বইয়ের নামঃ আন্না কারেনিনা
- লেখকের নামঃ লিও তলস্তয়
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
আন্না কারেনিনা – প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা – ১.১
প্রতিহিংসা আমার; আমিই তাহা শুধিব, বলিলেন সৃষ্টিকর্তা।
এক
সকল সুখী পরিবারের সুখের অনুভূতিগুলো একে অন্যের মত; প্রতিটা অ-সুখী পরিবারের অ-সুখের কারণগুলো নিজের নিজের ধরনে।
অবলোনস্কির পরিবারের সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী জানতে পারলেন যে, বাড়ির পুরানো ফরাসি গৃহশিক্ষিকার সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। স্বামীকে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, তার সাথে এক বাড়িতে বাস করতে আর পারবেন না। গত তিন দিন ধরে এরকম অবস্থা চলছে। খোদ দম্পতি এবং পরিবারের অন্যান্য লোক আর চাকর-বাকরদের কাছেও তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সকল সদস্য এবং চাকর-বাকররা বুঝতে পারছিল যে, আর একসাথে থাকার কোন অর্থ হয় না। সরাইখানায় অকস্মাৎ মিলিত লোকদের মধ্যেও তাদের চেয়ে, অবলোনস্কি পরিবারের লোক আর চাকর-বাকরদের চেয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক বেশি থাকে। স্ত্রী নিজের ঘর থেকে আর বেরোচ্ছেন না। স্বামী আজ তিন দিন বাড়িতে নেই। ছেলেমেয়েরা আশ্রয়হীনের মত সারা বাড়ি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে; ইংরেজ মহিলাটি ঝগড়া বাঁধালেন ভাণ্ডারিনীর সাথে এবং অন্য কোন জায়গায় কাজ খুঁজে দেবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিরকুট পাঠালেন বান্ধবীর কাছে। বাবুর্চি গতকালই দিবাহারের সময় বাড়ি ছেড়ে গেছে। রান্নাঘরের– পরিচারিকা আর কোচোয়ানও কাজ ছেড়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি সমাজে যাঁকে বন্ধু-বান্ধবরা ‘স্তিভা’ বলে ডাকে–ঝগড়া-বিবাদের পর তৃতীয় দিনে–যথাসময়ে অর্থাৎ সকাল আটটায় তার ঘুম ভাঙল স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, নিজের কাজের ঘরে, মরক্কো চামড়ায় মোড়া একটা সোফায়। সোফার গদিতে পুরুষ্টু অসার দেহটা ঘুরিয়ে অন্য দিক থেকে সজোরে বালিশ আলিঙ্গন করে গাল ঠেকালেন তাতে; তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন, সোফায় বসে চোখ মেলে তাকালেন।
স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ায় ভাবলেন, তাই তো, তাই তো, কি যেন হয়েছিল? হা, কি হয়েছিল? হ্যাঁ, আলাবিন একটা ভোজের আয়োজন করেছিল ডার্মস্টাটে, কিংবা হয়ত আমেরিকান কিছু। হ্যাঁ, ওই ডার্মস্টাক্ট ছিল আমেরিকায়। হু, আলাবিন ভোজ দিচ্ছিল কাঁচের টেবিলে। আর টেবিলগুলো ইতালীয় ভাষায় গান গাইছিল : আমার গুপ্তধন, আরে না, আমার গুপ্তধন নয়, তার চেয়েও ভালো, আর ছোট ছোট কেমন সব পানপাত্র, আর তারা সব নারী, তার মনে পড়ল।
অবলোনস্কির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল এবং হাসিমুখে তিনি বিভোর হয়ে রইলেন। ‘হ্যাঁ, ভীষণ জমেছিল। বেশ ভালো। আরো কত কি যে ছিল চমৎকার, কথায় তা বলা যায় না, জাগা অবস্থায় চিন্তাতেও তা ফোঁটানো যায় না।’ তারপর শাটিনের পর্দার পাশ দিয়ে এসে পড়া এক ফালি আলো দেখে সোফা থেকে পা বাড়িয়ে খুঁজলেন স্ত্রীর বানানো সোনালি মরক্কোর এম্ব্রয়ডারি করা জুতা (গত বছর জন্মদিনে তার জন্য উপহার) এবং না উঠে ন’বছরের অভ্যাসমত হাত বাড়ালেন যেখানে শয়নকক্ষে টাঙানো থাকত তার ড্রেসিং গাউন। আর তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল– কেন তিনি তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, ঘুমাচ্ছেন নিজের কাজের ঘরে; এবার তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কপাল কুঁচকালেন এবং কি হয়েছিল তা মনে করে ককিয়ে উঠলেন, ‘উহ্, উহ্, উহ্! আহ!’ তার কল্পনায় আবার ভেসে উঠল : স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার সমস্ত খুঁটিনাটি, তাঁর অবস্থার সমস্ত নিরুপায়তা আর সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক তাঁর নিজ অপরাধের কথা।
তিনি ভাবলেন, ‘না, ও ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করতে পারে না। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, সব কিছুর জন্য আমার দোষ, আমার দোষ, কিন্তু আমি তো দোষী নই। আর সেটাই তো ট্রাজেডি। তাঁর পক্ষে এই ঝগড়ার সবচেয়ে কষ্টকর দিকগুলোর কথা ভেবে তিনি বলে উঠলেন, উহ্, উহ্, উহ্!’
সবচেয়ে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটেছিল সেই প্রথম মুহূর্তটা, যখন তিনি হাসি-খুশি হয়ে স্ত্রীর জন্য প্রকাণ্ড একটা নাশপাতি হাতে থিয়েটার থেকে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না ড্রয়িংরুমে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাজের ঘরেও তার দেখা পাওয়া গেল না। শেষে তাকে শোবার ঘরে পেলেন। সব কিছু ফাঁস হয়ে-যাওয়া হতভাগা সেই চিরকুটটা তার হাতে।
সব সময়ই শশব্যস্ত, উদ্বিগ্ন এবং স্বামী যা ভাবতেন, বোকা-সোকা তার ডল্লি চিরকুট হাতে নিস্পন্দ হয়ে বসে। আছেন, এবং আতঙ্ক, হতাশা আর ক্রোধের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। চিরকুটটা দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা? এটা?
আর অবলোনস্কিকে কষ্ট দিচ্ছিল এই স্মৃতিচারণায়। যা প্রায়ই হয়ে থাকে, আসল ঘটনাটা নয়, স্ত্রীর এই প্রশ্নে যেভাবে তিনি জবাব দিয়েছিলেন সেটা।
হঠাৎ করে যদি বড় বেশি লজ্জাকর কিছু-একটায় ধরা পড়ে যাওয়া লোকের ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে সে মুহূর্তে তার তাই ঘটেছিল। অপরাধ ফাঁস হয়ে যাবার পর স্ত্রীর সামনে যে অবস্থায় তিনি পড়েছিলেন, তার জন্য নিজেকে তৈরি করে তুলতে তিনি পারলেন না। অপমানিত বোধ করা, অস্বীকার করা, কৈফিয়ত দেওয়া, মার্জনা চাওয়া, এমন কি নির্বিকার থাকার বদলে তিনি যা করলেন তার তুলনায় এ সবই হত ভালো!–তাঁর মুখে একেবারে অনিচ্ছাকৃতভাবে (‘মস্তিষ্কের প্রতিবর্তী ক্রিয়া’, ভাবলেন অবলোনস্কি, যিনি শারীরবৃত্ত ভালোবাসতেন)–একেবারে অনিচ্ছায় হঠাৎ ফুটল তাঁর অভ্যস্ত, সদাশয় এবং সেই কারণেই বোকাটে হাসি।