- বইয়ের নামঃ ওয়ার অ্যান্ড পিস
- লেখকের নামঃ লিও তলস্তয়
- প্রকাশনাঃ সালাউদ্দিন বইঘর
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
ওয়ার অ্যান্ড পিস
০১.১ জেনোয়া ও লুক্কা
ওয়ার অ্যান্ড পিস (যুদ্ধ এবং শান্তি) – অখণ্ড সংস্করণ – মূল রুশ থেকে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ
মূল : কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয়
সম্পাদনা : তপন রুদ্র
ভূমিকা
এক পৃথিবীতে এমন চারজন সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছেন যাদের সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। তাঁরা দেশকালের অতীত। সর্বযুগের মানুষের আশা-আকাক্ষা সাফল্য নৈরাশ্য অসাধারণ ভাষায় তাঁরা প্রকাশ করেছেন। স্ব-স্ব দেশকালের গভীরে প্রবেশ করে জগৎ ও জীবনের এক সর্বকালীন সুমহান তাৎপর্য তারা আবিষ্কার করে গেছেন। তাই তারা শুধু নিজের দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন, তাঁরা বিশ্বশ্রেষ্ঠ। এই চারজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হলেন হলেন–ইংল্যান্ডের শেক্সপিয়র, জার্মানির গ্যেটে, রাশিয়ার তলস্তয় এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথ।
শেক্সপিয়র ইংল্যান্ডের বুর্জোয়াযুগের ঐশ্বর্যকালীন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, গ্যেটে বিপুল জনজাগরণের অন্যতম ভাষ্যকার এবং রবীন্দ্রনাথ আমাদের গভীর উপলব্ধির মহৎদ্রষ্টা ও স্রষ্টা।
উনিশ শতকের রাশিয়া মহা ভাগ্যবান। একের পর এক দিকপাল সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাশিয়াকে এক শতকের মধ্যেই দীপ্যমান করে তুলেছিলেন। সাহিত্যের সকল শাখায় সাফল্য দেখা দিলেও উপন্যাসে ও ছোটগল্পে যে অভূতপূর্ব সমারোহ দেখা গিয়েছিল তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। পুশকিন, গোগোল, তুর্গিনেভ, দস্তয়ভস্কি, গোর্কি এবং কম বেশি শক্তিসম্পন্ন আরো অনেক কথাসাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং এঁদের সকলের শীর্ষে আছেন তলস্তয়। তিনি সর্বোত্তম। রুশসাহিত্যের গ্র্যান্ড মাস্টার।
কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয় ১৮২৮ সালের ২৬ আগস্ট ইয়াসিনা পলিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে তিনি রাশিয়ার অভিজাতশ্রেণীর অন্যতম একজন। তখনকার রাশিয়া বর্তমানের মতো শিল্পসমৃদ্ধ ছিল না। অভিজাতদের ঐশ্বর্যের জোগান দিত জমি থেকে আয়। কিন্তু তলস্তয় জমিদার হয়েও নিজের শ্রেণী থেকে নিজেকে মুক্ত করার সগ্রামে আজীবন কাটিয়ে গেছেন। নিজের শ্ৰেণীকে পরিত্যাগ করা কখনো সহজ হয় না। তলস্তয়ের পক্ষেও বিষয়টি সহজ হয়নি। ফলে সারা জীবন স্ববিরোধীতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। অনেক লোকের বাধা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি, জীবনের একটি পর্বে স্ত্রীর বিরাগভাজনও হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের অন্বেষা থেকে কখনো বিরত হননি তিনি।
রাশিয়ার কৃষকশ্রেণী তখন জেগে উঠেছে। বহু শতাব্দীব্যাপী ভূমিদাস প্রথার বিলোপ হল ১৮৬১ সালে। তলস্তয়ের তখন পূর্ণ যৌবনকাল। তিনি দেখেছেন, আইনত ভূমিদাসপ্রথা লুপ্ত হলেও কৃষকদের দাসত্ব ও দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি সমাজের এই পুঞ্জীভূত অন্যায় ও বেদনাকে দূর করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ চেষ্টা শুধু তাঁর লেখনীকে আশ্রয় করে পরিস্ফুট হয়নি। তাঁর জীবনচর্যাও এই মহৎ প্রচেষ্টাকে ব্যক্ত করেছে। নিজের জমিদারি ত্যাগের বাসনা এই জীবনচর্যারই একটি দিক। বিলাসবহুল অভিজাতসুলভ জীবনযাত্রাকে তাই অস্বীকার করে তিনি দরিদ্র চাষী হতে চেয়েছিলেন। আমার জীবনই আমার বাণী–এ মহৎ বাক্য এ যুগে তাই তলস্তয়ের জীবনেই সর্বাধিক সার্থক হতে পেরেছিল।
তলস্তয় শৈশবেই তার মা-বাবাকে হারান। তাঁর দুবছর বয়সে মায়ের এবং নয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হয়। এক নিকট আত্মীয়ের কাছে তিনি লালিত পালিত হন। রাশিয়ার অভিজাতদের উপযুক্ত শিক্ষা তাঁকে দেওয়া হয়। অন্যান্য বিদ্যার সঙ্গে ফরাসি ও জার্মান ভাষাও শেখেন। মোল বছর বয়সে কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাদান পদ্ধতি তাকে খুশি করতে পারেনি। ফলে স্নাতক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে কলেজ ছাড়েন। তারপর থেকে জীবনের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমনকি সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে জুয়ার আড্ডাতেও তাঁকে দেখা যেত। অবশেষে তখনকার রুশপ্রথা অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি ককেশাসে প্রেরিত হন। অতঃপর জুনিয়র অফিসার হিসেবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ-ফরাসি-তুর্কির মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এ সময়কার অভিজ্ঞতা থেকেই রচিত হয় সেবাস্তপোলের গল্পসমূহ। বিভিন্ন প্রণয় ব্যাপারেও তিনি কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলেন। ক্লিয়ার গ্লের্ডস অঞ্চলে চাষী ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য স্কুলও খুলেছিলেন। এখানেই তিনি তাঁর প্রগতিশীল শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। একসঙ্গে বহুমুখী কার্যধারা ও তাদের পরস্পরবিরোধী চরিত্র তলস্তয়ের মনে জটিল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেছিল। সারা জীবন তিনি এ দ্বন্দ্ব দিয়ে তাড়িত হয়েছিলেন।
তাঁর সাহিত্যজীবনের যথার্থ সূত্রপাত ঘটে ১৮৬২ থেকে। এই বছরেই তিনি সোফিয়া বেহস নামের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বয়সে সোফিয়া তার প্রায় অর্ধেক ছিলেন। তখন থেকে তিনি ইয়াসিয়ানা পলিয়ানায় বসবাস করতে থাকেন। এরপর থেকেই তার শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। দি কসাকস প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে। এ বছরেই লেখা শুরু করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড পিস। ১৮৭৩ সালে আনা কারেনিনা লেখা শুরু হয়। এ উপন্যাসটি শেষ হবার আগেই গভীর আত্মিক সংকটের চেহারা কিছুটা ব্যক্ত হয়েছে ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত কনফেশনস নামের গ্রন্থে।