দীর্ঘমেয়াদী বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উপর কি প্রভাব পড়ছে তা পরীক্ষা করে দেখানো খুবই জটিল একটি বিষয়। ব্যবহারিকভাবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যখন আমরা সত্যিকারের আচরণগুলোর উপর সংজ্ঞাগুলো প্রয়োগ করি, আমাদের সেই শব্দটিকে গুণগতভাবে পরিবর্তন করতে হবে ‘আপাতদৃষ্টিতে’ শব্দটি ব্যবহার করে। আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী কোনো কাজ বা পরোপকারী কোনো কাজ হচ্ছে সেটি, যেটি উপরিদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, সেই কাজটির কারণে পরার্থবাদী খুব সম্ভবত ( যতই সামান্য হোক না কেন সেই সম্ভাবনা), মারা যাবে এবং পরার্থবাদী কাজটির উপকার-গ্রহীতার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। প্রায়শই যেটা দেখা যায়, খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে কোনো আপাতদৃষ্টি পরার্থবাদী কাজগুলো আসলে ছদ্মবেশে স্বার্থপরতা। আরো একবার, আমি কিন্তু বোঝাতে চাইছি না যে, তাদের সেই কাজটির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কোনো গুপ্ত স্বার্থপরতা কিন্তু বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উপর এর সত্যিকারের প্রভাব আমরা প্রথমে যা ভেবেছিলাম, তার বিপরীতমুখী।
আমি কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করবো, যাদের কোনোটি আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপর এবং কোনটি আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী; খুবই কঠিন আসলে আত্মগত চিন্তার অভ্যাসটিকে দমিয়ে রাখা যখন আমরা আমাদের প্রজাতি নিয়ে আলোচনা করি, সুতরাং আমি অন্য প্রাণীদের থেকেই উদাহরণগুলো দেব, প্রথমে কিছু প্রাণী প্রজাতির একক সদস্যদের বিবিধ স্বার্থপরমূলক আচরণের উদাহরণ।
ব্ল্যাকহেডেড গালরা (Blackheaded gull) বড় আকারের কলোনী হিসাবে তাদের নীড় বানায়। সাধারণত এই সব বাসাগুলো পরস্পর থেকে অল্প কয়েক ফুট দূরত্বে অবস্থান করে। যখন ডিম ফুটে প্রথম বাচ্চা বের হয়, তারা আকারে খুব ছোট আর নিজেদের সুরক্ষা করার কোনো উপায় থাকে না, খুব সহজেই তাদের আস্ত গিলে খাওয়া যায়। এই গাল পাখিদের মধ্যে খুব প্রচলিত একটি আচরণ দেখা যায়, সেটি হচ্ছে, তারা অপেক্ষা করে কখন তাদের প্রতিবেশী গাল অন্যদিকে তাকাবে বা নিজের বাসা ছেড়ে বের হবে, তখনই তারা ছো মেরে প্রতিবেশীর কোন একটি পাখির ছানা আস্ত গিলে খেয়ে নেয়। এভাবেই সেই পাখিটি মাছ ধরার জন্য কোনো ঝামেলা না করে এবং নিজের বাসাটিকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে যাওয়া ছাড়াই বেশ ভালো একটি পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করে নেয়।
অপেক্ষাকৃতভাবে স্ত্রী প্রেইং মানটিসদের (praying mantise) অদ্ভুত স্বজাতি ভক্ষণ করার আচরণটি আরো সুপরিচিত। মানতিসরা বড় আকারের মাংসাশী কীট। তারা সাধারণত অপেক্ষাকৃত ছোট পোকামাকড় যেমন, মাছি খায়, কিন্তু তাদের নড়াচড়া করে এমন প্রায় সব কিছুকেই আক্রমণ করার স্বভাব আছে। তারা যখন প্রজননের জন্য মিলিত হয়, পুরুষ মানতিসরা সন্তর্পনে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের স্ত্রী সদস্যদের উপরে ওঠে আসে, তারপর সঙ্গম করে, যদি স্ত্রী সদস্যটি সুযোগ পায়, সে তাকে খেয়ে ফেলে। প্রথমে এক কামড়ে তার মাথাটি খেয়ে ফেলে, এই কাজটি সে করতে পারে, যখন কোনো পুরুষ মিলিত হবার জন্য তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অথবা তার উপর উঠেছে এবং সঙ্গমরত অবস্থায়, কিংবা সঙ্গমের পর পর তারা পথক হলে। মনে হতে পারে পুরুষটির মাথা ছিঁড়ে খাবার জন্য সঙ্গম শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা স্ত্রী মানতিসের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হতো। কিন্তু দেখা গেছে পুরুষের মাথাটি খেয়ে নেবার পরও পুরুষটির বাকী শরীরের সঙ্গম অব্যাহত রাখতে কোনো সমস্যা হয়না, আসলেই বরং ভাবা হয়, যেহেতুটি পতঙ্গটির মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে ইনহিবিটরী বা দমিয়ে রাখার কেন্দ্র থাকে, সম্ভাবনা আছে, স্ত্রী মানতিসরা তাদের পুরুষদের মাথা চিবিয়ে খেয়ে আসলে তাদের যৌন দক্ষতাকেই বাড়িয়ে দেয় (১৩)। যদি তা হয়ে থাকে তবে সেটি বাড়তি উপকারিতা, প্রথমটি হচ্ছে সে ভালো একটি খাদ্যের ব্যবস্থা করা।
‘স্বার্থপর’ শব্দটি এধরনের কোনো চূড়ান্ত ক্যানিবালিজম বা স্বজাতিভক্ষণের ক্ষেত্রে উনোক্তি মনে হতে পারে। আমাদের সংজ্ঞায় যদিও এটি খুব ভালোভাবে মানানসই। হয়তো আমরা সমব্যথী হতে পারি এমপেরর পেঙ্গুইনদের আপাতদৃষ্টিতে ভীরু কাপুরুষোচিত আচরণ লক্ষ করে। তাদেরকে দেখা গেছে কোনো সমুদ্রের সীমানায় দল বেধে দাঁড়িয়ে থাকতে, পানিতে ঝাঁপ দেবার আগে তাদের মধ্যে ইতস্ততা দেখা যায়, তাদের ভয় সীলের আক্রমণ ও তাদের খাদ্য পরিণত হওয়া থেকে নিজেকে যেন বাঁচানো যায়। যদি তাদের একজন পানিতে ঝাঁপ দেয়, বাকী সবাই কিন্তু সাথে সাথেই জেনে যায়, পানিতে সীল অপেক্ষা করছে, নাকি কোনো সীল সেখানে নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে কেউ চায় না গিনিপিগ হতে, সুতরাং তারা অপেক্ষা করে, মাঝে মাঝে তারা নিজেদের মধ্যে ধাক্কা ধাক্কি করে একে অপরকে পানিতে ফেলে দেবার জন্য।
আরো সাধারণভাবে, স্বার্থপর ব্যবহার হতে পারে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারযোগ্য উপাদান ভাগাভাগি করতে অস্বীকার করা, যেমন খাদ্য, বাসস্থান ও শিকার করার এলাকা অথবা যৌনসঙ্গী। এবার কিছু আপাতদৃষ্টিকে পরার্থবাদী কাজের উদাহরণ লক্ষ করি।
কর্মী মৌমাছিদের হুল ফোটানোর আচরণ যারা মৌচাকের মধু চোরদের বিরুদ্ধে কার্যকরী একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু যে মৌমাছিরা এই কাজটি করে, তারা আসলে কামিকাজি (১৪) যোদ্ধা, বা আত্মঘাতী। কারণ এই হুল দিয়ে তাদের এই দংশনের কাজটি করতে হলে, তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আসলে বাইরে ছিঁড়ে চলে আসে আর আক্রমণকারী মৌমাছিও মারা যায় এই কাজটি শেষ করার পরে। তার এই আত্মঘাতী মিশন হয়তো তার কলোনীর গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যমজুদের সুরক্ষা করে ঠিকই, কিন্তু সে নিজে বেঁচে থাকে না সেই সুবিধাটি নেবার জন্য। আমাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি একটি পরার্থবাদী আচরণ। মনে রাখবেন আমরা কিন্তু এখানে কোনো সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছিনা, সেটি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, এখানে কিংবা স্বার্থপরতার উল্লেখিত অন্য উদাহরণেও, কিন্তু তারা আমাদের সংজ্ঞার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।