যেহেতু ভুল-অনুলিপি করা হয় এবং সেগুলো বিস্তার লাভ করে, হুবহু একই রকম অনুলিপিদের জনগোষ্ঠী দিয়ে সেই আদিম সুপ বা মিশ্রণ পূর্ণ হয়না, বরং বেশ কয়েকটি ধরনের বা প্রকরণের অনুলিপনকারী দ্বারা মিশ্রণটি পুর্ণ হয়, যাদের সবাই একটি পূর্বসূরি অণু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কোনো বিশেষ ধরনের অনুলিপি কি অন্য ধরনের চেয়ে সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করে? প্রায় নিশ্চিৎভাবে বলা যায়, হ্যাঁ। সেই অণুগুলো কোনো কোনো প্রকার তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণে অন্য প্রকারের চেয়ে বেশী স্থিতিশীল হবে। কিছু অণু একবার তৈরী হলে অন্য অণুদের তুলনায় আবার সেটির ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে। সেই মিশ্রণের মধ্যে এই প্রকারের অণুগুলো সংখ্যায় অপেক্ষাকৃতভাবে বেড়ে যাবে, সরাসরি তাদের দীর্ঘায়ুর’ যৌক্তিক পরিনামের জন্যে নয় বরং আরো একটি কারণ হচ্ছ, তাদের নিজেদের অনুলিপি তৈরী করার জন্য এইসব দীর্ঘায়ু অনুলিপনকারী অণুগুলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় পায়, সুতরাং মিশ্রণে ক্রমশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অণু হয়ে উঠতে তাদের প্রবণতা থাকে। আর বাকী সব কিছুই অপরিবর্তিত থাকার কারণে এই অণু জনগোষ্ঠীর আরো দীর্ঘায়ু হবার দিকে একটি বিবর্তনীয় প্রবণতা থাকে।
কিন্তু অন্য সব বিষয়গুলো সম্ভবত এক ছিল না এবং একটি অনুলিপিকারক প্রকরণের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, পুরো জনগোষ্ঠীতে সেটি বিস্তার হবার চেয়ে যা অবশ্যই আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে অনুলিপি সৃষ্টি করার দ্রুততা বা ‘উর্বরতা’। যখন ‘ক’ টাইপের অনুলিপক অণুরা তাদের প্রতিলিপি তৈরী করে সপ্তাহে একবার, তখন টাইপ ‘খ’ তাদের অনুলিপি তৈরী করে প্রতি ঘন্টায় একবার, ব্যপারটা অনুধাবন করতে খুব কঠিন হবেনা যে, খুব দ্রুত টাইপ ‘ক’ অণুকে ছাড়িয়ে যাবে ‘খ’ টাইপের অণুগুলো, এমনকি যদিও তারা ‘খ’ টাইপ অণুর চেয়ে দীর্ঘদিন বাঁচে। সুতরাং সে কারণে আরো উচ্চতর ‘উর্বরতা সম্পন্ন অণুর সংখ্যা সেই মিশ্রণে বৃদ্ধি পাবার সম্ভবত একটি “বিবর্তনীয় প্রবণতা থাকে। এই অনুলিপিকারক অণুর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যা পজিটিভ বা ইতিবাচকভাবে নির্বাচিত হবে সেটি হচ্ছে অনুলিপন প্রক্রিয়ার ক্রটিহীনতা। যদি টাইপ ‘ক’ এবং টাইপ ‘খ’ অণুরা একই সময় ধরে টিকে থাকে এবং একই হারে অনুলিপি সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘ক’ প্রতিটি দশম অনুলিপন প্রক্রিয়ায় গড়পড়তা একটি ভুল করে, অন্যদিকে ‘খ’ ভুল করে প্রতি একশত অনুলিপন প্রক্রিয়ায় একবার, অবশ্যই ‘খ’ অণুর সংখ্যা অনেক হারে বেড়ে যাবে। জনগোষ্ঠীর ‘ক’ অংশ শুধু ‘ভুল উত্তরসূরিদেরই হারাবে না, তাদের উত্তরসুরিদের উত্তরসুরিদের হারাবে, সত্যিকারের কিংবা সম্ভাব্য।
আপনি যদি বিবর্তন সম্বন্ধে ইতিমধ্যে কিছু জেনে থাকেন, আপনার হয়তো বিষয়টি শুনে সামান্য কিছুটা খটকা লাগবে, বিশেষ করে শেষ অংশটি। আমরা কি এই দুটি ধারণার মধ্যে সমঝোতা করতে পারবো, অনুলিপি করার সময় ভুল হওয়াটা বিবর্তন ঘটার জন্য একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত আর প্রাকৃতিক নির্বাচন নিখুঁত-অনুলিপি করার বৈশিষ্ট্যটিকে বিশেষভাবে সুবিধা দেয়? এর উত্তরটি হচ্ছে যদিও বিবর্তনকে মনে হতে পারে, কোনো একটি অস্পষ্ট অর্থে, ভালো কোনো কিছু, বিশেষ করে যখন আমরা এর ফসল। কিন্তু কোনো কিছুই আসলে বিবর্তিত হতে চায় না। বিবর্তন হচ্ছে এমনকিছু যা না চাইলেও ঘটবে, কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই, অনুলিপনকারীদের বিবর্তন যেন না ঘটে সেই প্রতিরোধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (এখন যাদের আমরা জিন বলি)। জ্যাক মননা বিষয়টি চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তার হার্বার্ট স্পেন্সর বক্তৃতায় খানিকটা হতাশা সহ : “বিবর্তন তত্ত্বের আরো একটি মজার বিষয় হচ্ছে, সবাই ভাবেন তারা এটি বুঝতে পেরেছেন।
আদিম সেই সুপ বা মিশ্রণের আলোচনায় ফিরে আসি, অবশ্যই সেটি ‘স্থিতিশীল’ প্রকৃতির অণু দ্বারা পুর্ণ হয়ে পড়েছিল। স্থিতিশীল দুই অর্থে, হয় প্রতিটি অণু দীর্ঘস্থায়ী বা তারা দ্রুত অনুলিপি তৈরী করে বা তারা খুব নিখুঁতভাবে তাদের অনুলিপি তৈরী করে। এই তিন ধরনের স্থিতিশীলতার প্রতি বিবর্তনীয় প্রবণতাটি ঘটে এভাবে: আপনি যদি সেই মিশ্রণ থেকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নমুনা সংগ্রহ করেন, পরের নমুনাটিতে সেই সমস্ত প্রকারের অণুদের পরিমানের শতাংশ বেশী হবে যারা দীর্ঘ সময় ধরে বাঁচে উর্বর বা দ্রুত অনুলিপি তৈরী করে/ নিখুঁতভাবে তারা তাদের অনুলিপি তৈরী করতে পারে; আর মূলত এটাই কোনো জীববিজ্ঞানী বিবর্তন বলতে বোঝাতে চান যখন তিনি জীবিত জীব নিয়ে কথা বলেন এবং প্রক্রিয়াটি সেই একই প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তাহলে কি আমাদের মূল অনুলিপনকারী অণুটিকে বলা উচিৎ তারা ‘জীবিত’ বা তাদের জীবন আছে? কার কি এসে যায় তাতে? আমি হয়তো আপনাকে বলতে পারি, পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন এমন মানুষগুলোর মধ্যে ডারউইনই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘না, অবশ্যই না, ‘নিউটন ছিলেন সেই শ্রেষ্ঠতম মানব’, কিন্তু আমি আশাকরি আমরা সেই তর্ক দীর্ঘায়িত করবো না, মূল বিষয়টি হচ্ছে কোনো সত্যিকারের উপসংহারে আমরা পৌঁছাতে পারবো না, যেদিকেই আমাদের এই বিতর্ক অগ্রসর হোক না কেন। বাস্তব সত্য হচ্ছে নিউটন আর ডারউইনের জীবন ও অর্জন সম্পূর্ণভাবে অপরিবর্তিত থাকবে, আমরা তাদের ‘মহান’ হিসাবে চিহ্নিত করি কিংবা না করি। একইভাবে, অনুলিপি অণুগুলোর গল্প সম্ভব ঘটেছিল যেভাবে আমি বলছি, আমরা তাদের জীবিত বলবো নাকি বলবো না, তাতে কিছু আসে যায় না। মানুষের বহু যন্ত্রণার কারণ, আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনা শব্দ হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উপাদান বা টুল যা আমরা ব্যবহার করি মাত্র, কোনো অভিধানে ‘জীবিত (লিভিং)’ শব্দটির উপস্থিতি থাকা মানে এই না যে বাস্তব পৃথিবীতে এটি আবশ্যিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট কিছু বোঝাবে। আমরা আদি অনুলিপনকারীদের জীবিত কিংবা জীবিত না, যেভাবেই ডাকি না কেন, তারাই জীবনের পূর্বসূরি, তারাই ছিল আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বসূরি।