ডকিন্স, হ্যামিলটনের প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার করার পর, প্রস্তাব করেন যে তিনি ভুল করেছিলেন ফিটনেসের ধারণাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য চূড়ান্ত একটি প্রচেষ্টা করে, এবং তার জন্য আরো ভালো হতো যদি তিনি সম্পূর্ণভাবে জিনের দৃষ্টিতে বিবর্তনের ধারণাটিকে গ্রহন করতেন। তিনি আমাদের তাড়না দেন– রেপ্লিকেটর’ বা অনুলিপনকারী– যে সত্তাদের সঠিক গঠন প্রজনন প্রক্রিয়ায় অনুলিপি হয়, এবং ভেহিকল’ বা বাহক– সে সত্তারা মরণশীল ও তাদের কোনো অনুলিপি হয়না কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে রেপ্লিকেটররা– এই দুটির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটিকে শনাক্ত করার জন্য। প্রধান যে রেপ্লিকেটর’ এর সাথে আমরা পরিচিত, তারা নিউক্লিক অ্যাসিড অণু- যেমন ডিএনএ অণু– যাদের দিয়ে জিন এবং ক্রোমোজোম তৈরী হয়। সাধারণ সব ভেহিকল বা বাহকরা হচ্ছে জীব শরীর, যেমন, কুকুর, ফুট ফ্লাই এবং মানুষ। ধরুন, আমরা একটি অঙ্গ যেমন চোখের কথা ভাবি, যারা সুস্পষ্টভাবেই কোনো কিছু দেখার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। আমরা হয়তো যুক্তিসঙ্গতভাবে জিজ্ঞাসা করতে পারি কার সুবিধার জন্য চোখ বিবর্তিত হয়েছে। একটি মাত্র যুক্তিসঙ্গত উত্তর হতে পারে, ডকিন্স প্রস্তাব করেন, এটি বিবর্তিত হয়েছে সেই সব অনুলিপনকারীদের জন্য যারা এর ভ্রূণগত বিকাশের জন্য দায়ী। যদিও গ্রুপের সুবিধার চেয়ে একক কোনো সদস্যের সুবিধা হয় এমন ব্যাখ্যাকে তিনি আমার মতই অনেক বেশী শ্রেয়তর মনে করেন, তবে তার কাছে শুধুমাত্র অনুলিপনকারীদের সুবিধা হয় এমন চিন্তা করা আরো বেশী শ্রেয়তর মনে হয়।
নোটস (পর্যালোচনা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ)
১. লেমিং (Lemming)- একধরনের রোডেন্ট বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, যাদের বাস মূলত আর্কটিক বা উত্তর মেরু অঞ্চলে।
২. Konrad Lorenz: On Aggression (German: Das sogenannte Böse zur Naturgeschichte der Aggression), 1963
৩. Robert Ardrey, The Social Contract: A Personal Inquiry into the Evolutionary Sources of Order and Disorder,1970
8. Irenaus Eibl-Eibesfeldt, Love and Hate: A Natural History of Behavior Patterns (Zur Naturgeschichte elementarer Verhaltensweisen), 1970
৫. কমন ব্ল্যাকবার্ড যেমন Turdus merula, এই জিনাসের পাখিদের ট্রু গ্রাসও বলা হয়।
৬. এক্টোপ্লাজম শব্দটি ব্যবহার করা আধ্যাত্মিক শক্তিপূর্ণ কিছু দিয়ে তৈরী বস্তু, সাধারণত আত্মা নামানোর অনুষ্ঠানে এই ধারণাটি ব্যবহার করা হয় আত্মার শরীরি উপস্থিতি জানান দেবার জন্য। এটি মূলত একটি প্রতারণা।
৭. E. O. Wilson, Sociobiology: The New Synthesis, 1975
৮. David Lack, The life of the Robin. 1943
.
লেখক পরিচিতি
রিচার্ড ডকিন্স
ক্লিনটন রিচার্ড ডকিন্স সুপরিচিত রিচার্ড ডকিন্স নামেই। তাঁর প্রশিক্ষণ আর পেশাগত ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞান, বিশেষ করে ইথোলজী (প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যাক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন) এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান। ব্রিটিশ সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা বাবার কাজের সুবাদে তাঁর জন্ম এবং শৈশব কাটে আফ্রিকায়। বাবা এবং মা, দুজনেরই আগ্রহ ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, আর পারিবারিক সেই আগ্রহটিও সঞ্চারিত হয়েছিল শিশু ডকিন্সের মনে। জীবজগতের দৃশ্যমান নানা রুপ আর বৈচিত্র্যময়তার একটি বিকল্প ব্যাখ্যা হিসাবে মধ্য কৈশোরেই চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বটি তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল; উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জীববিজ্ঞান। অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে ১৯৬২ সালে স্নাতক এবং বিশ্বসেরা ইথোলজিষ্ট ও জীববিজ্ঞানী নিকোলাস টিনবার্গেন (১) এর তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি শেষ করেন ১৯৬৬ সালে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বাকলীতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ডকিন্স তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন, কিন্তু শিক্ষক ‘নিকো’ টিনবার্গেন তাঁর প্রিয় মেধাবী ছাত্রটিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অক্সফোর্ডে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭০ সালে অক্সফোর্ডে প্রাণিবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে এই বিভাগের রিডারও (২) হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বিখ্যাত সফটওয়্যার প্রকৌশলী চার্লস সিমোনী (৩) বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য আর জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে অক্সফোর্ডে রিচার্ড ডকিন্সের জন্য একটি বিশেষ অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন, Simonyi Professorship for the Public Understanding of Science (৪), এই পদ থেকে ২০০৮ এ অবসর গ্রহন করেন তিনি।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন বিষয়টি নিয়ে বহু জীববিজ্ঞানীর মধ্যেই কিছু মৌলিক ভ্রান্ত ধারণার অস্তিত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (৫), জন মেনার্ড স্মিথ(৬ ), ডাবলিউ, ডি, হ্যামিলটন(৭) ও রবাট ট্রিভার্স (৮) এর কিন সিলেকশন, অ্যালটুইজম বা পরার্থবাদীতা, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ সংক্রান্ত গাণিতিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো বিষয়গুলি নিয়ে একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার জন্য। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে সৃষ্ট বিদ্যুত সরবাহ ঘাটতির সময় যখন তার ঝিঁঝি পোকা (ক্রিকেট) নিয়ে গবেষণার কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সেই অবসরে ধারণাগুলো তিনি লিখে ফেলেছিলেন একটি বহনযোগ্য ছোট টাইপরাইটারে, ১৯৭৬ সালে সেই ভাবনাগুলো তাঁর প্রথম বই ‘দ্য সেলফিশ জিন (The Selfish Gene)’ রুপে প্রকাশিত হয়েছিল।