কোনো চার্চ বা যেভাবে ফক্স চার্চকে বর্ণনা করতেন, স্টিপলহাউসের (বা চূড়াসহ দালান) প্রয়োজন নেই। যাজকদের কালো গাউন বা রঙিন পরিচ্ছদ, ক্যাথলিকদের বিস্তারিত ধর্মীয় আচার অথবা প্রটেস্টান্টদের কঠোর সরলতা ধর্মের এইসব আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো আসলে প্রার্থনাকারীদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে। একইভাবে মানুষের কোনো সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবিশ্বাস বা একটি তালিকারও দরকার নেই, যা তাদের বিশ্বাস করতেই হবে। এছাড়া অবশ্যই তাদের ধর্মীয় পুলিশেরও কোনো প্রয়োজন নেই, যারা সেগুলো সবাইকে অনুসরণ করতে বাধ্য করাবে! তাদের শুধু যা করতে হবে সেটি হচ্ছে, নীরবে পরস্পরের সাথে বসে। থাকতে হবে এবং হৃদয়ে পবিত্র আত্মার কথা বলে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ঈশ্বরের আলো ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে দীপ্যমান।
আর এই প্রস্তাবনাটি যথেষ্ট পরিমাণে বৈপ্লবিক ছিল। যদি এটি ব্যাপকভাবে মানুষের সমর্থন পেত তাহলে এটি সংগঠিত ধর্মগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত। কিন্তু আরো কিছু বিষয় ছিল, যেমন তাদের সেই অদ্ভুত সাহসী প্রস্তাবনা আর দাবিটি : সব মানুষের মর্যাদা সমান, নারী কিংবা পুরুষ, ক্রীতদাস অথবা স্বাধীন! চার্চ কিংবা রাষ্ট্র। ফক্সের এই দাবি মেনে নেবার জন্যে কেউই তখন প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তার কোয়েকার বন্ধুরা নিজেদের মতো করেই তাদের জীবন কাটাতে শুরু করেছিলেন। এর জন্য তাদের চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল। কয়েক হাজার কোয়েকার সদস্যকে তাদের বিশ্বাসের কারণে কারাবন্দি করা হয়েছিল, যাদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছিল কারাগারে।
অপ্রতিরুদ্ধ, তারা অসহায় আর গরিবদের মান উন্নয়নে যুদ্ধ করা অব্যাহত রেখেছিলেন। সেই নিষ্ঠুর যুগে, তারা জেলখানার কয়েদি আর মানসিক রোগীদের সাথে মানবিক আচরণ এবং হাসপাতালে উত্তম ব্যবস্থা করতে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তাদের সবচয়ে বড় অবদান ছিল, দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তাদের কঠোর বিরোধিতা, যা মানব-ইতিহাসে গভীর একটি প্রভাব ফেলেছিল। আর এটি শুরু হয়েছিল আমেরিকায়।
সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকেই উত্তর-আমেরিকা ইউরোপের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা এবং আরেকটি প্রতিশ্রুত দেশ খুঁজতে থাকা বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্যে একটি নিরাপদ গন্তব্য ছিল। আমেরিকার সেই নতুন বিশ্বে ব্যাপক ইউরোপীয় আগ্রাসন শুরু হয়েছিল এবং সেখানে বসতিস্থাপন করা অভিবাসীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে আগে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ইংল্যান্ডের কোয়েকাররা ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন উইলিয়াম পেন, ১৬৮২ সালে যিনি একটি উপনিবেশ তৈরি করেছিলেন, যা পরে পেনসিলভেনিয়া নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
কিন্তু ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীরা উত্তর-আমেরিকায় তাদের খ্রিস্টধর্ম ছাড়াও আরো অনেক কিছু সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিততম অশুভ পদ্ধতি, দাসপ্রথাও তারা তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। এটি ছিল একটি প্রাচীন আর বিশ্বজনীন নিষ্ঠুরতা, কিন্তু আমেরিকায় ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়ায় এই পদ্ধতির ব্যবহার একটি বাড়তি প্রণোদনা পেয়েছিল। তাদের দখল করা এই নতুন দেশের অসহনীয় কঠোর জমিতে চাষাবাদ করতে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের প্রচুরপরিমাণে শ্রমিকের দরকার পড়েছিল, যাদের তারা পশুর মতো খাটাতে পারবেন মৃত্যুর কোলে চুলেপড়া অবধি। ক্রীতদাসরাই তাদের এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে ক্রীতদাসও ছিল লভ্য।
যে জাহাজগুলো তথাকথিত ‘মিডল প্যাসেজে’ চলাচল করেছিল, সেগুলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের আখক্ষেত এবং আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কৃষি-খামারে কাজ করার জন্যে বহু মিলিয়ন ক্রীতদাসকে আফ্রিকার পশ্চিম-উপকূল থেকে বহন করে এনেছিল। আর এই মিডল প্যাসেজের সময় পরস্পরের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা, প্রায় বাতাসহীন জাহাজের গহ্বরে বন্দি অবস্থায়, লক্ষ লক্ষ আফ্রিকাবাসী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এছাড়া যদি আবহাওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠত, ক্যাপ্টেনরা তাদের জাহাজের ভার হালকা করতেন এই শিকল বাঁধা ক্রীতদাসদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।
ক্রীতদাসদের ডুবিয়ে হত্যা করা হোক, কিন্তু জাহাজের নিরাপত্তা যেন কোনো ঝুঁকির মুখে না পড়ে। অবশ্যই এটা শেষ পদক্ষেপ ছিল। কারণ এই দাসরা তাদের জন্য মূল্যবান পণ্য ছিল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ কিংবা ক্যারোলাইনা অবধি নিয়ে গেলে তাদের বিনিময়ে অন্য পণ্য যেমন, চিনি কিংবা তুলা বাণিজ্য করা যেত। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ব্রিটিশরা মূলত এই বাণিজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এই বাণিজ্যে স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছিলেন। এবং যখন তারা স্বদেশে ফিরে আসতেন তাদের বিস্মরণপূর্ণ অবসর জীবন কাটাতে, তখন তারা বসবাসের জন্যে সুবিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করতেন, যেখানে তারা তাদের বৃদ্ধজীবন কাটিয়ে দিতেন। এরকম বহু প্রাসাদ ব্রিটিশ গ্রামাঞ্চল এখনো অলংকৃত করে রেখেছে। কিন্তু এই খ্রিস্টানরা কীভাবে এই অমানবিক আর অশুভ বাণিজ্যে তাদের অংশ নেবার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত করেছিলেন?
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, বাইবেলে ক্রীতদাসপ্রথাটি স্বাভাবিক, যেভাবে চলছে সেভাবেই গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। এটাই ছিল সেই সময়ের প্রচলিত নিয়ম। আর এটি অবশ্যই যিশুর বার্তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু আদি খ্রিস্টানদের এই বিষয়ে কিছু না-করার একটি বৈধ অজুহাত ছিল। কারণ তারা আশা করেননি যে, এই পৃথিবী, যেভাবে এটি নিজেকে সংগঠিত করে রেখেছে, খুব বেশিদিন আর টিকে থাকবে না। কারণ যিশু খুব শীঘ্রই ফিরে আসবেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য উদ্বোধন করতে, যখন স্বর্গে যেভাবে সবকিছু হয় তেমনভাবেই সবকিছু পরিচালিত হবে এই পৃথিবীতেও। আর এমন কিছু ঘটার আগ অবধি খ্রিস্টানদের পাপমুক্ত বিশুদ্ধ জীবন কাটানো এবং শেষদিনের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা উচিত। আর পৃথিবী যেমন আছে সেভাবেই তারা বিষয়গুলো অপরিবর্তিত রেখেছিলেন। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে, পল নিজেই ক্রীতদাস অনেসিমাসকে। তার মালিক ফিলেমনের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তিনি তার প্রতি সদয় আচরণ করতে অনুরোধ করেছিলেন, কারণ অনেসিমাস এখন তার মতোই যিশু-বিশ্বাসী একজন অনুসারী। কিন্তু সেখানে তাকে মুক্ত করে দেওয়া তার উচিত হবে, এমন কোনো প্রস্তাবনা কখনোই ছিল না। আর সেটি করেই বা কী লাভ হবে, যদি তারা বিশ্বাসই করে থাকেন এই সবকিছুই খুব শীঘ্রই শেষ হতে যাচ্ছে?