- বইয়ের নামঃ হাজি মুরাদ
- লেখকের নামঃ লিও তলস্তয়
- প্রকাশনাঃ প্রথমা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
হাজি মুরাদ
০১. গর্বাচভের খোলা হাওয়া
হাজি মুরাদ – লিও তলস্তোয় / অনুবাদ – কাজী জাওয়াদ
অনুবাদকের কথা
আশির দশকের শেষভাগে রাশিয়ায় গর্বাচভের খোলা হাওয়া বইছে। দমকা বাতাসে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীন হয়ে গেল। স্বায়ত্তশাসিত চেচেন-ইশ প্রজাতন্ত্র ভেঙে দুটো হলো! খোদ গর্বাচভ বিদায় নিলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন বরিস ইয়েলৎসিন।
আমার পালেও নতুন হাওয়া লাগায় পাড়ি জমাতে হলো বিলাতে। যোগ দিলাম বিবিসি বাংলা বিভাগে। তত দিনে নতুন দশক শুরু হয়েছে।
রাশিয়া তখন বিবিসির খবরের প্রধান এক বিষয়। বছর দুয়েক কাটলে চেচনিয়া প্রজাতন্ত্র নিজেরাই নাম নিয়ে নিল চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়া। এক গণভোটে এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন দুদায়েভ। ইয়েলৎসিনের সঙ্গে তার কোনো সম্ভব ছিল না, শত্রুভাব বরং। দুয়ের মধ্যে গালমন্দেরও কমতি নেই। দুদায়েভ একতরফাভাবে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলেন। ইয়েলৎসিন ও দুদায়েভের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ থাকার কারণে কোনো রকম সমঝোতা হতে পারেনি। শুরু হলো চেচনিয়ার বিদ্রোহ।
১৯৯৪-৯৫ সালের প্রাথমিক অভিযান শেষে গ্রজনি বিধ্বংসী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাশিয়ার ফেডারেল বাহিনী চেচনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার চেষ্টা করেছিল। রাশিয়ার জনশক্তি, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের যানবাহন, বিমানঘাঁটি ও বিমানসহায়তার দুর্দান্ত সুবিধা সত্ত্বেও চেচেনদের গেরিলাযুদ্ধ এবং সমতলভূমিতে চোরাগোপ্তা হামলা রুশ আক্রমণ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে রাশিয়ার জনসাধারণের সর্বজনীন বিরোধিতায় বরিস ইয়েলৎসিনের সরকার চেচেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ১৯৯৬ সালে শান্তিচুক্তি করে।
সে যুদ্ধের তীব্রতা বোঝা যাবে পরিসংখ্যান থেকে। রাশিয়ার সামরিক মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৫ হাজার ৭৩২, অনুমান ১৪ হাজারের বেশি। চেচেন বাহিনীর মৃত ও নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে বিভিন্ন অনুমানে তা ৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার ৪০০ জন। বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন হিসাবে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ এবং আহতের সংখ্যা ২ লাখ। প্রজাতন্ত্রজুড়ে শহর ও গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় ৫ লাখের বেশি লোক আশ্রয়হীন হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে চেচেন জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
বিবিসিতে চেচনিয়ার যুদ্ধের খবর পরিবেশন করেছি। চেচেন নেতা দুদায়েভের নেতৃত্বে যুদ্ধরত মুক্তিপিয়াসী মানুষের অদম্য মনোবলের খবর জানতে পেরেছি, মুগ্ধ হয়েছি। জেনেছি শহর ও গ্রামগুলোর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে খুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও চেচেনরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। নৈকট্য অনুভব করতাম তাদের সঙ্গে।
চেচেনদের ইতিহাস ঘেঁটে হাজি মুরাদের নাম পাই। তলস্তায়ের হাজি মুরাদআমাকে টেনে নেয়। আমাদেরও তো বিদ্রোহের, গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাস আছে। তাই তা অনুবাদ করার ইচ্ছা হয়।
ঔপন্যাসিকার শুরুতে দেওয়া থিসল ফুলটির বাংলা নাম বের করার ইচ্ছাও আমাকে পেয়ে বসে। বাংলায় নিশ্চয়ই তেজি গাছ আছে। কিন্তু সংগৃহীত কোনো ছবিতেই তা কাটা গেন্ধালির (নামটি ভুলে গিয়েছিলাম) মতো দেখতে না হওয়ায় কাজটি এগোয়নি। একদিন জুতসই একটি ছবি পেলাম। দুই বোন মোজেজা জহুরা আর ইসরাত জহুরা জানাল আমাদের এলাকায় তার নাম। আমার আলস্যের অজুহাত শেষে অনুবাদের কাজটা করতেই হলো।
ককেশীয় যুদ্ধের পটভূমি
ককেশীয় যুদ্ধ রাশিয়ার তিনটি জার প্রশাসনের সময় সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম আলেকজান্ডারের সময় (১৮০১-২৫), প্রথম নিকোলাসের সময় (১৮২৫-৫৫) এবং দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সময় (১৮৫৫-৮১ সালে)। ১৮১৬-২৭ সালে আলেক্সি পেট্রোভিচ ইয়েরোমোলভ, ১৮৪৪-৫৩ সালে মিখাইল সেমিওনিভিচ ভরন্তসভ এবং ১৮৫৩-৫৬ সালে আলেকজান্ডার বারিতিনস্কি শীর্ষস্থানীয় রুশ সেনাপতি ছিলেন।
লেখক মিখাইল লারমন্টোভ ও লিও তলস্তোয় এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তলস্তোয় তার যুদ্ধ ও শান্তি (ওয়ার অ্যান্ড পিস) উপন্যাসে এই যুদ্ধে পাওয়া অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শব্দবন্দী করেছিলেন। রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিন লর্ড বায়রনের কবিতার ধাঁচে লিখিত ককেশাসের বন্দী কবিতায় এই যুদ্ধের উল্লেখ করেছিলেন, ১৮২১ সালে তা লেখা হয়েছিল। সাধারণত ককেশীয় যুদ্ধে সেরা রুশ সৈন্যদের নেওয়া হতো; পাশাপাশি রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকেও তাদের বাছাই করা হতো। তাদের মধ্যে ছিল কসাক, আর্মেনীয়, জর্জীয়, ককেশীয় গ্রিক, ওসেটীয়, এমনকি তাতার, বাশকির ও তুর্কমেনীয়রা। কিছু ককেশীয় মুসলমান উপজাতিও রুশদের পক্ষে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছিল।
রুশ আক্রমণ ভীষণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। প্রথম দফায় যুদ্ধটি শেষ হয় প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যু এবং ১৮২৫ সালে ডিসেম্বরপন্থীদের বিদ্রোহের কাকতালীয় কারণে। (ডিসেম্বরপন্থী বিদ্রোহ ২৬ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম নিকোলাসের বড় ভাই কনস্ট্যান্টিন উত্তরাধিকারসূত্র থেকে সরে যাওয়ার পর প্রথম নিকোলাসের সিংহাসন দখলের প্রতিবাদে রুশ সেনা কর্মকর্তারা আনুমানিক ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ করেন। এই ঘটনা ডিসেম্বর মাসে ঘটেছিল বলে বিদ্রোহীদের ডিসেম্বরপন্থী বলা হতো।) ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের গ্রেট আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয়ের তুলনায় বিস্ময়করভাবে কম সাফল্য নিয়ে এটা শেষ হয়।