সেদিন দেখলাম দুটো পায়রা উড়ে এসে আমার জানালার ওপারে বসলো, আমার মা যেরকম পায়রা পুষতো, ঠিক সেরকম দুটো পায়রা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল চলে এসেছিল। সন্ধ্যের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই। কৈশোরে বেজায় ভালোবাসতাম সেই বেলি ফুলের ঘ্রাণ! ঘ্রাণটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে হেঁটে যাই, ঝাড় জঙ্গল যা কিছু পড়ুক সামনে, হেঁটে যাই। আর, এদিকে আমার বারান্দার টবে পুঁতেছি হাসসুহানার চারা। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ছিল হাসনুহানা। ওর সুঘ্রাণ আমাদের ঘুম পাড়াতো। জানিনা, কী এর নাম! এই বার বার পেছন ফিরে তাকানোর! কী নাম এর। এই কুড়ি বছরে পৃথিবীর পথে অনেক হেঁটেছি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি অনেক। যারা ভালোবাসে, যারা আমার মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়, আমার নীতি আর আদর্শে বিশ্বাস যাদের, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার মতোই সরব, তাদের আমার দেশ বলে মনে হয়। তারা পাশে থাকলে আমি নিরাপদ বোধ করি। দেশ মানে আমি ভালোবাসা বুঝি, নিরাপত্তা বুঝি। যে দেশ ঘৃণা করে, ছুঁড়ে ফেলে, ভয় দেখায়, সে দেশকে দেশ বলে কেন মনে। হবে! জন্ম দিলেই তো মা হওয়া যায় না, মা হতে গেলে ভালোবাসতে হয় সন্তানকে। দেশ তো কেবল মাটি, নদী, গাছপালা, আর বাড়িঘর নয়। দেশ এসবের চেয়েও আরও বড়, অনেক বড়।
বেঁচে থাকতে সম্ভবত আমার দেশটিকে খুব উদার বা মানবিক হতে দেখবো না, কিন্তু অপেক্ষা করবো এমন দিনের, যেদিন দেশটিকে নিয়ে গর্ব করতে পারি। অপেক্ষা করবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইণ্ডিয়া, মার্কসবাদী) বিধায়ক ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা মেয়েদের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন, শুনে সত্যি বলতে কী, আমি অবাক হইনি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে স্বভাবচরিত্রে সিপিআইএম খুব আলাদা নয়। সত্যিকার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের সম্পূর্ণ সমানাধিকার নিশ্চিত। এ সম্পর্কে প্রচুর সিপিআইএম নেতা-সমর্থক দের কোনও ধারণা নেই। রেজ্জাক মোল্লারও নেই বলে তিনি অসমাজতান্ত্রিক, অশ্লীল, এবং অসত্য একটি মন্তব্য করেছেন। এবং করেছেন জামাতে ইসলামি হিন্দএর জমায়েতে। আদর্শগত কারণে কোনও ধর্মীয় দলের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক থাকার কোনও কথা নয়। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সত্যিকার কমিউনিজমের আদর্শ থেকে লক্ষ যোজন দূরে।
রেজ্জাক মোল্লা বলেছেন, জিনস আর টপ পরে বেরোলে মেয়েদের নিগ্রহ অনি বার্য, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির শিকার হলেও তাদের নালিশ করা উচিত নয়, পোশাকই মেয়েদের বিপদ ডেকে আনে। –এই কথাগুলো রেজ্জাক মোল্লার একার কথা নয়, এগুলো প্রায় সব পুরুষের মনের কথা। অন্য পুরুষেরা আজকাল এসব কথা মুখে না বললেও মনে মনে বলে। রেজ্জাক মোল্লার চোখ কান অত খোলা নেই বলে ফস করে বলে ফেলেছেন, জানেন না যে আজকাল ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করাটা পলি টিক্যালি ইনকারেক্ট। বহু বছর ধরে নারীবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র সবাইকে বোঝাচ্ছে, এমনকী প্রমাণও দেখাচ্ছে যে, ধর্ষণ নারীর পোশাকের কারণে ঘটে না। ধর্ষণের কারণ: ১. বীভৎস কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে পুরুষ তার পৌরুষ প্রমাণ করে, ২. নারীকে নিতান্তই যৌনবস্তু মনে করে পুরুষ। সুতরাং যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করা অপরাধ নয় বলেই বিশ্বাস
নারীবাদীদের আন্দোলনের ফলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাদের দায়ী করাটা সভ্য এবং শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এখন অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এখনও বন্ধ করছে না, তাদের নিশ্চিতই চক্ষুলজ্জা বলতে যে জিনিসটা প্রায় সবার থাকে, নেই। পশ্চিমবঙ্গের অনেকে রেজ্জাক মোল্লার মন্তব্যের প্রতিবাদ করলেও বর্তমান তৃণমূল সরকারের কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। সম্ভবত আগামী নির্বাচনে ধর্ষকদের ভোট আবার যদি না জোটে, এই ভয়ে।
রেজ্জাক মোল্লা বলেছেন, পুরুষের কুনজর থেকে বাঁচতে মেয়েদের শপিং মলে যাওয়া বন্ধ করা উচিত। রেজ্জাক কিন্তু পুরুষদের উপদেশ দেননি তাদের কুনজর বন্ধ করার জন্য। সম্ভবত এতদিনে তিনি বুঝে গেছেন পুরুষ-জাতটা খারাপ। তো এই খারাপ-জাতকে ভালো করার তাঁর মোটেও ইচ্ছে নেই। বরং ভালো-জাত না রী-জাতকে উপদেশ দিয়েছেন খারাপ-জাত থেকে গা বাঁচিয়ে চলার জন্য। মোল্লার বিবৃতি যত না নারীবিরোধী, তার চেয়ে বেশি পুরুষবিরোধী। তিনি পুরুষদের ভালো মানুষ বলে মনে করেন না। পুরুষেরা নিজের যৌনইচ্ছেকে সংযত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। তাদের কুনজরকে সুনজর করার কোনও উপায় আছে বলে তিনি মানেন না। পুরুষবিরোধীরা যেমন পুরুষকে শুধুই কামুক, শুধুই লম্পট, শুধুই ধর্ষর্ক, লিঙ্গসর্বস্ব, শুধুই অসৎ, অবিবেচক বলে মনে করে, রেজ্জাক মোল্লাও তেমন মনে করেন। এই পুরুষবিরোধীরাই পুরুষের কুনজর থেকে বাঁচতে মেয়েদের বোরখা পরার উপদেশ দেয়।
খাপ পঞ্চায়েতের মোড়লদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রেজ্জাক মোল্লার কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য হিন্দু মুসলমানেও নেই। মেয়েদের অপদস্থ আর অপমান। করতে, মেয়েদের অসম্মান করতে, অত্যাচার নির্যাতন করতে দুই সম্প্রদায়ই সমান পারদর্শী। যখন তাঁর বক্তব্যের নিন্দা হচ্ছে খুব, রেজ্জাক মোল্লা বললেন যে তিনি যা বলেছেন মুসলমান মেয়েদের সম্পর্কে বলেছেন, অমুসলমান মেয়েদের সম্পর্কে কিছুই বলেননি। বেফাঁস মন্তব্য করে, বেগতিক দেখে, এখন নিজের ধর্মের গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। ধর্মের গুহা সবসময়ই খুব নিরাপদ কি না। মুসলমান মেয়েদের সম্পর্কে বলেছেন কারণ নিশ্চয়ই তিনি মনে করেন মুসলমান মেয়েদের নিয়ে যা কিছু মন্তব্য করার অধিকার তাঁর আছে। আজ তাদের সালোয়ার কামিজ পরার উপদেশ দিচ্ছেন, কাল তাদের বোরখা পরার উপদেশ দেবেন। অর্ধেক আকাশকে কালো মেঘে ঢেকে দিতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই।