- বইয়ের নামঃ ছোট ছোট দুঃখ কথা
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
আপনার কি মা বোন নেই?
প্রায়ই রাস্তা ঘাটে বাসে টেনে ছেলেরা যখন মেয়েদের প্রতি অশোভন আচরণ করে, তখন মেয়েদের পক্ষ নিতে কিছু লোক জড়ো হয়। সাধারণত এরা ছেলেদের গালাগাল করে এবং সদুপদেশ বিতরণ করে। এরা ছেলেদের তিরস্কার করতে গিয়ে বলে আপনার কি মা বােন নেই? আমি অনেকদিন ভেবেছি। এমন অবস্থায় বিবেকবান মানুষেরা মা বোনের প্রসঙ্গ তোলেন কেন? পুরুষেরা নারীকে অত্যাচার করছে, এতে মা বোনের সম্পর্ক উল্লেখ করা জরুরী কেন তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কেবল রাস্তাঘাটের উপদেষ্টা পুরুষ নয় এমন কথা আমাদের নামকরা লেখকও বলেন যে নারীকে মাতৃরূপে কন্যারূপে এবং ভগ্নীরূপে দেখতে হবে। আমার প্রশ্ন —নারীকে মা, বোন কন্যা হিসেবে দেখতে হবে কেন? এগুলো একধরনের সম্পর্ক। নারীকে সম্মান করতে হলে কোনও এক সম্পর্কের বাউন্ডারির মধ্যে এসে সম্মান করতে হবে কেন? যে পুরুষের মা বোন নেই, সে পুরুষের কাছে তবে কি নারীরা সম্মান পাবার অধিকার রাখে না? নারীকে কেন পুরুষের মা বােন এবং কন্যা রূপে বিরাজ করে নিজের সুবিধা আদায় করতে হবে? নারী আপাদমস্তক মানুষ, এই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা নিশ্চয়ই সে রাখে। বলা হচ্ছে পুরুষ তাকে অমর্যাদা করবে না। কারণ পুরুষের মা এবং বোন সম্পর্কটি যেহেতু নারীরা বহন করে, তাই কোনও নারী ওই সম্পর্ক বহন না করলেও অন্তত পুরুষের স্মরণ করতে হবে তার আত্মীয়দের মতোই দেখতে নারীকে নির্যাতন করা বা অসম্মান করা যাবে না। অথবা তাকে করুণা করতে হবে । মা ও বোনকে সাধারণত করুণাই করে পুরুষরা। এই করুণা যেন পুরুষেরা নারীকে করে—এই হল মূল কথা। এ ক্ষেত্রে আগের কথাটিই আসে কোনও পুরুষের যদি মা এবং বোন না থাকে, তবে কি সে নারীকে অপমান করবার অধিকার রাখে? “আপনার কি মা বোন নেই?” এর উত্তরে কোনও পুরুষ যদি বলে বসে—“না নেই, তবে? তার অপরাধ কি তখন ক্ষমার যোগ্য?
একবার এক ছেলে রাস্তায় এক মেয়ের ওড়না টেনে নিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিল। লোক জমা হল। অনেকে জিজ্ঞাসা করল—“আপনার কি মা বোন নেই?” ছেলেটি উত্তর দিয়েছিল—“মা বােন আছে, তবে বউ নেই।” ছেলেটি কিন্তু মন্দ বলেনি। যদি সম্পর্ক দিয়েই বিচার করা হবে তাবৎ নারীকে, তবে বন্ধুরূপে কেন নয়? মা-বােন এবং কন্যার মত বধূও তো একধরনের সম্পর্ক। রূপের কথাই যদি ধরা হয়, তবে এও তো প্রশ্ন যে সব ‘রূপ’ নয় কেন? পুরুষেরা কোনও নারীর মধ্যে মাতৃরূপ দেখবে, কোনও নারীতে পাবে ভগ্নীরূপ, কোনও নারীতে আবার বন্ধুরূপ। বন্ধুরূপে যাকে মনে হবে, তাকে রাস্তাঘাটে যেমন যখন তখন পেটে পিঠে গুতাে দেওয়া যায় তেমন দেবে। বধূকে যেমন যখন ইচ্ছে আদর সােহাগ করা যায়, তেমন করবে।
পুরুষের মা বােন কন্যা রূপে পরিচিত হয়ে সম্মান পাওয়া নারীর জন্য অপমানকর কোনও সম্পর্করূপে নয়, নিজের পরিচয়ই এখন আসল পরিচয় হওয়া উচিত নারীর জন্য। সম্পর্কের দোহাই দিয়ে নারীকে সম্মান পেতে হবে কেন? নারী কি মানুষ হিসেবে সম্মান পাওয়ার দাবি রাখে না?
“মেয়েরা তো মায়ের জাত।”…এরকম একটি কথাও প্রচলিত বেশ । মেয়েদের সম্মান করতে হবে কারণ তারা মা। এখানে ঠিক সম্মান করবার কথাও বােঝানাে হয় না, যেহেতু কষ্ট করে প্রসব করে তাই তাদের লাথিঝাঁটা দিও না, বেচারাকে মারধাের না করলেও তো পারো”— ব্যাপারটি এরকম। এখানে মা বলে যে গৌরব করা হয়েছে, তা অনুমান করি কোনও কন্যার মায়ের গৌরব নয়, বেটা ছেলেদের জন্মের কথা ভাবা হয়েছে। বেটা ছেলেদের জন্ম দিয়ে মেয়েরা মহৎ কাজ করে, তাই মেয়েদের একেবারে ছুড়ে না ফেললেও তো চলে… মেয়েদের মায়ের জাত বলবার পেছনে যে টোনটি কাজ করে তা এরকমই।
মেয়েদের সম্মান করাবার জন্য নানারকম যুক্তি টানা হয়, কিন্তু পুরুষকে সম্মান করবার জন্য কোনও যুক্তি টানবার দরকার পড়ে না, মস্তিস্ককে এরকম একটা ধারণা দিতে হয় না যে এরা বাপের জাত, এদের বাপ ভাই-এর মত দেখতে হবে ইত্যাদি। এসব যুক্তির প্রয়োজন হয় না। কারণ মেয়েরা কোনও যুক্তি এবং উদাহরণ ছাড়াই পুরুষকে সম্মান করে, যেহেতু পুরুষেরা ‘মানুষ’, পুরুষকে তারা মানুষের মর্যাদাটুকু দেয়।
নারী মানুষের মর্যাদা পাবে, সে তার নিজের অধিকারেই। পুরুষেরা মা বোন সম্পর্কের কারণে নয়। সেই সম্পর্কের ক্যামোফ্লেজেও নয়।
অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবীও বলেন নারীকে মা এবং বোনরূপে দেখতে। আমি বলি, সম্পর্কের করুণা কেন নারীকে করতে হবে? সে কি কারও মা এবং বােন না হয়েও কেবল মানুষ হয়ে মানুষের পরিচয়ে সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখে না? আমরা সবাই জানি নারীর এই অধিকার আছে। যারা তার এই অধিকার খর্ব করতে চায় তারা কেবল লেখাপড়া না জানা মানুষই নয় লেখাপড়া জানা মানুষও।
প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে ভণ্ড প্রগতিশীলদের ব্যাপারে নারীকে সচেতন থাকতে হবে বেশি। মুর্খ পুরুষের চেয়ে ধূর্ত পুরুষ থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এরা ধীরে ধীরে নারীকে বিভিন্ন মা-খালা-বোনের খোলসে আবৃত করে ফেলে, এইসব সামাজিক সম্পর্কের বাইরে তার পরিচয় স্বীকার করে না। নারী যেন জন্মজন্মান্তরের মেধাহীন-বুদ্ধিহীন! গোটাকয় সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে নারীকে আটার গোলা বানানো হয়। রুটি-পুরি-লুচির মতো সময়-সুবিধামতো নারীকে মা-বোন-খালা ইত্যাদি গড়ে নেওয়া যায়,এতে নারী নামের আটার গোলা নানা আকার হয়ে কেবল সামাজিক তাওয়ায় পোড়ে।
পুনশ্চঃ নারী মানুষ-এই হোক নারীর প্রথম ও শেষ পরিচয়।