গেম থিওরী একটি পাঠ্যপুস্তকে কেউ বেশী গেম দেখবেন না, আধুনিক জ্যামিতির বইয়ে যেমন কেউ বৃত্ত আর ত্রিভুজ দেখে না তার। চেয়ে। হঠাৎ দৃষ্টিতে সবই শুধুমাত্র বীজগণিত: গেম তত্ত্ব শুরু থেকেই জটিল কারিগরী একটি বিষয়। সেকারণেই আসলেই একটি সাহিত্যিক অর্জন এই বইতে এত বেশী কিছু উপস্থাপন করার বিষয়টি, শুধু বাইরের ভাব কিংবা গুণাবলী নয়, এর অভ্যন্তরীণ ব্যাখ্যাতো বটেই, কোনো সমীকরণের সাহায্য ছাড়াই গেম থিওরীর পরিস্থিতিগুলো ব্যাখ্যা করা। আর, এ. ফিশার, তার বিখ্যাত বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমার কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি এই বইটিকে সহজপাঠ্য করার জন্য। সেই বইয়ে অসংখ্য গাণিতিক সূত্র এবং বাক্যগুলো যেমন বাহুল্যবর্জিত, তেমনই সুগভীর, যেখানে পাঠক খুব দ্রুতই বাধ্য হয় নতি স্বীকার করে নিতে। দ্য সেলফিশ জিন পড়ে আমি এখন অনুভব করতে পারি যে, ফিশার আরো ভালো কাজ করতে পারতেন, যদিও স্বীকার করতে হবে, তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি বই লিখতে হতো। মনে হয় যেন বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছে, এমনকি ধ্রুপদী জনসংখ্যা জিনতত্ত্বে নির্ধারণী সব ধারণাগুলোও হয়তো আরো বেশী সুখপাঠ্য বোধগম্য হতো সাধারণ গদ্যে। বাস্তবিকভাবে হলডেন ফিশারের চেয়ে আরো উত্তম কিছু করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু এত সুগভীর ছিলনা)। কিন্তু যা আসলেই অসাধারণ সেটি হলো কতো বেশী বরং বিরক্তিকর গণিত অনুপ্রবেশ করেছে পপুলেশন জেনেটিক্সের মূলধারায়, রাইট, ফিশার এবং হলডেন এর নেতৃত্বে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নতুন, জীবনের বাস্তবতার প্রতি আরো বেশী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। আমি বরং বিস্মিত হয়েছি ডকিন্স আমার মতই ফিশারকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম জীববিজ্ঞানী হিসাবে মনে করেন জেনে। (একটি দূর্লভ দৃষ্টিভঙ্গি, যেমনটি আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি আরো লক্ষ করে যে কত সামান্যই তিনি ফিশারের বইটির পুনরাবৃত্তি করেছেন তার এই বইটিতে।
পরিশেষে, তার শেষ অধ্যায়ে, ডকিন্স সংস্কৃতির বিবর্তনের বিস্ময়কর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মিম শব্দটি (মাইমিম এর সংক্ষিপ্ত রুপ) প্রচলন করেন জিন এর সমতুল্য সাংস্কৃতিক একককে। যদিও খুব কঠিন শব্দটি সংঙ্গায়িত করা– নিশ্চয়ই জিন এর সংজ্ঞার চেয়ে কঠিন– আমি সন্দেহ করি খুব শীঘ্রই এটি জীববিজ্ঞানীদের কাছে প্রচলিত একটি শব্দ হয়ে উঠবে এবং, আমরা আশা করি, দার্শনিক,ভাষাতত্ত্ববিদ এবং অন্যরাও শব্দটিকে আত্মস্থ করে নেবেন, প্রাত্যহিক ভাষায় যেমন জিন শব্দটি আত্মীভূত হয়েছে।
.
জিন এবং মিম : জন মেনার্ড স্মিথ।
(দ্য লন্ডন রিভিউ অব বুকস, ৪-১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮২, দ্য এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপের পর্যালোচনা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ)।
বই হিসাবে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ অসাধারণ, কারণ যদিও সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবেই এটি লেখা হয়েছে, কিন্তু এটি জীববিজ্ঞানে মৌলিক একটি অবদান রেখেছে। উপরন্তু, সেই অবদানটি খুবই অসাধারণ ধরনের। সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা ডেভিড ল্যাকের ধ্রুপদী বই ‘দ্য লাইফ অব দ্য রবিন’(৮) বইটিরও মৌলিক অবদান ছিলো। দ্য সেলফিশ জিন কোনো নতুন বাস্তব তথ্য জানায়নি, বইটিতে কোনো গাণিতিক মডেলও নেই– আসলেই এই বইটিতে আদৌও কোনো গণিত নেই। এটি যা নিবেদন করেছে তা হচ্ছে একটি নতুন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
যদিও ব্যাপকভাবে বইটি পড়া হয়েছে এবং উপভোগ করা হয়েছে, কিন্তু খুব শক্তিশালী বৈরিতারও উদ্রেকও করেছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই বৈরিতা উদ্ভব হয়, আমি বিশ্বাস করি, ভুল বোঝাবুঝি থেকে অথবা বরং, বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝি থেকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ভ্রান্তিটি হচ্ছে এই বইটি আসলে কি বিষয়ে সেটি বুঝতে ব্যর্থ হওয়া। এটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বই, এটি নৈতিকতা বিষয়ে না অথবা রাজনীতি সংক্রান্ত নয় অথবা কোনো মানবিক বিজ্ঞান বিষয়কও না। যদি আপনি আগ্রহী না হন কিভাবে বিবর্তন ঘটেছে, এবং বুঝতে ব্যর্থ হন যে কিভাবে কেউ এত গভীরভাবে মানুষের কর্মকাণ্ড ছাড়াও অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত হতে পারে,তাহলে বইটি পড়ার দরকার নেই আপনার: এটি শুধুমাত্র আপনাকে অপ্রয়োজনীভাবে ক্ষুদ্ধ করবে।
তবে, ধরে নিচ্ছি যে আপনি বিবর্তন সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, ডকিন্স কি করছেন সেটি বোঝার একটি ভালো উপায়, সেই বিতর্কের প্রকৃতিটিকে অনুধাবন করা, যা বিবর্তন জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে চলমান ছিল, ষাটের এবং সত্তরের দশকে। এটি দুটি সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট– গ্রুপ সিলেকশন এবং কিন সিলেকশন। গ্রুপ সিলেকশন বিতর্কটির সূচনা করেছিলেন ওয়েইন-এডওয়ার্ড (যিনি প্রস্তাব করেছিলেন আচরণগত অভিযোজন) বিবর্তিত হয়েছে গ্রুপ সিলেকশনের মাধ্যমে, যেমন কিছু গ্রুপের টিকে থাকা আর কিছু গ্রুপের বিলুপ্তির মাধ্যমে…
প্রায় একই সময়ে কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে সেই প্রসঙ্গে ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি দেখান যে বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে বাঁচানোর জন্য যদি কোনো জিনের বাহকের আত্মবিসর্জন দেবার কারণ হয়, পরবর্তীতে এই জিনের বেশ কয়েকটি অনুলিপি হয়তো থেকে যাবে জনগোষ্ঠীতে, আত্মবিসর্জন যদি না দেয়া হয় সেই পরিস্থিতি অপেক্ষা। এই প্রক্রিয়াটির গাণিতিক মডেল হিসাবে দেখানোর জন্য, হ্যামিলটন ‘ইনকুসিভ ফিটনেস’ ধারণাটির প্রস্তাবনা করেন– যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি সদস্যের নিজের সন্তানরাই শুধু নয়, বরং যেকোনো বাড়তি সন্তানও যাদের প্রতিপালন করে তার নিকটাত্মীয়রা সেই সদস্যের সাহায্য নিয়ে, যে সঠিক প্রযোজ্য মাত্রা নির্ধারিত হয় আত্মীয়তার সম্পর্কের মাত্রা হিসাবে।