বইয়ের নামঃ আন্না কারেনিনা
- লেখকের নামঃ লিও তলস্তয়
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
আন্না কারেনিনা – প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা – ১.১
প্রতিহিংসা আমার; আমিই তাহা শুধিব, বলিলেন সৃষ্টিকর্তা।
এক
সকল সুখী পরিবারের সুখের অনুভূতিগুলো একে অন্যের মত; প্রতিটা অ-সুখী পরিবারের অ-সুখের কারণগুলো নিজের নিজের ধরনে।
অবলোনস্কির পরিবারের সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী জানতে পারলেন যে, বাড়ির পুরানো ফরাসি গৃহশিক্ষিকার সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। স্বামীকে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, তার সাথে এক বাড়িতে বাস করতে আর পারবেন না। গত তিন দিন ধরে এরকম অবস্থা চলছে। খোদ দম্পতি এবং পরিবারের অন্যান্য লোক আর চাকর-বাকরদের কাছেও তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সকল সদস্য এবং চাকর-বাকররা বুঝতে পারছিল যে, আর একসাথে থাকার কোন অর্থ হয় না। সরাইখানায় অকস্মাৎ মিলিত লোকদের মধ্যেও তাদের চেয়ে, অবলোনস্কি পরিবারের লোক আর চাকর-বাকরদের চেয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক বেশি থাকে। স্ত্রী নিজের ঘর থেকে আর বেরোচ্ছেন না। স্বামী আজ তিন দিন বাড়িতে নেই। ছেলেমেয়েরা আশ্রয়হীনের মত সারা বাড়ি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে; ইংরেজ মহিলাটি ঝগড়া বাঁধালেন ভাণ্ডারিনীর সাথে এবং অন্য কোন জায়গায় কাজ খুঁজে দেবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিরকুট পাঠালেন বান্ধবীর কাছে। বাবুর্চি গতকালই দিবাহারের সময় বাড়ি ছেড়ে গেছে। রান্নাঘরের– পরিচারিকা আর কোচোয়ানও কাজ ছেড়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি সমাজে যাঁকে বন্ধু-বান্ধবরা ‘স্তিভা’ বলে ডাকে–ঝগড়া-বিবাদের পর তৃতীয় দিনে–যথাসময়ে অর্থাৎ সকাল আটটায় তার ঘুম ভাঙল স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, নিজের কাজের ঘরে, মরক্কো চামড়ায় মোড়া একটা সোফায়। সোফার গদিতে পুরুষ্টু অসার দেহটা ঘুরিয়ে অন্য দিক থেকে সজোরে বালিশ আলিঙ্গন করে গাল ঠেকালেন তাতে; তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন, সোফায় বসে চোখ মেলে তাকালেন।
স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ায় ভাবলেন, তাই তো, তাই তো, কি যেন হয়েছিল? হা, কি হয়েছিল? হ্যাঁ, আলাবিন একটা ভোজের আয়োজন করেছিল ডার্মস্টাটে, কিংবা হয়ত আমেরিকান কিছু। হ্যাঁ, ওই ডার্মস্টাক্ট ছিল আমেরিকায়। হু, আলাবিন ভোজ দিচ্ছিল কাঁচের টেবিলে। আর টেবিলগুলো ইতালীয় ভাষায় গান গাইছিল : আমার গুপ্তধন, আরে না, আমার গুপ্তধন নয়, তার চেয়েও ভালো, আর ছোট ছোট কেমন সব পানপাত্র, আর তারা সব নারী, তার মনে পড়ল।
অবলোনস্কির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল এবং হাসিমুখে তিনি বিভোর হয়ে রইলেন। ‘হ্যাঁ, ভীষণ জমেছিল। বেশ ভালো। আরো কত কি যে ছিল চমৎকার, কথায় তা বলা যায় না, জাগা অবস্থায় চিন্তাতেও তা ফোঁটানো যায় না।’ তারপর শাটিনের পর্দার পাশ দিয়ে এসে পড়া এক ফালি আলো দেখে সোফা থেকে পা বাড়িয়ে খুঁজলেন স্ত্রীর বানানো সোনালি মরক্কোর এম্ব্রয়ডারি করা জুতা (গত বছর জন্মদিনে তার জন্য উপহার) এবং না উঠে ন’বছরের অভ্যাসমত হাত বাড়ালেন যেখানে শয়নকক্ষে টাঙানো থাকত তার ড্রেসিং গাউন। আর তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল– কেন তিনি তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, ঘুমাচ্ছেন নিজের কাজের ঘরে; এবার তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কপাল কুঁচকালেন এবং কি হয়েছিল তা মনে করে ককিয়ে উঠলেন, ‘উহ্, উহ্, উহ্! আহ!’ তার কল্পনায় আবার ভেসে উঠল : স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার সমস্ত খুঁটিনাটি, তাঁর অবস্থার সমস্ত নিরুপায়তা আর সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক তাঁর নিজ অপরাধের কথা।
তিনি ভাবলেন, ‘না, ও ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করতে পারে না। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, সব কিছুর জন্য আমার দোষ, আমার দোষ, কিন্তু আমি তো দোষী নই। আর সেটাই তো ট্রাজেডি। তাঁর পক্ষে এই ঝগড়ার সবচেয়ে কষ্টকর দিকগুলোর কথা ভেবে তিনি বলে উঠলেন, উহ্, উহ্, উহ্!’
সবচেয়ে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটেছিল সেই প্রথম মুহূর্তটা, যখন তিনি হাসি-খুশি হয়ে স্ত্রীর জন্য প্রকাণ্ড একটা নাশপাতি হাতে থিয়েটার থেকে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না ড্রয়িংরুমে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাজের ঘরেও তার দেখা পাওয়া গেল না। শেষে তাকে শোবার ঘরে পেলেন। সব কিছু ফাঁস হয়ে-যাওয়া হতভাগা সেই চিরকুটটা তার হাতে।
সব সময়ই শশব্যস্ত, উদ্বিগ্ন এবং স্বামী যা ভাবতেন, বোকা-সোকা তার ডল্লি চিরকুট হাতে নিস্পন্দ হয়ে বসে। আছেন, এবং আতঙ্ক, হতাশা আর ক্রোধের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। চিরকুটটা দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা? এটা?
আর অবলোনস্কিকে কষ্ট দিচ্ছিল এই স্মৃতিচারণায়। যা প্রায়ই হয়ে থাকে, আসল ঘটনাটা নয়, স্ত্রীর এই প্রশ্নে যেভাবে তিনি জবাব দিয়েছিলেন সেটা।
হঠাৎ করে যদি বড় বেশি লজ্জাকর কিছু-একটায় ধরা পড়ে যাওয়া লোকের ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে সে মুহূর্তে তার তাই ঘটেছিল। অপরাধ ফাঁস হয়ে যাবার পর স্ত্রীর সামনে যে অবস্থায় তিনি পড়েছিলেন, তার জন্য নিজেকে তৈরি করে তুলতে তিনি পারলেন না। অপমানিত বোধ করা, অস্বীকার করা, কৈফিয়ত দেওয়া, মার্জনা চাওয়া, এমন কি নির্বিকার থাকার বদলে তিনি যা করলেন তার তুলনায় এ সবই হত ভালো!–তাঁর মুখে একেবারে অনিচ্ছাকৃতভাবে (‘মস্তিষ্কের প্রতিবর্তী ক্রিয়া’, ভাবলেন অবলোনস্কি, যিনি শারীরবৃত্ত ভালোবাসতেন)–একেবারে অনিচ্ছায় হঠাৎ ফুটল তাঁর অভ্যস্ত, সদাশয় এবং সেই কারণেই বোকাটে হাসি।
এই বোকাটে হাসিটার জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না; সেই হাসি দেখে ডল্লি যেন শারীরিক যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলেন। তারপর তার স্বাভাবিক উত্তপ্ততায় চোখা চোখা কথার বন্যা তুলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। তিনি সেই থেকে আর স্বামীকে দেখতে চাননি।
অবলোনস্কি ভাবলেন, ‘ওই বোকাটে হাসিটারই সকল দোষ।’ তিনি হতাশ হয়ে নিজেকেই বললেন, ‘কিন্তু কি করা যায়? কি করি?’ তবে এ কথার কোন উত্তর পেলেন না।
দুই
অবলোনস্কি নিজের প্রতি খুবই সত্যনিষ্ঠ মানুষ। তিনি তাঁর আচার-আচরণের জন্য অনুতপ্ত–এ কথা বলে তিনি নিজেকে ভোলাতে পারেন না। এখন তিনি অনুশোচনা করতে পারেন না যে তিনি, চৌত্রিশ বছরের সুদর্শন, প্রেমাকুল পুরুষ পাঁচটা জীবিত ও দুটো মৃত সন্তানের জননী, তার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন না। তাঁর অনুশোচনা শুধু এজন্য যে, স্ত্রীর কাছ থেকে আরো ভালো করে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারেননি। তবে তিনি নিজের অবস্থার গুরুত্ব সবই টের পাচ্ছিলেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং নিজের জন্য মায়া হচ্ছিল তার। খবরটা স্ত্রীর ওপর কেমন রেখাপাত করবে তা জানা থাকলে হয়ত তিনি তার অপরাধ আরো ভালো করে চাপা দিতে পারতেন। প্রশ্নটা নিয়ে তিনি কখনো পরিষ্কার করে ভাবেননি, কিন্তু ঝাপসাভাবে তার মনে হত যে, অনেকদিন থেকেই স্ত্রী আন্দাজ করেছেন যে তিনি তার প্রতি বিশ্বস্ত নন এবং সেটায় গুরুত্ব দেন না। তার এমন কি এও মনে হত যে শীর্ণা, বুড়িয়ে-আসা, ইতিমধ্যেই অসুন্দরী নারী, কোন দিক থেকেই যে উল্লেখযোগ্য নয়, সাধারণ, নিতান্ত সংসারের সহৃদয়া জননী; ন্যায়বোধে তার উচিত প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা।
অবলোনস্কি বারবার নিজেকেই বললেন, ‘আহ্, ভয়ানক ব্যাপার! ইস্, ইস্, ইস্! ভয়ানক!’ কিন্তু কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না : ‘অথচ এর আগে পর্যন্ত সব কিছু কি ভালোই না ছিল! কি সুন্দর দিন কাটছিল আমাদের! উনি ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখী, সন্তুষ্ট, কোন কিছুতে ওঁর অসুবিধা ঘটাইনি আমি। উনি যা চাইতেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ওঁকে দিয়েছি। তবে ঐ মেয়েটা যে আমাদের গৃহশিক্ষকা ছিল, সেটা ভালো হয়নি। ভালো নয়! গৃহশিক্ষিকার প্রতি প্রেম নিবেদনে কেমন একটা তুচ্ছতা, মামুলিপনা আছে। কিন্তু কেমন গৃহশিক্ষিকা! (জীবন্ত হয়ে ওঁর মনে ভেসে উঠল মাদমোয়াজেল রোলার কালো চোখ আর মিষ্টি হাসি)। কিন্তু যতদিন সে আমাদের বাড়িতে ছিল ততদিন আমি নিজেকে কিছু করতে দিইনি। সবচেয়ে খারাপ এই যে, ও এখন…এসব যেন ইচ্ছে করেই! উহ্, উহ্, উহ্! কিন্তু কি করা যায় এখন?’
সকল জটিল অমীমাংসেয় প্রশ্নের যে সাধারণ উত্তর দেয় জীবন, তাছাড়া অন্য কোন উত্তর ছিল না। সেটা এই: দিনের চাহিদা মত বাঁচতে হবে, অর্থাৎ বিভোর হয়ে থাকতে হবে। স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা চলে না, অন্তত রাত পর্যন্ত পানপাত্র নারীরা যে গান গেয়েছিল ফেরা যায় না তাতে; তাহলে জীবনের স্বপ্নেই বিভোর হয়ে থাকা উচিত।
অবলোনস্কি মনে মনে বললেন, তখন দেখা যাবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, নীল রেশমি আস্তর দেওয়া ধূসর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে, থুপিতে বাঁধন দিয়ে, প্রশস্ত বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে খুশি হয়ে, তার পুরুষ্টু দেহ অত অনায়াসে বহন করে যে পদদ্বয়, তাতে তার অভ্যস্ত, উফুল্ল, পাক দেওয়া কদম বাড়িয়ে গেলেন জানালার কাছে। পর্দাটা সরিয়ে ঘণ্টি দিলেন। ঘণ্টি শুনেই তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকল পুরানো বন্ধু, খাস চাকর মাতভেই, গাউন জুতা আর টেলিগ্রাম নিয়ে। মাতভেইয়ের পিছু পিছু ক্ষৌরকমের সাজসরঞ্জাম নিয়ে নাপিত এল।
অবলোনস্কি টেলিগ্রামটা নিয়ে আয়নার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অফিস থেকে কাগজ আছে।’
মাতভেই জবাব দিল, ‘টেবিলে আছে।’ তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সহমর্মিতায় মনিবের দিকে তাকিয়ে ধূর্ত হেসে যোগ করল, ‘ঘোড়া গাড়ির মালিকের কাছ থেকে লোক এসেছিল।’
অবলোনস্কি কোন জবাব না দিয়ে আয়নায় তাকালেন মাতভেইয়ের দিকে; আয়নায় যে দৃষ্টি বিনিময় হল, তাতে বোঝা যায় পরস্পরকে তারা কতটা বোঝে। অবলোনস্কির দৃষ্টি যেন বলছিল, এ কথা কেন বলছিস? তুই কি জানিস না?
মাতভেই তার জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে নীরবে, ভালো মনে, একটু-বা হেসে তাকিয়ে ছিল তার মনিবের দিকে।
সে বলল, ‘আমি বলেছিলাম ওই রবিবারে আসতে। এর মাঝখানে যেন আপনাকে আর নিজেকে মিছেমিছি বিরক্ত না করে।’ বোঝা যায় কথাটা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল।
অবলোনস্কি বুঝলেন যে মাতভেই রসিকতা করতে, নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে। টেলিগ্রামটা ছিঁড়ে বরাবরের মত ছিন্ন শব্দগুলো অনুমান করে সেটা তিনি পড়লেন, তাঁর মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
‘মাতভেই, বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা কাল আসছে’, তিনি মিনিটখানেক নাপিতের চেকনাই মোটা হাতের দিকে না তাকিয়ে বললেন। কোঁকড়া দুই গালপাট্টার মাঝখানে সে হাত গোলাপি সেতু রচনা করছিল।
মাতভেই বলল, হায় আল্লাহ্! জবাবটায় সে বোঝাতে চাইল যে মনিবের মত সেও বোঝে এই আগমনের গুরুত্ব। অর্থাৎ অবলোনস্কির স্নেহের বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা স্বামী-স্ত্রীর মিল করিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারেন।
মাতভেই জিজ্ঞেস করল, ‘একা, নাকি স্বামীর সাথে?
অবলোনস্কি কোন কথা বলতে পারলেন না। কেননা নাপিত তখন তার ওপরের ঠোঁট নিয়ে ব্যস্ত। উনি একটা আঙুল তুললেন। আয়নায় মাথা নাড়ল মাতভেই।
‘বেশ। ওপর তলায় ব্যবস্থা করব?
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে বল, যেখানে বলবে সেখানে।
কেমন যেন সন্দিহান হয়ে পুনরুক্তি করল মাতভেই, দারিয়া আলেকসান্দ্রভনাকে?’
হ্যাঁ, ওঁকে বল। আর এই টেলিগ্রামটা নে, কি উনি বললেন–জানাস।
যাচাই করে দেখতে চাইছেন?’ মাতভেই বুঝল ব্যাপারটা। কিন্তু শুধু বলল, ‘জ্বি আচ্ছা।
মাতভেই যখন টেলিগ্রাম হাতে বুট জুতার কাঁচকেঁচে শব্দ তুলে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরে ঢুকল, অবলোনস্কি ততক্ষণে বোয়া-পাকলা হয়ে চুল আঁচড়ে পোশাক পরার উপক্রম করছেন। নাপিত চলে গেছে।
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা জানাতে বলেছেন যে, উনি চলে যাচ্ছেন। ওঁর, তার মানে আপনার যা খুশি তাই করুন, সে বলল শুধু চোখ দিয়ে হেসে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ঘাড় কাত করে মনিবের দিকে তাকিয়ে।
অবলোনস্কি চুপ করে রইলেন। পরে সহৃদয় কিন্তু খানিকটা করুণ হাসি ফুটে উঠল তাঁর সুন্দর মুখে।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ্যাঁ? মাতভেই?
মাতভেই বলল, ‘ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হয়ে যাবে?
‘জ্বি হ্যাঁ।
দরজার ওপাশে মেয়েলী পোশাকের খসখস শব্দ শুনে অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর তাই মনে হচ্ছে? কে ওখানে?’
‘জ্বি, এটা আমি’, সাড়া এল দৃঢ় মোলায়েম নারীকণ্ঠে, দরজার বাইরে থেকে বসন্তের দাগ ধরা কঠোর মুখখানা বাড়ালেন আয়া মাত্রেনা ফিলিমনোভনা।
অবলোনস্কি দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল, মাত্রেনা?’
অবলোনস্কি স্ত্রীর কাছে পুরোপুরি দোষী হলেও এবং নিজেও সেটা অনুভব করলেও বাড়ির সবাই, এমন কি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার প্রধান বান্ধবী আয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে।
তিনি ক্লান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তা কি হল?
‘মিটিয়ে নিন, নয় দোষ স্বীকার করুন। সৃষ্টিকর্তা দেখবেন। খুবই যাতনা পাচ্ছেন, দেখতে কষ্ট লাগে। বাড়ির সব কিছুই একেবারে এলোমেলো। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য একটু মায়া হওয়া উচিত। দোষ মেনে নিন। কি করা যাবে। ভালোবাসার দায় অনেক।
‘আমাকে তো নেবে না…’
‘আপনার যা যা করার করুন না। সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়ালু, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন! ক্ষমা চান!
অবলোনস্কি হঠাৎ লাল হয়ে উঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও এখন। মাতভেইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, যাক গে, পোশাক পরা যাক’, এবং দৃঢ় ভঙ্গিতে ছাড়লেন ড্রেসিং গাউনটা।
অদৃশ্য কি-একটা জিনিসকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে দিতে মাতভেই আগে থেকেই শার্টটা ধরে ছিল, সুস্পষ্ট তৃপ্তির সাথে মনিবের সযত্নমার্জিত শরীরে তা পরিয়ে দিল।
তিন
অবলোন্স্কি পোশাকটা পরার পর সেন্ট মেখে তার শার্টের হাতা ঠিক করে নিলেন এবং অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেট, মানিব্যাগ, দেশলাই, দুটো চেন আর পেন্ডেন্ট লাগানো ঘড়ি পকেটে ঢোকালেন, তারপর রুমাল ঝাড়া দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুরভিত, সুস্থ আর নিজের দুর্ভাগ্যটা সত্ত্বেও শারীরিকভাবে উৎফুল্ল অনুভব করে দু’পা সামান্য নাচিয়ে নাচিয়ে ডাইনিং-রুমে ঢুকলেন। সেখানে তার জন্য ইতিমধ্যেই কফি প্রস্তুত আর কফির পাশে রয়েছে কয়েকটা চিঠি আর কর্মচারীদের দাখিলা। তিনি সেখান থেকে তুলে নিয়ে চিঠিগুলো পড়লেন। একটা চিঠি বড়ই অপ্রীতিকর, তার স্ত্রীর সম্পত্তির অন্তর্গত বন কিনছে যে বেনিয়া, সে লিখেছে। বনটা বিক্রি করা অত্যাবশ্যক ছিল; কিন্তু এখন, স্ত্রীর সাথে মিটমাট না-হওয়া পর্যন্ত সে কথাই ওঠে না। সবচেয়ে অপ্রীতিকর এই যে, এতে স্ত্রীর সাথে মিটমাটের ব্যাপারে আর্থিক স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে। এই স্বার্থে তিনি চালিত হতে পারেন, এই বিক্রির জন্য তিনি স্ত্রীর সাথে মিটমাট চাইবেন, এ ভাবনাটাই তার কাছে অপমানকর বলে মনে হল।
অবলোনস্কি চিঠি পড়া শেষ করে কর্মচারীদের দাখিলাগুলো টেনে নিলেন। দ্রুত পাতা উটিয়ে গেলেন দুটো মামলার, বড় একটা পেনৃসিলে কয়েকটা মন্তব্য টুকলেন, তারপর কাগজপত্রগুলো সরিয়ে শুরু করলেন কফি খেতে; কফির পর তিনি তখনো সোঁদা সোঁদা প্রভাতী কাগজ খুলে পড়তে লাগলেন।
যে সাহিত্যিক উদারনৈতিক সংবাদপত্রটি চরমপন্থী নয়, কিন্তু অধিকাংশই ছিল যার মতামতের পেছনে, অবলোনস্কি তা পেতেন এবং পড়তেন। বিজ্ঞান বা শিল্প বা রাজনীতি, কিছুতেই আসলে তার আগ্রহ না থাকলেও এসব ব্যাপারে অধিকাংশ লোকের এবং তার পত্রিকার যা মতামত তিনিও তাই পোষণ করতেন এবং সেটা পালটাতেন শুধু যখন অধিকাংশ লোক সেটা পালটাত, অথবা বলা ভালো, পালটাত না, নিজেরাই তাতে অলক্ষ্যে বদলে যেত।
অবলোনস্কি মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি বাছবিচার করে গ্রহণ করতেন না। এগুলো তার কাছে আসত আপনা থেকেই। ঠিক যেমন টুপির আকৃতি বা ফ্রক-কোট তিনি তাই বেছে নিতেন লোকে যা পরে। আর উঁচু সমাজে যিনি বাস করছেন, যেখানে কিছুটা মস্তিষ্কচালনা যা পরিপক্বতার কালে সাধারণত বিকশিত হয়ে ওঠে, সেখানে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একটা টুপি থাকার মতই সমান প্রয়োজন। তাঁর মহলের অনেকেও রক্ষণশীল মতবাদ পোষণ করত, তার বদলে তিনি কেন উদারনৈতিক ধারা পছন্দ করলেন তার যদি কোন কারণ থেকে থাকে, তাহলে সেটা এই নয় যে উদারনৈতিক মতবাদ তাঁর কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে ঠেকেছিল, উদারনৈতিক ধারাটার মিল ছিল তাঁরই জীবনযাত্রার সাথে । উদারনৈতিক পার্টি বলত যে রাশিয়ায় সবই খারাপ এবং সত্যিই অবলোনস্কির ঋণ ছিল প্রচুর আর টাকায় একেবারে কুলাচ্ছিল না। উদারনৈতিক পার্টি বলত যে বিবাহ একটা অচল প্রথা, ওটাকে ঢেলে সাজা দরকার আর সত্যিই পারিবারিক জীবন অবলোনস্কিকে তৃপ্তি দিয়েছে কম, তাকে মিথ্যা কথা বলতে, ভান করতে বাধ্য করেছে যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। উদারনৈতিক পার্টি বলত, অথবা বলা ভালো ধরে নিত যে ধর্ম হল কেবল অধিবাসীদের বর্বর অংশকে বলগায় টেনে রাখার ব্যাপার, এবং সত্যিই ছোট একটা প্রার্থনাতে অবলোনস্কির পা ব্যথা করে উঠত এবং তিনি বুঝতে পারতেন না কেন পরলোক নিয়ে ঐ সব ভয়াবহ, বড় বড় কথা, যখন ইহলোকেই দিন কাটানো এত আনন্দের। সেই সাথে হাসি-খুশি রসিকতার ভক্ত অবলোনস্কি নিরীহ কোন লোককে এই বলে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতে আনন্দ পেতেন যে বংশ নিয়ে গর্ব যদি করতেই হয়, তাহলে রিউরিকেই থেকে গিয়ে প্রথম বংশপিতা বানরকে অস্বীকার করা অনুচিত। এভাবে উদারনৈতিক মতবাদ একটা অভ্যাস হয়ে ওঠে অবলোনস্কির কাছে এবং নিজের কাগজটিকে তিনি। ভালোবাসতেন আহারের পর একটা চুরুটের মত, মাথায় যে একটা হালকা কুয়াশা তাতে দেখা দিত, তার জন্য। সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি পড়লেন, তাতে বলা হয়েছে যে আমাদের কালো খামোকাই এই বলে চিৎকার তোলা হচ্ছে যে র্যাডিকেলিজম বুঝি সমস্ত রক্ষণশীল উপাদানকে গ্রাস করে ফেলার বিপদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের নাকি উচিত বৈপ্লবিক সর্পদানবকে দমন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া, উলটে বরং আমাদের মতে বিপদটা সর্পদানবে নয়, সমস্ত প্রগতি রুদ্ধ করা সনাতনতার একগুয়েমিতে’, ইত্যাদি। অর্থ বিষয়ে আরেকটা প্রবন্ধ তিনি পড়লেন, যাতে বেন্থাম ও মিল-এর উল্লেখ করে খেচা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিদপ্তরকে। নিজের প্রকৃতিগত দ্রুত কল্পনাশক্তিতে প্রতিটি খেচার অর্থ তিনি বুঝতেন : কার কাছ থেকে, কার উদ্দেশে, কি উপলক্ষে এসব খোঁচা শাণিত আর বরাবরের মত এতে তিনি। খানিকটা তৃপ্তি পেতেন। কিন্তু আজ এ তৃপ্তি বিষিয়ে গেল মাত্রেনা ফিলিমনোভনার উপদেশে আর বাড়িটা যে কি অশান্তিকর হয়ে উঠেছে সে কথা মনে পড়ে গিয়ে। তিনি আরো পড়লেন যে শোনা যাচ্ছে কাউন্ট বেইস্ট ভিসবাডেনে গেছেন, সাদা চুল আর নেই, হালকা ঘোড়াগাড়ি বিক্রি হচ্ছে, তরুণ জনৈক ব্যক্তি কি প্রস্তাব দিয়েছে; কিন্তু এসব খবরে আগের মত মৃদু অন্তর্ভেদী আনন্দ আর পেলেন না।
পত্রিকা পড়া, দ্বিতীয় পাত্র কফি আর মাখন-লাগানো মিহি কুটি শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ওয়েস্ট-কোট থেকে ঝেড়ে ফেললেন রুটির গুড়ো। ঝেড়ে ফেলে চওড়া বুক টান করে আনন্দে হাসলেন। সেটা এজন্য নয় যে, অন্তর তাঁর বিশেষ প্রীতিকর কোন কিছুতে ভরে উঠেছিল; সানন্দ হাসিটা এসেছিল খাদ্যের উত্তম পরিপাক থেকে।
এই সানন্দ হাসিটা তাকে তৎক্ষণাৎ সব কিছু মনে পড়িয়ে দিয়েছিল এবং চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি।
দরজার ওপাশে শোনা গেল দুটো শিশু কণ্ঠ (অবলোনস্কি চিনতে পারলেন ছোট ছেলে গ্রিশা আর বড় মেয়ে তানিয়ার গলা)। কি-একটা তারা নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা পড়ে গেল।
‘আমি যে তোকে বলেছিলাম ছাদে প্যাসেঞ্জার বসাতে নেই’, মেয়েটা ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নে, এখন কুড়োয়
সব তালগোল পাকিয়েছে। শিশুরা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে একা একা, ভাবলেন অবলোনস্কি। দরজার কাছে গিয়ে তিনি তাদের ডাকলেন। যে কাসকেটটা ট্রেন হয়েছিল, সেটাকে ফেলে দিয়ে তারা বাবার কাছে এল।
মেয়েটা বাবার প্রিয়পাত্রী। সোৎসাহে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আর বরাবরের মতই খুশি হয়ে উঠল সেন্টের পরিচিত গন্ধে, যা ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর জুলপি থেকে। নুয়ে থাকার ফলে আরক্ত আর কমনীয়তায় জ্বলজ্বলে মুখে বাবাকে চুমু খেয়ে মেয়েটা আবার ছুটে যেতে চাইল; কিন্তু বাবা তাকে ধরে রাখলেন।
মায়ের কি হল?’ মেয়ের মসৃণ নরম গালে হাত বুলিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হেসে তিনি তাকে স্বাগত জানালেন।
অবলোনস্কি জানতেন যে, ছেলেটাকে তিনি কম ভালবাসেন, সব সময় চেষ্টা করতেন সমান চোখে দেখতে; কিন্তু ছেলেটা তা টের পেত, বাবার নিষ্প্রাণ হাসির জবাব সে দিল না হাসি দিয়ে।
মেয়েটা জবাব দিল, মা? বিছানা ছেড়ে উঠেছেন।
অবলোনস্কি নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, তার মানে আবার ঘুমায়নি সারা রাত!
মেজাজ ভালো?
মেয়েটা জানত যে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। মা খুশি থাকতে পারছেন না, বাবার সেটা জানার কথা, কিন্তু বাবা ভান করে সে কথা জিজ্ঞেস করছেন অমন অনায়াসে। বাবার জন্য লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল। অবলোনস্কি
তখনই সেটা বুঝে নিজেও লাল হয়ে উঠলেন।
মেয়েটা বলল, কি জানি, মা পড়ায় বসতে বললেন না। বললেন আজ মিস হল-এর সাথে বেড়াতে যা নানীর কাছে।
‘তা যা-না, তানচুরোচকা (বিশেষ সাদরে বলা ‘তানিয়া’ নাম) আমার। ও হ্যাঁ, দাঁড়া’, মেয়েটাকে তখনো ধরে রেখে তার নরম হাতে হাত বুলোত বুলোতে তিনি বললেন।
তিনি গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার প্লেসের ওপর এক কৌটা মিষ্টি রেখেছিলেন। সেটা নিয়ে তা থেকে তার প্রিয় দুটো বনবন দিলেন মেয়েকে। একটায় চকোলেটের অন্যটায় পমেদকার প্রলেপ।
চকোলেটটা দেখিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, গ্রিশাকে।
হ্যাঁ। তারপর আরেকবার তার কাঁধে হাত বুলিয়ে চুলের গোড়ায় আর গালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে।
মাতভেই বলল, গাড়ি তৈরি, তারপর যোগ করল, তাছাড়া উমেদারনিও।
অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেকক্ষণ?
‘আধঘণ্টা থেকে।
কতবার না তোকে বলা হয়েছে যে তখনই খবর দিবি!
আপনাকে অন্তত কফি খেতেও তো দিতে হয়, মাতভেই বলল এমন একটা ভালোমানুষি রূঢ় গলায় যাতে রাগ করা চলে না।
‘নে, তাড়াতাড়ি ডেকে আন’, বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন অবলোনস্কি।
উমেদারনি স্টাফ-ক্যাপ্টেন কালিনিনের স্ত্রী। তিনি যা চাইলেন সেটা অসম্ভব ও অর্থহীন; কিন্তু তাঁর যা স্বভাব অবলোনস্কি বাধা না দিয়ে মন দিয়ে তার কথা শুনলেন এবং বিস্তারিত পরামর্শ দিলেন কার কাছে কিভাবে আবেদন করতে হবে, এমন কি নিজের বড় বড় দীর্ঘায়ত, সুন্দর এবং নিখুঁত হস্তাক্ষরে একটা চিরকুট লিখে দিলেন জনৈক ব্যক্তির কাছে যিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। স্টাফ-ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে বিদায় দিয়ে অবলোনস্কি টুপি তুলে নিলেন, তারপর থেমে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন কিছু ভুলে যাননি তো। দেখা গেল যেটা তিনি ভুলতে চাইছিলেন– স্ত্রীকে–সেটা ছাড়া কিছুই তিনি ভোলেননি।
‘হুঁ। মাথা নিচু করলেন তিনি, তাঁর সুন্দর মুখে ফুটে উঠল কষ্টের ছাপ। মনে মনে তিনি বললেন, যাব কি যাব না? আর ভেতরের একটা কণ্ঠস্বর তাঁকে বলছিল, যাবার দরকার নেই। মিথ্যাচার ছাড়া এক্ষেত্রে আর কিছুই হবার নয়। তাদের সম্পর্ক শোধরানো, ঠিকঠাক করে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা অসম্ভব আবার ওকে আকর্ষক উন্মাদক প্রেম দেওয়া অথবা নিজেকে ভালোবাসতে অক্ষম বৃদ্ধ করে তোলা। এখন অসত্য আর মিথ্যা ছাড়া কিছুই দাঁড়াবে না; কিন্তু অসত্য আর মিথ্যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।
কিন্তু এক সময় তো ওটা দরকার; এটা যে এভাবেই থেকে যাবে সেটা তো হতে পারে না, নিজেকে সাহস দেবার চেষ্টা করে তিনি বললেন। বুক টান করলেন তিনি। সিগারেট ধরিয়ে দু’বার টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন ঝিনুকের ছাইদানিতে, দ্রুত পায়ে বিষণ্ণ ড্রয়িংরুম পেরিয়ে অন্য দরজাটা খুললেন–স্ত্রীর শয়নকক্ষে।
চার
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রাউজ পরে আছেন। এককালের ঘন সুন্দর চুল এখন পাতলা হয়ে এসেছে। মাথার পেছনে তার বিনুনি কাঁটা দিয়ে গোঁজা। ভয়ানক শুকিয়ে যাওয়া রোগা মুখে আর মুখের শীর্ণতার ফলে সুপ্রকট হয়ে ওঠা ভীত চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরময় ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্রের মধ্যে খোলা শিফোনিয়েরকার সামনে, যা থেকে তিনি কি সব বাঁচাই করছিলেন। স্বামীর পদশব্দ শুনে তিনি থেমে গেলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বৃথাই চেষ্টা করলেন মুখে একটা কঠোর, ঘৃণাব্যঞ্জক ভাব ফুটিয়ে তুলতে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, স্বামীকে তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং ভয় পাচ্ছেন আসন্ন সাক্ষাৎ। এইমাত্র তিনি যার চেষ্টা করছিলেন, এই তিন দিনে সেটা তিনি করেছেন দশবার; ছেলেমেয়েদের এবং নিজের জিনিসপত্র বেছে তা নিয়ে চলে যাবেন মায়ের কাছে–এবং আবার মনস্থির করতে পারলেন না; কিন্তু আগের মত এখনো তিনি মনে মনে বলছিলেন, এটা এভাবেই থাকতে পারে না, কিছু-একটা তাকে করতে হবে, শাস্তি দিতে, কলঙ্কিত করতে হবে ওঁকে। স্বামী তাকে যে যাতনা দিয়েছে তার খানিকটার জন্যও অন্তত প্রতিহিংসা নিতে হবে। তিনি তখন বলছিলেন যে স্বামীকে ছেড়ে যাবেন, কিন্তু টের পাচ্ছিলেন যে সেটা অসম্ভব; ওঁকে স্বামী বলে ভাবায় এবং ভালোবাসায় অনভ্যস্ত হয়ে তিনি অক্ষম। তাছাড়া তিনি টের পাচ্ছিলেন, এখানে, নিজের বাড়িতেই যদি তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করে ওঠা সহজ না হয়, তাহলে ওদের সবাইকে নিয়ে তিনি যেখানে যাবেন সেখানে তো আরো খারাপই দাঁড়াবে। আর এই তিন দিন ছোটটার জন্য তার কষ্ট হচ্ছিল কারণ ছোটটাকে খাওয়ানো হয়েছে বিছিরি বুলিয়ন আর বাকিগুলো তো কাল সন্ধ্যায় না খেয়েই ছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে চলে যাওয়া অসম্ভব; কিন্তু তাহলেও আত্মপ্রতারণা করে তিনি জিনিসপত্র বাছছিলেন, ভান করছিলেন যে চলে যাবেন।
স্বামীকে দেখে তিনি শিফোনিয়েরকার ড্রয়ারে হাত ঢোকালেন যেন কি খুঁজছেন আর তার দিকে তাকালেন শুধু যখন স্বামী এসে পড়লেন একেবারে কাছে। কিন্তু যে মুখখানায় তিনি একটা কঠোর, অনমনীয় ভাব ফোঁটাতে চেয়েছিলেন, তাতে ফুটল বিহ্বলতা আর যাতনা।
‘ডল্লি! স্বামী বললেন মৃদু, ভীরু ভীরু গলায়। মাথাটা তিনি কাঁধের দিকে খুঁজলেন, চেয়েছিলেন একটা করুণ বশংবদ চেহারা দাঁড় করাবেন, তাহলেও জ্বলজ্বল করছিলেন তাজা আমেজ আর স্বাস্থ্যে। ক্ষিপ্ৰ দৃষ্টিপাতে তার জ্বলজ্বলে সতেজ স্বাস্থ্যবান মূর্তিটা ডল্লি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ও সুখী, সন্তুষ্ট! ভাবলেন তিনি, আর আমি…আর ওর এই সদয়তাটাও বিছিরি যার জন্য সবাই ভালোবাসে তাকে, প্রশংসা করে, দেখতে পারি না ওর এই সদয়তা, ভাবলেন তিনি। বিবর্ণ, স্নায়বিক মুখের ডান দিককার পেশী কেঁপে উঠে ওর ঠোঁট চেপে বসল।
কি চাই আপনার?’ বললেন তিনি নিজের স্বাভাবিক নয়, দ্রুত, জোরালো গলায়।
‘ডল্লি! কাঁপা কাঁপা গলায় পুনরুক্তি করলেন স্বামী, আন্না আজ আসছে।
‘তাতে আমার কি? আমি ওকে বরণ করতে পারব না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন উনি।
‘কিন্তু করতে হয় যে, ডল্লি…’
‘চলে যান, চলে যান, চলে যান! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, যেন চিৎকারটা এল দৈহিক কোন যন্ত্রণা থেকে।
স্ত্রীর কথা মনে পড়ে শান্ত থাকতে পারতেন অবলোনস্কি, আশা করতে পারতেন যে মাততেইয়ের কথামত সব ঠিক হয়ে যাবে, এবং নিশ্চিন্তে কাগজ পড়তে আর কফি খেতে পারতেন; কিন্তু যখন তিনি দেখলেন স্ত্রীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট, আর্ত মুখ, শুনলেন ভাগ্য ও হতাশার কাছে আত্মসমর্পিত এই কণ্ঠধ্বনি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার, গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠল, অশ্রুতে চোখ চিকচিক করে উঠল।
‘হায় সৃষ্টিকর্তা! এ আমি কি করলাম! ডল্লি! সৃষ্টিকর্তার দোহাই!…এ যে…’ কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না, গলায় দেখা দিল একটা ফোঁপানি।
স্ত্রী শিফোনিয়েরকার ড্রয়ার বন্ধ করে তাকালেন তার দিকে।
‘ডল্লি, কি আর বলব? শুধু একটা কথা; ক্ষমা কর আমাকে ক্ষমা কর…ভেবে দেখো, নয় বছরের জীবনে কি এক মিনিট, এক মিনিটের খণ্ডন হয় না…’
চোখ নিচু করে স্ত্রী শুনে গেলেন, যেন অনুনয় করছিলেন স্বামী কোনরকমে তার সন্দেহ নিরসন করুক।
স্বামী বললেন, ‘এক মিনিটের মোহ…’ এবং আরো বলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু এই কথাটাতেই যেন শারীরিক যন্ত্রণায় আবার চেপে বসল স্ত্রীর ঠোঁট, আবার মুখের ডান দিকে কেঁপে উঠল গালের পেশী।
‘চলে যান, চলে যান এখান থেকে!’ আরো তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, আপনার মোহ আর জঘন্যতার কথা আমাকে বলতে আসবেন না!
চলে যেতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু শরীর দুলে উঠল, ভর দেবার জন্য চেয়ারের পিঠটা ধরলেন। স্বামীর মুখ স্ফীত হয়ে উঠল, ফুলে উঠল ঠোঁট, অশ্রুতে সজল হয়ে উঠল চোখ।
‘ডল্লি!’ ফুঁপিয়ে বললেন তিনি, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো। ওদের তো দোষ নেই, দোষী আমি, আমাকে শাস্তি দাও, সে দোষ স্থালন করতে বলে। আমি যতটা পারি, সব কিছুর জন্য আমি তৈরি! আমি দোষী, কতটা যে দোষী বলার নয়। কিন্তু ডল্লি, ক্ষমা কর।
স্ত্রী বসলেন। ওঁর গুরুভার, সজোর নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল স্বামীর, স্ত্রীর জন্য অবর্ণনীয় মায়া হল তার। স্ত্রী কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। স্বামী অপেক্ষা করে রইলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা তুমি ভাবছ ওদের সাথে খেলা করার জন্য, আর আমি ভাবছি আর জানি যে ওরা এবার মারা পড়ল’, বললেন স্ত্রী, বোঝা যায় এ তিন দিন একাধিক বার যেসব কথা তিনি মনে মনে বলেছেন, এটা তার একটা।
উনি বললেন, ‘তুমি’, এতে স্বামী কৃতার্থে মত চাইলেন ওঁর দিকে, এগিয়ে গেলেন ওঁর হাতটা ধরতে, কিন্তু উনি ঘৃণাভরে সরে গেলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা আমার মনে হচ্ছে, তাই ওদের বাঁচাবার জন্য দুনিয়ায় সব কিছু করতে পারতাম; কিন্তু আমি নিজেই জানি না কি করে বাঁচাই; বাবার কাছ থেকে ওদের নিয়ে গিয়ে কি, নাকি ব্যভিচারী বাপের কাছে রেখে যেয়ে হ্যাঁ, ব্যভিচারী বাপ…বলুন তো, যা… ঘটেছে তার পরে কি আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব? সে কি সম্ভব? বলুন-না, সে কি সম্ভব? গলা চড়িয়ে আবার বললেন তিনি, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়েদের বাবা নিজের ছেলেমেয়েদের গভর্নেসের সাথে প্রেম সম্পর্কে যানার পর…’
‘কিন্তু কি করা যায়? কি করা যায়? স্বামী বললেন করুণ স্বরে, নিজেই জানতেন না কি বলছেন, ক্রমেই নুয়ে এল তার মাথা।
‘আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার লোক, ন্যক্কারজনক!’ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে চেঁচালেন স্ত্রী, আপনার কান্না নেহাৎ পানি! কখনো আমাকে ভালোবাসেননি আপনি; আপনার হৃদয়ও নেই, উদারতাও নেই! আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার, নীচ, বাইরের লোক, হ্যাঁ, একেবারে বাইরের লোক! এই ভয়ঙ্কর বাইরের লোক’ কথাটা উনি উচ্চারণ করলেন যন্ত্রণায় আর আক্রোশে।
অবলোনস্কি স্ত্রীর দিকে তাকালেন আর তাঁর মুখে ফুঠে ওঠা আক্রোশ তাঁকে ভীত ও বিস্মিত করল। উনি বোঝেননি যে ওঁর মায়াটার স্ত্রীর পিত্তি জ্বলে গেছে। এতে তিনি দেখছেন অনুকম্পা, প্রেম নয়। আমাকে ও ঘৃণা করে। ক্ষমা করবে না, ভাবলেন স্বামী।
তিনি বললেন, কি ভয়ঙ্কর! ভয়ঙ্কর!
এই সময় অন্য ঘরে, সম্ভবত পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শিশু; দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা কান পেতে শুনলেন, মুখখানা তার হঠাৎ নরম হয়ে এল। বোঝা যায় কয়েক সেকেন্ড লাগল তার চেতনা ফিরতে, যেন বুঝতে পারছিলেন না কোথায় তিনি আছেন, কি তাকে করতে হবে, তারপর দ্রুত উঠে গেলেন দরজার দিকে।
‘আমার ছেলেটাকে ও যে ভালোবাসে, শিশুর চিৎকারে ওঁর মুখের ভাব পরিবর্তন লক্ষ্য করে স্বামী ভাবলেন, : ‘আমার ছেলে; কি করে সে ঘৃণা করতে পারে আমাকে?
তিনি স্ত্রীর পিছু পিছু গিয়ে বললেন, ‘ডল্লি, আরো একটা কথা।’
‘আপনি যদি আমার পেছন পেছন আসেন, তাহলে আমি লোকদের, ছেলেমেয়েদের ডাকব! সবাই জানুক যে আপনি একটা বদমায়েস। আজ আমি চলে যাব আর আপনি এখানে থাকবেন আপনার প্রণয়িনীর সাথে!
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে উনি বেরিয়ে গেলেন।
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মুখ মুছলেন, মৃদু পায়ে গেলেন ঘর বরাবর। মাতভেই বলছে ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু কেমন করে? এমন কি তার লক্ষণও আমি দেখছি না। উহ্, কি ভয়ংকর! আর কি হেঁদোভাবেই না চেঁচাল, চিৎকার আর বদমায়েশ ও প্রণয়িনী কথা দুটো স্মরণ করে মনে মনে ভাবলেন তিনি, হয়ত-বা মেয়েগুলোর কানে গেছে! সাংঘাতিক, ছেঁদো, সাংঘাতিক!’ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন অবলোনস্কি, চোখ মুছলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুক টান করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
দিনটা শুক্রবার, ডাইনিংরুমে জার্মান ঘড়ি-বরদার দম দিচ্ছিল ঘড়িতে। এই টেকো জার্মান ঘড়ি-বরদার সম্পর্কে নিজের রসিকতাটা মনে পড়ল তাঁর : ঘড়িতে দম দেওয়ার জন্য জার্মানটিকেই দম দেওয়া হয়েছে সারা জীবনের জন্য, মুখে হাসি ফুটল। ভালো ভালো রসিকতা অবলোনস্কি ভালোবাসতেন। আর হয়ত ঠিক হয়েই যাবে! ঠিক হয়ে যাবে–বেশ কথাটি’, ভাবলেন তিনি, তা বলতেই হবে।’
মাতভেই! হাঁক দিলেন তিনি। মাতভেই আসতে বললেন, তাহলে আন্না আর্কাদিয়েভনার জন্য সোফার ঘরে সব গোছগাছ করে রাখ।
‘জ্বি আচ্ছা।’
অবলোনস্কি তার কোট চাপিয়ে গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
মাতভেই তাকে এগিয়ে দিতে এসে জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে যাবেন না?’
‘যেমন দাঁড়াবে। হ্যাঁ, এই নে খরচার জন্য, মানিব্যাগ থেকে বের করে দশ রুল ওকে দিয়ে বললেন তিনি। ‘এতে হবে তো?
‘হোক না-হোক, দেখা যাবে, চালিয়ে নিতে হবে, এই বলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাতভেই গাড়ি বারান্দায় উঠে এল।
ইতিমধ্যে ছেলেটাকে শান্ত করে গাড়ির শব্দে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা বুঝলেন যে উনি চলে গেলেন। আবার নিজের শোবার ঘরে ফিরলেন তিনি। বেরোতেই যেসব সাংসারিক ঝামেলা হাজির হত, তা থেকে এটাই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়। এমন কি এখনো, অল্প সময়ের জন্য যখন তিনি শিশুদের ঘরে গিয়েছিলেন, ইংরেজ মহিলাটি আর মাত্রেনা ফিলিমনোভনা তার ভেতর এমন কিছু ব্যাপার তাঁকে জিজ্ঞেস করে ওঠার ফুরসত করে নিলেন যা মুলতবি রাখা যায় না এবং একমাত্র তিনি যার উত্তর দিতে পারেন : বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য বাচ্চাদের কি পোশাক পরানো হবে? দুধ খেতে দেব কি? অন্য একটা বাবুর্চি ডাকলে হয় না?
‘আহ, আমাকে রেহাই দাও, রেহাই দাও!’ এই বলে তিনি ফিরলেন শোবার ঘরে। স্বামীর সাথে যেখানে বসে কথা কয়েছিলেন আবার বসলেন সেই চেয়ারেই, অস্থিল আঙুল থেকে খসে পড়ো-পড়া কয়েকটা আংটি সমেত হাত জড়ো করে মনে করতে লাগলেন ভূতপূর্ব কথাবার্তাটা। চলে গেল! কিন্তু তার সাথে দেখা করবে? কেন জিজ্ঞেস করলাম না ওকে? না-না, মিলন চলে না। আমরা যদি এক বাড়িতেও থাকি, তাহলেও আমরা হব বাইরের লোক। বরাবরের মত বাইরের লোক!’ তার কাছে ভয়ংকর এই কথাটায় বিশেষ অর্থ দিয়ে তিনি আবার পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘আর কি ভালোই না তাকে বেসেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম…সৃষ্টিকর্তা, কি ভালোই না বেসেছিলাম। আর এখন কি ওকে ভালোবাসি না? আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসি না কি? কিন্তু সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর…’ নিজের চিন্তা শুরু করলেও সেটা শেষ হল না, কেননা মাত্রেনা ফিলিমনোভনা ঢুকল দরজা দিয়ে।
বলল, আমার ভাইকে ডেকে আনার হুকুম দিন। সে খাবার রান্না করে দেবে। না হলে গতকালের মত ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকবে।’
‘ঠিক আছে, আমি এখনই বেরিয়ে সব দেখছি। হ্যাঁ, টাটকা দুধের জন্য লোক পাঠানো হয়েছে?
এবং ডলি সংসারের নানা কাজে ডুবে গিয়ে তাতে নিজের দুঃখ সাময়িকভাবে ভুলে গেলেন।
আন্না কারেনিনা – ১.৫
পাঁচ
অবলোনস্কি ভালো মেধা থাকার দরুন স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন ভালোই। কিন্তু আলসে আর দুরন্ত হওয়ায় পাশ করে বেরোন শেষ সারিতে; কিন্তু সব সময় আড্ডা মেরে বেড়ানো জীবন, অনুচ্চ র্যাঙ্ক আর অপ্রবীণ বয়স সত্ত্বেও মস্কোর একটা সরকারি অফিসে চাকরি পেয়েছিলেন ভালো বেতনের। চাকরিটা পেয়েছিলেন তাঁর বোন আন্নার স্বামী আলেকসেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন-এর সাহায্যে। তিনি মন্ত্রীদপ্তরে একজন পদস্থ ব্যক্তি, অফিসটি এই দপ্তরেরই অধীনে। কারেনিন তার শ্যালককে এই চাকরিটা না দিলেও শত শত অন্য লোক, ভাই-বোন, নিকট-আত্মীয় মারফত এই চাকরিটাই অথবা হাজার ছয়েক বেতনের অমনি একটা চাকরিই তিনি পেতেন, যা তার দরকার ছিল। কেননা স্ত্রীর যথেষ্ট সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাল দাঁড়িয়েছিল খারাপ।
মস্কো আর পিটার্সবুর্গের অর্ধেকই ছিল অবলোনস্কির আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব। যেসব লোকের পরিবেশে তাঁর জন্ম, তাঁরা ছিলেন এবং হয়ে ওঠেন ইহজগতে প্রতিপত্তিশালী। সরকারি লোকদের এক-তৃতীয়াংশ যারা বৃদ্ধ, তাঁর ছিলেন তাঁর পিতার সুহৃদ, ওঁরা তাঁকে জানতেন তার বাল্যাবস্থা থেকে দুই-তৃতীয়াংশের সাথে তার তুমি বলে ডাকার সম্পর্ক, আর তৃতীয়দের সাথে তার পরিচয় ছিল ভালো; সুতরাং চাকরি, পারমিট ইত্যাদির বিতরণকারীরা স্বজনকে এড়িয়ে যেতে পারত না; একটা মোটা চাকরি পাবার জন্য অবলোনস্কিরও চেষ্টা করার প্রয়োজন ছিল না; তেমন প্রয়োজন ছিল শুধু আপত্তি না করা, ঈর্ষা না করা, ঝগড়া না বাধানো, আহত বোধ না করা, তাঁর প্রকৃতিগত সদয়তায় এটা তিনি কখনোই করেননি। কেউ যদি ওঁকে বলত যে ওঁর দরকারমত বেতনের কোন চাকরি তিনি পাবেন না, আরো এই জন্য যে বেশি বহরের দাবি তিনি করেননি, তাহলে সেটা তাঁর কাছে হাস্যকরই মনে হত; তার সমবয়সীরা যা পায় তিনি শুধু তাই পেতে চাইতেন, আর একই ধরনের কাজ তিনি করতেন অন্য কারো চেয়ে খারাপ নয়।
পরিচিতরা স্তিভা অবলোনস্কিকে ভালোবাসততা কেবল তার সদাশয়, হাসি-খুশি স্বভাব আর সন্দেহাতীত সততার জন্যই নয়, তার ভেতরে, তার সুদর্শন, সমুজ্জ্বল চেহারা, জ্বলজ্বলে চোখ, কালো ভুরু, চুল, মুখের শ্বেতাভা আর রক্তিমাভায় এমন কিছু ছিল যা লোকের ওপর আনন্দ প্রীতির একটা শারীরিক প্রভাব ফেলত। ওঁর সাথে দেখা হলে লোকে প্রায় সব সময়ই খুশির হাসিতে বলে উঠত, ‘আরে স্তিভা যে! অবলোনস্কি! সেই লোক! কখনো কখনো তার সাথে আলাপের পর দেখা গেল তেমন আনন্দের কিছু ঘটত না। তাহলেও তার পরের দিন, তৃতীয় দিনে তার সাথে দেখা হওয়ায় একই রকম খুশি হয়ে উঠত সবাই।
তিন বছর মস্কোর একটা অফিসে অধিকর্তার পদে থেকে অবলোনস্কি তাঁর সহকর্মী, অধীনস্থ, বড় সাহেব এবং তার সাথে যাদের সম্পর্ক ছিল তাদের সবার কাছ থেকে শুধু ভালোবাসাই নয়, শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। চাকরির ক্ষেত্রে এই সর্বজনীন শ্রদ্ধা অবলোনস্কি পেয়েছিলেন যে প্রধান গুণাবলির সুবাদে, তা হল প্রথমত, নিজের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থাকায় অন্য লোকদের প্রতি প্রশ্রয়দান; দ্বিতীয়ত, একান্ত উদারনৈতিকতা, যা তিনি খবরের কাগজে পড়েছেন তা নয়, যা মিশে আছে তার রক্তে, যার দরুন অবস্থা ও পদ নির্বিশেষে সমস্ত লোকের সাথে তার ব্যবহার একেবারে একইরকম, আর তৃতীয়ত, যেটা প্রধান কথা, যে কাজ তিনি করছেন তার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা, ফলে কখনো তিনি তাকে মেতে ওঠেননি এবং ভুল করেননি।
অবলোনস্কি চাকরিস্থলে এলে সম্ভ্রান্ত চাপরাশি তাঁকে এগিয়ে দিল, পোর্টফোলিও নিয়ে তিনি গেলেন তার ছোট কেবিনেটে, উর্দি চাপিয়ে এলেন অফিসে। কেরানি কর্মচারীরা সবাই উঠে দাঁড়াল, মাথা নোয়াল সানন্দে, সসম্মানে। অবলোনস্কি বরাবরের মত তাড়াতাড়ি করে গেলেন তার জায়গায়, সদস্যদের সাথে করমর্দন করে আসন নিলেন। কিছু রসিকতা করলেন, কথা বললেন ঠিক যতটা ভদ্রতাসম্মত হয় ততটা, তারপর কাজে মন দিলেন। স্বাধীনতা, সহজতা আর সানন্দে কাজ চালাবার জন্য যে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন তাদের ভেতরকার সীমারেখাটা অবলোনস্কির চেয়ে সঠিকভাবে আর কেউ খুঁজে পেত না। অবলোনস্কির অফিসের সবার মতই স্মিত সসম্মানে কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে এল সেক্রেটারি এবং কথা বলল সেই অন্তরঙ্গ-উদারনৈতিক সুরে যার প্রবর্তন করেছিলেন অবলোনস্কি :
‘শেষ পর্যন্ত আমরা পেনজা গুবেনিয়ার কর্তাদের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। এই যে, চলবে…’
‘পেয়েছেন তাহলে?’ কাগজটায় আঙুল দিয়ে বললেন অবলোনস্কি, তাহলে সাহেবরা…’ শুরু হল অফিসের কাজ।
রিপোর্ট শোনার সময় অর্থময় ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে তিনি ভাবলেন, যদি ওদের জানা থাকত আধ ঘন্টা আগে কি দোষী বালকই না হতে হয়েছিল সভাপতিকে!’ চোখ ওঁর হাসছিল। না থেমে কাজ চলার কথা বেলা দুটো পর্যন্ত। বেলা দুটোয় বিরতি আর আহার।
দুটো তখনো হয়নি, এমন সময় অফিস-কক্ষের কাঁচের বড় দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল এবং কে যেন ভেতরে ঢুকল। মনোযোগ বিক্ষেপে খুশি হয়ে পোর্ট্রেটের নিচে থেকে, আয়নার পেছন থেকে সমস্ত সভ্য চাইল দরজার দিকে; কিন্তু দরজার কাছে দণ্ডায়মান দারোয়ান তখনই আগন্তুককে বার করে দিল এবং কাঁচের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মামলাটা পড়া শেষ হলে অবলোনস্কি টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং একালের উদারনৈতিকতার আদর্শে অঞ্জলি দিয়ে সিগারেট বের করে চললেন তার কেবিনেটে। তার দুজন বন্ধু পুরানো কর্মচারী নিকিতিন আর দরবারে পদস্থ গ্রিনেভিচও বেরোলেন তার সাথে।
অবলোনস্কি বললেন, ‘খাবারের পর শেষ করে ওঠা যাবে।
খুব পারা যাবে!’ বললেন নিকিতিন।
‘আর এই ফোমিনটি একটা তোফা হারামজাদা নিশ্চয়’, যে মামলাটা ওরা দেখছেন তাতে জড়িত জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন গ্রিনেভিচ।
গ্রিনেভিচের কথায় অলোঙ্কি মুখ কোঁচকালেন, তাতে করে বুঝিয়ে দিলেন যে, আগেভাগেই রায় দিয়ে দেওয়া অশোন, তবে ওঁকে কিছু বললেন না।
তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, কে ঢুকেছিল?
‘কে-একজন লোক হুজুর জিজ্ঞাসাবাদ না করেই ঢুকে পড়ছিল, শুধু আমি ঘুরে দাঁড়াই। আপনাকে চাইছিল। বললাম : সদস্যরা যখন বেরোবেন তখন…’
‘কোথায় সে?
হয়ত বারান্দায় বেরিয়েছে। না হলে এখানেই তো কেবলি ঘোরাঘুরি করছিল। এই যে ওই লোকটা, কোঁকড়া দাড়িওয়ালা বলিষ্ঠগঠন বৃষ একজনকে দেখিয়ে বলল দারোয়ান। লোকটা তার ভেড়ার লোমের টুপি না খুলেই ক্ষিপ্র এবং লঘু পায়ে পাথুরে সিঁড়ির ক্ষয়ে যাওয়া ধাপগুলো বেয়ে ছুটে উঠল ওপরে। একজন রোগাটে রাজপুরুষ পোর্টফোলিও হাতে নিচে নামছিলেন, অননুমোদনের ভাব করে তিনি ছুটন্ত লোকটার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন অবলোনস্কির দিকে।
অবলোনস্কি সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধেয়ে-আসা লোকটাকে চিনতে পেরে নক্শা-তোলা কলারের ওপর তাঁর ভালোমানুষি জ্বলজ্বলে মুখখানা আরো জ্বলজ্বল করে উঠল।
তার দিকে এগিয়ে আসা লেভিনের দিকে তাকিয়ে বন্ধুসুলভ ঠাট্টামিশ্রিত হাসি হেসে তিনি বলে উঠলেন, তাই তো বটে! শেষ পর্যন্ত দেখা দিল লেভিন!’ বন্ধুর সাথে করমর্দন বিনিময়ে যেন আশ মিটছিল না তার, লেখিনকে চুম্বন করে বললেন, ‘এই চোরের আড্ডায় আমাকে খুঁজতে আসতে তোমার গা ঘিনঘিন করল না যে বুড়ো?
‘আমি এইমাত্র এসেছি। তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, লেভিন বললেন সসংকোচে, সেইসাথে রাগত আর অস্বস্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন চারদিক।
বন্ধুর আত্মাভিমানী রুষ্ট সংকোচের কথা জানা থাকায় অবলোনস্কি নাও, চলো যাই কেবিনেটে’ বলে তাকে নিয়ে গেলেন যেন বিপদ-আপদের মাঝখান দিয়ে।
পরিচিত প্রায় সকলের সাথেই অবলোনস্কির ‘তুমি’ সম্পর্ক ও ষাট বছরের বুড়ো, বিশ বছরের ছোকরা, অভিনেতা, মন্ত্রী, বেনিয়া-কারবারী, জেনারেল-অ্যাডজুট্যান্ট–সকলের সাথেই, তাঁর ‘তুমি’ সম্পর্কিত অনেকেই ছিল সামাজিক সোপানের দুই চরম প্রান্তে এবং অবলোনস্কির সাথে তাদের সাধারণ কিছু একটা আছে জেনে খুবই অবাক হত। যার সাথেই তিনি শ্যাম্পেন খেতেন তার সাথেই তার ‘তুমি’ সম্পর্ক, আর শ্যাম্পেন তিনি খেতেন সকলের সাথেই, তাই অফিসে নিজের অধীনস্থদের সামনে সংকুচিত ‘তুমি’র ঠাট্টা করে তিনি তাঁর অনেক বন্ধুদের যা বলতেন–সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর প্রকৃতিগত উপস্থিত বুদ্ধিতে অধীনস্থদের এই প্রসঙ্গে অপ্রীতিকর অনুভূতিটা হ্রাস করে আনতে পারতেন। লেভিন সংকুচিত ‘তুমি’র দলে ছিলেন না, কিন্তু অবলোনস্কি তাঁর সহজাত লোকচরিত্রবোধে অনুভব করছিলেন যে তার অধীনস্থদের সমক্ষে তাঁর ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করতে না চাইতেও পারেন বলে লেভিন ভাবছেন, তাই তাড়াতাড়ি করে তাকে নিয়ে গেলেন কেবিনেটে।
লেভিন অবলোনস্কির প্রায় সমবয়সী, তাই তার সাথে ‘তুমি’ সম্পর্কটা শুধু শ্যাম্পেনের সুবাদে নয়। প্রথম যৌবন। থেকেই লেভিন তাঁর সাথী ও বন্ধু। চরিত্র ও রুচিতে পার্থক্য সত্ত্বেও তারা ভালোবাসতেন পরস্পরকে, যেমন প্রথম যৌবনে মিলিত বন্ধুরা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াকলাপের পথ নেওয়া লোকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়ে থাকে, অপরের কাজ বিচার করে তাকে সঙ্গত প্রতিপন্ন করলেও মনে মনে সেটাকে তারা ঘৃণা করে। প্রত্যেকেরই মনে হত যে জীবন, সে নিজে অতিবাহিত করছে সেটাই আসল জীবন, আর বন্ধুর জীবনটা কেবল ছায়ামূর্তি। লেভিনকে দেখে অবলোনস্কি ঈষৎ ঠাট্টা-মেশা হাসি চাপতে পারলেন না। গ্রাম থেকে মস্কোয় এলে কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, গ্রামে লেভিন কি একটা করছিলেন, কিন্তু ঠিক কি সেটা অবলোনস্কি কখনো ভালো করে বুঝে উঠতে পারেননি, তাছাড়া তাতে তার আগ্রহও ছিল না। লেভিন মস্কো আসতেন সব সময়ই উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হয়ে, কিছুটা সংকোচবোধ নিয়ে আর সে সংকোচবোধে বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সব কিছু দেখতেন একটা নতুন অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিতে। এসবে হাসতেন অবলোনস্কি এবং ভালোবাসতেন এসব। ঠিক তেমনি লেভিনও মনে মনে বন্ধুর নাগরিক জীবনযাত্রা আর তাঁর কাজ–দুইই ঘৃণা করতেন, ও কাজটাকে তিনি মনে করতেন বাজে, হাসতেন তা নিয়ে। কিন্তু তফাৎটা এই যে লোকে যা করে তা সব কিছু করে অবলোনস্কি হাসতেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে এবং ভালো মনে আর লেভিনের আত্মবিশ্বাস ছিল না, মাঝে মাঝে রেগেও উঠতেন।
কেবিনেটে ঢুকে লেভিনের হাত ছেড়ে দিয়ে এবং তাতে করে এখানে আর বিপদ নেই এটা যেন বুঝিয়ে অবলোনস্কি বললেন, ‘আমরা অনেকদিন তোমার অপেক্ষায় আছি। ভারি, ভারি আনন্দ হল তোমাকে দেখে। কিন্তু কি ব্যাপার? কেমন আছো? এলে কবে?
লেভিন চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর কাছে অপরিচিত অবলোনস্কির দু’বন্ধুর মুখের দিকে, বিশেষ করে ভারি লম্বা লম্বা সাদা আঙুল, ডগার দিকে বেঁকে যাওয়া হলদে হলদে নখ আর কামিজের বিরাট ঝকঝকে কফ-
বোম সমেত মার্জিত গ্রিনেভিচের হাতের দিকে, যে হাত দুখানা তাঁর সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করেছে, চিন্তার ফুরসৎ দিচ্ছে না। অবলোস্কি তৎক্ষণাৎ সেটা লক্ষ্য করে হাসলেন। বললেনঃ
‘ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। আমার সাথি ও ফিলিপ ইনিচ নিকিতিন, মিখাইল স্তানিস্লাভিচ গ্রিনেভিচ,–আর লেভিনের দিকে ফিরে–জেমস্থভো’র কর্তকর্তা, জেমস্তুভো’র নতুন আমলের লোক, ব্যায়ামবীর–এক হাতে পাঁচ পুদ ওজন তোলেন, পশুপালক, শিকারী এবং আমার বন্ধু কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন, সের্গেই ইনিচ কনিশেভের ভাই।
‘ভারি আনন্দ হল, বললেন বৃদ্ধ।
আপনার ভাই, সের্গেই ইভানিচকে জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার’, লম্বা লম্বা নখ সমেত সরু হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন গ্রিনেভিচ।
লেভিন ভুরু কোঁচকালেন, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে করমর্দন করেই তৎক্ষণাৎ ফিরলেন অবলোনস্কির দিকে। সারা রাশিয়ায় নামকরা সাহিত্যিক তাঁর সৎভাইয়ের প্রতি তাঁর প্রচুর শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁকে কনস্তান্তিন লেভিন না বলে বিখ্যাত কজনিশেভের ভাই বলা হলে তিনি সইতে পারতেন না।
না, আমি আর জেমস্তভো’র কর্মকর্তা নই। সবার সাথে ঝগড়াঝাটি করেছি, সভায় আর যাই না’, অবলোনস্কির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
‘এত তাড়াতাড়ি! হেসে বললেন অবলোনস্কি, কিন্তু কি করে? কেন?
‘সে এক লম্বা ইতিহাস। বলব পরে এক সময়’, লেভিন এ কথা বললেও সাথে সাথেই ইতিহাসটা জানাতে শুরু করলেন : মানে সংক্ষেপে বললে, জেমস্তভো’র কর্মকর্তা বলে কেউ নেই, থাকতেও পারে না। এমনভাবে উনি বললেন যেন এই মাত্র কেউ তাঁকে আঘাত দিয়েছে, একদিক থেকে ওটা খেলনা, পার্লামেন্ট-পার্লামেন্ট খেলা হচ্ছে, আর আমি তেমন তরুণও নই, তেমন বুড়োও নই যে খেলনা নিয়ে মাতব; অন্য (একটু তোতলালেন তিনি) দিকে এটা উয়েদের দুবৃত্ত দলের পক্ষে টাকা করার একটা উপায়। আগে ছিল তত্ত্বাবধান, বিচারালয়, আর এখন জেমস্তভো, উৎকোচের চেহারায় নয়, বিনা মোগ্যতায় বেতন হিসেবে’, বললেন উনি এত উত্তেজিত হয় যেন উপস্থিতদের কেউ আপত্তি করেছে তার মতামতে।
বটে! তুমি দেখছি আবার নতুন পর্যায়ে, রক্ষণশীল পর্যায়ে’, বললেন অবলোনস্কি, তবে সে কথা হবে পরে।
‘হ্যাঁ, পরে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করা আমার দরকার ছিল, বিদ্বেষের দৃষ্টিতে গ্রিনেভিচের হাতের দিকে তাকিয়ে লেভিন বললেন।
অবলোনস্কি প্রায় অলক্ষ্যে হাসলেন একটু।
‘তুমি যে বড় বলেছিলে আর কখনো ইউরোপীয় পোশাক পরবে না? তাঁর নতুন, স্পষ্টতই ফরাসি কাটের পোশাকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বটে! দেখছি নতুন পর্যায়!
হঠাৎ লাল হয়ে উঠলেন লেভিন, বয়স্ক লোকেরা যেভাবে লাল হয়ে হয়ে ওঠে নিজেরাই তা লক্ষ না করে, তেমন নয়, যেভাবে লাল হয়ে ওঠে বালকেরা, যখন তারা টের পায় যে তাদের সংকোচপরায়ণতায় তারা হাস্যকর, তার ফলে লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে ওঠে আরো বেশি, প্রায় কান্না এসে যায়। আর এই বুদ্ধিমান পুরুষালী মুখখানাকে শিশুদের দশায় দেখতে পাওয়া এত বিচিত্র যে তার দিকে অবলোনস্কি আর তাকালেন না।
লেভিন বললেন, ‘তা কোথায় দেখা হবে? তোমার সাথে কথা বলা আমার কাছে খুবই জরুরি।’
অবলোনস্কি যেন চিন্তায় ডুবে গেলেন।
‘শোন, চল গুরিনের ওখানে প্রাতরাশ সারতে, সেখানে কথা হবে। তিনটা পর্যন্ত আমি ফাঁকা।
একটু ভেবে লেভিন বললেন, না, আমাকে তো আবার যেতে হবে।’
‘তা বেশ, তাহলে একসাথে লাঞ্চ করা যাক।
লাঞ্চ আমার যে দরকার শুধু দুটো কথা বলা, আর আলোচনা করা যাবে পরে।
‘তাহলে এখনই কথা দুটো বলে ফ্যালো, লাঞ্চে আবার আলাপ কি।
কথা দুটো এই’, বললেন লেভিন, তবে বিশেষ কিছু নয়।
মুখখানায় ওঁর হঠাৎ আক্রোশ ফুটে উঠল, যেটা দেখা দিয়েছে নিজের সংকোচশীলতা দমনের প্রয়াসে।
উনি বললেন, ‘শ্যেরবাৎস্কিরা কি করছে? সব আগের মতই?’
বহুদিন থেকে লেভিন তার শ্যালিকা কিটির প্রেমাসক্ত, সেটা জানা থাকায় অবলোনস্কি সামান্য হাসলেন, চোখ তার আমোদে চকচক করে উঠল।
‘তুমি বললে দুটো কথা, কিন্তু দুটো কথায় আমি জবাব দিতে পারব না, কেননা…মাপ কর, এক মিনিট…’.
অন্তরঙ্গতা মেশা সম্মান দেখিয়ে ঘরে ঢুকল সেক্রেটারি, সমস্ত সেক্রেটারির পক্ষেই যা সাধারণ, কর্তার চেয়ে সে, যে কাজটা ভালো বোঝে তেমন একটা বিনীত চেতনাসহ, কাগজপত্র নিয়ে সে গেল অবলোনস্কির কাছে এবং প্রশ্নের আড়ালে কি একটা মুশকিলের কথা বোঝাতে শুরু করল। অবলোনস্কি সেটা পুরো না শুনে সস্নেহে তাঁর হাত রাখলেন সেক্রেটারির আস্তিনে।
না, আমি যা বলেছিলাম তাই করুন’, হাসিতে তার মন্তব্যটাকে নরম করে তিনি বললেন, এবং ব্যাপারটা তিনি কিভাবে বুঝছেন সেটা ব্যাখ্যা করে কাগজগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন, এই করুন অনুগ্রহ করে, এই ধারায়, জাখার নিকিতিচ।
অপ্রস্তুত হয়ে সেক্রেটারি চলে গেল। তার সাথে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল, লেভিন তার মধ্যে তাঁর সংকোচ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে চেয়ারে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখে তার দেখা দিয়েছিল বিদ্রুপাত্মক মনোযোগ। বললেন, বুঝি না, একেবারে বুঝি না।
‘কি বুঝতে পারছ না?’ তেমনি আমুদে হাসি হেসে, সিগারেট বের করে বললেন অবলোনস্কি। লেভিনের কাছ থেকে তিনি কোন একটা বিদঘুঁটে কাণ্ড আশা করছিলেন।
‘কি যে তোমরা করে যাচ্ছ কিছুই বুঝি না, লেভিন কাঁধ কুঁচকে বললেন। গুরুত্বসহকারে এটা তুমি করতে পারো কি করে?
কি জন্য?’
‘এজন্য যে, করার কিছু নেই।
‘তুমি তাই ভাবছ, কিন্তু আমরা কাজে আকণ্ঠ ডুবে আছি।
‘কাগজে ডুবে আছ। তা এ ব্যাপারে তোমার গুণ আছে বৈকি, যোগ করলেন লেভিন।
তার মানে তুমি ভাবছ আমার কোন একটা ঘাটতি আছে?’
হয়ত সত্যিই আছে’, লেভিন বললেন। ‘তাহলেও তোমার উদারতায় আমি মুগ্ধ হই এবং গর্ববোধ করি যে এমন উদার মানুষ আমার বন্ধু। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না’, অবলোনস্কির চোখে চোখে তাকাবার মরিয়া চেষ্টা করে তিনি যোগ দিলেন।
নাও, হয়েছে-হয়েছে। দাঁড়াও না, তুমিও এই পথেই আসবে। তোমার যে কারাজিনস্কি উয়েজুদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা (এক দেসিয়াতিনা–১০,০০০ বর্গ মিটারের মত)। জমি আছে, এমন পেশী, বারো বছরের কুমারীর মত এমন তাজা আমেজ, তাহলেও আসবে তুমি আমাদের কাছেই। তা তুমি যা জিজ্ঞেস করেছিলে অদলবদল কিছু হয়নি, তুমি বহুদিন যাওনি সেখানে–এটাই শুধু আফসোসের কথা।
লেভিন ভীতভাবে বললেন, ‘কেন, কি হল?
‘ও কিছু না, জবাব দিলেন অবলোনস্কি। কথা হবে। কিন্তু সত্যি, কেন তুমি এলে বলো তোর ‘আহ্, এ নিয়েও কথা হবে পরে, আবার আকর্ণ রক্তিম হয়ে বললেন লেভিন।
তা বেশ। বোঝা গেল’, অবলোনস্কি বললেন। কি জানো, আমি তোমাকে নিজের বাড়িতেই ডাকতাম, কিন্তু স্ত্রী মোটেই সুস্থ নয়। আর শোনো, ওদের সাথে যদি দেখা করতে চাও, তাহলে ওরা নিশ্চয় এখন জু-পার্কে, চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত থাকবে। কিটি স্কেট করে। তুমি চলে যাও সেখানে, আমিও যাব, তারপর একসাথে খেয়ে নেব কোথাও।
চমৎকার, আবার দেখা হওয়া পর্যন্ত।
‘দেখো, আমি তো তোমাকে জানি, ভুলে যাবে কিংবা হঠাৎ চলে যাবে গায়ে!’ হেসে চিৎকার করে বললেন অবলোনস্কি।
না, সত্যি বলছি।
এবং অবলোনস্কির বন্ধুদের অভিনন্দন জানাতে যে ভুলে গেছেন কেবিনেট থেকে।
লেভিন চলে গেলে গ্রিনেভিচ বললেন, ‘নিশ্চয় খুব উদ্যোগী পুরুষ।
‘হ্যাঁ গো, মাথা দুলিয়ে বললেন অবলোনস্কি, সুখী লোক! কারাজিনস্কি উয়েজদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা জমি, সবই পড়ে আছে ওর সামনে, আর কি তাজা! আমাদের মত নয় ভায়া।
‘অবলোনস্কি, আপনার নালিশ করার কি আছে?
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আরে যাচ্ছেতাই, বিছছিরি।
ছয়
লেভিনকে অবলোনস্কি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন ঠিক কেন সে এসেছে, তখন লেভিন লাল হয়ে ওঠেন, এবং লাল হয়ে উঠেছেন বলে রেগে ওঠেন নিজের ওপরেই, কেননা এ জবাব তিনি দিতে পারতেন না : ‘এসেছি তোমার শ্যালিকার পাণিপ্রার্থনা করতে, যদিও শুধু এজন্যই তিনি এসেছিলেন।
লেভিন আর শ্যেরবাৎস্কিদের বংশ মস্কোর বনেদি অভিজাত বংশ, সব সময়ই তাদের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় লেভিনের উচ্চশিক্ষার্থী জীবনে। ডল্লি আর কিটির ভাই তরুণ প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কির সাথে একই সাথে তিনি প্রস্তুত হন এবং একসাথেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই সময় লেভিন প্রায়ই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতে আসতেন, বাড়িটাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন। যতই এটা আশ্চর্য ঠেকুক, লেভিন ভালোবেসেছিলেন ঠিক বাড়িটাই, পরিবারটাকে, বিশেষ করে তার অন্দরমহলকে। নিজের মাকে লেভিনের মনে পড়ে না, আর বোন ছিল তাঁর চেয়ে বয়সে বড়, তাই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতেই তিনি প্রথম দেখেন সেই বনেদি, অভিজাত, সুশিক্ষিত ও সততাশীল সংসার, যা তিনি হারিয়েছিলেন পিতা-মাতার মৃত্যুতে। এ পরিবারের সমস্ত সভ্য, বিশেষ করে মেয়েরা ছিল কেমন একটা রহস্যময় কাব্যধর্মী অবগুণ্ঠনে ঢাকা, আর তিনি তাদের ভেতর কোন ত্রুটি দেখেননি তাই নয়, এই অবগুণ্ঠনের তলে সবচেয়ে সমুন্নত অনুভূতি, সবরকমের পূর্ণতা আছে বলে ধরে নিতেন। একদিন পর পর কেন এই তিন দ্ৰ কন্যার প্রয়োজন হত ফরাসি আর ইংরেজিতে কথা বলার; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা পালা করে বাজাতো পিয়ানো যার ধ্বনি পৌঁছতো ওপরতলায় ভাইয়ের ঘরে যেখানে পড়াশুনা করত ছাত্ররা; কেন আসততা ফরাসি সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্যের এই শিক্ষকেরা; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই তিন কন্যাই মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে গাড়ি করে তভেঞ্চয় বুলভারে যেত তাদের বিলিতি কোট পরে–ডল্লিরটা লম্বা, নাটালির আধা-লম্বা, আর কিটিরটা একেবারেই খাটো, ফলে টানটান লাল মোজা পরা তার সুঠাম পা-দু’খানা চোখে পড়ত; সোনালি তকমা লাগানো টুপি পরা চাপরাশি সমভিব্যাহারে কেন তাদের রহস্যময় জগতে আরো যা যা ঘটত তার অনেককিছুই তিনি বুঝতেন না, কিন্তু জানতেন যে এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই অপরূপ আর প্রেমে পড়ে যান ঠিক এই রহস্যময়তার সাথে।
ছাত্রজীবনে উনি প্রায় বড় বোন ডল্লির প্রেমে পড়তে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তার বিয়ে হয়ে গেল অবলোনস্কির সাথে। পরে তিনি মেজো বোনের প্রণয়াসক্ত হতে থাকেন। উনি কেমন যেন অনুভব করতেন যে, বোনদের একজনের প্রেমে তার পড়া দরকার, শুধু ঠিক কার প্রেমে সেটা স্থির করে উঠতে পারতেন না। কিন্তু নাটালিও সমাজে দেখা দিতে না দিতেই কূটনীতিক ভভের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেভিন যখন পাশ করে বেরোলেন, কিটি তখনো হোট। তরুণ শ্যেরবাৎস্কি যোগ দিলেন নৌবহরে এবং বালটিক সাগরে সলিলসমাধি নেন। অবলোনস্কির সাথে বন্ধুত্ব সত্ত্বেও শ্যেরবাৎস্কি পরিবারের সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এল। কিন্তু এক বছর গ্রামে গ্রামে কাটিয়ে এ বছর শীতের প্রারম্ভে লেভিন যখন মস্কো আসেন এবং দেখা হয় শ্যেরবাৎস্কিদের সাথে, তিনি বুঝলেন, এই তিনজনের মধ্যে সত্যি-সত্যিই কাকে ভালোবাসা ছিল তাঁর নিবন্ধ।
ভালো বংশের লোক, গরিবের চেয়ে বরং বড়লোক বলাই উচিত, বত্রিশ বছর বয়স, তার মত এমন একজনের পক্ষে প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার পাণিপ্রার্থনা করার চেয়ে সহজ আর কিছু হতে পারে না বলেই মনে হতে পারত; একান্ত সম্ভব ছিল যে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা হত উত্তম পাত্র হিসেবে। কিন্তু লেভিন প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাঁর মনে হত যে কিটি সব দিক দিয়ে এতই সুসম্পূর্ণ, পার্থিব সব কিছুর উর্ধ্বে এমন এক জীব আর তিনি এতই পার্থিব ও হীন যে অন্যেরা এবং কিটি স্বয়ং তাকে তার যোগ্য বলে স্বীকার করবে এমন কথা ভাবাই যায় না।
মস্কোয় যেন ঘোরের মধ্যে দুমাস কাটিয়ে, প্রতি দিন সমাজে কিটিতে দেখে, তার সাথে দেখা করার জন্যই সেখানে তিনি যেতেন, লেভিন হঠাৎ ঠিক করলেন, এ হতে পারে না এবং চলে গেলেন গ্রামে।
এ হতে পারে না, লেভিনের এমন প্রত্যয়ের ভিত্তি ছিল এই যে আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি ছিলেন মাধুরীময়ী কিটির পক্ষে অলাভজনক অযোগ্য পাত্র আর কিটি নিজে তাঁকে তো ভালোবাসতেই পারে না। আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি প্রচলিত সুনির্দিষ্ট কোন কাজে নিযুক্ত নন, সমাজেও কোন প্রতিষ্ঠা নেই, যে ক্ষেত্রে ওঁর বত্রিশ বছর বয়সে বন্ধুরা ইতিমধ্যেই কেউ কর্নেল, কেউ এইডডেকং, কেউ প্রফেসর, কেউ ব্যাঙ্ক আর রেলপথের ডিরেক্টর, কেউ-বা অবলোনস্কির মত সরকারি অফিসের অধিকর্তা; আর উনি ওদিকে (অন্য লোকের কাছ তাকে কেমন লাগার কথা সেটা তিনি ভালোই জানতেন) জমিদারি চালাচ্ছেন, গো-পালন করছেন, পাখির কোটরে গুলি মারছেন, আর এটা-ওটা ঘর তুলছেন। অর্থাৎ গুণহীন ছোকরা যার কিছুই হল না, এবং সমাজের মতে, যারা কোন কাজের নয়, তারা যা করে উনি ঠিক তাই করছেন।
তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর লোক, প্রধান কথা, কোন দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য নয় এমন একটা মামুলী লোককে রহস্যময়ী মনোরমা কিটি নিজেই ভালোবাসতে পারে না। তা ছাড়া কিটির সাথে তার পূর্বতন সম্পর্ক, ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের ফলে যেটা ছিল শিশুর প্রতি বয়স্কের সম্পর্কের মত, সেটা তাঁর কাছে মনে হয়েছিল ভালোবাসার পথে আরো একটা নতুন অন্তরায়। তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর সদয় লোককে বন্ধুর মত ভালোবাসা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন, কিন্তু তিনি নিজে কিটিকে যেরকম ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসা পেতে হলে হওয়া উচিত সুদর্শন, বিশেষ করে অসাধারণ একজন লোক।
তিনি শুনেছেন যে মেয়েরা প্রায়ই অসুন্দর, সাধারণ লোককে ভালোবেসে থাকে, কিন্তু সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কেননা নিজেকে দিয়ে বিচার করে দেখলে, উনি নিজে ভালোবাসতে পারেন কেবল সুন্দরী, রহস্যময়ী, অনন্যসাধারণ নারীকে।
কিন্তু গ্রামে একা একা দুমাস কাটিয়ে উনি নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলেন যে প্রথম যৌবন যে সব ভালোবাসা তিনি অনুভব করেছিলেন, এটা তারই একটা নয়; এই আবেগ তাকে মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছিল না; এই প্রশ্নের মীমাংসা না। করে বাঁচতে পারেন না তিনি; ও আমার বৌ হবে কি হবে না; তাঁর হতাশাটা আসছে শুধু তাঁর এই কল্পনা থেকে যে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করাই হবে এমন কোন প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। এবং পাণিপ্রার্থনা করবেন আর গৃহীত হলে বিবাহও করবেন এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি এবার চলে এলেন মস্কোয়। অথবা…প্রত্যাখ্যাত হলে তার কি হবে সে কথা ভাবতেও পারছিলেন না তিনি।
সাত
লেভিন সকালের ট্রেনে মস্কো এসে ওঠেন তার মায়ের প্রথম স্বামীর ঔরসজাত পুত্র, তার সৎ বড় ভাই সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ-এর বাড়িতে; কেন তিনি এসেছেন তখনই তা বলে তার পরামর্শ নেবেন বলে স্থির করে পোশাক বদলে তিনি ঢুকলেন তার স্টাডিতে; কিন্তু বড় ভাই কজনিশেভ একা ছিলেন না। তাঁর কাছে বসে ছিলেন দর্শনের নামকরা এক প্রফেসর। খারক থেকে তিনি এসেছেন বিশেষ করে অতি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে মতভেদের মীমাংসা করার উদ্দেশ্যেই। বস্তুবাদের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত বিতর্ক চালাচ্ছিলেন প্রফেসর আর সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ আগ্রহভরে তা অনুসরণ করে গেছেন; তারপর বিতর্কের শেষ প্রবন্ধটা পড়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে প্রফেসরকে চিঠি লেখেন। বস্তুবাদীদের কাছে বড় বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে তিনি প্রফেসরকে ভর্ৎসনা করেন। সাথে সাথেই প্রফেসর চলে আসেন আলোচনার জন্য। প্রসঙ্গটা ছিল একটা চলতি প্রশ্ন নিয়ে মানুষের। ক্রিয়াকলাপে মনস্তাত্তিক আর শারীরবৃত্তীয় ঘটনার মধ্যে সীমারেখা আছে কি, থাকলে সেটা কোথায়?
সকলকেই যে নিরুত্তাপ স্নেহের হাসিতে স্বাগত করতেন কজনিশেভ, ভাইকেও সেভাবে গ্রহণ করে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রফেসরের সাথে, তারপর চালিয়ে গেলেন কথোপকথন।
সরু-কপালে ক্ষুদ্রকায় হলুদ-রঙা চশমা-পরা মানুষটা সম্ভাষণ বিনিময়ের জন্য এক মুহূর্ত আলাপ থামিয়ে আবার। কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন, লেভিনের দিকে মন দিলেন না। প্রফেসর কখন চলে যাবেন তার অপেক্ষায় বসে রইলেন লেভিন, কিন্তু অচিরেই আলোচনার প্রসঙ্গে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
যে সব প্রবন্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল, পত্র-পত্রিকায় লেভিনের তা চোখে পড়েছে, এবং সেগুলো তিনি পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে প্রকৃতিবিদ্যার যে মূলকথাগুলো তার জানা ছিল তার পরিবিকাশ সম্পর্কে আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু জীব হিসেবে মানুষের উদ্ভব, প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ে জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার যুক্তিকে তিনি কখনো জীবন ও মৃত্যুর যা তাৎপর্য সে প্রশ্নের সাথে যুক্ত করেননি যা ইদানীং ঘন ঘন তার মনে উঠছে।
প্রফেসরের সাথে বড় ভাইয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে লেভিন লক্ষ্য করলেন যে তাঁরা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে যুক্ত করছেন প্রাণের প্রশ্নের সাথে, বারকয়েক তারা প্রায় এসব প্রশ্নেরই কাছে এসে গিয়েছিলেন, কিন্তু যা তার মনে হচ্ছিল, প্রতিবার যেই তাঁরা সবচেয়ে প্রধান ব্যাপারটার কাছে আসছেন অমনি তারা তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছেন এবং সূক্ষ্ম ভেদাভেদ, কুণ্ঠা জ্ঞাপন, উদ্ধৃতি, ইঙ্গিত, প্রামাণ্যর নজিরের জগতে ডুব দিচ্ছেন, তাদের কথাবার্তা বোঝা তাঁর পক্ষে কঠিন হচ্ছিল।
‘আমি এটা মানতে পারি না, কজনিশেভ বললেন তার অভ্যস্ত প্রাঞ্জলতা আর প্রকাশের সুনির্দিষ্টতা আর মার্জিত বাচনভঙ্গিতে, কোনক্রমেই আমি কেইসের সাথে এ বিষয়ে একমত হতে পারি না যে, বহির্জগৎ থেকে আমার সমস্ত ধারণা আসছে সংবেদন মারফত। মূল যে বোধ সত্তা, সেটা আমি পেয়েছি সংবেদন মারফত নয়, কেননা এই বোধটা দেবার মত কোন বিশেষ প্রত্যক্ষ নেই।’
হ্যাঁ, কিন্তু ওঁরা–ভুর্স্ট, কনাউস্ট, প্রিপাসভ জবাবে আপনাকে বলবেন যে আপনার সত্তাচেতনা আসছে সমস্ত অনুভূতির যোগফল থেকে, সত্তার এ চেতনা হল অনুভূতির পরিণাম। ভু তো আরো এগিয়ে সোজাসুজি দাবি করেন যে অনুভূতি না থাকলে সত্তার চেতনাও থাকে না।
কজনিশেভ শুরু করলেন, আমি বলব বিপরীত কথা…’
কিন্তু এবারেও লেভিনের মনে হল ওঁরা প্রধান জিনিসটার কাছাকাছি এসে আবার সরে যাচ্ছেন এবং প্রফেসরকে একটা প্রশ্ন করবেন বলে তিনি ঠিক করলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে দাঁড়াচ্ছে, আমার অনুভূতি যদি ধ্বংস পায়, দেহ মরে যায়, তাহলে কোনক্রমেই আর অস্তিত্ব সম্ভব নয়?
প্রফেসর বিরক্তিতে এবং বাধা পাওয়ায় যেন একটা মানসিক যন্ত্রণায় তাকালেন প্রশ্নকর্তার দিকে, দেখতে যে দার্শনিকের বদলে বরং গুণটানা খালাসির মত, তারপর কজনিশেভের দিকে চোখ ফেরালেন, যেন জিজ্ঞেস করছেন? কি আর বলার আছে এখানে। কিন্তু কজনিশেভ যিনি কথা বলছিলেন প্রফেসরের মত উদগ্রতায় আর একদেশদর্শিতায় নয়, প্রফেসরের জবাব দেওয়ার সাথে সাথে যে সহজ স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্নটা করা হয়েছে তা বোঝার মত মানসিক প্রসারতা যার ছিল, তিনি হেসে বললেন : ‘এ প্রশ্ন সমাধানের অধিকার আমাদের এখনো নেই…’
তথ্য নেই’, সমর্থন করলেন প্রফেসর এবং নিজের যুক্তিবিস্তার চালিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি উল্লেখ করতে চাই, প্রিপাসভ যা সোজাসুজি বলেন, অনুভবের ভিত্তি যদি হয় সংবেদন, তাহলে এ দুয়ের মধ্যে কঠোরভাবে পার্থক্য করতে হবে।’
লেভিন আর শুনছিলেন না, প্রফেসর কখন চলে যান তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আট
প্রফেসর চলে যাবার পর সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ তার ভাইকে বললেন, ‘তুই এসেছিস বলে ভারি খুশি হলাম। কতদিনের জন্য? চাষবাস কেমন চলছে?
লেভিন জানতেন যে চাষবাসে বড় ভাইয়ের বিশেষ কৌতূহল নেই। প্রশ্নটা করলেন শুধু তাঁকে একটু প্রশ্রয় দিয়ে, তাই লেভিনও উত্তরে কেবল গম বিক্রি আর টাকার কথাটা বললেন।
লেভিন ভেবেছিলেন যে তার বিবাহের সংকল্পের কথা বড় ভাইকে জানাবেন, তার উপদেশ চাইবেন, এমন কি এ বিষয়ে একেবারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন; কিন্তু যখন তিনি ভাইকে দেখলেন, প্রফেসরের সাথে তার কথাবার্তা কানে গেল এবং পরে যে পৃষ্ঠপোষকতার সুরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন চাষবাসের কথা (ওঁদের মায়ের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়নি, লেভিন দুই অংশই দেখতেন) সেটা শুনলেন, তখন টের পেলেন কেন জানি বড় ভাইয়ের কাছে বিয়ের কথাটা পাড়তে তিনি অক্ষম। লেভিন টের পাচ্ছিলেন, উনি যা চান, বড় ভাই সেভাবে জিনিসটা দেখবেন না।
‘তা জেমস্তভোর খবর কি? কেমন চলছে?’ জিজ্ঞেস করলেন কজনিশেভ, জেমস্তভোর ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল প্রচুর এবং তাতে বড় একটা তাৎপর্য আরোপ করতেন।
‘সত্যিই আমি জানি না…’।
‘সেকি? তুই যে বোর্ডের সদস্য?
না, এখন আর নই, বেরিয়ে এসেছি’, জবাব দিলেন কনস্তান্তিন লেভিন, সভায় আর যাই না।
‘আফসোসের কথা!’ ভুরু কুঁচকে কজনিশেভ বললেন।
কৈফিয়ৎ দেবার জন্য লেভিন বলতে শুরু করেছিলেন তাঁর উয়েজদে সভায় কি-সব হচ্ছে।
কজনিশেভ তাঁকে বাধা দিলেন, সৰু সময়ই ওই ব্যাপারে। আমরা রুশীরা সব সময়ই ওই রকম। হয়ত এটা আমাদের একটা ভালো গুণ–নিজের ত্রুটি দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা, কিন্তু আমরা নুন-পোড়া করে ছাড়ি, আমরা বিদ্রূপ করে তুষ্টি লাভ করি আর সেটা সব সময়ই আসে আমাদের জিবের ডগায়। আমি তোকে শুধু বলব, আমাদের জেমস্তভো প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অধিকার আছে, তা যদি অন্য ইউরোপীয় জাতি পায়,জার্মানরা বা ইংরেজরা তা ব্যবহার করে নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা করে নিত, আর আমরা কেবল হাসাহাসি করি।
কিন্তু কি করা যায়? দোষীর মত বললেন লেভিন, এটা আমার শেষ অভিজ্ঞতা। মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছি। পারি । আমার সে সামর্থ্য নেই।’
সামর্থ্য নেই’, বললেন নিশেভ, ব্যাপারটা তুই ঠিকভাবে দেখছিস না। হতে পারে, মনমরা জবাব দিলেন লেভিন।
‘আরে জানিস, নিকোলাই ভাই আবার এখানে।
নিকোলাই ভাই কনস্তান্তিন লেভিনের আপন সহোদর বড় ভাই আর কজনিশেভের সহোদর সভাই। ভুষ্টিনাশা ‘লোক, সম্পত্তির বেশির ভাগটা উড়িয়ে দিয়েছে, বিচিত্র আর বদ লোকেদের সমাজে ঘোরাঘুরি করে ঝগড়া করেছে ভাইদের সাথে।
বলছ কি? সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘কোত্থেকে তুমি জানলে?
‘প্রকোফিই ওকে রাস্তায় দেখেছে।
‘এখানে, মস্কোয়? কোথায় সে? জানো তুমি?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লেভিন, যেন তখনই যেতে চান তিনি।
‘তোকে কথাটা বললাম বলে অনুতাপ হচ্ছে, ছোট ভাইয়ের উত্তেজনায় মাথা নেড়ে বললেন কজুনিশেভ, ‘কোথায় আছে জানার জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম, ক্রবিনের কাছে দেওয়া যে হুভিটার টাকা আমি শোধ করেছি, সেটাও পাঠিয়েছিলাম। এই তার উত্তর।
কাগজ-চাপার তল থেকে একটা কাগজ কজনিশেড দিলেন তার ভাইকে।
বিচিত্র, কিন্তু চেনা হস্তাক্ষরে লেখা চিরকুটটা লেভিন পড়লেন : বিনীত প্রার্থনা যে আমাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হোক। আমার অমায়িক ভাইয়েদের কাছে আমার একটা মাত্র দাবি। নিকোলাই লেভিন।’
লেভিন এটা পড়লেন এবং হাতের চিরকুটটা থেকে মাথা না তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন কজনিশেভের সামনে। হতভাগ্য ভাইয়ের ভুলে যাবার ইচ্ছা আর সেটা যে খারাপ এই চেতনার মধ্যে লড়াই চলছিল তার অন্তরে।
‘বোঝা যাচ্ছে, ও আমাকে অপমান করতে চায়’, বলে গেলেন কজনিশেভ, তবে আমাকে সে অপমান করতে পারে না আর আমি সর্বান্তঃকরণে ওকে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু জানি যে সেটা হবার নয়।’
হ্যাঁ, হা’, পুনরুক্তি করলেন লেভিন, ‘আমি বুঝি, ওর প্রতি তোমার মনোভাবের কদর করি আমি; কিন্তু আমি যাব।’
‘তোর যদি ইচ্ছে হয়, যা, কিন্তু আমি সে পরামর্শ দেব না, কজনিশেভ বললেন, ‘মানে আমার দিক থেকে এতে আমার ভয় নেই, আমার সাথে তোর একটা ঝগড়া বাধিয়ে দিতে ও পারবে না, কিন্তু তোর জন্য বলছি, না যাওয়াই বরং ভালো। সাহায্য করা যাবে না। তবে কর তোর যা ইচ্ছে।’
‘সাহায্য হয়ত করা যাবে না, কিন্তু আমি অনুভব করছি, বিশেষ করে এই মুহূর্তে, তবে সেটা অন্য ব্যাপার আমি অনুভব করছি যে না হলে আমি শান্তি পাব না।
কজনিশেভ বললেন, এটা আমি বুঝি না। তারপর যোগ করলেন, ‘আমি শুধু এটা বুঝি যে এটা হীনতাবোধের একটা পাঠ। অন্য দিকে নিকোলাই এখন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তারপর যাকে বলা হয় নীচতা সেটাকে আমি প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছি। জানিস কি সে করেছে…’
‘ওহ্ কি ভয়ানক, ভয়ানক!’ দু’বার কথাটা উচ্চারণ করলেন লেভিন।
কজনিশেতের চাপরাশির কাছ থেকে ভাইয়ের ঠিকানা পেয়ে লেভিন তখনই তার কাছে যাবার উপক্রম করছিলেন, কিন্তু খানিক ভেবে ঠিক করলেন ওটা সন্ধে পর্যন্ত মুলতবি রাখবেন। সেটা সর্বাগ্রে মনের প্রশান্তি পাবার জন্য, মস্কোয় যে কারণে এসেছেন সে ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করা দরকার। ভাইয়ের কাছ থেকে লেভিন আসেন অবলোনস্কির অফিস এবং শ্যেরবাৎস্কিদের খবর পেয়ে যেখানে কিটিকে ধরা যাবে বলে অবলোনস্কি বললেন, রওনা দিলেন সেখানেই।
নয়
লেভিন বেলা চারটায় দুরুদুরু বুকে জু-পার্কের কাছে ভাড়া গাড়ি থেকে নামলেন এবং হাঁটা পথ দিয়ে চললেন টিবি আর স্কেটিং রিঙ্কের দিকে। নিশ্চিত ছিলেন যে, সেখানে কিটিকে পাওয়া যাবে। কেননা গেটের কাছে। শ্যেরবাৎস্কিদের গাড়ি দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।
দিনটা পরিষ্কার। গেটের কাছে সারি বেঁধে গাড়ি, জে, কোচোয়ান, সিপাহী জ্বলজ্বলে রোদে টুপি ঝলকিয়ে গেটের কাছে আর খোদাই কাঠের ছোট ছোট রুশী কুটিরের মাঝখান দিয়ে পরিস্কৃত পথে গিজগিজ করছে পরিপাটী সব লোক। বাগানের আঁকড়া বুড়ো বাচগাছগুলো সমস্ত ডালপালায় বরফ ঝুলিয়ে যেন সমারোহের নববেশ ধারণ করেছেন।
হাঁটা পথ দিয়ে স্কেটিং রিঙ্কের দিকে যেতে যেতে নিজেকে তিনি বলছিলেন, ব্যাকুল হওয়া উচিত নয়, শান্ত থাকা দরকার। কি রে তুই? কি হল তোর? চুপ করে থাক, বোকাটা’, নিজের হৃদয়কে বললেন তিনি। আর যত তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলেন, ততই নিঃশ্বাস তার আরো বন্ধ হয়ে আসছিল। দেখা হল একজন পরিচিতের সাথে, তাকে সে ডাকলে, কিন্তু লেভিন চিনতেই পারলেন না লোকটাকে। ঢিবির কাছে এলেন তিনি, সেখানে গড়িয়ে নামা আর টেনে তোলা ছোট ছোট খেলার স্নেজগুলোর শেকল ঝনঝন করছে, শব্দ তুলছে ছুটন্ত স্লেজ, শোনা যাচ্ছে খুশির কলরোল। আরো কয়েক পা এগোতে সামনে দেখা দিল স্কেটিং রিঙ্ক, যারা কেট করছে তাদের মধ্যে তখনই তিনি চিনতে পারলেন কিটিকে।
যে আনন্দ আর ভয় তার হৃদয়কে চেপে ধরেছিল, তা দিয়েই তিনি জেনে গেলেন যে সে এখানেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা বলছিল রিঙ্কের বিপরীত প্রান্তে একটা মহিলার সাথে। তার পোশাকে আর ভঙ্গিমায় বিশেষত্ব কিছু ছিল না বলেই মনে হবে; কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে লেভিনের পক্ষে ওকে সনাক্ত করা বিছুটি গাছের ঝোঁপ থেকে একটা গোলাপ ঠাহর করার মতই সহজ। সব কিছুই উজ্জ্বল করে তুলেছে সে। ও যেন এক হাসি যার কিরণ পড়ছে পরিপার্শ্বের ওপর। লেভিনের মনে হল, বরফের ওপর দিয়ে, ওখানে ওর কাছে আমি সত্যিই যেতে পারি কি? যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সে জায়গাটা লেভিনের কাছে মনে হল অনধিগম্য পবিত্র, এক সময় তিনি প্রায় ফিরেই যাচ্ছিলেন : এতই ভয় করছিল তার। নিজের ওপর জোর করে তাঁকে ভাবতে হল যে ওর আশেপাশে আসা-যাওয়া করছে নানান ধরনের লোক, এবং তিনি নিজেও সেখানে যেতে পারেন স্কেটিং করতে। নিচে নামলেন তিনি, সূর্যকে না দেখার মত করে তার দিকে দৃষ্টিপাত এড়িয়ে, কিন্তু না তাকিয়েও তিনি তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন সূর্যের মত।
সপ্তাহের এই দিনটায়, এই সময়টায় জুটেছিল একই চক্রের লোকেরা, পরস্পর যারা পরিচিত। ছিল স্কেটিংয়ে যারা ওস্তাদ, নিজেদের ফলিয়ে বেড়াচ্ছিল, ছিল চেয়ার ধরে ভীরু ভীরু আনাড়ি ভঙ্গিতে স্কেটিং শিক্ষার্থী, ছিল শিশু আর স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে স্কেটিং-করা বৃদ্ধ; লেভিনের মনে হল সবাই তারা ভাগ্যের বরপুত্র, কেননা ওরা রয়েছে কিটির কাছাকাছি। যারা ফেট করছিল, সবাই যেন একেবারে নির্বিকার চিত্তে তার পাল্লা ধরছিল, তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, এমন কি কথাও বলছিল তার সাথে আর একেবারেই তার অপেক্ষা না রেখেই খুশি হয়ে উঠছিল চমৎকার বরফ আর চমৎকার আবহাওয়ায়।
খাটো জ্যাকেট আর সরু প্যান্টলুন পরা কিটির চাচাতো ভাই নিকোলাই শ্যেরবাৎস্কি স্কেট পরা পায়ে বসে ছিলেন বেঞ্চিতে, লেভিনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘আরে পয়লা নম্বরের রুশ স্কেটার যে! কতদিন এসেছেন? চমৎকার বরফ, নিন, কেট পরে নিন।
‘স্কেট আমার নেই’, বললেন লেভিন। কিটির উপস্থিতিতে তার এই অসংকোচ অকুণ্ঠতায় অবাক লাগল লেভিনের। কিটির দিকে না তাকালেও তাকে দৃষ্টিপথচ্যুত করতে এক সেকেন্ডও তিনি অপব্যয় করছিলেন না। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে সূর্য কাছিয়ে এসেছে। কিটি ছিল কোণে, উঁচু বুট পরা সরু পায়ে ভর দিয়ে স্পষ্টতই একটু ভয়ে ভয়ে সে এগিয়ে এল তাঁর দিকে। জোরে হাত দুলিয়ে রুশী কোর্তা পরা একটা ছেলে প্রায় মাটি পর্যন্ত নুয়ে ছাড়িয়ে গেল তাকে। কিটি কেট করছিল খুব নিশ্চিত ভঙ্গিতে নয়; রশিতে ঝোলানো হোট মাফ থেকে হাত বার করে সে তৈরি হয়ে রইল, তারপর লেভিনের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পেরে হাসল তার উদ্দেশে আর হেসে ওড়াল নিজের ভয়ও। বাঁক নেওয়াটা শেষ হলে সে তার স্থিতিস্থাপক পায়ে ঠেলা দিয়ে ফেট করে এল সোজা শ্যেরবাৎস্কির কাছে। আর তার হাত আঁকড়ে ধরে হেসে মাথা নোয়ালে লেভিনের দিকে। লেভিন যা কল্পনা করেছিলেন, তার চেয়েও সে অপরূপা।
তার কথা লেভিন যখন ভাবতেন, তখন সব কিছু জীবন্ত হয়ে কিটি ভেসে উঠত তার কল্পনায়, বিশেষ করে এই মাধুরী, শিশুর স্বচ্ছ শুভময়তার ব্যঞ্জনা, সুকুমার কুমারী কাঁধের ওপর ফরসা চুলের অনায়াস মাথাটি। তার মুখের শিশুসুলভ অভিব্যক্তি দেহের সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের সাথে মিলে গড়ে তুলেছিল তার বিশেষ একটা লাবণ্য, যেটা তার বেশ মনে আছে? কিন্তু তার ভেতর অপ্রত্যাশিত যে জিনিসটা তাকে সব সময়ই বিস্মিত করেছে সেটা তার নম্র, শান্ত, সত্যনিষ্ঠ চোখের দৃষ্টি, বিশেষ করে তার হাসি, লেভিনকে তা সব সময়ই নিয়ে যেত ইন্দ্রজালের জগতে, সেখানে তিনি নিজেকে অনুভব করতেন কোমল, মরমী, যেমনটি তিনি স্মরণ করতে পারেন তার একান্ত শৈশবের বিরল কয়েকটি দিনের ক্ষেত্রে।
‘অনেকদিন এসেছেন? হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিটি বলল। আর লেভিন তার মাফ থেকে খসে পড়া রুমাল কুড়িয়ে দিলে যোগ করল, ধন্যবাদ।
‘আমি? আমি এসেছি সম্প্রতি, গতকাল… মানে আজকেই এসেছি’, উত্তেজনাবশে চট করে তার প্রশ্নটা ধরতে না পেরে জবাব দিলেন লেভিন। ভাবছিলাম আপনাদের ওখানে যাব’, বললেন লেভিন এবং তখনই কি সংকল্প নিয়ে তিনি ওকে খুঁজছিলেন সেটা মনে পড়ায় থতমত খেয়ে লাল হয়ে উঠলেন, ‘আমি জানতাম না যে, আপনি স্কেট করেন। এবং সুন্দর করেন।
কিটি মন দিয়ে তাকিয়ে দেখল তার দিকে, যেন অস্বস্তির কারণটা বুঝতে চায়।
‘আপনার প্রশংসার কদর করতে হবে বৈকি। এখানে লোকমুখে এখনো চলে আসছে যে, আপনি সেরা স্কেটার, কালো দস্তানা পরা হোট হাত দিয়ে মাফের ওপর জমা হিমের কাঁটাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল কিটি।
হ্যাঁ, এক সময় আমি ফেট করতাম পাগল হয়ে; ইচ্ছে হত সুসম্পূর্ণতায় পৌঁছাই।’
মনে হয় আপনি সব কিছুই করেন পাগল হয়ে’, একটু হেসে সে বলল, আমার ভারি ইচে হচ্ছে আপনি কি রকম ক্ষেট করেন দেখব। কেট পরে নিন, চলুন আমরা একসাথে কেটিং করব।’
‘এক সাথে স্কেটিং! সে কি সম্ভব?’ লেভিন ভাবলেন কিটির দিকে তাকিয়ে। বললেন : ‘এখনই পরে আসছি।
স্কেটিঙের জুতা পরতে চলে গেলেন তিনি।
‘অনেকদিন আমাদের এখানে আসেননি’, পা ধরে হিলে স্কু পেঁচাতে পেঁচাতে বলল স্কেটিং পরিচারক, আপনার পর ওদের মধ্যে ওস্তাদ আর কেউ নেই। এটা চলবে’ বেল্ট টানতে টানতে সে বলল।
‘চলবে, চলবে, তাড়াতাড়ি কর, সুখের যে হাসিটা আপনা থেকে তার মুখে এসে গিয়েছিল সেটাকে বহু কষ্টে সংযত করে তিনি বললেন। ভাবলেন, হ্যাঁ, এই হল জীবন, এই হল সুখ। ও বলল এক সাথে, আসুন এক সাথে স্কেট করি। এবার ওকে বলব? কিন্তু আমি যে এখন সুখী, অন্তত সুখ পাচ্ছি আশা থেকে, সেই জন্যই যে বলতে ভয় হচ্ছে..আর যদি বলি?…কিন্তু বলা যে দরকার, দরকার! দূর হোক ছাই এই দুর্বলতা!
লেভিন উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কুটিরের সামনের খড়খড়ে বরফের ওপর দিয়ে ছুটে গেলেন মসৃণ বরফে, তারপর অনায়াসে, যেন তার ইচ্ছাশক্তিতেই গতিবেগ বাড়িয়ে পথ সংক্ষিপ্ত করে ছুটলেন। কিটির কাছে তিনি এলেন সসংকোচে, কিন্তু আবার তার হাসি আশ্বস্ত করল তাঁকে।
কিটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে, গতিবেগ বাড়তে থাকল আর যতই তা হল দ্রুত, ততই সজোরে কিটি হাত চেপে ধরল তার।
‘আপনার কাছে হলে আমি তাড়াতাড়ি শিখে ফেলতে পারতাম, কেননা আপনার ওপর বিশ্বাস আছে আমার।’
আর আপনি যখন আমার ওপর ভর দেন তখন আমিও বিশ্বাস রাখি নিজের ওপর, আর যা বলে ফেলেছেন তাতে তখনই ঘাবড়ে গিয়ে লাল হয়ে উঠলেন তিনি। এবং সত্যিই, এ কথাগুলো বলা মাত্র সূর্য যেন মেঘে ঢাকা পড়ল, মুছে গেল মুখের মৃদুলতা, লেভিন লক্ষ্য করলেন মুখের সেই ভাব পরিবর্তন যাতে বোঝায় চিন্তায় নিমগ্নতা ও তার মসৃণ কপালে দেখা দিয়েছে কুঞ্চন।
তাড়াতাড়ি করে তিনি বললেন, আপনার অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি তো? অবশ্য এ কথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই।’
‘কি কারণে?…না, অপ্রীতিকর কিছু আমার ঘটেনি’, নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল সে, তারপর সাথে সাথেই যোগ করল, মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে দেখা হয়েছে আপনার?
না এখনো নয়।
ওর কাছে যান। ভারি উনি ভালোবাসেন আপনাকে।
‘কি ব্যাপার? আমি আঘাত দিয়েছি ওকে। সৃষ্টিকর্তা, আমাকে সাহায্য করো!’ এই ভাবতে ভাবতে লেভিন ছুটে গেলেন বেঞ্চে বসা পাকা চুলের কুণ্ডলী দোলানো বৃদ্ধা ফরাসিনীর কাছে। বাঁধানো দাঁত বার করে হেসে তিনি তাঁকে। গ্রহণ করলেন পুরনো বন্ধুর মত।
‘হ্যাঁ, এই তো আমরা বেড়ে উঠছি’, চোখ দিয়ে কিটিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আর বুড়োচ্ছি। ছোট্ট ভালুক এখন বড় হয়ে উঠেছে!’ হেসে বলে চললেন ফরাসিনী, তিন বোনকে ইংরেজি কাহিনী থেকে তিন ভালুক বলে লেভিন যে রসিকতা করতেন, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। মনে আছে, আপনি তাই বলতেন?
লেভিনের সেটা আদৌ মনে ছিল না, কিন্তু এই দশ বছর উনি এই রসিকতাটায় হেসে আসছেন আর ভালোবাসতেন সেটা।
‘নিন যান, স্কেটিং করুন গে। আমাদের কিটি ভালোই স্কেটিং করতে শিখেছে, তাই না?
লেভিন যখন আবার কিটির কাছে এলেন, মুখ তার তখন আর কঠোর নয়, চোখে চোখে সততাশীল স্নেহময় দৃষ্টি। কিন্তু লেভিনের মনে হল এই স্নেহময়তার ভেতর আছে একটা বিশেষ রকমের, ইচ্ছাকৃত শান্তভাব। মন খারাপ হয়ে গেল তার। নিজের বৃদ্ধা গাভর্নেস আর তার বিদঘুঁটেমির গল্প করে কিটি তাকে তার জীবনের কথা জিজ্ঞেস করল।
বলল, সত্যিই কি শীতকালে গাঁয়ে আপনার একঘেয়ে লাগে না?’
না, একঘেয়ে লাগে না, কাজ আমার অনেক’, লেভিন বললেন, তিনি টের পাচ্ছিলেন যে কিটি তাকে তার শান্ত সুরের কবলে ফেলছে, তা থেকে বেরোনো তার পক্ষে অসাধ্য, যেমন হয়েছিল এই শীতের গোড়ায়।
কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক দিনের জন্য এসেছেন?
‘জানি না, কি বলছেন সে কথা না ভেবেই বললেন লেভিন। যদি কিটির এই শান্ত বন্ধুত্বে তিনি ধরা দেন, তাহলে কিছুরই ফয়সালা না করে আবার তিনি ফিরে যাবেন, এই ভাবনাটা মনে এল তাঁর, ঠিক করলেন ক্ষেপে উদ্দাম হয়ে উঠবেন।
জানেন না মানে?
‘জানি না। সব নির্ভর করছে আপনার ওপর’, এই বলেই তখনই তাঁর আতঙ্ক হল নিজের কথাগুলোয়।
কিটি তার কথাগুলো হয়ত-বা শুনেছিল, হয়ত শুনতে চায়নি, সে যাই হোক, যেন হোঁচট খেল সে, দু’বার পা ঠুকে তাঁর কাছ থেকে সে দূরে চলে গেল। মাদমোয়াজেল লিনোর কাছে গিয়ে কি যেন বললে, তারপর মহিলারা যেখানে স্কেট খোলে, সেই ঘরটায় গেল।
সৃষ্টিকর্তা, কি আমি করলাম! সৃষ্টিকর্তা! সাহায্য কর আমাকে, জ্ঞান দাও’, এই বলে প্রার্থনা করার সাথে সাথে সবেগ গতির একটা তাগিদ অনুভব করে ছুটে গেলেন একটা বাইরের, আরেকটা ভেতরের বৃত্ত এঁকে।
ঠিক এই সময় পায়ে স্কেট, মুখে সিগারেট নিয়ে কফি ঘর থেকে বেরিয়ে এল তরুণ স্কেটারদের সেরা একজন, সশব্দে স্কেট পায়েই লাফাতে লাফাতে সে নামল সিঁড়ি বেয়ে। ধেয়ে সে নামল নিচে, হাতের অবাধ ভঙ্গি না বদলিয়েই সে ফেট করতে লাগল বরফের ওপর।
‘আরে, এ যে দেখি নতুন খেল, এই বলে লেভিন তখনই ওপরে উঠলেন এই নতুন খেলটা খেলবার জন্য।
মারা পড়তে যাবেন না। এর জন্য অভ্যেস দরকার!’ নিকোলাই শ্যেরবাৎস্কি তাঁকে বললেন চেঁচিয়ে।
ওপরে উঠে লেভিন যতটা সম্ভব দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিলেন নিচে, অনভ্যস্ত এই গতিতে ভারসাম্য বজায় রাখলেন হাত বাড়িয়ে, শেষ ধাপে তার পা আটকে গিয়েছিল, কিন্তু হাত দিয়ে বরফ সামান্য স্পর্শ করে সজোর একটা দেহভঙ্গিতে সামলে নিয়ে হেসে এগিয়ে গেলেন।
স্কেট খোলার ঘর থেকে এই সময় মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে বেরিয়ে এসেছিল কিটি। হেসে, যেন তার আদরের বড় ভাই এমনি একটা মৃদু স্নেহে লেভিনের দিকে তাকিয়ে কিটি ভাবলে, কি ভালো, কি মিষ্টি! সত্যিই কি আমি দোষী, সত্যিই কি খারাপ কিছু করেছি? লোকে বলে? ছিনালি। আমি জানি যে আমি ভালোবাসি ওকে নয়; তাহলেও ওর সাহচর্যে আমার বেশ লাগে, ভারি সুন্দর লোক। কিন্তু ওই কথাটা ও বলল কেন?
সিঁড়িতে মেয়ের কাছে আসা মা আর কিটিকে চলে যেতে দেখে দ্রুতবেগে ধাবনের জন্য লাল হয়ে ওঠা লেভিন থেমে গিয়ে ভাবনায় ডুবে গেলেন। তারপর স্কেট খুলে ফটকের কাছে সঙ্গ ধরলেন মা আর মেয়ের।
প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘ভারি আনন্দ হল আপনাকে দেখে। বরাবরের মতই আমরা লোককে অভ্যর্থনা করি। বৃহস্পতিবার।
তার মানে আজকে?’
‘আপনার দেখা পেলে খুবই খুশি হব’, শুকনো গলায় বললেন প্রিন্স-মহিষী।
মায়ের এই নিরুত্তাপ ভাবটাকে শুধরে নেবার ইচ্ছা থেকে নিবৃত্ত হতে পারল না কিটি।
লেভিনের দিকে ফিরে হেসে সে বলল : তাহলে দেখা হবে।
এ সময় পাশকে করে টুপি মাথায়, চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে, বিজয়ীর আনন্দে পার্কে এলেন অবলোনস্কি। কিন্তু শাশুড়ির কাছে গিয়ে মনমরা আর দোষী মুখ করে তিনি ডল্লির স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে বুক টান করে লেভিনের হাত ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন? তাহলে কোথায় যাব? লেভিনের চোখের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কেবলই তোমার কথা ভেবেছি, এসেছ বলে ভারি খুশি।’
যাব, যাব’, উত্তর দিলেন সুখী লেভিন, তাহলে দেখা হবে’ এই কণ্ঠস্বর আর যে হাসির সাথে তা উচ্চারিত হয়েছিল তা তখনো তার কানে আর চোখে ভাসছিল।
ইংরেজি হোটেল, নাকি ‘এর্মিতাজ??
‘আমার কাছে সবই সমান।’
‘তাহলে ইংরেজি হোটেলই’, বললেন অবলোনস্কি, ইংরেজি হোটেল তিনি বাছলেন কারণ সেখানে, ইংরেজি হোটেলে তার দেনা ‘এর্মিতাজের চেয়ে বেশি। তাই এ হোটেলটা এড়িয়ে যাওয়া ভালো নয় বলে তার মনে হয়েছিল।
‘তোমার ভাড়া গাড়ি আছে? চমৎকার। আমি নিজের গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছি।’
সারাটা রাস্তা দু’বন্ধু চুপ করে রইলেন। কিটির মুখের এই ভাবপরিবর্তনের অর্থ কি, সেই কথা ভাবছিলেন লেভিন, কখনো নিজেকে আশ্বস্ত করছিলেন এই বলে যে আশা আছে, কখনো হতাশ হয়ে উঠছিলেন এবং পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন যে আশা করাটা পাগলামি, তাহলেও কিটির হাসি আর তাহলে দেখা হবে’ কথাটায় আগে তিনি যা ছিলেন তার চেয়ে নিজেকে ভিন্ন একটা লোক বলে অনুভব করছিলেন তিনি।
পথে যেতে যেতে অবলোনস্কি খাবারের মেনু ঠিক করছিলেন।
লেভিনকে বললেন, তুমি তো তুর্বো ভালোবাসো?
লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ্যাঁ? ত্যুর্বো? হ্যাঁ, আমি দারুণ ভালোবাসি ত্যুর্বো।
আন্না কারেনিনা – ১.১০
দশ
লেভিন যখন অবলোনস্কির সাথে হোটেলে ঢুকলেন তখন অবলোনস্কির মুখভাবের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য, মুখের আর গোটা দেহের জ্যোতির যেন-বা একটা সংযত লক্ষ্য না করে তিনি পারেননি। অবলোনস্কি তার ওভারকোট খুলে, টুপিটা মাথায় বাঁকা করে বসিয়ে গেলেন ডাইনিং-রুমে ফ্রক-কোট পরা ভোয়ালে হাতে যে তাতারগুলো তাকে হেঁকে ধরেছিল, তাদের অর্ডার দিতে লাগলেন। যেমন সর্বত্র তেমনি এখানেও তাঁকে সানন্দে স্বাগত করছিল যে পরিচিত, ডাইনে বায়ে তাদের উদ্দেশে মাথা নুইয়ে তিনি গেলেন ব্যুফেতে, মৎস্য সহযোগে ভোদকা পান করলেন এবং কাউন্টারের ওধারে উপবিষ্টা এবং রিবন, লেস, আর কেশকুণ্ডলী শোভিত রঙমাখা ফরাসিনীকে এমন কিছু বললেন যাতে এমন কি সেও অকপটে হেসে উঠল। লেভিন ভোকা খেলেন না শুধু এজন্য যে, আগাগোড়া পরের চুল আর চালের পাউডার আর প্রসাধনী ভিনিগার-এ বানানো ফরাসিনীটি তার কাছে অপমানকর ঠেকেছিল। একটা নোংরা জায়গা থেকে সরে যাবার মত করে তিনি তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন তার কাছ থেকে। তাঁর সমস্ত বুকে ভরে উঠেছিল কিটির স্মৃতিতে, চোখে তার জ্বলজ্বল করছিল জয় আর সুখের হাসি।
‘এখানে হুজুর, এখানে হুজুর কেউ বিরক্ত করবে না আপনাকে, সবচেয়ে বেশি করে তাঁকে যে হেঁকে ধরেছিল সেই বুড়োচুলো তাতারটা বলল, পাছাটা তার প্রকাণ্ড, ফ্রক-কোটের টেইল-দুটো তাতে ফাঁক হয়ে গেছে। আসুন হুজুর’, লেভিনকে সে ডাকল, অবলোনস্কির অতিথির দিকে মনোযোগ দিয়ে সে সম্মান দেখাতে চাইল অবলোনস্কিকে।
ব্রোঞ্জের দেয়াল-রাতির তলে আগে থেকেই টেবিল-ক্লথে ঢাকা গোল টেবিলটার ওপর মুহূর্তে টাটকা আরেকটা টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে সে অর্ডারের প্রতীক্ষায় অবলোনস্কির সামনে দাঁড়িয়ে রইল তোয়ালে আর মেনু-কার্ড হাতে নিয়ে।– আপনি যদি বলেন হুজুর, তাহলে আলাদা একটা কেবিনের ব্যবস্থা হতে পারে। তার মহিলার সাথে প্রিন্স গলিৎসিন এখনই চলে যাচ্ছেন। ঝিনুকের টাটকা মাংস পেয়েছি আমরা।’
‘অ, ঝিনুক।
অবলোনস্কি একটু ভাবলেন।
মেনু-কার্ডে আঙুল রেখে তিনি বললেন, ‘পরিকল্পনাটা বদলাব নাকি, লেভিন?’ মুখে তার গুরুতর অনিশ্চিতি ফুটে উঠল, ‘ঝিনুক কি ভালো হবে? তুমি ভেবে দেখো!
‘ফ্লেসবার্গ ঝিনুক, হুজুর, অস্টেন্ড নয়।
‘ফ্লেসবার্গ নয় হল, কিন্তু টাটকা কি
কাল পেয়েছি।’
‘তাহলে ঝিনুক দিয়েই শুরু করব নাকি, তারপর গোটা পরিকল্পনাটা বদলানো যাবে? হ্যাঁ?
‘আমার কাছে সবই সমান। আমার পক্ষে সবচেয়ে বাঁধাকপির স্যুপ আর শস্যদানার মণ্ড। তবে সে তো আর এখানে পাওয়া যাবে না।
‘আ-লা-রুস মণ্ড’ শিশুর ওপর ধাই-মা যেভাবে খুঁকে আসে, সেভাবে লেভিনের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলে তাতার।
না, ঠাট্টা নয়। তুমি যা পছন্দ করবে, তাই ভালো। স্কেটিং করে ছুটোছুটি করেছি, খিদে পেয়েছে, তারপর অবলোনস্কির মুখে অসন্তোষের ছায়া দেখে যোগ করলেন, ভেবো না তোমার রুচির তারিফ আমি করি না। তৃপ্তির। সাথে আমি দিব্যি খাব।’
‘তা আর বলতে! তবে যাই কও, এটাই জীবনের একটা পরিতৃপ্তি’, বললেন অবলোনস্কি, তাহলে ভায়া, আমাদের দাও বিশ, নাকি সেটা কম হবে। আচ্ছা, তিরিশটা ঝিনুক আর মূল দিয়ে সিদ্ধ সুপ..’
‘প্রেস্তানিয়ের’, তাতার লুফে নিল কথাটা, কিন্তু অবলোনস্কির ইচ্ছে ছিল না খাদ্যের ফরাসি নাম জানিয়ে সে তুষ্টি পাক।
মূল দেওয়া, বুঝেছ। তারপর গাঢ় সস্ সমেত ত্যুর্বো, তারপর… রোস্টবিফ, কিন্তু দেখো যেন ভালো করে বানানো হয়। তা ছাড়া কাপলুন চলতে পারে, আর বয়াম-জাত শবজি।’
ফরাসি মেনু অনুসারে খাদ্যের নাম না করার যে অভ্যাস ছিল অবলোনস্কির সেটা মনে রেখে তাতার আর নামগুলোর পুনরাবৃত্তি করল না, কিন্তু মেনু-কার্ড অনুসারে সে গোটা অর্ডারটা আওড়ে নিয়ে তৃপ্তি পেল ‘সুপ। প্রেস্তানিয়ের, অ্যার্বো সস বামার্শে, পুলা-আ লেস্ত্রাগ, মাসেদুয়া দ্য ফুই…’ এবং তখনই স্প্রিঙের মত একটা মলাট বাঁধানো মেনু-কার্ড রেখে মদের অন্য কার্ডটা নিয়ে এল অবলোনস্কির কাছে।
‘কি খাওয়া যায়?
‘তোমার যা ইচ্ছে তাই, তবে অল্প, শ্যাম্পেন’, বললেন লেভিন।
‘সেকি? প্রথমেই? তবে ঠিকই বলেছ। সাদা লেবেল ভালো লাগে তোমার?
‘কাশে ব্লাঁ’, খেই ধরল তাতার।
‘বেশ, ঝিনুকের সাথে ওই মার্কাটা আনো, পরে দেখা যাবে।
‘জি আচ্ছ। আর টেবিল-ওয়াইন কিছু?
ন্যুই দাও। না, বরং ক্লাসিকাল শাবলিই ভালো।
‘জ্বি আচ্ছা। আপনার পনিরের অর্ডার দেবেন কি?
‘ও হ্যাঁ, পারমেজান। নাকি তোমার পছন্দ অন্য কিছু।
না, আমার কিছু এসে যায় না, হাসি চাপতে না পেরে বললেন লেভিন।
ফ্রক-কোটের টেইল উড়িয়ে তাতার ছুটে গেল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল এক প্লেট খুলে ফেলা ঝিনুকের ঝকঝকে ভোলার ভেতর তার শাস আর আঙুলের ফাঁকে ধরা একটা বোতল নিয়ে।
মাড় দেওয়া ন্যাপকিনটা দলা-মোচড়া করে অবলোনস্কি সেটা তার ওয়েস্টকোটে খুঁজলেন এবং শান্তভাবে আয়েস করে হাত রেখে লাগলেন শুক্তি মাংসের সদ্গতিতে।
মন্দ নয়’, রুপার চামচে দিয়ে ঝিনুকের খোলা থেকে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন, ‘মন্দ নয়! চকচকে সজল চোখে কখনো তাতার, কখনো লেভিনের দিকে তাকিয়ে পুনরুক্তি করলেন তিনি।
ঝিনুকও লেভিন খেলেন যদিও পনিরের সাথে সাদা রুটি তার বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু অবলোনস্কিকে তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন মুগ্ধ হয়ে। এমন কি তাতারটিও বোতলের ছিপি খুলে পাতলা পানপাত্রে ফেনিল সুরা ঢালতে ঢালতে তার সাদা টাইটা ঠিক করে নিয়ে চাইছিল অবলোনস্কির দিকে।
নিচের পাত্র নিঃশেষ করে অবলোনস্কি বললেন, ‘ঝিনুক তোমার বিশেষ ভালো লাগে না, তাই না? নাকি কিছু একটা দুশ্চিন্তায় আছ? এ্যাঁ?
উনি চাইছিলেন লেভিন যেন হাসিখুশি হয়ে ওঠেন। কিন্তু লেভিনের যে শুধু খুশিই লাগছে না তাই নয়, সংকোচই । লাগছিল। তার মনে যে ভাবনাটা রয়েছে তাতে এই খানাঘরে, এই কেবিনগুলোর মধ্যে যেখানে মহিলাদের নিয়ে । আহার করছে লোকে, এই ছুটোছুটি আর ব্যস্ততার মাঝখানে তার কেমন ভয়-ভয় করছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল; ব্রোঞ্জ, আয়না, গ্যাসের আলো আর তাতারদের এই পরিবেশটা অপমানকর ঠেকছিল তাঁর কাছে। ভয় হচ্ছিল, তার হৃদয় যাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাতে বুঝি মালিন্য লাগবে।
বললেন, ‘আমি? হ্যাঁ, আমি একটু চিন্তায় আছি; কিন্তু তা ছাড়াও এই সব কিছু আমাকে ঠেসে ধরছে। আমি একটা গ্রাম্য লোক, তুমি ভাবতেই পারবে না আমার কাছে এ সবই বিকট, তোমার কাছে যে ভদ্রলোককে দেখেছিলাম, তার নখের মত…’
হেসে অবলোনস্কি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বেচারা গ্রিনেভিচের নখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলে তা দেখেছিলাম।
লেভিন বললেন, ‘আমি পারি না। তুমি আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখার চেষ্টা কর, গ্রাম্য লোকের দৃষ্টিভঙ্গি নাও। গ্রামে আমরা হাত-দুখানা এমন অবস্থায় রাখার চেষ্টা করি যাতে কাজের সুবিধা হয়। তার জন্য নখ কেটে ফেলি, মাঝে মাঝে আস্তিন গুটিয়ে রাখি। আর এখানে লোকে ইচ্ছে করে যতটা পারা যায় নখ রাখে, আর কফে লাগায় পিরিচের মত চওড়া বোতাম যাতে হাত দিয়ে কিছু করতে না হয়।
অবলোনস্কি খুশিতে হেসে উঠলেন।
‘হ্যাঁ, ওর যে স্থল পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, এটা তার লক্ষণ। কাজ করে ওর মাথা…’
হয়ত তাই। তাহলেও আমার কাছে এটা বিকট লাগে যে আমরা গাঁয়ের লোকেরা কাজে লাগার জন্য তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিই, আর তুমি আমি চেষ্টা করছি খাওয়াটা যত পারা যায় লম্বা করতে, আর তাই ঝিনুকের মাংস খাচ্ছি ..’
‘সে তো বলাই বাহুল্য, কথাটা লুফে নিলেন অবলোনস্কি, শিক্ষাদীক্ষার লক্ষ্যই তো এই : সব কিছু থেকে তৃপ্তি হেঁকে নেওয়া।
তাই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে আমি বরং বুনো হয়েই থাকতে চাই।’
এমনিতেই তো তুমি বুনো। বুনো লেভিনরা সবাই।’
দীর্ঘশ্বাস নিলেন লেভিন। মনে পড়ল নিকোলাই ভাইয়ের কথা, লজ্জা আর কষ্ট হল তাঁর, ভুরু কুঁচকে গেল। কিন্তু অবলোনস্কি এমন বিষয় নিয়ে কথা শুরু করলেন যে সাথে সাথেই তাতে আকৃষ্ট হলেন তিনি।
ঝিনুকের শুন্য খড়খড়ে খোলাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে তিনি পনির টেনে এনে রীতিমত চোখ চকচক করে বললেন, ‘কি, ওদের ওখানে, মানে শ্যেরবাস্কিদের ওখানে যাবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই যাব’, বললেন লেভিন, যদিও আমার মনে হয়েছিল যে প্রিন্স-মহিষী আমাকে ডেকেছেন অনিচ্ছায়।
‘কি বলছ? একেবারে বাজে কথা! এই ওঁর ধরন…ওহে ভাই, স্যুপ দাও!…ওটা ওঁর বড়লোকী স্বভাব’, বললেন অবলোনস্কি, ‘আমিও যাব, কিন্তু কাউন্টেস বানিনার ওখানে রিহার্সালে থাকতে হবে আমাকে। কিন্তু তুমি বুনো নও কি বলে? হঠাৎ তুমি মস্কো থেকে উধাও হলে, কি তার ব্যাখ্যা? তোমার সম্পর্কে শ্যেরবাৎস্কিরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন অবিরাম, যেন আমারই জানার কথা। আর আমি জানি শুধু একটা জিনিস : তুমি সব সময়ই তাই কর যা কেউ করে না।
‘হ্যাঁ’, লেভিন বললেন ধীরে ধীরে, বিচলিত হয়ে, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি বুনো। তবে আমি যে চলে গিয়েছিলাম তাতে নয়, ফিরে যে এলাম, এতেই আমার বন্যত্ব প্রকাশ পাচ্ছে…’
‘ওহ্, কি সুখী তুমি!’ লেভিনের চোখে চোখে তাকিয়ে তার কথার খেই ধরে বললেন অবলোনস্কি।
কেন?
‘দৌড়বাজ ঘোড়াকে চেনা যায় তার গায়ে দাগা মার্কা দেখে, আর প্রেমিক যুবককে চেনা যায় তার ভাবাকুল চোখ দেখে’, বড় গলায় বললেন অবলোনস্কি, সব কিছুই তোমার সামনে।
‘আর তোমার কি সবই পেছনে?’
না, পেছনে না হলেও ভবিষ্যৎ তোমার, আর আমার আছে বর্তমান–এমনি, গিঠে গিঠে বাঁধা।
‘কেন, কি ব্যাপার?
‘ভালো নয়। মানে, নিজের কথা আমি বলতে চাই না, তার ওপর সব বুঝিয়ে বলা অসম্ভব’, বললেন অবলোনস্কি, ‘তা তুমি মস্কো এলে কেন?… ওহে প্লেটগুলো সরিয়ে নাও!’ তাতারের উদ্দেশে হাঁক দিলেন তিনি।
অবলোনস্কির ওপর থেকে তাঁর গভীরে প্রোজ্জ্বল দৃষ্টি না সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন, ‘আন্দাজ করতে পেরেছ?
‘আন্দাজ করেছি, কিন্তু এ নিয়ে কথা পাড়তে পারছি না। এ থেকেই তুমি বুঝবে আমি ঠিক ধরেছি কি না, অবলোনস্কি লেভিনের দিকে তাকিয়ে বললেন সূক্ষ্ম হাসিতে।
‘কিন্তু তুমি কি বলে? কম্পিত কণ্ঠে লেভিন বললেন, টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর মুখের পেশী কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘তোমার কি মনে হচ্ছে,
লেভিনের চোখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ধীরে ধীরে শাবলির গেলাস নিঃশেষ করে অবলোনস্কি বললেন : ‘আমি? এর চেয়ে ভালো আর কিছু আমার চাইবার নেই। যা হওয়া সম্ভব তা ভেতর এটাই শ্রেয়।
‘কিন্তু তোমার ভুল হচ্ছে না তো? কি নিয়ে আমরা কথা বলছি তা জান তুমি? স্থির দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে লেভিন বলে উঠলেন, ‘তুমি কি ভাব এটা সম্ভব?
ভাবি যে সম্ভব। অসম্ভব হবে কেন?
‘আরে না-না, সত্যিই তুমি ভাবছ যে এটা সম্ভব না-না, তুমি যা ভাবছ সবটুকু খুলে বল। কিন্তু যদি, যদি প্রত্যাখ্যান আমার কপালে থাকে… আমি এমন কি নিশ্চিতই যে…’
তার আকুলতায় হেসে ফেলে অবলোনস্কি বললেন, কেন ও কথা ভাবছ তুমি?
মাঝে মাঝে আমার এরকমই মনে হয়। তাহলে সেটা যে একটা ভয়াবহ ব্যাপার হবে ওর কাছেও, আমার কাছেও।
মানে, মেয়েদের কাছে অন্তত এক্ষেত্রে ভয়াবহ কিছু নেই, পাণিপ্রার্থনায় প্রত্যেক মেয়েই গর্বিত বোধ করে।
‘হ্যাঁ প্রত্যেকে, কিন্তু সে নয়।’
অবলোনস্কি হাসলেন। লেভিনের এই আবেগপ্রবণতা তিনি বেশ বোঝেন, জানেন যে ওঁর কাছে বিশ্বের সমস্ত মেয়ে দুভাগে বিভক্ত। এক দলে পড়ে কিটি ছাড়া আর সব মেয়ে, সব কিছু মানবিক দুর্বলতা আছে তাদের, অতি মামুলী মেয়ে সব; দ্বিতীয় দলে পড়ে শুধু সে, কোনরকম দুর্বলতা যার নেই, সমস্ত মানবজাতির সে অনেক উর্ধ্বে।
‘আরে দাঁড়াও’, লেভিনের হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, সসের পাত্রটা লেভিন ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন, সস্ নাও।’
বাধ্যের মত লেভিন সস্ নিলেন, কিন্তু অবলোনস্কিকে খাওয়ার ফুরসত দিলেন না। বললেন : ‘আরে না, না, একটু রোসো তো তুমি। বুঝতে তো পারছ এটা আমার কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন। কারো সাথে কখনো এ নিয়ে কথা বলিনি। তাছাড়া তোমার সাথে যেমন তেমন ভাবে আর কারো সাথেই কথা বলতে পারি না আমি। দেখো, তুমি আর আমি একেবারে ভিন্ন লোক, রুচিতে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, সব কিছুতেই; কিন্তু আমি জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাকে বোঝো আর এই জন্যই দারুণ ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দোহাই, একেবারে খোলাখুলি সব বলো।’
যা ভাবছি তাই তো তোমাকে বলছি, হেসে বললেন অবলোনস্কি, কিন্তু তোমাকে আর বেশিকিছু বলব? আমার স্ত্রী আশ্চর্য মহিলা’, স্ত্রীর সাথে নিজের সম্পর্কের কথা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, তারপর এক মিনিট চুপ করে বলে গেলেন : ‘ওর দিব্যদৃষ্টি আছে, লোকের অন্তর ভেদ করে সে দেখতে পায় তাই নয়। কি ঘটবে তাও তার জানা থাকে, বিশেষ করে বিবাহাদি ব্যাপারে। যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে শাখোস্কায়া ব্রেনতেকে বিয়ে করবে। কারুর বিশ্বাস হতে চাইছিল না, কিন্তু ঘটল ঠিক তাই-ই। আর সে তোমার পক্ষে।
তার মানে!
মানে এই যে তোমাকে সে ভালোবাসে তাই নয়, বলছে যে কিটি অবশ্য-অবশ্যই হবে তোমার বউ।
এ কথায় লেভিনের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল যে হাসিতে সেটা চরিতার্থতার অশ্রুকণার সামিল।
‘এই কথা সে বলছে! চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, আমি সব সময়ই বলে এসেছি যে অতি চমৎকার লোক তোমার বউটি, কিন্তু যথেষ্ট হল এ সব কথা, উঠে দাঁড়িয়ে লেভিন বললেন।
‘বেশ, কিন্তু বসো তো।’
দৃঢ় পদক্ষেপে লেভিন পিঞ্জরাকৃতি ঘরখানায় দু’বার পায়চারি করলেন, চোখ পিটপিট করলেন যাতে অশ্রু দেখা যায় এবং কেবল তারপরেই ফিরে এলেন নিজের আসনে। বললেন, বুঝতে পারছ, প্রেম নয় এটা। প্রেমে আমি পড়েছি, কিন্তু এটা সে জিনিস নয়। আমার নিজের অনুভূতি এটা নয়, বাইরেকার কি-একটা শক্তি আচ্ছন্ন করেছিল আমাকে। আমি তো চলেই গেলাম, কেননা ঠিক করলাম ও সব হবে না, বুঝেছ, ওটা পৃথিবীতে যা হয় না তেমন একটা সুখ; নিচের সাথে লড়াই চালিয়েছি আমি, এখন দেখতে পাচ্ছি ওটা ছাড়া জীবন অর্থহীন। ফয়সালা করা দরকার…’
‘কিন্তু তুমি চলে গিয়েছিলে কেন?
‘আহ্ দাঁড়াও! ইস্, কত যে ভাবনা ঘুরছে মাথায়! কত কি জিজ্ঞেস করার আছে! শোন বলি, এই-যে বললে, এতে যে কি করে দিলে আমাকে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এতই আমি সুখী যে জানোয়ারই বনে গেছি । সব ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আমি শুনলাম যে নিকোলাই ভাই…জানো তো, সে এখানে… অথচ তার কথা ভুলে গেছি। আমার মনে হয় সেও যেন সুখী। ওটা একটা পাগলামি গোছের। কিন্তু একটা জিনিস সাঘাতিক… এই যেমন তুমি বিয়ে করেছ, এই অনুভূতিটা তোমার জানা আছে… এটা সাঘাতিক যে আমরা বয়স্ক, প্রেমের পথ নয়, পাপের পথ অতিক্রম করে এসেছি, হঠাৎ মিলিত হতে যাচ্ছি নিষ্পাপ, নিষ্কলংক একটা প্রাণীর সাথে; এটা বীভৎসতা, তাই নিজেকে অযোগ্য বলে না ভেবে পারা যায় না।
‘তোমার পাপ তো তেমন বেশি নয়।
‘আহ্, তাহলেও’, লেভিন বললেন, তাহলে, নিজের জীবনের পাতাগুলো পড়তে গিয়ে আমি কেঁপে উঠি, অভিশাপ দিই, তিক্ত বিলাপ করি…’ হ্যাঁ!
অবলোনস্কি বললেন, তা কি আর করা যাবে, দুনিয়াটাই যে অমনি ধারায় গড়া।
‘শুধু একটা সান্ত্বনা ওই প্রার্থনাটা যা সবসময় আমার ভালো লাগতো–আমাকে ক্ষমা কর আমার পুণ্যকর্মের জন্য নয়, তোমার অনুকম্পাভরে। শুধু এভাবেই সে ক্ষমা করতে পারে।
এগারো
লেভিন তার পানপাত্রটা খালি করে ফেললেন, তারপর দুজন চুপচাপ বসে রইলেন।
লেভিনকে অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা তোমাকে আমার বলা দরকার। ভ্রনস্কিকে চেনো তুমি?
না, চিনি না। কিন্তু কেন?
‘আরেকটা আনো’, অবলোনস্কি বললেন তাতারকে। পানপাত্র ভরে দিচ্ছিল সে, আর ওঁদের কাছে ঘুরঘুর করছিল ঠিক যে সময়টিতে তার দরকার থাকত না।
‘ভ্রনস্কিকে আমার জানতে হবে কেন?
‘জানতে হবে, কেননা সে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন।
‘কে এই ভ্রনস্কি জিজ্ঞেস করলেন লেভিন, এই কিছুক্ষণ আগেও তাঁর যে শিশুসুলভ উল্লসিত মুখভাব অবলোনস্কিকে মুগ্ধ করেছিল হঠাৎ তা হয়ে উঠল রাগত আর অপ্রীতিকর।
‘ভ্রনস্কি হলেন কাউন্ট কিরিল ইভানোভিচ ভ্রনস্কির এক ছেলে এবং পিটার্সবুর্গের গিল্টি-করা যুবসমাজের শ্রেষ্ঠ নির্দশন একটা। ভেরে যখন কাজ করতাম, তখন চিনতাম তাকে। সৈন্য রিক্রুটিঙের ব্যাপারে তিনি এসেছিলেন সেখানে। সাঙ্ঘাতিক ধনী, সুপুরুষ, বিস্তৃত যোগাযোগ, এইডডেকং, সেইসাথে ভারি মোলায়েম, চমৎকার লোক। না, নেহাৎ একজন চমৎকার লোকের চেয়েও বেশি। এখানে যখন আমি ওঁকে দেখলাম, তখন তিনি যেমন সুশিক্ষিত, তেমনি বুদ্ধিমান; এ লোক অনেক দূর যাবে।
লেভিন ভুরু কুঁচকে চুপ করে রইলেন।
‘তা উনি এখানে দেখা দিয়েছেন তুমি চলে যাবার কিছু পরেই, আর আমি যতদূর বুঝছি, কিটির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন আর বুঝতেই তো পারো, মা…’
‘মাপ কর, কিছুই আমি বুঝছি না’, লেভিন বললেন মুখ হাঁড়ি করে কপাল কুঁচকিয়ে, সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল নিকোলাই ভাইয়ের কথা এবং কি জানোয়ার তিনি যে তাকে ভুলতে পারলেন।
‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, হেসে তাঁর হাত ধরে বললেন অবলোনস্কি, ‘আমি যা জানি শুধু তাই তোমাকে বলেছি, তবে আবার জানাই, এই সূক্ষ্ম, সুকোমল ব্যাপারে যতটা অনুমান করা সম্ভব তাতে আমার মনে হয় চান্তা তোমার দিকেই বেশি।
লেভিন চেয়ারে আবারা ধপাস করে বসে পড়লেন, মুখ তার বিবর্ণ হয়ে উঠল।
তাঁর পানপাত্র পূর্ণ করে দিতে দিতে অবলোনস্কি বলে চললেন, ‘আমি পরামর্শ দেব যথাসত্বর ব্যাপারটার হেস্ত নেস্ত করে ফেলতে।
‘না, ধন্যবাদ, কিন্তু পান করতে আমি আর পারছি না’, গেলাস ঠেলে দিয়ে লেভিন বললেন, মাতাল হয়ে পড়ব… কিন্তু তুমি আছ কেমন? স্পষ্টতই কথার মোড় ফেরাবার জন্য বললেন লেভিন।
‘আরেকটা কথা, সমস্যাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলল, এই আমার পরামর্শ। আজই কথা বলতে বলছি না, বললেন অবলোনস্কি, ‘চলে যাও কাল সকালে। চিরায়ত রীতিতে প্রস্তাব দিও। তারপর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ…’।
কই, তুমি যে কেবলি বল শিকারের জন্য আমার ওখানে আসবে? এসো-না বসন্ত কালে’, লেভিন বললেন।
অবলোনস্কির সাথে এই আলাপটা শুরু করেছিলেন বলে এখন তিনি সর্বান্তঃকরণে অনুতপ্ত। কোন এক পিটার্সবুর্গ অফিসারের প্রতিযোগিতা নিয়ে কথাবার্তাটায়, অবলোনস্কির প্রস্তাব আর পরামর্শে তার বিশেষ অনুভূতিতে মালিন্য লেগেছে। অবলোনস্কি হাসলেন। তিনি বুঝেছিলেন কি চলছে লেভিনের ভেতরটায়।
বললেন, যার কোন এক সময়। আহ্ ভাই, নারী–এই স্কুপটা দিয়েই সব কিছু ঘুরছে। এই যেমন আমার অবস্থাটা খারাপ, অতি খারাপ। আর সবই ঐ নারীদের জন্য। তুমি আমাকে খোলাখুলি বলো তো, চুরুট বের করে অন্য হাতে পানপাত্র নিয়ে তিনি বলে চললেন, ‘তুমি উপদেশ দাও আমাকে।’
‘কিন্তু কি ব্যাপার?
ব্যাপার এই। ধরা যাক তুমি বিবাহিত, স্ত্রীকে ভালোবাসো, কিন্তু অন্য নারীর প্রেমে মেতে উঠেছ…’
‘মাপ কর, এটা আমি একেবারেই বুঝি না, যে যেন…যতই বলো, যেমন বুঝি না কেন আমি ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পরই রুটিখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় চুরি করব কিনা একটা বন রুটি।’
অবলোনস্কির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল সচরাচরের চেয়েও বেশি।
‘কেন নয়? মাঝে মাঝে বন রুটি এমন গন্ধ ছাড়ে যে লোভ সামলানো দায়।
নিজের পাথিব কামনা-বাসনাকে
যদি আমি পরাজিত করে থাকি, সে তো চমৎকার;
আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলেও
আনন্দটুকু তো পাওয়া গেল।
জার্মান ভাষায় এই বলে অবলোনস্কি শুধু সূক্ষ্ম হাসলেন। না হেসে পারলেন না লেভিনও।
অবলোনস্কি বলতে লাগলেন, না, এটা ঠাট্টার কথা নয়। ভেবে দেখো, এ নারী মিষ্টি, নম্র, প্রেমময়ী একটা প্রাণী, বেচারা, নিঃসঙ্গিনী, সব বিসর্জন দিয়েছে আমার জন্য। এখন, কাণ্ডটা যখন হয়েই গেছে–ভেবে দেখো–সত্যিই কি ওকে ত্যাগ করতে পারি? ধরা যাক, পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য ছাড়াছাড়ি হল, কিন্তু ওর জন্য কি করুণা হবে না, ওর একটা ব্যবস্থা করব না, সহনীয় করে তুলব না ওর জীবন?
কিন্তু মাপ কর ভাই, তুমি তো জানো, আমার কাছে সমস্ত নারী দু’ভাগে বিভক্ত… মানে, না… সঠিক বলল : নারী আছে এবং আছে… মনোরমা পতিতা আমি দেখিনি, দেখবও না, আর কাউন্টারের ওই চাচর চিকুর দোলানো রঙ-করা ফরাসিনীর মত যারা, তারা আমার কাছে জঘন্য জীব, সব পতিতাই তাই।
‘আর বাইবেলোক্ত পতিতা?’
‘আহ চুপ কর তো! খ্রিস্ট যদি জানতেন কথাগুলোর কি অপব্যবহার হবে, তাহলে কখনোই তিনি তা বলতেন না। কেননা সারা খ্রিস্ট উপদেশামৃত থেকে লোকে মনে রেখেছে কেবল ঐটুকুই। তবে আমি বলছি যা ভাবি তা নয়, যা অনুভব করি। পতিতা নারীদের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা আছে। তুমি ভয় পাও মাকড়শায়, আমি এই কদর্য জীবগুলোকে। মাকড়শাদের নিয়ে তুমি নিশ্চয় অনুসন্ধান চালাওনি, তাদের ধরন-ধারন জানো না? আমিও সেইরকম।’
‘তোমার পক্ষে এ সব কথা বলতে আর কি; এ ঠিক ডিকেন্সের ওই ভদ্রলোকটির মত, যিনি বাঁ হাতে সমস্ত মুশকিলে প্রশ্নগুলোকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেন ডান কাঁধের ওপর দিয়ে। কিন্তু বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা তার জবাব নয়। কি করা যাবে, তুমি বলো আমাকে, কি করি? বৌ বুড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি জীবনে ভরপুর। দেখতে না দেখচে টের পেতে হয়, বৌকে যতই শ্রদ্ধা করি, সপ্রেম ভালোবাসা আর সম্ভব নয়। তারপর হঠাৎ দেখা দিল প্রেম, তুমিও ডুবলে, একেবারে ডুবলে!’ বিষন্তাশায় বললেন অবলোনস্কি।
লেভিন ঠোঁট কুঁচকে হাসলেন।
হ্যাঁ, ডুবেছি’, অবলোনস্কি বলে চললেন, কিন্তু কি করা যায়?
বন রুটি চুরি করতে যেও না।’
হেসে উঠলেন অবলোনস্কি।
‘আহা আমার নীতিবান! কিন্তু ভেবে দেখো। রয়েছে দুটো নারী। একজন দাবি করছে শুধু নিজের অধিকার, আর সে অধিকার হল ভালোবাসা যা তুমি দিতে অক্ষম; অন্যজন তোমার জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছে, অথচ কিছুই দাবি করছে না। কি করা যাবে তখন, কি কর্তব্য? এ এক ভয়ংকর ট্রাজেডি।’
‘এ ব্যাপারে আমার উপদেশ যদি শুনতে চাও, তাহলে আমি বলব যে এক্ষেত্রে কোন ট্রাজেডি ঘটেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেন, তা বলি। আমার মতে প্রেম… দু’ধরনের প্রেমই, মনে আছে তো? প্লেটো যার সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সিম্পোজিয়ামে’, দু’ধরনের প্রেমই লোককে পরখ করার কষ্টিপাথর। একদল লোক শুধু এক ধরনের প্রেম বোঝে, অন্য দল অন্যটা। যারা অনিষ্কাম প্রেমই বোঝে, খামোকাই তারা ট্রাজেডির কথা বলছে। এরকম প্রেমে কোন ট্রাজেডিই হতে পারে না। সুখদানের জন্য বিনীত ধন্যবাদ’, ব্যাস, ফুরিয়ে গেল ট্রাজেডি। আর নিষ্কাম প্রেমে ট্রাজেডির কথাই ওঠে না, কেননা এরূপ প্রেমে সবই উজ্জ্বল আর নির্মল, কেননা…’
এই সময় লেভিনের মনে পড়ল তার নিজের পাপ আর তা নিয়ে আত্মগ্লানির কথা। তাই হঠাৎ তিনি যোগ করলেন : ‘তবে তুমিও হয়ত ঠিক, খুবই তা সম্ভব… কিন্তু আমি জানি না, সত্যিই জানি না।’
অবলোনস্কি বললেন, ‘কি জানো, তুমি খুবই লক্ষ্যনিষ্ঠ লোক। এটা তোমার গুণও বটে, দোষও বটে। তোমার নিজের চরিত্র লক্ষ্যনিষ্ঠ আর চাও যেন গোটা জীবন অন্বিত হয়ে ওঠে লক্ষ্যনিষ্ঠ ঘটনায়, অথচ এটা হয় না। এই যে তুমি প্রশাসনিক রাজপুরুষদের কার্যকলাপ ঘৃণা কর, কারণ তোমার ইচ্ছে যেন ব্যাপারটা চলে একটা লক্ষ্য মেনে, এটা হয় না। তুমি এও চাও, একজন ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপের যেন সব সময়ই একটা লক্ষ্য থাকে, প্রেম আর পারিবারিক জীবন যেন সব সময় একসাথে মিলে যায়। অথচ সেটা হয় না। জীবনের সমস্ত বৈচিত্র্য, সমস্ত মাধুরী, সমস্ত সৌন্দর্য গড়ে ওঠে ছায়া আর আলো দিয়ে।
লেভিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কোন জবাব দিলেন না তিনি। মগ্ন ছিলেন নিজের চিন্তায়, অবলোনস্কির কথা কানে যাচ্ছিল না।
হঠাৎ দুজনেই টের পেলেন যে তাঁরা যদিও বন্ধু এবং একসাথে খানাপিনা করেছেন, যাতে তাদের আরো কাছাকাছি আসার কথা, তাহলেও প্রত্যেকে ভাবছেন শুধু নিজের ব্যাপার নিয়ে, অপরের জন্য কারোর মাথাব্যথা নেই। আহারের পর নৈকট্যের পরিবর্তে এই চূড়ান্ত বিযুক্তির অভিজ্ঞতা অবলোনস্কির হয়েছে একাধিক বার এবং জানতেন এ সব ক্ষেত্রে কি করা উচিত।
‘বিল!’ বলে চিৎকার করে তিনি গেলেন পাশের কক্ষে এবং তৎক্ষণাৎ পরিচিত একজন অ্যাডজুট্যান্টের দেখা পেলেন, তার সাথে শুরু করে দিলেন জনৈকা অভিনেত্রী আর তার পৃষ্ঠাপোষককে নিয়ে আলাপ। অ্যাডজুট্যান্টের সাথে কথা কয়ে অবলোনস্কি তৎক্ষণাৎ লেভিনের সাথে কথাবার্তা থেকে হাঁপ ছেড়ে হালকা হবার আমেজ পেলেন। লেভিন সব সময়ই তাকে আহ্বান করতেন বড় বেশি মানসিক ও আত্মিক প্রয়াসে।
তাতার যখন ছাব্বিশ রুবল আর কিছু কোপেক, সেই সাথে ভোদুকার জন্য বখশিসের বিল নিয়ে এল, গ্রামবাসী যে লেভিন অন্য সময়ে তার ভাগের এই চৌদ্দ রুবল বিল দেখে আঁতকে উঠতেন, এবার তিনি ভ্রূক্ষেপও করলেন না, হিসাব মিটিয়ে দিলেন এবং বাড়ি ফিরলেন পোশাক বদলিয়ে শ্যেরবাৎস্কিদের ওখানে রওনা দেবার জন্য, যেখানে তাঁর ভাগ্য স্থির হয়ে যাবে।
বারো
এখন প্রিন্সেস কিটি শ্যেরবাঙ্কায়ার বয়স আঠারো বছর। সমাজে সে বেরোচ্ছে এই প্রথম শীত। এখানে তার সাফল্য তার দু’বোনের চেয়ে বেশি, এমন কি প্রিন্স-মহিষীর প্রত্যাশাকেও তা ছাড়িয়ে গেছে। মস্কোর বলনাচগুলোতে যেসব তরুণ যোগ দিত, তাদের প্রায় সবাই যে কিটির প্রেমে পড়েছিল শুধু তাই নয়, সেই প্রথম শীতেই দেখা দিল। গুরুত্বের সাথে বিবেচনার যোগ্য দুজন পাত্র ও লেভিন, এবং তিনি চলে যাওয়ার পরেই আবির্ভূত হন কাউন্ট ভ্রনস্কি।
শীতের গোড়ায় লেভিনের আগমন, তার ঘন ঘন যাতায়াত, কিটির প্রতি তার সুস্পষ্ট অনুরাগ প্রিন্স ও প্রিন্স মহিষীর মধ্যে কিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর আলোচনা ও তাঁদের মধ্যে কলহের উপলক্ষ হয়ে উঠেছিল। প্রিন্স ছিলেন লেভিনের পক্ষে, বলতেন যে কিটির জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু তিনি কামনা করেন না। আর নারীদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাসে তার স্ত্রী বলতেন যে কিটির বয়স বড় কম, লেভিনের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকল্প আছে, সেটা কোন কিছুতেই তিনি প্রকাশ করেননি, ওঁর জন্য কিটির টান নেই ইত্যাদি নানা যুক্তি দিতেন; কিন্তু প্রধান কথাটা তিনি বলেননি যে মেয়ের জন্য তিনি যোগ্যতর পাত্রের অপেক্ষায় আছেন, লেভিনকে তাঁর ভালো লাগে না, তাঁকে বোঝেন না তিনি। লেভিন যখন অকস্মাৎ চলে গেলেন, প্রিন্স-মহিষী খুশিই হলেন, সগৌরবে স্বামীকে বললেন, ‘দেখছ তো, আমার কথাই ঠিক।’ আর যখন উদয় হল ভ্রনস্কির, তখন তিনি আরো খুশি হলেন তার এই অভিমতে নিশ্চিত হয়ে যে কিটির হওয়া উচিত নেহাৎ ভালো রকম নয়, চমৎকার একটা বিয়ে।
মায়ের কাছে নস্কি আর লেভিনের মধ্যে কোন তুলনাই হতে পারে না। মায়ের ভালো লাগতো না যেমন লেভিনের উদ্ভট, উকট সব মতামত, সমাজে তার আনাড়িপনা (যেটা তার গর্বপ্রসূত বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন), তেমনি, মহিলাটির ধারণায়, গরু-বাছুর চাষী-বাসী নিয়ে গাঁয়ের কি-একটা বুনো জীবন;এটাও তার পছন্দ হয়নি যে লেভিন তার মেয়ের প্রেমে পড়ে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন দেড় মাস, যেন কিসের আশা করছিলেন, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, যেন ভয় পাচ্ছিলেন, পাণিপীড়িনের প্রস্তাব দিলে কি ওঁদের বড় বেশি সম্মান দেখানো হবে, আর । ভেবেই দেখেননি, যে-বাড়িতে বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, সেখানে যাতায়াত করলে নিজেকে ব্যক্ত করে বলা দরকার। আর হঠাৎ কিছুই না বলে কয়ে তিনি চলে গেলেন। এতই ও অনাকর্ষণীয় যে কিটি তার প্রেমে পড়েনি, এটা ভালোই হয়েছে, ভেবেছিলেন মা।
সব দিক দিয়েই ভ্রনস্কি তৃপ্ত করেছিলেন মায়ের আকাঙ্ক্ষা। অতি ধনী, বুদ্ধিমান, অভিজাত, দরবারে যে চমৎকার একটা সামরিক কেরিয়ার গড়ে তুলতে চলেছেন, মনোহর একটা লোক। এর চেয়ে ভালো কিছুর আশা করা যায় না।
বলনাচগুলোয় ভ্রনস্কি স্পষ্টতই কিটির দিকে সবিশেষ মনোযোগ দিতেন নাচতেন তার সাথে, তাঁদের বাড়ি যেতেন, ফলে তার সংকল্পের শুরুত্বে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তাহলেও এই সারাটা শীত ছিলেন একটা অদ্ভুত অস্থিরতা আর উত্তেজনার মধ্যে।
ফুফুর ঘটকালিতে প্রিন্স-মহিষীর নিজের বিয়ে হয়েছিল ত্রিশ বছর আগে। পাত্র সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল সব কিছু, এল সে কনে দেখতে, তাকেও দেখা হল; কার কেমন লেগেছে সেটা জেনে ঘটকী ফুফু জানালেন পরস্পরকে; ভালোই লেগেছিল দু’পক্ষের; তারপর নির্ধারিত দিনে পিতামাতার কাছে এল পাণিপীড়নের প্রত্যাশিত প্রস্তাব এবং তা গৃহীত হল। সবই চলেছিল অতি সহজে আর নির্বিঘ্নে। অন্তত প্রিন্স মহিষীর তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু নিজের মেয়েদের বেলায় তাকে টের পেতে হয়েছিল যে এই বিয়ে দেওয়াটা মোটেই তেমন সহজ, সরল, আপাত-সাধারণ ব্যাপার নয়। তার বুড়ো দু’মেয়ে ডল্লি আর নাটালির বিয়েতে কতরকম ভয়ই-না তার করেছে, কত ভাবনা ফিরে ভাবতে হয়েছে, খরচ করেছেন কত টাকা, কত খিটিমিটি বেধেছে স্বামীর সাথে। এখন ছোট মেয়ের বেলায় তাঁকে সইতে হচ্ছে সেই একইরকম ভয়, একইরকম সন্দেহ, আর আগের চেয়ে স্বামীর সাথে আরো বেশি কলহ। বৃদ্ধ প্রিন্স সমস্ত পিতার মতই ছিলেন নিজের মেয়েদের সম্মান ও নিষ্পপতা নিয়ে অতিশয় খুঁতখুঁতে আর কড়া। তার মেয়েদের, বিশেষ করে তার আদরিণী কিটি সম্পর্কে তিনি ছিলেন অবিবেচকের মত স্নেহে ঈর্ষায় পীড়িত, মা মেয়ের নাম ডোবাচ্ছে বলে প্রতি পদে তিনি একটা তুলকালাম কাণ্ড বাধাতেন। প্রথম মেয়েদের সময় থেকেই স্ত্রী এতে অভ্যস্ত, কিন্তু এবার তিনি অনুভব করছিলেন যে প্রিন্সের খুঁতখুতানির ভিত্তি এখন আছে বেশি। তিনি দেখছিলেন যে সাময়িক কালে সমাজের রীতিনীতি অনেক বদলে গেছে, এতে মায়ের দায়িত্ব হয়ে উঠেছে অনেক কঠিন, তিনি দেখছেন যে কিটির সমবয়সীরা নানান সব সমিতি গড়ে তুলছে, কিসব কোর্সে যোগ দিচ্ছে, অবাধে আলাপ করছে পুরুষের সাথে, একা একা রাস্তায় বেরোচ্ছে গাড়ি করে, অনেকে উপবেশনের ভঙ্গিতে অভিবাদনও করছে না আর সবচেয়ে বড় কথা, সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস, স্বামী নির্বাচন তাদেরই ব্যাপার, পিতামাতার নয়। এসব তরুণী, এমন কি বৃদ্ধেরাও ভাবতো এবং বলত, এখন আর লোকে আগের মত মেয়ের বিয়ে দেয় না। কিন্তু কি করে এখন মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়, সেটা প্রিন্স-মহিষী জানতে পারেননি কারো কাছ থেকে। সন্তানের ভাগ্য স্থির করে দেবে মা-বাপে–এই ফরাসি রেওয়াজ এখন অগ্রহণীয়, ধিকৃত। মেয়েদের অবাধ স্বামীনতার ইংরেজ কেতাও অগ্রাহ্য এবং রুশ সমাজে অসম্ভাব্য। ঘটকালির রুশী রীতি বিকট, এবং সবাই, এমন কি প্রিন্স-মহিষীও হাসাহাসি করেছেন তা নিয়ে। কিন্তু মেয়ে কিভাবে বিয়ে করবে, তার বিয়ে দেওয়া হবে কেমন করে, সেটা কেউ জানে না। এ ব্যাপারে প্রিন্স-মহিষী যাদের সাথে কথা বলেছেন, তারা শুধু বলেছেন একটা কথাই? ও সব ছাড় ন, একালে ও সব সেকেলে প্রথা ঝেড়ে ফেলাই উচিত। বিয়ে তো করতে যাচ্ছে মা-বাপে নয়, তরুণ-তরুণীরা, তাই যা বোঝে সেইভাবে। ঠিকঠাক করে নিক। যার মেয়ে নেই, তার পক্ষে এ কথা বলা সহজ, অথচ প্রিন্স-মহিষী বুঝতেন যে মেলামেশায় মেয়ে এমন লোকের প্রেমে পড়তে পারে যে তাকে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক অথবা এমন লোক, যে স্বামী হবার অযোগ্য। এবং তাকে যতই বোঝানো হোক যে আমাদের কালে নবীনদের উচিত নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য স্থির করে নেওয়া, তিনি সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি, যেমন তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে কোন কালেই পাঁচ বছর বয়সী শিশুর সেরা খেলনা হওয়া উচিত গুলিভ পিস্তল। তাই বড় মেয়েদের চেয়ে কিটির জন্য তার দুশ্চিন্তা ছিল বেশি।
এখন তার ভয় হচ্ছিল যে ভ্রনস্কি আবার যেন তার মেয়ের প্রতি ওই সবিশেষ মনোযোগেই সীমিত না থাকেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে মেয়ে তার প্রেমে পড়েছে, কিন্তু এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে লোকটা সৎ ও কাজ তিনি করবেন না। কিন্তু সেইসাথে তার জানা ছিল যে বর্তমানের অবাধ মেলামেশায় একটা মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া কত সহজ এবং সাধারণভাবে পুরুষেরা এই অন্যায়টাকে কত লঘু চোখে দেখে। গত সপ্তাহে কিটি মাকে বলেছিল মাজুরকা নাচের সময় ভুক্তির সাথে কি কথাবার্তা হয়েছিল তার। কথাবার্তাটি খানিকটা আশ্বস্ত করে প্রিন্স মহিষীকে; কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে তিনি পারেননি। কিটিকে ভ্রনস্কি বলেছিলেন যে তাঁরা, দু’ভাই-ই সব কিছু ব্যাপারেই মায়ের কথামত চলতে এত অভ্যস্ত যে তার পরামর্শ না নিয়ে গুরুতুপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত কখনো গৃহীত হয় না। এখন আমি পিটার্সবুর্গ থেকে মায়ের আগমনের অপেক্ষা করছি একটা বিশেষ সৌভাগ্য হিসেবে’, বলেছিলেন : ভ্রনস্কি।
কিটি তার মাকে এটা বলেছিল কথাগুলোয় কোন গুরুত্ব না দিয়ে। কিন্তু মা জিনিসটাকে নিয়েছিলেন অন্যভাবে। তিনি জানতেন যে বৃদ্ধা যে কোন দিন এসে পড়বেন বলে অপেক্ষা করা হচ্ছে, ছেলের নির্বাচনে বৃদ্ধা খুশি হবেন, তাই মাকে আঘাত দেবার ভয়েই নাকি ছেলে এখনো পাণিপ্রার্থনা করছে না এটা তার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছিল; তাহলেও বিয়েটা তিনি এত চাইছিলেন, এবং তার চেয়েও বেশি করে চাইছিলেন দুর্ভাবনা থেকে শান্তি যে তাই-ই তিনি বিশ্বাস করতেন। বড় মেয়ে ডল্লি যে স্বামীকে ছেড়ে যাবে বলে ঠিক করেছে তা চোখে দেখা তাঁর কাছে এখন যতই কষ্টকর হোক, ছোট মেয়ের যে ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে তার জন্য অস্থিরতাই তাঁর অন্য সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আজ লেবিনের আবির্ভাবে আরো নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছি তার। তার ধারণা, লেভিনের প্রতি এক সময় টান ছিল মেয়ের, অতিরিক্ত সততাবশে সে আবার স্কিকে প্রত্যাখ্যান না করে বসে, এবং সাধারণভাবেই লেভিনের আগমনে সমাপ্তির মুখে এসে পড়া ব্যাপারটা আবার গোলমালে না পড়ে, বিলম্বিত না হয়, এই ভয় করছিলেন তিনি।
বাড়ি ফিরে প্রিন্স-মহিষী লেভিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কি অনেকদিন হল এসেছে?
‘আজ, মামা।
‘একটা কথা আমি বলতে চাই…’ মা শুরু করলেন এবং তাঁর গুরুগম্ভীর উত্তেজিত মুখ দেখে কিটি টের পেল কথাটা হবে কি নিয়ে।
লাল হয়ে উঠে ঝট করে দায়ের দিকে ফিরে সে বললে, মা, মিনতি করছি, বলল না। আমি জানি, সব জানি।
মা যা চাইছিলেন, সেও চাইছিল তাই, কিন্তু মায়ের চাওয়ার পেছনকার উদ্দেশ্যগুলো আঘাত দিচ্ছিল তাকে।
‘আমি শুধু বলতে চাই যে একজনকে আশা দিয়ে …’
মা, লক্ষ্মী মা আমার, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, বলল না। ও নিয়ে কথা বলতে ভারি ভয় লাগে।
‘আচ্ছা, বলব না, বলব না, মেয়ের চোখে পানি দেখে মা বলল, কিন্তু একটা কথা, সোনা আমার, আমাকে কথা দাও যে আমার কাছ থেকে তুমি লুকিয়ে রাখবে না কিছু। রাখবে না তো?
কখনো না, কোন কিছুই না, আবার লাল হয়ে উঠে মায়ের চোখে চোখে তাকিয়ে বলল কিটি, কিন্তু এখন আমার বলার কিছু নেই। আমি… আমি… যদি আমি বলতে চাইতাম, তাহলেও জানি না কি বলব, কেমন করে বলব… আমি জানি না…’।
‘এইরকম চোখ নিয়ে তুমি মিথ্যে বলতে পারো না’, মেয়ের ব্যাকুলতায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে মা ভাবলেন হাসিমুখে। হাসিমুখে, কেননা মেয়ের প্রাণের ভেতর যা চলেছে সেটা বেচারির কাছে কি বিপুল আর অর্থময়ই না মনে হচ্ছে।
তেরো
আহারের পর থেকে সান্ধ্য পার্টি শুরু হওয়া পর্যন্ত কিটির অনুভূতিটা এমন হয়েছিল যে, লড়াইয়ে নামার আগে একটা তরুণের অনুভূতি যে রকম হয়। বুক তার ভয়ানক ঢিপঢিপ করছিল, কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না।
সে অনুভব করছিল, ওঁদের দুজনের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হচ্ছে এই যে সন্ধ্যায়, সেটা তার ভাগ্যনির্ধারক হওয়ার কথা। অনবরত তার কল্পনায় ভেসে উঠছিলেন ওঁরা দুজন, কখনো আলাদা আলাদা, কখনো দুজন একসাথে। অতীতে লেভিনের সাথে তার সম্পর্কের কথা সে স্মরণ করছিল পুলকে আর দরদে। শৈশবের স্মৃতি, তার প্রয়াত ভাইয়ের সাথে লেভিনের বন্ধুত্বের স্মৃতিতে তার সাথে কিটির সম্পর্কে লাগছিল একটা কাব্যিক মাধুর্যের ছোঁয়া। কিটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা যাতে কিটি কাব্যিকে মাধুর্যের ছোঁয়া। কিটির প্রতি তার ভালোবাসা যাতে কিটি সুনিশ্চিত, সেটা ছিল তার কাছে অহংতৃপ্তি আর আনন্দের ব্যাপার। লেভিনের কথা ভাবাটা তার কাছে সহজ। কিন্তু ভ্রনস্কির কথা ভাবতে গেলে কি একটা সংকোচ গোল বাধাতো, যদিও তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় মার্জিত আর শান্ত; কেমন একটা মিথ্যাচার এসে পড়ত–ভ্রনস্কির দিক থেকে নয়, তিনি ছিলেন খুবই সহজ আর মিষ্টি স্বয়ং কিটির দিক থেকেই, যে ক্ষেত্রে লেভিনের কাছে সে নিজেকে অনুভব করত একেবারে সহজ আর পরিষ্কার। কিন্তু আবার যেই ভাবত ভ্রনস্কির সাথে তার ভবিষ্যতের কথা, অমনি তার সামনে ভেসে উঠত একটা জ্বলজ্বলে সুখময় পরিপ্রেক্ষিত; লেভিনের বেলায় ভবিষ্যৎটা দেখাতো ঝাপসা।
সন্ধ্যার জন্য সাজগোজ করতে ওপরে উঠে কিটি আয়নার তাকিয়ে সানন্দে লক্ষ্য করল যে আজকের দিনটা তার একটা ভালো দিন, নিজের সমস্ত শক্তি আছে তার পরিপূর্ণ দখলে আর সেটা দরকার আসন্নের জন্য; নিজের মধ্যে সে অনুভব করছিল বাইরের একটা প্রশান্তি এবং গতিভঙ্গিমায় অসংকোচ সৌষ্ঠব।
সাড়ে সাতটায় ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চাপরাশি খবর দিল : কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন। প্রিন্স-মহিষী তখনো তাঁর ঘরে আর প্রিন্স বেরিয়ে এলেন না। কিটি ভাবল, ‘ঠিক যা ভেবেছিলাম, সমস্ত রক্ত ধেয়ে এল তার হৃৎপিণ্ডে। আয়নার নিজের পাণ্ডুরতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে।
এখন সে নিশ্চিত জানে যে আগে আগে তিনি এসেছেন শুধু কিটিকে একা পেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন বলে। এখন এই প্রথম গোটা ব্যাপারটা তার কাছে প্রতিভাত হল একেবারে অন্য, নতুন একটা দিক থেকে। কেবল এখনই। সে বুঝল যে প্রশ্নটা কেবল একা তাকে নিয়ে নয়–করে সাথে সে সুখী হবে, কাকে সে ভালোবাসছে, এই নয়–এই মুহূর্তে তাকে আঘাত দিতে হবে এমন একজনের মনে যাকে সে ভালোবাসে। এবং আঘাত দিতে হবে নিষ্ঠুরভাবে…কিসের জন্য? এজন্য যে সে ভারি ভালো লোক, ভালোবাসে তাকে, তার প্রণয়াসক্ত। কিন্তু করবার কিছু নেই। এটাই দরকার, এটাই উচিত।
‘সৃষ্টিকর্তা, এটা কি আমাকে নিজেকেই বলতে হবে ওকে?’ কিটি ভাবলে, কিন্তু কি বলব? সত্যিই কি ওকে বলব যে আমি ওকে ভালোবাসি না? কিন্তু সে তো মিথ্যে বলা হবে। কি বলি তাকে? বলব কি ভালোবাসি অন্যকে? না, সে অসম্ভব। আমি চলে যাব এখান থেকে, চলে যাব।
দরজার কাছে ও চলেই গেছে, এমন সময় লেভিনের পদশব্দ কানে এল। না, এটা অসাধুতা। আমার ভয় পাবার কি আছে? আমি খারাপ তো কিছু করিনি। যা হবার, হবে! সত্যি কথাই বলব। ওর কাছে আমার অস্বস্তি লাগতে পারে না। ওই এসে গেছে, তার বলিষ্ঠ আর ভীরু মূর্তি, তার দিকে নিবদ্ধ তার জ্বলজ্বলে চোখ দেখে মনে মনে বলল সে। সোজাসুজি তার মুখের দিকে তাকাল যেন ক্ষমা প্রার্থনা করছে, হাত এগিয়ে দিল।
ফাঁকা ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে লেভিন বললেন, আমি ঠিক সময়ে নয়, মনে হচ্ছে বড় বেশি আগে এসে পড়েছি। যখন দেখলেন যে তার আশা সফল হয়েছে, মন খুলতে কেউ তাকে বাধা দেবে না, মুখখানা তার হয়ে উঠল বিষণ্ণ-গভীর।
‘আরে না, এই বলে কিটি বসল একটা টেবিলের কাছে।
না বসে, আর মনোবল যাতে না হারায় সে জন্য কিটির দিকে না তাকিয়ে তিনি শুরু করলেন, আমি আপনাকে একলা পেতেই চেয়েছিলাম।’
মা এখনই বেরোবেন। গতকালের পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। গতকাল…’
সে কথা বলছিল যদিও নিজেই জানত না কি বলছে তার ঠোঁট, লেভিনের ওপর থেকে মিনতিভরা কোমল দৃষ্টি সে সরিয়ে নিচ্ছিল না।
লেভিন তাকালেন ওর দিকে; কিটি লাল হয়ে উঠে চুপ করে গেল।
‘আমি আপনাকে বলেছি যে অনেকদিনের জন্য এসেছি কিনা জানি না… সব নির্ভর করছে আপনার ওপর…’
কিটি ক্রমশ মাথা নুইয়ে আনল। ভেবে পাচ্ছিল না আসন্নের কি জবাব দেবে।
লেভিন পুনরুক্তি করলেন, ‘সব আপনার ওপর নির্ভর করছে। আমি বলতে চাইছিলাম… আমি বলতে চাইছিলাম… আমি এই জন্যই এসেছি… যে… বলব, আমাকে বিয়ে করুন!’ কি বলছেন তা খেয়াল না করেই তিনি বলে যাচ্ছিলেন; কিন্তু সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক জিনিসটা বলা হয়ে গেছে টের পেয়ে থেমে গেলেন এবং তাকালেন কিটির দিকে।
লেভিনের দিকে না তাকিয়ে সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। পরমানন্দের অনুভূতি হচ্ছিল তার। সুখাবেশে ভরে উঠেছিল হৃদয়। একেবারেই সে আশা করেনি যে লেভিনের প্রেম-স্বীকৃতি তার ওপর এমন প্রবল রেখাপাত করবে। কিন্তু এ অনুভূতিটা টিকল শুধু এক মুহূর্ত। ভ্রনস্কির কথা মনে পড়ল তার। লেভিনের দিকে তার উজ্জ্বল সত্যনিষ্ঠ চোখ মেলে এবং তার মরিয়া মুখখানা দেখে তাড়াতাড়ি করে সে জবাব দিলে :
‘সে হতে পারে না… মাপ করবেন আমাকে…’
এক মুহূর্ত আগেও কিটি ছিল লেভিনের কত আপন, তাঁর জীবনের পক্ষে কত জরুরি! আর এখন সে হয়ে গেল তার কত পর। তার কাছ থেকে কত সুদূর!
তিনি কিটির দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘এছাড়া আর কিছু হতে পারত না।
তিনি মাথা নুইয়ে চলে যাবার উপক্রম করলেন।
চৌদ্দ
প্রিন্স-মহিষী এ সময় ঘরে ঢুকলেন। ওদের একা দেখে এবং মুখভাবে হতাশা লক্ষ্য করে তার আতঙ্ক হয়েছিল। লেভিন তাকে অভিবাদন করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। কিটি চোখ না তুলে চুপ করে রইল। মা ভাবলেন, হায় সৃষ্টিকর্তা! রাজি হয়নি তাহলে, এবং প্রতি বৃহস্পতিবার সচরাচর যে হাসি দিয়ে তিনি অভ্যাগতদের বরণ করেন, তাতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর মুখ। আসন নিয়ে তিনি লেভিনের গ্রামের জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আবার বসলেন লেভিন, অতিথিদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলেন যাতে অলক্ষ্যে চলে যেতে পারেন।
পাঁচ মিনিট বাদে ঢুকলেন কিটির বান্ধবী, গত শীতে বিবাহিতা, কাউন্টেস নর্ডস্টন।
রোগা, হলদেটে, রুগ্ণ, স্নায়বিক চেহারার এক মহিলা ইনি, কালো চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। কিটিকে ভালবাসতেন তিনি, আর অনূঢ়াদের প্রতি বিবাহিতাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে সব সময় যা ঘটে থাকে, তার এ ভালোবাসা প্রকাশ পেত সুখ সম্পর্কে তাঁর আদর্শ অনুসারে কিটির বিয়ে দেবার বাসনায়, তাই চাইতেন যে ভ্রনস্কিকে সে বিয়ে করুক। শীতের গোড়ায় লেভিনকে তিনি প্রায়ই এদের এখানে দেখেছেন এবং কখনোই তাঁকে পছন্দ হয়নি। লেভিনের সাথে দেখা হলে তার বরাবরের প্রিয় কাজ হত তাঁকে নিয়ে তামাসা করা।
‘উনি যখন তার মহিমার শিখর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন : হয় আমার সাথে মননশীল কথাবার্তা বন্ধ করেন কারণ আমি বোকা, নয় কৃপা করে আমার পর্যায়ে নেমে আসেন,–তখন সেটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি ভারি ভালোবাসি : এই নেমে আসা! আমাকে যে উনি দেখতে পারেন না, তাতে আমি খুব খুশি, উনি বলতেন।
উনি ঠিকই বলতেন, কেননা সত্যিই লেভিন ওঁকে দেখতে পারতেন না এবং যা নিয়ে তার গর্ব ছিল এবং যা তিনি নিজের গুণ বলে মনে করতেন–তাঁর স্নায়বিকতা, স্থল ও ঐহিক সব কিছুর প্রতি তাঁর সূক্ষ্ম অবজ্ঞা ও উদাসীনতা– তার জন্য লেভিন ঘৃণা করতেন তাঁকে।
নর্ডস্টন আর লেভিনের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা উঁচু সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, যথা, দুজন ব্যক্তি বাহ্যত বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে পরস্পরকে ঘৃণা করছে এমন মাত্রায় যে পরস্পরকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে, এমন কি কেউ কারো দ্বারা আহত হতেও অক্ষম।
কাউন্টেস নর্ডস্টন তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন লেভিনের ওপর।
‘আরে, কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ যে! আবার এলেন আমাদের ব্যভিচারী ব্যাবিলনে’, ওঁর দিকে তাঁর ছোট্ট হলদেটে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল যে শীতের গোড়ায় লেভিন একবার বলেছিলেন যে মস্কো হল ব্যাবিলন। তা ব্যাবিলনেরই চরিত্র শোধরাল নাকি আপনার চরিত্রই নষ্ট হল?’ মুচকি হেসে কিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি যোগ দিলেন।
‘আমার কথা আপনি এত মনে রাখেন দেখে কৃতার্থ বোধ করছি কাউন্টেস’, ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে তখনই অভ্যাসবশত কাউন্টেস নর্ডস্টনের সাথে রসিকতা-শত্রুতার সম্পর্ক পাতলেন, ‘নিশ্চয় কথাগুলো আপনার মনে খুব ছাপ ফেলেছিল।’
বাঃ, তা নয়ত কি? আমি সব টুকে রাখি। কি কিটি, আবার স্কেটিং করেছিস বুঝি?…’ ।
কিটির সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। এখন চলে যাওয়া যতই অস্বস্তিকর হোক, সারা সন্ধে এখানে বসে থেকে কিটিকে দেখার চেয়ে সে অস্বস্তিকরতা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ। কিটি মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল তাঁর দিকে এবং তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। উনি উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু উনি চুপ করে আছেন দেখে প্রিন্স-মহিষী তাকে জিজ্ঞেস করলেন?
মস্কোয় আপনি এসেছেন অনেক দিনের জন্য? আপনি তো মনে হয় জেমস্তৃতোর কর্মকর্তা, বেশি দিন থাকা তো আপনার চলে না।
লেভিনের কঠোর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাউন্টেস নর্ডস্টন ভাবলেন, কিছু একটা হয়েছে ওঁর, কেন জানি তর্কে নামছেন না। কিন্তু আমি ওঁকে টেনেবোর করব। ভারি মজা লাগে কিটির সামনে ওঁকে অপদস্থ করতে এবং তা করব।’
কাউন্টেস বললেন, ‘কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ, আমাকে একটু বুঝিয়ে দিন তো-আপনি তো এ ব্যাপারগুলো সবই জানেন–আমাদের কালুগা গ্রামে সব চাষী আর সব মাগীগুলো তাদের যা কিছু ছিল মদ খেয়ে উড়িয়েছে, এখন আমাদের আর খাজনা-পত্র কিছু দিচ্ছে না। কি এর মানে? আপনি তো সব সময়ই চাষীদের খুব প্রশংসা করেন।
এই সময় ঘরে এলেন আরেকজন মহিলা, লেভিন উঠে দাঁড়ালেন।
মাপ করবেন কাউন্টেস, আমি সত্যিই এ সব ব্যাপার কিছু জানি না, আপনাকে কিছু বলতেও পারব না, এই বলে তিনি তাকালেন মহিলার পিছু পিছু আসা জনৈক সামরিক অফিসারের দিকে।
ইনিই নিশ্চয় ভ্রনস্কি’, ভাবলেন লেভিন এবং সেটা যাচাই করার জন্য তাকালেন কিটির দিকে। ইতিমধ্যে কিটি ভ্রনস্কিকে দেখে চকিত দৃষ্টিপাত করল লেভিনের দিকে। অজান্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখের সেই একটা দৃষ্টিপাত থেকেই লেভিন বুঝলেন যে কিটি এই লোকটিকে ভালোবাসে, নিজে মুখে কিটি সে কথা বলল যা দাঁড়াতো, বুঝলেন তেমনি সুনিশ্চিত হয়ে। কিন্তু কি ধরনের লোক ইনি?
এখন–ভালো হোক, মন্দ হোক–লেভিন থেকে না গিয়ে পারেন না; তাঁকে জানতে হবে, কিটি যাকে ভালোবেসেছে, কেমনধারা লোক সে।
কিছু কিছু লোক আছে যারা কোন-না-কোন দিক থেকে সৌভাগ্যবান প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পেলে তার ভেতর ভালো যা কিছু সব বরবাদ করে শুধু খারাপটাই দেখতে উগ্রীব; উল্টো দিকে আবার কিছু লোক আছে যারা এই সৌভাগ্যবান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দেখতে চায় কি কি গুণের জন্য সে তাদের পরাভূত করল, এবং বুক টনটন করলেও তার মধ্যে খোঁজে শুধু ভালোটাই। লেভিন ছিলেন এই ধরনের লোক। কিন্তু প্রনস্কির মধ্যে ভালো আর আকর্ষণয়ের খোঁজ পেতে তার বেগ পেতে হল না। সাথে সাথেই তা চোখে পড়ল। ভ্রনস্কি ছিলেন মধ্যম দৈর্ঘ্যের সুগঠিত দেহের মানুষ, কালো চুল, সহৃদয়, কান্তিমান মুখে অসাধারণ প্রশান্তি আর দৃঢ়তা। তার মুখে এবং মূর্তিতে, ছোট করে ছাঁটা কালো চুল আর সদ্য কামানো থুতনি থেকে শুরু করে চওড়া আনকোরা উর্দি পর্যন্ত সব কিছুই সাধারণ, অথচ সুচারু। মহিলাকে পথ ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথম প্রিন্স-মহিষী, পরে কিটির কাছে গেলেন।
কিটির দিকে যখন তিনি যাচ্ছিলেন তাঁর সুন্দর চোখজোড়া বিশেষ একটা কমনীয়তায় ঝলমল করে উঠল; প্রায় অলক্ষ্য একটা সুখ আর নম্র বিজয়ের হাসি নিয়ে (লেভিনের তাই মনে হল), তিনি সাবধানে সম্মান দেখিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলেন এবং বাড়িয়ে দিলেন তার ছোট তবে চওড়া হাত।
সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে কয়েকটা করে কথা বলে উনি বসলেন লেভিনের দিকে না তাকিয়ে, ওঁর ওপর থেকে লেভিনের দৃষ্টি সরছিল না।
‘আসুন আলাপ করিয়ে দিই’, লেভিনকে দেখিয়ে প্রিন্স-মহিষী বললেন, কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন, কাউন্ট আলেকসেই কিরিলোভিচ ভ্রনস্কি।
ভ্রনস্কি উঠে দাঁড়ালেন এবং বন্ধুর মত লেভিনের চোখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
তাঁর সহজ খোলামেলা হাসি হেসে বললেন, এই শীতে মনে হয় আমার সাথে আপনার আহারের কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আপনি চলে গেলেন।
কনস্তান্তিন দমিত্ৰিচ শহর, আর আমাদের শহুরেদের দেখতে পারেন না, ঘৃণা করেন, বললেন কাউন্টেস নর্ডস্টন।
‘আমার কথাগুলো যখন আপনি এত মনে রাখেন তখন আপনার ওপর তা নিশ্চয় খুব চাপ ফেলে’, লেভিন বললেন এবং এই কথাগুলো যে আগেই বলেছেন সেটা মনে পড়ে যাওয়ায় লাল হয়ে উঠলেন।
ভ্রনস্কি লেভিন আর কাউন্টেস নর্ডস্টনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সব সময়ই গ্রামে থাকেন? আমার মনে হয় শীতকালে একঘেয়ে লাগে, তাই না?
‘কোন কাজ থাকলে একঘেয়ে নয়, তা ছাড়া নিজেকে তো আর একঘেয়ে লাগে না’, তীক্ষ্ণ জবাব দিলেন লেভিন।
‘গ্রাম আমি ভালোবাসি’, লেভিনের গলার সুর লক্ষ্য করে এবং লক্ষ্য করেননি এই ভাব করে কি বললেন।
কাউন্টেস নর্ডস্টন বললেন, কিন্তু আশা করি কাউন্ট সব সময় গ্রামে থাকতে রাজি হবেন না।
জানি না, গ্রামে আমি থাকিনি বেশিদিন’, ভ্রনস্কি বলে চললেন, তবে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমার। মায়ের সাথে নীস্-এ শীত কাটাবার সময় গায়ের জন্য, বাকলের জুতা আর চাষীগুলো নিয়ে রুশী গায়ের জন্য আমার যে মন কেমন করেছিল তেমন আর কোথাও হয়নি। জানেনই তো, নীস্ এমনিতেই একটা একঘেয়ে জায়গা। নেপলস, সরেন্তোও তাই, ভালো লাগে শুধু অল্প সময়ের জন্য। আর ঠিক সেখানেই বড় বেশি মনে পড়ে রাশিয়া, ঠিক তার গাঁয়ের কথাই… সেগুলো ঠিক যেন…’।
তিনি বলে যাচ্ছিলেন কিটি লেভিন, উভয়কেই লক্ষ্য করে ও একজনের ওপর থেকে আরেকজনের দিকে তাঁর শান্ত, অমায়িক দৃষ্টি ফিরিয়ে–বলে যাচ্ছিলেন স্পষ্টতই যা তার মাথায় আসছিল।
কাউন্টেস নর্ডস্টন কিছু একটা বলতে চাইছেন লক্ষ্য করে তিনি কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলেন, মন দিয়ে শুনতে লাগলেন তাকে আলাপ মুহূর্তের জন্যও থামছিল না, ফলে প্রসঙ্গের ঘাটতি পড়লে বৃদ্ধা প্রিন্স-মহিষীর সব সময়ই মজুদ থাকত যে দুটো ভারি কামান ও ক্লাসিক আর আধুনিক শিক্ষা এবং বাধ্যতামূলক সৈনিকবৃত্তি, তা আর ব্যবহার করতে হল না, আর কাউন্টেস নর্ডস্টনেরও লাগা হল না লেভিনের পেছনে।
সাধারণ আলাপে যোগ দেবার ইচ্ছে হচ্ছিল লেভিনের, কিন্তু পারছিলেন না; প্রতি মুহূর্তে তিনি নিজেকে বলছিলেনঃ ‘এবার যেতে হয়, কিন্তু চলে গেলেন না, কি যেন আশা করছিলেন।
আলাপ চলল প্ল্যানচেত টেবিল আর প্রেতাত্মা নিয়ে। কাউন্টেস নর্ডস্টন প্রেতবাদে বিশ্বাসী, কি কি অলৌকিক কাণ্ড তিনি দেখেছেন সে কথা বলতে লাগলেন তিনি।
‘আহ্ কাউন্টেস, সৃষ্টিকর্তার দোহাই! অবশ্য-অবশ্যই ওদের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিন। অসাধারণ কিছু আমি দেখিনি, যদিও তার খোঁজে থেকেছি সর্বত্র’, হেসে বললেন ভ্রনস্কি।
‘বেশ, আগামী শনিবার, জবাব দিলেন কাউন্টেস নর্ডস্টন, আর কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচ, এসবে বিশ্বাস করেন? লেভিনকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘কেন জিজ্ঞেস করছেন? জানেনই তো আমি কি বলব।’
কিন্তু আমি আপনার মত জানতে চাইছি।’
লেভিন বললেন, আমার মত শুধু এই যে, এসব প্ল্যানচেত টেবিলে প্রমাণ হয় যে, শিক্ষিত সমাজ কৃষকদের চেয়ে উন্নত নয়। তারা চোখ দেওয়ায়, মারণ, উচাটন বশীকরণে বিশ্বাস করে, আর আমরা…’
‘সে কী! আপনি বিশ্বাস করেন না?’
বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
কিন্তু আমি যদি স্বচক্ষে দেখে থাকি?’
কৃষক মেয়েরাও বলে যে, তারা বাস্তুভূতকে দেখেছে।
‘তার মানে আপনি ভাবছেন, আমি মিথ্যে বলছি?’ নিরানন্দ হাসি হেসে উঠলেন তিনি।
না-না, মাশা। কনস্তান্তিন দুমিত্রিচ বলছেন যে, উনি বিশ্বাস করতে পারেন না, লেভিনের পক্ষ নিয়ে লাল হয়ে বলল কিটি। সেটা লেভিন বুঝলেন এবং উত্যুক্তি তার আরো বেড়ে গেল। ভেবেছিলেন জবাব দেবেন, কিন্তু কথাবার্তা অপ্রীতিকর হয়ে উঠবে-এমন আশঙ্কা দেখা দিতেই তখনই তার খোলামেলা প্রসন্ন হাসি নিয়ে সাহায্যে এলেন ভ্রনস্কি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সম্ভব বলে আপনি একেবারে স্বীকার করেন না কেন, বলুন তো? বিদ্যুতের অস্তিত্ব আমরা মানি– যা কেউ দেখিনি; কেন আরো একটা নতুন শক্তি সম্ভব হবে না, যা আমাদের কাছে এখনো অজ্ঞাত, যা…’।
‘বিদ্যুৎ যখন আবিষ্কৃত হয়, ক্ষিপ্রগতিতে বাধা দিয়ে বললেন লেভিন, তখন দেখা গিয়েছিল শুধু ঘটনাটা, জানা ছিল না কোত্থেকে তা ঘটছে এবং কি তা করতে পারে তাকে কাজে লাগাবার আগে বহু যুগ কেটে যায়। প্রেতবাদীরা কিন্তু শুরু করেছেন প্ল্যানচেত টেবিলকে দিয়ে লিখিয়ে। প্রেতাত্মারা আসছে তাদের কাছে, তারপর বলতে লাগলেন যে অজ্ঞাত শক্তি আছে।
ভ্রনস্কি মন দিয়ে লেভিনের কথা শুনছিলেন, যা তিনি সব সময় শুনে থাকেন। স্পষ্টতই আকৃষ্ট বোধ করছিলেন। তাঁর কথায়।
‘তা ঠিক, কিন্তু প্রেতবাদীরা বলেন : এ শক্তিটা কি তা বর্তমানে আমরা জানি না। কিন্তু শক্তি আছেই, আর ঐ পরিস্থিতিতে তা সক্রিয় হচ্ছে। শক্তিটা কি তা বের করুন বিজ্ঞানীরা। কেন এটা নতুন কোন শক্তি হতে পারবে না, আমি তার কোন কারণ দেখছি না। যদি তা…’
কারণ, বাধা দিলেন লেভিন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যতবারই আপনি উল দিয়ে রজন ঘষবেন, ততবারই দেখা যাবে। নির্দিষ্ট একটা ঘটনা। আর এক্ষেত্রে ঘটছে প্রতিবার নয়, তার মানে প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়।’
সম্ভবত, কথাবার্তাটা ড্রয়িং-রুমের পক্ষে বড় বেশি ভারী হয়ে উঠছে অনুভব করে ভ্রনস্কি আর আপত্তি করলেন না। প্রসঙ্গ ফেরাবার চেষ্টায় ফুর্তিতে হেসে তিনি ফিরলেন মহিলাদের দিকে। বললেন, ‘আসুন কাউন্টেস, এখনই চেষ্টা করে দেখা যাক, কিন্তু লেভিনের ইচ্ছে, যা ভেবেছেন তা পুরো বলবেন।
তিনি বলে চললেন, আমি মনে করি যে কোন একটা নতুন শক্তি দিয়ে নিজেদের আজব কাণ্ডগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য প্রেতবাদীদের এই প্রচেষ্টা একেবারে অসার্থক। তারা সরাসরি আত্মিক শক্তির কথা বলছেন আর চাইছেন তার। একটা বস্তুগত পরীক্ষা চালাতে।’
সবাই অপেক্ষা করছিলেন কখন উনি শেষ করবেন, লেভিনও টের পাচ্ছিলেন সেটা।
‘আর আমি মনে করি, চমৎকার মিডিয়া হবেন আপনি’, বললেন কাউন্টেস নর্ডস্টন, ‘আপনার মধ্যে ভাবাবেগের মত কি-একটা যেন আছে।
মুখ খুলতে গিয়েছিলেন লেভিন, ভেবেছিলেন কিছু একটা বলবেন, কিন্তু লাল হয়ে গিয়ে কিছুই আর বললেন না।
ভ্রনস্কি বললেন, ‘আসুন, কাউন্টেস, এখনই টেবিলের পরীক্ষা হয়ে যাক। আপনার আপত্তি নেই তো প্রিন্সেন?
উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রনস্কি এদিক-ওদিক তাকিয়ে টেবিল খুঁজতে লাগলেন।
কিটি টেবিল ছেড়ে উঠে পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখাচোখি হয়ে গেল লেভিনের সাথে। তার ভারি কষ্ট হচ্ছিল লেভিনের জন্য। কষ্টটা আরো হচ্ছিল এই কারণে যে ওঁর দুর্ভাগ্যের হেতু সে-ই। তার চাহনি বলছিল, ‘পারলে আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভারি সুখী।
আর লেভিনের দৃষ্টি জবাব দিলে, ঘৃণা করি সবাইকে। আপনাকেও, নিজেকেও। টুপি তুলে নিলেন তিনি, কিন্তু চলে যাবার নির্বন্ধ তার ছিল না। ছোট টেবিলটা ঘিরে সবাই জুটতে চাইছে আর লেভিন চাইছেন যেতে–এমন সময় ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ প্রিন্স। মহিলাদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে ফিরলেন লেভিনের দিকে। সানন্দে তিনি শুরু করলেন, ‘আরে! অনেকদিন হল নাকি? আমি জানতাম না যে তুমি এখানে! ভারি খুশি হলাম আপনাকে দেখে।
বৃদ্ধ প্রিন্স লেভিনকে কখনো বলছিলেন তুমি’, আবার কখনো ‘আপনি। লেভিনকে আলিঙ্গন করে তার সাথেই কথা জুড়লেন, খেয়াল করলেন না ভ্রনস্কিকে। ভ্রনস্কি উঠে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে অপেক্ষা করছিলেন–কখন প্রিন্স ফিরবেন। তার দিকে।
কিটি টের পাচ্ছিল, যা ঘটে গেছে তার পর বাবার এই মনোযোগ লেভিনের পক্ষে কত দুঃসহ। সে এও দেখল যে, বাবা শেষ পর্যন্ত ভ্রনস্কির অভিবাদনের জবাবে কি নিরুত্তাপ প্রত্যভিবাদন দিলেন এবং কি অমায়িক বিহ্বলতায় ভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন তার বাবার দিকে, বুঝবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন না কেন, কিসের জন্য তার প্রতি বিরূপতা সম্ভব। লাল হয়ে উঠল কিটি।
কাউন্টেস নর্ডস্টন বললেন, প্রিন্স, কনস্তান্তিন দৃমিত্রিচকে আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা একটা পরীক্ষা করতে চাই।’
‘কি পরীক্ষা? টেবিল চালনা? কিন্তু ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়ারা, মাপ করবেন আমাকে, আমার ধারণা, কলেচুকো’ খেলায় মজা বেশি’, ভ্রনস্কির দিকে তাকিয়ে এবং তিনি-ই যে ব্যাপারটার হোতা তা আন্দাজ করে বৃদ্ধ প্রিন্স বললেন, কলেচুকো’র তবু একটা মানে হয়।’
ভ্রনস্কি অবাক হয়ে তার অচঞ্চল চোখে প্রিন্সের দিকে তাকালেন এবং সামান্য হেসে তখনই কাউন্টেস নর্ডস্টনের সাথে আলাপ শুরু করলেন–আগামী সপ্তাহে বড় রকমের একটা বলনাচের ব্যাপার নিয়ে।
কিটির দিকে তিনি ফিরলেন, আশা করি আপনি আসবেন। আসবেন তো?’
তাঁর কাছ থেকে বৃদ্ধ প্রিন্স সরে যেতেই লেভিন অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেলেন, এ সন্ধ্যার শেষ যে ছাপটা তার মনে রইল, সেটা বলনাচ নিয়ে ভ্রনস্কির প্রশ্নের জবাবে কিটির হাসিমাখা সুখী-সুখী মুখখানি।
আন্না কারেনিনা – ১.১৫
পনেরো
লেভিনের সাথে তার কি কথা হয়েছে–সান্ধ্য বাসর শেষ হলে কিটি মাকে বলল আর লেভিনের জন্য তার কষ্ট হলেও এই ভেবে তার খুশি লাগছিল যে, তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার সন্দেহ ছিল না যে সে উচিত কাজই করেছে। কিন্তু শয্যায় অনেকক্ষণ ঘুম এল না তার। একটা ছবি কিছুতেই ছেড়ে যাচ্ছিল না তাকে। সেটা ভুরু কোঁচকানো লেভিনের মুখ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার পিতার কথা শোনবার সময় সে ভুরুর তল থেকে মন মরার মত চাইছিল তার সদয় চোখ, যখন তিনি দৃষ্টিপাত করছিলেন তার আর ভ্রনস্কির দিকে। তাঁর জন্য এত কষ্ট হল যে চোখ ভরে উঠল পানিতে। কিন্তু ওঁর বদলে যাকে সে বেছেছে, তখনই তার কথা ভাবল সে। তার স্পষ্ট মনে পড়ল সেই পৌরুষব্যঞ্জক দৃঢ় মুখমণ্ডল, সেই উদার স্থৈর্য আর তার সব কিছু থেকে বিকিরিত সবার প্রতি সহায়তা; মনে পড়ল নিজের প্রতি তার ভালোবাসা যাকে সে ভালোবেসেছে এবং আবার প্রাণ তার ভরে উঠল আনন্দে, সুখের হাসি নিয়ে সে বালিশে মাথা দিলে। নিজেকে সে বলছিল, কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কি করি? আমার তো দোষ নেই; কিন্তু অন্তরের কণ্ঠস্বর বলছিল ভিন্ন কথা। কিসের জন্য তার অনুতাপ হচ্ছে–লেভিনকে আকৃষ্ট করেছে, নাকি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে, তা সে জানত না। কিন্তু নানা দুশ্চিন্তায় সুখ ওর বিষিয়ে যাচ্ছিল। সৃষ্টিকর্তা দয়া কর, সৃষ্টিকর্তা দয়া কর, সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত নিজের জন্য এই প্রার্থনা করে গেল সে।
এই সময় নিচে, প্রিন্সের ছোট পাঠকক্ষে চলছিল স্নেহের মেয়েকে নিয়ে মা-বাপের মধ্যে ঘন ঘন কলহের একটা।
‘কি বলছি? এই বলছি!’ দু’হাত আস্ফালন করে এবং সাথে সাথেই ড্রেসিং-গাউনটা ঠিক করে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিন্স, বলছি যে, আপনার গর্ববোধ নেই, মর্যাদাবোধ নেই। মেয়ের নাম ডোবাচ্ছেন, তাকে ধ্বংস করছেন এই হীন, নির্বোধ ঘটকালি করে!’
‘কিন্তু দোহাই, সৃষ্টিকর্তার দোহাই প্রিন্স, কি আমি করলাম? প্রিন্স-মহিষী বললেন কাঁদো-কাঁদো হয়ে।
মেয়ের সাথে কথা কওয়ার পর তিনি খুশি হয়ে প্রিন্সের কাছে এসেছিলেন সচরাচরের মত শুভরাত্রি জানাতে এবং যদিও লেভিনের প্রস্তাব ও কিটির প্রত্যাখ্যানের কথা জানাবার কোন অভিপ্রায় তার ছিল না, তাহলেও স্বামীকে এই ইঙ্গিত দেন যে তার মনে হচ্ছে, ভ্রনস্কির ব্যাপারটা শেষের মুখে এসে পড়েছে, ওঁর মা এলেই স্থির হয়ে যাবে সব। এ কথা শুনেই প্রিন্স খেপে ওঠেন এবং অশালীন গালাগালি দিয়ে চেঁচাতে থাকেন।
কি আপনি করেছেন? করেছেন এই : প্রথমত আপনি টোপ ফেলে বর ধরেছেন, গোটা মস্কো সে কথা বলাবলি করবে এবং যুক্তিসহকারেই। আপনি যদি সান্ধ্য বাসরের আয়োজন করেন, তাহলে সবাইকে ডাকুন। শুধু বাছাই করা পাত্রদের নয়। ডাকুন সমস্ত এই ন্যাকামণিদের (মস্কোর যুবকদের প্রিন্স এই নাম দিয়েছিলেন), পিয়ানোবাদক ভাড়া করুন, নাচানাচি করুক সবাই–আজকের মত কেবল পাত্রদের জোটানো নয়। আমার দেখতেও বিছুছিরি লাগে, বিছুছিরি, আর আপনি যা চেয়েছিলেন–পেয়েছেন, মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন মেয়েটার। লেভিন হাজার গুণ ভালো লোক। আর এই পিটার্সবুর্গী সাহেব–এদের বানানো হয় যন্ত্রে, সবাই ওরা একই ধাঁচের এবং সবাই ওঁছা। ও যদি বনেদি ঘরের প্রিন্সও হয়, তাহলেও ওকে কোন দরকার নেই আমার মেয়ের!
‘কিন্তু আমি কি করেছি?
করেছেন এটা…’ রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিন্স।
বাধা দিয়ে প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘তোমার কথা শুনতে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে না কখনো। আর তাই যদি হয়, তাহলে গায়েই চলে যাওয়া দরকার।
সেই ভালো।
‘শোনো, আমি কি পাত্র ধরার সন্ধানে আছি? কখনো তা করিনি। নেহাৎ একটা যুবক এবং অতি উত্তম যুবক প্রেমে পড়েছে এবং মনে হয় মেয়েটাও…’।
হ্যাঁ, আপনার মনে হচ্ছে। মেয়েটা যদি সত্যিই প্রেমে পড়ে থাকে আর বিয়ে করার কথা উনি ততটাই ভাবছেন যতটা আমি, তাহলে? ওহ! ওঁকে যদি কখনো চোখে না দেখতে হত!… ‘ও প্রেতবাদ, ও নীস, ও বলনাচ…’, আর এই প্রতিটা শব্দের পর প্রিন্স স্ত্রীকে অনুকরণ করে আধবসা হয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করতে লাগলেন, এই করেই আমরা দুর্ভাগা করে তুলব কিটিকে, এই করে সত্যিই ওর মাথায় ঢুকবে…’
কিন্তু তুমি তা ভাবছ কেন?
‘আমি ভাবছি না, জানি; এ ব্যাপারে আমাদের চোখ আছে, মেয়েদের নেই। একজন লোককে আমি দেখতে পাচ্ছি যার গুরুত্বপূর্ণ সংকল্প আছে, সে লেভিন; তিতির-টিতিরও আমি দেখতে পাই। যেমন এই… শুধু আমোদ আহ্লাদ হলেই যার হল।
মাথায় ঢুকিয়েছ যতসব…’
‘এ সব কথা তোমার মনে পড়বে, যখন আর সময় থাকবে না। যেমন ডল্লির বেলায়।
নাও হয়েছে, হয়েছে। এ সব কথা আর তুলব না’, ডল্লির কথা মনে পড়ায় ওঁকে থামিয়ে দিলেন প্রিন্স-মহিষী।
সে তো তোফা! শুভ রাত্রি!
পরস্পরের ওপর ক্রস করে ওঁরা চুম্বন বিনিময় করলেন। কিন্তু দুজনেই টের পাচ্ছিলেন যে ওঁরা নিজের নিজের মত আঁকড়েই রইলেন। যে যার ঘরে গেলেন স্বামী-স্ত্রী।
প্রথমটায় প্রিন্স-মহিষীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আজকের সন্ধ্যায় কিটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। ভ্রনস্কির অভিপ্রায়ে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না; কিন্তু স্বামীর কথাগুলোয় তিনি গোলমালে পড়লেন। নিজের ঘরে এসে তিনি ঠিক কিটির মতই ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সামনে কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলেন : ‘সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! সৃষ্টিকর্তা দয়া কর! সৃষ্টিকর্তা দয়া কর!
ষোলো
ভ্রনস্কি জানতেন না–পারিবারিক জীবন কি। যৌবনে তার মা ছিলেন উঁচু সমাজের মনোহারিণী মহিলা। বিয়ে করার সময় এবং বিশেষ করে তার পরে বহু প্রেমলীলা করেছেন তিনি, গোটা সমাজই তা জানত। পিতাকে ভ্রনস্কির প্রায় মনেই পড়ে না। তিনি শিক্ষা পান পেজেস কোরে।
স্কুল থেকে চমৎকার তরুণ অফিসার হয়ে বেরিয়ে এসেই তিনি পিটার্সবুর্গের ধনী সামরিক অফিসারদের মহলে গিয়ে পড়েন। কখনো কখনো সমাজে গেলেও তার প্রেমের সমস্ত আকর্ষণগুলো ছিল সমাজের বাইরে।
বিলাসবহুল আর রুক্ষ পিটার্সবুর্গ জীবনের পর ভ্রনস্কি মস্কোতে প্রথম অনুভব করলেন সমাজের একটা মনোরম নিষ্পাপ বালিকার সাথে সান্নিধ্যের মাধুর্য, যে ভালোবেসেছে তাকে। কিটির সাথে তার সম্পর্কে খারাপ কিছু থাকতে পারে, এটা তার কল্পনাতেই আসেনি। বলে তিনি নাচতেন প্রধানত তার সাথেই; খেতেন ওঁদের বাড়িতে। তার সাথে তিনি যে সব কথা বলতেন, সাধারণতই তা বলা হয়ে থাকে সমাজে, যত বাজে কথা, কিন্তু সেই বাজে কথাকেই তিনি অজান্তে কিটির কাছে বিশেষ অর্থময় করে তুলতেন। সবার সমক্ষে যা বলতে পারেন না তেমন কোন কথা কিটিকে না বললেও তিনি অনুভব করছিলেন যে কিটি ক্রমেই তার মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে এবং যত তা অনুভব করছিলেন ততই সেটা তার ভালো লাগছিল, কিটির প্রতি তার মনোভাব হয়ে উঠছিল কোমল। তিনি জানতেন না যে, কিটির কাছে তার এই ধরনের আচরণের একটা নির্দিষ্ট নাম আছে। এটা হল বিবাহের সংকল্প না করে বালিকার মন ভোলানো আর এই ভোলানোটাই হল তাঁর মত চমৎকার যুবকদের ভেতর প্রচলিত গর্হিত আচরণের একটা। তাঁর মনে হচ্ছিল এই তৃপ্তি আবিষ্কার করেছেন তিনিই প্রথম এবং সে আবিষ্কারে পরম আনন্দ পাচ্ছিলেন তিনি।
সে সন্ধ্যায় কিটির মা-বাবা কি কথা বলেছেন তা যদি তিনি শুনতে পেতেন, তিনি যদি নিজেকে পরিবারের দৃষ্টিকোণে নিয়ে গিয়ে জানতে পারতেন যে কিটিকে তিনি বিয়ে না করলে সে অসুখী হবে, তাহলে ভয়ানক অবাক লাগত তার এবং সেটা বিশ্বাস করতে পারতেন না। তিনি বিশ্বাসই করতে পারতেন না যে তাকে এবং বড় কথা কিটিকে যা এমন তৃপ্তি দিচ্ছে সেটা খারাপ কিছু হতে পারে। তার যে বিয়ে করা উচিত, এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারতেন আরো কম।
বিয়ে তার কাছে সম্ভবপর বলে কদাচ মনে হয়নি। পারিবারিক জীবন তিনি শুধু যে ভালোবাসতেন না তাই নয়, যে অবিবাহিত দুনিয়ায় তার বাস, সেখানকার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পরিবারে, বিশেষ করে স্বামী হিসেবে নিজেকে কল্পনা করা তার কাছে মনে হত বিজাতীয়, তার চেয়েও বেশি হাস্যকর। কিটির মা-বাবা কি বলাবলি করেছেন তাঁর কোন সন্দেহ না থাকলেও সে সন্ধ্যায় শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে তিনি অনুভব করছিলেন যে তার আর কিটির মধ্যে যে গোপন আত্মিক সংযোগ ছিল, সেটা সে সন্ধ্যায় এত দৃঢ়ীভূত হয়ে উঠেছে যে কিছু-একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু কি করা সম্ভব এবং উচিত সেটা তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না।
বরাবরের মত নির্মলতা আর স্নিগ্ধতার একটা প্রীতিকর অনুভূতি নিয়ে–যা এসেছে অংশত সারা সন্ধ্যে তিনি ধূমপান করেননি বলে এবং সেইসাথে তাঁর প্রতি কিটির ভালোবাসায় তাঁর মন গলে যাবার একটা নতুন অনুভূতি থেকে–শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে ভ্রনস্কি ভাবছিলেন, ‘সবচেয়ে যেটা অপূর্ব, সেটা আমরা কেউ কিছু বলিনি। কিন্তু দৃষ্টিপাত আর কথার ধ্বনিভঙ্গির এই অদৃশ্য কথোপকথনে আমরা পরস্পরকে এত বুঝতে পেরেছি যে কথাটা সে মুখ ফুটে যদি বলতও, তার চেয়েও আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমাকে সে ভালোবাসে। আর কি মধুর, সহজ, এবং বড় কথা, আস্থায় তা ভরা! আমি নিজেই নিজেকে অনুভব করছি আরো ভালো, আরো নির্মল বলে। আমি অনুভব করছি যে আমার একটা হৃদয় আছে, অনেক ভালো কিছু আছে আমার ভেতর। কি মিষ্টি প্রেমাকুল চোখ। যখন সে বলল : খুবই…’
‘তা কি হল? কিছুই না। আমারও ভালো লাগছে। ওরও ভালো লাগছে। তারপর সন্ধেটা কোথায় শেষ করা যায় এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। ক্লাবে? এক হাত বেজিক খেলা, ইনাতভের সাথে শ্যাম্পেন? না, যাব না। Chateau des fleurs, সেখানে থাকবে অবলোনস্কি, গান, ক্যানক্যান নাচ। উঁহু, বিরক্তি ধরে গেল। শ্যেরবাৎস্কিদের আমি এই জন্যই ভালোবাসি যে নিজেই আমি ভালো হয়ে উঠি। ঘরেই ফেরা যাক।তিনি সোজা গেলেন দ্যুসসো হোটেলে নিজের কামরায়। ঘরে নৈশাহার আনতে বললেন, তারপর ধরাচুড়া খুলে বালিশে মাথা ঠেকাতে-না-ঠেকাতেই বরাবরের মত তার গভীর শান্ত ঘুমে ঢলে পড়লেন।
সতেরো
মাকে আনার জন্য প্রস্কি গেলেন পিটার্সবুর্গ রেল স্টেশনে–পরদিন বেলা এগারোটায় আর বড় সিঁড়িতে প্রথম যাকে দেখলেন তিনি অবলোনস্কি, এসেছেন বোনের জন্য, তিনি একই ট্রেনে আসছেন।
‘আরে হুজুর যে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন অবলোনস্কি, কাকে নিতে এসেছ?
মাকে’, অবলোনস্কির সাথে দেখা হলে সবারই মুখে হাসি ফোটে, ভ্ৰস্কিও হেসে করমর্দন করে একসাথে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে, পিটার্সবুর্গ থেকে আজ ওঁর আসার কথা।’
‘ওদিকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি রাত দুটো পর্যন্ত। শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে গিয়েছিলে কোথায়?
‘হোটেলে’, বললেন ভ্রনস্কি, ‘স্বীকারই করছি, কাল শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে মনটা এত ভালো লাগছিল যে কোথাও যাবার ইচ্ছে হল না।’
‘দৌড়বাজ ঘোড়াকে চেনা যায় তার গায়ে দাগা মার্কা দেখে, আর প্রেমিক যুবককে চেনা যায় তার ভাবাকুল চোখ দেখে, ঘোষণা করলেন অবলোনস্কি, ঠিক আগে যেমন করেছিলেন লেভিনের কাছে।
ভ্রনস্কি এমন ভাব করে হাসলেন যেন এতে তিনি আপত্তি করছেন না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আলাপের প্রসঙ্গ পালটালেন।
জিজ্ঞেস করলেন, আর তুমি কাকে নিতে এসেছ?
অবলোনস্কি বললেন, ‘আমি? আমি এসেছি একটা সুন্দরী মহিলার জন্য।
বটে!
ফরাসি ভাষায় বললেন, এটা যে খারাপভাবে বোঝে, ধিক তাকে! বোন আন্নার জন্য।
ভ্রনস্কি বললেন, ‘ও, কারেনিনা?’
‘তুমি নিশ্চয় চেনো?’
মনে হচ্ছে চিনি। কিন্তু বোধ হয় না… সত্যি ঠিক মনে নেই, অন্যমনস্কভাবে বললেন ভ্রনস্কি, কারেনিনা নামটার সাথে সাথে কি-একটা যেন কাটখোট্টা আর একঘেয়ে তার কল্পনায় আবছা ভেসে উঠেছিল।
‘কিন্তু আমার নামজাদা ভগ্নিপতি কারেনিনকে জানো নিশ্চয়। সারা দুনিয়া তাকে চেনে।
‘মানে ওই নামে চিনি, আর চোখের দেখায়। জানি তিনি বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, এবং কি ধরনের যেন ধর্মপ্রাণ… তবে জানই তো এটা আমার… আমার এখতিয়ার নয়’, বললেন ভ্রনস্কি।
‘কিন্তু উনি অসাধারণ মানুষ ও একটু রক্ষণশীল, কিন্তু চমৎকার লোক’, অবলোনস্কি মন্তব্য করলেন, ‘চমৎকার লোক।
‘সে তো তাঁর পক্ষে ভালোই’, হেসে ভ্রনস্কি বললেন। আরে তুমি এখানে’, দরজার কাছে দাঁড়ানো মায়ের ঢ্যাঙা বৃদ্ধ খানসামাকে দেখে বললেন তিনি, ‘এদিকে এসো।’
সকলের কাছেই অবলোনস্কির যা আকর্ষণ তা ছাড়াও ভ্রনস্কি তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরাগ বোধ করছিলেন আরো এই জন্য যে তিনি তাকে একত্রে ধরেছেন কিটির সাথে।
হেসে তার হাতটা নিয়ে ভ্রনস্কি বললেন, তাহলে কি, রবিবারে কিন্নরীপ্রধানার জন্য নৈশভোজ হচ্ছে?
‘অবশ্যই। আমি চাঁদা তুলছি। ও হ্যাঁ, কাল আমার বন্ধু লেভিনের সাথে পরিচয় হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন অবলোনস্কি।
হবে না মানে? কিন্তু কেন জানি উনি চলে গেলেন তাড়াতাড়ি।
‘ভারি ভালো লোক, বলে চললেন অবলোনস্কি, তাই না?
ভ্রনস্কি বললেন, ‘জানি না কেন সমস্ত মস্কোওয়ালাদের মধ্যে, অবশ্য যার সাথে কথা বলছি তিনি ছাড়া, রহস্য করে যোগ দিলেন তিনি, রুক্ষ কি-একটা যেন আছে। এই একেবারে উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ, যেন সব কিছু দিয়ে টের পাওয়াতে চায় কি-একটা…’
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে বটে, সত্যি আছে…’, ফুর্তিতে হেসে উঠলেন অবলোনস্কি।
‘কি, শিগগিরই আসছে কি?’ রেল কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রনস্কি।
‘ট্রেন আসছে’, জবাব দিল সে।
ট্রেন যত কাছিয়ে আসে ততই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় স্টেশনে, ছুটোছুটি করে মুটেরা, দেখা দেয় সশস্ত্র পুলিশ আর কর্মচারী, এগিয়ে যায় যারা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের জন্য এসেছিল। হিমেল ভাপের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ভেড়ার চামড়ার খাটো কোট আর ফেল্টের নরম হাই-বুট পরা মজুরেরা বাকা রেল লাইন ডিঙিয়ে যাচ্ছে। শোনা গেল দূরের লাইনে ইঞ্জিনের হুইসিল আর ভারী কি-একটা চলাচলের আওয়াজ।
‘না’, ভ্রনস্কিকে বললেন অবলোনস্কি, কিটি প্রসঙ্গে লেভিনের সংকল্পের কথা জানাবার ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর না, তুমি আমার লেভিনকে সম্ভবত ঠিক বোঝনি। অতি উত্তেজনাপ্রবণ লোক সে, অপ্রীতিকর হয়েও ওঠে তা সত্যি, কিন্তু মাঝে মাঝে সে হয়ে ওঠে ভারি ভালো। অতি সৎ ন্যায়নিষ্ঠ লোক, মনটাও সোনার। কিন্তু কাল ছিল একটা বিশেষ কারণ’, অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলে চললেন অবলোকি, একেবারেই ভুলে গেলেন বন্ধুর প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ যা তিনি কাল অনুভব করেছিলেন, এবং এখন ঠিক সেইরকম দরদই অনুভব করছেন শুধু ভ্রনস্কির প্রতি, হ্যাঁ, কারণ ছিল যাতে তার পক্ষে বিশেষ সুখী অথবা বিশেষ অসুখী হওয়া সম্ভব।’
ভ্রনস্কি থেকে গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন ও তার মানে? নাকি সে কাল তোমার শ্যালিকার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে?
অবলোনস্কি বললেন, হয়ত। কাল আমার এমনি কিছু-একটা মনে হয়েছিল। হ্যাঁ, ও যখন আগেই চলে গেছে, আর মন-মেজাজও ভালো ছিল না, তখন এটা তাই… অনেকদিন থেকে ও প্রেমে পড়েছে, ওর জন্য ভারি কষ্ট হয় আমার।’
‘বটে!… তবে আমি মনে করি কিটি ওর চেয়ে ভালো পাত্রের ভরসা করতে পারে।’ এই বলে ভ্রনস্কি বুক টান করে আবার হাঁটা শুরু করলেন, ‘তবে আমি তো ওকে চিনি না’, যোগ করলেন তিনি, হ্যাঁ, এ এক বিছছিরি অবস্থা! এজন্যই বেশির ভাগ লোক পছন্দ করে ক্লারাদের সাহচর্য। সেখানে অসাফল্যে প্রমাণ হয় যে টাকা ততটা নেই। আর এখানে-মর্যাদাটাই বিপন্ন। যাক গে, ট্রেন এসে গেছে।’
সত্যিই দূরে হুইসিল দিল ইঞ্জিন। কয়েক মিনিট বাদে কেঁপে-কেঁপে উঠল প্ল্যাটফর্ম, ফেস-ফোঁস করে ভাপ ছেড়ে ঢুকল ইঞ্জিন, হিমে সে ভাপ নুয়ে পড়ছিল নিচের দিকে, ধীরে ধীরে, মাপ তালে মাঝের চাকার সাথে লাগানো পিস্টন রড বেঁকে যাচ্ছে আর টান হচ্ছে, আঁটসাঁট পোশাকে হিমানীতে আচ্ছন্ন ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে আছে, টেন্ডারের পেছনে ক্রমেই ধীরে আর প্ল্যাটফর্মকে বেশি করে কাঁপিয়ে এল মালপত্রের ওয়াগন, তাতে ঘেউ-ঘেউ করছে একটা কুকুর, শেষে প্যাসেঞ্জার ওয়াগনগুলো কেঁপে-কেঁপে এসে থামল।
চটপটে কন্ডাক্টর হুইসিল দিতে দিতে লাফিয়ে নামল ট্রেন থেকে। তার পেছনে একের পর এক অধীর যাত্রী ও নিজেকে টানটান করে চারদিকে কড়া চোখে তাকাতে থাকল এক গার্ড অফিসার; খুশির হাসি হেসে থলি হাতে নামল এক শশব্যস্ত বেনিয়া; কাঁধে বস্তা ঝুলিয়ে কৃষক।
অবলোনস্কির পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রনস্কি দেখছিলেন ওয়াগনগুলো আর তা থেকে নামা যাত্রীদের। তিনি তখন মায়ের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলেন। কিটি সম্পর্কে এখন তিনি যা জানলেন সেটা উদ্বুদ্ধ আর উল্লসিত করেছিল তাকে। আপনা থেকেই বুক তার টান হয়ে উঠেছিল, জ্বলজ্বল করে উঠেছিল চোখ। নিজেকে তিনি বিজয়ী বলে ভাবছিলেন।
‘কাউন্টেস ভ্ৰনস্কায়া এই কম্পার্টমেন্টে’, ভ্রনস্কির কাছে এসে জানাল চটপটে সেই কন্ডাক্টর।
কন্ডাক্টরের কথায় চৈতন্য ফিরল তার, মা আর তার সাথে আসন্ন সাক্ষাতের কথা ভাবতে হল। আসলে মায়ের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা ছিল না এবং সে সম্পর্কে সচেতন না থেকেই ভালোবাসতেন না তাকে, যদিও যে মহলে তাঁর জীবনযাত্রা সেখানেকার বোধ, নিজের শিক্ষাদীক্ষা অনুসারে অতিমাত্রায় বাধ্যতা আর শ্রদ্ধা ছাড়া মায়ের সাথে অন্য কোন সম্পর্ক তিনি কল্পনা করতে পারতেন না আর বাইরে যতই তিনি হতেন বাধ্য ও সশ্রদ্ধ, মনে মনে ততই তিনি তাঁকে কম শ্রদ্ধা করতেন, কম ভালোবাসতেন।
আঠারো
ভ্রনস্কি কন্ডাক্টরের পেছন পেছন ওয়াগনটায় উঠলেন। একজন মহিলা বেরিয়ে আসছিলেন, তাঁকে পথ দেবার জন্য থামলেন কম্পার্টমেন্টে ঢোকার মুখে। উঁচু সমাজের লোকদের অভ্যস্ত মাত্রাবোধে ভ্রনস্কি মহিলার চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝলেন, ইনি উঁচু সমাজের লোক। ক্ষমা চেয়ে তিনি ভেতরে যাবার উপক্রম করছিলেন, কিন্তু মহিলাটির প্রতি আরেকবার তাকিয়ে দেখার তাগিদ বোধ করলেন তিনি–সেটা এই জন্য নয় যে মহিলা অতীব সুন্দরী, তাঁর সমস্ত দেহলতা থেকে সুচারুতা আর সংযত ভঙ্গিমালাবণ্য দেখা গিয়েছিল বলে নয়, এই জন্য যে ভ্রনস্কির পাশ দিয়ে উনি যখন যাচ্ছিলেন তখন তার মিষ্টি মুখখানায় ভারি কমনীয়, স্নেহময় একটা ভাব দেখা গিয়েছিল। ভ্রনস্কি যখন মুখ ফেরালেন, তিনিও মুখ ফিরিয়েছিলেন। ঘন আঁখিপল্লবে তার উজ্জ্বল ধূসর যে চোখ দুটো কালো বলে মনে হয় তা বন্ধুর মত নিবদ্ধ হল ভ্রনস্কির মুখে, যেন তাকে চিনতে পেরেছেন, পরমুহূর্তেই কাকে যেন খুঁজতে চলে গেলেন এগিয়ে আসা ভিড়ের মধ্যে। এই সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাতেই ভ্রনস্কির চোখে পড়ল তার মুখের সংযত সজীবতা, উজ্জ্বল চোখ আর বঙ্কিম রক্তিম ঠোঁটে ঈষৎ হাসির মাঝখানে তার ঝিলিমিলি। যেন তাঁর সত্তা পূর্ণ হয়ে হয়ে তার উদ্বুত্তটা তার ইচ্ছার অপেক্ষা না করেই আত্মপ্রকাশ করছে কখনো চোখের ছটায়, কখনো হাসিতে। ইচ্ছে করেই তিনি তাঁর চোখের ছটা চাপা দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা দেখা দিয়েছে তার প্রায় অলক্ষ্য হাসিতে।
ভ্রনস্কি ভেতরে গেলেন। মা তার রোগাটে বৃদ্ধা, কালো চোখ, কুণ্ডলী করা চুল। ছেলেকে দেখে চোখ কুঁচকে তিনি পাতলা ঠোঁটে সামান্য হাসলেন। সোফা থেকে উঠে দাসীকে থলে দিয়ে তিনি ছোট্ট শুকনো হাত বাড়িয়ে দিলেন ছেলের দিকে, তারপর তার মাথা তুলে চুম্বন করলেন মুখে।
‘টেলিগ্রাম পেয়েছিলি? ভালো তো?
সৃষ্টিকর্তার কৃপা।’
‘ভালোয় ভালোয় এসেছ তো?’ মায়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন পুত্র, অজান্তে তার কান ছিল দরজার ওপাশে একটা নারীকন্ঠের দিকে। উনি জানতেন যে ঢোকার মুখে যে মহিলাকে দেখেছিলেন, এটি তারই গলা।
কণ্ঠস্বর বলছিল, তাহলেও আমি আপনার সাথে একমত নই।’
‘ওটা পিটার্সবুর্গী দৃষ্টিভঙ্গি মান্যবরা।
‘পিটার্সবুর্গী নয়, নিতান্ত নারীসুলভ’, উত্তর দিলেন তিনি।
‘তা আপনার হস্তচুম্বন করতে দিন।
‘আসুন, আবার দেখা হবে ইভান পেত্রভিচ। তাঁ, দেখুন তো, আমার ভাই এখানে আছে কিনা, আমার কাছে। পাঠিয়ে দিন’, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহিলা বললেন এবং আবার ঢুকলেন কম্পার্টমেন্টে।
ভ্ৰনস্কায়া তাঁকে বললেন, ‘কি, ভাইকে পেলেন?
এবার ভ্রনস্কির স্মরণ হল, ইনিই কারেনিনা।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার ভাই এখানেই। মাপ করবেন, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, তাছাড়া আমাদের পরিচয় এত সামান্য, ভ্রনস্কি মাথা নোয়ালেন, ‘আমার কথা নিশ্চয় আপনার মনে নেই।’
উনি বললেন, ‘আরে না, আমি আপনাকে চিনতে পারতাম, কেননা সারা পথটাই বোধহয় আপনার মায়ের সাথে আমরা আপনার কথা গল্প করতে করতে এসেছি’, তার যে সজীবতা বহিঃপ্রকাশ চাইছিল, অবশেষে তাকে হাসিতে পথ ছেড়ে দিয়ে বললেন, কিন্তু আমার ভাই তো এখনো এল না।’
‘ওকে ডেকে আন আলিওশা’, বললেন বৃদ্ধা কাউন্টেস।
ভ্রনস্কি প্ল্যাটফর্মে নেমে চিৎকার করলেন : ‘অবলোনস্কি!’
কিন্তু ভাইয়ের জন্য কারেনিনা বসে রইলেন না, তাঁকে দেখা মাত্র দৃঢ় লঘু পায়ে বেরিয়ে এলেন ওয়াগন থেকে। আর ভাই কাছে আসতেই যে দৃঢ়, ললিত ভঙ্গিতে তিনি বাঁ হাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে প্রগাঢ় চুম্বন করলেন, তাতে আশ্চর্য লেগেছিল ভ্রনস্কির। চোখ না সরিয়ে ভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন কারেনিনার দিকে, নিজেই জানতেন না কেন হাসছেন। কিন্তু মা তার অপেক্ষায় আছেন মনে পড়ায় আবার উঠলেন ওয়াগনে।
কারেনিনা সম্পর্কে কাউন্টেস বললেন, সত্যি, ভারি মিষ্টি, তাই না? ওঁর স্বামী ওঁকে উঠিয়ে দেন আমার কামরায়। আমি ভারি খুশি, সারা রাস্তা আমরা গল্প করেছি। কিন্তু তুই…’, এরপর ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘এখনো তোমাকে আদর্শ প্রেম টানছে। সে ভালোই প্রিয়বর, ভালোই।’
জানি না কি বলতে চাইছেন, নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিলেন পুত্র, মা, তাহলে যাওয়া যাক।
কাউন্টেসের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য কারেনিনা আবার এলেন ওয়াগনে। ফুর্তির সুরে তিনি বললেন, তাহলে কাউন্টেস, আপনি আপনার ছেলেকে পেলেন, আমি আমার ভাইকে। আমার সব কাহিনী শেষ, এর পর আর বলার কিছু নেই।
‘আরে না, না, ওঁর হাত ধরে বললেন কাউন্টেস, আপনার সাথে আমি সারা দুনিয়া ঘুরে আসতে পারি, একটুও বিরক্তি লাগবে না। আপনি তেমনি একজন মিষ্টি মেয়ে যার সাথে কথা বলা বা চুপ করে থাকা, দুই-ই সমান আনন্দের। আর আপনার ছেলের কথা কিছু ভাববেন না : কখনো ছেড়ে থাকা যাবে না, এটা তো চলে না।
একেবারে খাড়া শরীরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কারেনিনা, চোখ দুটো তার হাসছিল।
ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন কাউন্টেস, ‘আন্না আর্কাদিয়েভনার ছেলে আছে একটা, বোধ হয় আট বছর বয়স। কখনো তাকে ছেড়ে থাকেননি, এবার রেখে এসেছেন বলে কষ্ট পাচ্ছেন।
কারেনিনা বললেন, হ্যাঁ, সারাটা সময় কাউন্টেস আর আমি গল্প করেছি, আমি বলেছি আমার ছেলের কথা, উনি। ওঁর। মুখ ওঁর আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে, ভ্রনস্কির উদ্দেশে স্নিগ্ধ হাসি।
রঙ্গলীলার যে বলটা ছোঁড়া হয়েছিল সেটা তৎক্ষণাৎ লুফে নিয়ে কি বললেন, তাতে নিশ্চয় ভারি ক্লান্ত হয়েছেন আপনি। কিন্তু বোঝা গেল এসবের কথাবার্তা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না কারেনিনার, উনি বৃদ্ধা কাউন্টেসের দিকে ফিরলেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কাল কি করে যে সময় কেটে গেল খেয়ালই করিনি। আসি তাহলে, কাউন্টেস।
কাউন্টেস বললেন, ‘বিদায় ভাই, দিন আপনার সুন্দর মুখখানায় একটু চুমু দিই। বুড়িদের মত স্রেফ সোজাসুজিই বলছি, আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি।
কথাটা যেভাবেই বলা হোক, বোঝা গেল কারেনিনা মনেপ্রাণে সেটা বিশ্বাস করেছেন এবং তাতে খুশি হয়ে উঠেছেন; লাল হয়ে তিনি সামান্য নত হয়ে মুখ পাতলেন কাউন্টেসের ঠোঁটের কাছে, আবার সিধে হয়ে ঠোঁট আর চোখের মাঝখানে চঞ্চল সেই হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন ভ্রনস্কির দিকে। বাড়িয়ে দেওয়া ছোট্ট হাতখানায় চাপ দিলেন তিনি আর কেমন যেন সতেজে কারেনিনা তাঁর হাতটা নিয়ে সজোরে এবং অসংকোচে ঝাঁকুনি দিলেন, তাতে খুশি লাগল তার। কারেনিনা চলে গেলেন তার রীতিমত পুরুষ্টু দেহের পক্ষে দ্রুত, আশ্চর্য অনায়াস গতিভঙ্গিমায়।
‘ভারি মিষ্টি’, বললেন বৃদ্ধা।
পুত্রও তাই ভাবছিলেন। কারেনিনার সৌষ্ঠবমণ্ডিত মূর্তি দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ভ্ৰভ্রনস্কি তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে, মুখে তার হাসিটা লেগেই ছিল। জানলা দিয়ে তিনি দেখলেন কারেনিনা ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁকে বাহুলগ্ন করে সোৎসাহে কি-একটা বলতে শুরু করলেন, অবশ্যই এমন কোন কথা যার সাথে ভ্রনস্কির কোন সম্পর্ক নেই এবং তাতে মন খারাপ হয়ে গেল তার।
‘কি মা, আপনি পুরোপুরি সুস্থ তো?’ মায়ের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আবার।
‘সব ভালো, দিব্যি সুন্দর। আলেক্সান্দার ভারি ভালো ব্যবহার করেছে। মারিও খুব সুন্দরী হয়ে উঠেছে, ভারি মন টানে।
এবং আবার শুরু করলেন সেই কথা বলতে যাতে তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ, অর্থাৎ নাতির খ্রিস্টদীক্ষা, যার জন্য তিনি পিটার্সবুর্গ গিয়েছিলেন, এবং বড় ছেলের ওপর জারের বিশেষ আনুকূল্যের কথা।
‘এই তো, লাভ্রেন্তি এসে গেছে’, জানালার দিকে তাকিয়ে একি বললেন, ‘আপনার অসুবিধা না হলে এবার যাওয়া যেতে পারে।
কাউন্টেসের যাত্রাসঙ্গী বৃদ্ধ খানসামা গাড়িতে উঠে জানালা যে সব তৈরি। কাউন্টেসও উঠে দাঁড়ালেন যাবার জন্য।
ভ্রনস্কি বললেন, যাওয়া যাক, এখন লোক কম।
দাসী নিল একটা থলে আর কুকুটাকে। খানসামা আর একজন মুটে নিল অন্য মালগুলো। কিন্তু মাকে বাহুলগ্ন করে ভ্রনস্কি যখন গাড়ি থেকে নামলেন, হঠাৎ ব্ৰস্ত মুখে জনকয়েক লোক ছুটে গেল পাশ দিয়ে। ছুটে গেলেন অসামান্য রঙের টুপি মাথায় স্টেশন-মাস্টারও। স্পষ্টতই অস্বাভাবিক কিছু-একটা ঘটেছে। ট্রেনের লোকেরা ছুটে গেল পেছন দিকে।
‘কি?… কি ব্যাপার?… কোথায়?… ঝাঁপিয়ে পড়েছিল!… কাটা পড়েছে!…’ যারা যাচ্ছিল তাদের মধ্যে থেকে শোনা যাচ্ছিল এসব কথা।
অবলোনস্কি এবং তার বাহুলগ্না বোনও ভীত মুখে লোকেদের ফেলে রেখে ফিরে এসে দাঁড়ালেন ওয়াগনের সামনে।
মহিলারা গাড়িতে উঠলেন এবং ভ্রনস্কি আর অবলোনস্কি লোকেদের পিছু পিছু গেলেন দুর্ঘটনার বিশদ খবর জানতে।
একজন পাহারাওয়ালা, হয় সে ছিল মাতাল নয় প্রচণ্ড শীতের জন্য এত বেশি জামা-কাপড় জড়ানো যে পেছন দিকে যাওয়া ট্রেনের শব্দ শুনতে পায়নি, এবং চাপা পড়ে।
ভ্রনস্কি আর অবলোনস্কি ফেরার আগেই মহিলারা এ খবর জানতে পান খানসামার কাছ থেকে।
অবলোনস্কি আর ভ্রনস্কি দুজনেই দেখেছিলেন বিকৃত লাশটা। স্পষ্টতই অবলোনস্কির কষ্ট হচ্ছিল। চোখ-মুখ কুঁচকে ছিলেন তিনি, মনে হল এই বুঝি কেঁদে ফেলবেন।
‘উহ্ কি বীভৎস! উঁহু, আন্না, তুমি যদি দেখতে! উহ্ কি বীভৎস!’ বলছিলেন তিনি।
ভ্রনস্কি চুপ করেছিলেন, তার সুন্দর মুখ গম্ভীর, তবে প্রশান্ত।
উহ, আপনি যদি দেখতেন কাউন্টেস’, বললেন অবলোনস্কি, বউ গিয়েছে সেখানে,.. তার দিকে তাকিয়ে দেখতেও ভয় হয়… লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে। লোকে বলছে, লোকটার একার রোজগারে বিরাট একটা সংসার চলতো। কি ভয়ঙ্কর?
‘ওর জন্য কিছু-একটা করা যায় না?’ বিচলিত হয়ে কারেনিনা বললেন ফিসফিস করে।
ভ্রনস্কি তার দিকে তাকিয়ে তখনই নেমে গেলেন গাড়ি থেকে।
দরজার কাছে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই আসছি মা।’
কয়েক মিনিট পরে উনি যখন ফিরলেন, অবলোনস্কি তখন কাউন্টেসকে নতুন গায়িকার কথা বলছিলেন আর ছেলের প্রতীক্ষায় কাউন্টেস অধীর হয়ে তাকাচ্ছিলেন দরজার দিকে।
ভেতরে ঢুকে ভ্রনস্কি বললেন, ‘এবার চলি।’
সবাই বেরোলেন একসাথে। মাকে নিয়ে ভ্রনস্কি চললেন আগে আগে। পেছনে ভাইয়ের সাথে কারেনিনা। ফটকের মুখে ভ্রনস্কিকে ধরলেন স্টেশন-মাস্টার।
‘আমার অ্যাসিস্টেন্টকে আপনি দু’শ রুল দিয়েছেন। দয়া করে বলুন এটা কার জন্য।
‘বিধবার জন্য, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন ভ্রনস্কি, এ আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে?
‘আপনি দিয়েছেন?’ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন অবলোনস্কি এবং বোনের হাতে চাপ দিয়ে যোগ করলেন, ‘খুব ভালো করেছেন, খুব ভালো করেছেন! ভারি ভালো ছেলে, তাই না? আমার শ্রদ্ধা রইল কাউন্টেস।
বোনের সাথে তিনি থেমে গিয়ে খুঁজতে লাগলেন কারেনিনার দাসীকে।
যখন তারা বেরোলেন, ভ্রনস্কির গাড়ি ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। যারা বেরিয়ে আসছিল, তারা তখনো বলাবলি করছিল দুর্ঘটনাটা নিয়ে।
‘দেখো কেমন বীভৎস মরণ!’ পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে একজন বলল, ‘শুনছি, দু’টুকরো হয়ে গেছে।
আরেকজন বলল, আমি উল্টো মনে করি, এই তো সবচেয়ে সহজ, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।
‘ওরা ব্যবস্থা নেবে না কেন?’ বলল তৃতীয় জন।
কারেনিনা গাড়িতে বসলেন, অবলোনস্কি অবাক হয়ে দেখলেন তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পানি চেপে রেখেছেন বহু কষ্টে।
কিছু দূরে যাবার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল তোমার, আন্না?’
আন্না বললেন, এটা একটা অলক্ষণ।
অবলোনস্কি বললেন, ‘যত বাজে কথা! তুমি এসেছ এটাই প্রধান ব্যাপার। তোমার ওপর কত যে ভরসা করে আছি ভাবতে পারবে না।’
আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, এই ভ্রনস্কি তোমার অনেক দিনের চেনা?
‘হ্যাঁ। জানো, আমরা আশা করছি ও কিটিকে বিয়ে করবে।’
‘তাই নাকি? আস্তে করে বললেন আন্না, তারপর যেন অনাবশ্যক অসুবিধাজনক কিছু-একটাকে দেহ থেকে ঝড়ে ফেলার জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে যোগ দিলেন, এবার কোতার কথা শোনা যাক। বল কি তোমার ব্যাপার। তোমার চিঠি পেয়ে এই চলে এলাম।
হ্যাঁ, তোমার ওপরেই সব ভরসা’, বললেন অবলোনস্কি।
‘তা, সব আমাকে বল।
অবলোনস্কি বলতে শুরু করলেন।
অবলোনস্কি বাড়ি এসে বোনকে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতে চাপ দিয়ে অফিসে চলে গেলেন।
উনিশ
ডল্লি যখন ছোট ড্রয়িং-রুমটায় বসেছিলেন শণচুলো গোলগাল একটা খোকার সাথে—শুনছিলেন তার ফরাসি ভাষার পাঠ, আন্না তখন ভেতরে ঢুকলেন। ছেলেটি এখন হয়ে উঠেছে তার বাবার মতই দেখতে। ছেলেটি পড়ছিল আর জামার একটা আলগা বোতাম পাকিয়ে পাকিয়ে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করছিল। কয়েক বার তার হাত সরিয়ে দিয়েছেন ডল্লি, কিন্তু গোলমাল হাতটা আবার এসে ঠেকেছে সেখানে। মা বোতামটা ছিঁড়ে রেখে দিলেন নিজের পকেটে।
‘হাত সামলে রাখ গ্রিশা’, বলে মা আবার তাঁর শাল বোনায় মন দিলেন। এটি তিনি বুনছেন অনেক দিন থেকে মনঃকষ্টের মুহূর্তে এটি টেনে নিতেন, এখন বুনছিলেন একটা স্নায়বিক উত্তেজনায়, আঙুল দিয়ে দিয়ে ঘর গুনছিলেন। বোন আসছেন কি আসছেন না এটা তাঁর কোন দায় নয়, কাল স্বামীকে এ কথা বলে পাঠালেও তিনি তাঁর আসার জন্য সব তৈরি করে রেখেছিলেন এবং অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ননদের।
তাঁর নিজের দুঃখে ডল্লি একেবারে মূহ্যমান। তাহলেও তাঁর মনে ছিল যে ননদ আন্না পিটার্সবুর্গের একজন অতি নামজাদা লোকের স্ত্রী, পিটার্সবুর্গ সমাজের একজন নামীদামী মহিলা। এই পরিস্থিতির কারণে স্বামীকে যা বলে পাঠিয়েছিলেন, তা তিনি করলেন না, অর্থাৎ বললেন না যে ননদ আসছেন। ডল্লি ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, যতই হোক, আন্নার তো কোন দোষ নেই। ওঁর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ আমি কিছু দেখিনি, আর আমার সম্পর্কে তাঁর ব্যবহারে আমি কেবল প্রীতি আর বন্ধুত্বই দেখেছি।’ অবশ্য পিটার্সবুর্গে কারেনিনদের ওখানে তাঁর বসবাসের যে স্মৃতিটুকু তাঁর মনে আছে তাতে ওঁদের বাড়িটাই তাঁর ভালো লাগেনি; তাঁদের গোটা পারিবারিক জীবনযাত্রার মধ্যে কি-একটা যেন মিথ্যা ছিল। ‘কিন্তু ওঁকে গ্রহণ করব না কেন? শুধু আমাকে যেন সান্ত্বনা দিতে না আসেন’, ভাবলেন ডল্লি, ‘সমস্ত সান্ত্বনা, আর উপদেশ, আর খ্রিস্টীয় ক্ষমার কথা আমি হাজার বার ভেবে দেখেছি, ও সব কাজের কিছু নয়।
এই কয়দিন ডল্লি একা ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। নিজের দুঃখের কথা উনি কাউকে বলতে চাননি, আর মনের মধ্যে সে দুঃখ পুষে রেখে তিনি অন্য কিছু বলতেও পারতেন না। তাহলেও তিনি জানতেন যে আন্নাকে যে করেই হোক না কেন সব বলবেন। আর কখনো তিনি বলবেন ভেবে খুশি হচ্ছিলেন, আবার কখনো রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে ওঁর কাছে, স্বামীর বোনের কাছে নিজের অপমানের কথা বলতে হবে, আর তাঁর মুখ থেকে শুনতে হবে উপদেশ আর সান্ত্বনার তৈরি বুলি।
যা প্রায়ই ঘটে থাকে, উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রতি মুহূর্তে অতিথির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং ঠিক সেই মুহূর্তটাই খেয়াল করলেন না যখন অতিথি এসে গেছেন, কেননা ঘণ্টি কানে যায়নি তাঁর।
গাউনের খসখস আর ততক্ষণে দরজায় লঘু পদশব্দ শুনে তিনি ফিরে তাকালেন, তাঁর কাতর মুখে আপনা থেকেই ফুলে উঠল আনন্দ নয়, বিস্ময়। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আলিঙ্গন করলেন ননদকে।
চুমু খেয়ে বললেন, ‘সে কি, এর মধ্যেই এসে গেছ?’
‘তোমাকে দেখে কি আনন্দই না হচ্ছে ডল্লি!’
‘আমারও আনন্দ হচ্ছে’, ক্ষীণ হেসে এবং আন্নার মুখের ভাব দেখে তিনি জানেন কিনা সেটা অনুমান করার চেষ্টা করে ডল্লি বললেন। আন্নার মুখে সহানুভূতির ছায়া লক্ষ্য করে ভাবলেন, ‘নিশ্চয় জানে।’, ‘চল, তোমার ঘরে তোমাকে দিয়ে আসি’, বোঝাবুঝির মুহূর্তটা যথাসম্ভব পেছিয়ে দেবার চেষ্টা করে ডল্লি বললেন।
‘এই গ্রিশা? আরে, কি বড়ই না হয়ে উঠেছে!’ ওকে চুমু খেয়ে এবং ডল্লির ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে আন্না থেমে গেলেন এবং লাল হয়ে উঠলেন, ‘না, কোথাও এখন আর যেতে চাই না বাপু।
রুমাল আর টুপি খুললেন তিনি, সবদিকে তাঁর কালো চুলেল কুণ্ডল, একগোছা আটকে গিয়েছিল টুপিতে, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা ছাড়ালেন।
প্রায় ঈর্ষা নিয়ে ডল্লি বলল, ‘সুখে স্বাস্থ্যে সব সময়ই জ্বলজ্বল কর তুমি।’
‘আমিঃ… তা হ্যাঁ’, বললেন তিনি, ‘আরে তানিয়া না? সৃষ্টিকর্তা! আমার সেরিওজার সমবয়সী।’ ছুটে আসা একটা মেয়েকে দেখে বলে উঠলেন আন্না, কোলে নিয়ে চুমু খেলেন তাকে। ‘কি সুন্দর মেয়ে, কি সুন্দর! দেখাও না ওদের সবাইকে।’
এক-এক করে ওদের নাম করলেন তিনি, এবং শুধু নাম নয়, কার কোন বছর, কোন মাসে জন্ম, কার কেমন স্বভাব, কি রোগে ভুগেছে এ সবই মনে করে বললেন তিনি এবং ডল্লি তার কদর না করে পারলেন না।
‘বেশ, চলুন ওদের কাছে’, ডল্লি বললেন, ‘শুধু ভাসিয়া ঘুমাচ্ছে, এটাই যা আফসোস।’
ছেলেদের দেখে এসে ওঁরা একলা ড্রয়িং-রুমে বসলেন কফি নিয়ে। আন্না ট্রে-টা নিয়েছিলেন, পরে তা সরিয়ে রাখলেন। বললেন, ‘ডল্লি, ও আমাকে বলেছে।’
শীতল দৃষ্টিতে ডল্লি তাকালেন আন্নার দিকে। এর পর ভান করা সহানুভূতির বুলি আশা করছিলেন তিনি; কিন্তু আন্না তেমন কিছু বললেন না। বললেন, ‘ডল্লি লক্ষ্মীটি, ওর হয়ে তোমাকে কিছু বলব না, সান্ত্বনা দিতে যাব না, সে অসম্ভব। কিন্তু, লক্ষ্মী আমার, শুধু কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য।’
তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের ঘন পক্ষ্মতল থেকে হঠাৎ টলমল করে উঠল অশ্রু। তিনি ঘেঁষে বসলেন ভাবীর দিকে, নিজের ছোট্ট সজীব হাতে চেপে ধরলেন তাঁর হাত। ডল্লি সরে গেলেন না, কিন্তু বদল হল না মুখের নীরস ভাবটায়। বললেন : ‘আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই। যা ঘটেছে তারপর সবই গেছে, সবই ডুবেছে।’
আর এই কথাটা বলামাত্র হঠাৎ নরম হয়ে এল তাঁর মুখভাব। ডল্লির শুকনো রোগা হাতখানা তুলে চুমু খেয়ে আন্না বললেন : ‘কিন্তু ডল্লি, কি করা যায়, কি করা যায়? এই ভয়ংকর অবস্থায় কি করলে ভালো হবে? সেটাই ভাবা দরকার।’
ডল্লি বললেন, ‘সব শেষ, সব চুকে গেছে। আর সবচেয়ে খারাপ কি জান, আমি ওকে ত্যাগ করতে পারি না; ছেলেপেলেরা রয়েছে, আমি যে বাঁধা। কিন্তু ওর সাথে ঘর করতেও আমি পারব না, ওকে দেখলেই যন্ত্রণা হয় আমার।
‘ডল্লি, বোনটি আমার, ও আমাকে বলেছে, কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই, সব কিছু আমাকে বল।’
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডল্লি তাকালেন তাঁর দিকে।
আন্নার মুখে দেখা গেল অকৃত্রিম সহমর্মিতা আর ভালোবাসা।
হঠাৎ ডল্লি বললেন, ‘বেশ তাই হোক। কিন্তু আমি গোড়া থেকে সব বলব। তুমি জানো আমার বিয়ে হয় কিভাবে? মায়ের শিক্ষাগুণে আমি শুধু নিরীহ নয়, বোকাই ছিলাম। কিছুই জানতাম না আমি। আমি জানি লোকে বলে, স্বামী তার আগের জীবন সম্পর্কে স্ত্রীকে সব কিছু বলবে। কিন্তু স্তিভা…’ নিজেকে সংশোধন করে নিলেন তিনি, ‘অব্লোন্স্কি আমাকে কিছুই বলেনি। তোমার বিশ্বাস হবে না, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আমি ভেবে এসেছি, আমিই একমাত্র নারী যাকে ও জানে। এভাবেই কাটিয়েছি আট বছর। তুমি বুঝে দেখো, আমি শুধু তাকে অবিশ্বস্ততায় সন্দেহ করিনি তাই নয়, ভাবতাম ওটা অসম্ভব। তারপর এই ধরনের ধারণা নিয়ে হঠাৎ, ভেবে দেখো, এসব বীভৎসতা, এই কদর্যতা… তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা কর। নিজের সুখে একেবারে নিঃসন্দেহ থাকার পর হঠাৎ…’ ডল্লি বলে চললেন তাঁর ফোঁপানি চেপে, ‘পাওয়া গেল চিঠি, ওর চিঠি ওর প্রণয়িনীর কাছে। আমারই গভর্নেসের কাছে। না, এটা বড় বেশি সাঙ্ঘাতিক!’ উনি তাড়াতাড়ি করে রুমাল চাপা দিলেন মুখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে চললেন, ‘একটা আসক্তির ব্যাপার হলেও নয় বুঝতাম। কিন্তু ভেবে চিন্তে ধূর্তামি করে আমাকে প্রতারণা… কিন্তু কার সাথে? ওকে নিয়ে আবার সেইসাথে আমার স্বামী হয়ে থাকা… এটা সাঙ্ঘাতিক! তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।‘
‘না না, আমি বুঝতে পারছি ডল্লি, বুঝতে পারছি’, তাঁর হাতে চাপ দিয়ে বললেন আন্না।
ডল্লি বলে চললেন, ‘আমার অবস্থা যে কি সাঙ্ঘাতিক সেটা ও বোঝে বলে তুমি ভাবছ? এক বিন্দু না! ও দিব্যি সুখে-স্বচ্ছন্দে আছে।’
‘না, না’, তাড়াতাড়ি করে বাধা দিলেন আন্না, ‘ও নেহাৎ কৃপাপাত্র, অনুশোচনায় মরছে…’
‘ওর পক্ষে অনুশোচনা কি সম্ভব?’ একদৃষ্টে ননদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধা দিলেন ডল্লি।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি ওকে জানি। ওকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল আমার! দুজনেই তো আমরা ওকে জানি। ওর মনটা ভালো, কিন্তু গর্ব আছে তো, আর এখন একেবারে হতমান… প্রধান যে জিনিসটা আমাকে নাড়া দিয়েছে’, (আন্না অনুমান করে নিলেন প্রধান কোন জিনিসটা ডল্লিকে নাড়া দিতে পারে), ‘দুটো ব্যাপার তাকে দগ্ধে মারছে : ছেলেমেয়েদের সামনে লজ্জা, আর তোমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি করে তোমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও’, আপত্তি করতে ওঠা ডল্লিকে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমাকেই কষ্ট দিয়েছে, তোমাকে শেষ করে ফেলেছে। ও কেবলি বলছে, ‘না, না, আমাকে ও ক্ষমা করবে না।’
চিন্তামগ্নের মত ডল্লি ননদের দিকে না তাকিয়ে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝি যে ওর অবস্থাটা দুর্বিষহ; নির্দোষের চেয়ে দোষীর হাল হয় খারাপ, যদি সে বুঝে থাকে যে তার দোষেই এই দুর্ভাগ্য। কিন্তু কি করে ক্ষমা করি, ওই মেয়েটার পর কি করে থাকি তার স্ত্রী হয়ে? ওর সাথে থাকা এখন আমার কাছে যন্ত্রণা, ওর প্রতি আমার অতীত ভালোবাসাটা আমি ভালোবাসি বলেই…’
ফোঁপানিতে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু যতবার তিনি নরম হয়ে আসছিলেন, ততবারই যেটা তাঁকে জ্বালাচ্ছে, আবার সেই কথা বলতে শুরু করছিলেন তিনি।
‘ওর যে বয়স কম, ও যে সুন্দরী’, ডল্লি বলে চললেন, ‘আমার যৌবন, আমার রূপ কে হরণ করেছে জানো আন্না? ও আর তার ছেয়েমেয়েরা। ওর জন্য খেটে গেছি আমি, সেই খাটুনিতেই আমার সব কিছু গেছে, আর এখন তাজা, ইতর একটা প্রাণীকে মনোরম লাগবে বৈকি। ওরা নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে আমার কথা বলাবলি করেছে, কিংবা যা আরো খারাপ, চুপ করে থেকেছে, বুঝেছ?’ আবার চোখে ওঁর ফুটে উঠল আক্রোশ, ‘আর এর পর ও আমাকে বলবে… ওকে আমি কি আর বিশ্বাস করব? কখনো না। না, যা ছিল আমার সান্ত্বনা, আমার খাটুনির পুরস্কার, যন্ত্রণা, সব চুকে গেছে… তুমি বিশ্বাস করবে কি? এই তো, গ্রিশাকে পড়াচ্ছিলাম : আগে এটা ছিল আনন্দের ব্যাপার, এখন কষ্ট। কেন আমি খাটছি, চেষ্টা করে যাচ্ছি? ছেলেপিলে নিয়ে কি হবে আমার? সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে মন আমার হঠাৎ পালটে গেছে। ভালোবাসা, কোমলতার বদলে ওর প্রতি আমার আছে কেবল আক্রোশ, হ্যাঁ আক্রোশ। আমি ওকে খুন করতে পারি…’
‘ডল্লি, বোন আমার, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজেকে কষ্ট দিও না। তুমি এত অপমানিত, এত উত্তেজিত হয়েছ যে অনেক জিনিসকে তুমি দেখছ একটু অন্যভাবে।’
ডল্লি শান্ত হয়ে এলেন, মিনিট দুয়েক চুপ করে রইলেন ওঁরা।
‘কি করা যায় আন্না, ভেবে বল, সাহায্য কর আমাকে। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, কিন্তু পথ পাচ্ছি না।‘
আন্না কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না, কিন্তু ভাবীর প্রতিটা কথা, প্রতিটা মুখভাবে সরাসরি সাড়া দিচ্ছিল তাঁর হৃদয়।
এই বলে শুরু করলেন আন্না, ‘শুধু একটা কথা বলি, আমি ওর বোন, ওর চরিত্র আমার জানা, জানি ওর সব কিছু ভুলে যাবার’, (কপালের সামনে হাতের একটা ভঙ্গি করলেন তিনি), ‘এই সামর্থ্য, পুরোপুরি আসক্তি তবে আবার পুরোপুরি অনুশোচনার এই প্রবণতা। যা সে করেছে সেটা করতে পারল কিভাবে তা এখন আর তার বিশ্বাস হচ্ছে না, বুঝতে পারছে না।’
ডল্লি বাধা দিলেন, ‘না, বোঝে, বুঝেছে! কিন্তু আমার কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ… আমার পক্ষে কি এটা সহজ?’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমাকে যখন ও ঘটনাটা বলেছিল, তখন তোমার অবস্থাটা কত ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝিনি, সেটা তোমার কাছে স্বীকার করছি। আমি শুধু দেখেছিলাম ওকে, দেখেছিলাম যে পরিবার ভেঙে পড়ছে; ওর জন্য মায়া হয়েছিল আমার, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলার পরে আমি নারী হিসেবে অন্য কিছু দেখছি; দেখছি তোমার যন্ত্রণা, বলতে পারব না তোমার জন্য কি যে কষ্ট হচ্ছে আমার! কিন্তু ডল্লি, বোন আমার, তোমার যন্ত্রণা আমি বেশ বুঝতে পারছি, শুধু একটা জিনিস আমি জানি না… জানি না… জানি না ওর জন্য তোমার প্রাণের ভেতর কতটা ভালোবাসা এখনো আছে। সেটা তুমি জানো—এতটা কি আছে যাতে ওকে ক্ষমা করা সম্ভব। যদি থাকে, তাহলে ক্ষমা কর।’
‘না’, ডল্লি শুরু করেছিলেন, কিন্তু আরেকবার তাঁর হাতে চুমু খেয়ে আন্না থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, ‘দুনিয়াটা আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। স্তিভার মত এসব লোকেদের আমি চিনি, জানি কিভাবে তারা এই ব্যাপারগুলোকে দেখে। তুমি বলছ, মেয়েটার সাথে ও তোমার কথা বলাবলি করেছে। তা সে করেনি। এসব লোকে বিশ্বাসহানির কাজ করতে পারে, কিন্তু নিজেদের গৃহ আর গৃহিণী তাদের কাছে পবিত্র। এই ধরনের মেয়েদের ওদের কাছে কেমন যেন অবজ্ঞাই পেয়ে থাকে, পরিবারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে না। ওরা যেন দুর্লঙ্ঘ্য কি-একটা রেখা টানে পরিবার আর এদের মধ্যে। আমি ঠিক বুঝি না, কিন্তু ব্যাপারটা এই রকমই।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু ও তো চুমু খেয়েছে ওকে…’
‘শোনো ডল্লি, বোনটি আমার। স্তিভা যখন তোমার প্রেমে পড়েছিল তখন তো আমি ওকে দেখেছি। সে সময়টা আমার বেশ মনে আছে যখন সে আমার কাছে তোমার কথা বলতে গিয়ে কাঁদতো, ওর কাছে কি কাব্য আর সমুন্নতির উপলক্ষ ছিল তুমি। আমি এও জানি যে তোমার সাথে ওর যত দিন কেটেছে ততই ওর চোখে তুমি উঁচু হয়ে উঠেছ। ওকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, প্রতিটা কথায় ও যোগ দিত : ‘ডল্লি আশ্চর্য মেয়ে।’ ওর কাছে তুমি সব সময়ই ছিলে এবং আছ স্বর্গের দেবী। ওর এই আসক্তিটা প্রাণ থেকে নয়…’
‘কিন্তু আসক্তির যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে?’
‘আমি যতটা বুঝি হওয়া সম্ভব নয়…’
‘কিন্তু তুমি ক্ষমা করতে পারতে?’
‘জানি না, বিচার করে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়… না, সম্ভব’, খানিকটা ভেবে নিয়ে মনে মনে অবস্থাটা মানদণ্ডে চাপিয়ে আন্না বললেন, ‘না, সম্ভব, সম্ভব, সম্ভব। হ্যাঁ, আমি হলে ক্ষমা করতাম। ঠিক একইরকম থেকে যেতাম না নিশ্চয়, কিন্তু ক্ষমা করতাম, এবং এমনভাবে করতাম যে কিছু হয়নি, একেবারেই কিছু হয়নি।
‘সে তো বটেই’, তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন ডল্লি। যেন অনেক বার যা ভেবেছিলেন তাই বলছেন, ‘না হলে তো ওটা ক্ষমাই নয়। যদি ক্ষমা করতে হয়, তাহলে পুরোপুরি, পুরোপুরি। নাও, চল তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই’, উঠে দাঁড়িয়ে ডল্লি বললেন এবং যেতে যেতে আন্নাকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ভারি খুশি হয়েছি, তুমি এসেছ বলে। মনটা হালকা হল, খুবই হালকা।’
আন্না কারেনিনা – ১.২০
বিশ
আন্না সারাটা দিন বাড়িতে, অর্থাৎ অব্লোন্স্কিদের ওখানে কাটালেন। পরিচিত কারো সাথে দেখা করলেন না। আন্নার আসার খবর পেয়ে তাঁরা সেদিনই এসে হাজির হয়েছিলেন। সকালটা তিনি কাটালেন ডল্লি আর ছেলেমেয়েদের সাথে। ভাইকে চিঠি লিখে পাঠালেন তিনি যেন অবশ্য-অবশ্যই বাড়িতে খান। লিখলেন, ‘চলে এসো, সৃষ্টিকর্তা করুণাময়।’
বাড়িতেই খেলেন অব্লোন্স্কি; কথাবার্তা হল সাধারণ। স্ত্রী তাঁর সাথে কথা বললেন ‘তুমি’ বলে, যেটা আগে বলছিলেন না। স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সম্পর্কে একইরকম অনাত্মীয়তা রয়ে গেল, কিন্তু ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন আর ছিল না এবং ব্যাখ্যা করে মিটিয়ে নেবার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন অব্লোন্স্কি।
খাওয়ার ঠিক পরেই এল কিটি। আন্না আর্কাদিয়েভনাকে কিটি চিনত, তবে খুবই সামান্য। বোনের কাছে কিটি এল একটু ভয়-ভয় মনেই, পিটার্সবুর্গের উচ্চ সমাজের এই যে মহিলাকে সবাই এত প্রশংসা করে, তিনি কিভাবে তাকে গ্রহণ করবেন এই নিয়ে তার শংকা ছিল। কিন্তু কিটিকে ভালো লাগল আন্না আর্কাদিয়েভনার—এটা সে তখনই টের পেল। স্পষ্টতই আন্না মুগ্ধ হয়েছিলেন কিটির রূপ ও তারুণ্যে এবং কিটি সচেতন হতে না হতেই অনুভব করল যে সে শুধু আন্নার প্রভাবে পড়েছে তাই নয়, তাঁকে ভালোবেসেও ফেলেছে, যেভাবে কোন তরুণী ভালোবাসতে পারে বয়সে বড় বিবাহিত কোন মহিলাকে। আন্নাকে উঁচু সমাজের মহিলা বা আট বছর বয়স্ক ছেলের মা বলেও মনে হল না। বরং গতির নমনীয়তা, সতেজ ভাব আর মুখের যে সজীবতা কখনো তাঁর হাসিতে, কখনো দৃষ্টিতে ফুটে উঠত তাতে তাঁকে বিশ বছরের তরুণীর মতই লাগে, অবশ্য যদি তাঁর সে মুখ গম্ভীর, মাঝে মাঝে বিষণ্ন ভাবে ধারণ না করত। সেটায় বিস্মিত ও আকৃষ্ট বোধ করল কিটি। সে অনুভব করছিল যে আন্না একেবারে সহজ মানুষ, কিছুই লুকিয়ে রাখেন না, তবু কিটির কাছে অনধিগম্য জটিল কাব্যিক আগ্রহের একটা উঁচু ধরনের জগৎ যেন তাঁর মধ্যে বিরাজমান।
ডল্লি যখন আহারের পর উঠে গেলেন তাঁর ঘরে, আন্না দ্রুত চলে গেলেন ধূমপানরত ভাইয়ের কাছে। ফুর্তি করে চোখ মটকে তাঁর ওপর ক্রুশ করে চোখ দিয়ে দরজার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘যাও স্তিভা, সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুন!’
আন্নার কথা ধরতে পেরে তিনি চুরুট ফেলে দিয়ে অন্তর্ধান করলেন দরজার ওপাশে।
অব্লোন্স্কি চলে যেতে তিনি ফিরলেন সোফায়, সেখানে রইলেন শিশু পরিবৃত হয়ে। তা যে এই ফুফুকে ভালোবাসেন সেটা তাদের চোখে পড়েছিল বলেই কি, অথবা তারা নিজেরাই তাঁর মধ্যে একটা বিশেষ মাধুর্য অনুভব করেছিল বলেই হোক, তবে বড় দুটো আর তাদের দেখাদেখি ছোটরাও, শিশুদের বেলায় যা প্রায়ই ঘটে থাকে, আহারের আগে থেকেই নতুন ফুফুকে ছেঁকে ধরেছিল, সঙ্গ ছাড়ছিল না তাঁর। কি করে ফুফুর যথাসম্ভব কাছ ঘেঁসে বসা যায়, তাঁকে ছোঁয়া যায়, তাঁর ছোট্ট হাতখানা নিয়ে চুমু খাওয়া যায়, খেলা করা যায় তাঁর আংটি নিয়ে, অন্তত তাঁর পোশাকের কুঁচি নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় এই নিয়ে যেন একটা খেলা শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে।
নিজের জায়গায় বসে আন্না বললেন, ‘নাও, নাও, আগে যে যেমন বসেছিলাম।’
এবং আবার গ্রিশা তাঁর হাতের তল দিয়ে মাথা গলিয়ে পোশাকের ওপর মাথা রাখলে, গর্বে আর সুখে জ্বলজ্বল করে উঠল সে।
‘তা বলনাচটা হচ্ছে কখন?’ কিটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘সামনের সপ্তাহে। চমৎকার নাচ। যেখানে সব সময়ই ফুর্তি লাগে তেমনি ধরনের একটা।’
‘কিন্তু এমন বলনাচ আছে কি যেখানে সব সময়ই ফুর্তি জমে?’ স্নিগ্ধ রহস্যের সুরে বললেন তিনি।
‘আশ্চর্য লাগলেও আছে। বব্রিশ্যেভদের ওখানে সব সময় জমে, নিকিতিনদের ওখানেও, কিন্তু মেঝকোভদের ওখানে সব সময়ই একঘেয়ে। আপনি কি লক্ষ্য করেননি?’
‘না, বোন, ফুর্তির বলনাচ আমার আর নেই’, আন্না বললেন আর কিটি তার চোখে দেখল সেই বিশেষ জগৎ যা তার কাছে অনুদ্ঘাটিত, ‘আমার কাছে শুধু তেমন বলনাচই সম্ভব যা কম দুঃসহ, কম একঘেয়ে … ‘
‘বলনাচে আপনার একঘেয়ে লাগে কেমন করে?’
‘কেন একঘেয়ে লাগবে না আমার?’ জিজ্ঞেস করলেন আন্না।
কিটি লক্ষ্য করল যে কি উত্তর আসবে সেটা আন্নার জানা।
‘আপনি সব সময় সবার চেয়ে সেরা বলে।’
লাল হয়ে ওঠার সামর্থ্য আন্নার ছিল। লাল হয়ে তিনি বললেন :
‘প্রথমত, কখনোই তা নই। দ্বিতীয়ত, যদি হইও তাতে আমার কি এসে গেল?’
কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এই বলনাচে যাবেন?’
‘আমার মনে হয় না গিয়ে চলবে না। এই নে’, তিনি বললেন তানিয়াকে, ক্রমশ সরু হয়ে আসা তাঁর সাদা আঙুল থেকে সহজে খসে আসা একটা আংটি টানাটানি করছিল সে।
‘আপনি গেলে ভারি খুশি হব আমি। বলনাচে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার।’
‘অন্তত যদি যেতে হয়, তাহলে এই ভেবে প্রবোধ মানব যে এতে আপনি আনন্দ পেয়েছেন… গ্রিশা টানাটানি করিস না রে, এমনিতেই সব আলুথালু হয়ে আছে’, বেরিয়ে আসা যে একগোছা চুল নিয়ে গ্রিসা খেলছিল, সেটা ঠিক করে নিয়ে বললেন তিনি।
‘বলনাচে আমি আপনাকে কল্পনা করছি ভায়োলেট রঙের পোশাকে।’
‘ঠিক ভায়োলেট রঙই হতে হবে কেন?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন আন্না, ‘নাও ছেলেমেয়েরা, যাও এবার, যাও। শুনছ না, মিস গুল ডাকছেন চা খেতে’, ছেলেদের হাত থেকে নিজেকে খসিয়ে তাদের ডাইনিং-রুমে পাঠাতে পাঠাতে বললেন তিনি 1
‘আর আমি জানি কেন আপনি আমাকে বলনাচে ডাকছেন। এই বলনাচটা থেকে আপনার আশা অনেক, তাই আপনার ইচ্ছে হচ্ছে সবাই যেন সেখানে থাকে, তাতে যোগ দেয়।’
‘কি করে জানলেন? হ্যাঁ, তাই।’
‘ওহ্ কি চমৎকার আপনাদের এই বয়সটা’, আন্না বলে চললেন, ‘বেশ মনে আছে, সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের ওপরকার নীল কুয়াশার মত এই কুয়াশাটা যে আমার চেনা। এ কুয়াশা পুলকে ছেয়ে দেয় ওই বয়সটাকে, যখন শৈশব এই শেষ হল বলে, আর এই বিশাল সুখী মহলটা থেকে কেবলি বেরিয়ে আসছে পথ, আর সারি সারি এই কক্ষগুলোয় ঢুকতে যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি ভয়ও করছে যদিও মনে হচ্ছে এ হর্ম্য যেন উজ্জ্বল আর অপরূপ…কে না গেছে এর ভেতর দিয়ে?
নীরবে হাসল কিটি। আন্নার স্বামী আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিনের অকাব্যিক চেহারাটা মনে করে সে ভাবল, ‘কিন্তু কেমন করে উনি গেলেন এর ভেতর দিয়ে? ওঁর সমস্ত রোমান্সটা জানতে আমার ভারি ইচ্ছে।’
‘আমি কিছু কিছু জানি। স্তিভা আমাকে বলেছে, অভিনন্দন জানাই আপনাকে, লোকটিকে আমার ভারি ভালো
লেগেছে’, আন্না বলে চললেন, ‘ভ্রন্স্কির সাথে আমার দেখা হয়েছে রেল স্টেশনে।’
‘আরে, উনি গিয়েছিলেন সেখানে?’ লাল হয়ে জিজ্ঞেস করল কিটি, ‘স্তিভা কি বলেছে আপনাকে?’
‘বকবক করে স্তিভা আমাকে সবই বলে ফেলেছে। আমিও খুব খুশি হয়েছি। কাল আমি ট্রেনে এসেছি প্রস্কির মায়ের সাথে’, আন্না বলে চললেন, ‘মা-র মুখে কেবলি ছেলের কথা; এটি ওঁর আদরের ছেলে; মায়েরা কিরকম পক্ষপাতী হয় তা আমি জানি, কিন্তু …‘
‘মা আপনাকে কি বললেন?
‘সে অনেক! আমি জানি যে ও মায়ের আদরের ছেলে, তাহলেও দেখেই বোঝা যায় সে বীরব্রতী… যেমন, ম বলেছেন সে তার সব সম্পত্তি ভাইকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল, ছেলেবেলাতেই অসাধারণ একটা কাণ্ড করেছে সে, পানিতে ডোবা থেকে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছে। মোট কথা বীর…’ হেসে বললেন আন্না। স্টেশনে যে দু’শ রুবুল দিয়েছেন, সেটা স্মরণ করলেন তিনি।
কিন্তু ওই দু’শ রুলের কথাটা উনি বললেন না। কেন জানি সেটা মনে করতে তাঁর খারাপ লাগছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে ঘটনাটার সাথে তাঁরও যেন কিছু-একটা যোগ আছে যা থাকা উচিত ছিল না।
আন্না বললেন, ‘কাউন্টেস আমাকে খুব করে তাঁর ওখানে যেতে বলেছেন। বুড়িকে দেখতে যেতে আমার আনন্দই হবে, কালই যার। তবে, থাক, বাবা, স্তিভা ডল্লির ঘরে রয়েছে অনেকক্ষণ’, আলাপের প্রসঙ্গ বদলিয়ে যোগ করলেন আন্না এবং উঠে দাঁড়ালেন, কিটির মনে হল কেন জানি অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।
‘না-না, আগে আমি! না আমি!’ চা-পর্ব শেষ করে আন্না খালার কাছে ছুটে আসতে আসতে ছেয়ে-মেয়েরা চেঁচাচ্ছিল।
‘আমরা সবাই একসাথে’, এই বলে আন্না হাসতে হাসতে ছুটে গেলেন তাদের দিকে, উল্লাসে চেঁচামেচি করা এই গোটা দলটাকে এবং সবাইকে জড়িয়ে ধরে ঢিপ করে ফেললেন।
একুশ
ডল্লি তাঁর ঘর থেকে বেরোলেন বড়দের চায়ের সময়। অবলোন্স্কি বেরোলেন না। তিনি নিশ্চয় পেছনের দরজা দিয়ে স্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।
ডল্লি আন্নার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, ওপরে তোমার শীত করবে। আমার ইচ্ছে তোমাকে নিচে নামিয়ে আনি, দুজনে কাছাকাছিও থাকা যাবে।’
‘আরে না, আমার জন্য ভাবনা নেই’, ডল্লির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমাট হয়ে গেছে কিনা আন্দাজ করার চেষ্টা করে বললেন আন্না।
ভাবী বললেন, ‘এখানে আলো হত বেশি।’
‘তোমাকে বলছি যে সবখানে এবং সব সময় আমি অঘোরে ঘুমাই।’
‘কি নিয়ে কথা হচ্ছে’, স্টাডি থেকে বেরিয়ে বৌকে উদ্দেশ করে বললেন অব্লোন্স্কি।
তাঁর গলার সুরে কিটি এবং আন্না দুজনেই বুঝলেন যে মিটমাট হয়ে গেছে।
‘আমি চাইছি আন্নাকে নিচে নামিয়ে আনতে, তবে পর্দা টাঙাতে হবে নতুন করে। কিন্তু কেউ সেটা পারবে না, করতে হবে আমাকেই’, জবাবে স্বামীকে বললেন ডল্লি।
‘পুরো মিটমাট হয়েছে কিনা সৃষ্টিকর্তাই জানে না’, তাঁর নিরুত্তাপ অচঞ্চল গলা শুনে আন্না ভাবলেন।
স্বামী বললেন, ‘আহ্ ডল্লি, বাড়িয়ে বলো না। বল তো আমিই করে দিচ্ছি…’
‘হ্যাঁ, মিটমাট হয়েছে তাহলে’, ভাবলেন আন্না।
‘তুমি যে কি করবে তা বেশ জানা আছে সাহেব’, ডল্লি বললেন, ‘মাতভেইকে এমন কিছু করার হুকুম দেবে যা করা যায় না, আর নিজে যাবে বেরিয়ে। সেও সব গোলমাল করে বসবে।’ আর এ কথা বলার সময় ডল্লির ঠোঁটের কোন কুঁচকে উঠল তাঁর অভ্যস্ত শ্লেষের হাসিতে।
‘একেবারে! একেবারে মিটমাট, এক্কেবারে’, ভাবলেন আন্না, ‘মহান সৃষ্টিকর্তা!’ এবং তিনিই যে এর হেতু এতে খুশি হয়ে ডল্লির কাছে গিয়ে চুমু খেলেন তাঁকে।
‘মোটেই না। আমাকে আর মাতভেইকে এত তাচ্ছিল্য কেন কর বল তো?’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রায় অলক্ষ্য একটু হেসে বললেন অব্লোন্স্কি।
বরাবরের মত সারাটা সন্ধ্যা ডল্লি স্বামীকে ঠাট্টা করে চললেন আর অব্লোন্স্কি রইলেন হাসিখুশি তুষ্ট হয়ে, কিন্তু শুধু ততটা যাতে না প্রকাশ পায় যে মার্জনা লাভ করায় তিনি তাঁর অপরাধ ভুলে গেছেন।
সাড়ে ন’টার সময় অব্লোন্স্কিদের বাড়িতে চায়ের আসরে সবিশেষ আনন্দময় প্রীতিকর পারিবারিক সান্ধ্যালাপটা ক্ষুণ্ণ হল বাহ্যত অতি সাধারণ একটা ঘটনায় কিন্তু সেই সাধারণ ঘটনাটাই কেন জানি সবার কাছে মনে হল অদ্ভুত। পিটার্সবুর্গের সাধারণ পরিচিতদের কথা বলতে বলতে আন্না ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমার অ্যালবামে ছবি আছে। ভালো কথা, আমার সেরিওজাকেও দেখাব তোমাদের’, গর্বিত মায়ের হাসি নিয়ে যোগ করলেন তিনি।
দশটার সময় যখন সাধারণত তিনি ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিতেন এবং বলনাচে যাবার আগে নিজে শুইয়ে দিতেন তাকে, এখন তার কাছ থেকে এত দূরে আছেন ভেবে বিষণ্ণ লাগল তাঁর; এবং যা নিয়েই কথাবার্তা চলুক, থেকেই থেকেই তাঁর মন চলে যাচ্ছিল তাঁর কোঁকড়া-চুলো সেরিওজার পানে। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল তার ছবিটা তাকিয়ে দেখে তার গল্প করে শোনায়, প্রথম অজুহাতের সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর লঘু, দৃঢ়চিত্ত চলনে উঠে গেলেন অ্যালবাম আনতে। ওপরে, তাঁর ঘরে যাবার সিঁড়িটা উঠেছিল। প্রধান সিঁড়ির উষ্ণ চাতাল থেকে।
ড্রয়িং-রুম থেকে বেরোতেই সদর হলঘরে ঘণ্টি শোনা গেল।
ডল্লি বলল, ‘কে এল আবার?’
কিটি টিপ্পনি কাটলে, ‘আমার জন্য এসে থাকলে আগেই এসেছে, আর কারো কারো পক্ষে দেরি করে।’
‘নিশ্চয় কাগজ নিয়ে এসেছে’, যোগ করলেন অব্লোন্স্কি আর আন্না যখন সিঁড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, চাকর ওপরে উঠছিল অভ্যাগতের খবর দিতে আর অভ্যাগত নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাতির কাছে। নিচে তাকিয়ে আন্না তখনই চিনতে পারলেন ভ্রন্স্কিকে, এবং হঠাৎ তাঁর বুকের মধ্যে দুলে উঠল আনন্দ আর সেই সাথে ভয়ের একটা বিচিত্র অনুভূতি। ওভারকোট না ছেড়ে ভ্রন্স্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন, কি যেন বার করছিলেন পকেট থেকে। আন্না যখন সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠেছেন, ভ্রন্স্কি চোখ তুলতেই দেখতে পেলেন তাঁকে, মুখের ভাবে ফুটে উঠল কেমন একটা লজ্জা আর ভয়। আন্না সামান্য মাথা নত করে চলে গেলেন আর তার পরেই শোনা গেল আগতকে ভেতরে আসবার জন্য উচ্চৈস্বরে ডাকছেন অব্লোন্স্কি আর অনুচ্চ নরম, অচঞ্চল গলায় আপত্তি করছেন ভ্রন্স্কি।
অ্যালবাম নিয়ে আন্না যখন ফিরলেন, ভ্রন্স্কি তখন আর নেই। অব্লোন্স্কি বলছিলেন, নামকরা যে ব্যক্তিটি শহরে এসেছেন তাঁর জন্য যে ডিনার দেওয়া হচ্ছে তার কথা জানতে এসেছিলেন তিনি।
যোগ করলেন তিনি, ‘কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে চাইল না। আশ্চর্য লোক বটে।’
কিটি রাঙা হয়ে উঠল। তার মনে হল, কেন তিনি এসেছিলেন আর কেনই বা ভেতরে ঢুকলেন না, কেবল সে- ই বুঝেছে একা। সে ভাবছিল, ‘আমাদের ওখানে গিয়েছিল ও, আমাকে না পেয়ে ভেবেছিল আমি এখানে; আর ভেতরে যে ঢুকল না তার কারণ বড় দেরি হয়ে গেছে, তা ছাড়া আন্না রয়েছেন এখানে।’
কিছু না বলে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আন্নার অ্যালবাম দেখতে লাগলেন।
যে ডিনারের আয়োজন হচ্ছে তার খুঁটিনাটি জানার জন্য একটা লোক এসেছিলেন বন্ধুর কাছে কিন্তু ভেতরে ঢোকেননি, এর মধ্যে অসাধারণ বা অদ্ভুত কিছু নেই। কিন্তু সবার কাছেই এটা মনে হল অদ্ভূত। তবে আন্নার কাছেই সবচেয়ে বেশি করে অদ্ভুত আর বিশ্রী লাগল
বাইশ
আলোয় ঝলমলে ফুলের টব আর পাউডার মাখা এবং লাল কাফতান পরা সব চাপরাশি শোভিত প্রশস্ত সিঁড়িতে মায়ের সাথে কিটি যখন উঠল, বলনাচ তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। হল থেকে আসছে গতিবিধির সমতাল মর্মর, যেন মধুচক্র, আর যখন তাঁরা গাছগুলোর মাঝখানকার চাতালে আয়নার সামনে কবরী আর পোশাক ঠিক করে নিচ্ছিলেন, হলে শোনা গেল অর্কেস্ট্রার বেহালায় প্রথম ওয়াজ নাচ শুরুর সন্তর্পণ সুস্পষ্ট সুর। অন্য এক আয়নার সামনে চাঁদির পাকা চুল সামলে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে যেতে গিয়ে সিঁড়িতে তাঁদের সাথে ধাক্কা খেলেন বেসামরিক পোশাকের এক বৃদ্ধ, তাঁর কাছে অপরিচিত কিটিকে দেখে স্পষ্টতই মুগ্ধ হয়ে সরে গেলেন তিনি। ভয়ানক নিচু কাটের ওয়েস্ট কোট পরা শ্মশ্রুহীন এক তরুণ, উঁচু সমাজের যে ছোকরাদের বৃদ্ধ প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কি বলতেন ন্যাকামণি তাদেরই একজন, যেতে যেতেই তার সাদা টাই ঠিক করতে করতে অভিবাদন করল ওঁদের উদ্দেশে এবং পাশ দিয়ে চলে গিয়ে আবার ফিরে এল কিটিকে কোয়াড্রিল নাচে আমন্ত্রণ জানাতে। কিটির প্রথম কোয়াড্রিল আগেই ভ্রন্স্কিকে দিয়ে রাখায় তরুণটিকে সে দ্বিতীয় নাচটা দিতে বাধ্য হল। দরজার কাছে দস্তানায় বোতাম আঁটতে আঁটতে ওঁদের পথ করে দিলেন সামরিক এক অফিসার এবং মোচে তা দিতে দিতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল গোলাপি কিটির দিকে।
সাজসজ্জা, কবরী আর বলনাচের সব কিছু প্রস্তুতিতে কিটির প্রচ্যুর মেহনত আর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন পড়লেও এখন তার গোলাপি আস্তরের ওপর জটিল ‘ত্যুল’ গাউনে বলনাচে নামল এমন স্বচ্ছন্দে আর সহজে যেন এসব রোজেট, লেস, সাজসজ্জায় নানা খুঁটিনাটির জন্য তার বা বাড়ির লোকেদের এক মুহূর্তও মাথা ঘামাতে হয়নি, যেন এই ত্যুল, লেস, ওপরে দুটো পাতা সমেত গোলাপ গোঁজা উঁচু কবরী নিয়েই সে জন্মেছে।
হলে ঢোকার মুখে প্রিন্স-মহিষী যখন তার কটির গুটিয়ে আসা রিবন ঠিক করে দিতে চাইলেন, কিটি আস্তে সরে গেল। তার মনে হচ্ছিল যে তার পোশাকের সব কিছুই আপনাআপনিই সুন্দর আর সৌষ্ঠবমণ্ডিত হওয়ার কথা, কিছুই সংশোধন করার প্রয়োজন নেই।
এটা ছিল কিটির এক সৌভাগ্যের দিন। গাউন আঁট হয়ে বসেনি কোথাও, বার্থা লেস কোথাও ঝুলে পড়েনি, দলামোচড়া হয়নি রোজেটগুলো, ছিঁড়েও যায়নি; উঁচু বাঁকা হিলের ওপর গোলাপি জুতোজোড়া খামচে ধরছে না, বরং ফূর্তি পাচ্ছে পা। সোনালি চুলের ঘন গুছি তার ছোট্ট মাথাটিতে খাপ খেয়ে গেছে তার নিজের চুলের মত। গড়ন না বদলিয়ে যে লম্বা দস্তানা তার হাত জড়িয়ে ছিল তার তিনটে বোতামই আঁটা, খসে আসেনি। ভারি একটা কোমলতায় তার গ্রীবা ঘিরে আছে কণ্ঠালংকারের কালো মখমল বন্ধনী। অপূর্ব সে মখমল, বাড়িতে আয়নায় নিজের গলা দেখে কিটি টের পেয়েছিল কি জানাতে চায় মখমলটি। আর সব কিছুতে খুঁতখুঁতি থাকলেও মখমল অপরূপ। এবং এখানে, এই বলনাচেও আয়নায় ওটা দেখে হাসি ফুটল কিটির মুখে। অনাবৃত কাঁধ আর হাতে মর্মরের শীতলতা অনুভব করল কিটি, এই অনুভূতিটা তার খুবই ভালো লাগে। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ, নিজের আকর্ষণীয়তার চেতনায় না হেসে পারছিল না তার রক্তিম ঠোঁট। হলে ঢুকে নাচের আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষমাণ মহিলাদের ত্যুল-রিবন-লেস-রঙের ভিড়টায় পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই (এরকম ভিড়ে কিটি কখনো দাঁড়িয়ে থাকেনি বেশিক্ষণ), ওয়াজে নাচার আমন্ত্রণ এল, আর আমন্ত্রণ করলেন কিনা নৃত্যের সেরা নাগর, বলনাচের পদাধিকারে প্রথম পুরুষ, তার খ্যাতনামা পরিচালক, আসরের অধিকারী, সামমণ্ডিত বিবাহিত সুপুরুষ এগুরুশকা কর্জুনস্কি। কাউন্টেস বানিনার সাথে তিনি প্রথম পালা ওয়াল্জ নাচ শেষ করে তাঁর এখতিয়ার, অর্থাৎ নৃত্যাবতীর্ণ কয়েক জোড়া নাচিয়ের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলেন কিটি আসছে, অমনি ছুটে গেলেন নৃত্যের পরিচালকদের পক্ষেই শুধু যা শোভা পায় তেমন একটা হেলা-ফেলা স্বাচ্ছন্দে এবং মাথা নত করে, সে রাজি আছে কিনা এমন কি সেটুকুও জিজ্ঞেস না করেই কিটির ক্ষীণ কটিদেশ আলিঙ্গনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিটি তাকিয়ে দেখল কাকে দেওয়া যায় তার হাতের পাখা, গৃহকর্ত্রী হেসে সেটা নিলেন।
‘ঠিক সময়ে এসে গিয়ে ভারি ভালো করেছেন’, কর্মনস্কি তার কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন। ‘দেরি করে আসা সত্যি কি যে এক বদভ্যাস।’
কিটি তার বাঁ হাত বেঁকিয়ে রাখল তাঁর কাঁধে, গোলাপি জুতা পরা তার ছোট ছোট পা মেঝের চিকন পার্কেটের ওপর অনায়াসে তাল মেলাল সঙ্গীতের সাথে।
ওয়াজের প্রথম ধীর লয়-ছন্দ শুরু করে কিটিকে উনি বললেন, ‘আপনার সাথে ওয়াজ নাচা একটা আরাম। কি লঘুতা, কি লঘুতা, কি সঠিকতা’, সে কথাই তিনি ওকে বললেন যা বলতেন তাঁর প্রায় সমস্ত সুপরিচিতাদের।
কিটি হাসল তাঁর প্রশংসায় এবং তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল হলঘরে। এমন নবাগতা সে নয়, যার কাছে বলনাচে সমস্ত লোকের মুখ মিলে যায় একক একটা ঐন্দ্রজালিক অনুভূতিতে; আবার বলনাচে ঢুঁ মেরে বেড়ানো তেমন কুমারীও সে নয়, যার কাছে সব মুখই চেনা, যাতে একঘেয়েমি লাগে; সে ছিল এই দুইয়ের মাঝামাঝি,—উত্তেজনা বোধ করছিল সে, কিন্তু সেই সাথে পর্যবেক্ষণ করার শক্তি রাখার মত দখলও ছিল তার নিজের ওপর। হলের বাম কোণে সে দেখল সমাজ চূড়ামণিদের জোট। সেখানে ছিল অসম্ভব রকমের অনাবৃত দেহে কর্সুনস্কির স্ত্রী, সুন্দরী লিদা, ছিলেন গৃহকর্ত্রী, নিজের টাক নিয়ে সেখানে জ্বলজ্বল করছেন ক্রিভিন, সমাজশ্রেষ্ঠরা যেখানে, সেখানে তিনি থাকেন সব সময়ই; কাছে যাবার সাহস না পেয়ে ছোকরারা তাকিয়ে দেখছিল সেদিকে; সেখানেই কিটির চোখে পড়ল স্তিভা, পরে দেখতে পেল কালো মখমলের পোশাকে আন্নার অপরূপ মূর্তি। তিনি-ও ছিলেন সেখানে। যে সন্ধ্যায় কিটি লেভিনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তার পর থেকে সে আর তাঁকে দেখেনি। কিটি তার দূরবীক্ষণ দৃষ্টিতে তখনই চিনতে পারল তাঁকে। এটাও লক্ষ্য করল যে, ভ্রন্স্কি তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
‘আরো এক পালা হবে নাকি? হাঁপিয়ে পড়েননি তো?’ সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন কর্মনস্কি।
‘না-না, আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘কোথায় পৌঁছে দেব আপনাকে?’
‘মনে হচ্ছে কারেনিনা রয়েছে ওখানে…ওঁর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
‘যেখানে বলবেন, সেখানেই।’
কর্সুনস্কিও তাঁর পদক্ষেপ সংযত করে ওয়াল্জ নাচতে নাচতে চলে গেলেন হলের বাঁ কোণের সেই ভিড়টার দিকে। ফরাসি ভাষায় ক্রমাগত বলতে থাকলেন, ‘ভদ্রমহিলাগণ, মাপ করবেন! মাপ করবেন, মাপ করবেন ভদ্রমহিলাগণ’, এবং লেস্, ত্যুল, রিবনের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে এদিক-ওদিক করে, কারো একটা পালক পর্যন্ত না ছুঁয়ে তাঁর নৃত্যসঙ্গিনীকে এমন সজোরে ঘোরালেন যে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল মিহি মোজা পরা তার তন্বী পা, পোশাকের পিছ-ঝুল গিয়ে জড়িয়ে পড়ল ক্রিভিনের হাঁটুতে। কর্মনস্কি মাথা নত করে খোলা বুক টান করে তাকে আন্না আর্কাদিয়েভনার কাছে নিয়ে যাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিটি লাল হয়ে ক্রিভিনের হাঁটু থেকে তার ঝুল খসিয়ে নিল। মাথা তখনো ঘুরছিল কিছুটা, আন্নার সন্ধানে তাকিয়ে দেখল চারদিকে। কিটি অবশ্য-অবশ্যই যা চেয়েছিল তেমন ভায়োলেট পোশাকে আন্না আসেননি। পরনে তাঁর নিচু কাটের কালো মখমলের গাউন, উদ্ঘাটিত তাঁর সুঠাম কাঁধ, বুক, যেন পুরানো হাতির দাঁতে খোদাই করা ছোট্ট ক্ষীণকায় মণিবন্ধ, সুডৌল বাহু। গোটা গাউন ভেনিসিয়ান লেসে সেলাই করা। নিজের কালো চুলে ভেজাল কিছু নেই, সেখানে প্যান্সি ফুলের ছোট একটা মালা, সাদা সাদা লেসের মাঝখানে কালো কোমরবন্ধেও তাই। কবরীর ছাঁদ চোখে পড়ার মত নয়, চোখে পড়ে শুধু তাঁর মাথার ওপরে আর পেছনে অনবরত খসে আসা কোঁকড়া চুলের ছোট ছোট স্বেচ্ছাচারী কুণ্ডল, যাতে খোঁপার শোভা বেড়েছে। দৃঢ় গ্রীবা যেন খোদাই করা, তাতে মুক্তার মালা।
আন্নাকে প্রতিদিন দেখেছে কিটি, তাঁর অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল, চাইছিল অবশ্য-অবশ্যই তাঁকে ভায়োলেট পোশাকে দেখতে। কিন্তু এখন কালো পোশাকে তাঁকে দেখে সে টের পেল যে তাঁর সমস্ত লাবণ্য সে বুঝতে পারেনি। এখন তাঁকে সে দেখল একেবারে নতুন, নিজের কাছে অপ্রত্যাশিত এক রূপে। এখন সে উপলব্ধি করল যে ভায়োলেট পোশাক ওঁর পক্ষে অসম্ভব। ওঁর লালিত্য ঠিক এখানে যে সব সময়ই উনি তাঁর সাজসজ্জার ঊর্ধ্বে উঠে যান, বেশভূষা ওঁর কখনোই লক্ষণীয় হওয়া সম্ভব নয়। ফলাও লেস সমেত তাঁর গায়ের এই কালো পোশাকটাও চোখে পড়ছে না; ওটা কেবল একটা কাঠামো, চোখে পড়ছে কেবল ওঁকে সহজ, স্বাভাবিক, সুচারু, সেই সাথে হাসিখুশি, সজীব।
উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বরাবরের মত অসাধারণ সিধে হয়ে, কিটি যখন এই দলটার কাছে আসে তখন তিনি গৃহকর্তার সাথে কথা বলছিলেন তাঁর দিকে সামান্য মাথা ফিরিয়ে।
‘না-না, আমি ঢিল ছুঁড়ছি না’, ওঁর কি-একটা কথায় তিনি বলছিলেন, ‘তবে আমি ঠিক বুঝি না’, কাঁধ কুঁচকে উনি বলে চললেন, এবং তখনই কিটির দিকে তাকালেন কোমল হাসিমুখে। তার সাজসজ্জায় রমণীর ত্বরিত দৃষ্টিপাত করে মাথা নাড়লেন অলক্ষ্যে কিন্তু কিটি বুঝল যে ওটা তার সাজ ও রূপ অনুমোদনের ভঙ্গি।—’আপনি হলে ঢুকছেন নাচতে নাচতে’, যোগ করলেন তিনি।
কর্সুনস্কি আন্না আর্কাদিয়েভনাকে আগে কখনো দেখেননি। তাঁর উদ্দেশে মাথা নত করে তিনি বললেন, ‘ইনি আমার একজন বিশ্বস্ত সহায়। বলনাচের আসরকে প্রিন্সেস হাসি-খুশি আর সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করেন। আন্না আর্কাদিয়েভনা, ওয়াজের পালা’, আবার মাথা নত করে বললেন তিনি।
গৃহকর্তা বললেন, ‘আপনাদের কি পরিচয় ছিল?’
‘কার সাথে আমাদের পরিচয় নেই? সাদা রঙের নেকড়ের মত আমি আর আমার স্ত্রীকে চেনে সবাই’, জবাব দিলেন কর্সুনস্কি, ‘ওয়াজের পালা, আন্না আর্কাদিয়েভনা।’
আন্না বললেন, ‘পারা গেলে আমি নাচি না।’
কর্সুনস্কি জবাব দিলেন, ‘কিন্তু আজকে ওটি চলবে না।’
এই সময় এগিয়ে এলেন ভ্রন্স্কি।
‘তা আজকে যখন না নাচলে চলবে না, তখন চলুন’, ভ্রন্স্কির অভিবাদন খেয়াল না করে আন্না বললেন এবং দ্রুত হাত রাখলেন কর্মুনস্কির কাঁধে।
ভ্রন্স্কির অভিবাদনের প্রত্যুত্তর আন্না ইচ্ছে করে দিলেন না, এটা লক্ষ্য করে কিটি ভাবলে, ‘কেন ওর ওপর উনি অসন্তুষ্ট?’ ভ্রন্স্কি কিটির কাছে এসে প্রথম কোয়াড্রিলের কথাটা মনে করিয়ে দিলেন এবং এই কয়দিন তাকে দেখার আনন্দলাভ ঘটেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আন্নার ওয়াজ নাচ কিটি দেখছিল মুগ্ধ হয়ে আর শুনে যাচ্ছিল ভ্রন্স্কির কথা। ভ্রন্স্কি তাকে নাচতে ডাকবেন বলে অপেক্ষা করছিল কিটি, কিন্তু উনি ডাকলেন না, অবাক হয়ে কিটি তাকাল তাঁর দিকে। ভ্রন্স্কি লাল হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি করে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন কিন্তু তার ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরে প্রস্কি নাচ শুরু করতেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গীত। ভ্রন্স্কির মুখ ছিল কিটির একেবারে কাছে, সেদিকে তাকাল কিটি এবং ভালোবাসায় ভরপুর এই যে দৃষ্টিতে সে ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে ছিল ভ্রন্স্কি যার প্রতিদান দেননি, সেটা পরে অনেক দিন, বেদনার্ত লজ্জায় তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছে, কয়েক বছর পরেও।
‘Pardon, pardon! ওয়াজ, ওয়াজ হোক!’ হলের অন্য প্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন কর্সুনস্কি এবং নাচ শুরু করে দিলেন—সামনে যে ললনাকে প্রথম পেলেন তাকে নিয়েই।
তেইশ
ভ্রন্স্কি কয়েক পালা ওয়াজ নাচলেন কিটিকে নিয়ে। এর পর কিটি মায়ের কাছে এসে নস্টনের সাথে কয়েকটা কথা বলতে-না-বলতেই ভ্রন্স্কি এলেন প্রথম কোয়াড্রিলের জন্য। কোয়াড্রিল নাচের সময় উল্লেখযোগ্য কোন কথা হল না, ছেঁড়া ছেঁড়া আলাপ চলল কখনো কর্সুনস্কি দম্পতিকে নিয়ে, যাদেরকে তিনি ভারি মজা করে বলেছিলেন চল্লিশ বছরে মিষ্টি শিশু, কখনো ভবিষ্যৎ সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে; শুধু একবার আলাপটা কিটিকে খুব বিচলিত করেছিল যখন লেভিনের কথা জিজ্ঞেস করেন ভ্রন্স্কি, এখানে সে আছে কিনা এবং যোগ দেন যে লোকটিকে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু কোয়াড্রিল নাচ থেকে কিটির বেশি কিছু প্রত্যাশা ছিল না। দুরুদুরু বুকে সে অপেক্ষা করছিল মাজুরকা নাচের। তার মনে হয়েছিল মাজুরকাতেই সব সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। কোয়াড্রিল নাচের সময় উনি যে মাজুরকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন না, তাতে কোন দুশ্চিন্তা হয়নি তার। আগেকার বলনাচগুলোর মত সে যে ওঁর সাথেই মাজুরকা নাচবে তাকে কোন সন্দেহ ছিল না কিটির, নাচছে বলে পাঁচজনের মাজুরকা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল সে। শেষ কোয়াড্রিল পর্যন্ত কিটির কাছে গোটা আসরটা ছিল আনন্দঘন বর্ণ, ধ্বনি আর গতির এক ঐন্দ্রজালিক স্বপ্ন। যখন বড় বেশি সে ক্লান্ত বোধ করে বিশ্রাম চায়, তখনই কেবল সে নাচেনি। কিন্তু নীরস যে তরুণটিকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না, তার সাথে শেষ কোয়াড্রিল নাচের সময় সে পড়ে গেল ভ্রন্স্কি আর আন্নার মুখোমুখি। একেবারে সেই আসার পর থেকে সে আন্নার কাছাকাছি আর থাকেনি, এখন হঠাৎ তাঁকে দেখল আবার একটা নতুন, অপ্রত্যাশিত রূপে। সাফল্যজনিত উত্তেজনার যে চেহারাটা তার নিজের কাছেই অতি পরিচিত, সেটা সে দেখল আন্নার মধ্যে। যে উল্লাস তিনি সঞ্চার করেছেন তার মদিরায় আন্না মাতাল। এই অনুভূতিটা কিটির জানা, চেনে সে তার লক্ষণগুলোকে, তা সে দেখতে পেল আন্নার মধ্যে, দেখল চোখে ঝলকে ওঠা কাঁপা কাঁপা ছটা, সুখ আর উত্তেজনার হাসিতে আপনা থেকে বেঁকে যাওয়া ঠোঁট, গতির সুপ্রকট সৌষ্ঠব, যথার্থ আর লঘুতা।
সে মনে মনে ভাবল, ‘কে সে? সবাই, নাকি একজন?’ যে বেচারী ছোকরার সাথে সে নাচছিল কথোপকথনের খেই হারিয়ে ফেলে সে আর তা খুঁজে পাচ্ছিল না। কর্মুনস্কি সবাইকে কখনো বৃহৎ বৃত্ত’, কখনো-বা ‘শেকল’ নাচাচ্ছিল, বাহ্যত তাঁর ফুর্তিবাজ উচ্চকণ্ঠ আদেশ মেনে চলছিল কিটি। কথাবার্তায় ছোকরাকে কোন সাহায্য না করে কিটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ক্রমেই হিম হয়ে আসছিল তার বুক। ‘না, জনতার উচ্ছ্বাসে আন্না মাতাল হননি, এ শুধু একজনের প্রশংসা। এই কি সেই একজন? ভ্রন্স্কিই কি?’ প্রতি বার আন্নার সাথে তিনি যখন কথা বলছিলেন, আন্নার চোখে ঝলক দিচ্ছিল আনন্দের ছটা, সুখের হাসিতে বেঁকে যাচ্ছিল তাঁর রক্তিম ঠোঁট। আনন্দের এই লক্ষণগুলো যেন জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন তিনি, কিন্তু আপনা থেকেই তা ফুটে উঠছিল তাঁর মুখে। ‘কিন্তু ভ্রন্স্কি?’ ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে ভয় পেল কিটি। আন্নার মুখের মুকুরে যা পরিষ্কার ধরতে পেরেছিল কিটি, তা সে দেখল ভ্রন্স্কির মধ্যেও। কোথায় গেল তাঁর বরাবরকার ধীর-স্থির ভঙ্গি, নিশ্চিন্ত প্রশান্ত মুখভাব? না, এখন উনি আন্নার সাথে কথা বলার সময় প্রতিবার সামান্য মাথা নোয়াচ্ছেন, যেন লুটিয়ে পড়তে চান আন্নার সামনে, তাঁর দৃষ্টিতে শুধুই বশ্যতা আর শংকার ছাপ। ‘আমি অপমান করতে চাই না’, প্রতিবার তাঁর দৃষ্টি যেন বলছিল। ‘নিজেকে আমি বাঁচাতে চাই, কিন্তু জানি না কেমন করে।’ মুখে তাঁর এমন একটা ভাব যা আগে সে কখনো দেখেনি।
দুজনের সাধারণ পরিচিতদের নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা, একান্ত অকিঞ্চিৎকর আলাপ, কিন্তু কিটির মনে হল তাঁদের প্রতিটা কথাতেই তাঁদের ও কিটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। এবং এটা আশ্চর্য যে সত্যিই তাঁরা বলাবলি করছিলেন ইভান ইভানোভিচের ফরাসি বুকনি কি হাস্যকর এবং এলেৎস্কায়ার জন্য আরো ভালো বর জোটানো যেত, অথচ এসব কথাই তাৎপর্যময় হয়ে উঠছে তাঁদের কাছে আর কিটির মত তাঁরাও সেটা টের পাচ্ছেন। এখন বলনাচের গোটা আসর, সমস্ত উঁচু সমাজ, সবই কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল কিটির অন্তরে, শুধু শীলতার যে কঠোর বিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে সে গেছে, সেটাই ধরে রাখছিল তাকে, বাধ্য করছিল তার কাছে যা প্রত্যাশা সেটা করতে, যথা, নাচা, প্রশ্নের জবাব দেওয়া, এমন কি হাসাও। কিন্তু ঠিক মাজুরকা শুরুর আগে যখন চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখা হল, কিছু কিছু জুটি সরে গেল ছোটটা থেকে বড় হলঘরে, হতাশা আর আতংকের মুহূর্ত এল কিটির সামনে। পাঁচজনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে কিটি এবং এখন সে আর, কেননা উঁচু সমাজে তার সাফল্য খুবই বেশি, এখনো পর্যন্ত সে আমন্ত্ৰণ পায়নি, এমন কথা ভাবতেই পারেনি কেউ। সে অসুস্থ, মাকে এই কথা বলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত ছিল তার, কিন্তু সেটুকু ক্ষমতাও তার ছিল না। একেবারে বিধ্বস্ত বলে তার মনে হচ্ছিল নিজেকে।
ছোট ড্রয়িং-রুমটার নিভৃতে গিয়ে সে বসে পড়ল একটা ইজি-চেয়ারে। তার তন্বী দেহ ঘিরে মেঘের মত ভেসে উঠল পোশাকের হাওয়াই স্কার্ট; বালিকার মত শীর্ণ, কমনীয়, অনাবৃত, শক্তিহীন একটা বাহু ডুবে গেল গোলাপি পোশাকের ভাঁজের মধ্যে; অন্য হাতটায় পাখা নিয়ে ছোট ছোট ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে হাওয়া করতে লাগল তার আতপ্ত মুখমণ্ডলে। কিন্তু সবে ঘাসের ওপর গিয়ে বসেছে, এখনই রংধনু ডানা মেলে ফরফর করে উঠবে এমন এক প্রজাপতির মত দেখালেও ভয়ংকর এক হতাশায় ভেঙে যাচ্ছিল তার বুক।
‘আর হয়ত ভুল হয়েছে আমার, অমন কিছু ঘটেনি?’
যা দেখেছে সেটা আবার মনে মনে স্মরণ করতে চাইল সে।
‘কিটি, এ আবার কি? গালিচার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে তার কাছে এসে বললেন কাউন্টেস নক্স্টন, ‘এ আমি বুঝতে পারছি না।’
কিটির নিচের ঠোঁট কেঁপে উঠল, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল সে।
‘কিটি, মাজুরকা নাচ্ছ না তুমি?’
‘না’, অশ্রুতে কম্পমান কণ্ঠে কিটি বলল।
‘আমার সামনেই ওকে সে মাজুরকা নাচে ডাকল’, নষ্টন বললেন, ‘কে ‘ও’ আর কে ‘সে’, এটা কিটি বুঝবে বলে তাঁর জানাই ছিল। ‘ও বলল : কেন, প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার সাথে নাচবেন না আপনি?’
কিটি বলল, ‘আহ্, ওতে আমার কিছু এসে যায় না!
কিটি নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝছিল না তার অবস্থা, কেউ জানত না যে এই সেদিন সে একজনকে প্রত্যাখ্যান করেছে যাকে হয়ত সে ভালোই বাসতো এবং প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ বিশ্বাস করছিল অন্য একজনকে।
কর্সুনস্কিকে পাকড়াও করে তাঁর সাথে মাজুরকা নেচে কাউন্টেস নস্টন তাঁকে বললেন তিনি যেন কিটিকে নাচে ডাকেন।
কিটি নাচল প্রথম জুটিতে। সৌভাগ্যবশত কথা বলার প্রয়োজন তার ছিল না, কেননা, কর্মুনস্কি অনবরত ছোটাছুটি করে তাঁর কর্তৃত্ব ঠিক রাখছিলেন। ভ্রন্স্কি আর আন্না বসেছিলেন একেবারে প্রায় তার সামনেই। তাঁদের সে দেখেছিল তার দূরের দৃষ্টিতে, দেখেছিল কাছ থেকেও যখন জুটিতে জুটিতে তাঁরা মুখোমুখি হন, আর যত বেশি দেখল ততই সে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠল যে তার দুর্ভাগ্য ঘটে গেছে, সে দেখল যে জনাকীর্ণ এই হলে নিজেদের একলা করে নিয়েছেন তাঁরা। ভ্রন্স্কির যে মুখভাবে সব সময়ই থাকত অমন একটা দৃঢ়তা আর স্বাধীনতার ছাপ, সেখানে কিটিকে বিমূঢ় করে দেখা দিয়েছে কেমন একটা অসহায়তা আর বশ্যতা, দোষ করলে বুদ্ধিমান কুকুরের মুখে যা ফুটে ওঠে।
আন্না হাসছিলেন, সে হাসি সঞ্চারিত হচ্ছিল তাঁর মধ্যেও। কিছু-একটা ভাবনা পেয়ে বসছিল আন্নাকে, অস্কিও হয়ে উঠছিলেন গুরুগম্ভীর। কি-একটা অপ্রাকৃত শক্তি কিটির চোখ টেনে ধরছিল আন্নার মুখে দিকে। নিজের সাধারণ কালো পোশাকে আন্না অপরূপ, অপরূপ তাঁর ব্রেসলেট-শোভিত পুরুষ্টু হাত, অপরূপ তাঁর মুক্তার মালা পরা দৃঢ় গ্রীবা, অপরূপ তাঁর কবরী এলোমেলো করা কুঞ্চিত কেশদাম, অপরূপ তাঁর ছোট ছোট পা আর হাতে ললিত লঘু গতি, সজীবতায় সুন্দর তাঁর মুখখানা অপরূপ; কিন্তু এই অপরূপতার মধ্যে ভয়াবহ, নিষ্ঠুর কিছু-একটাও যেন ছিল।
আগের চেয়েও কিটি মুগ্ধ হল তাঁর রূপে, আর ক্রমে কষ্ট পেতে লাগল বেশি করে। নিজেকে দলিত মনে হল তার, সেটা ফুটে উঠল তার মুখভাবে। মাজুরকা নাচে মুখোমুখি হয়ে ভ্রন্স্কি যখন তাকে দেখতে পান, চট করে চিনে উঠতে পারেননি—এতই বদলে গিয়েছিল কিটি!
‘চমৎকার নাচের আসর’, ভ্রন্স্কি বললেন কিছু-একটা বলতে হয় বলে।
কিটি বলল, ‘হ্যাঁ।’
মাজুরকার মাঝামাঝি কর্সুনস্কি উদ্ভাবিত একটা জটিল নৃত্যভঙ্গিমা অনুসরণ করে আন্না চলে এলেন বৃত্তের মাঝখানে, দুজন নৃত্য-সহচরকে নিয়ে একজন মহিলা আর কিটিকে ডাকলেন নিজের কাছে। যেতে যেতে কিটি ভীত চোখে তাকাল তাঁর দিকে। আন্না চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আর হেসে চাপ দিলেন তার হাতে। কিন্তু কিটি মুখে শুধু একটা হতাশা আর বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে সে হাসির প্রত্যুত্তর দিল দেখে আন্না তার কাছ থেকে সরে অন্য মহিলার সাথে খুশির আলাপ জুড়লেন।
কিটি মনে মনে ভাবলে, ‘হ্যাঁ। বিজাতীয়, দানবিক আর সুমধুর কি-একটা আছে ওঁর মধ্যে।’ নৈশাহারের জন্য থেকে যাবার ইচ্ছে ছিল না আন্নার, কিন্তু গৃহকর্তা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।
‘হয়েছে, হয়েছে আন্না আর্কাদিয়েভনা’, আন্নার অনাবৃত একটা হাত বগলদাবা করে কর্সনস্কি বললেন, ‘কতিলিওন নিয়ে চমৎকার একটা আইডিয়া আছে আমার! অপূর্ব!’
তিনি আন্নাকে টেনে আনার চেষ্টা করে খানিকটা এগুলেন। অনুমোদনের হাসি হাসলেন গৃহকর্তা।
‘না, আমি থাকব না’, হেসে আন্না জবাব দিলেন; কিন্তু সে হাসি সত্ত্বেও যেরকম দৃঢ়কণ্ঠে তাঁর জবাবটা হয়েছিল, তাতে গৃহকর্তা আর কর্সুনস্কি দুজনেই বুঝলেন যে আন্না থাকবেন না।
‘না, পিটার্সবুর্গে সারা শীতকালে যত না নেচেছি, মস্কোয় আপনাদের এই একটা আসরেই নাচলাম তার চেয়ে বেশি’, কাছেই দণ্ডায়মান ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে আন্না বললেন, ‘রওনা দেবার আগে খানিকটা বিশ্রাম দরকার।’
ভ্রন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালই চলে যাচ্ছেন নাকি—সত্যি করে?’
আন্না জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তাই ভেবেছি’, যেন প্রশ্নের এই সাহসিকতার বিস্মিত হয়েই; কিন্তু এ কথা বলার সময় চোখের দপদপে অদম্য ঝলক আর হাসিটা পুড়িয়ে দিয়ে গেল ভ্রন্স্কিকে।
আন্না আর্কাদিয়েভনা চলে গেলেন, রাতের খাবারের জন্য রইলেন না।
চব্বিশ
শ্যেরবাৎস্কিদের ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় লেভিন মনে মনে ভাবছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মধ্যে বিছুছিরি, অরুচিকর কিছু-একটা আছে’, ভাইয়ের কাছে তিনি রওনা দিলেন পায়ে হেঁটেই, ‘আমার সাথে অন্য লোকের বনে না। বলে, আমি নাকি অহংকরী। না, আমার অহংকারটুকুও নেই। অহংকার থাকলে নিজেকে অমন অবস্থায় ফেলতাম না আমি।’ ভ্রন্স্কির কথা মনে হল তাঁর—সুখী, সহৃদয়, বুদ্ধিমান, প্রশান্ত সে সন্ধ্যায় তিনি যে ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছিলেন, ভ্রন্স্কি নিশ্চয় কখনো তাকে পড়েননি। ‘হ্যাঁ, কিটির ওঁকেই পছন্দ হওয়া কথা। সেটাই উচিত, কারো ওপর, কিছুর বিরুদ্ধে আমার নালিশ নেই। আমার নিজেরই দোষ। আমার জীবনের সাথে সে তার জীবন মেলাতে চাইবে, এ কথা ভাবার কি অধিকার ছিল আমার? কে আমি? কিই-বা আমি? নগণ্য একটা লোক, আমাকে কারো প্রয়োজন নেই।’ নিকোলাই ভাইয়ের কথা মনে পড়ল তাঁর এবং সানন্দে সেই চিন্তায় ডুবে গেলেন। ‘দুনিয়ার সব কিছুই খারাপ আর জঘন্য ওর এই কথা কি সত্যি নয়? নিকোলাই ভাই সম্পর্কে বড় একটা ন্যায়বিচার আমরা করছি না এবং করিনি। অবশ্য প্রকোফি, যে ওকে দেখেছিল ছেঁড়া কোটে, মাতাল অবস্থায়, তার চোখে ও একটা ঘৃণার্হ লোক। কিন্তু আমি তো তাকে অন্যরকম জানি। আমি ওর প্রাণটা চিনি, জানি যে আমি ওরই মত। আর আমি ওর খোঁজে যাওয়ার বদলে গেলাম ডিনার খেতে, তারপর এলাম এখানে।’ লেভিন একটা লাইট পোস্টের কাছে গিয়ে ভাইয়ের ঠিকানাটা পড়লেন, সেটা ছিল তাঁর মানি-ব্যাগের মধ্যে। তারপর একটা গাড়ি ডেকে নিকোলাই ভাইয়ের জীবনের যেসব ঘটনা তাঁর জানা ছিল তা স্মরণ করতে লাগলেন ভাইয়ের জীবনের যে সব ঘটনা তাঁর জানা ছিল তা স্মরণ করতে লাগলেন ভাইয়ের কাছে যাবার লম্বা রাস্তাটায়। মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার পরের বছরটা বন্ধুবান্ধবদের উপহাস অগ্রাহ্য করে সে দিন কাটিয়েছে সন্ন্যাসীর মত, কঠোরভাবে মেনে চলেছে ধর্মের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম, উপাসনা, উপবাস, পরিহার করেছে সমস্ত ভোগসুখ, বিশেষ করে রমণীদের; তারপর হঠাৎ তার ধৈর্য টুটল, গিয়ে পড়ল অতি ইতর সব লোকেদের সাহচর্যে, শুরু করল অতি বল্গাহীন বেলেল্লাপনা। সেই ছেলেটির কথা স্মরণ হল তাঁর, লালনপালন করবে বলে যাকে সে এনেছিল গ্রাম থেকে আর রাগের মাথায় এমন তাকে পিটিয়েছিল যে অঙ্গহানির দায়ে ব্যাপারটা গড়ায় আদালতে। তারপর মনে পড়ল ঠগ খেলোয়াড়টার ঘটনা, যার কাছে সে তাসে হারে, একটা হুন্ডিও লিখে দেয়, তারপর নিজেই তার বিরুদ্ধে এই বলে নালিশ করে যে লোকটা তাকে ঠকিয়েছে। (সের্গেই ইভানিচ যা শোধ দেন, এটা সেই টাকা।) মনে পড়ল, হৈ-হাঙ্গামার জন্য তার এক রাত্রি হাজত বাসের কথা। ভাই কনিশেভ নাকি তার মায়ের সম্পত্তির অংশ দেননি, এই বলে তাঁর বিরুদ্ধে লজ্জাকর মোকদ্দমার কথাটাও মনে এল। আর শেষ ঘটনাটা হল সে যখন পশ্চিম প্রদেশে চাকরিতে যায়, ‘সেখানে গ্রাম মাতব্বরকে মারপিট করার জন্য সোপর্দ হয় আদালতে। এ সবই ভয়ানক জঘন্য, কিন্তু নিকোলাই লেভিনকে যারা জানত না, জানত না তার ইতিহাস, তার অন্তঃকরণ, তাদের কাছে যতটা জঘন্য লাগার কথা, লেভিনের কাছে মোটেই সেরকম মনে হল না।
লেভিনের মনে পড়ল, নিকোলাই যখন ছিল ধার্মিকতা, উপবাস, সাধুসন্ন্যাসী, গির্জায় উপাসনার পর্বে, যখন সে সাহায্য, তার উদ্দাম স্বভাবকে বেঁধে রাখার বল্লা খুঁজছিল ধর্মে, তখন কেউ তাকে সমর্থন তো করেইনি, বরং সবাই, সে নিজেও হাসাহাসি করেছে তাকে নিয়ে। লোকে টিটকারি দিয়েছে তাকে, বলেছে ‘নোয়া’, সন্ন্যাসী, আর যখন তার বাঁধন ছিঁড়ল, কেউ তাকে সাহায্য করেনি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আতঙ্কে, ঘৃণায়।
লেভিন অনুভব করছিলেন যে জীবনের সব কিছু কদর্যতা সত্ত্বেও নিকোলাই ভাই মনেপ্রাণে, তার অন্তরের গভীরে তাদের চেয়ে বেশি অসৎ নয় যারা তাকে ঘৃণা করে। ও যে একটা উদ্দাম চরিত্র আর কিসে যেন বিড়ম্বিত মানসিকতা নিয়ে জন্মেছে সেটা তো তার দোষ নয়। তবু সব সময় ও ভালো হতে চেয়েছে। ‘সব কিছু বলব তাকে, সব কিছু বলতে বাধ্য করব ওকে, দেখাব যে আমি ওকে ভালোবাসি, তাই ওকে বুঝি’, রাত এগারোটায় ঠিকানায় লেখা হোটেলটার দিকে যেতে যেতে লেভিন এই স্থির করলেন মনে মনে।
লেভিনের জিজ্ঞাসার জবাবে খানসামা বলল, ‘ওপরে, বারো আর তেরো নম্বর কামরা।’
‘ঘরে আছে?’
‘থাকার কথা।’
বারো নম্বরের দরজা আধ-খোলা, সেখান থেকে এক ফালি আলোর মধ্যে আসছিল কদর্য আর দুর্বল তামাকের ধোঁয়া, শোনা যাচ্ছিল লেভিনের কাছে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর; কিন্তু তখনই লেভিন টের পেলেন যে ভাই এখানেই; তার কাশি শোনা গেল।
যখন তিনি দরজায় ঢুকলেন, অপরিচিত কণ্ঠস্বর বলছিল : ‘কতটা বিচক্ষণতা আর সচেতনতার সাথে ব্যাপারটা চালানো হবে তার ওপরেই সব নির্ভর করছে।’
ঘরে উঁকি দিলেন কনস্তান্তিন লেভিন, দেখলেন কথা বলছেন একটা যুবক, একমাথা তাঁর চুল, গায়ে সাবেকী ধাঁচের রুশী কোট। একটা মেয়ে বসে আছে সোফায়, মুখে বসন্তের দাগ, উলের পোশাকটায় কফ নেই, কলারও সাদামাটা। ভাইকে দেখা যাচ্ছিল না। কনস্তান্তিনের বুক টনটন করে উঠল এই ভেবে যে, ভাই তার দিন কাটাচ্ছে কি- সব অনাত্মীয় লোকদের মাঝে। কেউ কনস্তান্তিনের আসার শব্দ শুনতে পায়নি, তিনিও তাঁর ওভার-স্যু খুলতে খুলতে শুনতে লাগলেন রুশী কোট পরা ভদ্রলোকটি কি বলছেন। কথা হচ্ছিল কি-একটা উদ্যোগ নিয়ে।
‘চুলোয় যাক এসব সুবিধাভোগী শ্রেণী’, কাশির মধ্যে শোনা গেল ভাইয়ের গলা, ‘মাশা, রাতের খাবার কিছু জোগাড় কর তো আমাদের জন্য। আর মদ দাও যদি থেকে থাকে, নইলে লোক পাঠাও।’
মেয়েটা উঠে পার্টিশনের ওপাশে যেতেই দেখতে পেল কনস্তান্তিনকে।
বলল, ‘কে একজন ভদ্রলোক, নিকোলাই দমিত্রিচ।’
নিকোলাই লেভিনের রাগত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কাকে চাই?’
আলোয় এসে কনস্তান্তিন লেভিন বললেন, ‘আমি এসেছি!’
‘আমি-টা কে?’ আরো রাগত শোনাল নিকোলাইয়ের গলা। শব্দ শুনে বোঝা গেল কিছু-একটাতে ধাক্কা খেয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে সে, দরজায় লেভিন দেখলেন অতি পরিচিত তবু বন্যতায় আর রুগ্নতায় স্তম্ভিত করার মত তাঁর ভাইয়ের বিশাল, শীর্ণ, কুজো হয়ে আসা মূর্তি, বড় বড় চোখে ভীতি 1
তিন বছর আগে কনস্তান্তিন লেভিন যখন তাকে শেষ বার দেখেন, তার চেয়েও এখন সে রোগা। গায়ে একটা খাটো জ্যাকেট। হাত আর চওড়া হাড়গুলো মনে হচ্ছিল আরো বিরাট। চুল পাতলা হয়ে এসেছে, সেই একই সোজা মোচ ঝুলে পড়েছে ঠোঁটের ওপর, সেই একই চোখ বিচিত্র আর সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগন্তুকের দিকে।
‘আরে কস্তিয়া যে’, ভাইকে চিনতে পেরে হঠাৎ বলে উঠল সে, চোখ তার জ্বলজ্বল করে উঠল আনন্দে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সে তাকাল যুবকটির দিকে এবং মাথা আর ঘাড়ের এমন একটা ঝটকা-মারা ভঙ্গি করল যেন টাই এঁটে বসেছে, ভঙ্গিটা কনস্তান্তিনের অতি পরিচিত; একেবারেই অন্য একটা রুক্ষ, আর্ত, নিষ্ঠুর ভাব ফুটে রইল তার রোগাটে মুখে।
‘আপনাকে আর সের্গেই ইভানিচকে, দুজনকেই লিখেছিলাম যে আপনাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রাখতেও চাই না। কি তোমার, কি আপনার দরকার পড়ল?’
কনস্তান্তিন যা কল্পনা করেছিলেন, সে মানুষ ভাই একেবারেই নয়। তার কথা ভাবার সময় তার চরিত্রের সবচেয়ে কষ্টকর আর খারাপ দিক, যার জন্য তার সাথে কথা বলা এত কঠিন হয়ে ওঠে, কনস্তান্তিন তা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন তার মুখ, বিশেষ করে এই ঝটকা-মারা মাথা ফেরানো দেখে সে সবই মনে পড়ে গেল তাঁর।
ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘কোন দরকারে আসিনি। শুধু তোমাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল।’
ভাইয়ের ভয় দেখে স্পষ্টতই নরম হয়ে এল নিকোলাই। ঠোঁট কেঁপে উঠল তার। বলল, ‘ওঃ, এমনি এসেছ? ভেতর এস, বস। রাতের খাবার খেয়ে যাবে? মাথা, তিন প্লেট খাবার এনো। আচ্ছা থাক, দাঁড়াও। জান, ইনি কে?’ রুশ কোট পরা ভদ্রলোককে দেখিয়ে সে বলল ভাইকে, ‘ইনি ক্রিৎস্কি, কিয়েভে থাকতেই আমার বন্ধু। অতি অসামান্য লোক। বলাই বাহুল্য, পুলিশ ওঁর পেছনে লেগেছে, কেননা উনি বদমাশ নন।’
এবং নিজের অভ্যাসমত ঘরের সব লোকদের দিকে তাকাল সে। দরজার কাছে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে যাবার উপক্রম করছে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি যে বললাম, দাঁড়াও।’ তারপর কনস্তান্তিনের যা ভালোই জানা, কথাবার্তা চালাবার সেই অক্ষমতা, সেই আনাড়ীপনায় সবার দিকে আরেক বার তাকিয়ে ভাইকে বলতে লাগল ক্রিৎস্কির কাহিনী : দরিদ্র ছাত্রদের জন্য সাহায্য সমিতি আর রবিবারের স্কুল চালাবার জন্য কেমন করে তিনি বিতাড়িত হন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে, তারপর তিনি হন গ্রাম্য স্কুলের একজন মাস্টার, অবশেষে কি কারণে যেন সোপর্দ হন আদালতে।
‘আপনি কিয়েভ ইউনিভার্সিটির ছাত্র?’ একটা অস্বস্তিকর নীরবতা দেখা দেওয়ায় সেটা দূর করার জন্য ক্রিৎস্কিকে জিজ্ঞেস করলেন কনস্তান্তিন লেভিন।
‘হ্যাঁ, ছিলাম কিয়েভে’, ভুরু কুঁচকে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন ক্রিৎস্কি।
ভাইকে বাধা দিয়ে মেয়েটাকে দেখিয়ে নিকোলাই লেভিন বলল, ‘আর এই মেয়েটা আমার জীবনসঙ্গিনী, মারিয়া নিকোলায়েভনা। আমি ওকে এনেছি গণিকালয় থেকে’, এ কথা বলার সময় সে ঘাড় ঝাঁকাল, ‘কিন্তু ওকে ভালোবাসি, মান্য করি, আর আমার বন্ধুত্ব যারা চায়’, গলা চড়িয়ে ভুরু কুঁচকে সে যোগ করল, ‘তাদের সবার কাছে অনুরোধ করি ওকে ভালোবাসতে, মান্য করতে। যাই হোক না কেন, ও আমার স্ত্রী, যে যাই বলুক। তাহলে এবার জানলে তো কাদের নিয়ে ব্যাপার। আর যদি তোমার মনে হয় যে হেয় হয়ে যাচ্ছ, তাহলে পথ দেখো, দরজা খোলা।’
আবার চোখ তার সপ্রশ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে নিল সবার মুখে।
‘কেন হেয় হয়ে যাব, বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে মাথা, তিনজনের খাবার আনতে বল, ভোদ্কা আর সুরা… না, না, না, দাঁড়াও… আচ্ছা দরকার নেই… যাও।’