এই শিক্ষা দেবার ব্যাপারে উল্লেখিত মন্তব্যগুলোর অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে, এটি আসলেই একটি ভ্রান্তি– ঘটনাচক্রে খুব সাধারণ একটি ভ্রান্তি– এমন কিছু মনে করা যে জিনগত উত্তরসুরি হিসাবে প্রাপ্ত কোনো বৈশিষ্ট্যাবলী হচ্ছে তাদের সংজ্ঞানুযায়ী স্থির এবং অপরিবর্তনযোগ্য। স্বার্থপর হবার জন্য আমাদের জিন হয়তো আমাদের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আবশ্যিকভাবে সারা জীবনের জন্য সেই সব নির্দেশ পালনের জন্য আমরা আদৌ বাধ্য নই। হয়তো পরার্থবাদিতা শেখাটাই শুধু কঠিন একটি বিষয়ে রূপান্তরিত হয় মাত্র যদি না জিনগতভাবে পরার্থবাদ শেখার জন্য আমরা আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা না থাকি। সব জীবদের মধ্যে, মানুষরা অনন্যভাবে সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, বংশ পরম্পরায় হস্তান্তর হওয়া শিক্ষা এবং নানা কিছু করে ও দেখে শেখার দ্বারা প্রভাবিত। কেউ হয়তো বলতেই পারেন যে জিনের চেয়ে আমাদের উপর সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশী, সেই জিন স্বার্থপর হোক কিংবা না হোক, জিন মানুষের প্রকৃতি বোঝার জন্য কার্যত অপ্রয়োজনীয়। অন্যরা হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। পুরোটাই নির্ভর করবে ‘প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন’ এই বিতর্কে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, মানবীয় বৈশিষ্ট্যের নিয়ামকগুলো চিহ্নিত করার প্রসঙ্গে। বিষয়টি আমাকে নিয়ে আসে, এই বইটি আসলে কি নয় তার দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিতে: প্রকৃতি/প্রতিপালন বিতর্কে কোনো একটি অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো এই বইটির উদ্দেশ্য নয়, খুব স্বাভাবিকভাবে এই বিষয়ে আমার একটি মতামত আছে, কিন্তু আমি সেই মতামতটি এখানে প্রকাশ করবো না, শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যতটুকু নিহিত আছে, সেটাই আমি শেষ অধ্যায়ে উপস্থাপন করবো। যদি জিনরা আসলে আধুনিক মানুষের আচরণের নির্ণায়ক হিসাবে সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়, যদি আমরা আসলেই এই ক্ষেত্রে সব জীবদের মধ্যে অনন্য ব্যতিক্রম হয়েও থাকি, তারপরও, অন্তত কৌতূহদ্দেীপক এই বিষয়টির নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের জানার আগ্রহ থাকা উচিৎ, খুব সম্প্রতি যে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছি আমরা। আর যদি আমাদের প্রজাতি আমরা যতটুকু ভাবি ততটুকু ব্যতিক্রম না হয়ে থাকে, তাহলে আরো বেশী জরুরী আমাদের সেই নিয়ম সম্পর্কে গবেষণা করা।
তৃতীয় যে জিনিসটি এই বইটি নয় তাহলো, মানুষের বা কোন জীব প্রজাতির বিস্তারিত আচরণের বর্ণনা। আমি শুধুমাত্র দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণের জন্য বাস্তব কিছু উদাহরণ দেবো। আমি এমন কিছুই বলবো না যেমন, যদি আপনি কোনো একটি বেবুনের আচরণ লক্ষ্য করেন, আপনার কাছে মনে হবে তারা আসলেই স্বার্থপর, আর সেহেতু মানুষের আচরণও সেরকমই হবার সম্ভাবনা আছে। আমার শিকাগো গ্যাংস্টারে প্রস্তাবের যুক্তি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা হচ্ছে এরকম: মানুষ আর বেবুনরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে; আর আপনি যদি লক্ষ করেন কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে, মনে হবে যে এমন কিছু যা কিনা বিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সব স্বার্থপর হবার কথা। সুতরাং আমাদের সেটাই অবশ্যই আশা করতে হবে যখন আমরা বেবুন, মানুষ আর অন্যান্য সব জীবিত প্রাণীদের আচরণ অনুসন্ধান করতে যাবো, আমরা তাদের আচরণ দেখবো স্বার্থপরের মত। আমরা যদি আবিষ্কার করি, আমরা যা আশা করেছিলাম, সেটি ভুল, আমরা যদি লক্ষ করতে পারি মানুষের আচরণ সত্যিকারভাবেই পরার্থবাদী, তাহলে আমাদের একটা ধাঁধার মুখোমুখি হতে হবে, এমন একটি প্রশ্ন যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।
আলোচনায় আরো অগ্রসর হবার আগে, আমাদের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একটি সত্তা, যেমন একটি বেবুন, তাকে আমরা পরার্থবাদী বলতে পারবো, যদি এটি এমন ভাবে আচরণ করে যে তার আচরণ এরকমই আরেকটি সত্তার কল্যাণ বৃদ্ধি করে তার নিজের ক্ষতি করে। স্বার্থপর আচরণের পরিণতি ঠিক এর বিপরীত। কল্যাণ বা ওয়েলফেয়ার-এর অর্থ এখানে হচ্ছে ‘বেচে থাকার সুযোগ’, এমন কি যখন সত্যিকারের বাঁচা মরার সম্ভাবনার উপর এর প্রভাব এত সামান্য যেন মনে হতে পারে অগ্রাহ্য। ডারউইনীয় তত্ত্বের আধুনিক সংস্করণের একটি বিস্ময়কর ফলাফল হচ্ছে যে টিকে থাকার উপর আপাতদৃষ্টিতে খুব তুচ্ছ ক্ষুদ্র কোনো প্রভাবও বিবর্তনের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আর এর কারণ, এ ধরনের কোনো প্রভাবগুলো তাদের উপস্থিতি টের পাইয়ে দেবার জন্য পায় সুবিশাল সময়।
যে বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরী, উপরের পরার্থবাদ আর স্বার্থপরতার সংজ্ঞাগুলো “আচরণগত, এটি আত্মগত অনুভুতি নির্ভর কোনো বিষয় নয়। এখানে আমি উদ্দেশ্য-সংশ্লিষ্ট মনোবিজ্ঞান নিয়ে চিন্তিত নই। আমি এমন কোনো তর্ক করবো না, যে মানুষগুলো, যারা পরার্থবাদী আচরণ করে তারা আসলেই তাদের অবচেতন বা গোপন কোনো স্বার্থপর উদ্দেশ্যে সেটি করছে। হয়তো তারা সেটি করছে বা হয়তো করছে না, এবং হয়তো আমরা কখনোই কখনো তা জানতে পারবো না, যাই হোক না কেন, এই বইটির বিষয় কিন্তু সেটি নয়। আমার সংজ্ঞাটি সীমাবদ্ধ শুধুমাত্র কোনো একটি আচরণ বা ক্রিয়ার ‘প্রভাব’ একজন সম্ভাব্য পরার্থবাদী এবং তার পরার্থবাদী আচরণের দ্বারা লাভবানকারীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে, নাকি হ্রাস করে।