ্ধই পারে যুদ্ধের সকল ভাঙন জয় করে জয়ের পতাকা ওড়াতে। আমরা পতাকা উড়িয়েছি ঠিকই, আমরা দেশ থেকে উটকে বর্বরদের দূর করেছি ঠিকই কিন্তু সমাজের নষ্ট ও নোংরা সংস্কার দূর করতে পারিনি—যে সংস্কার একাত্তরের কোনও অত্যাচারিত তরুণীকে ক্ষমা করেনি এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর পর এখনও তাদের ক্ষমা করবার ক্ষমতা অর্জন করেনি।
আবার একটি মুক্তিযুদ্ধের অপেক্ষা করতে হবে—আবার অপেক্ষা করতে হবে দেশজোড়া তুমুল তাণ্ডবের–আবার আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অগণন মৃত্যুর। আর কত মৃত্যু, কত ভাঙন, কত ধর্ষণ এদেশে ঘটলে ধর্ষিতারা মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে সমাজের কাঠগড়ায় এবং ঘৃণায় উচ্চারণ করতে পারবে অসভ্য পুরুষের নাম! এক যুদ্ধে আমরা মন ও মানসিকতার উত্তরণ ঘটাতে পারিনি, এক যুদ্ধে আমরা অর্জন করতে পারিনি সত্য ও সুন্দরের পক্ষে যাবার সামান্যও দুঃসাহস। আর কত যুদ্ধের দরকার এদেশে? আর কত মৃত্যুর?
বছর ঘুরে এদেশে বিজয়ের উৎসব হয়। আনন্দে নেচে ওঠে পুরো দেশ, দুঃসহ দুঃশাসনে ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের এক হতভাগ্য দেশ। ডিসেম্বরের ষোল তারিখের প্রতিটি শীতার্ত সকালে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি নগরীর উৎসব দেখি আর আমার সারা শরীরে হেঁটে যায় শীতল একটি সাপ। চোখ বুজলেই টের পাই শরীরে টর্চের আলো। ওরা আমার বয়স মাপছে। নগরীর এই অশ্লীল উৎসবের প্রতি ঘৃণায় আমার দুচোখ ফেটে কান্না নামে। কে আছে আমার এবং আমার মত অগণন নারীর কান্না থামায়? আছে কোনও আইন এবং সংস্কার এদেশে? মুক্তিযুদ্ধ অনেককে অনেক কিছু দিয়েছে, নারীকে দিয়েছে কী?
৭৭. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ
১. এদেশের এক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সম্প্রতি পুত্রসন্তানের জনক হয়েছেন। তাঁর তিন কন্যা বর্তমান। তিন কন্যার কেউ অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়, মস্তিষ্কের কোনও বিকৃতিও কারও নেই। সকলেই সুস্থ, সুন্দর, সকলেই স্বাস্থ্যবান, সকলেই প্রখর মেধায় দীপ্যমান। তবু প্রয়োজন হয় কেন আরও এক সন্তানের? আসলে এ কোনও সন্তানের প্রয়োজন নয়, এই প্রয়োজন পুত্রের। প্রথিতযশা সাহিত্যিক, যাঁকে মানুষ আদর্শ মানে, যাঁর জীবনাচারণ মানুষ অনুসরণ করে, তাঁর এমন পুত্রপিপাসু, চরিত্র মানুষকে আর যা-ই দিক সততা বা মহত্ত্বের তিলমাত্র দেবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
শুনেছি পুত্রের লালসা তাঁকে শাহজালালের মাজার অবধি নিয়েছে। মাথায় টুপি পরে আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সাহিত্যিক মাজারে দাঁড়িয়ে হযরত শাহজালালের কাছে পুত্রের প্রার্থনা করেছেন। অবশেষে নানা তাবিজ, কবজ, দোয়া কালাম, মাজার জিয়ারত-এর পর একটি পুত্র-জন্ম তাঁর পিতৃত্বকে মজবুত করেছে এবং একই সঙ্গে তাঁর পুরুষ-জন্ম সার্থক করেছে।
কী শেখেছে তাঁর অগুণতি পাঠক এবং তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারী? শিখেছে এই যে, তিন কন্যা যথেষ্ট নয়, একটি পুত্রই সন্তান হিসেবে সম্পূর্ণ এবং একটি পুত্র জন্মানোর আগে উৎপাদন বন্ধ করা অনুচিত। শিখেছে শরীরে ও মনে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠলেও নারীর পঙ্গুত্ব কাটে না। তাই লিখতে গেলে বড় বড় নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ, কিন্তু স্বভাবে চরিত্রে এই নীতির চর্চা সম্ভব নয়।
এ কথা নারী সবচেয়ে বেশি জানে যে তার জন্ম অনাকাঙ্খিত। একটি দু’টি পুত্রের পর যদি কন্যা জন্মে তবে সেই কন্যা-জন্মে কেউ হয়ত রুষ্ট হয় না। কিন্তু কন্যা কখনও একক ও সম্পূর্ণ রূপে কোনও দম্পতির প্রার্থিত নয়। আমাদের খ্যাতিমান সাহিত্যিকও আর দশজন মানুষের মত পুত্র প্রত্যাশী। তার মন ও মেঘার স্তর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূর্খ মানুষের স্তর ডিঙিয়ে সামাণ্যও উর্ধ্বে ওঠেনি।
২. নারীর প্রতি ঘৃণা যাঁর প্রবচনের প্রধান উপাদেয় বিষয়, নারীকে অশ্রদ্ধা এবং অকথ্য অপমান করা যাঁর স্বভাবের হাড়মজ্জার অন্তর্গত সেই নারীবিদ্বেষী পুরুষই ‘নারীবাদী গ্রন্থ’ লিখবার কৃতিত্ব অর্জন করতে আগ্রহী। কৃতিত্ব সবসময় খুব সুস্বাদু জিনিস। নারীকে হেয় করে প্রবচন রচনা করবার কৃতিত্ব যে পুরুষ একবার অর্জন করেছেন, সে পুরুষই নারীবাদী গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অর্জন করেন–এই চূড়ান্ত স্ববিরোধী আচরণে ‘কৃতিত্ব’ই একমাত্র উপার্জন। নারীকে একবার গালে চড় দিয়ে আনন্দে তাঁরা হাততালি দেন, আরেকবার চুমু দিয়ে উল্লাসে নৃত্য করেন। মূলত নারী নিয়ে তাঁরা খেলা করেন। তাঁরা নারীকে যখন খুশি ভাঙেন, যেমন ইচ্ছে গড়েন। নারী নিয়ে এই মজাদার খেলা খেলবার কৃতিত্ব পুরুষের জন্য বীরত্বের সম্মন বয়ে আনে নিশ্চয়ই।
তাছাড়া বাণিজ্যও হচ্ছে। এদেশে নারী নিয়ে বাণিজ্য করতে গেলে কোনও মেধা বা পুঁজির দরকার হয় না, কিন্তু ফলাফল লাভজনক। নারী নিয়ে বাণিজ্য করে আজ অবধি কারও ক্ষতি হয়নি, বরঙ অর্থ-যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি সকল কিছুই বেড়েছে।
এই নারী বিদ্বেষী ভাষাবিদেরও সম্ভবত ইহকাল সমৃদ্ধ হবে।
৩. এদেশের এক স্বনামধন্য কবির কথা জানি–কবি তখন দ্বিতীয় বিয়ে করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রথম স্ত্রীকে তিনি তালাকনামা লিখে দেবার জন্য চাপ দিচ্ছেন প্রতিদিন–কবি তাঁর স্ত্রী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হতে চাচ্ছেন, এতে দেন মোহরের টাকার ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, স্ত্রী এই প্রস্তাবে রাজী না হলে প্রখ্যাত কবিটি স্ত্রীকে বলেন–‘আমি তোমার চরিত্রের দোষ ছড়িয়ে দেব চারদিকে। তুমি এখনও রাজি হও তা না হলে বলে বেড়াব তুমি একটা আস্ত বেশ্যা।’
নারীর চরিত্র এমনই এক অদ্ভুত জিনিস যে, ‘শারীরিক’ সম্পর্কই তাঁর চরিত্র ভাল-খারাপের মাপকাঠি। বিতরণের জন্য নারীর চারিত্রিক দোষ যতটা উপযোগী, তত আর অন্য কিছু নয়।
সেই কবি শেষ অব্দি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীকে তিনি চরিত্র দোষের ভয় দেখিয়েছিলেন, যেন এই ভয়ে স্ত্রী তাঁর সকল প্রস্তাব মেনে নেন। চরিত্র তো আগলে রাখবার জিনিস, বিশেষ করে নারীর জন্য। এই মূল্যবান জিনিসটিকে আগলে না রাখলে নারীর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নারীর এই একটিমাত্র সম্পদ–এই সম্পদটিকে হাতছাড়া করলে তার আর সমাজে বেঁচে থাকা মানায় না। ‘সতীত্ব’ই নারীর চরিত্র বাঁচিয়ে রাখে। আগে ‘সতীদাহ’ করে নারীর সতীত্ব রক্ষা হত, আজকাল সতীদাহর নিয়ম নেই, ঘরের পুরুষ-প্রহরীরা নারীর সতীত্ব রক্ষা করে। তারাই নিজেদের প্রয়োজনে নারীকে কখনও ‘সতী’ এবং কখনও ‘অসতী’ বানায়। এই বানানোটা এত সহজ যে আমাদের খ্যাতিমান কবিও নিজের দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীকে ‘অসতী’ বানিয়েছিলেন। এতে কারও লজ্জা হয় না, দ্বিধা হয় না, সঙ্কোচ হয় না। সে যত বড় কবি বা চিত্রকরই হোন না কেন, সে যত বড় শিল্পী বা শিল্পপতিই হোন না কেন।
৪. আমাদের বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের বুদ্ধির চর্চার সঙ্গে কিছুটা মাজার চর্চা, কিছুটা নারীচর্চা বজায় রেখে জীবনযাপনে স্বাভাবিকতা আনেন। এতে করে দেশের নির্বোধ জনগণের কাতারে দাঁড়ানোও হয় এবং সকলের একজন বলে দাবী করবার মধ্যেও এক ধরনের গৌরব হয়। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এই গৌরব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে কিছুতেই রাজি নন।
৭৮. কুমারীর ব্রত
কুমারী শব্দটির অর্থ অবিবাহিত নারী। দশ থেকে ষোল বছর বয়সের অনূঢ়া কন্যাকেও কুমারী বলে। কুমারী নারীর প্রতি পুরুষের প্রবল আকর্ষণ সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। পুরুষের আকর্ষণ যেন কিছুতেই হ্রাস না পায় এবং ঈশ্বরও যেন কুমারীর প্রতি বিশেষ নজর রাখেন—তাই সমাজের ভাল মানুষেরা কুমারী মেয়েদের সতীত্ব রক্ষার ব্যাপারে নানাবিধ উপদেশ বর্ষণ করেন এবং ‘ব্রত’ পালনের ব্যবস্থা করেন। হিন্দু ধর্মে কুমারীদের জন্য বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন ব্রতের নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। বৈশাখ মাসে শিবব্রত, পুণ্য পুকুর, দশ পুতুল, হরির চরণ, অশ্বখ পাতা, গোকুল ও পৃথিবী ব্ৰত; কার্তিক মাসে যম পুকুর ব্ৰত; অগ্রহায়ণ মাসে–সেঁজুতির ব্ৰত; পৌষ মাসে তুঁষ-তুষলী ব্ৰত; এইসব ব্রতে নানারকম মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। প্রতিটি মন্ত্রের মূল কথা—সতী হওয়া, স্বামী পাওয়া, পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়া, ভাল রাঁধুনি হওয়া, সধবা অবস্থায় মৃত্যু হওয়া এবং সাত ভাইয়ের এক বোন হওয়া। পুণ্যি পুকুর ব্রতে পুকুরে জল ঢালবার মন্ত্র—পুণ্যি পুকুর পুষ্প-মালা/কে পূজেরে দুপুর বেলা?/আমি সতী লীলাবতী/সাত ভা’য়ের বোন ভাগ্যবতী।/এ পূজলে কি হয়?/নির্ধনীর ধন হয়।/সাবিত্রী—সমান হয়।/স্বামী আদরিণী হয়৷/পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে।/ মরণ-যেন হয় গঙ্গাজলে॥/দশ পুতুল ব্রত করতে হয় মেয়েদের পাঁচ বছর বয়স থেকে। এই ব্রতের মন্ত্র—এবার মরে মানুষ হব, রামের মত পতি পাব।/এবার মরে মানুষ হব, সীতার মত সতী হব।/এবার মরে মানুষ হব, দশরথের মত শ্বশুর পাব।/এবার মরে মানুষ হব, কৌশল্যার মত শাশুড়ি পাব। এবার মরে মানুষ হব, কুন্তীর মত পুত্রবতী হব। এবার মরে মানুষ হব, দ্রৌপদীর মত রাঁধুনি হব৷/এবার মরে মানুষ হব, পৃথিবীর মত ভার সব।
কোনও ব্রত বা মন্ত্র নারীর বানানো নয়। বানিয়েছে পুরুষ। এইসব ব্রত মূলত নারীকে স্বামী-পুত্র-সংসারের আকাঙক্ষায় নিমগ্ন রাখবার কৌশল। নারী যেন কখনও বুঝতে না পারে যে সেও মানুষ। স্বামী পুত্র সংসারের বাইরে নানা কাজে দক্ষতা দেখাবার অধিকার তারও আছে। সেও অশ্বারোহী হতে পারে, সেও সন্মুখ সমরে জয়ী হতে পারে। সেও বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, চিত্রকর, কবি ও রাষ্ট্রপতি হতে পারে।
হরির চরণ ব্ৰতে মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়—কোন যুবতী পূজে পা/সে যুবতী কি চায়?/রাজেশ্বর স্বামী চায়,/দরবার জোড়া ব্যাটা চায়,/… গোয়ালে গরু, মরায়ে ধান,/ বছর বছর পুত্ৰ পান।/ না দেখেন স্বামী পুত্রের মরণ।/ না দেখেন বন্ধু-বান্ধবের মরণ।/ হবে পুত্র, মরবে না।/ চক্ষের জল পড়বে না।/ দিয়ে ছেলে স্বামীর কোলে/মরণ যেন হয়,/এক গলা গঙ্গাজলে।
অশ্বত্থ পাতা ব্ৰতে মন্ত্র পড়তে হয়—পাকা পাতাটি মাথায় দিলে পাকা চুলে সিঁদুর পরেত।/ কাঁচা পাতাটি মাথায় দিলে কাঞ্চন মূর্তি হয়। কচি পাতাটি মাথায় দিলে নবকুমার কোলে হয়।
সেঁজুতি ব্রতের মন্ত্রে আছে—খাট পালঙ্ক, লেপ, দোলঙ্গ, গির্দে আশে পাশে/রূপযৌবন, সদাই সুখী, স্বামী ভালবাসে।/ পাড়াপড়শি, প্রতিবাসী, মেী বর্ষে মুখে।/ জন্ম এয়োতী পুত্রবতী, জন্ম যায় সুখে।
মূলত একই মন্ত্র ঘুরে ফিরে বছরব্যাপী ব্রতে উচ্চারিত হয়। মন্ত্রে যা উচ্চারিত হয়, সংসার সমাজে একই কথা উচ্চারিত হয়। ভিন্ন কিছু নয়। কুমারীর জন্য যে ব্ৰত সাধনার নিয়ম ছিল আজ থেকে হাজার বছর আগে, সেই নিয়ম একটু এদিক ওদিক করে এখনও প্রচলিত। ব্রত পালন আজকাল অনেকেই হয়ত করে না। কিন্তু ব্রতের ওই মন্ত্রের সুর মস্তিষ্কের কোষে কোষে, রক্তের প্রতি কণিকায় গোপনে বাজে। এ থেকে মুক্তি নেই কারও। প্রতিটি মেয়ের ভেতরে শৈশব থেকে স্বামী পুত্র সংসারের স্বপ্ন রোপন করা হয়। এই স্বপ্ন মহীরুহ হয়ে নারীকে শত খণ্ডে খণ্ডিত করে। পুরুষের ঔরসে পুরুষ জন্ম দেওয়াই নারী জন্মের সার্থকতা। নারীর নিজস্ব কোনও অস্তিত্ব নেই, যেন নারীর জন্মই হয়েছে পুরুষকে সেবায় ও সঙ্গমে তৃপ্ত করা, নিজের জরায়ুতে পুরুষ-সন্তান ধারণ করে পুরুষেরই বংশ বিস্তার করা।
কোনও ব্রতেই কন্যা সন্তানের আকাঙক্ষা নেই, কোনও ব্রতে স্বামী ছাড়া, স্বামীকে তৃপ্ত করা ছাড়া অন্য কোনও স্বপ্ন নেই। এবং এখনও নেই—যখন নারী আর কুমারী ব্রত পালন করে না, যখন নারী বই-খাতা হাতে স্কুলে যায়, কলেজে যায়, অফিসে-আদালতে চাকরি করতে যায়, এখনও একই বৃত্তে নারী আবর্তিত হয়, একই সংস্কারের কুয়োয় নারী পতিত হয়।
কেন এই আবর্তন? নিশ্চয় এই কারণে, যে শিক্ষা ও সংস্কার আশ্রয় করে মানুষ গড়ে উঠছে, তা সুস্থ নয়। ভিতে ফাটল রেখে সাততলা দালান হয়ত ওঠানো যায়, কিন্তু টেকে না। এক ধ্বংসস্তুপের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই কথা স্পষ্ট করে কেউ জানছে না যে নারী মানুষ। নারীর নারীত্ব ও মাতৃত্বের চেয়ে নারীর ব্যক্তিত্ব বড়। নারীত্ব ও মাতৃত্বের যে ব্যাখ্য প্রচলিত, তা পুরুষের স্বার্থে পুরুষেরই বানানো এক সিদ্ধান্ত।
নারী তার শরীরে জরায়ু ধারণ করে, কিন্তু জরায়ুর স্বাধীনতা ধারণ করে না। জরায়ুতে সন্তান বহন করবার এবং না করবার স্বাধীনতা নারীর নেই, নারীকে বলা হয় মাতৃত্বে নারীর সার্থকতা। নারী তা-ই মানে। একটি মিথ্যেকে লালন করে নারী সারা জীবন বাঁচে। জরায়ু নারীর। নারীই নির্ধারণ করবে এই জরায়ুতে সে কিছু ধারণ করবে কি করবে না। জরায়ুতে সন্তান ধারণের নানারকম শর্ত পুরুষেরা আরোপ করেছে। যেমন—বিবাহ (স্বামী-সঙ্গ ছাড়া নারী সন্তানবতী হতে পারে না), বংশ (বংশ রক্ষার কাজ কন্যা দিয়ে চলে না, তাই পুত্রের প্রয়োজন), মাতৃত্ব (যেহেতু মাতৃত্বে নারী জন্মের সার্থকতা, তাই নারীজন্মকে সার্থক করতে হবে)। শর্ত থাকবার অর্থ জরায়ু । যার, জরায়ুর ওপর তার কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছের অধিকার চলবে না।
মেয়েদের ব্রত কথায় মেয়েরা ‘পুত্রকে স্বামীর কোলে’ রেখে মৃত্যুবরণ করতে আগ্রহী। স্বামী সাধারণত মেয়ের চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বা চতুর্গুণ হত (যে সময় ব্ৰত কথার জন্ম)। স্বামীর কোলে পুত্র রেখে, স্বামীর আগে মরে যাওয়া নিশ্চয় অল্প বয়সে মরে যাওয়া। নিজের অকালমৃত্যু কামনাও পুরুষের জন্য এমন এক সুবিধা তৈরি করা যেন পুরুষ এক জীবনে বহু-স্ত্রী ভোগ করতে পারে এবং যেন তারা শতায় বা দীর্ঘায়ু হয়। বহু স্ত্রী ভোগ করবার কথা এইজন্য যে, এক স্ত্রীর অকালমৃত্যু হলে আরেক স্ত্রীর প্রয়োজন জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া স্বামীহীনতা নারীর জন্য এত অকল্যাণকর, এত ভয়াবহ এবং দুর্বহ যে নারী স্বামীহীনতা মোটেও সহ্য করতে চায় না। তাই মাথায় সিঁদুর রেখেই মরতে চায়।
একথা সর্বত্র অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পুরুষের কাজে সহায়তা করবার জন্যই নারীর জন্ম। নারী নিজের কোনও কাজে