ইচ্ছের কথাগুলো বলি একটু একটু করে। বলি, কিন্তু ছোটদার ওই ওজন কমতে থাকা শরীরটির দিকে তাকিয়ে বড় ভয় হতে থাকে। ভয়গুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। বাবা নেই। মা নেই। মার সামনে এই ঘটনা ঘটেনি, একদিক থেকে ভালো। ছোটদাকে খুব ভালোবাসতো মা। দেরিতে-কথা-বলা, দেরিতে-দুধ-ছাড়া ছেলেটি তার বুকের ধন ছিল। ছোটদার ক্যানসার মা কি আর একফোঁটা সইতে পারতো! কেঁদে কেঁদেই হয়তো একদিন মরে যেতো। ভয় হয়, কিন্তু নিজেকে বলি, আমরা নিশ্চয়ই আবার আগের মতো চা খেতে খেতে গল্পের বই পড়বো। আমি পড়বো, ছোটদা শুনবে। আবার নিশ্চয়ই ছোটদাকে নতুন নতুন শহর দেখাতে নিয়ে যাবো। শহরের ইতিহাস বলবো, ছোটদা মন দিয়ে শুনবে। আর ছোটদা যখন তার নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসবে, সেসব শুনবো মন দিয়ে, কোনওদিন বলে শেষ হবে না যেসব কাহিনী, ছোটদার অফুরন্ত রোমহর্ষক কাহিনী। আমাদের আর কী আছে স্বপ্ন ছাড়া?
ডায়রি
সেদিন একটা পুরস্কার পেলাম বেলজিয়ামের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, আর্টস অ্যাণ্ড লিটারেচার থেকে। ওদিকে প্যারিস থেকে একটা ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্টও পেলাম।
এই পাসপোর্টটি রীতিমত স্বপ্নের মতো। কখনও হয়তো পৃথিবী এমন হবে, যখন কোনও দেশের সীমানা বা বর্ডার বলে কিছু থাকবে না, পৃথিবীই দেশ হবে সবার। কোনও ভিসা বা পাসপোর্টের দরকার হবে না কারও। যেখানে খুশি যাবার, যেখানে খুশি থাকার স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি মানুষের।
ইওরোপীয় পার্লামেন্ট, বেলজিয়াম সেনেট, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, হিউম্যানিস্ট কনফারেন্স, সবখানেই পেয়েছি অভিনন্দন, সম্মান, আর বক্তৃতার পর স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন। স্ট্যান্ডিং ওভেশনের বাংলাটা কী? কিছু কিছু শব্দ নিয়ে এত মুশকিলে পড়ি আজকাল। ইংরেজিটার বাংলা জানি না, অথবা বাংলাটার ইংরেজি জানি না। অনেক শব্দ আছে, যেগুলো অন্য ভাষায় ঠিকঠাক অনুবাদ করা যায় না। অভিমান শব্দটাকে আজো আমি ইংরেজিতে বোঝাতে পারি না। স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন, আমি লক্ষ্য করেছি, ডাকসাইটে বক্তাদের কারও জুটছে না, কিন্তু আমার জুটছে। এবার বিখ্যাত বিবর্তন-বিষয়ক বিজ্ঞানী ব্লগার পিজি মায়ার্সকে ডাবলিনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বলুন তো, আপনারা এত বড় বড় স্পিকার, আপনারা স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন পান না, আমি কেন পাই? আমার ভাষা ইংরেজি নয়, স্পিচে প্রচুর গ্রামারের ভুল, তার ওপর ভুল উচ্চারণ, আমাকে কী কারণে স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন দেওয়া হয় সবখানে? পিজি বললেন, লোকে উচ্চারণ ভুল আর গ্রামার ভুলকে অত গ্রাহ্য করে না। তোমার স্পিচের সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিস হলো, কনটেন্ট, বিষয়। সেটাই মানুষকে স্পর্শ করে। কী জানি, কনটেন্ট তো আমার মনে হয়, আমার বক্তৃ তার চেয়ে ওঁদের বক্তৃতায় কিছু কম নয়, বরং বেশি। ওঁরা যেভাবে ওঁদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে বলতে পারেন, ব্যাখ্যা করতে পারেন, গাদা গাদা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেন, তার ধারে কাছেও আমি পারি না। ভাষার সীমাবদ্ধতা তো আছেই, মস্তিষ্কও আমার অত ব্যাপক নয়, মেমরিও ভোঁতা। তাহলে কি সম্মানটা পাই নির্বাসন জীবন যাপন করি বলে? পাশ্চাত্যের শিক্ষিত বুদ্ধিমানদের যতদুর আমি জানি, কারও নির্বা সনের সমবেদনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় না। মঞ্চ থেকে নেমে এলে ঘিরে ধরে আমাকে যারা, তারা কেউ আমার নির্বাসন জীবনের জন্য চোখের জল ফেলছে বলে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আমার মধ্যে তবে আছে। কী সেটা? সততা! নিষ্ঠা। জানি না কী, কিছু একটা হবে।
এই যে বিদেশে সম্মান জোটে, এ কিন্তু দেশের লোকেরা কেউ জানে না। কারণ দেশের কোথাও এসব খবর ছাপা হয় না। আমার একসময় মনে হতো, আমাকে হয়তো ভুলেই গেছে দেশের মানুষ। মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। যে দেশে আমার বই ছাপানো হয় না, পত্রিকায় লেখা ছাপানো হয় না, সে দেশে কতদিন আর মানুষ। মনে রাখতে পারে একজন লেখককে। কিন্তু আমাকে যে একেবারেই ভোলেনি কেউ, তার প্রমাণ পাই, যখন মিডিয়া রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার সম্পর্কে লেখে, এবং লেখাগুলো সশব্দে গোগ্রাসে গেলে পাঠককূল, আমাকে নিয়ে অবশ্য তখনই কিছু লেখা হয়, যখন আমাকে কেউ মারধোর করে, গালাগালি করে, বিদ্রূপ করে, অসম্মান। করে, যখন আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়, আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু ভিড় করে মানুষ আমার বই কেনে, বই পড়ে প্রশংসা করে, বই পড়ে অনেকে সচেতন হয়, দেশে না জুটলেও বিদেশে অনেক সম্মান জোটে– এসব খবরের কোনও চিহও উপমহাদেশের কোথাও কিন্তু কখনও দেখা যায় না। হতে পারে বিদেশের মেইনস্ট্রিমের সব ঘটনা দেশি সাংবাদিকদের জানা সম্ভব নয়। কিন্তু জানা যদি সম্ভব হতো? আমার বিশ্বাস, আমার সম্মানের কথা কেউ কোথাও লিখতো না। এর কারণ সম্ভবত এই যে, মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে লিখে লিখে, দীর্ঘদিন মিথ্যেচার করে করে, শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে মানুষের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা রাগ, একটা ঘূণ তৈরি করতে, এখন আস্ত একটা ঘৃণার। বস্তু হিসেবে আমাকে পরিণত করার পর, তাদের এতদিনের পরিশ্রমের ফসলকে, এই ক্রিয়েশনকে দুএকটা ভালো খবর বা সত্য খবর লিখে নষ্ট করতে পারে না। আর পাঠকও আমাকে ঘৃণা করতে করতে বেড়ে উঠেছে, সেই ডাঙর পাঠককে এখন তো এমন কিছু খাওয়ানো যায় না, যা তার হজম হবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, মিডিয়ার কেন এত দরকার ছিল আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগার! নিশ্চয়ই ছিল, এবং এখনও আছে। আমি নাস্তিক বলে, বা ইসলাম এবং ইসলামের আইন নিয়ে মন্দ বলেছি বলে রাগ? সেটা হয়তো কুড়িভাগ, আশিভাগ রাগ পুরুষতন্ত্রের নিন্দা করেছি বলে। অন্তত দেখেশুনে এরকমই আমার ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজটাকে যে মানুষ পাল্টাতে চাইছে, তাকে এক ফুয়ে ভ্যানিস করে দেওয়ার দরকার সবার। সরকারের, সমাজের, পরিবারের, পুরুষের। মিডিয়া সমাজেরই অংশ। সমাজ যেমন পুরুষতান্ত্রিক, মিডিয়াও পুরুষতান্ত্রিক। আর কোনওভাবে ধ্বংস করা না গেলেও কুৎসা রটিয়ে করা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের। এ কথা যে কোনও গাধাও জানে।