যে তাকে দেখে সেই বলে, কী চমৎকার! ভাইকেতের বিপরীত দিকের আসনে বসে সে যখন তার দিকে তাকিয়েও সেই অপরিবর্তনীয় হাসিটি হাসল তখন ভাইকোঁত এমনভাবে কাঁধ দুটি তুলে দুই চোখ আনত করল যেন একটা অসাধারণ কিছু দেখে সে চমকে উঠেছে।
সহাস্যে মাথাটা কাৎ করে সে বলল, মাদাম, এ হেন শ্রোতৃবৃন্দের সামন কিছু বলবার সামর্থ্য সম্পর্কে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে।
প্রিন্সেস তার উন্মুক্ত সুডৌল বাহুখানিকে একটি ছোট টেবিলের উপর রাখল; কোনো জবাব দেওয়াই প্রয়োজন মনে করল না। হেসে অপেক্ষা করতে লাগল। যতক্ষণ গল্প বলা চলল ততক্ষণই সে সোজা হয়ে বসে রইল, কখনো চোখ রাখল তার সুডৌল বাহুখানির উপর, আবার কখনো বা সুন্দর বুকের উপর দৃষ্টি রেখে হীরের নেকলেসটিকে ঠিকভাবে বসিয়ে দিল। মাঝে মাঝে পোশাকের ভাঁজগুলোকে ঠিক করে নিল; আর যখনই গল্প বেশ জমে উঠেছে তখনই আন্না পাভলভনার দিকে তাকাচ্ছে, আর তার মুখের ভাবকে নিজের মুখে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে; তারপর আবার ফিরে যাচ্ছে তার উজ্জ্বল হাসিতে।
ছোট প্রিন্সেসও হেলেনের দেখাদেখি চায়ের টেবিল ছেড়ে চলে এসেছিল।
একটু অপেক্ষা করুন, আমার সেলাইটা নিয়ে আসছি।…এবার বলুন, কি ভাবছেন? প্রিন্স হিপোলিৎতের দিতে ফিরে বলল। আমার সেলাইয়ের থলেটা নিয়ে এস।
প্রিন্সেস যখন হাসিমুখে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলতে এসে বহাল তবিয়তে আসনে বসল সেই সময়টুকুতে সকলেই একবার নড়েচড়ে বসল।
এখন আমি স্থির হয়ে বসেছি, এই কথা বলে সেলাইটা হাতে নিয়ে সে ভাইকোঁতকে গল্প শুরু করতে বলল।
প্রিন্স হিপোলিৎ সেলাইয়ের থলেটা এনে দিয়ে বলে ভিড়ে গেল এবং একটা চেয়ার টেনে এনে ছোট প্রিন্সেসের গা ঘেঁষে বসল।
কে দেখে অবাক হতে হয়। সুন্দরী বোনটির সঙ্গে তার অসাধারণ মিল, অথচ তা সত্ত্বেও সে অত্যন্ত কুৎসিত। বোনের মতোই তার চোখ-মুখ, কিন্তু বোনের বেলায় যে মুখ আনন্দে, আত্মতৃপ্তিতে, যৌবনে সতত প্রাণবন্ত, হাসিতেও আশ্চর্য এক ধ্রুপদী দেহ-সুষমায় উজ্জ্বল, ভাইয়ের বেলায় সেই মুখ, অপদার্থতা ও আরোপিত এক বিপ্ন আত্মবিশ্বাসে ক্লিষ্ট; তার দেহ শীর্ণ ও দুর্বল। তার চোখ, নাক, মুখ, সবই যেন এক অর্থহীন বিষণ্ণ বিকৃতিতে ভরা; হাত ও পায়ের অবস্থান যেন সর্বদাই কেমন অস্বাভাবিক।
একটা ভূতের গল্প বলবেন না তো? প্রিন্সেসের পাশে বসে সে বলে উঠল। তাড়াতাড়ি সে তার চশমাটা ঠিক করে নিল, যেন এটা যন্ত্রটা ছাড়া সে কিছুই শুনতে পায় না।
ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বক্তা বলল, না, না, তা বলব না। । কারণ ভূতের গল্পকে আমি ঘৃণা করি, প্রিন্স হিপোলিৎ এমন সুরে কথাটা বলল যাতে মনে হয়, নিজের মুখে উচ্চারণ করলে তবেই সে কোনো কথার অর্থ বুঝতে পারে। এত বেশি জোর দিয়ে সে কথাটা বলল যে তার বক্তব্যটা খুব বুদ্ধিদীপ্ত না অত্যন্ত বোকা-বোকা সেটাই শ্রোতারা ঠিক বুঝতে পারল না। তার পরিধানে গাঢ় সবুজ রঙের ড্রেস-কোট, হালকা রঙের ব্রিচেস, জুতো ও রেশমি মোজা।
ভাইকোঁত সুন্দরভাবে গল্পটি বলল। ঘটনাটি তখন চলতি। দুক দএনঝিন গোপনে প্যারিতে গিয়েছিল মাদময়জেল জর্জের সঙ্গে দেখা করতে; সেখানে বোনাপার্টের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়, বোনাপার্তও ছিল সেই বিখ্যাত অভিনেত্রীটির অনুকম্পার অংশীদার; দুকের উপস্থিতিতেই বোনাপার্ত তার পুরনো মূৰ্ছারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, এবং তার ফলে দুকের একেবারে হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। কিন্তু সে বোনাপার্তকে ছেড়ে দেয়, আর পরবর্তীকালে বোনাপার্ত মৃত্যু দিয়ে সে উদারতার প্রতিদান দেয়।
গল্পটি যেমন সুন্দর, তেমনি আকর্ষণীয়, বিশেষ করে সেই জায়গাটায় যেখানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে চিনতে পারে; সেখানটায় মহিলারা খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
ছোট প্রিন্সেসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্না পাভলভনা বলে উঠল, মনোরম!
মনোরম! ফিস্ ফিস্ করে কথাটা বলে ছোট প্রিন্সেসও সেলাইতে একটা ছুঁচের ফোঁড় দিল; যেন গল্পের আকর্ষণে এতক্ষণ সে সেলাইটা করতে পারছিল না।
এই নীরব প্রশংসাকে সাদরে গ্রহণ করে ভাইকোঁত সকৃতজ্ঞ হাসি হেসে পুনরায় গল্প শুরু করতে প্রস্তুত হতেই আন্না পাভলভনা লক্ষ্য করল যে সেই যুবকটি মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে অত্যন্ত উদ্ধত ও সোচ্চারভাবে কথা বলে চলেছে; কাজেই সে তাড়াতাড়ি মঠাধ্যক্ষের উদ্ধারে এগিয়ে গেল। শক্তি-সাম্যের সমস্যা নিয়ে পিয়ের মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে একটা আলোচনার সূত্রপাত করেছে, আর মঠাধ্যক্ষও যুবকটির সরলতা ও আগ্রহ দেখে নিজের প্রিয় মতবাদটি তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। দুজনই সমান আগ্রহে ও সমান স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে ও শুনছে, আর তাতেই আন্না পাভলভনার যত আপত্তি।
মঠাধ্যক্ষ তখন বলে চলেছে, ইওরোপের শক্তি-সাম্য এবং জনগণের অধিকারই…পথ। এখন শুধু প্রয়োজন রাশিয়ার মতো কোনো শক্তিশালী জাতি-যদিও তাকে বর্বর বলা হয়ে থাকে–নিঃস্বার্থভাবে এসে একটি মিত্রশক্তির নেতৃত্ব গ্রহণ করুক, তার লক্ষ্য হোক ইওরোপে শক্তি-সাম্যকে অক্ষুণ্ণ রাখা; তাহলেই সে মিত্র-শক্তি পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে।
কিন্তু শক্তি-সাম্য কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখবেন? পিয়ের বলতে শুরু করল।
সেই মুহূর্তে আন্না পাভলভনা এসে হাজির হল; পিয়েরের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইতালিয় লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, রাশিয়ার আবহাওয়া তার কেমন লেগেছে। মুহূর্তের মধ্যে ইতালিয় লোকটির মুখের ভাব বদলে গিয়ে বেশি মিষ্টি-মিষ্টি হয়ে উঠল; মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক।