আপনি যদি ভাষার নতুনত্ব আর রুপক যথেষ্ট পরিমান দূরে নিতে পারেন, আপনিও নতুনভাবে দেখার একটি উপায় খুঁজে পাবেন। এবং এই নতুনভাবে দেখা, যা আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এর নিজের অধিকারেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখতে পারে। আইনস্টাইন নিজে সাধারণ মাপের জনপ্রিয়কারী ছিলেন না। এবং আমি প্রায়ই সন্দেহ করেছি তার উজ্জল রুপকের ব্যবহার আমাদের বাকী সবাইকে বুঝতে সাহায্য করার চেয়ে বেশী কিছু করেছিল। সেগুলো কি তার সৃজনশীল প্রতিভাকেও চালিত করেনি?
তিরিশের দশকে আর. এ. ফিশার (১) ও নব্য-ডারউইনবাদের অন্যান্য অগ্রদূতদের লেখার মধ্যে ডারউইনবাদের জিন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত আমরা পাই। কিন্তু ষাটের দশকে ডাবলিউ ডি. হ্যামিলটন (২) এবং জি. সি. উইলিয়ামস (৩) তাদের লেখায় এটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন। আমার জন্য তাদের অন্তর্দৃষ্টি একটি ভবিষ্যৎসূচক গুণাবলী বহন করে। কিন্তু তাদের অভিব্যক্তিকে আমার অনেক বেশী সংক্ষিপ্ত, স্বল্পভাষী মনে হয়েছে, যা যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করা হয়নি। আমি স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছিলাম যে, তাদের প্রস্তাবনাগুলোর একটি বিস্তারিত আর বিকশিত সংস্করণ জীবনের ইতিহাস ব্যাখ্যায় সর্বক্ষেত্রেই কার্যকরী হতে পারে, হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে উভয় ক্ষেত্রেই। বিবর্তনের জিনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটির ব্যাখ্যা ও সমর্থনে আমি একটি বই লিখবো। এটি মূলত নজর ঘনীভূত করবে সামাজিক আচরণের উদাহরণের উপর, যার উদ্দেশ্য হবে জনপ্রিয় ডারউইনবাদিতায় সর্বব্যাপী অবচেতনে গ্রুপ সিলেকশনবাদের (গ্রুপ-নির্বাচন) ভ্রান্ত ধারণাটি সংশোধন করা। আমি বইটি শুরু করেছিলাম ১৯৭২ সালে যখন শিল্প কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের জন্যে দৈনন্দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমার ল্যবরেটরী নির্ভর গবেষণা ব্যহত করেছিল। দুঃখজনকভাবে (একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটেছিল শুধুমাত্র দুটি অধ্যায় লেখার পরপরই। আমি পুরো প্রজেক্টটি, ১৯৭৫ সালে যখন দীর্ঘদিনের ছুটি বা সাবাটিকাল পাই, সেই সময়ের জন্য তুলে। রেখেছিলাম। ইতিমধ্যে বিশেষ করে জন মেনার্ড স্মিথ এবং রবার্ট ট্রিভার্সের কল্যাণে তত্ত্বটি অনেকটুকু সম্প্রসারিত হয়েছিল। আমি এখন সেই সময়টাকে দেখি সেই সব রহস্যময় পর্বগুলোর একটি হিসাবে যেখানে নতুন সব ধারণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি একধরনের তীব্র উত্তেজনার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ‘দ্য সেলফিস জিন’ লিখেছিলাম।
যখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আমাকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল, তারা জানিয়েছিলেন, সাধারণ প্রথাগত পন্থায় বেশ ব্যাপকভাবে বইটির প্রতিটি পাতা সংশোধন বা পরিমার্জন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিছু বই আছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, যা আবশ্যিকভাবে বেশ কিছু ধারাবাহিক সংস্করণ হিসাবে প্রকাশিত হবার জন্য চিহ্নিত, তবে ‘দ্য সেলফিশ জিন তাদের একটি নয়। প্রথম সংস্করণ যে সময় লেখা হয়েছিলো, সেই সময়ের তারুণ্যময় একটি বৈশিষ্ট্য এটি ঋণ করেছিল। বিদেশের বাতাসে তখন বিপ্লবের ঝাঁপটা, ওয়ার্ডসওয়ার্থের তীব্র সুখের ভোরের একটি আলোকচ্ছটা অনুভূত হয়েছিল তখন। সেই সময়ের একটি শিশুকে পরিবর্তন করা, নতুন তথ্য যুক্ত করে তাকে স্কুল করা বা জটিলতা আর সতর্কবাণী ব্যবহার করে একে কুচকানো খুব দুঃখজনক কাজ হবে। সুতরাং মূল লেখ্য অংশ যেমন ছিল তেমনই থাকবে, সেই সব লিঙ্গবাদী সর্বনাম, অস্বস্তিকর অংশসহ সব কিছুই। বইটি এর শেষে উল্লেখিত নোটগুলো সব সংশোধন, প্রতিক্রিয়া, প্রত্যুত্তর এবং বিকাশ এই সব বিষয়গুলোর দিকে নজর দিবে। এবং পুরোপুরি নতুন অধ্যায় যুক্ত করা উচিৎ হবে, এমন কোনো বিষয়ে যার নিজের সময়ের নতুনত্ব, বৈপ্লবিক ঊষালগ্নের সেই মেজাজটি আরো সামনে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে। এর ফলাফল হচ্ছে অধ্যায় ১২ এবং ১৩। এই দুটি অধ্যায়ের জন্যে আমি আমার অনুপ্রেরণা আহরণ করছি এই মধ্যবর্তী সময়ে প্রকাশিত একটি বই, যা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হিসাবে আমার মনকে নাড়া দিয়েছিল: রবার্ট অ্যাক্সেলরডের (৪) “দি ইভোলুশন অব কোঅপারেশন, কারণ এটি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাকে এক ধরনের আশাবাদ দিয়েছিল; এবং আমার নিজের ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’, কারণ আমার জন্য এই বইটি সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল সেই বছরগুলোয়– এর প্রভাব যাই হোক না কেন– সম্ভবত এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ট রচনা–যা আমি আর কখনো লিখতে পারবো।
‘নাইস গাইস ফিনিশ ফার্স্ট’ (বা ভালোরা সফল হয়) এই শিরোনামটি আমি ঋণ করেছি বিবিসি হরাইজন টেলিভিশন প্রোগ্রাম থেকে, যা ১৯৮৫ সালে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এটি পঞ্চাশ মিনিট দীর্ঘ একটি প্রামাণ্যচিত্র, যার বিষয়বস্তু ছিল সহযোগিতা বা কোঅপারেশন বিবর্তনে গেম-তাত্ত্বিক (গেম থিওরি) দৃষ্টিভঙ্গি। জেরেমি টেইলর এটি প্রযোজনা করেছিলেন। এই প্রামাণ্য চিত্রটির একই প্রযোজকের আরেকটি কাজ, ‘দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’ প্রামাণ্য চিত্রটির নির্মাণের সময় নতুন করে তার পেশাগত দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধার জন্ম হয়েছিল। তাদের শ্রেষ্ঠ সময়ে হরাইজন প্রযোজকরা (তাদের কিছু প্রোগ্রাম আমেরিকাতেও দেখা যেতে পারে, যেখানে প্রায়ই নতুন করে তাদের প্যাকেজ করা হয়েছে ‘নোভা’ নামে) তারা যে বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতেন সেই বিষয়ের কোনো অগ্রসর বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেন। শুধুমাত্র অধ্যায় বারোরই শিরোনাম না, জেরেমি টেইলর ও হরাইজন টিমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সেই অভিজ্ঞতার কাছেও আমি অনেক বেশী ঋণী এবং কতজ্ঞ।