কখনো কখনো যখন পরমাণুরা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়, তারা একে অপরের সাথে যুক্ত হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণু সৃষ্টি করার জন্য। তারা কম বেশী স্থিতিশীল হতে পারে। কোনো কোনো অণু হতে পারে অনেক বেশী বড়। কোনো স্ফটিক, যেমন, হিরার একটি টুকরোকে মনে করা যেতে পারে একটি অণু, এবং প্রবাদ বাক্যের মতই এটি স্থিতিশীল এই ক্ষেত্রে; কিন্তু আবার এটি খুব বেশী সরলও তার গঠনে কারণ এর আভ্যন্তরীণ পরমাণুগুলোর গঠন অসীম সংখ্যকবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কোনো জীবিত আধুনিক প্রাণীদের মধ্যে আরো অনেক বড় আকারের অণুদের আমরা খুঁজে পারে, যারা খুবই জটিল এবং তাদের জটিলতা আমরা দেখি বেশ কয়েকটি স্তরে। আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন হচ্ছে খুব বৈশিষ্ট্যসূচক একটি প্রোটিন অণু। এটি তৈরী হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট অণুদের দ্বারা, যারা অ্যামাইনো অ্যাসিড, যাদের প্রত্যেকটির মধ্যেই আছে কয়েক ডজন পরমাণু, যারা সজ্জিত থাকে সুনির্দিষ্ট একটি প্যাটার্নে। হিমোগ্লোবিন অণুতে মোট ৫৭৪ টি অ্যামাইনো এসিড আছে। এরা সজ্জিত থাকে চারটি চেইন বা শঙ্খল হিসাবে, যারা একে অপরের সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে গোলাকৃতির বা গ্লোবিউলার হতভম্ভ করে দেবার মত জটিল একটি ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরী করে। হিমোগ্লোবিন অণুর মডেল দেখতে বরং কোনো ঘন থর্নবুশ বা কাটা গাছের ঝোঁপের মত, সত্যিকারের কোনো কাটা ঝোঁপের ব্যতিক্রম এটি এলোমেলো খামখেয়ালী কোনো প্যাটার্ণ না বরং একটি সুনির্দিষ্ট ও অভিন্ন কাঠামো, যার হুবহু পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যার একটিও শাখা-প্রশাখা কিংবা কুণ্ডলী ভুল জায়গায় নেই, আর এই একই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে গড়পড়তা কোনো মানুষের শরীরের প্রায় ছয় হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন বারেরও বেশী। প্রোটিন অণু যেমন, হিমোগ্লোবিন সেই নিখুঁত কাটা-ঝোঁপের আকারে স্থিতিশীল এই অর্থে যে দুটি অ্যামাইনো এসিডের চেইন বা শৃঙ্খলদের প্রবণতা আছে, দুটি স্প্রিং-এর মত, ঠিক একই ত্রিমাত্রিক কুণ্ডলী আকারের কাঠামো তৈরী করেই স্থিতিশীল হয়। হিমোগ্লোবিনের কাটা-ঝোঁপরা আমাদের শরীরে তাদের পছন্দসই আকার নিচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ডে চার শত মিলিয়ন মিলিয়ন বার এবং একই ভাবে বহু অণু একই হারে ধ্বংস হচ্ছে।
হিমোগ্লোবিনের একটি আধুনিক অণু, পরমাণুদের স্থিতিশীল একটি প্যাটার্ন গঠন করার প্রবণতা আছে, এই মূলনীতিটি বোঝানোর জন্য যা একটি উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক সেটি হচ্ছে পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব হবার আগে,। পদার্থবিদ্যা আর রসায়নের সাধারণ প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে অণুদের কিছুটা প্রারম্ভিক বিবর্তন হতে পারে। কোনো ডিজাইন বা পূর্বপরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য বা কোনো দিক নির্দেশনার কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। প্রাকৃতিক নির্বাচনের আদিমতম রুপটি ছিল শুধুমাত্র একটি স্থিতিশীল রুপের নির্বাচন এবং অস্থিতিশীল কোনো রুপের বর্জন। কোনো রহস্য নেই এই বিষয়ে, সংজ্ঞানুযায়ী এটি অবশ্যই হতে হবে।
এখান থেকে, অবশ্যই, শুধুমাত্র এই একই মূলনীতি ব্যবহার করে কিন্তু আপনি সেই সব সত্তার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যেমন, মানুষের মত জটিল কোনো কিছু। কোনোই লাভ হবে না, যতই আপনি সঠিক সংখ্যক পরমাণু এক সাথে নিয়ে যতক্ষণ না তারা সঠিক প্যাটার্নটি তৈরী করছে ততক্ষণ তাদের ভালো করে ঝাঁকিয়ে বাইরে থেকে কিছু শক্তি সরবরাহ করেন না কেন, সেখান থেকে আস্ত আদমও বেরিয়ে আসবে না! অল্প কয়েক ডজন পরমাণু দিয়ে আপনি সেখানে হয়তো একটি অণু তৈরী করতে পারবেন, কিন্তু একটি মানুষের শরীরে এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন পরমাণু আছে। কোনো একটি মানুষ তৈরীর চেষ্টা করতে, আপনি আপনার সেই জৈবরাসায়নিক ককটেল শেকার নিয়ে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হবে যে, মহাবিশ্বের পুরো বয়সকে চোখের পলকের মত সংক্ষিপ্ত অনুভূত হবে এবং এমনকি তারপরও আপনি সফল হবেন না। আর এখানেই ডারউইনের তত্ত্ব, এর সবচেয়ে সাধারণতম রুপে আমাদের উদ্ধার করে। ডারউইনের তত্ত্ব। সেখান থেকে এর দ্বায়িত্ব নেয় যেখানে অণুদের ধীরে ধীরে তৈরী হবার গল্পটি শেষ হয়।
জীবনের উৎপত্তির কাহিনী যা আমি এখানে বর্ণনা করবো আবশ্যিকভাবে সেটি ধারণা নির্ভর; সংজ্ঞানুযায়ী, আসলে কি ঘটেছিল সেটি দেখার জন্য কেউই সেখানে ছিলনা। বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব আছে কিন্তু তাদের সবার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যে সরলীকৃত ব্যাখ্যা আমি আপনাদের দেবো সেটি সম্ভবত সত্য থেকে খুব বেশী দূরে নয় (১)।
আমাদের জানা নেই জীবনের উৎপত্তি হবার আগে পৃথিবীতে কোন রাসায়নিক কাঁচামালগুলোর প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু আপাতগ্রাহ্য সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে সেখানে ছিল পানি, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া: সরল সব যৌগ, আমাদের সৌরজগতের অন্ততপক্ষে কয়েকটি গ্রহে তাদের উপস্থিতি আছে বলে আমরা জানি। রসায়নবিদরা চেষ্টা করেছে সেই নবীন পৃথিবীর রাসায়নিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য। তারা এইসব রাসায়নিক উপাদানগুলো কাঁচের ফ্লাস্কে রেখে সেখানে কোনো উৎস থেকে শক্তি সরবরাহ করেছিলেন, যেমন, অতিবেগুনী রশ্মি কিংবা বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট আদিম সেই বিদ্যুত চমকের রুপ। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, সাধারণত কিছু অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এই সব কাঁচের পাত্রের মধ্যে একটি হালকা বাদামী সুপ, যেখানে ছিল বহু সংখ্যক অণুর শুরুতে যে অণুগুলো সেখানে রাখা হয়েছিল সেগুলোর চেয়ে যারা অনেক বেশী জটিল। বিশেষ করে অ্যামাইনো অ্যাসিড খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল– প্রোটিন তৈরীর একক, বিখ্যাত দুটি জৈববৈজ্ঞানিক অণু শ্রেণীর একটি। এই পরীক্ষাগুলো হবার আগে, প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া অ্যামাইনো অ্যাসিডকে জীবনের উপস্থিতির শনাক্তকারী চিহ্ন হিসাবে ভাবা হতো। যদি তাদের খুঁজে পাওয়া যেত, যেমন ধরুন মঙ্গল গ্রহে, সেই গ্রহে জীবনের উপস্থিতিকে মনে করে হতে প্রায় নিশ্চিৎ। এখন অবশ্য কোথাও জীবনের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করার জন্য প্রয়োজন বায়ুমণ্ডলে কিছু সাধারণ গ্যাসের উপস্থিতি, কিছু আগ্নেয়গিরি, সূর্যের আলো অথবা বিদ্যুত চমকাচ্ছে এমন আবহাওয়া ইত্যাদি। আরো সাম্প্রতিক সময়ে, পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাবের আগে রাসায়নিক পরিস্থিতি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করার মাধ্যমে সেই জৈব যৌগগুলো পাওয়া গেছে, যেমন, পিউরিন আর পাইরিমিডিন; তারা জেনেটিক অণু, ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোজ নিউক্লিক এসিড) এর গঠনগত একক।