সেই থেকে ছোটদা কম ভুগছে না। দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালও লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিস্তর ভোগান্তি দিয়েছে। প্যানক্রিয়াসের অপারেশন হবে, তার আগে এক উড়িষ্যার কার্ডিওলজিস্ট ফতোয়া দিয়ে বসলেন, আগে হার্ট অপারেশন করতে হবে। ছোটদাকে বলেছিলাম, তুমি আমেরিকার স্লোন কেটেরিংএ গিয়ে চিকিৎসা করো, সিঙ্গা পুরের ক্যানসার হাসপাতাল ভালো, ওখানে যাও, আর দুরে কোথাও না যেতে চাইলে বোম্বের টাটা মেমোরিয়ালে অন্তত যাও। ছোটদা সিদ্ধান্ত নিল দিল্লিতেই হওয়ার হবে। কেন? দিল্লিতে তার ছোটবোন, আমি, আছি। ছোটবোন ডাক্তার। হ্যাঁ ডাক্তার বটে, কিন্তু ডাক্তারি তো করি না বহু বছর। আমি ছোটবোন, আমি তো ক্যানসার ভালো করে দিতে পারবো না, সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা যেখানে পাবে, সেখানে যাও। ছোটদা শুনলোনা। আমার কাছে থেকে চিকিৎসা করালো। খামোকা একটা বাইপাস অপারেশন হতে হল, তা না হলে নাকি অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না প্যানিক্রয়াসের দীর্ঘ হুইপল সার্জারির জন্য। সবই হলো। হার্ট সার্জারি। হুইপল সার্জারি। ছোটদা ওই ভীষণ কষ্টগুলো সব সহ্য করলো। কাতরালো। ছটফট করলো। দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। চোখ মেললো। কিন্তু হাল ছাড়লো না। আমি তাকাতে পারতাম না ওই কষ্টের দিকে। বুক চিরে বার বার দীর্ঘশ্বাস বেরোতো। দুরে সরে থাকতাম।
অপারেশনের পর কেমোথেরাপির প্রেসক্রিপশান নিয়ে ঢাকায় ফিরে গেল ছোটদা। স্কাইপেতে কথা হতো আমাদের। ছোটদা একটা ল্যাপটপ কিনেছিল কথা বলার জন্যই। ক্যানসার নিয়ে বেশি কথা বলতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ভীষণ ভীষণ কাণ্ড হচ্ছে সেসব খবর দিত আমাকে। আমারও ইচ্ছে করতো না ক্যানসার নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু জোর করে কী আর মুখ বুজে থাকতে পারি। উদ্বেগ কোনও না কোনও ভাবে প্রকাশ পেতোই। ছোটদা নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া লোক, শুধু চেকআপের জন্য। তারই কিনা হলো এই রোগ! আমি ডাক্তারের কাছে না-যাওয়া লোক। আমার শরীরেও কোথাও নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে এই কর্কট রোগ। ছোটদাকে বলেছিলাম, আমাদের জিন খুব খারাপ জিন। অসুখ বিসুখে ভর্তি। হাইপারটেনশন, ডায়বেটিস, ক্যানসার। ছোটদাও জানে আমাদের জিন ভালো নয়। বারবারই বলেছে ছোটদা, আমিও যেন সব কিছু পরীক্ষা করিয়ে নিই। অল্প স্বল্প মদ্যপান করেছিল বলেই কি ক্যানসার হয়েছে? কত লোক তিরিশ চল্লিশ বছর প্রতি সন্ধেয় মদ্যপান করছে, তাদের লিভার যেমন ছিল তেমনই আছে। প্যানক্রিয়াসেও এক ফোঁটা কিছু বদল নেই। জিন খারাপ না হলে এমন হতো না।
প্যানক্রিয়াস ক্যানসার সাধারণত এত আগে কারও ধরা পড়ে না, ছোটদার যত আগে ধরা পড়েছে। কোনও উপসর্গই শুরু হয়নি। প্যানক্রিয়াসের বাইরে খুব কোথাও ক্যানসারটা ছড়ায়নি। তাই আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কারণ হুইপল সার্জারি যখন সাক সেসফুল, নিশ্চয়ই অনেক বছর বেঁচে থাকবে ছোটদা। কত চেনা মানুষ ন্যানসার হওয়ার পরও হেসে খেলে কুড়ি পঁচিশ বছর বেঁচে আছে। ছোটদার বেলাতেও নিশ্চয়ই তাই হবে। কিন্তু তিনমাস কেমোথেরাপি দেওয়ার পর ছোটদা যখন এলো পরীক্ষা করাতে আবার দিল্লিতে, রক্তে ক্যানসার ধরা পড়লো প্রচুর। তার মানে কেমোথেরাপির বিষ পেয়েও কর্কট রোগের ছিটেফোঁটা মরেনি, বরং শরীর জুড়ে আরও তাণ্ডব নৃত্য করেছে। তাহলে অত বড় যে বিলেত ফেরত সমীরণ নন্দী, উনি নিশ্চয়ই হুইপল সার্জারিটা ভালো করে করতে পারেননি। আমি যখন রেগে আগুন, সব ডাক্তারদের খিস্তি করছি, ছোটদা তখন ধীর, শান্ত। কোনও ডাক্তারের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই। কোনও ডাক্তা রই নাকি ভুল চিকিৎসা করেনি। সবই নাকি ছোটদার ভাগ্য। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি না। কোথাও কোনও ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। ভীষণ ক্রুদ্ধ আমি, সমীরণ নন্দীকে জিজ্ঞেস করলাম, ভুলটা উনিই করেছিলেন কি না। কেউ কি আর ভুল স্বীকার করে। ছোটদা ঢাকায় ফিরে গিয়ে নতুন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রেডিওথেরাপি নিচ্ছে। জানিনা প্যা নক্রিয়াস ক্যানসারে রেডিওথেরাপি কতটা কাজ করবে। আমার খুব ভয় হয়। এখনও স্কাইপেতে কথা হয়, আগের মতো প্রতিদিন ছোটদা স্কাইপেতে আসতে পারে না। মা ঝেমাঝেই নাকি শরীর খারাপ থাকে। ভয়ে আমি ফোন করি না। ফোন এলে গা কাঁপে। না জানি কী শুনবো! প্রতিদিন সকালে যদি স্কাইপেতে না আসে, তিরতির করে একটা দুশ্চিন্তা মনের কোথাও যেন কাঁপে। দুদিন আগে বললাম, আর দিল্লি বোম্বে না গিয়ে যেন আমেরিকায় যায়, এখানে বড় ক্যানসার হাসপাতালে ডাক্তার দেখায়। বাঁচার জন্য চেষ্টা তো করতেই হবে। জীবন তো একটাই। মাঝে মাঝেই উপদেশ দিই, প্রতিটি মুহূর্তকেই যেন সে গুরুত্ব দেয়। যেন যা তার করতে ইচ্ছে করে, করে। বলি যখন, নিজের কণ্ঠস্বরই নিজের কাছে খুব অদ্ভুত ঠেকে। কেন আমি ভাবছি ছোটদা মরে যাবে শিগগিরই, আর আমি বেঁচে থাকবো অনন্তকাল? আসলে প্রতিটি মুহূর্ত সবার জন্যই মূল্যবান। জীবন সবার কাছে একবারের জন্যই আসে। এই পৃথিবীর পর আর কোনও পৃথিবী নেই, কোনও দোযখ বেহেস্ত নেই, কোথাও আমাদের কোনও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একবার মরে গেলে আমাদের কারও সঙ্গে কারওর কোনওদিন আর দেখা হবে না। জীবন সকলেরই অনিশ্চিত। ছোটদা যখন বিছানায় শুয়ে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, বড়দাও, তখন বড়দারই হয়ে গেল একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। মরেও যেতে পারতো। ক্যানসার ভুগিয়ে মারে। হার্ট অ্যাটাক চোখের পলকে মারে।