উঠতি প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবী জীববিজ্ঞানীদের একজন, রিচার্ড ডকিন্স মৃদুভাবে ও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরার্থবাদের বিবর্তন সংক্রান্ত সোস্যাল বায়োলজী বা সামাজিক জীববিজ্ঞানের কিছু প্রিয় বিভ্রমকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই বইটিকে শুধুমাত্র কোনো ধারণা ভুল প্রমাণ করার প্রচেষ্টাপূর্ণ বই হিসাবে ভাবলে চলবে না: এটি এর বিপরীত, সোস্যাল বায়োলজীর কেন্দ্রীয় সমস্যাটির প্রাকৃতিক নির্বাচনের জিনগত তত্ত্বের অত্যন্ত দক্ষতাপূর্ণ পুনসূত্রবদ্ধকরণ। এছাড়াও, এটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অত্যন্ত সুলিখিত। প্রাণিবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য যে জিনিসগুলো রিচার্ড ডকিন্সকে আকর্ষণ করেছিল সেটি হলো প্রাণীদের স্বাভাবিক পছন্দনীয়তা- যে দৃষ্টিভঙ্গিটি সব ভালো জীববিজ্ঞানীরাই ধারণ করেন, যাদের প্রজ্ঞা এই পুরো বইটি জুড়েই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। যদিও দ্য সেলফিশ জিন বইটি তার প্রকৃতিতে বিতর্কমূর্খর, এবং কিছু বইয়ে –যেমন, লরেঞ্জের ‘অন অ্যাগ্রেসন’ (২), আর্সেই এর দ্য সোস্যাল কন্ট্রাক্ট (৩), এবং আইবেল-আইবেসফেল্ড ‘লাভ অ্যান্ড হেট’ (৪)– উল্লেখিত দাবীগুলোর আত্মম্ভরিতা দর্পচূর্ণ করার ডকিন্সের পরিকল্পনার জন্য যা খুবই জরুরী অংশ, যেমন, ডকিন্স মন্তব্য করেছেন– ‘এই বইগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এদের লেখকরা বিষয়টি বুঝতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ভুল করেছেন.. কারণ, তারা বিবর্তন কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়টি সম্বন্ধে ভুল বুঝেছিলেন। তারা সেই ভ্রান্ত প্রাকধারণা করেছেন যে বিবর্তনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একক সদস্য (বা জিন) নয় বরং প্রজাতির কল্যাণ (অথবা গ্রুপের)। আসলেই স্কুলের ছেলেদের প্রবচন ‘মুরগী হচ্ছে আরেকটি ডিম তৈরী করার জন্য ডিমের একটি উপায়’ এ ডজন খানেক বক্তৃতা দেবার জন্য যথেষ্ট পরিমান সত্য আছে। রিচার্ড ডকিন্স বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘এই বইয়ের যুক্তি হচ্ছে যে আমরা, এবং অন্য সব জীবরা, আমাদের জিনদের তৈরী যন্ত্র… আমি যুক্তি দেবো যে কোনো একটি সফল জিনের প্রধান যে গুণটি আশা করা উচিৎ, সেটি হচ্ছে এর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা। এই জিন স্বার্থপরতাই সাধারণত সৃষ্টি করে একক সদস্যদের স্বার্থপর আচরণগুলোকে। তবে, আমরা এটাও দেখবো, বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে, যেখানে একটি জিন তার নিজের স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে অর্জন করতে পারে সীমিত রুপে পরার্থবাদীতার চর্চা করার মাধ্যমে। যে বাক্যটি আপনি এই মাত্র পড়লেন সেখানে বিশেষ’ এবং ‘সীমিত আকারে’ এই দুটি শব্দ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যতই চেষ্টা করিনা কেন অন্য কিছু বিশ্বাস করতে, বিশ্বজনীন ভালোবাসা এবং প্রজাতির কল্যাণ সার্বিকভাবে এমন একটি ধারণা যা বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আদৌ অর্থবহ হয়না।
‘আমরা হয়তো এই সত্যটাকে ঘৃণা করতে পারি’, ডকিন্স বলেন, ‘কিন্তু কোনো অংশেই তা এটিকে কম সত্যতে রূপান্তরিত করেনা। যত বেশী সুস্পষ্টভাবে আমরা জিনগত প্রক্রিয়ার স্বার্থপরতা বুঝতে পারবো, ততই আমরা আরো বেশী যোগ্য হয়ে উঠবো উদারতা এবং সহযোগিতার উপকারিতা এবং বাকী সব কিছু যা সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে সেগুলো শিক্ষা দেবার জন্য। এবং বাকী সবার চেয়ে ডকিন্স আরো সুস্পষ্টভাবে মানবজাতির ক্ষেত্রে সংস্কৃতি অথবা জিনের বাইরের– এক্সোজেনেটিক– বিবর্তনের বিশেষ গুরুত্বটিকে ব্যাখ্যা করেছেন।
বইটর শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে, ডকিন্স নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন একটি মৌলিক নীতি সূত্রবদ্ধ করার প্রয়াসে, যা অবশ্যই সব বিবর্তনীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে– এমনকি হয়তো সেই সব জীবের ক্ষেত্রেও যেখানে কার্বন পরমাণুর জায়গা নিয়েছে সিলিকন পরমাণু, এবং মানুষের মত জীবের ক্ষেত্রেও, যেখানে অনেক পরিমান বিবর্তন ঘটে থাকে জিনগত নয় এমন প্রক্রিয়ায়। সেই মূলনীতি হচ্ছে, বিবর্তন কাজ করে অনুলিপি করতে সক্ষম সত্তাদের সর্বমোট প্রজনন সুবিধার উপর। সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে সাধারণ কোনো জীবের ক্ষেত্রে এই সত্তাগুলো ডিএনএ অনুতে একক হিসাবে অবস্থান করে, যারা পরিচিত ‘জিন’ নামে। ডকিন্সের প্রস্তাবনায় সাংস্কৃতিক বিস্তারের একক হচ্ছে সেটি, যার তিনি নাম দিয়েছেন ‘মিম’ এবং তার বইটির শেষ অধ্যায়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যা কার্যত একটি ডারউইনিয় মিম তত্ত্ব।
ডকিন্সের এই অসাধারণ ভালো বইটির সাথে আমি একটি পাদটিকা যোগ করবো: সকল জীবিত জীব মৌলিক একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে ‘মেমোরি ফাংশন’ ধারণ করে এমন ধারণাটি প্রথম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ব্যাখ্যা করেছিলেন অস্ট্রীয় ফিজিওলজিস্ট ইভার্ল্ড হেরিং। ঠিক ‘মিম’ এর মত করেই উপস্থাপন করে তিনি তার এই একক সম্বন্ধে বলেছেন, এর উৎস সম্বন্ধে সচেতন থেকে বাছাই করা ঋজু একটি শব্দ এটি। এই বিষয়ে রিচার্ড সেমন এর ব্যাখ্যা (১৯২১) যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবেই সম্পূর্ণ অ-ডারউইনীয়, এখন আর যাকে সেই সময়ের একটি ধারণা ছাড়া আর কোনোভাবে অন্য কিছু ভাবা যাবে না। হেরিং এর একটি ধারণাকে তিরষ্কার করেছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাকৃতিক দার্শনিক অধ্যাপক জে. এস. হলডেন: সেই ধারণাটি, এমন একটি যৌগের অবশ্যই অস্তিত্ব আছে যার ঠিক সেই একই গুণাবলী আছে, যা এখন আমরা জানি ডি-অক্সিরাইবোজ নিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ অণুর আছে।