.
অধ্যায়-৮
পরিচালনা সংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে নিকলাস মাঝে মাঝে চিন্তিত বোধ করত–সেটা বদমেজাজ আর ঘুষি চালানোর অনেক দিকের হুজারি অভ্যাস। প্রথম প্রথম সে এতে দোষের কিছু পেত না, কিন্তু বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই এধরনের দণ্ডবিধানের ব্যাপারে হঠাৎ তার মতটা বদলে গেল।
একবার গ্রীষ্মকালে সে বগুচারেভোর গ্রাম-প্রধানকে ডেকে পাঠাল। তার বিরুদ্ধে ছিল আচরণ ও নানারকম বিধিবহির্ভূত কাজের অভিযোগ। নিকলাস বাইরে গেল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। গ্রাম-প্রধান কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবার পরেই চেঁচামেচী ও ঘুষির শব্দ শোনা গেল। প্রাতরাশে যোগ দিতে এসে নিকলাস স্ত্রীর কাছে গেল। স্ত্রী, তখন সেলাইয়ের ফ্রেমটার উপরে ঝুঁকে বসে ছিল। সকালে সে কী কী করেছে তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে নিকলাস বগুচারেভোর গ্রাম-প্রধানের কথাও বলল। কাউরন্স মারির মুখ প্রথমে রক্তবর্ণ ও পরে বিবর্ণ হয়ে গেল মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে সে বসে রইল। স্বামীর কোনো কথার জবাব দিল না।
গ্রাম-প্রধানের কথা মনে হতেই রেগে টং হয়ে নিকলাস চেঁচিয়ে বলল, লোকটা এত বেহায়া আর পাজী। যদি আমাকে বলত যে মদ খেয়েছিল বলে সে কিছু দেখাশোনা করতে পারেনি…আরে, তোমার কি হয়েছে মারি? হঠাৎ নিকলাস প্রশ্ন করল। কাউন্টেস মারি মাথা তুলে কি যেন বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু তখনই আবার মুখ নামিয়ে নিল, ঠোঁট দুটি বেঁকে যেতে লাগল।
আরে, কি হয়েছে বল না লক্ষ্মীটি?
চোখে পানি এলে কাউন্টেস মারিকে বড় সুন্দর দেখায়। সে তো বেদনায় বা বিরক্তিতে কখনো কাঁদে না, কাঁদে দুঃখে ও করুণায়, আর তখনই তার দুটি উজ্জ্বল চোখে ফুটে ওঠে এক দুর্বার মোহ।
নিকলাস তার হাতটা ধরতেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, কাঁদতে শুরু করল।
নিকলাস, আমি সব দেখেছি…সে দোষ করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তুমি কেন নিকলাস! কাউন্টেস মারি দুই হাতে মুখ ঢাকল।
নিকলাস কিছুই বলল না। মুখ লাল করে স্ত্রীর কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। স্ত্রী কেন কাঁদছে তা সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু অন্তরের দিক থেকে তার সঙ্গে একমত হয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে শিশুকাল থেকে যাকে সে প্রাত্যাহিক ঘটনা বলে জেনে এসেছে সেটা অন্যায় কাজ। সে নিজেকেই শুধাল : এটা কি নেহাই মেয়েলিপনা, না কি তার বিচারই ঠিক? এ সমস্যার সমাধানের আগেই সে আর একবার স্ত্রী ভালোবাসা ও বেদনায় ভরা মুখখানির দিকে তাকাল, আর তখনই সহসা বুঝতে পারল যে তার স্ত্রীর কথাই ঠিক, এতকাল ধরে সে নিজেই ভুল পথে চলে এসেছে।
স্ত্রীর কাছে গিয়ে ধীর গলায় বলল, মারি, এ জিনিস আর কখনো ঘটবে না, আমি তোমাকে কথা দিলাম।
ক্ষমাপ্রার্থী বালকের মতো সে আর একবার বলল, কখনো না।
কাউন্টেসের দুই চোখে আরো বেশি করে জলের ধারা নামতে লাগল। স্বামীর হাতখানা নিয়ে তাতে চুমো খেল।
নিকলাসের আঙুলে পরা ছিল লাওকুনের মাথা খোদাই-করা পাথর বসানো একটা আংটি। সেটার দিকে তাকিয়ে কাউন্টেস মারি শুধাল, তোমার আঙ্গুলের পাথরটা কখন ভেঙে ফেললে?
আজই-ওই একই ব্যাপার। ও মারি, সেকথা আর আমাকে মনে করিয়ে দিও না! নিকলাসের মুখটা আবার রাঙা হয়ে উঠল। তোমাকে কথা দিচ্ছি, এ ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে না। ভাঙা আংটিটা দেখিয়ে বলল, আর এটাই হবে আমার প্রতিশ্রুতির স্মারক।
তারপর থেকে গ্রাম-প্রধান অথবা নায়েবদের সঙ্গে আলোচনাপ্রসঙ্গে যখনই নিকলাসের মুখে রক্ত উঠে আসে, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হতে শুরু করে, তখনই সে আঙুলের ভাঙা আংটিটা তুলে ধরে, আর যার উপরে সে রাগ করছিল তার সামনেই নিজের চোখ দুটো নামিয়ে আনে। কিন্তু পুরো বারোটি মাসের মধ্যে দু একবার সে প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও গেছে, তখনই সে স্ত্রীর কাছে গিয়ে সে ভুল স্বীকার করেছে এবং পুনরায় কথা দিয়েছে যে সেটাই শেষবার।
স্ত্রীকে বলত, মারি, তুমি আমাকে ঘৃণা কর। সেটাই আমার প্রাপ্য।
স্বামীকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টায় স্ত্রী বিষণ্ণ গলায় বলত, নিজেকে সংযত করবার মতো যথেষ্ট মনের জোর যদি তোমার না থাকে, তাহলে চলে যাও, এখনই চলে যাও।
এ তল্লাটের ভদ্রসমাজ নিকলাসকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু পছন্দ করত না। স্বীয় সমাজের স্বার্থ নিয়ে সে মাথা ঘামাত না, ফলে কেউ তাকে ভাবত অহংকারী, আবার কেউ ভাবত বোকা। সারা গ্রীষ্মকালটা সে খামারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। হেমন্তকালে চলে যেত শিকারে-একমাস, এমন কি দুমাসও বাড়ি ছেড়ে থাকত। শীতকালে অন্যগ্রামগুলি দেখতে যেত, আর পড়াশুনা করে সময় কাটাত। বেশির ভাগ পড়ত ইতিহাসের বই, আর সেজন্য প্রতি বছরই বেশ কিছু টাকা ব্যয় করত। এইভাবে একটা ভালো গ্রন্থাগার সে গড়ে তুলেছে, নিয়ম করে নিয়েছে, যত বই কেনা সব সে পড়বে। ক্রমে পড়াটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল, পড়তে বসলেই সে একটা ভীষণ ধরনের আনন্দ পায়। শীতকালটা বিশেষ কোনো কাজে বাইরে না গেলে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গেই কাটায়। এইভাবে স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ক্রমেই ঘনিষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল : প্রতিদিন স্ত্রীর মধ্যে আবিষ্কার করতে লাগল নব নব আত্মিক সম্পদ।
বিয়ের পর থেকে সোনিয়া নিকলাসের বাড়িতেই থাকে। বিয়ের আগে নিকলাস স্ত্রীকে সোনিয়া সম্পর্কে সব কথাই বলেছে, সব দোষ নিজের ঘাড়ি নিয়ে সোনিয়ার প্রশংসা করেছে। প্রিন্সেস মারিকে বলেছে, এই বোনটির প্রতি সে যেন সদয় ব্যবহার করে। কাউন্টেস মারি ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে নিকলাস সোনিয়ার প্রতি অবিচার করেছে, তার মনে হয়েছে, তার সম্পত্তির জন্যই নিকলাস তাকে পছন্দ করেছে। সোনিয়ার কোনো দোষ সে দেখতে পায়নি। তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতেই চেষ্টা করেছে, তবু অনেক সময় তার প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করেছে।