একটা ছোরা। তার মাথায় লম্বা টুপিটার ওপরের দিকটা সমান, পাশে কালো ঝালর ঝোলানো। টুপিটার চারপাশে সাদা পাগড়ি। সেটার এক দিক তার কাঁধ ছুঁয়েছে। তিনি পরেছিলেন কিনারে নকশা করা আঁটসাঁট কালো পায়জামা আর সবুজ চপ্পল।
আসলে ইমাম উজ্জ্বল কিছু পরেননি। না সোনা, না রুপা। তার লম্বা খাড়া সুঠাম শরীর, অলংকারহীন পোশাক, সোনা-রুপা লাগানো কাপড় ও অস্ত্রসজ্জিত মুরিদরা তাকে ঘিরে রাখলে মানুষের মনে ঠিক তার কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া হয়। কীভাবে তা সৃষ্টি করতে হয়, সেটাও তিনি জানতেন। সুন্দর করে ছাঁটা লালচে দাড়ির ডৌলে আঁটা নিষ্প্রভ চেহারায় চোখ দুটো সব সময় কুঞ্চিত, যেন পাথরে খোদাই করা-অনড়। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার ওপর হাজারখানেক লোকের উৎসুক দৃষ্টি অনুভব করতে পারছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কারও দিকে তাকাননি।
ইমামের আগমন দেখার জন্য হাজি মুরাদের স্ত্রীরা বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বারান্দায় বের হয়ে এসেছিল। শুধু তার বৃদ্ধা মা ফাতিমা বাইরে যাননি। তার পাকা চুল ঝুলিয়ে ঘরের মেঝেয় বসে ছিলেন। তার হাঁটু দুটোকে বেড় দিয়ে রেখেছিল লম্বা হাত দুটো। আগুনের স্তূপে জ্বলন্ত কয়লাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকায় তার কালো চোখ দুটো জ্বলছিল। তার ছেলের মতো তিনিও সব সময় শামিলকে ঘৃণা করতেন। এখন আগের চেয়ে বেশি ঘৃণা করছেন এবং তাকে দেখতে চাননি। হাজি মুরাদের ছেলেও এই বিজয়ীর বেশে প্রবেশ দেখেনি। সে তার অন্ধকার তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত গর্তে বসে শুধু গুলি আর ধ্বনির শব্দ শুনেছে। স্বাধীনতাবঞ্চিত প্রায় তরুণেরা যেভাবে যন্ত্রণা অনুভব করে, সে-ও তেমনি করছিল। দুর্ভাগা, অপরিচ্ছন্ন এবং ক্লান্ত অন্য সহবন্দীদের দেখছিল। আর একে অন্যকে ঘেন্না করছিল। যারা তাদের ইমামের চারপাশে ঘোড়ার ওপর বসে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে প্রশস্তি গাইছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাদের ওপর তার গভীর হিংসা হলো।
গ্রামটি পার হয়ে শামিল তার বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে গেলেন। দুজন সশস্ত্র শান্ত্রি খোলা ফটকের কাছে তার দিকে এগিয়ে এল। পুরো আঙিনায় মানুষের ভিড়। অনেকেই বহুদূর থেকে নিজেদের কাজে এসেছে। কেউ কেউ দরখাস্ত নিয়ে এসেছে। কাউকে শামিল ডাকিয়ে এনেছেন বিচার করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। শামিল ভেতরে ঢুকলে সবাই দাঁড়িয়ে বুকের ওপর হাত রেখে সালাম দিল। তিনি আঙিনা থেকে অন্দরমহলে যাওয়া পর্যন্ত অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকল। তিনি জানতেন, আঙিনায় অপেক্ষাকারীদের অনেককে তিনি পছন্দ করেন না। অনেকে দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে আবেদন করছে। চেহারায় সেই স্থির পাথুরে দৃষ্টি রেখে সবাইকে কাটিয়ে তিনি অন্দরমহলে ঢুকলেন। ফটকের বাঁ দিকে নিজের ঘরের বারান্দার কাছে ঘোড়া থেকে নামলেন। তিনি যুদ্ধের ধকলে ক্লান্ত। যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক। কারণ, প্রকাশ্যে বিজয়ী হওয়ার ঘোষণা দিলেও ভালো করেই জানতেন তিনি পরাজিত। তিনি জানতেন, অনেক চেচেন গ্রাম পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। অস্থির চঞ্চল চেচেনরা দোমনা ছিল। আর সীমান্তের কাছের চেচেনরা রুশদের সঙ্গে যোগ দিতে তৈরি।
এগুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। এর বিহিত করা দরকার। কিন্তু সে মুহূর্তে শামিল কিছুই ভাবতে চাননি। তার শুধু একটাই চাহিদা-বিশ্রাম। তিনি চাইছিলেন পরিবারের মধ্যে থাকার আনন্দ আর তার প্রিয়তমা স্ত্রীর আদর। সেই আঠারো বছর বয়সী কালো চোখ চঞ্চল হরিণী ঠিক সে মুহূর্তে পুরুষ ও মেয়েদের আলাদা রাখার বেড়ার অপর দিকে ছিল। (শামিল নিশ্চিত ছিলেন, অন্য স্ত্রীদের সঙ্গে সে-ও বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখছিল। কিন্তু শুধু তার সান্নিধ্যে যাওয়াই অসম্ভব নয়, তিনি পালকের গদিতে শুয়ে পড়তেও পারছিলেন না। আগে তাকে জোহরের নামাজ পড়তে হবে। যার জন্য সেই মুহূর্তে তার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও মানুষের ধর্মীয় নেতা হিসেবে বাদ দিতে পারছিলেন না। নিজের জন্যও তা প্রতিদিনের খাদ্যের মতো। তাই তিনি অজু করে নামাজ পড়লেন এবং তার অপেক্ষায় থাকা লোকদের ডাকলেন।
প্রথমে এলেন জামাল উদ্দিন। তার শ্বশুর ও শিক্ষক। লম্বা পাকাচুল সুদর্শন বৃদ্ধ। বরফের মতো সাদা দাড়ি আর গোলাপি লাল চেহারা। দোয়া পড়ে তিনি শামিলের কাছে যুদ্ধের খবর জানতে চাইলেন। তার অনুপস্থিতিতে পাহাড়ে কী কী ঘটেছে, জানালেন।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে বংশগত শত্রুতার কারণে খুন, গরু-ভেড়া চুরি এবং তরিকা না মানার (ধূমপান ও মদ্যপান) অভিযোগ করলেন। জামাল উদ্দিন বললেন, হাজি মুরাদ তার পরিবারকে রুশদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কীভাবে নোক পাঠিয়েছিল। কিন্তু তা ফাঁস হয়ে গেলে তাদের ভিদেনোয় আনা হয়েছে। ইমামের সিদ্ধান্তের জন্য তাদের পাহারায় রাখা হয়েছে। জামাল উদ্দিন আরও বললেন, এসব বিষয় আলোচনার জন্য বয়স্করা তিন দিন মেহমানখানায় অপেক্ষা করছেন। তিনি শামিলকে সেগুলো শেষ করার পরামর্শ দিলেন!!
তার ঘরে জাইদা নামের কালো খাড়া-নাক কুশ্রী মহিলা খাবার পরিবেশন করল। শামিল তাকে ভালোবাসেন না কিন্তু সে তার বড় বউ। খেয়েদেয়ে শামিল গেলেন মেহমানখানায়।