দুটো…আরও তিনটে…তারপর আরও একটা। শেষটা একক, ফাইনাল শট। কিছুর যেন সমাপ্তি ঘটল।
লাগাম টেনে থেমে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল রনি, কিন্তু কিছু শোনা গেল না। আবার বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথমে ধীরে তারপর প্রচণ্ড ধারায়। হ্যাটটা সামনের দিকে কিছুটা টেনে নামিয়ে, বর্ষাতির কলার উঁচিয়ে কান দুটো প্রায় ঢেকে, গুলির শব্দ সম্পর্কে ভাবছে সে। একটা ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা ওর ঘাড়ের পিছনে পড়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নামল। শিউরে উঠে অন্ধকারের ভিতর সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঠাহর করে দেখার চেষ্টা করল সে।
অন্ধের মত গোলাগুলির এলাকায় হাজির হওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এই এলাকাটা তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, যেটুকু জানে সেটাও লোকের মুখে শোনা। এখন ট্রেইল ছেড়ে সরে গেলে হারিয়ে যাওয়াটা মোটেও বিচিত্র হবে না। হঠাৎ সে অনুভব করল ঘোড়ার পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। বিদ্যুতের চমকে দেখতে পেল একটা গাঢ় আকারের কিছু কাদার মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।
থেমে দাঁড়িয়ে আবার বিদ্যুৎ চমকাবার অপেক্ষায় রইল রনি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। লোকটার পিছনে যতদূর দেখা যায় দেখল-ট্রেইলটা খালি। এখানে যা ঘটেছে সেটা এখন শেষ। লোকটার পাশে নেমে ওকে চিত করল। মৃত সাদা একটা মুখের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল। দেহটা বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। একটা ম্যাচের কাঠি জ্বেলে বৃষ্টির থেকে আড়াল করে দেখল, আগের গুলিগুলোর আঘাতেই লোকটা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ গুলিটা করা হয়েছে। খুলির সাথে পিস্তল ঠেকিয়ে। গুলিতে লোকটার চামড়া আর চুল পুড়ে গেছে। লোকটার মৃত্যু ওরা একেবারে নিশ্চত করেছে।
লোকটার পকেট হাতড়ে কাগজ-পত্র টাকা পয়সা যা ছিল বের করে নিল রনি। ওগুলো তার আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকলে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কাগজ-পত্র থেকে হয়তো ওর পরিচয়টাও জানা যাবে। এই বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেখাগুলো দুর্বোধ্য হয়ে যাবে রক্ষা করা না হলে।
লোকটা নিজের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। পিস্তলটা এখনও ওর হাতেই ধরা রয়েছে। ওটা থেকে একটা গুলিও ছোঁড়া হয়েছে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওখানে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করল রনি। লোকটাকে স্টেজ থেকে জোর করে নামিয়ে নেয়া হয়েছিল। কারণ লোকটা ট্রেইলের একপাশে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ওকে তার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সুযোগ নিয়ে হেরে গিয়েছে। স্টেজের চাকার দাগ গভীর হয়ে ট্রেইলের ওপর বসে গেছে। হোল্ডআপ, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল রনি। লোকটা হয়তো নিজেই লাগতে গেছিল কিংবা জোর করে ওকে লাগতে বাধ্য করা হয়েছে। ওকে ঠিক কাঁচা বলা যাবে না, আগেও সে গান-ফাইট করেছে।
ঘোড়ার পিঠে চেপে ট্রেইল ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বিজলীর চমকে আরও একজনকে পড়ে থাকতে দেখে থামল। নেমে ঝুঁকে লোকটাকে ছুঁতেই সে ককিয়ে উঠল। সোজা হয়ে আবার বিদ্যুৎ চমকালে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট গুহা ওর চোখে পড়ল।
ঘোড়াকে জুনিপার গাছের সাথে বেঁধে রেখে লোকটাকে তুলে গুহায় নিয়ে এল রনি। ভিতরটা শুকনো। মরা একটা উপড়ে পড়া গাছের থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালাল সে। ভাল করে জ্বলে উঠলে কিছু পানি গরম করতে দিয়ে আহত লোকটার কোট আর শার্ট খুলে ফেলল। এক নজরেই বোঝা গেল লোকটা গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে।
প্ৰথম গর্তটা বাম পাশে নিচের দিকে কিছুটা মাংস কেটে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ওটার থেকে অনেক রক্ত বেরিয়েছে। পুরো জামা রক্তে ভেজা। কিছুটা উপরে আরেকটা জখম, ওটা মারাত্মক। ঠিক হার্টের একটু উপরে।
পানি গরম হলে, সময় নিয়ে ক্ষতগুলোকে ভাল করে ধুয়ে কিছুটা রোস্ট করা প্রিকলি-পেয়ার পাতা ছিলে শক্ত করে বেঁধে দিল। ফোলা কমানোর জন্যে ইণ্ডিয়ানরা এই ওষুধ ব্যবহার করে। বুলেটের ক্ষত রনির কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু সে জানে লোকটার বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। তবু লোকটার বয়স কম, শক্ত গড়ন, স্বাস্থ্যও ভাল, তাই বলা যায় না।
আরও কিছু কাঠ সংগ্রহ করে ঘোড়াটাকে গুহার ভিতরে এনে জিন খুলে দিল। ফিরে আসার সময়ে লক্ষ করল তার রুগীর চোখ খোলা। অবাক বিস্ময়ে লোকটা চারপাশে দেখছে। আরও এগিয়ে এসে রনি বলল, বিশ্রাম নাও, বন্ধু, খারাপ দুটো চোট পেয়েছ তুমি।
লোকটা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রশ্ন করল, কে, কে তুমি?
ভেসে বেড়াচ্ছি। আমার সামনে কিছু গোলাগুলির শব্দ পেলাম। যখন এগিয়ে এলাম একটা লাশ দেখতে পেলাম, তারপর তোমাকে।
তাহলে একজনকে আমি ঘায়েল করতে পেরেছি?
মনে হয় না। লোকটার পরনে একটা ফ্রক কোট ছিল। টুপিটা কালো। কঠিন চেহারা, গোঁফ লালচে।
ওহ। সে ছিল একজন যাত্রী। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। শ্বাসটা ভারি। লোকটা পরিচ্ছন্ন, সুদর্শনই বলা যায়। কোমরে দুটো পিস্তল ঝুলছে, এবং মনে হয় ওগুলোর ব্যবহার সে জানে।
কি ঘটেছিল? রনি প্রশ্ন করল।
ডাকাতি। আমি স্টেজের ছাদে শটগান নিয়ে পাহারায় ছিলাম। ওরা প্রথমেই আমাকে গুলি করেছিল, কিন্তু আমি টিকে রইলাম। ধারণা করেছিলাম ওদের একজনকে খতম করেছি। ওরা আবার আমাকে গুলি করলে আমি স্টেজকোচ থেকে পড়ে যাই। ওরা মুখোশ পরা ছিল। প্রত্যেকবারই তাই ঘটে।