সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পরে শামিল একটা পশমের পরত লাগানো চাদর গায়ে তার স্ত্রীদের ঘরগুলোর দিকে গেলেন। সোজা ঢুকলেন আমিনার ঘরে। কিন্তু তাকে সেখানে পেলেন না। সে বড় বউদের সঙ্গে ছিল। শামিল দরজার পেছনে লুকিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু আমিনা তার ওপর খেপে ছিল। তিনি জাইদাকে রেশমি কাপড় দিয়েছেন, তাকে দেননি। সে তাকে তার ঘরে ঢুকে তাকে খুঁজতে দেখেছে। তাই ইচ্ছা করেই দেরি করছিল। জাইদার ঘরের দরজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। তার ঘরে শামিলের যাওয়া দেখে সে মনে মনে হাসছিল।
তার জন্য অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়ে শামিল যখন নিজের ঘরে ফিরে এলেন, তখন এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে।
২০. মেজরের বাড়িতে হাজি মুরাদ
২০
দুর্গে মেজরের বাড়িতে হাজি মুরাদের এক সপ্তাহ কেটে গেল। তিনি সঙ্গে মাত্র দুজন মুরিদ রেখেছিলেন–খানেফি আর এলডার। মেরি দমিত্রিয়েভনা নোংরা খানেফিকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেও হাজি মুরাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি ছিল পরিষ্কার। সে আর তাকে খাবার পরিবেশন করত না, সে কাজটা এলডারকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেকোনো সুযোগে হাজি মুরাদকে দেখতে বা সেবা করতে যেত। তার পরিবারের ব্যাপারে আলোচনায় তার খুব আগ্রহ ছিল। জানত তার স্ত্রী কজন। সন্তান কজন, তাদের বয়স কত। কোনো চর তার সঙ্গে দেখা করতে এলেই সে আলোচনার ফলাফল জানতে সব রকম চেষ্টা করত।
এই সপ্তাহে বাটলার আর হাজি মুরাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো সময় হাজি মুরাদ তার ঘরে যেতেন বা বাটলার যেত তার ঘরে। কখনো তারা দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলতেন, কখনো ইশারা-ইঙ্গিতে বা হাসিতে।
হাজি মুরাদ বাটলারকে পছন্দ করতেন বোঝাই যায়। তার সঙ্গে এলডারের সম্পর্ক দিয়ে সেটা বোঝা যায়। বাটলার হাজি মুরাদের ঘরে এলে এলডার মধুর হাসি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়, তার ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে। তাড়াতাড়ি একটা তাকিয়া নামিয়ে তাকে বসতে দেয়। তার তলোয়ার নিয়ে এলে তা খুলে রাখতে সাহায্য করে।
বাটলার হাজি মুরাদের ধর্মভাই নোংরা খানেফির সঙ্গেও ভাব জমিয়ে ফেলে। খানেফি অনেক পাহাড়ি গান জানত এবং গাইতও ভালো। বাটলারকে খুশি করার জন্য হাজি মুরাদ প্রায়ই খানেফিকে গান গাইতে বলতেন। নিজের পছন্দের গানগুলো গাইতে বলতেন। খানেফির গলা ছিল চড়া এবং অতি চমৎকার পরিষ্কার গলায় ভাবগুলো ফুটিয়ে গাইত। একটা গান হাজি মুরাদের বিশেষ পছন্দের। সেটার পবিত্র বেদনাবিধুর সুরে বাটলার অভিভূত। দোভাষীকে সে গানটির অর্থ করে দিতে বলেছিল।
গানটির বিষয়বস্তু হাজি মুরাদ ও খানেফিদের দুই বংশে শত্রুতা। তার কথাগুলো এমন :
আমার গোরের মাটি শুকিয়ে যাবে,
মা, মা গো আমার!
তুমি ভুলে যাবে যে আমায়,
আমার ওপর বয়ে যাবে ঘাসসিঁড়ি ঢেউ,
বাবা, আমার বাবা!
তোমাকেও বিধবে না আমার শোক!
যখন গভীর চোখে অশ্রু শুকোবে তোমার,
বোন, আমার বোন!
শোকে আর অস্থির হবে না তো কেউ!
তুমি তো আমার ভাই, বড় ভাই কখনো ভুলবে না,
আমার বদলা তুমি নিতে পারোনি!
তুমি তো আমার ভাই, ছোট ভাই করবে মাতম,
যত দিন না ঘুমাবে আমারই পাশে!
তপ্ত হয়ে এসেছিলে আমার অবজ্ঞার মৃত্যুবাহী গুলি,
তুমিই তো ছিলে আমার কৃতদাস!
এবং কষ্ণ মত্তিকা, ঘোড়ার পায়ের ঘায়ে হয়েছ মথিত!
তুমিই তো ঢেকে দেবে আমার শরীর!
হে মৃত্যু, শীতল চিত্রকলা একদা তো আমিই প্রভু, তোমার ঈশ্বর!
শরীর আমার ডুবে যাচ্ছে পৃথিবীর ভেতর;
স্বর্গে যাচ্ছে উড়ে আত্মা আমার।
হাজি মুরাদ সব সময় গানটি শুনতেন চোখ বুজে, দীর্ঘ টানে গানটি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেলে তিনি রুশ ভাষায় মন্তব্য করতেন, ভালো গান! জ্ঞানীদের গান!
হাজি মুরাদ আসার পর তার এবং তার মুরিদদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে পাহাড়িদের তেজস্বী জীবনের কাব্য বাটলারকে ভীষণ মুগ্ধ করে। নিজের জন্য সে একটা বেশমেত, একটা চাপকান আর আঁটসাঁট পায়জামা কেনে। কল্পনায় মনে করে সে পাহাড়িদের মতো জীবন কাটাচ্ছে।
হাজি মুরাদের যাওয়ার দিন তাকে বিদায় জানানোর জন্য মেজর কয়েকজন অফিসারকে দাওয়াত দিয়েছিল।
তারা বসে ছিল। কেউ কেউ বসে ছিল যে টেবিলে মেরি দমিত্রিয়েভনা চা ঢালছিল সেটায়, কেউ কেউ ভোদকা, চিখির ও কিছু খাবার রাখা টেবিলটায়। ভ্রমণের জন্য পোশাক পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজি মুরাদ হালকা দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলেন।
তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদের সঙ্গে হাত মেলাল। মেজর তাকে সোফায় বসতে বললে হাজি মুরাদ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসলেন গিয়ে জানালার পাশের একটা চেয়ারে।
ঘরে ঢোকার পর নীরবতা তাকে অপ্রস্তুত করেনি। তিনি মনোযোগ দিয়ে প্রত্যেকটি চেহারা দেখলেন এবং সামোভার ও খাবার রাখা টেবিলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাজি মুরাদের সঙ্গে উচ্ছল অফিসার পেত্রভস্কির সেই প্রথম দেখা। দোভাষীর মাধ্যমে সে জিজ্ঞেস করল তিবলিস তার ভালো লেগেছে কি না।
আলিয়া! তিনি জবাব দিলেন।
তিনি বলেছেন, হ্যা, দোভাষী বলল।
এখানকার কী তার ভালো লেগেছে?
হাজি মুরাদ জবাবে কিছু বললেন।
তার কাছে থিয়েটার সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
সেনাপ্রধানের বাড়িতে বলনাচের আসর তার ভালো লাগেনি?