আমরা হচ্ছি সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্র। কিন্তু ‘আমরা’ মানে এখানে শুধু মানুষকে বোঝাচ্ছে না, এই ‘আমরা’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সকল প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস। এই পৃথিবীতে সারভাইভাল মেশিনের মোট সংখ্যা কত, সেটি গণনা করা খুবই কঠিন এবং এমনকি পথিবীতে প্রজাতির মোট সংখ্যা কত সেটিও আমাদের অজানা। যদি শুধু কীটপতঙ্গদের কথাই ধরা হয়,তাদের জীবিত প্রজাতির সংখ্যা অনুমান করা হয়েছে প্রায় তিন মিলিয়নের কাছাকাছি, এবং কীটপতঙ্গদের একক সদস্যদের সংখ্যা হতে পারে এক মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন।
বিভিন্ন ধরনের সারভাইভাল মেশিনগুলো আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে কিংবা তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর ক্ষেত্রে খুবই ভিন্ন ভিন্ন রুপের মনে হতে পারে। একটি অক্টোপাস কোনোভাবেই ইঁদুরের মত নয় এবং দুটি প্রাণীই আবার একটি ওক গাছ থেকে খুব ভিন্ন। কিন্তু তাদের মৌলিক রসায়নে তারা বরং একই, এবং, বিশেষ করে, যে অনুলিপনকারীদের তারা তাদের মধ্যে ধারণ করে, জিনগুলো, সেগুলো মূলত একই ধরনের অণু, যা আমাদের সবার মধ্যে থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে হাতি। আমরা সবাই একই ধরনের অনুলিপনকারী অণুর সারভাইভাল মেশিন– যে অণুর নাম ডিএনএ– কিন্তু আরো অনেক উপায় আছে এই পথিবীতে বাঁচার জন্য এবং সেই সব উপায়গুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে অনুলিপনকারী সেই অণুটি বহু ধরনের মেশিনও তৈরী করেছে। বানর হচ্ছে একটি যন্ত্র যা গাছের উপরের মগডালে জিনগুলোকে সুরক্ষা করে, মাছ হচ্ছে তেমনই একটা যন্ত্র পানিতে জিনগুলোকে সুরক্ষা করে, এমনকি খুব ক্ষুদ্র একটি নেমাটোড প্রজাতি আছে যারা জার্মান বিয়ার ম্যাটে (বিয়ারের গ্লাসের নীচে রাখার জন্যে কার্ডবোর্ডের তলাচি) তাদের জিনগুলোকে সুরক্ষা করে (১)। বহু রহস্যময় উপায়ে ডিএনএ কাজ
করে। খুব সরলভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য আমি এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছি যে, আধুনিক জিনগুলো, যারা ডিএনএ দিয়ে তৈরী হয়েছে, আদিম সেই রাসায়নিক মিশ্রণে আবির্ভূত অনুলিপনকারী অণুর মত তারা ঠিক একই রকম দেখতে ছিল। আমার প্রস্তাবিত যুক্তির জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু বিষয়টি আসলেই সত্যি নাও হতে পারে। সেই আদি মূল অনুলিপনকারী অণুরা হয়তো ডিএনএ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন কোনো অণুই ছিল। অথবা হয়তো তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো প্রকারের ছিল। পরের সম্ভাবনাটির ব্যপারে আমরা হয়তো বলতে পারি যে তাদের টিকে থাকার যন্ত্রগুলো পরবর্তীতে কোনো একসময় দখল করে নেয় ডিএনএ’রা। যদি তাই হয়, তাহলে আধুনিক টিকে থাকার কোনো যন্ত্রে তাদের আর কোনো চিহ্নের অবশেষ নেই, আদিম সেই অনুলিপনকারী অণুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ভাবনা সুত্রেই এ. জি. কেয়ার্ন-স্মিথ (২) আমাদের পূর্বসূরিদের নিয়ে দারুণ আগ্রহ উদ্দীপক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছিলেন, প্রথম অনুলিপনকারী অণুগুলো হয়তো আদৌ কোনো জৈব অণুই ছিল না, সেগুলো হয়তো অজৈব স্ফটিক ছিল– খনিজ, ক্লে বা কাদার ক্ষুদ্র কোনো অংশ। দখলকারী হোক বা না হোক বর্তমানে ‘ডিএনএ’ তর্কাতীতভাবে মূল নিয়ন্ত্রণে আছে, যদি না, যেমন, পরীক্ষামূলকভাবে প্রস্তাব করেছি। অধ্যায় ১১ তে, ক্ষমতা নতুন করে দখল করার একটি পক্রিয়া কেবল শুরু হয়েছে।
কোনো ডিএনএ অণু হচ্ছে বিল্ডিং ব্লক বা গঠনগত একক অণু দিয়ে তৈরী একটি সুদীর্ঘ শৃঙ্খল, এই সব গঠনগত একক অণুগুলোকে বলে ‘নিউক্লিওটাইড’। ঠিক যেমন করে কোনো প্রোটিন অণু অ্যামাইনো এসিডদের শৃঙ্খল, তেমনি ডিএনএ হচ্ছে। নিওক্লিওটাইডদের শিকল। একটি ডিএনএ অণু খালি চোখে দেখার জন্যে অনেক বেশী ক্ষুদ্র, কিন্তু পরোক্ষ উপায়ে এর সঠিক আকারটি উদ্ভাবনী দক্ষতার সাথে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এটি তৈরী হয়েছে এক জোড়া নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরী শঙ্খল দিয়ে, যারা পরস্পরের সাপেক্ষে কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচানোর মাধ্যমে সর্পিলকার একটি আকার তৈরী করে। সেই ডাবল হেলিক্স (৩), সেই ‘অমর কুণ্ডলী’। নিউক্লিওটাইডগুলো, যারা ডিএনএ তৈরী করে তারা চার ধরনের, তাদের নামের আদ্যক্ষর ব্যবহার করে সংক্ষেপে বলা হয়, A,L,G এবং C; আর সব প্রাণী বা উদ্ভিদের নিউক্লিওটাইডরা ঠিক একই রকমের। শুধুমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে তারা কোন অনুক্রমে একটার পর একটি সাজানো থাকে। কোনো একটি G বিল্ডিং ব্লক মানুষের যেমন, সেটি শামুকের G বিল্ডিং ব্লকের মত হুবহু একই রকম দেখতে। কিন্তু কোনো একটি মানুষের ক্ষেত্রে এইসব নিউক্লিওটাইড বেসগুলোর সজ্জা বা অনুক্রম কোনো শামুকের বেস সজ্জা বা অণক্রম থেকে শুধু ভিন্নই না, অন্য কোনো মানুষের বেস সজ্জা থেকে আলাদা– যদিও অপেক্ষাকৃত কম ( শুধুমাত্র হুবহু জিনগত যমজদের ক্ষেত্র ছাড়া)।
আমাদের ডিএনএ বাস করে আমাদের শরীরে, শরীরের কোনো একটি অংশে তারা জড়ো হয়ে থাকে না, তারা ছড়িয়ে থাকে শরীরের কোষগুলোয়। গড় পড়তা কোনো মানব শরীরে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ থাকে, গ্রাহ্য না করার মত অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে একটি সম্পূর্ণ সেট ডিএনএ থাকে। এই ডিএনএ-কে মনে করা যেতে পারে এক সেট নির্দেশাবলী হিসাবে, যেখানে কিভাবে একটি শরীর তৈরী করতে হয় সেই নির্দেশ থাকে, এবং সেই নির্দেশাবলী লেখা থাকে নিওক্লিওটাইড বেসদের বর্ণমালায়, A,T,G এবং C। তুলনা করা যেতে পারে কোনো একটি সুবিশাল অট্টালিকা, যার প্রতিটি রুমে বই রাখার একটি আলমারী বা ‘বুক-কেস আছে, যেখানে সেই পুরো অট্টালিকাটি কিভাবে তৈরী করতে হবে, সে ব্যপারে স্থপতির পরিকল্পনাটি রাখা আছে। প্রতিটি কোষের সেই ‘বুক-কেসটিকে বলা হয় নিউক্লিয়াস, মানুষের ক্ষেত্রে স্থপতির পরিকল্পনাটি সাজানো আছে ৪৬ টি খণ্ডে। এই সংখ্যাটি প্রজাতিভেদে ভিন্ন। আর সেই ভলিয়ুম বা খণ্ডকে বলা হয় ক্রোমোজোম। মাইক্রোস্কোপের নীচে তাদের লম্বা সুতার মত দেখা যায়, এবং জিনরা সেই সুতায় ধারাবাহিকভাবে সাজানো থাকে। বিষয়টি অবশ্য এত সহজ না, আসলেই এমনকি এটি অর্থবহও হয় না, ঠিক কোথায় কোনো একটি জিন শেষ হচ্ছে আর পরবর্তী জিনটি শুরু হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে এই অধ্যায় আমাদের প্রদর্শন করবে, আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্যের জন্য বিষয়টি তেমন কোনো সমস্যা না।