বন্ধুদের জন্য কারো নিজের জীবন উৎসর্গ করা অবশ্যই পরার্থবাদী একটি কাজ, কিন্তু একইভাবে তাদের জন্য সামান্য ঝুঁকি নেয়াটাও পরার্থবাদের উদাহরণ হতে পারে। অনেক ছোট পাখিরা, যখনই তারা উড়ন্ত কোনো শিকারী পাখিকে, যেমন, বাজ পাখি, কাছাকাছি দেখে, তারা সাথে সাথে একটা বৈশিষ্ট্যসুচক একটি ‘সতর্ক সঙ্কেত দিয়ে বাকীদের জানান দেয়, যা শুনে ছোট পাখিদের ঝাক দ্রুত আত্মরক্ষামূলক একটি ব্যবস্থা গ্রহন করে শিকারী প্রাণী থেকে বাঁচতে। পরোক্ষ প্রমাণ আছে যে পাখিটি এই সতর্কতা মূলক ডাকটি দেয়, সে তার নিজেকে বিশেষ ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়, কারণ তার সেই ডাকটি শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশেষ করে তার প্রতি; এটি শুধুমাত্র সামান্য একটু বাড়তি ঝুঁকি নেয়া, কিন্তু তা সত্ত্বেও, এটি প্রথম দৃষ্টিতে আমাদের সংজ্ঞা মোতাবেক একটি পরার্থবাদী কাজ হিসাবে গণ্য হতে পারে।
প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণতম ও সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ার মত পরোপকারী কাজটি পিতা-মাতার দ্বারা সম্পাদিত হয়, বিশেষ করে জন্মদানকারী মায়েরা– তাদের সন্তানের প্রতি; তারা তাদের নীড়ে বা তাদের নিজেদের শরীরে সন্তানকে জন্ম দেবার আগ অবধি প্রতিপালন করেন, তাদের জন্মের পর নিজেদের বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে তাদের খাদ্য সরবরাহ করেন, এবং শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে সন্তানদের বাঁচাতে বিশাল ঝুঁকি নেন। একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণের কথা ধরা যাক, মাটিতে নীড় বানানো অনেক পাখিরা একটি প্রদর্শনী আচরণ করে, যা পরিচিত মনোযাগ বিক্ষিপ্ত করার জন্য প্রদর্শনী বা ‘ডিসট্রাকশন ডিসপ্লে। যখন কোনো শিকারী প্রাণী যেমন শিয়াল আক্রমণ করে, পিতা কিংবা মাতা পাখিটি তখন তার নীড় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তাদের শুধু একটি ডানা প্রশস্ত করে ধরে রেখে, এমনভাবে যেন মনে হয় তাদের একটি ডানাটি ভেঙ্গে গেছে; শিকারী প্রাণীটি সেই ডানা ভাঙ্গা পাখিটিকে সহজ শিকার ভেবে নেয় আর তার নজর পাখির বাসায় থাকা নবজাতক পাখির চেয়ে সেই পাখির প্রতি নিবদ্ধ হয়। অবশেষে পাখিটি তার ভান করা নাটকটি ত্যাগ করে, শিয়ালের মুখে ধরা পড়ার আগে বাতাসে উড়ে যায়। যদিও এটি তার নীড়ের অন্যদের রক্ষা করে, কিন্তু তাকে ঝুঁকি নিতে হয়।
গল্প বলে আমি কোনো বিশেষ কিছু বোঝাতে চাইছি না, বাছাই করা উদাহরণ কখনোই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারে না যা দিয়ে কার্যকরী কোনো একটি সাধারণীকরণ সম্ভব।এই গল্পগুলো বলা হচ্ছে শুধুমাত্র উদাহরণ হিসাবে যে, প্রজাতির একক সদস্যদের পর্যায়ে পরার্থবাদীতা আর স্বার্থপরতা বলতে আসলে আমি কি বোঝাতে চাইছি। এই বইটি পরবর্তীতে দেখাবে কিভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিগত পরার্থবাদীতা দুটোই একটি মৌলিক সূত্র বা আইন দিয়ে বোঝানো সম্ভব, যাকে আমি বলছি “জিন স্বার্থপরতা’ (gene selfishnes); কিন্তু তার আগে আমাকে অবশ্যই পরার্থবাদীতার একটি বিশেষ ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, কারণ এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং এমনকি ব্যাপকভাবে এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পড়ানো হয়ে থাকে।
এই ব্যাখ্যাটি একটি ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যা আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম, তা হলো জীবিত সব জীবরা ‘প্রজাতির কল্যাণে’ বা ‘কোনো গ্রুপ বা গোষ্ঠীর কল্যাণে কোনো কিছু করার জন্যবিবর্তিত হয়। খুবই সহজ কিন্তু দেখা কিভাবে এই ধারণাটির জন্ম হয়েছে জীববিজ্ঞানে। কোনো একটি জীবের জীবনের বেশীর ভাগ অংশই ব্যয় হয় প্রজননের জন্য এবং পরার্থবাদী আত্মত্যাগের বেশীর ভাগ ক্রিয়া যা আমরা প্রকৃতিতে দেখি, সেগুলো সন্তানদের প্রতি তাদের পিতামাতারা করে থাকে। প্রজাতির ধারা অব্যহত রাখা’ প্রজননের একটি খুব প্রচলিত সুভাষণ এবং এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রজননেরই একটি পরিণতি। সামান্য একটু সম্প্রসারিত যুক্তির প্রয়োজন হয় সেই উপসংহারে উপনীত হতে যে, প্রজননের কাজ হচ্ছে প্রজাতির ধারা অনন্তকালের জন্য ‘অব্যহত রাখা। এখান থেকে আরো একটি ছোট মিথ্যা পদক্ষেপ নিলেই সেই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, প্রাণীরা সাধারণত এমনভাবেই আচরণ করে যা প্রজাতির ধারা অব্যহত রাখার বিষয়টি বিশেষ সুনজর পায়। প্রজাতি বা গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি পরার্থবাদী আচরণ মনে করা হয় এখান থেকেই এসেছে।
এই চিন্তার সূত্রটি হালকাভাবে ডারউইনীয় ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়। বিবর্তন কাজ করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত বা ‘ফিটেষ্টদের’ বৈষম্যমূলকভাবে বেঁচে থাকা (প্রজাতির ফিটেস্ট সদস্যদের তুলনামূলকভাবে বেশী বেঁচে থাকাটা নিশ্চিৎ করে) (১৫)। কিন্তু আমরা কি নিয়ে কথা বলছি, সবচেয় ফিট একক সদস্য, নাকি সবচেয়ে ফিট জনগোষ্ঠী, রেস বা বর্ণ নাকি সবচেয়ে ফিট প্রজাতি অথবা কি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। কিন্তু যখন আমরা পরার্থবাদীতা নিয়ে কথা বলবো এটি অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি এটি প্রজাতি হয়, যারা ডারউইনের ভাষায় টিকে থাকার সংগ্রামে প্রতিদ্বন্দিতা করতো, তাহলে প্রজাতির সদস্যরা সেই খেলায় দাবার ‘পন’ বা সৈন্য গুটির মত হতো, যাদের যখন খুশী বিসর্জন দেয়া যেতো, যখন প্রজাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই কাজটি করার দরকার পড়তো; ব্যপারটাকে কিছুটা সম্মানজনক উপায়ে বলতে চাইলে, কোন একটি গ্রুপ, যেমন একটি প্রজাতি বা কোনো একটি জনগোষ্ঠী সেই প্রজাতির মধ্যে, যাদের প্রতিটি সদস্য পুরো গ্রুপটির কল্যাণে নিজেদের বিসর্জন দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে, হয়তো তাদের বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা কম, অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপদের তুলনায়, যে গ্রুপের সদস্যরা তাদের নিজেদের স্বার্থ গ্রুপের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়। সুতরাং পৃথিবী সেই সব গ্রুপদের দ্বারা পূর্ণ হয় যাদের গ্রুপে আত্মত্যাগী সদস্যরা আছে। এটাই ‘গ্রুপ সিলেকশন’ তত্ত্ব। বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা একে সত্য হিসাবে ধারণা করে এসেছেন, বিশেষ করে সেই সব জীববিজ্ঞানীরা যারা বিবর্তন তত্ত্বটির বিস্তারিত অনেক কিছুই জানেন না। যে ধারণাটিকে ব্যাপকভাব পচার করেছিল ভি, সি ওয়াইন-এডওয়ার্ডের একটি বিখ্যাত বই (১৬) ও রবার্ট আর্ডে তার “দি সোস্যাল কনট্রাক্ট” বইটির মাধ্যমে এটি জনপ্রিয় করেছিলেন। এর প্রচলিত বিকল্পটি সাধারণত বলা হয়, “ইন্ডিভিজুয়াল সিলেকশন’, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে চাই ‘জিন’ সিলেকশনের কথা।