এই যুক্তির পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সংযোগটি হচ্ছে সেটি, যা ডারউইন নিজেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে (যদিও তিনি কথা বলছিলেন প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে, অণুদের নিয়ে নয়) প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা কম্পিটিশন’। আদিম মিশ্রণের অসীম সংখ্যক অনুলিপনকারী অণুকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা ছিলনা। একটি কারণ তো অবশ্যই পৃথিবীর আকার সীমিত, কিন্তু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করার আরো কারণ ছিল যেগুলো হয়তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের দৃশ্যকল্পে অনুলিপনকারী অণু ছাচ বা টেমপ্লেট হিসাবে কাজ করে, আমরা ধারণা করে নিয়েছিলাম যে, এটি ক্ষুদ্র গঠনগত একক অণুদের সমৃদ্ধ সুপ বা মিশ্রণে ভাসছে, যারা এর অনুলিপি তৈরী করার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যখন অনুলিপনকারী অণুদের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাদের তৈরী করার জন্য ছোট অণুগুলো এমন একটি হারে ব্যবহৃত হয়ে যায় যে তারা দ্রুত দুর্লভ আর মূল্যবান উপাদানে পরিণত হয়। সেই সময় বিভিন্ন ধরনের আর রুপের অনুলিপি অণুরা অবশ্যই তাদের পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা করেছে। আমরা সেই সব শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, যেখানে অনুলিপনকারী অণুদের মধ্যে যে অণুটি বিশেষ আনুকুল্য পায়, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা এখন দেখতে পাবো, অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাপ্রাপ্ত প্রকারগুলোর সংখ্যা আসলেই ‘কমে গিয়েছিল প্রতিযোগিতার কারণে। অবশেষ তাদের অনেক বংশধারাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেখানে নানা প্রকারের অনুলিপনকারী অণুগুলোর মধ্যে অস্তিত্ব বাঁচানোর সংগ্রাম বিদ্যমান ছিল। তারা কিন্তু জানতো না যে তারা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে বা বিষয়টি নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলনা। কোনো তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করা ছাড়াই এই সংগ্রাম চলমান, আসলে কোনো ধরনের কোনো অনুভুতি এখানে সংশ্লিষ্ট নয়। কিন্তু তারা সংগ্রাম করছিল এই অর্থে যে, কোনো ধরনের ভুল অনুলিপি নতুন কোনো উচ্চতর পর্যায়ে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বা কোনো নুতন উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অণুর স্থিতিশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। আর সেই সব পরিবর্তনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুরক্ষিত হবে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে। এই উন্নতির প্রক্রিয়াটি ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়। অণুগুলোর স্থিতিশীলতা বাড়ানোর উপায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী অণুদের স্থিতিশীলতা কমানোর উপায় আরো বেশ জটিলতর, বিস্তারিত আরো দক্ষতর একটি প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। তাদের কেউ কেউ এমনকি আবিষ্কার করে কিভাবে রাসায়নিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকারের অণুগুলো ভাঙ্গতে হয় এবং তাদের ভেঙ্গে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গঠনগত মূল একক অণুগুলোকে নিজেদের অনুলিপি বানানোর কাজে ব্যবহার করতে শেখে। এই প্রোটো-কার্নিভোর, আদি-মাংসাশীরা যুগপতভাবে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে এবং দ্বন্দ্বরত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেয়। অন্য অনুলিপনকারী অণুগুলো কিভাবে এই ধরনের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয় সেটি হয়তো আবিষ্কার করেছিল, রাসায়নিকভাবে অথবা তাদের চারপাশে প্রোটিনের তৈরী কোনো দেয়াল সৃষ্টি করে নেবার মাধ্যমে। এভাবেই হয়তো প্রথম জীবিত কোষের আবির্ভাব ঘটেছিল। অনুলিপনকারী অণুগুলো শুধুমাত্র তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে শুরু করেনি, এছাড়াও তারা তাদের অস্তিত্বের ধারা রক্ষা করার জন্যে নিজেদের জন্য খোলস, বাহনও তৈরী করতে শুরু করেছিল। যে অনুলিপনকারীরা টিকে গিয়েছিল তারা হচ্ছে সেই অনুলিপি যারা তাদের নিজেদের বাঁচানো আর বসবাস করার লক্ষ্যে সারভাইভাল মেশিন বা বেচে থাকার যন্ত্র তৈরী করে নিতে পেরেছিল। প্রথম সেই সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্রগুলো সম্ভবত তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা প্রতিরক্ষামূলক একটি পর্দা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু টিকে থাকার সেই সংগ্রামটিও ধীরে ধীরে আরো কঠিন হয়ে ওঠে যখন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের আবির্ভাব ঘটেছিল, যাদের টিকে থাকার যন্ত্রটি অপেক্ষাকৃত বেশী কার্যকর। পুঞ্জীভূত এই পরিবর্তনগুলো ধারণ করার মাধ্যমে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকা একটি প্রক্রিয়ায় টিকে থাকার যন্ত্রটি ক্রমশ আকারে আরো বড়, বিস্তারিত আর জটিলতর হয়ে উঠেছিল।
কোনো কি শেষ আছে নানা কৌশল আর যন্ত্র উদ্ভাবনের এই ক্রমোন্নয়নের ধারাবাহিকতার, পৃথিবীতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য যা অনুলিপনকারীরা ব্যবহার করে আসছে? বহু সময় আছে আরো উন্নতি করার। এই নিজেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়ার কি অদ্ভুত যন্ত্রই না জানি সৃষ্টি করেছিল ধীরে ধীরে বহু হাজার বছরের পরিক্রমায়? চার হাজার মিলিয়ন বছর পরে, আদিম অনুলিপনকারী এই অণুটির নিয়তি কি হবে? না, তারা নিঃশেষ হয়ে যায়নি, কারণ তারা হচ্ছে এই টিকে থাকার কৌশল আর ক্ষমতার আদি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু উন্মুক্ত অবস্থায় এখনও সমুদ্রের পানিতে ভেসে আছে এমন ভাবনায় তাদের খোঁজার চেষ্টা করবেন না। তারা তাদের সেই বিরোচিত স্বাধীনতা পরিত্যাগ করেছে বহুদিন আগেই। এখন তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে, বিশাল কলোনি রুপে, নিরাপদে দানবাকৃতির এলোমেলো হাটা রোবোটদের (৪) অভ্যন্তরে, বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, যার সাথে তাদের যোগাযোগ এখন বহু ঘুরপথে, দুর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মত যাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের বাস এখন আমার আর আপনার মধ্যে, তারা আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের শরীর ও মন, এবং তাদের সংরক্ষণ করা আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত যৌক্তিকতা। এইসব অনুলিপনকারীরা বহু দূর অতিক্রম করে এসেছে। এখন তারা পরিচিত ‘জিন’ নামে আর আমরা হচ্ছি তাদের ‘সারভাইভাল’ মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্র।