শুধুমাত্র ভূগোল বা সময় ছাড়াও বুদ্ধ আর মহাবীরের মধ্যে আরো বেশকিছু মিল আছে। তিনিও একজন রাজকুমার ছিলেন। তিনিও দুঃখের সমস্যা, এর কারণ আর প্রতিকার নিয়ে ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলেন। অনন্ত জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা লাভের আশায় তিনিও তার স্বচ্ছল বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত জীবন ত্যাগ করেছিলেন। এবং তিনি বুদ্ধের সাথে একমত হয়েছিলেন যে, তৃষ্ণাই (কামনা/আসক্তি) হচ্ছে সব দুঃখের কারণ। মানুষ অসুখী কারণ, তাদের যা নেই, তারা সেই জিনিসই কামনা করে। কিন্তু যখনই তারা যা তারা কামনা করেছিল সেটি পায়, আবার তারা অন্য কোনোকিছু কামনা করতে শুরু করে। সেকারণে তৃষ্ণাই হচ্ছে সব দুঃখের কারণ, এই তৃষ্ণা নির্বাপন করার মধ্যেই আছে আমাদের পরিত্রাণ। এবং যেভাবে তিনি এই তৃষ্ণা নির্বাপন করার পথ বেছে নিয়েছিলেন সেটি ইঙ্গিত করে মহাবীর আসলে ঠিক কতটা বৈপ্লবিক একটি চরিত্র ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অশুভ সব কাজকে এড়িয়ে চলা এবং ভালো কাজ করার মাধ্যমেই জন্ম-জন্মান্তরের সামসারার চক্র থেকে মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। বুদ্ধের মতোই, তিনিও তালিকা বানাতে ভালোবাসতেন। তিনি তার প্রক্রিয়াটিকে পাঁচটি নির্দেশনায় সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা কিংবা ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা। চুরি না করা। মিথ্যাচার না করা। অপবিত্র কিংবা বিশৃঙ্খল জীবন না কাটানো। এবং কোনোকিছুতে আসক্তি বা কামনা না করা। এই পঞ্চব্রতগুলো হচ্ছে : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এই নির্দেশগুলোর মধ্যে নতুন কিছুই নেই। বিশ্বাসের অন্য অনেক পদ্ধতিই একই ধরনের তালিকা তাদের অনুসারীদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে এর আগে। কিন্তু জৈনধর্মকে যা স্বতন্ত্র করেছে, সেটি হচ্ছে মহাবীরের প্রথম নির্দেশনাটির ওপর এটি যে-পরিমাণ গুরুত্ব দিয়েছে, কোনো জীবকে হত্যা বা জীবের ক্ষতি না করা। অহিংসা, তার শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটিকে তিনি বিশ্বজনীন এবং চূড়ান্ত একটি আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যারা মোক্ষলাভ করতে চাইছেন, তারা শুধুমাত্র চরম অহিংসার মাধ্যমে কার্মাকে পরিবর্তন করতে পারবেন, যা তাদেরকে পুনর্জন্মের চক্রের সাথে বেঁধে রেখেছে।
জৈন সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীরা অবশ্যই কোনোকিছুকে কষ্ট দিতে অথবা হত্যা করতে পারবেন না! খাদ্য হিসাবে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা তাদের জন্যে। নিষিদ্ধ। তারা শিকার কিংবা মাছ ধরতে পারবেন না। এমনকি তারা মশাও মারতে পারবেন না, যখন কিনা সেটি তাদের মুখের উপর বসে রক্ত শুষে নেয়, কিংবা মৌমাছি, যদি সেটি তাদের ঘাড়ে হুল ফুটিয়ে দেয়। যদি তারা কোনো একটি মাকড়শা বা অবাঞ্ছিত কীট তাদের বাড়িতে খুঁজে পান, তারা তাদের হত্যা করতে পারবেন না। যদি তারা সেটি সেখানে না চান, তাহলে খুব সতর্কতার সাথে সেটি ধরতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যেন এই প্রক্রিয়ায় সেগুলো আহত না হয়, এবং সম্মানের সাথে তাদের বাইরের পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। এবং যেহেতু মাটিতে তারা হাঁটেন, যেখানে বহু ক্ষুদ্র জীবন্ত প্রাণীদের বাস, তাদের খুব সতর্কভাবে হাঁটতে হবে, যেন তারা কোনো প্রাণীরই ক্ষতি না করেন। তাদের পায়ের চাপে যেন কোনো জীবন পিষ্ট না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে জৈন সন্ন্যাসীরা নরম পালকের ঝাড়ু ব্যবহার করেন, এবং তারা হাঁটার সময় আগে খুব সতর্কভাবে ঝাড়ু দিয়ে নেন, সেখানে পা রাখার আগে। কেউ কেউ এমনকি মুখোশ পরেন, কোনো প্রাণী যেন ভুল করে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে না পারে। তারা যেন কোনো জীবের ক্ষতি না করেন। সবধরনের জীবনের প্রতি তাদের এই বিশেষ শ্রদ্ধা, এমনি কন্দমূলের জন্যে প্রযোজ্য। মাটির নিচের সবজি টেনে উঠানো যেমন যাবে না, তেমনি সেভাবে সংগৃহীত খাদ্যও খাওয়া যাবে না, তাদেরও জীবন আছে, যে জীবন মানুষের জীবনের মতোই মূল্যবান।
বেশ, যদি তারা মাংস, মাছ অথবা সবজি না খান, তাহলে জৈনরা কী খেয়ে বেঁচে আছেন? তাদের কেউ কেউ আসলেই বেঁচে না-থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সাল্লেখানা বা সন্ত্রা বা উপোস করার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া সর্বোচ্চ জৈন আদর্শ। এটি আত্মা থেকে সব আসক্তির নির্বাপণ এবং কার্মা থেকে চূড়ান্ত মুক্তি চিহ্নিত করে। কিন্তু আপনি কয়েক মুহূর্ত ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে, এধরনের আত্মহত্যার একটি বিশ্বজনীন আচার হবার সম্ভাবনা নেই, এমনকি জৈন অনুসারীদের মধ্যেও। প্রতিটি ধর্মেই ধর্মীয় আচার অনুসরণ করার তীব্রতায় নানাধরনের স্তর আছে, অতিউৎসাহীদের তীব্র উগ্রতা থেকে শুরু করে কদাচিৎ আচার-অনুসরণকারী স্বল্পমাত্রার উৎসাহীরা। জৈনবাদ, যদিও ইতিহাসে খুবই তীব্র ধর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম, তবে এর অনুসারীদের মধ্যেও এই তীব্রতার নানামাত্রা আমরা দেখতে পাই। অধিকাংশই উপোস করে আত্মহত্যা করেন না। কিন্তু তারা যা করেন সেটি যথেষ্ট পরিমাণেই চরম পর্যায়ের। তারা শুধু ফল খান, সেই ফল, যা মাটিতে পড়ে। জৈনরা বৈপ্লবিকমাত্রায় ফলাহারী। বাতাসের কারণে মাটিতে পড়া ফল খাওয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখেন অন্য কোনোধরনের জীবনের ক্ষতি না করে।