বর্তমানে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে এই তত্ত্ব নিয়ে যতটুকু সন্দেহ করা হয়, বিবর্তন তত্ত্বটি নিয়ে ঠিক ততটুকুই সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু ডারউইনের বিল্পবটির পূর্ণ তাৎপর্য এখনও ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাণিবিজ্ঞান এখনও গুরুত্বহীন একটি বিষয়, এবং যারা এটি অধ্যয়ন করার জন্য বেছে নেন, তারাও প্রায়শই সেই কাজটি করেন এর গভীর দার্শনিক গুরুত্বটি অনুধাবন না করেই। দর্শন এবং অন্যান্য বিষয়গুলো যারা পরিচিত হিউম্যানিটিস বা মানববিদ্যা হিসাবে, সে বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া হচ্ছে এমনভাবে যেন ডারউইনের কোনো অস্তিত্ব কখনোই ছিলনা। কোনো সন্দেহ নেই সময়ের সাথে এর পরিবর্তন হবে। তবে কোনোভাবেই, এই বইটির উদ্দেশ্য ডারউইনবাদের সপক্ষে সাধারণ কোনো গুণকীর্তন নয়, বরং একটি বিশেষ প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে বিবর্তন তত্ত্বের পরিনামগুলো এটি অনুসন্ধান করবে। স্বার্থপরতা আর পরার্থবাদের একটি জৈববৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করাই আমার উদ্দেশ্য।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণায় কৌতূহল ছাড়াও, এই বিষয়টির মানবিক গুরুত্ব খুবই স্পষ্ট। আমাদের সামাজিক জীবনের পরিমণ্ডলে প্রতিটি ক্ষেত্র এটি স্পর্শ করে, আমাদের ভালোবাসা এবং ঘৃণা করা, দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতায়, কোনো কিছু দান করা এবং চুরি করায়,আমাদের লোভ এবং দয়াপরায়নশীলতায়। এই সব দাবীগুলো লরেঞ্জের (৩) “অন অ্যাগ্রেসন’ (৪), আর্ডের (৫) “দ্য সোস্যাল কনট্রাক্ট’ (৬), আইবল-আইবেসফেল্টের (৭) “লাভ অ্যান্ড হেট’ (৮) বইগুলোর উপরেও করা যেতে পারতো। কিন্তু এই বইগুলোর সমস্যা হলো, এই লেখকরা বিষয়টিকে চূড়ান্তভাবে ভুল বুঝেছিলেন। তারা ভুল বুঝেছিলেন, কারণ বিবর্তন কিভাবে কাজ করে, সেই বিষয়টি তারা আসলে ভুল বুঝেছিলেন। তারা ভ্রান্ত একটি ধারণা করেছিলেন, ভেবেছিলেন একক কোনো সদস্যের (অর্থাৎ জিনের) জন্য নয় বরং প্রজাতির (অথবা গ্রুপের) কল্যাণই হচ্ছে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যপারটিকে বক্রাঘাতই মনে হতে পারে, যখন কিনা অ্যাশলে মনটে (৯) ‘একেবারে উনবিংশ শতাব্দীর “দাঁতে ও নখরে হিংস্র বন্য প্রকৃতির” (১০) সরাসরি উত্তরসূরি চিন্তাবিদ…’ আখ্যা দিয়ে বরং লরেঞ্জকেই বিদ্রূপ করেছিলেন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ লরেঞ্জের বিবর্তন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বলতে আমি যতটুকু বুঝি, তিনি নিজেও মনটের সাথে টেনিসনের (১১) বিখ্যাত এই বাক্যটির নিহিত্যার্থ প্রত্যাখ্যান করতে খুব বেশী মাত্রায় একমত পোষণ করবেন। তাদের দুজনের ব্যতিক্রম, আমি মনে করি, “দাঁত ও নখরে হিংস্র প্রকৃতি’ মোটামুটি প্রশংসনীয় উপায়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধে আমাদের আধুনিক ধারণাটির সার্বিক সংক্ষিপ্ত একটি রুপ উপস্থাপন করছে।
আমার মূল যুক্তিটি শুরু করার আগে আমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই, এটি কোন ধরনের প্রস্তাব এবং এটি কোন ধরনের প্রস্তাব নয়। আমাদের যদি বলা হয় কোনো একজন ব্যক্তি, যিনি শিকাগোর অপরাধ জগতে দীর্ঘ এবং সফল জীবন কাটিয়েছেন, তাহলে সেই ব্যক্তিটির চরিত্র কেমন ছিল, সেই বিষয়ে আমরা কিছু অনুমান নির্ভর ধারণা করার অধিকার রাখি। আমরা হয়তো আশা করতে পারি যে, তার নিশ্চয়ই সেই সব গুণাবলী ছিল, যেমন, সাহসী, দৃঢ়, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতা, প্রায়শই যে দক্ষতাটি সে ব্যবহার করেছে এবং এছাড়াও আছে তার বিশ্বস্ত বন্ধুদের আকর্ষণ করার যোগ্যতা। এই সব ধারণাগুলো যে একেবারে নির্ভুল অনুমান হবে তা কিন্তু না, তবে কোনো মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু ধারণা আপনি অবশ্যই অনুমান করতে পারবেন যদি আপনি খানিকটা জানতে পারেন, কি পরিস্থিতিতে সফলতার সাথে সেই মানুষটি টিকে ছিল। এই বইটির প্রস্তাবিত যুক্তি হচ্ছে যে, আমরা এবং অন্য সকল জীবরা, আসলে যন্ত্র, যাদের তৈরী করেছে আমাদের বহন করা জিনগুলো। অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পৃথিবীতে সফল শিকাগো গ্যাঙ্গস্টারদের মত আমাদের জিনগুলো টিকে গেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহু মিলিয়ন বছর। আমাদের জিনগুলোর সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশা করার জন্য এটি আমাদের অধিকার দেয়। আমি যুক্তি দেবো যে, একটি সফল জিনের প্রধানতম যে গুণটি আমরা আশা করতে পারি, সেটি হচ্ছে এর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা। এই জিনগত স্বার্থপরতা সাধারণত একক সদস্যের আচরণেও স্বার্থপরতার জন্ম দেয়। যদিও, আমরা পরে বিষয়টি যেমন দেখবো, বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে একটি জিন একক জীবের স্তরে খানিকটা সীমিত আকারের পরার্থবাদিতা বা আলট্রইজম লালন করার মাধ্যমে তার স্বার্থপর লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারে। বিশেষ” এবং “সীমিত’– আগের বাক্যটিতে ব্যবহৃত দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। যতই আমরা অন্য কিছু বিশ্বাস করতে চাই না কেন, সর্বজনীন ভালোবাসা আর সার্বিকভাবে প্রজাতির কল্যাণ আসলেই হচ্ছে সেই সব ধারণাগুলো, বিবর্তনীয় ব্যাখ্যাই যা কোনভাবেই অর্থবহ হয় না।
এটি আমাকে সেই প্রথম বিষয়টিতে নিয়ে আসে, যা আমি প্রস্তাব করতে চাইছি এই বইটি কি ‘বিষয়ে নয়’ সে প্রসঙ্গে। আমি কোনো নৈতিকতা নির্ভর বিবর্তনের সপক্ষে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি না (১২)। আমি বলছি কিভাবে এসব কিছু বিবর্তিত হয়েছে, আমি বলছি না, মানুষদের নৈতিকভাবে কিভাবে আচরণ করা উচিৎ। আমি বিষয়টির উপর জোর দিচ্ছি, কারণ জানি আমাকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে সেই সব মানুষদের, তারা সংখ্যায় অগণিত, যারা, কোনো একটি বিষয় বা পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিশ্বাস নির্ভর একটি বক্তব্য কি বলছে আর বিষয় ও পরিস্থিতিটি কি হওয়া উচিৎ তার পক্ষে ওকালতি করার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। আমার নিজস্ব অনুভূতি হচ্ছে যে, কোনো একটি মানব সমাজ যা শুধুমাত্র জিনের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার সার্বজনীন সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত, নিঃসন্দেহে বাস করার জন্য সেটি খুবই জঘন্য একটি সমাজ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা কোনো কিছুকে যতই ঘৃণা করিনা কেন, সত্য হওয়া থেকে কিন্তু তা বিরত থাকে না। মূলত এই বইটির উদ্দেশ্য কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের অবতারণা করা, কিন্তু আপনি যদি কোনো নৈতিকতা এখান থেকে সংগ্রহ করতে চান, তাহলে বইটি একটি সতর্ক সংকেত হিসাবে পড়ন। সতর্ক থাকুন যদি আপনি চান, যেমনটি আমি চাই, এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করতে, যেখানে প্রতিটি সদস্য উদারতার সাথে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে এবং সবাই নিঃস্বার্থভাবে একটি সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কাজ করছে; তাহলে তাদের জৈববৈজ্ঞানিক প্রকৃতির কাছে আপনি বেশী কিছু আশা করতে পারবেন না। আসুন আমরা উদারতা এবং পরার্থবাদ বা পরোপকারিতা শিক্ষা দিতে চেষ্টা করি, কারণ আমরা জন্মগতভাবেই স্বার্থপর। আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি, আমাদের স্বার্থপর জিনগুলো আসলে কি পরিকল্পনা করছে, কারণ হয়তো তখনই অন্ততপক্ষে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেবার জন্য আমাদের একটা সুযোগ থাকবে, আর কোনো প্রজাতি কখনোই এমন কিছু করার উচ্চাকাঙ্খ বোধ করেনি কোনোদিনও।