আমি স্থপতির পরিকল্পনার রুপকটি এখানে ব্যবহার করবো, স্বাধীনভাবে রুপকের ভাষার সাথে সত্যিকারের বিষয়টির ভাষা মিশ্রণ করার মাধ্যমে। খণ্ড’ শব্দটি ক্রোমোজোমের সাথে পরস্পর পরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহৃত হবে। “পৃষ্ঠা’ শর্ত সাপেক্ষে পরস্পর পরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহৃত হবে জিনের সাথে, যদিও জিনদের মধ্যে বিভাজন কোনো বইয়ের আলাদা আলাদা পাতার মত এতটা সুস্পষ্ট নয়। তবে এই রুপকটি আমাদের অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করবে। যখন এটি অপ্রতুল হয়ে অবশেষে ভেঙ্গে পড়বে, আমি আরো নতুন কোনো রুপক ব্যবহার করবো। ঘটনাচক্রে, অবশ্যই কোনো ‘স্থপতির’ অস্তিত্ব নেই, ডিএনএর নির্দেশাবলী একসাথে জড়ো করেছে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
ডিএনএ অণুগুলো দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, প্রথমত তারা অনুলিপনকারী, অর্থাৎ তারা নিজেদের অনুলিপি তৈরী করে। এবং জীবনের সূচনা থেকে এটি বিরামহীনভাবেই চলেছে এবং ডিএনএ অণুগুলো বর্তমানে আসলেই এই কাজটি করতে অত্যন্ত দক্ষ। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, আপনার শরীরের প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ আছে, কিন্তু যখন মাতৃগর্ভে প্রথম আপনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, আপনি ছিলেন শুধু একটি মাত্র কোষ। আপনার সেই কোষে ‘স্থপতির’ পরিকল্পনার একটি মাত্র ‘মাস্টার’ বা মূল কপি ছিল, সেই কোষটি দ্বিবিভাজিত হয় এবং উৎপন্ন দুটি কোষ সেই মূল কপি থেকে তাদের নিজেদের কপিটি পায়। পরবর্তী আরো বিভাজনে কোষ সংখ্যা বাড়াতে থাকে ধারাবাহিক হারে, ৪, ৮, ১৬, ৩২ এবং এভাবে হাজার কোটি কোষে। প্রতিটি কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ পরিকল্পনাটি বিশ্বস্তভাবে অনুলিপি হয়, প্রায় কোনো ভুল ছাড়াই।
ডিএনএ’র অনুলিপি তৈরী নিয়ে কথা বলা এক বিষয়, কিন্তু ডিএনএ যদি আসলে শরীর গঠন করার জন্য এক সেট পরিকল্পনাই হয়ে থাকে, কিভাবে সেই পরিকল্পনাটিকে কাজে প্রয়োগ করা হয়? কিভাবে আমাদের শরীরের গঠনের প্রক্রিয়ায় সেটি অনূদিত হয়? আর এই বিষয়টি আমাকে ডিএনএ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে নিয়ে আসে। একটি ভিন্ন ধরনের অণু সৃষ্টি করার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে এটি তদারকী করে– প্রোটিন। আগের অধ্যায়ে হিমোগ্লোবিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উদাহরণ, অসংখ্য প্রোটিন অণুর একটি মাত্র উদাহরণ। ডিএনএ’র সাংকেতিক বা কোড করা বার্তা লেখা আছে চার অক্ষরের ‘নিউক্লিওটাইড’ বর্ণমালায়, এবং সাধারণ যান্ত্রিক একটি উপায়ে এটি অনুদিত হয় অন্য একটি বর্ণমালায়, সেটি হচ্ছে অ্যামাইনো এসিডদের বর্ণমালা, যা প্রোটিন অণু গঠন করে।
কিন্তু শুধু প্রোটিন বানানো পুরো একটি শরীর বানানো থেকে অনেক দূরের একটি বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু সেই লক্ষ্যে এটি হচ্ছে প্রথম ক্ষুদ্র পদক্ষেপ। প্রোটিন শুধুমাত্র শরীরের গঠনগত মূল উপাদান হিসাবে কাজ করে না, তারা কোষের মধ্যে সব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, বিশেষ সময় ও বিশেষ স্থানে তাদের বেছে বেছে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করে তাদের সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব খাটায়। এবং ঠিক কি ভাবে এই সব কাজ অবশেষে একটি শিশুকে তৈরী করে সে এক বিশাল কাহিনী, যার রহস্য পুরোপুরি উদ্ধার করতে ভ্রূণতত্ত্ববিদদের। কয়েক দশক কিংবা শতাব্দীকাল সময় লাগবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এটি তাই করে। জিন পরোক্ষভাবে শরীর তৈরী হবার প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সেই প্রভাবটি খুব কঠোরভাবে একমুখী: অর্জিত কোনো বৈশিষ্ট্যই উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হয় না। জীবনে আপনি যত জ্ঞান আর প্রজ্ঞা অর্জন করুন না কেন, তার একটি বিন্দুও জিনের মাধ্যমে আপনার সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তরিত হবেনা, প্রতিটি প্রজন্মকেই শুরু থেকে শুরু করতে হয়। অবিকৃত অবস্থায় জিনগুলোকে সংরক্ষিত করার জন্য শরীর সে-কারণে জিনেরই একটি উপায়।
আর জিনরা যে ভ্রূণসংক্রান্ত বিকাশ প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই বাস্তব সত্যটির বিবর্তনীয় গুরুত্ব হচ্ছে এটি: এর অর্থ জিনরা অন্ততপক্ষে আংশিকভাবে ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী। কারণ তাদের টিকে থাকাটা নির্ভর করবে যে শরীরে তারা বাস করবে এবং যে শরীর তৈরী করতে তারা সাহায্য করেছে, সেই শরীরের দক্ষতার উপর। কোন এক সময়, প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত ছিল আদিম সুপ বা মিশ্রণের মধ্যে মুক্তভাবে ভাসমান অনুলিপন করতে সক্ষম এমন অণুদের বৈষম্যমূলক একটি হারে টিকে থাকা, এখন প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই অনুলিপনকারী অণুদের প্রতি আনুকুল্যতা প্রদর্শন করে যারা ভালো ‘সারভাইভাল মেশিন’ তৈরী করতে পারে, সেই সব জিনগুলো, যারা দক্ষতার সাথে ভ্রূণগত বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখানে এই অনুলিপনকারী অণু, তারা যেমন কখনোই ছিল না, তেমনি কোনোভাবে আরো বেশী সচেতন বা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না। সেই পুরানো প্রক্রিয়া, স্বয়ংক্রিয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বী অণুগুলোর মধ্যে তাদের দীর্ঘসময় টিকে থাকা বা দীর্ঘজীবিতা, উর্বরতা আর অনুলিপি করার সময় ভুল না করার দক্ষতা বা অনুলিপি-বিশ্বস্ততার কারণে তখনও পরিচালিত হয় অন্ধভাবেই এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে, যেমন একসময় বহু দিন আগে তারা করতো। জিনদের কোনো ভবিষ্যৎদর্শিতা নেই। আগে থেকে তারা কোনো পরিকল্পনা করে না। জিন শুধু জিন, কিছু জিন অন্য জিনদের তুলনায় কিছু বেশী এবং এখানে আর বেশী কিছু বলারও নেই। কিন্তু যে গুণগুলো কোনো জিনের দীর্ঘায়ু নির্ধারণ করে বা তাদের অনুলিপি করার দ্রুততা বা উর্বরতাকে নির্দেশ করে তারা জিনদের মত আর সরল নয় এখন, যেমন আগে ছিল, অনেক পার্থক্য সেখানে।