আমি নিজে একজন ইথোলজিষ্ট (১), এবং এটি প্রাণী-আচরণ বিষয়ক একটি বই। ইথোলজির ঐতিহ্যবাহী ধারার প্রতি আমার ঋণ খুব বেশী স্পষ্ট, যে বিষয়ে আমি নিজে প্রশিক্ষিত হয়েছি। বিশেষ করে, নিকো টিনবার্গেন (২) আমার উপর তার প্রভাবের ব্যাপ্তিটা আসলে কতটুকু ছিল তা তিনি কখনোই অনুধাবন করেননি, যখন অক্সফোর্ডে বারো বছর আমি তার অধীনে কাজ করেছিলাম। ‘সারভাইভাল মেশিন’ বাক্যটি, যদিও সত্যিকারভাবে তার নিজস্ব নয়, তবে তার হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইথথালজী সম্প্রতি নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে নতুন সব ধারণার আগ্রাসনে, এবং তারা এসেছে এমন কিছু উৎস থেকে যাদের প্রথাগতভাবে ইথথালজী সংক্রান্ত কোনো বিষয় মনে করা হয়না। এই বই অনেকাংশই সেই সব নতুন ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে লেখা। এই ধারণাগুলো জন্মদাতাদের প্রতি বইয়ের লেখ্য অংশের যে জায়গায় প্রযোজ্য সেখানেই ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। প্রধান সেই ব্যক্তিরা হলেন জি. সি, উইলিয়ামস, জে, মেনার্ড স্মিথ, ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন এবং আর, এল, ট্রিভার্স।
বহু মানুষই এই বইয়ের শিরোনাম প্রস্তাব করেছেন, আমি কৃতজ্ঞতার সাথে যে নামগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করেছিঃ ‘ইমোৰ্টাল কয়েলস’ (অমর কুণ্ডলী), জন ক্রেবস; ‘দ্য জিন মেশিন’(জিন যন্ত্র), ডেসমন্ড মরিস; ‘জিনম্যানশিপ’(জিন দক্ষতা), টিম ক্লাটন-ব্রক এবং জিন ডকিন্স, স্বতন্ত্রভাবে ক্ষমাপ্রার্থনাসহ স্টিফেন পটার। কাল্পনিক পাঠকরা বিনম্র আশা এবং আকাঙ্খার নিশানা হিসাবে কাজ করতে পারেন কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তারা সত্যিকার পাঠক ও সমালোচকদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম কাজে আসেন। পুনসংশোধন আর পরিমার্জনা করার প্রতি আমার আসক্তি আছে। এবং মারিয়ান ডকিন্স বাধ্য হয়েছেন প্রতিটি পাতার অসংখ্য সংশোধন এবং পুনসংশোধন পড়ার জন্য। জৈববৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সম্বন্ধে তার সমীহ জাগানোর মত জ্ঞান এবং তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অনুধাবন করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছাড়াও, তার সার্বক্ষণিক বিরামহীন উৎসাহ এবং নৈতিক সমর্থন আমার জন্য অপরিহার্য ছিল। জন ক্রেবস যিনি এই বইটি খসড়া পাণ্ডুলিপি ড্রাফট হিসাবে পড়েছিলেন। তিনি এই বিষয় সম্বন্ধে আমার চেয়ে অনেক বেশী জানেন, এবং তিনি উদারতার সাথে অকৃপনভাবে আমাকে তাঁর উপদেশ এবং নানা প্রস্তাব দিয়েছেন। গ্লেনিস থমসন এবং ওয়াল্টার বড়মার জিনগত বিষয়গুলো নিয়ে আমার আলোচনা দয়ার সাথে তবে দৃঢ়ভাবে সমালোচনা করেছেল। আমি শঙ্কিত যে আমার পুনসংশোধন হয়তো তাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কিন্তু আমি আশা করি বইটি পড়ার পর তারা অন্তত মনে করবেন আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। তাদের সময় আর ধৈর্যের জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। জন ডকিন্সও তার নির্ভুল দৃষ্টি ব্যবহার করেছেন বিভ্রান্তিকর বাক্যগঠনের প্রতি এবং অসাধারণ কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব করেছিলেন কিছু শব্দ পরিবর্তনের জন্য। ম্যাক্সওয়েল স্টাম্পের মত এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় এমন কোনো বুদ্ধিমান মানুষ আমার পক্ষে আশা করা অসম্ভব। তার সতর্ক দৃষ্টির কারণে প্রথম ড্রাফটের শৈলীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ ভুল সংশোধন করা সম্ভব হয়েছিল যা চূড়ান্ত ড্রাফটটি সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনেক কিছু করেছিল। অন্যরা যারা গঠনমূলক সমালোচনা করেছিলেন বিশেষ অধ্যায়গুলো নিয়ে অথবা যারা তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছিলেন, তারা হলেন জন মেনার্ড স্মিথ, ডেসমন্ড মরিস, টম মাশলার, নিক ব্লার্টন জোনস, সারা কেটলওয়েল নিক হাম্পফ্রে, টিম ক্লাটন-ব্রক, লুইস জনসন, ক্রিস্টোফার গ্রাহাম, জিওফ পার্কার এবং রবার্ট ট্রিভার্স। প্যাট সিয়ারলে এবং স্টেফানি ভেরহয়েভেন শুধুমাত্র দক্ষতার সাথে টাইপই করেননি, কাজটি আনন্দের সাথে করে দেখিয়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। পরিশেষে আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মাইকেল রজার্সকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই, পাণ্ডুলিপির প্রয়োজনীয় সমালোচনা ছাড়াও এই বই প্রকাশনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সতর্ক দৃষ্টি রেখে যিনি তার স্বাভাবিক। দ্বায়িত্বের বাইরেও অনেক পরিশ্রম করেছিলেন।
রিচার্ড ডকিন্স (১৯৭৬)
পাদটীকা:
১. প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন।
২. নিকোলাস ‘নিকো’ টিনবার্গেন (১৯০৭-১৯৮৮) : ডাচ প্রাণিবিজ্ঞানী ও ইথোলজিস্ট, কার্ল ভন ফ্রিশ এবং কনরাড লরেঞ্জ এর সাথে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতেছিলেন।
০১. মানুষরা কেন?
অধ্যায় ১: মানুষরা কেন?
একটি গ্রহে বুদ্ধিমান জীবন এর প্রাপ্তবয়স্কতা অর্জন করে যখন প্রথমবারের মত এটি সেখানে এর অস্তিত্বের কারণ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলো সমাধান করে উঠতে পারে। যদি আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমত্তায় অগ্রসর কোনো প্রাণীরা মহাশূন্য থেকে কখনো পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে আসে, আমাদের সভ্যতাটি ঠিক কোন স্তরে অবস্থান করছে সেটি নিরুপন করার লক্ষ্যে প্রথম যে প্রশ্নটি তারা জিজ্ঞাসা করবে, সেটি হলো: এরা কি এখনও বিবর্তনের বিষয়টি আবিষ্কার করতে পেরেছে? কোনো কারণ জানা ছাড়াই এই পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন বছর ধরে জীবের অস্তিত্ব ছিল, অবশেষে তাদেরই একজনের কাছে এই সত্যটি স্পষ্ট হয়েছিল। তার নাম ছিল চার্লস ডারউইন। নিরপেক্ষভাবে বলতে হলে, অনেকেই সত্যটা সম্বন্ধে খানিকটা আভাস পেয়েছিলেন, কিন্তু ডারউইনই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আমাদের অস্তিত্বের কারণ সম্বন্ধে প্রথমবারের মত সঙ্গতিপূর্ণ আর প্রমাণযোগ্য একটি ব্যাখ্যা প্রস্তাব করেছিলেন। ডারউইনের কারণে, সেই কৌতূহলী শিশুটির প্রশ্ন, যা এই অধ্যায়ের শিরোনাম, তার একটি বোধগম্য উত্তর দেয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব। যখন গভীর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হই, আমাদের আর এখন কোনো কুসংস্কারের আশ্রয় নিতে হয়নাঃ জীবনের কি কোনো অর্থ আছে? আমরা কিসের জন্য এখানে? মানুষ কি? এই প্রশ্নগুলোর শেষ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করে বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী জি. জি. সিম্পসন (১) মন্তব্য করেছিলেন এভাবে: ‘এখন আমি যে প্রস্তাবনাটি করতে চাই সেটি হচ্ছে, ১৮৫৯ সালের আগে এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার সকল প্রচেষ্টাই ছিল অর্থহীন, আর আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যদি আমরা সম্পূর্ণভাবে সেগুলো উপেক্ষা করতে পারি।(২)