একটি শুক্রাণু, তার ২৩ ক্রোমোজোমসহ, তৈরী হয় অণ্ডকোষের সাধারণ ৪৬টি ক্রোমোজোমসহ কোষের মাইওটিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে। কিন্তু কোন ২৩টি ক্রোমোজোমকে কোনো একটি শুক্রাণুতে স্থানান্তর করা হবে? স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হচ্ছে, কোনো একটি শুক্রাণু যেন অবশ্যই যেকোনো পুরোনো ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম না পায়: অবশ্যই এমন ঘটনা যেন না ঘটে, যেমন, এটি খণ্ড ১৩ র দুটি কপি আর খণ্ড ১৭ র কোনো কপি পেল না। তাত্ত্বিকভাবে যদিও সম্ভব কোনো একটি ব্যক্তি তার কোনো একটি শুক্রাণুতে শুধুমাত্র সেই ক্রোমোজোমগুলো রাখতে পারে, যারা এসেছে ধরুন, পুরোপুরিভাবে তার মায়ের কাছ থেকে, যেমন খণ্ড ১, ২খ, ৩খ ..২৩খ; এবং এই অসম্ভাব্য পরিস্থিতিতে সেই বিশেষ শুক্রাণুটি দ্বারা নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে সৃষ্ট শিশু তার অর্ধেক জিন সমষ্টি পাবে তার দাদীর কাছ থেকে, কোনটাই তার দাদার কাছ থেকে না। কিন্তু আসলেই এই ধরনের মোটা দাগের পুরো ক্রোমোজোমসহ বিন্যাস সাধারণত ঘটেনা। আসল সত্যিটাই বরং আরো বেশী জটিল। মনে করে দেখুন যে খণ্ডগুলোকে (ক্রোমোজোম) আমরা ভাবছিলাম খোলা-আলাদা পাতার কোনো। বাইন্ডার হিসাবে। যা ঘটে তা হলো, শুক্রাণু তৈরী হবার সময়, একক পাতাগুলো বা বরং অনেকগুলো পাতার কিছু অংশ আলাদা হয়ে এর। বিকল্প খণ্ডটির সেই একই অংশের সাথে জায়গা রদবদল করে। সুতরাং কোন একটি নির্দিষ্ট শুক্রাণু কোষের খণ্ড ১ হয়তো তৈরী হয়েছে খণ্ড ১ক এর পৃষ্ঠা ৬৫ এবং খণ্ড ১খ এর পৃষ্ঠা ৬৬ থেকে শেষ পর্যন্ত পাতাগুলো একসাথে নিয়ে। শুক্রাণু কোষটি বাকি ২২ টি খণ্ডও পূর্ণ হয় একইভাবে। সুতরাং কোনো একক ব্যাক্তির প্রতিটি শুক্রাণু কোষ আসলেই অনন্য, যদিও তার সকল শুক্রাণু কোষ তাদের ২৩টি ক্রোমোজোম জড়ো করেছে সেই একই সেট ৪৬ টি ক্রোমোজোমের নানা অংশ নিয়ে। ডিম্বাণু এভাবেই তৈরী হয় ডিম্বাশয়ে, তারাও প্রত্যেকটি অনন্য।
বাস্তব ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ায় এই মিশ্রণটি ঘটে সেটি এখন আমরা খুব ভালো করে জানি। কোনো একটি শুক্রাণু (বা ডিম্বাণু) তৈরী হবার সময়, পিতার কাছ থেকে আসা প্রত্যেকটি ক্রোমোজোমের টুকরো টুকরো অংশ শারীরিকভাবেই তাদের নিজেদের ক্রোমোজোম থেকে পৃথক করে নেয়, এবং মায়ের থেকে আসা সংশ্লিষ্ট ক্রোমোজোমের সেই অংশগুলোর সাথে তাদের জায়গা রদবদল করে। (মনে রাখতে হবে আমরা ক্রোমোজোম নিয়ে কথা বলছি যা মূলত এসেছে সেই মানুষটির বাবা-মার কাছ থেকে যে শুক্রাণুটি বানাচ্ছে, যেমন, সেই শিশুটির দাদা-দাদীর কাছ থেকে, যে শিশুটি সেই শুক্রাণুটি দিয়ে তার মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হবার পর জন্ম নেবে)। ক্রোমোজোমের টুকরোগুলোর এই অদল-বদল করার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘ক্রসিং ওভার’। এই বইটির মূল যুক্তিটির জন্যে এই প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে যে আপনি যদি আপনার মাইক্রোস্কোপ বের করেন এবং আপনার নিজের শুক্রাণুর ( বা ডিম্বাণুর– যদি আপনি নারী হন) দিকে তাকান, সেখানে কোনগুলো আপনার মায়ের কাছ থেকে এসেছে, আর কোনগুলো আপনার বাবার কাছ থেকে এসেছে সেটা পার্থক্য করা আসলেই সময়ের অপচয় হবে। (এটি খুব বড় একটি পার্থক্য, শরীরের অন্যান্য সাধারণ কোষের সাথে যদি আপনি তুলনা করেন) (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৩১ দেখুন)। যেকোনো একটি ক্রোমোজোম একটি শুক্রাণুতে আসলেই একটি প্যাঁচওয়ার্ক, বা মিশ্রণ, একটি মোজাইক, মা এবং বাবার জিনের সমন্বয়ে যা তৈরী হয়েছে।
এই পর্যায়ে জিনের রুপক হিসাবে ‘পৃষ্ঠার’ বর্ণনা আসলেই ভেঙ্গে পারে। কোনো একটি আলাদা করে খোলা যায় এমন পাতার বাইন্ডারে পুরো একটি পৃষ্ঠাই হয়তো কোথাও ঢুকে যেতে পারে কিংবা অপসারিত হতে পারে বা রদবদল হতে পারে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার সাথে, কিন্তু আংশিক পৃষ্ঠার ক্ষেত্রে তেমন হবার কথা না নয়। কিন্তু জিন কমপ্লেক্সরা আসলেই আণবিক নিউক্লিওটাইড অক্ষরের একটি ধারাবাহিক সুতোর মত, যা আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় সুস্পষ্ট করে বিভাজিত নয়।
নিশ্চিতভাবে যদিও, সেই ধারাবাহিক অনুক্রমে, প্রোটিন চেইন তৈরীর সংকেতের সমাপ্তি’ ও ‘প্রোটিন অণু তৈরীর করার সংকেত শুরু; এর বিশেষ সংকেত থাকে সেই একই চারটি নিউক্লিওটাইড বেস নির্দেশিত অক্ষরে, ঠিক যেমন করে প্রোটিন বার্তা নিজেরাও সজ্জিত হয়। এই দুটি বিরাম চিহ্নের মাঝখানে কেমন করে একটি প্রোটিন অণু তৈরী করতে হবে সেই সাংকেতিক বার্তাটি থাকে। আমরা যদি চাই তাহলে একটি জিনকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি নিউক্লিওটাইড বর্ণমালার অনুক্রম হিসাবে যারা ‘শুরু’ আর ‘শেষ’ সংকেতের মধ্যে অবস্থান করে এবং যা একটি প্রোটিন অণুর শৃঙ্খল তৈরী করার সংকেত-বার্তা ধারণ করে। এভাবে সংজ্ঞায়িত করা কোন একটি ইউনিট বা একককে বোঝাতে ‘সিসট্রোন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এবং অনেকেই সিসট্রোন আর জিন শব্দ দুটি পরস্পর পরিবর্তনীয় রুপেও ব্যবহার করেন। কিন্তু ‘ক্রসিং ওভার’ প্রক্রিয়াটি সিসট্রোনদের মধ্যে থাকা কোনো বিভাজক সীমানা মেনে চলে না। একটি সিসট্রোনের ঠিক মাঝখানে বা কোনো দুটি সিসট্রোনের মাঝখানেও বিভাজিত হতে পারে। যেমন, অনেকটা এমন, স্থপতির পরিকল্পনাটি কোনো আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লেখা হয়নি, যেন তাদের লেখা হয়েছে ৪৬ টি ‘টিকার টেপের’ রোল এর উপর (টিকার টেপ হচ্ছে কাগজের ফিতার মত, যার উপর টেলিগ্রাফিক টেপ মেশিনে বার্তাগুলো লিপিবদ্ধ হতো)। সিসট্রোনের কোনো সুনির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য নেই। কোথায় একটি সিসট্রোন শেষ হচ্ছে আর কোথায় আরেকটি শুরু হচ্ছে সেটি বলার একটি মাত্র উপায় হতে পারে, সেই টেপের উপর সংকেতটি ভালো করে লক্ষ করা, ‘বার্তা শেষ’ বা ‘বার্তা শুরু’ সংকেত খুঁজে বের করার মাধ্যমে। ‘ক্রসিং-ওভার’ প্রক্রিয়াটি প্রতিনিধিত্ব করে— বাবা ও মায়ের ম্যাচিং বা সদৃশ টেপগুলো নিয়ে, সংশ্লিষ্ট অংশগুলো কেটে আবার সদৃশ আংশগুলো তাদের জায়গায় রদবদল করে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটিকে, সেই টেপে কি লেখা আছে সেটি আদৌ লক্ষ না করে।