সাম্প্রতিক বছরগুলোয়– গত ছয়শ মিলিয়ন বছরের মত এই অনুলিপিকারী অণুগুলো তাদের টিকে থাকার যন্ত্র তৈরীর প্রযুক্তিতে কিছু উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করেছে, যেমন, মাংসপেশী, হৃদপিণ্ড, চোখ (স্বতন্ত্রভাবে বেশ কয়েকবার যা বিবর্তিত হয়েছে); তবে এর আগে অনুলিপনকারী অণু হিসাবে তাদের পূর্বতন জীবনাচরণের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো তারা বৈপ্লবিকভাবেই বদলে ফেলেছে, আমাদের সেটা অবশ্যই আগে বুঝতে হবে, যদি যুক্তিটি নিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হতে চাই।
একটি আধুনিক অনুলিপনকারী অণুর বিষয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে সেটি হচ্ছে তারা ভীষনভাবে সঙ্গলি, দলবদ্ধ হয়ে তারা বাস করতে চায়। কোনো একটি সারভাইভাল মেশিন’ হচ্ছে সেই বাহন, যা শুধু একটি জিন ধারণ করেনা, সেখানে বাস করে ‘বহু’ হাজার জিন। একটি শরীর তৈরীর প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম জটিল সমবায়ী একটি উদ্যোগ, সেই উদ্যোগে কোনো একটি জিনের অবদান অন্য কোনো জিনের অবদান থেকে পৃথক করা প্রায় অসম্ভব (৪)। একটি জিনের হয়তো পৃথক অনেক প্রভাব থাকতে পারে শরীরের বিভিন্ন অংশে। শরীরের যেকোনো একটি জায়গা প্রভাবিত হয় বহু জিনের কর্মকাণ্ডে এবং কোনো একটি জিনের প্রভাব আরো অনেকগুলো জিনের সাথে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। কিছু জিন আছে যারা কাজ করে মাষ্টার’ জিন হিসাবে, যারা অন্য একগুচ্ছ জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। রুপকের ভাষায় বললে, স্থপতির পরিকল্পনার কোনো একটি পাতা, অট্টালিকার বিভিন্ন অংশের পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করে এবং প্রতিটি পাতা অর্থবহ হয় অন্য পাতায় থাকা অসংখ্য তথ্যের আলোকে।
জিনদের এই জটিল ও সূক্ষ্ম পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আপনাকে ভাবাবে, আসলেই আমরা ‘জিন’ শব্দটি আদৌ কেন ব্যবহার করি? কেনই বা আমরা কোনো সমষ্ঠীসূচক শব্দ, যেমন, “জিন-কমপ্লেক্স’ শব্দটি ব্যবহার করিনা? উত্তর হচ্ছে, নানা উদ্দেশ্যের কারণে এটি আসলেই খুব ভালো একটি ধারণা, কিন্তু আমরা যদি বিষয়টি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি, কোনো জিন কমপ্লেক্সের ধারণাটিও অর্থবহ হয়, যখন জিন কমপ্লেক্সটি সুস্পষ্টভাবে পৃথক পৃথক অনুলিপনকারী অংশে বা জিনে বিভাজিত হবে এমনভাবে চিন্তা করা হয়। আর যৌন প্রজননের কারণে এই সমস্যাটি সৃষ্টি হয়। জিনগুলোকে মিশ্রণ আর সাফলিং বা এলোমেলো করে মিশিয়ে দেবার ক্ষেত্রে যৌন প্রজননের একটি বিশাল প্রভাব আছে। এর অর্থ হচ্ছে যে, একজন ব্যক্তির শরীর শুধু একটি স্বল্পায়ু জিন সন্নিবেশের ক্ষণস্থায়ী বাহন। আর জিনদের এই সন্নিবেশ হচ্ছে, যা কোনো একক সদস্যের শরীর ধারণ করে, সেই শরীরটি হয়তো বেশী দিন নাও বাঁচতে পারে, কিন্তু এর ধারণ করা জিনরা নিজেরা অনেক দীর্ঘায়ু হবার সম্ভাবনা রাখে। তাদের পথগুলো অবিরতভাবে বারবার মুখোমুখি হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কোনো একটি জিনকে মনে করা যেতে পারে ‘একক’ হিসাবে, ধারাবাহিকভাবে আসা বহু সংখ্যক একক সদস্যদের শরীরে স্থানান্তরিত হবার মাধ্যমে যা টিকে থাকে। আর এটাই এই অধ্যায়ে মূল যুক্তি হিসাবে গড়ে তোলা হবে। এটি হচ্ছে একটি যুক্তি, আমার বেশ কিছু সম্মানিত সহকর্মীরা যে যুক্তিটির সাথে দুর্দমনীয়ভাবে একমত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সুতরাং আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন যদি মনে হয় আমি বিষয়টি নিয়ে পরিশ্রম করছি!। প্রথমে যৌন প্রজনন নিয়ে কিছু বাস্তব বিষয় আমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই।
আমি বলেছিলাম যে মানুষের একটি শরীর তৈরী করার বিস্তারিত পরিকল্পনাটি সুরক্ষিত আছে ৪৬ টি খণ্ডে। আসলেই এটি অতিসরলীকরণ হয়ে গেছে। সত্যিটা বরং আরো অদ্ভুত, ৪৬টা ক্রোমোজোমে আছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। আমরা হয়তো বলতে পারি শরীর নির্মাণের পরিকল্পনাটি ২৩ খণ্ডের বিকল্প দুইটি সেট হিসাবে প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে সজ্জিত আছে। আমরা তাদের নাম দিলাম খণ্ড ১ক’ এবং ১খ, খণ্ড ‘ক’ এবং ২খ’ ইত্যাদি থেকে খণ্ড ‘২৩ক’ এবং খণ্ড ‘২৩খ’। অবশ্যই শনাক্তকারী সংখ্যাগুলো যা খণ্ডগুলো চিহ্নিত করতে এখানে এবং পরবর্তীতে পাতা নির্দেশ করতে আমি ব্যবহার করছি, সেটি অবশ্যই বিশুদ্ধভাবে কাল্পনিক।
আমরা প্রতিটি ক্রোমোজোম অবিকৃত অবস্থায় পাই আমাদের পিতা বা মাতা– এই দুজনের কারো একজনের কাছ থেকে, যাদের অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ে সেই ক্রোমোজোমটি তৈরী হয়েছিল। ধরুন খণ্ড ‘ক’, ‘২ক’, ‘ক’ .. এসেছে আপনার বাবার কাছ থেকে, খণ্ড ‘খ’, ‘২খ’, ‘খ’ এসেছে আপনার মায়ের কাছ থেকে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজটি করা অত্যন্ত দুরুহ একটি ব্যাপার, তবে তাত্ত্বিকভাবে আপনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে আপনার যে কোনো একটি কোষের ৪৬টি ক্রোমোজোমের দিকে তাকাতে পারেন এবং যেখান থেকে যে ২৩টি আপনার মায়ের কাছ থেকে এসেছে এবং যে ২৩ টি আপনার বাবার কাছ থেকে এসেছে, সেগুলো পৃথক করতে পারেন।
জোড়া ক্রোমোজোমগুলো তাদের সারা জীবন কিন্তু একসাথে পাশাপাশি পরস্পরে সংস্পর্শে থেকে কাটায় না কিংবা এমনকি একে অপরের কাছাকাছিও থাকেও না, তাহলে কোন অর্থে তাদের জোড়া বলা হচ্ছে? সেই অর্থে যে, এর প্রতিটি জোড়ের যেটি আসছে মূলত বাবার কাছ থেকে এসেছে সেটির প্রতিটি পাতা অনুযায়ী, তার সঙ্গী ক্রোমোজোমের বিকল্প হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে যেটি মূলত আসছে মায়ের কাছ থেকে। যেমন, খণ্ড ১৩ক’ এর ‘পৃষ্ঠা ৬’ এবং খণ্ড ‘১৩খ’ এর ‘পৃষ্ঠা ৬’ দুটোই হয়তো চোখের কি রঙ হবে সেই বিষয়ের নির্দেশনা হতে পারে, হয়তো একটি বলছে ‘নীল’, অন্যটি বলছে ‘বাদামী।